১৫. মিসির আলি একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছেন

১৫

মিসির আলি একটা থিওরি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি গত কয়েক দিন ধরেই চেষ্টা করছেন তাঁর সেই থিওরি গুছিয়ে ফেলতে। পারছেন না। লিখতে গিয়ে সব আরো কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে যা ভাবছেন, তা লিখতে পারছেন না। সারা দুপুর বসে বসে তিনি তাঁর থিওরির পয়েন্টগুলো লিখলেন। সেগুলো কেটে ফেলে আবার লিখলেন। সন্ধ্যাবেলা সব কাগজপত্র ফেলে দিয়ে নতুন খাতা কিনে আনলেন। কলম কিনলেন। তিনি লক্ষ করেছেন, খাতা-কলম বদলে ফেললে মাঝে-মাঝে তরতর করে লেখা এগোয়। তাই হল। রাতের বেলা বেশ কয়েকটা পৃষ্ঠা লিখে ফেললেন। রচনার নাম দিলেন–

একজীবন : বহুজীবন

একটি মানুষের কয়েকটি জীবন থাকে? তাই তো মনে হয়। এক জন শিশু জন্মায়, বড় হয়, মৃত্যু হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনকাল একটি ধারায় প্রবাহিত হয়। সেই ধারায় সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার নানান ঘটনা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জীবনের ধারা একটি না হয়ে কি অনেকগুলো হতে পারে না? ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করি। মনে করি, মুনির নামের একটি ছেলে বড় হচ্ছে। শৈশবে তার পিতৃবিয়োগ হল। সেই মুহূর্ত থেকে যদি তার জীবন দুটি ভাগে ভাগ হয়, তাহলে কেমন হয়? একটি ভাগে ছেলেটির পিতৃবিয়োগ হল, অন্য ভাগে হল না–বাবা বেঁচেই রইলেন। দুটি জীবনই সমানে প্রবাহিত হতে লাগল। তবু এক জীবনের সঙ্গে অন্য জীবনের কোনো যোগ রইল না। কারণ এই দুটি জগতের মাত্রা ভিন্ন।

দুই ভিন্ন মাত্রায় দুটি জীবন প্রবাহিত হচ্ছে। এক জীবনে ছেলেটি সুখী অন্য জীবনে নয়।

এখন এই দুটি জীবনের ব্যাপারটাকে আরো বিস্তৃত করা যাক। ধরা যাক, জীবন দুটি নয়। অসংখ্য, সীমাহীন।’প্রকৃতি’ একটি মানুষের জীবনে যতগুলো ভেরিয়েশন হওয়া সম্ভব, সবগুলোই পরীক্ষা করে দেখছে। সবই সে চালু করেছে।

অসীম ব্যাপারটা এমনই যে, এ-পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্যেই অসীম সংখ্যক জীবনধারা চালু করতে পারে। কারণ অসীম সংখ্যাটির এমনই মাহাত্ম্য যে, সে অসীমসংখ্যক অসীমকেও ধারণ করতে পারে। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ডেভিড হিলবার্ট অসীমের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর ‘হিলবার্ট’ হোটেলের সমস্যায়। এই হোটেলটির সবচে’ বড়ো গুণ হচ্ছে, হোটেলের প্রতিটি কক্ষ অতিথি দিয়ে পূর্ণ হবার পরও যত খুশি অতিথিকে ঢোকান যায়। এর জন্যে পুরনো অতিথিদের কোনো অসুবিধে হয় না। কারো কক্ষে দু’ জন অতিথি ঢোকানোর প্রয়োজন হয় না। এটা সম্ভব হয় অসীম সংখ্যাটির অদ্ভূত গুণাবলীর জন্যে। মানুষ তার প্রচুর জ্ঞান সত্ত্বেও অসীমকে ব্যাখ্যা করতে পারছে না। সবচে’ সহজ ব্যাখ্যাটি হচ্ছে–অসীম হচ্ছে বিরাট বই, যার শুরুর পাতা এবং শেষের পাতা বলে কিছু নেই।

এখন কথা হচ্ছে, প্রকৃতি কেন একটি মানুষের জন্যে অসংখ্য জীবনের ব্যবস্থা করবে? প্রকৃতির স্বার্থ কী?

প্রকৃতির একটি স্বার্থের কথা আমরা কল্পনা করতে পারি, সেটি হচ্ছে–কৌতূহলের সঙ্গে সে একটি পরীক্ষা চালাচ্ছে। তার চোখের সামনে মানবজীবনের, সেই সঙ্গে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরও, অসংখ্য ভেরিয়েশন। প্রতিটিই চলছে স্বাধীনভাবে, একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো যোগ নেই, কারণ প্রতিটিই প্রবাহিত হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়।

‘প্রকৃতি’ না বলে ‘ঈশ্বর’ শব্দটি ব্যবহার করলে ব্যাপারটা আরো সহজ হয়। ঈশ্বর নামের কোনো মহাশক্তিধর, যিনি অসীমকে ধারণ করতে পারেন, কারণ তিনি নিজেই অসীম–সেই তিনিই অসীম নিয়ে খেলছেন।

কাজেই আমরা দেখছি মুনির নামের ছেলেটির অসংখ্য জীবন। এক জীবনে সে বিনুকে বিয়ে করে, অন্য জীবনে বিনুকে বিয়ে করতে পারে না। এক জীবনে তার এবং বিনুর একটি ছেলে হয়, ছেলেটি চার বছর বয়সে মারা যায়। অন্য জীবনে ছেলেটি বেঁচে থাকে। কত বিচিত্র রকমের পরিবর্তন! এবং প্রতিটি পরিবর্তনকেই প্রকৃতি গভীর আগ্রহে এবং গভীর মমতায় দেখছে।

প্রকৃতির নিয়ম কঠিন এবং ব্যতিক্রমহীন, তবু মাঝে-মাঝে হয়তো কিছু-একটা হয়। সামান্য এদিক-ওদিক হয়। জীবনের এক ধারায় মানুষ প্রকৃতিরই কোনো-এক বিচিত্র কারণে অন্য ধারায় এসে হকচকিয়ে যায়।

এ-রকম ঘটনা অতীতে ঘটেছে। এই মুহূর্তে আমি একটি উদাহরণ দিতে পারি। খুঁজলে নিশ্চয়ই আরো প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে।

উদাহরণটি আমেরিকার আরিজোনা শহরের। আঠার শ’ চব্বিশ সালের ঘটনা। ঘটনাটি স্থানীয় মেথডিস্ট চার্চের নথিতে অন্তর্ভুক্ত। বেশ কিছু অনুসন্ধানী দল ঘটনাটি বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা অতীতে করেছে। এই ঘটনা বিশ্বে সংঘটিত অদ্ভুত ঘটনাগুলোর একটি বলে এখনো মনে করা হয়।

ডেভিড ল্যাংম্যান আরিজোনা শহরের এক জন সাধারণ ছুতোর মিস্ত্রী। ছুতোরের কাজ করে জীবনধারণ করেন। সরল সাধাসিধে মানুষ। তবে অতিরিক্ত মদ্যপানের বদ অভ্যাস ছিল। মাঝে-মাঝে পুরো মাতাল হয়ে ঘরে ফিরতেন। স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদের ওপর অত্যাচার করতেন। নেশা কেটে গেলেই আবার ভালোমানুষ।

ভদ্রলোক চল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। যথারীতি তাঁকে কফিনে ঢুকিয়ে গোর দেওয়া হয়। এর প্রায় চার বছর পরের ঘটনা। এক রাতে প্রবল তুষারপাত হচ্ছে। রাস্তায় হাঁটুউঁচু বরফ। দেখা গেল, এই বরফ ভেঙে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত ডেভিড ল্যাংম্যান আসছেন। প্রথমে সবাই ভাবল চোখের ভুল। পরে দেখা গেল–না, চোখের ভুল নয়, আসলেই ডেভিড ল্যাংম্যান। সেই মানুষ, সেই আচার-আচরণ। বাঁ হাতের একটি আঙুল নেই। কপালে গভীর ক্ষতচিহ্ন, তাঁর চোখের দৃষ্টিতে দিশেহারা ভাব। লোকজন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে?’

