১৫. মিসির আলি আতংকিত

১৫

মিসির আলি আতঙ্কিত গলায় বললেন, তোমার একি অবস্থা! কী সর্বনাশ!

শায়লাকে চেনা যাচ্ছে না। তাঁর ওজন কমেছে আঠার পাউন্ড। গালের হাড় বের হয়ে গেছে। চোখ গর্তে ঢুকে গেছে। চোখের চারদিকে কালি। শায়লা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, স্যার আমি কিছু খেতে পারছি না। রাতে ঘুমাতে পারছি না। আমার ভার্টিগো হয়েছে। চারদিকে সবকিছু ঘুরছে।

মিসির আলি বললেন, আমি পানিতে ভিজিয়ে টাওয়েল এনে দিচ্ছি। চোখের উপরে ভেজা টাওয়েল চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাক এবং মনে মনে বল, আমি ঠিক হয়ে গেছি। আমি ঠিক হয়ে গেছি। ভার্টিগোর ক্ষেত্রে অটো সাজেশনে খুব ভালো কাজ করে।

স্যার আমার কোনো কিছুই কাজ করবে না। আমি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এই যন্ত্রণায় আমি থাকব না।

কোথায় যাচ্ছ, কবে যাচ্ছ?

মঙ্গলবার বিকেলে আমার ফ্লাইট। যাচ্ছি ইংল্যান্ড। সেখানে আমার বড় চাচা আর চাচি থাকেন। তাদের সঙ্গে থাকব। সব ছেড়েছুড়ে চলে যাচ্ছি তাতেও ভয় কাটছে না।

ভয় কাটছে না কেন?

আমার মনে হচ্ছে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে দেখব জোয়ার্দার আমাকে নিতে এসেছে। তাঁর সঙ্গে বের হয়ে দেখব আরেকজন জোয়ার্দার কালো বিড়াল কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মিসির আলি হেসে ফেললেন।

.

চোখে ভেজা টাওয়েল এবং সেলফ হিপনোসিসে কিছুটা কাজ হয়েছে। শায়লা আগের চেয়ে ভালো বোধ করছে। তাঁর মাথাও ঘুরছে না।

মিসির আলি বললেন, তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কিছু তথ্যও জোগাড় করেছি।

শায়লা বলল, স্যার আমি এই বিষয়ে আর কোনো কিছুই শুনতে চাচ্ছি না। আমি আপনার কাছে এসেছি বিদায় নিতে। আমি সবকিছু থেকে হাত ধুয়ে ফেলেছি।

মিসির আলি বললেন, তুমি চেষ্টা করলেও হাত ধুতে পারবে না। পালিয়ে গিয়েও লাভ হবে না।

পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমি করব কী?

Reality face করবে।

শায়লা বলল, কোনটা রিয়েলিটি? চিরকুমার জোয়ার্দার রিয়েলিটি নাকি স্ত্রী-কন্যা নিয়ে যে জোয়ার্দার বাস করছে সে রিয়েলিটি?

তুমি দু’জন জোয়ার্দারকে দেখছ তোমার কাছে দু’জনই রিয়েলিটি। তোমার শুনলে ভালো লাগবে যে এরকম সমস্যায় তুমি একা পড় নি। অনেকেই পড়েছে।

শায়লা বলল, পাগলাগারদে যারা আছে তারা হয়তো পড়েছে। পাগলদের কাছে রিয়েলিটি বলে কিছু নেই কিন্তু স্যার আমি তো পাগলাগারদের বাসিন্দা না।

মিসির আলি বললেন, পাগলাগারদের বাসিন্দা না হয়েও অনেকে রিয়েলিটি সমস্যায় পড়েছে। তিনটা ডকুমেন্টেড উদাহরণ আমি তোমাকে দিতে পারি।

শায়লা বলল, স্যার আমি কিছু শুনব না। ডকুমেন্টেড গল্প শুনে তো আমার সমস্যার সমাধান হবে না।

মিসির আলি বললেন, শুনতে না চাইলে শুনবে না তবে আমি মনে করি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে রিয়েলিটির নতুন ব্যাখ্যা তোমার শোনা উচিত।

শায়লা হতাশ গলায় বলল, আচ্ছা আমি শুনছি। আপনি বলুন।

চা বানিয়ে আনি? চা খেতে খেতে শোন।

আচ্ছা। আর টোস্ট বিস্কিট থাকলে আনুন। প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। গার্লিক টোস্ট উইথ চিজ।

টোষ্ট বিস্কিট নেই। তুমি তোমার ড্রাইভারকে পাঠাও তোমার জন্য এক বাটি স্যুপ নিয়ে আসবে। তোমার খাওয়া দরকার!

শায়লা আধশোয়া হয়ে চেয়ারে বসা। তাঁর চোখে ভেজা টাওয়েল। পুরো এক বাটি স্যুপ সে কিছুক্ষণ আগে খেয়ে শেষ করেছে। তাঁর সামনে চায়ের কাপ। সে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে না।

মিসির আলি বললেন, তোমার যদি ঘুম পেয়ে থাকে তা হলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নাও।

শায়লা বলল, আমি ঘুমাব না। আপনি কী বলবেন বলুন। আমি মন দিয়ে শুনছি।

মিসির আলি বললেন, সারা পৃথিবীতেই গির্জা হচ্ছে রেকর্ড কিপিংয়ের জায়গা এটা তো জান?

জানি। গির্জা জন্ম মৃত্যুর রেকর্ড রাখে।

জন্ম মৃত্যু ছাড়াও বড় বড় ঘটনার রেকর্ডও রাখা হয়। ছয় শ বছর আগে একটা সুপার নোভার এক্সপ্লোশন হয়ে ছিল। রাতের বেলাতেও তখন পৃথিবীতে দিনের মতো আলো থাকত। মনে হত আকাশে দু’টি সূর্য। এই ঘটনাও আমরা পেয়েছি গির্জার রেকর্ড থেকে। শায়লা! তুমি শুনছ না ঘুমিয়ে পড়েছ?

শায়লা মুখ থেকে টাওয়েল সরাল। সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, আমি খুব মন দিয়ে শুনছি।

মিসির আলি বললেন, রেকর্ড রাখার দায়িত্ব চার্চের ফাদারের তবে তিনি ছাড়াও কেউ যদি বিশেষ কোনো ঘটনা জানাতে চাইত তাও পারত।

১৮৬৭ সনে আমেরিকার মন্টানা স্টেটের চার্চে জন উইলিয়াম স্মিথ নামের এক ভদ্রলোক তার জীবনের একটি বিশেষ ঘটনা লিখে জমা দেন। ঘটনা তিনি যেভাবে লিখে গেছেন সেভাবে পড়ি। নাকি তুমি নিজে পড়বে?

আমি নিজে পড়ব।

মিসির আলি একটি বই এগিয়ে দিলেন। বইটির মাঝামাঝি জায়গায় পেজ মার্ক দেয়া আছে। বইটির নাম The Oxford book of the Supernatural লেখক D. J. Enright. বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯০২ সনে। প্রকাশক Oxford University Press.

জন উইলিয়াম স্মিথ লিখেছেন ইংরেজিতে। তার বাংলা ভাষ্য-

আমি জন উইলিয়াম স্মিথ। মন্টানার বনের ভেতর আমার একটা খামার বাড়ি আছে। তিনশ একর জমি ইজারা নিয়ে আমি এই বাড়িতে বাস করি। আমার সঙ্গী একটা কুকুর। কুকুরটার নাম লং টেইল। তার লেজ অস্বাভাবিক লম্বা বলেই এই নাম। আমি লগ হাউসে একা বাস করি। লগ হাউস হ্রদের কাছে। হ্রদ থেকে ট্রাউট মাছ ধরি। বনের ভেতরে শিকারের জন্য প্রচুর প্রাণী আছে। একটা হরিণ মারলে অনেক দিন যায়।

আমি একা মানুষ আমার প্রয়োজন সামান্য। একদিনের কথা, মধ্য দুপুর। বনের ভেতর থেকে মৌচাক ভেঙে লগ হাউসে ফিরছি। আমার সঙ্গে লং টেইল নেই। সে খরগোশ তাড়া করতে গিয়ে কাঁটা বিঁধে ব্যথা পেয়েছে। আমি মধু নিয়ে যাচ্ছি তার ক্ষতস্থানে লাগানোর জন্য।

দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকে আমি হতভম্ব। সাত আট বছরের একটি কিশোরী লং টেইলের গায়ে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। অবিকল কিশোরীর মতো দেখতে এক তরুণী ফায়ার প্লেসের সামনে কাঠ জড়ো করছে। এরা দু’জন আমাকে দেখে অবাক হল না বা চমকাল না। মেয়েটি বলল, পাপা মধু এনেছ? লং টেইলের কাটা জায়গায় আমি মধু দিয়ে দেব।

তরুণী বলল, জন তুমি যখন ডাউন টাউনে যাবে আমাদের নিয়ে যাবে এলিজাবেথের জন্য ড্রেস কিনতে হবে।

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে এলিজাবেথ নামের এই কিশোরী আমার মেয়ে। তরুণী আমার স্ত্রী। এটা কী করে সম্ভব?

হলি ফাদার এবং হলি গোস্টের নামে শপথ আমি যা লিখছি সবই সত্য। এর মধ্যে কোনো অতিরঞ্জন নেই।

অবিবাহিত মানুষের লগ হাউস আর বিবাহিত মানুষের লগ হাউসে কিছু পার্থক্য থাকে। এখন আমার লগ হাউস বিবাহিত মানুষদের ঘর ভর্তি মেয়ে এবং তার মেয়ের জিনিস।

আমি এদের কাছে নিজের কথা কিছুই বললাম না। এদেরকে আমি সঙ্গে সঙ্গে গ্রহণ করে নিলাম। আমার স্ত্রীর নাম মার্থা। তার গর্ভে আমার একটি পুত্রসন্তান হল। পুত্রের নাম দিলাম মার্শাল।

এক শীতের রাতের কথা। প্রচুর বরফ পড়ছে। মার্শাল তার বোনের কোলে এলিজাবেথ ফায়ার প্লেসে আগুন দিয়েছে। আগুনের পাশে লং টেইল থাবা মেলে বসে আছে। লং টেইল জীবনের শেষ প্রান্তে উপস্থিত।

সে মৃত্যুর অপেক্ষায়। আমার সঙ্গে শিকারে যাওয়া বন্দুক। আমি বন্দুক নিয়ে বের হচ্ছি। ঘরে মাংস নেই। হরিণ পাওয়া গেলে হরিণের মাংস বরফের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে হবে। শীতের খাদ্য সঞ্চয়।

মার্থা বলল, যেভাবে বরফ পড়ছে তুমি যেও না। ফায়ার প্লেসের সামনে মার্শালকে কোলে নিয়ে বস। এস আমরা গল্প করি।

.

আমি তার কথা শুনলাম না। বন্দুক নিয়ে বের হলাম। একটা বন্য ছাগল মেরে ঘরে ফিরে দেখি কেউ নেই। শুধু লং টেইল মরে পড়ে আছে। ফায়ার প্লেসে

আগুন জ্বলছে না। আমার ছেলেমেয়ে এবং তাদের মা’র কোনো কাপড়চোপড়ও নেই। আমি ফিরে গেছি অবিবাহিত পুরুষের জীবনে।

এরপর আমি আর পরিবারের দেখা পাই নি। বৎসরের পর বৎসর অপেক্ষা করেছি কোনো একদিন লগ হাউসে ঢুকে দেখব সবাই আছে।

.

শায়লা পড়া শেষ করে বলল, জন স্মিথের এই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা কি কেউ দিয়েছে?

মিসির আলি বললেন, একটা ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, জন স্মিথ ছিলেন নিঃসঙ্গ মানুষ। তিনি তার পরিবার কল্পনা করে নিয়েছেন। কল্পনাকেই রিয়েলিটি ভেবেছেন। এই রিয়েলিটির একটা নাম আছে SCR অর্থাৎ Self Created Reality.

শায়লা বলল, এই ব্যাখ্যা আমার কাছে যথেষ্টই যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে।

মিসির আলি বললেন, ভুল ব্যাখ্যা। লং টেইলের মৃত্যুর পর জন স্মিথ আরো নিঃসঙ্গ হয়েছে। এই অবস্থায় কল্পনার পরিবার তার কাছে ফিরে আসার কথা কিন্তু আসে নি।

শায়লা চুপ করে রইল। মিসির আলি বললেন, আমার ধারণা লং টেইল কুকুরটা জন স্মিথের ডাবল রিয়েলিটির সঙ্গে যুক্ত। কুকুর নেই ডাবল রিয়েলিটিও নেই।

শায়লা বলল, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন জোয়ার্দারের পুফি বিড়ালটা তার ডাবল রিয়েলিটির সঙ্গে যুক্ত? পুফি না থাকলে ডাবল রিয়েলিটি থাকবে না?

মিসির আলি শায়লার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, তোমার একটা সিগারেট দাও খেয়ে দেখি। আমার প্যাকেটে সিগারেট নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *