বাইবেলের আদি উৎস প্রসঙ্গে
পুস্তকাকারে সংকলনের পূর্বে বাইবেল ছিল ঐতিহ্যবাহী জনকথা অর্থাৎ মানুষের স্মৃতিনির্ভর কাহিনী। আদিতে এই ধরনের স্মৃতিচারণই ছিল ভাবাদর্শ প্রচারের একমাত্র উপায়। আর এই ঐতিহ্যনির্ভর স্মৃতিকথা সম্প্রচারের প্রধান মাধ্যম বা বাহন ছিল সঙ্গীত।
ই. জ্যাকোব লিখেছেন, “আদিযুগের মানুষেরা ছিল সঙ্গীতপ্রিয়। অন্যান্য স্থানের মতো ইহুদীদের মধ্যেও আগে কবিতা সৃষ্টি হয়েছে, পরে এসেছে গদ্য। ইহুদী সঙ্গীত ছিল সুদীর্ঘ এবং সুন্দর। সঙ্গীতই ছিল তাঁদের আনন্দ ও বেদনা প্রকাশের বাহন। এভাবে সঙ্গীতের মাধ্যমে তাঁরা ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে এমনভাবে একাত্মতা বোধ করতেন যে, প্রত্যেকটি ঘটনা যেন তারা প্রত্যক্ষ করছেন। এছাড়াও, ইহুদীরা তাঁদের সঙ্গীতকে ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়ের প্রকাশ হিসেবে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস পেতেন।” বিভিন্ন কারণ ও ঘটনা উপলক্ষে ইহুদীরা সঙ্গীতের মাধ্যমে নিজেদের মনোভাব প্রকাশ করতেন। এ প্রসঙ্গে ই. জ্যাকোব বেশকিছু উপলক্ষের কথা উল্লেখ করেছেন। এভাবে নানাবিষয় ও ঘটনা উপলক্ষে রচিত বিভিন্ন সঙ্গীত বাইবেলে স্থান লাভ করেছে। যেমন–ভোজন-সঙ্গীত, ফসল কাটার গান ইত্যাদি। এছাড়াও বিশেষ কোনো কর্মকাণ্ড উপলক্ষে রচিত গান যেমন–বিখ্যাত কূপ খননের গান (বাইবেলের পুরাতন নিয়ম, গণনাপুস্তক ২১, ১৭), বিবাহ-সঙ্গীত, সঙ্গীত সম্পর্কিত সঙ্গীত এবং বিলাপ-সঙ্গীত। বাইবেলে যুদ্ধ-সংক্রান্ত বেশকিছু সঙ্গীতও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দেবোরা সঙ্গীত (ঐ, বিচারকগণ ৫, ১-৩২) এবং সদাপ্রভুর (জেহোভা) ইচ্ছায় ও নেতৃত্বে অর্জিত বিজয়ের গান (ঐ, গণনাপুস্তক ১০, ৩৫) : “আর সিন্দুক এগিয়ে যাওয়ার সময় মোশি বলতেন :
“হে সদাপ্রভু, ওঠ, তোমার শত্রুগণ ছিন্নভিন্ন হউক, তোমার বিদ্বেষীগণ তোমার সম্মুখ থেকে পলায়ন করুক।”
এ ছাড়াও বাইবেলে রয়েছে নীতিবাক্য ও প্রবাদ (বুক অব প্রভার্ব : হিস্টোরিক বুকস-এর প্রবাদ ও নীতিমালা দ্রষ্টব্য), আশীর্বাদ বা অভিশাপবাণী এবং নবুয়তপ্রাপ্তির পর নবীগণ কর্তৃক মানুষের প্রতি প্রদত্ত আসমানী বিধিবিধান সংক্রান্ত বাণী।
ই. জ্যাকোবের মতে, এসব বাণী ও কাহিনী পরিবার পরম্পরায় অথবা উপাসনালয়গুলো মাধ্যমে স্রষ্টা কর্তৃক মনোনীত মানুষের (নবীর) তথা ইতিহাসের কাহিনী বা গাধা হিসেবে জারি ছিল। ইতিহাসের এসব কাহিনী কখনো কখনো লোকমুখে গল্প-কথায় পরিণত হয়েছে। যেমন : বোথমের গল্প-কথা। (বিচারকগণ ৯, ৭-২১) যেখানে বলা হয়েছে, “একদা বৃক্ষগণ আপনাদের উপর অভিষেককরণার্থে রাজার অনেষণে গমন করিল–তাহারা জলপাই, ডুমুর, আঙুর এবং কণ্টকবৃক্ষকে কহিল” ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে ই. জ্যাকোবের অভিমত হলো, “কাহিনীকে সুন্দর করে তোলার বাসনায় এসব বর্ণনা টেনে আনা হয়েছে। কাহিনীতে ‘অশ্রত ইতিহাসের ঘটনাও বর্ণিত হয়েছে; এসেছে সেকালের নানা বিবরণীও। এভাবে জানা-অজানা কাহিনী বর্ণিত হয়েছে বটে, কিন্তু বর্ণনার গতি কোথাও ব্যাহত হয়নি।”
উপসংহারে ই. জ্যাকোবের বক্তব্য হলো : “ওল্ড টেস্টামেন্টে (বাইবেলের পুরাতন নিয়মে) হযরত মুসা এবং অন্যান্য গোষ্ঠীপতির যে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে, তাতে খুব সম্ভব ধারাবাহিক ইতিহাসের ঘটনা প্রতিফলিত হয়েছে, একান্ত প্রক্ষিপ্তভাবেই। বহুবিচিত্র এইসব কাহিনী বর্ণনাকালে কথককে জোড়াতালির স্বার্থে এ ধরনের বহু কল্পনা ও গল্প-কথার আশ্রয় নিতে হয়েছে। পরিশেষে, এসব বর্ণনাকে সুন্দর ও বিশ্বাসযোগ্য করে ইতিহাস হিসেবে করা হয়েছে উপস্থাপন। আর এ থেকেই আধুনিক চিন্তাবিদ সমালোচককে বুঝে নিতে হচ্ছে যে, পৃথিবীর ও মানবজাতির সূচনাপর্বে কী ঘটেছিল।”
এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, খ্রিস্টপূর্ব শতকের শেষভাগে ইহুদীরা যখন কেনানে বসতি স্থাপন করেছিল, তখন থেকেই ঐতিহ্যবাহী এসব কাহিনী লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়। তবে, সে লেখা যে নির্ভুল ছিল, তা নয়। এমনকি আইন বা বিধানের মতো যেসব বিষয় মানুষের চাহিদা ছিল সর্বাধিক, সেসব যেমন-তেমনি অন্য আরো যেসব বিষয় স্থায়ীভাবে ধরে রাখা প্রয়োজন ছিল যেসব বিধান এবং বিষয়ও নির্ভুলভাবে উল্লিখিত হয়নি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিধাতার নিজ হাতে রচিত বলে প্রচারিত দশটি বিধান বা টেন-কম্যান্ডমেন্টস। ওল্ড টেস্টামেন্টে এই টেন-কম্যান্ডমেন্টস-এর দু’টি পৃথক ও ভিন্নপাঠ বিদ্যমান : একটি যাত্রাপুস্তকে (২০, ১-২১) এবং অপরটি দ্বিতীয় বিবরণীতে (৫, ১-৩০)। মূল বক্তব্যের দিক থেকে এ দুটির মধ্যে খুব বেশি অমিল নেই; কিন্তু এ দুটি রচনায় বর্ণনার পার্থক্য স্পষ্ট। এছাড়াও, তখন বিভিন্ন চুক্তি, চিঠিপত্র, ব্যক্তিত্বের তালিকা (বিচারক, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, বংশ তালিকা ইত্যাদি) এবং দান ও লুণ্ঠনের বিশদ বিবরণ ও এতদসংক্রান্ত বিভিন্ন দলিল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। এরফলে গড়ে উঠেছিল আর্কাইভ বা সরকারি মোহাফেজখানা বা সংরক্ষণাগার। বাইবেল-সংক্রান্ত চূড়ান্ত রচনা প্রণয়নে এই মোহাফেজখানায় রক্ষিত দলিলপত্রাদি ব্যবহৃত হয়েছিল। এভাবেই প্রণীত হয়েছিল এখন আমাদের হাতের কাছে পাওয়া বাইবেলের পুরাতন নিয়ম। আর এভাবে বাইবেলের নামে সংকলিত পুস্তকটিতেও বিভিন্ন লেখকের রচনার ঘটেছিল সংমিশ্রণ। প্রাপ্ত এসব দলিলপত্রসমূহ কেন যে এরকম বিসদৃশ পাঁচমিশালীভাবে পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ ও সংকলিত হয়েছিল, তার কারণ খুঁজে বের করার দায়িত্ব বিশেষজ্ঞদের।
প্রকৃতপক্ষে, বাইবেলের পুরাতন নিয়মের গোটাটাই এমনিভাবে প্রচলিত লোক-ঐতিহ্যের ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল। সুতরাং, যে পদ্ধতিতে এটি প্রণীত হয়েছে তাতে সময় যদি অন্যরকম হত, আর এসব ঘটনাস্থল যদি হত ভিন্ন, তাহলে আদিযুগের আর পাঁচটি সাহিত্যের মতোই এই বাইবেলও তুলনামূলকভাবে সম্পূর্ণ আলাদা এক সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে পরিণত হতে পারতো এবং তা যদি হত, তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকতো না।
উদাহরণ হিসেবে রাজ-রাজড়াদের আমলে গড়ে ওঠা ফরাসী সাহিত্যের কথা বলা যেতে পারে। অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী তখন চালু ছিল ঐতিহ্যভিত্তিক লোককাহিনীকে সম্বল করে। অতীতের যুদ্ধ-কাহিনী (এরমধ্যে কোনো কোনো যুদ্ধ আবার খ্রিস্টধর্মের নিরাপত্তার স্বার্থে সংঘটিত); নানাধরনের উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনা, ফরাসী বীরদের বীরত্ব। সবকিছু শতাব্দীকাল পরেও রাজকবি, কাহিনীকার ও বিভিন্ন ধারার লেখকদের উদ্বুদ্ধ করেছিল সৃষ্টিধর্মী কিছু রচনা করতে। এভাবে একাদশ শতাব্দীর পর থেকে সত্যিকার ঘটনার সঙ্গে নানা উপকথা সংমিশ্রিত হয়ে লোক-গাথাসমূহ ফরাসী-সাহিত্যের অঙ্গনে নতুনভাবে উপস্থাপিত হতে শুরু হয়েছিল আর এভাবেই গড়ে উঠেছিল ফরাসী সাহিত্যের মহাকাব্যের ধারা। এরমধ্যে সুবিখ্যাত মহাকাব্যটি হচ্ছে ‘সং অব রোল্যান্ড। রোল্যান্ড ছিলেন সম্রাট শার্লিম্যানের সেনাপতি। স্পেন অভিযানশেষে দেশে ফেরার পথে তিনি যেসব ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তাতে যে দুঃসাহসিক অস্ত্রচালনার কৌশল ও বীরত্ব প্রদর্শন করে আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন, তার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল এই মহাকাব্যটি।
তবে, শুধু রোল্যান্ডের আত্মত্যাগ এই মহাকাব্যের একমাত্র উপজীব্য ছিল না। তারসঙ্গে সংমিশ্রিত হয়েছিল নানা গল্পকথা, বহু উপ-কাহিনী। রোল্যান্ডের আত্মত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল ৭৭৮ সালের ১৫ আগস্ট। বাস্তবে পার্বত্য এলাকার বাস্ক সম্প্রদায়ের লোকেরা রোল্যান্ডের ফেরার পথে তার উপরে হামলা চালিয়েছিল। সুতরাং, এই মহাকাব্যটি শুধু উপকথার বর্ণনা নয়, এর ঐতিহাসিক ভিত্তিও ছিল। কিন্তু তবুও কোনো ঐতিহাসিক এই মহাকাব্যের ঘটনাবলীকে সম্পূর্ণভাবে ইতিহাস হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হবেন না।
এ ধরনের একটি ধর্মনিরপেক্ষ সাহিত্য যেভাবে তৈরি হয়েছে, তারসঙ্গে বাইবেল রচনার হুবহু তুলনা চলে। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, অনেকে যেভাবে পদ্ধতিগত-বিচারে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে চান, আমরাও সেভাবে নানা উপ-কাহিনীর সংকলন হিসেবে ধরে নিয়ে বাইবেলের সব বক্তব্যকে হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইছি। না, তা নয়। বিশ্বসৃষ্টির বাস্তবতা, স্রষ্টা কর্তৃক হযরত মুসার উপরে টেন-কম্যান্ডমেন্টস বা দশধারার বিধান অবতীর্ণ করার ঘটনা আমরা বিশ্বাস করি এবং আমরা এও বিশ্বাস করি যে, হযরত সোলায়মানের আমলে যেমনটি হয়েছিল মানবিক বিষয়ে স্রষ্টার মধ্যস্থতা করার মত ঘটনা তাও অসম্ভব নয়। কিন্তু এই বিশ্বাস সত্ত্বেও আমরা এ কথা না বলে পারছি না যে, বাইবেলের পুরাতন নিয়ম আমাদের যা উপহার দিচ্ছে, তা ঘটনার সারার্থ মাত্র; পুরো সত্য ঘটনা নয়। কেনান একইসঙ্গে নানা কল্পকাহিনীর যে বিশদ বর্ণনা বাইবেলে স্থান পেয়েছে, সেসবের কঠোর সমালোচনা না করে উপায় নেই। বস্তুত, লোকমুখে প্রচলিত ঐতিহ্যগাথার ভিত্তিতে বাইবেল যাঁরা রচনা করেছিলেন, তারা মূলবাণীর সঙ্গে নিজেদের কল্পনা ও মানবীয় উপাদান এতো অধিকমাত্রায় সংযোজন করে গেছেন যে, সেক্ষেত্রে সমালোচনা অপ্রতিরোধ্য হতে বাধ্য।