তিনি বললেন, ‘আমি ডেভিড ল্যাংম্যান।’

‘তুমি কোথেকে এসেছ?’

‘আসব আবার কোথা থেকে। আমি তো এখানেই ছিলাম। আমি আমার বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘তোমার ছেলেমেয়েদের নাম কি?’

তিনি তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের নাম বললেন। কাউন্টির শেরিফ তাঁকে গ্রেফতার করে হাজতখানায় রেখে দিল। খবর পেয়ে ডেভিড ল্যাংম্যানের স্ত্রী এল দেখতে। বিস্ময়ে তার বাকরোধ হল। ডেভিড ল্যাংম্যন বললেন, ‘আমার কী হয়েছে বল তো, সব কেমন অচেনা লাগছে। এরা আমাকে হাজতে আটকে রেখেছে।’

‘তুমি মারা যাও নি?’

‘আমি মারা যাব কেন! এ-সব কী বলছ?’

‘তুমি তো মারা গেছ। চার্চ ইয়ার্ডে তোমাকে গোর দেয়া হয়েছে।’

ডেভিড ল্যাংম্যানের স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ডেভিড ল্যাংম্যানকে তাঁর স্ত্রী-পুত্ররা কেউ গ্রহণ করল না। শহরের সবাই তাঁকে বর্জন করল। তিনি একা একা থাকতেন। রাতে চার্চে ঘুমাতেন। শেষের দিকে তাঁর মাথারও গণ্ডগোল হল। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে বলতেন, ‘আমার কী হয়েছে? আমার কী হয়েছে?’ তাঁর এই কষ্টের জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। দু’ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর ডেভিড ল্যাংম্যান নামেই তাঁর কবর হয়

ঘটনাটি অবিশ্বাস্য। কোনো রকম ব্যাখ্যা এর জন্যে দেয়া যায় না। এ-জাতীয় অবিশ্বাস্য ঘটনার নজির প্রাচীন উপকথায় প্রচুর আছে। উত্তর ভারতের উপকথায় মহারাজ উরনির কথা আছে, যাঁকে বলা হয়েছে ‘দানসাগর’। মহারাজ উরনি শিকার করতে গিয়ে, গণ্ডারের শিংয়ের আঘাতে নিহত হন। রাজকীয় মর্যাদায় তাঁর দাহ সম্পন্ন করার পরপরই তিনি আবার বন থেকে ফিরে আসেন এবং রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। তবে তাঁর চরিত্রের বিরাট পরিবর্তন হয়। তিনি ধর্মকর্ম দানধ্যানে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। রাজভাণ্ডার দেখতে-দেখতে শূন্য হয়ে যায়।

এইজাতীয় রহস্যকে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রবণতা আমাদের মধ্যে আছে। আমরা ভান করি যে, এ-সব কখনো ঘটে নি। তা না-করে এই ধরনের ঘটনাগুলো নিয়ে ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। যাতে প্রকৃতির বিপুল রহস্যের কিছু জট আমরা খোলার চেষ্টা করতে পারি।

.

মিসির আলি তাঁর এই লেখাটি পড়তে দিলেন তাঁর বন্ধু দেওয়ান সাহেবকে। দেওয়ান সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। পুরোপরি অ্যাকাডেমিক মানুষ। পদার্থবিদ্যার সূত্রের মধ্যে যা পড়ে না, তা তিনি চোখ বন্ধ করে ঝুড়িতে ফেলে দেন।

দেওয়ান সাহেব মিসির আলির লেখা পড়ে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘তুমি বদ্ধ উন্মাদ।’

‘তোমার তাই ধারণা?’

‘ধারণা অন্য রকম ছিল। লেখা পড়ে ধারণা পাল্টেছে। তুমি এক কাজ কর। ভালো এক জন ডাক্তারকে বল তোমার চিকিৎসা করতে।’

‘আমার এই লেখাটাকে তোমার পাগলের প্রলাপ বলে মনে হচ্ছে?’

‘হুঁ। পদার্থবিদ্যার একটি সূত্র হচ্ছে, একই সময়ে একই স্থানে দুটি বস্তু থাকবে না। কারণ বস্তু স্থান দখল করে। আর তুমি অসীম বস্তু নিয়ে এসেছ, সবাইকে ঠেসে ধরছ এক জায়গায়।’

‘মাত্রা কিন্তু ভিন্ন। এক-এক জীবন এক-এক ডাইমেনশনে প্রবাহিত।’

‘মূর্খরা যখন পদার্থবিদ্যা কিছু না-জেনে কথা বলে, তখন এ-রকম কথা বলে। ডাইমেনশনের তুমি জান কী?’

‘খুবই কম জানি। এইটুকু জানি যে, বস্তুর তিনটি মাত্রা : দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা। সময়কে একটি মাত্রা ধরা হলে, হয় চারটি। এ ছাড়াও মাত্রা তিনের বেশি হয়। যেমন একটি বস্তুর কথা ধরা যাক, যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা সমান–একটি পারফেক্ট কিউব। এর মাত্রা হচ্ছে তিন। তবে চতুর্মাত্রিক কিউবও আছে, যার নাম খুব সম্ভব টেসারেক্ট। চতুর্মাত্রিক কিউব আমরা আঁকতে পারি না, তবে তার প্রজেকশন বা ছায়ার মডেল তৈরি করা হয়েছে।’

‘মন্দ না। কিছু-কিছু তো জান বলেই মনে হচ্ছে।’

মিসির আলি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তোমরা বিজ্ঞানীরা একটা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে সব সময় ভোগ। সব সময় মনে কর–তোমরা ছাড়া অন্য কেউ বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে পারবে না।

‘রেগে যাচ্ছ কেন?

‘রাগছি না, বিরক্ত হচ্ছি। তোমাদের বিজ্ঞানে অসংখ্য গোঁজামিল। তোমরা তা ভালো করেই জান, অথচ ভান কর যে, এটা একটা নিখুঁত জিনিস।’

‘গোঁজামিল তুমি কোথায় দেখলে?’

‘থার্ড ডিনামিক্সের প্রথম সূত্রে তোমরা বল–শক্তি শূন্য থেকে সৃষ্টি করা যায় না, ধ্বংসও করা যায় না। আবার এই তোমরাই বল যে, সৃষ্টির আদিতে শূন্য থেকে শক্তির সৃষ্টি।’

‘সৃষ্টির আদি অবস্থা ছিল ভিন্ন।’

‘প্রাকৃতিক সূত্রগুলো তাহলে কি একেক অবস্থায় একেক রকম হবে? তোমরাই তো তা অস্বীকার কর। তোমরাই তো বল, প্রাকৃতিক সূত্রের কোনো পরিবর্তন হয় নি, হবে না।’

দেওয়ান সাহেব গলার স্বর নরম করে বললেন, ‘চা খাও।’

‘তা খাব। তুমি আমার কথার জবাব দাও।’

‘আছে। কিছু সমস্যা তো আছেই। প্রকৃতির ব্যাপারটায় রহস্য এত বেশি যে, কোনো থই পাওয়া যায় না। এবং সবচে’ বড় মুশকিল কি জান? আমরা নিজেরাও এই প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতির অংশ হয়ে সেই প্রকৃতিকে পুরোপুরি জানা সম্ভব নয়। তার জন্য প্রকৃতির বাইরে যেতে হবে। তা যেহেতু পারছি না, প্রকৃতির অনেক রহস্যই বুঝতে পারছি না।’

মিসির আলি বললেন, ‘প্লেটোর সেই বিখ্যাত গুহার উপমাটা কি তুমি জান?’

