1 of 2

১৫. ভয়ঙ্কর রাতের পরের যে ভোর

ভয়ঙ্কর রাতের পরের যে ভোর, সেখানে কিছু আশা থাকে, কিছু আনন্দ থাকে। দিনের আলো মানুষকে আর কিছু দিক না-দিক ভরসা দেয়। মঙ্গল-সঙ্গীতের মতো পাখি ডাকতে শুরু করে। এমনকি ভোরবেলার কাকের কা-কা ধ্বনিকেও শুভ মনে হয়। তারাও আলোর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে।

পঁচিশে মার্চের ভয়ঙ্কর রাত কেটে গেছে। ভোর হয়েছে। পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে, অথচ কোনোরকম ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা দীর্ঘ রজনী পার করার পর শুরু হয়েছে আরেকটি দীর্ঘ রজনী। রাতের পর দিন আসে নি। রাতের পর এসেছে রাত।

শাহেদ বসে আছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই পরিবারের প্রধান বৃদ্ধ সোবাহান সাহেবের শোবার ঘরের একটা চেয়ারে। সারারাত এক পলকের জন্যেও সে চোখ বন্ধ করে নি। এখন তার চোখ জ্বালা করছে। মাঝে মাঝে চোখকে আরাম দেয়ার জন্যে সে কিছুক্ষণের জন্যে চোখ বন্ধ করছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখ খুলে ফেলছে। মনে হচ্ছে এখন চোখ বন্ধ করে থাকার সময় না।

সোবাহান সাহেব তাঁর বিছানায় জায়নামাজ পেতে নামাজে বসেছেন। তিনি শেষরাতে কিছু সময়ের জন্যে ঘুমিয়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা এরকম–তার ছেলে বরিশাল থেকে লঞ্চে করে ফিরছে। ছেলের বন্ধু সঙ্গে আছে। বন্ধুর নব-পরিণীতা স্ত্রী আছে। তাদের আত্মীয়স্বজনও আছে। তারা লঞ্চের একটা কেবিনের দরজা-জানালা বন্ধ করে গানবাজনা করছে। জমিয়ে গল্প করছে। এই সময় লঞ্চের তলা খুলে গেল। লঞ্চে হুড়মুড় করে পানি ঢুকতে লাগল। লঞ্চ ধীরে ধীরে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। অন্য যাত্রীরা প্ৰাণে বাঁচার জন্যে ছোটাছুটি করছে। কেউ কেউ নদীতে ঝাপ দিয়ে পড়ে সীতারাবার চেষ্টা করছে। দূরে উদ্ধারকারী কিছু পাল তোলা নৌকাও দেখা যাচ্ছে। অথচ সোবাহান সাহেবের ছেলে সালুর (সালাউদ্দিন) এই দিকে কোনো নজরই নেই। সে এখন তাস খেলছে। নববধূও তাস নিয়ে বসেছে। সবাই খুব মজা পাচ্ছে। লঞ্চ যে তলিয়ে যাচ্ছে সেদিকে কারো ইশ নেই। সবাই এত মত্ত। সোবাহান সাহেব ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করতে লাগলেন, এই গাধা, এই বেকুব, তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেখা কী হচ্ছে। গাধারবাচ্চা গাধা, তাস পরে খেলবি দরজা খোল। দরজা খোল। দরজা খোল।

চিৎকারের এই পর্যায়ে শাহেদ তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙায়। ঘুম ভাঙার পর ঘোরলাগা গলায় তিনি শাহেদকে যে প্রশ্নটা করেন তা হলো–দরজা খুলেছে? খুলেছে। দরজা?

দুঃস্বপ্ন দেখার পর থেকে সোবাহান সাহেব ছেলের জন্যে অস্থির হয়ে পড়েছেন। একটা মুরগি সদগা মানত করেছেন। সেই সঙ্গে একশ রাকাত নফল নামাজ। ফজরের নামাজের পর থেকে তার নফল নামাজ চলছে। আটটা বাজে। মাত্ৰ চল্লিশ রাকাত পড়া হয়েছে। শুরুর দিকে দাঁড়িয়েই পড়ছিলেন। হাঁটুতে আর্থরাইটিসে তীব্র ব্যথা শুরু হওয়ায় এখন আর দাঁড়িয়ে পড়তে পারছেন না। মাথাও বেশি নিচু করতে পারছেন না, কোমরে ব্যথা করছে। জায়নামাজের সামনে দুটা বালিশ রেখে সেজদার সময় কোনোমতে বালিশে মাথা ছোয়াচ্ছেন। কংকন দাদুভাইয়ের এই অদ্ভুত ভঙ্গির নামাজ পড়া দেখে খুব মজা পাচ্ছে। সোবাহান সাহেব যতবার বালিশে মাথা ছোয়াচ্ছেন ততবারই সে ফিক করে হেসে ফেলছে। আঙুল উচিয়ে শাহেদকেও এই মজার দৃশ্য দেখাচ্ছে। শাহেদের সঙ্গে এক রাতেই তার খুব ভাব হয়েছে। শাহেদকে সে ডাকছে বাবু। কেন বাবু ডাকছে সে-ই জানে। শিশুদের সব কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করা কঠিন।

