১৫. মা

১৫
কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আজাদ আবার চলে আসে করাচিতে ৷ এমএ-তে ভর্তি হয় ৷ একটা ব্যবসাও সে শুরু করে সেখানে ৷ ব্যবসায় সে ভালো করবে, এই রকম আশা তার ছিল ৷ এ সময় সে মাকে মাঝে মধ্যে টাকা পাঠাত ৷ মাকে সে চিঠি লিখত নিয়মিত, আর সেসব চিঠিতে মাকে বারবার করে অনুরোধ করত মা যেন তাঁর শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেন ৷ লিখত, মা যেন টাকার জন্যে চিন্তা না করেন ৷ দরকার হলেই যেন ব্যাঙ্ক থেকে সোনা তুলে মা বিক্রি করে দেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যয়নির্বাহ করেন ৷ সে লিখেছিল : ‘টাকার দরকার হলে যদি তুমি বিক্রি না করো, তবে আমি দুঃখিত হব ৷ এইসব গয়না কারু জন্যে রাখতে হবে না ৷ এই আমার অনুরোধ ৷’ কিন্তু মা সোনায় হাত দিতে চাইতেন না ৷ এই সোনা তো আসলে আজাদের বউয়ের হক ৷ ছেলের বিয়ের সময় কনেকে সোনা দিয়ে সাজাতে হবে না!
করাচিতে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়েছিল আজাদ ৷ মাকে লিখেছিল,
মা,
আমি ভালোই আছি ৷ আমার জন্য কোন চিন্তা করিও না ৷ চিঠি লিখতে অবশ্য দেরি হয়ে গেল ৷
দোয়া কোরো, এখনো কোনো অসুবিধা হয় নাই ৷ ব্যবসা ইনশাল্লাহ ভালোই চলবে মনে হয় ৷ আমি ছোট্ট একটা বাড়ি নিয়েছি ৷ কয়েক মাস পরে বড় বাড়ি নেব, তখন তোমাকে নিয়ে আসব ৷ আর এই মাসের শেষের দিকে তোমাকে আমি কিছু টাকা পাঠাব ৷ আগেও পাঠাতে পারি, ঠিক নেই ৷ তবে দেরি হবে না ৷ তুমি কোথায় থাকবে তখন চিঠি দিয়ে জানাইও ৷ এমএতে ভর্তি হয়ে গেছি ৷
আর বিশেষ কিছু লেখার নেই ৷ দোয়া কোরো যেন ইনশাল্লাহ ব্যবসাতে উন্নতি করতে পারি ৷
ইতি
আজাদ
ঠিকানা
AZAD
646, C, CENTRAL COMMERCIAL AREA
PECHS
KARACHI 29
এই চিঠি লিখিত হওয়ার ২০ বছর পর জায়েদ আজাদের এইসব চিঠি পড়ে, আর তার মনে নানা প্রতিক্রিয়া হয় ৷ কোনো চিঠিতে আছে, ‘মা, টাকার অভাবে তোমাকে চিঠি লিখতে পারি নাই ৷’ কী রকম অর্থকষ্টটাই সহ্য করতে হয়েছিল আজাদকে যে একটা চিঠি পোস্ট করার মতো টাকা তার ছিল না ৷ জায়েদ একটা এরোগ্রাম মেলে ধরে ৷ এটায় খাম আর চিঠি একই কাগজে লিখতে হতো ৷ তাতে বোধ করি ডাকখরচ কম পড়ত ৷
BY AIR MAIL
INLAND
AEROGRAM
If anything is enclosed this letter will be sent by ordinary mail
ইংরেজি, উর্দু আর বাংলায় লেখা পাকিস্তান ৷ পোস্টেজ ১৩ পয়সা ৷ আর তাতে টিকেটের ঘরের মতো চৌকোয় যে ছবিটা আঁকা, সেটা পূর্ব বাংলার-নারকেলগাছ, ধান বা পাটক্ষেত আর নদীতে পালতোলা নৌকা ৷
মাত্র ১৩ পয়সা জোগাড় করতেও কষ্ট হয়েছিল আজাদ দাদার!
করাচি বিশ্ববিদ্যালয়েই আজাদের পরিচয় ঘটে আবুল বাশারের সঙ্গে ৷ টাঙ্গাইলের সম্পন্ন ঘরের ছেলে বাশার ৷ পড়তে গেছে করাচিতে ৷ বাঙালি সমিতি করে ৷ সমিতির অনুষ্ঠানের জন্যে খায়খাটুনি করে ৷ আর তার আছে বই পড়ার অভ্যাস ৷ আজাদের রুমে এসে দেখে প্রচুর বই, নানা রকমের ইংরেজি উপন্যাস, বাশার ধার নেয় সেসব বই ৷ আবার সময়মতো ফিরিয়েও দেয় ৷ এভাবেই আজাদের সঙ্গে বাশারের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় ৷
বাঙালিরা যখন একত্র হয়, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয় ৷ শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি ঘোষণা করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের সমাবর্তন উৎসবে মোনায়েম খানের হাত থেকে সনদ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আন্দোলন করেছে, ছাত্রদের ওপর হামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে বহু ছাত্র, ৬ দফার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, শেখ মুজিব প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে ৬ দফার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন, আইয়ুব খান দমননীতির আশ্রয় নিচ্ছেন, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সঙ্গে আরো আরো নেতা আর কর্মীকে, তাঁর মুক্তি ও ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়েছে, হরতালে গুলি চলেছে, ঢাকা নারায়ণগঞ্জে বহু শ্রমিক হতাহত-ঘটনা ঘটতে থাকে দ্রুত ৷ এইসব নিয়ে বাঙালি ছাত্ররা তর্ক-বিতর্ক করে, বাম-ঘেঁষা ছাত্ররা মনে করে, আওয়ামী লীগ বুর্জোয়াদের দল, তাদের দিয়ে জাতীয় মুক্তি অসম্ভব ৷
ইউনুস আহমেদ চৌধুরী জার্মানি যান ৷ সেখান থেকে তিনি চিঠি লেখেন সাফিয়া বেগমকে ৷ বড়ই আবেগপূর্ণ চিঠি ৷ সাফিয়া বেগমকে তিনি সম্বোধন করেন প্রাণের পুতুল বলে ৷ তিনি তাঁর জন্যে হা-হুতাশ করেন, নিজের ভুলের কথা স্বীকার করেন, তাঁকে ছাড়া যে তার চলছে না, তিনি তিষ্ঠাতে পারছেন না, এটা তিনি বলেন বড়ই আকুল স্বরে ৷ তিনি সবকিছু ভুলে আবার সাফিয়াকে তাঁর কাছে আসতে বলেন ৷ মিনতি করেন আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে ৷
চিঠি পেয়ে সাফিয়া বেগম আরো কঠিন হয়ে পড়েন ৷ না, মিষ্টি কথায় ভোলা যাবে না ৷ কত কষ্ট করে ছেলেকে নিয়ে তিনি একা দিনগুজরান করছেন ৷ ছেলেকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন ৷ ছেলেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করিয়েছেন, আইএ পাস করিয়েছেন, বিএ পাস করিয়েছেন, এখন ছেলে এমএ পড়ছে ৷ কত কষ্টই না তাঁর হয়েছে এই কটা বছর ৷ গয়না বিক্রি করে পুঁজি জোগাড় করে ব্যবসা করতে দিয়েছেন একে-ওকে ৷ কিন্তু টাকা লগি্নই সার হয়েছে, লাভ তো দূরের কথা, তিনি আসলই ফিরে পাননি ৷ তাঁর ছেলেও কত কষ্ট করেছে ৷ টাকার অভাবে চিঠি পর্যন্ত লিখতে পারেনি ৷ শেষতক তাকে ব্যবসায় নামতে হয়েছে ৷ এত কষ্ট সহ্য করে এতটা কাঁটা-বিছানো পথ পাড়ি দিয়ে অনেক রক্ত ঝরিয়ে যখন প্রায় মসৃণ পথে তাঁরা এসে পড়েছেন, তখন কিনা তিনি নতি স্বীকার করবেন!
আমেরিকা গিয়েছিলেন ইউনুস চৌধুরী ৷ সেখান থেকেও তিনি সাফিয়াকে চিঠি লিখেছেন ভয়ানক কাকুতি-মিনতি করে ৷ লিখেছেন, ‘হাজার হাজার মাইল দূরে এক অচেনা জায়গায় বসে আর কাউকে নয়, শুধু তোমাকে মনে পড়ছে বলে তোমাকেই চিঠি লিখতে বসেছি ৷ মানুষ মাত্রই ভুল করে ৷ আমিও একটা ভুল করেছি ৷ তুমি কি আমাকে ক্ষমা করে দিতে পার না ? আমাদের আগেকার সুখের জীবনে আবার কি আমরা ফিরে যেতে পারি না ? আমি যেখানেই যাচ্ছি, প্রাণে তো সুখ পাচ্ছি না ৷ তোমাকে ছাড়া এ জীবনে আর সুখ পাব না, এটা নিশ্চিত ৷ শুধু মৃত্যুর পরে যেন হাশরের ময়দানে তোমার মুখটা আমি দেখতে পাই ৷ যেন তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি ৷’
চিঠি পেয়ে সাফিয়া বেগমের সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় ৷ তিনি খানিকক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকেন ৷ লোকটা এখন মৃত্যুর পরে হাশরের ময়দানে তাঁর দেখা পাবে বলে অপেক্ষা করছে ৷ নতুন বিয়ে, নতুন সম্পর্ক-এসব কিছুতে তাঁর আত্মা সুখ পেল না! পাওয়ার তো কথা না ৷ নিজের ছেলে, নিজের স্ত্রীকে ফেলে যারা অন্যের কাছে যায়, জীবনে সুখ কিংবা স্থিতি তারা কে কবে কোথায় পেয়েছে! মরীচিকার দিকে ছুটলে তো তৃষ্ণা মেটে না ৷ বরং বিভ্রান্তি আর পণ্ডশ্রমে জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় মাত্র ৷
কী করবেন সাফিয়া বেগম ? ফিরে যাবেন চৌধুরীর কাছে ? ফিরে যাবেন ইস্কাটনের বাড়িতে ? কর্তৃত্ব তুলে নেবেন ওই বাড়ির! যে চিত্রা হরিণটা তাঁর হাতে সবুজ গাছের পাতা খাওয়ার জন্যে রোজ ভোরবেলা কাতর নয়নে তাকিয়ে থাকত, সে যে তাঁকে তার নীরব চোখের ভাষায় ডাকছে ৷ পোষা কুকুর টমি যে রোজ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে তাঁর ঘ্রাণ শুঁকবে বলে! গৃহপরিচারিকা জয়নব নাকি এখনও রোজ রাতে মিহি সুরে কাঁদে! আত্মীয়স্বজন আশ্রিতেরা নাকি তাঁর অনুপস্থিতির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ৷
সাফিয়া বেগমের মনটা দুর্বল হয়ে পড়ে ৷ সারা দিন তিনি ঘোরের মধ্যে থাকেন ৷ রাত্রিবেলা ভালো করে ঘুম হয় না তাঁর ৷ ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে আবার তিনি চিঠিটা মেলে ধরেন ৷ আগাগোড়া পড়েন ৷ পড়তে পড়তেই সেই নাট্যদৃশ্য আবার তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে : ষোলশ গোপিনী টানাটানি করছে কৃষ্ণরূপী চৌধুরীকে; মুহূর্তে তাঁর সমস্ত সত্তাজুড়ে নাছোড় প্রত্যাখ্যানের শক্তি জেগে ওঠে, সমস্ত আকাশ-বাতাস যেন বলে ওঠে : না ৷ তিনি ফিরে যেতে পারেন না ৷ চৌধুরীর এই হলো কৌশল ৷ এভাবেই সে একের পরে এক নারীকে মোহজালে আটকে ফেলে ৷ তাঁর এই ছল সাফিয়া বেগমের ভালো করেই জানা আছে ৷
আর তা ছাড়া তাঁর প্রতিজ্ঞার একটা দাম আছে না ? তিনি চৌধুরীকে বলেছিলেন ওই অনৈতিক সম্পর্কটাতে না যেতে, স্পষ্ট ভাষাতেই তো জানিয়েছিলেন, ওই মহিলাকে বিয়ে করার একটাই মানে, মৃত্যুর পরেও সাফিয়ার মুখ আর চৌধুরী দেখতে পাবে না ৷
সাফিয়া বেগম তাঁর স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পরে আরো ২৪ বছর বেঁচে ছিলেন, তিনি তাঁর কথাটা আশ্চর্য রকমভাবে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন ৷ একই শহরে তাঁরা ছিলেন ২৪টা বছর, কখনও কখনও একই পাড়াতেই, একই মাহফিলে, একই মাজারে, একই মিলাদে দুজনই গিয়েছেন, এ রকম একাধিকবার হয়েছে, কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, কেউ কারো মুখ দেখতে পাননি ৷
জায়েদ এ কথা স্মরণ করে ৷ তার মনে পড়ে, আম্মা বলতেন, পাবে না রে, পাবে না, আমার মুখ সে বেঁচে থাকতে দেখতে পাবে না ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *