পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – বাংলা সাহিত্য
চর্যাগীতির রচনা দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই সম্পূর্ণ হইয়াছিল। জয়দেবের গীতগোবিন্দ বাংলায় রচিত না হইলেও বাংলা সাহিত্যের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পান্বিত, তাহাও ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের মত সময়ে প্রণীত হইয়াছিল। ইহার পর প্রায় আড়াই শত বৎসর বাঙালীর সাহিত্যসৃষ্টির বিশেষ কোন নিদর্শন পাই না। এই সময়টাতে বাঙালী সংস্কৃত ভাষাতেও উল্লেখযোগ্য কিছু রচনা করে নাই, বাংলা ভাষাতে তো করেই নাই। কেন করে নাই, তাহা বলা দুঃসাধ্য। অনেকে মুসলমান বিজয়কেই এজন্য দায়ী করেন। তাঁহাদের মতে মুসলমান বিজেতাদের অত্যাচার ও তাহাদের হিন্দুদের গ্রন্থাদি নষ্ট করার প্রবণতার দরুণ এবং সারা দেশে অশান্তি ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করিতে থাকার দরুণই এদেশে এই সময়ে সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভবপর হয় নাই। কিন্তু এই অভিমত স্বীকার করা যায় না। কারণ হিন্দুদের সাহিত্যের প্রতি মুসলমানদের আক্রোশের কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই; আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অশান্তির সময়েও যে সাহিত্যিকের লেখনী নিশ্চল হইয়া থাকে না, তাঁহার বহু প্রমাণ বিভিন্ন দেশের সাহিত্যের ইতিহাস হইতে পাওয়া যায়। সুতরাং আলোচ্য সময়ে বাংলা দেশে সাহিত্যসৃষ্টির অনাবির্ভাবের কারণ এইভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ সম্বন্ধে নিশ্চিত করিয়া কিছু বলা সম্ভব নয়। সম্ভবত ইহার প্রকৃত কারণ এই যে, এই সময়ের মধ্যে কোন প্রতিভাধর সাহিত্যিক আবির্ভূত হন নাই। কিছু নগণ্য লেখক আবির্ভূত হইয়াছিলেন, তাহাদের অকিঞ্চিৎকর রচনা স্বতই লুপ্ত ও বিস্মৃত হইয়াছে।
১
বিদ্যাপতি
পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালী কবিদের মধ্যে দুইজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য চণ্ডীদাস ও কৃত্তিবাস। অবশ্য আরও একজন কবির নাম এই প্রসঙ্গে উল্লিখিত হইতে পারে-ইনি মৈথিল কবি বিদ্যাপতি। বিদ্যাপতি বাঙালী নহেন, এবং বাংলা ভাষায় কিছু লেখেন নাই। তাহা সত্ত্বেও তাঁহার নাম বাংলা সাহিত্যের সহিত অচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িত হইয়া গিয়াছে, কারণ বিদ্যাপতির জনপ্রিয়তা তাঁহার মাতৃভূমি মিথিলা অপেক্ষা বাংলা দেশেই অধিক হইয়াছিল; স্বয়ং চৈতন্যদেবের নিকট বিদ্যাপতির পদ অত্যন্ত প্রিয় ছিল। বিদ্যাপতি যে বাঙালী নহেন, সে কথাই এক সময়ে বাংলা দেশের লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল। বিদ্যাপতির শ্রেষ্ঠ পদগুলি বাংলা দেশেই সংরক্ষিত হইয়া কালের গ্রাস হইতে অব্যাহতি পাইয়াছে। এইগুলি এখন যে ভাবে পাওয়া যাইতেছে, তাহাতে বাঙালীর হাতের ছাপও অনেকখানি আছে। তাহা ভিন্ন বাংলায় প্রচলিত বিদ্যাপতি-নামাঙ্কিত পদগুলি যে সমস্তই মৈথিল বিদ্যাপতির রচনা, তাহাও নহে। ইহাদের মধ্যে পরবর্তীকালের এক বা একাধিক বাঙালী বিদ্যাপতির রচনা আছে; আছে সেই সমস্ত অজ্ঞাতনামা কবির রচনা, যাঁহারা নিজেদের পদকে অমরত্ব দান করিবার জন্য তাহাতে নিজের ভণিতা না দিয়া বিদ্যাপতির ভণিতা বসাইয়া দিয়াছিলেন; অধিকন্তু ইহাদের মধ্যে আছে অন্য অনেক কবির লেখা পদ, যেগুলির মধ্যে আদিতে মূল কবিরই ভণিতা ছিল, গায়নরা বা পুঁথি-লিপিকররা পদগুলির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করিবার জন্য তাহাদের ভণিতা বদলাইয়া মূল কবিদের নামের স্থলে বিদ্যাপতির নাম প্রবেশ করাইয়া দিয়াছেন। সুতরাং বিদ্যাপতি-নামাঙ্কিত পদগুলির মধ্যে কেবল মৈথিল বিদ্যাপতিরই রচনা নাই, অনেক বাঙালী কবিরও রচনা আছে। অতএব যেকোন দিক হইতেই দেখা যাক না কেন, বিদ্যাপতিকে বা তাঁহার নামাঙ্কিত পদগুলিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হইতে নির্বাসন দেওয়ার কোন উপায় নাই।
বিদ্যাপতি শুধু কবি ছিলেন না, নানা বিষয়ের নানা গ্রন্থও তিনি রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার লেখা গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে কয়েকটি স্মৃগ্রিন্থ দানবাক্যাবলী, বিভাগসার, কৰ্ষকৃত্য, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী ও ব্যাড়ীভক্তিতরঙ্গিণী, দুইটি গল্পের বই-ভূপরিক্রমা ও পুরুষ-পরীক্ষা, একটি পৌরাণিক নিবন্ধ শৈবসর্বস্বসার, একটি পত্র-লিখন বিষয়ক গ্রন্থ-লিখনাবলী, একটি নাটক গোরক্ষবিজয়, দুইটি সমসাময়িক রাজার কীর্তিগাথা-কীর্তিলতা ও কীর্তিপতাকা। বিদ্যাপতির রচিত পদগুলি নানা ধরনের; লৌকিক প্রেমবিষয়ক পদ, রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদ, হরগৌরী বিষয়ক পদ, গঙ্গা সম্বন্ধীয় পদ, অন্যান্য দেবদেবী বিষয়ক পদ, প্রহেলিকা পদ-প্রভৃতি অনেক ধরনের পদই তিনি রচনা করিয়াছিলেন; তন্মধ্যে লৌকিক প্রেমবিষয়ক পদ ও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদগুলিই সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত। তবে মির্ধিলায় তাঁহার হরগৌরী বিষয়ক পদগুলি সমধিক প্রসিদ্ধ। বিদ্যাপতির পদগুলি মৈথিলী ও ব্রজবুলি ভাষায়, কীর্তিলতা ও কীর্তিপতাকা অবহট্ট ভাষায় এবং অন্যান্য গ্রন্থগুলি সংস্কৃত ভাষায় রচিত। বিদ্যাপতির মত বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ও এতগুলি ভাষায় লেখনী ধারণে সক্ষম লেখক সে যুগে বোধ হয় আর কেহই জন্মগ্রহণ করেন নাই।
বিদ্যাপতির ব্যক্তিগত পরিচয় সম্বন্ধে প্রায় কিছুই অবগত হওয়া যায় না। তিনি পণ্ডিত ছিলেন ও জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন, ইহার অতিরিক্ত তাঁহার সম্বন্ধে আর বিশেষ কোন কথা প্রামাণিকভাবে জানা যায় না। তবে একটি বিষয় জানা যায় তিনি মিথিলা বা ত্রিহুতের ওইনিবার বংশীয় ব্রাহ্মণ রাজাদের এবং রাজপরিবারভুক্ত বিভিন্ন লোকদের পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন। এই সমস্ত রাজারা স্বাধীন ছিলেন না। জৌনপুরের সুলতান এই সময় ত্রিহুতের সার্বভৌম অধিপতি ছিলেন; তাঁহার অধীনে এইসব রাজারা সামন্ত ছিলেন। বিদ্যাপতি ভোগীশ্বর, কীর্তিসিংহ, দেবসিংহ, শিবসিংহ, পদ্মসিংহ, নরসিংহ, ধীরসিংহ, ভৈরবসিংহ প্রভৃতি অনেক রাজা ও রাজপুত্রের নিকটে পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন, তবে ইহাদের মধ্যে শিবসিংহের সহিতই তাঁহার সম্পর্ক ছিল সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ। কালিদাস ও বিক্রমাদিত্যের মত বিদ্যাপতি ও শিবসিংহের নামও এক সূত্রে গ্রথিত হইয়া আছে। শিবসিংহের রানী লছিমার নামও বিদ্যাপতির অনেক পদে উল্লিখিত হইয়াছে। তবে বিদ্যাপতি ও লছিমার পরকীয়া প্রেম সম্বন্ধে বাংলা দেশে যে কাহিনী প্রচলিত আছে, তাহা অমূলক।
বিদ্যাপতি একজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। প্রেমের মধুর, সুকুমার রূপ তাঁহার পদাবলীতে অপরূপভাবে শিল্পকলামণ্ডিত হইয়া রূপায়িত হইয়াছে। রূপের বর্ণনাতে তাঁহার জুড়ি নাই; বিশেষভাবে বয়ঃসন্ধি পর্যায়ের নায়িকার তরুণ লাবণ্যের বর্ণনায় তিনি অদ্বিতীয়। বিদ্যাপতির পদের বাণীসৌন্দর্যও অনন্যসাধারণ। তাঁহার ভাষা যেমন মার্জিত ও মধুর, ছন্দও তেমনি স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল, তাঁহার শব্দচয়নও ত্রুটিহীন। বিদ্যাপতির উপমা ও উৎপ্রেক্ষা অলঙ্কারগুলি অত্যন্ত মৌলিক ও হৃদয়গ্রাহী। অবশ্য বিদ্যাপতির অনেক পদে সৌন্দর্যের তুলনায় ভাবগভীরতার অভাব দেখা যায়। কিন্তু তাঁহার লেখা বিরহ ও ভাবসম্মিলন বিষয়ক পদগুলিতে আবার ভাবের অতলস্পর্শী গভীরতার নিদর্শন মিলে, বিরহের অপরিসীম শূন্যতা বিরহিণীর হৃদয়ের অন্তহীন হাহাকার এই পদগুলির মধ্যে অপূর্বভাবে রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে।
বাংলা দেশের পদাবলী-সংকলনগ্রন্থগুলিতে বিদ্যাপতির পদগুলিকে অত্যন্ত বিশিষ্ট স্থান দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু বাংলা দেশের বৈষ্ণব পদকর্ত্তারা শুধু কবি ছিলেন না, সেই সঙ্গে ভক্তও ছিলেন। বিদ্যাপতিও তাহাই ছিলেন বলিয়া অনেকে মনে করেন। কিন্তু বিদ্যাপতি কেবলমাত্র কবি ছিলেন, নিছক কাব্য-প্রেরণার তাগিদেই তিনি পদ লিখিয়াছিলেন; তিনি যে ভক্ত ছিলেন অথবা বৈষ্ণবধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন, তাঁহার কোন প্রমাণ এ পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই। বিদ্যাপতি নানা ধরনের পদ লিখিয়াছিলেন, তন্মধ্যে রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদও অন্যতম; রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদ রচনার দিকে তাঁহার যে বিশেষ ধরনের আসক্তি ছিল, তাহা নহে; তাঁহার প্রেমবিষয়ক পদগুলির মধ্যে অধিকাংশই লৌকিক প্রেমের পদ, এগুলিতে রাধাকৃষ্ণের নাম নাই; যেগুলিতে রাধাকৃষ্ণের নাম আছে, তাহাদের মধ্যে অনেকগুলিতে ভক্তিভাবের কোন নিদর্শন মিলে না, সেগুলিও প্রেমবিষয়ক পদ।
বিদ্যাপতির পদগুলি অপূর্ব হইলেও তাহাদের একটি ত্রুটি এই যে, তাহাদের মধ্যে অনেক স্থানে অশ্লীল ও রুচিবিগর্হিত বর্ণনা পাওয়া যায়; অসামাজিক ও অশোভন পরকীয়া প্রেমের নগ্ন বর্ণনাও তাঁহার অনেক পদে দেখা যায়; তবে এগুলির জন্য বিদ্যাপতি ততটা দায়ী নহেন, যতটা দায়ী তাঁহার সমসাময়িক কালের রুচি ও প্রবৃত্তি।
বিদ্যাপতির রচনা বলিয়া প্রসিদ্ধ এমন অনেক পদ বর্তমানে প্রচলিত আছে, যেগুলি অন্য কবিদের রচনা, যথা—’ভরা বাদর মাহ ভাদর’ ও ‘কি পুছসি অনুভব মোয়’; এই দুইটি পদ যথাক্রমে শেখর ও কবিবল্লভের রচনা।
বিদ্যাপতির আবির্ভাবকাল নির্ণয়ের প্রশ্ন কিছু জটিল। অনেক সমসাময়িক পুঁথিতে তাঁহার নাম পাওয়া যায়; এই সব পুঁথির তারিখ ‘লক্ষ্মণসেন-সংবতে’ (সংক্ষেপে ‘ল সং’) দেওয়া আছে। ল সং-এর আদি বৎসর কোন্ খ্রীষ্টাব্দে পড়িয়াছিল, সে সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কীলহর্ন মনে করিয়াছিলেন, ১১৯ খ্রীষ্টাব্দই ল সং-এর আদি বত্সর, কিন্তু এই মত ভিত্তিহীন। এ পর্যন্ত যে সমস্ত তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে দেখা যায় যে মিথিলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ল সং প্রচলিত ছিল এবং খ্রীষ্টাব্দের সঙ্গে তাহাদের পার্থক্য ১০৭৯ বৎসর হইতে সুরু করিয়া ১১১৯ বৎসর পর্যন্ত হইত।
যাহা হউক, ল সং-এ তারিখ দেওয়া পুঁথিগুলি হইতে একটা বিষয় জানা যায় যে, বিদ্যাপতি চতুর্দ্দশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ও মধ্যভাগে বর্তমান ছিলেন। এই পুঁথিগুলির সাক্ষ্য বাদ দিলেও বিদ্যাপতির আবির্ভাবকাল নির্ণয় করা যায়। বিদ্যাপতির প্রথম দিককার একটি পদে রাজা ভোগীশ্বরের নাম পৃষ্ঠপোষক হিসাবে উল্লিখিত হইয়াছে; ভোগীশ্বর ফিরোজ শাহ্ তোগলকের (রাজত্বকাল ১৩৫১-৮৮ খ্রী) সমসাময়িক। জৌনপুরে সুলতান ইব্রাহিক শর্কী পঞ্চদশ শতকের প্রথম দশকে ত্রিহুতে আসিয়া রাজা কীর্তিসিংহকে তাঁহার পিতৃসিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন; বিদ্যাপতি ঐ সময়ে জীবিত ছিলেন, কারণ তিনি এই ঘটনা স্বচক্ষে দেখিয়া তাঁহার কীর্তিলতা’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। বিদ্যাপতির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাজা শিবসিংহ পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে রাজত্ব করেন এবং ১৪১৫ খ্রীষ্টাব্দেই ইব্রাহিম শর্কী ও বাংলার রাজা গণেশের সংঘর্ষে গণেশের পক্ষাবলম্বন করেন। সুতরাং বিদ্যাপতি নিশ্চয়ই ১৪১৫ খ্রীষ্টাব্দেও জীবিত ছিলেন। বিদ্যাপতি রাজা নরসিংহেরও পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন, নরসিংহের একটি শিলালিপির তারিখ ১৩৭৫ শক বা ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দ। মোটের উপর বিদ্যাপতি আনুমানিকভাবে ১৩৭০ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৪৬০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলিয়া সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে। এইরূপ সিদ্ধান্ত করিলেই বিদ্যাপতির জীবঙ্কাল সম্বন্ধে প্রাপ্ত সমস্ত তথ্যের এবং তাঁহার ভোগীশ্বর হইতে নরসিংহ পর্যন্ত রাজাদের পৃষ্ঠপোষণ লাভ করার সামঞ্জস্য করা যায়।
নরসিংহের এক পুত্র ধীরসিংহ পিতার জীবদ্দশাতেই রাজা হইয়াছিলেন, কিন্তু অপর পুত্র ভৈরবসিংহ পিতার পরে রাজা হন। বিদ্যাপতি তাঁহার কোন কোন পদ ও গ্রন্থে ভৈরবসিংহের নাম উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু সর্বত্র তাঁহাকে তিনি রাজপুত্র’ বলিয়াছেন, কোথাও ‘রাজা বলেন নাই। ভৈরবসিংহ ১৪৭৩ খ্রীষ্টাব্দে রাজা হন বলিয়া প্রামাণিকভাবে জানা যায়; সুতরাং বিদ্যাপতি যে ১৪৭৩ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই পরলোক গমন করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ অল্প।
২
চণ্ডীদাস
চণ্ডীদাস একজন শ্রেষ্ঠ ও অবিস্মরণীয় কবি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাঁহাকে লইয়া এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি হইয়াছে। সংক্ষেপে আমরা এই সমস্যাটি সম্বন্ধে আলোচনা করিতেছি।
চণ্ডীদাসের নামে অনেকগুলি শ্রেষ্ঠ বাংলা রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদ প্রচলিত আছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত সকলে এইগুলিকেই কবি চণ্ডীদাসের একমাত্র কৃতি বলিয়া জানিত। চণ্ডীদাস যে চৈতন্য-পূর্ববর্তী কবি, তাহাতেও কাহারও কোন সন্দেহ ছিল না, কারণ কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ও অন্যান্য প্রামাণিক বৈষ্ণব গ্রন্থে লেখা আছে যে চৈতন্যদেব চণ্ডীদাসের লেখা গীত শুনিতেন।
কিন্তু ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ হইতে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে একখানি নবাবিষ্কৃত গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার ফলে সমস্যার সৃষ্টি হইল। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন একখানি রাধাকৃষ্ণবিষয়ক আখ্যানকাব্য; জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড–ইত্যাদি অনেকগুলি খণ্ডে কাব্যখানি বিভক্ত; ভণিতায় এই কাব্যের রচয়িতার নাম পাওয়া যায় ‘বড় চণ্ডীদাস’। কাব্যখানির ভাষা প্রাচীন ধরনের, রচনার মধ্যে লেখকের পাণ্ডিত্য ও অলঙ্কারপ্রীতির নিদর্শন আছে, উপরন্তু তাঁহার মধ্যে স্কুল আদিরস এবং অশ্লীল বর্ণনার নিদর্শন অনেক স্থানে মিলে; কাব্যের মধ্যে কবিত্বের পরিচয় যথেষ্ট থাকিলেও কাব্যটিতে আধ্যাত্মিকতা বিশেষ নাই, উৎকট লালসার কথাই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। কিন্তু চণ্ডীদাসের নামে প্রচলিত শ্রেষ্ঠ পদগুলির ভাষা আধুনিক ভাষার কাছাকাছি, তাহাদের মধ্যে লেখকের পাণ্ডিত্য প্রদর্শন বা কৃত্রিম অলঙ্কার সৃষ্টির কোন নিদর্শন নাই এবং তাহাদের ভাব অত্যন্ত পবিত্র ও অপার্থিব আধ্যাত্মিকতায় পূর্ণ। অবশ্য দুইটি বিষয়ে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সঙ্গে চণ্ডীদাস নামাঙ্কিত পদাবলীর মিল দেখা গেল; উভয় রচনাতেই কবি মাঝে মাঝে ‘বাসলী’ (বা “বাশুলী”) দেবীর বন্দনা করিয়াছেন আর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র মত পদাবলীতেও অনেক স্থানে কবির ভণিতায় ‘বড় চণ্ডীদাস’ নাম পাওয়া যায়। ইহার পরে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একটি পদ রূপান্তরিত আকারে প্রচলিত পদাবলীর মধ্যে পাওয়া গেল। চৈতন্যদেবের বিশিষ্ট পার্ষদ সনাতন গোস্বামী তাঁহার বৃহৎবৈষ্ণবতোষণী’ নামক ভাগবতের টীকার মধ্যে চণ্ডীদাস রচিত ‘দানখণ্ড-নৌকাখণ্ড’র উল্লেখ করিয়াছেন বলিয়াও আবিষ্কৃত হইল।
যাহা হউক, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ প্রকাশিত হইবার পর হইতেই এই গ্রন্থ ও চণ্ডীদাস নামাঙ্কিত শ্রেষ্ঠ পদগুলি এক লোকের লেখা কিনা, সে সম্বন্ধে বিতর্ক চলিয়া আসিতেছে। অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালে একজন অর্ব্বাচীন চণ্ডীদাসের লেখা একটি বৃহৎ কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক আখ্যানকাব্য আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত হইয়াছে। এই বইটির মধ্যে কবি অনেকবার “দীন চণ্ডীদাস” নামে নিজেকে অভিহিত করিয়াছেন। এই কাব্যটিতে চৈতন্যদেবের পরবর্তীকালের ভাবধারার প্রভাব আছে এবং রূপ গোস্বামীর গ্রন্থের নাম আছে। পর্তুগীজ শব্দও আছে। বইটির মধ্যে কবিত্বশক্তি বিশেষ কিছুই নাই। এই বইখানি ছাড়াও চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত আরও বহু নিকৃষ্ট পদ পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত হইয়াছে। চণ্ডীদাসের ভণিতার বহু সহজিয়া পদও পাওয়া গিয়াছে।
পূর্ব্বোল্লিখিত বিষয়গুলি মিলিয়া চণ্ডীদাস-সমস্যাকে এত ঘোলা করিয়া তুলিয়াছে যে, এ সম্বন্ধে সর্বদিসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত ইহবার আশা করা যাইতে পারে না। তবে, যে সমস্ত বিষয় সম্বন্ধে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ একমত, সেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হইল।
১। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ চৈতন্য-পূর্ববর্তী কালের রচনা। কোন কোন পণ্ডিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে চৈতন্য-পরবর্তী রচনা বলিতে চাহেন, কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর ভাষার প্রাচীনতা, আদিরসের স্থূলতা, ইহার মধ্যে বিভিন্ন বিষয়বস্তু ও প্রাচীন ভাবধারার নিদর্শন মেলা এবং সনাতন গোস্বামী কর্ত্তৃক চণ্ডীদাস রচিত “দানখণ্ড-নৌকাখণ্ড”র উল্লেখ–এই সমস্ত কারণের জন্য ইহাকে চৈতন্য-পূর্ববর্তী রচনা বলাই সঙ্গত।
২। চৈতন্যদেবের পূর্বে মাত্র একজন চণ্ডীদাসই ছিলেন, তিনি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ু চণ্ডীদাস। অবশ্য ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ চৈতন্যদেব আস্বাদন করেন নাই, করিলে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এমনভাবে বিস্মৃত ও লুপ্তপ্রায় হইত না। সুতরাং বড় চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ছাড়া কতকগুলি পদও লিখিয়াছিলেন এবং চৈতন্যদেব তাহাই আস্বাদন করিয়াছিলেন–এইরূপ মনে করাই যুক্তিসঙ্গত।
৩। চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত শ্ৰেষ্ঠ পদগুলির মধ্যে কতকগুলি বড় চণ্ডীদাসের রচনা; বাকীগুলির মধ্যে কয়েকটি অন্যান্য কবির রচনা, এখন চণ্ডীদাসের নামে চলিয়া গিয়াছে। অবশিষ্ট শ্রেষ্ঠ পদগুলি ‘দ্বিজ চণ্ডীদাস’ নামক একজন চৈতন্য-পরবর্তী কবির রচনা।
৪। চৈতন্য-পরবর্তী কালের কবি “দীন চণ্ডীদাস”–”বড় চণ্ডীদাস” ও “দ্বিজ চণ্ডীদাস” ইহতে স্বতন্ত্র ব্যক্তি। কোন কোন গবেষক মনে করেন, দীন চণ্ডীদাসই চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত শ্রেষ্ঠ পদগুলির রচয়িতা। কিন্তু ইহা সম্ভব নহে, কারণ প্রথমত, দীন চণ্ডীদাসের অসন্দিগ্ধ রচনাগুলি অত্যন্ত নিকৃষ্ট শ্রেণীর; দ্বিতীয়ত, তাঁহার কৃষ্ণলীলাবিষয়ক আখ্যানকাব্যে বহু পদ থাকিলেও শ্রেষ্ঠ পদগুলির একটিও তাঁহার মধ্যে মিলে নাই; তৃতীয়ত, শ্রেষ্ঠ পদগুলির মধ্যে কোথাও “দীন চণ্ডীদাস” ভণিতা মিলে নাই।
৫। চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত সহজিয়া পদগুলি চণ্ডীদাসের নাম দিয়া অন্য সহজিয়া কবিরা লিখিয়াছেন; চণ্ডিদাসকে সহজিয়ারা নিজেদের গুরু মনে করিতেন, তাঁহারা তাঁহাকে “রসিক” আখ্যা দিয়াছেন এবং তাঁহারাই তাঁহার নামে সহজিয়া পদ লিখিয়া নিজেদের কৌলীন্য বৃদ্ধি করিয়াছেন। তরুণীরমণ নামক একজন সহজিয়া কবির নামান্তর ছিল চণ্ডীদাস।
৬। চণ্ডীদাস নামে আরও দুই একজন অর্ব্বাচীন ও নগণ্য কবি ছিলেন।
‘পদকল্পতরু’তে সঙ্কলিত দুইটি পদে বলা হইয়াছে যে, চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতি পরস্পরের সমসাময়িক ছিলেন, তাঁহারা পরস্পরকে গীত লিখিয়া প্রেরণ করিতেন এবং উভয়ের মধ্যে সাক্ষাৎ হইয়াছিল। আরও দুইটি পদে বলা হইয়াছে যে, সাক্ষাতের পর উভয়ের মধ্যে সহজিয়া তত্ত্ব সম্বন্ধে আলোচনা হইয়াছিল। কোন কোন গবেষকের মতে প্রথম দুইটি পদের উক্তি সত্য, অর্থাৎ বড় চণ্ডীদাস ও মৈথিল বিদ্যাপতির সমসাময়িকত্ব, পরস্পরের সহিত যোগাযোগস্থাপন ও মিলন ঐতিহাসিক ঘটনা, কিন্তু শেষ দুইটি পদের উক্তি, অর্থাৎ কবিদের সহজিয়া তত্ত্ব লইয়া আলোচনা করার কথা সত্য নহে। আবার কোন কোন গবেষক মনে করেন, চারিটি পদের উক্তিই কবিকল্পনা মাত্র। তৃতীয় একদল গবেষকের মতে পদগুলির কথা সত্য, কিন্তু চৈতন্য-পূর্ববর্তী চণ্ডীদাস ও বিদ্যাপতির কথা তাহাদের মধ্যে বলা হয় নাই, চৈতন্য-পরবর্তী দ্বিতীয় চণ্ডীদাস ও দ্বিতীয় বিদ্যাপতির কথা ইহাদের মধ্যে বলা হইয়াছে এবং ইঁহাদের মধ্যেই মিলন ঘটিয়াছিল; কিন্তু এই মত সত্য হইতে পারে না, কারণ পদগুলির মধ্যে “লছিমা”র উল্লেখ হইতে বুঝা যায় যে, ইহাদের মধ্যে বিদ্যাপতি’ বলিতে চৈতন্য-পূর্ববর্তী বিদ্যাপতিকে বুঝানো হইয়াছে।
রামী নামে চণ্ডীদাসের একজন রজকজাতীয় পরকীয়া প্রেমিকা ছিলেন বলিয়া প্রবাদ আছে। এই প্রবাদ অমূলক এবং সহজিয়াদের বানানো বলিয়া মনে হয়। প্রাচীন সহজ-পন্থী সাধকেরা আধ্যাত্মিক শক্তির তারতম্য অনুসারে ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী–এই পাঁচটি কুলে বিভক্ত হইতেন। “রজকী” কুলের সহিত চণ্ডীদাসের “রজকিনী”-প্রেমের কাহিনীর কোন সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়। চণ্ডীদাসের বাসভূমি হিসাবে কোন কোন কিংবদন্তীতে বাঁকুড়া জেলার ছাতনা এবং কোন কোন কিংবদন্তীতে বীরভূম জেলার নানুরের নাম পাওয়া যায়। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক বিষয় হইতে মনে হয়, বড় চণ্ডীদাস বাঁকুড়া অঞ্চলের এবং দ্বিজ চণ্ডীদাস বীরভূম অঞ্চলের লোক। তবে এ সম্বন্ধে জোর করিয়া কিছু বলা যায় না।
বড় চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে অনেক অশ্লীল ও রুচিবিগহিত উপাদান থাকিলেও কাব্যটি শক্তিশালী কবির রচনা। কবি সংক্ষিপ্ত ও শাণিত উক্তিপরম্পরার মধ্য দিয়া এবং লৌকিক জীবনের উপমার মধ্য দিয়া যেরূপে ভাব প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা বিশেষ প্রশংসনীয়। এই কাব্যের ‘বংশীখণ্ড’ ও ‘রাধাবিরহ’ নামক খণ্ড দুইটি উচ্চস্তরের রচনা, ইহাদের মধ্যে স্থূলতা বা অশ্লীলতা বিশেষ নাই, এই দুইটি খণ্ডে গভীর প্রেমের হৃদয়গ্রাহী অভিব্যক্তি দেখিতে পাওয়া যায়। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে তিনটি প্রধান চরিত্র–রাধা, কৃষ্ণ ও বড়াই (বৃদ্ধা দূতী); তিনটিই জীবন্ত, উজ্জ্বল ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। রাধার চরিত্র একটি সুন্দর ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়া রূপায়িত হইয়াছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, কাব্যটি প্রায় আগাগোড়াই নাটকীয় রীতিতে, অর্থাৎ বিভিন্ন পাত্রপাত্রীর উক্তিপ্রত্যুক্তির মধ্য দিয়া রচিত; তাঁহার ফলে ইহার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ নাট্যরস সৃষ্টি হইয়াছে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ সে যুগের সমাজ সম্বন্ধে অজস্র তথ্য পাওয়া যায়; তখনকার লোকদের জীবনযাত্রা, আচার-ব্যবহার, খাদ্য-পরিধেয়, এমন কি কুসংস্কার সব কিছুর পরিচয় এই গ্রন্থ হইতে মিলে। ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে স্কুল লালসার বর্ণনা হইতে মনে হয়, সে যুগে বাঙালী বিশেষভাবে দেহসচেতন ও ভোগাসক্ত হইয়া উঠিয়াছিল।
চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদগুলি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই পদগুলিতে ভাবের যে গভীরতা দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহার তুলনা বিরল। ইহাদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রেমের বেদনাকে মর্মস্পর্শীভাবে রূপায়িত করা হইয়াছে। এই পদগুলিতে একটি অপার্থিব আধ্যাত্মিকতা ব্যঞ্জিত হইয়াছে। চণ্ডীদাসের পদে যে রাধার দেখা পাওয়া যায়, তিনি বাহ্যত প্রেমিকা হইলেও প্রকৃতপক্ষে সাধিকা, হৃদয়ে প্রেমের উন্মেষ তাহাকে জীবনের সমস্ত ভোগ ও সুখের মোহ ভুলাইয়া দিয়া তপস্বিনীতে পরিণত করিয়াছে। চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত পদগুলিতে গভীরতম ভাব অভিব্যক্ত হইলেও পদগুলির ভাষা অত্যন্ত সরল; ইহাদের মধ্যে সর্বজনবোধ্য উপমার মধ্য দিয়া ভাব প্রকাশ করা হইয়াছে। এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের একজন কবি চণ্ডীদাসের পদ সম্বন্ধে মন্তব্য করিয়াছিলেন, “সরল তরল রচনা প্রাঞ্জল প্রসাদগুণেতে ভরা”। এই মন্তব্য সম্পূর্ণ সার্থক। চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত পদগুলির মধ্যে বিশেষভাবে পূর্বরাগ, আক্ষেপানুরাগ, রসোদ্গার, আত্মনিবেদন, বিরহ ও ভাবসম্মিলনের পদগুলি উৎকৃষ্ট।
৩
কৃত্তিবাস
কৃত্তিবাস সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। তাঁহার মত জনপ্রিয় কবি বাংলা দেশে বোধ হয় আর কেহই জন্মগ্রহণ করেন নাই। তাঁহার আবির্ভাবকালের পরে কত শতাব্দী পার হইয়া গিয়াছে, অথচ তাঁহার জনপ্রিয়তা এখনও অম্লান।
কিন্তু এই জনপ্রিয়তা একদিক দিয়া ক্ষতির কারণ হইয়াছে। কৃত্তিবাসের রামায়ণ বিপুল প্রচার লাভ করিবার ফলে লোকমুখে এত পরিবর্তিত হইয়াছে এবং তাহাতে এত প্রক্ষিপ্ত অংশ প্রবেশ করিয়াছে যে কৃত্তিবাস-রচিত মূল রামায়ণের বিশেষ কিছুই আজ বর্তমান প্রচলিত “কৃত্তিবাসী রামায়ণ”-এর মধ্যে অবশিষ্ট নাই।
কৃত্তিবাসের রামায়ণকে বাঙালীর জাতীয় কাব্য বলা যাইতে পারে। কারণ প্রথমত সমগ্র জাতিই এই কাব্যকে সাদরে বরণ করিয়াছে, কোটিপতির প্রাসাদ হইতে দীনদরিদ্রের পর্ণ-কুটির পর্যন্ত, দেশের এ প্রান্ত হইতে ও প্রান্ত পর্যন্ত এ কাব্যের সমান জনপ্রিয়তা; দ্বিতীয়ত, কৃত্তিবাসের রামায়ণ বর্তমানে যে রূপ লাভ করিয়াছে, তাহা আর ব্যক্তিবিশেষের রচনা নাই, তাঁহার উপরে সমগ্র জাতির হাতের ছাপ আছে; তৃতীয়ত, কৃত্তিবাসের রামায়ণের চরিত্রগুলি ও তাহাদের জীবনযাত্রা অবিকল বাঙালীর চরিত্র ও জীবনযাত্রার ছাঁচে ঢালা; চতুর্থত, কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাঙালীর জাতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরের স্বাক্ষর সংরক্ষিত হইয়াছে, যে স্তরে বৈষ্ণবরা প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল, সেই স্তরের স্বাক্ষর রহিয়াছে রামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত রাক্ষসদের রামভক্তি প্রদর্শনমূলক অংশ প্রক্ষেপ করার মধ্যে; আবার শাক্তেরা যে স্তরে প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল, তাঁহার স্বাক্ষর রহিয়াছে রামচন্দ্র কর্ত্তৃক শক্তিপূজা করার অংশ প্রক্ষেপের মধ্যে।
কৃত্তিবাসের ব্যক্তিগত পরিচয় সম্বন্ধে ধ্রুবানন্দের ‘মহাবংশাবলী’ প্রভৃতি কুলজী গ্রন্থ এবং কৃত্তিবাসী রামায়ণের কয়েকটি পুঁথি হইতে কিছু কিছু সংবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু সর্বাপেক্ষা অধিক সংবাদ পাওয়া যায় “কৃত্তিবাসের আত্মকাহিনী” হইতে। এই আত্মকাহিনী বদনগঞ্জনিবাসী হারাধন দত্তের একটি পুঁথিতে সর্বপ্রথম আবিষ্কৃত হয় এবং দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে (১৮৯৯ খ্রী) সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়। হারাধন দত্তের যে পুঁথিতে এই আত্মকাহিনী পাওয়া গিয়াছিল, সেটি সাধারণের দৃষ্টিগোচর না হওয়াতে কেহ কেহ এই আত্মকাহিনীর অকৃত্রিমতা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন। কিন্তু পরে ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী আর একটি পুঁথিতে এই আত্মকাহিনী পাইয়াছেন; আত্মকাহিনীর অনেকগুলি খণ্ডাংশ অন্যান্য কৃত্তিবাসী রামায়ণের পুঁথিতে পাওয়া গিয়াছে এবং আত্মকাহিনীতে প্রদত্ত প্রায় সমস্ত সংবাদের সমর্থন অন্য কোন না কোন সূত্রে মিলিয়াছে। সুতরাং আত্মকাহিনীটি যে কৃত্তিবাসের নিজেরই রচনা, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ইহার প্রচার বেশি না হওয়ার দরুণ ইহার মূল রূপটি প্রায় অবিকৃতভাবেই রক্ষিত হইয়াছে, তবে ভাষা খানিকটা আধুনিক হইয়া গিয়াছে।
কৃত্তিবাসের আত্মকাহিনী হইতে জানা যায় যে, কৃত্তিবাসের বৃদ্ধ প্রপিতামহ–“বেদানুজ মহারাজা”র পাত্র (পাঠান্তরে-’পুত্র’)-নারসিংহ ওঝার আদি নিবাস পূর্ববঙ্গে; সেখানে কোন বিপদ উপস্থিত হওয়াতে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলিয়া আসিয়া গঙ্গাতীরে ফুলিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন; নারসিংহের পুত্র গর্ভেশ্বর, গর্ভেশ্বরের অন্যতম পুত্র মুরারি; মুরারির অন্যতম পুত্র বনমালী; বনমালীর ছয় পুত্র-তন্মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ কৃত্তিবাস। গর্ভেশ্বরের বংশে আরও অনেক বিশিষ্ট ও রাজানুগৃহীত ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। কৃত্তিবাস মাঘ মাসে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রবিবারে (“আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘ মাস”) জন্মগ্রহণ করেন। বারো বৎসর বয়সে পদার্পণ করিয়া তিনি গুরুগৃহে পড়িতে যান এবং নানা দেশে নানা গুরুর কাছে অধ্যয়ন করিয়া অবশেষে উত্তরবঙ্গের একজন গুরুর কাছে পাঠ সাঙ্গ করিয়া সর্বশাস্ত্র-বিশারদ হইয়া ঘরে ফেরেন। অতঃপর কৃত্তিবাস “গৌড়েশ্বর” অর্থাৎ বাংলার রাজার সহিত দেখা করিতে যান। সভাভঙ্গের অল্পক্ষণ পূর্বে রাজসভায় প্রবেশ করিয়া কবি দেখেন যে গৌড়েশ্বর সভায় বসিয়া আছেন, তাঁহার চতুর্দিকে জগদানন্দ, সুনন্দ, কেদার খা, কেদার রায়, নারায়ণ, তরণী, গন্ধর্ব রায়, সুন্দর, শ্রীবৎস্য, মুকুন্দ পণ্ডিত প্রভূতি সভাসদেরা বসিয়া আছেন; ইহা ভিন্ন আরও বহু লোক বসিয়া ও দাঁড়াইয়া আছে। রাজার প্রাসাদ কোলাহল ও নৃত্যগীতে ভরপুর। কৃত্তিবাসকে রাজা সঙ্কেতে আহ্বান করিলে কৃত্তিবাস তাঁহার কাছে গিয়া সাতটি শ্লোক পড়িলেন। ইহাতে রাজা খুশী হইয়া কৃত্তিবাসকে ফুলের মালা ও পাটের পাছড়া দিলেন এবং রাজসভাসদ কেদার খা কবির মাথায় চন্দনের ছড়া ঢালিয়া দিলেন; রাজা কৃত্তিবাসের ইচ্ছামত যে কোন বস্তু দান করিতে চাহিলেন, কিন্তু কৃত্তিবাস তাহা প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন যে কাহারও নিকট হইতে তিনি অর্থ চাহেন না, গৌরব ভিন্ন তাঁহার আর কিছু কাম্য নাই। অতঃপর কৃত্তিবাস রাজপ্রাসাদ হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। তখন প্রাসাদের বাহিরে সমবেত বিরাট জনতা কৃত্তিবাসকে বিপুল সংবর্ধনা জানাইল এবং কৃত্তিবাসের রামায়ণ রচনার উল্লেখ করিয়া তাহারা বাল্মীকির সহিত কৃত্তিবাসের তুলনা করিল।
কৃত্তিবাস কোন সময়ে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে বিভিন্ন সূত্র হইতে কিছু কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ধ্রুবানন্দের ‘মহাবংশাবলী’ প্রভৃতি কুলজী-গ্রন্থে কৃত্তিবাস ও তাঁহার পূর্বপুরুষদের এবং তাঁহার অনেক আত্মীয়ের নাম পাওয়া যায়; কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষ ও আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে কুলীন ব্রাহ্মণদের ‘সমীকরণ, ‘মেল বন্ধন’ প্রভৃতি সামাজিক অনুষ্ঠানগুলিতে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। এই সব সামাজিক অনুষ্ঠানের সময় সম্বন্ধে মোটামুটি যে আভাস পাওয়া যায়, তাহা হইতে কৃত্তিবাসের আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে এইটুকু মাত্র অনুমান করা যায় যে, কৃত্তিবাস পঞ্চদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে বর্তমান ছিলেন।
কৃত্তিবাসের আত্মকাহিনী হইতেও তাঁহার আবির্ভাবকাল নির্ণয়ের চেষ্টা হইয়াছে। আত্মকাহিনীর প্রথম ছত্রে উল্লিখিত “বেদানুজ মহারাজকে কেহ ত্রয়োদশ শতাব্দীর রাজা দনুজমাধবের সহিত, আবার কেহ পঞ্চদশ শতাব্দীর রাজা দনুজমর্দনের সহিত অভিন্ন ধরিয়াছেন এবং তাহা হইতে কৃত্তিবাসের সময় নির্ধারণের চেষ্টা করিয়াছেন। আবার কেহ কেহ কৃত্তিবাসের জন্ম-তিথি “আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘ মাস” (এবং তাঁহার ভ্রান্ত পাঠান্তর “আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘ মাস”) এর উপর নির্ভর করিয়াছেন এবং কতক কল্পনা, কতক জ্যোতিষ গণনার আশ্রয় লইয়া কৃত্তিবাসের একটা “জন্মসাল” স্থির করিয়াছেন। এই সমস্ত সিদ্ধান্ত কল্পনাভিত্তিক বলিয়া ইহাদের কোন মূল্য নাই।
কৃত্তিবাস যে গৌড়েশ্বরের সভায় গিয়াছিলেন, তাঁহার নাম তিনি উল্লেখ করেন নাই; না করাই স্বাভাবিক, কারণ আমরা এখনও পর্যন্ত সমসাময়িক রাজাদের কথা বলিবার সময় তাঁহার রাজপদবীরই উল্লেখ করি, নামের উল্লেখ করি না। যাহা হউক, পরোক্ষ প্রমাণের সাহায্যে কৃত্তিবাসের সংবর্ধনাকারীর পরিচয় আবিষ্কারের অনেকে চেষ্টা করিয়াছেন। কোন কোন পণ্ডিতের মতে এই গৌড়েশ্বর রাজা গণেশ; ইঁহাদের যুক্তি এই যে, কৃত্তিবাস গৌড়েশ্বরের যে সমস্ত সভাসদের উল্লেখ করিয়াছেন, তাঁহাদের সকলেই হিন্দু; সুতরাং গৌড়েশ্বরও হিন্দু; যেহেতু চতুর্দ্দশ পঞ্চদশ শতকে রাজা গণেশ ভিন্ন অন্য কোন হিন্দু গৌড়েশ্বরকে পাওয়া যাইতেছে।
, অতএব ইনি রাজা গণেশ। কিন্তু কৃত্তিবাস গৌড়েশ্বরের মাত্র ৮/৯ জন সভাসদের নাম করিয়াছেন; গৌড়েশ্বরের সভায় অন্তত ৬০/৭০ জন সভাসদ উপস্থিত ছিলেন; কৃত্তিবাস মাত্র কয়েকজন স্বধর্মী রাজসভাসদের উল্লেখ করিয়াছেন বলিয়া গৌড়েশ্বরের সমস্ত সভাসদই যে হিন্দু ছিলেন, তাহা বলার কোন অর্থ হয় না; সুতরাং ইহা হইতে গৌড়েশ্বরের হিন্দু হওয়াও প্রমাণিত হয় না। তাঁহার পর, কোন কোন পণ্ডিতের মতে কৃত্তিবাস-বর্ণিত গৌড়েশ্বর তাহিরপুরের ভূস্বামী রাজা কংসনারায়ণ; তিনি প্রকৃত গৌড়েশ্বর না হইলেও কৃত্তিবাস তাঁহাকে স্তাবকতা করিয়া গৌড়েশ্বর বলিয়াছেন। ইঁহাদের যুক্তি এই–কৃত্তিবাস গৌড়েশ্বরের যে সমস্ত সভাসদের উল্লেখ করিয়াছেন তাহাদের মধ্যে মুকুন্দ, জগদানন্দ ও নারায়ণ–এই তিনটি নাম পাওয়া যায়; এদিকে কুলজী-গ্রন্থে মুকুন্দ, জগদানন্দ ও নারায়ণ নামে কংসনারায়ণের তিনজন আত্মীয়ের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে; সুতরাং কংসনারায়ণই কৃত্তিবাস-উল্লিখিত গৌড়েশ্বর। কিন্তু এই মত সমর্থন করা কঠিন; কারণ, প্রথমত আত্মকাহিনীর মধ্যে কৃত্তিবাসের যে নির্লোভ ও তেজস্বী মনের পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতে তিনি একজন সাধারণ ভূস্বামীকে “গৌড়েশ্বর” বলিবেন, ইহা সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না; দ্বিতীয়ত, কংসনারায়ণের সময় সম্বন্ধে কিছুই জানা নাই; তৃতীয়ত, কংসনারায়ণের আত্মীয় মুকুন্দ জগদানন্দের পিতামহ ছিলেন বলিয়া কুলজী-গ্রন্থে উক্ত হইয়াছে, কিন্তু কৃত্তিবাসের আত্মকাহিনীতে উল্লিখিত রাজসভাসদ মুকুন্দ জগদানন্দের পুত্র (“মুকুন্দ রাজার পণ্ডিত প্রধান সুন্দর। জগদানন্দ রায় মহাপাত্রের কোঙর ॥”)। সুতরাং আলোচ্য মতের ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল।
কৃত্তিবাসের সংবর্ধনাকারী গৌড়েশ্বরকে হিন্দু বলিবার কোন কারণ নাই। তিনি যে মুসলমান নহেন, সে কথা জোর করিয়া বলিবারও কোন হেতু নাই। আসলে এই গৌড়েশ্বর যে রুকনুদ্দীন বারবক শাহ, সে সম্বন্ধে অনেক প্রমাণ আছে।
প্রথম প্রমাণ, কৃত্তিবাসের আত্মকাহিনীতে গৌড়েশ্বরের কেদার রায় ও নারায়ণ নামে দুইজন সভাসদের উল্লেখ পাওয়া যায়; রুকনুদ্দীন বারবক শাহের অধীনে এই দুই নামের দুইজন রাজপুরুষ ছিলেন; নারায়ণ ছিলেন বারবক শাহের চিকিৎসক; ইনি চৈতন্যদেবের পার্ষদ মুকুলের পিতা; ইহার নাম চূড়ামণি দাসের ‘গৌরাঙ্গবিজয়’ ও ভরত মল্লিকের চন্দ্রপ্রভাতে পাওয়া যায়, কেদার রায় ছিলেন বারবক শাহের অত্যন্ত বিশ্ব রাজপুরুষ, ইনি মিথিলা বা ত্রিহুতে বারবক শাহের প্রতিনিধি নিযুক্ত হইয়াছিলেন; বর্ধমান উপাধ্যায়ের ‘দণ্ডবিবেক ও মুল্লা তকিয়ার ‘বয়াজে’ ইঁহার নাম পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় প্রমাণ, জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল হইতে জানা যায় যে, হরিদাস ঠাকুর যখন ফুলিয়া হইতে নীলাচলে যান, তখন মুরারি, দুর্গাবর ও মনোহরের বংশে জাত কুলীননন্দন সুষেণ পণ্ডিত হরিদাসকে বিদায় দিয়াছিলেন; এই ঘটনা আনুমানিক ১৫১৬ খ্রীষ্টাব্দের। এদিকে ধ্ৰুবানন্দের মহাবংশাবলী’র মতে কৃত্তিবাসের সুষেণ নামে এক সম্পর্কিত পৌত্র (কৃত্তিবাসের পিতৃব্য অনিরুদ্ধের প্রপৌত্র) ছিলেন; এই সুষেণের বৃদ্ধ প্রপিতামহ, জ্যেষ্ঠতাত ও পিতার নাম যথাক্রমে মুরারি, দুর্গাবর ও মনোহর; ইনিও ফুলিয়ানিবাসী কুলীন ব্রাহ্মণ। সুতরাং এই সুষেণ ও জয়ানন্দ উল্লিখিত সুষেণ পণ্ডিত যে অভিন্ন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। সুষেণ পণ্ডিত যখন ১৫১৬ খ্রীষ্টাব্দের মত সময়ে জীবিত ছিলেন, তখন তাঁহার পিতামহ-স্থানীয় কৃত্তিবাস গড়পড়তা হিসাবে তাঁহার পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে, অর্থাৎ ১৪৬৬ খ্রীষ্টাব্দের মত সময়ে জীবিত ছিলেন বলিয়া ধরা যায়; ১৪৬৬ খ্রীষ্টাব্দে রুকনুদ্দীন বারবক শাহই গৌড়েশ্বর ছিলেন।
তৃতীয় প্রমাণ, রুকনুদ্দীন বারবক শাহ বিদ্যা ও সাহিত্যের একজন বিখ্যাত পৃষ্ঠপোষক। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-কার মালাধর বসু, অমরকোষটীকা ‘পদচন্দ্রিকা’র রচয়িতা রায়মুকুট বৃহস্পতি মিশ্র, ফার্সী শব্দকোষ শরফ নামা’র সঙ্কলয়িতা ইব্রাহিম কায়ুম ফারুকী প্রভৃতি তাঁহার নিকট পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন। সুতরাং অন্য গৌড়েশ্বর অপেক্ষা তাঁহারই নিকটে কৃত্তিবাসের সংবর্ধনা লাভ করা বেশি স্বাভাবিক।
অতএব কৃত্তিবাস যে রুকনুদ্দীন বারবক শাহেরই সভায় গিয়াছিলেন ও তাঁহারই নিকট সংবর্ধনা লাভ করিয়াছিলেন, এইরূপ সিদ্ধান্ত খুবই যুক্তিসঙ্গত। এই সম্বন্ধে গৌণ প্রমাণও কতকগুলি আছে, বাহুল্যবোধে সেগুলি উল্লেখ করা হইল না।
মহাকবি কৃত্তিবাসের নাম বাঙালীর অমূল্য সম্পত্তি। তাঁহার রচিত মূল রামায়ণ আজ অবিকৃতভাবে পাওয়া যাইতেছে না, ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। কিন্তু আর এক দিক দিয়া ইহা কবির পক্ষে অত্যন্ত গৌরবের বিষয়, কারণ কৃত্তিবাসের কাব্যের জনপ্রিয়তা ও প্রচার যে কত অসাধারণ হইয়াছিল, তাহা ইহা হইতেই বুঝা যায়; সাধারণ কবির বা জনপ্রিয়তাহীন কবির রচনা এইভাবে যুগে যুগে লোকহস্তে পরিবর্তন লাভ করে না। অসামান্য জনপ্রিয়তা ভিন্ন কৃত্তিবাসের পক্ষে আর একটি গর্বের বিষয় এই যে, তিনি শুধু বাংলা রামায়ণের প্রথম রচয়িতা নহেন, শ্রেষ্ঠ রচয়িতাও। সাধারণত সাহিত্যের কোন ধারার প্রবর্তক ঐ ধারার শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা হন না। কৃত্তিবাস ইহার উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
কৃত্তিবাসের রচিত মূল রামায়ণ কী রকম ছিল, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত করিয়া কিছু বলা যায় না। তবে এইটুকু স্বচ্ছন্দে বলা যাইতে পারে যে, তিনি বাল্মীকির রামায়ণকে অবিকলভাবে অনুসরণ করেন নাই। বাল্মীকি-রামায়ণ বহির্ভূত রামলীলা বিষয়ক অনেক কাহিনী বহু পূর্ব হইতে বাংলা দেশে প্রচলিত ছিল, কৃত্তিবাস নিঃসন্দেহে তাহাদের অনেকগুলিকে তাঁহার রামায়ণের মধ্যে স্থান দিয়াছিলেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণের বর্তমান-প্রচলিত সংস্করণে রাম, সীতা, লক্ষ্মণ প্রভৃতি চরিত্রের মধ্যে যে বাঙালীসুলভ কোমলতা দেখিতে পাওয়া যায়, কৃত্তিবাসের মূল রচনার মধ্যেও চরিত্রগুলির এই বৈশিষ্ট্য ছিল বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে। বর্তমান প্রচলিত সংস্করণের তুলনায় কৃত্তিবাসের মূল রচনা যে কতকটা সংক্ষিপ্ত ছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, কারণ ইহার বিভিন্ন সময়ে লিপিকৃত পুঁথিগুলির তুলনা করিলে দেখা যায় প্রাচীনতর পুঁথিগুলির তুলনায় অর্ব্বাচীন পুঁথিগুলি অপেক্ষাকৃত বিপুলকলেবর; যতই দিন গিয়াছে, ততই ইহার মধ্যে উত্তরোত্তর প্রক্ষিপ্ত উপাদান প্রবেশ করিয়াছে এবং বর্ণনাগুলি পল্লবিত হইয়াছে।
৪
মালাধর বসু
মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামক কাব্য রচনা করিয়া খ্যাতি অর্জন করিয়াছেন; কাব্যটির মধ্যে শ্রীমদ্ভাগবতের অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা বর্ণিত হইয়াছে। এই কাব্যের অনেক স্থানে শ্রীমদ্ভাগবতের অংশবিশেষের অনুবাদ দেখিতে পাওয়া যায়, ‘হরিবংশের প্রভাবও কোথাও কোথাও দেখা যায়। কিন্তু কাব্যটির মধ্যে কবির স্বাধীন রচনার নিদর্শনও যথেষ্ট পরিমাণে মিলে।
‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর প্রাচীন পুঁথিতে ইহার যে রচনাকালবাচক শ্লোক পাওয়া যায়, তাহা হইতে জানা যায় যে, এই কাব্যের রচনা ১৩৯৫ শকাব্দে (১৪৭৩-৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) আরম্ভ হয় এবং ১৪০২ শকাব্দে (১৪৮০-৮১ খ্রীষ্টাব্দ) শেষ হয়। মালাধর বসু গৌড়েশ্বরের নিকট ‘গুণরাজ খান’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। স্বনাম অপেক্ষা এই উপাধি দ্বারাই তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে’র শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত মালাধর ‘গুণরাজ খান’ নামে ভণিতা দিয়াছেন। সুতরাং কাব্যের রচনা আরম্ভ করিবার পূর্বে তিনি ‘গুণরাজ খান’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। ১৩৯৫ শকাব্দে (১৪৭৩-৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) গৌড়েশ্বর ছিলেন রুকনুদ্দীন বারবক শাহ। অতএব মালাধর বারবক শাহের কাছেই যে ‘গুণরাজ খান’ উপাধি লাভ করিয়াছিলেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
মালাধর বসুর নিবাস ছিল কাটোয়ার কুলীনগ্রামে। তিনি জাতিতে কায়স্থ ছিলেন। তাঁহার পিতার নাম ভগীরথ, মাতার নাম ইন্দুমতী। মালাধর বসুর সত্যরাজ খান ও রামানন্দ নামে দুই পুত্র ছিলেন। ইহারা পরে চৈতন্যদেবের বিশিষ্ট পার্ষদ হইয়াছিলেন এবং প্রতি বৎসর রথযাত্রার সময় নীলাচলে গিয়া ইহারা চৈতন্যদেবকে দর্শন করিয়া আসিতেন।
মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ অত্যন্ত সরল ও সুখপাঠ্য রচনা। মালাধর শুধু কবি ছিলেন না, ভক্তও ছিলেন। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর অনেক স্থানে তাঁহার ভক্ত হৃদয়ের ছাপ পড়িয়াছে। বাংলার চৈতন্যপূর্ববর্তী যুগের বৈষ্ণব ভক্তির স্বরূপ সম্বন্ধে খানিকটা আভাস ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয় হইতে পাওয়া যায়। ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর আর একটি প্রশংসনীয় বিষয় এই যে, ইহার মধ্যে অনেক স্থানে ভারতীয় অধ্যাত্মতত্ত্বের সারকথাগুলি অত্যন্ত সংক্ষেপে সরল ভাষায় বর্ণিত হইয়াছে।
‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যে কিছু কিছু অভিনব বিষয়ের নিদর্শন পাওয়া যায়। রাধার সখী ও কৃষ্ণের সখাদের যে সমস্ত নাম বাংলা দেশে প্রচলিত (যেমন বৃন্দা, ললিতা, অনুরাধা, বিশাখা, শ্রীদাম, সুদাম, সুবল প্রভৃতি), তাহাদের দুই একটি ভিন্ন অন্যগুলি বাংলার বাহিরে পরিচিত নহে; প্রাচীন পুরাণে বা কাব্যেও সেগুলি মিলে না, এই সমস্ত নামের অধিকাংশেরই উল্লেখ মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে’ সর্বপ্রথম পাওয়া যায়।
চৈতন্যদেব মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য আস্বাদন করিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন। নীলাচলে তিনি মালাধর বসুর পুত্র সত্যরাজ খানের কাছে ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর একটি চরণ (“নন্দের নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ”) আবৃত্তি করিয়া বলেন যে এই বাক্যটি রচনার জন্য তিনি গুণরাজ খানের বংশের কাছে বিক্রীত হইয়া থাকিবেন; তিনি আরও বলিয়াছিলেন যে মালাধর বসুর গ্রামের কুকুরও তাঁহার নিকট অন্য লোকের অপেক্ষা প্রিয়। চৈতন্যদেবের এই প্রশংসার জন্যই মালাধর বাংলার বৈষ্ণবদের হৃদয়ে শ্রদ্ধার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন।
৫
চৈতন্যদেব
চৈতন্যদেব ১৪৮৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম জগন্নাথ মিশ্র, মাতার নাম শচী দেবী। চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষদের নিবাস ছিল শ্রীহট্ট। চৈতন্যদেবের পূর্ব-নাম বিশ্বম্ভর, ডাক-নাম নিমাঞি বা নিমাই।
শৈশবে নিমাই অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির ছিলেন। ছাত্র হিসাবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। অল্প বয়সেই পণ্ডিত হইয়া তিনি নবদ্বীপে টোল খুলিয়া বসেন এবং সেখানে ব্যাকরণ পড়াইতে থাকেন। তিনি প্রথমে লক্ষ্মীদেবীকে বিবাহ করেন, কিন্তু বিবাহের কিছুদিন পর লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যু হওয়াতে তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর পাণিগ্রহণ করেন।
তেইশ বৎসর বয়সে গয়ায় পিতার পিণ্ড দিতে গিয়া নিমাই পণ্ডিত বিষ্ণুর পাদপদ্ম দর্শন করেন এবং তাহাতেই তাঁহার ভাবান্তর উপস্থিত হয়। এখন হইতে তিনি হরিভক্তিতে বিভোর হইয়া পড়েন। ইহার পর নবদ্বীপে ফিরিয়া তিনি এক বৎসর বন্ধু ও ভক্তদের লইয়া হরিনাম সঙ্কীর্তন করেন। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁহার পার্ষদশ্রেণীভুক্ত হন। ইহাদের মধ্যে ছিলেন শান্তিপুরনিবাসী প্রবীণ বৈষ্ণব আচার্য অদ্বৈত, বীরভূমের একচাকা গ্রামের হাড়াই ওঝার পুত্র অবধূত নিত্যানন্দ, বৈষ্ণবধর্ম্মান্তরিত মুসলমান হরিদাস ঠাকুর, নিমাই পণ্ডিতের সহপাঠী ও চরিতকার মুরারি গুপ্ত প্রভৃতি। এইসব ভক্তরা নিমাইকে ঈশ্বর বলিয়া গ্রহণ করেন।
এক বৎসর সঙ্কীর্তন করার পর নিমাই সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেন এবং ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ (সংক্ষেপে শ্রীচৈতন্য বা চৈতন্যদেব) নাম গ্রহণ করিলেন। ইহার পর তিনি নীলাচল বা পুরীতে চলিয়া গেলেন। পরবর্তী ছয় বৎসর তিনি তীর্থভ্রমণ করেন এবং তাঁহার পর একাদিক্রমে আঠারো বৎসর নীলাচলে শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করিয়া অতিবাহিত করিবার পর সাতচল্লিশ বৎসর ছয় মাস বয়সে–১৫৩৩ খ্রীষ্টাব্দের ১০ই অগস্ট তারিখে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁহার জীবকালে সহস্র সহস্র লোক তাঁহার ভক্তশ্রেণীভুক্ত হইয়াছিলেন; প্রতি বৎসর রথযাত্রার সময়ে ভক্তেরা নীলাচলে যাইতেন তাঁহাকে দর্শন করিবার জন্য।
চৈতন্যদেব বৈষ্ণবধর্মকে এক নতুন রূপ দেন; এই নতুন বৈষ্ণব ধর্ম ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম’ নামে পরিচিত। এই ধর্ম্মের মূল কথা সংক্ষেপে এই–শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র ঈশ্বর ও আরাধ্য, কিন্তু তিনি প্রেমময়; তাঁহাকে লাভ করিতে হইলে তিনি যে ঈশ্বর, সে কথা ভুলিয়া তাঁহাকে ভালবাসিতে হইবে। এই ভালবাসার প্রাথমিক স্তর ভক্তি, তাঁহার অপেক্ষাও উক্তৃষ্ট দাস্যপ্রেম, তাঁহার অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট সখ্যপ্রেম, তাঁহার অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট বাৎসল্যপ্রেম এবং সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট কান্তাপ্রেম। কান্ত প্রেমের মধ্যে আবার স্বকীয়া প্রেমের তুলনায় পরকীয়া প্রেম শ্রেষ্ঠ, কারণ পরকীয়া প্রেমের মধ্যে যে তীব্রতা ও চিরনবীনতা রহিয়াছে, স্বকীয়া প্রেমে তাহা নাই। এই কারণে কৃষ্ণের সমস্ত ভক্তদের মধ্যে পরকীয়া প্রেমের নায়িকা গোপীদের স্থান সর্বোচ্চে, গোপীদের মধ্যে আবার রাধাই শ্রেষ্ঠা, কারণ কৃষ্ণ তাঁহার প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট। তত্ত্বের দিক দিয়া রাধা সর্বশক্তিমান কৃষ্ণের হ্লাদিনী অর্থাৎ আনন্দদায়িনী শক্তি; শক্তি ও শক্তিমান অভিন্ন, সুতরাং রাধা ও কৃষ্ণও অভিন্ন, কিন্তু লীলারস আস্বাদনের জন্য দুই রূপ ধারণ করিয়াছেন। রাধাকৃষ্ণের লীলা নিত্য, ভক্তেরা এই লীলা শ্রবণ-কীর্তন-চরণ-বন্দন করিবে, ইহাই তাহাদের সাধনার মুখ্য অঙ্গ।
গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্মের তত্ত্বের পরিকল্পনা চৈতন্যদেবের, অবশ্য উপরে বর্ণিত তত্ত্বগুলির সবটাই চৈতন্যদেবের দান বলিয়া মনে হয় না। ‘চৈতন্যভাগবত’ প্রভৃতি প্রাচীন চৈতন্যচরিতগ্রন্থে রাধার কোন উল্লেখ নাই। যাহা হউক, এই ধর্মকে বিস্তৃত ভাষ্যের মধ্য দিয়া চূড়ান্ত রূপ দান করিয়াছেন বৃন্দাবনের গোস্বামীরা। ইঁহাদের মধ্যে রূপ-সনাতন ভ্রাতৃযুগল ও তাঁহাদের ভ্রাতৃম্পুত্র জীব প্রধান।
চৈতন্যদেব কর্ত্তৃক প্রবর্তিত ও বৃন্দাবনের গোস্বামীগণ কর্ত্তৃক ব্যাখ্যাত বৈষ্ণবধর্ম অচিরেই বাংলা দেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করিল। ইহার ফলে বাংলা সাহিত্যও বিশেষভাবে সমৃদ্ধি লাভ করিল। পূর্বেই বলা হইয়াছে যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম্মে ভক্তের সাধনার মুখ্য অঙ্গ রাধা-কৃষ্ণ-লীলা শ্রবণ-কীর্তন-স্মরণ-বন্দন। এই শ্রবণ-কীর্তন-স্মরণ-বন্দন-গানের মধ্য দিয়া যতটা সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব, অন্য কোনভাবে ততখানি করা সম্ভব নহে; তাই বৈষ্ণব ভক্তদের মধ্যে যাঁহারা কবি ছিলেন, তাঁহারা কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে অসংখ্য গান বা পদ লিখিতে লাগিলেন; বহু পদই খুব উৎকৃষ্ট হইল; এইভাবে বাংলার বিশাল ও সমৃদ্ধ পদাবলী-সাহিত্য গড়িয়া উঠিল। চৈতন্যদেবের জীবন-চরিত অবলম্বনেও অনেকগুলি বৃহৎ ও সুন্দর গ্রন্থ রচিত হইল; এইভাবে বাংলা সাহিত্যের এক নতুন শাখা-চরিত-সাহিত্য সৃষ্ট হইল। ইহা ভিন্ন কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে অনেক আখ্যানকাব্য রচিত হইল এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম্মের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করিয়া, বৈষ্ণব ভক্তদের গুরু-শিষ্য পরম্পরা বর্ণনা করিয়া অনেকগুলি ক্ষুদ্র ও বৃহৎ গ্রন্থ লিখিত হইল। চৈতন্যদেব আবির্ভূত না হইলে এইসব রচনাগুলির কোনটিই রচিত হইত না। অথচ এইসব রচনাগুলিই প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং ইহাদের পরিমাণও সুবিশাল। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে চৈতন্যদেব স্বয়ং বাংলা ভাষায় কিছু না লিখিলেও তিনি বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন।
বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্যের সমৃদ্ধি বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখাকেও প্রভাবিত করিয়াছিল, তাই ঐ সমস্ত শাখাতেও চৈতন্য-পরবর্তী কালে উন্নততর সৃষ্টির অজস্র ফসল ফলিয়াছিল। ( মোটের উপর, ষোড়শ শতাব্দী হইতে বাংলা সাহিত্যে যে সৃষ্টির বান ডাকিয়াছিল, চৈতন্যদেবই তাঁহার প্রধান কারণ। এই কারণে সাহিত্যস্রষ্টা না হইয়াও চৈতন্যদেব বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট আসন অধিকার করিয়া আছেন।
৬
পদাবলী-সাহিত্য
পদাবলী-সাহিত্য প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বৈষ্ণব পদগুলির মধ্যে প্রেমের যে অপূর্ব মধুর ভক্তিসমণ্ডিত রূপায়ণ দেখা যায়, তাঁহার তুলনা বিরল। এ কথা সত্য যে, চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বেও বাংলা দেশে কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক পদ রচিত হইয়াছে। কিন্তু চৈতন্য-পূর্ববর্তী কবিরা পদ লিখিয়াছেন নিজেদের স্বাধীন কবি-প্রেরণার বশবর্তী হইয়া এবং তাঁহাদের রচিত পদের সংখ্যা খুব বেশি নহে। কিন্তু চৈতন্য-পরবর্তী পদকর্ত্তাদের অধিকাংশই বৈষ্ণব সাধক ছিলেন। তাঁহাদের পদের উপরে তাঁহাদের সাধনার প্রভাব পড়াতে তাহা একটি অভিনব বৈশিষ্ট্য লাভ করিয়াছে এবং পদ-রচনাও তাঁহাদের সাধনার অঙ্গস্বরূপ বলিয়া তাঁহারা স্বতই অনেক বেশি পদ রচনা করিয়াছেন। এই জন্য বাংলার চৈতন্য পরবর্তী যুগের পদাবলী-সাহিত্য অনন্যসাধারণ বিশালতা লাভ করিয়াছে।
বিষয়বস্তু ও রসের দিক দিয়া পদাবলী-সাহিত্যে বৈচিত্র্য অপরিসীম। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর প্রভৃতি বিভিন্ন রসের অসংখ্য পদাবলী বাংলা দেশে রচিত হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে মধুর রসের রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদই সংখ্যায় সর্বাধিক। রাধাকৃষ্ণবিষয়ক পদগুলির মধ্যে সম্ভোগ ও বিপ্রলম্ভ উভয় পর্যায়েরই রচনা পাওয়া যায়। সম্ভোগ পর্যায়ের পদগুলিতে অভিসার, মিলন, মান প্রভৃতি এবং বিপ্রলম্ভ পর্যায়ের পদগুলিতে র্বরাগ, বিরহ, মাথুর প্রভৃতি স্তর বর্ণিত হইয়াছে।
বাঙালী কবিদের লেখা বৈষ্ণব পদগুলির সমস্তই অবিমিশ্র বাংলা ভাষায় রচিত নহে। অনেক পদ “ব্রজবুলী” নামে পরিচিত এক কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষায় লেখা। বিদ্যাপতির পদের, বিশেষভাবেতাঁহার যে সব পদ বাংলা দেশে প্রচলিত, তাহাদের ভাষার সহিত এই ব্রজবুলী ভাষার মিল খুব বেশি। ব্রজবুলী ভাষার উদ্ভব কীভাবে হইয়াছিল, সে প্রশ্ন রহস্যাবৃত। অনেকের মতে বিদ্যাপতিই এই ব্রজবুলী ভাষার সৃষ্টিকর্ত্তা। কিন্তু এই মত গ্রহণযোগ্য নহে; কারণ, প্রথমত, পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও এরকম দৃষ্টান্ত দেখা যায় না যে একজন মাত্র তোক একটি ভাষা সৃষ্টি করিলেন এবং সেই ভাষায় শত শত লোক পরবর্তী কালে সাহিত্য সৃষ্টি করিল; দ্বিতীয়ত, বিদ্যাপতির পূর্বেও কোন কোন কবি ব্রজবুলী ভাষায় পদ লিখিয়াছিলেন মনে করিবার সঙ্গত কারণ আছে। আবার কেহ কেহ মনে করেন বিদ্যাপতির খাঁটি মৈথিল ভাষায় লেখা পদগুলির ভাষা বিকৃত করিয়া মিথিলা হইতে প্রত্যাগত বাঙালী ছাত্রেরা বাংলা দেশে প্রচার করিয়াছিলেন এবং এই বিকৃত ভাষাই ব্রজবুলী; কিন্তু এই মতও গ্রহণ করা যায় না; কারণ প্রথমত, বাংলা দেশের শ্রেষ্ঠ কবিরা
একটি বিকৃত ভাষায় পদ লিখিবেন, ইহা বিশ্বাসযোগ্য নহে; দ্বিতীয়ত, পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিক হইতে একই সঙ্গে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও উড়িষ্যায় ব্রজবুলী ভাষায় পদ রচনার নিদর্শন পাওয়া যাইতেছে। সব জায়গাতেই মিথিলা হইতে প্রত্যাগত ছাত্রেরা একইভাবে বিদ্যাপতির পদের ভাষাকে বিকৃত করিয়াছে বলিয়া কল্পনা করা যায় না। ব্রজবুলীর উদ্ভব সম্বন্ধে তৃতীয় মত এই যে, আধুনিক ভারতীয় ভাষাসমূহ উদ্ভূত হইবার পরেও কেবল সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যম হিসাবে যে “অর্ব্বাচীন অপভ্রংশ” ভাষার প্রচলন ছিল, সেই ভাষাই ক্রমবিবর্তনের ফলে অবহট্ট ভাষায় এবং অবহট্ট ভাষা আবার ক্রমবিবর্তনের ফলে ব্রজবুলী ভাষায় পরিণত হইয়াছে। এই মত যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয়।
চৈতন্যপরবর্তী যুগের পদকর্ত্তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইঁহাদের মধ্যে সময়ের দিক দিয়া প্রথম হইতেছেন যশোরাজ খান, মুরারি গুপ্ত, নরহরি সরকার, বাসুদেব ঘোষ ও কবিশেখর। যশোরাজ খান হোসেন শাহের অন্যতম কর্মচারী ছিলেন এবং ঐ সুলতানের নাম উল্লেখ করিয়া ব্রজবুলী ভাষায় একটি পদ লিখিয়াছিলেন; বাংলা দেশে প্রাপ্ত ব্রজবুলী ভাষায় লেখা প্রাচীনতম পদ এইটিই। মুরারি গুপ্ত চৈতন্যদেবের সহপাঠী ছিলেন, পরে তাঁহার ভক্ত হন, তাঁহার লেখা কয়েকটি উৎকৃষ্ট পদ পাওয়া গিয়াছে। নরহরি সরকার চৈতন্যদেবের বিশিষ্ট পার্ষদ ছিলেন, তিনি প্রথম জীবনে ব্রজলীলা অবলম্বনে পদ রচনা করিতেন, কিন্তু চৈতন্যদেবের অভ্যুদয়ের পরে তিনি কেবল চৈতন্যদেব সম্বন্ধেই পদ রচনা করিয়া অবশিষ্ট জীবন অতিবাহিত করেন। বাসুদেব ঘোষও চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ ছিলেন, তিনি চৈতন্যদেবের লীলা সম্বন্ধে বহুসংখ্যক পদ রচনা করিয়াছিলেন।
কবিশেখর সম্ভবত দুইজন ছিলেন। একজন কবিশেখর—’কবিরঞ্জন’ ও ‘বিদ্যাপতি’ ভণিতায়ও পদ রচনা করিতেন। ইহার প্রকৃত নাম রঞ্জন। পদ রচনায় ইঁহার উৎকর্ষের জন্য সকলে ইঁহাকে ‘ছোট বিদ্যাপতি’ বলিত। ইনি প্রথম জীবনে হোসেন শাহ, নসরৎ শাহ, গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহ প্রভৃতি সুলতানের কর্মচারী ছিলেন; ঐ সমস্ত সুলতানের নাম উল্লেখ করিয়া তিনি কয়েকটি পদ লিখিয়াছিলেন। পরে তিনি বৈষ্ণব হন এবং শ্রীখণ্ডের রঘুনন্দন গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় কবিশেখর ‘গোপালের কীর্তন অমৃত’ ও ‘গোপীনাথ-বিজয় নাটক’ নামে দুইখানি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন, এই দুইটি গ্রন্থ পাওয়া যায় নাই। ইহা ভিন্ন তিনি কৃষ্ণলীলা বিষয়ক একটি বৃহৎ আখ্যানকাব্য লিখিয়াছিলেন, তাঁহার নাম ‘গোপালবিজয়’; এই কবিশেখরের প্রকৃত নাম দৈবকীনন্দন সিংহ, ইঁহার পিতার নাম চতুর্ভুজ, মাতার নাম হীরাবতী। যতদূর মনে হয়, ইনি ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে বর্তমান ছিলেন। ইনিও রঘুনন্দনের শিষ্য ছিলেন।
দ্বিতীয় কবিশেখর শ্রীকৃষ্ণের অষ্টকালীন লীলা বর্ণনা করিয়া দণ্ডাত্মিকা পদাবলী নামে একটি পদসমষ্টি গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন। কবিশেখর’ ব্যতীত ‘শেখর’ ও রায়শেখর’ ভণিতাতেও ইনি পদ লিখিতেন। ইনি বাংলা ও ব্রজবুলী উভয় ভাষায় বহু সংখ্যক পদ রচনা করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে ব্রজবুলী ভাষায় রচিত পদগুলিই উৎকৃষ্ট। কতকগুলি পদে কবিশেখর বর্ষার রাত্রির এবং রাধার অভিসার ও বিরহের বর্ণনা দিয়াছেন। এই পদগুলি খুব উচ্চাঙ্গের রচনা। এই কবিশেখরের কোন কোন পদ (যেমন ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর’) ভ্রমবশত মৈথিল বিদ্যাপতির রচনা বলিয়া মনে করা হইয়া থাকে।
পদাবলী-সাহিত্যের আর একজন শ্রেষ্ঠ কবি জ্ঞানদাস। ইনি ১৫২০ খ্রীষ্টাব্দের মত সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। ইনি নিত্যানন্দের শিষ্য। ভক্তিরত্নাকর’ নামক গ্রন্থের মতে জ্ঞানদাসের নিবাস ছিল বর্তমান বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কাঁদড়া গ্রামে। জ্ঞানদাস বাংলা ও ব্রজবুলী দুই ভাষাতেই পদ লিখিয়াছিলেন, তবে তাঁহার বাংলা পদগুলিই উদ্ধৃষ্টতর। জ্ঞানদাস বিশেষভাবে ‘পূর্বরাগ’ ও ‘আক্ষেপানুরাগ’ বিষয়ক পদ রচনাতেই দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। পূর্বরাগের পদে তিনি প্রেমাস্পদের জন্য রাধার অন্তরের তীব্র আর্তি ও ব্যাকুলতা অপরূপভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। আক্ষেপানুরাগের পদে প্রেমের কণ্টকাকীর্ণ পথে পদার্পণ করার দরুণ রাধার আক্ষেপকে জ্ঞানদাস সুন্দরভাবে রূপায়িত করিয়াছেন। জ্ঞানদাসের পদগুলি রচনা-বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়া চণ্ডীদাস-নামাঙ্কিত পদগুলির সমধর্মী; ইহাদের ভাব অত্যন্ত গম্ভীর হইলেও ভাষা অত্যন্ত সরল ও প্রসাদগুণমণ্ডিত। জ্ঞানদাস নারীর হৃদয়ের কথাকে নারীর বাচনভঙ্গীর মধ্য দিয়া নিখুঁতভাবে রূপায়িত করিয়াছেন। জ্ঞানদাস একজন বিশিষ্ট বৈষ্ণব সাধক ছিলেন, চৈতন্যদেব ছিলেন তাঁহার উপাস্য দেবতা। এইজন্য চৈতন্যদেবের প্রভাব তাঁহার রচনার মধ্যে খুব বেশি পড়িয়াছে। জ্ঞানদাস তাঁহার পদের মধ্যে রাধার যে চিত্র আঁকিয়াছেন, তাঁহার উপরে বহু স্থানেই চৈতন্যদেবের মূর্ত্তির ছায়া পড়িয়াছে। জ্ঞানদাসের বহু উৎকৃষ্ট পদ পরবর্তীকালে চণ্ডীদাসের নামে চলিয়া গিয়াছে।
আর একজন শ্রেষ্ঠ পদকর্ত্তা–অনেকের মতে সর্বশ্রেষ্ঠ পদকর্ত্তা-গোবিন্দদাস কবিরাজ। ইহার জীবৎকাল আনুমানিক ১৫২৫-১৬১০ খ্রীষ্টাব্দ। ইনি শ্রীখণ্ডের বৈদ্য বংশে জন্মগ্রহণ করেন। ইঁহার পিতা চিরঞ্জীব সেন হোসেন শাহের “অধিপাত্র” এবং চৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ ছিলেন। অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগ হওয়ার ফলে গোবিন্দদাস এবং তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা রামচন্দ্র শক্তিধর্ম্মাবলম্বী মাতামহের আশ্রয়ে মানুষ হন এবং মাতামহের প্রভাবে নিজেরাও শক্তিধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু পরিণত বয়সে শ্রীনিবাস আচার্যের কাছে তাঁহারা বৈষ্ণব ধর্ম্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর গোবিন্দদাস পদাবলী রচনায় ব্রতী হন। তাঁহার অপূর্ব সুন্দর পদ আস্বাদন করিয়া বৃন্দাবনের মহান্তরা তাঁহাকে কবিরাজ’ উপাধি দেন। জীব গোস্বামীও তাঁহার পদের প্রশংসা করিয়া তাহাকে পত্র লিখিয়াছিলেন।
গোবিন্দদাস কবিরাজ প্রধানত ব্রজবুলী ভাষায় পদ রচনা করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার পদগুলির কাব্যমাধুর্য অতুলনীয়। পূর্বরাগ এবং অনুরাগের বর্ণনায় তিনি প্রেমের সূক্ষ্ম ভাববৈচিত্র্য অপূর্বভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। কিন্তু গোবিন্দদাস সর্বাপেক্ষা দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন অভিসার বিষয়ক পদে। বিশেষত তাঁহার বর্ষাভিসার সম্বন্ধীয় পদগুলির তুলনা হয় না, এই সব পদের শব্দঝঙ্কারের মধ্য দিয়া বর্ষার ছন্দ আশ্চর্যভাবে ঝঙ্কত হইয়া উঠিয়াছে। গোবিন্দদাস অভিসারের বহু নূতন নূতন পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া মৌলিকতা দেখাইয়াছেন। গোবিন্দদাস ‘গৌরচন্দ্রিকা পদ রচনাতেও অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন; বিভিন্ন পর্যায়ের পদাবলী গাহিবার পূর্বে গায়কেরা চৈতন্যদেবের ঐ পর্যায়ের ভাবে ভাবিত হওয়া বিষয়ক একটি পদ গাহিয়া লন; এই পদগুলিকেই ‘গৌরচন্দ্রিকা’ বলা হয়; ‘গৌরচন্দ্রিকা পদের শ্রেষ্ঠ কবি গোবিন্দদাস। গোবিন্দদাস ভাষা, শব্দপ্রয়োগ, ছন্দ ও অলঙ্কারের ক্ষেত্রে অসামান্য নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়াছেন; বাণী-সৌষ্ঠব ও আঙ্গিক-পারিপাট্যের দিক দিয়া তাঁহার পদগুলি তুলনারহিত বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।
গোবিন্দদাসের সমসাময়িক অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁহার গুণগ্রাহী ছিলেন। ইঁহাদের মধ্যে অন্যতম যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্য এবং পক্কপল্লীর (পাইকপাড়া) রাজা হরিনারায়ণ।
গোবিন্দদাসের সমসাময়িক আর একজন বিশিষ্ট পদকর্ত্তা নরোত্তম দাস। ইনি উত্তরবঙ্গের জনৈক ধনী ভূস্বামীর পুত্র। যৌবনে সন্ন্যাসগ্রহণ করিয়া ইনি বৃন্দাবনে গিয়া লোকনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরে ইনি শ্রীনিবাস আচার্যের সঙ্গে বাংলা দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং এ দেশে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করিতে থাকেন। নরোত্তম বাঙালীর একান্ত পরিচিত ঘরোয়া ভাষায় পদ রচনা করিতেন; পদগুলি অনাড়ম্বর সৌন্দর্যের জন্য আমাদের মনোহরণ করে। প্রার্থনা বিষয়ক পদে নরোত্তম সর্বাপেক্ষা দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। এই পদগুলির মধ্যে ভক্তহৃদয়ের আকুতি মর্মস্পর্শী অভিব্যক্তি লাভ করিয়াছে। নরোত্তম কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন। তাহাদের মধ্যে প্রেমভক্তিচন্দ্রিকা সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত।
ষোড়শ শতকের আর একজন বিখ্যাত পদকর্ত্তা বলরাম দাস। ইনি ব্রজবুলী ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পদ রচনা করিতেন, কিন্তু ইহার বাংলা পদগুলিই উৎকৃষ্ট। বলরাম দাস বিশেষভাবে বাৎসল্য-রসাত্মক পদ রচনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। এই পদগুলিতে শিশু-কৃষ্ণের জন্য যশোদার মাতৃহৃদয়ের আর্তিকে বলরাম দাস অপূর্বভাবে রূপায়িত করিয়াছেন।
সপ্তদশ শতকের পদকর্ত্তাদের মধ্যে রামগোপালদাস বা গোপালদাসের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইহার পদগুলি ভাষার সারল্য ও ভাবের গভীরতার দিক দিয়া চণ্ডীদাসের পদকে স্মরণ করায়। গোপালদাসের কোন কোন পদ চণ্ডীদাসের নামেই চলিয়া গিয়াছে। গোপালদাস ‘রসকল্পবল্লী’ নামে একটি বৈষ্ণব রসতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ এবং বৈষ্ণবদের শাখানির্ণয়’ অর্থাৎ গুরুশিষ্যপরম্পরা-বর্ণন-গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন।
অষ্টাদশ শতকের পদকর্ত্তাদের মধ্যে দুইজনের নাম উল্লেখযোগ্য নরহরি চক্রবর্তী এবং জগদানন্দ। নরহরি চক্রবর্তীর নামান্তর ঘনশ্যাম। ইনি ভক্তি রত্নাকর’ প্রভৃতি বিখ্যাত চরিতগ্রন্থের রচয়িতা। নরহরির পদে ভাষা ও ছন্দের ঝঙ্কার প্রাধান্য লাভ করিলেও ভাবগভীরতার পরিচয়ও স্থানে স্থানে পাওয়া যায়। জগদানন্দ একজন অসাধারণ শব্দকুশলী কবি। ইহার পদগুলি শব্দের ঝঙ্কার এবং অনুপ্রাসের চমৎকারিত্বের জন্য মনোহরণ করে। জগদানন্দের অধিকাংশ পদই ব্রজবুলী ভাষায় রচিত।
যাঁহাদের কথা বলা হইল, ইঁহারা ভিন্ন আরও অসংখ্য কবি পদাবলী রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে অনন্তদাস, বংশীবদন, যাদবেন্দ্র, দীনবন্ধুদাস, যদুনন্দনদাস, গোবিন্দদাস চক্রবর্তী প্রভৃতি কবিদের রচনায় বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়।
সপ্তদশ শতকের শেষভাগ হইতে পদাবলী চয়ন-গ্রন্থের মধ্যে সঙ্কলিত হইতে থাকে। চারিটি পদসঙ্কলন-গ্রন্থের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য–(১) বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘ক্ষণদাগীতচিন্তামণি’ (সঙ্কলনকাল সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দশক), (২) নরহরি চক্রবর্তীর ‘গীতচন্দ্রোদয়’ (সঙ্কলনকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম পাদ), (৩) রাধামোহন ঠাকুরের ‘পদসমুদ্র’ এবং (৪) বৈষ্ণবদাস অর্থাৎ গোকুলানন্দ সেনের ‘পদকল্পতরু’ (সঙ্কলনকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ) ইহাদের মধ্যে ‘পদকল্পতরু সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কলনগ্রন্থ।
অষ্টাদশ শতাব্দী হইতেই পদাবলী-সাহিত্যের অবনতি দেখা দেয়। ভাব এবং আঙ্গিক উভয় ক্ষেত্রে ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি হইতে থাকায় এই শতকের শেষে পদাবলী-সাহিত্য একেবারে নিষ্প্রাণ ও কৃত্রিম হইয়া পড়ে।
পদাবলী-সাহিত্য বাংলা সাহিত্যের অপূর্ব গৌরবের সামগ্রী। ইহার মধ্যে মানব-জীবনের প্রেম ও কেদনার সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলি অপার্থিব আধ্যাত্মিকতায় মণ্ডিত হইয়া যেভাবে অপূর্ব শিল্পসুষমার মধ্য দিয়া অভিব্যক্তি লাভ করিয়াছে, তাঁহার তুলনা বিরল। শতাব্দীর পর শতাব্দী চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু এই অমৃতনিস্যন্দী পদগুলির আকর্ষণ প্রথম রচনার সময়ে যেমন ছিল, আজও প্রায় তেমনই আছে।
৭
চরিত-সাহিত্য
চৈতন্যদেবের জীবন-চরিত বর্ণনা করিয়া সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় অনেকগুলি গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। এই গ্রন্থগুলি এদেশের সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উদ্ঘাটন করিল। কেবল দেবদেবীকে লইয়া নহে, মানুষের বাস্তব জীবনকাহিনী লইয়াও যে গ্রন্থ রচনা করা যাইতে পারে, ইহাদের মধ্য দিয়া তাহাই প্রমাণিত হইল। অবশ্য জীবন-চরিত হিসাবে এই গ্রন্থগুলি আদর্শস্থানীয় নহে। কারণ ইহাদের লেখকেরা সকলেই ভক্ত ছিলেন, চৈতন্যদেবকে তাঁহারা মানুষ হিসাবে দেখেন নাই, দেখিয়াছেন ভগবান হিসাবে। তাঁহার ফলে চৈতন্যদেবের মানবতা ইহাদের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে ফোটে নাই। এই সব গ্রন্থের মধ্যে স্থানে স্থানে অলৌকিক বর্ণনার নিদর্শন পাওয়া যায়, তাঁহার ফলে বাস্তবতার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হইয়া পড়িয়াছে। তবে সে যুগের কবিদের রচনায়, বিশেষত ভক্ত কবিদের রচনায় এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য। এগুলি উপেক্ষা করিয়া বিশ্লেষণী দৃষ্টি লইয়া অগ্রসর হইলে ইহাদের মধ্য হইতে অকৃত্রিম তথ্য আবিষ্কার করা দুরূহ নয়।
চৈতন্যদেবের সর্বপ্রথম জীবনচরিত-গ্রন্থ মুরারি গুপ্ত রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য চরিতামৃতম্’। সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই বইটি সাধারণের কাছে ‘মুরারি গুপ্তের কড়চা’ নামে পরিচিত। মুরারি গুপ্ত প্রথম জীবনে চৈতন্যদেবের সহপাঠী ছিলেন, পরে তাঁহার পার্ষদ হন। সুতরাং তাঁহার লেখা এই চৈতন্যজীবনী-গ্রন্থটির মূল্য স্বাভাবিকভাবেই খুব বেশি।…
ইহার পরবর্তী বাংলা চৈতন্যচরিতগ্রন্থ জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’। জয়ানন্দ ১৫১০ খ্রীষ্টাব্দের মত সময়ে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং অতি শৈশবে চৈতন্যদেবের দর্শন ও আশীর্বাদ লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার ‘জয়ানন্দ’ নামও চৈতন্যদেবের দেওয়া। ১৫৪৮ হইতে ১৫৬০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে জয়ানন্দ ‘চৈতন্যমঙ্গল’ রচনা করেন। জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গলে’ চৈতন্যদেব সম্বন্ধে অনেক নূতন তথ্য পাওয়া যায়। চৈতন্যদেবের তিরোধান সম্বন্ধে অন্য চরিতগ্রন্থগুলি হয় নীরব নাহয় অলৌকিক উক্তিতে পূর্ণ; কেবল জয়ানন্দই এ সম্বন্ধে বিশ্বাসগ্রাহ্য বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন; তিনি লিখিয়াছেন যে চৈতন্যদেবের মৃত্যুর মূল কারণ কীর্তনের সময় পায়ে ইট লাগিয়া আহত হওয়া। অবশ্য এ কথা সত্য কিনা, তাহা বলা যায় না। জয়ানন্দ যে তাঁহার গ্রন্থে চৈতন্যদেব সম্বন্ধে অনেক ভুল সংবাদ দিয়াছেন, তাহাও অস্বীকার করা চলে না। জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গলেও সে যুগের সমাজ সম্বন্ধে অনেক তথ্য পাওয়া যায়।
জয়ানন্দের প্রায় সমসাময়িক কালেই লোচনদাস নামে জনৈক গ্রন্থকার ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে আর একটি বাংলা চরিগ্রন্থ রচনা করেন। লোচনদাস ছিলেন চৈতন্যদেবের পার্ষদ নরহরি সরকারের শিষ্য। নরহরি সরকার ‘গৌরনগরবাদ’ নামে একটি নূতন মতবাদ প্রচার করিয়াছিলেন, এই মতবাদ অনুসারে চৈতন্যদেব শ্রীকৃষ্ণের অন্যান্য ভাবের মত নাগরভাবেও ভাবিত হইতেন। লোচনদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গলে’ এই গৌরনগরবাদের প্রতিফলন দেখা যায়। লোচনদাস প্রধানত মুরারি গুপ্তের গ্রন্থ অনুসরণ করিয়া চৈতন্যচরিত বর্ণনা করিয়াছেন। মুরারি গুপ্তের গ্রন্থের বহির্ভূত যে সমস্ত সংবাদ লোচনদাস তাঁহার গ্রন্থে দিয়াছেন, সেগুলির ঐতিহাসিক মূল্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায় না। লোচনদাস প্রথম শ্রেণীর কবি ছিলেন, সেই জন্য তাঁহার ‘চৈতন্যমঙ্গলের’ কাব্যমূল্য অসামান্য।
ষোড়শ শতাব্দীতে চূড়ামণিদাস নামে আর একজন গ্রন্থকার ‘গৌরাঙ্গবিজয়’ নামে একখানি বাংলা চরিগ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। এই গ্রন্থে তথ্যের তুলনায় কল্পনা প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। বইটির মধ্যে অলৌকিক বর্ণনার খুব বেশি নিদর্শন পাওয়া যায়।
এইসব গ্রন্থকারের পরে কৃষ্ণদাস কবিরাজ ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ নামক বিখ্যাত বাংলা চরিগ্রন্থ রচনা করেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের নিবাস ছিল কাটোয়ার নিকটবর্তী ঝামটপুর গ্রামে। যৌবনে তিনি সংসার ত্যাগ করিয়া বৃন্দাবনে চলিয়া যান এবং ছয় গোস্বামী–অর্থাৎ রূপ, সনাতন, জীব, রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট ও গোপাল ভট্টের নিকটে শিক্ষা গ্রহণ করেন। কৃষ্ণদাস সংস্কৃত ভাষায় কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে ‘গোবিন্দলীলামৃত’ নামক মহাকাব্য এবং বিল্বমঙ্গলের ‘কৃষ্ণকৰ্ণামৃতের টীকা ‘সারঙ্গরঙ্গদা’ রচনা করেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি বৃন্দাবনের মহান্তদের অনুরোধে ‘‘চৈতন্যচরিতামৃত’ রচনা করেন। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ তিনটি খণ্ডে বিভক্ত আদিলীলা, মধ্যলীলা ও অন্ত্যলীলা; ইহার মধ্যে ‘আদিলীলা’য় চৈতন্যদেবের সন্ন্যাসগ্রহণ অবধি জীবনকাহিনী, ‘মধ্যলীলা’য় সন্ন্যাসগ্রহণের পরবর্তী ছয় বৎসরের তীর্থপর্যটন এবং অন্ত্যলীলা’য় অবশিষ্ট জীবন বর্ণিত হইয়াছে, তবে চৈতন্যদেবের মৃত্যুর বর্ণনা ইহাতে নাই। কৃষ্ণদাস কবিরাজ মুরারি গুপ্তের কড়চা, স্বরূপদামোদরের কড়চা (বর্তমানে পাওয়া যায় না) এবং বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ হইতে তাঁহার গ্রন্থের উপকরণ সংগ্রহ করিয়াছেন। বৃন্দাবনদাসের ‘চৈতন্যভাগবতে’ যে সমস্ত বিষয় বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হইয়াছে, তাহাদের অধিকাংশই কৃষ্ণদাস সংক্ষেপে উল্লেখ করিয়া কর্তব্য শেষ করিয়াছেন। অন্য বিষয়গুলি তিনি বিশদভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। ‘চৈতন্যচরিতামৃতে’র আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম্মের সমস্ত মূল তত্ত্ব ইহার মধ্যে সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে। এইজন্য এই গ্রন্থ শুধু চৈতন্যদেবের জীবনচরিত-গ্রন্থ হিসাবেই উল্লেখযোগ্য নহে, দর্শন-গ্রন্থ। হিসাবেও ইহার একটি বিশিষ্ট মূল্য আছে। এই গ্রন্থের কাব্যমূল্যও অপরিসীম। নীলাচলে বাসের সময়ে চৈতন্যদেবের ‘দিব্যোন্মাদ’ অবস্থার যে বর্ণনা কৃষ্ণদাস দিয়াছেন, তাহা প্রথম শ্রেণীর কাব্য। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহার মধ্যে লেখক অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় অত্যন্ত জটিল দার্শনিক তত্ত্বকে অবলীলাক্রমে বর্ণনা করিয়াছেন। ইহা তাঁহার অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয়। ‘চৈতন্যচরিতামৃতের ভাষায় স্থানে স্থানে হিন্দী ভাষার প্রভাব দেখা যায়, লেখক দীর্ঘকাল বৃন্দাবনে বাস করিয়াছিলেন বলিয়াই এইরূপ হইয়াছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ অসাধারণ বিনয়ী লোক ছিলেন, ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে নানাভাবে তিনি নিজের দৈন্য প্রকাশ করিয়াছেন। চৈতন্যচরিগ্রন্থগুলির মধ্যে ‘চৈতন্যচরিতামৃত নানা দিক দিয়াই শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করিতে পারে। তবে ইহার একমাত্র ত্রুটি এই যে, ইহার মধ্যে অলৌকিক বর্ণনার কিছু আধিক্য দেখা যায়।
‘চৈতন্যচরিতামৃতে’র পরেও আরও কয়েকটি চৈতন্যচরিতগ্রন্থ রচিত হইয়াছিল, কিন্তু সেগুলি তেমন উল্লেখযোগ্য নহে। তবে ব্রজমোহন দাসের ‘চৈতন্যতত্ত্ব-প্রদীপ’, নিত্যানন্দদাসের ‘প্রেমবিলাস’, মনোহর দাসের অনুরাগবল্লী’, নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’ ও ‘নরোত্তমা বিলাস’ প্রভৃতি গ্রন্থের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে। শেষ চারখানি গ্রন্থে অনেক বৈষ্ণব মহান্তের জীবনী এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। ‘প্রেমবিলাস’-রচয়িতা নিত্যানন্দদাস ছিলেন নিত্যানন্দের স্ত্রী জাহ্নবী দেবীর শিষ্য; এই বইটি সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকেই রচিত হইয়াছিল, তবে ইহার মধ্যে পরবর্তীকালে অনেক প্রক্ষিপ্ত উপাদান প্রবেশ করিয়াছে। মনোহর দাসের ‘অনুরাগবল্লী’ ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দে রচিত হয়; ইহার মধ্যে মুখ্যত শ্রীনিবাস আচার্যের জীবনী বর্ণিত হইয়াছে। নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’ সুবিশাল গ্রন্থ; ইহার মধ্যে প্রমাণ সহযোগে শ্রীনিবাস আচার্য প্রমুখ বৈষ্ণব আচার্যদের জীবনী ও বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে, অধুনালুপ্ত কয়েকটি গ্রন্থ সমেত বহু গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃতি দেওয়া হইয়াছে, জীব গোস্বামী ও নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র গোস্বামীর লেখা কয়েকটি পত্র অবিকলভাবে উদ্ধৃত করা হইয়াছে এবং নবদ্বীপ ও বৃন্দাবনের বিশদ ও উজ্জ্বল বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে। এই সমস্ত কারণে ‘ভক্তিরত্নাকর’-এর মূল্য অপরিসীম। নরহরি চক্রবর্তীর অপর গ্রন্থ ‘নরোত্তমবিলাস’ ক্ষুদ্রতর গ্রন্থ, ইহার মধ্যে নরোত্তম দাসের জীবনী বর্ণিত হইয়াছে। নরহরি চক্রবর্তীর দুইটি গ্রন্থই অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রচিত হইয়াছিল। তিনি ‘শ্রীনিবাসচরিত্র’ নামে অধুনালুপ্ত আর একটি গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন।
অদ্বৈত ও তাঁহার পত্নী সীতাদেবীর জীবনী বর্ণনা করিয়া সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় কয়েকটি বই লেখা হইয়াছিল। বইগুলি অদ্বৈত ও সীতার সমসাময়িকত্ব দাবি করিলেও এগুলি অর্ব্বাচীন ও অপ্রামাণিক রচনা।
৮
বৈষ্ণব নিবন্ধ-সাহিত্য
বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্যের একটি গৌণ শাখা নিবন্ধ-সাহিত্য। বৈষ্ণবদের পক্ষে প্রয়োজনীয় নানা বিষয় আলোচনা করিয়া ছোট বড় অনেকগুলি নিবন্ধ-গ্রন্থ বাংলায় রচিত হইয়াছিল।
ইহাদের মধ্যে এক শ্রেণীর নিবন্ধ-গ্রন্থে বৈষ্ণব ধর্ম, দর্শন ও রসশাস্ত্র সম্বন্ধীয় বিভিন্ন তত্ত্ব আলোচিত হইয়াছে। এই শ্রেণীর গ্রন্থগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৃন্দাবনের গোস্বামীদের রচনাবলী ও ‘‘চৈতন্যচরিতামৃত’কে অনুসরণ করিয়াছে, মাত্র অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে রচয়িতারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য দেখাইয়াছেন। এই শ্রেণীর নিবন্ধ-গ্রন্থের মধ্যে প্রধান কবিবল্লভের ‘রসকদম্ব’ (রচনাকাল ১৫৯৯ খ্রীষ্টাব্দ), রামগোপাল দাসের ‘রসকল্পবল্লী’ (রচনাকাল ১৬৭৩ খ্রীষ্টাব্দ) এবং রামগোপাল দাসের পুত্র পীতাম্বর দাসের ‘রসমঞ্জরী’ ও ‘অষ্টরসব্যাখ্যা’ (রচনাকাল সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ)।
আর এক শ্রেণীর নিবন্ধ-গ্রন্থে বৈষ্ণব ভক্তদের নামের তালিকা এবং গুরুশিষ্য পরম্পরা বর্ণিত হইয়াছে। এই জাতীয় রচনার মধ্যে দৈবকীনন্দনের ‘বৈষ্ণববন্দনা’ (রচনাকাল সোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ) এবং রামগোপালদাসের শাখানির্ণয়’ (রচনাকাল সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ) উল্লেখ করা যাইতে পারে।
৯
বৈষ্ণব আখ্যানকাব্য
কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে যে সমস্ত আখ্যানকাব্য রচিত হইয়াছিল সেগুলিও বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্তর্গত। এই আখ্যানকাব্যগুলিকে ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ বলা হয়।
চৈতন্য-পরবর্তী যুগের সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ‘কৃষ্ণমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা মাধবাচার্য। ইনি সম্ভবত চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ছিলেন। কাহারও কাহারও মতে ইনি চৈতন্যদেবের শ্যালক ছিলেন; কিন্তু এই মতের সত্যতা সম্বন্ধে কোন প্রমাণ নাই।
মাধবাচার্যের শিষ্য কৃষ্ণদাসও একখানি ‘কৃষ্ণমঙ্গল’, রচনা করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড প্রভৃতি ভাগবতবহির্ভূত লীলা বর্ণিত হইয়াছে। কৃষ্ণদাস বলিয়াছেন যে তিনি ‘হরিবংশ’ হইতে এগুলি সগ্রহ করিয়াছেন। কিন্তু হরিবংশ’ পুরাণের বর্তমান-প্রচলিত সংস্করণে এগুলি পাওয়া যায় না। সম্ভবত সে যুগে ‘হরিবংশ’ নামে অন্য কোন সংস্কৃত গ্রন্থ ছিল এবং তাঁহার মধ্যে দানখণ্ড প্রভৃতি লীলা বর্ণিত ছিল।
কবিশেখরের ‘গোপালবিজয়’-ও ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ কাব্য। এই বইটি ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে রচিত হইয়াছিল। গোপালবিজয়’ বৃহদায়তন গ্রন্থ এবং শক্তিশালী রচনা।
সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ভবানন্দ নামক জনৈক পূর্ববঙ্গীয় কবি ‘হরিবংশ’ নামে একখানি ‘কৃষ্ণমঙ্গল কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। এই কাব্যটিতেও দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড প্রভৃতি বর্ণিত হইয়াছে এবং কৃষ্ণদাসের মত ভবানন্দও বলিয়াছেন যে তিনি ব্যাসের ‘হরিবংশ’ হইতে এগুলি সংগ্রহ করিয়াছেন। কাব্যটি রচনা হিসাবে প্রশংসনীয়, তবে ইহাতে আদিরসের কিছু আধিক্য দেখা যায়।
এইসব ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ ব্যতীত গোবিন্দ আচার্য, পরমানন্দ এবং দুঃখী শ্যামদাস রচিত ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ গ্রন্থগুলিও উল্লেখযোগ্য। এই বইগুলি ষোড়শ শতাব্দীর রচনা। সপ্তদশ শতাব্দীর ‘কৃষ্ণমঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে পরশুরাম চক্রবর্তী রচিত ‘কৃষ্ণমঙ্গল’ ও পরশুরাম রায় রচিত “মাধবসঙ্গীত’-এর নামও উল্লেখ করা যাইতে পারে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিশিষ্টতম ‘কৃষ্ণমঙ্গল-রচয়িতা হইতেছেন “কবিচন্দ্র” উপাধিধারী শঙ্কর চক্রবর্তী; ইনি বিষ্ণুপুরের মল্লবংশীয় রাজা গোপালসিংহের (রাজত্বকাল ১৭১২-৪৮ খ্রীষ্টাব্দ) সভাকবি ছিলেন; ইহার ‘কৃষ্ণমঙ্গল কাব্য অনেকগুলি খণ্ডে বিভক্ত; প্রতি খণ্ডের অজস্র পুঁথি পাওয়া গিয়াছে; শঙ্কর চক্রবর্তী কবিচন্দ্র রামায়ণ, মহাভারত, ধর্মমঙ্গল ও শিবায়নও রচনা করিয়াছিলেন; ইঁহার লেখা কাব্যগুলির যত পুঁথি এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে, তত পুঁথি আর কোন বাংলা গ্রন্থে মিলে নাই।
১০
সহজিয়া সাহিত্য
“সহজিয়া” নামে (নামটি আধুনিককালের সৃষ্টি) পরিচিত সম্প্রদায়ের লোকেরা বাহ্যত বৈষ্ণব ছিলেন, কিন্তু ইহাদের দার্শনিক মত ও সাধন-পদ্ধতি দুইই গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তুলনায় স্বতন্ত্র। ইহারা বিশ্বাস করিতেন যাহা কিছু তত্ত্ব ও দর্শন সবই মানুষের দেহে আছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা পরকীয়া প্রেমকে সাধনার রূপক হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন, বাস্তব জীবনে গ্রহণ করেন নাই। কিন্তু সহজিয়া সাধকেরা বাস্তব জীবনেও পরকীয়া প্রেমের চর্চ্চা করিতেন, ইঁহাদের বিশ্বাস ছিল যে ইহারই মধ্য দিয়া সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব। সহজিয়ারা মনে করিতেন যে, বিল্বমঙ্গল, জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, রূপ, সনাতন, কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রভৃতি প্রাচীন সাধক ও কবিরা সকলেই পরকীয়া-সাধন করিতেন।
সহজিয়াদেরও একটি নিজস্ব সাহিত্য ছিল এবং তাঁহার পরিমাণ সুবিশাল। সহজিয়া-সাহিত্যকে দুইভাগে ভাগ করা যাইতে পারে-পদাবলী ও নিবন্ধ সাহিত্য। এ পর্যন্ত বহু সহজিয়া পদ ও সহজিয়া নিবন্ধ পাওয়া গিয়াছে। ইহাদের মধ্যে কিছু উৎকৃষ্ট রচনা থাকিলেও অধিকাংশই নিতান্ত অকিঞ্চিত্বর রচনা। অনেক রচনায় অশ্লীল ও রুচিবিগর্হিত উপাদানও দেখিতে পাওয়া যায়। সহজিয়া লেখকেরা নিজেদের রচনায় প্রায়ই রচয়িতা হিসাবে নিজেদের নাম না দিয়া বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, নরহরি সরকার, রঘুনাথ দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, নরোত্তম দাস প্রভৃতি প্রাচীন কবি ও গ্রন্থকারদের নাম দিতেন। নিজেদের নামে যাহারা সহজিয়া পদ ও নিবন্ধ লিখিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে মুকুন্দদাস, তরুণীরমণ, বংশীদাস প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে।
১১
অনুবাদ-সাহিত্য
রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত এবং অন্যান্য বহু সংস্কৃত গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হইয়াছিল। কিছু কিছু ফার্সী এবং হিন্দী বইও অনূদিত হইয়াছিল। তবে এই অনুবাদ প্রায়ই আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ। ইহাদের মধ্যে কবির স্বাধীন রচনা এবং বাংলা দেশের ঐতিহ্য অনুসারী মূলাতিরিক্ত বিষয় প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়।
রামায়ণ
বাংলার অনুবাদ-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে রামায়ণের কথাই প্রথমে বলিতে হয়। প্রথম বাংলা রামায়ণ-রচয়িতা কৃত্তিবাস সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচনা করা হইয়াছে। ইহার পরে ষোড়শ শতকে রচিত শঙ্করদেব ও মাধব কন্দলীর রামায়ণের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। শঙ্করদেব আসামের বিখ্যাত বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক। শূদ্র হইয়াও তিনি ব্রাহ্মণদের দীক্ষা দিতেন, এই অপরাধে তাঁহাকে স্বদেশে নিগৃহীত হইতে হয়। তখন তিনি কামতা (কোচবিহার) রাজ্যে পলাইয়া আসেন এবং কামতা-রাজের আশ্রয়ে অবশিষ্ট জীবন কাটাইয়া পরলোকগমন করেন। মাধব কন্দলী শঙ্করদেবের পূর্ববর্তী কবি। মহামাণিক্য বরাহ রাজার অনুরোধে তিনি ছয় কাণ্ড রামায়ণ রচনা করেন উত্তরকাণ্ডটি লেখেন শঙ্করদেব। প্রাচীন বাংলা ও প্রাচীন অসমীয়া ভাষার মধ্যে প্রায় কিছুই পার্থক্য ছিল না। এই কারণে, মাধব কন্দলী ও শঙ্করদেব আসামের অধিবাসী হইলেও ইঁহাদের রচিত রামায়ণকে প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে।
সপ্তদশ শতাব্দীর বাংলা রামায়ণ-রচয়িতাদের মধ্যে “অদ্ভুত আচার্য” নামে পরিচিত জনৈক কবির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইহার প্রকৃত নাম নিত্যানন্দ। প্রবাদ এই যে, সাত বৎসর বয়সে অক্ষরপরিচয়হীন অবস্থায় ইনি মুখে মুখে রামায়ণ রচনা করিয়াছিলেন; এই অদ্ভুত কাজ করিয়াছিলেন বলিয়া ইনি “অদ্ভুত আচার্য” নাম পাইয়াছিলেন; মতান্তরে, ইনি সংস্কৃত অদ্ভুত রামায়ণ অবলম্বনে বাংলা রামায়ণ লিখিয়াছিলেন বলিয়া ইহার নাম “অদ্ভুত-আচার্য” হইয়াছিল; আর একটি মত এই যে, ইহার নাম “অদ্ভুত আচার্য” আদপে ছিল না, লিপিকর-প্রমাদে “অদ্ভুত আশ্চর্য রামায়ণ” কথাটিই “অদ্ভুত আচার্য রামায়ণ”-এ পরিণত হইয়াছে এবং তাহা হইতেই সকলে ধরিয়া লইয়াছে যে কবির নাম “অদ্ভুত আচার্য”। সে যাহা হউক, “অদ্ভুত আচার্য” রচিত রামায়ণটি বেশ প্রশংসনীয় রচনা। ইহাতে সপত্নী সুমিত্রার সমব্যথিনী স্নেহময়ী কৌশল্যার চরিত্রটি যেরূপ জীবন্ত হইয়াছে, তাঁহার তুলনা বিরল। “অদ্ভুত আচার্য”র রামায়ণ এক সময়ে উত্তরবঙ্গে খুব জনপ্রিয় ছিল, ঐ অঞ্চলে তখন কৃত্তিবাসী রামায়ণের তেমন প্রচার ছিল না। বর্তমানে “অদ্ভুত আচার্য”র রামায়ণ তাঁহার জনপ্রিয়তা হারাইয়াছে বটে, তবে ইহার অনেক অংশ কৃত্তিবাসী রামায়ণের মধ্যে প্রবেশ করিয়া এখন কৃত্তিবাসেরই নামে চলিয়া যাইতেছে।
ইঁহারা ভিন্ন আরও অনেক বাঙালী কবি রামায়ণ রচনা করিয়াছিলেন। কয়েকজনের নাম এখানে উল্লিখিত হইল–দ্বিজ লক্ষ্মণ, কৈলাস বসু, ভবানী দাস, কবিচন্দ্র চক্রবর্তী, মহানন্দ চক্রবর্তী, গঙ্গারাম দত্ত, কৃষ্ণদাস। ১৭৬২ খ্রীষ্টাব্দে রচিত রামানন্দ ঘোষের রামায়ণের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে; এই রামায়ণে রামানন্দ নিজেকে বুদ্ধদেবের অবতার বলিয়াছেন। ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে আর একটি বাংলা রামায়ণের রচনা সম্পূর্ণ হইয়াছিল। এটি বাঁকুড়া-নিবাসী জগত্রাম বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁহার পুত্র রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় দুইজনে মিলিয়া রচনা করেন।
মহাভারত-কাশীরাম দাস
বাংলা মহাভারত রচনা শুরু হয় আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩ ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দ)। হোসেন শাহ কর্ত্তৃক নিযুক্ত চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তা পরাগল খান মহাভারত শুনিতে খুব ভালবাসিতেন, কিন্তু সংস্কৃত মহাভারতের মর্ম ভালভাবে গ্রহণ করিতে পারিতেন না। তাই তিনি তাঁহার সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বরকে দিয়া একখানি বাংলা মহাভারত রচনা করান। এইটিই প্রথম বাংলা মহাভারত এবং সম্ভবত উত্তর ভারতে প্রচলিত কোন আধুনিক ভারতীয় ভাষায় লেখা প্রথম মহাভারত। কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারতখানি সুখপাঠ্য, তবে সংক্ষিপ্ত।
পরাগল খানের পুত্র ছুটি খান (প্রকৃত নাম নসরৎ খান) ত্রিপুরার বিরুদ্ধে অভিযানে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন এবং তিনি দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে হোসেন শাহের অধিকৃত অঞ্চলবিশেষের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তিনি জৈমিনি রচিত মহাভারতের অশ্বমেধ-পর্বের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তাই তিনি তাঁহার সভাকবি শ্রীকর নন্দীকে দিয়া জৈমিনির অশ্বমেধ-পর্বকে বাংলায় ভাবানুবাদ করান। শ্রীকর নন্দীর এই মহাভারত হোসেন শাহের রাজত্বের শেষ দিকে-নসরৎ শাহের যৌবরাজ্য প্রাপ্তির পরে–রচিত হয়।
পূর্ববঙ্গের যে মহাভারতটির প্রচার সর্বাপেক্ষা অধিক ছিল, সেটির প্রায় আগাগোড়াই সঞ্জয়ের ভণিতা পাওয়া যায়। ইহা হইতে অনেকে মনে করেন এই মহাভারতের রচয়িতার নাম সঞ্জয়। কিন্তু অন্যান্য পণ্ডিতদের মতে এই সঞ্জয় মহাভারতের অন্যতম চরিত্র সঞ্জয় ভিন্ন আর কেহই নহে, তাঁহারই নামে ইহাতে কবি ভণিতা দিয়াছেন। শেষোক্ত মতই সত্য বলিয়া মনে হয়। কোন কোন পুঁথিতে লেখা আছে যে, হরিনারায়ণ দেব নামে জনৈক ভরদ্বাজ বংশীয় ব্রাহ্মণ সঞ্জয়’ নামের অন্তরালে নিজেকে গোপন রাখিয়া এই মহাভারত রচনা করিয়াছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে সঞ্জয়ের মহাভারত কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারতের পূর্বে রচিত হয় এবং ইহাই প্রথম বাংলা মহাভারত। কিন্তু এই মতের সমর্থনে কোন যুক্তি নাই। কবীন্দ্র পরমেশ্বরের মহাভারতে উহার রচনার যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তাহা হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে উহার পূর্বে অন্তত পূর্ববঙ্গে কোন বাংলা মহাভারত রচিত হয় নাই।
আর একজন বিশিষ্ট মহাভারত-রচয়িতা নিত্যানন্দ ঘোষ। ইনি সম্ভবত ষোড়শ শতাব্দীর লোক। ইহার মহাভারত আকারে বৃহৎ এবং ইহার প্রচার পশ্চিম বঙ্গেই সমধিক ছিল।
ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত অন্যান্য বাংলা মহাভারতের মধ্যে উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা মুকুন্দদেবের বাঙালী সভাকবি দ্বিজ রঘুনাথ রচিত ‘অশ্বমেধপর্ব’, উত্তর রাঢ়ের কবি রামচন্দ্র খান রচিত ‘অশ্বমেধপর্ব’ এবং কোচবিহারের রাজসভার আশ্রিত দুইজন কবির রচনা-রামসরস্বতীর ‘বনপর্ব’ ও পীতাম্বর দাসের ‘নলদময়ন্তী উপাখ্যান’-এর উল্লেখ করা যাইতে পারে।
ইঁহাদের পরে কাশীরাম দাস আবির্ভূত হন। কাশীরামের আসল নাম কাশীরাম দেব। তাঁহার পিতার নাম কমলাকান্ত দেব। তাঁহার তিন পুত্র-জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণ, মধ্যম কাশীরাম, কনিষ্ঠ গদাধর। জাতিতে কায়স্ত বলিয়া ইঁহারা নামের সহিত দাস’ শব্দ যোগ করিতেন। ইঁহাদের আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার অন্ত গত ইন্দ্রাবনী বা ইন্দ্রাণী পরগণার কোন এক গ্রামে। গ্রামটির নাম কোন পুঁথিতে ‘সিঙ্গি’, কোন পুঁথিতে সিদ্ধি পাওয়া যায়। ঐ অঞ্চলে এই দুই নামেরই দুটি গ্রাম আছে। ‘সিদ্ধি’র দাবির পক্ষেই যুক্তি অধিক। তবে কমলাকান্ত দেব দেশত্যাগ করিয়া উড়িষ্যায় বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। সেখানেই কাশীরাম দাসের মহাভারত রচিত হয়।
বর্তমানে যে অষ্টাদশ-পর্ব মহাভারত কাশীরাম দাসের নামে প্রচলিত, তাঁহার সবখানিই কাশীরাম দাসের রচনা নহে। ইহার সমগ্র আদিপর্ব, সভাপর্ব ও বিরাটপর্ব এবং বনপর্বের কিয়দংশ কাশীরামের লেখনীনিঃসৃত। এই সাড়ে তিনটি পর্ব রচনা করিয়া কাশীরাম দাস পরলোকগমন করেন। তাঁহার সম্পর্কিত ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম দাস দাবি করিয়াছেন যে, কাশীরাম মৃত্যুকালে তাঁহার আরব্ধ কার্য শেষ করিবার ভার নন্দরামকেই দিয়া যান। নন্দরাম মহাভারতের আর কয়েকটি পর্ব রচনা করেন, কিন্তু তিনিও মহাভারত শেষ করিতে পারেন নাই। নন্দরাম ও অন্যান্য অনেক কবির রচনা হইতে খুশিমত অংশ নির্বাচন করিয়া কাশীরামের রচিত সাড়ে তিনটি পর্বের সহিত তাহা যোগ করিয়া গায়েনরা একটি অষ্টাদশ-পর্ব মহাভারত গড়িয়া তুলে। ইহাই “কাশীদাসী মহাভারত”। ইহার যে সমস্ত পর্ব কাশীরাম দাস লিখেন নাই, সেগুলিতে তাহাদের প্রকৃত রচয়িতাদেরই ভণিতা আদিতে ছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এই মহাভারতের লিপিকর, গায়ন ও প্রকাশকরা ঐসব কবির ভণিতা তুলিয়া দিয়া সর্বত্র কাশীরাম দাসের ভণিতা বসাইয়া দিয়াছেন। ফলে এখন সমগ্র মহাভারতখানিই কাশীরাম দাসের নামে চলিয়া যাইতেছে।
কাশীরাম দাসের মহাভারতের বিরাটপর্বের কোন কোন পুঁথিতে যে রচনাকালবাচক শ্লোক পাওয়া যায়, তাহা হইতে জানা যায় যে ঐ পর্বের রচনা ১৬০৪-০৫ খ্রীষ্টাব্দে সম্পূর্ণ হয়। কাশীরাম দাসের লেখা অন্যান্য পর্বগুলি ইহার কিছু আগে পরে রচিত হইয়াছিল বলিয়া ধরিয়া লওয়া যাইতে পারে। কাশীরাম দাসের অনুজ গদাধর দাস ১৬৪২ খ্রীষ্টাব্দে ‘জগন্নাথমঙ্গল’ নামে একটি কাব্য লিখিয়াছিলেন, এই কাব্যে তিনি কাশীরাম দাসের মহাভারত রচনার উল্লেখ করিয়াছেন। সুতরাং কাশীরাম দাসের রচিত পর্বগুলির রচনাকালের অধস্তন সীমা ১৬৪২ খ্রীষ্টাব্দ।
কাশীরাম দাসের রচিত পর্বগুলি হইতে বুঝা যায় যে, কাশীরাম একজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। বিষ্ণুর মোহিনী-রূপ ধারণ, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভা প্রভৃতি বিষয়ের বর্ণনায় কাশীরাম অতুলনীয় দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। কাশীরামের মহাভারত বাংলা দেশে অসামান্য জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল, এক কৃত্তিবাস ছাড়া আর কোন কবির রচনা অনুরূপ জনপ্রিয়তা লাভ করিতে পারে নাই। কৃত্তিবাসের রামায়ণের মত কাশীরাম দাসের মহাভারতও বাঙালীর জাতীয় কাব্য। কিন্তু কৃত্তিবাস শুধু বাংলা রামায়ণের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা নহেন, সেই সঙ্গে আদি রচয়িতাও। পক্ষান্তরে কাশীরাম দাসের পূর্বেই অনেক কবি বাংলা মহাভারত রচনা করিয়া কাশীরামকে পথ প্রদর্শন করিয়াছিলেন। এই কারণে কাশীরাম দাসের অপেক্ষা কৃত্তিবাসের কৃতিত্ব অধিক।
কাশীরাম দাসের মহাভারত অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করার ফলে তাঁহার পূর্ববর্তী কবিদের রচিত বাংলা মহাভারতগুলি অচিরে বিস্মৃতির জগতে চলিয়া গেল। কাশীরাম দাসের পরে সপ্তদশ শতকে ঘনশ্যাম দাস, অনন্ত মিশ্র, রাজেন্দ্র দাস, রামনারায়ণ দত্ত, রামকৃষ্ণ কবিশেখর, শ্রীনাথ ব্রাহ্মণ প্রভৃতি কবিগণ এবং অষ্টাদশ শতকে কবিচন্দ্র চক্রবর্তী, ষষ্ঠিবর সেন তৎপুত্র গঙ্গাদাস সেন, “জ্যোতিষ ব্রাহ্মণ” বাসুদেব, ত্রিলোচন চক্রবর্তী, দৈবকীনন্দন, কৃষ্ণরাম, রামনারায়ণ ঘোষ, লোকনাথ দত্ত প্রভৃতি কবিরা বাংলা মহাভারত রচনা করেন। অবশ্য সম্পূর্ণ মহাভারত খুব কম কবিই রচনা করিয়াছিলেন, অধিকাংশই মহাভারতের অংশবিশেষকে বাংলা রূপ দিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন। ইঁহাদের কাহারও রচনা বিশেষ জনপ্রিয় হইতে পারে নাই।
ভাগবত
রামায়ণ ও মহাভারতের মত ভাগবতেরও বাংলা অনুবাদ হইয়াছিল, তবে খুব বেশি হয় নাই। চৈতন্যদেবের সমসাময়িক এবং চৈতন্যদেবের দ্বারা ‘ভাগবতাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত বরাহনগর-নিবাসী কবি রঘুনাথ পণ্ডিত ‘কৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিণী’ নাম দিয়া ভাগবতের অনুবাদ করেন; কিন্তু ভাগবতের বারটি স্কন্ধের মধ্যে প্রথম নয়টি স্কন্ধের তিনি সংক্ষিপ্ত ভাবানুবাদ করিয়াছিলেন এবং শেষ তিনটি স্কন্ধের আক্ষরিক অনুবাদ করিয়াছিলেন। ইহার পর আসামের ধর্মপ্রচারক শঙ্করদেব কামতারাজের আশ্রয়ে থাকিয়া ভাগবতের কয়েকটি স্কন্ধের অনুবাদ করিয়াছিলেন। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে সনাতন চক্রবর্তী নামে একজন কবি সমগ্র ভাগবতের বঙ্গানুবাদ করেন–১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার অনুবাদ সম্পূর্ণ হয়। সপ্তদশ শতকের শেষ পাদে সনাতন ঘোষাল বিদ্যাবাগীশ নামে আর একজন কবি কটকে বসিয়া ভাগবতের প্রথম নয়টি স্কন্ধের আক্ষরিক অনুবাদ করেন; ইনি ছিলেন কলিকাতার ঘোষাল বংশের সন্তান।
অন্যান্য অনুবাদগ্রন্থ
রামায়ণ, মহাভারত এবং ভাগবত ভিন্ন অন্যান্য কোন কোন সংস্কৃত গ্রন্থও বাংলায় অনূদিত হইয়াছিল। তবে সেগুলি সাহিত্য-সৃষ্টি হিসাবে উল্লেখযোগ্য কিছু হয় নাই। হিন্দী এবং ফার্সী ভাষায় যে সমস্ত গ্রন্থ বাংলায় অনূদিত হইয়াছিল, তাহাদের অধিকাংশেরই অনুবাদক মুসলমান। পরবর্তী প্রসঙ্গে সেগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হইতেছে।
১২
বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের দান
বাংলা সাহিত্যের মুসলমান লেখকেরা হিন্দু লেখকদের অপেক্ষাকৃত পরে অংশগ্রহণ করিতে আরম্ভ করেন। কারণ, বাঙালী মুসলমানদের মাতৃভাষা যে আরবী ও ফার্সী নহে–বাংলা, ইহা উপলব্ধি করিতে তাঁহাদের কয়েক শতাব্দী লাগিয়াছিল। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও বাঙালী মুসলমানরা বাংলা ভাষাকে “হিন্দুয়ানি ভাষা” বলিতেন; কবি সৈয়দ সুলতানের লেখা হইতে তাঁহার প্রমাণ মিলে।
বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকেরা এমন একটি নূতন বস্তু দিয়াছেন, যাহা হিন্দু লেখকেরা দিতে পারেন নাই। ধর্মনিরপেক্ষ বা লৌকিক কাব্য এবং বিশুদ্ধ প্রণয়মূলক কাব্য প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে তাঁহারাই প্রবর্তন করিয়াছেন। হিন্দুরা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের যে সমস্ত ধারায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন, তাহাদের প্রায় সবই ধর্মমূলক, কারণ হিন্দুরা সাহিত্যকে ধর্মচর্চ্চার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করিতেন। কিন্তু মুসলমানরা সাহিত্যচর্চ্চার মধ্য দিয়া ধর্মচর্চ্চার বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করেন নাই; এইজন্য তাঁহারা ধর্মনিরপেক্ষ বা বিশুদ্ধ প্রণয়মূলক বিষয় অবলম্বনে বহু কাব্য রচনা করিয়াছেন। অবশ্য ধর্মমূলক বিষয় অবলম্বনেও তাঁহারা লিখিয়াছেন।
প্রথম যুগের লেখকগণ
ষোড়শ শতাব্দী হইতে মুসলমান লেখকদের বাংলা রচনার সাক্ষাৎ পাই। এই শতাব্দীতে সাবিরিদ খান নামে একজন মুসলমান কবি দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর অনুকরণে একখানি ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন।
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকের একজন বিশিষ্ট বাঙালী মুসলমান কবি চট্টগ্রামের পরাগলপুর-নিবাসী কবি সৈয়দ সুলতান। ইনি জ্ঞানপ্রদীপ’, নবীবংশ এবং শবে মেরাজ’ নামে তিনখানি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন; প্রথম গ্রন্থটিতে যোগসাধনার তত্ত্ব, দ্বিতীয়টিতে বারজন নবীর জীবনকাহিনী এবং তৃতীয়টিতে হজরত মুহম্মদের জীবনকাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। নবীবংশ বইখানি আয়তনে খুব বিরাট। শবে মেরাজ’ প্রকৃতপক্ষে ‘নবীবংশেরই সূচনাংশ।
জৈনুদ্দীন নামে আর একজন কবি ‘রসুলবিজয়’ নাম দিয়া হজরত মুহম্মদের জীবনকাহিনী বর্ণনা করিয়া একটি কাব্য লিখিয়াছিলেন। ইনি সম্ভবত সৈয়দ সুলতানের পরবর্তী। “ইছপ খান” অর্থাৎ য়ুসুফ খান নামে একজন ব্যক্তি জৈনুদ্দীনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
সৈয়দ সুলতানের শিষ্য মোহাম্মদ খান একজন শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। ইনি ১০৫৬ হিজরা বা ১৬৪৬ খ্রীষ্টাব্দে মকুল হোসেন নামে একখানি কাব্য লিখিয়াছিলেন। এই কাব্যটিতে কারবালার করুণ কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে। মোহাম্মদ খান সংস্কৃত ভাষা যে খুব ভাল জানিতেন এবং হিন্দু পুরাণসমূহ যে তাঁহার ভাল করিয়া পড়া ছিল, তাঁহার পরিচয় তাঁহার এই কাব্য হইতে পাওয়া যায়। তাঁহার রচনা-রীতি অত্যন্ত পরিশুদ্ধ। মোহাম্মদ খান ১৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দে ‘সত্য-কলি-বিবাদ-সংবাদ’ বা যুগ-সংবাদ’ নামে আর একটি কাব্য লিখিয়াছিলেন; ইহাতে সত্যযুগ ও কলিযুগের কাল্পনিক বিবাদের বর্ণনা দেওয়া হইয়াছে। মঙুল হোসেন কাব্যে মোহাম্মদ খান নিজের মাতৃকুল ও পিতৃকুলের যে পরিচয় দিয়াছেন, তাহা হইতে দেখা যায় যে, উভয় কুলেই অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন; তাঁহার পিতৃকুলের লোকেরা বহু পুরুষ ধরিয়া চট্টগ্রামের শাসনকর্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
দৌলৎ কাজী ও আলাওল
সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান কবিদ্বয়-দৌলৎ কাজী ও আলাওল আবির্ভূত হন। ইহারা আরাকানের রাজধানী রোসাঙ্গ নগরে বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন এবং আরাকানরাজের অমাত্যদের কাছে পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়া কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। দৌলৎ কাজী আরাকানরাজ শ্রীসুধর্ম্মার (রাজত্বকাল ১৬২২-৩৮ খ্রী) সেনাপতি লস্কর-উজীর আশরফ খানের পৃষ্ঠপোষণ লাভ
করিয়াছিলেন এবং তাঁহার আদেশে ‘সতী ময়নামতী’ নামে একখানি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। কাব্যটি সাধন নামে একজন উত্তর-ভারতীয় কবির লেখা ‘মৈনা সৎ নামে একটি ছোট হিন্দী কাব্যের আধারে রচিত। এই কাব্যের নায়িকা সতী ময়নামতী স্বামী লোর কর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া যে বিরহ-যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিলেন, তাঁহার বর্ণনায় দৌলৎ কাজী অপরূপ দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। সংহত স্বল্পপরিমিত ভাবঘন উক্তিসমূহের মধ্য দিয়া কাব্যরস সৃষ্টি করা দৌলৎ কাজীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই কাব্যে ময়নামতীর বারমাস্যা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও কাব্যরসপূর্ণ রচনা। তবে দৌলৎ কাজীর আকস্মিক মৃত্যু হওয়ার ফলে ‘সতী ময়নামতী’ কাব্য অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। দীর্ঘকাল পরে আলাওল এই কাব্যকে সম্পূর্ণ করেন।
আলাওল তাঁহার বিভিন্ন কাব্যে নিজের জীবনকাহিনী বিস্তৃতভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তিনি ১৬০০ খ্রী কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা ফতেহাবাদের (আধুনিক ফরিদপুর অঞ্চল) স্বাধীন ভূস্বামী মজলিস কুতুবের অমাত্য ছিলেন। একদিন জলপথ দিয়া যাইবার সময় আলাওল ও তাঁহার পিতা পর্তুগীজ জলদস্যগণ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হন। আলাওলের পিতা পর্তুগীজদের সহিত যুদ্ধ করিয়া প্রাণ দেন। আলাওল কোনক্রমে অব্যাহতি লাভ করিয়া আরাকানের কুলে আসিয়া উঠেন। ইহার পর আলাওল আরাকান রাজ্যের অশ্বারোহী-বাহিনীতে নিযুক্ত হইলেন। আলাওলের উচ্চ কুল, পাণ্ডিত্য ও সঙ্গীতনৈপুণ্যের জন্য তাঁহার খ্যাতি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। রাজ্যের প্রধান কর্ত্তা মুখ্য অমাত্য মাগন ঠাকুর আলাওলকে নিজের গুরুপদে অভিষিক্ত করিয়া তাঁহার পৃষ্ঠপোষণ করিতে লাগিলেন। মাগনের অনুরোধে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ নামে একটি কাব্য লিখিলেন; কাব্যটি জায়সী নামক উত্তর-ভারতীয় সূফী মুসলমান কবির লেখা ‘পদমাবৎ’ নামক কাব্যের (রচনাকাল ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ) স্বাধীন অনুবাদ। ‘পদ্মাবতী’ আরাকানরাজ থদো-মিনতারের রাজত্বকালে (১৬৪৫-৫২ খ্রীষ্টাব্দ) রচিত হয়। ‘পদ্মাবতী’র মধ্যে রোমান্টিক উপাদান এবং অধ্যাত্ম-অনুভূতির আশ্চর্য সমন্বয় সাধিত হওয়ায় কাব্যটি অভিনবত্ব ও উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে। হিন্দু পুরাণ এবং সংস্কৃত সাহিত্য সম্বন্ধে আলাওলের প্রগাঢ় জ্ঞানের নিদর্শনও এই কাব্যে পাই। বৈষ্ণব পদাবলীর প্রভাবও এই কাব্যে দেখা যায়। মোটের উপর ‘পদ্মাবতী’ কাব্য হিসাবে সম্পূর্ণ সার্থক এবং এইটিই আলাওলের শ্রেষ্ঠ রচনা।
‘পদ্মাবতী’র পরে আলাওল মাগন ঠাকুরের অনুরোধে ‘সৈফুলমুলুদি উজ্জামাল’ নামে একটি কাব্য লিখিতে আরম্ভ করেন। এটি ঐ নামের একটি ফার্সী কাব্যের বঙ্গানুবাদ। মাগন ঠাকুরের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে এই কাব্যের রচনায় ছেদ পড়ে। কয়েক বৎসর পরে সৈয়দ মুসা নামে একজন সদাশয় ব্যক্তির আজ্ঞায় আলাওল কাব্যটি শেষ করেন। আলাওল আরাকানরাজের মহাপাত্র সোলেমানেরও পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিয়াছিলেন। সোলেমানের অনুরোধে আলাওল ১৬৫৯ খ্রীষ্টাব্দে দৌলৎ কাজীর অসম্পূর্ণ কাব্য ‘সতী ময়নামতী’ সম্পূর্ণ করিয়া দিয়াছিলেন। কবি হিসাবে দৌলৎ কাজী আলাওলের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ছিলেন; তাঁহার উপর ফরমায়েসী রচনার মধ্যে আলাওলের নিজস্ব কবিত্বশক্তিও তেমন স্ফুর্তি পায় নাই; সেইজন্য এই কাব্যের আলাওল-রচিত অংশ দৌলৎ কাজীর রচনার তুলনায় নিকৃষ্ট হইয়াছে। সোলেমানের অনুরোধে আলাওল য়ুসুফ গদার আরবী গ্রন্থ ‘তোহফা’র বঙ্গানুবাদ করেন; এই বইটি ইসলাম ধর্ম্মের অনুষ্ঠান ও কৃত্য বিষয়ক নিবন্ধ। আলাওলের ‘তোহফা’র রচনা ১৬৬৩-৬৪ খ্রীষ্টাব্দে আরম্ভ ও ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দে শেষ হয়।
কিন্তু ঘটনাচক্রে আলাওল এক বিপদে পড়েন; শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র শুজা ঔরঙ্গজেবের নিকট পরাজিত হইয়া আরাকানরাজের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ১৬৬১ খ্রীষ্টাব্দে তিনি আরাকানরাজ শ্রীচন্দ্ৰসুধর্ম্মার সহিত বিবাদ করিতে গিয়া আরাকানরাজের আজ্ঞায় সপরিজনে নিহত হন। শুজার সহিত আলাওলের মেলামেশা ছিল। তাই আলাওলের জনৈক শত্রু আলাওলের নামে রাজার মন বিষাক্ত করিয়া দিয়া আলাওলকে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করাইল। পঞ্চাশ দিন পরে রাজা আলাওলের নির্দোষিতার প্রমাণ পাইয়া তাহাকে মুক্তি দিলেন এবং তাঁহার শত্রুর প্রাণদণ্ড বিধান করিলেন। কিন্তু মুক্তি পাইয়া আলাওল অপরিসীম দারিদ্র্য ও দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হইলেন। এগারো বৎসর এইভাবে কাটিবার পর আলাওল মজলিস নবরাজ নামে একজন রাজ অমাত্যের পৃষ্ঠপোষণ লাভ করিলেন। ইহার আদেশে আলাওল ‘সেকেন্দারনামা’ নামে একটি কাব্য রচনা করিলেন; এটি নিজামীর লেখা ফার্সী কাব্য ‘সেকেন্দারনামা’র বঙ্গানুবাদ। আলাওল আরাকানরাজের সেনাপতি সৈয়দ মোহাম্মদের পৃষ্ঠপোষণও লাভ করিয়াছিলেন এবং তাঁহার অনুরোধে ‘সপ্তপয়কর’ নামে একটি কাব্য লেখেন; বইটি নিজামীর ‘হপ্তপয়কর’ নামক সপ্ত-কাহিনী বর্ণনামূলক ফার্সী কাব্যের অনুবাদ।
আলাওল রাগনামা’ নামক একটি সঙ্গীতশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থও লিখিয়াছিলেন। কিছু রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক পদও তিনি রচনা করিয়াছিলেন।
‘পদ্মাবতী’ ভিন্ন অন্য কোন রচনায় আলাওল উল্লেখযোগ্য দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন নাই।
অন্যান্য মুসলমান কবিরা নানা ধারা অবলম্বনে কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। এখানে কয়েকটি প্রধান ধারা এবং ঐ সব ধারার প্রধান প্রধান কবিদের নাম উল্লিখিত হইল।
হিন্দী রোমান্টিক কাব্যের অনুবাদ বা অনুসরণ
অন্তত দুইটি হিন্দী রোমান্টিক কাব্য একাধিক কবি কর্ত্তৃক বাংলায় অনূদিত বা অনুসৃত হইয়াছিল। প্রথম—কুৎত্তনের ‘মৃগাবতী’ (রচনাকাল ৯০৯ হিজরা বা ১৫০৩ খ্রীষ্টাব্দ); এই কাব্য অবলম্বনে কয়েকজন মুসলমান কবি বাংলা কাব্য রচনা করিয়াছিলেন; তাঁহাদের মধ্যে মুহম্মদ খাতের ও করিমুল্লার নাম উল্লেখযোগ্য। তারপর, মনোহর ও মধুমালতীর প্রণয়কাহিনী অবলম্বনে হিন্দীতে কয়েকটি কাব্য রচিত হইয়াছিল। এই সব কাব্য অবলম্বনে বাংলা কাব্য রচনা করিয়াছিলেন মুহম্মদ কবীর, সৈয়দ হামজা ও সাকের মামুদ।
ফার্সী রোমান্টিক কাব্যের অনুবাদ বা অনুসরণ
ফার্সী ভাষায় রচিত রোমান্টিক কাব্যগুলির এক বৃহদংশই ‘লায়লি-মজনু’ এবং ‘ইউসুফ-জোলেখা’র প্রেমোপাখ্যান অবলম্বনে রচিত হইয়াছিল। কয়েকজন মুসলমান কবি এইসব কাব্যের অনুবাদ বা অনুসরণ করিয়া বাংলা কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। বাংলা ‘লায়লি-মজনু’-রচয়িতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ চট্টগ্রাম-নিবাসী কবি বাহরাম খান। ইনি “নিজাম-শাহ” উপাধিধারী “ধবল অরুণ গজেশ্বর” অর্থাৎ আরাকান ও চট্টগ্রামের অধিপতির “দৌলত-উজীর” ছিলেন এবং ঔরঙ্গদেবের রাজত্বকালে (১৬৫৮-১৭৮৭ খ্রীষ্টাব্দ) কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। বাংলা ইউসুফ জোলেখা’র রচয়িতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাহ মোহাম্মদ সগীর (বা “সগিরি”)। ইঁহার কাব্যের ভাষা হইছে এবং কাব্যের উপর জামীর (১৪১৪-৯২ খ্রীষ্টাব্দে) ফার্সী। ইউসুফ-জোলেখা’র প্রভাব হইতে মনে হয়, ইনি ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধের লোক। কেহ কেহ শাহ মোহাম্মদ সগীরকে বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহের (রাজত্বকাল ১৩৯০-১৪১০ খ্রীষ্টাব্দ) সমসাময়িক মনে করেন, কিন্তু এই মত কোনমতেই সমর্থন করা যায় না।
নবীবংশ, রসুলবিজয় ও জঙ্গনামা
‘নবীবংশ’ পয়গম্বরদের কাহিনী, ‘রসুলবিজয়’ হজরত মুহম্মদের কাহিনী ও ‘জঙ্গনামা’ যুদ্ধের (বিশেষত ইসলাম-ধর্ম-প্রচারকদের ধর্মযুদ্ধের) কাহিনী অবলম্বনে লেখা কাব্য। এই শ্রেণীর কাব্যগুলি হরিবংশ ও মহাভারতের অনুসরণে রচিত। যাহারা এই জাতীয় কাব্য রচনা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে কয়েকজনের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। অন্যান্য রচয়িতাদের মধ্যে হায়াৎ মামুদ, শাহা বদিউদ্দীন, শেখ চাঁদ, নসরুল্লা খান ও মনসুরের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। ইহাদের মধ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি হায়াৎ মামুদই শ্রেষ্ঠ। ইনি ‘মহরমপর্ব’ নামে যে বইটি লিখিয়াছিলেন, তাঁহার মধ্যে কারবালা-কাহিনীর সঙ্গে মহাভারতের মিল দেখানোর চেষ্টা করা হইয়াছে। ইহা ভিন্ন হায়াৎ মামুদ ‘চিত্ত-উত্থান’, ‘হিতজ্ঞান-বাণী’ ও ‘আম্বিয়া-বাণী’ নামে তিনটি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন; তন্মধ্যে চিত্ত-উত্থান’ কাব্য হিতোপদেশের ফার্সী অনুবাদ অবলম্বনে রচিত।
পীর ও গাজীর মাহাত্মবর্ণনামূলক কাহিনী
‘পীর’ অর্থাৎ অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ধর্মগুরু এবং ‘গাজী’ অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধের যোদ্ধাদের লইয়া বঙ্গীয় মুসলমান কবিরা অনেক কাব্য লিখিয়াছিলেন। এই শ্রেণীর কাব্যের মধ্যে “গরীব ফকীর”-এর ‘মাণিকপীরের গীত’ এবং ফয়জুল্লার ‘গাজীবিজয়’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পীর-মাহাত্মমূলক কাব্যগুলির মধ্যে সত্যপীরের পাঁচালী’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তবে ইহার মধ্যে একটু বৈশিষ্ট্য আছে বলিয়া পরবর্তী প্রসঙ্গে ইহার সম্বন্ধে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা হইবে।
পদাবলী
বাংলার মুসলমান কবিরা হিন্দু কবিদের অনুসরণে কৃষ্ণলীলা বিষয়ক অনেক পদ রচনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে বলা বাহুল্য, রাধাকৃষ্ণের প্রেম সম্বন্ধীয় পদই সংখ্যায় অধিক। রাধাকৃষ্ণের প্রেমের মাধুর্য ঘঁহাদের কবি-অনুভূতিকে দোলা দিয়াছিল বলিয়াই ইহারা এই সমস্ত পদ রচনা করিয়াছিলেন, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। অবশ্য দুই একজনের পদে ভাবের যে আন্তরিকতা দেখা যায়, তাহা হইতে মনে হয় ইঁহাদের অন্তরে প্রকৃত ভক্তিও ছিল। যে সমস্ত মুসলমান কবি পদাবলী রচনা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে সৈয়দ মূর্তজার নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। ইহার একটি পদে (‘শ্যাম বঁধু আমার পরাণ তুমি’) ভাবের যে গভীরতা দেখা যায়, তাহা চণ্ডীদাস ও জ্ঞানদাসের পদকে স্মরণ করায়। অন্যান্য মুসলমান পদকর্ত্তাদের মধ্যে নাসির মামুদ, শাহা আকবর, গরীবুল্লা, গরীব খা, আলী রাজা প্রভৃতির নাম। উল্লেখযোগ্য। চৈতন্যদেবের রূপ ও মাহাত্ম বর্ণনা করিয়াও কোন কোন বাঙালী মুসলমান কবি পদ রচনা করিয়াছিলেন।
গাথা
বাংলার মুসলমান কবিদের লেখা গাথা-কাব্য বেশ কয়েকখানি পাওয়া গিয়াছে। এই গাথা-কাব্যগুলির অধিকাংশই প্রণয়বিষয়ক। ইহাদের মধ্যে সরূফের ‘দামিনী চরিত্র’, কোরেশী মাগনের ‘চন্দ্রাবতী’ এবং খলিলের ‘চন্দ্রমুখী-পুথি’র উল্লেখ করা যাইতে পারে। এইসব গাথা-কাব্যের কাহিনী এ দেশে লোকমুখে প্রচলিত ছিল বলিয়া মনে হয়।
সাধনতত্ত্বসম্বন্ধীয় নিবন্ধ
কোন কোন বঙ্গীয় মুসলমান কবি সাধনতত্ত্ব বিষয়ক নিবন্ধও রচনা করিয়াছিলেন। এই জাতীয় গ্রন্থের মধ্যে কয়েকটি বাউল-দরবেশী সাধনতত্ত্ব সম্বন্ধীয় গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য; যেমন, আলী রাজা বিরচিত ‘জ্ঞানসাগর’ ও ‘সিরাজকুলুপ’।
১৩
সত্যনারায়ণ ও সত্যপীরের পাঁচালী
বহু শতাব্দী ধরিয়া বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় পাশাপাশি বাস করিয়া আসিলেও ধর্ম ও সংস্কৃতির দিক দিয়া উভয় সম্প্রদায়ের মিলন-সেতু রচনার প্রচেষ্টা খুব বেশি হয় নাই। সত্যনারায়ণ বা সত্যপীরের উপাসনা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত হওয়া এ দিক দিয়া একটি উজ্জ্বল ও বলিষ্ঠ ব্যতিক্রম। ‘সত্যপীর’ ও ‘সত্যনারায়ণ’ আসলে একই উপাস্যের দুইটি রূপ। এই দুইটি রূপের মধ্যে কোটি প্রাচীনতর, তাহা বলা দুরূহ। সত্যনারায়ণ প্রাচীনতর হইলে বলিতে হইবে হিন্দু দেবতা পরবর্তী কালে মুসলমানী প্রভাবে ‘পীর’-এ পরিণত হইয়াছেন, সত্যপীর’ প্রাচীনতর হইলে বলিতে হইবে ‘পীর’ হিন্দুপ্রভাবে দেবতা বনিয়াছেন (এ সম্বন্ধে ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদের ষষ্ঠ ভাগে বিশদভাবে আলোচনা করা হইয়াছে)। যাহা হউক, ‘সত্যনারায়ণ’-এর পূজা কেবলমাত্র হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত, সত্যপীর’-এর উপাসনা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত। সত্যপীরের উপাসনার সময়ে মুসলমানী রীতি অনুযায়ী সিনি’ নিবেদন করা হইয়া থাকে। ‘সত্যনারায়ণ’-এর হিন্দুমতে পূজার সময়েও ‘সিনি’ নিবেদন করা হয়।
‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ ব্রতকথা এবং পূজার সময়ে ইহা পঠিত হয়। ইহার কাহিনী দুইটি–প্রথমটি ধর্মমঙ্গলের ধর্মঠাকুরের আবির্ভাবের কাহিনীর মত, দ্বিতীয়টি চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতির কাহিনীর মত। ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’-রচয়িতাদের মধ্যে ঘনরাম চক্রবর্তী, রামেশ্বর, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, কবিবল্লভ, জয়নারায়ণ সেন, দৈবকীনন্দন, গঙ্গারাম প্রভৃতি কবির নাম উল্লেখযোগ্য। আরও বহু কবি এই পাঁচালী লিখিয়াছিলেন।
‘সত্যপীরের পাঁচালী’ও অনেকগুলি রচিত হইয়াছিল। বিভিন্ন পাঁচালীতে বিভিন্ন ধরনের কাহিনী দেখা যায়। কোন কাহিনীতে দেখা যায় যে, সত্যপীর “আলা বাদশা” নামক জনৈক নৃপতির কন্যার কানীন-পুত্ররূপে অবতীর্ণ, কোন কাহিনীতে দেখি তিনি নারীরূপে “হোসেন শাহা বাদশা”র কামনা নিবৃত্ত করিতেছেন, আবার কোন কাহিনীতে অন্য কিছু। সবগুলি কাহিনীতেই দেখা যায় সত্যপীর তাঁহার কৃপাভাজন ব্যক্তিদের দিয়া পৃথিবীতে তাঁহার উপাসনা প্রবর্তন করাইতেছেন। ‘সত্যপীরের পাঁচালী’-রচয়িতাদের মধ্যে কৃষ্ণহরি দাস, শঙ্কর, কবি কর্ণ, নায়েক ময়াজ গাজী, আরিফ, ফয়জুল্লা প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
কোন কোন পণ্ডিত এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন যে বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দ) সত্যপীরের উপাসনা প্রবর্তন করিয়াছিলেন। এই মত সম্পূর্ণ কাল্পনিক। উপরের অনুচ্ছেদে উল্লিখিত “আলা বাদশা” ও “হোসেন শাহা বাদশা”র নাম একত্র মিলাইয়া এই পণ্ডিতেরা আলাউদ্দীন হোসেন শাহকে আবিষ্কার করিয়াছেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য, সত্যপীর’ ভিন্ন আরও কয়েকটি উপাস্যের উপাসনা হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায়। হিন্দুরা বনদুর্গা, ওলাই চণ্ডী, কালু রায় (কুমীরের দেবতা), সিদ্ধা মৎস্যন্দ্রনাথের পূজা করে; এই সব দেবতাই মুসলমানদের কাছে যথাক্রমে বনবিবি, ওলাবিবি, কালু শাহ এবং মোছরা পীর রূপে উপাসিত হইয়াছেন। এই সব উপাস্যের প্রশস্তি-বর্ণনামূলক পাঁচালীও উভয় সম্প্রদায়ের কবিরাই রচনা করিয়াছেন। তবে সেগুলির সাহিত্যিক মূল্য বেশি নয়।
১৪
নাথ-সাহিত্য
বাংলার নাথ সম্প্রদায়ের ধর্ম ও সাধনতত্ত্ব এবং ঐ সম্প্রদায়ের আদি গুরুদের কাহিনী অবলম্বনে বাংলা ভাষায় কয়েকটি গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। নাথ সম্প্রদায়ের সাধন-প্রণালী অত্যন্ত বিচিত্র। অন্য সমস্ত সম্প্রদায় সাধনা করেন মৃত্যুর পরে মুক্তি লাভের জন্য; আর নাথদের সাধনার লক্ষ্য নরদেহের অমরত্ব অর্জন করিয়া জীবদ্দশাতেই মুক্তিলাভ করা; এই সাধনার মূল অঙ্গ সংযম, ব্রহ্মচর্য এবং কায়া সাধন’ নামক যৌগিক প্রক্রিয়া; নাথদের মতে প্রতি মানুষের মস্তকে অমৃতক্ষরণকারী চন্দ্র এবং নাভিদেশে অমৃগ্রাসী সূর্য থাকে, কায়া-সাধন’ নামক যৌগিক প্রক্রিয়ার দ্বারা চন্দ্রের অমৃতকে ক্ষরিত হইতে না দিয়া সূর্যের গ্রাস হইতে রক্ষা করা যায় এবং তাহা করিলেই অমরত্ব লাভ করা যায়। নাথদের আদি গুরু বা আদি সিদ্ধা চারজন–মীননাথ, গোরক্ষনাথ, হাড়িপা ও কানুপা। গোরক্ষনাথ মীননাথের শিষ্য এবং কানুপা হাড়িপার শিষ্যা। ইঁহারা সকলেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি বলিয়া মনে হয়, তবে ইঁহাদের সম্বন্ধে যে কাহিনীগুলি প্রচলিত আছে, সেগুলির মধ্যে অলৌকিক উপাদান এত অধিক যে, তাহা হইতে সত্য নির্ধারণের কোন উপায় নাই।
বাংলার নাথ-সাহিত্যের কাহিনী মূলত দুইটি-–গোরক্ষনাথ-মীননাথের কাহিনী এবং হাড়িপা-কানুপা-ময়নামতী-গোপীচাঁদের কাহিনী। প্রথম কাহিনীতে দেবী গৌরীর ছলনায় গোরক্ষনাথ ব্যতীত আর তিনজন আদি সিদ্ধা অর্থাৎ মীননাথ, হাড়িপা ও কানুপার প্রবঞ্চিত ও শাপগ্রস্ত হওয়া, শাপগ্রস্ত মীননাথের কদলী দেশে নারীদের রাজ্যে রাজা হওয়া এবং গোরক্ষনাথের নর্তকী-বেশে মীননাথের সভায় গমন করিয়া তত্ত্বোপদেশ দ্বারা তাঁহার চৈতন্য-সম্পাদন বর্ণিত হইয়াছে। দ্বিতীয় কাহিনীতে শাপগ্রস্ত হাড়িপার হাড়ি (মেথর) হইয়া রানী ময়নামতীর রাজ্যে যাওয়া, তাঁহার পরিচয় পাইয়া রানী ময়নামতীর নিজ পুত্র গোবিন্দ্রচন্দ্রকে বা গোপীচাঁদকে তাঁহার নিকট দীক্ষা লওয়াইবার চেষ্টা, গোপীচাঁদের দীক্ষা লইতে অনিচ্ছা, তাহাকে ঘরে রাখিতে তাঁহার রানীদের প্রয়াস, গোপীচাঁদ কর্ত্তৃক হাড়িপাকে মাটির নিচে পুঁতিয়া রাখা, কানুপা কর্ত্তৃক হাড়িপার উদ্ধার সাধন এবং শেষ পর্যন্ত হাড়িপার কাছে গোপীচাঁদের দীক্ষাগ্রহণ বর্ণিত হইয়াছে। এই দুইটি কাহিনী অবলম্বনে যেসব লেখক গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন তাঁহাদের সকলেই নাথ সম্প্রদায়ের লোক নহেন, এমন কি সকলে হিন্দুও ননে। কেহ কেহ মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক। তবে ইহাদের রচনাগুলি নাথ সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিশেষভাবে পঠিত ও আদৃত হইত। প্রথম কাহিনী লইয়া যে কাব্যটি রচিত হইয়াছিল, তাঁহার নাম ‘গোরক্ষবিজয়। ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্যের বিভিন্ন পুঁথিতে ফয়জুল্লা, কবীন্দ্র দাস, শ্যামাদাস সেন, ভীমদাস, ভীমসেন রায় প্রভৃতির ভণিতা পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ পুঁথিতেই ফয়জুল্লার ভণিতা পাওয়া যায় বলিয়া এবং আরও কয়েকটি বিষয় হইতে মনে হয়, ফয়জুল্লাই ‘গোরক্ষবিজয়’ কাব্যের রচয়িতা। গোরক্ষবিজয়’ কাব্যের রচনাকাল ১৭০০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি বলিয়া মনে হয়। অবশ্য, এই কাব্যের কাহিনীটি সংক্ষিপ্ত আকারে কোন কোন প্রাচীনতর বাংলা রচনার মধ্যে পাওয়া যায়। মিথিলাতে বহু পূর্বে-পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে–বিদ্যাপতি এই কাহিনী অবলম্বনে ‘গোরক্ষবিজয়’ নাটক রচনা করিয়াছিলেন। গোরক্ষবিজয়’ কাব্যের মধ্যে নাথধর্ম্মের সাধনতত্ত্ব সম্বন্ধীয় কথা প্রাধান্য প্রাপ্ত হওয়ায় ইহার কাব্যরস কতকটা মন্দীভূত হইয়াছে। তবে এই কাব্যে গোরক্ষনাথ তাঁহার উন্নত চরিত্র, দৃপ্ত পুরুষকার, অটল অধ্যবসায় ও অবিচলিত গুরুভক্তির মধ্য দিয়া এবং মীননাথ ভোগলিপ্সা ও কৃচ্ছসাধন-বিমুখতার মধ্য দিয়া জীবন্ত চরিত্র হইয়া উঠিয়াছেন। কাব্যটির মধ্যে শিষ্য কর্ত্তৃক গুরুর উদ্ধার বর্ণিত হইয়াছে–বিষয়বস্তু হিসাবে ইহা খুবই অভিনব ও মধুর। এই কাব্যের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গীতে একটা প্রশংসনীয় সংযমের পরিচয় পাওয়া যায়। গোরক্ষবিজয়ে’ নারী জাতিকে খুব হেয় করিয়া দেখান হইয়াছে।
নাথ-সাহিত্যের দ্বিতীয় কাহিনীটি অর্থাৎ গোপীচাঁদ-ময়নামতীর কাহিনী লইয়া অনেক গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে নেপালে এই কাহিনী অবলম্বনে একটি নাটক রচিত হয়, তাঁহার সংলাপ নেওয়ারী ভাষায় রচিত হইলেও গানগুলি বাংলায় রচিত; রচনা হিসাবে ইহার অভিনবত্ব থাকিলেও ইহার সাহিত্যিক মূল্য খুব বেশি নয়। এই কাহিনী অবলম্বনে রচিত তিনটি বাংলা কাব্য পাওয়া গিয়াছে–ইহাদের রচয়িতাদের নাম দুর্লভ মল্লিক, ভবানী দাস ও সুকুর মুহম্মদ। দুর্লভ মল্লিকের কাব্য অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের রচনা, ভবানী দাস ও সুকুরের কাব্যও অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত বলিয়া মনে হয়। তিনটি কাব্যের মধ্যে দুর্লভ মল্লিকের রচনাটিই শ্রেষ্ঠ; ভবানী দাসের রচনা কতকটা বৈষ্ণবপদাবলী-প্রভাবিত ও মধ্যে মধ্যে কৌতুকরসোদ্দীপক; সুকুরের রচনা স্থানে স্থানে বেশ সুখপাঠ্য, তবে ইহাতে ময়নামতী, হাড়িপা, গোরক্ষনাথ প্রভৃতি চরিত্রগুলিকে কতকটা হেয় করিয়া দেখানো হইয়াছে। ইহা ভিন্ন গোপীচাঁদ-ময়নামতীর কাহিনী লইয়া একটি ছড়াও রচিত হইয়াছিল, সেটি রংপুর অঞ্চলে লোকের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল; এই ছড়াটির সংক্ষিপ্ত ও বিস্তৃত উভয় রূপই পাওয়া গিয়াছে; ছড়াটি বাংলার লোক সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট নিদর্শন; এটির পরিণতি মিলনান্ত। গোপীচাঁদ-ময়নামতীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত সমস্ত রচনাতেই মানবিক রসের আধিক্য দেখিতে পাওয়া যায় এবং গোপীচাঁদের সন্ন্যাসে তাঁহার রানীদের বিরহ-বেদনা সব রচনাতেই মর্মস্পর্শিরূপে বর্ণিত হইয়াছে। গোপীচাঁদ-ময়নামতীর কাহিনীর উদ্ভব সম্ভবত বাংলা দেশেই, কারণ সর্বত্রই গোপীচাঁদকে বঙ্গের রাজা বলা হইয়াছে। কিন্তু এই কাহিনী বঙ্গের বাহিরেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে-বিহার, উড়িষ্যা, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, এমন কি সুদূর মহারাষ্ট্রেও প্রচলিত ছিল ও আছে, এইসব রাজ্যের মধ্যে কোন কোনটিতে বাংলা দেশের রচনাগুলির তুলনায় প্রাচীনতর গোপীচাঁদ-বিষয়ক রচনা পাওয়া গিয়াছে, এখনও এইসব স্থানে কোথাও কোথাও যোগী সন্ন্যাসীরা গোপীচাঁদের গাথা-গান গাহিয়া ভিক্ষা করে; কিন্তু বাংলা দেশে আধুনিককালে এক উত্তরবঙ্গ ভিন্ন আর কোথাও জনসমাজে এই কাহিনীর প্রচলন নাই। গোপীচাঁদ ময়নামতীর কাহিনীর মত বাংলার আর কোন কাহিনীই বাংলার বাহিরে এতখানি ব্যাপ্তি লাভ করিতে পারে নাই।
১৫
মঙ্গলকাব্য
‘মঙ্গলকাব্য’ প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট শাখা। মঙ্গলকাব্য নামটি আধুনিক। কাব্যগুলির নামের শেষে ‘মঙ্গল’ শব্দ থাকিত বলিয়া বর্তমানকালের গবেষকরা ইহাদের এই নাম দিয়াছেন। ‘মঙ্গলকাব্য’ বলিতে দেবদেবীর মাহাত্মবর্ণনামূলক আখ্যানকাব্য বুঝায়। বাংলা দেশে অসংখ্য লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীর পূজা প্রচলিত ছিল। মুসলমান আমলে হিন্দুদের মধ্যে এইসব দেবদেবীর জনপ্রিয়তা সবিশেষ বৃদ্ধি পাইয়াছিল। বিধর্মী রাজশক্তি হিন্দুদের উপর অনেক সময় উৎপীড়ন করিত; ইহা ভিন্ন সর্প, ব্যাঘ্র, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী প্রভৃতি বিপদও সে যুগে খুব বেশি মাত্রায় ছিল। এই সমস্ত সঙ্কট হইতে পরিত্রাণ পাইবার অন্য কোন উপায় না দেখিয়া বাঙালী হিন্দুরা দেবদেবীদের শরণাপন্ন হইত। এইভাবে যেমন ঐসব দেবদেবীর জনপ্রিয়তা বাড়িতে থাকে, তেমনি কবিরা তাঁহাদের মাহাত্ম বর্ণনা করিয়া মঙ্গলকাব্যও রচনা করিতে থাকেন।
মঙ্গলকাব্যের ধারায় তিন শ্রেণীর মঙ্গলকাব্যকে প্রধান বলা যাইতে পারে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল। ইহা ব্যতীত শিবমঙ্গল বা শিবায়ন, কালিকা মঙ্গল, ‘রায়মঙ্গল, শীতলামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, লক্ষ্মীমঙ্গল, সারদামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল প্রভৃতি অন্যান্য বহু মঙ্গলকাব্য বিভিন্ন কবি কর্ত্তৃক রচিত হইয়াছিল।
মঙ্গলকাব্যগুলি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছিল। সর্বসাধারণের মধ্যে এগুলি সমাদর লাভ করিয়াছিল। ইহাদের মধ্যে সে-যুগের বাঙালী সমাজের আলেখ্য লাভ করা যায় এবং বাঙালীর জাতীয় চরিত্রের প্রতিফলন দেখিতে পাওয়া যায়। এই জন্য মঙ্গলকাব্যগুলিকে বাঙালীর জাতীয় কাব্য বলা যাইতে পারে।
প্রতি মঙ্গলকাব্যের মধ্যে কতকগুলি বিশেষ বিশেষ বিষয়ের অবতারণা দেখা যায়। যেমন, কাব্যের সূচনায় বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা, শাপভ্রষ্ট দেবদেবীর কাব্যের নায়ক-নায়িকারূপে জন্মগ্রহণ করা, নারীদের পতিনিন্দা, অন্তঃসত্ত্বা রমণীদের গর্ভের বর্ণনা, খাদ্যের বর্ণনা, বিবাহের বর্ণনা, চিত্রলিখিত কাঁচুলীর বর্ণনা, ‘বারমাস্যা’ অর্থাৎ বার মাসের সুখ বা দুঃখের বর্ণনা। মঙ্গলকাব্যগুলির গান এক মঙ্গলবার রাত্রিতে সুরু হইয়া পরের মঙ্গলবার রাত্রিতে শেষ হইত।
মনসামঙ্গল
সমস্ত মঙ্গলকাব্যের মধ্যে মনসামঙ্গলের ধারাতেই এ পর্যন্ত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন রচনার নিদর্শন মিলিয়াছে। মনসামঙ্গল কাব্যে সর্পের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার মাহাত্ম বর্ণিত হইয়াছে। মনসার পূজা করিলে সর্পের কবল হইতে রক্ষা পাওয়া যায় বলিয়া লোকের বিশ্বাস। এই মনসা দেবীর ঐতিহ্য খুব প্রাচীন। কোন কোন পণ্ডিতের মতে ঋগ্বেদে মনসার প্রচ্ছন্ন উল্লেখ আছে। লৌকিক ঐতিহ্যমতে মনসা শিবের কন্যা, চণ্ডী ইহার বিমাতা, ঈর্ষার বশে চণ্ডী ইঁহার এক চক্ষু নষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন; এইজন্য ইহাকে অভক্তেরা “কাণী” বলিয়া অভিহিত করিত। ইহা ভিন্ন লৌকিক ঐতিহ্যে মনসা আস্তিক-জননী জরৎকারুর সহিত অভিন্না।
মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনী সংক্ষেপে এই : মনসা বণিক চন্দ্রধর বা চাঁদ সদাগরকে দিয়া তাঁহার পূজা করাইবার জন্য অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু চাঁদ সদাগর শিবের ভক্ত বলিয়া তাহাতে রাজী হন নাই; ইহাতে ক্রুদ্ধ হইয়া মনসা চাঁদ সদাগরের ছয় পুত্রের জীবন নাশ করেন। চাঁদের হতাবশিষ্ট একমাত্র পুত্র লখিন্দরের বিবাহের রাত্রে মনসার প্রেরিতা সর্পিণী কালনাগিনী লখিন্দরকে দংশন করিয়া সংহার করে। লখিন্দরের সদ্যোপরিণীতা স্ত্রী বেহুলা স্বামীর শব লইয়া একটি ভেলায় চড়িয়া ভাসিয়া যায় এবং স্বর্গে পৌঁছিয়া নৃত্যগীত প্রভৃতির দ্বারা দেবতাদের সন্তুষ্ট করিয়া–শেষ পর্যন্ত মনসারও ক্রোধ শান্ত করিয়া স্বামীর ও মৃত ভাশুরদের প্রাণ ফিরাইয়া আনে। অতঃপর দেশে ফিরিয়া বেহুলা চাঁদ সদাগরকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়া তাহাকে দিয়া মনসার পূজা করায়।
মনসামঙ্গল কাব্যের প্রথম রচয়িতা কানা হরি দত্ত। ইহার কাব্য অনেকদিন বিলুপ্ত হইয়াছে, তবে সেই কাব্যের দুই একটি পদ পরবর্তী কোন কোন কবির কাব্যের মধ্যে দেখা যায়।
যাহাদের লেখা ‘মনসামঙ্গল’ পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের মধ্যে প্রাচীনতম কবি বৈদ্যজাতীয় বিজয় গুপ্ত। ইঁহার নিবাস ছিল বর্তমান বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত ফুল্লশ্রী গ্রামে। “ঋতু শূন্য বেদ শশী” অর্থাৎ ১৪০৬ শকে (১৪৮৪-৮৫ খ্রীষ্টাব্দে) “হোসেন শাহ” অর্থাৎ জলালুদ্দীন ফতেহ্ শাহের (ইহার দ্বিতীয় নাম ছিল ‘হোসেন শাহ’) রাজত্বকালে বিজয় গুপ্ত মনসামঙ্গল রচনা করেন–এই কথা তাঁহার মনসামঙ্গলের উপক্রম হইতে জানা যায়। বিজয় গুপ্ত লিখিয়াছেন যে দেবী মনসার কাছে হরি দত্তের ‘মনসামঙ্গল’ প্রীতিকর না হওয়াতে এবং ঐ মনসামঙ্গল লুপ্তপ্রায় হওয়াতে তিনি বিজয় গুপ্তকে স্বপ্নে দেখা দিয়া মনসামঙ্গল’ রচনা করিতে বলিয়াছিলেন। বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল’ শক্তিশালী হাতের রচনা। চাঁদ সদাগরের পত্নী সনকার মমতা-করুণ মাতৃমূর্ত্তিটি ইহাতে খুব উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়াছে। বিজয় গুপ্তের রচনা খুব বেশী জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছিল। এই কারণে তাহাতে অনেক প্রক্ষিপ্ত উপাদান প্রবেশ করিয়াছে এবং তাঁহার ভাষাও আধুনিকতাপ্রাপ্ত হইয়াছে।
বিজয় গুপ্তের পরে বর্তমান ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্গত বাদুড়িয়া গ্রাম নিবাসী ব্রাহ্মণ কবি বিপ্রদাস পিপিলাই মনসামঙ্গল রচনা করেন–“সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক” অর্থাৎ ১৪১৭ শকাব্দে (১৪৯৫-৯৬ খ্রীষ্টাব্দ)। বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে কাহিনী খুব বিস্তৃত আকারে মিলিতেছে। এই গ্রন্থে মনসার পূজাপদ্ধতির খুব বিশদ বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলে অনেকগুলি আধুনিক স্থানের উল্লেখ থাকার জন্য কেহ কেহ সন্দেহ করেন যে এই কাব্যের সবটাই প্রাচীন বা অকৃত্রিম নয়।
‘মনসামঙ্গলে’র আর একজন প্রাচীন কবি কায়স্থজাতীয় নারায়ণদেব। ইঁহার নিবাস ছিল বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত বোরগ্রামে। নারায়ণদেব “সুকবি” বা “সুকবিবল্লভ” উপাধি লাভ করিয়াছিলেন। ইঁহার কাব্যের ভাষা বেশ প্রাচীন; রচনাকাল সঠিকভাবে জানা যায় না; ভাষা দেখিয়া কাব্যটিকে ষোড়শ শতাব্দীর রচনা বলিয়া মনে হয়। নারায়ণদেবের ‘মনসামঙ্গলে’ চাঁদ সদাগরের চরিত্রটি অত্যন্ত জীবন্ত। চাঁদের দুর্জয় ব্যক্তিত্ব ও অদম্য পুরুষকার নারায়ণদেব অত্যন্ত চমৎকারভাবে রূপায়িত করিয়াছেন। নারায়ণদেবের চাঁদ সদাগর শেষপর্যন্ত মনসার নিকট নতি স্বীকার করেন নাই–বেহুলার ও ইষ্টদেবতা শিবের অনুরোধ ঠেলিতে না পারিয়া তিনি পিছন ফিরিয়া বাম হাতে মনসার উদ্দেশ্যে একটি ফুল ফেলিয়া দিয়াছেন মাত্র। নারায়ণদেবের ‘মনসামঙ্গল’ প্রতিবেশী রাজ্য আসামে খুব জনপ্রিয় হইয়াছিল, সেখানে তাঁহার ভাষা লোকমুখে পরিবর্তিত হইয়া অসমীয়া হইয়া গিয়াছে। আসামে নারায়ণদের “হুকনান্নি” (“সুকবি নারায়ণ”-এর অপভ্রংশ) নামে পরিচিত।
অপর একজন প্রাচীন ও জনপ্রিয় মনসামঙ্গল-রচয়িতা বংশীদাস। ইঁহার। নিবাস ছিল বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত পাটবাড়ী (বা পাতুয়ারী) গ্রামে। ইনি সম্ভবত সপ্তদশ শতকের লোক। বংশীদাসের ‘মনসামঙ্গল’ পূর্ববঙ্গে অত্যন্ত জনপ্রিয় হইয়াছিল। সেখানে নারীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই ‘মনসামঙ্গল’ গাওয়া হইত। পূর্ববঙ্গের বহু লোকে এই ‘মনসামঙ্গল’ আদ্যন্ত কণ্ঠস্থ করিয়া রাখিয়াছে। বংশীবদনের কন্যা চন্দ্রাবতীও কবি ছিলেন। তিনি একটি বাংলা রামায়ণ এবং কিছু কিছু ছড়া রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার ব্যর্থ প্রণয় সম্বন্ধে একটি কাহিনী ‘ময়মনসিংহ-গীতিকা’র মধ্যে পাওয়া যায়।
মনসামঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। ইহার আত্মকাহিনী হইতে জানা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গের সেলিমাবাদ পরগণার অন্তর্গত কথড়া গ্রামে ঘঁহার নিবাস ছিল। সেখানে স্থানীয় শাসনকর্ত্তার মৃত্যুর পরে অরাজকতা দেখা দিলে কবির পিতা তিন পুত্রকে লইয়া দেশত্যাগ করেন এবং রাজা বিষ্ণুদাসের ভাই ভরামলের কাছে আশ্রয় ও সম্পত্তি লাভ করেন। নূতন বাসভূমিতে একদিন বর্ষাকালে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ বস্ত্রবিক্রয়িণী মূচিনীর মূর্ত্তিধারিণী মনসার দেখা পাইলেন। মনসা কবিকে মনসামঙ্গল রচনা করিতে বলিয়া অন্তর্হিত হইলেন। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ মনসামঙ্গল রচনা করেন। ইহার প্রকৃত নাম ‘ক্ষেমানন্দ’, ‘কেতকাদাস’ (অর্থ মনসার দাস) উপাধি। ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল’ পশ্চিমবঙ্গে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করিয়াছিল। সে জনপ্রিয়তা এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গলে’র বেহুলা একটি অপূর্ব চরিত্র; কবিত্বপ্রতিভার দিক দিয়া বাল্মীকির সহিত ক্ষেমানন্দের তুলনা হয় না। কিন্তু ক্ষেমানন্দের বেহুলা বাল্মীকির সীতার মতই করুণ ও মর্মস্পর্শী।
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ ব্যতীত ক্ষেমানন্দ নামক আরও দুইজন পশ্চিমবঙ্গীয় কবি মনসামঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য মনসামঙ্গল রচয়িতাদের মধ্যে সীতারাম দাস, দ্বিজ রসিক, দ্বিজ বাণেশ্বর, কবিচন্দ্র কালিদাস ও বিষ্ণুপালের নাম উল্লেখযোগ্য। ইহাদের মধ্যে কেহ সপ্তদশ শতকের, কেহ অষ্টাদশ শতকের লোক।
উত্তরবঙ্গের অনেক কবিও মনসামঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে দুর্গাবর, বিভূতি, জগজ্জীবন ঘোষাল, জীবনকৃষ্ণ মৈত্র প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। দুর্গাবর ষোড়শ শতাব্দীর, অন্যেরা সপ্তদশ বা অষ্টাদশ শতাব্দীর লোক। ইহাদের মধ্যে জগজ্জীবন ঘোষালের কাব্যই শ্রেষ্ঠ–যদিও এই কাব্যে মাঝে মাঝে গ্রাম্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্য–মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
মনসার মত চণ্ডীর ঐতিহ্যও খুব প্রাচীন। তন্ত্রে ও পুরাণে চণ্ডীদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বাংলা দেশের চণ্ডীমঙ্গলে যে চণ্ডীদেবীর মাহাত্ম বর্ণিত হইয়াছে, তাঁহার পৌরাণিক স্বরূপটি সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ নাই, তাঁহার সহিত লৌকিক ঐতিহ্য মিলিয়া দেবীকে এক নূতন রূপ দিয়াছে।
চণ্ডীমঙ্গলগুলির মধ্যে দুইটি কাহিনী দেখিতে পাওয়া যায়। প্রথমটি ব্যাধদম্পতি কালকেতু ও ফুল্লরার কাহিনী; কালকেতু অপূর্ব শক্তিধর পুরুষ এবং তাঁহার স্ত্রী ফুল্লরা সাধ্বী নারী; ইহারা চণ্ডীর কৃপা লাভ করে এবং চণ্ডীর দেওয়া অর্থে বন কাটাইয়া এক নূতন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে; ইহার পর কলিঙ্গরাজের আক্রমণের ফলে তাহাদের সৌভাগ্য-সূর্য সাময়িকভাবে রাহুগ্রস্ত হয়, কিন্তু চণ্ডীর কৃপায় অচিরেই বিপদ কাটিয়া যায়। দ্বিতীয়টি এক বণিক-পরিবারের-ধনপতি-লহনা-খুল্লনা শ্রীমন্তের কাহিনী। প্রথমা স্ত্রী লহনা থাকাসত্ত্বেও বণিক ধনপতি খুল্লনাকে বিবাহ করিয়াছিল; এই খুল্লনা সপত্নীর হাতে নানারূপ নির্যাতন সহ্য করিয়া অবশেষে চণ্ডীর কৃপা লাভ করে; কিন্তু শিবভক্ত ধনপতি চণ্ডীর অমর্যাদা করিয়াছিল বলিয়া তাহাকে শাস্তি ভোগ করিতে হয়; সিংহলে যাইবার সময় সে পদ্মফুলের উপর দণ্ডায়মানা নারীর হস্তী গলাধঃকরণ করার এক অলৌকিক দৃশ্য দেখিতে পায়, কিন্তু সিংহলের রাজাকে তাহা দেখাইতে না পারায় তাহাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করিতে হয়; খুল্লনার পুত্র শ্ৰীমন্ত বড় হইয়া পিতার সন্ধানে সিংহলে যায়, সেও সেই একই দৃশ্য দেখে এবং সিংহলরাজকে তাহা দেখাইতে না পারায় তাঁহার প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়, অবশেষে চণ্ডীর কৃপায় সমস্ত বিপদ কাটিয়া যায়, ধনপতি মুক্ত হয়, শ্ৰীমন্ত সিংহলের রাজকন্যাকে বিবাহ করিয়া স্ত্রী ও পিতাকে লইয়া দেশে ফিরে।
মনসামঙ্গলের মত চণ্ডীমঙ্গলের রচনাও চৈতন্য-পূর্ববর্তী যুগেই আরম্ভ হইযাছিল, কারণ চৈতন্যভাগবতে’ ‘মঙ্গলচণ্ডীর গীত’ (যাহা চণ্ডীমঙ্গলের নামান্তর) এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু চৈতন্য-পূর্ববর্তীকালে রচিত কোন চণ্ডীমঙ্গলের এ পর্যন্ত নিদর্শন পাওয়া যায় নাই।
প্রথম চণ্ডীমঙ্গল রচনা করেন মাণিক দত্ত। ইহার রচিত কাব্য এ পর্যন্ত মিলে নাই, পরবর্তী কবিদের উক্তি হইতে তাঁহার অস্তিত্বের কথা মাত্র জানিতে পারা যায়। এক মাণিক দত্তের লেখা চণ্ডীমঙ্গল পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু ইনি দ্বিতীয় মাণিক দত্ত–পরবর্তীকালের লোক।
ষোড়শ শতাব্দীতে যাঁহারা চণ্ডীমঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন (বা অন্তত করিয়াছিলেন বলিয়া বলা হয়), তাঁহাদের মধ্যে দ্বিজ মুকুন্দ কবিচন্দ্র, বলরাম কবিকঙ্কণ এবং দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্যের নাম উল্লেখযোগ্য। দ্বিজ মুকুন্দের কাব্যের বিশিষ্ট নাম ‘বাশুলীমঙ্গল’, ইহা “শাকে রস রস বেদ” অর্থাৎ ১৪৬৬ শকাব্দে (১৫৪৪-৪৫ খ্রীষ্টাব্দে) রচিত হয় বলিয়া গ্রন্থমধ্যে উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু এই কাব্যের ভাষা অত্যন্ত আধুনিক। বলরাম কবিকঙ্কণের কাব্য যে ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত হইয়াছিল, তাঁহার কোন প্রমাণ নাই, তবে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলে কবির “গীতের গুরু শ্রীকবিকঙ্কণ”-এর উল্লেখ আছে, অনেকে মনে করেন বলরামই এই শ্রীকবিকঙ্কণ। বলরাম মেদিনীপুর অঞ্চলের লোক ছিলেন, তাঁহার কাব্য উড়িষ্যায় জনপ্রিয় হইয়াছিল ও উড়িয়া-রূপান্তর লাভ করিয়াছিল। দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্য “ইন্দু বিন্দু বাণ ধাতা শক” অর্থাৎ ১৫০১ শকাব্দে (১৫৭৯-৮০ খ্রীষ্টাব্দ) তাঁহার কাব্য রচনা করেন। কাব্যের সূচনায় কবি “পঞ্চগৌড়”-এর রাজা “একাব্বর” অর্থাৎ ভারতসম্রাট আকবরের নাম উল্লেখ করিয়াছেন। দ্বিজ মাধবের নিবাস ছিল সপ্তগ্রামে, ইঁহার পিতার নাম পরাশর। দ্বিজ মাধবের চণ্ডীমঙ্গলে অল্পস্বল্প গ্রাম্যতা থাকিলেও কাব্যটি সুলিখিত, ভাড় দত্তের চরিত্র অঙ্কনে কবি দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন। তাঁহার ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গী অত্যন্ত সরল ও অনাড়ম্বর। দ্বিজ মাধবের কাব্যে কালকেতু ও ফুল্লরার উপাখ্যানটি বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইয়াছে। অপর উপাখ্যানটির বর্ণনা অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত। আশ্চর্যের বিষয়, দ্বিজ মাধব পশ্চিমবঙ্গীয় কবি হইলেও চট্টগ্রাম ব্যতীত বাংলার অন্য কোন অঞ্চলে তাঁহার কাব্যের প্রচারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, সম্ভবত মুকুন্দরামের কাব্যের অত্যধিক জনপ্রিয়তার ফলে অন্য সব অঞ্চলে দ্বিজ মাধবের কাব্যের প্রচার লোপ পাইয়াছিল। দ্বিজ মাধব চণ্ডীমঙ্গল ব্যতীত ‘কৃষ্ণমঙ্গল ও গঙ্গামঙ্গল কাব্যও রচনা করিয়াছিলেন।
চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা এবং প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ষোড়শ শতকের শেষভাগে আবির্ভূত হন। তিনি যে সুন্দর আত্মকাহিনীটি লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা হইতে জানা যায় যে, তাঁহার নিবাস ছিল বর্তমান বর্ধমান জেলার অন্তর্গত দামুন্যা বা দামিন্যা গ্রামে। এখানকার ডিহিদার মামুদ (বা মুহম্মদ) সরিফ প্রজাদের উপর অত্যাচার করিতে থাকেন এবং মুকুন্দরামের প্রভু ভূস্বামী গোপীনাথ নন্দীকে বন্দী করেন; তখন মুকুন্দরাম হিতৈষীদের সহিত পরামর্শ করিয়া দেশত্যাগ করেন; অনেক দুঃখকষ্ট সহ্য করিয়া এবং ঠিকমত স্নানাহার করিতে না পাইয়া তাঁহাকে পথ চলিতে হয়; পথে এক জায়গায় চণ্ডী তাঁহাকে স্বপ্নে দেখা দিয়া চণ্ডীমঙ্গল রচনা করিতে বলেন; ইহার পর মুকুন্দরাম বর্তমান মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত আরড়া গ্রামে উপনীত হন; সেখানে ব্রাহ্মণভূমির রাজা বাঁকুড়া রায় বাস করিতেন; বাঁকুড়া রায় কবির সকল দুঃখ দূর করিয়া দিয়া নিজের পুত্রকে পড়াইবার কাজে কবিকে নিযুক্ত করেন; বাঁকুড়া রায়ের মৃত্যুর পরে-তাঁহার পুত্র রঘুনাথ রায়ের রাজত্বকালে মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গল রচনা করেন এবং রঘুনাথের কাছে তিনি পুরস্কার লাভ করেন। মুকুন্দরামের আত্মকাহিনী হইতে জানা যায় যে মানসিংহ যখন গৌড়, বঙ্গ ও উৎকলের শাসনকর্ত্তা (১৫৯৪ ১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দ), তখন মুকুন্দরাম জীবিত ছিলেন।
মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্য হিসাবে উচ্চাঙ্গের। ইহার মধ্যে যে মানবিক রস আছে, তাহা তুলনারহিত। এই কাব্যের মধ্যে মানুষের জীবন, মানুষের সুখদুঃখ, মানুষের হৃদয়ের কথা যেমন নিখুঁতভাবে রূপায়িত হইয়াছে, তেমনি ইহার চরিত্রগুলি পরিপূর্ণভাবে রক্তমাংসের মানুষ হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে।
মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের ভাষা সরল, বর্ণনা অনাড়ম্বর, কিন্তু তাঁহারই মধ্যে অপূর্ব কবিত্বশক্তির নিদর্শন পাওয়া যায়। এই কাব্যে নারীচরিত্র-বিশেষভাবে ফুল্লরা ও খুল্লনার চরিত্র অঙ্কনে মুকুন্দরাম নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়াছেন। কুটিল স্বার্থান্বেষী প্রতারকের চরিত্র সৃষ্টিতে মুকুন্দরাম এই কাব্যে অপরূপ দক্ষতা দেখাইয়াছেন। মুরারি শীল, ভাঁড় দত্ত ও দুর্বলা দাসী এই শ্রেণীর চরিত্র। ইহাদের মধ্যে ভাঁড় দত্তের চরিত্রটি অতুলনীয়। শঠতার এমন জীবন্ত প্রতিমূর্ত্তি প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয় একটিও মিলে না।
জীবন সম্বন্ধে মুকুন্দরামের যে ব্যাপক ও গভীর অভিজ্ঞতা ছিল, তাঁহারই। রূপায়ণ এই কাব্যে দেখা যায়। মুকুন্দরাম বিশেষভাবে দুঃখের অভিজ্ঞতাই লাভ করিয়াছিলেন, তাই এই কাব্যে দুঃখের চিত্রগুলিই জীবন্ত ও উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। কবির আত্মকাহিনী হইতে সুরু করিয়া কালকেতুর শরে জর্জর পশুদের খেদোক্তি, ফুল্লরার বারমাস্যা, খুল্লনার ক্লিষ্ট জীবনযাত্রা প্রভৃতি বর্ণনাগুলিতে সর্বত্রই দুঃখের তীব্র নগ্ন রূপ দেখিতে পাই। এই জন্য কেহ কেহ মুকুন্দরামকে ‘দুঃখবাদী কবি’ বলিয়া অভিহিত করেন। কিন্তু ইঁহাদের মত সমর্থন করা যায় না। কারণ মুকুন্দরাম দুঃখকেই জীবনের সার কথা বলেন নাই; দুঃখের পিছনে যে আশা আছে, সে কথাও তিনি শুনাইয়াছেন।
মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, কাব্যটি নাটকীয় রীতিতে রচিত। কবির নিজের উক্তি ইহাতে খুব কমই আছে, বেশীর ভাগই বিভিন্ন পাত্রপাত্রীর উক্তিপ্রত্যুক্তির মাধ্যমে রচিত। এই কাব্যের জাগরণ-পালার মধ্যে নাটকীয় সঙ্কট-মুহূর্ত অর্থাৎ ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টির প্রকৃষ্ট নিদর্শন দেখা যায়। এই কারণে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকে নাট্যধর্মী কাব্যও বলা যায়।
আর একটি কারণে মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল বিশেষভাবে মূল্যবান। এই কাব্য হইতে সে-যুগের সমাজ সম্বন্ধে অজস্র তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষত, কালকেতুর নগরপত্তন-সংক্রান্ত অংশটি অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ। এই গ্রন্থ ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণের বাঙালী-সমাজের দর্পণস্বরূপ।
মুকুন্দরামের পরেও আরও অনেক কবি চণ্ডীমঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর কবিদের মধ্যে রামদেব, দ্বিজ জনার্দন ও দ্বিজ কমললোচন এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর কবিদের মধ্যে মুক্তারাম সেন, জয়নারায়ণ সেন ও রামানন্দ যতির নাম উল্লেখযোগ্য। রামানন্দ যতির ‘চণ্ডীমঙ্গলে’র মধ্যে কিছু অবিনবত্ব আছে; এই কাব্যে তিনি অলৌকিক ব্যাপারে নিজের অনাস্থার পরিচয় দিয়াছেন এবং মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।
ধর্মমঙ্গল ও ধর্মপুরাণ
চণ্ডী ও মনসার মত ধর্মঠাকুরকে কেন্দ্র করিয়াও বাংলা দেশে এক বিরাট সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল। ধর্মঠাকুর সম্পূর্ণভাবে লৌকিক দেবতা। তবে ইঁহার পরিকল্পনার উপরে বুদ্ধ, সূর্য, বরুণ, যম প্রভৃতির পরিকল্পনার প্রভাব আছে বলিয়া কেহ কেহ মনে করেন। ধর্মঠাকুরের পূজা কেবলমাত্র রাঢ় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। হিন্দু সমাজের তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর লোকেরা ডোম, বাগদী, হাড়ি প্রভৃতি জাতির লোকেরাই বিশেষভাবে ধর্মঠাকুরের উপাসক। এইজন্য ধর্মমঙ্গল কাব্যও রাঢ় ভিন্ন অন্য কোন অঞ্চলের লোকেরা রচনা করেন নাই এবং ধর্মমঙ্গল কাব্যের জনপ্রিয়তা পূর্ব্বোক্ত জাতিসমূহের লোকদের মধ্যেই অধিক ছিল। ইঁহাদের রচয়িতা অবশ্য তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকেরাই হইতেন; কিন্তু ধর্মমঙ্গল রচনার ‘অপরাধে’, বিশেষ করিয়া আসরে গান করার ‘অপরাধে’, ইঁহারা অনেক সময়ে নিজেদের সমাজে পতিত হইতেন।
ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী সংক্ষেপে এই। জনৈক গৌড়েশ্বর (ইনি ধর্মপালের পুত্র বলিয়া অভিহিত, ইহার নাম কোথাও উল্লিখিত নাই) তাঁহার শ্যালক মহাপাত্র মহামদকে না জানাইয়া তরুণী শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সহিত ময়নাগড়ের বৃদ্ধ সামন্ত রাজ কর্ণসেনের বিবাহ দেন। মহামদ পরে এ কথা জানিয়া খুব ক্রুদ্ধ হয়। এদিকে রঞ্জাবতী ধর্মঠাকুরের পূজা এবং তদুপলক্ষে কঠোর আত্মনিপীড়ন করার পরে ধর্ম্মের অনুগ্রহে লাউসেন নামক পুত্রকে লাভ করে। মহামদ শিশু লাউসেনকে বধ করিবার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হয়। বড় হইয়া লাউসেন বহুবার অলৌকিক বীরত্ব দেখায়, অনেকবার বিপদেও পড়ে, কিন্তু ধর্মঠাকুরের কৃপায় প্রতিবার রক্ষা পায়। শেষপর্যন্ত লাউসেন কঠিন তপস্যার দ্বারা ধর্মঠাকুরকে সন্তুষ্ট করিয়া পশ্চিমদিকে সূর্যোদয় দেখাইতেও সমর্থ হয়। মহামদ লাউসেনকে বিনষ্ট করিবার জন্য অনেক ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, কিন্তু কিছুই করিতে পারে নাই; অবশেষে একবার লাউসেনের অনুপস্থিতির সুযোগ লইয়া মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করিল এবং লাউসেনের স্ত্রী কলিঙ্গা ও অনেক অনুচরকে বধ করিল; লাউসেন ফিরিয়া আসিয়া ধর্ম্মের স্তব করিল এবং ধর্ম্মের কৃপায় সবাইকে পুনরুজ্জীবিত করিয়া ময়নায় নিরুদ্বেগে রাজত্ব করিতে লাগিল; ধর্মঠাকুরের অভিশাপে মহামদ কুষ্ঠরোগগ্রস্ত হইল।
ধর্মমঙ্গল কাব্য অনেকগুলি রচিত হইয়াছিল। সবগুলির সাহিত্যিক উৎকর্ষ সমান নয়। তবে চরিত্রগুলি (এক নায়ক লাউসেন ছাড়া) প্রায় সব ধর্মমঙ্গলেই জীবন্ত হইয়াছে। রঞ্জাবতী পুত্রস্নেহে অন্ধ; কর্ণসেন ভীরু ও দুর্বল প্রকৃতির; গৌড়েশ্বর ব্যক্তিত্বহীন; মহামদ খল ও জিঘাংসু; কর্পূরধবল কাপুরুষ ও ভড়; লাউসেনের দুই স্ত্রী কলিঙ্গা ও কানড়া মহীয়সী বীরাঙ্গনা; কালু ডোম, কালুর স্ত্রী, ধুমসী, হরিহর বাইতি প্রভৃতি চরিত্রগুলি ন্যায়ের জন্য আত্মোৎসর্গের মধ্য দিয়া আমাদের হৃদয়ে স্থান লাভ করে। এই সব চরিত্র সব ধর্মমঙ্গলেই জীবন্ত হইয়াছে; ধর্মমঙ্গলগুলিতে তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকদের চাইতে নিম্নবর্ণের লোকদের চরিত্রগুলিই বেশি প্রাণবন্ত হইয়াছে। সে যুগের যোদ্ধৃ জাতি ডোমদের বীরত্বও ধর্মমঙ্গলে সুন্দরভাবে বর্ণিত হইয়াছে। তবে নায়ক লাউসেনের চরিত্র-তাঁহার বীরত্ব বাস্তবতার সীমা ছাড়াইয়া যাওয়ার জন্য এবং প্রতিপদেই তাঁহার ধর্মঠাকুরের উপর নির্ভর করা ও ধর্মঠাকুরের কৃপায়, বিপন্মুক্ত হওয়ার ফলে জীবন্ত হইতে পারে নাই। ধর্ম মঙ্গলকাব্যগুলিতে রাঢ়ের লোকদের জীবনযাত্রার পরিচয় বেশ সুপরিস্ফুট হইয়াছে।
প্রথম ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করিয়াছিলেন ময়ূরভট্ট; পরবর্তী ধর্মমঙ্গল-কাব্যের রচয়িতারা ইঁহার নাম করিয়াছেন; কিন্তু ময়ূরভট্টের কাব্য পাওয়া যায় নাই। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ হইতে ময়ূরভট্ট বিরচিত শ্রীধর্মপুরাণ’ নাম দিয়া যাহা বাহির হইয়াছিল, তাহা জাল। খেলারাম নামক জনৈক ধর্মমঙ্গল-কাব্যরচয়িতাকে কেহ কেহ ষোড়শ শতাব্দীর লোক বলেন, কিন্তু এই মতের যাথার্থে গভীর সংশয় আছে; খেলারামের কাব্যের কয়েকটি পংক্তি মাত্র পাওয়া গিয়াছে; এগুলি হইতে তাঁহাকে সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের লোক বলিয়া মনে হয়। শ্রীশ্যাম পণ্ডিত সম্ভবত সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধের লোক, কিন্তু তাঁহার রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্যও সম্পূর্ণ মিলে নাই। যাহাদের লেখা ধর্মমঙ্গল পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের মধ্যে রূপরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক, সীতারাম দাস, ঘনরাম চক্রবর্তী ও মাণিকরাম গাঙ্গুলীর নাম উল্লেখযোগ্য। রূপরামের নিবাস ছিল বর্তমান বর্ধমান জিলার শ্রীরামপুর গ্রামে। শুজা যে সময় বাংলার শাসনকর্ত্তা (১৬৩৯-৫৯ খ্রী.), সে সময়ে রূপরাম ধর্ম্মের গান গাহিতে শুরু করেন এবং শুজার শাসন অবসানের কিছু পরে ধর্মমঙ্গল রচনা সম্পূর্ণ করেন। রূপরামের ধর্মমঙ্গলের চরিত্রগুলি বেশ জীবন্ত; ইহার মধ্যে সে-যুগের যুদ্ধযাত্রার বাস্তব ও উজ্জ্বল বর্ণনা পাওয়া যায়; রূপরামের আত্মকাহিনী সুরচিত ও তথ্যপূর্ণ। রামদাস ১৬৬২ খ্রীষ্টাব্দে ধর্মমঙ্গল রচনা করেন; ইনি রূপরামকেই অনুসরণ করিয়াছেন। সীতারাম ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দে ধর্মমঙ্গল সম্পূর্ণ করেন; ইহার আত্মকাহিনী বেশ কবিত্বপূর্ণ; ইনি একটি মনসামঙ্গলও লিখিয়াছিলেন। ঘনরাম ১৭১১ খ্রীষ্টাব্দে ধর্মমঙ্গল রচনা শেষ করিয়াছিলেন। ইনি বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের আশ্রিত ছিলেন। ঘনরাম পণ্ডিত লোক ছিলেন, তাঁহার কাব্যেও পাণ্ডিত্যের পরিচয় আছে; ইহার ধর্মমঙ্গলখানি আয়তনে অত্যন্ত বৃহ; কিন্তু কাব্যহিসাবে তাঁহার বিশিষ্ট মূল্য রহিয়াছে; ছন্দ ও অলঙ্কার–বিশেষত অনুপ্রাসের ক্ষেত্রে ঘনরাম এই কাব্যে সবিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়াছেন। ঘনরাম একটি ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ও রচনা করিয়াছিলেন। মাণিকরাম ১৭১১ হইতে ১৭৬৪ খ্রষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে ধর্মমঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন; ইহার রচিত ধর্মমঙ্গল আয়তনে ক্ষুদ্র হইলেও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ; তাঁহার মধ্যে উপভোগ্য হাস্যরসের নিদর্শন পাওয়া যায়। মাণিকরাম একটি শীতলামঙ্গল কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। এই কয়জন কবি ব্যতীত নিধিরাম চক্রবর্তী, প্রভুরাম মুখটি, রামচন্দ্র বাড়জ্জ্যা, রামকান্ত রায়, নরসিংহ বসু, ভবানন্দ রায়, দ্বিজ রাজীব প্রভৃতি কবিরাও ধর্মমঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন। ইঁহাদের অধিকাংশই অষ্টাদশ শতাব্দীর লোক।
ধর্মঠাকুরের ব্যাপার অবলম্বনে ধর্মমঙ্গল কাব্যগুলি ব্যতীত আরও এক ধরনের গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। এগুলিকে ‘ধর্মপুরাণ’ বলা হয়। ইহাদের মধ্যে বিশ্বসৃষ্টির কাহিনী (ধর্মঠাকুরের উপাসকদের মতানুযায়ী), ধর্মপূজা প্রবর্তনের কাহিনী এবং ধর্মপূজার পদ্ধতি বর্ণিত হইয়াছে। বিশ্বসৃষ্টির কাহিনীটি বেশ বিচিত্র। এই কাহিনী অনুসারে ধর্মই বিশ্বের সৃষ্টিকর্ত্তা; ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব তাঁহার পুত্র; ধর্ম পুত্রত্রয়কে পরীক্ষা করিবার জন্য ছয় মাসের শব হইয়া তাঁহাদের সম্মুখ দিয়া ভাসিয়া যান; ইহাদের মধ্যে শিবই পিতাকে চিনিতে পারেন; অতঃপর শিবের জানুর উপরে বিষ্ণুকে কাষ্ঠ করিয়া ব্রহ্মার নিঃশ্বাসে আগুন ধরাইয়া ধর্মকে সৎকার করা হয়; ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবের জননী কেতকা অনুমৃতা হন। ধর্মপূজা-প্রবর্তনের কাহিনীতে সদা নামক ডোম কর্ত্তৃক ধর্মঠাকুরকে প্রথম পূজা করা এবং রামাই পণ্ডিত (আদিত্যের অবতার) কর্ত্তৃক ধর্মপূজা সুপ্রতিষ্ঠিত করা বর্ণিত হইয়াছে। ধর্মপূজার পদ্ধতির মধ্যে নানা ধরনের জিনিস দেখা যায়; যেমন, ধর্মঠাকুরের নিত্যপূজার প্রণালী, ধর্ম্মের “ঘরভরা” নামক গাজনের বিধি, সূর্যের ছড়া, ধর্ম্মের চাষ ও শিবের চাষ প্রভৃতির কাহিনী।
ধর্মপুরাণ প্রথম রামাই পণ্ডিত রচনা করিয়াছিলেন বলিয়া পরবর্তী গ্রন্থগুলিতে উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু রামাই পণ্ডিতের ‘ধর্মপুরাণ’ পাওয়া যায় নাই। যাদুনাথ, সহদেব চক্রবর্তী, লক্ষণ, রামচন্দ্র বড়জ্জ্যা প্রভৃতি কবির লেখা ধর্মপুরাণ পাওয়া গিয়াছে। যাদুনাথের গ্রন্থ সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দশকের এবং অন্যদের গ্রন্থ অষ্টাদশ শতাব্দীর রচনা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ হইতে ‘শূন্যপুরাণ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হইয়াছিল; ইহা ধর্ম্মের পূজাপদ্ধতির সংকলন। এই বইটিকে প্রথম প্রকাশের সময়ে খুব প্রাচীন রচনা বলিয়া মনে করা হইয়াছিল, কিন্তু ইহার রচনা অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী নয়।
শিবমঙ্গল বা শিবায়ন
শিবের সম্বন্ধে বাংলা দেশে বহু প্রাচীনকাল হইতে কাব্য রচনা হইয়া আসিতেছে। বাংলা দেশে শিবের বিশুদ্ধ পৌরাণিক রূপটি অক্ষুণ্ণ ছিল না। তাঁহার সহিত বহু লৌকিক ঐতিহ্য মিশিয়া গিয়াছিল। এইসব লৌকিক ঐতিহ্য অনুসারে শিব চাষ। করেন, গাঁজা-ভাঙ খান, এমন কি নীচজাতীয় লোকদের পাড়ায় গিয়া নীচজাতীয়া স্ত্রীলোকদের সহিত অবৈধ সংসর্গ পর্যন্ত করেন। শিবের গৃহস্থালীর চিত্রও বাঙালীর পরিচিত, কিন্তু সে গৃহস্থালী দরিদ্রের গৃহস্থালী।
শিবের চরিত্র ও তাঁহার গৃহস্থালীর বর্ণনা চণ্ডীমঙ্গল ও মনসামঙ্গল কাব্যে পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ হইতে শিব সম্বন্ধে স্বতন্ত্র মঙ্গলকাব্যও রচিত হইতে থাকে। এইগুলির নাম ‘শিবমঙ্গল’ বা ‘শিবায়ন’।
যাহাদের রচিত ‘শিবায়ন’ পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের মধ্যে প্রাচীনতম রামকৃষ্ণ রায়। ইহার উপাধি ছিল কবিচন্দ্র। ইঁহার নিবাস ছিল বর্তমান হাওড়া জেলার অন্ত গত রসপুর-কলিকাতা গ্রামে। রামকৃষ্ণের ‘শিবায়ন’ সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত হয়। ইহার মধ্যে প্রধানতঃ পৌরাণিক শিবের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে।
‘কবিচন্দ্র’ উপাধিধারী আর একজন কবি আর একখানি ‘শিবায়ন’ রচনা করিয়াছিলেন। ইহার প্রকৃত নাম শঙ্কর চক্রবর্তী। গ্রন্থের মধ্যে কবি লিখিয়াছেন যে, বিষ্ণুপুরের রাজা বীরসিংহের রাজত্বকালে তিনি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন।
দ্বিজ রতিদেব নামক জনৈক কবি ১৫৯৬ শকাব্দ বা ১৬৭৪ খ্রীষ্টাব্দে মৃগলুব্ধ’ নামে একটি ক্ষুদ্র শিবমাহাত্ম-বর্ণনামূলক আখ্যানকাব্য রচনা করেন। এই কবি সম্ভবত চট্টগ্রামের লোক ছিলেন।
‘শিবায়ন’ কাব্যের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা রামেশ্বর ভট্টাচার্য। ইঁহার নিবাস ছিল বর্তমান মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার যদুপুর গ্রামে। পরে ইনি কর্ণগড়ের রাজা রামসিংহের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষণ লাভ করেন এবং রামসিংহের পুত্র যশমন্ত সিংহের রাজত্বকালে ‘শিবায়ন’ রচনা করেন। এই গ্রন্থের রচনা-সমাপ্তিকাল বিষয়ক যে শ্লোক কবি লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাঁহার অর্থ সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা একমত না হইলেও তিনি যে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কাব্য রচনা করিয়াছিলেন, ইহা নিশ্চিত করিয়া বলা চলে। রামেশ্বরের ‘শিবায়ন’ অত্যন্ত সুখপাঠ্য রচনা। ইহার ভাষাও খুব সরল। এই কাব্যে কবি গ্রাম্য কাহিনীকে ভদ্র রূপ দিয়া সাহিত্যে প্রবেশ করাইয়াছেন, ইহা অত্যন্ত কৃতিত্বের বিষয়। কাব্যটিতে স্থানে স্থানে অল্পস্বল্প গ্রাম্যতা থাকিলেও মোটামুটিভাবে অধিকাংশ স্থানে সুরুচিরই পরিচয় পাওয়া যায়। রামেশ্বরের শিবায়নে সমসাময়িক সমাজের নিখুঁত প্রতিফলন পাওয়া যায়। সে যুগে লোকেরা এত দরিদ্র হইয়া পড়িয়াছিল যে কোনক্রমে খাইয়া পরিয়া বাঁচিয়া থাকাই চরম কাম্য মনে করিত-ইহা এই কাব্য হইতে জানা যায়। এই কাব্যের চাষ-পালাতে রামেশ্বর ধান-চাষের অত্যন্ত বিশদ ও সুনিপুণ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। রামেশ্বর একটি ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’-ও লিখিয়াছিলেন।
কালিকামঙ্গল
কালিকামঙ্গল কাব্যে বাংলার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় দেবী কালীর মাহাত্ম বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ‘কালিকামঙ্গল কাব্যে বিদ্যা ও সুন্দরের রোমান্টিক প্রেম-কাহিনী প্রধান স্থান লাভ করিয়াছে। সংস্কৃত সাহিত্যে রাজশেখর সূরী, বররুচি প্রভৃতি লেখকেরা ‘বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী লইয়া কাব্য রচনা করিয়াছেন। কিন্তু সে কাহিনী লৌকিক কাহিনী, তাঁহার সহিত কালী দেবীর কোন সম্পর্ক নাই। বাংলা দেশের ‘কালিকামঙ্গল কাব্যে বলা হইয়াছে সুন্দরের উপাস্যা দেবী কালী এবং তিনি সুন্দরকে প্রাণদণ্ড হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। এইভাবে কালীর মাহাত্মের সহিত ‘বিদ্যাসুন্দরের প্রেম-কাহিনী এক সূত্রে গ্রথিত হইয়াছে।
যাহাদের লেখা ‘কালিকামঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য পাওয়া গিয়াছে, তাহাদের মধ্যে সময়ের দিক দিয়া সর্বাপেক্ষা প্রাচীন দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ। ইনি নসরৎ শাহের রাজত্বকালে (১৫১৯-৩২ খ্রীষ্টাব্দ) তাঁহার পুত্র ফিরোজ শাহের পৃষ্ঠপোষণ ও আদেশ লাভ করিয়া এই বইটি লিখিয়াছিলেন; ইহার একটি খণ্ডিত পুঁথি পাওয়া গিয়াছে। সাবিরিদ খান নামক একজন মুসলমান কবির লেখা একটি ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যেরও খণ্ডিত পুঁথি পাওয়া গিয়াছে; ইহার ভাষা বেশ প্রাচীন; কাব্যটি শ্রীধর কবিরাজের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর অনুকরণে রচিত হইয়াছিল। গোবিন্দদাস নামক একজন চট্টগ্রাম-নিবাসী কবি ১৫২৭ শকাব্দে (১৬০৫-০৬ খ্রীষ্টাব্দে) একটি ‘কালিকামঙ্গল’ রচনা করিয়াছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর আর একজন ‘কালিকামঙ্গল’–রচয়িতা প্রাণরাম চক্রবর্তী; ইহার কাব্যরচনাকাল ১৫৮৮ শকাব্দ (১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দ)। ইহা ভিন্ন কলিকাতার নিকটবর্তী নিমতার অধিবাসী কৃষ্ণরাম দাস ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ও শায়েস্তা খাঁর বঙ্গশাসনকালে–১৫৯৮ শকাব্দে (১৬৭৬-৭৭ খ্রীষ্টাব্দ) মাত্র কুড়ি বৎসর বয়সে একখানি ‘কালিকামঙ্গল’ রচনা করেন। ইঁহাদের কাহারও রচনা অসাধারণ নয়, এবং সকলের রচনাতেই অল্প-বিস্ত র অশ্লীলতা আছে। কৃষ্ণরামের কাব্যে এ দোষ সর্বাপেক্ষা বেশি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বলরাম চক্রবর্তী ‘কালিকামঙ্গল’ রচনা করেন। ইহার পর ১৬৭৪ শকাব্দে (১৭৫২-৫৩খ্রষ্টাব্দে) রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র ‘অন্নদামঙ্গল রচনা করেন, ইহার অন্যতম খণ্ড ‘বিদ্যাসুন্দর এবং সমস্ত ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের মধ্যে ইহাই শ্রেষ্ঠ। ভারতচন্দ্রের কিছু পরে কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেন আর একখানি ‘বিদ্যাসুন্দর’ রচনা করেন। ভারতচন্দ্র ও রামপ্রসাদ সম্বন্ধে পরে আমরা স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করিব। ইঁহারা ভিন্ন নিধিরাম আচার্য ১৬৭৮ শকাব্দে (১৭৫৬-৫৭ খ্রীষ্টাব্দ) এবং কলিকাতা-নিবাসী রাধাকান্ত মিশ্র ১৬৮৯ শকাব্দে (১৬৬৭-৬৮ খ্রীষ্টাব্দ) ‘কালিকামঙ্গল’ রচনা করিয়াছিলেন। কবীন্দ্র চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তিও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এখানি ‘কালিকামঙ্গল’ লিখিয়াছিলেন। ইঁহাদের রচনা গতানুগতিক শ্রেণীর, তবে রাধাকান্ত মিশ্র অন্য কবিদের দেবতার প্রত্যাদেশ প্রাপ্তিতে আংশিক অনাস্থা প্রকাশ করিয়া দৃষ্টিভঙ্গীর অভিনবত্বের পরিচয় দিয়াছেন।
রায়মঙ্গল
মনসা যেমন সাপের দেবতা, তেমনি বাঘের দেবতা দক্ষিণরায়। তাঁহাকে উপাসনা করিলে বাঘের কবল হইতে রক্ষা পাওয়া যায় বলিয়া বাংলা দেশের লোকেরা বিশ্বাস করিত। ‘রায়মঙ্গল কাব্যে এই দক্ষিণরায়ের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হইয়াছে। এই কাব্যের মধ্যে আরও দুইজন উপাস্যের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। একজন কুমীরের দেবতা কালুরায়, অপর জন মুসলমানদের পীর বড় খাঁ গাজী। ‘রায়মঙ্গল কাব্যে এই দুইজনের মাহাত্মও বর্ণিত হইয়াছে। দক্ষিণরায়, কালুরায় ও বড় খাঁ গাজী, তিনজনেরই পূজা সুন্দরবন অঞ্চলে অধিক প্রচলিত। ‘রায়মঙ্গলের মধ্যে দক্ষিণরায় ও বড় খা গাজীর যুদ্ধ এবং ঈশ্বরের অর্ধ-শ্রীকৃষ্ণ অর্ধ-পয়গম্বর বেশে অবতীর্ণ হইয়া উভয়ের মধ্যে সন্ধিস্থাপন করার বর্ণনা পাওয়া যায়।
‘রায়মঙ্গলে’র প্রথম রচয়িতার নাম মাধব আচার্য। ইনি ‘কৃষ্ণমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ও গঙ্গামঙ্গলের রচয়িতা মাধব আচার্যের সঙ্গে অভিন্ন হইতে পারেন। ইহার নাম কৃষ্ণরামের ‘রায়মঙ্গলে উল্লিখিত হইয়াছে, কিন্তু ইহার কাব্য পাওয়া যায় নাই। যে কয়টি ‘রায়মঙ্গল পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার মধ্যে নিমতা গ্রাম নিবাসী কৃষ্ণরাম দাসের রচনাটিই প্রাচীনতম। ইহার লেখা ‘কালিকামঙ্গলের নাম পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। কৃষ্ণরামের ‘রায়মঙ্গল’ ১৬০৮ শকাব্দে (১৬৮৬-৮৭ খ্রীষ্টাব্দে) রচিত হয়। এই কাব্যখানি অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হইলেও শক্তিশালী হাতের রচনা; ইহার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, ইহার মধ্যে অনেক রকমের বাঘের নাম ও বর্ণনা পাওয়া যায়।
কৃষ্ণরামের পর আরও দুইজন কবি ‘রায়মঙ্গল’ লিখিয়াছিলেন। একজনের নাম রুদ্রদেব। ইঁহার কাব্যের খণ্ডিত পুঁথি মিলিয়াছে। ইনি সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের লোক ছিলেন। দ্বিতীয় জনের নাম হরিদেব। ১৬৫০ শকাব্দে (১৭২৮ খ্রীষ্টাব্দে) ইঁহার ‘রায়মঙ্গল’ সম্পূর্ণ হয়।
অন্যান্য মঙ্গলকাব্য
যে সমস্ত মঙ্গলকাব্য সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করিলাম, সেগুলি ভিন্ন আরও অনেক মঙ্গলকাব্য রচিত হইয়াছিল। ইহাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও প্রধান প্রধান রচয়িতাদের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হইল।
শীতলামঙ্গল–ইহাতে বসন্ত রোগের দেবী শীতলার মাহাত্ম বর্ণিত হইয়াছে। মাণিকরাম গাঙ্গুলী, নিত্যানন্দ বল্লভ, দয়াল, অকিঞ্চন চক্রবর্তী, দ্বিজ গোপাল, শঙ্কর এবং পূর্ব্বোল্লিখিত নিমতাবাসী কৃষ্ণরাম দাস প্রভৃতি কবিগণ শীতলামঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন।
ষষ্ঠীমঙ্গল–ষষ্ঠী শিশুদের রক্ষয়িত্রী দেবী। ইহার মাহাত্ম ষষ্ঠীমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত হইয়াছে। নিমতার কৃষ্ণরাম দাস (কাব্যের রচনাকাল ১৬০১ শক বা ১৬৭৯-৮০ খ্রীষ্টাব্দ) এবং রুদ্ররাম প্রভৃতি কবিগণ ষষ্ঠীমঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন।
সারদামঙ্গল–সারদামঙ্গলে সারদা অর্থাৎ সরস্বতী দেবীর মাহাত্ম বর্ণিত হইয়াছে। দয়ারাম, দ্বিজ বীরেশ্বর প্রভৃতি কবিগণ ইহার রচয়িতা।
জগন্নাথমঙ্গল–ইহার মধ্যে স্কন্দপুরাণ’ অবলম্বনে জগন্নাথদেবের মাহাত্ম্য বর্ণিত হইয়াছে। ইহার অন্যতম লেখক গদাধর দাস (কাশীরাম দাসের অনুজ)।
সূর্যমঙ্গল–সূর্যদেবতার মাহাত্মবর্ণনামূলক কাব্য সূর্যমঙ্গল’। ইহার রচয়িতাদের মধ্যে রামজীবন ও কালিদাসের নাম উল্লেখযোগ্য।
লক্ষ্মীমঙ্গল–ধনের দেবী লক্ষ্মী বা কমলার মাহাত্মবর্ণনামূলক কাব্য লক্ষ্মীমঙ্গল’। ইহার রচয়িতাদের মধ্যে নিমতার কৃষ্ণরাম দাস, গুণরাজ খান এবং দ্বিজ নরোত্তমের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে। কৃষ্ণরাম দাস মোট পাঁচখানি মঙ্গলকাব্য লিখিয়াছিলেন–কালিকামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, ‘রায়মঙ্গল, শীতলামঙ্গল ও লক্ষ্মীমঙ্গল।
গঙ্গামঙ্গল–গঙ্গামঙ্গলে গঙ্গাদেবীর মাহাত্ম বর্ণিত। মাধব আচার্য, দ্বিজ গৌরাঙ্গ, জয়রাম দাস, দ্বিজ কমলাকান্ত, শঙ্কর আচার্য প্রভৃতি কবিগণ ‘গঙ্গামঙ্গল রচনা করিয়াছিলেন। দুর্গাপ্রসাদ মুখুজ্জ্যের লেখা ‘গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ও (রচনাকাল অষ্টাদশ শতকের শেষ পাদ) গঙ্গামঙ্গল কাব্যের শ্রেণীভুক্ত; এই কাব্যে কবির শক্তির পরিচয় আছে; ইহার মধ্যে ভারতচন্দ্রের প্রভাব ও অনুকরণ দেখা যায়। এই কাব্যটি এক সময়ে কলিকাত্ৰা অঞ্চলে বহুল প্রচারিত ছিল।
কপিলামঙ্গল–ব্রহ্মার কামধেনু কপিলার অপহরণ ও কপিলার মাহাত্ম্য কপিলামঙ্গল কাব্যে বর্ণিত হইয়াছে। কপিলামঙ্গল’-এর প্রধান রচয়িতা শঙ্কর কবিচন্দ্র, কাশীনাথ ও কেতকাদাস-ক্ষুদিরাম দাস।
গোসানীমঙ্গল–এই কাব্যে উত্তরবঙ্গের এক স্থানীয় দেবতার মাহাত্ম বর্ণিত হইয়াছে। এ পর্যন্ত একটি মাত্র ‘গোসানীমঙ্গল’ পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার রচয়িতার নাম রাধাকৃষ্ণ দাস।
বরদামঙ্গল–ইহার মধ্যে ত্রিপুরার বরদাখাত পরগণার অধিষ্ঠাত্রী দেবী বরদেশ্বরীর মাহাত্ম বর্ণিত হইয়াছে। এ পর্যন্ত কেবলমাত্র নন্দকিশোর শর্মার লেখা একখানি বরদামঙ্গল’ পাওয়া গিয়াছে।
১৬
ঐতিহাসিক কাব্য
আধুনিক-পূর্ব যুগে হিন্দুরা ইতিহাসবিমুখ ছিলেন। বাংলা দেশে আবার হিন্দু মুসলমান সকলেরই মধ্যে ইতিহাস সম্বন্ধে একটা নিস্পৃহতার ভাব ছিল। এইজন্য মুসলিম যুগের বাংলা দেশ সম্বন্ধে কোন প্রামাণিক ইতিহাস-গ্রন্থ রচিত হয় নাই বলিলেই চলে। এই যুগের বাংলা সাহিত্যেও তাই ঐতিহাসিক রচনা একান্ত দুর্লভ।
কেবলমাত্র ত্রিপুরায় বাংলা ভাষায় কয়েকটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল। ইহাদের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য ‘রাজমালা’; এই গ্রন্থে আদিকাল হইতে শুরু করিয়া অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত ত্রিপুরা রাজ্যের ধারাবাহিক ও বিশদ ইতিহাস লিপিবদ্ধ হইয়াছে। বইটি চারি খণ্ডে বিভক্ত; প্রথম খণ্ড পঞ্চদশ শতকে ধর্মমাণিক্যের রাজত্বকালে, দ্বিতীয় খণ্ড ষোড়শ শতকে অমরমাণিক্যের রাজত্বকালে, তৃতীয় খণ্ড সপ্তদশ শতকে গোবিন্দমাণিক্যের রাজত্বকালে এবং চতুর্থ খণ্ড অষ্টাদশ শতকে কৃষ্ণমাণিক্যের রাজত্বকালে রচিত হইয়াছিল। ‘রাজমালাতে স্থানে স্থানে অলৌকিক উপাদান ও একদেশদর্শিতা-দোষ থাকিলেও মোটের উপর বইটির মধ্যে প্রামাণিক বিবরণই লিপিবদ্ধ হইয়াছে। ঊনবিংশ শতকের প্রথমে দুর্গামণি উজীর নামে ত্রিপুরার একজন রাজকর্মচারী ‘রাজমালা’র স্বেচ্ছানুযায়ী পরিবর্তন সাধন করেন, সেই পরিবর্তিত রূপটিই পরে মুদ্রিত হইয়াছে। এই মুদ্রিত সংস্করণটির তুলনায় দুর্গামণি উজীরের আবির্ভাবের পূর্বে লিপিকৃত পুঁথিগুলি অধিকতর নির্ভরযোগ্য। ‘রাজমালা ব্যতীত ত্রিপুরায় রচিত ‘চম্পকবিজয়’, ‘কৃষ্ণমালা’ ও ‘বরদামঙ্গল’ প্রভৃতি ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘চম্পকবিজয়’ গ্রন্থে ত্রিপুরারাজ দ্বিতীয় রত্নমাণিক্যের রাজত্বকালে (১৬৮৫-১৭১০ খ্রীষ্টাব্দ) নরেন্দ্রমাণিক্যের বিদ্রোহ এবং রত্নমাণিক্যের সাময়িক রাজ্যচ্যুতি ও বিশ্বস্ত সেনাপতি চম্পক রায়ের সহায়তায় রাজ্য পুনরুদ্ধার বর্ণিত হইয়াছে। ‘কৃষ্ণমালা’য় ত্রিপুরারাজ কৃষ্ণমাণিক্যের (রাজত্বকাল ১৭৬০-৮৩ খ্রীষ্টাব্দ) জীবনেতিহাস বর্ণিত হইয়াছে। ‘বরদামঙ্গল’ গ্রন্থ বাহ্যত বরদেশ্বরী দেবীর মাহাত্মবর্ণনামূলক মঙ্গলকাব্য হইলেও ইহার মধ্যে ত্রিপুরার অন্যতম পরগণা বরদাখাতের ইতিহাস বিশদভাবে বর্ণিত হইয়াছে।
অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত ‘মহারাষ্ট্রপুরাণ’ নামক গ্রন্থটিকেও ঐতিহাসিক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে। ইহার লেখকের নাম গঙ্গারাম। ইহার ‘ভাস্কর-পরাভব’ নামক প্রথম কাণ্ডটি পাওয়া গিয়াছে, অন্যান্য কাণ্ড রচিত হইয়াছিল কিনা জানা যায় না। অষ্টাদশ শতকের পঞ্চম দশকে বর্গীদের পশ্চিমবঙ্গ আক্রমণ ও লুণ্ঠন, নবাব আলীবর্দীর সাময়িক পরাজয়, অবশেষে জনসাধারণের বিরোধিতায় বর্গী-সেনাপতি ভাস্করের পরাভব এবং আলীবর্দীর চক্রান্তে ভাস্করের নিধন এই গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে; ইহার মধ্যে লেখকের প্রত্যক্ষদৃষ্ট ‘বর্গীয় হাঙ্গামা’র জীবন্ত ও উজ্জ্বল বর্ণনা পাওয়া যায়; এই। গ্রন্থের রচনাকাল ১১৫৮ বঙ্গাব্দ (১৭৫১-৫২ খ্রীষ্টাব্দ)।
অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় পদে বিজয়রাম নামক জনৈক বৈদ্যজাতীয় লেখক ‘তীর্থমঙ্গল’ নামে একখানি ভ্রমণকাহিনী রচনা করিয়াছিলেন। খিদিরপুরের কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষাল নামে একজন ধনী ব্যক্তি নৌকাযোগে নবদ্বীপ, হাঁড়রা, ঝিনুকঘাটা, টুঙ্গীবালী, জলঙ্গী, রাজমহল, মুঙ্গের, গয়া, রামনগর, কাশী, প্রয়াগ, বিন্ধ্যগিরি প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ ও তীর্থদর্শন করিয়াছিলেন; বিজয়রামও তাঁহার দলের সহিত গিয়াছিলেন। এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই গ্রন্থটিতে বর্ণিত। ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র দেশে ফিরেন এবং তাঁহার কিছু পরে ‘তীর্থমঙ্গল’ রচিত হয়। বইখানির যথেষ্ট ঐতিহাসিক মূল্য আছে।
১৭
ময়মনসিংহ-গীতিকা
পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জিলার গ্রামাঞ্চলে অনেকগুলি গীতিকা অর্থাৎ কাহিনী বর্ণনাত্মক গাথা লোকমুখে প্রচলিত ছিল। এইগুলিই আধুনিককালে সঙ্কলিত হইয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক ‘মৈমনসিংহ-গীতিকা’ নামে প্রকাশিত হইয়াছে।
এই গীতিকাগুলি যেভাবে সঙ্কলিত ও প্রকাশিত হইয়াছে, তাঁহার মধ্যে ইহাদের প্রাচীন রূপটি অক্ষুণ্ণ নাই; সংগ্রাহকদের হস্তক্ষেপের ফলে ইহাদের কলেবর অনেকাংশে বর্ধিত হইয়াছে এবং ভাষা আধুনিকতাপ্রাপ্ত হইয়াছে। দুই একটি গীতিকার প্রাচীনতর রূপ অন্য সূত্র হইতে পাওয়া যায়; যেমন মেওয়া (নামান্তর মহুয়া) সুন্দরী ও জয়ানন্দের বিবাহ প্রভৃতি সম্বন্ধীয় গীতিকাগুলি; ইহাদের আদি রচনাকাল অজ্ঞাত। গীতিকাগুলি ‘লোকসাহিত্য’ নহে–কবিদের নিজস্ব সৃষ্টি। কবিদের নামও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জানা যায়।
মোটের উপর, ময়মনসিংহ-গীতিকা প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের গণ্ডীভুক্ত হইতে পারে কিনা সে বিষয়ে কিছু সংশয়ের অবকাশ আছে। তবে গীতিকাগুলি যে সাহিত্যসৃষ্টি হিসাবে খুব উল্লেখযোগ্য তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
এই গীতিকাগুলির অধিকাংশই প্রণয়মূলক। ইহাদের মধ্যে গ্রাম্য প্রেমেরই বর্ণনা পাই, কিন্তু তাহা একটি অপূর্ব রোমান্টিকতায় মণ্ডিত। কাজলরেখা, মেওয়া (মহুয়া), মলুয়া, মদিনা, নীলা, চন্দ্রাবতী প্রভৃতি নায়িকাদের প্রেম যেভাবে কৃচ্ছসাধন ও ত্যাগের মধ্য দিয়া মহিমান্বিত হইয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা আমাদের মনকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। দুই একটি গীতিকা প্রণয়মূলক নহে, যেমন দস্যু কেনারামের পালা; এই পালাটিতে একজন নরহন্তা দস্যুর ভক্ত ও সুগায়কে পরিণত হওয়ার জীবন্ত চিত্র পাই; এটিও কারুণ্যরসমণ্ডিত ও মর্মস্পর্শী।
এই গীতিকাগুলির মধ্যে পুরাণের প্রভাব খুবই অল্প। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখা যেমন ধর্ম্মাশ্রিত, এই শাখাঁটি তাঁহার আশ্চর্য ব্যতিক্রম। এই শাখাঁটিতে হিন্দু-সংস্কৃতি ও মুসলিম-সংস্কৃতির সম্মিলনেরও নিদর্শন পাওয়া যায়। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নায়কনায়িকার প্রণয়কাহিনীই এই গীতিকাগুলির মধ্যে সমান দক্ষতা ও সহানুভূতির সহিত বর্ণিত হইয়াছে।
ইহাদের মধ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলের পল্লীজীবনের যে আলেখ্য ফুটিয়াছে, তাহাও অপরূপ। এই পল্লীজীবনের পটভূমিতে নায়কনায়িকাদের প্রেম মনোহর বর্ণচ্ছটায় রঞ্জিত হইয়াছে এবং তাঁহার রূপায়ণে একটি নবতর লাবণ্য ফুটিয়া উঠিয়াছে। এই গীতিকাগুলিতে যেন প্রকৃতি ও মানবহৃদয় একাত্ম হইয়া গিয়াছে, কবিরা প্রকৃতিবর্ণনার মধ্য দিয়া আশ্চর্য কৌশলে মানুষের নিগূঢ় হৃদয়রহস্যকে উদ্ঘাটিত করিয়াছেন।
মানুষের নানা অনুভূতি এই গীতিকাগুলির মধ্যে সার্থক অভিব্যক্তি লাভ করিয়াছে। রূপমোহ, অন্তরের আলোড়ন, মিলনের আকুতি, বিরহের জ্বালা এবং বিদায়ের হাহাকার-সমস্ত কিছুকেই কবিরা আশ্চর্য কুশলতার সহিত জীবন্ত করিয়া
তুলিয়াছেন। এই সমস্ত ভাবের বর্ণনায় যেমন তাঁহাদের কবিত্বশক্তির নিদর্শন। মিলে, অপরদিকে তেমনি জীবন সম্বন্ধে তাঁহাদের গভীর ও বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞতারও পরিচয় পাওয়া যায়।
এই গীতিকাগুলির ভাষা অমার্জিত ও গ্রাম্য পূর্ববঙ্গীয় কথ্যভাষা। কিন্তু ইহাতেই অপরিসীম কাব্যসৌন্দর্য ফুর্ত হইয়াছে। এই ভাষার মধ্যদিয়া যেন আমরা রূপকথার জগতে উত্তীর্ণ হই। ইহার মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যাংশগুলি যেন রূপকথার মায়াঞ্জনজড়িত; অথচ সেগুলি যেমনই স্বাভাবিক, তেমনই প্রাণবন্ত।
মোটের উপর, ময়মনসিংহ-গীতিকা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য। ইহাদের মধ্যে মানুষের হৃদয়ানুভূতি, মানুষের সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য এই তিন উপাদানের সমন্বয়ে এক সজীব ব্যঞ্জনাময় কবিত্ব-স্বর্গ রচিত হইয়াছে। এই স্বর্গ যাহারা রচনা করিয়াছিলেন, তাঁহারা যে পণ্ডিত, সংস্কৃতিবান নাগরিক কবিগোষ্ঠী নহেন, সুদূর গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত কবি-সম্প্রদায়–ইহা ভাবিয়া আমরা বিস্ময় অনুভব করি।
ময়মনসিংহ ব্যতীত পূর্ববঙ্গের অন্য কোন অঞ্চলেও অনেকগুলি গাথার সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। ইহাদের অধিকাংশই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক প্রকাশিত ‘পূর্ববঙ্গ-গীতিকা’ গ্রন্থে সংকলিত হইয়াছে। কোন কোনটি পূর্বেই মুদ্রিত হইয়াছিল।
এই গীতিকাগুলি ময়মনসিংহ-গীতিকার অন্তর্ভুক্ত গাথাগুলির সমপর্যায়ভুক্ত না হইলেও উপভোগ্য। ইহাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মনোরম ও জনপ্রিয় গাথা ‘ভেলুয়া সুন্দরী।
১৮
ভারতচন্দ্র রায়
ভারতচন্দ্র প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। শুধু তাহাই নয়, জনপ্রিয়তার দিক দিয়া আঁহার সমকক্ষ কবি এ পর্যন্ত বাংলাদেশে খুব কমই আবির্ভূত হইয়াছেন। ১৭১০ খ্রীষ্টাব্দের মত সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার আদি নিবাস ছিল বর্তমান হুগলি জেলার অন্তর্গত ভুরশুট পরগণার পাণ্ডুয়া বা পেঁড়ো গ্রামে। ভারতচন্দ্র মুখুজ্জ্যে-বংশীয় ব্রাহ্মণ। তাঁহার বংশ রাজবংশ হইলেও বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্ৰ কবির পিতা নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের নিকট হইতে রাজ্য কাড়িয়া লওয়ার ফলে তাহাদের অবস্থা খারাপ হইয়া পড়ে। ভারতচন্দ্রের প্রথম জীবন দুঃখকষ্টেই অতিবাহিত হয়। তাহা সত্ত্বেও তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং ব্যাকরণ, অলংকার, পুরাণ, আগম প্রভৃতি শাস্ত্রের বিশারদ হন। বাংলা ও সংস্কৃত ভিন্ন হিন্দী, উড়িয়া ও ফার্সী ভাষাতেও তিনি ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। অল্প বয়স হইতেই তিনি কবিত্বশক্তিরও পরিচয় দেন। প্রথম যৌবনে তিনি ঘটনাচক্রে এক সন্ন্যাসীর দলের সঙ্গে মিশিয়া যান এবং নানা দেশে ভ্রমণ করেন। অবশেষে আত্মীয় ও কুটুম্বদের নিবন্ধে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন এবং চন্দননগরের ফরাসী সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মারফতে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আশ্রয়লাভ করেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাহাকে সভাকবির পদে নিয়োগ করেন; তিনি ভারতচন্দ্রকে ‘রায়গুণাকর’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং অনেক ভূসম্পত্তি দান করিয়া মূলাজোড় গ্রামে স্থিত করান। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রেরই আদেশে ভারতচন্দ্র ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতচন্দ্রের মৃত্যু হয়।
অন্নদামঙ্গলই ভারতচন্দ্রের রচিত শ্রেষ্ঠ কাব্য। ১৬৬৪ শকাব্দে (১৭৪২-৪৩ খ্রষ্টাব্দ) বাংলার নবাব আলীবর্দী রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে বার লক্ষ টাকা নজরানা চান এবং কৃষ্ণচন্দ্র তাহা না দিতে পারায় তাঁহাকে বন্দী করেন। কারাগারে দেবী অন্নপূর্ণা তাঁহাকে স্বপ্নে দেখা দিয়া বলেন যে তিনি যেন তাঁহার সভাকবি ভারতচন্দ্রকে তাঁহার মাহাত্মবর্ণনামূলক কাব্য রচনা করিতে বলেন। মুক্ত হইয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভারতচন্দ্রকে ঐ কাব্য রচনা করিতে বলেন এবং তদনুসারে ভারতচন্দ্র ‘অন্নদামঙ্গল’ লেখেন; ১৬৭৪ শকাব্দে (১৭৫২-৫৩ খ্রীষ্টাব্দ) এই কাব্য সম্পূর্ণ হয়। এই কাব্য তিনটি খণ্ডে বিভক্ত; প্রথম খণ্ডে কৃষ্ণচন্দ্রের বিপন্মুক্তি অবলম্বনে অন্নদার মাহাত্ম্য বর্ণনা, কাব্য রচনার উপলক্ষ বর্ণনা, শিবের উপাখ্যান বর্ণনা এবং কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের বাসভবনে অন্নদার আগমনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ হইয়াছে। দ্বিতীয় খণ্ডে পাই ‘কালিকামঙ্গল অর্থাৎ ‘বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যান। তৃতীয় খণ্ডের নাম ‘মানসিংহ’। ইহাতে ভবানন্দ মজুমদারের ইতিহাস, মানসিংহ কর্ত্তৃক প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করার কাহিনী এবং অন্নদার মহিমা বর্ণিত হইয়াছে। প্রথম খণ্ডটি অত্যন্ত সরস; এই খণ্ডে শিব, অন্নপূর্ণা, নারদ, মেনকা প্রভৃতি দেবচরিত্রগুলিও মানবতাগুণে মণ্ডিত হইয়াছে; মানবচরিত্রগুলির মধ্যে ঈশ্বরী পাটনী জীবন্ত ও উপভোগ্য। দ্বিতীয় খণ্ডে ‘বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী ভারতচন্দ্রের প্রতিভার স্পর্শে অনুপম লাবণ্য লাভ করিয়া রূপায়িত হইয়াছে; ইহার মধ্যে স্থানে স্থানে অশ্লীলতাদোষ থাকিলেও ইহার বর্ণনাভঙ্গীর মনোহারিত্ব সকলকেই মুগ্ধ করে; ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দরে’ বিগতযৌবনা দূতী হীরা মালিনীর দুষ্ট চরিত্রটি যেরূপ জীবন্ত হইয়াছে, তাঁহার তুলনা বিরল। তৃতীয় খণ্ড মানসিংহ বাহ্যত ঐতিহাসিক কাব্য হইলেও আদর্শ ঐতিহাসিক কাব্যের লক্ষণ ইহাতে দেখা যায় না, কারণ ইহাতে বর্ণিত কাহিনীটির মধ্যে তথ্যের সহিত কল্পনার নির্বিচার সংমিশ্রণ হইয়াছে এবং ইতিহাসের পরিবেশ ইহার মধ্যে জীবন্ত হয় নাই; তবে এই খণ্ডটি বেশ সরস ও সুখপাঠ্য; ইহাতে বর্ণিত ঘেসেড়ানী, দাসু, বাসু প্রভৃতি গৌণচরিত্রগুলি বেশ জীবন্ত হইয়াছে। ইহার মধ্যে যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহা খুবই উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। ‘অন্নদামঙ্গলে’র ভাষা অত্যন্ত স্বচ্ছ, সাবলীল ও বৈদগ্ধ্যপূর্ণ। ভারতচন্দ্র প্রথম শ্রেণীর হাস্যরসিক ছিলেন এবং শ্লেষ ও যমক সৃষ্টিতে তাঁহার অসামান্য দক্ষতা ছিল। তাঁহার এই বৈশিষ্ট্যগুলির পরিচয় ‘অন্নদামঙ্গলে’ পূর্ণমাত্রায় বর্তমান। ছন্দের ক্ষেত্রেও ভারতচন্দ্র এই কাব্যে অপরূপ নৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়াছেন; বহু সংস্কৃত ছন্দকে তিনি এই কাব্যে বাংলা ভাষায় প্রথম প্রয়োগ করিয়াছেন। মোটের উপর, ‘অন্নদামঙ্গলের বহিরাঙ্গিকের লাবণ্য অতুলনীয়। অবশ্য ইহার মধ্যে গভীরতার খানিকটা অভাব লক্ষিত হয়। তবে ইহার মধ্যে যে গানগুলি রহিয়াছে, তাহাদের মধ্যে মাধুর্য ও ভাবগভীরতার নিদর্শন পাই। ‘অন্নদামঙ্গল’ তাঁহার অসামান্য গুণগুলির জন্য শতাধিক বর্ষ ধরিয়া বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় কাব্যের আসন অধিকার করিয়াছিল। ‘অন্নদামঙ্গল’-এর মধ্যে কিয়ৎপরিমাণে আধুনিক যুগের দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তাভাবনার পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
ভারতচন্দ্রের অন্যান্য রচনাগুলি আয়তনে ক্ষুদ্র। তিনি দুইটি ‘সত্যনারায়ণের পাঁচালী’ রচনা করিয়াছিলেন; একটি ত্রিপদী ছন্দে, অপরটি চৌপদী ছন্দে লেখা; দ্বিতীয়টি ১১৪৪ সনে (১৭৩৭-৩৮ খ্রীষ্টাব্দে) রচিত হয়। তাঁহার আর একটি কাব্য ‘রসমঞ্জরী’, ইহা মৈথিল কবি ভানুদত্তের ‘রসমঞ্জরী’ নামক নায়ক-নায়িকার লক্ষণ বর্ণনামূলক গ্রন্থের অনুবাদ; ইহা ১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে রচিত হইয়াছিল। তাঁহার ‘নাগাষ্টক’ কাব্যে আটটি সংস্কৃত শ্লোক ও তাহাদের বঙ্গানুবাদ রহিয়াছে; দুই একটি শ্লোক দ্ব্যর্থমূলক; এক অর্থে কালীয়নাগের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কালীয়দের জীবজন্তুরা কৃষ্ণের কাছে অভিযোগ জানাইতেছে, দ্বিতীয় অর্থে মূলাজোড় গ্রামের পত্তনিদার রামদেব নাগের (বর্ধমানরাজের কর্মচারী) অত্যাচারের বিরুদ্ধে ভারতচন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে অভিযোগ জানাইতেছেন; এই কাব্যটি পড়িয়া কৃষ্ণচন্দ্র রামদেব নাগের অত্যাচার নিবারণ করিয়াছিলেন। এই বইগুলি ভিন্ন ভারতচন্দ্র সংস্কৃত ভাষায় একটি ‘গঙ্গাষ্টক’ লিখিয়াছিলেন এবং হিন্দী, বাংলা ও সংস্কৃত তিন ভাষা মিলাইয়া ‘চণ্ডী-নাটক’ নামে একটি নাটক লিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন; ইহা সম্পূর্ণ হয় নাই। ইহা ব্যতীত ভারতচন্দ্র নিতান্ত লৌকিক বিষয়বস্তু লইয়া ‘বসন্ত বর্ণনা’, ‘বর্ষাবর্ণনা’, ‘বাসনাবর্ণনা’, ‘ধেড়ে ও ভেড়ে’ প্রভৃতি কয়েকটি ছোট বাংলা কবিতা রচনা করিয়াছিলেন; তাঁহার পূর্বে এই জাতীয় কবিতা এদেশে আর কেহ লেখেন নাই।
১৯
রামপ্রসাদ সেন ও তাঁহার অনুবর্তী কবিগোষ্ঠী
রামপ্রসাদ সেন ভারতচন্দ্রের সমসাময়িক এবং তিনিও বাংলার শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় কবিদের অন্যতম। রামপ্রসাদ ১৭২০ খ্রীষ্টাব্দের মত সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জাতিতে বৈদ্য। তাঁহার পিতার নাম রামরাম সেন। বর্তমান ২৪ পরগণা জেলার অন্তর্গত হালিসহর-কুমারহট্ট গ্রাম রামপ্রসাদের নিবাসভূমি। অল্প বয়স হইতেই রামপ্রসাদ কবিতা রচনায়, বিশেষত শ্যামাসঙ্গীত রচনায় দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি প্রথম হইতেই তাঁহার ইষ্টদেবী কালীর ভক্ত সাধক, বিষয়-কর্মে তাঁহার তেমন মন ছিল না। তাঁহার রচিত গানগুলি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা দেশে জনপ্রিয় হইয়া উঠে এবং তাঁহার প্রতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি ও অনেক ভূসম্পত্তি দান করেন। তিনি রামপ্রসাদকে ভঁহার সভাকবির পদেও নিয়োগ করিতে চাহেন; বিষয়াসক্তিহীন রামপ্রসাদ তাহাতে সম্মত হন নাই। দীর্ঘকাল সাধনা ও কাব্য রচনার মধ্য দিয়া অতিবাহিত করিবার পরে রামপ্রসাদ ১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দের মত সময়ে পরলোকগমন করেন।
রামপ্রসাদের রচনাবলীর মধ্যে দেবীবিষয়ক গানগুলিই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আধুনিক কালে এই গানগুলিকে ‘শাক্ত পদাবলী’ নাম দেওয়া হইয়াছে। দেবীবিষয়ক গানগুলি দুইভাগে বিভক্ত–(১) বাৎসল্যরসাত্মক, (২) ভক্তিরসাত্মক। বাৎসল্যরসাত্মক গানগুলিতে শক্তিদেবী হিমালয় ও মেনকার কন্যা হইয়া দেখা দিয়াছেন এবং তাঁহার বাল্যলীলা, আগমনী ও বিজয়া এই গানগুলির মধ্যে বর্ণিত হইয়াছে। এই গানগুলি অপূর্ব সুধানির্যাসে ভরপুর। মেনকার মাতৃহৃদয়ের স্নেহ ও ব্যাকুলতা গানগুলিতে যেরূপ মর্মস্পর্শীভাবে প্রকাশিত হইয়াছে, তাঁহার তুলনা বিরল। আগমনী-গানে তিন দিনের জন্য উমার পিতৃগৃহে আগমনে মেনকার অপার আনন্দ বর্ণিত হইয়াছে এবং বিজয়া-গানে তিন দিনের অবসানে উমার বিদায়ে মেনকার বেদনা বর্ণিত হইয়াছে। তখনকার দিনে বাঙালী পিতামাতারা নববিবাহিতা বালিকা কন্যাদের পিতৃগৃহে আগমন ও শ্বশুরালয়ে প্রত্যাবর্তনের সময়ে ঠিক এইরূপ আনন্দ ও বেদনা অনুভব করিত। তাঁহারই প্রতিধ্বনি আগমনী ও বিজয়া গানগুলির মধ্যে শোনা যায়। রামপ্রসাদই এই অপূর্ব বাৎসল্যরসাত্মক গানের আদি রচয়িতা এবং তিনিই ইহাদের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা।
রামপ্রসাদের ভক্তিরসাত্মক দেবীবিষয়ক গানগুলিতে শক্তিদেবী কালীর রূপে দেখা দিয়াছেন। এই গানগুলির মধ্য দিয়া ভক্ত কবি-সন্তান যেমন জননীকে ভালোবাসা জানায়, তেমনিভাবেই দেবীকে মাতৃরূপে কল্পনা করিয়া তাঁহার ভালোবাসা জানাইয়াছেন। এইরূপ অনাবিল অকৃত্রিম ভালোবাসার মধ্য দিয়া আরাধ্যের প্রতি ভক্তি-নিবেদন বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত দুর্লভ। বৈষ্ণব পদাবলীর রাধার মধ্যেও অবশ্য আমরা ভালোবাসার ভিতর দিয়া পূজারই নিদর্শন পাই, কিন্তু সে প্রেম কান্তাপ্রেম,–শুধু তাহাই নয়, পরকীয়া প্রেম। এই কারণের জন্য এবং সে প্রেম সামাজিক বিধিনিষেধের দ্বারা বারিত বলিয়া তাঁহার আবেদন ততটা ব্যাপক নহে। কিন্তু রামপ্রসাদের গানের মধ্যে যে ভাব অভিব্যক্ত হইয়াছে, তাহা যেমনই পবিত্র, তেমনই মধুর। তাঁহার আবেদন সর্বসাধারণের মধ্যেই পরিব্যাপ্ত। কতকগুলি গানে রামপ্রসাদ অবোধ শিশুর মত তাঁহার শ্যামা-মাতার কাছে আবদার করিয়াছেন, এমনকি কোন কোন গানে তিনি শ্যামা-মাতাকে ভর্ৎসনা ও গঞ্জনা পর্যন্ত করিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার অন্তরের সরলতা ও ভক্তির অকপটতার অত্যন্ত মধুর নিদর্শন পাই। রামপ্রসাদের গানগুলির মধ্যে অত্যন্ত গভীর ভাব একান্ত অবলীলাক্রমে বর্ণিত হইয়াছে। এই গানগুলির ভাষা অত্যন্ত সরল ও প্রাঞ্জল। ইহাদের মধ্যে রামপ্রসাদ আমাদের পরিচিত লৌকিক জীবন হইতে উপমা সংগ্রহ করিয়া তদ্বারা ভাব পরিস্ফুট করিয়াছেন, এমনকি নিতান্ত জটিল দার্শনিক তত্ত্বকেও এই সব উপমার মধ্য দিয়াই তিনি রূপায়িত করিয়াছেন। ভক্তির প্রগাঢ়তা, ভাবের মাধুর্য ও অকপটতা এবং প্রকাশভঙ্গীর সরলতার জন্য রামপ্রসাদের এই গানগুলি সর্বজনপ্রিয় হইয়াছিল; এই সমস্ত গুণের জন্যই এগুলি এখনও আমাদের মুগ্ধ করে।
দেবীবিষয়ক গান ছাড়া রামপ্রসাদ কয়েকখানি গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রথম গ্রন্থ সম্ভবত ‘কালীকীর্তন’; ইহা রাজকিশোর নামে একজন ধনী ব্যক্তির আজ্ঞায় রচিত হইয়াছিল; বইটির মধ্যে অনেক মধুর পদ রহিয়াছে; তবে ইহার একটি ত্রুটি এই যে, ইহার মধ্যে কালীর লীলাকে কৃষ্ণলীলার ছাঁচে ঢালিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে এবং কৃষ্ণের মত কালীরও গোষ্ঠলীলা, রাসলীলা প্রভৃতি বর্ণিত হইয়াছে; রামপ্রসাদের এই অভিনব প্রচেষ্টকে তাঁহার গানের প্যারডি-রচয়িতা আজু গোঁসাই ব্যঙ্গ করিয়া কাঁঠালের ‘আমসত্ত্ব’ বলিয়াছিলেন। রামপ্রসাদ ‘কৃষ্ণকীর্তন’ নামেও একটি কাব্য লিখিয়াছিলেন, তাঁহার মধ্যে তিনি কৃষ্ণলীলা বর্ণনা করিয়াছিলেন; ইহার একটি মাত্র পদ পাওয়া গিয়াছে। রামপ্রসাদ শাক্ত হইলেও বৈষ্ণবদের প্রতি যে তাঁহার কোন বিদ্বেষ ছিল না, তাঁহার প্রমাণ তাঁহার ‘কৃষ্ণকীর্তন’ রচনা এবং কৃষ্ণ ও কালীর অভিন্নতা ঘোষণা করিয়া গান লেখা হইতে পাওয়া যায়। রামপ্রসাদের অপর গ্রন্থ ‘কালিকামঙ্গল’ বা ‘বিদ্যাসুন্দর’ বা
কবিরঞ্জন। কেহ কেহ মনে করেন ইহা ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর পূর্বে রচিত হইয়াছিল, কিন্তু বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ ও বহিরঙ্গ প্রমাণ হইতে বলা যায় যে রামপ্রসাদের ‘বিদ্যাসুন্দর’ ভারতচন্দ্রের মৃত্যুরও পরে রচিত হইয়াছিল। কাব্য হিসাবে রামপ্রসাদের ‘বিদ্যাসুন্দর’ ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর তুলনায় নিকৃষ্ট; ইহার মধ্যে অশ্লীলতাও ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর তুলনায় বেশি; কিন্তু রামপ্রসাদের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর একটি গুণ এই যে, ইহার প্রত্যেকটি চরিত্র জীবন্ত হইয়াছে। ইহার মধ্যে কয়েকটি কৌতুকরসাত্মক বর্ণনায়ও রামপ্রসাদ দক্ষতা দেখাইয়াছেন, যেমন ভণ্ড সন্ন্যাসীদের বর্ণনা।
রামপ্রসাদের পরে আরও অনেক কবি তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া দেবীবিষয়ক গান রচনা করেন। ইঁহাদের মধ্যে সর্বাগ্রে যাহার নাম উল্লেখযোগ্য, তিনি হইতেছেন বর্ধমানের মহারাজা তেজচন্দ্রের সভাকবি এবং ‘সাধকরঞ্জন’ নামক তান্ত্রিক যোগ নিবন্ধের রচয়িতা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। উঁহার রচিত শ্যামাসঙ্গীতগুলির মধ্যে রামপ্রসাদের গানেরই মত ভক্তির প্রগাঢ়তা, ভাবের গভীরতা ও প্রকাশভঙ্গীর সরলতার নিদর্শন মিলে। অন্যান্য শ্যামাসঙ্গীত-রচয়িতাদের মধ্যে যুগল ব্রাহ্মণ, রামানন্দ, ভৃগুরাম দাস, দ্বিজ নরচন্দ্র প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। রামপ্রসাদ সেন ছাড়া রামপ্রসাদ নামক অন্যান্য শ্যামাসঙ্গীত-রচয়িতাও আবির্ভূত হইয়াছিলেন এবং তাঁহাদের মধ্যে দ্বিজ রামপ্রসাদ’ নামক একজন ব্রাহ্মণ কবি ছিলেন। আগমনী বিজয়া গান রচনায় রামপ্রসাদের পরে সর্বাপেক্ষা দক্ষতা দেখাইয়াছেন কবিওয়ালা রাম বসু। মোটের উপর রামপ্রসাদ রচিত ভক্তিরসাত্মক ও বাৎসল্যরসাত্মক দেবীবিষয়ক গানগুলির অনুসরণে বাংলায় একটি সুবিশাল ও সমৃদ্ধ গীতি-সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল। এই সাহিত্যের ধারা সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দী ধরিয়া অপ্রতিহত গতিতে প্রবাহিত হইবার পরে বিংশ শতাব্দীতে উপনীত হইয়াও প্রাণবন্ত রহিয়াছে।
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদের পরিশিষ্ট
প্রাচীন বাংলা গদ্য
মধ্যযুগে বাংলার পদ্য সাহিত্যের যথেষ্ট উন্নতি হইলেও গদ্য সাহিত্যের বিশেষ কোন পরিচয় পাওয়া যায় না। অবশ্য নানা বৈষয়িক ব্যাপারে গদ্য লেখা প্রচলিত ছিল এবং লোকে চিরকাল গদ্যেই কথাবার্তা বলিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে সাহিত্যের পর্যায়ে পড়ে মধ্যযুগের এমন কোন বাংলা গদ্য রচনা এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। গদ্যে লেখা যাহা কিছু পাওয়া গিয়াছে তাহা নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
(ক) সংস্কৃত সূত্রের ন্যায় কতকগুলি ছোট ছোট বাক্য–অনেকগুলিই দুর্বোধ্য প্রহেলিকার মত মনে হয়। দৃষ্টান্ত :
“পশ্চিম দুয়ারে কে পণ্ডিত–সেতাই জে
চারিসত্ৰ গতি আনি লেখ্যা।”
“হে কালিন্দিজল বার ভাই বার আদিত্ত।
হথে পাতি লহ সেবকর অর্ঘ পুষ্পপাণি। সেবক হব সুখি আমনি ধীমাৎ কন্নি”।
এ দুইটি শূন্য পুরাণ হইতে উদ্ধৃত। কেহ কেহ বলেন এই গ্রন্থ ত্রয়োদশ শতকে রচিত হইয়াছিল। কিন্তু অনেকের মতে ইহার রচনা কাল অষ্টাদশ শতকের পূর্বে নহে।
(খ) শ্রীচৈতন্যদেবের প্রিয় ভক্ত রূপ গোস্বামী বিরচিত কারিকা’ বলিয়া কথিত গ্রন্থ। রূপ গোস্বামী ষোড়শ শতাব্দীর লোক–কিন্তু তিনিই ইহার রচয়িতা কিনা সে বিষয়ে অনেকে সন্দেহ করেন। ইহার ভাষার নমুনা : “আগে তারে সেবা। তার ইঙ্গিতে তৎপর হইয়া কার্য করিবে। আপনাকে সাধক অভিমান ত্যাগ করিবে।”
(গ) সপ্তদশ শতাব্দীর রচনা “জ্ঞানাদি সাধনা” একখানি সহজিয়া সম্প্রদায়ের গ্রন্থ। ইহাতে জীবের জন্ম সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ আছে। দীনেশচন্দ্র সেন ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত ইহার একখানি পুঁথি হইতে যে অংশ উদ্ধৃত করিয়াছেন তাঁহার ভাষার নমুনা :
“পরে সেই সাধু কৃপা করিয়া সেই অজ্ঞান জনকে চৈতন্য করিয়া তাঁহার শরীরের মধ্যে জীবাত্মাকে প্রত্যক্ষ দেখাইয়া পরে তাঁহার বাম কর্ণেতে শ্রীচৈতন্য মন্ত্র কহিয়া পরে সেই চৈতন্য মন্ত্রের অর্থ জানাইয়া পরে সেই জীব দ্বারা দশ ইন্দ্রিয় আদি যুক্ত নিত্য শরীর দেখাইয়া পরে সাধক অভিমানে শ্রীকৃষ্ণাদির রূপ আরোপ চিন্তাতে দেখাইয়া পরে সিদ্ধি অভিমান শ্রীকৃষ্ণাদির মুক্তি পৃথক দেখাইয়া প্রেম লক্ষণার সমাধি ভক্তিতে সংস্থাপন করিলেন।” দীনেশচন্দ্রের মতে ইহা সম্ভবত সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে রচিত। [বঙ্গ-সাহিত্য পরিচয় দ্বিতীয় খণ্ড, ১৬৩০-৩৭ পৃ.]
(ঘ) অষ্টাদশ শতাব্দীর রচনা
অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোচবিহারের রাজমুন্সী জয়নাথ ঘোষের ‘রাজোপাখ্যান’ গ্রন্থের ভাষার নমুনা :
“শ্রীশ্রীমহারাজা ভূপ বাহাদুরের বাল্যকাল অতীত হইয়া কিশোরকাল হইবাই, পার্শী বাঙ্গলাতে স্বচ্ছন্দ আর খোশখত অক্ষর হইল সকলেই দেখিয়া ব্যাখ্যা করেন বরং পার্শীতে এমত খোঝনবিস লিখক সন্নিকট নাহি চিত্রেতে অদ্বিতীয় লোক সকলের এবং পশু পক্ষী বৃক্ষ লতা পুষ্প তৎস্বরূপ চিত্র করিতেন অশ্বারোহণে ও গজচালানে অদ্বিতীয়।” [বঙ্গ-সাহিত্য পরিচয় দ্বিতীয় খণ্ড, ১৬৭৮ পৃ.]
১৭৭৫ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত ‘ভাষা-পরিচ্ছেদ’ নামক সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ : “গৌতম মুনিকে শিষ্য সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন আমাদিগের মুক্তি কি প্রকারে হয় তাহা কৃপা করিয়া বলহ। তাহাতে গৌতম উত্তর করিতেছেন তাবৎ পদার্থ জানিলে মুক্তি হয়।”
ইহার ভাষা প্রাঞ্জল এবং ইহা গদ্যরীতির সূচনা বলিয়া গ্রহণ করা যায়।
প্রায় সমসাময়িক ‘বৃন্দাবনলীলা’ গ্রন্থে গদ্য ভাষা আরও একটু উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে :
(কৃষ্ণচন্দ্র) “যে দিবস ধেনু লইয়া এই পর্বতে গিয়াছিলেন সে দিবস মুরলির গানে যমুনা উজান বহিয়াছিলেন এবং পাষাণ গলিয়াছিলেন।”
নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের একখানি দানপত্র পাওয়া গিয়াছে। [ইহার তারিখ ১১৬৫ সন ৪ ফাল্গুন। (সাহিত্যসাধক চরিতমালা নবম খণ্ড)]
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অষ্টাদশ শতাব্দীতে লিখিত ‘স্মৃতি কল্পদ্রুম’ নামে একখানি বাংলা গদ্য গ্রন্থের উল্লেখ করিয়াছেন। [শ্রীচণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত ৪র্থ সংস্করণ ১১৮-১৯ পৃষ্ঠা]
(ঙ) চিঠিপত্রের ভাষা
ইহা ষোড়শ শতাব্দীতেই অনেকটা উন্নত হইযাছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ১৫৫৫ খ্রীষ্টাব্দে অহোম রাজ্যের রাজাকে লিখিত কোচবিহার মহারাজার পত্র হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।
“এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্ছা করি। অখন তোমার আমার সন্তোষ সম্পাদক পত্রপত্রি গতায়াত হইলে উভয়ানুকূল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রহে।”
১৬৮২ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত আর একটি পত্র হইতে কিছু অংশ উদ্ধৃত করিতেছি, “কএক দিবস হইল তথাকার মঙ্গলাদি পাই নাই। মঙ্গলাদি লিখিয়া আপ্যায়িত করিবেন… মহাশয় আমার কত্তা আমি ছাওল আমার দোষসকল আপনকার মাপ করিতে হয়।”
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে (১৭৭১ ও ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দ) লিখিত মহারাজা নন্দকুমারের দুইখানি সুদীর্ঘ পত্র পাওয়া গিয়াছে। ইহাতে কিছু ফারসী শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, কিন্তু মোটের উপর প্রাঞ্জল গদ্য ভাষা। শ্রীযুক্ত পঞ্চানন মণ্ডল সম্পাদিত ‘চিঠিপত্রে সমাজ চিত্র’ নামক পত্ৰসঙ্কলনে অষ্টাদশ শতাব্দীর অনেক চিঠি আছে। এইগুলি হইতে দেখা যায় যে তখন বাংলা গদ্য লিখিবার একটি রীতি ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠিতেছে।
(চ) খ্রীষ্টীয় মিশনারীর রচনা
সাধারণ লোকের মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য পর্তুগীজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় মিশনারীগণ যত্নপূর্বক বাংলা শিখিতেন ও বাংলায় ছোট ছোট পুস্তিকা লিখিয়া খ্রীষ্টের মাহাত্ম প্রচার করিতেন। সপ্তদশ শতকে পর্তুগীজ মিশনারীরা বাংলা অভিধান ও ব্যাকরণ রচনা করিয়াছিলেন। ষোড়শ শতকের শেষভাগে বাংলা গদ্যে দুইখানি পুস্তিকা লিখিত হইয়াছিল বলিয়া শোনা যায়। কিন্তু এই সমুদয় পুস্তক এখন আর পাওয়া যায় না। এই শ্রেণীর যে সকল গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে তাঁহার মধ্যে সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ ‘ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’। ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দে এই বইখানি রচিত হয়। ইহার রচয়িতা ভূষণার (পূর্ব পাকিস্তানে) এক সম্ভ্রান্ত বংশে জাত খ্রীষ্টধর্ম্মান্তরিত বাঙালী হিন্দু। বাল্যকালে (১৬৬৩ খ্রীষ্টাব্দে) আরাকানের জলদস্যুরা তাহাকে অপহরণ করে। একজন পর্তুগীজ মিশনারী তাহাকে অর্থ দিয়া ক্রয় করিয়া খ্রীষ্টানধর্ম্মে দীক্ষিত করেন। তখন তাঁহার নাম হয় দোম আন্তোনিও (Dom Antonio)। এই গ্রন্থে একজন ব্রাহ্মণ ও রোমান ক্যাথলিক খ্রীষ্টানের মধ্যে কথাবার্তার অবতারণা করিয়া তিনি খ্ৰীষ্টধর্ম্মের মহিমা কীর্তন করিয়াছেন। ইহার ভাষার একটু নমুনা দিতেছি।
“রামের এক স্ত্রী তাহান নাম সীতা, আর দুই পুত্রো লব আর কুশ তাহান ভাই লকোন। রাজা অযোধ্যা বাপের সত্যো পালিতে বোনবাসী হইয়াছিলেন, তাহাতে তাহান স্ত্রীরে রাবোণে ধরিয়া লিয়াছিলেন, তাহান নাম সীতা, সেই স্ত্রীরে লঙ্কাত থাকা আনিতে বিস্তর যুৰ্দো করিলেন।”
আর একখানি মিশনারী গ্রন্থ ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’। মনোএল-দা-আস-সূম্পসাঁম (Manoel Da Assumpcam) নামক এক পর্তুগীজ পাদ্রী ১৭৩৪ সালে ঢাকার নিকটবর্তী ভাওয়ালে বসিয়া এই গ্রন্থ রচনা করেন। ইহার ভাষার একটু নমুনা দিতেছি।
“লুসিয়া এত দুঃখের মধ্যে একলা হইয়া রোদন করিয়া ঠাকুরাণীর অনুগ্রহ চাহিল : কহিল : ও করুণাময়ী মাতা, আমার ভরসা তুমি কেবল; মুনিষ্যের অলক্ষ্য আছি আমি; তথাচ আশা রাখি যে তুমি আমারে উপায় দিবা। আমার কেহ নাহি, কেবল তুমি আমার, এবং আমি তোমার; আমি তোমার দাসী; তুমি আমার সহায়, আমার লক্ষ্য আমার ভরসা। তোমার আশ্রয়ে বিস্তর পাপী অধমে, যেমত আমি, উপায় পাইল। তবে এত অধমেরে যদি উপায় দিলা, আমারেও উপায় দিবা। ইহা নিবেদন করিল।”
এই দুই গ্রন্থের ভাষার গুণাগুণ বিচার করিবার পূর্বে স্মরণ রাখিতে হইবে যে এগুলি বাংলা-কিন্তু রোমান হরফে লেখা। সুতরাং ‘লক্ষ্মণ’-এর পরিবর্তে লকোন, ‘যুদ্ধ’-র পরিবর্তে যুদো প্রভৃতি ভুল নহে, মূলে হয়ত শুদ্ধই ছিল।
মোটের উপর এই দুই গ্রন্থ হইতেও প্রমাণিত হয় যে সপ্তদশ শতকের শেষ ও অষ্টাদশ শতকের প্রথমে এবং সম্ভবত ইহার পূর্বেই বাংলা গদ্যভাষার যে একটি সরল প্রাঞ্জল রূপ ছিল তাহা সর্বাংশে সাহিত্যের উপযোগী। দেশীয় প্রবীণ সাহিত্যিকরা ইচ্ছা করিলে গদ্যে উৎকৃষ্ট রচনা করিতে পারিতেন। কিন্তু যে কোন কারণেই হউক তাঁহারা কবিতায় লেখা পছন্দ করিতেন। সম্ভবত পাঁচালী প্রভৃতি গানের মধ্য দিয়া কাব্য জনপ্রিয় হইয়াছিল-সহজ কথাবার্তার ভাষায় সাহিত্য রচনার সে যুগে আর হয় নাই। যাহাই হউক, উল্লিখিত দুইখানি মিশনারী গ্রন্থের জন্য বাংলা সাহিত্য পর্তুগীজদের নিকট ঋণী। পাদ্রী মনোএলের আরও একখানি গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে। ইহার প্রথমভাগে বাংলা ব্যাকরণের মূল সূত্র ব্যাখ্যা করা হইয়াছে এবং দ্বিতীয় ভাগে বাংলা-পর্তুগীজ ও পর্তুগীজ-বাংলা শব্দকোষ প্রদত্ত হইয়াছে। এই তিনখানি গ্রন্থই বাংলাভাষার সর্বপ্রাচীন মুদ্রিত গ্রন্থের সম্মান দাবি করিতে পারে। পর্তুগীজদের নিকট আমাদের ঋণ আরও আছে। ভারতে তাহারাই প্রথমে মুদ্রণ-যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে-গোয়া শহরে ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে। পর্তুগীজরা যে এদেশে নূতন নূতন ফল ফুল আমদানি করিয়াছিল তাহা দ্বাদশ পরিচ্ছেদে বলা হইয়াছে। সাধারণ ব্যবহারের অনেক দ্রব্যও বাংলাভাষায় পর্তুগীজ নামে পরিচিত–যেমন ছবি, ফিতা, আলমারি, চাবি, বোতাম, বোতল, পিস্তল, বয়াম, বয়া, মাস্তুল, বালতী, পেরেক, সাবান, তোয়ালে, আলপিন ইত্যাদি। ইস্ত্রি, আয়া, মিস্ত্রী, নিলাম, দরজা, জানালা, গরাদে, কামরা, কেদারা, মেজ প্রভৃতি শব্দও পর্তুগীজ।
আরবী ও ফার্সীভাষার বহু শব্দ যে বাংলাভাষায় গৃহীত হইয়াছে তাহাতে আশ্চর্য বোধ করিবার কিছু নাই, কারণ ফার্সী ছিল মধ্যযুগে দরবারের ভাষা ও সম্ভ্রান্ত মুসলমানগণের কথ্য ভাষা। সুতরাং বিভিন্ন প্রাদেশিক হিন্দুভাষায়ও তাঁহার বহু শব্দ স্থায়ী আসন লাভ করিয়াছে। অষ্টাদশ শতাব্দী ও তাঁহার পরে অনেক ইংরেজী শব্দও বাংলাভাষার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। এইভাবে মধ্যযুগে বাংলাভাষা বিদেশীভাষার সাহায্যে সমৃদ্ধিলাভ করিয়াছে।