১৫. ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা
একটা প্যারাডক্স সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সত্যের মাথায় ওপর চড়ে বসে।
—নিকোলাস ফলেটা
প্রিকগনিশন বা ভবিষ্যৎ দেখা বলে কি সত্যিই কিছু আছে? প্রাচীন এই ধারণা সেই গ্রিক ও রোমানদের ওরাকল এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত নবীদেরসহ প্রতিটি ধর্মেই দেখা যায়। কিন্তু ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা উপহার দেওয়া অনেক সময় অভিশাপেও পরিণত হতে দেখা যায় এসব গল্পে। গ্রিক পুরাণে ক্যাসান্ড্রার একটি গল্প পাওয়া যায়। ক্যাসান্ড্রা ছিল ট্রয়ের রাজার কন্যা। তার রূপের কারণে সে সূর্যদেবতা অ্যাপোলোর নজরে পড়ে। তাকে জয় করতে অ্যাপোলো তাকে ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা দান করে। কিন্তু ক্যাসান্ড্রা অ্যাপালোকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে বসে। ভীষণ রেগে অ্যাপোলো তার দানটি উল্টে দেয়। ফলে ক্যাসান্ড্রা ভবিষ্যৎ দেখতে পায় ঠিকই, কিন্তু কেউই তাকে আর বিশ্বাস করে না। ক্যাসান্ড্রা যখন ট্রয়বাসীকে তাদের আসন্ন ধ্বংস সম্পর্কে সতর্ক করল, স্বভাবত তা বিশ্বাস করল না কেউ। এমনকি সে ট্রোজান ঘোড়ার প্রতারণা, আগামেমননের মৃত্যু, এমনকি তার নিজের মৃত্যু সম্পর্কেও ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। কিন্তু তার কথা আমলে না নিয়ে ট্রয়বাসী ভাবল, সে হয়তো পাগল হয়ে গেছে। সে কারণে তাকে বন্দী করে রাখল তারা।
ষোলো শতকে নস্ত্রাদামাস আর অতিসম্প্রতি এডগার সিসি দাবি করেছেন, তাঁরা সময়ের পর্দা উঠিয়ে ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন। অবশ্য এ ধরনের অনেক দাবি আছে যে তাঁদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে (যেমন তাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে, কেনেডির হত্যা ও সমাজতন্ত্রের পতন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন)। অস্পষ্ট, রূপকের মাধ্যমে তাঁরা অসংখ্য পঙ্ক্তি লিখে গেছেন, যা বিভিন্ন ধরনের স্ববিরোধিতায় ভরা। যেমন নস্ত্রাদামাসের চার লাইনের পদ্য এতই সাধারণ যে তার মধ্যে যে কেউ ইচ্ছেমতো কিছু ভেবে নিতে পারবে (লোকজন আসলে তা-ই করে)। তাঁর লেখা চার লাইনের একটি পদ্য নিচে দেওয়া হলো :
ওয়ার্ল্ড সেন্টার থেকে ঝলসে উঠবে দুনিয়াকাঁপানো আগুন : ‘নিউ সিটি’র চারপাশে শিহরিত হবে পৃথিবী অর্থহীন এক যুদ্ধের মূল্য চুকাতে হবে বিশাল দুটো লম্বকে বসন্তের দেবী বেরিয়ে আসবে নতুন, লাল এক নদী থেকে।
অনেকে দাবি করে, এই চার লাইনের পদ্যে নস্ত্রাদামাস ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। অথচ অন্য শতাব্দীতে এই একই পদ্যটিকে অন্য কিছু ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে দাবি করা হতো। এতে যে ছবিটি পাওয়া যায়, তা এতই অস্পষ্ট যে তাকে সম্ভাব্য সব রকম ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
যারা রাজাদের ও সাম্রাজ্যের পতন নিয়ে নাটক লেখেন, সেসব নাট্যকারের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী এক প্রিয় হাতিয়ার। শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নাটকে ভবিষ্যদ্বাণী প্রধান বিষয়বস্তু। আবার ম্যাকবেথেরও প্রধান বিষয়বস্তু বা আরাধ্য ওই ভবিষ্যদ্বাণী। ওই নাটকে ম্যাকবেথ ডাইনিদের মুখোমুখি হয়। সে স্কটল্যান্ডের রাজা হবে, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করে ডাইনিরা। ডাইনিদের ভবিষ্যদ্বাণীতে খুনে এক আকাঙ্ক্ষায় উদীপ্ত হয়ে সে তার শত্রুদের ভয়ানক ও বীভৎসভাবে খতম করতে শুরু করে। তার হত্যার তালিকায় বাদ যায়নি তার প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যাকডাফের নিষ্পাপ স্ত্রী ও সন্তানেরাও।
রাজমুকুট ছিনিয়ে নিতে একের পর এক ভয়ানক সব কাজ করতে থাকে। একসময় ডাইনিদের কাছ থেকে ম্যাকবেথ জানতে পারে, সে যুদ্ধে পরাজিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না বিনাম জঙ্গল থেকে ডানসিনান পাহাড় তার বিরুদ্ধে এসে না দাঁড়াবে। পাশাপাশি নারীর মাধ্যমে প্রসব করা কেউই ম্যাকবেথের ক্ষতি করতে পারে। এই ভবিষ্যদ্বাণীতে বেশ স্বস্তি পায় ম্যাকবেথ। কারণ, জঙ্গল তো আর নড়াচড়া করতে পারে না। আর সব মানুষই তো প্রসব হয় নারীর মাধ্যমেই। কিন্তু বির্নামের বিশাল জঙ্গল নড়াচড়া করতে দেখা গেল একসময়। কারণ, ম্যাকডাফের সেনাবাহিনী বিনাম জঙ্গলের ডালপালা দিয়ে ছদ্মবেশ নিয়ে ম্যাকবেথের দিকে এগিয়ে আসছিল। আবার স্বয়ং ম্যাকডাফ জন্মেছিল সিজার অপারেশনের মাধ্যমে।
অতীতে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, তাতে অনেক বেশি বিকল্প ব্যাখ্যা থাকে। তাই সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা অসম্ভব। তবু এসব ভবিষ্যদ্বাণীকে সহজে বিশ্লেষণ করা যায়। ডুমসডে বা পৃথিবীর শেষ দিবসের নির্দিষ্ট তারিখের অনুমান করে বাইবেলের শেষ অধ্যায় বা রেভেলেশনে পৃথিবীর শেষ দিনের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে। যখন বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংস আসবে খ্রিষ্টবিরোধীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আর তখনই খ্রিষ্টানদের চূড়ান্ত মুহূর্তটি আসবে। মৌলবাদীরা শেষ দিনের সুনির্দিষ্ট তারিখ অনুমানের চেষ্টা করেছেন অনেক দিন ধরে।
