১৫. মিস ওফেলিয়া
সেন্ট ক্লেয়ারদের বাড়িতে লোকের যেমন অভাব ছিল না, তেমনি প্রাচুর্যও ছিল প্রচুর। এ কারণেই এতদিনে টমকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে কোনো কাজ করতে হয় নি। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই আগাস্টিন আবিষ্কার করলেন, টম শুধু বিশ্বস্ত আর ধার্মিকই নয়, অসাধারণ বিচক্ষণ ও বাস্তবজ্ঞানী। ব্যবসায়িক বুদ্ধিতেও তার জুড়ি নেই। আগাস্টিন তাই ধীরে ধীরে যাবতীয় কেনাকাটা আর সংসারের দায়িত্ব টমের কাছেই ছেড়ে দিলেন।
নিজের কাছ থেকে সমস্ত ক্ষমতা একটু একটু চলে যেতে দেখে অ্যাডলফ প্রায়ই টমের নামে মনিবের কাছে মিথ্যে মিথ্যে নালিশ করত। আগাস্টিন সে-সব কখনো কান পেতে শুনতেনও না। কেননা আজ পর্যন্ত খরচ করে কেউ কখনো তাঁর কাছে হিসেব দেয় নি আর তিনিও নিজে থেকে কখনো কারুর কাছে হিসেব চান নি। অথচ অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও টম কখনো একটা পয়সাও এদিক-ওদিক করে নি। তাই অ্যাডলফের অভিযোগে কখনো কখনো ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠতেন আর বলতেন, না না, অ্যাডলফ, তোমার কাজ তুমি করে যাও। টমকে নিয়ে তোমার মোটেই মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তুমি যা চাও, তুমি শুধু সেটাই বোঝ, কিন্তু টম বোঝে হিসেব। কী করলে কী হয় টম তা ভালো করেই জানে। সে জানে কীভাবে মনিবের দুটো টাকা বাচানো যায়। একটা ব্যাপার তোমরা মোটেই বুঝতে চাও না যে টাকা-পয়সারও একটা শেষ আছে, একদিন না একদিন তা সবাইকেই বুঝতে হবে। তোমরা যেটা পার না, সেটা নিয়ে অন্যের নামে আর কখনো মিথ্যে নালিশ করতে এসো না।
টম সারাক্ষণই হাসিখুশি মানুষ, মিশুকে স্বভাবের। সুন্দর তরুণ মনিবটিকে বুঝে নিতে টমের একেবারে কম সময় লাগে নি। দু-একটা ভুল-ত্রুটি থাকলেও মনিব মানুষটাকে তার গভীরভাবে ভালো লেগেছে বেশ দেরিতে। টম প্রথম প্রথম খোলা মন নিয়ে মনিবকে দেখত, মনিব কখনো গির্জায় যায় না, বাইবেলও পড়ে না, কিন্তু সবার সঙ্গে সহজেই মেশেন, আড্ডা দেন, সব কিছুতেই হাসিঠাট্টা করেন, নিজেকে সবটাতেই মানিয়ে নেবার অসাধারণ ক্ষমতা তাঁর। রবিবারের বিকেলে হয় জলসাতে, নয় রঙ্গমঞ্চে যান তিনি। জলসা বা রঙ্গমঞ্চ থেকে আবার কোনো পার্টিতে, নয়তো কোনো ক্লাবে যান।
গভীর রাত পর্যন্ত তিনি সেখানেই কাটান। তাঁর সবকিছুই অন্যসব মানুষের মতোই খুব স্বাভাবিক। টম অনেকবারই লক্ষ করেছে, নিজের লাইব্রেরিতে অনেক রাত জেগে তিনি পড়াশোনাও করেন।
একদিন খুব ভোরে কফি নিয়ে টম দেখল, সেন্ট ক্লেয়ার তখনো পড়ার ঘরে। পরনে রাত-পোশাক, পায়ে চটি, অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তিনি কিছু একটা পড়ছেন। সেদিন অন্যদিনের মতো টম কফি নিয়ে ফিরে গেল না। পাথরের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল দরজার সামনে।
আগাস্টিন টমকে দেখতে পেলেন, বললেন, ‘কী ব্যাপার টম, তুমি কি কিছু বলতে এসেছ?’
টম তখন কিছুই বলতে পারল না, অথবা বলল না।
আগাস্টিন আবার বললেন, ‘তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?’
‘না, স্যার।’
‘তাহলে কি, হিসেবে কোনো সমস্যা হচ্ছে?’
‘না, স্যার হিসেবের সমস্যা নয়।’
আগাস্টিন এবার অবাক না হয়ে পারলেন না। তিনি কফির পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে ভালো করে টমের মুখের দিকে তাকালেন।
‘কী ব্যাপার টম, তোমার শরীর কি ভালো নেই?’
‘স্যার, শরীর আমার ভালোই আছে।’
‘টম, তাহলে কী হয়েছে তোমার? তোমাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন?’
‘আমার ধারণা ছিল মনিব সবসময়েই সবার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেন।‘
আগাস্টিন এবার বইটা ভাঁজ করে রেখে বললেন, ‘কেন টম, আমি তো তোমার সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করি নি।’
‘না না, স্যার আপনি সবসময়ই আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছেন। সেদিক থেকে আমার কোথাও কোনো অভাব নেই। শুধু মনিব একজনের সঙ্গেই যা ভালো ব্যবহার করেন নি।’
‘টম, তুমি কী বলছ, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
‘গতকাল রাতে আমি বেশ কয়েকবারই ব্যাপারটা খেয়াল করেছি। স্যার কিন্তু নিজের প্রতি মোটেই ভালো ব্যবহার করছেন না।’
টমের কথা শুনে আগাস্টিন হো হো করে হেসে উঠলেন।
‘ও, এই ব্যাপার!’
‘ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়, স্যার।’
কান্নায় ধরে আসা গলায়, মিনতিভরা চোখে টম এমনভাবে কথাগুলো বলল যে আগাস্টিন স্তব্ধ বিস্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘ঠিক আছে টম, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আর কোনোদিন রাত জেগে পড়াশোনা করব না।‘
কোনো কথা না বলে টম খুশি হয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ঘরদোর গুছিয়ে সংসারে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে মিস ওফেলিয়াকে রীতিমতো হিমসিম খেয়ে যেতে হয়েছিল। কেননা এ বাড়ির কর্ত্রী মেরি সেন্ট ক্লেয়ার বা তার মা আদৌ সুগৃহিণী ছিলেন না, ফলে দাসদাসীরাও সুষ্ঠু কোনো নিয়মের ধার ধারত না। বিশেষ করে সেন্ট ক্লেয়ারদের রান্নাঘরের অবস্থাটা হয়ে উঠেছিল সব চাইতে সঙ্গীন।
এতদিন পর্যন্ত রান্নাঘরের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল মার আমলের পুরনো ক্রীতদাসী দিনার হাতে। চাকর-বাকররা তো দূরের কথা, এ বাড়ির কর্ত্রী, অভ্যাসবশে দিনা যাকে আজও ‘মিস মেরি’ বলে ডাকে, সেই মেরিও দিনার মুখের ওপর কখনো তেমন করে ‘না’ করতে পারত না। অথচ এ পরিবারে দিনাই ছিল সবচাইতে নোংরা আর অগোছলো।
মিস ওফেলিয়া প্রথম প্রথম সবকিছু দেখলেন, কিন্তু একটা কথাও বললেন না। একদিন খুব ভোর থেকে শুরু করে সন্ধ্যে পর্যন্ত রোজাকে নিয়ে উনি শুধু রান্নাঘরটাই পরিষ্কার করলেন, যেখানকার জিনিস যেখানে থাকা উচিত সব গোজগাছ করে রাখলেন। কিন্তু কয়েকটা দিন যেতে না যেতেই দেখা গেল অবস্থা ঠিক আগেরই মতো যে তাই। ওফেলিয়া মনে মনে ঠিক করলেন এবার অবশ্যই বলা দরকার।
নিত্যকার মতো সেদিনও খুব ভোরে উঠে ওফেলিয়া নিজের ঘর নিজের হাতে গুছিয়ে সোজা চলে এলেন রান্নাঘরে।
রান্নাঘরটা পুরোনো আমলের হলেও বেশ বড় আর খোলামেলা। রান্নার উনুন থেকে শুরু করে সবকিছুই আধুনিক ধাঁচের। এখনেও আগাস্টিনের রুচির কোথাও কোনো অভাব নেই।
ওফেলিয়াকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে দিনা কিন্তু উঠে দাঁড়াল না, যেন ব্যাপারটা আদৌ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং এখানে মিস ওফেলিয়ার কোনো কাজ থাকতে পারে না।
ওফেলিয়া কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা গিয়ে আলমারির টানাগুলো খুললেন, তারপর দিনার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই টানাগুলো কিসের জন্যে?’
‘হাতের কাছে টুকিটাকি জিনিস রাখার জন্যে।’
মাংসের টুকরো লেগে থাকা রক্তমাখা একটা ন্যাকড়া টেনে বার করে উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে এটা কী? বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর টেবিলের ঢাকনাটায় মাংস কেটে ছুরি মুছে রেখে দিয়েছ?’
‘কী করব মিসেস, হাতের কাছে কোনো তোয়ালে পাই নি … কাচব বলে ওটা আমি ওখানে রেখে দিয়েছি।’
টেবিলের ঢাকনাটাকে উনি ছুড়ে ফেলে দিলেন ঘরের এক কোণে। শুধু তাই নয়, টানার ভেতর থেকে বের হলো বোনার কাঁটা, কিছুটা তামাক আর তামাকের নল, কয়েকটা জায়ফল, নোংরা কতকগুলো রুমাল, একপাটি পুরোনো জুতো, কয়েকটা পেয়ালা, সুন্দর ভাঁজ করা খানিকটা রাংতা, কয়েকটা রশুন আর চুলের কাঁটা।
‘তোমাদের জায়ফল রাখার কোনো জায়গা নেই?’
‘আছে।‘
‘কোথায়?’
‘ঢাকা-আলমারি মধ্যে একটা বোয়ামে।‘
‘এগুলোকে তার মধ্যে রেখে দাও। আর কোনোদিনও যেন এগুলোকে ড্রয়ারের মধ্যে না দেখি।’
দিনা ফিরে আসার পর ওফেলিয়া বললেন, ‘এটা কী? মনিবের সবচেয়ে ভালো প্লেটটা ছাড়া এসব রাখার আর জায়গা খুঁজে পাও নি?’
‘সবসময় এমন তাড়াহুড়ো করতে হয় …’
‘ঠিক আছে’, ওফেলিয়া ওকে দ্রুত থামিয়ে দিলেন।
‘এবার থেকে তোমার আর একটুও তাড়াহুড়ো করতে হবে না। যতটা সম্ভব আস্তে আস্তেই করবে। আর সুন্দর এই দামাস্কাস টেবিলের ডাকনা দুটো এলো কোত্থেকে?’
‘কাচার জন্যে আমি এখানে রেখে দিয়েছি?’
‘কাচার যা কিছু জিনিস সব এখানেই থাকে নাকি?’
‘না, পাছে ভুলে যাই, তাই … ।’
‘কিন্তু কাচার কাজ তো তোমার নয়।’ টানার জিনিসপত্তর সব গোছাতে গোছাতেই ওফেলিয়া বললেন। ‘রোজকে বল এগুলো এখান থেকে নিয়ে যাবে। আর শোনো, এবার থেকে নিজের প্লেট তুমি নিজেই ধোবে। এঁটো বাসন কখনো এভাবে ফেলে রাখবে না।’
‘কিন্তু আমি তোমাকে যা বলছি, তুমি তাই করবে। আর মনে রাখবে রান্নাঘরের কোনো জিনিসই যেন অগোছালো না দেখি।’
কয়েকদিনের মধ্যে মিস ওফেলিয়া শুধু রান্নাঘর নয়, এই বাড়ির সবকিছুতেই একটা স্বাভাবিক ধারা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অনেক দিনের পুরনো অভ্যাসকে রাতারাতি পাল্টে দেওয়া সহজ নয়, বিশেষ করে যেখানে চাকর-বাকরদের সহযোগিতার প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে।
সেদিন বিকেলে চায়ের পর খোলা বারান্দায় বসে সবাই গল্পগুজব করছে, ওফেলিয়া বললেন, ‘এ পরিবারে দেখছি কোনো নিয়ম বলে কিছু নেই। এত অপচয় আমি আর কোথাও দেখি নি। তাছাড়া সবাই সৎ বলেও আমার মনে হয় না।’
‘সৎ!’ ওফেলিয়ার কথা শুনে আগাস্টিন হো হো করে হেসে উঠলেন। ‘ওরা সৎ হতে যাবে কোন দুঃখে?’
ওফেলিয়া অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ‘তার মানে তুমি কি বলতে চাও সততার কোনো দাম নেই?’
‘নিশ্চয়ই আছে! কিন্তু এ পৃথিবীতে ওরা সৎ হয়ে কী করবে শুনি? জন্মের মুহূর্ত থেকেই ওরা দেখে, আমরা মনিব, ওরা ক্রীতদাস। ওরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিনরাত পরিশ্রম করে, আর ওদের সেই শ্রমলব্ধ ঐশ্বর্যের দৌলতে আমরা বিলাসিতা করি। ওরা দুর্বল, আমরা শক্তিশালী। ওরা লেখাপড়া জানে না, আমরা শিক্ষিত। আমরা চাবুক মারি, ওরা চাবুক খায়। ওরা কিসের জন্যে সৎ হতে যাবে, তুমিই বলো?’
উল বোনার কাজ থামিয়ে ওফেলিয়া স্তব্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। আগাস্টিন ওঁর অবাক হবার ভঙ্গি দেখে মনে মনে বেশ মজা পেলেন।
‘তবে ওফেলিয়া, আমি তোমাকে একটা কথা বেশ স্পষ্টভাবেই বলতে পারি নিজেদের জাতটাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে ওদের পক্ষে যতটা সৎ হওযা সম্ভব, ওরা নিশ্চয়ই ততটা সৎ। আমরা ওদের চাইতে কত অসৎ, সে তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, ওফেলিয়া! বেশ তো, আমাদের কথাই ধরো না কেন। আমার আর তোমার বাবারা ছিলেন দুভাই। দুজনেই মানুষ হয়েছিলেন নিউ ইংল্যান্ডে। পিতামহের সম্পত্তি ভাগ হবার পর তোমার বাবা রয়ে গেছেন নিউ ইংল্যান্ডে আর আমার বাবা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলেন লুসিয়ানায়। সে সময়ে আমাদের আবাদে কাজ করত সাত শো নিগ্রো ক্রীতদাস-দাসী। আমার বাবা ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী আর কড়া মেজাজের মানুষ। ক্রীতদাসদের কাজে কোনো ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটলে তিনি তাদের কঠোর শাস্তি দিতেন। আমার মা ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। উনি কারুর দুঃখ-কষ্ট একদম সহ্য করতে পারতেন না। লুকিয়ে লুকিয়ে যতটা সম্ভব সবাইকে সাহায্য করতেন। এর জন্যে প্রতিবেশী থেকে শুরু করে প্রতিটা দাস-দাসী ওঁকে অসম্ভব ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত। আমরা যমজ দু ভাই, অ্যালফ্রেড আর আমি। অনেকে বলে যমজ হলে নাকি দেখতে এবং স্বভাব চরিত্র অনেকটা একইরকম হয়। কিন্তু সবদিক থেকেই আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ বিপরীত। ওর গায়ের রঙ ছিল লালচে ধরনের, কালো চোখ, কুচকুচে কালো চুল, রোমানদের মতো বেশ বলিষ্ঠ চেহারা। আমার গায়ের রঙ ঠিক মার মতো ধবধবে সাদা, নীল চোখ, সোনালি চুল আর চেহারাখানা অনেকটা গ্রিকদের মতো। ও ছিল কর্মঠ আর বাস্তববাদী। আমি ছিলাম অসম্ভব কুঁড়ে আর স্বপ্নবিলাসী। ও ছিল সাহসী, আমি লাজুক আর ভীরু প্রকৃতির। তাই বলে আমাদের মধ্যে যে অসৎ ভাব ছিল তা কিন্তু নয়। আমার বাবা ভালোবাসতেন অ্যালফ্রেডকে আর মা ভালোবাসতেন আমাকে।
‘আমাদের আবাদে ক্রীতদাসদের কাজ দেখাশোনা করার জন্যে স্টাবস নামে একজন শ্বেতাঙ্গ সর্দার ছিল। লোকটা ভারমন্ট থেকে পালিয়ে আসা একজন দাগী আসামি। স্টাবসকে যেমন বিশ্রী দেখতে, তেমনি নিষ্ঠুর তার স্বভাব। স্টাবসের ভয়ে ক্রীতদাসরা সবসময় তটস্থ থাকত। একটা কিছু ভুল দেখলেই সে নির্মমভাবে চাবুক মারত। আমি প্রায়ই মার কাছে নালিশ করতাম, মা তুমি চুপিচুপি স্টাবসকে ডেকে বকতেন। তাতে কিন্তু কোনো ফলই হতো না। স্টাবস একদিন বাবাকে স্পষ্টই জানিয়ে দিল তার কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করলে সে চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। বাবা মাকে জানালেন স্টারসের মতো দক্ষ কর্মচারীকে তিনি কিছুতেই ছাড়তে পারবেন না। সে যা কিছু করে তাঁর বিষয়-সম্পত্তির উন্নতির জন্যেই। ফলে এখন থেকে স্টাবসের কোনো ব্যাপারে উনি যেন আর নাক গলাতে না আসেন আর স্টাবসও বাড়িতে নিযুক্ত দাসদাসীদের সম্পর্কে একটা কথাও বলবে না।
‘তারপর থেকে বাবাকে আর কিছু না বললেও, মা যে মনে মনে কষ্ট পেতেন আমি স্পষ্টই বুঝতে পারতাম। অবশ্য মাকে খুব বেশিদিন কষ্ট পেতে হয় নি। আমার যখন তের বছর বয়স, উনি তখন মারা যান। বাবা মারা যাবার পর আমরা দুভাই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হলাম। কিন্তু দাসপ্রথাকে আমি মনেপ্রাণে চিরকালই ঘৃণা করতাম, কেননা মার চরিত্রের প্রভাব ছিল আমার ওপরে বহুল পরিমাণে। বিষয়-সম্পত্তি পাবার কিছুকাল পরেই অ্যালফ্রেড বুঝতে পারল আমি আবাদি কাজের উপযুক্ত নই। তাই একদিন সে বলল, ‘যে বসে বসে শুধু মেয়েদের মতো উচ্ছ্বাসভরা কবিতা লিখতে পারে, তাকে দিয়ে এ কাজ হবে না। ব্যাংকে যত গচ্ছিত টাকা আছে সব নিয়ে তুমি বরং নিউ অর্লিয়েন্সের বাড়িটাতে বাস করতে যাও।’ আমি দেখলাম ক্রীতদাসদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করার চাইতে এটা বরং অনেক সহজ।’
এতক্ষণ মেরি চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল, এবার বলল, ‘কিন্তু ওই ছোটলোকগুলো যে কী বদ তুমি যদি জানতে, তাহলে ওদের সম্পর্কে আর এত কথা বলতে না। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ওরা অসম্ভব খারাপ। আমার বাবার একটা ক্রীতদাস ছিল। লোকটা অসম্ভব কুঁড়ে। কাজে ফাঁকি দিয়ে সে জলায় গিয়ে লুকিয়ে থাকত। বাবা গিয়ে লোকটাকে ধরে আনতেন, তারপর খুব করে চাবকাতেন। লোকটার স্বভাবের জন্যে তাকে প্রায়ই চাবুক খেতে হতো। তবু তার স্বভাব বদলালো না। একদিন সেই যে পালিয়ে গেল, আর ফিরে এল না। সেখানেই না খেতে পেয়ে মরে গেল।’
আগাস্টিন বললেন, ‘কিন্তু যাকে কেউ কোনোদিন শোধরাতে পারে নি এমন একজন নিগ্রোর চরিত্র আমি শুধরে দিয়েছিলাম।’
বিদ্রূপের সুরে বলে উঠল মেরি, ‘তুমি!’
‘হ্যাঁ। লোকটা ছিল দৈত্যের মতো বিশাল চেহারার একেবারে খাঁটি আফ্রিকান। তার অন্তরে স্বাধীনতার স্পৃহা ছিল দুর্দমনীয়। সে ছিল সত্যিকারের ‘আফ্রিকান সিংহ’। তার নাম ছিল স্কিপিও। কেউ ওকে শায়েস্তা করতে পারত না বলে, নানান হাত ঘুরতে ঘুরতে শেষকালে এসে পড়ল অ্যালফ্রেডের হাতে। বশ করতে পারবে ভেবেই অ্যালফ্রেড তাকে কিনেছিল। আমি তখন আলাদাভাবে নিউ অর্লিয়েন্সে বাস করছি। অ্যালফ্রেডদের ওখানে বেড়াতে গিয়ে শুনলাম সর্দারকেই বেশ কয়েক ঘা কষিয়ে দিয়ে স্কিপিও পালিয়ে গেছে। সব শুনে আমি বললাম, তার দোষেই লোকটা অমন দুর্দান্ত হয়ে উঠেছে এবং বাজি রাখলে আমি স্কিপিওর চরিত্র শুধরে দিতে পারি। অ্যালফ্রেড এক কথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু মুশকিল হলো লোকটাকে ধরা সম্পর্কে। তখন ঠিক হলো আমার ছয়-সাত জন মিলে বন্দুক আর শিকারি কুকুর নিয়ে লোকটাকে খুঁজতে বের হব। কিছুটা উত্তেজনা সেই প্রথম আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম। হরিণ শিকার করতে যা আনন্দ, একটা মানুষ শিকার করতে আনন্দ তার চাইতে কোনো অংশে কম নয়।
‘যাই হোক, ঘোড়ায় চড়ে আমরা তো সবাই দলবল নিয়ে গিয়ে হাজির হলাম সেই জলার ধারে। সবাই চিৎকার-চেঁচামেচি করছে, কুকুরগুলো ভয়ঙ্করভাবে গর্জন করছে। এতে স্কিপিও ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। সে আর লুকিয়ে থাকতে পারল না। ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করল। ঘোড়ায় চড়ে আমরাও তার পেছন পেছন ছুটতে লাগলাম, শিকারি কুকুরগুলোও ক্রুদ্ধ আক্রোশে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। অবশেষে স্কিপিও দুর্ভেদ্য একটা বেতবনে গিয়ে আটকে পড়ল। তার তখনকার ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখলে যেকোনো লোকই ভয়ে আঁতকে উঠবে! খালি হাতেই অমন প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শিকারি কুকুরগুলোর সঙ্গে যে লড়াই শুরু করে দিল। তিনটে কুকুর মারাই পড়ল তার ঘুঁসির ঘায়ে। শেষে কার যেন একটা বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে স্কিপিওর রক্তাক্ত দেহটা লুটিয়ে পড়ল আমার পায়ের ওপর। হতাশ হয়ে, অথচ সত্যিকারের একজন বীরের দৃষ্টিতে সে তাকাল আমার মুখের দিকে। বাকি কুকুরগুলো তার দিকে ছুটে যাবার চেষ্টা করতেই আমি তাদের নিরস্ত করলাম এবং অন্যদেরও গুলি করতে নিষেধ করলাম। যেহেতু লোকটা আমার পায়ের ওপরেই আছড়ে পড়েছিল, আমি তাকে বন্দি হিসেবে দাবি করলাম এবং অ্যালফ্রেড তাকে আমার কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হলো। তারপর দিন পনেরোর মধ্যেই আমি লোকটাকে শুধরে ফেললাম।’
কৌতূহলভরে সামনের দিকে ঝুঁকে মেরি জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন করে?’
