বাবা নুরদীন (কাল : ১৩০০ খৃষ্টাব্দ)
‘সে সব দিনকাল শেষ হয়েছে, যখন আমরা ভারতভূমিকে দুগ্ধবতী গাভীর চেয়ে বেশি। কিছু ভাবতে পারতাম না। তখনকার দিনে কৃষক, কারিগর, ব্যবসায়ী ও রাজাদের কাছ থেকে আদায় করে অনেক বেশি ধনদৌলত জমা হত আমাদের হাতে স্কুর্তি করে ওড়াতাম আর টাকা পাঠাতাম গোর দেশে। এখন আমরা আর গোরের অধীন নই, স্বাধীন খিলজী শাসক আমরা?’ কথাগুলো বলল একটি তীক্ষ্ণবুদ্ধি যুবক নিজের কালো দাড়ির ওপর হাত বুলোতে বুলোতে। তার সামনে বসে শুভ্ৰশ্বাশ্রমণ্ডিত সৌম্য সম্ভান্ত চেহারার একজন পুরুষ, পরনে সাদা আচকান, মাথায় বিরাট পাগড়ি।
বৃদ্ধ বলল, ‘কিন্তু জাঁহাপনা। মোড়ল, মাতব্বর, প্যাটেল, তালুকদার এদের স্বাৰ্থ যদি ক্ষুন্ন করা হয় তবে তারা বিগড়ে যাবে, আর খাজনা আদায় করার জন্য গ্রামে গ্রামে ফৌজ পাঠাবার সামৰ্থ্য আমাদের নেই।’
‘প্রথমে এই বিষয়ে আপনাকে মন স্থির করতে হবে যে, আপনারা ভারতের অধিবাসী। হয়ে ভারতবর্ষের শাসক রূপে এ-দেশে অবস্থান করবেন–না, উট ও খচ্চরের পিঠে। বোঝাই করে হীরা-মুক্ত লুণ্ঠনকারী গোর-গজনীর দাসু রূপে বাস করবেন!’
‘এখন ভারতবর্ষেই আমাদের বসবাস করতে হবে জাঁহাপনা।’ ‘হ্যাঁ, পূর্বতন শাসকদের মতো আমাদের অস্তিত্বের মূল এখন আর গোরে নেই। দিল্লীতে যদি কোনো বিদ্রোহ, অশান্তি শুরু হয় তবে আরব, আফগানিস্তান থেকে সাহায্য আমরা পাব না, অথবা কোথাও পালিয়ে গিয়েও নিস্তার পাব না।’
‘এ কথা স্বীকার করি জাঁহাপনা!’
‘সুতরাং এই আমাদের ঘর, এখন এখানেই থাকতে হবে, আর এ জন্য আমাদের–এমনভাবে এই ঘর তৈরি করতে হবে যাতে এখানকার লোকে সুখী এবং শান্ত থাকে। এখানকার প্রজাদের মধ্যে ক’জনই বা মুসলমান আছে? একশ’ বছরের ভেতর দিল্লীর আশপাশের জায়গাগুলোকেও আমরা মুসলমান করে তুলতে পারিনি। মোল্লা আবু মোহাম্মদ, আপনি কত দিনের ভেতরে সমগ্ৰ দিল্লী এবং এই দেশকে মুসলমানে রূপান্তরিত করতে পারেন, বলুন তো?’
সম্মুখে উপবিষ্ট তৃতীয় বৃদ্ধ দাঁতহীন ঠোঁটের নিচ থেকে নাভি পর্যন্ত প্রলম্বিত সাদা দাড়ির গোছা ঠিক করতে করতে বলল, ‘আমি নিরাশ হইনি। সুলতানে-জমানা। তবে। অশীতি বর্ষের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, যদি জবরদস্তি করে মুসলমান করাতে চাই
‘এ জন্য ভারতে অধিষ্ঠিত মুসলমানেরা সমগ্ৰ ভারতবর্ষ মুসলমান হয়ে যাবার দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে না। এক শতাব্দী আমরা এই ভাবেই কেটে যেতে দিয়েছি, এবং নিজেদের প্রজা-সম্বন্ধে কোনো কিছু না ভেবে যথাশক্তি শুধু জমির খাজনা বাণিজ্য শুল্ক এবং রাজস্ব আদায় করতেই চেয়েছি। তার পরিণাম হল-নবাবের খাজনা বাবদ এক টাকা আনে তো পাঁচ টাকা যায় তাহশীল আদায়কারীর পেটে। দুনিয়ার আর কোথাও দেখেছেন, গ্রামের কর্মচারীরা রেশমী পোশাক পরে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বের হয়, ইরানের তৈরি তীর-ধনুক ব্যবহার করে! না-ওয়াজির-উল-মূলক আমার রাজ্যে এই ধরনের অবাধ লুণ্ঠন এখনই বন্ধ করতেত হবে।’
‘কিন্তু হুজুর! বহু হিন্দু, মুসলমান হয়েছে এই লোভেই। এ-বার তাহলে সে পথও বন্ধ, হয়ে যাবে।’–মোল্লা বলল।’
‘ইসলামও যদি এই ধরনের লুট এবং ঘুষের ব্যাপার সমর্থন করত, তবু সরকারী খাজনা এবং সরকারি সম্পত্তির স্বার্থে সে-সব বরবাদ করে দেওয়া হত। তাছাড়া যে সরকারের কর্মচারীরাই লুট করে তার আর আশা-ভরসা কি?’
‘রাজ্যের ভিত এদের দিয়ে মজবুত হতে পারে না, স্বীকার করতেই হবে জাঁহাপনা। কিন্তু আমি শুধু বিদ্রোহ ও বিপদের কথাই ভাবছিলাম।’–ওয়াজির বলল।
‘গ্রামের আমলারা তাই করে বসবে। যদি তাদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, এ কথা ঠিক। কিন্তু গ্রামে আমলার সংখ্যা বেশি—না কৃষকের সংখ্যা বেশি?—কৃষকের। আমলা তো প্রতি একশ’ কৃষকে মাত্র একজন। এই একশ’ কৃষকের রক্ত চুষেই ঐ একজন ঘোড়ায় চড়ে, রেশমী পোশাক পরে আর ইরানী তীর-ধনুক ব্যবহার করে। এই ধরনের রক্তচোষা বন্ধ করে আমরা কৃষকের অবস্থায় উন্নতি করব! তাদের সরকারের অনুগত করে তুলব। একজনকে অখুশী রেখে একশ’ লোককে খুশী করে তোলাই কি ভালো কাজ হবে না?’