‘প্লেটো পড়ার সময় কোথায়? ফিজিক্স নিয়েই কুল পাচ্ছি না।’

‘মনে কর–একটা গুহায় কিছু লোককে সারা জীবন বন্দি করে রাখা হয়েছে। লোকগুলো গুহামুখের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসা বলে, গুহার বাইরে কী হচ্ছে জানে না। তাদের যে-ছায়া পড়ছে গুহার দেয়ালে, তা-ই শুধু তারা দেখছে। তার বাইরে এদের কোনো জগৎ নেই। ছায়াজগৎই তাদের কাছে একমাত্র সত্য। সত্যিকার জগৎ কী, এরা জানে না। আমাদের বেলাতেও তা-ই হতে পারে। আমরা যে-জগৎ দেখছি, এটা সম্ভবত ছায়াজগৎ। সত্যিকার জগৎ আছে আমাদের চোখের আড়ালে।’

‘এ তো ফিলসফি মায়াবাদ।’

‘ফিলসফিতে অসুবিধা কোথায়?

দেওয়ান সাহেব বললেন, ‘তুমি আমাকে কনফিউজ করে দিচ্ছ। দেখি, একটা সিগারেট দাও।’

দেওয়ান সাহেব সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলেন। তাঁকে চিন্তিত মনে হল। মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, ‘তোমাকে আরো কনফিউজ করে দিচ্ছি। তোমাদের দলের এক জন লোক বিখ্যাত পদার্থবিদ শ্রোডিনজার নিজেকে ঈশ্বর বলে দাবি করেছিলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রবক্তাদের এক জন।

‘ইরউইন শ্রোডিনজার?’

‘হ্যাঁ। তিনি বলেছিলেন–

My body functions as a pure mechanism according to laws of nature and I know by direct experience that I am directing the motions. It follows that I am the one who directs the atoms of the world in motions. Hence I am God Almighty.

‘এটা কি তোমার মুখস্থ ছিল?’

‘না, ছিল না। তোমার কাছে আসার আগে মুখস্থ করেছি।’

‘মনে হচ্ছে তৈরি হয়ে এসেছ।’

‘হ্যাঁ।’

‘খুব ভালো। এখন বল আর কি বলবে?’

‘তোমাকে একটা ছবি দেখাব। একটা বিয়ের ছবি। খুব মন দিয়ে ছবিটা দেখবে।

এবং ছবিটার মধ্যে কোনো বিশেষত্ব আছে কি না আমাকে বলবে।’

‘দাও তোমার ছবি।’

মিসির আলি মুনির এবং বিনুর বিয়ের ছবিটি দিলেন। দেওয়ান সাহেব দীর্ঘ সময় ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তেমন কিছু তো দেখছি না।’

‘মেয়েটা শাড়ি কিভাবে পরেছে সেটা দেখেছ?’

‘অন্য সবাই যেভাবে পরে, সেভাবেই পরেছে।‘

‘না, তা না। মেয়েরা শাড়ির আঁচল রাখে বাঁ কাঁধে। এই ছবিতে প্রতিটি মেয়ে শাড়ির আঁচল রেখেছে ডান কাঁধে। বয়স্ক মহিলারাও তাই করেছেন।’

‘তাতে হয়েছেটা কী?’

‘ছবিটা কোনো এক বিশেষ কারণে উল্টো হয়ে গেছে। তোমার কি তা মনে হয় না?’

‘হ্যাঁ, তা তো হয়েছেই। এটা অবশ্যই স্বাভাবিক ছবি নয়।’

মিসির আলি বললেন, ‘নেচার পত্রিকায় একবার পড়েছিলাম, একটা ডান হাতের গ্লাভস যদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বাইরে দিয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়, তবে সেই গ্লাভসটি হয়ে যাবে বাঁ হাতের গ্লাভস। আমি কি ঠিক বললাম?’

‘পুরোপুরি ঠিক না-হলেও ঠিক। ডান হাতের গ্লাভস বাঁ হাতের গ্লাভস হবে। রাইট হ্যাণ্ডেড অবজেক্ট হবে লেফট হ্যাণ্ডেড অবজেক্ট!