ডুমসডে সম্পর্কে অন্যতম বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল জ্যোতিষীরা। তাঁরা বলল, বড় ধরনের এক বন্যায় ১৫২৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তাঁদের এই ভবিষ্যদ্বাণীর ভিত্তি ছিল আকাশের সব গ্রহ বা বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি যুগপৎ একই রেখায় আসা। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। মরিয়া হয়ে ইংল্যান্ডে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায় ২০ হাজার মানুষ। সেন্ট বার্থোলোমিউ গির্জার চারপাশে দুর্গের মতো করে দুই মাস চলার মতো খাবার ও পানীয়ের মজুত করা হয়। বন্যা থেকে বাঁচতে জার্মানি ও ফ্রান্সজুড়ে লোকজন বড় ধরনের নৌকা বানাতে শুরু করে। এই ঐতিহাসিক ঘটনার আশঙ্কায় কাউন্ড ভন ইগলেহেম বানিয়ে ফেলেন তিনতলা সমান বিশাল এক নৌকা। কিন্তু সত্যি সত্যিই যখন দিনটি এল, তখন শুধু সামান্য বৃষ্টি ঝরে পড়তে দেখা গেল। এতে জনগণের মনের আতঙ্ক হঠাৎ রাগে পরিণত হলো। যেসব মানুষ তাদের সহায়-সম্বল সব বিক্রি করে ফেলেছিল, সব হারিয়ে নিজেদের প্রতারিত ভাবতে লাগল তারা। বিক্ষুব্ধ জনতা সন্ত্রাসে লিপ্ত হলো। কাউন্টকে পাথর ছুড়ে হত্যা করল তারা। কয়েক শ জনতা মারা গেল পদপৃষ্ট হয়ে।
ভবিষ্যদ্বাণীর মায়ায় যে শুধু খ্রিষ্টানরাই জড়িয়েছে, তা নয়। ১৬৪৮ সালে ধনী ইহুদি স্মিরনার ছেলে সাবাতাই জেভি একবার নিজেকে মসিহ বলে দাবি করে বসেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, পৃথিবী ধ্বংস হবে ১৬৬৬ সালে। ইহুদিদের কাব্বালার রহস্যময় পক্তি সুন্দর, ভক্তি উদ্রেক করা ও চমৎকার ছন্দময়ভাবে আবৃত্তি করে তিনি দ্রুতই একদল অনুগত অনুসারী জোগাড় করে ফেললেন। তারাই নিজ দায়িত্বে গোটা ইউরোপে এই খবরটা রটিয়ে দিল ১৬৬৬ সালের বসন্তে সুদূর ফ্রান্স, হল্যান্ড, জার্মানি ও হাঙ্গেরি থেকে ইহুদিরা দলে দলে তাদের ব্যাগ গোছাতে শুরু করল। তাদের মসিহর ডাকে সাড়া দিতে লাগল তারা। কিন্তু ওই বছরের শেষ দিকে জেভিকে কন্টাস্টান্টিপোলে গ্রেপ্তার করে গ্র্যান্ড ভাইজার। এরপর কারাগারে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হলো তাঁকে। সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ডের মুখে, তিনি নাটকীয়ভাবে তাঁর ইহুদি পোশাক ছুড়ে ফেললেন। তারপর মাথায় তুর্কি পাগড়ি চাপিয়ে দীক্ষিত হলেন ইসলাম ধর্মে তাঁর কয়েক হাজার অনুগত অনুসারীর তখনই অন্ধ মোহমুক্তির অবসান ঘটে। তারা দল থেকে সরে পড়ল একে একে।
ভবিষ্যদ্রষ্টাদের ভবিষ্যদ্বাণীর আগের সেই প্রতিধ্বনি এ যুগেও কমেনি। তারা সারা বিশ্বে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে যাচ্ছে। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রে উইলিয়াম মিলার একবার ঘোষণা করলেন, ১৮৪৩ সালের ৩ এপ্রিল হবে পৃথিবীর শেষ দিন। খবরের কাগজের মাধ্যমে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছড়িয়ে পড়ল গোটা যুক্তরাষ্ট্রে। ঘটনাক্রমে ১৮৩৩ সালে রাতের আকাশে উল্কাবৃষ্টিতে আলোকিত হয়ে উঠল। বেশ বড় ধরনের ছিল সেই উল্কাবৃষ্টি। এতে মিলারের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রভাব আরও বেড়ে যায়।
কয়েক হাজার অন্ধভক্ত, যাদের বলা হতো মিলারাইটস, পৃথিবীর শেষ দিনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতে লাগল। দেখতে দেখতে ১৮৪৩ সাল চলে এল। একসময় তা বহাল তবিয়তে চলেও গেল পৃথিবীর শেষ দিন আসার আগেই। এতে মিলারিটেস আন্দোলন কয়েকটি বড় ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বড় ধরনের মিলারিটেস জড়ো হওয়ার কারণে প্রতিটি বিভক্ত গ্রুপের ধর্মের ওপর এখনো ব্যাপক প্রভাব আছে। মিলারিটেসের একটি বড় অংশ ১৮৬৩ সালে নতুন করে দল গঠন করে। তারা নাম পাল্টে সেভেনথ ডে অ্যাডভেন্টিস্ট চার্চ নাম ধারণ করে। বর্তমানে তাদের ১৪ মিলিয়ন ব্যাপ্টিজড সদস্য আছে। তাদের বিশ্বাসের মূল বিষয় হলো দ্বিতীয় দফায় খ্রিষ্ট আসবেন।
মিলারিটেসের বিভক্ত আরেকটি গ্রুপ পরে চার্লস টেজ রাসেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তিনি ডুমসডেকে পিছিয়ে ১৮৭৪ সালে নিয়ে যান। এই তারিখও পার হয়ে যাওয়ার পর, মিশনের গ্রেট পিরামিড বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে তিনি তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীকে সংশোধন করে তারিখটি ১৯১৪ সালে পিছিয়ে নিয়ে যান। এই গ্রুপটি পরে জেহোভা’স উইটনেস নামে পরিচিতি পায়। এ গ্রুপের সদস্যসংখ্যা ৬ মিলিয়নের বেশি।
মিলারিটেস আন্দোলনের অন্য অংশগুলো এখনো ভবিষ্যদ্বাণী করে যাচ্ছে। প্রতিবার ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ হওয়ার পর সেগুলো আবারও বিভক্ত হয়ে যায়। এ ধরনের ছোট্ট একটি মিলারিটেস গ্রুপের নাম ব্রাঞ্চ ডেভিডিয়ান তারা সেভেনথ ডে অ্যাডভেনটিস থেকে ১৯৩০-এর দশকে আলাদা হয়ে যায়। তাদের ছোট একটি কমিউন আছে টেক্সাসের ওয়াকোতে। তরুণ ধর্মপ্রচারক ডেভিড কোরেশের প্রভাব রয়েছে তাদের ওপর। গ্রুপটি ১৯৯৩ সালে এফবিআইয়ের সঙ্গে দুঃখজনক এক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। তখন তাদের ভবনে যেন জলজ্যান্ত এক নরক নেমে আসে। তাতে ২৭ শিশুসহ ৭৬ সদস্যকে পুড়িয়ে মারা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং কোরেশও।
আমরা কি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই?
কঠোর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় কি প্রমাণ করা যায় যে কিছু ব্যক্তি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়? ১২ অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, টাইম ট্রাভেল পদার্থবিদ্যার সূত্রের সঙ্গে খাপ খেতেও পারে। উন্নত, টাইপ থ্রি সভ্যতার জন্য সেটা সত্য। কিন্তু পৃথিবীতে কি এখন ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব?
রাইন সেন্টারে কিছু বিশদ পরীক্ষায় দেখা গেছে, কিছু মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। অর্থাৎ কোনো কার্ড বের করে আনার আগেই তারা কার্ডটি শনাক্ত করতে পারে। কিন্তু পুনরাবৃত্তি করা বেশ কিছু পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই প্রভাব খুব অল্প। আবার অন্যরা ওই ফলাফল নকল করার চেষ্টা করলে তাদের প্রভাব হারিয়ে যায়।
ভবিষ্যদ্বাণীকে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় করা বেশ কঠিন কারণ, এটি কার্যকারণ সম্পর্ককে অমান্য করে, মানে কারণ ও তার প্রভাবকে লঙ্ঘন করে। কারণের পরই প্রভাব সংঘটিত হয়, উল্টোটা নয়। পদার্থবিজ্ঞানের যেসব সূত্র দেখা যায়, তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে। কার্যকারণ সম্পর্ক অমান্য করাটা পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। নিউটনের বলবিদ্যা কার্যকারণ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। নিউটনের সূত্রগুলো পরস্পরের সঙ্গে এতটাই সংযুক্ত যে আপনি যদি মহাবিশ্বের সব অণুর অবস্থান ও দশা জানেন, তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ গতিও হিসাব করতে পারবেন। কাজেই ভবিষ্যৎ আসলে গণনাযোগ্য। তাত্ত্বিকভাবে, নিউটনিয়ান বলবিদ্যা বলে, আপনার কাছে যদি যথেষ্ট বড়সড় একটা কম্পিউটার থাকে, তাহলে আপনি ভবিষ্যতের সব ঘটনা গণনা করতে পারবেন। নিউটনের মতে, মহাবিশ্ব বিশাল এক ঘড়ির মতো। কালের একদম শুরুতে ঈশ্বর এই ঘড়িতে চাবি এঁটে দিয়েছেন। এরপর থেকে ঘড়িটি টিক টিক করে চলছে তাঁর বিধি অনুযায়ী। নিউটনের তত্ত্বে ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো জায়গা নেই।
সময়ের পেছনে
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব আলোচনার সময় ঘটনা আরও জটিলতর হয়ে যায়। আলোর জন্য ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ সমাধান করার সময় আমরা একটি নয়, দুটি সমাধান পাই : একটি “রিটার্ডেড’ ওয়েভ আর আরেকটি ‘অ্যাডভান্সড’ ওয়েভ। রিটার্ডেড ওয়েভ এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে আলোর প্রমিত গতি বোঝায়। অন্যদিকে অ্যাডভান্সড ওয়েভ আলোকরশ্মি সময়ের পেছন দিকে যায়। এই অ্যাডভান্সড সমাধানটি ভবিষ্যৎ থেকে এসে অতীত গিয়ে পৌঁছায়!
১০০ বছর ধরে ইঞ্জিনিয়াররা ‘অ্যাডভান্সড’ সমাধানটির মুখোমুখি হয়েছেন। এটি সময়ের পেছন দিকে যায়। তাই তাঁরা একে গাণিতিক কৌতূহল হিসেবে নাকচ করে দিয়েছেন। কারণ, রিটার্ডেড ওয়েভ নিখুঁতভাবে রেডিও, মাইক্রোওয়েভ, টিভি, রাডার ও এক্স-রের আচরণ অনুমান করতে পারে। তাই বিজ্ঞানীরা অ্যাডভান্সড সমাধানটি ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। আবার রিটার্ডেড ওয়েভ বিস্ময়কর রকম সফল। তাই ইঞ্জিনিয়াররা তার কুৎসিত যমজকে অগ্রাহ্য করেন। সফলতার সঙ্গে অন্যায় হস্তক্ষেপ কেন?
তবে অ্যাডভান্সড ওয়েভ নিয়ে পদার্থবিদেরা গত শতাব্দীতে বেশ বিব্রতকর এক ঝামেলায় পড়েন। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণগুলোকে বলা হয় আধুনিক যুগের ভিত্তি। সে কারণে এসব সমীকরণের যেকোনো সমাধান খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়। এমনকি এতে কোনো তরঙ্গ যদি ভবিষ্যৎ থেকেও এসে থাকে, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। দেখে মনে হয়, ভবিষ্যৎ থেকে আসা অ্যাডভান্সড ওয়েভকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। প্রকৃতি কেন এ রকম মৌলিক স্তরে এ ধরনের উদ্ভট সমাধান দেয়? এটা নিষ্ঠুর কোনো কৌতুক, নাকি এর কোনো গভীর অর্থ আছে?
অধ্যাত্মবাদীরা এই অ্যাডভান্সড ওয়েভে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের সন্দেহ, তরঙ্গগুলো ভবিষ্যৎ থেকে আসা কোনো বার্তা। আমরা যদি কোনোভাবে এই তরঙ্গগুলোকে পোষ মানাতে পারি, তাহলে হয়তো অতীতেও বার্তা পাঠাতে পারব। এভাবে হয়তো আগের প্রজন্মকে আসন্ন কোনো ঘটনা সম্পর্কে সতর্ক করা যাবে। যেমন আমাদের দাদা-দাদিকে ১৯২৯ সালে আমরা একটি সতর্কবার্তা পাঠাতে পারি, যাতে তারা আর্থিক মন্দা শুরু হওয়ার আগেই তাদের জমানো সব স্টক বিক্রি করে ফেলে। অ্যাডভান্সড ওয়েভ ব্যবহার করে আমরা টাইম ট্রাভেলের মতো ব্যক্তিগতভাবে অতীতে যেতে পারব না, কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা অতীতকালে চিঠিপত্র ও বার্তা পাঠাতে পারব। এর মাধ্যমে অতীতের লোকজনকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে সতর্ক করা যাবে।
রিচার্ড ফাইনম্যানের গবেষণার আগ পর্যন্ত অ্যাডভান্সড ওয়েভ একটা রহস্য হয়েই টিকে ছিল। অতীতে যাওয়ার এই ধারণার জন্মদাতা তিনিই একসময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটান প্রজেক্টে কাজ করেছেন। প্রথম পারমাণবিক বোমাটি বানানো হয়েছিল এখানেই। ম্যানহাটান প্রজেক্টে কাজ শেষে ফাইনম্যান লস অ্যালামস ছেড়ে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা শুরু করেন জন হুইলারের অধীনে। ইলেকট্রন নিয়ে ডিরাকের গবেষণা বিশ্লেষণ করে ফাইনম্যান কিছু অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পান। দেখা গেল, ডিরাক ইকুয়েশনে সময়ের দিক উল্টে দিলেও সমীকরণটি একই থাকে। আবার ইলেকট্রনের চার্জ উল্টে দিলেও একই থাকে সমীকরণটি। অন্য কথায়, একটি ইলেকট্রন সময়ের পেছনে যেতে পারা ও একটি অ্যান্টি-ইলেকট্রনের সময়ের সামনে যাওয়া একই ব্যাপার! সাধারণভাবে কোনো সতর্ক পদার্থবিদ হয়তো এই ব্যাখ্যা নাকচ করে দিতেন। তিনি হয়তো বলতেন, এটা চতুর কৌশলমাত্র। গাণিতিকভাবে এই চতুর কৌশলের কোনো অর্থ নেই। ডিরাক ইকুয়েশন এখানে স্পষ্ট কথা বললেও সময়ের পেছনে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। অন্য কথায়, ফাইনম্যান দেখলেন প্রকৃতি কেন সময়ের পেছনে যাওয়াটা অনুমোদন করে। আসলে প্রতিবস্তুর গতির প্রতিনিধিত্ব করে এটি। তিনি বয়স্ক পদার্থবিদ হলে ফাইনম্যানও হয়তো সমাধানটি জানালা দিয়ে আস্ত ছুড়ে ফেলে দিতেন। কিন্তু গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে তাঁর কৌতূহলটাকে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
এই ধাঁধা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে তরুণ ফাইনম্যান আরও উদ্ভট ব্যাপার খেয়াল করলেন। সাধারণত কোনো ইলেকট্রন ও কোনো অ্যান্টি- ইলেকট্রন যদি সংঘর্ষের মুখে পড়ে, পরস্পরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয় তারা। এর ফলে গামারশ্মি নিঃসৃত হয়। তিনি এটি একটি কাগজে আঁকলেন : দুটি বস্তু পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খেল, তারপর তারা শক্তি নিঃসরণ করল।
কিন্তু এরপর অ্যান্টি-ইলেকট্রনের চার্জ উল্টে দেওয়া হলে সেটি সাধারণ ইলেকট্রনে পরিণত হয়ে সময়ের পেছন দিকে যাবে। এরপর ওই একই ডায়াগ্রামে সময়কে উল্টে দিয়ে নতুন করে লেখা যায়। এতে এখন দেখা যায়, ইলেকট্রনটি যদি সময়ের সামনের দিকে যায়, তারপর হঠাৎ করে উল্টো দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইলেকট্রনটি সময়ে একটি ইউটার্ন নেয় এবং এখন সেটি সময়ের পেছন দিকে যায়। এরপর সেটি এই প্রক্রিয়ায় বিস্ফোরিত ‘শক্তির নিঃসরণ করে। অন্য কথায়, এটা একই ইলেকট্রন। ইলেকট্রন ও অ্যান্টি-ইলেকট্রন ধ্বংস হওয়ার প্রক্রিয়াটা আসলে একই ইলেকট্রনের সময়ের পেছন দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্তের ফল!
কাজেই ফাইনম্যান প্রতিবস্তুর সত্যিকারের গুপ্তরহস্য উন্মোচন করেছিলেন। তাঁর মতে, এটা সাধারণ বস্তু, যা শুধু সময়ের পেছন দিকে যায়। এই সরল পর্যবেক্ষণ দ্রুতই যেসব কণার প্রতিকণা সঙ্গী আছে, তাদের ধাঁধা ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল। এর কারণ হলো, সব কণাই সময়ের পেছন দিকে চলাচল করে। তাতে প্রতিবস্তুর ছদ্মবেশ ধারণ করে তারা। (এই ব্যাখ্যাটি ডিরাক সমুদ্রের সমতুল্য। এ সম্পর্কে আগেই বলা হয়েছে। তবে এটি আরও সরলতর। এ ব্যাখ্যাটি এখন গ্রহণ করা হয়েছে।)
এখন ধরা যাক, আমাদের কাছে এক টুকরো প্রতিবস্তু আছে। সেটি সাধারণ বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়ে বিপুল বিস্ফোরণ সৃষ্টি করল। এখানে এখন অগণিত ইলেকট্রন ও অ্যান্টি-ইলেকট্রন থাকবে, যারা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা যদি অ্যান্টি-ইলেকট্রনের সময়ের দিক উল্টে দিয়ে তাকে সময়ের পেছন দিকে ইলেকট্রনের চলার পথ বানিয়ে দিই, তাহলে তার অর্থ হবে, একই ইলেকট্রন সামনের ও পেছনের দিকে আঁকাবাঁকা পথে কয়েক ট্রিলিয়ন বার যাতায়াত করেছে।
এ ছাড়া এখানে আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক ফল পাওয়া যায়। সেটি হলো, সেখানে বস্তুর টুকরোর মধ্যে অবশ্যই শুধু একটি ইলেকট্রন ছিল। ওই একই ইলেকট্রন সময়ের সামনে ও পেছনে আঁকাবাঁকা পথে যাতায়াত করেছে। প্রতিবার সেটি সময়ের পথে কোনো ইউটার্ন নিলেও তা প্রতিবস্তুতে পরিণত হতো। কিন্তু সেটি সময়ের পথে আরেকবার ইউটার্ন নিলে আরেকটি ইলেকট্রনে পরিণত হয়।
(তাঁর থিসিস অ্যাডভাইজার ছিলেন জন হুইলার। হুইলারের সহায়তায় ফাইনম্যান অনুমান করেন, হয়তো গোটা মহাবিশ্বে মাত্র একটা ইলেকট্রন আছে। সেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামনে-পেছনে আঁকাবাঁকা পথে চলে। কল্পনা করা যাক, প্রকৃত মহাবিস্ফোরণের বিশৃঙ্খলায় মাত্র একটি ইলেকট্রন তৈরি হয়েছিল। কয়েক ট্রিলিয়ন বছর পর ইলেকট্রনটি ক্রমান্বয়ে মহাবিশ্বের শেষ দিনের মুখোমুখি হবে। সেখানে ইলেকট্রনটি ইউটার্ন নিয়ে চলতে থাকবে সময়ের পেছনে। এ প্রক্রিয়ায় গামা রশ্মি নিঃসৃত হবে। এরপর ইলেকট্রনটি আবারও মহাবিস্ফোরণের কাছে ফিরে গিয়ে আরেকটি ইউটার্ন নেবে। ইলেকট্রনটি এরপর আবারও সামনে-পেছনে আঁকাবাঁকা পথে চলে মহাবিস্ফোরণ থেকে মহাবিশ্বের শেষ দিন পর্যন্ত যেতে থাকবে। একুশ শতকে আমাদের মহাবিশ্ব হলো এই ইলেকট্রনের ভ্রমণের একটা অংশমাত্র। এখানে আমরা ট্রিলিয়ন ইলেকট্রন ও অ্যান্টি-ইলেকট্রন বা দৃশ্যমান মহাবিশ্ব দেখি। তত্ত্বটি যত উদ্ভট লাগুক না কেন, এটা কোয়ান্টাম তত্ত্বের আগ্রহোদ্দীপক এক ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়। সেটা হলো, সব ইলেকট্রন একই রকম কেন। পদার্থবিজ্ঞানে ইলেকট্রনকে আলাদা করে শনাক্ত করা যায় না। এখানে সবুজ ইলেকট্রন বা জনি ইলেকট্রন বলে কিছু নেই। আসলে ইলেকট্রনদের পরস্পরের মধ্যে কোনো স্বাতন্ত্র্য নেই। বনের জীবজন্তু নিয়ে গবেষণার জন্য তাদের মাঝে মাঝে ট্যাগ করেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু কোনো ইলেকট্রনকে এভাবে ট্যাগ করা যায় না। এর কারণ, হয়তো গোটা মহাবিশ্বে একই ইলেকট্রনই সময়ের সামনে ও পেছনে দিকে যাওয়া- আসা করছে।)
কিন্তু প্রতিবস্তু যদি সাধারণ বস্তু হয়ে সময়ের পেছনে যায়, তাহলে অতীতে কি কোনো বার্তা পাঠানো সম্ভব? আজকের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল কি আপনি নিজের অতীতের কাছে পাঠাতে পারবেন? এর মাধ্যমে স্টক মার্কেটের মৃত্যুঘণ্টা বাজানো যাবে কি?
এর উত্তর হলো—না।
আমরা যদি প্রতিবস্তুকে শুধু অন্য আরেক ধরনের বস্তু হিসেবে বিবেচনা করে তা নিয়ে পরীক্ষা চালাই, তাহলে এতে কার্যকারণের কোনো লঙ্ঘন হবে না। কারণ, তার প্রভাব একই থাকবে। এখন অ্যান্টি-ইলেকট্রনের জন্য সময়ের তির উল্টে দিয়ে তাকে সময়ের পেছনে পাঠিয়ে দিলে শুধু গাণিতিক কাজটাই করা হবে। তখনো একই থাকবে পদার্থবিজ্ঞান, ভৌতভাবে কোনো কিছুর পরিবর্তন হবে না। সব পরীক্ষার ফলাফল একই থাকবে। কাজেই ইলেকট্রনকে সময়ের পেছনের দিকে যাওয়া এবং আসার দৃষ্টিভঙ্গি বৈধ। কিন্তু ইলেকট্রনের প্রতিবার সময়ের পেছনে যাওয়া সাধারণভাবে অতীতকে পূরণ করে। কাজেই এটি এভাবে দেখা যায়, ভবিষ্যৎ থেকে আসা এই অ্যাডভান্সড সমাধান কোনো সুসংগত কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত কার্যকারণকে লঙ্ঘন করে না। (আসলে এই উদ্ভট অ্যাডভান্সড তরঙ্গগুলো ছাড়া কার্যকারণ কোয়ান্টাম তত্ত্বকে লঙ্ঘন করতে পারে। ফাইনম্যান প্রমাণ করেছেন, আমরা যদি অ্যাডভান্সড ও রিটার্ডেড ওয়েভের ভূমিকা যোগ করি, তাহলে দেখা যাবে, যে শর্তটি কার্যকারণকে লঙ্ঘন করে, তা নিখুঁতভাবে দূর হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং কার্যকারণ অটুট রাখার জন্য প্রতিবস্তু প্রয়োজনীয়। প্রতিবস্তু ছাড়া কার্যকারণ ভেঙে পড়তে পারে।)
ফাইনম্যান এই উদ্ভট ধারণাটির অঙ্কুরে অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে থাকেন, যতক্ষণ না তা ইলেকট্রনের পরিপূর্ণ কোয়ান্টাম তত্ত্ব হিসেবে প্রস্ফুটিত না হয়। তাঁর সৃষ্টি কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকস বা কিউইডি পরীক্ষামূলকভাবে ১০ বিলিয়নের মধ্যে একটি অংশে যাচাই করা হয়েছে। এতে সর্বকালের সবচেয়ে নিখুঁত তত্ত্ব হিসেবে তৈরি করেছে একে। এ কারণে তিনি আর তাঁর সহকর্মী জুলিয়ান শুইঞ্জার ও সিন-ইটিরো তোমোনাগা ১৯৬৫ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
(নোবেল গ্রহণের সময় দেওয়া ভাষণে ফাইনম্যান বলেন, তরুণ বয়সে ঝোঁকের বশে ভবিষ্যৎ থেকে আসা অ্যাডভান্সড ওয়েভের প্রেমে পড়েন তিনি কোনো সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়ার মতো। আজ এই সুন্দরী মেয়েটি বড় হয়ে পরিপূর্ণ এক নারীতে পরিণত হয়েছে। এখন সে অনেক সন্তানের মা। এসব সন্তানের একটি হলো তার কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকস বা কোয়ান্টাম বিদ্যুৎগতিবিদ্যা।)
ভবিষ্যৎ থেকে ট্যাকিয়ন
ভবিষ্যৎ থেকে আসা অ্যাডভান্সড ওয়েভ (এটি কোয়ান্টাম তত্ত্বে বারবার উপযোগী বলে প্রমাণিত) নিয়ে কোয়ান্টাম তত্ত্বে আরও একটি উদ্ভট ধারণা আছে। এটিও বেশ পাগলাটে ধারণা মনে হলেও সম্ভবত তেমন দরকারি কিছু নয়। ধারণাটি হলো ট্যাকিয়ন। স্টার ট্রেকে একে প্রায়ই দেখা যায়। কোনো জাদুকরি কাণ্ড দেখানোর জন্য স্টার ট্রেক লেখকদের যখনই নতুন কোনো শক্তির প্রয়োজন হয়, তখন ট্যাকিয়ন আমদানি করেন তাঁরা।
ট্যাকিয়নের বাস অদ্ভুত এক বিশ্বে। সেখানে সবকিছুই আলোর চেয়ে দ্রুতবেগে চলাচল করে। ট্যাকিয়ন দ্রুতবেগে চলার সময় শক্তি হারাতে থাকে, যা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান লঙ্ঘন করে। আসলে তারা যদি সব শক্তি হারিয়ে ফেলে, তাহলে তাদের অসীম বেগে চলার কথা। ট্যাকিয়ন শক্তি অর্জন করতে থাকলে তারা ধীরগতির হয়ে পড়ে। এভাবে একসময় তারা আলোর গতিতে পৌঁছায়।
ট্যাকিয়নকে এ রকম অদ্ভুত বানাল কোন জিনিসটি, যে তারা কাল্পনিক ভর নিয়ে আসে। (এখানে কাল্পনিক বলতে বোঝাতে চাচ্ছি, তাদের ভর মাইনাস ১-এর বর্গমূলে বা ‘i-এর গুণফল।) সাধারণভাবে আমরা যদি আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণে m-এর বদলে im বসাই, তাহলে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। সব কণা তখন হঠাৎ করে আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলতে শুরু করবে।
এই ফলাফল অদ্ভুত পরিস্থিতির জন্ম দেয়। কোনো ট্যাকিয়ন বস্তুর ভেতর দিয়ে চলাচল করলে সেটি শক্তি হারায়। কারণ, পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের মুখে পড়ে ওই ট্যাকিয়ন। কিন্তু পরমাণুর সঙ্গে এর যতই সংঘর্ষ হয়, ততই এর গতি বেড়ে যায়। তাতে পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষের পরিমাণও বাড়ে। আবার এই সংঘর্ষের কারণে বাড়ে তার শক্তি হারানোর পরিমাণও এবং তার গতিও আরও বেড়ে যায়। এভাবে এমন এক চক্র সৃষ্টি হয় যে, ট্যাকিয়ন প্রাকৃতিকভাবে নিজে নিজেই অসীম গতিবেগ লাভ করে।
(ট্যাকিয়নরা প্রতিবস্তু আর ঋণাত্মক বস্তুর চেয়ে আলাদা। প্রতিবস্তুর শক্তি ধনাত্মক। এরা আলোর চেয়ে কম বেগে চলাচল করে। এদেরকে আমাদের
নির্মিত কণা ত্বরকযন্ত্রে তৈরি করা যায়। তাত্ত্বিকভাবে, মহাকর্ষের টানে নিচের দিকে পড়ে প্রতিবস্তু। সাধারণ বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিবস্তু সময়ের পেছনে যায়। ঋণাত্মক বস্তুর শক্তিও ঋণাত্মক। এরা আলোর চেয়ে কম বেগে চলাচল করে, কিন্তু মহাকর্ষের টানে নিচে নয়, ওপরের দিকে ওঠে। ঋণাত্মক বস্তুকে কখনোই গবেষণাগারে পাওয়া যায়নি। তাত্ত্বিকভাবে টাইম মেশিনের জ্বালানি হিসেবে এই বস্তু বিপুল পরিমাণে ব্যবহার করা হয়। আলোর চেয়ে বেশি বেগে চলাচল করে ট্যাকিয়ন। আর এর ভর কাল্পনিক। মহাকর্ষের টানে এটি নিচে পড়ে, নাকি ওপরে ওঠে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এদেরও গবেষণাগারে এখনো পাওয়া যায়নি।)
উদ্ভট ট্যাকিয়নের মতো আরও অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এদের নিয়ে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে গবেষণা করছেন পদার্থবিদেরা। এই পদার্থবিদদের মধ্যে আছেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত জেরাল্ড ফিনবার্গ এবং অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ সুদর্শন। সমস্যা হলো, গবেষণাগারে কেউই এখনো কোনো ট্যাকিয়ন দেখেনি। ট্যাকিয়ন নিয়ে পরীক্ষামূলক প্রমাণ থেকে দেখা যাচ্ছে, এরা কার্যকারণকে লঙ্ঘন করতে পারে। ফিনবার্গ এমনও বলেছেন, একটি যন্ত্র চালু হওয়ার আগে, তা থেকে নিঃসৃত লেজার রশ্মি পরীক্ষা করেছেন পদার্থবিদেরা। ট্যাকিয়নের অস্তিত্ব যদি সত্যিই থাকে, তাহলে হয়তো লেজার রশ্মির যন্ত্র চালু করার আগেই যন্ত্র থেকে আসা আলো শনাক্ত করা যাবে।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনিতে অতীতের দর্শকদের কাছে বার্তা পাঠাতে ট্যাকিয়নকে নিয়মিত ব্যবহার করা হয়। তবে কেউ যদি পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষা করে, তাহলে এটি সম্ভব কি না, তা পরিষ্কার নয়। যেমন ফিনবার্গ বিশ্বাস করেন, ট্যাকিয়নের নিঃসরণ সময়ের সামনের দিকে যায়, যা সময়ের পেছনে ঋণাত্মক শক্তির ট্যাকিয়নের শোষণের মতো (প্রতিবস্তুর সঙ্গে সম্পর্কিত পরিস্থিতির মতো)। কাজেই এখানে কার্যকারণের কোনো লঙ্ঘন হয় না।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকে একপাশে রেখে, ট্যাকিয়নের আধুনিক ব্যাখ্যাটি হলো, হয়তো মহাবিস্ফোরণের সময় তাৎক্ষণিকভাবে ট্যাকিয়নের অস্তিত্ব ছিল। সে সময় তারা কার্যকারণকে লঙ্ঘন করেছিল। কিন্তু এখন তাদের আর কোনো অস্তিত্ব নেই। আসলে মহাবিস্ফোরণের সময় হয়তো তাদের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা ছিল। এই অর্থে, বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের কিছু তত্ত্বের জন্য ট্যাকিয়ন অপরিহার্য।
ট্যাকিয়নের কিছু অদ্ভুত ধর্ম আছে। তাদের যখন কোনো তত্ত্বে রাখা হয়, তখন ভ্যাকুয়ামকে অস্থিতিশীল করে তোলে তারা। অর্থাৎ কোনো সর্বনিম্ন শক্তিস্তরকে অস্থিতিশীল করে। কোনো সিস্টেমে ট্যাকিয়ন থাকলে একটি ফলস ভ্যাকুয়ামের মধ্যে থাকে সেটি। কাজেই সিস্টেমটি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে ও ক্ষয় হয়ে সত্যিকারের ভ্যাকুয়াম অবস্থায় চলে আসে।
এমন কোনো বাঁধের কথা ভাবুন, যা কোনো হ্রদের পানি ধরে রেখেছে। এটি মেকি ভ্যাকুয়ামের মতো। বাঁধটিকে নিখুঁতভাবে স্থিতিশীল বলে মনে হলেও সেখানে একটি শক্তিস্তর থাকে, যা ওই বাঁধের চেয়ে নিচের স্তরে থাকে। বাঁধে কোনো ফাটল দেখা দিলে ভাঙনের জায়গায় পানি ছুটে এসে বাঁধ ভেঙে দেয়। পানি সমুদ্রপৃষ্ঠ বরাবর প্রবাহিত হতে গিয়ে সিস্টেমটি সত্যিকার ভ্যাকুয়ামের দিকে যায়।
একইভাবে, অনুমান করা হয় যে মহাবিস্ফোরণের আগে মেকি ভ্যাকুয়াম শুরু হয়েছিল। আর সেখানে ছিল ট্যাকিয়ন। কিন্তু ট্যাকিয়ন থাকার অর্থ হলো এটা সর্বনিম্ন শক্তিস্তর নয়। কাজেই সিস্টেমটি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। স্থান- কালের বুননে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র দেখা দেয়, যা সত্যিকারের ভ্যাকুয়ামের সৃষ্টি করে। ছিদ্রটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি বুদের আবির্ভাব ঘটে। বুদের বাইরে তখনো ট্যাকিয়নের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু বুদ্বুদের ভেতরের সব ট্যাকিয়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বুদটি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্যাকিয়ন ছাড়া আমরা বর্তমানের জানা মহাবিশ্ব খুঁজে পেয়েছি। এটিই হলো মহাবিস্ফোরণ।
ইনফ্লেশন বা স্ফীতি তত্ত্বকে কমসোলজিস্টরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে ধারণা করেন, ট্যাকিয়নই স্ফীতি প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। আগেই বলেছি, স্ফীতিময় মহাবিশ্ব তত্ত্বমতে, মহাবিশ্ব শুরু হয়েছিল স্থান-কালের একটি অতি ক্ষুদ্র বুদ্বুদ হিসেবে। একসময় স্ফীতিশীল পর্যায়ে এতে তীব্র গতি সঞ্চারিত হয়। পদার্থবিদেরা বিশ্বাস করেন, মহাবিশ্ব আসলে মেকি ভ্যাকুয়াম অবস্থার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। সেখানে স্ফীতিক্ষেত্র হিসেবে ছিল একটি ট্যাকিয়ন। কিন্তু কোনো ট্যাকিয়নের উপস্থিতি ভ্যাকুয়ামটিকে অস্থিতিশীল করে তোলে ও অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বুদ্বুদ গঠন করে। এসব বুদের ভেতরে স্ফীতিক্ষেত্র সত্যিকার ভ্যাকুয়াম অবস্থার অধীনে ছিল। এই বুদ এরপর দ্রুতবেগে স্ফীত হতে শুরু করে। এভাবে শেষ পর্যন্ত আমাদের এই মহাবিশ্ব গঠন করার পর সেটি থেমে যায়। আমাদের বুদ্বুদ মহাবিশ্বে স্ফীতি হারিয়ে গেছে। কাজেই একে আমাদের মহাবিশ্বে আর কখনোই শনাক্ত করা যাবে না। সুতরাং ট্যাকিয়ন এমন এক উদ্ভট কোয়ান্টাম অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে বস্তু আলোর চেয়েও দ্রুতবেগে চলতে পারে এবং হয়তো তা কার্যকারণকেও লঙ্ঘন করে। কিন্তু তারা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। সম্ভবত তারাই এই মহাবিশ্বকে জন্ম দিয়েছে।
এসব ধারণাকে অলস অনুমান বলে মনে হতে পারে। কারণ, এগুলো পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয়। কিন্তু মেকি ভ্যাকুয়াম তত্ত্ব প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে দেখা হবে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভার বাইরে ২০০৮ সালে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসি চালু করার পর এটি শুরু করা হয়েছে। এলএইচসির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো হিগস বোসন খুঁজে বের করা। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে এটিই সর্বশেষ কণা। জিগস পাজলের এটিই ছিল শেষ খণ্ড। (হিগস কণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী লিওন লেডারম্যান একে বলেছেন গড পার্টিকেল বা ঈশ্বরকণা।
পদার্থবিদদের বিশ্বাস, হিগস বোসন আসলে ট্যাকিয়ন হিসেবে শুরু হয়েছিল। মেকি ভ্যাকুয়ামে অতিপারমাণবিক কোনো কণার ভর থাকে না। কিন্তু ভ্যাকুয়ামের অস্থিতিশীলতার কারণে ও মহাবিশ্বে নতুন ভ্যাকুয়াম গঠনের সন্ধিক্ষণে হিগস বোসন সাধারণ কণায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ট্যাকিয়ন থেকে সাধারণ কণায় রূপান্তরের এই সন্ধিক্ষণে অতিপারমাণবিক কণাগুলো ভর পেতে শুরু করে। এই ভরই এখন গবেষণাগারে পরিমাপ করি আমরা। কাজেই হিগস বোসন কণার আবিষ্কার স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সর্বশেষে নিরুদ্দিষ্ট খণ্ডই পূরণ করবে। শুধু তা-ই নয়, সেই সঙ্গে এটাও যাচাই করে দেখা হবে একসময় ট্যাকিয়ন পর্যায়ের অস্তিত্ব ছিল কি না এবং পরে সেটি রূপান্তরিত হয়ে সাধারণ কণায় পরিণত হয়েছে কি না।
সংক্ষেপে বলা যায়, নিউটনিয়ান পদার্থবিদ্যা ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা নাকচ করে দেয়। কিন্তু কার্যকারণের লৌহকঠিন নিয়ম এতে কখনো লঙ্ঘিত হয় না। কোয়ান্টাম তত্ত্বে, বস্তুর নতুন অবস্থা থাকা সম্ভব। যেমন প্ৰতিবস্তু, এটি বস্তুর সময়ের পেছনে যাওয়ার শামিল। তবে এতে কার্যকারণ লঙ্ঘিত হয় না। আসলে কোয়ান্টাম তত্ত্বে, কার্যকারণকে পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিবস্তু অপরিহার্য। ট্যাকিয়নকে প্রথমে মনে হয় কার্যকারণ লঙ্ঘন করে। কিন্তু পদার্থবিদেরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মহাবিস্ফোরণের সৃষ্টি করা। কাজেই তাঁদের এখন আর পর্যবেক্ষণ করা যায় না।
সুতরাং ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা বাতিল হয়ে গেল। অন্তত সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত একে তৃতীয় শ্রেণির অসম্ভাব্যতা হিসেবে গণ্য করা যায়। ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা যদি কখনো বারবার পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে সেটি হবে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তির জন্য অনেক বড় একটা ধাক্কা।
তথ্যনির্দেশ
ফাইনম্যান : নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান (১৯১৮-৮৮ খ্রি.)। কোয়ান্টাম মেকানিকসে পাথ ইন্টেগ্রাল ফর্মুলেশন, কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকস, অতি শীতল তরল হিলিয়ামের অতিপরিবাহিতার ক্রিয়াকৌশল ব্যাখ্যা ও কণা পদার্থবিজ্ঞানে কাজের জন্য তিনি সুপরিচিত। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকসে তাঁর অবদানের জন্য ১৯৬৫ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।
কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডাইনামিকস : কণা পদার্থবিজ্ঞানে বিদ্যুৎগতিবিজ্ঞানের একটি আপেক্ষিকতাভিত্তিক কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব। কণাবাদী বিদ্যুৎগতিবিদ্যা সংক্ষেপে কিউইডি (QED) নামেও পরিচিত। আলো ও পদার্থ কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করে, তা আলোচিত হয় এখানে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম মেকানিকস ও বিশেষ আপেক্ষিকতাকে পরস্পরের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান এই তত্ত্বকে বলেছিলেন পদার্থবিদ্যার রত্ন (দ্য জুয়েল অব ফিজিকস)।
গামা রশ্মি : খুব ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় রশ্মি। তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষয় বা মৌলিক কণাদের সংঘর্ষে এই রশ্মির সৃষ্টি হয়।
স্ট্যান্ডার্ড মডেল : কণা পদার্থবিজ্ঞানের একটি তত্ত্ব। মহাকর্ষ বাদে মৌলিক কণাসমূহ ও প্রকৃতির মৌলিক বলগুলোকে ব্যাখ্যা করে। একই সঙ্গে জানা থাকা, সব মৌলিক কণাগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করা হয় এই তত্ত্বের মাধ্যমে। এ মডেলে বলা হয়েছে, সব বস্তুই ১২টি ফার্মিয়ন কণা (৬টি কোয়ার্ক ও ৬টি লেপটন) এবং তাদের বিপরীত বা প্রতিকণা দিয়ে গঠিত। আর তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া সংগঠিত হয় চারটি গেজ বা দূত বোসন কণার মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত এই তত্ত্বের সবগুলো ভবিষ্যদ্বাণীই পরীক্ষার সঙ্গে মিলে গেছে। সম্প্রতি এই তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করা নতুন একটি কণা (যা হিগস বোসন নামে পরিচিত) শনাক্ত করেছেন সার্নের বিজ্ঞানীরা।
হিগস বোসন : হিগস-বোসন কণাটি একসময় গড পার্টিকেল বা ঈশ্বরকণা নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে ওঠে। ২০০৮ সালে সুইজারল্যান্ডে মাটির নিচে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পরিধির সুড়ঙ্গ খুঁড়ে তাতে বসানো হয় লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার বা এলএইচসি। সেখানে আলোর গতিতে ধাবমান দুটি বিপরীতমুখী প্রোটনের মধ্যে সংঘর্ষে সৃষ্টি হয় বিপুল পরিমাণ শক্তি আর অসংখ্য অতিপারমাণবিক কণা। সেখানে বিজ্ঞানীরা খোঁজ পান বহু কাঙ্ক্ষিত হিগস-বোসন কণার। ২০১২ সালের ৪ জুলাই সার্ন এ কণা আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়।