সেন্ট ক্লেয়ার মুচকি মুচকি হাসলেন, ‘খুব সহজ উপায়ে। আমি তাকে পরিষ্কার করে ওষুধ দিয়ে বেঁধে যতদিন পর্যন্ত না সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে সে হাঁটা-চলা করতে পারল, আমি নিজে হাতে তার শুশ্রূষা করতে লাগলাম। তার কিছু কাল পরে স্কিপিওকে একখানা মুক্তিপত্র লিখে দিয়ে বললাম সে এবার যেখানে খুশি চলে যেতে পারে।’
মিস ওফেলিয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে চলে গিয়েছিল?’
‘না। কাগজটা সে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেছিল, কিছুতেই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চায় নি। স্কিপিওর মতো সাহসী ও বিশ্বাসী লোক আমি জীবনে আর কখনো দেখি নি। কিছুদিন পরে সে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করে এবং ছোট্ট একটা শিশুরই মতো সরল হয়ে যায়। হ্রদের ধারে আমার যে বিষয়সম্পত্তি রয়েছে, সেটা সে-ই দেখাশোনা করত। কিন্তু সে কলেরায় মারা যায়। সত্যি বলতে কী, স্কিপিও আমারই জন্যে প্রাণ দিয়েছিল। সে বছর আমিও কলেরায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আমার সেবা-শুশ্রূষা করতে করতেই সে রোগাক্রান্ত হয়। আমি সেরে উঠি, কিন্তু সে মারা যায়। তার অভাব আমি যতটা অনুভব করেছিলাম, জীবনে আর কারো জন্যে ততটা অনুভব করি নি।’
গল্প শুনতে শুনতে ইভা ধীরে ধীরে সরে এসে বাবার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ বড় বড় করে গভীর আগ্রহে শুনতে শুনতে সদ্য মেলা পাপড়ির মতো ওর ঠোঁট দুটো অল্প একটু ফাঁক হয়ে গিয়েছিল। গল্প শেষ হতেই হঠাৎ বাবার গলাটা জড়িয়ে ধরে ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, জল ভরে উঠল ওর ডাগর চোখ দুটোতে।
‘সোনামণি আমার, কী হয়েছে তোমার?’ মেয়ের সোনালি চুলে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে আগাস্টিন বললেন। কিন্তু ইভাকে তখনো অবরুদ্ধ আবেগে ফুলে ফুলে উঠতে দেখে উনি নিজেই অনুতপ্ত হলেন। ‘সত্যি, আমারই ভুল হয়েছে। মেয়েটার মন বড় দুর্বল, ওর সামনে আমার এসব বলা উচিত হয় নি।’
‘না বাপী, আমার মন দুর্বল নয়।’ নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে ইভা বেশ দৃঢ় স্বরেই বলল।
‘কিন্তু এইসব ঘটনা আমার মনকে খুব নাড়া দেয়।’
‘তার মানে! তুমি কী বলতে চাইছ, মামণি?’
‘আমি তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না, বাপী। কিন্তু আমি এসব সম্পর্কে অনেক কিছু ভাবি। হয়তো একদিন তোমাকে আমি সব বলব।’
‘তাই বল, সোনামণি; কিন্তু এখন কেঁদো না, লক্ষ্মীটি। তুমি তো জানো, কাঁদলে তোমার বাপীর মনে কত কষ্ট হয়। চলো, দুজনে বরং নতুন রঙিন মাছগুলো দেখে আসি।’
কথাগুলো বলে আগাস্টিন ইভার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই আঙিনার ওপার থেকে ভেসে এল দুজনের ছুটোছুটি আর মুখর কলহাস্য।
১৬. টপসি
আস্তাবলের ওপর টমের ঘরখানা ছোট হলেও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর খোলামেলা। আসবাব বলতে কেবল একটা শয্যা, একখানা চেয়ার আর টেবিল। ধবধবে সাদা টেবিলের ওপর সযত্নে সাজানো রয়েছে তার জীর্ণ বাইবেলখানা আর সামান্য কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস।
টম তখন চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর শ্লেট রেখে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী যেন লিখছে। আসলে বেচারির মন তখন বাড়ির জন্যে খুবই কাতর হয়ে উঠেছিল। তাই ইভার কাছ থেকে একখানা কাগজ চেয়ে নিয়ে সে চিঠি লেখার চেষ্টা করছিল। ভেবেছিল প্রথমেই চিঠির খসড়াটা শ্লেটের ওপর করে নেবে। কিন্তু খসড়াটা তার কিছুতেই মনঃপূত হচ্ছিল না, কেননা দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে মাস্টার জর্জের কাছ থেকে শেখা অক্ষরের অনেকগুলোই সে ভুলে গিয়েছিল। যেগুলো মনে আছে, তার সাহায্যে চিঠিটা কীভাবে লেখা সম্ভব সেটা সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না।
এমন সময় ইভা চুপিচুপি এসে পেছনে থেকে টমের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মারল। পরক্ষণেই কিছুটা অবাক হয়ে, কিছুটা মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে খিলখিল করে হেসে উঠল।
‘টম চাচা, এটা তুমি কী করছ?’
প্রথমে টম চমকে উঠেছিল, কিন্তু ছোট্ট পাখির মতো মিষ্টি ইভাকে দেখে সে খুশি হয়েছিল তার চাইতেও বেশি।
‘বাড়িতে আমার বড় আর ছেলেমেয়েদের কাছে একখানা চিঠি লেখার চেষ্টা করছি, ইভা। কিন্তু পারব বলে মনে হচ্ছে না।’
‘কেন, টম চাচা?’
‘কতকগুলো অক্ষর একদম ভুলে গেছি। এখন আর কিছুতেই মনে করতে পারছি না।’
‘আমার মনে হয় আমি তোমাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারি।’
তারপর দুজনে গভীর আগ্রহে টেবিলের ওপর একেবারে ঝুঁকে পড়ে প্রায় একই অনভিজ্ঞতায়, চিঠিখানা লিখতে শুরু করল। প্রতিটা শব্দ বহু আলোচনা ও শলাপরামর্শের পর লেখাটা মোটামুটি একটা চিঠির আকার ধারণ করল।
লেখাটার দিকে তাকিয়ে ইভা বলল, ‘তুমি যাই বল টম চাচা, চিঠিটা কিন্তু দেখতে বেশ ভালোই হয়েছে। তোমার বউ আর ছেলেমেয়েরা দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। তবে এটা সত্যিই খুব লজ্জার কথা যে ওদের কাছ থেকে তোমাকে চলে আসতে হয়েছে। আমি বাবাকে বলব উনি যেন কিছুদিনের জন্যে তোমাকে ঘরে যেতে দেন।’
‘আমার আগের মনিবানি বলেছিলেন যে টাকা সংগ্রহ করতে পারলেই পাঠাবেন। আমি বিশ্বাস করি উনি নিশ্চয়ই তা করবেন। মাস্টার জর্জ বলেছিল আমাকে নিতে আসবে। স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ সে এই ডলারটা আমাকে উপহার দিয়েছিল।’ জামার মধ্যে থেকে লকেটটা বার করে টম ইভাকে দেখাল।
‘তাহলে আমার মনে হয় ও নিশ্চয়ই তোমাকে নিতে আসবে। আর কেউ যদি তোমাকে নিতে আসে, আমি সত্যিই খুব খুশি হব, টম চাচা।’
‘আসলে কী, জানো’, ম্লানস্বরে টম বলল, ‘আমি চিঠিতে ক্লোকে জানাতে চাই যে আমি বেশ ভালো জায়গাতেই আছি … কেননা বেচারি আমার জন্যে সত্যিই খুব ভাবছে।’
‘টম।’ দরজার বাইরে হঠাৎ আগাস্টিন সেন্ট ক্লেয়ারের গলা শোনা গেল। টম ইভা দুজনেই চমকে উঠল।
একটু পরে আগাস্টিন ভেতরে ঢুকে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, এটা আবার কী হচ্ছে?’
ইভা বলল, ‘টম চাচার চিঠি। আমি ওকে লিখতে সাহায্য করেছি। তুমি বলো, চিঠিটা বেশ সুন্দর হয় নি?’
দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আগাস্টিন মুচকি মুচকি হাসলেন। ‘আমি তোমাদের কাউকেই ঠিক নিরুৎসাহ করতে চাই না। তবে আমার মনে হয় টম, চিঠিটা আমি লিখে দিলে হয়তো আর একটু ভালো হবে। তুমি যদি চাও, বেড়িয়ে ফিরে আসার পর তোমার চিঠিটা লিখে দিতে পারি।
ইভা বলল, ‘টম চাচার চিঠিটা সত্যিই খুব দরকারি, বাপী। ওর আগের মনিবের স্ত্রী বলেছিলেন যে ওকে আবার কিনে নেবার জন্যে টাকা পাঠাবেন। ‘
সেন্ট ক্লেয়ার জানতেন যে অনেক সহৃদয় মনিব ক্রীতদাস দাসীদের বিক্রি করার সময় এই ধরনের সান্ত্বনা দিয়ে থাকেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা কোনোদিনই ওদের সেই আশা পূরণ করেন না। উনি অবশ্য ইভার কথায় কোনো মন্তব্য করলেন না, শুধু টমকে তাঁর ঘোড়াটা সাজিয়ে বার করার আদেশ দিলেন।
তারপর বেড়িয়ে ফিরে এসে তিনি সেদিনই সন্ধ্যেয় টমের চিঠিটা লিখে দিলেন এবং চিঠিটা যথারীত ডাকবাক্সে ফেলেও দেওয়া হলো।
সেদিন সকালবেলায় মিস ওফেলিয়া ঘরের কাজে খুবই ব্যস্ত ছিলেন, আগাস্টিন সেন্ট ক্লোয়ার হঠাৎ ওঁকে বৈঠকখানায় ডেকে পাঠালেন।
‘ওঃ ওফেলিয়া! তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।’
কিছু বুঝতে না পারা ভঙ্গিতে ওফেলিয়া বললেন, ‘কী ব্যাপার?’
‘তোমার জন্যে এটাকে কিনে এনেছি, দেখো।’
নয় দশ বছরের একটা কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েকে দেখিয়ে আগাস্টিন বললেন।
মেয়েটি খুবই কালো। এত কালো যে আপাতদৃষ্টিতে আফ্রিকান বলেই ভুল হয়। মুক্তোর মতো ঝকঝকে সাদা দাঁত, গলায় পুঁতির মালা। কুচকুচে কালা কোঁকড়ানো চুলগুলো বিনুনী বাঁধা। অসম্ভব উজ্জ্বল, চঞ্চল চোখ দুটো বিস্ময়ে ঘরের চারদিকে ঘুরছে।
ওফেলিয়া অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটাকে আবার এখানে নিয়ে এলে কেন?’
‘এর নাম টপসি। খুব ভালো নাচতে আর গাইতে পারে। তুমি নিজে যেমনটা চাও, তেমনিভাবে একে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে পারবে বলেই একে নিয়ে এসেছি।’
ওফেলিয়া বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। সেই মুহূর্তে কী বলবেন উনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। বোনের অবাক হবার ভঙ্গি দেখে আগাস্টিন খুবই মজা পেলেন, মুচকি হেসে মেয়েটিকে বললেন টপসি, এখন থেকে ইনিই তোমার নতুন মনিবানী। এঁর হাতেই তোমাকে দিচ্ছি। দেখো যেন একটুও দুষ্টুমি করো না।’
চোখের মণিতে ঝিলিক তুলে টপসি বলল, ‘আচ্ছা।’
‘এঁর কথা শুনবে, আর খুব ভালো হয়ে থাকবে, বুঝেছ?’
‘হ্যাঁ!’
‘কিন্তু, আগাস্টিন’, এতক্ষণ পর ওফেলিয়া যেন ভাষা খুঁজে পেলেন, ‘এ সবের কী প্রয়োজন ছিল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! তোমার সারা বাড়ি এমনিতেই চাকর- বাকরদের ভিড়ে একবারে ঠাসা, ওদের সামলাতে সামলাতে আমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে। তার ওপর তুমি এটাকে আবার কোন দুঃখে এনে জোটালে শুনি?’
‘ওই যে তোমাকে বললাম, নিজের মতো করে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবে বলে।’
ওফেলিয়া রীতিমতো চটে উঠলেন। ‘ওসব করার আমার একটুও সময় নেই।’
‘সত্যিই তুমি বিশ্বাস করো ওফেলিয়া’, ওফেলিয়ার হাত দুটো ধরে ওঁর রাগ ভাঙানোর ভঙ্গিতে আগাস্টিন বললেন, ‘আমি কিন্তু তোমার কথা ভেবেই টপসিকে নিয়ে এসেছি।’
‘আমি স্পষ্টই বলছি, আমার আর কাউকে চাই না।’
‘তাহলে তোমাকে সত্যি কথাটাই বলি’, ওফেলিয়াকে একপাশে এনে আগাস্টিন চাপাস্বরে বললেন, ‘রেস্তোরাঁর মালিক মাতাল অবস্থায় মেয়েটাকে বেধড়ক মারধর করত, আমি প্রায়ই ওর আর্তচিৎকার শুনতে পেতাম কিন্তু কেন জানি না, হয়তো ওর সপ্রতিভ ভঙ্গির জন্যেই, মেয়েটাকে আমার বেশ ভালো লাগত। তাই ভাবলাম, কিনে নিয়ে ওকে যদি তোমার হাতে তুলে দিতে পারি, তাহলে হয়তো ওকে বাঁচানো সম্ভব হবে। তাছাড়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি চেষ্টা করলে ওকে নিশ্চয়ই তোমার মতো করে গড়ে তুলতে পারবে।
‘কিন্তু মেয়েটা দেখছি যা অসম্ভব নোংরা … আর পরনে জামাকাপড় প্রায় নেই বললেই চলে …’
‘ওটা কোনো ব্যাপারই নয়, ওফেলিয়া’, আগাস্টিনের কণ্ঠস্বর শুনে স্পষ্ট বোঝা গেল বোনকে রাজি করাতে পেরে তিনি খুশি হয়েছেন। স্নানঘরে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা পরিষ্কার পোশাক দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
টপসিকে নিয়ে ওফেলিয়া অন্দরমহলে চলে গেলেন। উনি ভালো করেই জানতেন নতুন এই মেয়েটিকে পুরনো দাসীরা খুব একটা ভালো চোখে দেখবে না। তাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে টপসিকে পরিষ্কার করে স্নান করানো ও পোশাকের ব্যাপারটা দেখাশোনা করলেন, তারপর ওকে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন।
‘তোমার বয়স কত, টপসি?’
‘জানি না, মিসিস।’ টপসির সাদা দাঁতগুলো ঝিকমিক করে উঠল।
‘কত বয়স তুমি জানো না? কেউ তোমাকে বলে নি?’
‘না, মিসিস।’
‘এ ভাবে তোমার মা কে?’
‘আমার মা ছিল না, মিসিস।’
‘তার মানে! তুমি কোথায় জন্মেছ?
‘আমি জন্মাই নি, মিসিস।’
না হেসে মিস ওফেলিয়া আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন। আর কখনো আমার কথার জবাব দেবে না, আমি তোমার সঙ্গে খেলা করছি না। বলো তুমি কোথায় জন্মেছ আর তোমার বাবা-মাই বা কে?
‘আমি জন্মাই নি, মিসিস। আর আমার বাবা-মাও নেই। খুব ছোটবেলায় একজন ব্যবসায়ী আমাকে কিনেছিল … ছোট ছোট অনেক ছেলেমেয়েকে সে প্রায়ই কেনে। একটু বড় হবার পর লোকটা আমাদের বাজারে বেচে দেয়।’
টপসির সরলতায় ওফেলিয়া মনে মনে বিচলিত বোধ না করে পারলেন না, তাই আগের চাইতে আরো আন্তরিকভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি সেলাই করতে পার, টপসি?’
‘না, মিসিস।’
‘আগের মনিবের ওখানে তুমি কী কাজ করতে?’
‘জল আনতাম, থালা-বাসন ধুতাম, ছুরি পরিষ্কার করতাম…‘
‘ঠিক আছে, এখন থেকে তুমি শুধু আমারই ঘরের কাজ করবে।’
বিছানা করা থেকে শুরু করে ঘর-গোছানোর প্রায় সমস্ত কাজই টপসি নিপুণ দক্ষতায় শিখে নিল। এখন আর ওসব কিছুই ওফেলিয়াকে দাঁড়িয়ে থেকে দেখিয়ে দিতে হয় না। কিন্তু সেদিন হঠাৎ ওফেলিয়ার নজরে পড়ল টপসির জামার হাতার মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে রঙিন একটা ফিতের একটুখানি অংশ।
‘কী ব্যাপার টপসি, তুমি ফিতেটা চুরি করেছ?’ মিস ওফেলিয়া সত্যিই খুব অবাক হলেন।
টপসি নিজেই ওই ফিতেটা জামার হাত থেকে টেনে বার করল।
‘মিস ওফেলিয়ার ফিতেটা আমার এই হাতার মধ্যে কী করে এল আমি নিজেই বুঝতে পারছি না।’
‘টপসি, তুমি খুব দুষ্টু মেয়ে। মিথ্যে বলো না। এই ফিতেটা তুমি চুরি করেছ।’
‘আমি চুরি করি নি, মিসিস।’
‘টপসি, মিথ্যে কথা বলাটা আরো খারাপ।’
‘আমি মিথ্যে বলছি না, মিসিস।’
‘টপসি, মিথ্যে বললে আমি কিন্তু তোমাকে চাবুক মারতে বাধ্য হব!’
‘সত্যিই আমি মিথ্যে বলছি না, মিসিস।’
কিন্তু টপসির চোখ-মুখ দেখে ওফেলিয়া স্পষ্টই বুঝতে পারলেন ও মিথ্যে বলছে। তাই ওর কাঁধ ধরে নাড়া দিতে দিতে ওফেলিয়া ধমক দিলেন, ‘টপসি! ফের তুমি মিথ্যে বলছ?’
‘আমি মিথ্যে বলছি না, মিসিস।’
নিজের জেদ বজায় রাখার জন্যে টপসি তখনো সমানে মিথ্যে বলে চলেছে, কিন্তু কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার ফলে টপসির অন্য জামার হাতা থেকে দুটো দস্তানা মেঝেতে পড়ে গেল।
‘বাঃ চমৎকার!’ ওফেলিয়া বলে উঠলেন। ‘এর পরেও তুমি বলবে ফিতেটা চুরি করো নি!’
দস্তানা দুটো চুরি করার কথা টপসি স্বীকার করল, কিন্তু ফিতে চুরির ব্যাপারটা স্বীকার করতে ও রাজি নয়। এদিকে ওফেলিয়াও এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নন। তাই রীতিমতো দৃঢ়স্বরেই বললেন, টপসি, এই মুহূর্তে সব স্বীকার না করলে আমি কিন্তু সত্যিই অ্যাডলফকে ডেকে চাবুক লাগাতে বলব।’
টপসি তখন নিঃসঙ্কোচেই স্বীকার করল ও দুটো ও চুরি করেছে।
‘ঠিক আছে, এবার বলো তো আর কী কী নিয়েছ?’
‘আমি শুধু কুমারী ইভার লাল প্রবালের মালাটা নিয়েছি।’
‘ওকে না বলে তুমি কেন নিয়েছ?’
‘আমি সত্যিই খুব খারাপ মেয়ে, মিসিস।’
‘না না, টপসি, তুমি খুব ভালো মেয়ে!’ নিঃশব্দ পায়ে ইভা কখন ঘরে ঢুকেছিল কেউ টের পায় নি। শেষের কথাগুলো শুনতে পেয়ে সে টপসির হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘শুধু প্রবালের মালাটা কেন, আমার যা আছে সব তোমাকে দিয়ে দেব। তাহলে তোমার আর কখনো চুরি করার দরকার হবে না।’
মূর্তিময়ী ইভার কথা শুনে টপসির দুচোখে তখন জল এসে গিয়েছিল, কেননা জীবনে ওর সঙ্গে এমন মিষ্টি করে কথা কেউ কখনো বলে নি।
টপসির প্রতিভার সত্যিই কোনো তুলনা হয় না। শুধু দক্ষতা বা নিপুণতা নয়, আশ্চর্য উল্লেখযোগ্য ওর স্মরণশক্তি। কয়েক দিনের চেষ্টাতেই ও প্রতিটা অক্ষর শিখে নিয়েছিল এবং নিজে নিজে মোটামুটি বেশ ভালোই পড়তে পারত। কিন্তু সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ ওর আদৌ ভালো লাগত না। ওফেলিয়া চোখের আড়াল হলেই হয় সুঁই ভাঙত, নয়তো সুতোয় জট পাকিয়ে রাখত এবং চোখের নিমেষে জানালা দিয়ে ফেলে এমন নিষ্পাপ মুখে চুপচাপ বসে থাকত, যেন এ সম্পর্কে ও কিছুই জানে না।
হাসি-গানে, মূকাভিনয়ে, ভাঁড়ামিতে, হইচই আর গোছানিতে ওর জুড়ি মেলা ভার। সেই ঘটনার পর থেকে ও আর কখনো চুরি করে নি বটে, কিন্তু প্রায়ই দেখা যেত, বেশ কয়েকদিন ধরে না-খুঁজে পাওয়া একজোড়া মাকড়ি হঠাৎ খুঁজে পাওয়া গেল কারুর জুতোর মধ্যে, কিংবা সুন্দর একটা পোশাক দলা-মোচড়ানো অবস্থায় বেরুল বিছানার তলা থেকে। কেউ হঠাৎ হোঁচট খেল গরমজলের পাত্রটার ওপর কিংবা কোথাও কিছু নেই, সুন্দর পোশাকপরা অবস্থাতেই দুম করে আছাড় খেল শুকনো মেঝের ওপর। দুর্ঘটনার কারণ আবিষ্কার করা গেলেও, অপরাধীকে কিন্তু কখনো আবিষ্কার করা যেত না। ওফেলিয়া কিন্তু স্পষ্টই বুঝতে পারতেন কাজটা টপসির।
কখনো কখনো হতাশ হয়ে উনি সত্যিই অভিযোগ করতেন, ‘মাঝে মাঝে আমার তো মনে হয় মেয়েটাকে সত্যিই চাবকানো দরকার।‘
একই ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে আগাস্টিন জবাব দিতেন, ‘প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই তা করবে। ওর সম্পর্কে আমি তো তোমাকে যা খুশি করার অধিকার দিয়েছি, ওফেলিয়া।’
‘তুমি হাসছ বটে’, ওফেলিয়া রাগ দেখিয়ে বলতেন, ‘কিন্তু আমি যে কী করে ওকে সামলাব নিজেই বুঝতে পারছি না!’
‘সেটা এই মুহূর্তে বলা সত্যিই খুব কঠিন। আর তুমি ওকে নিয়ে যা করতে চাও, তাতেও আমি বাধা দিতে পারি না। তবে তোমাকে একটা কথা বলতে পারি, ওফেলিয়া, ওকে মেরে কোনো লাভ হবে না, জীবনে ও অজস্র মার খেয়েছে। বরং ওকে ওর মতো থাকতে দিলেই হয়তো কিছুটা লাভ হবে।’
মুখে যাই বলুন না কেন, ওফেলিয়া ভাইয়ের মতামতের খুব একটা দ্বিমত ছিলেন না, তাই সবসময়ই টপসিকে চোখে চোখে রাখতেন। কিন্তু চোখের আড়াল হলেই টপসি একটা না একটা অঘটন বাঁধিয়ে বসে থাকবে। ওর যখন ইচ্ছে হবে বিছানার চাদরটা এমন সুন্দরভাবে পেতে রাখবে যে তাতে কোথাও কোনো ভাঁজ থাকবে না, ঘরদোরের ধুলো ঝেড়ে যেখানকার যা কিছু সব নিপুণ হাতে গুছিয়ে রাখবে। আবার যখন ইচ্ছে হলো তো বালিশের ঢাকনা খুলে মাথায় গলিয়ে ঘরময় ভূত সেজে ঘুরে বেড়াবে। নয়তো ওফেলিয়ার রাতের পোশাক থেকে শুরু করে সবকিছু ঘরময় ছড়িয়ে রেখে বারান্দায় কোনো একটা থামের ওপর উঠে মাথাটা নিচের দিকে ঝুলিয়ে দোল খেতে খেতে নিজের মনেই গান গাইবে।
একবার দেখা গেল মিস ওফেলিয়ার সবচেয়ে দামি কাশ্মিরী শালটাকে পাগড়ির মতো মাথায় দিয়ে মিস টপসি দীর্ঘ সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দেহ-ভঙ্গিমার মহড়া দিচ্ছে। সেই প্রথম মিস ওফেলিয়া আলমারির চাবিটা টানার মধ্যে রেখে দেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন এবং ধৈর্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, টপসি, আমাকে জিজ্ঞেস না করে তোমার আলমারি খোলাটা কি ঠিক হয়েছে?’
‘না, মিসিস।’
‘সত্যি তোমাকে নিয়ে কী করব আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’
‘আমাকে চাবকানো উচিত, মিসিস।’ অত্যন্ত নির্লিপ্ত স্বরেই টপসি জবাব দিল। ‘আমার পুরনো মনিব আমাকে সবসময়ই চাবুক মারতেন। চাবুক না খেলে আমি একদম ভালোভাবে কাজ করতে পারি না, মিসিস’
‘তোমাকে আমি কখনই চাবুক মারতে চাই না, টপসি। আমি জানি, একটু মন দিলেই তুমি ভালো কাজ করতে পার
‘কিন্তু চাবুক না খেলে আমি কাজে মন দিতে পারি না, মিসিস।’
টপসির সরল আন্তরিকতায় ওফেলিয়া কিছুতেই ওর ওপর রাগ করতে পারলেন না। তাই মনে মনে ঠিক করলেন আর কিছু না বলে ওকে ওর মতোই থাকতে দেবেন।
১৭. কেন্টাকি
গ্রীষ্মের এক গোধূলিবেলা। বিরাট বৈঠকখানার সমস্ত দরজা-জানলা একেবারে হাট করে খোলা রয়েছে, যদি বাইরের হিমেল হাওয়া ভুল করেও একটু ভেতরে ঢোকে। রাতের আহার সেরে মিস্টার শেলবি তখন একটা চেয়ারের ওপর পা তুলে দিয়ে আয়েস করে চুরুট টানছেন। মিসেস শেলবি দরজার সামনে নিচু একটা মোড়ায় বসে সেলাই করছেন। এতক্ষণ ধরে যে কথাটা উনি বলি বলি করেও সুযোগের অপেক্ষায় বলতে পারছিলেন না, এবার সেটা বলেই ফেললেন :
‘জানো আর্থার, টম ক্লোকে একটা চিঠি দিয়েছে।’
‘ও, তাই নাকি! তাহলে নিশ্চয়ই ওখানে ওর চিঠি লিখে দেওয়ার মতো কেউ না কেউ আছে। তা কেমন আছে ও?’
‘খুব ভদ্র পরিবারের একজন ওকে কিনেছেন। তিনি ওর সঙ্গে খুব ভালোই ব্যবহার করেন এবং টমকেও তেমন পরিশ্রমের কাজ কিছু করতে হয় না।’
‘বাঃ, শুনে সত্যিই খুব খুশি হলাম!’ আন্তরিকভাবেই শেলবি বললেন। ‘আমার মনে হয় দক্ষিণ দেশটা বেশ ভালোই ওর সয়ে যাবে। পরে হয়তো ও আর কোনোদিন এখানে ফিরেই আসতে চাইবে না।’
‘না না, বরং ঠিক তার উল্টো। ও জানতে চেয়েছে কবে নাগাদ ওকে উদ্ধারের টাকাটা আমরা যোগাড় করতে পারব?’ শেলবি একটু বিষণ্ণ হয়ে বললেন, ‘টাকাটা যোগাড় করা সত্যিই খুব কঠিন।’
কিন্তু আর্থার, আমার মনে হয় এ ব্যাপারে সত্যিই একটা কিছু করা দরকার। ধরো, আমার যদি সব ঘোড়াগুলো বেচে দিই কিংবা কোনো একটা খামারবাড়ি …
‘তুমি কি পাগল হয়েছ, এমিলি? যদিও আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি তুমি কেন্টাকির সব চাইতে বুদ্ধিমতী ও বিদুষী মহিলা, তবুও আমি না বলে পারছি না, তুমি ব্যবসার কিছু বোঝো না। শুধু তুমি কেন, কোনো মেয়েই বোঝে না।’
‘তবুও, তুমি যদি আমাকে বলো অন্তত সমস্ত ঋণের একটা তালিকা দাও, আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি কীভাবে সাহায্য করা যায়।’
‘না এমিলি, তুমি যতটা ভাবছ, ব্যাপারটা আদৌ ততটা সহজ নয়। তা যদি হতো, আমি অনেক আগেই চেষ্টা করে দেখতাম।’
এ ব্যাপারে আলোচনা করার কোনোরকম ইচ্ছে ছিল না বলে কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই তিনি কথাগুলো বললেন।
সেই মুহূর্তে মিসেস শেলবি কী বলবেন কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। কোনো ব্যাপারে স্বামীর সঙ্গে তর্ক করা যেমন তাঁর স্বভাব নয়, তেমনি কাউকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখতে না পারাটাও তাঁর কাছে বেদনাদায়ক। তাই একসময়ে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি বললেন, ‘কোনোভাবেই কি টাকাটা সংগ্রহ করা যায় না? বেচারি ক্লো সবসময়ই খুব মন খারাপ করে থাকে।’
‘এর জন্যে আমি সত্যিই খুব দুঃখিত, এমিলি। আমার মনে হয় এভাবে প্রতিজ্ঞা করাটা ঠিক হয় নি। যদিও আমি একেবারে সুনিশ্চিত নই, তবু এখন থেকেই ক্লোকে মন শক্ত করতে বলা উচিত যাতে টমের আশা ও আর না করে।’
মিসেস শেলবি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ‘এ তুমি কী বলছ আর্থার?’
‘কেন এমিলি, এর মধ্যে তো অন্যায়ের কিছু নেই?’
‘না না, আর্থার, তা হয় না!’ মিসেস শেলবি যেন অসহায়ের মতো আর্তনাদ করে উঠলেন। ‘এইসব অসহায় মানুষদের কাছে একবার যে প্রতিজ্ঞা করেছি, তা থেকে কোনোদিনই বিচ্যুত হতে পারব না। টমকে ফিরিয়ে আনার জন্যে যদি টাকাটা কোনোভাবেই সংগ্রহ করা সম্ভব না হয়, তাহলে আমি গান শিখিয়ে তা সংগ্রহ করব।’
‘না না, নিজেকে এভাবে ছোট করার অনুমতি আমি তোমাকে কিছুতেই দিতে পারি না, এমিলি।’ মিস্টার শেলবি কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন।
‘ছোট করা!’ এবার বিদ্রূপে তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মিসেস শেলবির কণ্ঠস্বর। ‘অসহায় মানুষদের কাছে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করাটাকে আমি তার চাইতেও বেশি ছোট কাজ বলে মনে করি, আর্থার।’
‘আমি জানি, একবার কোনোকিছু তোমার মাথায় ঢুকলে, তাকে বার করার সাধ্য আমার নেই। তবু আশা করব, কাজটা করার আগে তুমি নিশ্চয়ই সমস্ত ব্যাপারটা একবার ভালো করে ভেবে দেখবে।’
কফির পেয়ালাগুলো ফিরিয়ে নিতে এসে ক্লো শেলবিদের আলোচনার শেষ অংশটুকু পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিল এবং আলোচনাটা যে তাদেরই সম্পর্কে, সেটাও বুঝতে ওর কোনো অসুবিধা হয় নি। তাই কফির সাজ-সরঞ্জাম সব গুছিয়ে নেওয়া সত্ত্বেও ক্লো সেই মুহূর্তে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল না।
ওকে দাঁড়াতে দেখে মিসেস শেলবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি কিছু বলবে, ক্লো?
‘হ্যাঁ, মিসিস। আমি বলছিলাম, অনেকেই তো তাদের দাস-দাসীদের ভাড়া খাটিয়ে পয়সা রোজগার করে … সবাই তো আর তাদেরকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ায় না।’
ঠিক বুঝতে না পেরে মিসেস শেলবি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে তুমি ভাড়া খাটানোর কথা বলছ, ক্লো?’
‘আমি কাউকেই ভাড়া খাটানোর কথা বলছি না, মিসিস।’ ক্লো ইতস্তত করল। ‘তবে স্যাম বলছিল কী … লুসিভিলের একজন খাবারওয়ালা নাকি একটা লোক চেয়েছে, যে খুব ভালো কেক আর প্যাস্ট্রি বানাতে পারে। লোকটা বলেছে সপ্তায় সপ্তায় চার ডলার করে দেবে …’
‘তাতে তোমার কী, ক্লো?
‘আমি বলছিলাম, এতদিন ধরে কাছে থেকে স্যালি তো আমার কাজ প্রায় সবই শিখে নিয়েছে। তাই ওকে আমার জায়গায় দিয়ে আমাকে যদি কিছুদিনের জন্যে লুসিভিলে যেতে দেন, তাহলে টাকা সংগ্রহের ব্যাপারে আমি আপনাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারি।’
‘কিন্তু তোমার ছেলেমেয়েদের কী হবে, ক্লো?’
‘ওরা এখন বড় হয়ে গেছে, নিজেরাই থাকতে পারবে। তাছাড়া স্যালি বলেছে ছোটটাকে ও দেখাশোনা করবে।’
‘কিন্তু লুসিভিল তো এখান থেকে অনেক দূরে!
‘তা দূর। তবে টম যেখানে আছে, সেখান থেকে জায়গাটা কাছে।’
কী যেন ভাবতে ভাবতেই মিসেস শেলবি বললেন, ‘খুব একটা কাছে নয়, ক্লো। তবু তুমি যেতে পারো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, মাইনের প্রতিটা পয়সা তোমার স্বামীকে কিনে নেবার জন্যে সঞ্চয় করে রাখব।’
মেঘলা মেঘের ফাঁকে সূর্যের একফালি আলোর মতোই এতক্ষণ থমথমে হয়ে থাকা ক্লোর মুখটা অদ্ভুত একটা আভায় ঝিকমিক করে উঠল।
‘মিসিসকে অসংখ্য ধন্যবাদ! দেখবেন, জামাকাপড় কিনে আমি একটা পয়সাও বাজে খরচ করব না … প্রতিটা পয়সা পর্যন্ত জমিয়ে রাখব। আচ্ছা, কটা সপ্তায় এক বছর, মিসিস?
‘বাহান্ন সপ্তায় এক বছর, ক্লো।’
‘সপ্তাহে চার ডলার করে হলে বছরে কত হবে?’
‘দুশো আট ডলার।’
‘তাহলে আমাকে কত দিন কাজ করতে হবে, মিসিস?’
‘এই ধরো চার-পাঁচ বছর। তবে তোমাকে অতদিন কাজ করতে হবে না, ক্লো। আমিও তার সঙ্গে কিছু কিছু করে যোগ করতে পারব।
‘না না, মিসিস; আমি চাই না আপনি গান শিখিয়ে টাকা রোজগার করুন। কর্তা ঠিকই বলেছেন, এতে পরিবারের অসম্মান হবে।’
‘ও নিয়ে তোমাকে কিছু ভাবতে হবে না, ক্লো।’ হাসতে হাসতেই মিসেস শেলবি বললেন। ‘পরিবারের সম্মানের দিকে আমি নিশ্চয়ই নজর রাখব। কিন্তু তুমি কবে নাগাদ যাবে বলে আশা করছ?’
‘আমি নিজে থেকে কিছু ভেবে রাখি নি। তবে স্যাম বলছিল কাল কয়েকটা ঘোড়া নিয়ে ও নদী অব্দি যাবে। মিসিস যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি কাল সকালেই স্যামের সঙ্গে যেতে পারি। জিনিসপত্তর তেমন কিছুই সঙ্গে নেবার নেই, শুধু মিসিস যদি আমাকে একটা ছাড়পত্র লিখে দেন …’
‘ঠিক আছে ক্লো, তুমি এখন যাও। আমি কর্তার সঙ্গে আগে একটু কথা বলে নিই, তারপর নিজে গিয়ে তোমাকে জানিয়ে আসব।
১৮. শীর্ণ ফুল
একটা একটা করে দিন কাটতে কাটতে আমাদের সবার সঙ্গে টমের জীবনেও প্রায় দুটো বছর কেটে গেছে। মাস্টার জর্জ শেলবি তাকে যে চিঠিটা দিয়েছে, সেটা পেয়ে তার আর আনন্দ ধরে না। চিঠিতে অনেক খবরই ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য—ক্লো-চাচি লুসিভিলের একটা খাবারের দোকানে কেক তৈরির কাজ করছে এবং উপার্জনের টাকা সযত্নে সঞ্চয় করে রাখছে যাতে সেই টাকা দিয়ে টমকে আবার কিনে নিতে পারে। সবচেয়ে ছোট বাচ্চাটা এখন সারা বাড়ি দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ায়। স্যালিই টমের ঘর- সংসার আর ছোটদের দেখাশোনা করে।
চিঠির পরের অংশে আছে স্কুলে জর্জের পড়াশোনা আর তার সহপাঠীদের কথা। সেই সঙ্গে রয়েছে টম চলে যাবার পর থেকে যে চারটে ঘোড়ার বাচ্চা কেনা হয়েছিল, তাদের নাম আর বিস্তারিত বিবরণ। সব শেষে রয়েছে স্বামীর সঙ্গে এলিজার কানাডায় পৌঁছনোর খবর এবং বাবা, মা আর বাড়ির অন্যান্যদের সংবাদ।
চিঠিখানার দিকে বারবার তাকিয়েও টমের মনের আশা মিটছিল না। এমন কী চিঠিখানাকে বাঁধিয়ে নিজের ঘরে টাঙিয়ে দেওয়া যায় কিনা সে সম্পর্কে ইভার সঙ্গে শলাপরামর্শও করেছে। কিন্তু ফ্রেমে বাঁধালে চিঠির দুটো ঠিক দেখা যাবে না বলে সেটা আর বাস্তবে ঘটে উঠে নি।
ইতোমধ্যে টম আর ইভার মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক খুবই গাঢ় হয়ে উঠেছে। ইভার আশ্চর্য কোমল হৃদয়ের একপ্রান্তে টম কেমন করে তার আসনটাকে একেবারে পাকা করে নিল, বলা সত্যিই খুবই কঠিন। তবে একথা ঠিক, টম ইভাকে ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত পুরাণের কোনো দেবীর মতো। ওর নিষ্পাপ টলটলে মুখটার দিকে টম ঐশ্বরিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত আর কল্পনায় জীবন্ত হয়ে উঠত শৈশবে যিশুর সুন্দর মুখখানাই। আর কেন জানি না, টমকে দেখে ইভাও সাতরঙা রামধনুর মতো একেবারে ঝলমলিয়ে উঠত। সকালে বাজারে গিয়ে সবসময়েই টমের দৃষ্টি থাকত ফুলের দোকানগুলোর ওপর, যদি ইভার জন্যে সুন্দর কোনো ফুলের তোড়া চোখে পড়ে যায়। আর পছন্দসই কমলা চোখে পড়লে তা অবশ্যই টমের পকেটে লুকোনো থাকবে, যাতে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে ইভাকে উপহার দিতে পারে। দূর থেকে ইভার উজ্জ্বল সোনালি চুলের ছোট্ট মাথাটা দেখতে পেলেই টম খুশিতে ভরে উঠত। তার চাইতেও ভালো লাগত যখন কাছে এসে ইভা মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করত, ‘দেখি টম চাচা, আজকে আমার জন্যে তুমি কী নিয়ে এসেছ?’
তার বিনিময়ে ইভাও টমকে কিছু কম ফিরিয়ে দিত না। আশ্চর্য মিষ্টি, সুরেলা গলায় ও টমকে বাইবেল পড়ে শোনাত। প্রথম প্রথম ও শুধু পড়ত টমকে খুশি করার জন্যে, কেননা টম আগে এমন সুন্দরভাবে কাউকে আর কখনো পড়তে শোনে নি। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে ইভা ও এই দুর্লভ গ্রন্থটিকে হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে ফেলল। এর প্রতিটা শব্দ ওর শিশু মনে এক গভীর আলোড়ন সৃষ্টি করত, মনে হতো ও যেন একটা কল্পনার রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ও আর ওর বন্ধু টম, যে প্রায় ওরই মতো সরল আর শিশু, দুজনেই অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করে—ঈশ্বরের চোখে সবাই সমান এবং আজ যদি বাস্তবে নাও হয়, চিরন্তন ভবিষ্যতে এমন একটা অলৌকিক কিছু ঘটবে, যখন সাদা-কালো, উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোথাও কোনো প্রভেদ থাকবে না।
আমরা যে সময়ের কথা বলছি, সেন্ট ক্লেয়ার পরিবারের সবাই গ্রীষ্মযাপনের জন্যে সমুদ্রের ধারে তাঁদের ‘লেক ভিলা’য় অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। পূর্ব ভারতীয়দের ঢঙে তৈরি করা সেন্ট ক্লেয়ারদের বাংলো বাড়িটা সত্যিই খুব সুন্দর। চারদিকে খোলা মাঠ, সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান। চিত্রার্পিত সব গাছ আর নানা ধরনের ফুলের ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে সরু একফালি পথ এঁকে বেঁকে একবারে সমুদ্র-বেলার কোল পর্যন্ত নেমে গেছে। সূর্যালোকে ঝিকমিক করে ওঠে সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালা। কোনো ছবিই বেশিক্ষণের জন্য একরকম থাকে না, ক্ষণে ক্ষণেই তা যেন সুন্দর থেকে আরো সুন্দর হয়ে উঠে।
সূর্য তখন পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে, তার আরক্তিম আভায় সমুদ্রের জলকে মনে হচ্ছে যেন আর একটা আকাশ। সেই গোলাপি আর সেনালি আভায় সাদা পালতোলা তরণীগুলো অশরীরির মতো এখানে ওখানে ভেসে বেড়াচ্ছে। ইতোমধ্যেই দু-একটা তারা উঁকি দিয়ে প্রকম্পিত জলে যেন নিজেদের ছায়া দেখছে।
বাগানের একপ্রান্তে লতাবিতানের নিচে শেওলায় ঢাকা পাথরের বেদিটাতে টম আর ইভা বসে রয়েছে। হাঁটুর ওপর বাইবেলখানা খুলে রেখে ইভা একমনে পড়ে চলেছে, … এবং আমি দেখিতে পাইলাম অনলমিশ্রিত এক স্ফটিকের সমুদ্র
‘ওই যে টম চাচা, ওখানে। হঠাৎ পড়া থামিয়ে আঙুল দিয়ে সমুদ্রের দিকে দেখিয়ে ইভা বলল।
‘কী, মিস ইভা?’
‘এই যে, ওখানে, দেখতে পাচ্ছ না?’ যেখানে সমুদ্রের জলে আরক্তিম আকাশের আভা পড়ে জ্বলজ্বল করছে, তার দিকে নির্দেশ করে ইভা বলল, ‘ওইটেই তো অনলমিশ্রিত স্ফটিকের সমুদ্র!’
‘হ্যাঁ, ঠিক তাই!’ এতক্ষণ বুঝতে না পারার জন্য টম যেন লজ্জা পেল। তারপর নিজেই গানের মতো সুর করে বলল, ‘আঃ, আমার যদি উষার মতো পাখা থাকিতো, তাহা হইলে আমি ক্যানানের তীরে উড়িয়া যাইতাম জ্যোতিময় দেবদূতগণ নব জেরুজালেমে আমার আপন বাসগৃহে লইয়া যাইতেন।’
ইভা জিজ্ঞেস করল, ‘নব জেরুজালেম কোথায়, টম চাচা?’
‘ওই মেঘের রাজ্যে ‘
‘জানো টম চাচা, মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে ওইসব আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। আমার মনে হয় আমি শিগগিরই ওখানে চলে যাব।’
টম কিছুটা অবাক হয়েই ইভার মুখের দিকে তাকাল, ‘কোথায়, মিস ইভা?’
যেখানে সমুদ্র আর আকাশ এক হয়ে মিশে গেছে, এবং গাঢ় একটা দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে মেঘের চারপাশ, সেই দিকে নির্দেশ করে ইভা বলল, ‘ওইখানে, টম চাচা। মেঘের রাজ্যে।‘
ইভার কথায় টমের বিশ্বস্ত হৃদয় বেদনায় ভরে উঠল। গত মাস ছয়েক ধরেই সে লক্ষ করে আসছে ইভার ছোট্ট হাত দুটো কেমন যেন বিশীর্ণ হয়ে গেছে, আরো স্বচ্ছ হয়ে গেছে গায়ের রং। এখন বাগানে একটু খেলাধুলা বা ছুটোছুটি করলেই ও একেবারে ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়ে। মিস ওফেলিয়াকে সে প্রায়ই কী যেন একটা কাশির কথা বলতে শুনেছে, যেটা ডাক্তার দেখিয়েও ঠিক সারানো যাচ্ছে না। এখনো মেয়েটার হাত আর গাল গরম হয়ে রয়েছে, মনে হয় যেন জ্বর হয়েছে ওর।
হঠাৎ ভেতর থেকে ওফেলিয়ার ডাকে টম আর ইভার কথাবার্তায় বাধা পড়ল।
‘ইভা, ইভা … শিগগির ভেতরে এসো। আর বাইরে থেক না, হিম পড়ছে।‘
ইভা আর টম তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল।
ধাত্রীবিদ্যায় পরাদর্শী মিস ওফেলিয়া ইভার ওই খুকখুকে চাপা কাশি, জ্বরতপ্ত শুকনো চিবুক আর চোখের দীপ্তি দেখে মাঝেমাঝে খুবই শঙ্কিত হয়ে উঠতেন। কিন্তু উনি যখনই ভাইকে এই আশঙ্কার কথা জানাতেন, আগাস্টিন হেসেই উড়িয়ে দিতেন।
‘ও কিছু নয়, ওফেলিয়া’, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আগাস্টিন জবাব দিতেন। ‘দেখছো না মেয়েটা বড় হচ্ছে। বাড়ন্ত সময় মেয়েদের শরীর অমন ভেঙেই থাকে।’
‘আর কাশিটা?’
‘হয়তো একটু ঠাণ্ডা লেগেছে, তাই। দু-একদিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘একটুতেই মেয়েটা কী রকম ক্লান্ত হয়ে পড়ে সেটা লক্ষ করেছ?’
‘সারাদিন অত ছুটোছুটি করলে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়বে।’
মুখে যাই বলুন না কেন, আগাস্টিন কিন্তু মনে মনে মেয়েটার জন্যে উদ্বিগ্ন বোধ না করে পারতেন না। তাই তিনি আগের চাইতে আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়েই ইভাকে লক্ষ করতেন এবং প্রায়ই নিজের মনে বলতেন, ‘কই, আমি তো তেমন কিছু খারাপ দেখতে পাচ্ছি না!’ পক্ষান্তরে বরং মাঝে মাঝে ইভার কথা শুনে তিনি অবাক হয়ে যেতেন। শিশুর যা কিছু সরল মাধুর্য সত্ত্বেও ইভা কখনো কখনো পরিণত মানুষের মতো এমন সব গভীর আর অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলত, যা তাঁকে বিস্ময়ে একেবারে স্তম্ভিত করে অধীর করে দিত, তাঁকে বিপুল আনন্দে ভরিয়ে তুলত। তেমনি কোনো মুহূর্তে আগাস্টিন আগ্রহে মেয়েকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরতেন, যেন এইভাবে আঁকড়ে ধরে থাকলেই কেবল মেয়েকে বাঁচানো যাবে। সবসময় ইভাকে তিনি খুশি রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন, এবং সে-জন্যই মেয়েকে নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে প্রায়ই বাইরে বেড়াতে যেতেন।
অপরের প্রতি ভালোবাসা আর করুণায় ইভার সমস্ত অন্তর যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। বালিকা হলেও ওর পরিণত মনে গভীর চিন্তা পরিবারের সবাইকেই গভীরভাবে আকর্ষণ করত, অথচ ওর শিশুসুলভ চপলতার কোথাও কোনো অভাব ছিল না। এখনো ও টপসি আর অন্যান্য নিগ্রো শিশুদের সঙ্গে খেলতে বা ছুটোছুটি করতে ভালোবাসে। তবে আজকাল ও যেন খেলার চাইতে দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকতেই বেশি আনন্দ পায়। প্রথম খানিকক্ষণ বসে বসে ওদের খেলা দেখবে, উৎসাহ দেবে, টপসির যতরকম পুরনো চালাকিতে হাসবে—তারপরেই একটু একটু করে ওর মুখের ওপর নেমে আসবে ক্লান্তির একটা গাঢ় ছায়া, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাবে, মনটা হারিয়ে যাবে অনেক দূরে।
‘আচ্ছা, মামণি,’ ইভা একদিন হঠাৎ ওর মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমাদের দাসদাসীদের লেখাপড়া শেখাও না কেন?’
‘এটা আবার কী ধরনের প্রশ্ন! কেউই তা করে না।’
‘কেন করে না মামণি?
‘যেহেতু ওদের লেখাপড়া শেখার কোনো দরকারই হয় না।’
‘কিন্তু ওদের প্রত্যেকের লেখাপড়া শেখা দরকার, মামণি … অন্তত যাতে বাইবেলটা পড়তে পারে।’
‘পড়তে পারলেই বা ওদের কী লাভ? মিস ওফেলিয়া তো টপসিকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ইচ্ছে করলে ও নিজে নিজেই বাইবেল পড়তে পারে। কিন্তু তাতে কী লাভ হয়েছে শুনি? আমার তো মনে হয় যত ছেলেপুলে দেখেছি, টপসি তাদের মধ্যে সব চাইতে …’
‘না না, মামণি, টপসি এখন খুব ভালো হয়ে গেছে! আমি যখন সবাইকে বাইবেল পড়ে শোনাই, ও-ও খুব মন দিয়ে শোনে।’
‘ওঃ, ভালো কথা, ইভা! কয়েক দিন ধরেই বলব বলব করে আর কিছুতেই হয়ে উঠছিল না….’ টানার মধ্যে গয়নাগুলো গুছাতে গুছাতেই মেরি বলল, ‘চাকর-বাকরদের বাইবেল পড়ে শোনানো ছাড়াও তোমার অনেক কাজ আছে … তাছাড়া ও কাজটা যে খুব ভালো তা কিছু নয়। তোমার বয়সের মেয়েরা ও কাজ কখনো করে না। একটা কথা তোমার মনে রাখা দরকার, তুমি এখন বড় হচ্ছো। ভালো ভালো পোশাক গয়না পরে তোমাকে সমাজের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে হবে। এই দেখো, তুমি যখন বড় হবে, এই গয়নাগুলো আমি তোমাকে উপহার দেব। এই গয়নাগুলো পরেই আমি আমার জীবনের প্রথম বল নাচের আসরে গিয়েছিলাম। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আমার রূপে সেদিন সবাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল।’
গয়নার বাক্সটা নিয়ে তার মধ্যে থেকে একছড়া হীরের হার বার করে ইভা স্থিরদৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা গেল ওর মন রয়েছে তখন অন্যদিকে।
মেরি জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার ইভা, তোমাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন?’
‘এইগুলোর দাম কি অনেক, মামণি?’
‘নিশ্চয়ই।’
‘এগুলো যখন আমার, আশা করি এ দিয়ে আমি যা খুশি তাই করতে পারব।’
‘তুমি কী করতে চাও, ইভা?’
‘এগুলো বিক্রি করে আমি ফ্রি স্টেটে একটু জায়গা কিনব। তারপর আমাদের যত দাস-দাসী আছে সেখানে তাদের নিয়ে গিয়ে কয়েকজন শিক্ষককে দিয়ে লেখাপড়া শেখাব।
মেয়ের কথা শুনে মেরি হেসে ফেলল।
‘শিক্ষকরা ওদের লেখাপড়া শেখাবে, তুমি নিজে হাতে ওদের শেখাবে পিয়ানো বাজাতে আর মখমলের পর্দায় ছবি আঁকতে!’
‘আমি সবচেয়ে আগে যেটা ওদের শেখাতে চাই—ওরা যেন নিজে নিজেই বাইবেল পড়তে পারে।’ ইভা এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন এ সবই ওর পূর্বপরিকল্পিত এবং ওর কণ্ঠস্বরে কোথাও কোনো জড়াতা বা দ্বিধা নেই। ‘এটা ওদের বাঁচার জন্যেই বিশেষ প্রয়োজন। তারপর যেটা শেখাতে চাই, সেটা হলো লিখতে—যাতে নিজেদের চিঠি ওরা নিজেরাই লিখতে পারে। এগুলো না পারার জন্য ওরা সত্যিই খুব কষ্ট পায়, মামণি।’
‘চুপ করো, ইভা!’ এবার মেরি আর ধৈর্য রাখতে পারল না। ‘তুমি এখন অনেক ছোট। এসব জিনিস বোঝার বয়স তেমার হয় নি। তাছাড়া তোমার এসব কথা শুনলে আমার মাথা ধরে যায়।
কারো কথা মনমতো না হলে বরাবরই মেরির মাথা ধরে যেত।
ইভা নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল বটে, কিন্তু সেই দিন থেকেই ও মনে মনে স্থির করল মামিকে দিয়েই প্রথম শুরু করবে।
১৯. হেনরিক
এই সময় আগাস্টিন সেন্ট ক্লেয়ারের ভাই অ্যালফ্রেড সেন্ট ক্লেয়ার তাঁর বড় ছেলে হেনরিককে নিয়ে দিন-কয়েকের জন্যে বেড়াতে এলেন।
পরিণত বয়সের এই যমজ দুই ভাইকে একসঙ্গে দেখার চাইতে সুন্দর দৃশ্য আর কিছুই হতে পারে না। আকৃতিগত একটা দিক ছাড়া, দুজনেই সবদিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবু দুজনের অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের মধ্যে কোথায় যেন একটা রহস্যময় বন্ধন রয়ে গেছে।
দুজনে হাত ধরে গল্প করতে করতে বাগানের মধ্যে মন্থর পায়ে ঘুরে বেড়াতেন। আগাস্টিনের চোখ নীল, সোনালি চুল, আশ্চর্য উজ্জ্বল মসৃণ গায়ের রঙ, অনিন্দ্য-সুন্দর দেহ। আর অ্যালফ্রেডের চোখ কালো, গায়ের রঙ কিছুটা চাপা, পেটা লোহার মতো একেবারে টানটান পেশি। একজনকে দেখতে গ্রিক, অন্যজনকে ঠিক রোমানদের মতো। একজন অন্যজনকে প্রায় সারাক্ষণই তাঁর মতামত আর অভ্যাসের জন্যে অভিযুক্ত করছেন, বিতর্কের ঝড় তুলছেন, কিন্তু কেউ কারুর হাত ছেড়ে দিচ্ছেন না। যেন চুম্বকের দুপ্রান্তের এক আকর্ষণীয় শক্তি অলক্ষে দুজনের মধ্যেই সমানভাবে কাজ করে চলেছে।
অ্যালফ্রেডের বড় ছেলে হেনরিকের বয়েস ভালো, দেখতে আর স্বভাবে ঠিক বাপেরই মতো—দুরন্ত একটা ঘোড়ারই মতো অসম্ভব ছটফটে আর আশ্চর্য সজীব। আলাপের মুহূর্তেই চাচাতো বোন ইভানজেলিনকে তার খুব ভালো লেগে গেল।
সেদিন দুজনে একসঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যাবার কথা। ইভার খুব প্রিয় ছোট একটা টাট্টু ছিল। টাট্টুটা একেবারে বরফের মতো ধবধবে সাদা আর স্বভাবটা ঠিক ওর ছোট্ট মনিবেরই মতো শান্ত, নম্র। ইভার জন্যে টম টাট্টুটাকে পেছনের বারান্দায় নিয়ে এল আর হেনরিকের ঘোড়াটাকে নিয়ে এল বছর তেরো বয়সের ডোডো নামে একজন মুলাটো চাকর। হেনরিকের আরবি ঘোড়াটা কুচকুচে কালো আর অসম্ভব তেজি। অল্প কিছুদিন আগে অজস্র অর্থ ব্যয় করে ঘোড়াটাকে বিদেশ থেকে আনানো হয়েছিল।
হেনরিক এগিয়ে এসে ডোডোর হাত থেকে ঘোড়ার লাগামটা নেয়ার সময় হঠাৎ নজর পড়ায় তার ভ্রূদুটো কুঁচকে উঠল, তারপর ডোডোর দিকে তাকিয়ে রীতিমতো রুক্ষ মেজাজে ধমকে উঠল।
‘এই কুঁকে কুকুর, এটা কী! আজ সকালে আমার ঘোড়াটাকে পরিষ্কার করিস নি কেন?’
ডোডো নম্র ভাবেই বলল, ‘করেছিলাম, হুজুর। মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে ও আবার নিজেই ধুলো মেখেছে।
‘এই জানোয়ার, চুপ কর!’ চাবুক উঁচিয়ে হেনরিক গর্জে উঠল।
‘তোর এতটা সাহস যে আমার মুখের ওপর জবাব দিচ্ছিস?’
ডোডো দেখতে বেশ ভালোই, বড় বড় উজ্জ্বল দুটো চোখ, একমাথা উড়ানো কালো চুল। লম্বায় সে হেনরিকেরই সমান। চোখের দীপ্তি আর চিবুকে দ্রুত ঝলকে ওটা রঙের আভাস দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তার শরীরেও শ্বেতাঙ্গের রক্ত বইছে।
আপ্রাণ চেষ্টা করে ডোডো শুধু এটুকুই বলতে পারল, ‘স্যার …’
ডোডোর কথা শেষ হবার আগেই হেনরিক চাবুক দিয়ে তার মুখে শপাং শপাং করে আঘাত করল, তারপর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে তাকে নতজানু হয়ে বসতে বাধ্য করাল এবং হাঁফিয়ে না ওঠা পর্যন্ত তাকে সমানে চাবকে গেল।
‘নির্লজ্জ বেহায়া কুকুর! আশা করি এবার তুই শিখবি মনিবের মুখে মুখে কীভাবে জবাব না দিতে হয়। যা, ঘোড়াটা নিয়ে গিয়ে শিগগির পরিষ্কার করে নিয়ে আয়।’
নতমুখে ডোডো ঘোড়াটা নিয়ে চলে গেল।
টম বলল, ‘হুজুর, আমার মনে হয় ও বলতে চেয়েছিল ঘোড়াটাকে যখন আস্তাবল থেকে নিয়ে আসছিল, তখনই ঘোড়াটা মাটিতে গড়াগড়ি দিয়েছে। গোড়াটা খুব তেজি, হুজুর। মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়ার ফলেই ঘোড়াটার গায়ে ধুলো লেগেছে। ডোডোকে আমি নিজের চোখে পরিষ্কার করতে দেখেছি, স্যার।’
‘তুমি চুপ করো! তোমাকে যখন কিছু জিজ্ঞেস করব, তখনই শুধু কথা বলবে।’ কথাটা বলে হেনরিক পায়ে পায়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল, যেখানে ইভা রানির মতো ঘোড়ায় চড়ার পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হেনরিক ইভার কাছে গিয়ে বলল, ‘সত্যিই আমি খুব দুঃখিত, ইভানজেলিন। ওই নির্বোধটার জন্যেই মিছেমিছি তোমার এতটা দেরি হয়ে গেল। ঘোড়া নিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত এসো বরং আমরা দুজনে ওই পাথরের ওপর বসি। কী ব্যাপার ইভানজেলিন, তোমাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন?’
নতচোখে ইভা বলল, ‘তুমি কেমন করে ডোডোর ওপর এতটা নিষ্ঠুর হতে পারলে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, হেনরিক?’
‘নিষ্ঠুর! এ তুমি কী বলছ, ইভানজেলিন?’ বিস্ময়ে হেনরিক যেন গাছ থেকে পড়ল। ‘ডোডোকে তুমি চেনো না। এমন কুঁড়ে আর মিথ্যেবাদী যে ওভাবে সায়েস্তা না করলে ও মুখে মুখে সমানে তর্ক করে যাবে। আমার বাবাও ঠিক অমনিভাবে ওদেরকে সায়েস্তা করেন।‘
‘কিন্তু টম চাচা যে বলল ওর কোনো দোষ ছিল না। আমি জানি টম চাচা কখনো মিথ্যে বলে না।’
‘তাহলে বলব ওই বড়ো নিগ্রোটা অসাধারণ। ডোডো কিন্তু চলতে ফিরতে মিথ্যে বলে।
‘ও কিন্তু কোনো অন্যায় করে নি।’
‘সত্যিই ইভানজেলিন, ডোডোকে এত পছন্দ করো দেখে আমার নিজেরই হিংসে হচ্ছে।’
‘না, হেনরিক ডোডোকে তুমি শুধু শুধু মারলে কেন?’
‘ওটুকুতে ওর কিচ্ছু হয় না। দেখবে একটু পরেই ও সব ভুলে যাবে। ঠিক আছে, তুমি যখন চাও না, তোমার সামনে ওকে আর কখনো মারব না।’
এই সান্ত্বনাতে ইভা আদৌ খুশি হতে পারল না, অথচ এটাও ওর অজানা নয় যে অল্প কয়েকদিনের জন্যে বেড়াতে আসা হেনরিককে ওর মনোভাব বোঝাতে যাওয়া অর্থহীন।
একটু পরেই ডোডো আবার ঘোড়া নিয়ে ফিরে এলো।
‘হ্যাঁ, এবার বেশ ভালো হয়েছে!’ খুশি হবার ভঙ্গিতেই হেনরিক বলে উঠল। ‘ঠিক আছে, তুমি বরং ইভানজেলিনের ঘোড়াটা ধর, আমি ওকে জিনের ওপর বসিয়ে দিচ্ছি।’
ডোডো এগিয়ে এসে ইভার টাট্টুর লাগামটা ধরল। তার বিবর্ণ মুখ, লালচে চোখ দেখে স্পষ্টই বোঝা গেল এতক্ষণ সে কাঁদছিল। ইভা একটু ঝুঁকে তার হাত থেকে লাগামটা নেবার সময় মিষ্টি করে বলল, ‘তুমি খুব ভালো ছেলে, ডোডো। অসংখ্য ধনবাদ!’
অবাক চোখে ডোডোর সুন্দর মুখখানার দিকে তাকাতেই তার চিবুকের পাশ দুটো রক্তিম হয়ে উঠল, অবরুদ্ধ আবেগে ছলছল করে উঠল দুচোখ।
নিজের ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে হেনরিক একটা মুদ্রা ডোডোর দিকে ছুড়ে দিয়ে বললে, ‘যা, এটা দিয়ে কিছু মিষ্টি কিনে খাস।
মুদ্রাটা কুড়িয়ে নেওয়ার পরিবর্তে ডোডো তখনো নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে রয়েছে সুন্দর মূর্তি দুটোর দিকে, যাদের একজন তাকে দিয়েছে মিষ্টি কিনে খাওয়ার জন্যে পয়সা আর অন্যজন দিয়েছে এমন অসামান্য কিছু, যা এই জীবনে কেউ কখনো তাকে দিতে পারে নি।
দূরের সমুদ্রে তখন দ্রুত রঙ বদলাতে শুরু করেছে। খোলা বারান্দায় হালকা বেতের চেয়ারে মুখোমুখি রয়েছে দাবার ছক। কিন্তু সে শুধু ওই পর্যন্তই, খেলার দিকে কারুর মন. নেই। সারাক্ষণই দুজনে তর্ক করছেন একে অপরকে বিদ্রূপ করছেন, পরক্ষণেই আবার হো হো করে হেসে উঠছেন।
‘সত্যি আগাস্টিন, আমি যদি তোমার ভাবনার সঙ্গে একমত হতে পারতাম, জীবনে হয়তো অনেক বড় কাজ করতে পারতাম।’
‘নিশ্চয়ই!’ ভাইকে সমর্থন করে সেন্ট ক্লেয়ার বলে উঠলেন। ‘নিশ্চয়ই তুমি তো পারতে, অ্যালফ্রেড। আর যাই হোক, তুমি তো আর আমার মতো কুঁড়ে নও… তুমি পরিশ্রমী, তুমি কাজ করতে পারো।’
‘আমি ভাবছি ভবিষ্যতের জন্যে প্রথমেই যে কাজটা করা দরকার—তোমার নিগ্রো চাকর-বাকরগুলোর প্রত্যেকেরই এক-একটা প্রতিমূর্তি বানিয়ে রাখা, যাতে গবেষণার জন্যে ঐতিহাসিকরা তাদের নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করতে পারেন।
বিদ্রূপ-বেঁধানো স্বরে হাসতে হাসতেই আগাস্টিন বললেন, ‘অবশ্য সেই ঐতিহাসিকদের মানবিক বোধ বলে কোনো পদার্থ যদি থাকে …’
এমন সময় অদূরে শোনো গেল দ্রুত ছুটে আসা ঘোড়ার খুরের শব্দ।
‘ওরা ফিরে আসছে। দেখো অ্যালফ্রেড, ওদের দুজনকে কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে!’
‘সত্যি, এর চাইতে সুন্দর দৃশ্য কখনো দেখেছি বলে অন্তত আমার মনে পড়ছে না!’ অ্যালফ্রেড অকপটেই স্বীকার করলেন। ‘ইভার মতো এমন চোখ-ধাঁধানো রূপও আমি আর কখনো দেখি নি। এখন থেকেই আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আগাস্টিন, বড় হলেও অনেক পুরুষেরই রাতের ঘুম কেড়ে নেবে।’
ভাইয়ের কথা শুনে সেন্ট ক্লেয়ার হো হো করে হেসে উঠলেন, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ছিল একটা বিষণ্নতার ছাপ। মেয়েকে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামিয়ে আনার জন্যে উনি দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন।
দুহাতে মেয়েকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না তো, মামণি?’
‘না, বাপী।’
মুখে না বললেও ওকে টেনে টেনে শ্বাস নিতে দেখে আগাস্টিন শঙ্কিত হয়ে উঠলেন।
‘তোমার এত জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে আসাটা ঠিক হয় নি। তুমি জানো এটা তোমার শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।’
‘জানি। কিন্তু এত ভালো লাগছিল যে সে কথা আমার মনেই ছিল না।’
দুহাতের দোলায় মেয়েকে বয়ে এনে আগাস্টিন বৈঠকখানার সোফায় শুইয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘হেনরিক, ইভার শরীর খুব একটা ভালো নয়। ওর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে কখনো জোরে ঘোড়া ছুটিও না।’
‘আচ্ছা। এবার থেকে আমি খুব সতর্ক থাকার চেষ্টা করব।’ সোফায় ইভার পাশে বসে হেনরিক ওর একটা হাত নিজের মুঠোর মধ্যে তুলে নিল।
একটু পরে ইভা অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগল। কিশোর-কিশোরী দুজনকে একা রেখে সেন্ট ক্লেয়ার দুভাই অসমাপ্ত খেলাটাকে আবার নতুন করে শুরু করার জন্যে ফিরে গেলেন।
‘আমার সবচেয়ে কী খারাপ লাগছে জানো, ইভানজেলিন’, হেনরিক বলল, ‘বাবা পরশুই এখান থেকে চলে যাচ্ছেন। তোমার সঙ্গে হয়তো আমার আর অনেকদিন দেখা হবে না, তবে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, ডোডোর সঙ্গে কখনো খারাপ ব্যবহার করব না। আমি সাধারণত কারুর সঙ্গে খুব একটা খারাপ ব্যবহার করি না। কিন্তু আমার সবচেয়ে বড় ত্রুটি, রেগে গেলে একদম জ্ঞান থাকে না।’
‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, হেনরিক?’
‘বলো।’
‘রাগ করবে না?’
‘একটুও না।’
‘আচ্ছা, ধরো, এ পৃথিবীতে তোমাকে যদি ভালোবাসার কেউ না থাকে, তোমার ভালো লাগবে?’
হেনরিক অবাক হয়ে ইভার দিকে তাকাল। ‘কেন? নিশ্চয়ই না!’
‘তাহলে অন্তত সেদিক থেকে ডোডোর কথাটা একবার ভেবে দেখো। বাবা-মা, ভাই- বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সবাইকে ও চিরদিনের মতো হারিয়ে এসেছে। এখানে ওর এমন কেউ নেই যে ওকে ভালোবাসবে, কিংবা একটু ভালো ব্যবহার করবে।
‘এর জন্যে আমি সত্যিই খুব দুঃখিত, ইভানজেলিন। ওর মাকে কেনা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া ওকে আমি নিজে ভালোবাসতেও পারি না …‘
‘কেন পারো না, হেনরিক?’
‘ডোডোকে! এ তুমি কী বলছ, ইভানজেলিন? হয়তো ওকে আমি পছন্দ করতে পারি, কিন্তু তা বলে ভালোবাসা কেমন করে সম্ভব? তুমি কি তোমার চাকর-বাকরদের ভালোবাসতে পারো?’
‘নিশ্চয়ই। কেন নয়, হেনরিক?’
‘এটা কিন্তু সত্যিই ভাবা যায় না।’
‘কেন ভাবা যায় না, হেনরিক? বাইবেলে কি বলা হয় নি, প্রতিটা মানুষকে আমাদের ভালোবাসা উচিত?’
‘বাইবেলে ওরকম অনেক ভালো ভালো কথাই বলা আছে, কিন্তু কেউ সেসব কথা ভাবে না, বা করেও না।’
সেই মুহূর্তে ইভা কোনো কথা বলল না, নির্নিমেষ চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অন্তত আমার মুখ চেয়ে তুমি ডোডোকে একটু ভালোবেসো, হেনরিক। কখনো ওর ওপর নিষ্ঠুর হয়ো না!’
‘তোমার জন্যে আমি সবকিছু করতে পারি, ইভানজেলিন। তোমার চেয়ে সুন্দর আর রূপসী মেয়ে আমি আর কখনো দেখি নি। কথাটা বলতে গিয়ে কিশোর হেনরিকের সুন্দর মুখখানা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল।
হেনরিকের এই সরল আন্তরিকতা ইভাকেও স্পর্শ না করে পারল না, তাই খুশির সুরেই বলল, ‘তাহলে আশা করি, আমার কথাটা তোমার নিশ্চয়ই মনে থাকবে হেনরিক!
এমন সময় খাবার ঘণ্টা পড়ায় ওদেরকে উঠে পড়তে হলো।