‘ঠিকই বলেছেন হুজুর! এ বিষয়ে আমারও এখন আর সন্দেহ নেই যদিও হিন্দুস্থানের মুসলমান সুলতাগণের মধ্যে এক নতুন পন্থী আপনি অনুসরণ করতে যাচ্ছেন। এই পথেই হয়ত সাফল্য লাভ করা যাবে। এতে গ্রামের উচ্চশ্রেণীর কিছু লোককে শুধু অখুশী করে তুলব আমরা।’
‘গ্রামে এবং শহরে উচ্চশ্রেণীর সামান্য কিছু লোক অখুশী হয়ে উঠলে কিছু যায় আসে। না। এখন শাসনকার্যের পাকাপোক্ত ইমারতের বুনিয়াদ তৈরি করতে হবে।’
‘মোল্লা কি যেন চিন্তা করে বলল, ‘হুজুরআলী, আমিও এখন বুঝতে পারছি, গাঁয়ের সমগ্র কৃষকশ্রেণীর সুখ-সুবিধার প্রতি নজর রাখলে সরকারের পক্ষে সেটা লাভজনক হবে। গ্রাম এবং শহরের তাঁতীদের প্রতি সামান্য নজর দিয়েছি আমরা। পঞ্চায়েতকে মজবুত করে তুলতে তাদের সাহায্য করেছি, যাতে বেনে-মহাজনদের লুটের হাত থেকে রেহাই পায়। তারা। আগে প্রত্যেক আমলা এদের দিয়ে বেগার খাঁটিয়ে নিজেদের জন্য কাপড় তৈরি করাত, আমরা সে-সব বন্ধ করে দিয়েছি। এখন। আজ তার পরিণাম দেখতে পাচ্ছি-ধুনুরী, তাঁতী আর দর্জির ভিতর এমন লোক এখন আর দেখাই যায় না। যারা ইস্লামের আওতায় চলে আসেনি।’
‘তাহলে এখন নিজেই দেখলেন তো মোল্লাসাহেব, যে কাজে সাম্রাজ্যের মঙ্গল সাধিত হয়, তাতে ইসলামেরও মঙ্গল।’
‘কিন্তু এক বিষয়ে আমার আর্জি আছে জাঁহাপনা! আপনি হলেন আমিরউলু-মোমিনীন (মুসলমানদের নায়ক).’
‘সেই সঙ্গে হিন্দুদেরও সুলতান আমি, ভারতবর্ষে মুসলমানদের সংখ্যা তো খুব কম, সম্ভবত হাজারে একজন!’
‘হিন্দুরা অবিরাম ইস্লামের অপমান করে চলেছে। এদের এই আচরণ ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যেতে পারে। কাজেই এই অপমানকর আচরণ বন্ধ করতে হবে এবং সে কাজটা আপনারই।’
‘অপমান? কেন তারা কি পবিত্র কোরান পদদলিত করেছে?’
‘না, এত বড় সাহস কেমন করে তাদের হবে।’
‘তবে কি মসজিদকে অপবিত্র করেছে তারা?’
‘না, না, সেও সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।’
‘না, জাঁহাপনা! বরং যারাই আমাদের সুফিগণের সংস্পর্শে এসেছে, খোদী-রসূলকে তারা ঋষির মতোই দেখছে। কিন্তু এরা যে আমাদের চোখের সামনে বসেই এদের কাফের ধর্ম পালন করে চলেছে!’
‘যখন তাদের কাফের বলেই মনে করেন, তখন তাদের কাফেরোচিত আচরণে আপত্তি কেন? আমার চাচা সুলতান জালালউদ্দিন আমার মতো মনস্থির করতে পারেননি যে, নিজেকে তিনি ভারতবর্ষের স্থায়ী শাসক রূপেই গণ্য করবেন, না। সমগ্র ভারত মুসলমান নাহওয়া পর্যন্ত এক অস্থায়ী শাসক বলে মনে করবেন। কিন্তু তিনি একবার আপনার মতো এ প্রশ্নকারীকে কি জবাব দিয়েছিলেন জানেন?’
‘না হুজুর-আলা!’
‘বলেছিলেন, ‘বেওকুফ দেখতে পাওনা আমার মনূজিলের সামনে দিয়ে প্রতিদিন হিন্দুরা শাখ বাজিয়ে ঢোল পিটিয়ে নিজেদের মূর্তিপূজোর জন্য যমুনার তীরে যায়, আমার চোখের সামনেই তারা তাদের কাফের-ধর্মের অনুষ্ঠান করে, আমার এবং আমার শাহীরোবকে (বাদশাহী মর্যাদা)। খাটো করে দেখে, তারা আমার ধর্মের দুশমন (হিন্দু) যারা আমার রাজধানীতে আমারই চোখের সামনে বসে বিলাস-ব্যসনের মধ্য দিয়ে জীবন : কাটাচ্ছে এবং ধন-দৌলত আর উন্নত অবস্থার জন্য মুসলমানদের সঙ্গে নিজেদের ঠাটঠমক আর অহঙ্কার জহির করছে। আমার কাছে এ লজ্জার কথা। ধনদৌলত সমস্তই আমি তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। তাই আমি নিজে দান হিসেবে তাদের দেওয়া সামান্য খড়কুটো নিয়েই খুশী রয়েছি।’—আমার মনে হয় এর চাইতে ভালো জবাব আমিও দিতে পারি না।’
‘কিন্তু সুলতানে-জমানা, ইসলামের প্রতিও তো সুলতানের কর্তব্য রয়েছে।’
‘এমন অপরাধও যে করেছে, যার সাজা হল ফাঁসি, সেও ইসলামের শরণে এলে আমি
তাকে গোলামী থেকে মুক্ত করে দেবার হুকুম দিতে পারি। কিন্তু সরকারি খাজনা থেকে তার খরিদ-মূল্য দিয়ে। এই দেশে কোটি কোটি টাকা গোলাম রাখায় ব্যয় হয়েছে কাজেই ও ছাড়া সমস্ত গোলামের মুক্তির কথা তো আপনি বলতেই পারেন না।’
‘না জাঁহাপনা, গোলাম রাখার ফরম্যাজ তো আল্লাহ্ তালাও দিয়েছেন।’
‘না, যদি আপনি বলেন তো আমি তখতের বিনিময়েও মুসলমান-অমুসলমান সমস্ত দাস-দাসীর মুক্তির ফরমান জারি করতে পারি।’
‘কিন্তু তাহলে শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করা হবে।’
‘শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণের কথা ছাড়ুন মোল্লাসাহেব, এই মুহূর্তে আপনি নিশ্চয় কোনো প্রিয় দাসীর কথা ভাবছেন! সবচেয়ে বেশি গোলাম রয়েছে মুসলমানদেরই ঘরে।’
‘আল্লাহতালা মোমিনদের এই অধিকার স্বীকার করে নিয়েছেন!’
’কিন্তু দাস-দাসীরাও যদি মোমিন হয়! তা হলেও আমাদের মনে হয় আপনি এই দুনিয়ার মুক্ত হাওয়ায় ওদের নিশ্বাস নিতে দেবেন না এবং বেহেস্তের আশায় ওদের বসিয়ে রাখবেন।’
‘আমার আর কিছু বলার নেই ইসলামী সাম্রাজ্যে ইসলামী শরীয়তের শাসন চালু হওয়ার উচিত, আমি শুধু এই টুকুই বলতে চাই।’
‘কিন্তু এই চাওয়াটুকুই যে বিরাট এর জন্য ইসলামী সাম্রাজ্যের অধিকাংশ প্রজাকেই মুসলমান হতে হবে। আপনাদের সামনে–আপনিও শুনুন ওয়াজির সাহেব, আমার সাফ মতামত। সুলতান মামুদের মতো এক বিদেশী সুলতান জবরদস্ত সৈন্যবাহিনী নিয়ে শান্তিপূর্ণ শহরসমূহ লুণ্ঠন করতে পেরেছিল, লুটের মাল উট এবং খচ্চরের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পেরেছিল, কিন্তু সে রকম কোনো কাজ করা কাচ্চাব্বাচ্চা নিয়ে দিল্লীতে অধিষ্ঠিত আমার মতো লোকের ক্ষমতার বাইরে। আমার সরকার কায়েম হয়েছে হিন্দু প্রজাদের রাজস্বের ওপর, কায়েম হয়েছে হিন্দু সিপাই, সেনানায়কদের ওপর নির্ভর করে—আমার সেনাপতি হিন্দু; পাঁচ হাজার সৈন্যের সেনানায়ক চিতোরের রাজা আমার সপক্ষে।’
‘কিন্তু জাঁহাপনা গোলাম সুলতানও তো দিল্লীতেই থাকতেন।’
‘আপনি বাধা দেবেন না! আমাকে চঞ্চল এবং বদমেজাজী বলা হয়, কিন্তু এইসব বিরোধী মতামত শোনা থেকে আমাকে বিরত করতে পারে না। গোলামদের সরকার এক রাতের পাখীর বাসার সামিল ছিল। মোঙ্গলদের সৃষ্ট তুফানে হিন্দুস্থানের ইসলামিক রাজত্ব কোনো মতে বেঁচে গেছে। হিন্দুরা জানত না যে, মোঙ্গলদের মতো দুশমন, মুসলমানেরা কখনও দেখেনি। তারা যদি মোঙ্গলদের সামান্য উৎসাহও দিত। তবে ভারতের মাটিতে নতুন ইসলামী সাম্রাজ্য দাঁড়াতেই পারত না। আপনারা জানেন না যে, চেঙ্গিসের বংশ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য চীনের ওপর আধিপত্য করছে!’
‘জানি হুজুর-আলা।’–মোল্লা বলল।
’ঐ বংশ বৌদ্ধধর্মকেই অনুসরণ করে।’
‘বৌদ্ধধর্ম! এত সব মঠ-মন্দির জ্বলিয়ে, মাটিতে মিশিয়ে দেবার পরও কাফেরদের সাকার স্বরূপ ধর্ম ভারতের মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি!’
‘কাফেরদের সাকার স্বরূপ ধর্ম কেন?’
‘জাঁহাপনা, হিন্দুদের ব্ৰাহ্মণদের ধর্মে ও সিরাজনীহার (স্রষ্টা) আল্লাহ কথাও কিছু আছে, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম তো তাঁকে একবারেই অস্বীকার করে।’
‘চেঙ্গিসের বংশ শুধু আজ নয়, কুবলাই খাঁর সময় থেকেই বৌদ্ধধর্মের বিশ্বস্ত অনুচর বলে মনে করে নিজেদের। শুধু তাই নয় চেঙ্গিসের ফৌজে, মোঙ্গলদের মধ্যে বহু সিপাহসালার এবং সৈন্য ছিল। বুখারা, সমরখন্দ বলখ ইত্যাদি ইসলামী দুনিয়ার শহরগুলোর মুসলমানী সভ্যতার সমস্ত কেন্দ্রকে বেছে বেছে নির্মূল করে দিয়েছে তারা; আমাদের নারীদের উচ্চ-নিচ বংশের বিচার না করে যথেচ্ছভাবে দাসীতে পরিণত করেছে; শিশুদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে—আর এই সমস্ত অত্যাচারকে প্ররোচিত করেছিল বৌদ্ধ মোঙ্গলরা। তারা বলত, আরবেরা আমাদের বিহারসমূহ ধ্বংস করেছে, আমাদের এ সবের প্রতিশোধ নিতে হবে। ভেবে দেখুন, যদি মোঙ্গলেরা ভারতীয় বৌদ্ধদের সঙ্গে মিলে হিন্দুদের দলে টানতে পারত তবে ইসলামের অবস্থা কি হত?
‘নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত জাঁহাপনা।’
‘এই জন্যই বালুর চরে আমাদের রাজ্যের ভিত স্থাপন করা উচিত নয়, গোলামদের নকল করতেও আমরা পারি না।’
ওয়াজীর এতক্ষণ পর্যন্ত চুপ করে ছিল, এইবার সে মুখ খুলল, ‘সরকার আলী! গ্রামের আমলাদের ক্ষমতা কমে গেলে অতদূর পর্যন্ত সাম্রাজ্য পৌছাবে কি করে?’।
‘যখন রেশমী-পরা ঘোড়ায়-চড়া আমলারা ছিল না, তখন কি করে কাজ চলত?’
‘আমি সে সম্বন্ধে খোঁজ করিনি।’
‘আমি করেছি। যখন শাসকেরা নিজেদের লুণ্ঠনকারী বলে মনে করল, তখন তারা লুণ্ঠনকারী আমলা নিযুক্ত করল। সব জায়গায় এমনই হয়, কিন্তু তার আগে সমস্ত গ্রামে পঞ্চায়েত থাকত, পঞ্চায়েত গ্রামের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া থেকে শুরু করে সরকারের রাজস্ব দেওয়া পর্যন্ত সমস্ত ব্যবস্থাই করত। গ্রামের কোনো এক ব্যক্তিকে নিয়ে রাজার কোনো দুশ্চিন্তা ঘটত না। সে শুধু পঞ্চায়েতের সঙ্গেই যোগাযোগ রাখত এবং জানত যে তার এবং খাজনা-দেনেওয়ালা কৃষকের মাঝে সম্বন্ধ স্থাপিত করবার জন্য এই পঞ্চায়েত রয়েছে।’
‘তাহলে জাঁহাপনা, একশ’ বছরের বেশি মৃত এই পঞ্চায়েতগুলোকে আবার আমাদের বাঁচিয়ে তুলতে হবে?’
‘এ ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই। যদি ইসলামী সাম্রাজ্যকে এ দেশে শক্তিশালী করে তুলতে হয়, তাহলে সূৰ্বতোভাবে প্রজাসাধারণকে সুখী ও সন্তুষ্ট রাখবার চেষ্টা করতে হবে, দিল্লীর সাম্রাজ্যে ইসলামী শরীয়তের জায়গায় সুলতানী শরীয়ত চালু করতে হবে। ইসলামের প্রচার মোল্লাদের কাজ, তাদের আমরা বৃত্তিদান করতে পারি। সুফিদেরও কাজ তাই এবং ভালোভাবেই কাজ করে যাচ্ছে তারা। তাদের মঠগুলোকে আমরা নগদ টাকা দিতে পারি অথবা সরকারি খাজনা থেকে রেহাই দিতে পারি।’
২.
বর্ষা শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনও খালবিলগুলি জলে ভরে আছে। বড়-বড় বাঁধ দেওয়া ধানের ক্ষেতে জল জমে আছে, তার ভেতর সবুজ-সবুজ ধানের শিষ দুলছে। চারিদিকে সুদূর বিস্তৃত মগধের সবুজের মাঝখানে বড় হিলসা (পাটনা) গী। অবস্থিত, সেখানে কিছু ব্যবসায়ীদের ইটের পাকা বাড়ি, বাকি সব কৃষক এবং কারিগরদের খোলা বা খড়ের ঘর। এ ছাড়া ব্ৰাহ্মণদের কিছু বাড়ি আছে, তাদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। হিলসার মন্দিরসমূহ প্রায় একশ’ বছর আগে মহম্মদ বিন-বখতিয়ার খিলজির সৈন্যরাই বিধ্বস্ত করেছিল, তারপর থেকে সেই ভগ্নস্তুপগুলোকে যেখানে-সেখানে পূজা করছে হিন্দুরা। গায়ের পশ্চিম প্রান্তে বৌদ্ধদের মঠ, তার প্রতিমাগৃহ ভেঙে-চুরে গেলেও ঘর এখনও পর্যন্ত বাসযোগ্য। ভিতরে ঢুকে কেউ বলতে পারবে না যে, বৌদ্ধভিক্ষুরা তাদের ছেড়ে চলে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যার সময় মঠের বাইরে পাথরের ছোট এক ঋটাতনের ওপর আধাবয়সী। এক পুরুষ বসে ছিল। বাদামী এক কৌপীনে তার শরীর ঢাকা। মাথা এবং ক্ৰ কামানো গোফ-দাড়ি খুব ছোট ছোট-মনে হয় এক সপ্তাহ আগে কামানো হয়েছিল। হাতে কাঠের মালা। দিনটা ছিল আশ্বিনের পূর্ণিমার দিন, গ্রামের নর-নারী সকলে খাবার, কাপড় এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে এসে কৌপীন-পরা পুরুষের সামনে, রেখে হাত জোড় করে দাঁড়িয়েছিল। পুরুষটি স্থিত মুখে হাত তুলে আশীৰ্বাদ করছিল সবাইকে।
এ সব কি? হিলসার পুরনো বৌদ্ধ মঠ নষ্ট হয়ে গেলেও মঠের বাইরের ভক্তগণের হৃদয়ে শ্রদ্ধার ভাব ঠিকই ছিল। আজ হিলাসায় কৌপীনধারী বাবাকে দেখে কি বৌদ্ধভিক্ষু ছাড়া অন্য কিছু বলা যায়! সে অবিবাহিত, তার পূর্বতন চারজন গুরুও অবিবাহিত ‘ কেীপীনধারী ছিল। হিন্দু অথবা বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হওয়া দশ-পাঁচ ঘর কারিগর একে সন্ন্যাসীর সমাধি বলত; ব্ৰাহ্মণ এবং কিছু ব্যবসায়ী একে মঠ বলত না, কিন্তু গ্রামের বাকি। সকলে এখনও মঠ বলে। এই বাবার আগের সন্ন্যাসীদের কোনো জাতবিচার ছিল না, আর নতুন বাবাগণেরও জাত নেই। এরা কৌপীন পারত, অবিবাহিত থাকত। অসুস্থ হলে এরা ঔষধ-পথ্য দেয়, মরন ও শোকের সময় এরা অলখ-নিরঞ্জন নির্বাণের উপদেশ দিয়ে সান্ত্বনা। প্রদান করে। এই জন্য আজ শরতের পূর্ণিমার নির্বাণ দিনে লোকে আগের মতোই এই মুসলিম ভিক্ষুদেরও পূজা দেয়। আর কারিগর মুসলমানেরা আগে যেমন বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের আপন পূজ্য গুরু বলে মান্য করত, এখন তেমনি বাবা এবং তার কৌপীনধারী চেলাদের মান্য করে। r
মঠের পুরনো মোহান্তদের সমাধিগুলোকে বন্দনা করে গ্রামবাসীরা চলে গেল। রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে রূপালী চাঁদের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এই সময় কারিগরদের ঘরের দিক থেকে দুটো লোকের সঙ্গে একজনকে আঙিনার দিকে আসতে দেখা গেল। কাছে এলে মৌলানা আবুল-আলাইকে বাবা চিনতে পারল। তার মাথায় সাদা পাগড়ি, পরনে লম্বা চোগা, পায়ে জুতোর ওপর পর্যন্ত পায়জামা। তার কালো দাড়ি হাল্কা হাওয়ায় দুলছে। উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত বাড়িয়ে মধুর স্বরে বাবা বলল, ‘আসুন মৌলানা আবুল-আলাই। আসূসালাম-আলায়কুম।’ মৌলানার শক্ত দুই হাতকে নিজের হাতে নিয়ে তাকে আলিঙ্গন করল।
মৌলানাও অনিচ্ছুকভাবে ‘ওয়ালেকুম সালাম’ বলল!
তাকে খোলা পাটাতনের কাছে নিয়ে গিয়ে বাবা বলল, ‘আমার তখৎ এই নগ্ন পাথর, বসুন।’ মৌলানা বসবার পর বাবাও বাসল, প্রথমে মৌলানাই কথারম্ভ করল।
‘শাহ সাহেব, যখন এখানে কাফেরদের ভিড় লেগেছিল, তখন আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম। সেই তামাসা।’
‘তামাসা! একশ’ বার বলুন মৌলানা, কিন্তু ‘কাফের’ বলবেন না। আপনি, নূরের হৃদয়ে যেন শরাঘাত হয় এতে।’
‘এই হিন্দুরা কাফের নয় তো কি?’
‘সকলের ভেতরই ঐ নূর রয়েছে; নূর আর কাফের, আলো আর অন্ধকারের বিবাদের মতো–এরা এক জায়গায় থাকতে পারে না।’
‘আপনার এই সমস্ত তসৰ্ব্ববুফ (বেদান্ত) ইসলাম নয়, ঐন্দ্রজালিক ভেল্কি।’
‘আমরা কিন্তু আপনাদের ভাবধারাকে ইন্দ্ৰজাল বা ভেল্কি আখ্যা দিই না। আমরা ‘এক নদীর বহু ঘাট’-এর অস্তিত্ব স্বীকার করি। আচ্ছা আপনারা সকল মানুষকেই খোদার সন্তান বলে মনে করেন না?’
‘হ্যাঁ, মনে করি।’
‘আর এও মানেন তো যে তিনি সর্বশক্তিমান।’
‘নিশ্চয়ই।’
‘মৌলানা, আমাদের সর্বশক্তিমান মালিকের হুকুম ছাড়া যখন গাছের একটা পাতাও করতে পারে না, তখন আমি বা আপনি আল্লার এই সমস্ত সন্তানকে কাফের বলবার কে? আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন তাহলে সকলকেই এক পথে চালাতেন। চান না বলেই সকল পথই সমান প্রিয় তার।’
‘শাহ সাহেব, আমাকে আপনার তসকবুফের মিথ্যাগুলো শোনাবেন না!’
‘কিন্তু মৌলানা, এ তো আমি ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেই বলছি। আমরা সুফিরা আল্লা এবং তাঁর বান্দাদের মধ্যে কোনো পার্থক্যই স্বীকার করি না। আমাদের কলুমা (মহামন্ত্র) হল, ‘অনল-হক (আমিই সত্যদেব), ‘হাম-ও-স্ত’ (সবই ঐ ব্ৰহ্ম)!’
‘এটা কাফেরের ধর্ম।’
‘আপনি এ কথা মনে করেন, আগেও অনেকে এমনি মনে করত, কিন্তু সুফিরা আপন রক্ত ঢেলে এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছে এবং প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতেও করবে।’
‘আপনাদের জন্যেই এখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না।’ ‘আগুন এবং তলোয়ারের সাহায্যে তাকে প্রতিষ্ঠা করবার যে প্রচেষ্টা আপনাদের; তাকে আমরা অন্যায় মনে করেছি। ঠিকই কিন্তু তার বিরুদ্ধে তো রুখে দাঁড়াইনি, তবু কতটুকু সাফল্য আপনারা লাভ করেছেন শুনি!’
‘আপনারা ওদের ধর্মকেও সত্য বলে মনে করেন?’ ‘হ্যাঁ, কারণ মহানৃ সত্যকে কুলুঙ্গীতে তুলে রাখার শক্তি নিজের ভিতর অনুভব করি না। আমরা, ইসলাম যদি তার শহীদদের কাছে সত্যি হয় যদি তসৰ্ব্ববুফ প্রতিভাবন প্রেমিকের কাছে সত্যি হয়, তাহলে হিন্দুরাও আপনাদের তলোয়ারের নিচে হাসতে হাসতে গর্দান এগিয়ে দিয়ে হিন্দু ধর্মকেই সাচ্চা প্রমাণিত করেছে।’
‘হিন্দু-মার্গ সাচ্চা! হিন্দুদের মার্গ পূবের, আমাদের হল পশ্চিমের, সম্পূর্ণ উল্টো।’
‘এতই যদি উল্টো হবে তবে আজ সন্ধ্যায় গ্রামের মুসলমান মঠকে পূজা দিয়ে গেল কেন হিন্দুরা? আপনি মুসলমানদের মধ্যে হিন্দুয়ানীর গন্ধ-মাত্র সহ্য করতে চান মৌলানা?’
‘না, সহ্য করা চলবে না।’
‘তাহলে সধবা মুসলমান স্ত্রীদের সিন্দুর মুছিয়ে দিন গিয়ে।’
‘মোছাব।’
বাবা হেসে বললেন, ‘সিন্দুর মোছাবে! এই জুম্মন, বল দেখি আমাকে, তোমার বিবি সলিমা কি মেনে নেবে ব্যাপারটা?’,་
‘না বাবা। মৌলবী সাহেব জানেন না, সিন্দুর শুধু বিধবাদের কপাল থেকেই মোছা যায়।’ পাশেই দণ্ডায়মান জুম্মন উত্তর দিল।
বাবা তার কথা বলে যেতে লাগল, ‘ক্ষমা করুন মৌলানা আবুল-আলাই, আমরা সুফিরা কোনো সুলতানের ভিক্ষা অথবা কোনো আমীরের দয়ার দান নিয়ে এখানে বসিনি। আমরা কৌপীন আর লেংটি পরে এখানে এসেছিলাম। কোনো হিন্দুই আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্ৰ-ধারণ করেনি। এই মঠটাকেই ধরুন, আগে এটা বৌদ্ধ-বিহার ছিল। আমার পূর্বতন পঞ্চম গুরু বৌদ্ধ-শ্রমণদের চেলা ছিলেন। তিনি এসেছিলেন–বুখারা থেকে এবং বৌদ্ধ শ্রমণদের বেদান্ত দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তাদের চেলা হয়েছিলেন। বেদান্তের বাণী সর্বক্ষেত্রেই এক; বাইরের পোশাকের এর কোনো পরিবর্তন হয় না–সে পোশাক বৌদ্ধদেরই হোক, হিন্দুর হোক বা মুসলমানেরই হোক। আমাদের ঐ গুরুর পরে এই মঠ মুসলমান নামধারী ফকিরদের জিন্মায় রয়েছে। পোশাক বদলানোর ওপর আমরা কোনো জোর দিইনি, আমরা লোককে প্রেম শিখিয়েছি, যার ফলে দেখতে পাচ্ছেন গ্রামের খুব কম লোকই আমাদের ঘৃণা করে দূরে সরে থাকে। পণ্ডিতগণের মধ্যে জড়তা ছিল, প্রেমের পথ তারা চিনতে পারেনি, আপনারাও যেমন চিনতে পারছেন না। আজ-আর এই জন্যেই জুম্মনের বাপ-দাদাকে হিন্দুর বদলে মুসলমান নাম ধারণ করতে হয়েছিল, তাই এদের কাছে আপনাদের খাতির রয়েছে।’
৩.
চৈত্র মাস শেষ হয়ে গিয়েছে। গাছে নতুন পাতা গজিয়ে উঠেছে। এ বছর খুব আম হয়েছে, আম গাছগুলোতে তাই পুরনো পাতাই রয়ে গেছে। নিচে খামারের উঠেন। সেখানে দুপুরের গরম আবহাওয়ার মধ্যেও দু’জন কৃষক মাড়াই করছে। এমন সময় একজন পরিশ্রান্ত পথিক ঘর্মািসক্ত হয়ে খামারের এক গাছের নিচে এসে বসল। তার মুখচোখের চেহারা দেখে তাকে ভিনদেশী বুঝতে পেরে মঙ্গল চৌধুরী তার কাছে এসে বলল, ‘রাম রাম ভাই, এই রোদুরে হাঁটা যথেষ্ট শক্তির কাজ।’
‘রাম রাম ভাই! কিন্তু পথ চলতে যাকে হবেই, তার রোদুর-ছায়ার বিচার করবার সময় কই?’
‘জল খাও ভাই, তোমার যেন মুখ শুকিয়ে গেছে, ঐ ঘটিতে ঠাণ্ডা জল রয়েছে।’
‘কি জাত তোমরা?’
‘আহীর। মঙ্গল চৌধুরী আমার নাম।’
‘চৌধুরী, আমি ব্ৰাহ্মণ, কুয়োটা দেখিয়ে দাও আমাকে।’
‘যদি আমার ছেলেকে দিয়ে জল আনাই-তাহলে হবে না পণ্ডিতজী?’
‘তাই দাও পাঠিয়ে, বড্ড শ্ৰান্ত হয়ে পড়েছি।’
‘ঘীসা, এদিকে আয় তো বাবা।’
মাড়াই বন্ধ রেখে মঙ্গল চৌধুরী গুড় আর কুয়ো থেকে টাটুকা জল নিয়ে আসতে বলল। ছেলেকে। এদের কাছে জিজ্ঞেস করে পথিক জানতে পারুল, দিল্লী এখান থেকে বিশ ক্রোশ দূর; কাজেই আজ আর সে পৌঁছাতে পারবে না। মঙ্গল চৌধুরী অত্যন্ত রসিক লোক। চুপ? করে থাকাই তার পক্ষে সবচেয়ে মুস্কিলের ব্যাপার।
চৌধুরী বলল, ‘আমাদের এখানে এ বছর ভগবানের কৃপায় চমৎকার ফসল হয়েছে। বৈশাখে। ফসল কাটা কঠিন ব্যাপার হবে। ওখানে ফসলের অবস্থা কি পণ্ডিতজী?’ ফসল মন্দ হয়নি চৌধুরী’
‘রাজা ভালো হলে দেবতারাও খুশী হয় পণ্ডিতজী! যখন থেকে নতুন সুলতান তখতে বসেছে তখন থেকেই প্রজারা বেশ সুখে আছে।’
‘তুমি কি সেই রকমই দেখছ, চৌধুরী?’
‘আরে, এই খামারের তো কিছুটা দেখছি। দু’বছর আগে এলে দেখতে পেতে এর চার ভাগের এক ভাগ ফসলও হয়নি।’
‘তাহলে উন্নতি হয়েছে, চৌধুরী!
‘উন্নতি হয়েছে সুলতানের কৃপাতেই পণ্ডিতজী। আগে আমরা কিষাণর না খেয়ে, না-পরে মারতাম আর কয়েকটা বদ লোক রেশমী পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াত। গম এতটুকু হতে না হতেই তাদের ঘোড়া আমাদের ক্ষেতে এসে হাজির হত। কে প্রতিবাদ। করবে? আমাদের গ্রামগুলোর তো। ওরাই ছিল সুলতান!’
এই সময় মঙ্গল চৌধুরীর মতোই হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, গায়ে এক ময়লা। ফতুয়া, মাথায় চাপা সাদা-টুপি পরিহিত অপর এক চৌধুরী এসে পড়ল এবং ওদের দু’জনের কথার মাঝেই বলে উঠল, ‘আরো এখন দেখছ তো চৌধুরী, কোথায় চলে গেল তাদের সেই বিরাট ক্ষমতা! এখন ব্যাটারা আবার দান পাবার আশায় বসে আছে। আমাকে বলছিল। সেই ব্ৰাহ্মণ—কি যেন নাম তার, চৌধুরী?’
‘সিব্বা।’
‘এখন কেন সিকবা বলছি, সে সময় তো পণ্ডিত শিবরাম বলতে! বলছিল, ‘চৌধুরী ছেদারাম, দু’মণ গম দাও, হাতে পয়সা হলে দাম দেব।’ মুখের ওপর তো না বলা যায় না, কিন্তু আমার তখনকার কথামনে পড়ল, যখন এই ব্ৰাহ্মণটা ভদ্রভাবে কথাও বলতে জানত না। ‘আরে ছিদে’ ছাড়া অন্য কোনো রকম সম্ভাষণ তার মুখ থেকে শুনি নি।’
‘আর এখন? তুমি হলে চৌধুরী ছেদারাম, আর আমি চৌধুরী মঙ্গলরাম। মঙ্গে’ আর ছিদে থেকে কোথায় চলে এসেছি আমরা আড়াই বছরের মধ্যে।’
‘আমি বলব, এ সবই সুলতানের দয়া, তা না হলে আমরা সেই মঙ্গে’ আর ছিদেই রয়ে যেতাম।’
‘সেই কথাই তো আমি বলছিলাম পণ্ডিতজীকে। আমাদের পঞ্চায়েতও ফিরে পেতাম, না। আমরা, দিনও চলত না আমাদের।’
‘চৌধুরী মঙ্গলরাম, তুমি কলম ধরতে জানো না, অথচ তুমি গ্রামের পঞ্চায়েতের সবকাজকর্মচালাও। আমলাদের কথা ছেড়ে দাও, এইসব বানিয়ারাও এক টাকা দিয়ে দুটাকার ফসল তুলে নিয়ে যেত। জ্যৈষ্ঠ মাস পার হতে না হতেই আমাদের ঘরে ইঁদুর চরে বেড়াত।’
‘আমরা তো তাই বলছি, আমাদের সুলতান লক্ষ বছর বেঁচে থাকুক।’
ব্ৰাহ্মণ পথিক অজ্ঞ আহীরদের মুখে এই তারিফ শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে পড়ল, কিছু একটা বলার সুযোগ খুঁজতে লাগল সে। গুড় আর জল খাওয়ার পর সে আরও উতলা হয়ে উঠল! চৌধুরীদের কথা শেষ হচ্ছে না দেখে মাঝখানেই সে বলে উঠল, ‘সুলতান আলাউদ্দিন তোমাদের পঞ্চায়েত ফিরিয়ে দিয়েছে…’
‘হ্যাঁ পণ্ডিত মুখে ফুল-চন্দন পড়ােক। কিন্তু পণ্ডিত, জানি না কে আমাদের সুলতানের নাম অলাভদীন দিয়েছে। আমরা তো নিজেদের গায়ে লাভদীন বলি তাকে!’
‘তোমাদের যা খুশী নাম রাখ চৌধুরী! কিন্তু জানো, সুলতান হিন্দুদের ওপর কি ভয়ানক অত্যাচার করছে?’
‘আমাদের মেয়েরা গায়ে চাদর না দিয়েও রাত দিন বুক ফুলিয়ে ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়ায়। কই, কেউ তো তাদের টেনে নিয়ে যায় না!’
‘ইজ্জতওয়ালা ঘরের ইজ্জত নষ্ট করে তারা।’
‘তাহলে আমরা হলাম। সব বেইজ্জতওয়ালা কিন্তু তোমাদের সেই চোথামারা ইজ্জতওয়ালা কারা, পণ্ডিত?’।
‘তুমি অভদ্রভাবে কথা বলছি, চৌধুরী মঙ্গলরাম!’
‘কিন্তু পণ্ডিত, তোমার বোঝা উচিত যে, যখন থেকে আমরা পঞ্চায়েত ফিরে পেয়েছি, তখন থেকে আমাদের ইজ্জতও ফিরে এসেছে। এখন আমরা বুঝি, বড়-বড় আমলার দল হয়েছে, তারা সকলেই অত্যাচারী, তাছাড়া তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু।’
চৌধুরী ছেদারাম বলে উঠল, ‘আমাদের বলা হয় হিন্দু-মুসলমান-এরা দু’জত আলাদা। কিন্তু দেখনি চৌধুরী, নিজেদের হিন্দু ব্ৰাহ্মণ-বলা এইসব লোকেরা নিজেদের ধ বৌদের সাত-পর্দায় ঢাকা বেগম বানিয়ে রাখছে।’
‘হ্যাঁ! অথচ আমার ঠাকুর্দা বলত যে, কনৌজ এবং দিল্লীর রাণীকে খোলা মুখে ঘোড়ায় চড়তে দেখেছে।’
ব্ৰাহ্মণ বলল, ‘কিন্তু চৌধুরী, সে সময় আমাদের ইজ্জত নষ্ট করবার মতো কোনো সলমান এ দেশে ছিল না।’
‘আজও আমাদের ইজ্জত ক্ষেতে-খামারে ঘুরে বেড়ায়, কেউ নষ্ট করে না তাকে।’
‘আর যদি কখনও নষ্ট হয়ে থাকে তো সে ঐ ব্ৰাহ্মণ সিকাবাদেরই চালে।’
‘বেকার বসে-খাওয়া এইসব লোক অন্যের ইজ্জত নষ্ট করা ছাড়া আর কি করবে!’
‘এ হিন্দু-মুসলমানের প্রশ্ন নয়। পণ্ডিত, এ হল যারা পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায় তাদের কাজ। পাকা হিন্দু আমরাই পণ্ডিত। আমাদের মেয়ে-বউরা কোনোদিন সাত পর্দার আড়ালে থাকবে না।’
ব্ৰাহ্মণ আর একবার সাহস করে বলল, ‘আরো চৌধুরী, তোমরা তো জানো না, সুলতানের সেনাপতি মালিক কাফুর দক্ষিণে গিয়ে আমাদের মন্দির ভেঙে দিয়েছে, সব দেবমূর্তি পায়ের তলায় গুড়িয়েছে।’
‘আমরা অনেক শুনেছি পণ্ডিত, একবার নয়, হাজারবার শুনেছি যে মুসলমানী রাজত্বে হিন্দুদের ধর্ম বিপন্ন। কিন্তু আমরা দিল্লীর খুবই কাছে থাকি পণ্ডিত, না হলে হয়ত আমরাও বিশ্বাস করে নিতাম। আমাদের বিশ ক্রোশের মধ্যে তো কোনো মন্দির ভাঙা হয়নি, কোনো দেবমূর্তিকেও পায়ের তলায় মাড়ানো হয়নি।’
‘হ্যাঁ, মঙ্গলরাম এ সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা, আমি অনেকবারই দশহরা দেখতে দিল্লী গিয়েছি। কি বিরাট মেলা হয়। সেখানে, অর্ধেকের বেশি সেখানে স্ত্রীলোক। হিন্দুদের মেলা কাজেই মেলার লোক বেশিরভাগই হিন্দু। দেবমূর্তি সাজিয়ে সুলতানের অলিন্দের নিচে দিয়ে নিয়ে শঙ্খ, নাকাড়া আর শিঙা বাজাতে বাজাতে হিন্দুরা যায়।’
‘ঠিক কথাই বলেছ ছেদারাম, এ-সব মিথ্যাই। শেঠ নিক্কামল সুলতান-প্রাসাদ থেকে একশ’ গজ দূরেই এক বড় মন্দির তৈরি করাচ্ছে। কত লক্ষ টাকা লাগবে কে জানে। গতবারে পাথর আসতে দেখেছিলাম। আমি। এ-বারে দেখে এসেছি। এক কোমর সমান দেয়াল উঠে গেছে। সুলতানের যদি ভাঙার ইচ্ছাই থাকবে, তাহলে নিজের চোখের সামনে। মন্দির উঠতেই বা দেবে কেন?’
‘হ্যাঁ চৌধুরী, রাজায় রাজয় লড়াই হয়; লড়াইতে কেউ কারও অপেক্ষায় থাকে না। আগে কিছু হয়ত হয়ে গেছে, তাই নিয়ে এখন হল্লা বাধানো হচ্ছে। একশ বছর আগে আমাদের আশে-পাশে এমনি ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু আজ কোথাও কিছু শোনা যায় না।’
‘আমার মনে আছে যখন আমরা গ্রামের কয়েকজন লোক হাকিমের তাঁবুতে গিয়েছিলাম। সে বলেছিল, আগের সুলতানেরা এক রাত্রি বাস করতে আসত এখানে, আর এখন আমাদের সুলতান লাভদীন, আমাদের সুখ-দুঃখের চিরসাখী-এই জন্য প্রজাদের লণ্ঠন করে না সে, বরং তাদের সুখী দেখতে চায়।’
‘এখন শুধু এটা চাওয়ার কথা নয় বরং চারিদিকেই লোকেরা সুখী হয়ে উঠেছে।’
৪.
দিল্লীর বাইরে এক নির্জন কবর। তার কাছে কিছু নিম এবং তেঁতুলের গাছ জন্মেছে। অগ্রহায়ণের ঠাণ্ডা রাত। কাঠের আগুনের কাছে দুজন ফকির বসেছিল, এর মধ্যে একজন আমাদের পূর্ব-পরিচিত নুরদীন। দ্বিতীয় ফকির নিজের সাদা দাড়ি এবং গোঁফের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘বাবা, পাঁচ বছরের ভিতর আবার হরিখানায় দুধের নদী বয়ে যেতে আরম্ভ করেছে।’
‘ঠিক বলেছ বাবা জ্ঞানদীন, এখন কিষাণদের চেহারা বেশ হাসিখুশী।’
‘ক্ষেত-খামার যখন হেসে ওঠে, তখন মুখের চেহারাতেও হাসি ফোটে।’ ‘আমলারা গেছে, কিন্তু এই বানিয়া-মহাজনেরা মরলে শান্তির বাঁশরী বাজত।’ ‘প্রচুর লোটে ওরা। আর ওদের এই বড়-বড় মঠ, বড়-বড় মন্দির, সদাব্রত সবই এই লুটের অর্থেই চলছে।’
‘জ্ঞানী-ধ্যানী, পীর-পয়গম্বর, মুনি-ঋষি ছাড়া ধর্মের পথে কে চলবে? অথচ তাদের কাছে একটা কম্বল, একটা কৌপীন ছাড়া আর কি থাকে?’
‘যতদিন পর্যন্ত গরীবের শ্রমে বড় হওয়া লোক থাকবে ততদিন পর্যন্ত মানুষ ভাইভাই হতে পারবে না। আর সুলতানও মানুষে মানুষে শক্রিতা বাড়িয়ে তোলবার একটা যন্ত্র মাত্র, অথচ তার মান-মৰ্যাদাও জনসাধারণের শ্রম-বিনা টিকতে পারে না।’
‘সেই দিনের আশায় আমরা থাকব বন্ধু; যেদিন এই সমস্ত গোলকধাঁধাঁর খেলা শেষ হয়ে যাবে এবং পৃথিবীতে প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে।’