শওকত সাহেবের বাইরে হাঁটাহাঁটির পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এখন আর আগের মত দুপুরে খেতে আসেন না। কোনো একটা সস্তা হোটেলে ঢুকে পড়েন। খাওয়া-দাওয়া সেরে চেয়ারে বসেই খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নেন। এই নিয়ে হোটেলওয়ালাদের সঙ্গে মাঝে মাঝে মৃদু বাচসা হয়। সেদিন একেবারে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেল। নীলক্ষেতের এক হোটেলওয়ালা বিরক্ত মুখে বলল এই যে ঘুমান কেন? ভাত খাইছেন এখন যান। অন্য কাস্টমাররা বসুক।
শওকত সাহেব লজ্জিত হয়েই উঠে পড়লেন। ক্ষেপে গেল অন্য কাস্টমাররা একজন বুড়ো মানুষ খাওয়ার পর বিশ্রাম করছে, আর তুমি যে জোর করে তুলে দিলে। পয়সাটাই শুধু দেখ।
দেখতে দেখতে ওদের সঙ্গে হোটেলওয়ালার তুমুল লেগে গেল। প্রায় হাততাতির উপক্রম। এ সব ক্ষেত্রে যা হয় হোটেলওয়ালার পরাজয় হল। এবং সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, যান ভাই ঘুমান, ঐ বুড়া মিয়ারে একটা বালিশ আইন্যা দে।
শওকত সাহেব দ্বিতীয় দফায় ঘুমুতে গেলেন না। বিল মিটিয়ে চলে এলেন। লোকজন ইদানীং তাকে বুড়ো মিয়া ডাকছে। হঠাৎ করে বুড়ো হয়ে গেছেন নাকি? পান। কিনতে গিয়ে খুব নজর করে আয়নায় নিজেকে দেখলেন। চেহারা তো আগেই মতই আছে। শুধু কপালের কাছের কিছু চুল ইন্দিরা গান্ধীর মত পেকে গেছে। তবু সবাই কেন বুড়ো ভাবতে শুরু করল।
অবশ্যি বুড়ো হবার অনেক সুবিধাও আছে। বাসে উঠলে সহজেই সিট পাওয়া যাচ্ছে। গতকালই গুলিস্তান যাচ্ছিলেন। লেডিস সিটে বসা অল্পবয়সী একটা মেয়ে বলল জায়গা আছে বসুন না। মেয়েটি সরে কিছু জায়গা করে দিল।
কোথায় যাওয়া যায়? বাইরে বেশ রোদ। রোদ না কমলে হাঁটাহাঁটি করে আরাম পাওয়া যায় না। কোনো পার্ক-টার্কে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলে কেমন হয়? শওকত সাহেব চলে গেলেন সোহরাওয়াদী উদ্যানে। এই দুপুরের রোদেও জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে দেখা গেল। প্রেমের সুবিধা দেয়ার জন্যেই কি সরকার এই পার্ক বানিয়েছেন? এই ধরনের কথা ভাবতে ভাবতে শওকত সাহেব একটা ফাঁকা বেঞ্চ খুঁজে বের করলেন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমুলেন। বেশ লাগল তাঁর।
আজও তিনি সে রকম করবেন ভাবলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মত বদলে চলে গেলেন নিজের অফিসে। মল্লিক। বাবুর কাছে পঞ্চাশ টাকা পাওনা আছে ম্যাদি পাওয়া যায়। আজ মাসের এক তারিখ, হাতে টাকা থাকার কথা। তার নিজের হাত দ্রুত খালি হয়ে আসছে। কয়েক দিনের মধ্যেই হয়ত মুনার কাছে হাতখরচ চাইতে হবে।
আরে আরে শওকত সাহেব যে, কোথায় ডুব দিয়েছিলেন?
শওকত সাহেব হকচকিয়ে গলেন। অফিসের কোথাও যেন সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন হয়েছে। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে তার দিকে। তার পোস্টে যে নতুন ছেলেটির অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে সে উঠে দাঁড়িয়ে স্নামালিকুম দিল। জসীম সাহেব হাসি মুখে বললেন, এসেছেন ভাল হয়েছে, অনেক কথা আছে। শরীর কেমন আপনার বলেন?
শরীর ভালই।
ভাল কোথায়? আপনি তো ভাই বুড়ো হয়ে গেছেন। এ কি অবস্থা!
সংসারে অনেক ঝামেলা গেল। আমার স্ত্রী মারা গেছেন।
তাই নাকি? আহা বলেন কি? বড় আফসোসের কথা। কোনোই খবর রাখি না। ঐদিন অবশ্যি মল্লিক বাবু বলছিলেন চলেন যাই খোঁজ নিয়ে আসি। ঝামেলার জন্য যেতে পারলাম না। অডিট হচ্ছে। কোনো কোনো দিন আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকতে হয়। চলেন ক্যান্টিনে চলেন। চাটা কিছু খাই।
চা খাব না। এই মাত্র ভাত খেয়ে এসেছি।
চা না খাবেন অন্য কিছু খাবেন। পেপসি খান। ফান্টা খান? আপনার সাথে কথা আছে।
অফিসের ক্যান্টিনাটিরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কাঠের চেয়ার সরিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ার দেয়া হয়েছে। টেবিলের উপর পরিষ্কার টেবিল ক্লথ। জসীম সাহেব বললেন, ক্যান্টিনের ভোল পাল্টে গেছে, বুঝলেন তো?
জি।
ক্যান্টিন এখন ইউনিয়নের হাতে। ইউনিয়ন ক্যান্টিন চালাচ্ছে। এখন ইউনিয়ন খুব সন্ট্রং। এই জন্যেই আপনাকে খুঁজছিলাম।
কেন আমাকে কেন?
শওকত সাহেব বড়ই অবাক হলেন। ইউনিয়ন তাকে কেন খুঁজছে, সেটা জেনে তার বিস্ময়ের পরিমাণ আরো বাড়ল।
আপনাদের মামলাটার ব্যাপারেই খোঁজ হচ্ছে। আমরা সিরিযাস চাপ দিয়েছি। আমরা বলেছি, আসল যে আসামি দিব্যি চাকরি করছে বেতন নিচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কেইস তোমরা তুলে নিয়েছ। আর যে নিরপরাধ তাকে জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। আমরা এটা হতে দেব না।
আমি নিরপরাধ না।
আপনি তো এটা বললে হবে না। আমরা ব্যাপারটি জানি। আপনাকে সিগনেচার করতে বলা হয়েছে। আপনি দুর্বল মানুষ, ভয়ের চোটে সিগনেচার করেছেন। আপনার মুখ বন্ধ রাখার জন্য কিছু টাকা আপনার হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে, ব্যস।
শওকত সাহেব কপালের ঘাম মুছলেন।
ইউনিয়নের চাপে ওদের অবস্থা এখন কাহিল। সাপের ব্যাঙ খাওয়ার মত অবস্থা। ফেলতেও পারছে না গিলতেও পারছে না। হা হা হা। বারবার যে আপনার মামলার তারিখ পড়ছে, কি জন্যে পড়ছে? এই জন্যেই পড়ছে। ওরা সময় নিচ্ছে। আপনি এসেছেন যখন এক কাজ করুন। বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন।
দেখা করব?
হ্যাঁ। জাস্ট দেখা করবেন। অন্য কিছু বলার দরকার নেই। বড় সাহেব কিছু বললে শুনবেন।
সাহস হয় না।
সাহসের এখানে কি আছে, যান তো। ব্যাটার রি-অ্যাকশনটা কি দেখেন।
বড় সাহেব তাকে প্রথম চিনতেই পারলেন না। শওকত সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, স্যার আমি শওকত। ক্যাশ সেকশনের।
ও আচ্ছা। একি অবস্থা হয়েছে। আপনার?
অনেক রকম বিপদ-আপদ যাচ্ছে স্যার; জানেনই তো। তার ওপর স্ত্রী মারা গেলেন।
তাই নাকি? কবে?
গত মাসের চব্বিশ তারিখ?
আই অ্যাম সরি। আই অ্যাম ভেরি সরি। বসুন বসুন চা খান!
জি না স্যার চা খাব না।
খাবেন না কেন–খান। সাড়ে তিনটা বাজে, এখন অলমোস্ট টি টাইম।
শওকত সাহেব সংকুচিত ভঙ্গিতে বসলেন। বড় সাহেব বললেন, আপনার নিজের শরীর কেমন?
শরীর ভালই। মামলাটা নিয়ে ঘোরাঘুরি বেশি হয়। বারবার ডেট পড়ে। জেল-টেল যা হবার একবারে হয়ে গেলে ভাল ছিল।
জেলে যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছেন?
জি স্যার।
বাসায় কে আছে? আমার একটা মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে, একটা ছেলে আছে ক্লাস সেভেনে পড়ে। আর আমার ভাগ্নী আছে একটি।
বড় সাহেব হঠাৎ বললেন, ধরুন আপনাকে যদি জেলে যেতে হয় তাহলে ওদের দেখাশোনা কে করবে?
আমার ভাগীই করবে স্যার। আমি সেটা নিয়ে চিন্তা করি না। ও খুব তেজী মেয়ে। বড় সাহেবের ঘরের চা শওকত সাহেবের খুব পছন্দ হল। এই চা ক্যান্টিন থেকে আসে না। আলাদা তৈরি হয়। হালকা লিকার, মিষ্টি মিষ্টি একটা গন্ধ। আসল চায়ের গন্ধ বোধ হয় এ রকমই।
স্যার যাই।
ঠিক আছে যান। আর শোনেন, বেশি চিন্তা করবেন না। স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখবেন। ঐ মামলাটা নিয়ে কোম্পানি চিন্তা-ভাবনা করছে। হয়ত শেষ পর্যন্ত তুলে নেবে। যদিও আমি ঠিক সিওর না।
শওকত সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
আপনি দিন সাতেক পর খোঁজ নেবেন।
শওকত সাহেবের কি করা উচিত? ছুটে গিয়ে বড় সাহেবকে জড়িয়ে ধরা? কেঁদে ফেলা? এর কোনোটাই তিনি করতে পারলেন না। বেকুবের মত চারদিকে তাকাতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হেঁচকি উঠে গেল।
মল্লিক বাবু ধারের পঞ্চাশ টাকা ফিরিয়ে দিলেন। গলার স্বর নিচু করে বললেন, এই টাকায় ভাল দেখে দৈ-মিষ্টি কিনে নিয়ে যান। আমোদ-ফুর্তি করেন।
শওকত সাহেব সত্যি সত্যি পঞ্চাশ টাকারই সন্দেশ কিনে ফেললেন। চল্লিশ টাকার কিনলে ভাল হত, রিকশা করে বাসায় ফিরতে পারতেন। এখন যেতে হবে হেঁটে হেঁটে। কিন্তু বেশ লাগছে। হাঁটতে। কিসের যেন একটা মিছিল বের হয়েছে। তিনি মিষ্টির প্যাকেট হাতে ওদের সঙ্গে মিশে গেলেন। মিছিলের সঙ্গে হাঁটা বেশ মজার ব্যাপার। নিজেকে তখন আর ক্ষুদ্র মনে হয় না। শওকত সাহেব কোনো কিছু না বুঝেই দলের সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে হুংকার দিতে লাগলেন–দিতে হবে দিতে হবে।
তিনি বাসায় পৌঁছলেন সন্ধ্যাবেলা! বাসায় তখন ছোটখাটো একটা উত্তেজনার ব্যাপার চলছে। পুরনো ফ্যানটি নিয়ে আসা হয়েছে। বাকের-এর তত্ত্বাবধানে সেই ফ্যান ফিট করা হয়েছে। সুইচ টিপতেই ফ্যানে এক ধরনের কক্ষপন দেখা গেল। মেঘ ডাকার মত একটা শব্দ হয়ে সমস্ত ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। বাকের বলল শালা মদনা। হারামজাদার সবগুলি দাঁত আমি খুলে ফেলব। বকুল খিলখিল করে হেসে ফেলল।
হাসির কি হল? এর মধ্যে হাসির কি হল? কেউ একটা মোমবাতি আনো না। আরো ব্যাপার কি?
হ্যারিকেন, মোমবাতি, কুপী কিছুই পাওয়া গেল না। এ রকম একটা বিশৃঙ্খল অবস্থায় শওকত সাহেব মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে উপস্থিত হলেন। তার খুব ইচ্ছা ছিল ওরা জিজ্ঞেস করবে মিষ্টি কি জানো? কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না।
মুনা এক টুকরো সন্দেশ মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিল বাসি সন্দেশ। কোথেকে আনলে মামা?
শওকত সাহেব রাত আটটায় সন্দোশের দোকানে রওনা হলেন ফিরিয়ে দিয়ে পয়সা নিয়ে আসতে। বয়স হয়েছে টের পাওয়া যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। মুনার কাছ থেকে চেয়ে রিকশা ভাড়াটা নিয়ে এলে হত।
ঠাণ্ডাও লাগছে। এবার কি আগেভাগে শীত পড়ে গেল নাকি? গরম চাদরটা সঙ্গে আনলে হত।