বেদ-পুরাণ এর ইতিবৃত্ত
এই পুস্তকের প্রবন্ধসমূহ বেদ-পুরাণের ভিত্তিতে রচিত। সেজন্য পাঠকদের বেদ পুরাণ সম্বন্ধে একটা ধারণা থাকা উচিৎ। সেই কারণে বেদ-পুরাণ সম্বন্ধে এখানে কিছু বলছি। নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজের কাছে বেদ-পুরাণ অপেক্ষা পবিত্র জিনিষ আর কিছু নেই। পুরাণগুলি পরে লেখা হয়েছিল, বেদই সকলের আগে রচিত। কিন্তু হিন্দুদের বিশ্বাস বেদ রচিত গ্ৰন্থ নয়, ঋষিগণ কর্তৃক দৃষ্ট বা শ্রুত । সেজন্য বেদকে শ্রুতি বলা হয় । সে যাই হোক, বেদই হচ্ছে মানবজাতির সবচেয়ে প্রাচীন গ্ৰন্থ। মোক্ষমূলর (Maximuller ) তাঁর ঋগ্বেদের অনুবাদের প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় বলেছেন যে বেদ হচ্ছে–“the most ancient books in the library of mankind.”
বেদ সংখ্যায় চারটি — ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুৰ্বেদ ও অথর্ববেদ । এদের মধ্যে ঋগ্বেদই প্ৰধান ও সবচেয়ে প্ৰাচীন । ঋগ্বেদ দশটি মণ্ডলে বিভক্ত । প্রত্যেক মণ্ডলে অনেকগুলি করে সূক্ত আছে। প্রতি সূক্ত আবার অনেকগুলি ঋক বা মন্ত্র নিয়ে রচিত । প্ৰতি সূক্ত হচ্ছে এক বা একাধিক দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত স্তুতি ।
।। দুই ।।
ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি দশটি মণ্ডলে বিভক্ত বলে, ঋগ্বেদকে ‘দশতরী’ বলা হয় । তবে এখন আমরা যাকে ঋগ্বেদ বলি, তা ছাড়া আরও ঋক সংহিতা ছিল। বর্তমান ঋগ্বেদ সংহিতা যে শাখার অন্তর্ভুক্ত, তাকে ‘শাকল’ শাখা বলা হয়। পতঞ্জলি তাঁর মহাভাষ্যে এরূপ একুশটি শাখার উল্লেখ করেছেন ( ‘একবিংশতিধা বার্হ্বচ্যম’ ) । তবে বাকী শাখার সূক্তগুলি লুপ্ত হয়ে গেছে। এখন মাত্র ‘শাকল’ শাখার সূক্তগুলিই জীবিত ।
উপরে যে দশটি মণ্ডলের কথা বলেছি, সে দশটি মণ্ডল ‘শাকল’ শাখার ঋকসংহিতার । এই দশটি মণ্ডলের সূক্ত-বিন্যাস একই রকমের নয়। প্রথম ও দশম মণ্ডলের প্রতিটির সূক্ত সংখ্যা হচ্ছে ১৯১। বাকী মণ্ডলগুলির সূক্ত সংখ্যা যথাক্রমে—দ্বিতীয় মণ্ডলের ৪৩, তৃতীয় মণ্ডলের ৬২, চতুর্থ মণ্ডলের ৫৮, পঞ্চম মণ্ডলের ৮৭, ষষ্ঠ মণ্ডলের ৭৫, সপ্তম মণ্ডলের ১০৭, অষ্টম মণ্ডলের ৯২ ও নবম মণ্ডলের ১১৪ । আগেই বলেছি যে মোট সূক্ত সংখ্যা হচ্ছে ১০১৭ ৷ শাকল শাখার বিভিন্ন সংস্করণের অষ্টম মণ্ডলে (৮।৪৯-৫৯ ) এগারটি সূক্তকে ‘বালখিল্য’সূক্ত বলা হয় । এই এগারটি সূক্ত নিয়ে মোট সূক্ত সংখ্যা হচ্ছে ১০২৮ । সংখ্যার বিসংগতি ছাড়া মণ্ডলগুলির আরও এক বৈশিষ্ট্য আছে । দ্বিতীয় থেকে সপ্তম মণ্ডল পর্যন্ত সূক্তগুলি এক-একজন বিশেষ ঋষি বা তাদের বংশধরগণের রচিত। যথাক্রমে এই ঋষিগণ হচ্ছেন- গৃৎসমদ, বিশ্বামিত্র, বামদেব, অত্রি, ভরদ্বাজ ও বশিষ্ট । এই ছয়টি মণ্ডল একএকজন বিশেষ ঋষি বা তাঁদের বংশধরগণের রচিত বলে সাহেবরা এগুলিকে ‘ফ্যামিলি বুকস্’ বলেন । অষ্টম মণ্ডলটি প্রধানত কম্বগোত্রীয় ঋষিগণ কর্তৃক দৃষ্ট ‘প্রগাথ’ মন্ত্রের সংকলন, আর নবম মণ্ডলটি নানা ঋষিগণ রচিত ‘পবমান-সোম’-এর উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্রসমূহের সমষ্টি । প্ৰথম ও দশম মণ্ডলের স্তোত্রগুলি নানা ঋষির রচিত, এবং এগুলি অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের সংযোজন বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন ।
ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি সাধারণতঃ গায়ত্রী ( ২৪ অক্ষর ), উষ্ণিহ ( ২৮ অক্ষর), অনুষ্টুপ (৩২ অক্ষর , বৃহতী ( ৩৬ অক্ষর ), পঙক্তি ( ৪০ অক্ষর ), ত্ৰিষ্টুপ ( ৪৪ অক্ষর ), জগতী ( ৪৮ অক্ষর)–এই সাতটি ছন্দে রচিত ।
ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি পরবর্তীকালের সংস্কৃত ভাষায় রচিত নয়। এগুলি আদি আৰ্যভাষায় রচিত । এর বিশেষ নাম হচ্ছে বৈদিক ভাষা । ঋগ্বেদে এমন অনেক শব্দ আছে ( যথা বিশেষ্য পদ ও ক্রিয়াপদ ) যা পরবর্তীকালের সংস্কৃত ভাষায় দেখতে পাওয়া যায় না । তা ছাড়া, পরবর্তীকালে শব্দের মূল আদিম অর্থও পরিবর্তিত হয়েছে। তার জন্য ঋক মন্ত্রগুলির প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। এই অর্থ নির্ণয়ের সমস্যা যাস্ক-কেও বিব্রত করেছিল। তাঁর ‘নিরুক্ত’ এর সাক্ষ্য বহন করে । সাম্প্রতিককালে ইরাণীয়, হিত্তি ও অন্যান্য আর্যভাষার সাহায্যে আমরা একটা মোটামুটি সন্তোষজনক অর্থ নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছি। বৈদিক ভাষার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল ইরাণীয় ভাষার । ইরাণীয় ‘আবেস্তা’র অনেক মন্ত্র ধ্বনিপরিবর্তনের সাহায্যে ঋকমন্ত্রে রূপান্তরিত করাও সম্ভবপর হয়েছে ।
যাস্ক ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলিকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করেছেন-(১) পরোক্ষকৃত, (২) প্ৰত্যক্ষকৃত, ও (৩) আধ্যাত্মিক । দেবতাকে যেখানে পরোক্ষভাবে স্তুত করা হয়েছে ও ক্রিয়াপদ প্রথম পুরুষে ব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলিই হচ্ছে পরোক্ষাকৃত মন্ত্র । আর দেবতাকে যেখানে প্ৰত্যক্ষভাবে আহ্বান করা হয়েছে, সেগুলি হচ্ছে প্ৰত্যক্ষাকৃত মন্ত্র । আর যেখানে কোন ঋষি, দেবতার সঙ্গে তদাত্মাপ্রাপ্ত হয়ে উত্তমপুরুষের ক্রিয়াপদের সাহায্যে আত্মস্তুতিতে প্ৰবৃত্ত হয়েছেন, সেগুলি আধ্যাত্মিক মন্ত্র। তবে আধ্যাত্মিক মন্ত্রের সংখ্যা খুবই কম। অবশ্য, এর ব্যতিক্রমও আছে । যেমন দশম মণ্ডলের ৯৫ সূক্তে পুরূরবা ও উর্বশীর কথোপকথন । একে সংবাদ-সূক্ত বলা হয়। অনেক সময় লৌকিক বিষয়বস্তুরও অবতারণা করা হয়েছে । এই শ্রেণীর সূক্তগুলিকে ‘অক্ষসূত্র’ বলা হয় । আবার কোন কোন জায়গায় গম্ভীর দার্শনিকতত্বের অবতারণা করা হয়েছে ; যেমন নাসদীয় মুক্ত ) ( ১০৷১২৯ ) ও পুরুষসূক্ত ( ১০।৯০ ) । আবার, কোন কোন জায়গায় অথর্বন মন্ত্রের ন্যায় শাপ, অভিশাপ ইত্যাদিও দেখা যায় ।
সমস্ত ঋগ্ধেদখানা বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতমহল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মন্ত্রগুলি কোন এক বিশেষ সময়ে রচিত হয় নি। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ও কয়েক শতাব্দী ধরে মন্ত্রগুলি রচিত হয়েছিল । এমন কি ঋগ্বেদের মধ্যে এমন অনেক মন্ত্র আছে, যা আৰ্যদের ভারতে আগমনের পূর্বকালের রচিত। দেবতামণ্ডলীর গঠন দেখেও তাই মনে হয়। এ সম্বন্ধে আমি অন্যত্র বিশদ আলোচনা করেছি, সে কারণে এখানে আর তার পুনরাবৃত্তি করছি না । ( লেখকের ‘ডিনামিকস্ অভ্ সিনথেসিস ইন হিন্দু কালচার’ দেখুন)।
।। তিন ।।
সামবেদের নামকরণ করা হয়েছে ‘সামন’ শব্দ থেকে । ‘সামন’ শব্দের অর্থ হচ্ছে দেবতার স্তুতির উদ্দেশ্যে গান । তার মানে, সামবেদ হচ্ছে গানের সংকলন বা গানের জন্য ব্যবহৃত ঋকমন্ত্রই সাম । এক কথায়, যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য যে সকল ঋক উচ্চারিত না হয়ে, গীত হত, তাদের সমষ্টিই হচ্ছে সামবেদ । ঐতরেয়ব্ৰাহ্মণ অনুযায়ী উদ্গাতা, প্ৰস্তোতা ও প্ৰতিহর্তা—এই তিনজন ঋত্বিকে মিলে সামগান করত ।
সামবেদের তেরটি শাখা আছে। তার মধ্যে কৌথুমী শাখাই প্ৰসিদ্ধ। এটা উত্তরভারতে প্রচলিত। দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত শাখার নাম হচ্ছে রানায়নী শাখা ।
।। চার ।।
যজ্ঞের মন্ত্রকে ‘যজুস’ ( যজ+উসি) বলা হয়। যে বেদে এরূপ মন্ত্র আছে, তাকে যজুৰ্বেদ বলা হয়। এরূপ মন্ত্রের উচ্চারণে কোন চরণ বা অবসান থাকত না । সেজন্য যজুৰ্বেদকে গদ্যগ্ৰন্থ বলা হয়। যজুর্মন্ত্র অধ্বর্য়ু নামক ঋষ্ণিকের দ্বারা অনুঃচ্চস্বরে উচ্চারিত হত ।
যজুর্বেদের দুইভাগ— কৃষ্ণ ও শুক্ল । এই দুইভাগ সম্বন্ধে একটা উপাখ্যান আছে। প্রথমে বেদব্যাস বৈশাম্পয়নকে যজুৰ্বেদ শিক্ষা দেন । তারপর বৈশাম্পয়ন যাজ্ঞবল্ক্যকে এটা অধ্যায়ন করান । কোন কারণে বৈশাম্পায়ন যাজ্ঞবল্ক্যের ওপর রুষ্ট হয়ে, তাকে অধীত বিদ্যা ত্যাগ করতে বলেন । যাজ্ঞবল্ক্য বমন করে তার অধীত বিদ্যা ত্যাগ করে । তখন বৈশাম্পয়নের অন্য শিষ্যরা তিত্তিরিপক্ষী হয়ে ওই বমনকৃত যজুর্মন্ত্র ভক্ষণ করে । তাদের মলিন বুদ্ধির জন্য এই যজুর্মন্ত্র কৃষ্ণ হয়ে যায় । সে জন্য এর নাম কৃষ্ণ যজুৰ্বেদ বা তৈত্তিরীয় সংহিতা আখ্যা হয়। অনেকে মনে করেন যে শুক্ল যজুৰ্বেদ কুরু-পঞ্চাল দেশে ও কৃষ্ণ যজুৰ্বেদ মিথিলায় প্রচলিত ছিল। সামবেদের ন্যায় যজুর্বেদও যজ্ঞীয় সাহিত্য।
যজুর্বেদের বিভাগগুলি ক্রিয়ামূলক । এর ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন যজ্ঞক্রিয়ার মন্ত্র ও বিধান আছে । এই সকল বৈদিক যজ্ঞক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে –দৰ্শযাগ, পিণ্ডাপিতৃযজ্ঞ, অগ্নিহোত্ৰ, অগ্নিষ্টোম, রাজসূয়, সৌত্রামনী, অগ্নিচয়ণ, অশ্বমেধ, পুরুরমেধ, সর্বমেধ, ও পিতৃমেধ । যজ্ঞে মন্ত্রগুলি বিশুদ্ধভাবে উচ্চারিত হবার জন্য যে নিয়মগুলি প্ৰণীত হয়েছিল, তা থেকে ‘দেববিদ্যা’, ‘ব্রহ্মবিদ্যা’ ও ব্যাকরণের উৎপত্তি হয় । এবং যজ্ঞ সম্পাদনের জন্য যে চিতি তৈরী করা হত, তার নিয়মগুলি থেকে জ্যামিতি শাস্ত্রের উদ্ভব হয় । শুক্র যজুর্বেদের চতুর্দশ অধ্যায়টি উপনিষদ । একে ঈশা উপনিষদ বলা হয় ।
।। পাঁচ ।।
অথর্ববেদ পরে রচিত হয়েছিল। এর ক্রিয়াকলাপাদি ঋক, সাম ও যজুর্বেদের যজ্ঞক্রিয়াদি থেকে পৃথক । সেজন্য মনে হয় আদিতে ঋক, সাম ও যজু –এই তিন বেদ ছিল । কেননা, ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণ ( ৫।৩২)। শতপথব্রাহ্মণ ( ১৷৬।৭৷১৩ ) বৃহদারণ্যক উপনিষদ ( ১।৫।৫ ), ও ছান্দোগ্য উপনিষদ (৩।১৭৷১) প্ৰভৃতি প্ৰাচীন গ্রন্থের অনেক স্থলে মাত্র ঋক, সাম ও যজুবেদের উল্লেখ আছে। প্রাচীন ধর্মসূত্রগুলিতে ও মনুসংহিতাতেও তিনটি বেদেরই উল্লেখ আছে। সেজন্য ঋক, সাম ও যজুৰ্বেদকে ত্রয়ী বলা হয় । অথর্ববেদ পরবর্তী কালের সংযোজন । এতে ঐহিক ফলপ্রদ, শত্রুমারণাদির উপযোগী ক্রিয়াকলাপের মন্ত্রসমূহ আছে। এগুলি সোম যজ্ঞাদিতে অব্যবহার্য । সেজন্যই এর নাম অথর্ব ।
অথর্ববেদ ২০ কাণ্ডে বিভক্ত । এর সুক্ত সংখ্যা প্ৰথম কাণ্ডে ৩৫, দ্বিতীয় কাণ্ডে ৩৬, তৃতীয় কাণ্ডে ৩১, চতুর্থ কাণ্ডে ৪০, পঞ্চম কাণ্ডে ৩১, ষষ্ঠ কাণ্ডে ১৪২, সপ্তম কাণ্ডে ১১৮, অষ্টম কাণ্ডে ১০, নবম কাণ্ডে ১০, দশম কাণ্ডে ১০, একাদশ কাণ্ডে ১০, দ্বাদশ কাণ্ডে ৫, ত্ৰয়োদশ কাণ্ডে 8, চতুৰ্দশ কাণ্ডে ২, পঞ্চদশ কাণ্ডে ১৮, ষোড়শ কাণ্ডে ৯, সপ্তদশ কাণ্ডে ১, অষ্টাদশ কাণ্ডে ৪, উনবিংশ কাণ্ডে ৭১ ও বিংশ কাণ্ডে ১৪৩, উনবিংশ কাণ্ডটি হচ্ছে অন্যান্য কাণ্ডের পরিশিষ্ট । আর বিংশ কাণ্ডটি ঋগ্বেদ থেকে উদ্ধত সূক্তে পরিপূর্ণ। এই উদ্ধৃতিসমূহ অধিকাংশই ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের সূক্ত । অথর্ববেদের অধিকাংশ অংশই পদ্য, তবে কিছু অংশ গদ্য আছে ।
।। ছয় ।।
এ পর্যন্ত যে বৈদিক সাহিত্যের কথা বলা হল, তাকে সংহিতা বলা হয় । এ ছাড়া, বেদের আরও তিনটা ভাগ আছে যথা (১) ব্ৰাহ্মণ, (২) আরণ্যক, ও (২) উপনিষদ । ব্ৰাহ্মণগ্রন্থগুলির মধ্যে সন্নিবিষ্ট বিষয়বস্তু সমূহ হচ্ছে মন্ত্রের অর্থমীমাংসা, যজ্ঞের অনুষ্ঠান সম্বন্ধে বিস্তীর্ণ বিবরণ ও নানা বিষয়ক উপাখ্যান। ঋগ্বেদের দুইটা প্ৰধান ব্ৰাহ্মণ হচ্ছে- ১) শাঙ্খায়ণ বা কৌষীতকী, ও (২) ঐতরেয় । ব্ৰাহ্মণের যে অংশ অরণ্যে পাঠ করা হত, তাকে ‘আরণ্যক’ বলা হত । শাঙ্খায়ণ বা কৌষীতকী আরণ্যক ১৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এর তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায়কে কৌষীতকী উপনিষদ বলা হয়। ঐতরেয় ব্ৰাহ্মণে ৪০টি অধ্যায় আছে। এর প্রায় সমগ্ৰ অংশই সোমাযজ্ঞের বিবরণে পূর্ণ। শেষের দশটি অধ্যায়কে অপেক্ষাকৃত আধুনিক মনে করা হয়। এই অংশে ইক্ষাকুবংশীয় রাজা হরিশ্চন্দ্রের কথা আছে । একেবারে শেষের তিনটি অধ্যায়ে কিছু কিছু ঐতিহাসিক বিবরণ আছে, যেমন প্রাচ্যে বিদেহ প্ৰভৃতি জাতিদিগের সাম্রাজ্য, দক্ষিণে ভোজরাজ্য, পশ্চিমে নীচ্য ও অপাচ্য রাজ্য, ও উত্তরে উত্তর কুরু ও উত্তর মদ্রদিগের রাজ্য ও মধ্যদেশে কুরুপঞ্চালদিগের রাজ্য প্রভৃতির উল্লেখ আছে। এ ছাড়া, পরিক্ষীত পুত্ৰ জনমেজয়, মনুপুত্র শার্যার্ত, উগ্ৰসেন পুত্ৰ যুধাংশ্রেষ্ঠি, বিজবন পুত্ৰ সুদাস, দুষ্মন্ত পুত্র ভরত প্ৰভৃতি অনেক রাজার নাম আছে ।
সামবেদের দুটি প্রধান ব্ৰাহ্মণ হচ্ছে তাণ্ড্য ও ষড়বিংশ । আসলে সামবেদীয় ( কৌসুমী শাখার ) ব্ৰাহ্মণ ৪০ ভাগে বিভক্ত। তার মধ্যে ২৫ ভাগকে তাণ্ড্য বা পঞ্চবিংশ, ৫ ভাগকে ষড়বিংশ, দুইভাগকে মন্ত্রব্ৰাহ্মণ ও ৮ ভাগকে ছান্দোগ্য উপনিষদ বলা হয় । তাণ্ড্য ব্ৰাহ্মণে সোমাযজ্ঞের বিবরণ, ব্রাত্যস্তোমে ব্রাত্যদিগের বিবরণ, নৈমিষারণ্যের যজ্ঞ ও কুরুক্ষেত্রের উল্লেখ আছে। এতে কোশলরাজ পর আত্মার ও বিদেহরাজ নামী সাপ্যের উল্লেখও পাওয়া যায়। ষড়বিংশ ব্ৰাহ্মণে অনেক প্রকার প্রায়শ্চিত্ত বিধান ও দুৰ্দৈব, পীড়া, শস্যনাশ, ভূমিকম্প প্রভৃতি বিপদখণ্ডণ উপযোগী অনুষ্ঠানের কথা আছে। এখানে বলা প্ৰয়োজন যে পঞ্চবিংশ ব্ৰাহ্মণ ও ষড়বিংশ ব্ৰাহ্মণে যে সকল যজ্ঞের বিবরণ আছে, তাদের শ্রৌতযজ্ঞ বলা হয় । মন্ত্রব্রাহ্মণে গৃহস্থের অনুষ্ঠেয় গৃহাক্রিয়ার বিবরণ পাওয়া যায় । ছন্দোগ্য উপনিষদে ওঁ শব্দ, উদ্গীথ, সাম ও পরমব্ৰহ্ম প্ৰভৃতি বিষয়ের আলোচনা পাওয়া যায় । এ ছাড়া, দেবকীনন্দন শ্ৰীকৃষ্ণ, সত্যকাম জাবাল, শ্বেতকেতু আরুনেয়, অশ্বপতি কৈকেয়, শ্বেতকেতুর পিতা উদ্দালক, আরুনি, সনৎকুমার, নারদ প্রভৃতির কথা আছে ।
কৃষ্ণ যজুৰ্বেদ বা তৈক্তিরীয় ব্রাহ্মণ তিনভাগে বিভক্ত। এর দশটি অধ্যায় বা প্রপাঠক আছে। তার মধ্যে সপ্তম, অষ্টম ও নবম প্রপাঠককে তৈত্তিরীয় উপনিষদ বলা হয়, আর শুক্ল যজুর্বেদের বিস্তীর্ণ ব্ৰাহ্মণের নাম শতপথব্রাহ্মণ । মাধ্যান্দিন শাখার শতপথব্রাহ্মণ ১৪টি কাণ্ডে ও ১০০টি অধ্যায়ে বিভক্ত । সেজন্যই একে শতপথব্রাহ্মণ বলা হয়। ১৪টি কাণ্ডের মধ্যে নয়টি খুব প্ৰাচীন । দশমটিতে অগ্নিরহস্য ও একাদশে অগ্নিচয়নের কথা আছে । ত্রয়োদশে অশ্বমেধ ও নরমেধ-এর কথা আছে । এই কাণ্ডে দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার পুত্র ভরত, ভারতদিগের রাজা সাত্রোজিত ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কাশীরাজ ধৃতরাষ্ট্র, পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয় ও তাঁর ভ্ৰাতা ভীমসেন, উগ্ৰসেন ও শ্রুতসেন প্ৰভৃতি রাজাদের কথা আছে । শতপথব্রাহ্মণের চতুৰ্দশ কাণ্ডকে আরণ্যক বলা হয়। এরই শেষের ছয় অধ্যায় বৃহদারণ্যক উপনিষদ। এতে আলোচিত হয়েছে সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি, গার্গ্য, বালাকি ও কাশীর রাজা অজাতশত্রুর কথা, বিদেহরাজ জনকের কথা, গাৰ্গ বাচক নবীর কথা, যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ীর কথা, উদ্যালক আরুণির কথা, ও পরম ব্ৰহ্ম, পরমাত্মা, ব্ৰহ্ম ও প্ৰজাপতি, বেদত্ৰয় ও গায়ত্রী সম্বন্ধে ।
অথর্ববেদের ব্ৰাহ্মণের নাম গোপথ ব্ৰাহ্মণ । এতে এগারটি অধ্যায় বা প্ৰপাঠক আছে । শতপথব্ৰাহ্মণে যে সকল উপাখ্যান বিবৃত হয়েছে, তা গোপথব্ৰাহ্মণেও দেখতে পাওয়া যায় ।
আগেই বলেছি যে উপনিষদগুলি হচ্ছে দার্শনিক গ্রন্থ । এগুলি প্ৰধানত পরমব্রহ্মের আলোচনাতেই পরিপূর্ণ। অথর্ববেদের উপনিষদগুলি নানারূপ সাম্প্রদায়িক বিতর্কে পরিপূর্ণ। উপনিষদগুলির এক সময় সংখ্যা ছিল অনেক । তবে বর্তমানে ১২টি উপনিষদই প্ৰধান বলে গণ্য হয় । এগুলি হচ্ছে –(১) ঋগ্বেদের কৌষীতকী ও ঐতরেয়, (২) সামবেদের ছন্দোগ্য ও কেন, (৩) কৃষ্ণ যজুর্বেদের তৈত্তিরীয়, কঠ ও শ্বেতাশ্বতর, (৪) শুক্ল যজুর্বেদের বৃহদারণ্যক ও ঈশা, ও (৫) অথর্ববেদের প্রশ্ন, মুণ্ডক ও মাণ্ডুক্য ।
।। সাত ।।
আগেই বলেছি যে বেদকে শ্রুতি বলা হয় । তার কারণ বেদ গোড়ায় মুখে মুখে উচ্চারিত হত। পরেকার সাহিত্য সূত্রাকারে রচিত হয়েছিল । সূত্র সমূহের অন্যতম হচ্ছে পাণিনীয় জগৎ বিখ্যাত ব্যাকরণ সূত্র । আচার ব্যবহার ও রীতিনীতির জন্য রচিত হয়েছিল ধর্ম সূত্রসমূহ।
এই সময় আৰ্যসভ্যতার বিরুদ্ধে এক অবরোধ গঠন করেন। গৌতম বুদ্ধ। বুদ্ধপ্রবর্তিত ও প্রচারিত ধর্ম ভারতের সাংস্কৃতির ক্ষেত্রে এক বিপ্লব ঘটায়। মোটামুটিভাবে এই বিপ্লব গুপ্তসম্রাটগণের অভ্যুদয় কাল ( খ্ৰীষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী) পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই বিপ্লবের প্রকোপে ব্যয়সাধ্য যজ্ঞের আড়ম্বর ও অনুষ্ঠানসমূহ ক্রমশ হ্রাস পায় । গুপ্তসম্রাটগণের আমলে ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের পূর্ণপ্রতিষ্ঠা হয়, কিন্তু ব্যায়সাপেক্ষ যাগযজ্ঞাদির পরিবর্তে স্বল্পখরচে কৃত পূজাদির প্রবর্তন হয়। এই সময় লৌকিক দেবতাসমূহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাদের মাহাত্ম্য কীর্তিত হয় পুৰাণসমূহে ।
।। আট ।।
বেদোত্তর যুগের প্রাচীন সাহিত্য হচ্ছে পুরাণসমূহ । পুরাণসমূহে আছে ইতিহাস, কাহিনী, উপকথা ও বিভিন্ন দেবতাদের কথা । যদিও এগুলি বেদোত্তর যুগে রচিত হয়েছিল, তাহলেও এরূপ চিন্তা করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ, অতি প্ৰাচীনকালের। পুরাভবম্ ইতি পুরাণম্ –এই বচন থেকেও এটা সমর্থিত হয়।
পুরাণগুলি সংখ্যায় বহু ৷ তবে তাদের মধ্যে আঠারটি পুরাণকে মহাপুরাণ বলা হয়। বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী এই আঠারটি মহাপুরাণ হচ্ছে – (১) ব্ৰহ্ম, (২) পদ্ম, (৩) বিষ্ণু, (৪) শিব, (৬) ভাগবত, (৬) নারদ, (৭) মার্কণ্ডেয়, (৮) অগ্নি, (৯) ভবিষ্য, (১০) ব্ৰহ্মবৈবর্ত, (১১) লিঙ্গ, (১২) বরাহ, (১) স্কন্দ. (১৪) বামণ, (১৫) কুৰ্ম, (১৬), মৎস্য, (১৭) গরুড় ও (১৮) ব্ৰহ্মাণ্ড । উপপুরাণগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে- (১) দেবীভাগবত, (২) কালিকাপুরাণ ও (৩) বিষ্ণুধর্মেত্তিরপুরাণ । মহাপুরাণগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে স্কন্দপুরাণ। এতে ৮১,৮০০ শ্লোক আছে। এটা মহাভারতের চেয়েও বড়। আর উপপুরাণগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণ ।
অমরকোষ অনুযায়ী পুরাণগুলি পঞ্চলক্ষণযুক্ত। এই লক্ষণগুলি যথাক্রমে – (১) সৰ্গ ( সৃষ্টি ), (২) প্ৰতিসৰ্গা ( প্ৰলয়ের পর নবসৃষ্টি ), (৩) বংশ ( দেবতা ও ঋষিগণের বংশতালিকা ), (৪) মন্বন্তর ( চতুৰ্দশ মনুর শাসন বিবরণ ) ও (৫) বংশানুচরিত ( রাজগণের বংশাবলী ) । তবে ভাগবত ও ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণের লক্ষণ দশটি-যথা (১) সৰ্গ, (১) বিসর্গ, (৩) বৃত্তি, (৪) রক্ষা, (৫) অন্তর, (৬) বংশ, (৭) বংশানুচরিত, (৮) সংস্থা, (৯) হেতু ও (১০) অপাশ্রয়। মৎস্যপুরাণে একাদশ লক্ষণের কথা বলা হয়েছে । সেখানে বলা হয়েছে যে প্ৰাগোক্ত পঞ্চলক্ষণ ছাড়া পুরাণের আরও লক্ষণ হচ্ছে–(৬) ভূবন বিস্তার, (৭) দানধৰ্মবিধি, (৮) শ্ৰাদ্ধকল্প, (৯) বৰ্ণাশ্রম বিভাগ, (১০) ইষ্টাপূর্ত ও (১১) দেবতা প্রতিষ্ঠা ।
সমস্ত পুরাণগুলিকেই বেদব্যাসের রচিত বলা হয়। এদের প্রবক্তা হচ্ছেন লোমহর্ষণ পুত্ৰ উগ্রশবা । উগ্রশবা এর প্রচার করেন নৈমিষারণ্যে ! মহাভারতের ন্যায় পুরাণগুলিকে ‘জয়’ নামে অভিহিত করা হয়।
উনিশ শতকে জীবানন্দ বিদ্যাসাগরই প্রথম পুরাণগুলি মুদ্রিত করেন । পরে বঙ্গবাসী প্রেস বঙ্গানুবাদ সহ পুরাণগুলি প্ৰকাশ করে। বর্তমানে বোম্বাইয়ের বেঙ্গকটেশ্বর প্রেস ও কলকাতার আর্যশাস্ত্ৰ কাৰ্য্যালয় পুরাণগুলি আবার প্রকাশ করছে ।
সত্ত্ব, তম ও রজাগুণ অনুসারে পুরাণগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা হয় । বিষ্ণু, নারদ, ভাগবত, গরুড়, পদ্ম ও বরাহ সত্ত্বগুণ বিশিষ্ট পুরাণ । মৎস্য, কুৰ্ম, লিঙ্গ, স্কন্দ ও অগ্নি তমোগুণ বিশিষ্ট পুরাণ। আর ব্রহ্মা, ব্ৰহ্মাণ্ড, ব্ৰহ্মবৈবর্ত, মার্কণ্ডেয়, ভবিষ্য ও বামন রজ গুণ বিশিষ্ট পুরাণ ।
পুরাণগুলির মধ্যে অগ্নিপুরাণে এত প্রকীর্ণ বিষয়ের সমাবেশ আছে যে একে একখানা বিশ্বকোষ বলা যেতে পারে । এতে আছে প্ৰতিমালক্ষ্মণ, রত্নপরীক্ষা, মন্দির প্রতিষ্ঠা, বাস্তুণাস্ত্র, হস্তী ও অশ্বাচিকিৎসা আয়ুৰ্বেদ, নাটক, অভিনয়, রসাদি নিরূপণ, অলঙ্কার, বিচার, ব্যাকরণ ও অভিধান । এতে বিষ্ণু, লিঙ্গ, দুর্গা, গণেশ, সূর্য প্রভৃতি দেবতার পূজা, তান্ত্রিক অনুষ্ঠান, দেবতার মূর্তি নিৰ্মাণ ও প্রতিষ্ঠা, বিবাহানুষ্ঠান, অন্তেষ্টিপদ্ধতি প্ৰভৃতির কথা ছাড়া, মৃত্যু ও জন্মান্তরবাদ, সৃষ্টিতত্ত্ব, ভূগোল, বংশানুকীর্তন প্ৰভৃতি বিশুদ্ধ পৌরাণিক বিষয়েরও বিবরণ আছে । আরও যে সব বিষয় এতে আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে আছে জ্যোতিষ শাকুন বিদ্যা, গৃহনির্মাণ, রাজনীতি, যুদ্ধ বিদ্যা, চিকিৎসা, ছন্দ, কাব্য ইত্যাদি । অনুরুপভাবে বিশ্বকোষের সামিল হচ্ছে স্কন্দপুরাণ । আগেই বলেছি যে এতে ৮১৮০ ০ শ্লোক আছে। এতে স্কন্দ বা শড়াননের ঘটনাবলী বিবৃত হয়েছে। ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, কাশী, আবন্তী, নাগর ও প্রভাস এই সাত খণ্ডে বিভক্ত। এই পুরাণখনি যে অতি আধুনিক পুরাণ সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কেননা সত্যনারায়ণের ব্রত কথাও এতে আছে।
ব্ৰহ্মপুরাণকে আদিপুরাণ বলা হয়। তার কারণ হিন্দুর বিশ্বাস এই পুরাণই প্রথম রচিত হয়েছিল। এই পুরাণে সৃষ্টিতত্ত্ব, দেবতা ও অসুরগণের জন্ম, সূর্য ও চন্দ্ৰ বংশের বিবরণ, বিশ্ববৰ্ণনা, দ্বীপ ও বর্ষ, স্বর্গ, নরক ও পাতালদির বিবরণ, শ্ৰীকৃষ্ণের জীবন চরিত ও যোগশাস্ত্রের ব্যাখ্যা আছে। আবার অনেকের মতে ব্ৰহ্মপুরাণ নয়, আদিপুরাণ হচ্ছে বায়ুপুরাণ। বানভট্ট এই আদি পুরানের উল্লেখ করেছেন । গয়াশ্রাদ্ধ ও গয়ামাহাত্ম্য এই পুরাণের অন্তৰ্গত । বায়ুপুরাণের চারটি পাদ যথা প্রক্রিয়া, অনুষঙ্গ, উপোদখাত ও উপসংহার।
পুরাণসমূহের পঞ্চলক্ষণ বিশুদ্ধভাবে দেখতে পাওয়া যায় বিষ্ণুপুরাণে । সাহেবরা এর ঐতিহাসিক মূল্যও স্বীকার করেছেন । এটা পঞ্চরাত্র বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অন্যতম মূল গ্ৰন্থ । আচার্য রামানুজও এর প্রামাণ্য স্বীকার করেছেন । এটা ছয়ভাগে বিভক্ত, যথা (১) বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর উৎপত্তি, ধ্রুব চরিত্র, প্ৰহলাদ চরিত্র ইত্যাদি আখ্যান, (২) পৃথিবী, সপ্তদ্বীপ, সপ্তসমুদ্র ; (৩) ব্যাস কর্তৃক বেদবিভাগ, শাখা বিভাগ, আশ্রম ধর্ম ইত্যাদি ; (৪) সূর্য ও চন্দ্ৰবংশ এবং রাজবংশের বর্ণনা , (৫) কৃষ্ণচরিত্র, বৃন্দাবন লীলা, রাসলীলা ইত্যাদি ; (৬) বিষ্ণুভক্তি, যোগ ও মুক্তির কথা ।
অন্যান্য পুরাণে অন্যান্য দেবতার মহাত্ম্য বিবৃত হয়েছে। পদ্মপুরাণ বৈষ্ণবপুরাণ | পদ্মপুরাণে ৫৫,০০০ শ্লোক আছে । পাঁচখণ্ডে এই পুরাণ বিভক্ত, যথা সৃষ্টিখণ্ড, ভূমিখণ্ড, স্বৰ্গখণ্ড, পাতালখণ্ড ও উত্তরখণ্ড । এতে যে সব বিষয় বিবৃত হয়েছে, তা হচ্ছে–সৃষ্টির আদিক্রম, তারকাসুরের উপাখ্যান, গো মাহাত্ম্য, বৃত্ৰবধ, পৃথুচরিত, বেণুরাজার উপাখ্যান, নহুষ ও যযাতির কাহিনী, ব্রহ্মখণ্ডের উৎপত্তি, কুরুক্ষেত্রাদি তীর্থ বিবরণ, কাশী, গয়া, প্ৰয়াগ প্ৰভৃতির মাহাত্ম্য কীর্তন, কর্মযোগ নিরুপণ, অগস্তাদি ঋষির আগমন, রাবণোপাখ্যান, জগন্নাথের বিবরণ, কৃষ্ণের নিত্যলীলা কথন, দধীচির উপাখ্যান, শিব মাহাত্ম্য, ব্ৰতমাহাত্ম্য, নৃসিংহ উৎপত্তি, জম্বুদ্বীপের অন্তর্গত তীৰ্থসমূহের মাহাত্মা, ভাগবত মাহাত্ম্য, অবতারাদির বিবরণ ইত্যাদি ।
নারদপুরাণে শিব ও বিষ্ণু মাহাত্ম্য, বৈষ্ণব ধর্ম ও বৈষ্ণব আচরণ, ও তীর্থপ্রসঙ্গ আছে। ভবিষ্যপুরাণে সূর্য পূজার বিস্তৃত ইতিহাস আছে । ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণ কৃষ্ণলীলাত্মক । লিঙ্গপুরাণ শৈবপুরাণ। বরাহ বৈষ্ণবপুরাণ। বামুনপুরাণে শিব ও বিষ্ণুর উভয়েরই মাহাত্ম্য বিবৃত হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পু্রাণে সুপ্ৰসিদ্ধ দেবীমাহাত্ম্য বা সপ্তশতী চণ্ডীর স্তোত্র আছে । তা ছাড়া, এতে আছে বশিষ্ট ও বিশ্বামিত্রের কলহ, দুর্গ কথা, শ্ৰীকৃষ্ণের বাল্যাবস্থা কথন, হরিশ্চন্দ্রের উপাখ্যান, মদালসার উপাখ্যান, রুদ্রাদি সৃষ্টি, মার্কণ্ডের জন্ম, ইক্ষাকুচরিত, রামচন্দ্রের উপাখ্যান, পুরূরিবার উপাখ্যান ইত্যাদি। গরুড়পুরাণ বৈষ্ণবপুরাণ। কুর্ম ও ব্ৰহ্মাণ্ড প্রাচীন পুরাণ । মৎস্যপুরাণে সমুদয় পুরাণের একটা অনুক্রমনী দেওয়া আছে। উপপুরাণগুলির মধ্যে দেবীভাগবত শক্তিগণের কাছে মহাপুরাণ হিসাবে পরিগণিত হয়। বর্তমান দুর্গাপূজা কালিকাপুরাণ অনুযায়ী হয় । সমুদয় উপপুরাণের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে বিষ্ণুধর্মোত্তরপুরাণ। এর প্রথম খণ্ডে সৃষ্টি প্রকরণ, বংশ তালিকা ও উপাখ্যানাদির সঙ্গে কাশ্মীর ও গান্ধার দেশের ভৌগলিক বিবরণ আছে । দ্বিতীয় খণ্ডে নীতি ও ধর্মশাস্ত্র, আয়ুৰ্বেদ ও জ্যোতিষ, তৃতীয় খণ্ডে ব্যাকরণ, অভিধান, ছন্দ, অলঙ্কার, নৃত্যগীত, স্থাপত্য, প্ৰতিমানির্মাণ ও চিত্রকলার কথা ব্যাখ্যাত আছে ।
স্থানে স্থানে অসংগতি থাকলেও পুরাণগুলির ঐতিহাসিক মূল্য যথেষ্ট ।