১৫
বিকেল বিকেলই গিয়ে পৌঁছল পৃথু।
রুষাকে বলে, অজাইব সিংকে সঙ্গে নিয়ে গেছিল। ওকে পৌঁছে দিয়েই চলে আসবে। ফেরার সময় ভুচুই নামিয়ে দেবে। অথবা নিজেই গিরিশদার ল্যান্ডমাস্টার গাড়িটা চালিয়ে চলে আসতে পারে। শামীমের মোটর সাইকেলেও আসতে পারে। ফেরাটা কোনও প্রবলেম নয়।
পৃথু গিয়ে পৌঁছতে না পৌঁছতেই শামীম এল তার মোটর সাইকেল ফটফটিয়ে। তার আজকের পোশাকই আলাদা! চুড়িদার পাজামা, লক্ষ্ণৌ-এর কাজ করা কুর্তা, মাথায় বকরি ঈদের নামাজে যেমন সাদা টুপি পরে, তেমন টুপি। গা দিয়ে ভুরভুর করে ফিরদৌস ঈত্বর-এর গন্ধ বেরুচ্ছে। পৃথু ফিরদৌস আর রুহ খস্স্ মাখে গরমের দিনে। ফিরদৌস শীতে কম লোকই মাখে। শামীম অন্যদের চেয়ে আলাদা বলেই মেখেছে। পৃথু শামামা অথবা অম্বর ঈত্বরই মাখে শীতে। শীতে অনেকে হিনা অথবা গুলাবও মাখেন। বড় তীব্র লাগে ওই দুই আতরের গন্ধ পৃথুর নাকে।
ওরা সকলেই হাত লাগাল। বসার ঘরের সব ফার্নিচার সরিয়ে বিরাট কার্পেট পাতা হয়েছে। তার উপরে সাদা চাদর পেতে ফরাস বিছানো হয়েছে। ফুলও এসেছে বহত কিসিমের। গোলাপজলের স্প্রে ঠিক করে রেখেছে মুনেশ্বর।
ইতিমধ্যে ভুচুও এসে গেল, বন্দোবস্ত কেমন হল না হল, তা দেখে যাওয়ার জন্যে। ওই গাড়ি নিয়ে যাবে সাবীর মিঞার বাড়ি। সেখান থেকে তওয়ায়েফওয়ালী সারেঙ্গীওয়ালা এবং তবলচিদের তুলে আনবে। কুমার সরজু নারায়ণ মিশ্র ওরফে লাড্ডু, তার বাবা রাজা বীরজু নারায়ণ মিশ্রর সঙ্গে আসবে। রাজার একটি ঢাউস ওল্ডসমবিল গাড়ি আছে। সে গাড়িটি এখানেই থাকে, লাড্ডুর কাছে। শুধু সেরিমনিয়াল অকেশানেই ব্যবহার করে লাড্ডু। অন্য সময়ে সে তার এক ঘোড়ার এক্কা চালিয়ে যাওয়া-আসা করে। রহিস আদমি বলে খ্যাতি আছে হাটচান্দ্রাতে লাড্ডুর। সেই ওল্ডসমবিল গাড়ির উপরে হামলে পড়ে চারজন হাট্টা-কাট্টা লোক ভোরবেলা থেকে ম্যানসন পালিশের বড় বড় ডাব্বা নিয়ে পালিশ করছে। রূপোলি রঙের গাড়ি। পাঁচ লিটারে, ইদানীং পাঁচ মাইল যায়। ভুচু বলছিল। বুকের পাঁজরই জ্বলে, পেট্রলের বদলে। তবু, রাজা-রাজড়ার ব্যাপার তো। রাজত্ব চলে গেছে, রাজসিক ব্যাপার-স্যাপার, রহিসি, কিছু এখনও রয়ে গেছে। তবে, ওদের এমনি রোজগারও কম নয়। ডেয়ারি এবং মিঠাই-এর দোকান রৈ রৈ করে চলে।
গিরিশদার কাকবাহিনী সমস্বরে এমন ডাকাডাকি শুরু করেছে যে, পৃথুর খুবই দুশ্চিন্তা হল। গানের মধ্যে যদি ক্রোলন ক্রোলন বা ক্রেন ক্রেন করে তারা ডাকাডাকি শুরু করে দেয় তাহলেই চিত্তির!
শামীম বলল, শালাদের খাঁচাগুলো বাইরে বের করে দিয়ে আসব নাকি?
গিরিশদা হাঁ হাঁ করে উঠলেন। বললেন, পাগল। ওদের ঠাণ্ডা লাগবে। তাছাড়া ওদের নিয়ে তোমাদের কোনওই সমস্যা হবে না। ওরা রাতের বেলা ডাকবে না। সান-ডাউনের পর কাকের ডাক শেষ; হুইস্কি খাওয়া শুরু হয়। এই-ই নিয়ম!
দেখতে দেখতে সন্ধে হয়ে গেল। শীতের সন্ধ্যা অমন ঝুপ করেই আসে। সাবীর মিঞা এবং তওয়ায়েফরা আসার আগে গিরিশদা পৃথুদের সকলকেই এক পাত্তর করে চড়িয়ে দিলেন। খাটা-খাটনির আগে শরীর মেরামতি আর কী! আজ হুইস্কি নয়। লবঙ্গর সঙ্গে চিনি দিয়ে তাওয়াতে কড়া করে ভেজে, মহুয়ার বোতলের মধ্যে ফেলে তারপর সেই মহুয়া ছেঁকে নিয়েছেন। বস্তুটির চেহারাটি হয়েছে অনেকটা রাম-এর মতো। খেতে, জ্যামাইকান বিকার্ডি রাম আর অ্যান্টিকুয়ারি হুইস্কি মেশালে যেমন বিচিত্তির স্বাদ হতে পারে, তেমন। এক চুমুকেই মাথা সাফ। আর দিল খুশ।
গিরিশদা বললেন, রাজা সাহেব আফিং খান। তাঁর জন্যে সে বন্দোবস্তও রাখা হয়েছে। এবং দুধ। রাবড়ি। আফিং যে কেন খায় লোকে।
কেন? অনেকই তো খায়। শামীম বলল।
তা খায়। কিন্তু তোমরা সেই ইন্দোরের পরদেশিপুরার আফিংখোর আর মাতালদের ঝগড়ার গল্প জানো না? আমি তাদের দুজনকেই চিনতাম ছোটবেলায়।
কী গল্প? জানি না তো! শামীম শুধোল।
এক আফিংখোর আর মাতাল থাকত পাশাপাশি ঘরে। আফিং সেবন করে সেই আফিংখোর রোজই চেঁচামেচি করত আর মাতালকে গালাগালি দিত। মাতাল মানে, মত্ত নয়, মদ সে খেত; কিন্তু বেচাল ছিল না কোনও। জাতে মাতাল, তালে ঠিক। সে বেচারি শেষে একদিন আর সহ্য করতে না পেরে আফিংখোরকে বলল,
দারু পীয়া ত কেয়া বাফা? দুল খুশ ঔর পেট সাফা/আফিং পীয়া ত কেয়া বাফা? গাঁড় তংক ঔর দিল খাফা। মানে মদ খেলে মন খুশি আর পেট সাফ আর আফিং খেলে কন্ স্টিপেশান্ এবং দিল খাপ্পা।
ওরা সকলে হেসে লুটোপুটি খেল।
হবেই! পেট পরিষ্কার না হলেই মেজাজ অপরিষ্কার হয়। এ কে না জানে।
গিরিশদা বললেন।
ভুচু বলল, সত্যি, গিরিশদা! তোমার স্টকে কিছু গল্পও আছে বটে!
ভুচুও আজ পায়জামা পাঞ্জাবি পরেছে। ঘাড়ে পাউডারও মেখেছে। যদিও শীতকাল। শীতকাল হলে কী হয়। দৌড়াদৌড়ি এবং পেটের মধ্যে লিকুইড ফায়ারের ধিকিধিকি জ্বলার কারণে শীতকালেও সময় সময় ঘাম হয় বৈ কি!
ভুচু চলে গেল সাবীর মিঞাদের আনতে। ইতিমধ্যে সেই রূপোলি ওল্ডসমবাইল চড়ে রাজা বীরজু নারায়ণ এবং তাঁর ছেলে কুমার সরজু নারায়ণ এসে হাজির। সঙ্গে জোড়া তানপুরা। রাজা সাহেবের চেহারাটা অনেকটা উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেবের মতো। গোঁফ জোড়া তো বটেই। উনি গাইবেন না, ছেলের গান শুনবেন। বাবা ও ছেলের মধ্যে বয়সের খুব একটা তফাৎ আছে বলে মনে হল না। বেশি হলে, সতেরো-আঠারো বছরের হবে। আজ, লাড্ডুকেও একেবারেই চেনা যাচ্ছে না। তার ভাব-ভঙ্গি, চাল-চলন, ঠাট-বাট সবই পাকা গাইয়ের মতো।
তানপুরা ছাড়ার লোক বেশি নেই। ঠিক হল, পৃথু একটি ছাড়বে এবং ভুচুর কারখানার হেল্পার গুলাম আরেকখানি। গিরিশদাই স্বয়ং হারমনিয়াম নিয়ে বসবেন। বুড়ো হাড়ে ভেলকি খেলাবেন। তবলচি এসেছে ইন্দোর থেকে। রাজা সাহেবরই পুরোনো তবলচি। ছানা পাণ্ডে তার নাম। চেহারার সঙ্গে, ছানার মিল আছে।
গিরিশদার যে সব ইয়াং ক্যালকাটানস গেস্টরা এসেছেন তাদের টিকিট এ পর্যন্ত দেখা গেল না। তারা নাকি ঘুমোচ্ছেন। রাত্রি জাগরণ হবে বলে গায়ে জোর করছেন। রাজা যে কে, তা ঠিক বোঝা গেল না ভালমতো। ওই ছোকরাটির হাবভাবই বরং রাজার মতো। এখন তো রাজা-মহারাজা সব ফওত। বেওসাদার, মিল-মালিক এরাই সব রাজা-মহারাজা এখন। তাদেরই ছেলে এরা। গিরিশদার কথাবার্তায় মনে হল, উনি নিজেও একটু বিরক্ত তাঁর অল্পবয়সী অতিথিদের উপরে। বললেন, ছেলে-ছোকরারা কোথায় একটু হাত লাগিয়ে সাহায্য করবে, তা নয়; বুড়ো-হাবরার মতো ঘুমোচ্ছে পড়ে পড়ে। তোমাদের কলকাতার সব ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা!