রাতে গোলাগুলির ভয়ে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে থাকার জন্যে কংকনের গলা ব্যথা করছে। টনসিল ফুলে গেছে। তার মা মনোয়ারা গরম পানি দিয়ে মেয়েকে গাৰ্গল করানোর চেষ্টা করেছেন। সে গার্গল করতে পারছে না। মুখে পানি দিতেই সে পানি গিলে ফেলছে।

শাহেদ এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারছে না। তার সময় কাটছে হাঁটাহাঁটি করে। হাঁটাহাঁটি করার মতো বেশি জায়গা এ বাড়িতে নেই। সোবাহান সাহেবের ঘর থেকে বসার ঘর, সেখান থেকে বারান্দা। বারান্দা থেকে বসার ঘর, বসার ঘর থেকে আবার সোবাহান সাহেবের ঘর। তাঁতের মাকু চলছেই। বারান্দায় যেতে ভয় ভয় লাগে, কারণ বারান্দা থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তা দিয়ে কোনো মিলিটারি। যদি যায়। তারা বারান্দায় একজন কেউ হাঁটছে দেখতে পাবে। কিছুই বলা যায় না–গুলিও করে বসতে পারে।

কংকন বলল, তুমি শুধু হাঁট কেন?

শাহেদ জবাব দিল না। কী জবাব দেবে? সে কেন হাঁটছে সে নিজেই জানে না।

কংকন বলল, বাবু তোমার হাঁটতে ভালো লাগে, এই জন্যে তুমি হাঁট?

হ্যাঁ।

হাঁটতে ভালো লাগে কেন?

জানি না।

কেন জানো না?

মনোয়ারা রান্নাঘর থেকে বললেন, কংকন, বিরক্ত করবে না।

কংকন বলল, কেন বিরক্ত করব না?

তার প্রশ্ন করা খেলা শুরু হয়েছে। অবিকল রুনির স্বভাব। একবার প্রশ্ন করা শুরু করলে করতেই থাকবে। বিরক্ত করে মারবে। একবার তো চড় দিয়ে প্রশ্ন প্রশ্ন খেলা বন্ধ করতে হলো। টনসিালে গলাব্যথা রোগও রুনির আছে। একটু ঠাণ্ডা লাগল। তো গলায় ব্যথা। কিছুই গিলতে পারবে না। কাঁদো কাঁদো। গলায় মাকে বলবে, ব্যথা কমিয়ে দাও।

শাহেদ রুনির কথা বা রুনির মার কথা ভাবতে চাচ্ছে না। কিন্তু বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। এই দুঃসময়ে তারা কোথায় আছে? কীভাবে আছে? আসমানী সারাৱাত জেগেছিল তা অনুমান করা যায়। রুনি কি ঘুমিয়েছিল? গোলাগুলির শব্দে নিশ্চয়ই খুব ভয় পেয়েছে। ভয় পেলে রুনির জ্বর এসে যায়। জ্বর হলে সমস্যা–সে বাবার কোল ছাড়া কারো কোলেই যাবে না। মেয়ে জ্বরে পড়লে আসমানী খুবই বিপদে পড়বে।

শাহেদ হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে এখন বসার ঘরের বেতের চেয়ারে বসে আছে। ব্যাটারি না থাকার কারণে ট্রানজিস্ট্রর চলছে না। বাইরে কী হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বোঝার উপায় নেই। একতলা এই বাড়িটা অন্য বাড়ি থেকে আলাদা। প্রতিবেশীর কাছ থেকে খবর নেবার উপায় নেই। এই বাড়িটার উত্তর দিকে আরেকটা একতলা বাড়ি আছে। যেটা কাছাকাছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলে। ঐ বাড়ির লোকজন শুনতে পাবে। কিন্তু ঐ বাড়িতে কেউ নেই। তালা বন্ধ। শাহেদের আবারো চোখ জ্বালা করছে। বা চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে চোখ বন্ধ করল। মনোয়ারা এসে পাশে দাঁড়াল। তার হাতে চায়ের কাপ।

ভাই, একটু চা খান।

শাহেদ হাত বাড়িয়ে চা নিল। মনোয়ারা বলল, খিচুড়ি বসিয়েছি। আজকের নাশতা খিচুড়ি। ঘরে আটা-ময়দা কিছুই নাই।

শাহেদ বলল, বাজার আছে? চাল, ডাল, কেরোসিন?

