এমন একটি দিন আছে, যে দিন ধর্ষণহীন? না এমন দিন নেই। ২০০০ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ঘণ্টায় একটি অন্তত ধর্ষণ ঘটে ভারতবর্ষে।আসলে, ধর্ষণের এই সংখ্যাটি আরও ভয়াবহ হত, যদি ধর্ষিতারা মুখ খুলতো, বলতো যে তারা ধর্ষিতা হয়েছে। ধর্ষণ যে একটি অপরাধ তা বেশির ভাগ মানুষ জানে না। ধর্ষককে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত না করে ধর্ষিতাকে করা হয়। এর চেয়ে বড় লজ্জা একটি সমাজের জন্য আর কিছু নেই। পৃথিবীতে ধর্ষণই একমাত্র অপরাধ যেখানে আক্তান্তকে বা ভিকটিমকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
আমেরিকার নারীবাদী লেখিকা মেরিলিন ফ্রেঞ্চ লিখেছিলেন, ‘প্রতিটি পুরুষই ধর্ষক, এবং তাদের এই একটিই চরিত্র। তারা আমাদের ধর্ষণ করে তাদের চোখ দিয়ে, তাদের তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে, তাদের আইন দিয়ে। অল ম্যান আর রেপিস্ট এণ্ড দ্যাটস অল দে আর। দে রেপ আস উইদ দেয়ার আইজ, দেয়ার লজ, অ্যান্ড দেয়ার কোডস।’
আর আমার প্রিয় আন্দ্রিয়া ডরকিনের কথা, ‘যতদিন ধর্ষণ নামক জিনিস পৃথিবীতে আছে, ততদিন শান্তি অথবা সুবিচার অথবা সমতা অথবা স্বাধীনতা কিছুই থাকবে না। তুমি আর হতে পারবে না তা, যা তুমি হতে চাও, তুমি আর বাস করতে পারবে না সেই জগতে, যে জগতে তুমি বাস করতে চাও।’
আন্দ্রিয়া ডরকিন আরও বলেছেন, ‘ধর্ষণ কোনও দুর্ঘটনা নয়, কোনও ভুল নয়। পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে যৌনতার সংত্তা হল ধর্ষণ। যতদিন পর্যন্ত এই সংত্তা বহাল থাকবে, ততদিন পর্যন্ত যৌনআক্রমণকারী হিসেবে পুরুষ এবং তার শিকার হিসেবে চিহ্নিত হবে নারী। এই সংস্কৃতিকে স্বাভাবিক যারা মনে করে, তারা ঠাত্তা মাথায় প্রতিদিন ধর্ষণ চালিয়ে যায়।’
কেউ কেউ বলে, ধর্ষকদের ধর্ষদণ্ডটি কেটে ফেলা উচিত। এর ফলে দ্রুত বন্ধ হবে ধর্ষকদের ধর্ষণ। বন্ধ কি সত্যি হয়? ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হবার পরদিনই ধর্ষণ হয়নি এ রাজ্যে? হয়েছে। এর কারণ কি? ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠিন কঠিন আইন আছে, তারপরও কি ধর্ষণের কিছু মাত্র বন্ধ হয়েছে। যারা বলে যে মেয়েরা স্বল্প পোশাক পরে চলাফেরা করে বলেই পুরুষেরা তাদের ধর্ষণ করতে উৎসাহী হয়—সেই মোটামাথাগুলো খুব ভালো জানে যে, বড় বড় লম্বা লম্বা এমনকী বোরখা পরা মেয়েরাও অহরহ ধর্ষিতা হচ্ছে। পোশাক কোনও ঘটনা নয়, ঘটনা এখানে পুরুষাঙ্গ। জন্মের পর থেকে পুরুষেরা শিখে এসেছে তারা জগত জয় করতে পারে তাদের দু’উরুর মাঝখানে ঝুলে থাকা দুই বা তিন ইঙ্গি কেজো বা অকেজো জিনিসটি দিয়ে। এই শিক্ষা ইস্কুল-কলেজে রাস্তাঘাটে চাকরিস্থলে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, আইনে কানুনে, শহরে বন্দরে, রাষ্ট্রে রাজ্যে সমাজে সংসারে সবখানেই পুরুষেরা পেয়ে যায়। ঘরে বাইরে যে শিক্ষা এবং যে শিক্ষার চর্চা পুরুষেরা হাজার বছর ধরে চালিয়ে যাচ্ছে ক’টা পুরুষের বুকের পাটা তা থেকে নিরস্ত হয়?
বাংলাদেশে কয়েক বছর আগে একটি ঘটনা ঘটেছিল। ইয়াসমিন নামের এক মেয়ে, পনেরো বছর বয়স, ঢাকা শহরের কোনও এক মধ্যবিজ্ঞের বাড়িতে কাজ করতো। কিন্তু বাড়ির কর্তাটি ইয়াসমিনকে রাতে রাতে ধর্ষণ করতো। ইয়াসমিন একরাতে পালালো বাড়ি থেকে। যাচ্ছে সে বাপের বাড়ির দিকে। পথে পুলিশ ধরলো। ‘কোথায় যাচ্ছিস’? ‘বাপের বাড়ি’। ‘বাড়ি তো অনেক দূর, চল তোকে পৌঁছে দিই, গাড়িতে ওঠ।’ পুলিশের গাড়ি অন্ধকার নির্জনতায় থামলো। ওখানে সাত সাতটা পুলিশ ইয়াসমিনকে মনের আশ মিটিয়ে ধর্ষণ করে, ধর্ষণ শেষে গলা টিপে মেরে ফেলে রাখলো আবর্জনার স্তূপে। এলাকার লোকেরা পরদিন মিছিল বের করলো পুলিশের বিরুদ্ধে। সেই মিছিলে গুলি ছুঁড়লো পুলিশ, সাতজন গ্রামবাসীর মৃত্যু হলো। পরদিন সরকারি প্রেস বিত্তপ্তি ছিল এরকম, ‘ইয়াসমিন ছিল নষ্ট চরিত্রের মেয়ে, পুলিশ যা করেছে ঠিকই করেছে।’— এরকম ঘটনা কি শুধু বাংলাদেশেই ঘটে? অন্য কোথাও ঘটে না? আমরা সবাই জানি, ঘটে। রক্ষক সারাক্ষণই ভক্ষক হচ্ছে। হবে না কেন! নারী-ভক্ষণ তো কোনও অন্যায় নয়! কোথায় লেখা আছে অন্যায়! নারী তো ভোগ্য, ভোজ্য, ভক্ষণীয়। এ কথা সকলেই জানে, মানে। পুরোহিত থেকে শুরু করে পাঁচ বছরী পুত্র জানে যে পুরুষ সর্বশক্তিমান। এবং তাদের সর্বময় অধিকার যেমন খুশি নারীকে দলন করা, দমন করা, সর্বময় অধিকার যখন খুশি ধর্ষণ করা, জ্বালিয়ে মারা, পুড়িয়ে মারা।
এই জানা মানাটি যেদিন বন্ধ হবে, সেদিনই হয়তো চিরতরে দুঃসময়ের সরে যাবার সময় হবে। নারীকে সম্মান জানানোর রেওয়াজ এই সমাজে নেই। সম্মানের যে সংত্তা পুরুষেরা তৈরি করেছে, তাতে অসম্মান ছাড়া নারীর অন্য কিছু হয় না। বিখ্যাত নারীবাদী ম্যাগাজিন সিজ-এর সম্পাদক রবিন মরগ্যান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ধর্ষণ সম্পর্কে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বলেছেন, ‘যে যৌন সম্পর্কটির উদ্যোক্তা নারী নয়, নারীর সত্যিকার যৌনইচ্ছে থেকে যেটি ঘটে না, সেই যৌন সম্পর্কটি ঘটা মানেই ধর্ষণ ঘটা।’
পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশে পুরুষের ইচ্ছেয়, পুরুষের আওতায় যে যৌনসম্পর্কটি ঘটে, তাতে বৈষম্য শুধু নয়, প্রকট ভাবে অকথ্য অত্যাচার না থাকার কোনও কারণ নেই। সর্বত্র যেখানে বৈষম্য এবং পুরুষাধিপত্য, সেখানে তা থাকবেই। বন্ধ ঘরে বীভৎসতা ঘটিয়ে নাম তার লাভ মেকিং দিলেই যেন সাতখুন মাফ।
রবিন মরগ্যান বলেন, ‘রেপ ইজ দ্য পারফেক্টেড অ্যাক্ট অব মেইল সেক্সুয়ালিটি ইন এ পেট্রিআর্কাল কালচার। ইট ইজ দ্য আলটিমেট মেটাফর ফর ডমিনেশন, ভায়োলেন্স, সাবজুগেশন অ্যাণ্ড পজেশনস।’
না, আমাদের নারীবাদীরা এমনভাবে বলেন না। কোনওকালেই বলেননি। পশ্চিমের নারীবাদীদের হাত থেকে খুব কম ধর্ষকই বেঁচে যেতে পারে। ওখানকার নারীরা বহুকাল সংগ্রাম করেছেন এই জঘন্য ঘৃণ্য নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে। কাউকে ছাড় দেননি।
আজ পশ্চিমের যে দেশগুলোয় নারীরা প্রায় পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে পারে, সেখানে প্রেমে, যৌনতায় নারীর উদ্যোগী এবং সক্তিয় হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা। নারীই পুরুষকে পছন্দ করে প্রেমের জন্য, নারীই পুরুষকে শারীরিকভাবে কামনা করে, সেই কামনার কথা প্রকাশ করে এবং যৌনক্তিয়ায় নারীই সক্তিয় হয় বেশি।
এ দেশে নারী যত নিষিক্তয় হবে, পুরুষের যৌনসাধ তত হৈ রৈ করে বাড়বে। যৌন সম্পর্কের জন্য নিষিক্তয় নারীকেই পছন্দ করে পুরুষ। নারীবাদীরা বলেন, যৌন অধিকার অর্জনের কোনও দরকার নেই নারীর। দরকার শিক্ষার আর স্বনির্ভরতার। নারীবাদ দেশি ব্র্যাণ্ড। বটে। শিক্ষা আর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করেও যে সারাজীবন নারী থেকে যায় পুরুষের যৌনদাসী, সে কি তাঁরা জানেন না, নাকি মানেন না? নাকি তলে তলে পুরুষতন্ত্রের গোড়ায় জল সার দিয়ে তাজা রাখেন তন্ত্রটি !
নারীরা এ দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না। নারীদের কোনও অহংকার থাকতে নেই। সেই কবে ভোটাধিকার আন্দোলনের নেত্রী এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটন বলেছিলেন, ‘উই আর, অ্যাজ এ সঙ্গে, ইনফিনিটলি সুপিরিয়র টু ম্যান।’ ক’টা মেয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে এ কথা বিশ্বাস করে এবং বলে?
আমরা নারীরা পুরুষের চেয়ে সবদিক থেকে বড়। এ কথা বললে পুরুষ যেমন কৌতুকরসে হেসে ওঠে, নারীও হাসে। কেবল লিঙ্গে নয়, বিবেকে বুদ্ধিতে, বিচক্ষণতায়, বিদ্রোহে, বিস্ফোরণে, বীক্ষণে নারী চিরকালই পুরুষের চেয়ে ঊর্ধ্বে। কিন্তু শক্তিকে শেকলে বন্দি করে রাখা হয়েছে আজ হাজার বছর। সোজা এতকালের শেকল ছেঁড়া?
আমি মনে করি পুরুষবিদ্বেষ হল একটি সম্মানজনক রাজনৈতিক আদর্শ, যে আদর্শে অত্যাচারিতের অধিকার আছে অত্যাচারী শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছুড়ে দেওয়া।–ক’জন বলে এমন কথা এদেশে? এখন তো লিবারেলিজমের যুগ। যত আপোস করো, তত ভালো। যত মেনে নাও, তত তুমি সহিষ্ণু, তত তুমি শান্তিকামী। চিরকাল যারা অশান্তি করে, অশান্তি যাদের রক্তে, মস্তিষ্কের কোষে কোষে, তাদের সঙ্গে কি সত্যিকার কোনও শান্তি চুক্তি হয়, না, হতে পারে?
সেই কতকাল আগে মেরিলিন ফ্রেঞ্চ ‘দ্য উইমেনস রুম’ বইতে লিখেছেন, ‘পুরুষের প্রতি আমার অনুভূতি পুরুষ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পর্কিত। সত্যি কথা বলতে কী, পুরুষের প্রতি আমার কোনও সহানুভূতি নেই। ডাখাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এক ইহুদি যেমন কোনও তরুণ নাৎসি সেনাকে পেটে গুলি খাওয়া অবস্থায় কাতরাতে দেখে নির্বিকার হেঁটে চলে যায়, তেমন করে আমি পুরুষ দেখি। আমি এমনকী প্রয়োজনও বোধ করি না কাঁধ শ্রাগের। আমি কেয়ার করি না। মানুষ হিসেবে লোকটি কী ছিল, কেমন ছিল, তার ইচ্ছে অনিচ্ছে এগুলো আমার কাছে কোনও বিষয় নয়।’
পুরুষকে তুচ্ছ করার শক্তি এবং সাহস এ সমাজে ক’জনের হয়? তুচ্ছ না করলে পুরুষতন্ত্রের কবল থেকে মুক্তি নেই কোনও নারীর। বিয়েকেও ত্যাগ করেছিল আমাদের লড়াকু পূর্বনারীরা। সাহস আছে কারও এমন কথা উচ্চারণ করার, ‘যেহেতু বিয়ে মানে নারীকে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি করা, নারীবাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত বিবাহপ্রথার গায়ে জোরে লাথি মারা। বিবাহপ্রথাকে নির্মূল না করলে নারী স্বাধীনতা কখনই অর্জিত হবে না।’
‘না না না আমরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছি। আমরা এগিয়ে গেছি অনেক। আমরা আমাদের প্রাপ্য অধিকার পেয়ে গেছি কত আগে। যা বাকি আছে পাওয়ার, তার জন্য পুরুষকে সঙ্গে নিয়েই লড়াই করবো।’ ‘সচেতন’ বলে বড়াই করা নারীরাই বলছেন এমন কথা। নারী-পুরুষ উভয়কেই নারীর অধিকারের জন্য লড়তে হবে — এই মত নারী পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সকলের। কিন্তু ধর্ষককে সঙ্গে নিয়ে সত্যি কি লড়াই করা যায়? দুই বা তিন ইঙ্গি জিনিসটি নিয়ে অহংকার এমন কোনও পুরুষ আছে করে না? যে পুরুষ নিজেদের নারীবাদী বলে, তারাও সময় সময় উরুসন্ধিতে হাত রেখে জিনিসটির উপস্থিতি পরখ করে নেয়। ধর্ষকের জাতকে বিশ্বাস করেছো কী মরেছো।
কী ব্যাপার, জাত নিয়ে কথা? হ্যাঁ জাত নিয়েই কথা। পুরুষেরা আলাদা জাত। তারা মনুষ্যজাত থেকে ভিন্ন। এমন কথা প্রচণ্ড রাগ করেও কেউ বলে না এ সমাজে। মেয়েদের রাগ টাগ কি একেবারেই গেল? রাগের মাথায় তো অনেক কিছু করছে মেয়েরা, রাগের মাথায় ধর্ষকের ধর্ষদণ্ড কেন কেউ কেটে নেড়িকুত্তা দিয়ে খাওয়াচ্ছে না? ক্রোধে রাগে কেন উচ্চারণ করছে না সত্য, যে সত্য মুখে এসে গেলেও মেয়েদের গিলে ফেলতে হয়! গিলে ফেলেছে হাজারবছর। এখনও?