মধ্যযুগের বাঙ্গলার ইতিহাসের মশলা
মধ্যযুগের বাঙ্গলার ইতিহাস ভাল করিয়া চর্চ্চা করিতে গিয়া মহাবিপদে পড়িতে হয়। কি হিন্দুসমাজ, কি মুসলমান শাসকগণ, কাহারও সম্বন্ধেই বিস্তৃত সমসাময়িক লিখিত উপকরণ পাওয়া যায় না। মুসলমান- শাসিত ভারতের অন্যান্য অনেক প্রদেশের পৃথক ইতিহাস পারসিক ভাষায় লেখা দেখিতে পাওয়া যায় এবং ঐ ভাষায় রচিত ঐতিহাসিক পত্রাবলীও রক্ষা পাইয়াছে। বাঙ্গলার পক্ষে সেরূপ ইতিহাস একখানি মাত্র, রিয়াজ-উস-সালাতীন, তাহাও আবার পলাশীর যুদ্ধের ত্রিশ বৎসর পরে ইংরাজ আমলে ইংরাজের আজ্ঞায় লেখা। এই বইখানি যদি সমস্ত পূৰ্ব্বলিখিত সমসাময়িক গ্রন্থ হইতে সংগ্রহ করা হইত, তাহা হইলে ক্ষতি ছিল না; কারণ সঙ্কলন যখন বিশুদ্ধ হয়, তখন তাহা অনেকটা আসলের অভাব পূরণ করিতে পারে। আজ দেখাইব যে, মুসলমান-বাঙ্গলার এই সবে-ধন নীলমণি রিয়াজ কত দূর বিশ্বাসের অযোগ্য এবং তথ্যবিহীন।
বাঙ্গলার জন্য একখানিও স্বতন্ত্র প্রাদেশিক ইতিহাস মুসলমান-শাসনকালে (অর্থাৎ ৫৫৭ বৎসরের মধ্যে) লিখিত না হইলেও বাঙ্গলার ঘটনা অনেক স্থলে সমসাময়িক দিল্লীর ফার্সী ইতিহাসের মধ্যে অংশরূপে স্থান পাইয়াছে: সুতরাং তখনকার দিনের বাঙ্গলার আমরা “মাঝে মাঝে দেখা পাই, ক্রমাগত পাই না”। এবং এই দেখাও রাজারাজড়া এবং যুদ্ধ ও খুনের সহিত, দেশ ও দেশবাসী সম্বন্ধে নহে। তথাপি ইহাই আকবরের পূর্ব্ববর্ত্তী (অর্থাৎ তথাকথিত “পাঠান” যুগের) বাঙ্গলা সম্বন্ধে খাঁটি ও তারিখযুক্ত সংবাদ পাইবার একমাত্র আধার। এই শ্রেণীর দিল্লীর ইতিহাস তিন খানি– তের কাৎ-ই-নাসিরী, জিয়াবর্ণীকৃত তারিখ-ই-ফিরোজশাহী এবং আফিফ-কৃত পরিশিষ্ট (যাহাতে ফিরোজ তুঘলকের ৬ষ্ঠ রাজ্যসন হইতে মৃত্যু পর্যন্ত আছে) এবং নিজামুদ্দীন আহমদের তবকাৎ-ই-আকবরীর বাঙ্গলা সম্বন্ধে অধ্যায়টি। এগুলি সব ইংরাজীতে অনুবাদ হইয়াছে।
মুদ্রা এবং শিলালিপি হইতে আমরা যে নাম ও তারিখ পাই, তাহার সাহায্যে ‘পাঠান’ যুগের সুলতানদের নাম ও রাজ্যকাল আমরা এখন সঠিক জানিতে পারি এবং এইরূপে রিয়াজ এবং অন্য গ্রন্থের ভুল সংশোধন করি; কিন্তু ইহা ইতিহাসের কঙ্কাল মাত্র দেয়। শের শাহ কর্তৃক বাঙ্গলার স্বাধীন মুসলমানরাজ ধ্বংস (১৫৩৯) হইতে আকবরের দ্বারা বঙ্গ বিজয় (নামত : ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে, কার্যত ১৬০২ সালে) পর্যন্ত যে প্রকৃত পাঠান-যুগ ছিল, তাহার প্রামাণিক ইতিহাস নিয়ামত্-উল্লা কৃত মজন্-ই-আফাঘানা; ইহা ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে লেখা হইলেও খুব মূল্যবান্; কারণ, পাঠান-বাঙ্গলা সম্বন্ধে ইহাতে অনেক খবর আছে, যাহা অন্যত্র পাওয়া যায় না। যে আধার হইতে এই গ্রন্থকার তাঁহার তথ্য সংগ্রহ করিয়াছেন সেগুলির প্রায় সবই এখন লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তিনি হয় পূৰ্ব্ববর্ত্তী গ্রন্থ হইতে অথবা বৃদ্ধের মুখ হইতে অনেক সত্য তথ্য সংগ্রহ করিয়াছেন। এই পুস্তকখানির ইংরাজী অনুবাদ History of the Afghans, by Bernard Dorn, in two parts (London 1829) বড়ই অশুদ্ধ ও অসুবিধাজনক অনুবাদ। তাহার কারণ, ঐ জর্মান সাহেব ভারতীয় স্থান ও লোকের নাম ঠিক পড়িতে পারেন নাই; দ্বিতীয়ত: ঐ গ্রন্থের দুই ধরনের পাঠযুক্ত হস্তলিপি পাওয়া যায়, একখানি গ্রন্থকারের আসল বিস্তৃত রচনা, অপরখানি উহার এক ক্ষুদ্র সংক্ষিপ্তসার (অনেক অংশ বাদ দিয়া, কোন নকলনবিসের দ্বারা প্রস্তুত)। ডর্ণ সাহেব প্রথমে ঐ সংক্ষিপ্ত গ্রন্থখানি অনুবাদ করিয়া তাহা প্রথম খণ্ড নামে ছাপাখানায় দিয়া, বিলাত হইতে চলিয়া যাইবার দু-এক দিন আগে আসল ও বিস্তৃত গ্রন্থের এক হস্তলিপি সংগ্রহ করেন এবং পরে তাহা হইতে প্রথম ভাগের পদে পদে সংশোধন ও আবশ্যক বেশী কথাগুলি সংযোগ করিয়া দিয়া তাহাই দ্বিতীয় খণ্ড নামে ছাপেন। সুতরাং এই বই এক সময়ে দুই স্থানে না খুলিলে ইহা পড়া যায় না।
নিজামুদ্দীন্ আহমদ্ কোন্ কোন্ গ্রন্থ হইতে তাঁহার বঙ্গ-ইতিহাসের অধ্য ‘টি সংগ্রহ করিয়াছেন, তাহা জানিবার উপায় নাই, কিন্তু তিনি মুঘল-পূৰ্ব্ব যুগের ইতিহাসের কঙ্কাল মাত্র দিয়াছেন, এবং তাহা প্রায়শই বিশ্বাসযোগ্য। এখানে সাবধান করিয়া দিই যে, তারিখ-ই-দাউদীর কোন স্বাধীন মূল্য নাই, ওটা সঙ্কলন মাত্র। মুঘল-সাম্রাজ্য স্থাপনের ঠিক প্রথম কালে শের শাহের সহিত বাঙ্গলার সুলতানের ও বঙ্গদেশে হুমায়ূন বাদশার যে সংঘর্ষ হয়, তাহার বিস্তৃত বিবরণ আব্বাস-কৃত শের শাহের ইতিহাসে পাওয়া যায়। কিন্তু বাঙ্গলার লোক ও দেশের অবস্থা সম্বন্ধে ইহাতেও খবর নাই বলিলেই হয়।
তাহার পর মুঘল যুগ আরম্ভ; এখন হইতে আমরা সঠিক ও ধারাবাহিক সংবাদ পাই, এবং আমার দ্বারা প্যারিস রাষ্ট্রীয় পুস্তকাগারে আবিষ্কৃত পারসিক হস্তলিপি বহারিস্তান শুধু বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যা-আসামের ১৮ বৎসর (১৬০৮- ১৬২৫) ব্যাপী অতি বিস্তৃত স্বতন্ত্র ইতিহাস। তাহার পর মীরজুমলার আসাম-অভিযান এবং শায়েস্তা খাঁ কর্তৃক চাটগাঁ অধিকারের তালিশ-রচিত দীর্ঘ বিবরণ ইংরাজীতে অনুবাদ করিয়াছি। তদ্ভিন্ন আর সব সংবাদ দিল্লীর সরকারী ইতিহাসের অংশরূপে পাওয়া যায়। এই শেষ শ্রেণীর ইতিহাসের প্রথম এবং সৰ্ব্বাধিক মূল্যবান দৃষ্টান্ত আবুল ফজলের আকবরনামা। এই গ্রন্থ লিখিতে সাহায্য করিবার জন্য আকবর বাদশাহ হুকুম দিলেন যে, সব প্রদেশ হইতে সেখানকার পূর্ব্ব ইতিহাস, স্থানবর্ণনা, আয়ব্যয়, বাণিজ্য শিল্পের বৃত্তান্ত ইত্যাদি সঙ্কলন করিয়া আবুল ফজলের নিকট পাঠাইতে হইবে। যেসব তথ্য আমরা আজকালকার ইংরাজী গেজেটিয়ার এবং ষ্টাটিষ্টিকাল রিপোর্টে পাই, ভারতে সেগুলি এই প্রথম সংগৃহীত হয়, এবং এগুলি প্রায়শ আইন-ই-আকবরীতে, এবং অংশত: আকবরনামাতে স্থান পাইয়াছে। তাহার উপর বাদশাহের দপ্তরখানাতে যেসব সরকারী চিঠি ও রিপোর্ট এবং সেনানীদের ডেস্প্যাচ রক্ষিত ছিল, তাহা সমস্ত আবুল ফজলকে দেখিতে ও নকল করিতে দেওয়া হইল। ইহার ফলে আকবরনামা এক অতুলনীয় প্রামাণিক গ্রন্থ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নিজামুদ্দীন আহমদ ও বদায়ূনী যদিও আকবরের রাজ্যকালের ইতিহাস তাঁহাদের বৃহৎ ইতিহাসের অংশরূপে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তথাপি তাঁহারা কেহই আবুল ফজলের মত রেকর্ড দেখিয়া লেখেন নাই, শুধু বাজার-গুজবের উপর অথবা দু-এক জন নিম্নপদস্থ প্রত্যক্ষদ্রষ্টার কথার উপর নির্ভর করিয়া লিখিয়াছেন। নিজামুদ্দীন আহমদ স্পষ্টই লিখিয়াছেন (লক্ষ্মৌ লিথো, ২৪২ পৃষ্ঠায়)–“যদিও আল্লামা শেখ আবুল ফজল বাদশাহ আকবরের জন্ম হইতে আজ অবধি তাঁহার রাজ্যকালের ৩৮ ইলাহী’ বৎসর-১০০২ হিজরী (১৫৯৩ খ্রি.) পর্যন্ত ছোট-বড় সমস্ত ঘটনা তাঁহার আকবরনামা-নামক উৎকৃষ্ট গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তথাপি যখন আমি ভারতের সমস্ত সুলতানদের ইতিহাস লিখিতে লাগিয়াছি, তখন আকবর বাদশাহের রাজ্যকালের ঘটনাগুলির একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া কৰ্ত্তব্য বলিয়া মনে করি। অতএব, সেই অসীম সমুদ্র হইতে কয়েকটি ফোঁটা তুলিয়া লইয়াছি…।” ইহাতেই বুঝা যায় যে, তিনি আকবরনামা পড়িবার পর তাহা হইতে নিজ ইতিহাসের ঐ অংশ সংগ্রহ করেন।
বদায়ূনী ইহার কয়েক বৎসর পরে নিজ গ্রন্থ লেখেন এবং তাহাতে অনেক স্থলে লিখিয়াছেন– “পাঠক এই ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ আকবর-নামায় পাইবেন।” সুতরাং, এই দুইখানি গ্রন্থই আকবরের রাজ্যকাল সম্বন্ধে মৌলিক প্ৰামাণিক গ্রন্থ নহে, ইহাদের আকবর-নামার সঙ্গে এক শ্রেণীতে বসান যায় না। হয়ত দুই-একটি ঘটনা, যেখানে এই দুজন লেখকের মধ্যে কেহ সশরীরে উপস্থিত ছিলেন– যেমন হলদিঘাট-যুদ্ধে বদায়ূনী– সেখানে তাঁহার উক্তি অত্যন্ত মৌলিক বলিয়া মানিয়া লইব, কিন্তু বঙ্গদেশ সম্বন্ধে তাঁহাদের কাহারই চাক্ষুষ জ্ঞান ছিল না। সুতরাং, আমাদের প্রায় সকল লেখকই যে লেখেন- “আকবর-নামাতে অমুকের নাম (বা রাজ্যকাল) এইরূপ, বদায়ূনী অন্যরূপ ফিরিস্তা এইরূপ, তবকাৎ ঐরূপ লিখিয়াছে– (এমন কি) রিয়াজ অন্যরূপ বলেন”- তাহা ইতিহাসের দৃষ্টিতে অসার উক্তি মাত্র। মজন্ ও আকবর-নামার বিরুদ্ধে যে যে স্থানে রিয়াজ কোন উক্তি করিয়াছে, তাহা একেবারে বিবেচনার অযোগ্য। এবং তাহা লইয়া আলোচনা করাও সময়ের অপব্যয় মাত্র; কারণ, ১৭৮৭ সালে লিখিত এই পুস্তকে গ্রন্থকর্তা কোনই প্রামাণিক প্রাচীন গ্রন্থ উদ্ধৃত, এমন কি, নাম উল্লেখ করিতে পারেন নাই। সূক্ষ্মভাবে রিয়াজ পরীক্ষা করিয়া দেখা গেল যে গ্রন্থকার মালদহে বসিয়া আকবরনামা, মজন্ প্রভৃতি গ্রন্থ দেখিবার সুযোগ একেবারেই পান নাই, তৃতীয় শ্রেণীর কোন আধুনিক সঙ্কলন মাত্র পড়িয়াছিলেন। তাঁহার ভুলের দৃষ্টান্ত এত বেশী যে অতি সাংঘাতিক দু-একটি মাত্র এখানে উল্লেখ করিব:- (১) নসীরউদ্দীন মহমুদ এবং তাঁহার পৌত্র নসীরউদ্দীন ইব্রাহীমকে, এক ব্যক্তি ভাবিয়া তাঁহার রাজ্যকাল ২৬ বৎসর লেখা হইয়াছে (শুদ্ধ কাল ৬ বৎসর)। “সুলেমান কররাণী ২৫ বৎসর বিহার বঙ্গে শাসন করেন,” এই অসম্ভব কথা ফিরিস্তা হইতে উদ্ধৃত করা হইয়াছে; তাজ খাঁকে ধরিলেও অনেক কম বৎসর হয়। মুদ্রিত পার্সী গ্রন্থে ১৫৪ পৃষ্ঠায় সুলেমান কর্াণীকে যে কুচরিত্র দেওয়া হইয়াছে, তাহা প্রকৃত পক্ষে তৎপুত্র বায়াজিদের সম্বন্ধে সত্য (মখ্জন্ দ্রষ্টব্য); এটি রিয়াজের একটি মারাত্মক ভুল।
আরও একটি হাস্যাস্পদ ঐতিহাসিক ভুল ষ্টুয়ার্ট সাহেব তাঁহার বাঙ্গলার ইতিহাসে (১৮১৩ খ্রি. প্রকাশিত) ডাউ নামক কাল্পনিক লেখককে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করিবার ফলে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, এবং তাহাই পাঠ করিয়া বঙ্কিম তাঁহার দুর্গেশনন্দিনীর কাঠামো কল্পনা করেন। ডাউ-এর পারসিক জ্ঞানের অভাব এবং অতিরঞ্জিত কাহিনী সৃষ্টি করিবার অসাধু আগ্রহ ও মজ্জাগত অভ্যাসকে স্যর উইলিয়ম জোন্স্ এবং গীবন নিন্দা করিয়াছেন। মানসিংহের পুত্র কুমার জগৎসিংহ মদিরামত্ত অবস্থায় কলু খাঁর সেনাপতি বাহাদুর করুঃ কর্তৃক পরাজিত ও আহত হইয়া বিষ্ণুপুরের রাজাবীর হাম্বিরের যত্নে সেই রাজধানীতে পলাইয়া গিয়া বাঁচেন, ইহাই সত্য ঘটনা– এবং ইহা আবুল ফজল বর্ণনা করিয়াছেন। অথচ ডাউ লেখেন যে, কুমার জগৎসিংহ কলুর দুর্গে বন্দীভাবে নীত হন, এবং কলুর মৃত্যুর পর পাঠানেরা তাঁহাকে মুক্তি দিয়া তাঁহার মধ্যস্থতায় মানসিংহের সহিত সন্ধি করে- অর্থাৎ যেমন আমরা দুর্গেশনন্দিনীর শেষে পড়ি।
[সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, বর্ষ ৪৭, সংখ্যা ৪, ১৩৪৭।]