মনোয়ারা বলল, এক দুই দিন চলবে। ও এসে বাজার করে দিবে বলেছিল। এখন তো তারই খোঁজ নেই।

শাহেদ বলল, কারফিউ তুললেই আমি বাজার করে দিয়ে যাব। নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের জন্যে হলেও কারফিউ তুলবে। সমস্যা হচ্ছে, কারফিউ কখন তুলবে কতক্ষণের জন্যে তুলবে। এটা বুঝব কী করে? একটা রেডিওর খুব দরকার ছিল।

মনোয়ারা বলল, ভাই, আপনার কি সিগারেট খাবার অভ্যাস আছে? কংকনের বাবা তার সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গেছে। সিগারেট খাবার অভ্যাস থাকলে প্যাকেটটা আপনাকে দিতে পারি।

দিন সিগারেট।

মনোয়ারা আঁচলের ভেতর থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করল। সে সিগারেট-দেয়াশলাই সঙ্গে নিয়েই এসেছিল। শাহেদ বলল, ভাবি, থ্যাংক য়ু। সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে পেয়ে কী যে ভালো লাগছে, আপনি বুঝতেও পারবেন না।

মনোয়ারা বলল, আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ে আপনার স্ত্রী ভালো আছে। কারফিউ তুলে নিলেই ওদের সঙ্গে আপনার দেখা হবে।

শাহেদ বলল, কীভাবে জানেন? আমার মন বলছে। কাল রাতে তাহাৰ্জ্জুদের নামাজ পড়ে কংকনের বাবার জন্যে যেমন দোয়া করেছি, আপনার স্ত্রী এবং মেয়ের জন্যেও দোয়া করেছি। দোয়া শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে একটা শান্তি শান্তি ভাব হলো। তখনই বুঝলাম, আল্লাহপাক আমার দোয়া কবুল করেছেন। আমার কোনো দোয়া যখন কবুল হয়। আমি বুঝতে পারি।

শাহেদের চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। নিতান্তই অপরিচিত এই মেয়েটির সামনে চোখ মুছতে তার মোটেও লজ্জা লাগল না।

 

রুনি সকালবেলা হড়হড় করে বমি করল। রাতে গুলির শব্দে ভয় পেয়ে দুবার বমি করেছে। এখন বেলা প্রায় এগারটা। সকালে কিছু খায় নি। বমি হওয়ার জন্যে পেটে তো কিছু থাকতে হবে। বমি হচ্ছে কেন? আসমানী দুহাতে মেয়ের মাথা ধরে আছে। ভয়ে তার হাত-পা কাঁপছে। মেয়ের গা অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা। এর মানে কী? জ্বর এসে গা গরম হতে পারে, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে কেন? ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে যাচ্ছে না তো! বাচ্চাদের ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ করলে আগেভাগে কিছু বোঝা যায় না। এরা হোসে-খেলে বেড়ায়, তারপর হঠাৎ এক সময় নেতিয়ে পড়ে। ডাক্তারের কাছে নেওয়ার সময়ও পাওয়া যায় না। এরকম কিছু হচ্ছে না তো? এরকম কিছু যদি হয়, সে ডাক্তারের কাছে কীভাবে নেবে?

বাইরে কারফিউ। কখন কারফিউ তুলবে কিছুই বলছে না। রেডিওতে সারাক্ষণ হামদ আর নাত হচ্ছে। ফাকে ফাঁকে জরুরি নির্দেশ। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলছে–রাস্তায় কাউকে দেখা মাত্র গুলি করা হইবে।

আসমানী বলল, কেমন লাগছে রে মা?

রুনি বলল, ভালো।

আর বমি হবে?

না।

তাহলে আয়, মুখ ধুইয়ে দি।

না।

মুখ ধুবি না? মুখ ধুয়ে কুলি কর।

কুলি করব না।

মুখে না বললেও রুনি কুলি করল। আসমানী মেয়ের মুখ ধুইয়ে দিল।

শরীরটা এখন ভালো লাগছে মা?

লাগছে। বাবা কোথায় মা?

তোর বাবা আছে, ভালোই আছে।

কোথায় আছে?

বাসায় আছে। আর কোথায় থাকবে?

রুনি চোখ-মুখ শক্ত করে বলল, আমি বাবার কাছে যাব।

যাবে বললেই তো যে, ঐ পারবে না। বাইরে কারফিউ, মিলিটারি রাস্তায় কাউকে দেখলে গুলি করে দেবে।

আমি বাবার কাছে যাব।

কারফিউ তুললেই আমরা তোমার বাবার কাছে যাব।

আমি এখন যাব।

মা গো, অবুঝ হাইও না। এখন অবুঝ হবার সময় না।

আমি বাবার কাছে যাব। অবশ্যই যাব। যাবই যাব।

আসমানী মেয়ের গায়ে চড় বসিয়ে দিল। রুনি কাঁদল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যতই দিন যাচ্ছে মেয়েটা ততই অবাধ্য হচ্ছে। এতটুকু একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে হচ্ছে। অসুস্থ মেয়ে, শরীরে কিছু নেই–হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আছে। আসমানীর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কী করবে। সে? মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করবে? এখন তাও করা যাবে না। রুনি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। অনেক সময় লাগবে তার রাগ কমতে। আসমানী বলল, রুনি, মা, কথা শোন…।

রুনি বলল, আমি কথা শুনব না। আমি বাবার কাছে যাব। যাবই যাব।

আসমানী মেয়েকে বাথরুমে রেখেই বসার ঘরে চলে এলো। দুঃখ-কষ্টে তার প্রায় কান্না এসে যাচ্ছে। কী ভয়াবহ সমস্যায় যে পড়েছে! রাগ করে চলে এসেছিল কুমকুমাদের বাড়িতে। তার স্কুল এবং কলেজ জীবনের সবচে প্রিয় বান্ধবী কুমকুমা। রাগ করে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করলে সে এ-বাড়িতে এসে উঠে। কুমকুমের মা তাকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেন। গত দুদিন ধরে সে এ-বাড়িতে আছে। তার আদর-যত্নের কোনো অভাব হচ্ছে না। মেয়েকে নিয়ে থাকার জন্য তাকে আলাদা একটা ঘর দেওয়া হয়েছে। কুমকুমের মা তাকে দিনের মধ্যে প্রায় একশবার বলছেন, মা, তুমি কোনোরকম ভয় করবে না। শুধু আল্লাহ আল্লাহ করো। কারফিউ তোলা মাত্র শাহেদকে খুঁজে এনে সবাই একসঙ্গে গ্রামে চলে যাব।

কুমকুমাদের বাড়ির সবাই সুটকেশ টু্যটকেস গুছিয়ে অপেক্ষা করছে। কারফিউ শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করছে। আসমানীর খুব অস্বস্তি লাগছে। তাছাড়া বড় কথা, কুমকুম। এ-বাড়িতে নেই। সে কুমিল্লায় তার শ্বশুরবাড়িতে। আসমানী যে কারো সঙ্গে গল্প করবে, কথা বলবে, সে উপায় নেই। কুমকুমের বাবা মোতালেব সাহেব আছেন। তিনি অবশ্যি সারাক্ষণই কথা বলেন। সেইসব কথা শুনতে আসমানীর ভালো লাগে না। কথা বলার সময় ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে থুথু ছিটে বের হয়। দেখতে এত খারাপ লাগে–গা ঘিনঘিন করে।

বসার ঘরে মোতালেব সাহেব বসেছিলেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি। দেখে মনে হয় তিনি বেশ আনন্দে আছেন। কিছু কিছু মানুষ দুঃসময়ে ভালো থাকে। দুঃসময়ের গল্পে আনন্দ পায়। ইনি বোধহয় সে-রকম একজন। আসমানীকে দেখে মোতালেব সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, লেটেস্ট খবর কি জানো নাকি মা?

আসমানী শুকনো গলায় বলল, জানি ন  চাচা।

বাঙালি জাতির হাগা বের করে দিয়েছে। এখন তো যাকে বলে বেড়াছেড়া অবস্থা।

আসমানী বলল, জি।

এখন ধরে নিতে পার বাঙালি জাতি খতম। আর পাঁচ বছর পরে দেখবে সবাই উর্দুতে বাতচিৎ করছে। চারদিকে হাম করেঙ্গা, তুম করেঙ্গা।

আসমানী আবারও বলল, জি। তার এখন কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। শেখ সাহেব ধরা পড়লে ধরা পড়ুক, বাঙালি জাতি উর্দুতে কথা বললে বলুকি–তার এখন দরকার তার স্বামীকে। আর কিছু দরকার নেই। সে প্রতিজ্ঞা করল, বাকি জীবনে সে আর কখনোই রাগ করে শাহেদকে ছেড়ে কোথাও যাবে। না। ভয়ঙ্কর রাগারগি হোক, শাহেদ তার গায়ে থুথু দিক–তারপরেও না।

আসমানী!

জি।

একটা স্ট্রং রিউমার হচ্ছে, মিলিটারি সেকেন্ড অফেনসিভে যাবে। আরো ম্যাসিভ স্কেলে। গতরাতে যেটা হয়েছে সেটা হলো তবলার ঠিকঠাক। আসল পাজনা এখনো শুরু হয় নাই। তবে ওদের মূল টার্গেট শহর। আপাতত গ্রামে তারা হাত দেবে না। শহর পুরোপুরি শেষ করার পর ধরবে গ্রাম। কাজেই আমাদের গ্রামে চলে যেতে হবে।

আসমানী আবারও কিছু না বুঝেই বলল, জি। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে। না ভয়ঙ্কর কথাগুলি বলে এই বুড়ো মানুষটা অত আনন্দিত হচ্ছে কেন?

শাহেদের আমরা যদি ট্রেস করতে না পারি, তাহলে ওকে ছাড়াই যেতে হবে। এখন অবস্থাটা হচ্ছে ইয়া নফসি অবস্থা। বুঝতে পারছি? শুধু নিজে বেঁচে থাক।

জি

কাজেই তৈরি হয়ে নাও। বুড়িগঙ্গা দিয়ে নৌকা করে যাব। নদীপথ এখনো সেফ। ওরা পানি ভয় পায়।

বাথরুম থেকে হাড়হড় শ, আসছে। রুনি আবারও বমি করছে। আসমানী ছুটে গেল বাথরুমের দিকে। তার মনেই ছিল না মেয়েকে সে রাগ করে বাথরুমে রেখে এসেছে।

 

কারফিউ উঠল। পরদিন ২৭ মার্চ শনিবার ভোর নটায়। তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ তোলা হয়েছে।

রাস্তায় প্রচুর লোকজন। ভূমিকম্প হলে বাড়িঘরের ভেতর থেকে সব মানুষ বের হয়ে আসে। কিন্তু তাদের মনটা থাকে বাড়ির ভেতরে। শহরের মানুষের অবস্থাটা সে-রকম। তারা রাস্তায় এসেছে ঠিকই কিন্তু মনেপ্ৰাণে চাইছে আবার ঘরে ঢুকে যেতে। সবার চোখেমুখে অনিদ্রাজনিত গভীর ক্লান্তি। এরা কেউ গত দুরাত ঘুমোয় নি। মানুষের তৈরি দুর্যোগে একটা শহরের সব মানুষ দুরাত জেগে কাটিয়েছে এমন নজির বোধহয় নেই।

শাহেদ রিকশা নিল। মাত্র তিনঘণ্টার জন্যে কারফিউ তোলা হয়েছে, তার হাতে একেবারেই সময় নেই। কংকনদের বাসা থেকে বের হতে অনেক সময় লেগেছে। সোবাহান সাহেব কিছুতেই তাকে যেতে দেবেন না। কংকনও তার হাত ধরে রেখেছে। সেও তাকে যেতে দেবে না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, বাবু তুমি থাক। বাবু তুমি থাক।

 

রিকশাওয়ালা বুড়ে ধরনের। সে রিকশা টানতে পারছে না। বুড়োদের কৌতূহল থাকে কম। তার কৌতূহলও বেশি। জায়গায় জায়গায় থামছে। অবাক হয়ে দেখছে–যেখানে বস্তি ছিল এখন নেই, কিছু কালো অঙ্গার পড়ে আছে। শাহেদের ইচ্ছা করছে রিকশাওয়ালাকে বলে, অবাক হয়ে দেখার সময় এটা না। এখন মাথা নিচু করে প্ৰিয়জনদের সন্ধানে যাবার সময়। সে কিছু বলল না। রিকশাওয়ালা নিজের মনে বলল, ইকবাল হলের বেবাক ছাত্র মাইরা ফেলছে।

বিশ্বাসযোগ্য কথা না। তবে সময়টা এমন যে কোনটা বিশ্বাসযোগ্য। আর কোনটা না বোঝা যায় না। মেরে ফেলতেও পারে। ঢাকা শহরের সব মানুষ মেরে ফেললেও বা কী আর করা যাবে!

শাহেদ বলল, ইকবাল হলের সব ছাত্র মেরে ফেলেছে?

হ।

তুমি দেখেছ?

হ। দেখছি।

আর কী দেখেছি?

গজব দেখছি। গজব। রোজ-হাসরের কিয়ামত দেখছি।

গজব তো বটেই। এই গজবের শেষ কোথায় কে বলবে। ঢাকা কলেজের সামনে একটা মিলিটারি জিপ থেমে আছে। একজন অফিসার এবং দুজন জোয়ান জিপের কাছেই দাঁড়িয়ে। অফিসারটি হাসিমুখে গল্প করছে। জোয়ান দুজন এটেনশান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেও আগ্রহ নিয়ে গল্প শুনছে। শাহেদ মাথা নিচু করে ফেলল যেন এদের সঙ্গে চোখাচোখি না হয়। শাহেদের হাতে সিগারেট, তার জন্যই কেমন ভয় ভয় লাগছে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট দেখলে এরা রাগ করবে না তো? সিগারেটটা কি ফেলে দেওয়া উচিত? মুখে কী কারণে যেন থুথু জমছে। থুথু ফেলা নিশ্চয়ই ঠিক হবে না। এরা অন্য কিছু ভেবে বসতে পারে। এরা গল্প করুক এদের মতো। আমরা তাদের সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে চলে যাব।

শাহেদ আসমানীর খোজে। প্রথম গেল তার শ্বশুরবাড়িতে। সেই বাড়ি তালাবদ্ধ। পাশের বাড়ির ভদ্রলোক বললেন, আধঘণ্টা আগে একটা গাড়িতে করে সবাই চলে গেছে। গাড়িতে কে কে ছিল তা তিনি বলতে পারলেন না। বাড়ি ছেড়ে কেন গেল তাও তিনি জানেন না। শাহেদের সঙ্গে কথা বলতে তার বোধহয় বিরক্তি লাগছিল। তিনি একটু পরপর ভুরু কোঁচকাচ্ছিলেন। এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করা অর্থহীন, তবু শাহেদের নড়তে ইচ্ছা করছে না! মনে হচ্ছে তার হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। আবার যে হেঁটে গিয়ে রিকশায় উঠবে। সেই শক্তি নেই। এখন সে যাবে কোথায়? তার নিজের বাসায়? আগে সেখানেই যাওয়া উচিত ছিল। আসমানী নিশ্চয়ই সেই বাসাতেই তার খোজে লোক পাঠিয়েছে। শাশুড়িও গাড়ি নিয়ে নিশ্চয়ই সেখানে গেছেন। শাহেদ ঘড়ি দেখল। তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ তোলা হয়েছে–এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, আর মাত্র দুই ঘণ্টা বাকি। এর মধ্যেই নিজের আস্তানায় ফিরে যেতে হবে, দেরি করা যাবে। না। সময় এত দ্রুত যাচ্ছে কেন?

দোকানপাট কিছু কিছু খুলছে। লোকজন ব্যস্ত হয়ে কেনাকাটা করছে। কাঁচাবাজারে খুব ভিড়। চাল, ডাল কিনে জমিয়ে রাখতে হবে। আবার কতদিনের জন্য কারফিউ দিয়ে দেয় কে জানে লোকজনের কেনাকাটা, ব্যস্ততা দেখে মনে হয় শহরের অবস্থা স্বাভাবিক।

রিকশাওয়ালা আবারো নিজের মনে বলল, শেখ সাবরে মাইরা ফেলছে। শাহেদ হতভম্ব হয়ে বলল, বিলো কী? সত্যি? হ। সত্যি। শেখ সাব নাই বইল্যা আইজ এই অবস্থা। থাকলে ঘটনা হইত उिला।

শাহেদ সিগারেট ধরালো। প্যাকেটের শেষ সিগারেট। সিগারেট কিনতে হবে। রিকশা থামিয়ে রাস্তার কোনো দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেবে। খুব কড়া রোদ উঠেছে, চিড়চিড় করে মাথা ঘুরছে। রিকশার হুড কি সে তুলে দেবে? না থাক, হুড তুলে দেওয়া মানে কিছু গোপন করার চেষ্টা। শাহেদ আকাশের দিকে তাকাল। আকাশ ঘন নীল। এমন নীল আকাশ বোধহয় অনেক দিন দেখা যায় নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে শাহেদের মনে হলো, আসমানী ফিবে এসেছে। ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছে। রুনি মনের আনন্দে খেলছে। বাবাকে দেখে সে দৌড়ে এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। গালের সঙ্গে মাথা ঘষবে। একেকটা শিশু একেকরকম বিচিত্র অভ্যাস নিয়ে পৃথিবীতে জন্মায়। রুনি পেয়েছে গালে মাথা ঘষার অভ্যাস। কী জন্য এই জাতীয় অভ্যাস তৈরি হয়েছে কে জানে। সাইকিয়াট্রিক্টরা নিশ্চয়ই জানেন।

রিকশায় এক ভদ্রলোক যাচ্ছেন। পাশে খুব সম্ভব তার স্ত্রী। তিনি স্ত্রীকে জড়িয়ে আছেন। ভদ্রমহিলা শব্দ করে কাঁদছেন। ভদ্রলোক তাতে খুব বিরক্ত বোধ করছেন। তিনি হতাশ বোধে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। সে সময়মতো ফিরতে না পারলে আসমানীও নিশ্চয়ই এভাবে কাঁদবে।

শাহেদের বাড়ির দরজা তালাবদ্ধ। আসমানী ফেরে নি।

সে এখন কী করবে? এখানেই থাকবে না-কি ফিরে যাবে কংকনদের বাড়িতে? সে কথা দিয়ে এসেছিল ফিরে যাবে। তার যাওয়া উচিত। ওদের বাড়িতে চাল-ডাল নেই। চাল-ডাল কিনে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বাচ্চাটার জন্যে এন্টিবায়োটিক কিনতে হবে। তার গলা ফুলে গেছে। অবিকল রুনির মতো অবস্থা। গাৰ্গল ফাৰ্গলে কোনো কাজ করে না। এন্টিবায়োটিক নিতে হয়। এন্টিবায়োটিকের নামটা মনে আছে— ওরাসিন কে। কোনো ফার্মেসি কি খুলেছে?

শাহেদ রাস্তায় নামল। হাতে সময় কতটা আছে সে বুঝতে পারছে না। ঘড়ি দেখলেই মনে হবে হাতে সময় নেই। লোকজন যেহেতু চলছে–কারফিউ শুরু হয় নি। একটা খোলা ফার্মেসি দেখা যাচ্ছে। সেখানেও ভিড়। শাহেদ ওরাসিন কে সিরাপ কিনল। দোকানদার এমনভাবে ওষুধ দিচ্ছে টাকা নিচ্ছে যেন সব আগের মতোই চলছে। সব ঠিক আছে।

কোনো রিকশা চোখে পড়ছে না। সে রিকশার খোজে হেঁটে হেঁটে রেলগেট পর্যন্ত আসার পর চোখে পড়ল তিনজন মিলিটারির একটা দল। এদের মধ্যে একজনের পোশাক আবার অন্যরকম। কালো পোশাক। কালো পোশাকের মিলিটারি সে আগে দেখে নি। তাদের একজন হাত ইশারায় তাকে ডাকছে। কেন তাকে ডাকছে? সে চোখে ভুল দেখছে না তো?

না, তাকে ডাকছে না। তার কী করা উচিত? সে কি মিলিটারিটার দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার হাসি হাসবে? সেটাও মনে হয় ঠিক হবে না। হাসির অন্য অর্থ করে ফেলতে পারে। তার উচিত এই জায়গা থেকে অতি দ্রুত সরে পড়া। অতি দ্রুত সরাটাও ঠিক হবে না। মিলিটারিরা ভাবতে পারে লোকটা এত দ্রুত যাচ্ছে কেন? নিশ্চয়ই খারাপ লোক।

 

সোবাহান সাহেব শাহেদকে দেখে আনন্দে প্ৰায় চিৎকার করে উঠলেন। রান্নাঘরের দিকে মুখ করে পুত্রবধূকে ডাকলেন। বৌমা, তাড়াতাড়ি আসো। শাহেদ চলে এসেছে।

কংকন মার ঘরে শুয়েছিল। সোবাহান সাহেব তার কাছেও গেলেন, হড়বড় করে বললেন, শুয়ে আছিস কেন? উঠে আয়, শাহেদ এসেছে। তোর বাবু এসেছে।

সোবাহান সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে, এখন আর তাঁর মনে কোনো ভয়ভীতি নেই। তিনি নিশ্চিন্ত একজন কেউ এসেছে। মহাসঙ্কটের দীর্ঘ দিবস। দীর্ঘ রজনীর দায়-দায়িত্ব এখন তার।

শাহেদের আনা জিনিসপত্র দেখে মনোয়ারা বিস্মিত হলো। সবই এনেছে। চাল-ডাল-তেল, কেরোসিন, ময়দা, ব্যাটারি। সবচে আশ্চর্যের ব্যাপার, কংকনের জন্যে ওষুধও এসেছে। মনোয়ারা বললেন, ভাই, আপনি খুব গোছানো মানুষ।

শাহেদ বলল, বিপদের সময় সব মানুষ বদলায়। আমি কোনোকালেই গোছানো ছিলাম না।

মনোয়ারা বললেন, পৃথিবীর সবচে অগোছালো মানুষ কংকনের বাবা। একবার কী হলো শুনুন। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরা। মাথা ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে এরকম অবস্থা। কংকনের বাবাকে ফার্মেসিতে পাঠালাম মাথা ধরার ট্যাবলেট আনতে। সে দুঘণ্টা পরে ফিরল। রাজ্যের বাজার করে এনেছে। কাঁচাবাজার থেকে মাছমাংস কিনেছে, শাক-সবজি কিনেছে, পেয়ারা কিনেছে, কলা কিনেছেমাথাব্যথার ট্যাবলেট শুধু কিনে নি। ভুলে গেছে। ভুলো মন মানুষের সঙ্গে সংসার করা খুবই কষ্ট।

শাহেদ বলল, ভুলো মন মানুষের সঙ্গে সংসার করার অন্য ধরনের আনন্দও আছে।

মনোয়ারা বললেন, ঠিক বলেছেন। আনন্দও আছে। একবার কী হয়েছে শুনুন। কংকনের তখানা জন্ম হয় নি–রাতে আমাদের এক বিয়ের দাওয়াতে যাবার কথা। ও করল কী…।

মনোয়ারা হঠাৎ গল্পটা থামিয়ে দিল। তার সামনে যে মানুষটা বসে আছে সে অপবিচিত একজন মানুষ। এই মানুষটির সঙ্গে নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলা যায় না।

শাহেদ বলল, ভাবি, গল্পটা শেষ করবেন না?

মনোয়ারা বললেন, আরেকদিন শেষ করব। আপনাকে আসল কথাই জিজ্ঞেস করা হয় নি। আপনার স্ত্রীর খোঁজ পেয়েছেন?

শাহেদ বলল, না। ওর মার বাসায় গিয়েছিলাম। বাসা তালাবন্ধ। আশেপাশে কেউ কিছু জানে না।

মনোয়ারা বললেন, ভাই, আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন। তারা নিরাপদে আছে এবং ভালো আছে।

কীভাবে বলছেন?

আমার মন বলছে। আমার মন যা বলে তা ঠিক হয়।

সোবাহান সাহেব ব্যাটারি লাগিয়ে ট্রানজিস্টার চালু করেছেন। নিচু ভলিউমে ক্ৰমাগত রেডিও শুনে যাচ্ছেন। সামরিক নির্দেশাবলি প্রচারিত হচ্ছে। তিনি প্রতিটি নির্দেশ মন দিয়ে শুনছেন। অবাঙালি একজন কেউ বাংলায় বলছে। অদ্ভুত বাংলা–সময়কে বলছে সুময়। গুজবকে বলছে গজব। গজবে কান ডিবেন না। সোবাহান সাহেবের মনে হলো–এরা কি রেডিওর সব বাঙালিদের মেরে ফেলেছে? নির্দেশগুলি পড়ার মতো বাঙালি নেই।

সামরিক নির্দেশাবলির পর প্রচারিত হলো যন্ত্রসঙ্গীত। যন্ত্রসঙ্গীতের পর স্বাস্থ্যবিষয়ক কথিকা। বিষয় জলবসন্ত। সোবাহান সাহেব জলবসন্ত বিষয়ক কথিকাও অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শুনলেন। জলবসন্তে এন্টিবায়োটিক কোনো কাজে আসে না–এই তথ্য তাঁর কাছে হঠাৎ করেই খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। এখন তাঁকে দেখে গত রাতের সোবাহান সাহেব বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে মোটামুটিভাবে আনন্দে আছেন এমন একজন মানুষ। যে মানুষটি। কানের কাছে ট্রানজিস্টার রেডিও ধরে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পেয়েছেন। রেডিওতে পাওয়া খবর অন্যদের জানানোর বিষয়েও তাকে উৎসাহী মনে হচ্ছে। শাহেদকে বললেন, ভালো খবর আছে, আগামীকালও দুঘণ্টার জন্যে কার্ফ তোলা হবে। এমনিতে দুঘণ্টা কম সময় মনে হয়, আসলে কিন্তু অনেক সময়। দুই ঘণ্টায় দুনিয়ার কাজ করে ফেলা যায়। কাল মনে করে আরো ব্যাটারি কিনবে।

মনোয়ারাকে রাতে কী রান্না হবে সেই বিষয়ে বললেন, বৌমা খিচুড়ি রান্না করো। বর্ষা বাদলায় আনন্দের দিনে খিচুড়ি খেতে হয়, আবার বিপদে-আপদেও খিচুড়ি খেতে হয়। পাতলা খিচুড়ি সঙ্গে ডিমভুনা।

খিচুড়ি ডিমভুনা খেতে খেতে রাত দশটা বেজে গেল। তার পরপরই উত্তর দিক থেকে প্রবল গোলাগুলির শব্দ আসতে লাগল। গতকালের মতোই অবস্থা। রাস্তায় ভারী মিলিটারি গাড়ির চলার শব্দ কিছুক্ষণ পরপরই শোনা যাচ্ছে। গোলাগুলির সঙ্গে বুম বুম শব্দের বিকট আওয়াজও কানে আসছে। এই শব্দ কিসের তা সোবাহান সাহেব বুঝতে পারছেন না। তিনি চিন্তিত গলায় শাহেদকে বললেন, বুম বুম শব্দটা কিসের? শাহেদ বলল, জানি না। চাচা। কামান দাগছে না-কি? কামান দাগছে কী জন্যে?

রাত বারটার দিকে শব্দ আসতে শুরু করল পশ্চিম দিক থেকে। এই শব্দ অনেক কাছ থেকে আসছে। গুলি মনে হচ্ছে শী শী শব্দ করে এই বাড়ির ছাদের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সোবাহান সাহেব ভীত গলায় বললেন, সবাই মেঝেতে শুয়ে থাকে। সবাই একঘরে শোও। মহাআজাবের সময় আত্মীয়-অনাত্মীয় নারীপুরুষে কোনো ভেদাভেদ নাই। শাহেদ, তুমিও আমাদের সঙ্গে শুয়ে থাকে।

বসার ঘরের মেঝেতে সবাই শুয়ে আছে। কংকন শুয়েছে শাহেদের পাশে। সে একটা পা শাহেদের গায়ে তুলে দিয়েছে। রুনি এইভাবে ঘুমায় না। সে হাতপা গুটিয়ে পুটলির মতো শুয়ে থাকে। একটা আঙুল থাকে তার মুখে। ঘুমের মধ্যে সে আঙুল চুষতে থাকে। খুবই খারাপ অভ্যাস।

সোবাহান সাহেব অত্যন্ত ভয় পেয়েছেন। ভয়ের কারণে হঠাৎ তার কথা জড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। তিনি বললেন, সবাই একমনে আল্লাহপাকের নাম নাও–আমাদের বড়পীর সাহেব আবদুল কাদের জিলানি সব সময় যে জপ। করতেন। ঐটা করো। এক মনে বলো–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।

কংকন বলল, বাতি জ্বালাও, আমার ভয় লাগে। সোবাহান সাহেব বললেন, বাতি জ্বালানো যাবে না।

গুলির শব্দ আরো কাছে এগিয়ে এসেছে। মানুষজনের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সোবাহান সাহেব শব্দ করেই জিগির করছেন–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *