১৫. বাকশালী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

পঞ্চদশ অধ্যায় – বাকশালী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

  • ১৮ই জানুয়ারী ১৯৭৫ শেখ মুজিব পার্লামেন্টারি কমিটির বৈঠকে বাকশাল গঠনের প্রস্তাব পেশ করলেন।
  • ২৪শে ফেব্রুয়ারী ১৯৭৫ রাষ্ট্রপতি মুজিবর রহমান একদলীয় শাসন ব্যবস্থা জারি করলেন।
  • ২৫শে জানুয়ারী ১৯৭৫ সংসদে কোনরকম বিতর্ক ছাড়াই গণতন্ত্রকে সমাহিত করে পাশ করানো হয় ৪র্থ সংশোধনী।
  • বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করে বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এবং ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন সংসদ পদে ইস্তফা দেন।
  • বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটি।
  • কেন্দ্রিয় কমিটি।
  • ৫টি অঙ্গ সংগঠন এবং তার সাধারণ সম্পাদকগণ।
  • সারাদেশকে ৬১ টি জেলায় বিভক্তি এবং ৬১ জন গভর্ণর নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত
  • জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগগুলোকে নির্দেশ দেয়া হল সরকার বিরোধী ব্যক্তিদের তালিকা তৈরি করার জন্য।
  • আওয়ামী-বাকশাল বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো।
  • রাজ্জাক, তোফায়েল, নাসিমসহ ৭ জন আসামী, সিরাজ সিকদার মামলা দায়ের।
  • প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারাও। কারা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা?
  • মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অবিশ্বাস ও অবহেলা।
  • ১৯৭২ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠিত হয়।
  • রাজনীতির সাদামাটা সংজ্ঞা।
  • মুক্তিযুদ্ধে অস্বাভাবিক ইতি টানার সাথে সাথে ঔপনিবেশিক ছাঁচে গড়া রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোকে পুরোপুরি অক্ষুন্ন রাখার সিদ্ধান্ত।

দেশ স্বাধীন হবার পর আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্রের ধুঁয়া তুলে সমাজতন্ত্র আর মুজিববাদের এক গোজামিলের ফর্মূলা জারি করে কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের কাছে। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী তৎকালীন শ্রমমন্ত্রী ঘোষণা করেন, “শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৩০% শেয়ার হবে শ্রমিকদের, ৩০% মালিকদের এবং ৪০% হবে সরকারের।” ১৩ই ফেব্রুয়ারী ছাত্রলীগ নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী বলেছিলেন, “স্বল্প-বেতনের শ্রমিকদেরই বেশি সুবিধা দেয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সার্বিক প্রতিশ্রুতি ছিল সমাজতন্ত্র আর পুজিঁবাদের মিক্সার বানিয়ে আজব মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সংবাদপত্রের পাতা ঘাটলে দেখা যাবে যে, অযোগ্য প্রশাসন, দুর্নীতি, তোষণ নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতি কারণে দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশঃ দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। একদিকে দলীয় টাউট এবং দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসকরা যখন ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের রেসে ব্যস্ত, তখন ‘শ্রমিকদের তিন বছর কিছু দিতে পারব না’ মুজিবের এই বক্তব্য শ্রমিকদের আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে এগিয়ে আসেন। তখন শিল্প এলাকায়ও বিভেদের রাজনীতির আশ্রয় নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ২৮শে মে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প কারখানায় ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে দেয়া হয় সরকারি অধ্যাদেশ বলে। জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান বাওয়ানী জুট মিল সম্পর্কে বলেন, “এই মিলটির পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান জনৈক এমসিএ, মিল ম্যানেজার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সরকারের নিয়োজিত পরিচালকের যৌথ চেষ্টায় গোপনে চোরাপথে মিলের লাখ লাখ টাকার সুতা, যন্ত্রপাতি ও কাপড় আত্মসাৎ করায় মিল শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।” ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের আগষ্ট পর্যন্ত সামগ্রিক পরিসরে শিল্প কারখানার এটাই ছিল বাস্তব চিত্র। ‘৭২ এর আগষ্ট মাসে আদমজীতে দু’দল শ্রমিকের সংঘর্ষ হয়। ‘৭৩ এর ৭ই ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রামের বাড়বকুন্ডে শতাধিক শ্রমিক রক্ষীবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়।

ইতিমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প কারখানার ভেতর ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চলতে থাকে। ১৯৭৪ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী এক সংবাদে জানা যায় যে, পিপলস্ জুট মিল থেকে আশি লাখ টাকার যন্ত্রপাতি উধাও হয়ে গেছে। পাটকল ও গুদামে আগুন ছিল প্রায় নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা। তবে এই আত্মঘাতমূলক কাজের সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবতঃ ঘোড়াশাল সার কারখানার বিষ্ফোরন। ‘৭৪ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর ঘোড়াশাল সার কারখানার কন্ট্রোল রুম বিধ্বস্ত হয়। ২০শে সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটি সূত্রে বলা হয় যে, কাজটি ছিল নাশকতামূলক। ঐ বিষ্ফোরনের পর শুরু হয় বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সার কারখানার ঐ বিষ্ফোরনে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। প্রথম রিপোর্টের ‘নাশকতামূলক’ কথাটির ব্যাখ্যা আর কোনদিন দেয়া হয়নি।

১৯৭৪ সালের ২১শে জানুয়ারী সংসদে জানা যায় যে, জুট মিলগুলোতে ২৫০০০ অতিরিক্ত শ্রমিক রয়েছে। এদের নিয়োগ কি করে হল? এদের কাজ কি ছিল? কাদের স্বার্থে কাজ করতো এরা? এ সমস্ত বিষয়ে সরকার পক্ষ থেকে তদন্ত হয়নি। আসলে এরা দুর্নীতিবাজ অযোগ্য প্রশাসকের ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে কাজ করতো। বিরোধী শ্রমিকদের শায়েস্তা করার জন্যই নিয়োগ করা হয়েছিল এদের। এদের কাজ ছিল হত্যা, গুন্ডামী আর নাশকতামূলক তৎপরতা। বহুবার প্রমাণিত হয়েছে সরকার ও অযোগ্য প্রশাসকের পেটেয়া বাহিনী হিসাবেই কাজ করেছে এই সব তথাকথিত শ্রমিক।

‘৭৪ সালের ২৯শে মার্চ দৈনিক বাংলায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে বলা হয় যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপুল পরিমাণে অর্থ অপব্যয় করা হচ্ছে। শ্রমিক নেতাদের চাপে মিলে অতিরিক্ত লোক নিয়োগ করতে হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এজেন্ট নিয়োগ করতে হচ্ছে এক শ্রেণীর শ্রমিক নেতাদের পছন্দমাফিক লোকদের। এরা নিজেরা কখনও কাজ করে না। কারা ছিল এই সমস্ত শ্রমিক নেতা? কোনদিন তাদের বিরুদ্ধে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এর জের আজও টেনে চলেছে বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্র।

এমনই দুর্নীতি চলে দ্রব্যমূল্য নিয়ে, লাইসেন্স-পারমিট নিয়ে। ‘৭৩ সালের ১১ই মে বাণিজ্যমন্ত্রী কামরুজ্জামান বলেন, “২৫০০০ আমদানিকারকের মধ্যে ১৫০০০-ই ভুঁয়া।” এদের লাইসেন্স ইস্যু করেছিল মন্ত্রণালয়। কার সুপারিশে কাদের এ সমস্ত লাইসেন্স দেয়া হত সেটা জনগণ কখনো জানতে পারেনি। তাদের বিরুদ্ধে কোন বিচার হয়েছিল সে খবরও পায়নি দেশের মানুষ। এসব দেখে মনে হয় আওয়ামী বাকশালীরা ২২ পরিবারের বদলে হয়তো বা মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্য অনুযায়ী ২ 200 পরিবারই সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তাই দেখা যায় যার তাঁত নাই সে সুতা পায়, যার কোন ঠিকানা নেই সে হয় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ডিলার। সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে চলে এমনই আজব তামাশা। পরিণতিতে ‘৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ছয় লক্ষ সাধারণ বাংলাদেশী প্রাণ হারায়।

আওয়ামী লীগের মাত্র দুই বছরের শাসনে দেশবাসীর যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সে সময় আওয়ামী লীগের নেতা, তরুণ ও ছাত্র কর্মীদের মধ্যে অনেকের মনে এ সম্পর্কে প্রশ্ন জাগে। ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে সৃষ্টি হয় আভ্যন্তরীন কোন্দল। সে কোন্দল ক্রমশঃই সংঘাতে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের সচেতন ও জাতীয়তাবাদী অংশ আওয়ামী দুঃশাসন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে।

১৯৭৪ সালের ২৩শে মার্চ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দোকার মোশতাক আহমদ ও শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর কাছে দু’টো স্মারকলিপি পেশ করে। স্মারকলিপিতে বাড়ি, গাড়ি দখলকারীদের নামের তালিকা প্রকাশের আবেদন জাননো হয়। ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান যেসব ব্যক্তি টিসিবি ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে কোটা পায় তাদের নামের তালিকা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাছে অর্পনের আহ্বান জানান। জনাব প্রধান অভিযোগ করেন, “ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরা কালোবাজারী ও লাইসেন্স পারমিটধারী ভূঁয়া ব্যবসায়ীর জন্ম দিয়েছে। তারাই আজ জনসভায় নির্লজ্জভাবে গালভরা বক্তৃতা দিচ্ছেন।” তিনি আরো বলেন, “স্বাধীনতার পর কারা বাড়ি, গাড়ি ও প্রেস দখল করেছে জনগণ তাদের ভালোভাবেই চেনে। আজ ওদের অপকর্মের জন্যই দেশে ভয়াবহ সঙ্কট ও অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়েছে।” ৩০শে মার্চ জনাব প্রধান বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে এক গণজমায়েতে ২৩জন রাজনৈতিক নেতা, সরকারি আমলা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বিদেশে মুদ্রা ও সম্পদ পাচাঁর, চোরাকারবার ও কালোবাজারীর অভিযোগ উত্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী, জনাব প্রধান, ইসমত কাদির গামা প্রমুখ। বক্তৃতায় যুবলীগের প্রতি ইঙ্গিত করে তারা বলেন, “এরা বেনামীতে লাইসেন্স পারমিট, এজেন্সী, সুতা কেলেংকারী, পরিত্যাক্ত সম্পত্তি ও প্রেস দখল, ব্যাংক থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার ওভার ড্রাফ্‌ট গ্রহণ, সিগারেট কেলেংকারী, রাতারাতি ধানমন্ডি-গুলশান-বনানীতে বাড়ি, গাড়ি, লঞ্চ, ট্রাক ও লাখ লাখ টাকার মালিক বনে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।”

বক্তৃতায় তারা ব্যাংক ডাকাতি, হাইজ্যাক, পাট পোড়া, গুপ্ত হত্যা, দুর্নীতিবাজ চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানতে চান। প্রেস দখলকারী বলতে তারা শেখ ফজলুল হক মনিকে বোঝান। জনাব প্রধান বলেন, “জনৈক মন্ত্রী এই দুর্দিনে গুলশানে বিরাট অট্টালিকা নির্মান করেছেন। ক্ষমতাসীন দলের ঢাকা শহরের সাবেক এমপি বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙ্গিয়ে বায়তুল মোকাররমে ১৪টি দোকানের মালিক বনে গেছেন। এ দেশের মানুষ যখন অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন তখন এক শ্রেণীর নেতারা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের উপর দাড়িয়ে আপন ভাগ্য গড়ার ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। এরাই আবার আজকাল নির্লজ্জের মত জনসভায় দাড়িয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লম্বা বক্তৃতা দিচ্ছে। আদর্শের বুলি আওড়াচ্ছে অথচ এরাই দুর্নীতির প্রকৃত জন্মদাতা।”

৩১ শে মার্চ তৎকালীন যুবলীগের প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি ঐ তালিকা প্রকাশের প্রতিবাদ করেন। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে ছাত্রলীগ নেতারা যা করেছে, তা আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল।” তিনি অবশ্য তার প্রতি প্রেস দখল ও ব্যাংক থেকে ওভার ড্রাফট নেবার অভিযোগ সম্পর্কে কিছুই বললেন না। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ঐ তালিকা প্রকাশকারীদের বাংলার বাণী বিরোধী গোষ্ঠির এজেন্ট বলে অভিহিত করেন। জনাব মনিরুল হক চৌধুরী ও জনাব শফিউল আলম প্রধান শেখ মনির বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেন, “ছাত্রলীগে কোন কোন্দল নেই।” তারা বলেন, “ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্ক রেখে যে সব দুর্নীতিবাজ পত্রিকা ও বিভিন্ন মাধ্যম প্রতিক্রিয়াশীলদের পৃষ্ঠপোষকতার চেষ্টা করছে তাদের কাউকেই ক্ষমা করা হবে না।” শেখ মনির বিবৃতি সম্পর্কে বলেন, “এ হচ্ছে ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই নাই’ ধরণের মন্তব্য। কলা খান কিনা তা ২৯শে এপ্রিল প্রমাণিত হবে।” ২৯শে এপ্রিল বায়তুল মোকাররমের সভায় তারা দুর্নীতিবাজদের পূর্নাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করবেন বলে ঘোষণা দেন। তারা সাবেক সিতারুল পাকিস্তান প্রেস থেকে জনৈক আওয়ামী যুবলীগ নেতার মালিকানায় ও সম্পাদনায় একটি পত্রিকা বের হচ্ছে বলে জানান। উল্লেখ্য, বাংলার বাণী পত্রিকাটি ঐ প্রেস থেকে বের করা হত। স্বাধীনতার পর শেখ মনি ঐ প্রেসটি দখল করে নেয়। মুজিববাদী ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীন এই কোন্দলের পরিণতিতে ৩রা এপ্রিল ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে ভয়াবহ ৭জন ছাত্রের হত্যাকান্ড। ৭ই এপ্রিল প্রধান ও মনিরুল হক ছাত্রদের শোক মিছিল বের করার নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো ছাড়া আর কারো কাছে অস্ত্র রাখতে দেয়া হবে না।” একই দিন জনাব প্রধান ঐ ছাত্র হত্যাকান্ডের আসামী হিসাবে গ্রেফতার হন।

প্রধানের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৮ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গ্রেনেড নিক্ষিপ্ত হয়। তাতে কয়েকজন ছাত্র আহত হন। ঐদিকে প্রধানের মুক্তির দাবিতে ছাত্রলীগ ধর্মঘট ডাকে। প্রধানের মুক্তির দাবিতে ছাত্রলীগ কর্মীরা আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন। তারা বলেন, “দেশে প্রেসিডেন্ট এর অর্ডারের যদি অপপ্রয়োগ হয় তবে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে।” ১০ই এপ্রিল প্রধানের মুক্তির দাবিতে ছাত্রলীগের ৬জন ছাত্র অনশন শুরু করেন। এ প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “শেখ মুজিব মস্কো থেকে ফিরে না এলে তাদের পক্ষে এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়।” ১২ই এপ্রিল শেখ মুজিব মস্কো থেকে ফিরে আসেন। তার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদের ধর্মঘটের অবসান ঘটে। কিন্তু জনাব প্রধান আটকই রয়ে যান।

৪ঠা ফেব্রুয়ারীর ঘটনার পর শেখ ফজলুল হক মনির যুবলীগ ৩দিন ব্যাপী এক বৈঠকে ছাত্রলীগ সম্পর্কে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রস্তাবে ছাত্রলীগকে বর্তমান নেতৃত্ব বর্জন করে নতুন পথ গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবে বলা হয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির একটি অংশ যুবলীগের বিরুদ্ধে যে কুৎসা রটনা করেছে তা ষড়যন্ত্রমূলক ও বানোয়াট। ছাত্রলীগ কর্মীরা তাদের নেতৃত্বের একাংশের রাজনৈতিক হঠকারী ও ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছে বলে যুবলীগ মনে করে। ছাত্রলীগ সম্পর্কে গৃহিত ঐ প্রস্তাবে আরো বলা হয়, ছাত্রলীগকে একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বোতভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করতে যুবলীগ প্রস্তুত ছিল। কিন্তু কেন্দ্রিয় নেতৃত্বের একাংশের চক্রান্ত, হঠকারীতা, অর্বাচীনতা, অদূরদর্শিতা ও ছাত্রলীগের মধ্যে অন্য আদর্শের ফ্যাসীবাদী একটি প্রভাবশালী অনুপ্রবেশকারী মহলের সন্ত্রাসমূলক ও বিভেদমূলক কার্যকলাপের দরুন তা সম্ভব হয়নি। যুবলীগ সব সময়ই মহলটির আচরণকে জাতির জন্য ক্ষতিকর, দেশে শিক্ষা সম্প্রসারমের পরিপন্থী এবং শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও শিক্ষা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে বিবেচনা করে এসেছে। ছাত্রলীগকে আজকের অবক্ষয় থেকে রক্ষা ও উদ্ধার করার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন যুবলীগের সাহায্য ও সহানুভূতি। প্রতি জেলায় প্রতি কলেজে যুবলীগের সহানুভূতিশীল পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ছাত্রলীগের হারানো জনপ্রিয়তা ও মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তদলক্ষ্যে সমাদর্শী সংগঠনগুলোর মধ্যে যারা সংঘাত বাধাবার চেষ্টা করেছিল তাদের সাথে ছাত্রলীগের সকল সম্পর্ক ছেদ করতে হবে এবং যুবলীগের আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। এভাবে একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনকে বাকশালী স্বৈরশাসনের ক্রীড়ানকে পরিণত করা হয়।

সদ্যমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। অনেক আশার বাংলাদেশ। জনগণকে সোনার বাংলার যে স্বপ্ন নেতারা এতদিন দেখিয়ে এসেছেন তা বাস্তবায়িত করার সুযোগ এসেছে স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে। জাতীয় পরিসরে মুক্তি সংগ্রাম শ্রেণীভেদের প্রাচীর ভেঙ্গে-চুড়ে একাকার করে দিয়েছে। ফলে শ্রেণীভেদের অমিকা ভুলে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার এক অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা : নেতারা তাদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠি এবং দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জাতীয় স্বার্থে জনগণকে একত্রিত করে তাদের দেশপ্রেম এবং কর্মউদ্দীপনাকে গঠনমূলক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে পূর্ণগঠন করে গড়ে তুলবেন এক সোনার বাংলা। সমৃদ্ধ এবং দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্ভর করে বিশ্ব পরিসরে সর্গবে মাথা উঁচু করে দাড়াবে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক। অতীত ঐতিহ্য, নিজস্ব স্বতন্ত্রতা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সুদূরপ্রসারী বিচক্ষণতা, সঠিক দিক নির্দেশনা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, কঠিন পরিশ্রম সর্বোপরি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ ও জাতিকে আত্মমর্যাদাশীল করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাংলাদেশকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে উন্নতির চরম লক্ষ্যে। সুখী সমৃদ্ধ এবং গতিশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলে তার সুফল প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দেবার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। লাখো শহীদের রক্তের বদলে অর্জিত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে অর্থবহ। কিন্তু জনগণের মনে অনেক সন্দেহ। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের রাজনীতিতে কাজের চেয়ে কথার ফুলঝুরি ঝরেছে বেশি, তার চেয়ে বেশি থেকেছে প্রতিশ্রুতি। ‘ক্ষমতায় গেলে জনগণের সার্বিক মুক্তি এনে দেব’ এ ধরণের গালভরা বক্তব্য জনগণ হামেশাই শুনে এসেছে দীর্ঘকাল থেকে। কিন্তু ‘যেই গেছেন লংকা সেই হয়েছেন রাবন’ অর্থাৎ ক্ষমতায় গিয়ে বক্তৃতাকারীরাই নির্মমভাবে পদদলিত করেছেন জনগণ এবং জনগণের দাবিকে। এর মূলে রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গণবিচ্ছিন্নতা। দেশের ব্যাপক জনগণের সাথে তাদের কোন সংযোগ নেই। এখানে শাসকের সাথে শাসিতদের কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। তাই শাসক গোষ্ঠির বক্তৃতা-বিবৃতি সাধারন মানুষকে আলোড়িত করে না। তারা যখন যা খুশি তাই বলেন, তাই করেন। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য উপযুক্ত যুক্তি দিয়ে তাদের নীতি ও কাজ হালাল করে নেন। জনগণ ঘুরে ফিরে একই প্রতারণার শিকারে পরিনত হয় বারবার। মোহ এবং ব্যক্তিস্বার্থে অন্ধ রাজনীতিকরা নির্দ্বিধায় বিসর্জন দেন সাধারণ গণমানুষের স্বার্থ।

আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ১৯৪৭ সাল হতে পরবর্তিকালে যত সরকার এসেছে তারা প্রত্যেকেই মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন ধূয়া তুলেছে। ১৯৪৭ সালে সুবিধাবাদী নেতৃত্ব ধুঁয়া তুললেন ইসলামের। ধর্মপ্রাণ মানুষ অতি সহজেই মোহিত হয়েছিল সেই ধূম্রজালে। ১৯৫২ সালে তারা ভাষা আন্দোলনকে আখ্যায়িত করলেন ইসলাম বিরোধী সংগ্রাম বলে। ১৯৫৮ সালে আইয়ূব খান সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এলান করলেন মৌলিক গণতন্ত্রের। মানুষ বারবার আশাহত হয়েছেন এসমস্ত সরকারের কাছ থেকে। তাদের বিভিন্ন সব শ্লোগান পরিণত হয়েছে শুধু ফাঁকা। আওয়াজে। সাধারণ মানুষের অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশার বোঝা ক্রমান্বয়ে গিয়েছে বেড়ে। গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে সামাজিক সংকট। অর্থনৈতিকভাবে তারা হয়েছেন দেউলিয়া। পরিণামে জনগণ হয়েছে পশ্চাদমুখী। তাই শুনতে পাই তাদের আক্ষেপ, “পাক আমলেই ভালো ছিলাম। বৃটিশ আমলে ছিলাম আরও ভালো। ১৯৭১ সালের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতাদের মন-মানসিকতায় কোন গুনগত পরিবর্তন আনতে পারেনি। তাই তারাও তাদের পূর্বসুরীদের মত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পন করেই পুরনো কায়দায় ধুঁয়া তুললেন মুজিববাদ কায়েম করতে হবে। কিন্তু মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় যখন মুজিববাদের অসাড়তা পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত হল তখন জনাব শেখ মুজিব আবারো একই কায়দায় সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনী প্রণয়ন করে এবং জরুরী আইন ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষিগত করে একনায়কত্ব ও একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করেন। নজীরবিহীন তার এই শাসনতান্ত্রিক ক্যু’কে তিনি তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেন। তার এই সর্বক্ষমতা হরণের ফলে বাহ্যিকভাবে অবস্থা স্থিতিশীল মনে হলেও দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এই অবনতির একটি প্রধান কারণ ছিল শেখ মুজিব ও তার সরকার মনে করত কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠি এবং ক্ষমতাবলয়ের লোকজনের মাঝে সুখ-সুবিধা বন্টন করে তাদের খুশি রাখতে পারলেই ক্ষমতায় থাকার সমর্থন লাভ করা যায়। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা, আদর্শ অথবা নীতিগত বিশ্বাসের অভাব সর্বোপরি তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশসমূহের সমস্যাদি এবং সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামের মাধ্যমে সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের পূর্ণগঠনের সমস্যা সম্পর্কে তার জ্ঞানের অভাবের জন্যই শুধুমাত্র সুখ-সুবিধা বন্টনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। যে কোন নীতি নির্ধারনের ব্যাপারে তিনি তার অভিমতকেই প্রাধান্য দিতেন। কারো কোন যুক্তিই তার কাছে গ্রহণযোগ্য হত না। তার এই সবজান্তা ভাবও তার প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য অনেকাংশে দায়ী। পার্টি ও রাষ্ট্র সম্পর্কের ব্যাপারেও তার যথেষ্ট জ্ঞানের অভাব ছিল। ঐ ধরণের মানসিকতার জন্যই ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে শেখ মুজিবের মতবিরোধ ঘটে। জনাব খানের অভিমত ছিল প্রশাসনকে নির্দলীয় রাখতে হবে। প্রশাসনের উপর কোন প্রকার দলীয় প্রভাবের ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ বিঘ্নিত হবে। কিন্তু শেখ মুজিব তার এই মনোভাবের বিরোধিতা করে যুক্তি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, “পার্টির আনুগত্যকে প্রাধান্য দিতে হবে প্রশাসনকে তাদের নিরপেক্ষতা বর্জন করে। শুধু তাই নয় আওয়ামী লীগের দলীয় সদস্যদের কাজকে সহায়তা করাই হবে প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব এবং এভাবেই আওয়ামী লীগের প্রভাব বাড়তে সহযোগী হতে হবে প্রশাসনিক যন্ত্রকে।” শেখ মুজিবের দাপটের কাছে জনাব আতাউর রহমান খানকে নিশ্চুপ থাকতে হয়। ফলে ১৯৫৬-৫৭ সালে শেখ মুজিব যখন শিল্পমন্ত্রী তখন তার বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়। তিনি তার সরকারি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তার প্রিয়জন ও পার্টির লোকদের অনেক পারমিট, ব্যাংক লোন, ইনডেটিং লাইসেন্স, শিল্প কারখানা গড়ার পারমিশন প্রভৃতি করিয়ে দেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তিনি তার স্বভাবসুলভ প্রথায় তার পার্টির লোকজনদের নানাভাবে খুশি রাখার চেষ্টা করেন। কাউকে দেয়া হয় টাকা, কাউকে চাকুরী, কাউকে অযৌক্তিক পদোন্নতি, কাউকে বানানো হয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। এভাবেই দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই অযোগ্য ও অসৎ পরিচালকগণ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মেশিনপত্র, স্পেয়ার পার্টস, কাচামাল ভারতে পাচাঁর করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে উঠেন। সব রকম দেশী ও বিদেশী আমদানিকৃত পন্য সরবরাহ করা হত লাইসেন্স প্রাপ্ত ডিলারদের মাধ্যমে। তাদের সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের সুপাত্রগণ।

তাদের কেউই পেশাগতভাবে ব্যবসায়ী ছিল না। তারা তাদের লাইসেন্স পারমিটগুলো মধ্যসত্ব ভোগী হিসাবে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিত। ফলে জিনিসপত্রের দাম অনেকগুন বেড়ে যেত। এছাড়া পাকিস্তানী নাগরিকদের পরিত্যাক্ত ৬০,০০০ বাড়ি আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এভাবেই শুধু নয়, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের যোগ-সাজসে পাট, চাল, অন্যান্য কাচামাল ও রিলিফের বিস্তর মালামাল ভারতে পাচার করা হয়। এরই ফলে ব্যাঙের ছাতার মত দেশে একশ্রেণীর হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে ভূঁইফোড় বড়লোকের সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে আমার সাথে শেখ মুজিবের একান্তে আলাপের সময় প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্য উল্লেখ্য।

মুজিব পরিবারের সাথে বিশেষ ঘনিষ্ঠতার কারণে আমি প্রায়ই যেতাম ৩২নং ধানমন্ডিতে। কখনো তিনি ডেকে পাঠাতেন, কখনো যেতাম স্বেচ্ছায়। এমনই একদিন দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আমি তাকে বলেছিলাম,

—দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে আপনার পার্টির লোকজনদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আপনি জনপ্রিয়তা হারাচ্ছেন। জবাবে তিনি বলেন,

—আমার দলের লোকজন কি পাক আমলে নির্যাতন ভোগ করে নাই? তারা কি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই? তারা কি বিষয়-সম্পদ খোয়ায় নাই? আজ যদি তারা কিছুটা সুযোগ-সুবিধা পেয়েই থাকে তাইলে দোষের কি আছে? তাদেরতো আমি ফালাইয়া দিতে পারি না। এতে কেউ বেজার হইলে আমি কি করতে পারি।

এমন একটি জবাবের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। মনে মনে ভেবেছিলাম, আজতো তিনি জাতীয় নেতা, রাষ্ট্রের কর্ণধার। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে শুধু দলীয় স্বার্থ বড় করে দেখা কি তার উচিত? জাতিই বা সেটা আশা করে কি? এ বিষয়ে আর আলাপে না গিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিলাম এক অবর্ণনীয় অস্বস্তি নিয়ে। শাসকদলের এই সমস্ত নব্য পুজিঁপতিরা জাতীয় অর্থনীতিতে কোন প্রকার বিনিয়োগ করেননি, তারা শুধু যা ছিল সেটাকেই লুট করে বড়লোক হয়েছেন। জাতীয় সম্পদ শুষে নিয়ে খোকলা করে দিয়েছেন অর্থনীতিকে। এভাবে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের মত রাতারাতি বাংলাদেশ কয়েক হাজার পরিবার সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তাদের প্রভাবে পরিচালিত দল আওয়ামী লীগের মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। জ্ঞানের অভাব নাকি জনতাকে বোকা বানাবার অতি চালাকি বোঝা মুশকিল। শুধু যে কর্মীরা অসৎ হয়ে উঠেছিল, তা নয়। মুজিব পরিবারের সদস্যগণ ও তার আত্মীয়-স্বজনও দুর্নীতি ও চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন। শেখ মুজিবের অতি বিশ্বাসভাজন গাজী গোলাম মোস্তফা জাতীয়ভাবে ‘কম্বল চোর’ উপাধি পান এবং রিলিফের জিনিসপত্র নিয়ে কেলেংকারী ও চোরাচালানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি লাভ করেন। তিনি রেডক্রসের চেয়ারম্যান ছিলেন। শেখ মুজিবের ছোট ভাই শেখ নাসের শুধু খুলনায় বাড়িঘর এবং অবাঙ্গালীদের ব্যবসা-বাণিজ্য হাতিয়েই ক্ষান্ত হননি। ভারতে চোরাচালানের রিং লিডারও ছিলেন তিনি। শেখ মুজিবের প্রত্যেকটি ভাগীনা (শেখ মনি, আবুল হাসনাত, শেখ শহিদুল ইসলাম) মামুর জোরে শুধু যে রাজনৈতিক আধিপত্যই বিস্তার করে রাতারাতি নেতা বনে যান তাই নয়: অসৎ উপায়ে অর্জিত ধনদৌলতের পাহাড় গড়ে তোলেন তারা শেখ মুজিবের পুত্রদ্বয় বিশেষ করে শেখ কামালও অসৎ উপায়ে টাকা-পয়সা আয় করতে থাকে। এক ব্যাংক ডাকাতির সাথে শেখ কামালের জড়িত হয়ে পড়ার ব্যাপারে পূর্বেই বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে; সরকারের আমলে দুর্নীতি সম্পর্কে বিখ্যাত সাংবাদিক জনাব লরেন্স লিফসুলজ ৩০শে আগষ্ট ১৯৭৪ সালে Far Eastern Economics-তে লিখেন, “অসৎ কাজ ও অসাধু তৎপরতা কোন আমলেই নতুন কিছু নহে। কিন্তু ঢাকাবাসীদের অনেকেই মনে করেন যেভাবে মুজিব আমলে সরকারের ছত্রছায়ায় খোলাখুলিভাবে দুর্নীতি ও জাতীয় সম্পদের লুটপাট হয়েছে তার নজির ইতিহাসে বিরল।” স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে লুটপাট ও দুর্নীতির ফলে কোনরূপ অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক সুফল লাভ করা সরকারের পক্ষে ছিল অসম্ভব; উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কহীন পরগাছার মত গজিয়ে উঠা নব্য ধনীদের বিলাসবহুল জীবনধারা ও সহজ উপায়ে অর্জিত অর্থের অস্বাভাবিক অপচয় জাতীয় অর্থনৈতিক সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলেছিল একদিকে, অন্যদিকে তাদের নীতি বর্জিত ক্রিয়াকর্ম সরকার ও সরকারি দলের ভাবমুর্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিল জনসাধারণের চোখে। আওয়ামী লীগের পক্ষে সেই হারানো মর্যাদা আর কখনো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। মানুষের আকাশচুম্বি চাহিদা এবং সীমিত জাতীয় সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কিছু লোককে ফায়দা দিতে পারলেও বেশিরভাগ জনগণের কাছ থেকে সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় গড়ে তুলে সুষম সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে আওয়ামী লীগ সরকার এ ধরণের পক্ষপাতিত্ব ও দুর্নীতি প্রতিষ্ঠিত করবে সমাজের প্রতি স্তরে, এটাকে জনগণ জাতীয় বেঈমানীর সমান বলেই মনে করেছিল। আওয়ামী নেতৃত্বের প্রতি তারা বীতঃশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অতি প্রয়োজনীয় জনগণের আস্থা হারায় আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয় জনগণের সাথে সাথে ক্ষমতাবলয়ের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের আস্থা থেকেও বঞ্চিত হয় আওয়ামী সরকার। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য হল প্রশাসন, ছাত্র ও যুব সমাজ, মুক্তিযোদ্ধা ও সেনা বাহিনী।

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ৮ কোটি লোকের অন্নের সংস্থান করা ছিল অতি দুরূহ কাজ। বৈদেশিক বন্ধুরাষ্ট্রগুলো এবং সাহায্য সংস্থাগুলো মুক্তহস্ত নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুর্নগঠনের জন্য। তাদের সহানুভূতির ফলে ১৯৭৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সর্বমোট ১৩৭৩ মিলিয়ন ডলার ঋণ ও অনুদান লাভ করতে সমর্থ হয়। এছাড়া ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত UNROB এর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণের রিলিফ সাহায্যও দান করা হয় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ১৯৭৩ সাল থেকেই সংকট দেখা দেয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে শৈথিল্য দেখা দেয়। এর জন্য মূলতঃ তিনটি কারণই প্রধান-

(১) ১৯৭২ সালের বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা।

(২) বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাধীনতার পরপর অনভিজ্ঞ, দলীয় লোকদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অধিকর্তা বনিয়ে দেবার ফলে উৎপাদন কমে যায়। প্রায় সবগুলো শিল্প প্রতিষ্ঠানেই উৎপাদন হ্রাস পেয়ে নেমে আসে শতকরা ৯%-এ। এর জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠান চালনার দক্ষতার অভাব, অবাধ লুণ্ঠন ও দুর্নীতি, শ্রমিকদের পরিচালনার ক্ষেত্রে অরাজকতা।

(৩) বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতের সাথে বর্ডার ট্রেড চুক্তি সই করার ফলে বাংলাদেশ থেকে উৎপাদিত পাট ও চালের ১৫% চোরাচালানীদের মাধ্যমে ভারতে পাচার হয়ে যেত। ১৯৭১ সালের আগ অব্দি পাকিস্তানের জাতীয় বৈদেশিক আয়ের ৮৫% আসত পাট রফতানি থেকে। চাল বাংলাদেশের মানুষের মূল খাদ্য। এভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ইতিমধ্যে সরকার বাজারে কাগুজে নোট ছাড়ে ফলে দেশে ১৯৬৯ সালের তুলনায় ৩০০% মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি হয়। পরিণামে দ্রব্যমূল্য হয়ে উঠে আকাশচুম্বি। ১৯৭৩ সালের শেষার্ধে UNROB বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার পর বাংলাদেশে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ হ্রাস পায়। উপরন্তু সরকারের আয় আশানূরূপ না হয়ে অনেক কমে যায়। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দিন আহমদ বলেন, “১৯৭৩-৭৪ এর সমস্ত উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একই সাথে দেশের অর্থনীতিও ভেঙ্গে পড়েছে ১৯৭৪ সালে দ্রব্যমূল্য ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় প্রায় ৭০০-৮০০ গুণ বৃদ্ধি পায়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাধারণ জনগণের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। দেশে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। অক্টোবরের মধ্যে প্রায় এক লক্ষ লোক না খেয়ে দুর্ভিক্ষে মারা যায়। আন্তজার্তিক সাহায্য পাওয়া যায় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার (Cash & kind ) এবং আর্থিক সাহায্য পাওয়া যায় ১৪৪ মিলিয়ন ডলার। এ সাহায্যের ফলে সে যাত্রায় দুর্ভিক্ষ্য পীড়িত বাংলাদেশ কোন রকমে বেঁচে যায়।

পকিস্তানী বাহিনীর সারেন্ডারের পর ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশী সরকারের অনুরোধে বাংলাদেশে থেকে চলে যায়। বিজয়ী সেনা হিসেবে বা অন্য কোন কারণেই হোক চলে যাবার আগে তারা হাতিয়ার, অস্ত্রশস্ত্র, ভারী কামান, ট্যাঙ্ক, গোলাবারুদ, যুদ্ধের অন্যান্য আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এবং মিল কারখানার মেশিনপত্রও খুলে নিয়ে যায় ভারতে : তারা অধিকৃত শহর ও সেনানিবাসগুলো থেকে আসবাবপত্র, ফিটিংস ফার্নিচার, এমনকি কমোড- বেসিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে যেতে থাকে। অনিক পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর ইস্যুতে ছাপা হয়, “ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ১০০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র, মেশিনপত্র, যুদ্ধ-সরঞ্জাম ও কাচামাল ভারতে নিয়ে যায়।” স্বাধীনতার পর খুলনায় ডেপুটি কমিশনার হিসেবে নিযুক্ত জনাব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ভারতের কাছে সরকারিভাবে এক প্রটেষ্ট নোটের মাধ্যমে জানান যে, তার জেলা থেকে ভারতীয় বাহিনী লক্ষ লক্ষ টাকার মালসামগ্রী অন্যায়ভাবে ভারতে নিয়ে গেছে। তিনি ভারতীয় বাহিনীর এ ধরণের লুটপাটের ঘোর বিরোধিতা করেন। ভারত ও পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে আগেও চোরাকারবার চলতো। কিন্তু বাংলাদেশ হবার পর চোরাকারবারের মাত্রা বেড়ে যায় চরমভাবে। স্বাধীনতার পর বেশ কিছুদিন পর্যন্ত সীমান্ত সম্পূর্ণ খোলা রাখা হয়। মাওলানা ভাসানী দাবি করেন, “বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা বাহিনী কর্তৃক নিয়ে যাওয়া অস্ত্র ও যুদ্ধসম্ভার এবং চোরাচালানের মাধ্যমে সর্বমোট ৬০০০ কোটি টাকা মূল্যের জিনিসপত্র ও কাঁচামাল ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগষ্ট পর্যন্ত সময়ে চোরাচালানের মাধ্যমে ২০০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের দ্রব্য সামগ্রী ভারতে পাচাঁর হয়েছে বলে দাবি করেন বাংলা সংবাদপত্র অনিক। বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরেই ভারতে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রফতানির উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা উঠিয়ে নেয়। এর ফলে খোলা বর্ডার দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে উৎপাদিত পাট ও পাটজাত দ্রব্যের একটি বৃহৎ অংশ ভারতে চলে যাওয়ার পথ আরো সুগম হয়। ১লা জানুয়ারী ১৯৭২ সরকার বাংলাদেশী টাকার মান কমিয়ে দিয়ে ভারতীয় রুপির সমপর্যায়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। সরকার একই সাথে আরো ঘোষণা করে, ১৬ই ডিসেম্বরের আগে পাট ও পাটজাত সংক্রান্ত সমস্ত দ্রব্যের ব্যাপারে রফতানির সকল চুক্তি বাতিল বলে গন্য করা হবে। দি বাংলাদেশ অবজারভার ২/১/১৯৭২ সংখ্যায় লেখে, “ব্যবসায়ী এবং অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে উল্লেখিত সরকারি তিনটি সিদ্ধান্তই ভারতের স্বার্থে প্রণীত হয়েছে। ভারতীয় সরকারের চাপের মুখেই এ ধরণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।” এরপর সরকার কর্তৃক টাকার মান কমাবার পর পাটের দাম পুনঃনির্ধারণ করার ফলে সৎভাবে ব্যবসা করার চেয়ে চোরাচালান অনেক লাভজনক হয়ে দাড়ায়। ফলে বাংলাদেশের জীবন সোনালী আশের রপ্তানী হ্রাস পায়। এতে জাতীয় বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যায় এবং জাতীয় সঞ্চয়ও কমে যায়। উৎপাদনে ভাটা পড়ে। ১৯৭৪ সালে রহস্যজনকভাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপের ফলে অনেক জায়গায় পাটের গুদাম আগুনে পুড়ে যায়। গুদামে ভরা কাঁচা পাট ও পাটজাত দ্রব্য এভাবে পুড়ে যাওয়ার ফলে পাট শিল্পের ক্ষেত্রে সরকারের প্রচন্ড ক্ষতি হয়। গুদামে আগুন লেগে পুড়ে যাওয়ার ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা করতে গিয়ে পাটমন্ত্রী ১৯৭৪ সালে সংসদে বলেন, “আগুন লেগে প্ৰায় ১৩৯২ মিলিয়ন টাকার শুধু পাটই পুড়ে যায়। পাটজাত দ্রব্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি।” প্রচন্ড এই ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে BJMC এবং BJTC সরকারি ভর্তুকির উপর চলতে থাকে। আজঅব্দি পাট শিল্পক্ষেত্রে সরকার কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে চলেছে। একদিনের সোনালী আশঁ আজ জাতির গলায় হয়ে পড়েছে ফাঁস। পক্ষান্তরে যে ভারত কখনোই পাট রফতানি করতে পারত না, এমন কি পাটের অপর্যাপ্ত উৎপাদনের ফলে অনেক জুট মিল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হতে হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর অবস্থা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। ১৯৭৩ সালে ভারত ১ মিলিয়ন বেল পাট রফতানি করে বিদেশের মার্কেটে এবং ১৯৭৪ সালের মধ্যে শুধু যে তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলগুলোই আবার ফুল শিফটে চালু করা হয় তা নয়; তারা ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে আরো নতুন দু’টো মিল স্থাপন করে। দুই সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত বর্ডার চুক্তি বাংলাদেশের কোন উপকার না করে চোরাচালানের পথকেই প্রশস্ত করে দিয়েছিল। পরে জনগণের জোর আন্দোলন ও দাবির মুখে সরকার ঐ চুক্তি বছর শেষ না হতেই বাতিল করতে বাধ্য হয়। ১৯৭২ সালের মে মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে চারটি ঋণ চুক্তি এবং একটি বাণিজ্য চুক্তি সই করে। কিন্তু চুক্তিগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারতীয় দিক থেকে গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে চুক্তি অনুযায়ী দ্রব্য সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে ভারতের বিমুখিতা বাণিজ্য ঘাটতির সৃষ্টি করে। ভারত বাংলাদেশের জন্য টাকা ছাপায়। সেই কারণে নকল নোটে সারাদেশ ছেয়ে যায়। ফলে দু’দেশের সরকার বিব্রত হয় জনসম্মুখে। নকল টাকার বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করে। দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের স্বল্পতা এবং উচ্চ মূল্য জনগণের জীবনকে যতই আঘাত করতে থাকে ততই জনগণ ভারত বিরোধী হয়ে উঠে। কালোবাজারী, মুনাফাখোররা বৈধ ব্যবসার পরিবর্তে ভারতে চোরাচালান করে বেশি ফায়দা লাভের মানসিকতা জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। এভাবে একদিকে সরকার ও জনগণ এবং অপরদিকে বাংলাদেশের জনগণ ও ভারত সরকারের মধ্যে অবিশ্বাসের জন্ম দেয়। ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন, ভারতীয় আমলাদের জাতীয় প্রশাসনে হস্তক্ষেপ, সীমান্ত দিয়ে অবাধ চোরাচালান, ভারতে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রফতানির উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ভারতে বাংলাদেশী মুদ্রা ছাপানো, রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টি, বাংলাদেশের টাকার মূল্য কমানো, ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থান এসমস্ত কারণগুলিই ক্রমান্বয়ে জনগণের মনে সন্দেহের উদ্রেক করে। ভারতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠে বাংলাদেশের জনগণ। যুদ্ধকালীন অবস্থায় ভারত সরকার শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে বলে ভুল করে যে বীজ বপন করেছিল তারই প্রতিফল ‘ভারতীয় শোষণ’ হিসাবে ক্রমশঃ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মনে শিকড় গড়তে থাকে। বন্ধুবেশে বাংলাদেশকে শোষণ করে, জাতীয় সম্পদ লুটপাট করে, বাংলাদেশকে তাদের পশ্চাদভূমি ও মার্কেটে পরিণত করে তাদের নিয়ন্ত্রণে একটি করদ রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার নীল নকশায় আওয়ামী লীগ তাদের সহযোগী এ ধারণাও প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীর মনে বদ্ধমূল হয়ে উঠে। তাদের এ ধারণা আরো জোরদার হয় ভারত কর্তৃক সিকিম দখল করে নেয়ার পর। জনগণের এ চেতনার যথার্থ মূল্য না দিয়ে আওয়ামী সরকার এবং ভারত সরকার এ ধরণের বৈরী মনোভাব দূর করার জন্য কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। ফলে এর প্রভাব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়ে উঠে সুদূরপ্রসারী। এভাবে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দু’দেশের সম্পর্কে ফাটলের সৃষ্টি হয়। সরকারি পর্যায়ে যদিও বা সম্পর্ক বন্ধুসুলভ ও অটুট বলে আখ্যায়িত করা হয় তবুও এটাই সত্যি যে বাংলাদেশের জনগণ ভারত বিদ্বেষী হয়ে উঠে সেই দিন থেকেই যেদিন ভারতীয় সেনা বাহিনী বাংলাদেশ থেকে সবকিছু পাঁচার করতে শুরু করল ভারতে এবং দু’দেশের সীমান্ত খোলা রাখা হল ভারতেরই স্বার্থে

স্বাধীনতা লাভের কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের ভেতর ভারতীয় সেনা বাহিনীর অবস্থান দেশে বিদেশে ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয়। তাদের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ সরকার দেশ শাসন করতে অক্ষম সে ধরণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় বাংলাদেশ সরকারকে। এতে করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারেও প্রশ্ন দেখা দেয়। পাকিস্তান ও তার স্বপক্ষের শক্তিগুলো এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে আর্ন্তজাতিকভাবে প্রচারণা চালাতে থাকে- বাংলাদেশ ভারতীয় দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ভারত অন্যায়ভাবে পাকিস্তানের একটি অংশকে জবরদখল করে রেখেছে। তাদের এ প্রচারণার ফলে এবং বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অবস্থানের বাস্তবতায় আর্ন্তজাতিকভাবে অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অসম্মত হয়। দেশে ফিরে শেখ মুজিব যদিও বা ভারতীয় বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন কিন্তু জনগণ তাদের জাতীয় সম্পদ লুন্ঠন ও অন্যান্য কার্যকলাপে তাদের ভবিষ্যত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠে। মুজিব জনগণের মনোভাব বুঝতে পারেন কিন্তু তার তেমন বিশেষ কিছুই করার ছিল না। মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার পর ভারত সরকারের বাংলাদেশে তাদের সামরিক বাহিনী রাখার সিদ্ধান্ত ও তার বিরুদ্ধে জনরোষের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনী মোতায়েন রাখার কোন যুক্তিই তখন ভারতের পক্ষেও দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। শুধু তাই নয়, ‘নন এলাইনড মুভমেন্টে’ এর প্রবক্তা এবং পঞ্চশীলা নীতির প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলোর একটি হয়ে অন্য দেশে তার সেনা বাহিনী রাখার জন্য বিশ্ব পরিসরে ভারতের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল এবং ভারতকে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থার চাপে ব্যবস্থা গৃহিত হয় যে, ভারতীয় সেনা বাহিনী বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। কিন্তু এর পরিবর্তে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়- প্রবাসী সরকার ও ভারত সরকারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তা রদবদল করে স্বাক্ষরিত হবে ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তি এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর যুক্ত ইশতেহার : চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর ধারাও সংযুক্ত করা হবে চুক্তিতে। এ চুক্তি এবং যৌথ ইশতেহার স্বাক্ষরিত হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর মাঝে ১৯শে মার্চ ১৯৭২ সালে যখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের আমন্ত্রনে প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে আসেন। এ সফরের সময় তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ট্রানজিট ট্রেড এবং বর্ডার ট্রেড বজিয়ে রাখা হবে। দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়, সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়গুলোর দু’দেশের কর্মকর্তারা ছয় মাস অন্তর নিয়মিতভাবে মিলিত হয়ে মতবিনিময় ও কার্যপ্রনালী নির্ধারণ করবেন। ঐ সময় ‘জয়েন্ট রিভার কমিশন ও সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি, সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তির আলোকেই প্রণীত হয়েছিল। এভাবেই দেশে ফিরে এসে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে পূর্বের সুইজ্যারল্যান্ড বানাবার ঘোষণা দিয়ে মূলতঃ ভারতের একটি করদ রাজ্যেই পরিণত করলেন সদ্যমুক্ত বাংলাদেশকে। তিনি চালনা এবং চট্টগ্রামের. বন্দর পরিষ্কারের অযুহাতে সোভিয়েত ও ভারতীয় নৌ বাহিনীকেও আমন্ত্রন জানান। এভাবেই বাংলাদেশকে রুশ-ভারত অক্ষ শক্তির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানের পরাজয়ের পর উপমহাদেশের আধিপত্যবাদী ভারত নিজেকে আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে দাবি করে ঘোষণা দেয়, “দক্ষিন এশিয়া থেকে বিজাতীয় সবশক্তিকে চলে যেতে হবে।” শুধু তাই নয়; উপমহাদেশের জন্য ভারত এক নতুন ‘মনরোডকট্রেন’ তৈরি করে। ফলে উপমহাদেশের সব ছোট দেশগুলো ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকারে পরিণত হওয়ার আশংকায় ভীত হয়ে পড়ে। ভারতের জন্য এত কিছু করার পরও শেখ মুজিব পানি সমস্যা, সীমান্ত নির্ধারন, সমুদ্রসীমা এবং অর্থনৈতিক জলসীমা নির্ধারণ, সমুদ্রে জেগে ওঠা দ্বীপসমূহের দখল প্রভৃতি মূল সমস্যাগুলোর বিষয়ে ভারতের কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারেননি। শেখ মুজিব সেনা বাহিনীর মোকাবেলায় জাতীয় রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলেন। এর ফলে জনমনে সন্দেহ হয় শেখ মুজিব ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই ভারতের পরামর্শে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলেছেন। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে ভারত সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে সিকিম দখল করে নেবার পর দক্ষিন এশিয়া উপমহাদেশের জনগণ বিশেষভাবে ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্য সম্পর্কে আরো সচেতন হয়ে উঠে। আওয়ামী লীগ বাদে দেশের অন্যসব রাজনৈতিক দলগুলো ভারতের সাথে ২৫ বছরের চুক্তিকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ মনে করে অবিলম্বে ঐ চুক্তি নাকচ করে দেবার দাবি জানায়। মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সাত দলীয় এ্যাকশন কমিটি সরকারের কাছে যে ১৫ দফা দাবি উত্থাপন করেন তার প্রথম দাবিই ছিল ভারতের সাথে অসম মৈত্রী চুক্তি বাতিল করতে হবে। তারা অভিমত প্রকাশ করেন- বাংলাদেশের ভবিষ্যতের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বজিয়ে রাখার নীল নকশা অনুযায়ী এ চুক্তি করা হয়েছে এবং সমগ্র উপমহাদেশের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণকে পাকাপোক্ত করার জন্য এই চুক্তি সহায়ক হবে। পাঠকদের অবগতির জন্য ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির কয়েকটি ধারা সম্পর্কে কিছুটা আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে বলে বোধ করছি।

চুক্তির ৬নং অনুচ্ছেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। অনুচ্ছেদ ৮, ৯ এবং ১০নং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সমস্ত অনুচ্ছেদগুলো দুই দেশের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে। অনুচ্ছেদ ৮-এ বলা হয়, “কোন দেশ অপর দেশের বিরুদ্ধে কোনরূপ সামরিক জোটে যোগ দিতে পারবে না এবং অপর দেশের বিরুদ্ধে কোন রকম সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে পারবে না এবং তার সীমানাধীন স্থল, জল এবং আকাশ অপর রাষ্ট্রের সামরিক ক্ষতি অথবা অপর রাষ্ট্রের সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ কোন কাজে ব্যবহার করতে দিতে পারবে না।” অনুচ্ছেদ ৯-এ বর্ণিত রয়েছে, “প্রত্যেক পার্টিই অন্য পার্টির বিপক্ষে কোন তৃতীয় পার্টিকে যে কোন সামরিক সংঘর্ষে কোন প্রকার সাহায্য দিতে পারবে না। যদি কোন পার্টি আক্রমণের শিকার হয় কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মুখাপেক্ষি হয়, তবে অনতিবিলম্বে দুই পার্টিই পারষ্পরিক আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সেই আক্রমণ কিংবা আগ্রাসনের হুমকির মোকাবেলা করার জন্য। এভাবেই দুই দেশের শান্তি ও সংহতি বজিয়ে রাখা হবে।” অনুচ্ছেদ ১০-এ বর্ণিত আছে, “এই চুক্তির পরিপন্থী কোন প্রকার অঙ্গীকার কোন পার্টিই অন্য কোন দেশ বা একাধিক দেশের সাথে খোলাভাবে কিংবা গোপনে করতে পারবে না।” স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য এ ধরণের কোন চুক্তির কি প্রয়োজন ছিল? ভারত বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র। বাংলাদেশের তিন দিকই ঘিরে রয়েছে ভারত। পূর্বদিকে সামান্য সীমান্ত রয়েছে বার্মার সাথে। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। অনেকের মতে পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত এ ধরণের কোন চুক্তির প্রয়োজন ছিল না। যেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা নেই বিধায় কোন বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া চুক্তির ৮, ৯ এবং ১০নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার জন্য সামরিক সাহায্য চাওয়ার মানে দাড়ায় বাংলাদেশ ভারতের কাছে সম্পর্কের দিক দিয়ে হীনভাবে অনুগত।

চুক্তিতে অর্থনৈতিক সম্পর্কে যে শর্ত ছিল তার ফলে ভারত একটি অগ্রবর্তী শিল্পে উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রযুক্তি প্রকৌশলিক সাহায্য, ভারী এবং সাঝারি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল এবং অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প ও কৃষি দুই ক্ষেত্রেই অবকাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ভারতের অর্থনীতি ও শিল্প কাঠামো বাংলাদেশের চেয়ে আকারে অনেক বড় ও উন্নত। তারা প্রায় প্রয়োজনীয় সবকিছুই নিজেরা তৈরি করে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট ও দুর্বল। শিল্প ক্ষেত্রেও অগ্রসর। প্রয়োজনীয় তেমন কিছুই বাংলাদেশে তৈরি হয় না। সে ক্ষেত্রে দুই দেশের মাঝে উল্লেখিত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অর্থনৈতিক সহযোগিতার মানেই হচ্ছে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে সব বিষয়ে একটি বাজারে পরিণত করা। অর্থনৈতিক সহযোগিতার নামে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে ভারতের বিশাল অর্থনীতির অঙ্গীভূত করে নেয়া। চুক্তিতে ব্যক্ত ইচ্ছানুযায়ী ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং গঙ্গা অববাহিকার পানি সম্পদের উন্নয়ন ও সুব্যবস্থা করার ধারার প্রভাব হচ্ছে অনেক সুদূরপ্রসারী সাহায্য ও সহযোগিতার যে কোন চুক্তি যদি অসম দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পাদিত হয়, একটি বৃহৎ এবং ক্ষমতাশালী এবং অপরটি ছোট এবং দুর্বল রাষ্ট্র তাহলে সেই চুক্তির সুবিধা সাধারণভাবেই পাবে তুলনামূলকভাবে যে দেশ বড় ও শক্তিশালী। এ অকাট্য সত্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের অনেকেই এই চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু তাদের প্রতিবাদকে উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের ভেতরের ভারতপন্থীদের প্ররোচণায় শেখ মুজিব ২৫ বছরের আত্মঘাতী মৈত্রী চুক্তি সই করেছিলেন

সার্বভৌমত্বের মত বিষয়েও ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে। স্থলসীমা ছাড়াও, ইকোনমিক জোন সম্পর্কে দু’দেশের ভিন্ন অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জলসীমা নির্ধারণ করতেও দীর্ঘ সময় লাগবে। আর্ন্তজাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের উপকূলের সমুদ্র সীমানাও এ পর্যন্ত ঠিক করা সম্ভব হয়নি। ১৯৭৪ সালে বিতর্কিত কিছু জায়গার ব্যাপারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনা ভারতের কাছ থেকে পাইনি। সমুদ্রসীমা ও ইকনোমিক জোন সর্ম্পকে ভারতের অবস্থানের ভিন্নতার কারণে যে ছয়টি তেল কোম্পানী ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত করে। তাদের একটি কোম্পানী এ্যাসল্যান্ড অয়েল কোঃ-কে তৈলকূপ খনন করতে বাধা দেয় ভারত। ভারতীয় প্রতিবাদের মুখে ঐ তেল কোম্পানীকে খনন কার্য বন্ধ করে ফিরে চলে যেতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কয়েক জায়গায় নাশকতামূলক কার্যকলাপ ও কিডন্যাপিং এর মত পদক্ষেপের মাধ্যমে কোম্পানীগুলোকে ভয়ও দেখান হয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কিছুই করতে পারেনি। বঙ্গোপসাগরের মুখে জেগে ওঠা ভূ-খন্ড বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। হারিয়াভাঙ্গা নদীর মোহানায় দক্ষিণ তালপট্টি নামের এক ভূ-খন্ড জেগে উঠেছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। মালিকানা নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে দুই সরকারের মাঝে সমঝোতা হয় যৌথ সার্ভের মাধ্যমেই তালপট্টির মালিকানা নির্ধারন করা হবে। কিন্তু হঠাৎ করে সমঝোতার বরখেলাপ করে ভারতীয় নৌ বাহিনী একদিন তালপট্টি দখল করে নিয়ে সেখানে ভারতীয় পতাকা উড়িয়ে দেয় একতরফাভাবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পানি ভাগাভাগির সমস্যা। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অসংখ্য নদী-নালার পানিই হচ্ছে কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের জীবন দেশের বেশিরভাগ নদ-নদীর উৎপত্তি হয়েছে উত্তরে হিমালয় পর্বতমালায় এবং বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে : গঙ্গা, ব্ৰহ্মপুত্ৰ, মেঘনা, তিস্তা, যমুনা, গোমতি, মুহুরী, সুরমা, খোয়াই, কুশিয়ারা, পদ্মার প্রবাহের উপরেই নির্ভরশীল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। আর্ন্তজাতিক নদী গঙ্গার উপর একতরফাভাবে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করায় জনগণের উপর নেমে এসেছে এক দুর্বিষহ অভিশাপ। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ আজ মরু প্রায়। নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে : একই হারে বাড়ছে লবনাক্ততা। লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিবেশ ও প্রকৃতির পরিবর্তন আজ বাংলাদেশের জন্য এক হুমকির সৃষ্টি করেছে; গঙ্গার পানি বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ লোকের জীবনসংস্থানের জন্য অতি প্রয়োজন। ফারাক্কা বাঁধের ফলে পানির অপ্রতুলতা দু’দেশের মধ্যে তিক্ততাই বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশের জনগণের প্রয়োজনের প্রতি সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল হয়ে একটি ন্যায়সংগত সমাধান খুঁজে পাবার চেষ্টা না করা হলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটবে ভবিষ্যতে। ভারত তিস্তা নদীর উপরও বাঁধ দিয়েছে একতরফাভাবে। এ নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারেও তারা এখন পর্যন্ত কোন আলোচনা করছে না। বাঁধ দেয়ার ফলে নদীতে পানির প্রবাহ কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের চারটি জেলা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এছাড়া ভারত খোয়াই, গোমতি এবং আরো প্রায় দশটা নদীতে বাঁধ দিচ্ছে একতরফাভাবে, কোন আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। এর ফলে খরার সময় বা শুষ্ক মৌসুমে কৃষির জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন হবে কৃষকরা তা পাবে না। ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা এবং গঙ্গা অববাহিকার পানি সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহারের জন্য ভারত ইতিমধ্যে আবার এক লিংক ক্যানালের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। তারা চাচ্ছেন ক্যানাল খুড়ে ব্রহ্মপুত্র থেকে পানি সরবরাহ করা হবে গঙ্গা ও হুগলী নদীর নাব্যতা বাড়াবার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কোন যুক্তিতেই এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মত পোষণ করেন। যদিও মৈত্রী চুক্তিতে বলা হয়েছে, “আমাদের দুই দেশের মাঝে সীমান্ত হবে শান্তি ও বন্ধুত্বের অনন্তকালের সাক্ষী।” কিন্তু সামরিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একথার ভিন্ন মানেও খুঁজে পাওয়া যায়।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন অংশগুলোকে একত্রিকরণের মাধ্যমে একটি অখন্ড প্রতিরোধ ব্যবস্থা কায়েম করার যে সামরিক উদ্দেশ্য ভারত অনেকদিন ধরে মনে পোষণ করে আসছে তার সাথে স্বাধীনতার পরপর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচারণা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার ‘বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র আর গরীব দেশের জন্য কোন বড় আকারের সেনা বাহিনীর প্রয়োজন নেই’ এর একটা সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। ভারতের লক্ষ্য অর্জন করার জন্যই আওয়ামী সরকার এ ধরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। অনন্ত কালের শান্তি আর বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা সম্ভব শুধুমাত্র দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনার সব পথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমেই। রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সময় ও বাস্তবতার সাথে পরিবর্তনশীল। তাছাড়া দু’টি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে যেখানে রয়েছে হাজারও সমস্যা সেখানে অনন্তকালের শান্তি আর বন্ধুত্বের গ্যারান্টি পাওয়া অসম্ভবই শুধু নয় অবাস্তবও বটে। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি যেখানে সম্পুরক না হয়ে অনেকক্ষেত্রেই প্রতিযোগিতামূলক এবং অসম অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ফলে যেখানে চোরাচালান ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে দুর্বল প্রতিরক্ষা বাহিনীর তত্ত্ব কি করে জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে পারে? তথাকথিত অনন্তকালের শান্তিই বা কি করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে অনেক ধরণের সমস্যাই থাকতে পারে। তাই বলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সেগুলোর সমাধান করা যাবে না এটা ভাবাও যেমন ঠিক নয় তেমনি দু’দেশের মধ্যকার সব সমস্যা সংঘাতের মাধ্যমেই শুধু নিরসন করা সম্ভব এ ধারণাও সঠিক নয়। দু’দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দূরদর্শিতা, পরিপক্কতা, গতিশীলতা ও মানবিক দৃষ্টিকোন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার আন্তরিকতাই শুধু গড়ে তুলতে পারে বন্ধুত্ব। এর জন্য পোষাকি চুক্তির প্রয়োজন হয় না। পক্ষান্তরে অবিশ্বাস, দমন নীতি, একে অপরকে ঠকাবার প্রচেষ্টা যেখানে প্রকট সেখানে স্বাক্ষরিত চুক্তিও কোন কাজে আসে না।

স্বাধীনতার প্রথমলগ্ন থেকেই দেশে চরম নৈরাজ্য বিরাজ করতে থাকে মূলতঃ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার জন্য। আওয়ামী লীগ সরকারের রাষ্ট্র ও দলকে এক করে দেখা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে দলীয় নেতাদের হস্তক্ষেপের ফলে প্রশাসনিক অবকাঠামো নিঃক্রিয় হয়ে পড়ে এবং দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। শেখ মুজিবের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে পার্টির আওতাভুক্ত করার ফলে সব জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতারা এবং প্রভাবশালী দলীয় সমর্থকরা আমলাদের উপর খবরদারী করতে থাকেন; এ ধরণের পরিস্থিতিতে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কাজ করতে অভ্যস্ত নন বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা নিঃস্ক্রিয় ভূমিকাই পালন করতে থাকেন। তাদের কাজ করার স্পৃহা এবং উদ্দোম দু’টোই লোপ পায়। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি তার (PONO 9) অধ্যাদেশ জারি করেন। এ আদেশবলে যে কোন সরকারি চাকুরেকে সরকার বিনা কারণে বিনা নোটিশে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করার এখতিয়ার লাভ করে এবং সরকারি এ আদেশের বিরোধিতা করে আইনের সাহায্য নেবার অধিকারও হরণ করে নেয়। ফলে সরকারি চাকুরেদের মধ্যে আতংকের সৃষ্টি হয়। তারা তাদের চাকুরির নিশ্চয়তা হারান। এ অবস্থায় বেশিরভাগ সরকারি আমলা তাদের চাকুরি বজায়ে রাখার জন্য সর্বক্ষণ সচেষ্ট থাকতে বাধ্য হন। এতে করে আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষভাবে তাদের দায়িত্ব পালনেও ব্যর্থ হয়। ফলে সমস্ত প্রশাসনে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। বেড়ে যায় স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি এবং হঠকারিতা। এই সময় কয়েকটি ঘটনা ঘটে খুব দ্রুত। মোজাফফর ন্যাপের বিশিষ্ট কর্মী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম ১৫ই নভেম্বর ন্যাপের সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করে বলেন, “মস্কোর পরামর্শে আজ ন্যাপ আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করছে।” ১৭ই নভেম্বর বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতা মনি সিং বায়তুল মোকাররমে এক জনসমাবেশে ঘোষণা করেন, “কৃষক-শ্রমিকের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করব এবং আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তন ঘটালে আমরা তাতে সাহায্য করব।” ২৮শে নভেম্বর মস্কোপন্থী ন্যাপও একই কথা ঘোষণা করে এবং ১৩রা জানুয়ারী ১৯৭৫ সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়। একই দিন বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স জারি করা হয় এবং সংবিধানের কতিপয় ধারা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ৬ই জানুয়ারী ‘৭৫ এক ঘোষণায় বলা হয় যে, সরকারি কর্মচারীরা সমবায় সমিতি ছাড়া অন্য কোন সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। এছাড়া ৪৮ ঘন্টার মধ্যে দেয়ালের সব পোষ্টার মুছে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়।

দেশের এই দূরাবস্থায় শেখ মুজিবের ক্ষমতা লিপ্সা বেড়ে গেল। ক্ষমতার চূড়ায় অবস্থান করেও তার সন্তুষ্টি ছিল না। রাষ্ট্রের সর্বক্ষমতা তার নিজ হাতে কুক্ষিগত করার জন্য তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি মূল উপাদান ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা এর জন্যই হয়তো বা শেখ মুজিব এতদিন এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। তার এই মনোভাব জানতে পেরে দলীয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠি নিজেদের স্বার্থ ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য তাকে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য প্ররোচণা দিতে থাকে। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই শেখ মুজিব একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন। নভেম্বর ১৯৭৪-এ মস্কোপন্থী দলগুলোও সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারকে একদলীয় শাসন কায়েম করার জন্য আহ্বান জানায়। শেখ মুজিবের একান্ত বিশ্বস্ত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মনসুর আলীকে সোভিয়েত ইউনিয়নের দূতাবাসে ডেকে একদলীয় সরকার কায়েমের পরামর্শ দেয়া হয়। মনসুর আলী, শেখ মনি এবং মস্কোপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্ররোচণা এবং শেখ মুজিবের নিজের ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে তোলার বাসনা ও রাষ্ট্রকে সবদিক দিয়ে তার এবং তার দলের অনুগত রাখার জন্য একদলীয় সরকার কায়েমের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

১৮ই জানুয়ারী আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় শেখ মুজিবর রহমান নতুন সিষ্টেম বাকশাল চালু করার সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন। কিন্তু তার সেই সিদ্ধান্তের সাথে অনেকেই সেদিন একমত হতে পারেননি। যারা সেদিন একদলীয় বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন খন্দোকার মোশতাক আহমদ, বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণী ওসমানী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ওবায়েদুর রহমান, নূরুল ইসলাম মঞ্জু, নূরে আলম সিদ্দিকী, ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন প্রমুখ। বাকশাল গঠন করার আগে শেখ মুজিব কোন পদ্ধতিই অনুসরন করেননি। সংসদীয় দলের মিটিংয়ে অনেকেই বাকশাল গঠনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছিলেন। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী ৫৫মিনিট কাল বক্তৃতা করেন। তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় শেখ মুজিব প্রমাদ গুনেছিলেন। তার কারণ, এ বক্তৃতাকে সংসদ সদস্যদের বৃহৎ অংশ ঘনঘন করতালির মাধ্যমে সমর্থন জানান। এই বক্তৃতার পর অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা করা হয়। পরদিন জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং জনাব শামছুল হকও বক্তৃতা করার অনুমতি চান। কিন্তু তাদের সে অনুমতি না দিয়ে জনাব শেখ মুজিব গম্ভীর স্বরে সবাইকে বলেন, “আর বক্তৃতা নয়। তোমরা আমারে চাও কি না সে কথাই শুনতে চাই সবাই তার এ ধরণের বক্তব্যে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল, সব সদস্যকেই এ প্রস্তাবের উপর বক্তব্য রাখার সুযোগ দেয়া হবে। তিনি আবার বললেন, “বলো, আমারে চাও কিনা?” এরপর তার বিরোধিতা করার সাহস আর কারো হল না। কিন্তু বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এরপরও তার বক্তৃতায় নির্ভয়ে বলেন, “আমরা ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে মুজিব খানকে চাই না।”

এরপর ২০শে জানুয়ারী বসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংগঠিত সেই কলঙ্কিত অধিবেশন।

২৫শে জানুয়ারী সংসদে কোন রকমের বিতর্ক ছাড়া গণতন্ত্রকে পুরোপুরি সমাহিত করে পাশ করানো হয় চতুর্থ সংশোধনী। মাত্র এক বেলার সেই অধিবেশনে স্পীকার ছিলেন জনাব আব্দুল মালেক উকিল। এই আব্দুল মালেক উকিলই মাত্র তিন মাস আগে ১৬ই অক্টোবর সংসদ ভবনে পার্লামেন্ট সংক্রান্ত এক সেমিনারে বলেছিলেন, “আমাদের জনগণের জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রই সর্বাপেক্ষা উপযোগী বলে বিবেচিত হয়েছে।” তারই পৌরহিত্যে চালু হয়ে গেল প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। বাতিল করে দেয়া হল সকল বিরোধী দল। পাশ করিয়ে নেয়া হল একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা। প্রেসিডেন্টকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে শপথ পড়িয়ে নিলেন সেই আব্দুল মালেক উকিলই। ঐ চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীরা সংসদ সদস্য না হলে ভোট দিতে পারবেন না। প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী সংসদ সদস্য হবেন তেমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মন্ত্রী পরিষদ রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দিতে পারেন, তবে রাষ্ট্রপতি তা কার্যকর করলেন কি করলেন না সে সংক্রান্ত ব্যাপারে আদালতে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না। ঐ অধিবেশনে ‘জরুরী ক্ষমতা বিল’ কোন আলোচনা ছাড়াই আইনে পরিণত হয়ে যায়। ২৫শে জানুয়ারী দুপুর ১ঃ১৫ মিনিটে এক সংক্ষিপ্ত অধিবেশনে জারিকৃত চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হয়, “এই আইন প্রণয়নের পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে। শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করবেন। এই আইন প্রবর্তনের ফলে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন এমনিভাবে যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশোধিত সংবিধানের অধিনেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রপতি ও একজন উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। কার্যকালের মেয়াদ পাঁচ বছর। প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে। তিনি প্রত্যক্ষভাবে অথবা তার অধিনস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে যে ক্ষমতা নির্ধারণ করবেন উপ-রাষ্ট্রপতি শুধুমাত্র সেই ক্ষমতাই প্রয়োগ করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য একটি মন্ত্রী পরিষদ থাকবে। রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে কিংবা সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য এরূপ ব্যক্তিদের মধ্য হতে একজন প্রধানমন্ত্রী ও আবশ্যক মনে করলে অন্যান্য মন্ত্ৰী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবেন। প্রত্যেক মন্ত্রী সংসদে বক্তৃতা করতে এবং কার্যাবলীতে অংশ নিতে পারবেন তবে তিনি যদি সংসদ সদস্য না হন তাহলে ভোট দান করতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন অথবা তার নির্দেশে উপ-রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ঐ সভায় সভাপতিত্ব করতে পারবেন। মন্ত্রীগণ রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। সংশোধিত সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেশে শুধু একটি মাত্র রাজনৈতিক দল গঠন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা জাতীয় দল নামে অভিহিত হবে। সংশোধনীতে কার্যভারকালে তার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন ফৌজদারী কার্যধারা দায়ের করা বা

চালু রাখা যাবে না এবং তার গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোন আদালত হতে পরোয়ানা জারি করা যাবে না।” জাতীয় দলের ঘোষণায় বলা হয়, “কোন ব্যক্তি জাতীয় দল ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দল গঠন কিংবা ভিন্ন ধারার কোন রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।”

ঐ সংশোধনীর পক্ষে ২৯৪ জন সাংসদ ভোট দেন। কেউ বিরোধিতা করেননি। সংসদের ২ঘন্টা ৫মিনিট স্থায়ী ঐ অধিবেশনে স্পীকার ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। বিলের বিরোধিতা করে তিনজন বিরোধী ও একজন স্বতন্ত্র সদস্য ওয়াক আউট করেন। এরা হলেন জাসদের আবদুল্লাহ সরকার, আব্দুস সাত্তার ময়নুদ্দিন আহমেদ ও স্বতন্ত্র সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। আতাউর রহমান খান আগেই সংসদ অধিবেশন থেকে বেরিয়ে আসেন। বিলটি উত্থাপন করা হলে আওয়ামী লীগের দলীয় চীফ হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে কোন প্রস্তাব উত্থাপনের সুযোগ না দেবার আহ্বান জানান। এই পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের জনাব আতাউর রহমান খান বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করে আলোচনার সুযোগ দানের জন্য স্পীকার জনাব মালেক উকিলকে অনুরোধ করেন। কিন্তু স্পীকার তা নাকচ করে দেন। পরে কণ্ঠভোটে চীফ হুইপের প্রস্তাব গৃহিত হয় : তারপর আইনমন্ত্রী মনরঞ্জন ধর সংসদে জরুরী ক্ষমতা বিল ১৯৭৫ পেশ করেন। চীফ হুইপ এ ক্ষেত্রেও মৌলিক অধিকার স্থগিতকরণ বিধি প্রয়োগ না করার আবেদন জানালে বিষয়টি কণ্ঠভোটে পাশ হয়। এখানে একটি বিষয় বিশেষ প্রানিধানযোগ্য। যদিও বিলটি সংসদে বিনা বাধায় পাশ হয়; তবে গণতন্ত্রের বিকল্প একনায়কত্বের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যেও দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়।

পরে জেনারেল ওসমানী ও জনাব ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিরোধিতা করে তাদের সংসদ সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। আওয়ামী লীগের প্রবীণ গণতন্ত্রীমনা নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের এই পদক্ষেপে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন। বাকশাল গঠনের পর দেশের রাজনৈতিক অবস্থার কথা ভেবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়েন বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্য অন্য কেউই দায়ী নন। স্বয়ং শেখ মুজিবই হত্যা করেছিলেন গণতন্ত্রকে। দেশে একনায়কত্বের বিরুদ্ধে চাপা অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। বাকশাল গঠনের দিন অনেকেই বলেছিলেন, “শেখ মুজিব নিজেই আওয়ামী লীগের নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিলেন স্বীয় স্বার্থে।” বাকশালের জগদ্দল পাথর বাংলাদেশের মানুষের বুকের উপর এভাবেই চেপে বসল। এ পাথরকে উপড়ে না ফেলা পর্যন্ত মানুষের নিস্তার নেই। এর পরই সরকারি আদেশ জারি করে আইন বিভাগের স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও জনগণের মৌলিক স্বাধীকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। এ সম্পর্কে বিদেশে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা বোঝাবার জন্য পাঠকদের কাছে বিদেশী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হল। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলী টেলিগ্রাফ এর ১৯৭৫ সালের ২৭শে জানুয়ারী সংখ্যা পিটার গিল ‘মুজিব একনায়কত্ব কায়েম করেছেন’ শিরোনামে লেখেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান তার দেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। গত শনিবার ঢাকায় পার্লামেন্টের এক ঘন্টা স্থায়ী অধিবেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে ক্ষমতা অর্পন করেছে। অনেকটা নিঃসন্দেহে বলা চলে গণতন্ত্রের কবর দেয়া হয়েছে। বিরোধী দল দাবি করেছিল যে, এ ধরণের ব্যাপক শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য তিন দিন সময় দেয়া উচিত। জবাবে সরকার প্রস্তাব পাশ করল যে এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক চলবে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাস গৃহযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত কিন্তু গর্বিত স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব এমপিদের বলেছেন যে, পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অবদান। কিন্তু বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে বৃটিশ বিশেষজ্ঞরাই সাহায্য করেছিলেন। তিনি দেশের স্বাধীন আদালতকে ঔপনিবেশিক ও দ্রুত বিচার ব্যাহতকারী বলে অভিযুক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট খেয়ালখুশি মত বিচারক বরখাস্ত করতে পারবেন। নাগরিক অধিকার বিন্দুমাত্রও যদি প্রয়োগ করা হয় তা প্রয়োগ করবে নতুন পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত স্পেশাল আদালত। এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে একটি জাতীয় দল প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন শাসনতন্ত্র মুজিবকে ক্ষমতা প্রদান করেছে। তার গঠিত দলই হবে দেশের একমাত্র বৈধ দল। যদি কোন এমপি যোগদান করতে নারাজ হন অথবা এর বিরুদ্ধে ভোট দেন, তবে তার সদস্যপদ নাকচ হয়ে যাবে।

এহেন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ঢাকায় সমালোচনা বোধগম্য কারণেই চাপা রয়েছে। কিন্তু ৩১৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টের ৮জন বিরোধী দলীয় সদস্যের ৫ জনই এর প্রতিবাদে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের ১১জন সদস্য ভোট দিতে আসেননি। তাদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীর নায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী জেনারেল এম এ জি ওসমানী। শেখ মুজিব ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে শাসন করতে পারবেন। নতুন শাসনতন্ত্র ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত জাতীয় পার্লামেন্টের মেয়াদও ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে পার্লামেন্ট বছরে মাত্র দু’বার অল্প সময়ের জন্য বসবে। ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও কাউন্সিল অফ মিনিষ্টারস এর মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মনসুর আলীকে যথাক্রমে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট।

বাংলাদেশের ঘনায়মান আর্থিক ও সামাজিক সংকটে বিদেশী পর্যবেক্ষকগণ সন্দেহ করছেন যে, দেশে একনায়কত্বের প্রয়োজন আছে কিংবা শেখ মুজিবের আরো ক্ষমতার প্রয়োজন আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে যে নিশ্চিত দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শেখ মুজিবের নতুন ম্যান্ডেট তাতে তেমন কোন তারতম্য ঘটাতে পারবে কিনা? এক মাস আগে শেখ মুজিব জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন। অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বামপন্থী গেরিলা নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে, জরুরী আইন প্রয়োগে বিন্দুমাত্র সুশাসন (বর্তমানে সুশাসন বলতে কিছু নেই) পুনঃপ্রতিষ্ঠা আদৌ সম্ভব কিনা? নতুন প্রেসিডেন্টের যে আদৌও প্রশাসনিক দক্ষতা নেই তা গত বছরেই প্রমাণিত হয়েছে। তার ষ্টাইল হচ্ছে ডিকটেটরের স্টাইল। তিনি গুরুত্বহীন বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান এবং গুটিকয়েক আমলার প্রমোশনে ও তাদের অভিমতকে যথেষ্ট প্ৰাধান্য দেন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি প্রায়ই ফেলে রাখেন।

একদলীয় শাসন সৃষ্টির ফলে দুর্নীতি দূর না হয়ে বরং বাড়তে থাকবে। কেননা, উদ্ধত আওয়ামী লীগারদের চেক করতে পারবেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট। আর তিনি থাকবেন অতিরিক্ত কাজের চাপে সর্বদাই ব্যস্ত। সরকার বিরোধীরা যতই আত্মগোপন করতে বাধ্য হবে ততই গ্রাম-বাংলায় চরমপন্থী গেরিলা ও লুটতরাজকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকবে।”

ফার ইষ্টার্ণ ইকোনমিক রিভিউ-এর ১৯৭৫ সালের ১৪ই মার্চ সংখ্যায় হার্ডি ষ্টক উইল লেখেন, “আরেকটি এশীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হল। আরো একবার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে গণতন্ত্রকে ঝেটিয়ে বিদায় দেয়া হয়েছে। বৃটিশ শাসনের অবসানের পর এই দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্র অনুপযোগী বিবেচিত হয়েছে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানের বিদেহী আত্মা নিশ্চয়ই স্মিতহাস্যে মৃদুস্বরে বলছে, ‘আমি তোমাদের বলেছিলাম ……।’ ১৯৫৮ সালে আইয়ূব কর্তৃক ক্ষমতা জবরদখল গণতন্ত্র বিরোধী ছিল। তিনি নেতৃত্বের অভাব লক্ষ্য করেছিলেন এবং জাতীয় জীবনে যোগ্যব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানিক শূন্যতা পূরণ করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। ১৯৭৫ সালে সেই পটভূমি আদৌ নেই। শেখ আগেও বাংলাদেশের একমাত্র মুখ্য নেতা ছিলেন, এখনো আছেন। যে সময় তিনি আইয়ূবের রূপ পরিগ্রহ করেন তখন গণতন্ত্রে এমন কাটছাট হয়ে গিয়েছিল যে, তার ক্ষমতার অভাব ছিল এ কথা তিনি আদৌ বলতে পারতেন না। আইয়ুবের মত সেনা বাহিনীকে রাজনীতিতে জড়িত না করলেও সদ্য গঠিত একমাত্র জাতীয় দলে কয়েকজন সামরিক চাইকে কোঅপ্ট করে নেয়ার কৌশল গ্রহণ করেন তিনি। দ্বিতীয় বিপ্লবের আগেও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীকে ঠেঙ্গারে বাহিনী হিসেবে প্রয়োগ করার ক্ষমতার অধিকারী ছিল শেখ মুজিব। কেননা, সামরিক বাহিনীর কায়দায় গঠিত এবং মুজিবের ব্যক্তিগত বাহিনী বলে সাধারণভাবে পরিচিত রক্ষীবাহিনীকে বরাবরই অপ্রীতিকর কার্য সম্পাদনে নিয়োজিত করা হত নির্বিচারে। দাঙ্গা বিক্ষোভ দমন করা এবং সন্ত্রাসবাদী ও বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করা এগুলোও ছিল রক্ষীবাহিনীর কাজ। ‘নীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমন’ একচ্ছত্র ক্ষমতা গ্রহণের মামুলি অযুহাত মাত্র। আইয়ূব ও মুজিবের ক্ষমতা দখলে পার্থক্য রয়েছে। আইয়ূব ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন জাদরেল পাচারকারী ও কালোবাজারীকে পাকড়াও করেছিলেন। এতে সারা পাকিস্তানে বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। গোটা দেশে চালের দামও কমে গিয়েছিল। পরে অবশ্য দুর্নীতি আবার দেখা দেয়। এমনকি আইয়ুবের আত্মীয়-স্বজনরাও এতে জড়িয়ে পড়ে। বস্তুতঃ ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া এত সামান্য যে চাউলের দাম বেড়েই চলেছে। ‘শোষিতের গণতন্ত্র’-কে কোন সুযোগ না দিতে অনিচ্ছুক আইয়ূব-মুজিব চরিত্রের সাদৃশ্য সঠিকভাবে ফুটে উঠেছে জনৈক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক বুদ্ধিজীবির মন্তব্যে। তিনি বলেন, ‘আইয়ূব যে ভুল করেছিলেন শেখও ঠিক সেই ভুলই করছেন। আইয়ূব বিশ্বাস করতেন যে জনসাধারণ কেবলমাত্র অর্থেনৈতিক উন্নতিই চায়। তাই তিনি মানবাধিকারের বিনিময়ে অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পেছনে ছুটলেন। এর ফলেই মুজিব আন্দোলনের মওকা পেয়ে গেলেন। শেখ সে কথা ভুলে গেছেন অথবা ভাবেন তিনি তা ভুলে যেতে পারেন।’ বৃটিশ আমলে প্রশাসনিক দিক দিয়ে পূর্ববঙ্গ ছিল উপেক্ষিত। দেশ বিভাগের সময় ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে বাঙ্গালীর সংখ্যা এক হাতের আঙ্গুলে গোনা যেত। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের আমদানি হল। বাংলাদেশীরাও আজ খোলাখুলি স্বীকার করছেন যে, স্বাধীনতার পর কয়েকটি অত্যাবশ্যক সার্ভিসের বিশেষ করে রেলওয়ে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি ঘটেছে। আগে প্রধানতঃ বিহারীরাই এসব সার্ভিস চালাতো। এখন ওরা আর চাকুরিতে নেই।

কোন কোন দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা বিরোধী শাসন পদ্ধতি অধিকতর কার্যদক্ষতা অর্জন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা সম্ভব হবে কি না গভীর সন্দেহ রয়েছে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের নতুন শাসন পদ্ধতি সবকিছু প্রেসিডেন্টের হাতে অতিরিক্ত মাত্রায় কেন্দ্রীভূত করে চলেছে। সুকার্নো পাশ্চাত্য সাহায্যকারী দেশগুলোকে তীব্র ভৎসনা করেছিলেন। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়ার সাথে এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে শেখও অনূরূপভাবে পশ্চিমা জগতের সংবাদপত্রগুলোকে ঘা মেরেছেন। ‘বাংলাদেশ ধ্বসে পড়বে’ বিদেশী পত্রিকার এ ধরণের ভবিষ্যতবাণী সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলে শেখ জবাব দেন, ‘তাদের গোল্লায় যেতে বলে দিন। আমার শাসন নয়, তাদেরই বুদ্ধিমত্তা ধ্বসে পড়বে। পাশ্চাত্যের সংবাদপত্রগুলি শুধু সমালোচনা করছে আর উপদেশ দিচ্ছে। ১৯৭১ সালেও তারা তাই করেছিল। এখনো আবার করছে। এই উক্তিগুলো কৌতূহলজনক। কেননা, মুক্তি সংগ্রামের সময় বিদেশী সংবাদপত্রের ভূমিকা বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত প্রশংসাই করে এসেছে।”

২৪শে ফেব্রুয়ারী ‘৭৫ রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান এক আদেশবলে দেশে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করেন এবং নিজেকে দলীয় চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। ঘোষণার ৩নং আদেশে বলা হয়, “রাষ্ট্রপতি অন্য কোন নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত জাতীয় সংসদের অবলুপ্ত আওয়ামী লীগের দলীয় সকল সদস্য, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী সবাই ‘বাংলাদেশ-কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের’ সদস্য বলে গন্য হবেন।”

এ আদেশ অমান্য করে বাকশালে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বঙ্গবীর জনাব ওসমানী ও ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন তাদের সাংসদ পদে ইস্তফা দেন। বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ ও মোজাফফর ন্যাপ শেখ মুজিবের এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রণয়নকে অভিনন্দন জানান। তথাকথিত জাতীয় দল গঠিত হওয়ার ফলে দেশের সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটে। আওয়ামী লীগ, মোজাফফর ন্যাপ এবং মনি সিং এর কম্যুনিষ্ট পার্টি সামগ্রিকভাবে বাকশালে যোগদান করেন। সংসদের বিরোধী দলের ৮জন সদস্যের মধ্যে ৪জন বাকশালে যোগদান করেন। প্রবীণ নেতা জনাব আতাউর রহমান খানও বাকশালে যোগদান করে সুবিধাবাদী চরিত্র ও রাজনীতির এক নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ২রা জুন ‘৭৫ বাকশালে যোগদানের জন্য শেখ মুজিবর রহমানের কাছে ৯জন সম্পাদক আবেদন পেশ করেন। তারা হলেন বাংলাদেশ অবজারভার সম্পাদক ওবায়েদুল হক, জনাব নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক বজলুর রহমান, মর্নিং নিউজের সম্পাদক জনাব শামছুল হুদা, বাসস এর প্রধান সম্পাদক জাওয়াদুল করিম, বাংলাদেশ টাইমস ও বাংলার বাণীর নির্বাহী সম্পাদক শহীদুল হক, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক জনাব আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং বিপিআই সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান। ৬ই জুন ‘৭৫ বাকশালের সাংগঠনিক কাঠামো ও গঠনতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। তাতে দলের মহাসচিব মনোনীত হন মনসুর আলী। সচিব হন জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি, এবং আব্দুর রাজ্জাক। ঐ দিন বাকশালের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য হিসাবে ১১৫জনের নাম ঘোষণা করা হয়। তাতে উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সশস্ত্র বাহিনী প্রধানরা, বিডিআর এর মহাপরিচালক, রক্ষীবাহিনীর পরিচালক, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রমুখকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

দলের কার্যনির্বাহী পরিষদে থাকেন: (১) শেখ মুজিবর রহমান (২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম (৩) মনসুর আলী (৪) খন্দোকার মোশতাক আহমেদ (৫) আবু হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (৬) আব্দুল মালেক উকিল (৭) অধ্যাপক ইফসুফ আলী (৮) মনরঞ্জন ধর (৯) মহিউদ্দিন আহমেদ (১০) গাজী গোলাম মোস্তফা (১১) জিল্লুর রহমান (১২) শেখ ফজলুল হক মনি (১৩) আব্দুর রাজ্জাক।

কেন্দ্রিয় কমিটিতে থাকেন: (১) শেখ মুজিবর রহমান (২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম (৩) মনসুর আলী (৪) আব্দুল মালেক উকিল (৫) খন্দোকার মোশতাক আহমেদ (৬) কামরুজ্জামান (৭) মাহমুদ উল্লাহ (৮) আব্দুস সামাদ আজাদ (৯) ইউসুফ আলী (১০) ফনিভূষণ মজুমদার (১১) ডঃ কামাল হোসেন (১২) সোহরাব হোসেন (১৩) আব্দুল মান্নান (১৪) আব্দুর রব সেরনিয়াবাত (১৫) মনরঞ্জন ধর (১৬) আব্দুল মতিন (১৭) আসাদুজ্জামান (১৮) কোরবান আলী (১৯) ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক (২০) ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী (২১) তোফায়েল আহমেদ (২২) শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (২৩) আব্দুল মোমেন তালুকদার (২৪) দেওয়ান ফরিদ গাজী (২৫) অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী (২৬) তাহের উদ্দিন ঠাকুর (২৭) মোসলেম উদ্দিন খান (২৮) মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর (২৯) একেএম ওবায়দুর রহমান (৩০) ডঃ ক্ষিতিশচন্দ্র মন্ডল (৩১) রিয়াজুদ্দিন আহমদ (৩২) এম বায়তুল্লাহ (৩৩) রুহুল কুদ্দুস সচিব (৩৪) জিল্লুর রহমান (৩৫) মহিউদ্দিন আহমদ এমপি (৩৬) শেখ ফজলুল হক মনি (৩৭) আব্দুর রাজ্জাক (৩৮) শেখ শহীদুল ইসলাম (৩৯) আনোয়ার চৌধুরী (৪০) সাজেদা চৌধুরী (৪১) তসলিমা আবেদ (৪২) আব্দুর রহিম (৪৩) ওবায়দুল আউয়াল (৪৪) লুৎফর রহমান (৪৫) একে মুজিবর রহমান (৪৬) ডঃ মফিজ চৌধুরী (৪৭) ডঃ আলাউদ্দিন (৪৮) ডঃ আহসানুল হক (৪৯) রওশন আলী (৫০) আজিজুর রহমান আক্কাস (৫১) শেখ আবদুল আজিজ (৫২) সালাহউদ্দিন ইউসূফ (৫৩) মাইকেল সুশীল অধিকারি (৫৪) কাজী আব্দুল হাশেম (৫৫) মোল্লা জালাল উদ্দিন (৫৬) শামসুদ্দিন মোল্লা (৫৭) গৌর চন্দ্র বালা (৫৮) কাজী গোলাম মোস্তফা (৫৯) শামসুল হক (৬০) শামসুজ্জোহা (৬১) রফিকুদ্দিন ভূঁইয়া (৬২) সৈয়দ আহমদ (৬৩) শামসুর রহমান খান (৬৪) নূরুল হক (৬৫) এম এ ওহাব (৬৬) ক্যাপ্টেন সুজ্জাত আলী (৬৭) এম আর সিদ্দিক (৬৮) এমএ ওহাব (৬৯) চিত্ত রঞ্জন সুতার (৭০) সৈয়দা রাজিয়া বানু (৭১) আতাউর রহমান খান (৭২) খন্দোকার মোহাম্মদ ইলিয়াস (৭৩) সংঞ্জ সাইন (৭৪) অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ (৭৫) আতাউর রহমান (৭৬) পীর হাবিবুর রহমান (৭৭) সৈয়দ আলতাফ হোসেন (৭৮) মোহাম্মদ ফরহাদ (৭৯) মতিয়া চৌধুরী (৮০) হাজী দানেশ (৮১) তৌফিক ইমাম সচিব (৮২) নূরুল ইসলাম (৮৩) ফয়েজ উদ্দিন সচিব (৮৪) মাহবুবুর রহমান সচিব (৮৫) আব্দুল খালেক (৮৬) মুজিবুল হক সচিব (৮৭) আব্দুর রহিম সচিব (৮৮) মঈনুল ইসলাম সচিব (৮৯) সহিদুজ্জামান সচিব (৯০) আনিসুজ্জামান সচিব (৯১) ডঃ এ সাত্তার সচিব (৯২) এম এ সামাদ সচিব (৯৩) আবু তাহের সচিব (৯৪) আল হোসাইনী সচিব (৯৫) ডঃ তাজুল হোসেন সচিব (৯৬) মতিউর রহমান টিসিবি চেয়ারম্যান (৯৭) মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ (৯৮) এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দোকার (৯৯) কমোডর এমএইচ খান (১০০) মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান (১০১) একে নজিরউদ্দিন (১০২) ডঃ আব্দুল মতিন চৌধুরী (১০৩) ডঃ মাযহারুল ইসলাম (১০৪) ডঃ এনামুল হক (১০৫) এটিএম সৈয়দ হোসেন (১০৬) নূরুল ইসলাম আইজি পুলিশ (১০৭) ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম (১০৮) ডঃ নূরুল ইসলাম (পিজি হাসপাতাল) (১০৯) ওবায়দুল হক (সম্পাদক অবজারভার) (১১০) আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (ইত্তেফাক) (১১১) মিজানুর রহমান (বিপিআই) (১১২) মনোয়ারুল ইসলাম (১১৩) ব্রিগেডিয়ার এএমএম নূরুজ্জামান (রক্ষীবাহিনী প্রধান) (১১৪) কামরুজ্জামান শিক্ষক সমিতি (১১৫) ডঃ মাজহার আলী কাদরী।

একই ঘোষণায় বাকশালের পাচঁটি অঙ্গ সংগঠনও গঠন করা হয়। সেগুলো হচ্ছে:

জাতীয় কৃষকলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, জাতীয় মহিলা লীগ, জাতীয় যুবলীগ ও জাতীয় ছাত্রলীগ। এগুলোর সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন যথাক্রমে ফনিভূষণ মজুমদার, অধ্যাপক ইউসূফ আলী, সাজেদা চৌধুরী, তোফায়েল আহমদ ও শেখ শহীদুল ইসলাম। এসমস্ত সংগঠনের কেন্দ্রিয় কমিটিগুলোতে মোজাফফর ন্যাপ ও মনি সিংএর কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতাদের গ্রহণ করা হয়। বাকশালের এ সূত্র ধরেই ১৬ই জুন ‘সংবাদপত্র বাতিল অধ্যাদেশ’ জারি করা হয়। তার বলে পার্টি নিয়ন্ত্রণাধীন শুধুমাত্র চারটি দৈনিক ও কয়েকটি সাপ্তাহিক বাদে সকল পত্র-পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। গণতন্ত্রের হত্যাযজ্ঞ শেষে দেশ জুড়ে চলে তান্ডব উৎসব। রুদ্ধশ্বাস মানুষ জীবনের নিরাপত্তা হারিয়ে জন্মভূমিতেই বন্দী হয়ে পড়েন স্বৈরশাসনের নিষ্পেষনে ।

১৯৭৫ সালের আগে আইনজীবিরা সুপ্রীম কোর্ট এবং হাই কোর্টের মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে অনেক বিষয়ে রায় দেন। সরকার কর্তৃক বেআইনীভাবে আটককৃত অনেক রাজবন্দীদের তারা মুক্তিও দিয়েছিলেন সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। রক্ষীবাহিনীর অসামাজিক বেআইনী কার্যকলাপ সম্পর্কে আইনজীবিরা বিশেষভাবে সমালোচনা করতে থাকেন। কোন একটি কেসের ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্ট রায় দানকালে বলে, “দেশের প্রচলিত সব আইন ও প্রচলিত বিধি লঙ্ঘন করে জাতীয় রক্ষীবাহিনী তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।” সুপ্রীম কোর্ট অভিমত প্রকাশ করে, “রক্ষীবাহিনী কোন আইনের ভিত্তিতে তাদের কার্যকলাপ জারি রেখেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।” এ ব্যাপারে Far Eastern Economic Review-এর জানুয়ারীর ১০তাং ১৯৭৫- এ প্রকাশিত প্রতিবেদন – Mujib’s Private Army’ এর প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আইনজীবিদের সরকার বিরোধী কার্যকলাপে ক্ষুব্ধ হয়ে শেখ মুজিব আইন বিভাগের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেবার জন্য আদেশ জারি করেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারী মাসে তার অধ্যাদেশে বলা হয়, “দেশের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারকগণ দেশের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক নিয়োগ করা হবে। প্রেসিডেন্টের আদেশক্রমে যেকোন বিচারককে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া যাবে তার খারাপ ব্যবহার কিংবা অযোগ্যতার কারণে।” ফলে আইন বিভাগ সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় প্রধানের ত্রিয়াণকে পরিণত করা হয়।

জনগণের ফান্ডামেন্টাল রাইটস ও মানবিক অধিকার কায়েম রাখার জন্য সুপ্রীম কোর্টের সাহায্য নেবার পথও বন্ধ করে দেন শেখ মুজিবর রহমান। সংশোধিত বিধিতে বলা হয়, “এ আইনের বলে সংসদ গণতান্ত্রিক কোর্ট, ট্রাইবুনাল কিংবা কমিশন গঠন করতে পারবে। এসমস্ত গঠিত করা হবে জনগণের ফান্ডামেন্টাল এবং মানবিক অধিকারগুলো যে সম্পর্কে শাসনতন্ত্রের পার্ট থ্রি-তে বর্ণিত রয়েছে সেগুলোর নিশ্চয়তা প্রধান করার স্বার্থে।” এভাবেই সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এবং দেশের সব আইন তার মুঠোয় নিয়ে শেখ মুজিব দেশে কায়েম করলেন স্বৈরাচারী একনায়কত্ব। শ্লোগান তোলা হল, ‘এক নেতা, এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ’।

এ শ্লোগান গণতান্ত্রিক শ্লোগান নয়। এটা ছিল নাৎসী জার্মানীর হিটলার কিংবা ইটালীর মুসলিনির শ্লোগান। ব্যক্তি পুজাঁ কোন নেতার ভাবমুর্তিকে উজ্জ্বল করার পরিবর্তে তার চরম ক্ষতিই সাধন করেছে। এর নজির ইতিহাসে অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে।

১৯৭৫ সালের ২১শে জুন রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে সারা বাংলাদেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করা হয়। ১৬ই জুলাই শেখ মুজিব ৬১ জন জেলা গভর্ণরের নাম ঘোষণা করেন। তারা ১লা সেপ্টেম্বর থেকে জেলা প্রশাসনের সর্বময় অধিকর্তা হয়ে বসবেন সেটাই ছিল সরকারি সিদ্ধান্ত। ৬১জনের মাঝে ৪৪ জন ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা এবং বাকি ২৭ জন ছিলেন বাছাই করা সাংসদ। জাতীয় সংসদের মধ্য থেকে বাছাই করে নেয়া সদস্যবৃন্দ। নিয়োজিত গভর্ণরদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন প্রাক্তন CSP অফিসার, ৬ জন ছিলেন প্রাক্তন EPCS অফিসার, কাদের সিদ্দিকী, সেনা বাহিনীর একজন কর্নেল এবং পার্বত্য চট্টগাম থেকে দু’জন উপজাতীয় নেতা।

এই ৬১জন গভর্ণরদের বিশেষ রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করা হয়। প্ল্যান অনুযায়ী ১৬ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে প্রশিক্ষণ শেষে তারা যার যার জেলায় গিয়ে তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। তাদের প্রত্যেকের অধিনে দেয়া হবে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অর্ধেক ব্যাটেলিয়ন। তারা সরাসরিভাবে শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টের কাছেই জবাবদিহি থাকবেন। রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে ১৯৮০ সালের মধ্যে প্রতি গভর্ণরের অধিনে একটি পূর্ণাঙ্গ রক্ষীবাহিনীর ব্যাটেলিয়ন নিয়োগ করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। এসমস্ত গভর্ণরদের অধিনে রক্ষীবাহিনী নিয়োগ করার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের অধিনস্ত জেলায় বাকশাল বিরোধীদের সমূলে নির্মূল করে মুজিব ও তার পারিবারিক শাসন বংশানুক্রমে বাংলাদেশের মাটিতে পাকাপোক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশকে ভারতের পদানত একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা।

জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের লিষ্ট তৈরি করায় সাহায্য করতে। অর্থনৈতিক সংকট, হতাশা, শেখ মুজিবের ভারত তোষণ নীতি এবং দুর্নীতিপরায়ন অত্যাচারী সরকার সর্ম্পকে জনগণের নেতিবাচক মনোভাব, আইন-শৃঙ্খলা ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য সবকিছু মিলিয়ে দেশে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে তখনকার সবকয়টি প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অগ্রণীর ভূমিকায় এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। দেশের সাধারণ গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন চিরজীবন দেখেছেন মাওলানা ভাসানী। মার্কসীয় দর্শনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের মুক্তি আসতে পারে এটা সম্পূর্ণভাবে মাওলানা ভাসানী কখনই মেনে নেননি। ঐতিহ্যবাহী ইসলামী রাষ্ট্রীয় “ধারণাকে তিনি অধুনাকালের বৈজ্ঞানিক ও বৈপবিক রাষ্ট্রীয় চেতনায় বাস্তবায়িত করে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি এনে রাষ্ট্রীয় দুঃশাসনের অবসান করতে চেয়েছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক চিন্তার ব্যাখ্যায় তিনি সর্বদা স্রষ্টা ও সৃষ্টির হকের কথা বলতেন। এ সমস্ত কিছু নতুন কথা নয়। ইউরোপীয় রাজনৈতিক দর্শন, ক্রিশ্চিয়ান সোস্যালিজম ও আঞ্চলিক সাম্যবাদ, ইউরো কম্যুনিজম এর মধ্যেও একই ভাবধারা বিরাজমান। ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো চেয়েছিলেন ধর্ম, জাতীয়তাবাদ এবং কম্যুনিজমকে একত্রিকরণের মাধ্যমে ‘নাসাকম’ কায়েম করতে। পরে কম্যুনিজম বাদ দিয়ে সে জায়গায় সোস্যালিজম গ্রহণ করে তিনি স্থাপন করেন “নাসাসোস’ মাওলানা ভাসানী চেয়েছিলেন ধর্ম ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে কায়েম করতে ‘হুকুমতে রব্বানিয়া’ : ১৯৭১ সালে ভারতে নজরবন্দী হিসেবে মাওলানা ভাসানীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জনাব সাইফুল ইসলাম যখন শেষ বিদায় নিয়ে দেশে ফিরছিলেন তখন মাওলানা ভাসানী তাকে বলেছিলেন,

—চাইছিলাম লন্ডন যাব, প্রবাসী সরকার গঠন করব। কিন্তু কুটুম বাড়ি বেড়াইয়া গেলাম। অনেক বড় স্বপ্ন দেইখা দায়িত্ব কান্ধে নিয়া আমার সাথে আসছিলা। স্বপ্ন আমারও ছিল, বাংলার দুঃখী গরীব মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। সেটা পাইতে হইলে আর একটা লড়াই লড়তে হইবো। এতো রক্ত ঝরাইলো কিন্তু দ্যাশের মানুষ তো মুক্তি পাইবো না। আধা স্বাধীনতা নিয়া দ্যাশে ফিরলে আবার লাইগবো খটাখটি, তাই ভাইবতাছি—-।

—হুজুর কথা ঠিক। কিন্তু সে লড়াইতো বাইরের দুশমনের সাথে সরাসরি নয়। দেশের মধ্যেই সে লড়াই ঘরে ঘরে।

—সেই জন্যই আরও কঠিন আরও হিংসার মনডা পোক্ত কইরা নিয়া যাইতে হইবো

একাত্তরের বিচক্ষণ নেতা তার অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে ভবিষ্যতের যে অবস্থা দেখেছিলেন ঠিক সে অবস্থাই পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছিল মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালী চক্র বাংলার মাটিতে স্বৈরশাসনের একনায়কত্ব কায়েম করে। স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জনগণকে মুক্ত করার সংগ্রামে অগ্রণীয় ভূমিকা গ্রহণ করে অকুতোভয় মাওলানা ভাসানী ১৯৭১ সালে জনাব সাইফুল ইসলামের কাছে তার ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ঠিক সেই দায়িত্বই আন্তরিকভাবে পালন করেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে আপোষহীন ছিলেন মাওলানা। না ভারতের প্রতি দুর্বলতা, না, পাকিস্তানের পায়রবী। প্রয়োজনে চৈনীক নীতির তিরষ্কার, মার্কিনীদের অবিশ্বাস, সোভিয়েতের সমালোচক এই হল সিংহ পুরুষ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ।

আওয়ামী-বাকশাল বিরোধী আন্দোলনকালে বিভিন্ন বিরোধী দলগুলো সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। তাদের দলীয় অবস্থা, আন্দোলনের স্বরূপ, দলীয় নীতি ও কার্যপ্রনালী, সাফল্য, ব্যর্থতা, দলীয় দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্ন তৎপরতা প্রভৃতি বিষয় এবং তাদের প্রতি জনসমর্থন সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারা যাবে এ আলোচনার মাধ্যমে। বিচ্ছিন্নভাবে তাদের দলীয় প্রতিরোধ স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে কতটুকু কার্যকরী ছিল এবং তারা কি কখনও একনায়কত্বের অবসান ঘটাতে পারত কিনা সে সম্পর্কেও জনগণের মনোভাব বোঝা যাবে। সে সংগ্রাম ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি কেন? ঐক্য গঠন করার পথে বাধা ছিল কোথায়? ঐক্য প্রতিষ্ঠার আদৌ কোন চেষ্টা হয়েছিল কিনা? এসমস্ত বিরোধী দলগুলোর প্রতিরোধ সংগ্রামের মূল উৎপাটন করার ক্ষেত্রে স্বৈরাচারী সরকার কি নীতি গ্রহণ করেছিল এবং তারা তাদের উদ্দেশ্যে কতটুকু সফলকাম হয়েছিল, এসমস্ত প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাবার মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক পট পরিবর্তনের যুক্তিকতা।

গোড়া থেকেই আওয়ামী-বাকশালী বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। কিন্তু তার সেই বিরোধিতার আগুন সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে জাতিকে সংগঠিত করতে পারেনি তার দল। ‘৭১ এর সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে ভাসানী ন্যাপের দলীয় কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর ভেঙ্গে পড়া সেই দলকে আবার গড়ে তোলার কঠিন দায়িত্ব গ্রহণ করার মত অবস্থা ছিল না মাওলানা ভাসানীর। বার্ধক্যের জড়া এবং ভগ্ন স্বাস্থ্যই ছিল এর প্রধান কারণ।

আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসনের বিরোধিতা করেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই জন্ম হয়েছিল জাসদের। ষাটের দশকের প্রথম থেকেই আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একাংশ দাবি জানায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই কায়েম করতে হবে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। জনাব সিরাজুল আলম খানই ছিলেন এ দাবির মূল প্রবক্তা। জনাব আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকেই জনগণের মধ্যে এ দাবির পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা করেন এবং এ দাবির পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এই গ্রুপ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদ অধিবেশন বাতিল করে দিলে ১লা মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন বলে দাবি তোলেন। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে প্রসিদ্ধ বটতলায় জনাব রব সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এর পরদিনেই এক সভায় শেখ মুজিবের উপস্থিতিতে হঠাৎ করেই জনাব সিরাজ স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে এক ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। রব-সিরাজ গ্রুপ মনে করেন ইয়াহিয়া সরকারের সাথে শেখ মুজিবের আলোচনার ফলে জনগণের বিপ্লবী চেতনা নিস্তেজ হয়ে পড়ছিল; তাই তারা শেখ মুজিবকে সব আলোচনা বন্ধ করে দেবার জন্য অনুরোধ জানান। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ছাত্রলীগের ঘোষণাপত্র এর সাক্ষ্য দেয়। ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করেছিলেন জনাব মোহাম্মদ ইকরামুল হক. ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক মুক্তিযুদ্ধকালে তারা জনাব তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত প্রবাসী সরকারের প্রতি আস্থা প্রদর্শন না করে জনাব তাজুদ্দিনকে একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করার পরামর্শ দেন ও তাদের কথা মেনে নেবার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। ফলে জনাব তাজুদ্দিনের সাথে তাদের মত পার্থক্য দেখা দেয়। জনাব তাজুদ্দিন তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে আন্দোলনের সময় শেখ মুজিবের উপর এই গ্রুপের প্রচন্ড প্রভাব ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে তাজুদ্দিন যখন তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন তখন তারা বুঝতে পারলেন প্রবাসী সরকারের অধিনে মুক্তিযুদ্ধ করলে তারা তাদের প্রভাব ও ক্ষমতা দু’টোই হারাবেন। তাই তারা পরবর্তিকালে ভারতীয় সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থা র’ প্রধান জেনারেল ওবান সিং এর সহায়তায় তাজুদ্দিন সরকারের আওতার বাইরে মুজিববাহিনী গড়ে তোলেন। এ বাহিনীর সার্বিক কর্তৃত্ব ছিল তাদের হাতে। ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এ বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলতে ভারত সরকার সাহায্য প্রদান করে। যদিও মুজিবের ফিরে আসার পর তার প্রধানাই বজায় রাখার জন্য আপাতঃ দৃষ্টিতে এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে বলে জনগণ মনে করে। কিন্তু রব-সিরাজ গ্রুপ মুজিব পূজায় কতটুকু বিশ্বাস রাখতেন সেটা ছিল একটা বড় প্রশ্ন। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৭২ সালেই ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, এর মাঝে ভাঙ্গন সৃষ্টি করেন সর্বদা পর্দার অন্তরালে থাকা নেপথ্যের নায়ক জনাব সিরাজুল আলম খান। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সমন্বয়ে ৩১শে অক্টেবর ১৯৭২ সালে মেজর জলিলকে প্রেসিডেন্ট এবং জনাব রবকে সাধারণ সম্পাদক করে আত্মপ্রকাশ ঘটে নতুন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ বা জাসদ-এর। নতুন রাজনৈতিক দলের মূল তাত্ত্বিক গুরু হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন জনাব সিরাজুল আলম খান। জাসদের অভিমত ছিল- বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন জাতির মুক্তি সংগ্রামের রূপ নিচ্ছিল ঠিক তখনই তাকে বন্ধ করে দেয়া হয় চক্রান্তের মাধ্যমে। স্বাধীনতা সংগ্রামকাল থেকেই জাসদ নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে আসছিলেন বলে তারা দাবি করেন। তাদের সেই প্রতিরোধ সংগ্রামের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর। তারা দাবি তোলেন জনগণের ৮% সমর্থনপুষ্ট আওয়ামী লীগ জাতীয় সম্পদের ৮৫% লুট করে নিয়ে নিজেদের সম্পদ বৃদ্ধি করছে। (জাসদের ১৯৭৩ সালের ঘোষণাপত্র দ্রষ্টব্য)। জাসদ নিজেকে সত্যিকারের সর্বহারাদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ (BCL) এর গণসংগঠক হিসাবে দাবি করে। বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট লীগ গঠন করেন জনাব সিরাজুল আলম খান। এটি ছিল একটি গোপন সংগঠন। যুদ্ধকালীন সময় থেকে জাসদের জন্ম পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাপারে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৭৫ সালে সরকারি আদেশে বন্ধ করে দেয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ কতৃর্ক গণকণ্ঠ নামে একটি জনপ্রিয় পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। অতি পরিচিত ও বিখ্যাত প্রগতিশীল কবি আল মাহমুদ ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক।

দেশের অন্যান্য বিপ্লবী দলগুলোর মতই দেশের বিভিন্ন সমস্যাগুলি জনগণের কাছে তুলে ধরে জাসদ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগের ছাত্রফ্রন্ট বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলনে ১৯৭২-৭৩ সালের বার্ষিক কার্যবিবরণীতে তৎকালীন জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বসমূহের বিশ্লেষন করে জাতীয় বিপ্লবকে বিজয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে দ্বন্দ্বগুলোর অবসান ঘটানোর জন্য বিপ্লবের বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে দলিলে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দেয়া হয়। বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ সমাজতন্ত্রের উত্তরণে তিনটি ধাপ নির্ণয় করে বলে, “স্বাধীনতা সংগ্রামের তৃতীয় ধাপের পরিসমাপ্তি ঘটবে আওয়ামী লীগ ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টদের সাথে সর্বহারাদের রক্তক্ষয়ী ভবিষ্যত সংগ্রামের মাধ্যমে।” সংসদীয় রাজনীতিকে স্বার্থবাদী মহলের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার হিসাবে বর্ণনা করা হয়। গ্রামের সামন্তবাদীর অবশেষ, মধ্যসত্বভোগী এবং উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীদের সর্বহারাদের শত্রু শ্রেণী বলে অভিহিত করা হয় সেই দলিলে। তাদের দলিলে বলা হয় জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারার শাসন কায়েম হওয়ার আগে জনগণ বহিঃশোষণের শিকারে পরিণত হবে কারণ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদের পদানত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগের তত্ত্ব অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদী শোষণ পরিচালিত হবে মূলতঃ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ঋন ও অনুদানের মাধ্যমে। তবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হবে রুশ ও ভারতের দ্বারাও। এজন্য প্রয়োজনীয় শোষণমূলক অর্থনৈতিক সম্পর্কের নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তাদের রিপোর্টে বলা হয়- যুক্তিহীন এবং অন্যায়ভাবে ঢাকার পরিবর্তে দিল্লীতে ইন্দো-বাংলাদেশ জুট কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ মনে করে কোন এক পর্যায়ে গণচীন বাঙ্গালীদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে। এই প্রেক্ষিতে যদিও কম্যুনিষ্ট লীগ আন্তর্জাতিক কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের দ্বন্দ্বের বাইরে নিজেদের রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল; তথাপি চীনপন্থী অন্যান্য সাম্যবাদী লেনিনবাদী জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে বন্ধুসুলভ মনোভাব পোষণ করার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হয়েছিল রিপোর্টে। জাসদ মুক্তি বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের মাঝ থেকে দলীয় সদস্য রিক্রুট করতে থাকে। সেনা বাহিনীর মধ্যেও তাদের প্রকাশনী লাল ইশতেহার এর মাধ্যমে গোপন সেল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে জাসদ।

২০শে জানুয়ারী ১৯৭৪ সালে জাসদ, বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট লীগ এবং জাতীয় শ্রমিক লীগ (জাসদপন্থী) যুক্তভাবে বাংলাদেশের উপর মার্কিন, রুশ এবং ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরোধিতা করে এক হরতালের ডাক দেয় : হরতালের সময় নেতারা শিক্ষক এবং শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবি জানান। তারা বাংলাদেশের সর্বোপরিসরে দুর্নীতি, বিশেষ জরুরী আইন, সরকারের স্বজনপ্রীতি এবং বিশেষভাবে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মধ্যে পারমিট লাইসেন্স বিতরণের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দেশব্যাপী সেদিন পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ১৭ই মার্চের মধ্যে সরকার তাদের দাবি না মানলে তারা ঘেরাও এর হুমকি দেন। ১৭ই মার্চ জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে। পুলিশ ঘেরাও ভঙ্গ করে। পুলিশের গুলিতে ৩জন নিহত ও ১৪ জন গুরুতরভাবে আহত হন। মেজর জলিল, জনাব রব এবং আরো ৪০জন জাসদ কর্মী আহত অবস্থায় বন্দী হন। গোপন সংগঠনের অন্যান্য নেতাদের সাথে জনাব সিরাজুল আলম খান সেদিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। পরে তারা গ্রামাঞ্চলে তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। সেদিনের ঘটনাকে অনেকে চরম হঠকারী প্ররোচণা বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। জনাব সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জাসদ সম্পর্কে তার ‘স্বাধীনতার স্পৃহা সাম্যের ভয়’ গ্রন্থে লেখেন, “মুসলিম লীগের ঘর ভেঙ্গে একদা আওয়ামী লীগ বের হয়ে এসেছিল। অনেকটা সেই পদ্ধতিতেই আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে বের হয়ে এসেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। এরা নিজেদেরকে বলছে র‍্যাডিকেল-চরমপন্থী। তাদের তরুণ ও বিরাট কর্মী বাহিনী যে সমাজতন্ত্রের ডাকেই এই দলে এসে যোগ দিয়েছিল তাতে সন্দেহের কোনই কারণ নেই। কিন্তু নেতৃত্বে যারা ছিলেন তারা মনে হয় সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। আওয়ামী লীগারই ছিলেন আসলে। তাদের ইচ্ছা ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করবেন। কিন্তু শেখ মুজিব তার অবস্থান ছেড়ে বিপ্লবী হতে রাজি হননি ফলে এরা এগিয়ে গেছেন নিজেদের পথ ধরে। এদের দলের নামের সঙ্গে ‘জাতীয়’ এর যোগাযোগ আপতিক ঘটনা বলে মনে হয় না। এরাও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন। নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থ ই দেখছিলেন (যার সঙ্গে তাদের নিজেদের ভবিষ্যত ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত)। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামের আওয়াজ দিয়েছেন যাতে লোক জড়ো করা যায়, নায়ক হওয়া যায় নতুন প্রজন্মের ও নতুন বাংলাদেশের। শেখ মুজিব যদি আর না ফেরেন তাহলে বামপন্থীদের কি করে মোকাবেলা করা যাবে তার আগাম ব্যবস্থা হিসেবে এরা একাত্তরে মুজিববাহিনী গড়েছিলেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাদের রাজনীতি ছিল বুজুয়াদের রাজনীতিই। যদিও তাদের আওয়াজগুলো ছিল ‘বিপ্লবী’; ফলে তাদের নেতারা জাতীয় পুর্নগঠনের আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকেই সমর্থন দান করে যাচ্ছিলেন এতে বিস্ময়ের কোন অবকাশ নেই।”

তার এই বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা যাচাই করবার ভার রইলো পাঠকদের উপর। জাসদের এবং মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি প্রক্রিয়া থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে উঠে। ভারতীয় সরকার চার খলিফার মাধ্যমে প্রথমে মুজিববাহিনী, পরে খলিফাদের মূল ব্যক্তিত্ব জনাব সিরাজুল আলম খানের প্রচেষ্টায় জাসদ সৃষ্টি হওয়ায় বিশেষভাবে উপকৃত হয়। শুধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এবং ‘র’ প্রধান জেনারেল ওবান সিং এর সাথেই জনাব সিরাজুল আলম খানের বিশেষ সম্পর্ক ছিল তা নয়; সংগ্রামকালে ১৯৭১ সালে ভারতের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্রী জয় প্রকাশ নারায়ণের সাথেও জনাব সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। ১৯৭১ সালে জনাব সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রনেতারা দিল্লী গিয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাজুদ্দিনের বিরোধিতা করে তাদের নেতৃত্বে মুজিববাহিনী গঠন করার প্রস্তাব পেশ করলে ভারত সরকার প্রধান শ্রীমতি ইন্দীরা গান্ধী ও ‘র’ প্রধান জেনারেল ওবান সিং তাদের সেই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন মূলতঃ দু’টো সুদূরপ্রসারী কারণে।

প্রথমত: স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে এদের গুটি হিসাবে ব্যবহার করার জন্যে।

দ্বিতীয়ত: এ বাহিনীর মাধ্যমে মুজিব ও তার সরকারকে সম্পুর্ণভাবে ভারতীয় সরকারের উপর নির্ভরশীল করে তুলে শেখ মুজিবকে নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে। অনেকের মতে জাসদকে আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল ভারতের ক্ষমতা বলয়ের একাংশের সমর্থন ও মদদেই। জাসদের মূল্যায়ন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে যেভাবেই করা হোক না কেন একটি সত্যকে কোন ঐতিহাসিকই অস্বীকার করতে পারবেন না- স্বৈরাচারী নির্যাতনের হাত থেকে জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি অর্জন করার জন্য জাসদের ডাকে হাজার হাজার নিবেদিত প্রাণ কর্মী আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। নেতারা কে কি ভেবেছিলেন সেটা নিশ্চয়ই গবেষণার বিষয়, তবে কর্মীদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের মধ্যে ছিল না কোন খাদ কোন কলুশতা। মুজিবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তাদের বীরোচিত সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতিটি প্রজন্ম। তাদের রক্ত প্রেরণা যোগাবে প্রতিটি বাংলাদেশী দেশপ্রেমিককে তাদের ভবিষ্যত সংগ্রামে। তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার সঠিক মূল্যায়নের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে ভবিষ্যতের সঠিক দিক নির্দেশনা 1 আওয়ামী-বাকশালী শাসনের বিরোধিতা করেছিল বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী (BCPL)। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পিকিংপন্থী ৫টি কম্যুনিষ্ট গ্রুপ একত্রিত হয়ে যে বিপ্লবী সমন্বয় কমিটি কোলকাতায় গঠন করেছিল তাদেরই চারটি গ্রুপের ঐক্যের মাধ্যমে স্বাধীনতার পর সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী। এ পার্টিতে যোগ দেয় (১) কম্যুনিষ্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি (২) পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিষ্ট পার্টি মার্কসবাদী, লেনিনবাদী (৩) খুলনার কিছু কম্যুনিষ্ট কর্মী জনাব মারুফ হোসেন ও ডঃ সাইদুর দাহারের নেতৃত্বে। (৪) জনাব নাসিম খানের নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক কম্যুনিষ্ট। এই দলের নেতারা মনে করেন পূর্ব বাংলায় কম্যুনিষ্টরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত থাকায় স্বাধীনতা সংগ্রামে কম্যুনিষ্টদের পক্ষে নেতৃত্ব দান করা সম্ভব হয়নি। তাই তারা কম্যুনিষ্ট ঐক্য গঠন করে অসম্পূর্ণ বিপ্লব সম্পূর্ণ করার আহ্বান জানান। ‘একটি ঐক্যবদ্ধ কম্যুনিষ্ট পার্টি গড়ে তুলুন’ শিরোনামের একটি ইশতেহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট সংহতি কেন্দ্র এ আহ্বান ঘোষণা করে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। এরই ফলে গঠন করা হয় বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী (BCPL)। এই পার্টি প্রকাশ্য এবং একই সাথে গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। BCPL বাংলাদেশ বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নামে একটি ছাত্রফ্রন্টও গঠন করেন। শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য গঠন করা হয় বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন। পরবর্তিকালে বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী দল তাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (UPP) গঠন করেন। ১৯৭৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জনাব নাসিম আলী খান এই রাজনৈতিক দলের ঘোষণা করেন। BCI এর রাজনৈতিক দর্শনের সাথে BCPL এর দর্শনের মিল পাওয়া যায়। দু’টো দলের মতেই বাংলাদেশের জাতীয় বিপ্লব অসম্পূর্ণ থেকে যায় ১৯৭১ সালে, যেহেতু স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব চলে গিয়েছিল বুর্জুয়াদের হাতে। দু’দলই অভিমত পোষণ করে সোভিয়েত রাশিয়া একটি সংশোধনবাদী দেশ এবং রাশিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নাগপাশে আবদ্ধ করা। ভারতকে ও দু’টো দলই সম্প্রসারণবাদী শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে। কিন্তু দু’টো দলই ভারতের নকশাল আন্দোলনের সমালোচনা করে এবং আন্দোলনকে শৃঙ্খলাহীন হঠকারীতা বলে আখ্যায়িত করে। (দ্রষ্টব্য: বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট পার্টি লেনিনবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক শ্রী অমল সেনের ১৯৭২ সালের ঘোষণাপত্র।) BCL এর তুলনায় তাদের গণসংগঠন শ্রমিক এবং ছাত্রসংগঠন অনেক দুর্বল ছিল ফলে দেশব্যাপী তাদের আবেদনও ছিল কম এবং অঞ্চলভিত্তিক। যদিও BCPL এর বেশিরভাগ নীতি আদর্শের সাথে মিল ছিল দেবেন সিকদার ও আবুল বাশারের নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) মূল সমন্বয় কমিটির অপর একটি দলের তবুও সামান্য কয়েকটি বিষয়ে মত পার্থক্যের ফলে এ দলটি BCPL এর সাথে ঐক্য স্থাপন করা থেকে বিরত থাকে। এই দলটি বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানী নির্যাতনকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল কারণ বলে আখ্যায়িত করে স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের উপর ভারতের আধিপত্যকেই মূল দ্বন্দ্ব বলে নির্ধারণ করে। এ দলের নেতৃবৃন্দ অভিমত পোষণ করেন ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সার্বিক মুক্তি সংগ্রামে গণচীনের কম্যুনিষ্ট পার্টিই মুখ্য ভূমিকা রাখবে। এ ব্যাপারে BCPL নেতৃবৃন্দের অভিমত ছিল কিছুটা নমনীয়। এ ব্যাপারে বিশদভাবে জানতে হলে পাঠকদের ১৯৭২ সালে ‘পূর্ববাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টির আবেদন’ নামে সলিডারিটি সেন্টার অফ বাংলাদেশ কম্যুনিষ্ট কর্তৃক প্রকাশিত ইশতেহারটি এবং ‘বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলুন’ BCPL কর্তৃক প্রকাশিত ইশতেহার দু’টি পড়ে দেখতে হবে : সিকদার-বাশার গ্রুপের পার্টিকে পরে বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি বলা হয়। এই দলও প্রকাশ্য এবং গোপন রাজনীতি পাশাপাশি চালিয়ে যাবার পক্ষে ঘোষণা দেয়। এ দলেরও নিজস্ব ছাত্র, শ্রমিক সংগঠন গঠন করেন নেতৃবৃন্দ। কৌশলগত কারণে এ দলটি সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের পক্ষে মত দেয়। BCPL এবং BCP দু’টো দলই প্রকাশ্য গণসংগঠন এবং পার্টি সেল গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। এদের ছাড়া আরো চারটি রাজনৈতিক সংগঠন শুধুমাত্র তাদের গোপন পার্টি সেল এবং গোপন সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমে তাদের তৎপরতা চালাতে থাকে। এই চারটি দলের দু’টো দল ছিল EPCP (ML) থেকে বেরিয়ে আসা কম্যুনিষ্টদের নিয়ে গঠিত। তৃতীয় দলটি ছিল পূর্ববাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা একটি অংশ। পূর্ব বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে সিকদার-বাশারও গঠন করেছিল BCP (বাংলার কম্যুনিষ্ট পার্টি)। চতুর্থ দলটি ছিল এসমস্ত দলগুলোর উৎস থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে গড়ে ওঠা সর্বহারা পার্টি (পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি)। বিপ্লবী নেতা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে গঠিত হয় পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন। এ আন্দোলন থেকেই পরে গড়ে উঠে সর্বহারা পার্টি। ১৯৭৫ সালে মুজিব সরকারের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই পার্টির নেতৃত্ব দেন। এ দলের নেতৃত্বে মূলতঃ ছিলেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত ছাত্রবৃন্দ। যার ফলে তাদের বিপ্লব সম্পর্কীয় গবেষণা এবং প্রচারণা অন্যান্য পার্টিগুলোর চেয়ে ছিল ভিন্নতর এবং অধিক কার্যকরী। লাল ঝানডা এবং সংবাদ বুলেটিন ছাড়াও এ পার্টি নিয়মিতভাবে তাদের কেন্দ্রিয় কমিটির বৈঠক সংক্রান্ত এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর লিখিত দলিল প্রকাশ করতো। বেশিরভাগ দলিলগুলো জীবিত অবস্থায় ছিল সিরাজ সিকদারের নিজ হাতে লেখা। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল সুবিন্যাস্ত এবং প্রচার মাধ্যম ছিল অতি উত্তম। দেশের যে কোন প্রান্তে তাদের প্রকাশিত দলিলপত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত। সর্বহারা পার্টি অন্যান্য প্রগতিশীল ও বিপ্লবী পার্টিগুলোর সাথে একমত হয়ে মত প্রকাশ করে যে, স্বাধীনতা সংগ্রামকে তড়িঘড়ি করে শেষ করে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় বাংলাদেশের বিপ্লব অসম্পূর্ণ থেকে যায় আওয়ামী লীগ সরকারকে তারা ভারতের পুতুল সরকার বলে অভিহিত করেন। পার্টির প্রকাশনায় প্রচারিত হয় স্বাধীনতার পর ভারতের সহায়তায় ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে লুটপাট করে ভারতীয় নীল নকশা বাস্তবায়নের পরিল্পনাকেই সহায়তা করতে থাকে। সর্বহারা পার্টি মনে করে রক্ষীবাহিনীর সৃষ্টির মাধ্যমে ভারত বিকল্প প্রথায় বাংলাদেশে তাদের স্বার্থ বজিয়ে রাখার উদ্দেশ্য তাদের সামরিক অবস্থানকেই অটুট রাখে। বাংলাদেশ আওয়ামী সরকারের অধিন মার্কিন ও রুশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণের হুমকির সম্মুখীন বলেও সর্বহারা পার্টি জনগণকে হুশিয়ার করে দেয়। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের আহ্বানকে সর্বহারা পার্টি ট্রটস্কাইড পন্থী হঠকারীতা বলে আখ্যায়িত করে। কারণ জাতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করার আগে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব নয় বলে পার্টির তাত্ত্বিকরা অভিমত প্রকাশ করেন। তারা আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে জাতীয় বিপ্লব সম্পূর্ণ করা অসম্ভব কারণ তারা চারিত্রিকভাবে জাতীয় বুর্জুয়াদের প্রতিনিধি নয়, তারা হল সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের দালাল এবং মুৎসুদ্দি শ্রেণীর প্রতিনিধি। সর্বহারা পার্টির মতে বাংলাদেশের অসম্পূর্ণ বিপ্লবকে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের। বিপ্লবকে এগিয়ে নেবার জন্য সর্বহারা পার্টি কৃষক, শ্রমিক, নিপীড়িত জনতা, বিভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় গোষ্ঠির সমন্বয়ে গড়ে তোলে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট নামে একটি গণসংগঠন সর্বহারা পার্টির তাত্ত্বিকরা মনে করেন যেহেতু বাংলাদেশ তিন দিক দিয়েই ভারত বেষ্টিত, সেক্ষেত্রে বিপ্লবের জন্য বাইরের কোন সাহায্য পাওয়া হবে অতি দুঃষ্কর। তাই বিপ্লবীদের নিজস্ব শক্তির উপরই মূলতঃ নির্ভরশীল থাকতে হবে। সিরাজ সিকদারের গতিশীল নেতৃত্বে এবং সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী কার্যক্রমে মুজিব সরকারের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়। অসীম সাহসিকতার সাথে সর্বহারা পার্টির সদস্যরা একের পর এক সফল অভিযান চালিয়ে সরকার ও তার বিভিন্ন বাহিনীকে নাজেহাল করে তুলতে সমর্থ হয় অতি অল্প সময়ে। তাদের সাফল্যে দেশজুড়ে সাড়া পড়ে যায়। তরুণ সমাজের কাছে পার্টির ভাবমুর্তি বেড়ে যায়। ফলে তাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দলে দলে জনগণের বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত লোকজন সর্বহারা পার্টিতে যোগ দিতে শুরু করে এবং পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠে। এত অল্প সময়ে এ ধরণের জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব হয়নি। জাসদের চেয়েও ক্রমান্বয়ে সর্বহারা পার্টি বেশি জনসমর্থন লাভ করতে সমর্থ হয়। ১৯৭৩ সালের ২রা ডিসেম্বর এক বিবৃতির মাধ্যমে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী সর্বহারা পার্টিকে সমর্থন জানান এবং সিরাজ সিকদারকে অভিনন্দন জানান। ১৯৭৫ সালের ২রা জানুয়ারী শেখ মুজিবের নির্দেশে রক্ষীবাহিনীর শেরেবাংলা নগরের ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় অকথ্য নির্যাতনের পর বীর মুক্তিযোদ্ধা সর্বহারা পার্টির শীর্ষ নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই নৃশংস হত্যাকান্ড সম্পর্কে দৈনিক সংগ্রামে ৫ই জুন ১৯৯২ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হল। এ থেকে সিরাজ সিকদারের হত্যার নেপথ্যে কাহিনী সম্পর্কেই জানা যায় তা নয়; সর্বহারা পার্টির তৎকালীন কার্যকলাপ ও মুজিবের স্বৈরশাসন আমলের সার্বিক জাতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কেও অনেক তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল:

রাজ্জাক, তোফায়েল, নাসিমসহ ৭জন আসামী। সিরাজ সিকদার হত্যা মামলা দায়ের।

স্টাফ রিপোর্টার: – পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে হত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল ও মোহাম্মদ নাসিমসহ

৭জনকে আসামী করে গতকাল বৃহঃস্পতিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সিরাজ সিকদার পরিষদের সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন আহমদ বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। মামলার আসামীরা হলেন: (১) সাবেক পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ (২) আব্দুর রাজ্জাক এমপি (৩) তোফায়েল আহমদ এমপি (৪) সাবেক আইজি পুলিশ ইএচৌধুরী (৫) সাবেক রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক বর্তমানে সুইডেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কর্নেল (অবঃ) নূরুজ্জামান (৭) মোহাম্মদ নাসিম এমপি গং।

আসামীদের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ১০৯ নং ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার আর্জিতে বলা হয়, বিশিষ্ট প্রকৌশলী নিহত সিরাজ সিকদার ছিলেন একজন আজাদী পাগল মুক্ত বিবেকের অধিকারী ও স্বাধীনচেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তার জীবদ্দশায় নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে প্রথমে শ্রমিক সংগঠন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং পরবর্তীতে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে কাজ করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বের প্রতি জনসমর্থন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় তৎকালীন সরকার প্রধান মরহুম শেখ মুজিবর রহমান ঈর্ষান্বিত হয়ে জনসমর্থন হারানোর কারণে, ক্ষমতাচুত্যির ভয়ে ভীত হয়ে সর্বহারা পার্টির কর্মীদের ওপর দমন নীতি চালাতে থাকেন। এমনকি পার্টি প্রধান সিরাজ সিকদারকে হত্যার জন্য বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।

আর্জিতে বলা হয় আসামীরা মরহুম শেখ মুজিবের সহচর ও অধিনস্থ কর্মী থেকে শেখ মুজিবের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ও গোপন শলা-পরামর্শে অংশগ্রহণ করতেন এবং ১নং থেকে ৬নং আসামী তৎকালীন সময়ে সরকারের উচ্চপদে থেকে অন্যান্য ঘনিষ্ঠ সহচরদের সাথে শেখ মুজিবের সিরাজ সিকদার হত্যার নীল নকশায় অংশগ্রহণ করেন। তারা এ লক্ষ্যে সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন কর্মীকে হত্যা, গুম, গ্রেফতার, নির্যাতন ও হয়রানি করতে থাকেন। সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার ও হত্যার বিবরণ দিয়ে আর্জিতে বলা হয়, মরহুম শেখ মুজিব ও উল্লেখিত আসামীরা তাদের অন্য সহযোগীদের সাহচর্যে সর্বহারা পার্টির মধ্যে সরকারের চর নিয়োগ করেন। এদের মধ্যে ইএচৌধুরীর একজন নিকট আত্মীয়কেও চর হিসাবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে ১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়ারী চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে অন্য একজনসহ সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতার করে ঐদিনই বিমানে করে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকার পুরাতন বিমান বন্দরে নামিয়ে বিশেষ গাড়িতে করে বন্দীদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মালিবাগস্থ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সিরাজ সিকদারকে আলাদা করে তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। ২রা জানুয়ারী সন্ধ্যায় পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর বিশেষ স্কোয়াডের অনুগত সদস্যরা বঙ্গভবনে মরহুম শেখ মুজিবের কাছে সিরাজ সিকদারকে হাত ও চোখ বাধা অবস্থায় নিয়ে যায়। সেখানে শেখ মুজিবের সাথে তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম ক্যাপ্টেন (অবঃ) মনসুর আলীসহ আসামীরা, শেখ মুজিবের পুত্র মরহুম শেখ কামাল এবং ভাগ্নে মরহুম শেখ মনি উপস্থিত ছিলেন।

আর্জিতে আরো বলা হয়, প্রথম দর্শনেই শেখ মুজিব সিরাজ সিকদারকে গালিগালাজ শুরু করেন। সিরাজ এর প্রতিবাদ করলে শেখ মুজিবসহ উপস্থিত সকলে তার উপর ঝাপিয়ে পড়েন। সিরাজ সে অবস্থায়ও শেখ মুজিবের পুত্র কর্তৃক সাধিত ব্যাংক ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপকর্ম, ভারতীয় সেবাদাসত্ব না করার, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শেখ মুজিবের কাছে দাবি জানালে শেখ মুজিব আরো উত্তেজিত হয়ে উঠেন। সে সময় ১নং আসামী মাহবুব উদ্দিন তার রিভলবারের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে সিরাজ সিকদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। শেখ কামাল রাগের মাথায় গুলি করলে সিরাজ সিকদারের হাতে লাগে। ঐ সময় সকল আসামী শেখ মুজিবের উপস্থিতিতেই তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে কিল, ঘুষি, লাথি মারতে মারতে তাকে অজ্ঞান করে ফেলে। এরপর শেখ মুজিব, মনসুর আলী এবং দুই থেকে সাত নং আসামী সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১নং আসামীকে নির্দেশ দেন। ১নং আসামী মাহবুব উদ্দিন আহমদ আসামীদের সাথে বন্দী সিরাজ সিকদারকে শেরেবাংলা নগর রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যায়। এরপর তার উপর আরো নির্যাতন চালানো হয়। অবশেষে ২রা জানুয়ারী আসামীদের উপস্থিতিতে রাত ১১টার দিকে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরেই সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ১নং আসামীর সাথে বিশেষ স্কোয়াডের সদস্যগণ পূর্ব পরিকল্পনা মত বন্দী অবস্থায় নিহত সিরাজ সিকদারের লাশ সাভারের তালবাগ এলাকা হয়ে সাভার থানায় নিয়ে যায় এবং সাভার থানা পুলিশ পরের দিন ময়না তদন্তের জন্য লাশ মর্গে প্রেরণ করে। কিন্তু সরকারি ঘোষণায় বলা হয়, বন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করায় পুলিশ এনকাউন্টারে সিরাজ সিকদার নিহত হন। আর্জিতে উল্লেখ করা হয় যে, সিরাজ সিকদারকে হত্যার পর তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবর রহমান জাতীয় সংসদে ভাষণ দেয়ার সময় ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ এই দম্ভোক্তি উচ্চারণের মাধ্যমে তার জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। বিলম্বে মামলা দায়ের করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, ঘটনার সাথে সাথে সিরাজের পিতা মরহুম আব্দুর রাজ্জাক মামলা দায়ের করতে যান। কিন্তু তৎকালীন স্বৈরাচারী শাসন ও রক্ষীবাহিনীর সন্ত্রাসের ভয়ে পুলিশ মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। শাসকদের সন্ত্রাসের মুখে মোকদ্দমা দায়ের করা যায়নি। দেশে অস্থির অগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রী পরিবেশের কারণে আইন-শৃঙ্খলার অস্বাভাবিক অবনতি, ক্ষমতায় থাকা একনায়কত্ব ফ্যাসিবাদী দলের ক্ষমতার দাপটে ভয়ভীতি ও সন্ত্রস্ততায় দীর্ঘ ১৭বছর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতার বিচার নীরবে কেঁদে ফিরেছে। ঐ অবস্থায় মরহুমের পরিবার ও সহকর্মীদের পক্ষ থেকে এজাহার ও মামলা দায়েরের ক্ষুদ্রতম সাহসও কারো ছিল না এবং এখনও নেই। বাদী নিজে সিরাজ সিকদারের আদর্শের এক তরুণ, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই আর্জি পেশ করছে।”

এ আর্জির প্রেক্ষিতে ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম দরখাস্তখানা তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রতি নির্দেশ জারি করেন। বাদী পক্ষে মামলা পেশ করেন এডভোকেট ফরমান উল্লাহ খান। তাকে সহায়তা করেন জনাব মোঃ আফজাল হোসেইন। এভাবে চরম নিষ্ঠুরতায় পার্টি নেতা সিরাজ সিকদারের হত্যার পর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও নেতৃত্বের কোন্দলের ফলে এবং সরকারি নিষ্পেষণে সর্বহারা পার্টির সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। পার্টিতে ভাঙ্গন দেখা দেয়। জাতীয় পরিসরে পার্টির প্রভাব ও কর্মকান্ড এবং শক্তি ক্রমান্বয়ে লোপ পেতে থাকে। নেতৃত্বের দুর্বলতায় কর্মীরা উদ্দামহীন হয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। ফলে জনগণও হতাশ হয়ে সন্দিহান হয়ে উঠে সর্বহারা পার্টির ভবিষ্যত সম্পর্কে। এভাবেই সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর সাথে সাথে হঠাৎ করে জেগে উঠা গণমানুষের মুক্তির এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায় স্বৈরশাসনের আগ্রাসী জিঘাংসায়।

জনাব তোহা ও শরদীন্দু দস্তিদারের নেতৃত্বে সাম্যবাদী দল গোপন সংগঠন হিসেবে মুজিব বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করছিল। মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিষ্ট পার্টি ভেঙ্গে ১৯৬৮ সালে পিকিংপন্থী হিসাবে এ দলের উৎপত্তি ঘটে। স্বাধীনতার পর এই দল তাদের মুখপত্র গণশক্তির মাধ্যমে দাবি জানায়, “বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। রুশ-ভারত চক্র মুলতঃ বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের প্রতিষ্ঠিত মুজিবের পুতুল সরকারের মাধ্যমে।” সর্বহারা পার্টির মতই সাম্যবাদী দল বাংলাদেশের রক্ষীবাহিনীকে পরোক্ষভাবে ভারতীয় সেনা বাহিনীর উপস্থিতি বলেই মনে করে। কারণ এই রক্ষীবাহিনী সর্বোতভাবে ভারতীয় সেনা বাহিনীর সাহায্যেই গঠন করা হয়েছিল। সাম্যবাদী দল অভিমত প্রকাশ করে যে, রক্ষীবাহিনী তৈরি করে তাদের সাথে যৌথভাবে ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতায় সরকার বিরোধী আন্দোলনগুলোকে দমন করার চেষ্টা করছে। মুজিব তার সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্যই রক্ষীবাহিনী তৈরি করার ভারতীয় প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। সর্বহারা পার্টির মতই সাম্যবাদী দল একটি জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করে এবং একই সাথে গোপনে গণবাহিনী সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রধানতঃ ঢাকা, রাজশাহী, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর জেলাতেই সাম্যবাদী দল তাদের ঘাটি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ফলে ঐ জেলাগুলোতেই তাদের সরকার বিরোধী সংগ্রাম তীব্রতা লাভ করে। প্রগতিশীল এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো স্বৈরাচারী সরকার বিরোধী ভূমিকায় মূল্যবান অবদান রাখলেও দলীয় মতবিরোধ ও পার্থক্য নিয়ে দলগুলো একে অপরের প্রকাশ্য সমালোচনা ও নিন্দা করতে থাকে।

সাম্যবাদী দল সাম্রাজ্যবাদ’ সম্পর্কে BCPL এবং BCP এর অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করে। BCPL এবং BCP আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের উপর নির্ভরশীল বলে দাবি করলে সাম্যবাদী দল এ বক্তব্যের সমালোচনা করে বলে, “আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের পুতুল সরকার। তাকে ভারতের উপর নির্ভরশীল বলা মানেই হচ্ছে তাদের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখা।” সর্বহারা পার্টির সমালোচনা করে সাম্যবাদী দল বক্তব্য দেয়, “সাম্যবাদী দল সর্বহারা পার্টিকে একটি হঠকারী গ্রুপ বলেই মনে করে। এ গ্রুপ আত্মস্তুর সিরাজ সিকদারের ভুল প্ররোচণায় পরিচালিত হচ্ছে।” সর্বহারা পার্টি বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বন্দ্বকে প্রধান্য দেওয়ায় সাম্যবাদী দল সর্বহারা পাটির্কে তাত্ত্বিক দিক দিয়েও ভুল এবং দুর্বল বলে দাবি তোলে। সাম্যবাদী দলের তত্ত্ব অনুযায়ী, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বই মূল দ্বন্দ্ব। ( দ্রষ্টব্যঃ সাম্যবাদী দলের প্রকাশিত ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসের দলিল- ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার সাম্যবাদী দল’, ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত প্রবন্ধ- ‘এক ভূঁইফোড় বিপ্লবী সম্পর্কে’) একইভাবে জাসদ সম্পর্কে সাম্যবাদী দলের অভিমত ছিল, আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে ভারতই এই সংগঠন গড়ে তোলায় সাহায্য করে। মুজিব ও তার অনুগতদের নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যেই ভারত জাসদ গঠনে মদদ যোগায়। (দ্রষ্টব্য: এপ্রিল-মে ১৯৭৩ সালে গণশক্তিতে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ‘ইস্পাত কঠিন শ্রমিক শ্রেণীর পার্টিকে গড়ে তুলুন’) জনযুদ্ধ EPCP (ML) -এর মুখপাত্র হিসেবে সেই সময় আব্দুল হকের সম্পাদনায় বের হত। পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিষ্ট পার্টি (এম এল) থেকে বেশিরভাগ কর্মীকে বের করে এনে জনাব তোহা এবং শরদীন্দু দস্তিদার সাম্যবাদী দল গঠন করলেও জনাব আব্দুল হক পার্টির নাম পরিবর্তন না করার প্রশ্নে অটল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিষ্ট পার্টি (এম.এল) বা EPCP (ML) নামে একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। এই গ্রুপটি বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অস্বীকার করে। স্বাধীনতা সংগ্রামকে ভারতীয় আগ্রাসন বলে EPCP (ML) আখ্যায়িত করে। জনযুদ্ধের মাধ্যমে আগ্রাসী শক্তির কবল থেকে পূর্ব পাকিস্ত নিকে মুক্ত করার লাইন গ্রহণ করে EPCP (ML)। এই দল তাদের নাম না

বদলানোয় সরকারি নির্যাতনের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়। গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্যই মারা যায় নতুবা কারাবন্দী হয়। জনাব আব্দুল হককে বন্দী অথবা হত্যা করার সরকারি সব প্রচেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়। পূর্ব বাংলা কম্যুনিষ্ট পার্টি (এম এল) EBCP (ML) এবং সাম্যবাদী দলের মধ্যে তত্ত্বগতভাবে খুব একটা ব্যবধান দেখা যায় না। তবে EBCP (ML) কৃষক ও সামন্তবাদের অবশেষের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্বকে বেশি প্রধান্য দেয়। এ দল ভারতের বিপ্লবীদের সাথে একত্রিতভাবে বিশেষ করে নকশালীদের সাথে সম্পর্ক রেখে বিপ্লবকে এগিয়ে নেবার ঘোষণা ব্যক্ত করে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য প্রায় বিপ্লবী সব দলগুলোর কাছে নকশাল আন্দোলন একটি চরমপন্থী হঠকারীতা বলেই গৃহিত হয়। নকশালীদের দলগুলো বিশ্বাস করতেও রাজি ছিল না। আত্রাই, রাজশাহী, দিনাজপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে EBCP (ML) বিশেষভাবে তৎপরতা চালায়। প্রগতিশীল ও বামপন্থী তৎকালীন প্রায় সবগুলো দলই একমত প্রকাশ করে যে, বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব ১৯৭১ সালে অসমাপ্ত থেকে যায়। মুজিব সরকার বাংলাদেশের উপর রুশ-ভারতের আধিপত্য কায়েমে সহযোগিতা করে। মুজিব সরকার মূলতঃ ভারতের একটি পুতুল সরকার।

উপরের পর্যালোচনা থেকে একটা জিনিসই পরিষ্কার হয়ে উঠে। স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রবীণ নেতৃত্বের চেয়ে নবীনরাই সংগ্রামে অভূতপূর্ব গতিশীলতার সৃষ্টি করে। তারা যখন জনসমর্থন পেয়ে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত তখন পুরনো নেতৃত্ব তাত্ত্বিক কচকচানি নিয়েই ব্যস্ত থেকে নিজেদের দেউলিয়াপনা প্রকাশ করে গণবিছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের দেউলিয়াপনা, নেতৃত্বের লোভ, ভাববাদী তাত্ত্বিক চর্চা, সন্দেহপ্রবণতা, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস প্রভৃতি কারণেই স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা উল্লেখযোগ্য বা আশানুরূপ অবদান রাখতে ব্যর্থ হন। ফলে ক্রমশঃ তারা জনগণ থেকে সম্পূর্ণভবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। নবীন প্রজন্ম তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। নেতাদের অনেকের ব্যক্তিগত ত্যাগ স্বীকারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকলেও এটাই বাস্তব সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তাদের ব্যর্থতা সাফল্যের চেয়ে অনেক বেশি সেটাও আজ প্রমাণিত। অতীতে বিভিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ যখন সত্যিকারের মুক্তির জন্য পরিস্থিতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তখন নেতাদের ভ্রান্ত ও নেতিবাচক ভূমিকার ফলেই ইন্সিত লক্ষ্য জনগণ অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণ সর্বদা চলেছে আগে আর নেতারা চলেছেন পেছনে। আমাদের দেশের জনগণের সংগ্রামের ঐতিহ্যে এটাই বড় সত্য। লজ্জাকর হলেও এ সত্যকে খন্ডাবার উপায় নেই। সত্যকে মিথ্যা করার প্রচেষ্টা থেকেছে সর্বকালে। কিন্তু সত্যকে মেনে নিয়ে এগুলেই আশানূরূপ ফল পাওয়া যায়। মিথ্যার আবর্তে পাওয়া যায় শুধু বঞ্চনা ও প্রতারণা। ব্যর্থতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে না চাইলে নতুন প্রজন্মকে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে চলতে হবে ভবিষ্যতপানে। তারুণ্যের উদ্দাম ও গতিশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে প্রবীণরা নবীনদের পথ থেকে সরে দাড়ালেই অক্ষুন্ন থাকবে তাদের সম্মান। আর যদি তারা স্বার্থপরের মতো নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করেন তবে তারুণ্যের প্লাবনের দুর্বার স্রোত তাদের টেনে নিয়ে ফেলবে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। সময়কে হাতের মুঠোয় পুরে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা না করে সময়ের দাবিকে মেনে নেয়াটাই হবে নেতাদের জন্য কল্যাণকর। আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরতন্ত্রের বিরোধিতা করেছেন সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা। সদ্যমুক্ত বাংলাদেশের সর্বত্র প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলো অন্যায়, জুলুম, অত্যাচার এবং লুটপাটের বিরোধিতার সংগ্রামে উজ্জ্বল প্রতীক। তারা লড়েছেন বিভিন্ন অবস্থানে থেকে। কেউ তাদের নিজস্ব এলাকায় জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ সংগ্রাম করেছেন রাজনৈতিক বিরোধী দলের ছত্রছায়ায়। কেউ বা লড়েছেন সেনা বাহিনীর সদস্য হিসেবে। তাদের এ বহুমুখী ধারার সচেতনাকে সাংগঠনিক রূপ দেবার প্রচেষ্টা না থাকায় প্রতিরোধ দানা বেঁধে উঠতে পারেনি। যারা রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলেন দলীয় গন্ডির মাঝেই তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। অথচ স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের মাঝে যে দেশপ্রেম জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং নিঃস্বার্থ কর্মপ্রেরণার সৃষ্টি হয়েছিল তাকে সুষ্ঠ নেতৃত্বের অধিনে সুসংহত করতে পারলে বাংলাদেশের বর্তমান অনেক সংকটের অবসান হত সে বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যদিও তৎকালীন সরকার তাদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে বাড়তি সুবিধাদী দিয়ে হাত করার চেষ্টা করেছিলেন তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা তাদের সততা, দেশপ্রেম সামান্য প্রলোভনে কারো কাছে বিক্রি করে দেননি। তারা যে আশা-আকাংখা এবং স্বপ্ন নিয়ে জানবাজী রেখে একদিন দেশের স্বাধীনতার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সে স্বপ্ন আজো বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধার বুকে তুষের আগুনের মতই জ্বলছে। দেশের মঙ্গলের জন্য সুযোগ পেলে আজো তারা বিশেষ অবদান রাখতে উদগ্রীব। তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য আবার জনগণের সাথে সঙ্গবদ্ধ হয়ে সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন তারা। স্বাধীনতার মত সার্বিক মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেন স্বার্থপর জাতীয় বেঈমানদের পরাজিত করে। গড়ে তুলতে পারেন সত্যিকারের সোনার বাংলাদেশ। জাতিকে ফিরিয়ে দিতে পারেন তাদের হারানো মর্যাদা ও গৌরব।

কারা এই মুক্তিযোদ্ধা? কি ছিল তাদের স্বপ্ন? কি হল তাদের পরিণাম? তাদের বিরুদ্ধে কি চক্রান্ত করা হয়েছিল স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে? এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব পাঠকদের কাছে তুলে ধরবার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

১৯৭১ সালে যারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেছিল তারা সবাই ছিলেন বাংলাদেশের খেটে খাওয়া জনগণের সন্তান। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের ছেলে-মেয়েরাই সেদিন দেশকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়। এর পেছনে তাদের কোন হীন স্বার্থ ছিল না। ছিল একটি মাত্র স্বপ্ন। হানাদারদের কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে শোষণহীন আত্মমর্যাদাশীল বাংলাদেশ। তাদের এ গভীর দেশপ্রেমই ছিল তাদের ত্যাগের উৎস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ তাদের সেই নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও প্রচন্ড সাহসের ইতিহাস। তাদের সেই বীরত্ব ও ত্যাগের ফলেই স্বাধীন হল বাংলাদেশ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মেহনতী মানুষের ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাঙ্খিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হল না স্বাধীন বাংলাদেশে। অথচ তখনকার নেতৃত্ব যদি তাদের বিশ্বাস করে তাদের দুর্বার কর্মক্ষমতা ও আত্মত্যাগের অঙ্গীকারকে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে কাজে লাগাতে চাইতেন তবে তারা নিশ্চয়ই অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারতেন। কিন্তু তেমনটি হয়নি। তখনকার সরকার যে শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের অবিশ্বাসই করেছিল তা নয়; তাদের উপর চালানো হল নির্যাতনের ষ্টিমরোলার। একটি সশস্ত্র সংগ্রামের বিজয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হল বাংলাদেশ, নব চেতনায় জন্ম নিল একটি জাতি। কিন্তু মাত্র স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জাতির ভাগ্যে নেমে এল চরম বিপর্যয়। দারিদ্র, হতাশা, নৈরাশ্য, নৈরাজ্য, নীতিহীনতা, আদর্শের পরাজয় এবং মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অবজ্ঞা এবং লাঞ্ছনা। পৃথিবীর ইতিহাসে মুক্তিকামী মানুষের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও রক্তদানের প্রতি এমন অবমাননা এবং অসম্মান বোধ হয় অন্য কোথাও দেখানো হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের সর্বস্তরের জনগণ যুদ্ধ করল তবুও ঘৃণ্য অতীতই আবার ফিরে এল। মানুষের কাম্য জীবন ও সমাজ ব্যবস্থা কায়েম হল না। জাতীয় পর্যায়ে বেঈমান ও শোষকের দলই ক্রমে দেশের কর্ণধার হয়ে বসল।

মুক্তির জন্য যে যুদ্ধ করে তাকেই বলা হয় মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তি বলতে শুধুমাত্র ভৌগলিক স্বাধীনতা বোঝায় না। মুক্তি বলতে বোঝায়- সেই সমাজ যেখানে প্রতিটি মানুষ তার সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে আপন গর্বে, দাস বা ভিক্ষুকের মত নয়। মানুষ তখনই প্রকৃত অর্থে মুক্ত হয় যখন সে তার মেধা, প্রতিভা এবং কর্মক্ষমতা প্রকাশের সমান অধিকার লাভ করে। সুযোগ পায় তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা প্রকাশের এবং নিজ প্রজ্ঞা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তার ভাগ্যের উন্নতি করার। আর্থিক ও সামাজিক অধিকারে বৈষম্য থাকলে মানুষ মুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারে না। যে দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে বাস করে, দু’বেলা ভাত পায় না, সে দেশের মানুষ মুক্ত কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে এ ধরণের উচ্চবাচ্য করা পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকেই বলেন, ‘৭১ এর যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না। আমি বলি ভারতীয় বাহিনী কেন তার সাথে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীও যদি যোগ দিত তাহলেও ‘৭১ এর যুদ্ধে তাদের পক্ষে পাকিস্তানকে পরাজিত করা সম্ভব হত না। কারণ জয় পরাজয় নির্ভর করে জনগণের সমর্থনের উপর। অল্প কিছু লোক এবং গোষ্ঠি ব্যতিত পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনসাধারণ মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন দিয়েছিল বলেই দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু এই জনগণকেই তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয়নি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ সরকার।

মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করার হুকুম মোতাবেক সমস্ত অস্ত্র জমা নেবার পর দু/তিন দিনের নোটিশে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার হাতে ৫০ টাকা করে পথ খরচা দিয়ে খোদা হাফেজ জানায় আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার অঙ্গীকার করল মুক্তিযোদ্ধাদের সার্টিফিকেট দেয়া হবে। যারা এ সার্টিফিকেট পাবে তাদের পূর্ণবাসনের জন্য চেষ্টা করবে সরকার। পরবর্তিকালে এই সার্টিফিকেট সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ না করে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় জেলা প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের এমপি ও নেতাদের মাধ্যমে বিলি করা হয় তাদের পছন্দের লোকদের মাঝে। যদিও এদের অধিকাংশের সঙ্গে যুদ্ধের কোন সম্পর্ক ছিল না। যুদ্ধাপরাধী এবং দালালদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে মাফ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে অনেক রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনীর সদস্যরা নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে সার্টিফিকেট দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বনে ঘুরে বেড়াতে থাকে সমাজের সর্বত্র। দেশদ্রোহী এবং স্বাধীনতা বিরোধীদের আওয়ামী সরকার ক্ষমা করেছিল মহত্ত্বের করণে নয় বরং অভিন্ন শ্রেণী স্বার্থে এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তাদের মদদ হাসিল করে নিজেদের হাত শক্তিশালী করতে। যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লাখ। কিন্তু ১২ থেকে ২০ লাখ সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ডজন মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ১১জনই ভুয়া। অত্যন্ত সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমুর্তি নষ্ট করার জন্য এবং স্বাধীনতা বিরোধী দালাল চক্রকে পূনঃর্বাসিত করার জন্যই এ ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভীড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাপ্য কৃতিত্ব ও স্বীকৃতি পাবার আগেই হারিয়ে যায়।

যুদ্ধ শেষ হবার পরপরই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে হাতিয়ার নিয়ে নিলেও সরকার যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতীয় সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল তাদের নিরস্ত্র করা থেকে বিরত থাকে। উপরন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় ঐ বাহিনীর সদস্যরা স্বাধীনতার পরমুহূর্ত থেকেই লুটতরাজ, ডাকাতি, রাহাজানী, হত্যা, লাইসেন্স পারমিটবাজীতে মেতে উঠে। ভারতীয় মারোয়াড়ীদের সাথে হাত মিলিয়ে চোরাচালানেও তারাই লিপ্ত হয়। কালোবাজারী এবং মজুতদারীদের এরাই প্রটেকশন দিয়ে রাখে। পরিত্যক্ত সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে দলীয় লুটপাটও করা হয় এই বিশেষ বাহিনীর যোগসাজসে। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙ্গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সহযোগিতায় যারা সর্বপ্রকার অসামাজিক কাজ ও লুটপাট করেছিল তাদের পাপের বোঝা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আজও টানতে হচ্ছে। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে বিনা কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে এখনো বিনা বিচারে কারাবন্দী হয়ে থাকতে হচ্ছে। সরকারের ক্ষমা প্রাপ্ত লেলিয়ে দেয়া দালালরা ছাড়া পাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের পেছনে লাগে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য। দালালরা সবাই ছিল যার যার নিজ এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি। স্থানীয় প্রশাসন, থানা ইত্যাদির উপর এদের প্রভাব ছিল অসীম। স্বাধীন দেশের নতুন সরকার প্রশাসনিক কাঠামোর কোন পরিবর্তন না করায় তাদের প্রভাবেও কোন তারতম্য ঘটেনি ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন হয়ে উঠে সঙ্গীন ও দুঃবির্ষহ।

পৃথিবীর ইতিহাস থেকে দেখা যায়, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে যে সমস্ত দেশ এবং জাতি স্বাধীন হয়েছে ঐ সমস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে জাতীয় পুর্নঃগঠন প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারাই অগ্রণী ভূমিকায় থেকেছেন। নীতি নির্ধারণ করা থেকে নীতি বাস্তবায়ন করার প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারা বিশেষ অবদান রেখেছেন জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কিন্তু আমাদের বেলায় হল ঠিক তার বিপরীত। যে চেতনা ও সংকল্প একটা মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে তুলে আমাদের ক্ষেত্রে তার অভাব ছিল গোড়া থেকেই। যুদ্ধের জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যুদ্ধটা ছিল আমাদের উপর আরোপিত। ‘৭১ এর ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনীর আচমকা আক্রমণের আগ পর্যন্ত বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো এবং নেতারা সবাই রাজনৈতিক সমাধানের রাস্তাই খুঁজে পাবার চেষ্টা করছিলেন। এর ফলে যে কোন মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় শর্তাবলী যথা:- সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য উপযুক্ত নীতি আদর্শ, সংগঠন, সামরিক প্রস্তুতি এবং বিচক্ষণ নেতৃত্ব এর প্রায় সবকয়টিই ছিল অনুপস্থিত। ফলে যে নেতার নামে সংগ্রাম তিনি শুরুতেই ধরা দেন শত্রুর হাতে। আর তার সহযোগিরা নিরস্ত্র জাতিকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। প্রথমে বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও যে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল সেটা ছিল প্রধানত: আত্মরক্ষার তাগিদে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে। তবে যারা এ ধরণের প্রতিরোধ গড়ে তোলে তাদের সাহস ও সংকল্প ছিল অকৃত্রিম। কিন্তু যুদ্ধটা যে আকস্মিক ছিল এবং সমগ্র জাতিকে সে আকস্মিক ঘটনার সঙ্গে পর্যায়ক্রমে জড়িত হয়ে পড়তে হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। সূত্রহীন এই আকস্মিকতার একটা মহান যুদ্ধকে সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে নেবার জন্য যে রাজনৈতিক আদর্শের প্রয়োজন সে আদর্শ গড়ে উঠার সুযোগ আমরা পাইনি। যুদ্ধের নেতৃত্ব যারা কব্জা করে নেয় তাদেরও এটা কাম্য ছিল না। দেশের আপামর জনসাধারণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিপীড়নের বিরোধিতা করার জন্যই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল কিন্তু জনগণের সে আশা পূরণ করা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ সেটা হত তাদের শ্রেণী স্বার্থের পরিপন্থী। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতারণার শিকারে পরিণত হয় মূলতঃ একারণেই। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং যুদ্ধে সহায়তা করেছেন তারা লক্ষ্যহীন ছিলেন না। মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছেন তাদের বিপুল অংশই ছিলেন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, মা-বোন ও দেশবাসীর লাঞ্ছনার প্রতিশোধের আকাঙ্খাই তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল যুদ্ধে যোগ দিতে। অবশ্য আত্মরক্ষার তাগিদেও অনেকে যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে বেশিরভাগ লোকই স্বেচ্ছায়, আত্মত্যাগের মহৎ মনোভাব নিয়েই এগিয়ে এসেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন করা। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার কিশোর-যুবক বিচ্ছিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধ করে বিভিন্ন সেক্টরে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা তাদের কর্মীদের নিয়ে ভারতের সহায়তায় নিজেদের নিজস্ব বাহিনী গঠন করে তাদের যুদ্ধ ক্ষেত্রে না পাঠিয়ে তাদের অতি সযত্নে সংরক্ষিত করে রাখে স্বাধীনতা উত্তরকালে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য। প্রকৃতপক্ষে ন’মাসের আগাগোড়া যারা যুদ্ধ করেছে তাদের অধিকাংশই ছিল অরাজনৈতিক সাধারণ ঘরের ছেলে-মেয়ে। তারা ছিল সরলমনা। তাই যুদ্ধ শেষে বিনা দ্বিধায় তারা তাদের অস্ত্র জমা দিয়ে দেয়। স্বাধীন বাংলাদেশে অস্ত্রের দাপট, পারমিটবাজী, লুটতরাজ, হাইজ্যাক, গুম, খুন, ধর্ষণ ও অন্যান্য দুঃষ্কর্মে এসব নিবেদিত প্রাণ ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সামান্য। রাজনৈতিক চেতনার অভাবে শক্তি থাকা সত্ত্বেও এরা সংগঠিত হতে পারেননি। বাংলাদেশের বিশাল জনসমুদ্র থেকে এসে তারা আবার জনসমুদ্রেই মিশে যান। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করে সুষম আর্থসামাজিক ব্যবস্থা কায়েম করার মত শক্তি তাদের ছিল। এটা আঁচ করতে পেরেই আওয়ামী লীগ সরকার শংকিত হয়ে পড়ে এবং দেশে ফিরে প্রথমেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত থেকে অস্ত্ৰ কেড়ে নেয়। একই সাথে সুখী ভবিষ্যতের কথা বলে তাদেরকে ভাওতা দেয়। এভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের চুড়ান্ত বিজয়ের পর যুদ্ধ বিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে পুর্নগঠনের মাধ্যমে মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং সেই সঙ্গে সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের সমাজে সসম্মানে পূর্ণবাসনের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংসদের আহ্বানে দ্রুত দেশের প্রতিটি থানায় এবং ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের অঙ্গ সংগঠন গড়ে উঠে। ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে এই সংগঠনের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন হয় এবং ঐ অধিবেশনে একটি গঠনতন্ত্র এবং জাতীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচিত হয়। এই কমিটির লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশের তৎকালীন গণবিরোধী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বৈরী মনোভাবাপন্ন সরকার এবং ধোকাবাজীর রাজনীতির হাতছানি মারাত্মক অন্তরায় হয়ে দাড়ায়। সরকারের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে কয়েকজন কাউন্সিল সদস্য সরকারি প্ররোচণায় সংসদের গঠনতন্ত্রকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সংসদকে আওয়ামী সরকারের লেজুড়ে পরিণত করার উদ্যোগ নেন। জাতীয় নির্বাহী পরিষদের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়া সত্ত্বেও নতুন নির্বাচনের বিধানকে আমল না দিয়ে ১৯৭৫ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী ঐ চক্র এক কোরাম সভায় গঠনতন্ত্রকে উপেক্ষা করে বৈধ জাতীয় নির্বাহী কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে নতুন একটি কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি পরে ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের এক সভায় জনধিকৃত বাকশালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের যোগদানের কথা ঘোষণা করে। সংসদের আদর্শ জলাঞ্জলী দিয়ে সংসদের গঠনতন্ত্রের অবমাননার দায়ে জনাব নঈম জাহাঙ্গীর ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পচাঁত্তরের মার্চ মাসেই ঢাকা মুন্সেফ কোর্টে ঐ অবৈধ পরিষদ গঠনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। কোর্ট ইনজাংশন জারি করে অবৈধ পরিষদের গঠনতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ করে দেয়। ফলে সংসদ বাকশালের রাহুগ্রাস থেকে সাময়িকভাবে বেঁচে যায়। ইনজাংশন জারি করলেও কোর্ট সরকারের রোষ এড়াবার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে মামলার রায় প্রদান স্থগিত রাখে।

পচাত্তরের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর পরিবর্তনকারী নেতৃত্বকে জনাব মাহ্ফুজুর রহমান (মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তৎকালীন সহ-সভাপতি) দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ হতে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। বিপ্লবীদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধারা আবার নতুন উদ্দামে সংসদকে পুর্নঃগঠন করার কাজ শুরু করেন। সেপ্টেম্বরে কোর্ট সেই মামলার রায় নিরঙ্কুশভাবে বাদীপক্ষের স্বপক্ষে দান করে। গঠনতন্ত্র অবমাননাকারীরা পরাস্ত হয়। দেশের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪ঠা অক্টোবর ঢাকায় পুরনো বৈধ জাতীয় নির্বাহী পরিষদের এক পূর্ণাঙ্গ সভা লেখকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। সভার বিবরণী লিখতে গিয়ে জনাব নঈম জাহাঙ্গীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিবিদ, সদস্য জাতীয় নির্বাহী কমিটি (এডহক) বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তার প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’-এ লেখেন, “পচাত্তরের ১৫ই আগষ্ট সেনা বাহিনী সরকারকে উৎখাত করে। জনাব মাহ্ফুজুর রহমান (তৎকালীন সহ- সভাপতি এবং আহ্বায়ক) দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ হতে সেনা বাহিনীকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। আমরা উদ্যোগী হয়ে উঠি সংসদকে পুনর্গঠিত করতে। কোর্ট সেপ্টেম্বরে নিরঙ্কুশভাবে আমাদের পক্ষে রায় দেয়। গঠনতন্ত্র অবমাননার অভিযোগে ওরা অভিযুক্ত হয়। ১৫ই আগষ্টে দেশের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ৪ঠা অক্টোবর ঢাকায় পূর্বতন বৈধ জাতীয় নির্বাহী পরিষদের এক পূর্ণাঙ্গ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বিগত আড়াই বৎসরেরও অধিক সময়ের কুর্কীতি ও ধোকাবাজীর বিস্তারিত ফিরিস্তি তুলে ধরে অবৈধ পরিষদের ১২০জন সাংসদের প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করার আহ্বান জানিয়ে অবৈধ পরিষদের বিরুদ্ধে জনাব মাহফুজুর রহমান এক অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার সেই প্রস্তাব উপস্থিত সকল সদস্যের একচেটিয়া সমর্থনে পাশ হয়; ঐ একই সভায় অন্তবর্তীকালীন সময়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য সংসদদের গঠনতন্ত্র মোতাবেক ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় নির্বাহী পরিষদ (এডহক) নির্বাচিত করা হয়। জাতীয় নির্বাহী পরিষদ (এডহক) কার্যভার গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিম্নোক্ত কর্মসূচী গ্রহণ করে :-

১। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করে সরকারি গেজেটে তালিকা প্রকাশ করা।

২। স্বাধীনতা যুদ্ধে আহত পঙ্গু যোদ্ধাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করা এবং প্রয়োজনবোধে তাদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।

৩। স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রকৃত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা প্রস্তুত করা।

৪। দেশের বিভিন্ন জেলে আটককৃত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং হুলিয়া বা গ্রেফতারী পরোয়ানাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করে যথাযথ যাচাইয়ের মাধ্যমে নির্দোষ মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তির এবং হুলিয়া বা গ্রেফতারী পরোয়ানা উঠিয়ে নেবার ব্যবস্থা করা।

৫। পঙ্গু ও বেকার মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীয় যোগ্যতানুসারে সমাজে সসম্মানে পূর্ণবাসনের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শহীদ পরিবারের পূর্ণবাসনের নিশ্চয়তা বিধান করা।

৬। স্বাধীনতার কৃতি সন্তান হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ জাতীয় মানের পদক প্রদানের ব্যবস্থা করা।

৭। মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় তথ্যাবলী, স্মৃতিচিহ্ন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।

জনাব ফতেহ আলী চৌধুরী তার লেখা মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে লেখেন, “নয় মাস জীবনপণ যুদ্ধের পর যখন একজন যোদ্ধা চারিদিকে তাকালো, দেখলো নয় মাসের স্বপ্নের সঙ্গে মিলছে না। সবাই নিজের পদ নিয়ে ব্যস্ত। দেশপ্রেমের প্রতিযোগিতা চলছে। পদ নির্ধারিত হচ্ছে। আর একজন যোদ্ধার জন্য লিখিত প্রথম সরকারি ঘোষণা- ‘তোমার অস্ত্র জমা দাও। অস্ত্র জমা যে না দিবে সে দেশের শত্রু।’ দেশের মাটিতে তখন রয়েছে বিদেশী সৈন্য। বিদেশী সৈনিকদের তত্ত্বাবধানে অস্ত্র জমা নেয়া হল। বিদেশী মটরবহর দেশী সহযোগিদের সহায়তায় সীমান্ত পার করল এদেশের সম্পদ।

নারায়ণগঞ্জ রোডে সম্পদ হরণকারী বহরের উপর আক্রমণ চালায় কয়েকজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল দেশের অন্যান্য জায়গাতেও। পরে তাদের বলা হয় উস্কানিদাতা। দেশমাতৃকার জন্য আত্ম উৎসর্গকারী বীর সন্তানদের অস্ত্রহীন করে ওরা নিয়ে গিয়েছে যা নেয়া সম্ভব। আর তৈরি করে রেখে গিয়েছিল কিছু প্রাইভেট বাহিনী; যারা খোলাখুলিভাবে অস্ত্র নিয়ে ঘুরতো লুটতরাজ করতো; কারো কিছু বলার ছিল না। তারা ধর্ষণ করে ছাড়া পেতো, ব্যাংক ডাকাতি করে ছাড়া পেতো। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাকুরীর ৩০% নির্ধারণ করে জনগণের বৃহৎ অংশ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্ত করা হল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমনকি সামরিক বাহিনীতেও একইভাবে দেয়া হল দুই বৎসরের সিনিয়রিটি। উদ্দেশ্য সরকারি কাঠামোর বিভিন্ন প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বিভেদ সৃষ্টি করে জাতিকে দুর্বল করে তোলা। যুদ্ধ শেষে দালালরা যোগ দেয় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে। অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে আজও, অথবা রয়েছে জেলে বন্দী।”

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি লেখেন, দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। জনগণ এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু চক্রান্ত অব্যাহত রয়েছে। বার বার আমাদের সীমান্তের ঘাটিগুলোতে আঘাত হানছে বিদেশী সৈন্যরা। দেশের ভেতর পাঠানো হচ্ছে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের। দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে তারা নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। আমাদের সেনা বাহিনীর বীর জোয়ানরা শত্রুর প্রতিটি হামলাকে পর্যদুস্ত করে দিচ্ছেন। তারা আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করে চলেছেন গভীর দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে। ‘৭১ এর দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের দেশ ও জাতির এই সংকট মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। সাড়ে তিন বছরের বঞ্চনা, শোষণ ও হতাশার দিনগুলোকে চিরদিনের মত কবর দেয়ার জন্য গড়ে তুলতে হবে দুর্বার জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় প্রতিরোধ। সংগ্রাম করতে হবে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

বর্তমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোকে বজায় রেখে বৃহৎ জনগোষ্ঠির কল্যাণ সম্ভব নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। এখনও প্রতিনিয়ত শোষক আর শোষিতের ব্যবধান বাড়ছে। সমস্ত দেশে লুটপাট করে যাচ্ছে অল্প কিছু মাস্তান, টাউট, ফড়িয়া এবং ক্ষমতাসীন শোষক শ্রেণী। অন্যদিকে মেহনতী সাধারণ জনগণ দিন দিন দুর্ভোগের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে তাদের জীবন। ঐতিহাসিকভাবেই মুক্তিযোদ্ধাদের আজ রাজনৈতিকভাবে সঙ্গবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ যে স্বপ্ন-আকাঙ্খা নিয়ে তারা একদিন অস্ত্র ধরেছিল তার সাথে রাজনীতি জড়িত। রাজনৈতিক কারণেই স্বাধীনতা লাভ করেছে বাংলাদেশ।

সাদামাটা ভাবে বলতে গেলে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাচার সংগ্রাম, সামাজিক অধিকার, জীবিকার প্রশ্ন, অর্থনৈতিক মুক্তি, ব্যক্তি হিসেবে নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজের প্রতি তার দায়িত্ব এসমস্ত কিছুর হিসাব-নিকাশই রাজনীতি। তাই জন্মের পর থেকেই প্রতিটি মানুষই রাজনৈতিক চেতনায় পরিচালিত। এ অবস্থায় নিজেকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করা নিজেকে অজান্তে প্রতারণা করারই সামিল।

মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক চিন্তা-চেতনা তাকে অবশ্যই করতে হয়। এবং রাজনীতিকে বাদ দিয়ে সমাজ সম্পর্কে কোন চিন্তা চেতনাই ফলপ্রসু নয়। দেশপ্রেমিক সচেতন মুক্তিযোদ্ধাদের আজ দেশ ও দেশবাসীর শত্রু মিত্রকে চিনতে হবে। অধিকারহারা বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করে যেতে হবে অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে। ‘৭১ এর মত এ সংগ্রামেও জিতবে জনগণ। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ সে বিজয়কে ত্বরান্বিত করবে। নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সততা, কর্মউদ্দোম, প্রজ্ঞাকে যথার্থ মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাদের শক্তি এবং উদ্দোমকে দেশ পুনর্গঠনের কাজে না লাগিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেন তিনি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ভারত তোষণ নীতি, ২৫ বছর মেয়াদের মৈত্রী চুক্তির নামে দাসখত লিখে দিয়ে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অবমাননা, আওয়ামী লীগ নেতা, পাতি নেতাদের দুর্নীতি, অবাধ চোরাচালান, রক্ষীবাহিনী, লালবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক প্রভৃতি বিভিন্ন বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়ন, ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রের নামে জাতীয়করণ নীতির ফলে সৃষ্ট চরম নৈরাজ্য, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়া এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের বৃহৎ অংশ যখন সরকার বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হয়ে উঠে তখন বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ সরকারের দুঃশাসনের হাতিয়ার না হয়ে জনগণের সংগ্রামের প্রতিই সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেন। কেন এই ব্যতিক্রম? এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আধুনিক কালে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে সামরিক বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে তার বিশ্লেষন প্রয়োজন।

এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশের প্রায় সব দেশই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো অস্ত্রবলে দখল করে নেয়। দখল করে নেবার পর ঔপনিবেশিক প্রভুরা প্রতিটি দেশে জাতীয় শোষক শ্রেণীর যোগসাজসে গড়ে তোলে দু’টো প্রশাসনিক হাতিয়ার, সেনা বাহিনী এবং আমলাতন্ত্র। নিজেদেরকে জনগণের প্রত্যক্ষ শোষক হিসেবে প্রতিপন্ন না করার এক অপূর্ব ব্যবস্থা। ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এ কৌশল গ্রহণ করে জাতীয় শোষক শ্রেণীকে যৎসামান্য সুখ-সুবিধা দিয়ে জাতীয় সম্পদের সিংহভাগ তারা নিয়ে যায় নিজেদের দেশে। জাতীয় শোষক শ্রেণীকে বশীভূত করে তাদের বিদেশী ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আকৃষ্ট করতেও সমর্থ হয় ঔপনিবেশিক প্রভুরা প্রগতি ও মানবতাবাদের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। বিজাতীয় শোষণের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে জনগণের মাঝে। তারা মনে করে বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেই তাদের দাসত্ব ঘুচে যাবে। দেশের উন্নতি হবে এবং জীবনের মান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। তারই ফলে শুরু হয় জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম। সংগ্রামের প্রচন্ডতার মুখে এক পর্যায়ে প্রত্যক্ষ শোষণ টিকিয়ে রাখা অসম্ভ হয়ে পড়লে ঔপনিবেশিক শাসকরা পরোক্ষ শোষণের বন্দোবস্ত করে। জাতীয় উচ্চবিত্ত ও তাদের দোসরদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা দান করে প্রতিটি দেশের উপর পরোক্ষভাবে তাদের শোষণ কায়েম রাখে। বিদেশী প্রভুদের জায়গায় নতুন দেশী প্রভুরা ক্ষমতায় আসীন হয়ে তাদের প্রভুদের শিক্ষা অনুযায়ী এবং প্রভুদের প্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনী, শাসন ব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্রকে অটুট রেখে নিজেদের স্বার্থে জনগণের বিরুদ্ধে তাদের প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে থাকে। জাতীয় শোষক শ্রেণীর এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শুরু হয় জাতীয় শোষণ ও শাসন। ফলে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। দেশগুলো আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক সূত্রে অর্থনৈতিকভাবে জরাজীর্ণ এসমস্ত দেশগুলোর শাসনভার যারা গ্রহণ করে তাদের অযোগ্যতা, প্রশাসন চালানোর অনভিজ্ঞতা, লোভ-লালসা, কোন্দল এবং ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়ায় পালাক্রমে ক্ষমতা হাতবদল হতে থাকে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের দ্বারা গঠিত দলগুলোর মধ্যে। এই ‘মেরি গো রাউন্ড’ এর গোলক ধাধায় আজও তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। সামরিক বাহিনীই ক্ষমতায় থাকুক আর বেসামরিক রাজনৈতিক নেতারাই ক্ষমতায় থাকুক তাদের শিকড় একই শ্রেণীতে। তাই তাদের মধ্যে থাকে এক অটুট বন্ধন। তাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইকে রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে জাহির করার প্রচেষ্টা একটা প্রহসন মাত্র। জনগণকে বোকা বানানোর আরেকটি কায়দা। তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যতই তীব্র হোক না কেন জনগণের বিরুদ্ধে নিজেদের কায়েমী স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা নিজেদের বিবাদ ভুলে সব এক হয়ে যায়। এর ফলেই সম্ভব হয় সমঝোতার মাধ্যমে লোক দেখানো গণতন্ত্রের খেলা, দলবদলের ভেলকিবাজী। এই উদ্দেশ্যেই মুক্তিযুদ্ধের অস্বাভাবিক ইতি টানার সাথে সাথে ঔপনিবেশিক ছাঁচে গড়া রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো পুরোপুরি অক্ষুন্ন রাখার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *