1 of 2

১৫. মধ্যরাত পার হয়ে গেছে

মধ্যরাত পার হয়ে গেছে, একটু আগে এ বাড়ির সমস্ত ঘরের বাতি নিবেছে, কোথাও কোনও শব্দ নেই। বসু অনেক রাত জেগে পড়াশুনো করে। আজ সেও ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু জেগে আছেন রবি। রাত্রির পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছেন জানলার গরাদ ধরে। ক্রোধে তাঁর ব্রহ্মতালু জ্বলছে, দপদপ করছে কপালের পাশের দুটি শিরা। বাইরের আকাশ মেঘলা, নক্ষত্রমণ্ডলী নিয়ে নিশাপতি অদৃশ্য, মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছে বিদ্যুৎ, একটু পরে শোনা যাবে গুরু গুরু ধ্বনি। অদূরের গাছগুলি যেন নিশ্বাস বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে আছে প্রতীক্ষায়।

এত প্রকৃতিপ্রেমী এই কবি এখন দেখছেন না প্রকৃতির শোভা। ক্রোধের কারণে তাঁর চোখের সামনে এখন কিছুই নেই। এত রাগ তাঁর অনেক দিন হয়নি। তার নিশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। তিনি জানেন, ক্রোধকে বেশি প্রশ্রয় দিতে নেই, তাতে যুক্তিবোধ ঝাপসা হয়ে যায়। পাকস্থলিতে অম্নরস ক্ষরণ হয়। এ সব জেনেও রবি নিজেকে শান্ত করতে পারছেন না। জানা ছেড়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগলেন, একবার দরজা খুলে এলেন বাইরে। আজ বাতাসও থমথমে, তার মস্তিষ্কে শান্তির প্রলেপ দেবার মতন কিছু নেই।

মুস্কিল হচ্ছে এই, লোকজনের সামনে যতই ক্রোধের কারণ ঘটুক কিংবা যতই অপমানিত বোধ করুন, রবি কিছুতেই তাঁর ক্রোধ বা ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারেন না। যারা পারে, কিছুক্ষণ পরে তাদের মেজাজ সুস্থ হয়ে যায়। রবি লাজুক নন, কিন্তু কটুকথা কিছুতেই বেরুতে চায় না তাঁর মুখ থেকে। বিশেষত নিমন্ত্রিত হয়ে কোথাও গিয়ে কি দুর্ব্যবহার করা চলে? তাঁদের বংশের কেউ কখনও এমন কিছু করবে না। অন্য নিমন্ত্রিত কেউ যদি উল্লুকের মতন ব্যবহার করে, তবে সেটা তার বংশের দোষ, শিক্ষার দোষ! অথচ এরাই আবার শিক্ষিত বলে গর্ব করে, ডিগ্রিধারী, তকমাধারী।

মুখে বলতে না পারলেও লিখে প্রকাশ করলে মনের জ্বালা মেটে। রবি এর মধ্যে কাগজ-কলম নিয়ে বসেও ছিলেন, কিন্তু মনের একাগ্রতা আসেনি। ক্রুদ্ধ মেজাজ নিয়ে কবিতা লেখা উচিত না। রবি আগে কয়েকবার লিখেছেন বটে, কিন্তু বুঝতে পেরেছেন তাতে কবিতার মান ঠিক থাকে না। ক্রোধ, ক্ষোভ, ঈর্ষা, বক্রোক্তি, কারুর প্রতি ব্যক্তিগত অসুয়া নিয়ে রসসাহিত্য হয় না, মনকে এসব থেকে মুক্ত করে নিতে হয়।

এবার উড়িষ্যায় এসে বারবার তাঁর মন বিগড়ে যাচ্ছে।

উপলক্ষ যদিও জমিদারি পরিদর্শন, আসল উদ্দেশ্য ভ্রমণ, প্রকৃতির মধ্যে নিমজ্জন এবং বন্ধু-সংসর্গ উপভোগ। এমন মহান সুন্দর সমুদ্র। রবি মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইওরোপ ঘুরে এসেছেন দুবার। আরব্য সাগরের তীরে থেকে এসেছেন বারবার। কিন্তু পুরীর সমুদ্রের যেন তুলনা হয় না। বেলাভূমিতে দাঁড়ালে অবিরাম তরঙ্গমালার রূপ দেখতে দেখতে যেন ফেরানো যায় না চোখ। কিন্তু পুরীতেই একটি বিশ্রী অভিজ্ঞতা হয়েছিল, কটুকে এসে আবার। সমুদ্র নিয়ে একটা কবিতা লেখার কথা মাথায় এসেছিল, কলমের মুখে এসে হারিয়ে যাচ্ছে সেই ভাব। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে কি কবিতা লেখা যায়?

শুধু চিঠিতেই খুলে বলা যায় মনের কথা। কাকে চিঠি লিখবেন? একজনকেই শুধু লিখতে ইচ্ছে করে, ইন্দিরা, তাঁর বিবি, বাবি, বব। ইন্দিরা প্রতিদিন অপেক্ষা করে রবির চিঠির জন্য। রবির মনে পড়ে তার উম্মুখ চাহনি, তার ব্যাকুলতা। কিন্তু এমন তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে ইন্দিরাকেও চিঠি লেখা যায় না।

এবার যাঁদের কাছে আতিথ্য নিয়েছেন, সেই বিহারীলাল গুপ্ত ও সৌদামিনী দেবীর সৌজন্য ও যত্ন তুলনাহীন। কিন্তু তাঁরা বারবার একটা ভুল করছেন। বিহারীলালের ধারণা, রবীন্দ্রবাবু ওড়িশায় এসেছেন, এটা একটা বিশেষ ঘটনা, সুতরাং তা অনেককে জানানো দরকার। রবীন্দ্রবাবু একজন প্রসিদ্ধ কবি ও সুগায়ক, উচ্চ বংশের সন্তান এবং জমিদার, তাঁর সঙ্গে অনেকেই পরিচিত হলে খুশি হবে।

পুরীতে সমুদ্রস্নান এবং বেলাভূমিতে ঘণ্টার পর ঘন্টা শুয়ে বসে থাকতে চমৎকার সময় কাটছিল। পরী তাঁর এমন পছন্দ হল যে রবি এখানে একটা বাড়ি বানাবেন ঠিক করে ফেললেন। একটা বেশ ছোট্ট বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি, সেখানে এসে থাকবেন মাঝে মাঝে এখন থেকেই কল্পনায় দেখতে পান সেই বাড়িটা। এর মধ্যে বিহারীলাল তাঁর বাড়িতে লোকজনদের ডাকছেন। একদিন ঠিক করলেন রবিকে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাবেন। রবির যাবার ইচ্ছে নেই, তিনি যে নিরালায় কিংবা ছোট একটা পরিচিত গোষ্ঠীর মধ্যেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, সেটা অন্যে বোঝে না। ডিটি ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে বকবক কার চেয়ে নীলারাশির দিকে চুপচাপ চেয়ে থাকাও কি অনেক ভাল নয়? বিহারীলাল গুপ্ত যদি এটা বুঝতেন তা হলে তিনি নিজেই তো কবি হতেন। বিহারীলাল রবিকে বোঝাসেন যে রবি যখন জমিদার হিসেবে পরিদর্শনে এসেছেন, তখন ডিষ্টি ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে একবার অন্তত সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকার বিশেষ জরুরি।

ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালস সাহেবের কাছে রবির বিস্তৃত পরিচয় জানিয়ে আগে একটি চিঠি পাঠালেন বিহারীলাল, বিকেলবেলা রবিকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন সাহেবের বাংলোতে। তাঁদের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রেখে চাপরাশি ভেন্ত্র থেকে ঘুরে এসে জানাল যে সাহেব-মেম ব্যস্ত আছেন, কাল সকালবেলা এলে দেখা হতে পারে। অপমনে রবির মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। যেচে এসে এ রকম প্রত্যাখ্যানের অপমান সহ্য করতে হল!

বিহারীলাল অবশ্য ফেরার পথে বারবার লতে লাগলেন, নিশ্চয়ই কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এ রকম তো হবার কথা না। খানিকবাল ম্যাজিস্ট্রেট গিন্নির চিঠি এল, তাতে দুঃখ প্রকাশ করে জানানো হয়েছে যে, চাপরাশি আগের চিঠিটি দিতে ভুল কবেছে, না হলে ডিস্ট্রিক্ট জজের সঙ্গে ডিষ্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সব সময়ই দেখা করতে প্রস্তুত। কাল সবাইকে অবশ্যই ডিনারে আসতে হবে ইত্যাদি।

এ চিঠিও রবির পক্ষে সম্মান জনক নয় একজন জমিদার তথা লেখক বাড়ির দ্বার থেকে ফিরে এসেছেন সেটা বড় কথা নয়, ডিস্ট্রিক্ট জজ মিঃ গুপ্ত ফিরে গেছেন, সেটাই প্রটোকল হিসেবে ঠিক হয় নি। সেই জন্য ডিনার। রবির আবার যবার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু বিহারীলাল নাছোড়বান্দা। স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেট পত্নী চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, এখন না গেলে তিনি অপমানিত হবেন।

মরা অপমান গিলে ফেলতে পারি, কিন্তু রাজ্ঞার জাতকে তো অপমান করা যায় না। ভুল ভাঙাভাঙির দায়িত্ব বিহারীলাল নেবেনই। রবি বারবার না না বলতে পারেন না, অগত্যা বিহারীলালের সম্মান রক্ষার্থে তাঁকে যেতেই হল। তারপর শুধু কৃত্রিম হাসি আর আমড়াগাছি কথাবার্তা। রবির মন তিক্ত হয়ে ছিল, কিছুতেই সহজ হতে পারেন নি। ডিনার টেবিলে বসার সময় ম্যাজিস্ট্রেট গিন্নি বললেন, কোনও রকম গো-মাংসের ডিশ রাখা হয় নি, আপনারা তো হিন্দু, অপনাদের জাত যাবার সম্ভাবনা নেই!

সম্প্রতি গো-বক্ষা নিয়ে যে আন্দোন চলছে, সেই ইঙ্গিত করে একটা খোঁচা মারা হল। বিহারীলালের মুখ চেয়ে রবি কোনও উত্তর দিলেন না। লোককে আমন্ত্রণ করে তার রুচিমতন আহাই তো পরিবেশন করা উচিত, সাহেব-সুবাদের ডেকে আমরা কি খুব ঝাল রান্না তাদের পাতে দিই?

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আবার গান কনে। খানিকটা সুরাপানের পর তিনি গান জুড়ে দিলেন। বিহারীলালই বা ছাড়বেন কেন? তাঁর সঙ্গী এই তরুণ জমিদারটিও যে একজন প্রসিদ্ধ গায়ক সে কথা বলতে লাগলেন সাতকাহন কবে। রবি বারবার বিহারীলালকে ভুরুর ইঙ্গিতে নিষেধ করতে লাগলেন, এখানে গান গাইবাব তাঁর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই, বিহারীলাল বুঝছেনই না। ম্যাজিস্ট্রেটের যুবতী শ্যালিকা বিস্মিত চোখে বলল, রিয়েলি? ইনি একজন সিংগার? আমি কখনও ইন্ডিয়ান সং শুনিনি।

ববিকে গাইতেই হল। এমন অনিচ্ছুক ভাবে তিনি জীবনে কখনও–গান করেন নি। এই শ্বেতাঙ্গরা কথা বলছে ওপর থেকে, এরা পিঠ চাপড়াচ্ছে। এ গানের মর্ম কিছুই বুঝছে না। তবু হাততালি দিচ্ছে, বাচ্চাদের আধো আধো বুলি শুনে বয়স্করা যে-রকম হাততালি দেয়।

রবির মুখে একটা তিক্ত স্বাদ লেগে রইল। বাড়ি ফিরে সে বিহারীলালকে দৃঢ় স্বরে জানিয়ে দিল, আর কোনও ইংরেজ বাণে পুরুষের সঙ্গে সে দেখা করতে মোটেই রাজি নয়। জমিদারি কাজের জন্যও ওদের সংস্পর্শে যাবার কোনও প্রয়োজন নেই।

কটকে ফিবে আসার পর আরও বিপত্তি ঘটল। আজই সন্ধের ঘটনায় রবি এত ক্রুদ্ধ হয়েছেন যে তা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না।

বিহারীলাল বাড়িতে লোকজনদের না ডেকে পারেন না। মানুষজনদের না খাইয়ে সৌদামিনীর তৃপ্তি নেই। রবি অন্য কোথাও কারুর বাড়িতে দেখা করতে যাবেন না। কিন্তু এ বাড়িতে তো স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। ওড়িশার কবিরা সবাই বাংলা পড়েন, তাঁরা রবির কবিতার অনুরাগী, অগ্রগণ্য কবি মধুসুদন রাও রবিকে তাঁর কবিতা শোনাতে চান, তাঁরা তো আসবেনই। মধুসূদন রাও আবার স্থানীয় ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য। এর মধ্যে এক রবিবার ওড়িয়াবাজারেব ব্রহ্ম মন্দিরে উপাসনা সভায় রবিকে যেতে হয়েছিল। তিনি আদি ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক, এখানকার ব্রাহ্মরা ছাড়বেন কেন! রবির গান গাইবার কথা ছিল, কিন্তু গান গাইবেন কি, বেদিতে বসে মধুসুদন রাও ঝাড়া দেড় ঘন্ট বক্তৃতা দিলেন, রবির গান গাইবার মেজাজই নষ্ট হয়ে গেল। প্রার্থনা সভায় এত লম্বা লম্বা বক্তৃা রবির একেবারেই পছন্দ নয়। এর পরে মধুসূদন রাওয়ের কবিতা শোনার ব্যাপারেও রবির ভীতিজন্মে গেছে।

ইংরেজ রাজপুরুষদের সঙ্গে মিশতে চান না রবি, কিন্তু ইংরেজ শিক্ষকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে তাঁর আপত্তি থাকার কথা নয়। বিহারীলাল তাই আঃ ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এখানকার রাভেন শ’ কলেজের প্রিন্সিপাল হলয়ার্ড সাহেবকে। কিন্তু এই নাকি এক কলেজ অধ্যক্ষের ছিরি। লোকটির দৈত্যের মতন চেহারা। থ্যাবড়া নাক, ধুর্তে মতন চোখ, মুখখানাই প্রকাণ্ড, ঘ্যাড়ঘেড়ে গলার আওয়াজ, অনেক শব্দ বোঝাই যায় না। অধ্যক্ষর বদলে নগরকোটাল হলেই যেন তাকে বেশি মানাত। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ছোটলাট স্যার র্পস ইলিয়টের সঙ্গে এই হলয়ার্ডের দোস্তি আছে, তাই সবাই তাকে বেশি বেশি খাতির করে, ভয় পায়। ছাত্রদের কাছেও এই অধ্যক্ষ একেবারেই জনপ্রিয় নয়। কলেজ শুরু হয় সাড়ে দশটা, হলয়ার্ড নিয়ম করেছিল যে গেটের তালা দশটা পঁচিশের আগে খোলা হবে না। রোদুর কিংবা বৃষ্টি মধ্যে ছাত্রদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তালা খোলার পর সবাই হুড়হুড় করে ঢোকে, সে এক বিশ্রী ব্যাপার। কোনও একটি ছাত্র একদিন গেটের তালাটা চুরি করে নিয়েছিল, সেই জন্য শাস্তি পেতে হয়েছিল বহু ছাত্রকে।

হলয়ার্ডের চেহারা ও কর্কশ ব্যবহার দেখে রবি প্রথম থেকেই তাকে অপছন্দ করেছিলেন। এমন উৎকট ইংরেজ খুব কম দেখা যায়। রবি প্রায়ই ভাবেন, ইংল্যান্ডে তিনি কত ভদ্র, সভ্য, নম্র ইংরেজদের সঙ্গে মিশেছেন, মার্জিত ব্যবহার সে সব ইংরেজদের সঙ্গে বেশ মেশা যায়। এ দেশে এসেই ইংরেজরা এত অভদ্র হয়ে যায় কী করে? কিংবা বেছে বেছে অভদ্র, গৌয়ারগগাবিন্দদেরই পাঠানো হয় ভারতবর্ষে? এই হলয়ার্ড অনাদের কথা বলর সুযোগ দেয় না, নিজেই বেশি বকবক করে। খাবার টেবিলে বসেই তো অসভা শুরু করে দিল।

এ বাড়িতে রবি প্রধান অতিথি, তাঁর সঙ্গে পরিচয় করবার জন্যই সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কিন্তু হলয়ার্ড রবিকে পাত্তাই দিল না। কে একজন বাংলা কবিতা লেখে কি না লেখে তাতে তার কিছু যায় আসে না। একবার সে শুধু রবিকে লল, তুমি ইংরিজিতে কিছু লেখার চেষ্টা করো না? তারপরই চলে গেল প্রসঙ্গান্তরে। এই আসরে সে এক মাত্র ইংরেজ, সুতরাং তার কথাই শেষ কথা।

ইংরেজদের মহলে এখন মুখ্য আলোচনার বিষয় দুটি। গোরুর মাংসের মতন একটি সুখাদ্য খাওয়া হবে কি হবে না, তা নিয়ে নেটিভদের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি। আর দ্বিতীয়টি হল, বিচার ব্যবস্থায় জুরি প্রথা। লেফটেনান্ট গভর্নর স্যার চার্লস ইলিয়ট কিছুকাল আগে এক আদেশ জারি করে বাংলার কয়েকটি জেলায় জুরি ব্যবস্থা হেঁটে দিয়েছিলেন, তা নিয়ে প্রবল প্রতিবাদ ওঠে। শিক্ষিত সমাজ পত্র পত্রিকায় সরকারের এই আচরণের নিন্দা করে, ইংরেজদের কাগজগুলো আবার এই সব শিক্ষিত ভারতীয়দের কুকুর বাঁদরদের সঙ্গে তুলনা করে। সরকারি আদেশ এখন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বটে, কিন্তু ঝগড়ার জের মেটেনি।

খাবার টেবিলে বসে সুরায় চুমুক দিয়ে হলয়ার্ড বিহারীলালকে জিজ্ঞেস করল, তুমি তো একজন জজ, তুমি এই জুরি ব্যবস্থা সম্পর্কে কী বলে?

বিহারীলাল বলেন, ইংল্যান্ডে যদি এই জুরি ব্যবস্থা থাকতে পারে, তাহলে ভারতেই বা থাকবে না কেন? আইন তো একই।

হসয়ার্ড অট্টহাসি করে বলে উঠল, তুমি বলো কী গুপ্ত? ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে এদেশের লোকদের তুলনা? ইংল্যান্ডের লোকদের একটা মাল স্ট্যান্ডার্ড আছে। সেন্স অফ রেসপনসিবিলিটি আছে।

–এ দেশের লোকের নেই?

–কোথায়? কোথায়? নেটিভদের মধ্যে থেকে বেছে জুরি করলে দেখবে তারা ঘুষ খাবে। মিথ্যে কথা বলবে। আইনের পবিত্রতা রক্ষা করবে না।

—এ দেশের সবাই এরকম?

–আলবাত। আমি ছাত্র ছড়িয়ে খাই, আমি জানি না? শয়তানের হাড্ডি সব!

একটু থেমে, সকলের দিকে অকিয়ে হলয়ার্ড বলল, যে বি, দা প্রেজেন্ট কম্পানি এগজেটেড। কিন্তু আমি দেখেছি, এ দেশের অধিকাংশ লোক অসং। মিথ্যেবাদী। এরা জুরি সেজে ইংরেজদের বিচার করবে? অডাসিটি আর কাকে বলে। আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি, নেটিভদের মরাল স্ট্যান্ডার্ড লো, লাইফ-এর সেক্রেডনেস সম্পর্কে কোনও বিশ্বাস নেই…

লোকটি এই কথাই বলে গেল অনবরত। রবি প্রতিবাদ করতে গেলেন দু একবার, কিন্তু হায়ার্ড হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়েই বাজিমাৎ করতে চায়। রবি মরে গেলেও অত গলা তুলে কথা বলতে পারবেন না।

আশ্চর্য এই যে হলয়ার্ডের এই সব কথার মধ্যেও অনেকে হাসল, কৃতার্থ হয়ে যাবার ভাব করে তাকিয়ে রইল। অনেকখানি খাদ্য-পানীয় গলাধঃকরণ করে হলয়ার্ড যখন হঠাৎ এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এবার আমাকে যেতে হবে, তখন অনেকে হেঁ হেঁ করে তাকে এগিয়ে দিতে গেল, কেউ কেউ নিজের সন্তানের শিক্ষার কথাও বলল ফিসফিস করে।

এ দেশে বসে, এ দেশের একজন মানুষের বাড়িতে আমন্ত্রিত হয়ে এসে, এদেশের সব মানুষকে কুৎসিত ভাষায় গালি দিয়ে গেল একজন লোক। রাজার জাত বলেই তার এত সাহস? আমরা সকলে মিলে এর প্রতিবাদ করতে শিখব কবে?

সেই থেকে রবির মাথায় আগুন জ্বলছে, আজ আর ঘুম আসবে না কিছুতেই।

একটু পরে রবি পাশের ঘর থেকে বলুকে ডেকে তুললেন। বলেন্দ্র এখন তেইশ, চব্বিশ বছরের যুবক, রবি ইদানীং এই ভ্রাতুস্পুত্রটিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে আসছেন মাঝে মাঝে, তাকে জমিদারির কাজ শেখাচ্ছেন তো বটেই, তার সঙ্গে সাহিত্য আলোচনাতেও অনেক সময় কাটানো যায়। জোড়াসাঁকোর বাডিতে অল্পবয়সীদের মধ্যে বলেন্দ্ররই সত্যিকারের সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেছে। বলেন্দ্রব একটাই দোষ, সে বড় বেশি লাজুক, সে লোকজনের সামনে মুখ তুলে কথাই বলতে পারে না।

বলেন্দ্র ধড়মড় করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, রবিকা?

রবি ধমকের সুরে বললেন, ‘সাধনা’র জন্য তোকে লেখা তৈরি করতে হবে না? শুধু পড়ে পড়ে ঘুমোলেই চলবে? এত ঘুম ভাল নয়!

রাত্রির তৃতীয় প্রহর, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, বলের ঘর অন্ধকার, রবির ঘরে একটা হ্যাজাক বাতি রাখা আছে এক কোণে। এই রকম সময় হঠাৎ লেখার কথা?

রবি বললেন, তুই কতখানি লিখেছিস, আমাকে দেখা। আমি সংশোধন করে দিচ্ছি। কাল-পরশুই কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে হবে।

বলে নিজের লেখা কয়েকটি পৃষ্ঠা নিয়ে এ রবির ঘরে। হ্যাজাকটা তুলে রবি টেবিলে বসলেন। বলের অধিকাংশ লেখাই রবি নিজে দেখে দেন, কোথাও ভাষা বদল করেন, কোথাও জুড়ে দেন কয়েকলাইন, বলে পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, শেখে।

রবি মনঃসংযোগের চেষ্টা করলেন কয়েক মিনিট। তারপর মুখ তুলে বলেন, আজকের এই সাহেবটা যে আমাদের অপমান করে গেল, তুই কিছু বলি না কেন?

বলেন্দ্র বলল, লোকটা অতি অসভ্য। রবিকা, তুমিও তেমন প্রতিবাদ করলে না। আমি আর কী বলব।

রবি বললেন, আমি বলব কী, ও গাঁ গাঁক করে যাঁড়ের মতন চাচাচ্ছিল যে! একটি খাটি জন্‌বৃষ!

বলেন্দ্র বসল, লোকটা র-অক্ষরটা উচ্চারণই করে না, অনেক কথা বোঝা যায় না।

রবি বললেন, বলু, আমরা শুধু ওদের সহ্য করি, তাই না। তার ওপর আবার ওদের বাড়িতে ডেকে আনি, ওদের আদর কাড়তে যাই অবনতির একশেষ! ওদের উচ্ছিষ্ট, ওদের আদরের জন্য আমার তিলমাত্র প্রত্যাশা নেই। আমি তাতে লাথি মারি।

বলেন্দ্র চমকে উঠল। রবিকাকার মুখে এ ধরনের ভাষা সে কথনও শোনে নি।

রবি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আবার বললেন, মুসলমানের কাছে যেমন শুয়োরের মাংস, ওদের আদর আমার পক্ষে তেমন। যাতে আত্ম অবমাননা করা হয়, তাতেই তো যথার্থ জাত যায়। জানিস বলু, আমাদের ভারতবর্ষের সবচেয়ে ভাঙা কুটিরের, সবচেয়ে মলিন চাষিকেও আমি আপনার লোক বলতে কুণ্ঠিত হব না, আর যারা ফিটফাট কাপড় পরে ডগকার্ট হাঁকায়, আর আমাদের নিগার বলে, তারা যতই সভ্য, যতই উন্নত হোক—আমি যদি কখনও তাদের কাছাকাছি যাবার জনো লোভ করি, তা হলে যেন আমার মাথার ওপর জুতো পড়ে।

বলেন্দ্র ব্যাকুল ভাবে বলল, রবিকা, রবিকা।

রবি বললেন, এই লোকটার কথা শুনে আমার যে কী রকম করছিল, তোকে কী বলব। আমার বুকের মধ্যে রক্ত একেবারে ফুটছিল, এখনও–

বলেন্দ্র বলল, আর থাক, আর থাক, রবিকা। এখন আর ও নিয়ে ভেবো না। তুমি বরং একটা গান গাও–

রবি বললেন, এখানে আর একদিনও থাকব না। কালই আমরা বালিয়া চলে যাব! এখানে আর আমার গান আসবে না।

ক্রোধেব নিবৃত্তি হল বালিয়াতে গিয়ে। সেখানে ক’দিন ধরেই অশ্রান্ত বৃষ্টি। জমিদারির কাজকর্ম সেরে ফেরার পথে ভুবনেশ্বরের মন্দিরগুলি, উদয়গিরি-খণ্ডগিরি দেখে আবার চলে এলেন কটকে। ভারতের মহান ঐতিহ্যের এই শিল্প নিদর্শনগুলি দেখার পর রবির মন থেকে সব গ্লানি দূর হয়ে যায়।

কটকে এসে ওঁরা আবার উঠলেন বিহারীলালের বাড়িতেই। গুপ্ত দম্পতি অত্যন্ত সজ্জন, তাঁদের ওপর রাগ করে থাকা যায় না। চাকরির সুত্রে বিহারীলালকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহেবদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেই হয়। কিন্তু মনে মনে তাঁরা স্বদেশি। রবিদের পরিবারের সঙ্গে এদের সম্পর্ক অনেক দিনের।

এবারে আর বিহারীলাল সামাজিক অনুষ্ঠানাদির দিকে গেলেনই না। সৌদামিনী তাঁর ‘সখি সমিতির উদ্যোগে শুরু করলেন ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকের মহড়া। রবিকে অনুরোধ করলেন গানের সুরগুলি ঠিকঠাক দেখিয়ে দিতে।

এ কাজ রবির খুবই পছন্দ। তাঁর গান অন্য কেউ গাইলে তিনি বেশ শ্লাঘা অনুভব করেন। চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, রামপ্রসাদ, নিধুবাবুর মতন তাঁর গানও কি একদিন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে? এই বত্রিশ বছর বয়েসের মধ্যেই কম গান তিনি লেখেননি। কলকাতার রঙ্গমঞ্চে এখন তাঁর গান গাওয়া হয়, কিন্তু বাংলার বাইরে রবি তাঁর গান অন্যের মুখে এই প্রথম শুনলেন।

‘বাল্মীকি প্রতিভা’র বিভিন্ন চরিত্রে যারা অভিনয় করছে, তাদের সকলেরই উচ্চারণ বা সুর এখনও ঠিক সড়গড় হয়নি। বাল্মীকির ভূমিকায় হেরম্বচন্দ্র নামে স্থানীয় এক শিক্ষকের অভিনয় বেশ আড়ষ্ট। গানের গলা আছে, কিন্তু কথায় কথায় তাল দেবার দিকে ঝোঁক। অন্যরা মোটামুটি চলনসই, শুধু মহিলামণি নামে একটি তরুণীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন রবি। এই চঞ্চলা তরুণীটি অন্যদের সঙ্গে ওড়িয়া ভাষায় কথা বলে, আবার নাটকের মহড়ার সময় তার বাংলা উচ্চারণ একেবারে নির্ভুল, একটু টানও নেই। শুধু তাই নয়, অন্যরা কেউ দু’একটি পংক্তি ভুলে গেলে মহিলামণি বই না দেখেই তা বলে দেয়। অর্থাৎ পুরো নাটকটিই তার মুখস্ত।

অভিনয় প্রতিভা অনেকের সহজাত ভাবেই থাকে। আবার কারুর কারুর অনেক ঘষামাজাতেও কিছু হয় না। বাল্মীকির ভূমিকাটি ফুটছে না একেবারেই।

রবি এক সময় মহিলামণির তারিফ করে বললেন, তুমি দেখছি সব গানগুলিই শিখে নিয়েছ, ইচ্ছে করলে তুমি বোধহয় বাল্মীকি সাজ্জতেও পারো।

মহিলামণি সঙ্কোচে মাথা নিচু করল।

ইঙ্গিতটি বুঝতে পারলেন সৌদামিনী। তিনি বলেন, কী আশ্চর্য হেরম্ব, তুমি তো আগে এর চেয়ে অনেক ভাল শিখেছিলে। এখন ভুল করছ কেন?

হেরম্বচন্দ্র বলল, স্বয়ং নাট্যকারকে দেখে আমার সব গুলিয়ে গেছে। তা ছাড়া, উনি নিজে এই ভূমিকায় মঞ্চে নেমেছিলেন, সেই কথা ভেবেই আমার হাত-পা গুটিয়ে যাচ্ছে। এর তুলনায় আমি তো নিতান্তই তুচ্ছ!

একথা ঠিক, রবি উপস্থিত থাকলে মেয়েদের তুলনায় পুরুষরা সবাই যেন আড়ষ্ট হয়ে যায়। যেন তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে। রবির মতন এমন রূপবান ও মধুর স্বভাব সম্পন্ন পুরুষ দুর্লভ। মেয়েরা তাঁর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, পুরুষদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। রবি আসবার আগে মহড়ার সময় হেরম্বচন্দ্রের নায়কোচিত দাপট ছিল, এখন স্বয়ং নাট্যকারই নায়ক, সে একটি পার্শ্বচরিত্র মাত্র। নাট্যকারও নারীদের প্রতি যত মনোযোগী, পুরুষদের প্রতি ততটা নন। রবির স্বভাবই এই, অচেনা পুরুষদের সঙ্গে তিনি সহজে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না, কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে অনায়াসেই তাঁর সখ্য হয়ে যায়।

হেরচন্দ্র হাত জোড় করে বলল, আমি একটা প্রস্তাব নিবেদন করব? আমাদের এই নাটক মান্যগণ্য অনেকেই দেখতে আসবেন। আমাদের সৌভাগ্যবশত স্বয়ং রবীন্দ্রবাবু যখন এখানে উপস্থিত আছেন, তিনিই বাল্মীকির ভূমিকা গ্রহণ করুন। তা হলেই পালাটি সবঙ্গ সুন্দর হবে। আমি ঠিক পারছি না, আমি সরে দাঁড়াচ্ছি।

অনেকেই সমর্থনসূচক শব্দ করল। সৌদামিনী দারুণ আগ্রহের সঙ্গে চেয়ে রইলেন রবির দিকে।

রবি মাথা নেড়ে সহাস্যে বললেন, ‘তা হয় না। নাটক রচনা করে এমনই কী অপরাধ করে বসেছি যে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে আমায় তা অভিনয় করেও দেখাতে হবে? সঙ্গীত যিনি রচনা করেন, এক সময় তিনি তুচ্ছ হয়ে যান, বিভিন্ন গায়কেরাই সে সঙ্গীতের যথার্থ রূপ ফুটিয়ে তোলেন। আমি এখানে দর্শকের আসনেই বসতে চাই। হেরম্ববাবু, আপনি অবশ্যই পারবেন।

তিন চারদিন মহড়াতে বসেই রবি সকলকে চিনে গেলেন। মহিলামণিই তাঁকে সবচেয়ে মুগ্ধ কবেছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তিনি সৌদামিনীর কাছ থেকে ওর সম্পর্কে সব খবরাখবর জেনেছেন, এমন এক প্রাণোচ্ছল তরুণীকে অকালবৈধব্যের যাতনা বয়ে যেতে হবে সারাজীবন? সৌদামিনীর সাহচর্যে এসে সে বাইরের পৃথিবীর অনেক কথা জেনেছে, খানিকটা যেন মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। কিন্তু বিহারীলালের বদলিব চাকরি, তাঁরা তো কটকে বেশিদিন থাকবেন না। তাঁরা চলে গেলে এই মেয়েটি আবার যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরে?

রবিই প্রস্তাব করলেন, আচ্ছা, ওই যে ভরত নামে ছেলেটিকে দেখি পেছনের দিকে চুপ করে বসে থাকে, নিজে থেকে কোনও কথাই বলতে চায় না, যেন অন্যেই সব কথা বলবে, ও শুধু শুনবে, ওর কি বিবাহ হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে, তা হলে এই দু’জনকে মিলিয়ে দেবার জন্য ঘটকালি করলে হয় না?

সৌদামিনী বললেন, কে ঘটকালি করবে? তুমি? এখানে বিধবা বিবাহের প্রচলন নেই।

রবি বললেন, কারুকে তো শুরু করতে হবে? নইলে প্রচলন হবে কী করে? এই যুবকটি সেই সাহস সঞ্চয় করতে পারবে কি না, সেইটা জানাই আগে দরকার।

সৌদামিনী বললেন, আমি দু’একবার ইঙ্গিত দিয়েছি। ভরতের বিবাহে মন নেই মনে হয়।

ভরত পারতপক্ষে রবির কাছ ঘেঁষে না। এই কবির কবিতা সে কৈশোরকাল থেকে পছন্দ করে, মুখস্থও বলতে পারে এখনও অনেক লাইন, কিন্তু এর সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত হবার ব্যাপারে তার একটা আশঙ্কা আছে। ভরত জানে, রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে ত্রিপুরার রাজ সরকারের যোগাযোগ আছে। সেই জন্যই ভরত এঁর কাছে নিজের পরিচয় কোনওক্রমেই জানাতে চায় না। এর মধ্যেই একবার রবি ভরতের উচ্চারণ শুনে বলেছেন, বাড়ি কোথায়? কুমিল্লা, নাকি সিলেট?

নিজের পার্টের সময়টুকু ছাড়া আর মুখ খোলে না ভরত। মহিলামণিকে সে চক্ষু দিয়ে অনুসরণ করে, কিন্তু এখন আর তার বুক কাঁপে না। একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে মহিলামশির মুখে একটা পাশের সঙ্গে ভূমিসূতার মুখের যথেষ্ট মিল আছে ঠিকই, এই পৃথিবীতে কত মানুষ, একজনের সঙ্গে আর একজনের চেহারার কিছুটা সাদৃশ্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কিন্তু ভরত ইতিমধ্যেই জেনে গেছে যে ভূমিসূতার সঙ্গে মহিলামণির আর কোনও সম্পর্কই নেই। আত্মীয়তা দূরে থাক, ভূমিসূতা নামে সে কারুকে চেনে না। সুতরাং এখন আর মহিলামণি সম্পর্কে ভরতের কৌতূহল বা আগ্রহ নেই, মহিলামণির মুখের একটি পাশ যখন ভূমিসূতার মতন দেখায়, তখন শুধু সেইটুকু সে দেখে।

ঘটকালির বাপারে রবির খুব উৎসাহ। যে সব মেয়েরা নিছক অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকে না, স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসে, নিজস্ব কোনও গুণপনার পরিচয় দেয়, সে রকম কারুর সঙ্গে একবার পরিচয় হলে রবি তাদের একেবারে হারিয়ে ফেলতে চান না। তিনি চান, তারা কাছাকাছি থাকুক। পরিচিত কারুর সঙ্গে বিবাহ হলে সংস্পর্শ থেকে যায়।

ভরতের কাছে বিবাহের প্রস্তাব দেবার বদলে রবি তার কাছে বলেকে পাঠালেন। ভরত এখানকার একটি ব্যাঙ্কের হিসাবরক্ষক, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র, তাকে অন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। শিলাইদহে একজন নতুন ম্যানেজারের প্রয়োজন। জোড়াসাঁকোর বাড়িতেও খাজাঞ্চিখানায় এরকম একজন উপযুক্ত লোক পেলে ভাল হয়। বলেকে সে রকম কথাই বলে পাঠালেন রবি।

চতুর্ভুজ নামে কাজের লোকটি ছুটি নিয়ে বাড়ি যাবার নাম করে আর ফেরেনি, ভরতের ক্ষুদ্র সংসারটি এখন নিজেকেই সামলাতে হয়। মোটামুটি রান্নার কাজ ভরত নিজেই চালাতে পারে, কিন্তু স্বভাবটি তার বড় অগোছালো, তার জিনিসপত্র সব ছড়ানো থাকে এদিকে সেদিকে। বিছানাটা পাতাই থাকে দিনের পর দিন, গুটিয়ে রাখা হয় না। সেই ভোলা বিছানায় থাকে দুএকখানা বই, ময়লা জামা, ভিজে গামছা।

বলেন্দ্র ধনীর সন্তান, দাস-দাসী পরিবৃত সংসারে মানুষ, নিজের হাতে কোনও কিছু করতে শেখেনি, লেখা-পড়া ও সঙ্গীত-শিল্পের চচাতেই বর্ধিত হয়েছে। একটি অবিবাহিত যুবকের এমন ছন্নছাড়ার মতন সংসার দেখার অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম। সে এসে দেখল, ভরত নামে এই গ্র্যাজুয়েট যুবকটি কোমরে একটি গামছা বেঁধে, একটি ঝাঁটা নিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ঘরের কোণ থেকে আরশোলা মারছে।

আরশোলা নামক প্রাণীটিকে, প্রাণী বা পতঙ্গ যাই-ই হোক, বলে বড়ই ভয় পায়। তটস্থ হয়ে সে দরজার কাছ থেকে সরে গেল।

ভরত তাকে দেখে কুষ্ঠিতভাবে বলল, ইস, আপনি এলেন, কোথায় যে আপনাকে বসতে বন্সি। এই বর্ষার সময়ে বড় পোকামাকড়ের উপদ্রব হয়! সকালেই খাটের তলা থেকে একটা তেতুলে বিছে বেরিয়েছে। ব্যাটাকে মেরে ফেলেছি অশ্য।

তেঁতুলে বিছের নাম শুনেই বলের একটি লম্ফ দিতে ইচ্ছে হল। সভয়ে তাকিয়ে দেখল, দ্বিতীয় কোনও বিছে পায়ের কাছে ঘোরাফেরা করছে কি না। তেঁতুলে বিহেরা ব্যাচেলারের মতন একা একা থাকে এমন কখনও শোনা যায়নি, তাদের সঙ্গী-সাধী কাছাকাছি থাকতেই পারে।

হাত ধুয়ে, গামছাটা খুলে রেখে এসে ভরত বলেকে নিয়ে বাইরের রকে বসল। গল্প হল কিছুক্ষণ। ভরত অবশ্য এখানকার ব্যাকের চাকরি ছেড়ে, ঠাকুরদের জমিদারিতে চাকরি নিতে রাজি নয়। এখানেই সে বেশ আছে।

ভরতকে বেশ পছন্দই হল বলের। ফিরে গিয়ে রবিকাকাকে সব বিবরণ দিতে দিতে বলল, জানো, ওর এই একলা একলা গৃহস্থালি আমার বেশ লেগেছে। বিদেশের কোনও গল্পের নায়কের মতন। তবে, ওসব দেশে আরশোলা কিংবা তেঁতুলে বিয়ে থাকে না বোধ হয়।

সৌদামিনী বললেন, বকে দিয়ে হবে না, তুমি নিজে কথা বলে দেখো, রবি।

পরের দিন সারা দিন বৃষ্টি, অঝোরে বৃষ্টি, আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। বিকেল পাচটা থেকে মহড়া শুরু হওয়ার কথা, কেউ আসেনি। জজসাধ্যে অবশ্য যথাসময়ে আদালতে গেছেন, দুপুরে রবি কিছুক্ষণ ‘নেপালি বুদ্ধিস্ট লিটরেচার’ নামে একটি বই পড়েছেন, কিন্তু সাধনার অন্য একটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। বলেকেও শিখতে বসিয়ে দিলেন, কোনও এক ফাঁকে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু একেবারেই দিবানিদ্রার অভ্যেস নেই।

একসময় রবি একটা গান শুনতে পেলেন। কৌতূহলী হয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। সুর শুনে অনুসরণ করতে করতে তিনি এলেন মহড়ার ঘরটিতে। বাংলোর পেছন দিকে প্রশস্ত এই ঘরটিতে অন্য সময় সখি সমিতির অধিবেশন হয়। এখন প্রায় প্রতিদিনই থিয়েটারের মহড়ার শেষ পর্ব চলছে।

ঘর জোড়া সতরঞ্চি পাতা, তার ওপর রাখা রয়েছে দুটি তানপুরা। এই ঘরে সবই কাচের জানলা। বাইরের প্রান্তর ও দূরের গাছপালার রেখা স্পষ্ট দেখা যায়। একটি খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টি মাখানো বাতাস ভেতরে এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। সেই জানলার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মহিলা মণি। আর কেউ আসেনি। কিন্তু এই দুর্যোগের মধ্যেও তার গরজ এমন বেশি যে সে না এসে পারেনি। ভিজে গেছে তার শাড়ি। তার আলুলায়িত চুল থেকে ঝরে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা জল। গুনগুনিয়ে সে গাইছে : এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরিষায়…।

দূরে দাঁড়িয়ে রবি নিঃশব্দে শুনতে লাগলেন সেই গান। কোনও নিপুণ শিল্পীর আঁকা ভাল ছবি দেখলে যেরকম মুগ্ধতাবোধ হয়, কোনও উত্তম কাব্যের বর্ণনাংশ পড়লে যেমন হৃদয় উদ্বেল হয়ে ওঠে, সঙ্গীতরতা মহিলামণিকে দেখে রবিরও সেইরকম অনুভূতি হল। এ যেন মেঘদূতের সেই কশ্চিৎ বিরহী কান্তা, মেঘের উদ্দেশে জানাচ্ছে তার হৃদয়বেদনা।

রবি আরও গভীর তৃপ্তির আচ্ছন্নতা বোধ করলেন এই কারণে যে, এই নায়িকাটি কালিদাসের রচনা উচ্চারণ করছে না, গাইছে তাঁরই রচিত গান। নিজের সৃষ্টির এমন মূর্ত রূপ দেখলে কোন স্রষ্টার না আনন্দ হয়?

মহিলামণি হঠাৎ রবির উপস্থিতি টের পেয়ে মুখ নিচু করল। রবি বললেন, থামলে কেন? সম্পূর্ণ গানটা গাও, বেশ গাইছিলে।

মহিলামণি বলল, আর জানি না।

রবি বললেন, গাও, আমি তোমায় শিখিয়ে দিচ্ছি :

…সমাজ সংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব–
আঁধারে মিশে গেছে আর সব…

শিল্পের এমনই নিগূঢ় রহস্যময় টান যে এক এক সময় সত্যিই যেন সমাজ-সংসার সব তুচ্ছ হয়ে যায়। সেসবের কথা কিছুই মনে পড়ে না। এক মুগ্ধ রমণীর কণ্ঠে নিজের গান তুলিয়ে দিচ্ছেন এক কবি। বর্ষার সেই গানের সঙ্গে সঙ্গত করছে বৃষ্টিপাতের ধ্বনি, এখন শুধু এটাই সত্য।

এই নাটকটিকে উপলক্ষ করে কয়েক দিনের মধ্যেই একটা বেশ বড় নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল।

অভিনয়ের দিনক্ষণ সব ঠিক হয়ে গেছে, মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে বিহারীলালের বাড়িরই উদ্যানে। কটক শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে আমন্ত্রণ পাঠানো হচ্ছে। বলেন্দ্রনাথ মহা উৎসাহে মঞ্চ সাজাবার পরিকল্পনায় মেতে উঠেছেন, এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত।

যে-দিন পাত্রপাত্রীদের সাজসজ্জা পরে মহড়া হবার কথা, সেইদিন মহিলামণি এল না। নাটকের ব্যাপারে তারই সবচেয়ে বেশি উৎসাহ, প্রতিদিন সে সকলের চেয়ে আগে আসে, মাঝে মাঝে সে সারা দিনই এ বাড়িতে কাটায়, তবে কি সে অসুস্থ হয়ে পড়ল?

একজন আলিকে পাঠানো হল মহিলামণির বাড়িতে। আদালি ফিরে এসে বিশেষ কিছু খবর দিতে পারল না। মহিলামণি অসুস্থ কি না তা জানা যায়নি, সে বাড়ির একজন লোক শুধু বলে দিয়েছে, যে মহিলামণি আসতে পারবে না।

এর পর স্বয়ং বিহারীলাল গেলেন এবং ফিরে এলেন মুখ চুন করে। নাটক বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। মহিলামণিকে আর পাওয়া যাবে না। ওর বদলে অন্য কোনও মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি তৈরি করা অসম্ভব।

মহিলামশির বাবা সুদামচন্দ্র নায়ক একজন সম্পন্ন ব্যবসায়ী, শহরের অনেকেই তাঁকে চেনে। উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিয়েছিলেন, কন্যার বয়েস তখন এগারো বছর। দুবছরের মধ্যেই মহিলামণির সেই স্বামীটি জলে ডুবে মারা যায়, ভরা বর্ষায় মহানদী নদীতে সে সাঁতার কাটতে গিয়েছিল। এর মধ্যে মহিলামণি একদিনও স্বামীর ঘর করেনি, স্বামীটিকে সে চিনই না, তার সব সাধ-আহ্লাদ সারা জীবনের মতন ঘুচে গেল। এটা ওই মেয়ের নিয়তি। সকলেরই ধারণা, পূর্বজন্মের কোনও পাপের জন্যই মেয়েরা অকালে বিধবা হয়। এ জন্মে শুদ্ধচারিণী থেকে সেই পাপ মোচন করতে পারলে পরজন্মে সেই স্বামীর সঙ্গেই মিলিত হওয়া যায়।

সদামচন্দ্র মেয়ের ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন না। মহিলামণি বাড়িতে লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিল, গানবাজনারও চর্চা করেছে। জজসাহেব ও তাঁর পত্নীকে এখানকার সবাই খুব শ্রদ্ধা করে, তাঁদের বাড়িতে গিয়ে মহিলামণি আনন্দে সময় কাটায়, তাতেও তার বাবার আপত্তি নেই। সুদামচন্দ্র নিজে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত না হলেও স্থানীয় ব্রাহ্মদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি আছে, কারণ ব্রাহ্মরা মদ্যপান করে না, রক্ষিতা পোষে না। শহরের অনেক ভদ্ৰশ্রেণীর মধ্যে ওই দুটি ব্যাপার অবাধে চলে। সুতরাং মেয়ে একটি ব্রাহ্ম পরিবারের সুস্থ সংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বলে সুদামচন্দ্ৰ খুশিই হয়েছিলেন।

কিন্তু পুরুষের সঙ্গে মিলে নাটক করা, সে যে এক অসম্ভব ব্যাপার। সমাজে সবাই ছি ছি কবে। বিহারীলালের সামনে হাত জোড় করে সুদামচন্দ্র বলেছেন, জজসাহেব, এ অনুরোধটা আমাকে করবেন না। জেনেশুনে আমার মেয়েকে অমি অধঃপতনের দিকে ঠেলে দেব? বিধবা মেয়ে মঞ্চে নাচবে? লোকে আমার মুখে চুনকালি দেবে।

কটক শহরে নাটকের ঐতিহ্য অনেক দিনের। বাঁধা মঞ্চে ওড়িয়া নাটকের অভিনয় হয়, কিন্তু সেখানে পুরুষ অভিনেতারাই মেয়ে সাজে। শাড়ি পরা পুরুষরা নানান আদিরসাত্মক অঙ্গভঙ্গি আর রং ঢং করে, তাতে দর্শকরা হেসে গড়াগড়ি যায়। প্রকাশ্যে কোনও মেয়ের অমন কিছু করা মানে তো সমাজ একেবারে রসাতলে যাওয়া।

কলকাতার ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা, মেয়েরা, ঘরের বউরা পর্যন্ত মিলেমিশে অভিনয় করে। সেই দেখাদেখি আরও কয়েকটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে এরকম পারিবারিক নাটকের চল হয়েছে। বিভিন্ন মঞ্চেও মেয়েরা এসে গেছে অনেক দিন। এখানে একেবারে ঘরোয়া অভিনয়ে মেয়েদের নিয়ে অভিনয় কালে যে কোনও আপত্তি উঠতে পারে, তা বিহারীলালের মাথাতেই আসেনি।

সুদামচন্দ্রকে তিনি অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, এটা তো পেশাদারি মঞ্চের অভিনয় নয়, টিকিট কেটে যে-কেউ দেখতে আসতে পারবে না। শুধুমাত্র গণ্যমান্য নাগরিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, অভিনয় হচ্ছে তাঁর নিজের বাড়িতে। কিন্তু সুদামচন্দ্র অনড়।

যে দারুণ কোনও শোকের ঘটনা ঘটে গেছে, সবাই তেমনভাবে ম্যুহমান হয়ে পড়ল। সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়লেন সৌদামিনী। তিনিই তো সকলকে শিখিয়ে-পড়িয়ে তৈরি করেছেন। মহিলামণি তাঁর নিজের হাতে গড়া।

সৌদামিনী ঝঝের সঙ্গে বলে উঠলেন, ওর বাবা অমন অন্যায় জুলুম করলেই বা আমরা মেনে নেব কেন? এত একটা গুণী মেয়ে…আমরা ওকে জোর করে নিয়ে আসতে পারি না।

বিহারীলাল ম্লানভাবে হাসলেন। তিনি মহামান্য বিচারক হয়ে এমন একটা বে-আইনি কাজ করবেন কী করে?

রবি কোনও মন্তব্য করলেন না। এরকম কত মেয়ে হারিয়ে যায় এদেশে। নিয়তিনির্ভর জাতি। এই নিয়তির বোঝা সরাতে না পারলে আলো আসবে কীভাবে। তিনি বলের দিকে তাকালেন। অর্থাৎ এবার তল্পিতল্পা বাঁধতে হবে। এই নাটকের জন্যই ওরা কলকাতায় ফেরা বিলম্বিত করেছিলেন।

সৌদামিনী আবার আপন মনে বললেন, ভরতের সঙ্গে যদি ওর বিয়ে হত, কেমন সুন্দর মানাত দুটিকে, তা হলে আর কেউ আপত্তিও করতে পারত না।

সকলেরই তখন মনে হচ্ছে, এটাই যেন সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। অনেকে ঘিরে ধরল ভরতকে। দুটি মেয়ে তখুনি চলে গেল মহিলামণির কাছে।

তারপর কয়েকটি দিনেব মধ্যেই দ্রুত পরিবর্তন হতে লাগল ঘটনার। বিহারীলাল তাঁর ওড়িয়া বন্ধুদের ধরলেন বিধবাবিবাহের ব্যাপারে সুদামচন্দ্রকে রাজি করাতে। বিদ্যাসাগরমশাই ওড়িশাতে মমাটেই অপরিচিত নন, ফকিরমোহন সেনাপতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবন চরিত অনুবাদ করেছেন বহু দিন আগেই। পত্র-পত্রিকায় বিধবাবিবাহ সম্পর্কেও লেখালেখি হয়।

মহিলামণির আপত্তি নেই। ভরত আপত্তি জানাবার সুযোগই পেল না, সৌদামিনী নিজের মায়ের মতন তাকে স্নেহের ধমক দিতে লাগলেন বারবার। ভরত শেষ পর্যন্ত ঠিক করল, ভূমিসূতাকে সে আর পাবে না, হয়তো সে বেঁচেই নেই। তা হলে ভূমিসূতার মতন মুখের ডান পাশটা দেখতে, এমন একটি মেয়েই হোক তার জীবনসঙ্গিনী। এও যেন আংশিকভাবে ভূমিসূতাকে পাওয়া।

মহিলামণি ও ভরত দু’জনেই দীক্ষা নিল ব্রাহ্ম ধর্মে। ব্রাহ্ম মতে সম্পন্ন হয়ে গেল তাদের বিবাহ। পরদিনই তাদের অভিনয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *