এর মধ্যে এক দিন মহিম বাড়ি ফিরছিল। বেলা তখন নাবির দিকে আকাশে মেঘের ভিড় নেই, সূর্যের তেজ বড় প্রখর। কেমন যেন মাথা ধরিয়ে দেয়।
অক্ষয় জোতদারের বাড়ির পিছনে ডোবাটার ধারে থমকে দাঁড়াল মহিম। এ কী! দেখল হাড্ডিসার মোষ একটা চার পা মুড়ে ঘাড় সামনের দিকে বাড়ির মাথা পেতে পড়ে আছে। চোখ দুটো নিষ্পলক সেই মোষের পিঠের উপর একটি মানুষ মুখ থুবড়ে পড়ে ফুলে ফুলে উঠছে। বোধ হয় কান্নায়।
মহিম তাড়াতাড়ি কাছে ছুটে এল। দেখল মোযটা মৃত। ডাকল, কে গো?
যন্ত্রণাকাতর চোখের জলে ভরা মুখটা তুলল অখিল মোষের পিঠ থেকে। বলল, মোর কালাচাঁদেরে মেরে ফেলছে ভাই। বলতে বলতে তার কায়া বেড়ে উঠল।
মহিম বসে পড়ল অখিলের পাশে। জিজ্ঞেস করল, কী হইছে অখিলদাদা?
অখিলের বক্তব্যে মহিম বুঝল, অক্ষয় জোতদার দেনার দায়ে অখিলদের জীবনভর সঞ্চয়ের ক্রীত কালাচাঁদকে নিয়ে আসে। কালাচাঁদের ভরণপোষণের দায় থাকে অক্ষয়ের। তার জন্যও অবশ্য একটা আলাদা সুদ হিসাবে দেনা ধরা হবে তার। কিন্তু সে চুক্তি প্রতিপালিত তো হয়নি, উপরন্তু না খেতে দিয়ে মেরে ফেলেছে।
অখিল বলল, মহীরে, তোরা দেখছিস দশটা জোয়ান মনিষ কালাচাঁদেরে দেখে কাছে ঘেঁষত না, যেন চারটে ষাঁড় সমান। আশা ছিল জীবনে যদি আর একটা হয় তবে কালাচাঁদের ভাই শামচাঁদ এ দুজনারে নিয়া কোনওরকমে দুটো চাকা বানিয়ে গাড়ি চালিয়ে খাব। সে গেল, কিন্তু কালাচাঁদ যে মোর কী ছিল, সে কথা কেউ বুঝবে না। রোজ জোতদারের গোয়ালের পিছনে এসে আদর করে যেতাম, আর কালাচাঁদের সে কী ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস। মাঠে ঘরে কোথাও মোর শান্তি ছিল না। ঘুমিয়ে সেই নিশ্বাস শুনতাম মুই।
বুক চাপড়ে কেঁদে উঠল। তার কালাচাঁদের সুখ্যাতি ও সোহাগের কথা মহিম শুনেছিল। কান্না বড় অসহ্য লাগল তার। বলল, ছেড়ে দেও অখিলদাদা, ঘরে যাও, মুই ডোমপাড়ায় একটা খবর দিয়া যাই।
দেখ মহী।’ অক্ষয়ের গোলা আর বিচলির গাদা দেখিয়ে বলল অখিল, কত খাবার, বুঝি কয়েক বছরের, তবু মোর কালাচাঁদের দিনে দুটো আঁটিও জুটল না।
এমন সময় অক্ষয় জোতদার হেঁকে উঠল, ও-সব কান্না-মান্না রেখে যাবি ডোমপাড়ায়, না কি ধাষ্টামো করবি? এর পরে আবার পাওনা-গণ্ডার হিসাব-টিসাবগুলান দেখে যা, ন্যাকামো রাখ।
কথাগুলো যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল মহিমের মাথায়। সে অখিলকে উঠতে বলেছিল। কিন্তু বলে উঠল, না, ও থাকবে এখানে অক্ষয়কাকা, ওরে কাঁদতে দেও। তাতে তোমার পাওনা কমবে না। মুই যাই ডোমপাড়ায় লোক ডাকতে।
বলে সে উঠে পড়ল। যেতে যেতে শুনল অক্ষয়ের কথা, চাষার ব্যাটা কুমোর, ছুতোর হল বামুন—কতই দেখব। কিন্তু অক্ষয় ও-সব ঘোড়াই কেয়ার করে।
মহিমের সামনে পথ মাঠ। কিন্তু মরা মোযটার মতো নিষ্পলক চোখের দৃষ্টি তার শুন্যে নিবদ্ধ। বার বার হোঁচট খেল, খেয়াল রইল না তার। এক দারুণ প্রতিক্রিয়া করেছে সমস্ত ঘটনাটা তার মধ্যে। শিল্পীর মন যেন কোথায় ছুটে চলেছে।
ডোমপাড়া ঘুরে বেলা শেষে সে বাড়ি ফিরে এল।
ভরত বাড়ি নেই। অহল্যা আজ সহ্যের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে একটা বোঝাপড়া করার জন্য দৃঢ় অন্ধকার মুখে মহিমের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। বলল, আজ যদি এতখানি পর হয়ে গেছি তবে বলি, তোমার জন্য কি মোর খিদে তেষ্টা নাই?
আচমকা আঘাতে আড়ষ্ট মহিম জিজ্ঞেস করল, মোর জন্য রোজ তুমি বসে থাকো?
সে কথা থাকুক। চুলোয় যাক খাওয়া। আজ তোমাকে একটা বোঝাপড়া করতে লাগবে নইলে অনাছিষ্টি করব মুই। বলতে বলতে মহিমের চোখে কেমন উদ্ভ্রান্ত ভাব দেখে চমকে উঠল সে। কী যেন দেখছে মহিম। সমস্ত মুখে বেদনার আলোর বিচিত্র খেলা। মহিমের এ মুখ, এ চোখ অহল্যা চেনে। বলল, কী হইছে তোমার?
বুঝি কান্না পেয়েছে মহিমের। ফিসফিস করে বলল, মুই কাজ করব বউদি, কাজ করব।
কীসের কাজ?
মহিম অখিলের সমস্ত ঘটনা বলে গেল। পরে বলল, সে মুই ভুলতে পারি না। কালাচাঁদের পিঠে পড়ে অখিলের কান্না, এ দুইয়ের মূর্তি গড় আমি।
মহিমের মাথার চুলের গাদায় দু-হাত ঢুকিয়ে অহল্যা তাকে কাছে টেনে নিল। বলল, ছি, কেঁদো না। তোমার কাজ তত তোমারে করতেই হইবে। কিন্তু তার বুক ভরে উঠল আনন্দে। সে আনন্দের বেগ বুক ফাটিয়ে চোখে জলের ধারা বইয়ে দিল তার। আর এ জলের ধারাই বুঝি এ ক’দিনের সমস্ত সঙ্কট জ্বালা যন্ত্রণাকে ধুইয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। বলল, পাগল নিয়ে কারবার। না জানি আবার কবে বেঁকে বসবে।
বলে মহিমের মুখের দিকে মুহূর্ত তাকিয়ে পেছন ফিরে চলে গেল সে। যেন ভয় পেয়েছে সে এমনি ভাব। তার পর রান্নাঘরের অন্ধকার কোণে মুখে হাত চাপা দিয়ে বসে পড়ল সে। না, এ দুরন্ত কান্না বুঝি থামতে নেই, থামতে নেই। কেন?