পৃথু বলল, কলকাতার আমি কী জানি। আমি তো মধ্যপ্রদেশের জংলি বাঙালি। কলকাতার হালচাল আমার জানা নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুচু ফিরে এল। পামেলাও এল ওদের সঙ্গে। গাড়িতে লোক বেশি হওয়াতে সাবীর মিঞা পরের ট্রিপ-এ আসবেন। পৃথু, তানপুরার তার ঠিক ঠিক আছে কি নেই দেখে নিচ্ছিল। গিরিশদা হারমোনিয়ামের রীড চেপে সুর দিচ্ছিলেন। একটা পিচ-পাইপ থাকলে ভাল হত। কিন্তু পিচ্-পাইপ নেই এখানে কারও কাছেই। বি-শার্প-এ বাঁধতে হবে। লাড্ডু বলেছে, বি-শার্প-এ ও গায়। সাবীর সাহেব পাকা গাইয়ে। তবে, বড়ই লাজুক।
এমন সময় ঘরে ঢুকল তওয়াফে্রা।
পৃথু অবাক হয়ে দেখল, বিজ্লী। আর কম্লা।
বিজ্লী আর কম্লা পৃথুকে দেখেই আদাব করল। পৃথু ফরাস ছেড়ে উঠে আদাব জানাল। খুবই খুশি হল এমন অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে গেল বলে আবার।
গিরিশদা আর ভুচু সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন পৃথুর দিকে। ভাবটা, ব্যাপারখানা কী?
কম্লা আর বিজ্লী জমিয়ে বসে পান জর্দা মুখে দিল। সারেঙ্গীওয়ালা যন্ত্র বেঁধে নিল। সকলের সঙ্গে সকলের আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলেন গিরিশদা। ঠিক হল, বিজ্লী আর কম্লা আগে গাইবে। রাত গভীর হলে, তারপর লাড্ডু।
শামীম্, পৃথুর কানে কানে বলল, কাজটা কি ঠিক হল? ওই ষাঁড়ওয়ালা, লাড্ডুর আর মিঠাই-এর দুকান্দার কেমন যে গাইবে, তার ঠিক কী? লাড্ডুকে দেখে তো মনে হয় ওর গলা দিয়ে গাধারই আওয়াজ বেরুবে। রাতটা বিলকুল মাটিই না হয়ে যায়।
এমন সময়ে জিন-এর ট্রাউজার ও গরম ব্লেজার গায়ে দিয়ে টেরিটেরি বাগিয়ে গিরিশদার ইয়াং-গেস্টরা এসে ঢুকলেন ঘরে। এসে, সামনে বসলেন ওঁরা। সামনে যদি বেরসিক বসেন, তবে গায়কের পক্ষে গান গাওয়া ভারী মুশকিল। তবে ওঁদের হাব-ভাব আদব-কায়দা দেখে মনে হল না যে, তারা আদৌ বেরসিক নন।
মুনেশ্বর ও গিরিশদার ড্রাইভার নানারকম উদ্ভট স্ন্যাকস পরিবেশন করছিল। উদ্ভট ড্রিংক্স্-এর সঙ্গে। এমন সময় স্নাকস্ কেবলমাত্র গিরিশদার উর্বর মাথা থেকেই বেরুনো সম্ভব। তার মধ্যে দুটি স্ন্যাকস্-এর উপকরণ গিরিশদার কাছে পৃথু আগেই জিজ্ঞেস করেছিল। একটি, কাজু-কিসমিস-লেবু-পেঁয়াজ-লঙ্কা মাখা। অন্যটি, পাঁঠার মাংসর কিমার মধ্যে উর্তকা ডাল এবং ছেঁচা-ঝিঙে দিয়ে পুর বানিয়ে খুব বেশি করে ক্র্যাম দিয়ে ভাজা চপ। পুরটা আবার ভিনিগারে ভেজানো ছিল চার ঘণ্টা। পলেস্তারার আলুটা মাখার সময় তাতে বসকা ড্রাই ওয়াইন এবং শুকনো লঙ্কা এবং গোলমরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে জম্পেস মাখা হয়েছে। খেতে যা হয়েছে না! ওই চাঁট খেয়ে পৃথুর নিজেরই গাইতে ইচ্ছা করছে।
পৃথু যে গান গায় তা ও নিজেই ভুলে গেছে। এখানকার একজনও জানে না, ওর গানের কথা। গোলাম নবী বা শোরি মিঞার অধস্তন পুরুষের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়র কাছে, ভোপালে থাকাকালীন, সে পাঞ্জাবি টপ্পা শিখেছিল। জবলপুরের হৃদয় সেন-এর কাছে বাঙালি টপ্পাও শিখেছিল কিছু। হৃদয়দাদা, রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবুর শিষ্য কালীপদ পাঠকের কাছে গান শিখেছিলেন অনেকদিন। সেসব গান এখন পৃথুর নিজের গলাতেই কবরস্থ হয়ে আছে। তাদের রেজারেকশান আর হবে না কোনওদিনই। শোনাবার মতো মানুষ, আর গাইবার মতো মেজাজ, এই দুইয়ের যোগাযোগ না ঘটলে গান-গাওয়া-না-গাওয়া সমান। তা ছাড়া, হাটচান্দ্রাতে পাগলা ঘোষ্ষা যে গান জানে এমন অবিশ্বাস্য কথা বললে কেউই বিশ্বাস করবে না। কোনও কোনওদিন আত্মবিস্মৃত হয়ে বাথরুমে হঠাৎ দু’ এক কলি গেয়ে উঠলেই দরজায় দুমদাম ধাক্কা পড়ে। “স্টপ্ ইওর হাউলিং”। ওই সব উটওয়ালাদের টপ্পা গাইতে হয়তো আফগানিস্তানে বা দ্যা র্যান অফ কাচ-এ চলে যাও। সেখানে অনেক জংলি গাধাও আছে। ভদ্রলোকের বাড়িতে এ সব অসভ্যতা চলবে না।
রুষা অন্যান্য গানের সঙ্গে বাখ, বীটোভেন এবং মোৎজাটও শোনে। চাইকোভ্স্কি এবং মেণ্ডহেনসন্ও। ওর ক্লাসিকাল ওয়েস্টার্ন মিউজিক-এর রেকর্ড-এর স্টক দারুণ। টপ্পার মতো এ সব ঘৃণিত দেশজ ব্যাপারে ওর বিন্দুমাত্রও উৎসাহ নেই।
বিজ্লী বলল, তার তানপুরার দরকার নেই। সারেঙ্গী হারমোনিয়ম আর তবলা থাকলেই চলবে।
খানা-পিনা, গানের মধ্যে বিলকুল্ বন্ধ থাকবে। তাই গিরিশদা সকলকে এক পাত্র করে আবার চড়িয়ে নিতে বললেন।
শীতের রাত। পাঁয়তাড়া করতে করতেই আটটা বেজে গেল। ম্যায়ফিল যে কখন শেষ হবে কে জানে? বাড়ি ফিরে আবারও গালাগালি শুনতে হবে, ভাবছিল পৃথু। রাতে যদিও নয়। কারণ চাবি ও নিয়েই এসেছে ড্রইংরুমের। নিঃশব্দে ঘুমন্তপুরীতে ঢুকে পড়ে, চলে যাবে সোজা বইপত্তর গিসগিস নিজের শান্তির গর্তখানিতে। বোমাবাজি শুরু হবে কাল সকালে।
যাক। হলে, হবে।
বিজ্লীর কণ্ঠস্বর শুনে প্রথম দিন যেমন চম্কে উঠেছিল, আজও আবার তেমনই চমকে উঠল পৃথু। সুরের মতো ক্ষুরধার অস্ত্র বুঝি আর নেই। এমন নিপুণভাবে, চকিতে হৃদয় বিদীর্ণ করতে আর কোনও অস্ত্রই বুঝি পারে না। বিজ্লীর শরীরের যৌবনেরই মতো তার গলার স্বরের যৌবনও চোখ ঝল্সানো। চল্কে চলকে চলে। উপচে পড়ে অবলীলায়। প্রথমেই, কাজ্রী ধরল একটা বিজ্লী।
পামেলা, পৃথর কাছ ঘেঁষে বসেছিল। ভারী মিষ্টি মেয়ে। কালোকে কেন জগতের আলো বলে, তা পামেলাকে দেখলে, ওর সঙ্গে কথা বললে, বোঝা যায়। পামেলার নিজের গলার স্বরও ভারী মিষ্টি। নানারকম চার্চ-হীমস গায় ও। ও গায় বলেই, যেন গীর্জায় গেলে ওই সব গান অত বেশি ভাল লাগে পৃথুর।
পামেলা ফিসফিস করে বলল, কাজ্রী কী?
পৃথু গান বাজনা সম্বন্ধে এমন কিছু জানে না যে, অন্যকে বোঝাতে পারে। তার জ্ঞান অতি সামান্যই। তবু বলল, এই গান কিন্তু সাধারণত বর্ষার গান বলেই জানে লোকে। বর্ষা ঋতুর গান এবং বিরহ বর্ণনারও। উত্তরপ্রদেশের গান এ। লোকসংগীত। কাজ্রীও বলে, অনেকে আবার বলেন, কজ্লী। রাধা-কৃষ্ণর লীলা খেলা নিয়েই বেশি গান।
তারপর পৃথু বলল, শৃঙ্গার মানে বোঝো তো?
না। কী?
পামেলা বলল। ফোরপ্লে।
ইংরিজি ফোরপ্লে কথাটাতে শৃঙ্গার এর অতি সামান্যই ফুটে ওঠে। আমাদের শৃঙ্গার-এর মানে অনেক গভীর এবং বিস্তৃত। বুঝেছ?
পামেলা লাজুক লাজুক চোখে তাকাল। বুঝেছে, জানিয়ে, মাথা নাড়ল।
শৃঙ্গার রসেই ভরা এই কাজ্রী বা কজ্লী গান। উত্তরপ্রদেশের মীর্জাপুর আর বানারস-এলাহাবাদ অঞ্চলেই এই গান বেশি গাওয়া হয়। কাজরী এমন একা গাওয়ার গানও নয়। মোটে দুজন মিলে গাইছেন এঁরা। কিন্তু কাজ্রীর আসরে প্রধান গায়কের বা গায়িকার সঙ্গে অনেকে মিলে একই সঙ্গে বসেন। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়ার রাতে মেয়েরা নতুন শাড়িতে সেজে সালঙ্কারা হয়ে সারারাত কজ্লী দেবীর পুজো করে। হিন্দু, মুসলমান সকলে মিলেই কিন্তু এই গান শোনে একসঙ্গে।
পামেলা বলল, আজ হিন্দু মুসলমানের সঙ্গে খ্রীস্টানও যোগ হল।
পৃথু হাসল। বলল, গানও হচ্ছে, লালন ফকিরের সেই কথারই মতো। গানের মধ্যে কোনওই জাত বিচার নেই। শ্রোতার মধ্যে তো নেই-ই। একই জাত সবার সেখানে। সে জাতের নাম, রসিক জাত।
লালন ফকিরের কোন কথার কথা বলছেন? কে এই লালন ফকির?
কথা নয়। সেও এক গান। বাঙলার মুসলমান ফকির লালন গেয়েছিলেন না?“যদি ছুন্নৎ দিলে হয় মুসলমান, নারীর তবে কী হয় বিধান?”
লালন ফকিরের বই ইংরিজিতে পাওয়া যায়?
হয়তো যায়। এখন চুপ করো। আর কথা নয়। মনোযোগ দিয়ে গান শোনো। কোনও প্রশ্ন থাকলে, গান যখন শেষ হবে তখন জিজ্ঞেস কোরো।
মিশ্র গারাতে ধরল বিজ্লী। মিশ্র-গারা-দাদরা।
নাহি মানে জিয়ারা হামারে
নৈ হারোমে॥
বাবা হাটে গৈলা, গম্নুনা দই হা
বিখ্ ভইলে বর্খা বাহার নেহারুমে॥
আহা!
চোখের সামনে যেন বর্ষার রূপ ফুটে উঠল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গাইতে লাগল বিজ্লী। তার রূপোলি জরিমোড়া বেণী দুলতে লাগল, তার চোখের মধ্যে কালো চক্চকে গহুমন সাপ খেলা করতে লাগল। ফুলের গন্ধ, ধূপের গন্ধ, গোলাপ জলের গন্ধ, বিভিন্ন নারী-পুরুষের গায়ের ঈত্বর ও অন্য সুগন্ধীর গন্ধ এবং গিরিশদার অভিনব কনককশানের নেশা মিলে, পৃথুর মনে হল, যেন সুরের ভেলায় ভেসে ভেসে কোন দেবলোকের দিকে চলেছে। যেখানে মন্দাকিনী বয়ে যায়, দুগ্ধ-ফেননিভ রাজহাঁসী গাঢ় কমলা নীরব ঠোঁট নেড়ে খেলা করে, যেখানে উর্বশী, রম্ভারা রূপের হাট লাগিয়ে গজেন্দ্রগমনে চলেন!
কাজ্রীতে বিজ্লীর কম্লা বহিনও গলা মিলিয়েছিল। কিন্তু ওই কাজ্রী, বিজ্লী অস্থায়ী ও অন্তরাতে ঘুরে ফিরেই যেমন হঠাৎ শুরু করেছিল, তেমন হঠাৎই শেষ করে দিল।
কাজ্রী গানের মতো শৃঙ্গারও যতিতে মধুর হয়। সকলেই চলতে জানে, গতি ব্যাপারটা সকলেই বোঝে; কিন্তু জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই থামতে-জানা লোকের সংখ্যা, যতির কদর-করা মানুষের সংখ্যা অতি সীমিত। ও নিজেও ব্যতিক্রম নয়।
সুরের ছটায় অব্যবহিত পরের যে নিস্তব্ধতা সেই ক্ষণটুকুই বোধ হয় গানের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। সে নৈঃশব্দ্যে গানের রেশ পুরোপুরি স্বরাট থাকে; ঈশ্বরীর মতো! সমস্ত সৌন্দর্যরই শেষ থাকে। ফুরিয়ে যায়, এমন সময়; সব কিছুই। কিন্তু ফুরিয়ে যাওয়ার আগের এই নিঃশব্দ শব্দময়তাই বোধ হয় শ্রোতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
বিজ্লী হঠাৎ পৃথুকে কুর্নিশ করে তানপুরা ধরতে বলল। একটু অবাক হয়ে বিজ্লীর পিছনে গিয়ে বিজ্লীর স্কেলে, বেঁধে নিল নতুন করে তানপুরা পৃথু।
এবার ও একটি ঠুমরি ধরল। বাদীর ঋষভকে পিছা করল সম্বাদী পঞ্চম। খাম্বাজ ঠাটের এই রাগটি পৃথুর বড়ই প্রিয়। কত্বদিন পরে শুনল! পৃথুর বাবাও বিশেষ পছন্দ করতেন তিলোক কামোদ। আর পরজ বসন্ত। সরগমা, রমপধস পা; র্সা এই রকম আরোহণ, অবরোহণে র্স পধমগা, সরগা, স্না। পকড় হচ্ছে প্ন্সরগা, সা, রপমগা, স্না।
তানপুরা ছাড়তে ছাড়তে বিভোর হয়ে গেল পৃথু। গানের কোনওই বিকল্প নেই। বিজ্লীর আলাপে যেন লক্ষ লক্ষ ফুলকুঁড়ি ফুটে উঠতে লাগল। অথচ, এই রাগে একটিও কোমল স্বর নেই। সুরের পর্দার কাঠামোর উপর আস্তে আস্তে কথা বসাতে লাগল বিজ্লী। যেন, নতুন কোরা-গন্ধ তাঁতের শাড়ি পরে পুজোর আলপনা দিচ্ছে ভিজে চুল পিঠময় ছড়িয়ে দিয়ে বাঙলার কোনও মেয়ে। বড় যত্নে, বড়.শ্রদ্ধামিশ্রিত সোহাগে।
বাঙালি!
ঠুমরিটি ধরেছিল বিজ্লী, পাঞ্জাবি তালে।
পিয়া পরদেশ মোরা মনহ
রহে কৌন্ মোতন কে দ্বার॥
না মোরি নৈয়া নারে খাবৈয়া
কৌন্ বিধো উত্রানো পার॥
পিয়া পরদেশ মোরা…
ঠুমরির এই ছটফটানিহীন শান্ত, ধীর স্থির ভাবটি বড় ভাল লাগে পৃথুর। যদিও এই শান্ত সৌম্য ভাবটি ধ্রুপদে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন যে চঞ্চল বিজ্লী, সেও যেন ঠুমরির ভাবে পুরোপুরি সমাহিত হয়ে থির্-বিজুলি হয়ে গেল। দেদীপ্যমান হয়ে, উদ্ভাসিত ঔজ্জ্বল্যে স্থির হয়ে গেল। এক-একটি খট্কা, অথবা মুর্কীর ছোট ছোট কাজ লাগছে ওর চিকন গলায়। শুনে, পৃথুর মনে হচ্ছে তানপুরা ছেড়ে দিয়ে বিজ্লীর পায়ের উপর মাথা রাখে, দু’হাতে তার মুখ ধরে তার জর্দা-গন্ধী ঠোঁটে আর সুর্মাটানা চোখে চুমু খায়। ভাল গায়িকার মতো তাৎক্ষণিক সম্রাজ্ঞী, এ দুনিয়ার সত্যিকারের কোনও সম্রাজ্ঞীই বোধ হয় কখনওই হতে পারেন না। গায়িকার সঙ্গে শ্রোতার হৃদয়ের যে যোগাযোগ, তা মুহূর্তের মধ্যে ঘটে। বিদ্যুৎচমকেরই মতো হঠাৎই হৃদয় বাঁধা পড়ে।
স্থায়ী থেকে এসে যখন অন্তরার “না মোরি নৈয়া’তে নামল বিজ্লী, মনে হল শীতের সকালের প্রথম নরম রোদে গাঢ় সবুজ হরিয়ালের ঝাঁক যেন উড়ে এসে বসল অশ্বত্থের ডালে ডালে।
এ গান কোথায় শিখেছিল বিজ্লী কে জানে? মহারাষ্ট্রের কোনও ওস্তাদের কাছে কি? তিলোক কামোদের সঙ্গে দেশ ও সুরট রাগের সাদৃশ্য দেখা যায়, নিষাদ পুরোপুরি বর্জিত হওয়ার কারণেই। কিন্তু খরজ বদলে বিজ্লী কোমল ও শুদ্ধ নিষাদ দুই-ই লাগিয়ে দিল এক আশ্চর্য মুন্সীয়ানার সঙ্গে। চারিদিকে যেন রঙ ঝলসে উঠল। ফুল আর ঈত্বরের গন্ধর পুকুরে কে যেন রূপোর তাল ছুঁড়ে মারল। ছিটকে উঠল রঙ আর গন্ধ চতুর্দিকে। তিলোক কামোদের আরোহ-অবরোহে স্বরগুলির যে রকম এক বাঁকা গতি আসে, তা শুনতে বড় ভাল। তানপুরার সঙ্গে কানটি চেপে ধরে রসসাগরে যেন ভেসে গেল পৃথু। স্থান, কাল, পরিবেশ সব কিছু সম্বন্ধেই আর কোনওই হুঁশ রইল না।
বিজ্লীর হঠাৎ সপাট তানে গিরিশদার ড্রইংরুমে যেন শয়ে শয়ে সুরের পায়রা উড়তে লাগল, পাখা ঝাপটা-ঝাপটি করতে করতে সেই অদৃশ্য গেরোবাজ পায়রারা সুরের আগুনে যেন সুখের মরণে পুড়ে মরতে লাগল।
প্রত্যেকেই স্তব্ধ। গিরিশদার মুখটি হাঁ হয়ে গেছে। দেখল, পৃথু। যে কোনও মুহূর্তে মাছি ঢুকে যেতে পারত, মাছি থাকলে। বড় ভাল হারমোনিয়ম বাজান গিরিশদা। বিজ্লীদের দলের সারেঙ্গীওয়ালা পর্যন্ত লাবেদম হয়ে যাচ্ছে গিরিশ বুড়োর কাছে। ভেলকি দেখিয়ে দিচ্ছেন একেবারে।
যখন গান থামল, কেয়াবাৎ! কেয়াবাৎ! বহত খুউব! ক্যা মিঠি আওয়াজ! ইত্যাদি রব উঠতে লাগল চারধার থেকে। এবং সামনে রাখা রূপোর থালায় ঝনাৎ ঝনাৎ করে টাকা পড়তে লাগল। কলকাতার মেহেমান ছোঁড়ারা চোখ বড় বড় করে বিজ্লীকে দেখতে লাগল।
পৃথুর বুক-পকেটে একটি লাল রঙা কুড়ি টাকার নোট ছিল। বুকের ভিতর থেকে অদৃশ্য একটি লাল গোলাপ ছিঁড়ে সেই লাল টাকার সঙ্গে রাখল রূপোর থালায়। রূপোর থালা লাল পদ্মে ভরে গেল। পৃথু ছাড়া আর কেউ দেখতে পেল না তা। ওই ছেলেদের মধ্যে একজন ফিসফিস করে বাংলায় অন্যজনকে শুধোল, অ্যাই রমেন, ট্যাকটফুলি জিজ্ঞেস করবি তো একা পেলে। এ মাল কি শুধুই গায়, না বাজায়ও? দারুণ জিনিস।
পৃথু কথাটা শুনল। পাশে বসা ভুচুও শুনেছিল। যে ছেলেটি বলল, তাকে ভুচু ফিসফিস করে, প্রায় কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে বলল, কলকাত্তাইয়া বাবু, তোমার জামার নীচে জান ক’টা আছে?
ছেলেটি প্রথমে অপ্রতিভ হয়ে গেলেও, সপ্রতিভ মুখে হেসে বলল, আমরাও বাঈজীর গান অনেক শুনেছি। কলকাতার জান-বাজারে। জান্-এর ভয় আমাদের দেখাবেন না।
বিজ্লী ওদের চুপি চুপি কথাতে অবাক হয়ে একবার চোখ তুলে তাকাল ওদিকে।
বাবু! এ ডাকাতের দেশ। গোয়ালিয়র, ভিন্দ, মোরেনা এ সব নাম শুনেছ কখনও? পুত্লি বাঈ-এর? এক সময়ে বাঙালি মেয়েরাও বুকের মধ্যে করে পিস্তল লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করেছে। অত্যাচারী সাহেবকে, শুনেছি। কিন্তু তোমরা তো সেই জাতের নও বলেই মনে হচ্ছে। এখানে পেঁয়াজি কোরো না বাবু, খামোখা কেন গিরিশদাকে ডেডবডির ঝামেলাতে ফাঁসাবে? একদম চুপচাপ থাকো। এখনও দুগ্ধপোষ্য শিশু সব, শুধু গান শুনে মন ভরে না, বাজনা শুনতে চাও, আঁ? সাহস কত্ব!
ছেলেটি চুপ করে গেল। ভুচুর চেহারার মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যে, স্বয়ং ডাকু মালখান সিংও হয়তো ওকে সমীহ করত, যদি চিনত ওকে।
বিজ্লী সকলের স্তুতি কুড়োতে ব্যস্ত ছিল। ওর কানে ভুচুর কথা যায়নি। তা ছাড়া, বাংলা তো ও বোঝেও না। পৃথুর দিকে ফিরে সে বলল, ইয়াদ কভ্ভী নেহী পড়া থা ক্যা, রহিস্ আদমী কি?
পৃথু লজ্জার সঙ্গে বলল, নহী, নহী, উও বাত নহী।
আজ সাথ্হি লে চালুঙ্গি।
কাঁহা? পৃথু শুধোল।
কাঁহা? তারপর গলা আরও নামিয়ে বিজ্লী পৃথুর কানের সঙ্গে প্রায় মুখ ঠেকিয়েই বলল, জাহান্নম্। নহী, যাইয়েগা? ক্যা?
চমকে উঠল পৃথু।
জাহান্নম।
হাসল একটু। বোকার মতো। এখানে রুষা থাকলে হয়তো বলত, ছাগলের মতো।
পৃথু বলল, শোচেগা।
লাড্ডুর পোশাকটিও আজ দেখবার মতো। মাথায় মস্ত এক পাগড়ি। পরনে আচকান্ কামিজ। সোনা-রূপোর চুমকি বসানো। বনবেড়ালের ল্যাজের মতো দুটি পুরুষ্ট গোঁফ যেন তীব্রগন্ধী হিনা ঈত্বরের বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে। গোঁফের প্রতিটি চুল থেকে খুশবু উড়ে সমস্ত মহল্লাকে খুশবুদার করে দিয়েছে।
সে বলল, বিজ্লীর দিকে চেয়ে, যথাযথ বিনয়ের সঙ্গে, আরেকটি হোক। খেয়াল হবে না। একটি?
বিজ্লী পান-জর্দা খাচ্ছিল। হাঁসের মতো দেখতে রূপোর পানের বাটা বন্ধ করতে করতে, হাসতে হাসতে মাথা ঝুকিয়ে আদাব করল। ঘাড় নামিয়ে বলল, এবার আপনার গান শুনবে সকলে। সকলেই ইন্তেজার করছে আমরা তো বটেই।
রাতমোহানার অস্পষ্ট অন্ধকারে, সেদিন রাতে, বিজ্লীর কণ্ঠই শুধু শুনেছিল পৃথু। তার রূপের চেকনাই সম্বন্ধে কোনও ধারণাই করতে পারেনি। আজ এই ঝাড়লণ্ঠন-জ্বালা হালকা নীল-রঙা ঘরে এত ফুলের আর ঈত্বরের গন্ধের মধ্যে তার মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম হল বিজ্লীকে কাছ থেকে দেখে। পানের পিক গিলছিল বিজ্লী। তার ফিনফিনে ফর্সা পেঁয়াজ-খসীর মতো পাতলা চামড়ার আড়ালের নীল শিরা দিয়ে সেই লাল পিককে যেন নামতে দেখল পৃথু। বাবার কাছে গল্পে শোনা, কলকাতার গহরজান বাঈজীর কথা মনে পড়ে গেল ওর। কত সব নামী নামী বাঈজী! সম্ভ্রান্ত। সংগীতের প্রকৃত সাধক সব। গহরজান, মালকাজান, চুলবুল্লেওয়ালী, আগ্রাওয়ালী, মালকা, হুসনা। ভোপালের রূপা, ইন্দোরের কিমতি বাঈ।
ইতিমধ্যে আর এক পক্কড় করে পানীয় চলে এল গিরিশদার ফরমাসে। ইন্টারভ্যাল। সেই তরল প্লাস্টিক-বম্ব যারাই গিলেছে তাদের প্রায় সকলেরই হালত বিলক্ষণই খারাপ। কেবল ঠিক আছে ভুচু। পামেলাকে নিয়ে সে এই প্রথম বাইরে এসেছে, পামেলার মায়ের অনুমতি নিয়ে। কোনও রকম বেচাল করবে না, এবার সে উঠবে পামেলাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। ফেরার সময় সঙ্গে করে খাবারদাবার, খিদমদগার সব নিয়ে আসবে।
ভুচু আর পামেলা সকলের কাছেই বিদায় নিয়ে উঠল। পামেলা বিজলীর হাতে হাত দিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক উ্য ভেরী মাচ্।
বিজ্লী এক মুহূর্ত বোকা হয়ে গেল। মাথা নিচু করে, আদাব করে বলল, মেরী খুশনসীবি!
পৃথু ভাবছিল বিজ্লীর দিকে চেয়ে, এ মেয়ের কপাল খারাপ! আগের জামানা থাকলে এরও হয়তো ইজ্জত হত গহরজান বা মালকাজান-এরই মতো। এমন রূপ, এমন গান এবং এমন সপ্রতিভতার সংমিশ্রণ পৃথু খুব কম গানেওয়ালীর মধ্যেই দেখেছে!
গিরিশদা, এবার লাড্ডুর দিকে চেয়ে বললেন, অব কুছ শুনাও ভাই, কুমার বাহাদুর।
লাড্ডুকে রোজই বাজারে তার লাড্ডুর দোকানের গদিতে পা মুড়ে বসে থাকতে দেখা যায়। পরনে মিহি ধুতির উপরে হালকা গোলাপি টেরিকটের পাঞ্জাবি। কী শীত কী গ্রীষ্ম! শীতে অবশ্য পাঞ্জাবির উপরে একটি ঘোরতর লালরঙা জহরকোট চড়ায় সে। সেটাও তার ভুঁড়ির সবটা ঢাকতে পারে না। নাভির কাছটা অনাবৃতই থাকে। কে জানে, টাকাওয়ালা লোকেদের ভুঁড়িতে গরম বেশি বলে হয়তো ইচ্ছে করেই ঢাকে না সে ভুঁড়ি। মুখে হাসি, পেটে তরমুজ এবং চোখে বানিয়ার চকচকে দুর্বুদ্ধি। তাকে আজ হঠাৎ এমন গায়কের বেশ এবং গান বাজনার পরিবেশে দেখে বড়ই অবাক লাগছিল। একজন মানুষের মধ্যেই অনেক মানুষের বাস। ভুচু, লাড্ডুকে বলে গেছে, শুরু তুম্ করনে শকতা, ইয়ার। মগর খতম মত কর না। ম্যায় গ্যয়া, ঔর আয়া।
ভুচুই হচ্ছে লাড্ডুর সবচেয়ে কাছের লোক এখানে। ওদের দুজনের দেখাশোনা হয়। কোথায় হয়, কখন হয় এবং কী ওদের এই গভীর বন্ধুত্বর সূত্র তা যদিও জানা নেই ঠিক পৃথুর।
লাড্ডু তার বাবার দুপায়ের উপর গড় হয়ে প্রণাম করে ইজাজৎ চাইল। তারপর গিরিশদার কাছে, পৃথুর কাছে, সকলেরই কাছে। এমনকী বিজ্লীর কাছেও।
এইই তারিকা! এইসব ভারতীয় ব্যাপার-স্যাপার এখনও ভারতের এসব দিকে বেঁচে রয়েছে। এই সহবৎ, বিনয়; এই রিচুয়ালস্। কলকাতার ছেলেদের দেখে মনে হচ্ছে, বিনয়, নম্রতা, সহবৎ, ভদ্রতা এসব গুণ বোধহয় তামাদি হয়ে গেছে ওদিকে, অনেকদিনই হল। তামাদি হয়ে গেছে বলেই বোধহয় এইসব গুণাবলীকে সভ্যতার খতিয়ানের নাজাই খাতাতে লিখে, মুছে ফেলা হয়েছে বিলকুল।
কলকাতার ছেলেরা লাড্ডুকে বলল, শুরু কিজিয়ে। দেখা যায়।
ভাবটা এমন, যেন ওর গানের পরীক্ষকই ওঁরা।
লাড্ডু তাদেরও দুবার কুর্নিশ করে ঈজাজৎ চাইল। তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে কমবয়সী, সেই ছেলেটি, হেইল হিটলার বলে জার্মান সৈন্যরা যেমন করে হিটলারকে স্যালুট করত, তেমনই করে সোজা ডান হাতটি সামনে ছুঁড়ে দিয়ে লাড্ডুকে ঈজাজৎ দিল। ওই হরকৎ দেখে, লাড্ডু যেন গান শুরু করার আগে রীতিমতো ঘাবড়েই গেল।
লাড্ডুর গানের ব্যাপারটা যে একধরনের তামাশা হবেই সে বিষয়ে সাবীর মিঞা, শামীম, পৃথু এবং হয়তো ভুচুরও কোনও সন্দেহ ছিল না। এরকম অ্যামেচারদের ম্যায়ফিল জমাতে হলে কিছু তামাশার উপাদানও থাকা চাই। আর সেটা জানতেন বলেই গিরিশদা, লাড্ডু নিজেই যখন উপযাচক হয়ে গান শোনাবার জন্যে বার বার বলেছিল, তৎক্ষণাই রাজি হয়ে গেছিলেন। একটু আগে বড় ভাল গান শোনা গেল। পরেও যাবে। মাঝে একটু তামাশাও হোক। তামাশার মধ্যে দুপাত্তর আরও চড়িয়ে নিতে হবে সকলের। গিরিশদার নির্দেশ। ততক্ষণে নতুন স্ন্যাকস, গুলহার আর বটি কাবাবও এসে গেছে।
লাড্ডুর পাশে গিয়ে বসল পৃথু। জোড়া তানপুরার একটা নিয়ে। অন্যটা ভুচুর চেলা গুলাম ছাড়ছে। তানপুরা ছাড়তে তেমন কেরামতির দরকার নেই, কিন্তু বাঁধতে হলে কিছু সুরজ্ঞান থাকা চাই। পৃথু লক্ষ্য করল যে, যে তানপুরায় সে বিজ্লীর সঙ্গে বাজিয়েছিল। ভুচুর চেলা গুলাম ইতিমধ্যেই নিখুঁতভাবে বেঁধে ফেলেছে তা লাড্ডুর স্কেলে। এখানে ভারসেটাইল জিনিসয়াসদেরই ভীড় দেখছে পৃথু আজ। মোটর গাড়ির মিস্ত্রির কান, সুরে টিউন করা, কাকশাস্ত্র বিশারদ গিরিশদা, সঙ্গীতজগতের দিকপাল যন্ত্রজ্ঞ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কায়দায় হারমোনিয়ম বাজাচ্ছেন; লাড্ডুওয়ালা লাড্ডু খেয়াল গাইতে যাচ্ছে। হাবভাব এমন, যেন শ্রদ্ধাস্পদ সুরেশ চক্রবর্তী মশাই-ই হয়ে গেছে সে। ওয়াহ্! ওয়াহ্!
লাড্ডুর চোখে মুখে কিন্তু কোনওই উদ্বেগ উত্তেজনা নেই। দেখে মনে হচ্ছে, ও ওর দোকানেই বসে আছে। এক্ষুনি হালুয়া বা লাড্ডু নিজেই মেপে ওজন করে দেবে। সবসময় দুধ আর ঘিয়ের জিনিস নিয়ে কারবার করে বলে ওর গায়ে কেমন একটা সর-সর, ছানা-ছানা, ঘি-ঘি গন্ধ হয়ে গেছে। আজ সন্ধেতে লাড্ডু ভোল তো পালটেইছে, মায়, গায়ের গন্ধ পর্যন্ত পালটে ফেলেছে। ভোল পালটানো খুবই সহজ, গায়ের গন্ধ হাপিস করা সোজা কথা নয়, সে জন্তুরই হোক কি মানুষেরই হোক।
এবার সবাই প্রস্তুত। লাড্ডু বিশালাকৃতি এক গ্লাস সিদ্ধির শরবৎ খেয়েছে। সেই অর্ডার ইতিমধ্যে দুবার রিপিট করে গেছে মুনেশ্বর। এই একটি কাজে মুনেশ্বরের বড়ই উৎসাহ। যতবারই লাড্ডুর জন্যে বাদাম, পেস্তা, গোলমরিচ, গোলাপের পাপড়ি এবং থকথকে দুধ মিশিয়ে, তাতে ভোপাল থেকে আনানো দুখানা সবুজ গুলি মেরে, বানিয়ে আনছে ঠাণ্ডাই, ততবার সেও প্রসাদ নিচ্ছে। তবে, কণিকামাত্র নয়। ঠাণ্ডাই খেয়েছে বিজ্লীরাও। পৃথুকে চোখ দিয়ে ইশারা করল বিজ্লী। পৃথুর সাহস হল না। গিরিশদার ওই বিচিত্রবীর্যকারী পানীয়র সঙ্গে অন্য কোনও বলবর্দ্ধক সে মেশাতে আদৌ রাজি নয়। তার উপর বিজ্লী আবার বলেছে জাহান্নাম-এ নিয়ে যাবে আজ।
খুবই খুশি খুশি দেখাচ্ছে মুনেশ্বরকে। পাগল মনিবের অত্যাচার ভুলে থাকার এই একমাত্র পথ তার।
হঠাৎই একেবারে আচমকা লাড্ডু “রে” বলে দিল।
চমকে যাওয়ায়, পৃথুর হাত থেকে তানপুরা প্রায় পড়ে যাবার জোগাড়। ‘রে’টা এমন করে বলল, যেন মনে হল ফোর সেভেন্টি ডাবল-ব্যারেল রাইফেলের গুলি গিয়ে বাঘের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল।
একবার বাবার সঙ্গে ইন্দোরের হোলকারদের ম্যায়ফিলে উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেবের গান শুনতে গেছিল পৃথু। সকাল বেলা। রাজা মহারাজাদের বাড়িতে ভৈরবীর আসর সাজাতেই সকাল এগারোটা বেজে যেত। পৃথুরা প্রায় একঘন্টা বসে থাকার পর খাঁ সাহেব এলেন। ভৈরবীতে “বাজু বন্ধ খুলু খুলু যায়” গেয়েছিলেন প্রথমে উনি। এখনও মনে আছে পৃথুর। গান আরম্ভের আগের একটি ‘সা’তেই গায়ে শিহরণ জেগেছিল। অনেকক্ষণ অনুরণন ছিল ঘরে। পৃথুর বাবা ছেলেমানুষ পৃথুর পিঠে হাত রেখেছিলেন, ওর উত্তেজনাকে শান্ত করতে, পায়ে হেঁটে বাঘের মুখোমুখি হলে, যেমন পিঠে হাত দিতেন। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেবে আর বড় বাঘে তফাৎই বা কী ছিল?
কিন্তু এখানে পৃথুকে শান্ত করার কেউই নেই। লাড্ডুর এই নতুন সত্তা, তাকে এবং ঘরের অন্য সকলকেই যেন একটা ধাক্কা দিয়ে, তাদের অবিশ্বাসী তামাশা-প্রত্যাশী মনকে সম্পূর্ণই অন্য এক ভাবগম্ভীর সুরের জগতে পৌঁছে দিল। আশ্চর্য! একটি একটি স্বরের নিখুঁত উচ্চারণে কত কীই ঘটে যায়। লাড্ডুর কণ্ঠস্বরে যাদুও কিছু ছিল। আস্তে আস্তে, খুবই আস্তে আস্তে, যেন ওর প্রিয়তমার চুলে আঙুল বুলোচ্ছে লাড্ডু, যেন ওর আরাধ্য দেবতার পায়ে মাথা রাখছে এমনি করেই স্বরগম বলল ও। আরোহী। আরোহীতে পৌঁছে, নামল অবরোহীতে। সা ধ নি মগ মরে সা…
আহা! একে বলে পুরুষের গলা! মাধুর্য আর ঔদার্য যেন মাখামাখি হয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করতে লাগল লাড্ডু। শুদ্ধতানে ‘উঠাও’কে যেভাবে সে পেশ করল, তার তুলনা নেই। বেহেত্রীন্। এতদিন ওরই নিজের মুখ ওর শিশুসুলভ আত্মপ্রশংসার কথা শুনে ভেবেছিল পৃথু যে, লাড্ডু বুঝি একজন “আতাঈ”। কিন্তু আজ ওর গলার স্বর প্রথমবার শুনে কোনও সন্দেহই রইল না যে, সে আতাঈ তো নয়ই, বরং একজন জবরদস্ত “কসবী”। বড় গুণী মাত্রই বোধহয় ছেলেমানুষ এবং সরল। মনে হল ওর।
কী রাগে গান ধরল, প্রথমটা একটু ঠাহর করতে অসুবিধা হয়েছিল পৃথুর। গান তো ভুলেই গেছে।
ওর দোষ নেই। গানবাজনা, তার পরিবেশ কিছুই আর পৃথুর জীবনে অবশিষ্ট নেই। আরোহীটা শুনে ঠিক করতে পারল না। কিন্তু লাড্ডু অবরোহীতে আসতেই ধরে ফেলল পৃথু। গৌড়মল্লার। খাম্বাজ ঠাটের। অনেকের মতে অবশ্য, কাফি। কোমল গান্ধার লাগিয়ে অনেক গায়ক একে কাফি ঠাটে এনে ফেলেন।
দেখা যাক কী করে লাড্ডু।
খাম্বাজ এবং কাফি দুইই পৃথুর সমান প্রিয় রাগ। কিন্তু কোমল নিখাদের উপরই ওর জন্মগত দুর্বলতা। ওর বিয়ের আগে ঠিক করেছিল যে ওর স্ত্রীর নাম রাখবে কোমল নিখাদ। সে নাম রাখা হয়নি। রাখা যায়নি। রুষার বাহ্য চরিত্রে কোমল পর্দাগুলি একেবারেই অনুপস্থিত। কন্-এও নেই। দুঃখের। বড়ই দুঃখের।
বিলম্বিত একতাল-এ শুরু করল। আজ কী হয়েছে কে জানে, বিজ্লী এবং লাড্ডু ওরা দুজনেই এই শীতের মধ্যে বর্ষাকে মনে করছে কেন? গৌড়মল্লার তো বর্ষারই রাগ।
বাণীতে এল লাড্ডু, স্বরগম সেরে। কথা বসাল স্বরগমের জায়গায়।
আই বাদল।
চমকত রহি বিজুরী
বোলত মুরলা বনমে
স্থায়ী শেষ করে অন্তরাতে গড়িয়ে গেল লাড্ডু, লাড্ডুরই মতো অনায়াস গতিতে;
চঞ্চল সৈঁয়াকে পিয়া
গয়ে পরদেশ কল না পরত
কঁপন লাগে জিয়া ভরমে
আই বাদল…
বিলম্বিত একতালে গেয়ে রাগের চেহারাটা সকলের কাছে স্পষ্ট করে দিল ও।
খেয়াল যদি ঠিকভাবে গাওয়া হয়, তাহলে ঘড়ি বন্ধ হয়ে যায়। কী করে যে ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় তা কারও হুঁশই থাকে না। তার নাভি থেকে ওঠা গভীর সুরের ছোঁয়া যে কী সব বুদ্ধিমত্তার ছবি এঁকে দিয়ে যাচ্ছিল লাড্ডুর বোকা-বোকা মুখাবয়বে তা বলার নয়। নাদের সঙ্গে তার অন্তরের গভীর থেকে তেজালো সুরেলা গলার মাধ্যমে সুরের নানা মণি রত্ন তুলে এনে, পেশ করে; মুহূর্তে মুহূর্তে চমকে দিচ্ছিল সে সকলকে। পৃথুর মন নীরবে বলছিল, জীতা রহো, জীতা রহো! জীতা রহো!
একজন মানুষের চেহারা কী বিভ্রান্তিকরই না হতে পারে। শুধু চেহারা দিয়ে বোধহয় কাউকেই বিচার করতে নেই। খুবই ঠকতে হয় তাহলে। রুষার চেহারা দেখে যেমন ও ঠকেছে। লাড্ডু যেমন ঠকিয়েছে, তাদের সকলকেই তার চেহারা দিয়ে!
ভুচু ফিরে এসেছিল অনেকক্ষণই। তার মুখ দেখে মনে হল তার দোস্তের এই আনজান অজীব রূপ দেখে তার অকল বিলকুলই গুম হয়ে গেছে। সব নেশা উড়ে গেছে তার। চুপ করে লাড্ডুর মুখে তাকিয়ে বসেছিল ভুচু।
গিরিশদা বার বার মাথা নাড়ছিলেন। তার চোখের দু কোণা দিয়ে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তাঁর ফর্সা ডানহাতটি একটি গিনিপিগের মতো দ্রুত দৌড়ে বেড়াচ্ছিল হারমোনিয়ম-এর উপরে।
এমন আনন্দ পৃথিবীতে আর কী-ই বা আছে। এমন নির্দোষ, স্বার্থহীন, পবিত্র, পুণ্য আনন্দ। ভাল গান শোনা এবং তা তারিফ করার মতো আনন্দ? যারা এই আনন্দের কথা জানেন; তাঁরাই জানেন। বড় নির্মল আনন্দ এ।
মীড়, জমজমা, গমক, পুকার-এর একেবারে ছড়াছড়ি ফেলে দিল লাড্ডুওয়ালা। শেষে যখন সপাট তানে পৌঁছল, তার দাপটে আর মিষ্টত্বে মনে হতে লাগল ঘর ছুঁড়ে সোনা-রুপোর ফুলের ঝাড় গজাবে এক্ষুনি, ঝাড়লণ্ঠন থেকে চাঁদ সূর্য টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়বে গায়ক আর শ্রোতাদের মাথায় মাথায়!
গান শেষ হলে, পৃথু এবং অন্যান্য সকলে যখন তার রেশটুকুর মধ্যেই পুরোপুরি বুঁদ হয়ে আছে। আনতমস্তকে, তারিফ তখনও জানানোর মতো অবস্থা আসেনি শ্রোতাদের। সকলেই তখনও সুরের ঘোরে ভরপুর। ঠিক সেই সময় লাড্ডু চমকে দিয়ে খালি গলায়ই টপ্পা ধরে দিল।
হো মিঞা বে জানেবালে
তৈনু আল্লাদি কসম কিরিয়া লেনেবালে॥
কাফী-সিন্ধু। পাঞ্জাবি টপ্পা ধরল। ও আর বাঙালি টপ্পা জানবে কোত্থেকে!
গলা খুলতেই, পৃথু এবং ভুচুর সাগরেদ তানপুরা ছেড়ে ছেড়ে ওর দু কানে সুরের হাওয়া পুরে দিতে লাগল। গিরিশদা আবার হারমোনিয়মে ঝুঁকে পড়লেন। তবলচির হাত নেচে উঠল। লাড্ডুর টপ্পার প্রথম কলিতেই মনে হল বিজ্লী তীরবিদ্ধ হয়ে গেল। মানুষের হার্ট-অ্যাটাক হলে যেমন মুখচোখের ভাব হয়, বিজ্লীর অবস্থাও এখন তাই। পৃথু মনে মনে প্রমাদ গুণল! এই মুহূর্তে এই ফুলের ঘরে, সুরের ঘরে, এত সুগন্ধের মধ্যে নিঃশব্দে নিখুঁত খুন-খারাপি ঘটে যাচ্ছে।
শামীমের মুখচোখের অবস্থা হাস্যোদ্দীপক। ওর মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন ওর বন্দুকটাই কেড়ে নিয়েছে, গালে এক থাপ্পড় মেরে। হতবাক হয়ে বসে আছে। গানের মার, বড় মার। যার দিল সেই চোট কখনও খেয়েছে, সেই-ই জানে।
সাবীর মিঞার দু চোখ বন্ধ। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বুড়ো যেন ঘুমিয়েই পড়েছে। লাড্ডু গাইছিল :
“আদা জাঁদা তুসী মান্লে জাঁদে
আজও সজন ঘর সরশার লগ্দা হো মাত্বালে
হো মিয়া বে জানেবালে…”
পাতিয়ালা ঘরানার গায়করা টপ্পা গাইতেন। ভোপালে পৃথুর বাবার একজন বন্ধু ছিলেন, গোলাম তন্বীর। বড় ভাল গাইতেন টপ্পা। মনে আছে, একবার পৃথুদের সঙ্গে শিকারেও গেছিলেন। গভীর জঙ্গলের মধ্যে, সীওনীর কাছের এক বাংলোতে অনেক গান-বাজনাও হয়েছিল। বাঘও মারা হয়েছিল দুটো। একটা তন্বীর সাহেব মেরেছিলেন; অন্যটা পৃথু।
পুরনো কথা মনে এলেই আজকাল অনেক কথাই একই সঙ্গে শীতের মুখে দ্রুতপক্ষে ফিরে-আসা পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁকের মতো ভিড় করে আসে। ঝাঁকের পর ঝাঁক। স্মৃতির মুখে একটি ছাঁকনি লাগানোর দরকার হয়েছে বড়।
কাফী-সিন্ধুর টপ্পা শেষ করে এবার ভৈরবীতে ঠুংরী ধরল লাড্ডু। রাতের এই প্রহরে দরবারী কানাড়া ধরতে পারত। মালকোষও। কিন্তু ধরল ভৈরবী। গানে, নিজেও অবশ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, এমন হয় অনেক সময়। ঈশ্বর, সাধকদের উপর কখনও কখনও যেমন ভর করেন, গানও ভর করে গায়কের উপর। লাড্ডু কতদিন সাধনা করেছে, কে জানে। আজই ও প্রথম এই হাটচান্দ্রাতে গায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেল কি? মনে হয় না। হাটচান্দ্রাতে না পেলেও অন্য জায়গায় আগে ও গেয়েছে নিশ্চয়ই কোনও সন্দেহ নেই, ওর দোস্ত-বিরাদররা আজ থেকে ওকে অন্য চোখে দেখবে। আনন্দে আর সুরে লাড্ডু ভরপুর ডুবে রয়েছে। সুরের স্রোত বইছে ওর নিমজ্জিত সত্তার উপর দিয়ে। এদিকে, ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে গেছে। ভৈরবী গাওয়ার কথা তো ভোরের সময় বা সকালে। কিন্তু আজকাল রাগরাগিণীর সময় মেনে গান প্রায় কেউই গান না।
আবারও ধরে দিল লাড্ডু। আজ গানে পেয়েছে ওকেও। ও যেন নিজে গাইছে না, কোনও অদৃশ্য গলা গেয়ে উঠছে ওর ভিতর থেকে।
“বাবুল মোরা নৈহর ছুটেহি যায়।”
ক্যা ব্যাৎ! ক্যা ব্যাৎ! রব উঠল চারধার থেকে। সারেঙ্গী কেঁদে কেঁদে কোমল রে আর কোমল নি-র খুশবু ছড়াতে লাগল।
এবং…ঠিক সেই সময়ই কাণ্ডটা ঘটল।
গিরিশদার কাকবাহিনী একই সঙ্গে কা কা খ্বা খ্বা ক্রাঁ ক্রাঁ ক্রোন ক্রোন ক্রোলন্ ক্রোলন ক্রঁ ক্রঁ করে ডেকে উঠল। রাজা বাহাদুর, লাড্ডু, সাবীর মিঞা, ভুচু, শামীম, বিজ্লীর দল সকলেই চমকে উঠে ভীষণ ভয় পেয়ে অবাক হয়ে চেয়ে রইল গিরিশদার মুখের দিকে। সাবীর মিঞা লাফিয়ে উঠতে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন লাড্ডুকে বুকের মধ্যে।
বললেন, কামাল কর্ দিয়া ভাইয়া তু! মিঞা তানসেনকা বাদ অ্যায়সা গানেবালা প্যায়দা নহী হুয়া হিন্দুস্তাঁমে।
ব্যাপারটা কিছুই বোঝা গেল না।
যেই গুবলেট হল, গানে যেই যতি পড়ল, অমনি সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকেই দু-এক পাত্তর করে চড়িয়ে নিল। কন্ফ্যুশানের ফসল। কাকেদের কোরাস গানের পরে পরিবেশটা আর মানুষের গান-গাওয়া বা গান-শোনার মতো ছিলও না।
শামীম এসে পৃথুকে বলল, ইনসান আল্লা! ক্যা ব্যাত! ক্যা ব্যাত!
মিঞা তানসেন দীপক রাগ গেয়ে বাদশাহ আকবরের আমলে আগুন জ্বালিয়েছিলেন, মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়েছিলেন। বৈজু বাওয়ারাও অসাধ্য সাধন করেছিলেন। কিন্তু দরবারী কানাড়া বা মালকোষ গাইবার সময়ে ভৈরবীতে ঠুংরী ধরে দিয়ে পাঁচশ কাককে একই সঙ্গে ভোর হয়েছে ভাবিয়ে তাদের দিয়ে ঊষাসঙ্গীত গাওয়ানো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়!
গিরিশদা দাঁড়িয়ে উঠে, দুলে দুলে বললেন।
লাড্ডুর কাঁধে থাপ্পড় মেরে ভুচু বলল, শালে! ক্কাউয়া-গওয়াইয়া! ক্যা বাত্!
ভুচুর চোখ লাল, বাক রুদ্ধ গিরিশদার মৃত্যুবাণ তখন সকলের উপরই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সকলেই তখন পুরোপুরি প্রতিক্রিয়াশীল।
লাড্ডুকে কুর্নিশ করে বিজ্লী বলল, ক্যা মিঠি আওয়াজ আপ্কা!
ঠিক এমনই সময় পৃথুর নিজেরও খুব গান গাইতে ইচ্ছে করল।
মদ বেশি খাওয়া হলেই ওর মধ্যে সুর গুমরোতে থাকে। বুকের মধ্যে আকুলি-বিকুলি করে তার সুর। এক দুখিনী বন্দিনী নারী যেন ওর বুকের মধ্যে কেঁদে কেঁদে মুক্তি চায়। গান না গাইতে পারলে, তার খুবই কষ্ট হয় তখন। কিন্তু পৃথু যে গান আদৌ গায়, বা কখনও গাইত সে খবর এই দলের কেউই রাখে না। একমাত্র ঠুঠা বাইগা জানত। কিন্তু সে তো এই ভদ্রলোকদের আসরে নিমন্ত্রিত নয়!
মনে মনে ও বলল, ভদ্রলোক মাত্রই খুবই ছোটলোক হয়!
গিরিশদা বললেন, চলো এবার সকলে খেয়ে নেওয়া যাক। নইলে বিরিয়ানী বরবাদ হয়ে যাবে। খাওয়া দাওয়ার পর আবার লাড্ডুর গান এবং বিজ্লী বহীনের গান শোনা হবে। আজ সারা রাত ম্যায়ফিল চলবে।
সকলেই বলে উঠল, বহত আচ্ছা। কেবল পৃথু কিছু বলল না। কাক-ডাকার পর রাতে আর গান হয় না। ভোর রাতের মধ্যে তাকে বাড়ি পৌঁছে গুড বয়ের মতো শুয়ে পড়তে হবে। কুকুরগুলোর জন্যে নিঃশব্দে যে গৃহে প্রবেশ করবে তার জো কী আছে! কুকুর জাতটার প্রতিই ওর ঘেন্না ধরে গেছে। শুয়োরদের প্রতি যেমন।
খাবার ঘরে সার সার খাবার সাজানো হয়েছে। বড় বড় দস্তরখানের উপর। বাখরখানি রোটি, রোমালি রোটি, বটি কাবাব, শাম্মী কাবাব, পাক্কি বিরিয়ানী, মুর্গ রেজালা, বাগারে বায়গন, মীর্চি কী সাঁলা, হালীম। একেবারে মোগলাই, ভোপালি, হায়দরাবাদী রান্নার ছয়লাপ। সাবীর মিঞা নিজে বিরিয়ানীর হাঁড়ি থেকে স্তরে স্তরে বিরিয়ানী উঠিয়ে পরিবেশন করার তদারকি করছেন। বিরিয়ানী রাঁধা যেমন ঝকমারি, পরিবেশন করা তার চেয়েও বেশি ঝকমারি। এ গরীবের খাদ্য খিচুড়ি নয়। আমীর ওমরাহর মন পসন্দ-এ। এক স্ত্রীর উপর অভিমান করে যাঁরা একটামাত্র জীবন নষ্ট করতেন না কখনও, হারেম রাখতেন।
গিরিশদাও তো অবাক! বললেন, এ কী! বরাত দিলাম মোটে তিন পদের; এসে গেল এত পদ। এ তো ইলাহি ব্যাপার।
ভুচু বলল, আমাকে বকবেন না গিরিশদা। এ সব সাবীর মিঞার হরকৎ।
বুড়ো বলল, গিরিশবাবু গান শোনাচ্ছেন আর খাওয়ার ভার যখন আমার উপরই পড়েছে তখন আমি সামান্য একটু খানা-পিনার ইন্তেজামও করব না? এই-ই আমার উপহার আজ রাতে। দোকানের খাবার এক পদও নেই। সব আমি, আর আমার দুই বিবি মিলে বানিয়েছি।
এই মানুষটি খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি যাই-ই করুক না কেন ভবিষ্যতে এঁর স্থান খুদাহ্ বেহেস্তের বেস্ট জায়গায় নিজে হাতেই নিশ্চয়ই করে রেখেছেন। এত মানুষকে, এতবার এতরকম উম্দা খাওয়া খাইয়েছেন ইনি যে, সেই পূণ্যবলেই তার দোজখ-এ ঢোকার পথ কাঁটা বিছানো হয়ে গেছে।
খাওয়া দাওয়ার পর গিরিশদা তাঁর তুরুপের তাস ছাড়লেন। আফটার-ডিনার ড্রিংক। হাকিমি কায়দায়। তার আগে সাবীর মিঞা হামদর্দ দাওয়াখানার এক মস্ত শিশি বের করে প্রত্যেককে এক এক বাটি পাচনল খাইয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খনা, ইতমিনানসে পচ্ যায়েগা। অর্থাৎ, খাবার সহজেই হজম হয়ে যাবে।
গিরিশদা তারপরই পেশ করলেন, গিরিশী-লিকুওর। শর্টকাট-এ উনি বলেন গিরি-লিক্।
ছোট ছোট লাল-নীল-হলুদ-সবুজ জার্মান গ্লাসে হানি-বি-ব্রান্ডির মধ্যে লবঙ্গ, দারচিনি, বড় এলাচ, যষ্ঠিমধু এবং গন্ধরাজ লেবুর পাতা একসঙ্গে ছেঁচে গুলি বানিয়ে তারই এক একটি গুলি তার মধ্যে ফেলে দেওয়া।
শামীমের পেটে ওই বস্তু পড়তেই সে অমিতাভ বচ্চনের কায়দায় দু পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে আবৃত্তি করল :
“না পীনা হারাম, না পিলানা হারাম্।
পীকে হোঁসমে আনা হারাম হ্যায়।”
মনে হল, শামীম একটু পরেই ধপাস করে পড়ে যাবে ফরাসে, বেহোঁস হয়ে, শায়েরের যাথার্থ্য প্রমাণ করতে।
ওই পরিমাণ খাদ্য-পানীয়র পর এবং কাকেদের ক্রমাগত ডাকের কারণেই গানবাজনা আর হল না। তবে, মজা খুব হল। পান, গড়গড়া, আড্ডা রাতও দেড়টা হল। সভা ভঙ্গ হল সে-রাতের মতো। গিরিশদার গাড়িও বের করতে হল। ড্রাইভারও ছিল। সকালে তিন গাড়িতে ভাগাভাগি করে ফেরা হল। শামীমকেও জোর করে গাড়িতে আনা হল—ওর মোটর সাইকেল গিরিশদার ওখানেই থাকল। কাল এসে, নিয়ে যাবে।
বিজ্লী নামবার সময়, পৃথুকেও নামতে বলল।
না, লোকভয় নয়, ভীষণই ঘুম পাচ্ছিল পৃথুর। বিজ্লীদের বাড়িটা ভাল করে দেখে নিল। সবজি মণ্ডির একপাশে, গলির মধ্যে, ফাঁকা জায়গায় বাড়িটা। আলাদা বাড়ি। এদিকে কি অন্য কোনও তওয়ায়েফ থাকে? কে জানে? কতটুকুই বা খোঁজ রাখে পৃথু?
গাড়ি থেকে নামার আগে বিজ্লী পৃথুর হাতে হাত রাখল। পৃথু বলল, আসব একদিন। ঠিক আসব। দেখো।
ধাঙ্গড় বস্তির গলির মোড়ে ওরা নামিয়ে দিল পৃথুকে। ভুচু বলল, জড়ানো গলায়, একটু হেঁটে যাও পৃথু। মগজ সাফ হয়ে যাবে।
ও বিড়বিড় করে বলল, মগজ আমার সব সময়ই সাফ। কিন্তু, ধুলোয় ভরা পথে নেমেই ওই ঠাণ্ডার মধ্যেও বুঝতে পারল যে, গিরিশদার নানারকম মিশ্র-অবিমৃষ্যকারিতায় তার অবস্থা অত্যন্তই শোচনীয় হয়েছে।
ধাঙ্গড় বস্তির ভাঁটিখানার দিক থেকে চারটি ছেলে একটি মেয়ে হেঁটে আসছিল।
এত রাতে!
ওরা নিশ্চয়ই ভাল ছেলেমেয়ে নয়। পৃথুরই মতো তারা পৃথুকে চেনে না মনে হল। পরদেশি হবে। নতুন কুলি-কামিন এসেছে কত নানান জায়গা থেকে, ঠিকাদারের বেইমানির পর।
ওদের মধ্যে একটি ছেলে, জড়ানো গলায় পৃথুর উদ্দেশে কী যেন বলল। পৃথু শুনতে পেল না। মনে হল, কোনও খারাপ কথা। তার কান ঝাঁ-ঝাঁ করছিল, নেশার ঘোরে। সঙ্গের মেয়েটিও খিলখিল করে হেসে উঠল। আরেকটি ছেলে, পথ থেকে একটি ছোট্ট পাথর কুড়িয়ে নিয়ে আচমকা পৃথুর দিকে ছুঁড়ে মারল।
মেরেই, ওরা সকলেই টালমাটাল পায়ে বড় রাস্তার দিকে দৌড়ে গেল।
কী হল, বোঝার আগেই, পাথরটা এসে পৃথুর কপালে লাগল। বেশ বেশিই লাগল পৃথুর। ও ধাক্কা খেল একটা। এমন তো কখনও হয়নি আগে। তবু, গ্রাহ্য না করেই এগোল।
এত শীতেও বেশ ঘাম হচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথা, কপাল, ঘাড় মুছল পৃথু। পথের আলোয় হঠাৎই লক্ষ্য করল যে, রুমাল রক্তে ভিজে গেছে। চেতনা ও অবচেতনার মাঝামাঝি একরকম অনুভূতি হল। আশ্চর্য! নিজের রক্ত দেখে একটুও বিচলিত হল না। যেমন নিজের শিকার-করা নানা জানোয়ারের রক্ত দেখে হত আগে। রুমালটা দেখতে দেখতে রক্তে একেবারেই ভিজে গেল। সাদা ফ্ল্যানেলের পাঞ্জাবির বুক রক্তে লাল হয়ে গেল লাল গোলাপের মতো ফুল ফুটে উঠল অনেক, ওর বুকে।
ছেলেগুলো ওর সম্বন্ধে নিশ্চয়ই খারাপ কিছু বলেছিল। নইলে, মেয়েটি হাসত না।
কী বলল ওরা? কী বলতে পারে? কে জানে? সকলেই তো ওকে খারাপই বলে। ভাল আর বলল কে? ও তো সমাজের নয়। সমাজ তাকে গ্রহণ করেনি; সেও করেনি সমাজকে।
দূর থেকে রুষার বাংলোটা দেখা যাচ্ছিল। পোর্টিকোতে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় কুকুরগুলো একসঙ্গে ডেকে উঠল। এস ডি ও সাহেবের ধবধবে সাদা অ্যালসেশিয়ানও সেই বেজন্মা কুকুরগুলোর গলায় গলা মেলাল।
বাড়ির কাছে শ্লথ পা দুখানা টেনে টেনে হেঁটে আসতে আসতে ও ভাবতে চেষ্টা করল কাল সকালে রুষা কী কী বলবে ওকে। ওর ছেলে আর মেয়ে কী বলবে? সকলেই খারাপ বলবে। ও তো খারাপই। খারাপ। খুবই খারাপ। নিজের সম্বন্ধে কোনও মিথ্যা ধারণা নেই ওর। ও একটা বিচ্ছিরি; বাজে টাইপ!
“একটা অদ্ভুত বাজে লোক!”
টুসু বলে।
টুসু, তার গায়ের গন্ধের ভাগীদার।
তার একমাত্র ছেলে।
পৃথুর হঠাৎ মীর্জা গালিব-এর একটি শায়ের মনে পড়ে গেল। এইরকমই পড়ে হঠাৎ হঠাৎ।
একদিন মীর্জা গালিব এরকমই গভীর রাতে সরাইখানা থেকে টালমাটাল পায়ে হেঁটে আসছিলেন। পথের ছেলেরা তাঁকে ঢিল মারে। বড় দুঃখ হয়েছিল গালিবের। এত বড় কবি উনি! তাঁকে পথের অর্বাচীন ছেলেগুলো এমন গালাগালি করল; ঢিল মারল!
গালিব বিড় বিড় করে বলেছিলেন :
“বুঢ়াহ না মান গালীব, যো দুনিয়া বুঢ়াহ কহে
অ্যাইসা কোঈ হ্যায় দুনিয়াঁমে, সবহি ভালো কহে যিসে?”
অর্থাৎ তুমি দুঃখ কোরো না গালীব। এরা তোমার অবমাননা করল, তোমায় খারাপ বলছে এরা তবুও তুমি দুঃখ কোরো না। দুনিয়াতে এমন কি একজন মানুষও আছে, যাকে সকলেই ভাল বলে?
সাবধানে, শব্দ না করে, ড্রইংরুমের চাবি খুলে ঢুকল পৃথু। খাণ্ডেলওয়াল সাহেবের অ্যালশেসিয়ান কুকুরটা ঘাউ ঘাউ করে ডেকে উঠল অন্ধকার রাতকে মাদলের মতো বাজিয়ে দিয়ে।
সাবধান! বিপদ! বিপদ! হাউন্ড অফ দ্যা বাস্কারভিলস।
নাঃ। পরক্ষণেই মনে পড়ল। কুকুর নয়। শুয়োর। কুকুর ভাল। কুকুর অনেক ভাল শুয়োরের চেয়ে।
পৃথু পা-টিপে টিপে নিজের ঘরে এল। নিজের ঘরের টেবল লাইটটা জ্বেলে, বাইরে গিয়ে ড্রইংরুমের ফুট-লাইটটা নিবিয়ে দিল। তারপর ঘরে এসে তার বরাদ্দ জলের বোতল থেকে ঢকঢকিয়ে জল খেল অনেকখানি। খুব তেষ্টা। তেষ্টা পায়ই এমন সময়। ডি-হাইড্রেশান হয়ে যায়। এখন একটা পান হলে খুবই ভাল হত। বাড়িতে পান খাওয়া এবং পান রাখা বারণ। ছোটলোকের নেশা।
জল খেয়ে, আলো নিবিয়ে; শুয়ে পড়ল পৃথু।
কে জানে, কেন রাজ্যের শের-শায়ের ঠিক এখনই মাথার মধ্যে ভিড় করে আসতে লাগল ওর। মাঝে মাঝে এরকমই হয়। শামীমই শায়ের বলে, শায়েরের পোকাগুলোকে নড়িয়ে দিয়েছে। ও ভেবেছিল, হয় কুর্চি, নয় বিজ্লীর অদেখা নগ্নতাকে ভাবতে ভাবতে কোলবালিশ জড়িয়ে আশ্লেষে ঘুমিয়ে পড়বে। রুষাকে ও এমন এমন সময়, একেবারেই মনে করে না। কোনওদিনও না। সেক্স ব্যাপারটা, নিরানব্বুই ভাগই মানসিক, মোটে একভাগ শারীরিক। পৃথুর মনে হয়। মন যাকে না চায়, তার সঙ্গে কল্পনাতেও, স্বপ্নেও, মিলিত হওয়া যায় না। এমনকী আত্মরতির রানী হতেও, কিছু যোগ্যতা লাগে, সব মেয়েরই। কিন্তু কুর্চি বা বিজ্লী বা তার পরিচিত অন্য একজনও ভাললাগার নারীকে মনে পড়ল না ওর আজ রাতে। একটি মুখ। ক্লিষ্ট। খোঁচা-খোঁচা দাড়ির গভীর চোখের একটি মুখ।
কে যেন, কে যেন সেই কবি?
আঃ। কিছুতেই মনে পড়ছে না।
কপাল আবার ভেসে যাচ্ছে রক্তে। বাথরুম থেকে তোয়ালে এনে চেপে ধরল মাথায়। মানুষের রক্তে কেমন এক অমানুষিক গন্ধ আছে। স্বাদও। নোনতা-নোনতা। ওর মনে হল, জীবন-যৌবন সম্বন্ধীয় বেশির ভাগ জিনিসই বোধহয় লবণাক্ত।
কে জানে, কেন?
সেই মুখ মনে পড়েছে। হ্যাঁ হ্যাঁ। ফিরাক। ফিরাক গোরখপুরী।
মনে পড়তেই, ওর মাথার মধ্যে গড়ে-ওঠা মনে না-পড়ার সব টেনসান কেটে গেল। ঘুম নেমে এল দু চোখে। তার কপাল থেকে নিঃশব্দে রক্তক্ষরণ হতে থাকল। ও জানলও না। বড় সাদা তোয়ালেটাতে অন্ধকারে লাল লাল পদ্ম ফুটে উঠতে লাগল। রক্ত-পদ্ম। অনেক পদ্ম।
রক্ত, চিরদিন অমন নিঃশব্দে ক্ষরিত হয়, হয় স্তন্য; রক্তবীজ। নিঃশব্দে প্রাণ আসে, প্রাণ ভরে; প্রাণ চলে যায়।
তাই-ই পৃথু জানলও না, সেই মুহূর্তে, রাতের তৃতীয় প্রহরে বাইরের অন্ধকারের গর্ভে কখন আলোর বীজ নিঃশব্দে রোপিত হয়ে গেল।