‘এই ছবির মধ্যেও কি তাই হয় নি?’

দেওয়ান সাহেব আবার ছবিটি হাতে নিলেন। মিসির আলি বললেন, ‘ছবিটি এসেছে অন্য মাত্রার এক জীবন থেকে। এই জন্যে ছবির এই পরিবর্তন।’

‘তুমি খুব ছোট্ট জিনিস থেকে বড় সিদ্ধান্ত নিতে চাইছ। এটা ঠিক নয়।’

‘ঠিক নয়?’

‘না। ছবিটির আরো সহজ ব্যাখ্যা আছে। কোনো বিশেষ কারণে মহিলারা সেদিন ডান কাঁধে শাড়ির আঁচল দিয়েছিলেন। বাঁ কাঁধেই শাড়ির আঁচল রাখতে হবে, এ-রকম কোনো আইন তো জাতীয় পরিষদে পাস হয় নি।

‘তা হয় নি।’

‘অন্য একটা ব্যাখ্যাও দেয়া যায়। এটা সম্ভবত খুব সহজ কোনো ক্যামেরা-ট্রিক।’

‘টিকটা তারা করবে কেন?’

‘তোমার মতো পাগলদের উসকে দেবার জন্যে। দেখি, আরেকটা সিগারেট দাও, তোমার সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকলে আমিও পাগল হয়ে যাব। বিদেয় হও।’

‘হচ্ছি।’

‘শোন মিসির।’

‘বল।’

‘কাল-পরশু একবার এসো, তোমার থিওরিটা নিয়ে আলাপ করব।’

‘আলাপ করবার মতো কিছু কি আছে?’

‘না।’

‘তা হলে আসতে বলছ কেন?’

‘তোমার পাগলামি কথাবার্তা শুনতে ভালোই লাগে।’

মিসির আলি বললেন, ‘তুমি আমার এই প্রশ্নটির জবাব দাও। যদি তিনটি লোক একটি ছাগলকে দেখতে পায়, তাহলে কি তুমি স্বীকার করবে ছাগলটির একটি অস্তিত্ব আছে? সে রিয়েল?’

‘হ্যাঁ, স্বীকার করব।’

‘তিনটি মানুষ যদি একটি স্বপ্ন দেখে বা তিনটি মানুষ যদি একই চিন্তা করে, তাহলে সেই স্বপ্ন বা সেই চিন্তাকেও কি তুমি সত্য বলে স্বীকার করবে?’

‘না। চিন্তা কোনো বাস্তব বিষয় নয়। এটা হচ্ছে মাথার মধ্যে কিছু বায়োকেমিক্যাল রিঅ্যাকশন। তুমি কাল এসো। কাল তোমার সঙ্গে আলাপ করব।’

‘সপ্তাহখানিক পরে আসব। এই এক সপ্তাহ আমি পড়াশোনা করব। কোথাও বেরুব না। প্রচুর বইপত্র জোগাড় করেছি। কূর্ট গডেল-এর সেই থিওরি বোঝবার চেষ্টা করব।’

‘ভালো কথা, পড়। তবে খেয়াল রাখবে, অল্পবিদ্যার অনেক সমস্যা। নাপিত ফোঁড়া কাটতে পারে, সার্জেন চাকু হাতে নিতেও ভয় পায়।’

‘চাকু হাতে নিতে হলে—তোমার কাছে আসব।’

‘আরেকটা কথা—তোমার বিষয় সাইকোলজি, নিজেকে সেখানে আটকে রাখলে ভালো হয়। পদার্থবিদ্যা নিয়ে চিন্তাভাবনাটা পদার্থবিদদের ওপর ছেড়ে দাও।’

মিসির আলি কঠিন একটা উত্তর দিতে গিয়েও দিলেন না। অ্যাকাডেমিক মানুষরা একচক্ষু হরিণের মতো হন। নিজের বিষয় ছাড়া অন্য কিছু বুঝতে পারেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *