১৫. মওলানা সাহেব আগে আগে যাচ্ছেন

মওলানা সাহেব আগে আগে যাচ্ছেন। আমি তার পেছনে। মওলানা সাহেবের হাতের টর্চে কী যেন সমস্যা হয়েছে— কিছুতেই জ্বলছে না। আমরা পথ চলছি অন্ধকারে। মাঝে মাঝে মওলানা সাহেব থামছেন–হাতের টর্চ ঝাকাঝাকি করছেন। কোন লাভ হচ্ছে না।

আম্মাজী!

জ্বি।

নক্ষত্রের আলোয় নদীপথে যাওয়া যায় কিন্তু স্থলপথে যাওয়া যায় না। টর্চটা নষ্ট হয়ে বিপদে পড়লাম। চলেন বড় রাস্তা দিয়ে যাই। একটু ঘোরা হবে। উপায় কী।

চলুন যাই।

আমরা বড় রাস্তায় উঠলাম। আমার হাঁটতে ভাল লাগছে। লক্ষ লক্ষ ঝিঝি ডাকছে। বাতাসে মাটির এবং কাঠ পোড়ানো ধোয়ার গন্ধ। পোড়া কাঠের গন্ধ কোত্থেকে আসছে? হাঁটার সময় মানুষ না-কি খুব ভাল চিন্তা করতে পারে। আমি কিছুই চিন্তা করতে পারছি না। মাথা পুরোপুরি খালি হয়ে আছে। মোসাদ্দেক স্যার বলতেন, খুকীরা মন যখন খুব অস্থির হবে তখন মনে মনে গান করবে। মন শান্ত হবে, মন শান্ত করার এর চেয়ে ভাল অষুধ নাই। মন শান্ত করার এটা হল কোরামিন ইনজেকশন! আশ্চর্য কোন গানের কথা, কোন গানের সুর আমার মনে আসছে না।

আম্মাজী।

জ্বি মওলানা সাহেব।

মনটা কি অত্যধিক খারাপ হয়েছে?

নাতো মন খারাপ হবে কেন?

নীরা ম্যাডাম বলেছিলেন, চিঠি পড়ার পর রুমালীর মনটা হয়ত খুব খারাপ হবে। মওলানা তুমি তার দিকে লক্ষ্য রেখো। ম্যাডাম আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন। আমাকে তুমি করে বলেন। আম্মাজী মনটা কি বেশি খারাপ?

আমার মন খারাপ না।

হাঁটতে কষ্ট লাগছে?

হাঁটতে মোটেও কষ্ট হচ্ছে না। হাঁটতে ভাল লাগছে।

শুক্লা পক্ষ হলে হেঁটে মজা পেতেন। কৃষ্ণ পক্ষ শুরু হয়েছেতো হেঁটে মজা নাই। আম্মাজী একটা টেম্পো নিয়ে নেই।

এসেইতো পড়েছি টেম্পো নিতে হবে কেন?

মওলানা সাহেব প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, মিশনারী হাসপাতাল হয়ে যাই। মানে ব্যাপার হয়েছে কী আপনার মাতার শরীরটা সামান্য খারাপ করেছে। ডাক্তার বললেন হাসপাতালে থাকাই ভাল। তেমন কিছু অবশ্য না। হাসপাতালে না নিলেও চলত। বিদেশ জায়গা। হাসপাতালটা ভাল। মিশনারীরা হাসপাতাল, স্কুল এইসব ভাল করে।

আমি থমকে দাড়িয়ে গেলাম। মওলানা এইসব কী বলছেন? হাসপাতালে নেবার মত কী ঘটল!

মাকে হাসপাতালে কখন নেয়া হয়েছে?

বিকালে। তাঁর শরীরটা হঠাৎ খারাপ করল–নিঃশ্বাস নিতে পারেন না। হাসপাতালে আবার অক্সিজেনের ব্যবস্থা আছে। বিসমিল্লাহ বলে নলটা নাকে ঢুকায়ে দিলেই হয়।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, মাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে এমন অবস্থা আর খবরটা আপনি এতক্ষণে দিলেন?

আম্মাজী আপনিতো ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুম থেকে ডেকে তুলে দুঃসংবাদ দিতে নাই। নিষেধ আছে। ঘুম ভাঙ্গারও ঘন্টা খানিক পরে দুঃসংবাদ দিতে হয়।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মওলানা সাহেব বার বার দুঃসংবাদ দুঃসংবাদ করছেন কেন? মা কি মারা গেছেন? সুস্থ সবল মানুষ চোখের পলকে ধড়ফড় করে মারা যায়। মা কোন সুস্থ মানুষ না।

মার শরীর এখন কেমন? ঠিক করে বলুনতো?

আম্মাজী উনি ভাল আছেন। ডাক্তার ঘুমের অষুধ দিয়েছেন। আমি যখন আসি তখন দেখে এসেছি শান্তিমত ঘুমাচ্ছেন। যে কোন অসুখে ঘুম অষুধের মত কাজ করে। অস্থির হবার মত কিছু হয় নাই! অস্থিরত। আল্লাহপাক নিজেও পছন্দ করেন না। কোরআন মজিদে এই জন্যে বলা হয়েছে— হে মানব সন্তান তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।

আমার কোন তাড়াহুড়া নেই। আমি অস্থির না! আমি স্থির। আমি সব সময়ই এ রকম : মার মৃত্যু সংবাদ পেলেও হয়ত স্থিরই থাকতাম। ইউনিটের লেকজন বলত মেয়েটা মানুষ না পাথর? প্রকৃতি কাউকে পাথর বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠায় হাজারো দুঃখ কষ্টেও তাদের কিছু হয় না। আবার কাউকে কাউকে বরফ বানিয়ে পাঠায়––সামান্য উত্তাপে বরফ গলে পানি।

মার মৃত্যুর পর আমার কী হবে? জীবন যাত্রায় তেমন কোন পরিবর্তন কী হবে? মার সঙ্গে আগে যে ঘরে থাকতাম পরেও নিশ্চয়ই সেই ঘরেই থাকব। বজ্রপাতের শব্দে মার বুকের কাছে লুকানোর সুযোগ হবে না। আশ্বিন মাসে শেষ রাতের দিকে যখন শীত পড়বে তখন ঘুম ঘুম চোখে মাকে বলব না–মা গায়ে কথা দিয়ে দাও।

মৃত্যু শোক ভোলা যায় না বলে একটা ভুল কথা প্রচলিত আছে। সবচে সহজে যে শোক ভোলা যায় তার নাম মৃত্যু শোক সবচে তীব্র শোক হচ্ছে— জীবিত মানুষ হারিয়ে যাবার শোক। হারিয়ে যাওয়া মানুষটি যতদিন জীবিত থাকে ততদিন এই শোক ভোলা যায় না। বাবা যদি মাকে ছেড়ে না গিয়ে মারা যেতেন মা বাবাকে ভুলে যেতেন এক বছরের মাথায়। তার ভালবাসার কম্বল উইপোকায় কেটে ফেলত। বাবা বেঁচে আছেন কিন্তু হারিয়ে গেছেন বলেই মার এই তীব্র কষ্ট।

পাশাপাশি থেকে ওতো একজন মানুষ হারিয়ে যেতে পারে। মঈন সাহেব তাঁর স্ত্রীর পাশেই বাস করছেন কিন্তু হারিয়ে গেছেন। নীরা ম্যাডামের শোক এবং যন্ত্রণার এইটাই কারণ। নীরা ম্যাডাম কি এই তথ্য জানেন?

আম্মাজী আমরা এসে পড়েছি–এইটা মিশনারী হাসপাতাল।

হাসপাতাল কোথায়, ছিমছাম ছোট্ট লাল ইটের বাড়ি। সামনে কী সুন্দর বাগান। বাগানের ঠিক মাঝখানে মাদার মেরীর পাথরের মূর্তি। মেরীর কোলে শিশু জেসাস খাইস্ট। হাসপাতালের কাছাকাছি এলেই ফিনাইলের গন্ধ পাওয়া যায়— আমি পাচ্ছি ফুলের ঘ্রাণ। বেলী ফুলের ঝাড় থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। কী আশ্চর্য!

মিশনারীদের হাসপাতালতো আম্মাজী–বড় সুন্দর। এই হাসপাতালে মৃত্যু হলেও আরাম। একটা ভাল জায়গায় মৃত্যু হল। হাসপাতাল যিনি চালান—ফাদার পিয়ারে উনি বিশিষ্ট ভদ্রলোক বিশিষ্ট ডাক্তার। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। বড়দিনের দিন আমাকে এক ঝুড়ি ফল পাঠায়েছেন। একটা নতুন স্যুয়েটার পাঠায়েছেন। নীল রঙ। আসল ভেড়ার লোমের স্যুয়েটার। মাঘ মাসের শীতে এই স্যুয়েটার পরলে গরমে গায়ে ঘামাচি হয়ে যায়। স্যুয়েটারটা চুরি হয়ে গেছে। থাকলে দেখতাম।

আম্মাকে সবাই পছন্দ করে কেন?

এটাতো আম্মাজী বলতে পারব না। এটা আল্লাহপাকের একটা মহিমা!

বাগান পার হয়ে হাসপাতালের সামনে দাঁড়ালাম। আমাদের পায়ের শব্দে যিনি বের হয়ে এলেন তিনিই ফাদার পিয়ারে! তালগাছের মত লম্বা একজন মানুষ। বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। তারপরেও মনে হচ্ছে শক্ত শরীর। খেটে খাওয়া মানুষদের মত পেশী বহুল হাত। পরনে বাঙ্গালীদের মত লুঙ্গী এবং লুঙ্গীর উপর হাতকাটা পাঞ্জাবি। সুন্দর বাংলা বলেন। মাঝে মধ্যে দুএকটা নিতান্ত গ্রাম্য শব্দ তার বাংলায় ঢুকে পড়ে। তাতে তার বাংলা ভাষা আরো সুন্দর হয়ে কানে বাজে। যেমন আমার মা সম্পর্কে বললেন–তোমার মা ভাল আছে। শ্বাস কষ্ট ছিল এখন নাই। এখন শান্তিমত ঘুমাইচ্ছে। ঘুমাইচ্ছে শব্দটা কী সুন্দর করেই না কানে বাজল।

খুকী তুমি মাকে দেখে চলে যাও। আমাদের এখানে রুগীর সঙ্গে থাকার নিয়ম নাই। মা ঘুমাইচ্ছে–ডোন্ট ওয়েক হার আপ। ঘুমের অষুধ দিয়েছি।

 

আমি মার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছি। মা হাত পা এলিয়ে পড়ে আছেন। তাঁর নাকে অক্সিজেনের নল। হাতে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। খুব ধীর লয়ে তার বুক ওঠা নামা করছে। একজন নার্স মার পাশেই টুল পেতে বসে আছেন। ফাদার পিয়ারে বলেছিলেন মা শান্তিমত ঘুমুচ্ছেন। এই কি শান্তিমত ঘুমের নমুনা? দেখেতো মনে হচ্ছে মা মৃত্যুর হাত ধরে শুয়ে আছেন। আমি নার্সকে বললাম, সিস্টার আমি কি মায়ের গায়ে হাত রেখে পাশে বসতে পারি? সিস্টার ঘাড় কাত করলেন।

মার হাতে হাত রাখতেই তিনি ঘুমের মধ্যেই হাত সরিয়ে নিলেন। তার পরপরই চোখ মেললেন। আমি বললাম, কেমন আছ মা?

মা হাসলেন। এবং আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললেন।

শরীরটা কি খুব খারাপ লাগছে?

সন্ধ্যার সময় খুব খারাপ লাগছিল! এখন লাগছে না।

তোমার অবস্থা দেখে আমার খুব ভয় লাগছে।

ভয়ের কিছু নেই আমি মরব না। আমি মরলে তোকে কে দেখবে?

আমি মার হাত আমার কোলে রাখলাম! নার্স বললেন, আপনি চলে যান। তনি এখানে থাকলেই আপনার মা কথা বলতে থাকবেন। ঘুম হবে না। তার ঘুম দরকার। ফাদার জানতে পারলে খুব রাগ করবেন। উনি ভয়ংকর রাগী।

তুমি মার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললাম, মা যাই।

মা চোখ বন্ধ রেখেই বললেন–তোর বাবা বোধ হয় রাতেই আসবে। যদি আসে হাসপাতালে পাঠানোর দরকার নাই। এই হাসপাতালে বাইরের কাউকে থাকতে দেয় না।

মা আমার উপর তোমার রাগটা কি একটু কমেছে?

কোন রাগ নেই।

সত্যি বলছ?

হ্যাঁ সত্যি।

মা আমি যাই?

আচ্ছা। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করিস।

আচ্ছা।

তোর বাবা যদি আসে তাহলে তার খাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখিস। খাওয়ার সময় সামনে থাকিস। কেউ সামনে না থাকলে সে খেতে পারে না।

মা তুমি নিশ্চিত থাক। বাবা যদি আসে আমি অবশ্যই তাকে সামনে বসিয়ে খাওয়াব।

মার জন্যে আমার কষ্ট হচ্ছে। বাবা যে আসবে না, এই সহজ সত্যটা তিনি বুঝতে পারছেন না। যে চলে যায় সে ফিরে আসার জন্যে যায় না। তার জন্যে ভালবাসার স্বর্ণ সিংহাসন সাজিয়ে রাখলেও লাভ হবে না। আর যে আসে সে সিংহাসনের জন্যে অপেক্ষা করে না।

আমি মওলানা সাহেবকে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরছি। মওলানা সাহেবের টর্চ ঠিক হয়েছে। আলো দিচ্ছে। এর আগে কি তিনি মিথ্যা মিথ্যি টর্চ নষ্ট করে রেখেছিলেন? যাতে আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বড় রাস্তায় নিয়ে আসতে পারেন। সেখান থেকে মিশনারী হাসপাতালে।

মওলানা সাহেব!

জ্বি আম্মাজী।

আপনি কি আমার মার জন্যে একটু দোয়া করবেন?

এটাতো আম্মাজী আপনাকে বলতে হবে না। উনি হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে খতমে ইউনুস পড়তেছি। খুব শক্ত দোয়া ইউনুস নবী এই দোয়া পড়ে মাছের পেট থেকে নাজাত পেয়েছিলেন।

ক্যাম্প কেমন নিঃস্বাণ। লোকজন নেই। রাত এমন কিছু হয় নি অথচ মনে হচ্ছে সবাই খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু ডিরেক্টর সাহেবের ঘরে আলো জ্বলছে। আমি নিজের ঘরে চলে গেলাম। ঘরে ঢুকে বড় ধরনের চমক খেলাম। বাবা খাটে বসে আছেন। তাঁর পাশে কালো রঙের হ্যান্ড ব্যাগ।

টেবিলে কলা, আনারস। তাকে খুবই বয়স্ক দেখাচ্ছে। মাথার চুল প্রায় সবই পড়ে গেছে। শেষবার যখন দেখেছি তখনো তার মাথায় অনেক চুল ছিল। মনে হচ্ছে অল্পদিনেই তাঁর বয়স বেড়ে গেছে। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলেন। আমার মনে হল তিনি অকূল সমুদ্রে পড়েছিলেন। আমাকে দেখে খানিকটা ভরসা পেলেন। আমার ইচ্ছা করছে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলি—বাবা তুমি আজ আসায় আমি তোমার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছি। কিন্তু সে রকম কিছুই করতে পারলাম না। শুধু বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আমি খবর পেয়েই রওনা হয়েছি, তারপর গাড়ি নষ্ট, ফেরী নাই— বিরাট ঝামেলা। এসে শুনি তোর মা হাসপাতালে…।

তুমি যে সত্যি এসেছ বিশ্বাস হচ্ছে না।

বাবা অবাক হয়ে বললেন, তোরা বিপদে পড়বি আমি আসব না?

মা তোমাকে দেখে কী যে খুশি হবে।

বাবা ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর চোখ কেমন যেন ভেজা ভেজা মনে হচ্ছে। কেঁদে ফেলবেন নাতো? আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে বললাম, ওরা কেমন আছে বাবা? আমার দুই ভাই বোন?

বাবা নিচু ভঙ্গিতে বললেন, ভাল।

ওদের নাম আমি জানি না। ওদের নাম কী?

বাবা বিব্রত গলায় বললেন, মেয়েটার নাম রূপা আর ছেলের নাম তার মা রেখেছে সাকিব।

নিজের ছেলেমেয়েদের নাম বলছেন এতে এত বিব্রত হবার কী আছে? আমি বললাম, রূপা নাম তুমি রেখেছ?

হুঁ।

ওরা কি জানে রুমালী নামে তাদের একটা বোন আছে?

জানবে না কেন। জানে।

তুমি কি রূপাকে স্কুলে দিয়ে আসো, নিয়ে আসো?

তার মা দিয়ে আসে। আমি নিয়ে আসি।

ফেরার পথে তুমি কি তোমার মেয়েকে আইসক্রীম কিনে খাওয়াও? ততে যেমন খাওয়াতে?

বাবা জবাব দিলেন না। বাবা খুবই অস্বস্থি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। বাবার কি এখন উচিত না তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়া? না-কি মেয়ে অচেনা হয়ে গেছে? অচেনা মেয়েকে আদর করতে সংকোচ লাগছে?

তোমার শরীরটা এত খারাপ হয়েছে কেন বাবা। বুড়ো হয়ে গেছ।

বয়স হয়েছেতোরে মা।

কেন বয়স হচ্ছে?

বাবা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলেন। হাসি থামিয়ে বিপ্ন গলায় বললেন, তোর মার শরীর কি বেশি খারাপ?

হ্যাঁ। তবে তুমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই মার শরীর ভাল হয়ে যাবে।

আমি এখনই যাচ্ছি। রাতে হাসপাতালেই থাকব।

মিশনারী হাসপাতাল, তোমাকে থাকতে দেবে না।

অসুবিধা নেই। বারান্দায় বসে থাকব। না-কি বারান্দাতেও বসতে দেবে

বারান্দায় বসতে দেবে। বাবা শোন বিয়ের পর পর তুমি মাকে চমকে দেয়ার জন্যে অনেক উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করতে। এ রকম কোন উদ্ভট কিছু কি করতে পারবে?

বাবা অবাক হয়ে বললেন—কী করতে বলছিস?

জোনাকি পোকার একটা মালা মার গলায় পরিয়ে দেবে?

জোনাকি পোকার মালা পাব কোথায়?

আমি জোগাড় করে দেব। বাবা তুমিতো জান না— তুমি মাকে একটা কম্বল কিনে দিয়েছিলে–সেই কম্বলটা মা চৈত্র মাসের গরমেও গায়ে দিয়ে রাখে। তুমিতো হাসপাতালে যাচ্ছ মায়ের পায়ের কাছে কম্বলটা দেখবে।

এইসব কথা কেন বলছিস!

আমার মনটা খুব খারাপতো। এই জন্যে বলছি। যখন আমার মন খারাপ হয় তখন ইচ্ছে করে আশে পাশের সবার মন খারাপ করে দেই।

বাবা পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, তুই একটু কাছে আয়তো মা। তোর মাথায় হাত বুলিয়ে তোকে একটু আদর করি।

আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে আছি। আমি কাদছি না কিন্তু বাবা খুব কাঁদছেন।

আমি বাবার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি যেন তিনি বয়স্ক কোন মানুষ নন। অল্প বয়েসী শিশু! খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়ে কাঁদছেন।

 

বাবা মওলানা সাহেবকে নিয়ে মাকে দেখতে গেছেন। আমি গোসল করে কাপড় বদলে ডাইনিং হলে খেতে গিয়েছি। ডাইনিং হলে তিথি বসে আছে। একপাশে তিথি, এক পাশে তার মা এবং এক পাশে বাবা। তিথি মুখের সামনে একটা বই ধরে আছে। তিথির মা ভাত মাখিয়ে তার মুখে তুলে দিচ্ছেন। আমাকে দেখে তিনি লজ্জা পেলেন। এত বড় মেয়েকে মুখে ভাত তুলে খাইয়ে দিতে হচ্ছে এই জন্যেই হয়ত লজ্জা। আমার কাছে দৃশ্যটা খুব সুন্দর লাগল। তিথি মুখের উপর থেকে বই নামিয়ে বলল, তুমি কোথায় ছিলে? বিকেল থেকে তোমাকে খুঁজছি। কেউ বলতে পারছে না তুমি কোথায়। এদিকে তোমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। মেয়েকে খোঁজা হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে না। তুমি দেখি আমার চেয়েও অদ্ভুত।

খুঁজছিলে কেন?

বলেছিলাম না তোমাকে ছবি দেখাব? রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছবি। ছবি খুঁজে পাই নি। মনে হচ্ছে আনা হয় নি। সোহরাব আংকেলের কাছ থেকে তোমার ঠিকানা নিয়েছি। ঢাকায় পৌঁছেই তোমাকে পাঠিয়ে দেব।

আচ্ছা।

তুমি কি শুনেছ যে আমি অভিনয় করছি না। ঢাকা চলে যাচ্ছি।

শুনেছি।

কী জন্যে অভিনয় করব না, সেটা শুনেছ?

তিথির মা বললেন, চুপ করতো মা। এত সব বলার দরকার কী!

তিথি বলল, আমার বলতে ইচ্ছে করছে। তুমি দয়া করে ইন্টারফেয়ার করবে না। ভাত যা খাবার খেয়েছি। আর খাব না। আমার মুখ ধুইয়ে চলে যাও। কাল ঢাকা চলে যাচ্ছি–রুমালীর সঙ্গে আর দেখা হবে না। আজ তার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করব।

তিথির মা বললেন, গল্প সকালে করলে হবে না?

না সকালে করলে হবে না। এখনি করতে হবে। প্লীজ তোমরা দুজন এখন যাও।

আমি ভাত খাচ্ছি। তিথি আমার সামনে বসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্প হে খুব ভাল লাগছে তিথির গল্প শুনতে।

পাপিয়া ম্যাডামের সঙ্গে আমার লেগে গেল। একটা সিকোয়েন্স নেয়া হবে। দিলু আর নিশাত বসে আছে। দিলু বলবে–আপা তুমি কথা বলার সময় আমার নকে তাকাচ্ছ না কেন?

নিশাত বলবে, কথা বলার সময় তোর দিকে তাকাতে হবে কেন?

আমার সঙ্গে কথা বললে–আমার দিকে তাকিয়ে বলতে হবে!

কেন তুই এত বিরক্ত করিস দিলু।

এই কথাটা তুমি আমার দিকে তাকিয়ে বল।

নিশাত তখন বিরক্ত হয়ে উঠে যাবে। এই দৃশ্যটা হার সময় বামেলা হল। পাপিয়া ম্যাডাম অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছেন আমি হাত দিয়ে তার মুখ ধরে আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম–আমার সঙ্গে কথা বললে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে হবে?

পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, তিথি শোন আমার গায়ে হাত দিও না। আমাকে টাচ না করে ডায়ালগ বল।

আমি বললাম, সেটা ভাল হবে না।

পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, ভাল হোক বা না হোক। তুমি আমার গায়ে হাত দেবে না!

আমি বললাম–গায়ে হাত দেব না কেন? আপনার কি কোন ছোঁয়াছে অসুখ আছে যে গায়ে হাত দিলে আমার সেই অসুখ হয়ে যাবে?

পাপিয়া ম্যাডাম রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন— এ রকম বেয়াদবী কার কাছ থেকে শিখেছ? আমি বললাম, আমি কারো কাছ থেকে কিছু শিখি না। আমি যা করি নিজে নিজে করি।

তিথিকণা খুব হাসতে লাগল।

আমি বললাম, তোমাদের এই ঝগড়া ঝাটির সময় ডিরেক্টর সাহেব কি করলেন? চুপ করে রইলেন?

ঝগড়া যখন শুরু হল তখন উনি ছিলেন না। হঠাৎ উনার শরীর খারাপ করল। তিনি শট ডিভিশন তার এসিসটেন্টকে বুঝিয়ে দিয়ে তার ঘরে চলে গেলেন। আমি যখন বললাম আমি অভিনয় করব না। তখন সোহরাব চাচা ডিরেক্টর সাহেবকে আনতে গেলেন। উনি এলেন না। বলে পাঠালেন, শুটিং প্যাক আপ।

উনার সঙ্গে পরে তোমার দেখা হয় নি?

দেখা হয়েছে। শুটিং স্পট থেকে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। উনি দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে বসেছিলেন। আমি যখন বললাম, আংকেল আমি অভিনয় করব না। কাল ঢাকা চলে যাচ্ছি। উনি বললেন, আচ্ছা। আমি বললাম, আংকেল আপনি রাগ করছেন নাতো? উনি বললেন, আমি তোমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব। যদি ধাঁধার জবাব দিতে পার তাহরে রাগ করব না। তিনটা পিঁপড়া নিয়ে একটা ধাঁধা।

তুমি জবাব দিতে পেরেছ?

হ্যাঁ পেরেছি।

কাল সকালে তুমি চলে যাচ্ছ?

আমি একা না। সবাই চলে যাচ্ছে।

সে কী?

সোহরাব চাচা বলেছেন— শুটিং শিডিউল নতুন করে করা হবে। এখন সব কাজ বন্ধ। বাকি যা কাজ শীতের সময় করা হবে। তারা যে জেনারেটার নিয়ে এসেছিল সেটাও ঠিক মত কাজ করছে না। আমার কী মনে হয় জান? আমার মনে হয় এই ছবিটা আর হবে না। না হলেই ভাল।

না হলে ভাল কেন? গল্পটা বাজে। দিলু মরে গেল। দিলু মরবে কেন? মরার মত কী হয়েছে? দুঃখ কষ্ট পেলেই মরে যেতে হবে?

তিথি।

বল।

তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।

দূর থেকে দেখেছতো এই জন্যে পছন্দ হয়েছে। কাছ থেকে দেখলে পছন্দ হত না। দূর থেকে যে জিনিস যত সুন্দর কাছ থেকে সেই জিনিস তত অসুন্দর।

তাই বুঝি?

অবশ্যই তাই। দূর থেকে চাঁদ কত সুন্দর। কাছে গেলে পাথরের পাহাড়— এবড়ো থেবড়ো, খানা, খন্দ, গর্ত।

 

জাহেদা বলেছিল রাতে ঝড় হবে। সোমেশ্বরী নদীতে বান ডাকবে। হাতি ডোবা বান! জাহেদার কোন কথাই ঠিক হয় না। এই কথাটা কি মিলে যাবে? আকাশে কোন তারা দেখা যাচ্ছে না। মেঘ জমেছে। বিজলী চমকাচ্ছে। বিজলী চমকালেই বজের শব্দ শোনা উচিত। বজের শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। ঝড় দেখার জন্যে অপেক্ষা করছি। বারান্দায় বেতের চেয়ারে পা তুলে বেশ আরাম করে বসে আছি। ঝিঝি ডাকছে না। বড় ধরনের বৃষ্টি বা ঝড়ের আগে আগে ঝিঝি পোকারা চুপ করে যায়।

ক্যাম্প নীরব হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও উঠোনে কয়েকজন লাইটবয় ঝগড়া করছিল। এখন তারা নেই। জোনাকি আছে। প্রচুর পরিমাণে আছে। জোনাকি ধরার কোন জাল থাকলে এক খেপে অনেক জোনাকি ধরে ফেলা যেত। একটা লম্বা সুতায় মৌমাছির মোম মাখিয়ে জোনাকিগুলি বসিয়ে দিলেইজোনাকির মালা।

মাকে নিয়ে আমি এখন আর দুঃশ্চিন্তা করছি না। বাবা চলে এসেছেন দুঃশ্চিন্তা যা করার তিনিই করবেন। জোনাকি পোকার একটা মালা বানিয়ে বাবাকে দিয়ে এলে চমৎকার হত। দেয়া গেল না। একদিকে ভালই হয়েছে। মালা বানান হলে হয়ত দেখা যেত বাস্তবের মালা কল্পনার মালার মত সুন্দর হয় নি।

অস্পষ্ট ভাবে বৃষ্টির ফোঁটা কি পড়তে শুরু করেছে? বোধ হয় না। পাহাড়ি বৃষ্টি ঝম করে চলে আসে। ধীরে সুস্থে আসে না। যত বৃষ্টি নামুক, ঝড় আসুক আমি এই জায়গা থেকে নড়ব না। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হলেও খবরদারীর জন্যে আজ মা আসবেন না। টেনে হিচড়ে ঘরে ঢোকানোর চেষ্টা করবেন না। আজকের রাতটা পুরোপুরি আমার। রাতটা আমি গল্প করে করে কাটাব। কার সঙ্গে গল্প করব? দিলুর যেমন কল্পনার বান্ধবী আছে এমন কোন কল্পনার বান্ধবীকে নিয়ে আসব। ঝুম বৃষ্টি নামলে দুজনে মিলে ভিজব। সোমেশ্বরী নদীতে সত্যি যদি হাতি ডোবা বান ডাকে তাহলে তাকে নিয়ে নদী দেখতে যাব। মানুষ এক কোথাও যেতে পারে না। যখন কেউ থাকে না তখন কল্পনার একজনকে পাশে থাকতে হয়। কল্পনার বন্ধু থাকা খুব চমৎকার ব্যাপার। তাকে নিজের মত করে তৈরি করা যায়। পছন্দ না হলে ঢেলে সাজানো যায়। তাকে রূপ দেয়া যায়। তার কাছ থেকে রূপ কেড়ে নেয়া যায়।

নীরা ম্যাডামের মত একজন কাউকে এনে কি পাশে বসাব? তার সঙ্গে গল্প করব। না থাক। বরং তার চিঠিটার একটা জবাব মনে মনে লিখে ফেলি। এই চিঠি তিনি পড়বেন না। তাতে কী? অন্তত আমি নিজেতো জানব তাঁর চিঠির একটা জবাব আমার কাছে আছে। সম্বােধন কী হবে? নীরা ম্যাডাম লিখব?–কি ভাবী? সুজনেষু? সুহৃদয়েষু? কোনটাইতো মানাচ্ছে না। যদি শুধু নীরা লেখা যেত তাহলে মানাতো। সেটা সম্ভব না। উনি অনেক বড় মানুষ–আমি কে? আমি কেউ না।

 

আপনার চিঠিটি আজ রাতে পড়েছি। যে কোনো চিঠি আমি দুবার তিনবার করে পড়ি। আপনারটা একবারই পড়েছি। এত সুন্দর চিঠি কিন্তু দ্বিতীয়বার পড়তে ইচ্ছে করল না। আপনি চিঠিটা নষ্ট করে ফেলতে বলেছেন— আমি নষ্ট করে ফেলেছি। ছিড়ে কুচিকুচি করে চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছি। তারপরেও চিঠিটা পুরোপুরি নষ্ট হয় নি। আপনার মাথায় রয়ে গেছে। আমার মাথায়ও রয়ে গেছে। যেদিন আমরা দুজন পৃথিবীতে থাকব না শুধুমাত্র সেদিনই চিঠিটা নষ্ট হবে। চিঠিতে প্রচ্ছন্নভাবে হলেও আপনি জানতে চাচ্ছিলেন— কেন আমি উনাকে এত পছন্দ করলাম। বা আমার মত অন্যরা কেন করছে। আপনি এই প্রশ্নের জবাব জানেন না দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। আপনার মত বুদ্ধিমতী মেয়ের এই প্রশ্নের জবাব পেতে এত দেরি হল কেন? কী করে আপনি ভাবলেন–উনার ছেলে ভুলানো পিঁপড়ের ধাঁধা জাতীয় কথায় বিভ্রান্ত হয়ে পাগলের মত সবাই উনার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। কিংবা উনার দুঃখময় শৈশবের গল্প শুনে আমাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে প্রবল করুণা। করুণা থেকে জন্ম নিচ্ছে প্রেম। আপনি এমনও ধারণা করছেন যেন উনি নানান ধরনের কৌশল করে করে আমাকে বা লাবণ্যকে বা আমাদের মত কাউকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করছেন? আপনি নিজে মেয়ে — আপনারতো জানা উচিত মেয়েরা সবার আগে যা ধরতে পারে তা হল পুরুষদের কৌশল। পুরুষদের ছ্যাবলামী ও সহ্য করা যায় কিন্তু কৌশল না।

প্রবল আবেগ নিয়ে উনার কাছে ছুটে যাওয়ার কারণটি এখন আমি ব্যাখ্যা করি? আমার মা একবার টবে পুঁই শাকের একটা চারা পুতলেন। চারাটায় যেন ঠিকমত রোদের আলো পড়ে সে জন্যে মা টটাকে বারান্দার মাঝামাঝি এনে রাখলেন। তারপর আমি একদিন কী কারণে যেন বারান্দায় গিয়েছি হঠাৎ দেখি পুইশাকটা বড় হয়েছে। ডাল বের করে দিয়েছে। কিন্তু কোন কিছু ধরতে পারছে না। সে যেন তার অনেকগুলি হাত বের করে দিয়েছে, কিন্তু সেই হাত দিয়ে সে কাউকে ছুঁতে পারছে না। কী ভয়ংকর অসহায় যে লাগছে গাছটাকে।

ডিরেক্টর সাহেব অবিকল এ রকম একটা লতানো গাছ। যে গাছটা অনেক বড় হয়ে গেছে কিন্তু শক্ত করে ধরার মত কিছু পাচ্ছে না–সে আতঙ্কে অস্থির। সে কি এই জীবনে ধরার মত কিছু পাবে না?

এ ধরনের মানুষের পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছার নামই ভালবাসা। আমার ভালবাসার শুরুটা সেখানেই, সম্ভবত আপনার বোন লাবণ্যের ব্যাপারেও এ রকম হয়েছে।

মানুষটার পাশে আগ্রহ নিয়ে দাঁড়ানোর পর অবাক হয়ে দেখলাম তার শঙি ও ক্ষমতা। সৌন্দর্য দেখার ক্ষমতা। সৌন্দর্য ব্যাখা করার ক্ষমতা। সৃষ্টিশীল মানুষের যে ব্যাপারটা থাকে। প্রকৃতি হয়ত খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই ক্ষমতা দিয়ে দেয়। যারা এই ক্ষমতাটা পায় তারাও খুব স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। ক্ষমতার মাত্রা সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকে না। কিন্তু আমার মত মানুষ যারা সৃষ্টিশীল না তারা অভিভূত হয়। অভিভূত হয়ে ভাবে সাধারণ একজন মানুষের এত ক্ষমতা? আপনি নিজেও কি অভিভূত হন নি? তাঁকে দেখামাত্রই কি আপনার সমস্ত চেতনা কেঁপে ওঠে নি?

কোন মেয়ে যদি প্রেমে পড়ে তাহলে তার চোখে প্রেমিকের সৎ গুণ গুলিই পড়ে। ত্রুটি গুলি চোখে পড়ে না। আপনি লিখেছেন— প্রেমিক যখন নাক ঝেড়ে হাত সিকনিতে ভর্তি করে ফেলে — তখন মনে হয়—আহা কী সুন্দর করেই না নাক ঝাড়ছে।

আমি মেয়েটা একটু বোধ হয় আলাদা। আমি শুধু তার ত্রুটিগুলি বের করতে চেষ্টা করেছি। তার কারণও আছে, তার ত্রুটিগুলি চোখে পড়লে তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতা কমতে থাকবে। আমি ধাক্কা খাব। ফিরে যেতে পারব নিজের জগতে। সেলিম ভাইকে তিনি ছবিতে নিলেন। সুপারস্টার ফরহাদ সাহেব এসে উপস্থিত হলেন। তখন আমি মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম যেন তিনি সেলিম ভাইকে বাদ দিয়ে দেন। যেন আমি তার এই ব্যাপারে মস্ত একটা আঘাত পাই। যেন আমি তার কাছ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারি।

সে রকম হয় নি। উল্টোটাই হয়েছে। ফরহাদ সাহেবের মত নামী দামী অভিনেতাকে তিনি পাত্তাই দেন নি। কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের ত্রুটি গুলিই গুণ হিসেবে দেখা দেয়। উনি তেমন একজন। মানুষের মস্ত বড় ত্রুটি তার অহংকার। কিন্তু উনার অহংকারইতো উনার গুণ। আপনি জানেন না তার ত্রুটিগুলি দেখে আমি যতই দূরে সরতে গিয়েছি ততই তার গছে আসার জন্যে ব্যাকুল হয়েছি। ততবারই মনে হয়েছে এইসব ত্রুটি আমার নেই কেন?

আপনার মত একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে কী করে ধারণা করল মেয়ে ভুলানোর জন্যে তিনি তার মজার মজার গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেন?

আপনি কি দেখেন নি এই একই গল্প তিনি কত আগ্রহের সঙ্গে মওলানা সাহেবের সঙ্গে করছেন, বা ইউনিটের একটা ছেলের সঙ্গে করছেন।

তাঁর সম্পর্কে আমি এমন অনেক কিছুই বলতে পারব যা আপনি দীর্ঘদিন বিবাহিত জীবন যাপন করেও লক্ষ্য করেন নি।

আপনি কি তাঁর মুগ্ধ হবার ক্ষমতা লক্ষ্য করেছেন? তার মুগ্ধতার ভিন্ন একটা মাত্রাও আছে— তিনি তাঁর নিজস্ব মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিতে চান, যাতে তাঁর আনন্দের ভাগ অন্যরাও পায়। মুগ্ধ অনেকেই হয়। আনন্দ অনেকেই পায়। কিন্তু কজন তা ছড়িয়ে দিতে চায়?

অবশ্যই আপনি তাঁর সম্পর্কে এমন এক তথ্য জানেন— যা আমি জানি না। আমার জানার কথা নয়। সেই তথ্য জানিয়ে আপনি আমাকে যে ধাক্কাটি দিতে চেয়েছিলেন তা দিতে পেরেছেন। কী তীব্র কষ্ট যে আমি পেয়েছি তা আপনি কোনদিন জানবেন না। আপনি যদি ভেবে থাকেন— আমি কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে আমি মানুষটিকে নিয়ে কখনো সংসার করতে পারব না। আমাদের ঘরে ছোট্ট বাবু আসবে না। তাহলে আপনি ভুল করেছেন। আপনি যদি ভেবে থাকেন কেন একদিন আমি মানুষটাকে আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেব, তাহলে আপনি খুব বড় ভুল করেছেন। আমার বাবাকে একজন মার কাছ থেকে নিয়ে গেছে— মার কষ্ট আমি জানি। এই কষ্টের কোন সীমা নেই। আমি কি করে অন্যকে এই কষ্ট দেব? তা ছাড়া উনার মত মানুষকে ভুলানোর ক্ষমতা কি আমার মত বাচ্চা একটি মেয়েকে দেয়া হয়েছে?

আমার কষ্ট পাবার কারণ হল, যে মানুষ তার আনন্দ তার মুগ্ধতা চারদিকে ছড়িয়ে দেয় সে তার কষ্টটা কাউকেই বলতে পারে না। আমারতো মনে হয় নিজেকেও না। তাকে তার নিজের কষ্টও নিজের কাছ থেকে গোপন রাখতে হয়। মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ একজন মানুষ শারীরিক অসম্পূর্ণতার জন্যে অসম্পূর্ণ। শরীর কি এতই বড়?

হ্যাঁ বড়। অবশ্যই বড়। শরীরের কাছে আমরা বার বার পরাজিত হই তারপরেও কিন্তু বলার চেষ্টা করি–শরীর কিছুই না। মনকে ধারণ করার সামান্য পাত্র মাত্র। মুখের বলায় কী যায় আসে। শরীর হচ্ছে শরীর। তার ক্ষমতাও মনের ক্ষমতার মতই অসীম।

আপনি উনাকে অসম্পূর্ণ শরীরের কারাগার থেকে মুক্তি দিতে চাচ্ছেন। উনি মুক্ত হতে চান সাহসের অভাবে পারছেন না। সেই সাহ আপনি উনাকে দিতে পারেন নি। আমি কিন্তু পারি। আপনি কি চান সেই সাহস আমি তাকে দেই?

 

রুমালী।

আমি চমকে তাকালাম। চিঠি তৈরিতে বাধা পড়ল। সোহরাব চাচা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বললাম, কী ব্যাপার চাচা?

সোহরাব চাচা নিচু গলায় বললেন–স্যার তোমাকে একটু ডাকছেন।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। সোহরাব চাচা প্রায় কান্না কান্না গলায় বললেন, স্যারের শরীরটা খুব খারাপ করেছে। মন খারাপ। শরীর খারাপ।

শুটিং বন্ধ হয়ে গেল সেই জন্যে মন খারাপ?

হ্যাঁ। কী কষ্ট যে স্যার করেন ছবির জন্যে। সেই ছবি যখন হয় না ….

সোহরাব চাচা?

জ্বি মা।

লক্ষ্য করেছেন বেশ অনেকদিন পর আপনি আমাকে মা বললেন।

সোহরাব চাচা চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, আচ্ছা ঐ প্রসঙ্গ থাক। একটা জরুরি কথা বলি। আপনি আপনার স্যারকে এত পছন্দ করেন কেন?

জানি না মা।

সত্যি জানেন না?

না।

উনার কি জ্বর?

হ্যাঁ খুব জ্বর। তার উপর হাবিজাবি খেয়েছেন।

হাবিজাবিটা কী–মদ?

না মদ না–মন-ফল। চার পাঁচটা কোখেকে জোগাড় করে খেয়েছেন। মওলানা এনে দিয়েছে। শুনেছি এইসব খেলে পাগল হয়ে যায়।

আপনার কি ধারণা উনি পাগল হয়ে গেছেন?

আরে না। তবে চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে দেখলে ভয় লাগে।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমি ভয় পাব না। আমি খুব সাহসী মেয়ে। শুধু যে সাহসী তাই না–অন্যকে সাহস দেয়ার ব্যাপারেও এক্সপার্ট।

আমি খুব হাসছি। সোহরাব চাচা অবাক হয়ে তাকাচ্ছেন। আমিও নিজের কাণ্ড দেখে অবাক হচ্ছি— এত হাসছি কেন? আমি কি জাহেদা হয়ে যাচ্ছি?

উনার দরজার সামনে দাঁড়াতেই উনি বললেন–রুমালী এসো।

আমি পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। সোহরাব চাচা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি জানি উনি যাবেন না। দাঁড়িয়ে থাকবেন। তাঁর স্যারের শরীর খারাপ, মন খারাপ। তিনি তাকে ছেড়ে এক পাও যাবেন না। প্রয়োজনে সারারাত দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবেন।

আমি ভেবেছিলাম উনাকে দেখব চাদর গায়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। তা না। উনি চেয়ারে বসে আছেন। মনে হচ্ছে এখনই কোথাও বেরুবেন। ইলেকট্রিসিটি আছে। তারপরেও তাঁর সামনের টেবিলে মোমবাতি! ফুলদানী ভর্তি জবা ফুল। জবাফুল কেউ ফুলদানীতে সাজিয়ে রাখে না। তার ঘরে যতবার এসেছি জবা ফুল দেখেছি। জবা মনে হয় তার পছন্দের ফুল।

আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?

এখন যাচ্ছি না। যদি বৃষ্টি হয় নদীতে পানি আসে তাহলে পানি দেখতে যাব। শুটিং শেষ। সবাই চলে যাবে। এখন যদি নদী না দেখা হয় আর দেখা হবে না। শেষ সুযোগ। বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে না?

জ্বি পড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে।

তুমি বোস। দাঁড়িয়ে আছ কেন?

আমি বসলাম। তিনি সিগারেট ধরালেন। ডুয়ার খুলে রুমাল নিয়ে পকেটে ভরলেন। চুল আঁচড়াতে লাগলেন। আশ্চর্য তাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। চোখ ঝকমক করছে। মানুষের সৌন্দর্যের পুরোটাইতো তার চোখে। মন-ফল খেলে চোখ কি হীরের মত জ্বলে? আমি বললাম, আপনি দেখি একেবারে ফিটফাট বাবু হয়ে নদী দেখতে যাচ্ছেন।

তিনি বললেন, আমি যেমন নদী দেখব, নদীওতো আমাকে দেখবে। নদীও দেখুক যে আমি ফরম্যালি তার কাছে এসেছি। এলেবেলে ভাবে আসি নি। যাই হোক তোমাকে ডাকার কারণ হচ্ছে তোমাকে একটা কথা বলা কথাটা না বললে আমার খারাপ লাগবে।

আপনি এমন ভাব করেছেন— যেন আর কোনদিন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে না।

তোমার ধারণা দেখা হবে?

হ্যাঁ হবে। কারণ আপনি আবারো এই ছবি শুরু করবেন। তখন বিলু চরিত্র করার জন্যে আমাকে ডাকবেন।

তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন, না আমি আর ছবি করব না। ভাল লাগছে না। যে কথাটা তোমাকে বলতে চাচ্ছিলাম সেই কথাটা শোন— তোমাকে আমি খুব ভাল করে লক্ষ্য করেছি। তুমি যেমন আমাকে লক্ষ্য করেছ আমিও করেছি। তুমি বড় হয়ে ছবির লাইনে পড়াশোনা করো। কোন ফিল্ম ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়ো। ছবির ব্যাপারে তোমার আগ্রহ আছে। জগৎটকে তুমি ভালবাস। অভিনয় আছে তোমার রক্তের ভেতরে। তুমি পারবে।

থ্যাংক য়্যু।

শোন রুমালী একটা উপদেশ নেই–চেখ সব সময় খোলা রাখবে। অতি তুচ্ছ দৃশ্য ও যেন চোখ এড়িয়ে না যায়! চণ্ডিগড় গ্রামে জাহেল নামের একটা। মেয়ে আছে। মেয়েটা ভবিষ্যৎ বলে— তার বাড়িতে একদিন গিয়ে দেখি— একটা পোষা বক। নাম ধলামিয়া। বুড়ো মানুষদের মত টুক টুক করে হাঁটে। মজার ব্যাপার কী জান? বকটা অন্ধ।

আপনাকে কে বলেছে? জাহেদা।

তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিষণ্ণ গলায় বললেন, না কেউ বলে নি। কিছুক্ষণ বকটার দিকে তাকিয়েই বুঝলাম সে অন্ধ। তোমাকে এটা বললাম কেন জান–যাতে তুমি তোমার দেখার চোখ তীক্ষ্ম করতে পার। এইটা বলার জন্যে তোমাকে ডেকেছিলাম— এখন তুমি যেতে পার।

একটু বসি?

আচ্ছা বোস। বৃষ্টি বেশ ভালই নেমেছে তাই না?

জ্বি।

তিনি উঠে জানালার পাশে গেলেন। জানালার পর্দা সরালেন। বৃষ্টির ছাট তার গায়ে লাগল। তিনি চট করে সরে গেলেন। যেন বৃষ্টিতে তাঁর কাপড় না ভেজে। অথচ আমি নিশ্চিত জানি–ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই তিনি নদী দেখতে যাবেন। তার মাথার উপর ছাতা থাকবে না।

রুমালী! মোমবাতির আলেটা কেন জানি চোখে লাগছে। কিছুক্ষণের জন্যে বাতিটা নিভিয়ে দি?

দিন।

তিনি বেশ কয়েকবার ফু দিলেন। বাতি নিভল না। তিনি ক্লান্ত এবং হতাশ চোখে মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের তারায় মোমবাতির শিখার ছায়া।

নীরা বলছিল তুমি খুব সুন্দর গান কর শোনাও একটা গান। আচ্ছা তুমি কি ঐ গানটা জান? Where have all the flowers gorle?

জি না।

তিনি নিজের মনে গুন গুন করলেন–Where have all the flowers gone? Young girls pick the evely one …. তারপর চুপ করে গেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বিব্রত গলায় বললেন আমার পছন্দের গান। কথাগুলি সুন্দর। গানটা শেষ হয় প্রশ্ন দিয়ে। When will they ever learn? তারা কবে শিখবে?

আমি আপনাকে অন্য একটা গান শুনাই?

না— কেন জানি এই গানটা ছাড়া অন্য কোন গান এখন শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমার একটা সমস্যা আছে, যখন যে গানটা শুনতে ইচ্ছে করে তখন সেই গানের বদলে অন্য গান অসহ্য লাগে।

আমি এই গানটা শিখে রাখব যদি পরে কখনো আপনার সঙ্গে দেখা হয় আপনাকে শুনাব।

থ্যাংক য়্যু ইয়াং লেডি। মনে হচ্ছে আর দেখা হবে না। চল ওঠা যাক। আমি এখন নদী দেখতে যাব।

আমি কি আসব আপনার সঙ্গে?

না। আমি একা যেতে চাই।

তিনি বৃষ্টির মধ্যেই উঠোনে নামলেন সোহরাব চাচা ছাতা নিয়ে ছুটে গেলেন। তিনি ইশারায় বললেন না। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে লাগলেন।

 

বৃষ্টি পড়ছে। ঝড় শুরু হয়েছে।

সোমেশ্বরী নদী গর্জাচ্ছে। নদী তার অলৌকিক গলায় ডাকছে— এসো। এসো। সেই আহ্বান সবাই শুনতে পায় না। কেউ কেউ পায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *