বলামাত্র সদানন্দ রাজি হইল না, তবে শেষ পর্যন্ত রাজি সে হইয়া গেল। তবে একটা চুক্তি সে করিল বড় খাপছাড়া। প্রথমটা আরম্ভ করিল যেন একটু সলজ্জভাবে, সঙ্কোচের সঙ্গে, বিপিনের হাঁটুর দিকে তাকাইয়া, আমার সব কথা শুনে চলবি?
না।
আর খানিকটা চোখ তুলিয়া সদানন্দ বলিল, কোনো বিষয়ে আমায় জ্বালাতন করবি না?
করব।
আর খানিকটা তুলিয়া; আমার কাছে কিছু গোপন করবি না?
করব।
তখন সোজাসুজি চোখের দিকে চাহিয়া সদানন্দ বলিল, আরেকটা কাজ করতে হবে আমার জন্যে। মাধুকে আমার চাই।
মাধুকে তোর চাই? কি করবি মাধুকে দিয়ে–ও!
বিপিন হাঁ করিয়া সদানন্দের দিকে চাহিয়া রহিল। এ রকম সদানন্দের সঙ্গে তার কোনোদিন পরিচয় ছিল না। মাধবীলতার জন্য আকর্ষণ অনুভব করা অবস্থাবিশেষে সদানন্দের পক্ষে সম্ভব, অবস্থাবিশেষে হঠাৎ মাথাটা তার মাধবীলতার জন্য খারাপ হইয়া যাওয়াও অসম্ভব নয়, কিন্তু এভাবে কোনো মেয়েমানুষকে চাওয়ার মানুষ সে নয়। যদি বা মনে মনে চায়, লজ্জায়, দুঃখে, ঘৃণায়, লোকের কাছে মুখ দেখাইতে তার অস্বস্তি বোধ হওয়া উচিত। বিপিন নিজেই দারুণ অস্বস্তি বোধ করিতে থাকে, সে স্পষ্টই বুঝিতে পারে, মাধুকে পাওয়া সম্বন্ধে চেষ্টা করিবার কথা না দিলে সদানন্দ ফিরিয়া যাইবে না।
কিন্তু মাধুর যে বিয়ে হয়ে গেছে?
তাতে কি?
তাতে কি? তাতে কি? তুই একটা পাঁঠা সদা, আস্ত পাঠা। আগে বলিস নি কেন, বিয়ের আগে? তোর কথায় যখন উঠত বসত?
সদানন্দের চোখ জ্বলিয়া উঠিল–এ জ্যোতি বিপিন চেনে। মানুষকে খুন করবার আগে মানুষের চোখে এ জ্যোতি দেখা দেয়–কি জানিস বিপিন, আগে মেয়েটাকে বড় মায়া করতাম, তখন কি জানি এমন পাজি শয়তান মেয়ে, তলে তলে এমন বজ্জাত! একটা রাত্রির জন্য ওকে শুধু আমি চাই, ব্যস, তারপর চুলোয় যাক, যা খুশি করুক, আমার বয়ে গেল। ওর অহঙ্কারটা ভাঙতে হবে।
এবার বিপিন যেন ব্যাপারটা খানিক খানিক বুঝিতে পারে। মাধবীলতা হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে, তাই সদানন্দের এত জ্বালা। নিজে সে যাচিয়া মাধবীলতাকে প্রত্যাখ্যানের অধিকার দিয়াছে, তাই আজ প্রত্যাখ্যানের জ্বালা সহ্য হইতেছে না, নয়তো তাকে অবহেলা করার অধিকার কোনো মেয়ের আছে, এ ধারণাই সদানন্দের মনে আসিত কিনা সন্দেহ। নিজে সে মাধবীলতাকে বড় করিয়াছে, মাধবীলতাকে অধিকার দিয়াছে অনেক, নিজের উপভোগের স্বাদ বাড়ানোর জন্য নিজের কামনাকে জোরালো করিয়াছে, ব্যাপক করিয়াছে। নয়তো কে ভাবিত মাধবীলতার কথা
–কেবল মাধবীলতার কথা নয়, সে কি করে না করে আর ভাবে না ভাবে তা পর্যন্ত! বড়জোর একদিন তার কাছে মুচকি হাসির সঙ্গে আফসোস করিয়া বলিত, ঘুড়িটা বড় ফসকে গেল রে বিপিন!
নূতন করিয়া সদানন্দকে আশ্রমে প্রতিষ্ঠা করিয়া এই ব্যাপারটা নিয়াই বিপিন মাথা ঘামায়। সদানন্দের সম্বন্ধে মহেশ চৌধুরীর কয়েকটা মন্তব্যও সে যেন কম বেশি বুঝিতে পারে। সদানন্দের সংযম সত্যই অসাধারণ ছিল, কারণ তার মধ্যে সমস্তই প্রচণ্ড শক্তিশালী, অসংযম পর্যন্ত। কেবল তাই নয়, সংযমও তার মাঝে মাঝে ভাঙিয়া পড়ে। কামনার যার এমনিই জোর নাই, ভিতর হইতে যার মধ্যে বোমা ফাটিবার মতো উপভোগের সাধ কোনোদিন ঠেলা দেয় নাই, আত্মজয়ের তো তার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সদানন্দের মতো মানুষ, অতি অল্প বয়সেই যারা নিজের উপর অধিকার হারাইয়া বিগড়াইয়া যাইতে আরম্ভ করে, তার পক্ষে তো হঠাৎ কদাচিৎ অন্যায় করিয়া ফেলিয়াও অন্যায় না করিয়া বাঁচিয়া থাকা, অন্যায় করার অসংখ্য সুযোগের মধ্যে অন্যায় করার সাধ দমন করিয়া চলা, আত্মোপলব্ধির সাংঘাতিক সাধনায় ব্যাপৃত থাকার মতো মনের জোর বজায় রাখা তো সহজ ব্যাপার নয়। সদানন্দের অনেক দুর্বলতা, অনেক পাগলামির একটা নূতন অর্থ বিপিনের কাছে পরিষ্কার হইয়া যায়। সে বুঝিতে পারে মহেশ চৌধুরীর কথাই ঠিক, ও সব দুর্বলতা শক্তির প্রতিক্রিয়া, ও সব পাগলামি অতিরিক্ত জ্ঞানের অভিব্যক্তি। নিজে সদানন্দ জানি না সে সত্য সত্যই মহাপুরুষ, তাই ভাবিত লোকের কাছে মহাপুরুষ সাজিয়া লোককে ঠাঁইতেছে। শত শত মানুষ যে তার ব্যক্তিত্বের প্রভাবে অভিভূত হইয়া যায়, সামনে দাঁড়াইয়া চোখ তুলিয়া মুখের দিকে চাহিতে পারে না, তাও সে ধরিয়া নিয়াছিল শুধু তার নানারকম ছল আর মিথ্যা-প্রচারের ফল। এত বড় বড় আদর্শ সে পোষণ করিত ( হয়তো এখনো করে) যে, নিজের অসাধারণত্বকে পর্যন্ত তার মনে হইত (হয়তো এখনো হয়। সাধারণ লোকের তুচ্ছতার চেয়েও নিচু স্তরের কিছু।
বন্ধুর জন্য বিপিন একটা শ্ৰদ্ধার ভাব অনুভব করে, বন্ধুর আধুনিকতম এবং বীভৎস ও বিপজ্জনক প্রস্তাবটাও যার তলে চাপা পড়িয়া যায়। যোগাযোগটা তার বড় মজার মনে হয়। মহেশ চৌধুরী যখন সদানন্দকে মনে করিত দেবতা, তখন তার জন্য বিপিনের মনে ছিল প্রায় অবজ্ঞারই ভাব, তারপর সদানন্দের অধঃপতনের জন্য মহেশ চৌধুরীর ভক্তি যখন উবিয়া যাইতে আরম্ভ করিয়াছে, তখন বিপিনের মধ্যে জাগিয়াছে শ্রদ্ধা! মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের নিয়মকানুনগুলি খাপছাড়া নয়?
বিপিনের আশ্রম ত্যাগ করা, মহেশ চৌধুরীর বাড়িতে বাস করা, নূতন আশ্রম খুলিয়া নূতনভাবে জীবনযাপন করা এবং তারপর আবার নিজের পুরাতন আশ্রমে ফিরিয়া আসা, নাম ছড়ানোর দিক দিয়া এ সমস্ত খুবই কাজে আসিল সদানন্দের। মহেশ চৌধুরীর আশ্রমে সমবেত নারী-পুরুষের ভক্তিশ্রদ্ধা হারানোর যে ভয়টা সদানন্দের মধ্যে মাঝে মাঝে দেখা দিতেছিল সেটা অবশ্য নিছক ভয়, সকলেই শিষ্যত্ব অর্জনের এবং তার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিবার অধিকার আর সুযোগ পাওয়ায় তার সম্বন্ধেই লোকের অস্বাভাবিক ভয়টা কমিয়া আসিতেছিল। বিপিনের সাহায্যে নিজের চারিদিকে সে যে কৃত্রিম ব্যবধানের সৃষ্টি করিয়াছিল, মহেশের চেষ্টা ছিল সেটা ভাঙিয়া ফেলিয়া সকলের সঙ্গে তার সম্পর্কটা সহজ করিয়া তোলা। সম্পর্কটা সত্য সত্যই সহজ হইয়া আসিতে থাকায় সদানন্দের মনে হইয়াছিল, লোকের কাছে সে বুঝি নিচে নামিয়া যাইতেছে।
হয়তো নামিয়া যাওয়াই। সংস্কার-নাড়া-দেওয়া ভয়ের ভিত্তিতেই হয়তো দেবতার সর্বোচ্চ আসন পাতা সম্ভব।
সদানন্দের সঙ্গে মহেশ চৌধুরীর আশ্রমের জনপ্রিয়তা যেন শেষ হইয়া গেল, যেদিন পুরাতন আশ্রমে সদানন্দ নূতন পর্যায়ে আসর বসাইল প্রথমবার, সেদিন মহেশ চৌধুরীর আশ্রমে লোক আসিল মোটে দশ-বার জন। সকলে সদানন্দের উপদেশ শুনিতে গিয়াছে—আগে যত লোক আসিত তার প্রায় তিনগুণ। সদানন্দ ভাবিয়াছিল এবার হইতে যতটা সম্ভব মহেশ চৌধুরীর নিয়মেই আশ্রম পরিচালনা করবে, শিষ্য করিবে সকলকেই, নাগালের মধ্যে আসিতে দিবে সকলকেই, কথা বলিবে সহজভাবে। একনজর তাকাইয়াই আর নারী বা পুরুষকে অপদাৰ্থ করিয়া দিবে না। কিন্তু ভিড় দেখিয়া হঠাৎ তার কি যে জাগিল উল্লাস আর গর্ব মেশানো একটা নেশা, মুখের গাম্ভীর্যের আর তুলনা রহিল না, যেন গোপন পাপ সব আবিষ্কার করিয়া ফেলিতেছে দৃষ্টির তীব্রতায়, এমনি অস্বস্তি বোধ হইতে লাগিল অনেকের, আর কথা শুনিতে শুনিতে অনেকের মনে হইতে লাগিল তার পায়ে মাথা খুঁড়িতে খুঁড়িতে মরিয়া যায়।
প্ৰণামী দিতে গিয়া দু-একজন পায়ে আছড়াইয়া পড়িবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সুবিধা হইল না!
প্রথম জনকে সদানন্দ বলিল, উঠে বোসো। তিনমাস মাছ, মাংস, মেয়েমানুষ ছুঁয়ো না। এবার যাও–যাও!
দ্বিতীয় জনকে সংক্ষেপে বলিল, পাঁচ বছরের মধ্যে তুমি আমার কাছে এস না।
আগে কেউ বাড়াবাড়ি করার সাহস পাইত না, ভাবপ্রবণতার নাটকীয় অভিব্যক্তি সদানন্দ পছন্দ করে না। মাঝখানে অনেকগুলি ব্যাপার ঘটায় আর সদানন্দ নিজের নূতন পরিচয় দেওয়ায় কয়েকজনের সাহস হইয়াছিল, নূতন লোকও আজ আসিয়াছিল অনেক। কিন্তু পায়ে আছড়াইয়াই পড়ার (তিন টাকা প্রণামী দেওয়ার পরেও) আর হাউ হাউ করিয়া কাঁদতে আরম্ভ করার (প্ৰণামী–আড়াই টাকা) ফল দেখিয়া সকলের সাহস গেল। সকলের বসিবার ভঙ্গি দেখিয়া মনে হইতে লাগিল, সদানন্দ যেন কোথাও কোনোদিন যায় নাই, মাঝখানে প্রায় বছরখানেকের ফাঁক পড়ে নাই, এইখানে আগে যেমন সভা বসিত, আজ একটু বড় ধরনে সেই রকম সভাই বসিয়াছে।
কিন্তু দোকানে ফিরিয়া গিয়া শ্ৰীধর সেদিন সন্ধ্যার পর মুখখানা যেন কেমন একটু ম্লান করিয়া বলিল ঠাকুরমশায় কেমন যেন বদলে গেছেন। ঠাকুরমশায়ের রাগ তো দেখি নি কখনো, সত্যিকারের রাগ?
ঠিক সেই সময় আশ্রমে নিজের গোপন অন্তঃপুরে সদানন্দ বিপিনকে বলিতেছিল, উমা আর রতনকে দিয়ে মাধুকে আনতে হবে। এই ঘরে মাধুকে বসিয়ে রেখে ওরা চলে যাবে, তারপর আমি না ডাকলে কেউ আমার মহলে আসবে না।
উমা আর রতন? ওরা কেন রাজি হবে?
হবে। আমি বললেই হবে।
তা হবে না। এ রকম মতলবের কথা শুনলেই ওদের মন বিগড়ে যাবে, আশ্রম ছেড়েই হয়তো চলে যাবে।
সে আমি বুঝব।
কিন্তু বোঝ বিপিনের পক্ষেও প্রয়োজন, সে তাই সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়ে। তারপর অন্য কথা বলে, কিন্তু মহেশ বা বিভূতি যদি পুলিশ ডেকে আনে?
আনে তো আনবে।
আনে তো আনবে? তোর খারাপ মাথাটা আরো খারাপ হয়ে গেছে সদা।
তুই বড় বোকা বিপিন। পুলিশ আশ্রমের ধারে আসামাত্র উমা, রতন আর আশ্রমের আরো পাঁচ-সাতটি মেয়ে মাধুকে ঘিরে বসবে। পুলিশ এসে দেখবে মাধুকে কেউ আটকে রাখে নি, মেয়েদের সঙ্গে ফাকা জায়গায় বসে গল্প করছে। তবু যদি জেলে যেতে হয়, আমি যাব, সব দোষ আমি নিজে মেনে নেবখন।
কিন্তু দরকার কি শুনি এত হাঙ্গামায়?
সে তুই বুঝবি না।
বুঝুক না বুঝুক, বিপিন ভয় পাইয়া গেল। একদিন চুপিচুপি গিয়া মাধবীলতাকে সাবধান করিয়া দিয়া আসিল। সব কথা সে ফাঁস করিয়া দিল তা নয়, আভাসে ইঙ্গিতে বুঝাইয়া দিল যে সদানন্দ বড় চটিয়াছে, সে যেন কখনো কোনো অবস্থায় আশ্রমে না যায়।
যেই নিতে আসুক, যে উপলক্ষেই নিতে আসুক, যেও না। উমা, রতন এলেও নয়। বুঝেছ? মাধবীলতা সায় দিয়া বলিল, বুঝেছি। আপনি না বললেও আমি যেতাম না।
কয়েকদিন পরে উমা আর রত্নাবলী মাধবীলতাকে আনিতে গেল। সদানন্দ যেন কোথায় গিয়াছে, আশ্রমে মেয়েদের কি যেন একটা ব্ৰত আছে, কি যেন একটা বিশেষ কারণে বিপিন তাকে ডাকাইয়া পঠাইয়াছে। মহেশ চৌধুরী আর বিভূতির অবশ্য নিমন্ত্ৰণ আছে।
মাধবীলতা আসিল না, বিভূতিও নয়। মহেশ চৌধুরী শুধু নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিল। ব্ৰতের কোনো আয়োজন নাই দেখিয়া সে আশ্চর্যও হইয়া গেল না, কিছু জিজ্ঞাসা করিল না। মেয়েদের ব্রত কোন ঘরের কোণে, গাছের নিচে বা পুকুরঘাটে কি ভাবে হয়, মেয়েরাই তা ভালো করিয়া জানে! নিমন্ত্ৰণ করিয়া আসিয়া কেউ কিছু খাইতে দিল না দেখিয়াই সে একটু আশ্চর্য হইয়া গেল। কে জানে, হয়তো ব্রত শেষ না হইলে খাইতে দিতে নাই। কিন্তু বেলা তিনটার সময়ও যদি ব্ৰত শেষ না হয়, না খাওয়াইয়া বসাইয়া রাখিবার জন্য কেবল তার বাড়ির তিনজনকে নিমন্ত্রণ করিবার কি দরকার ছিল?
সদানন্দ যেখানেই গিয়া থাক, ফিরিয়া আসিয়াছে। মহেশ চৌধুরী তার কাছে গিয়া বসে। এদিকে বিপিন ভাবে, উমা আর রত্নাবলী যখন সঙ্গে করিয়া আনিয়াছে, তারাই মহেশের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করিবে। উমা আর রত্নাবলী ভাবে, বিপিন যখন নিমন্ত্ৰণ করিয়া আনিতে বলিয়াছে, সেই জানে অতিথিকে কি খাইতে দেওয়া হইবে। বিপিন নিশ্চিন্তমনে কাজে বাহির হইয়া যায়। সদানন্দের কুটিরে মহেশকে খাইতে দেওয়া হইয়াছে ভাবিয়া উমা আর রত্নাবলী নিশ্চিন্তমনে বিশ্রাম করে।
সদানন্দ বলে, কি খবর মহেশ?
মহেশ বলে, আজ্ঞে, খবর আর কি?
মহেশ যেন প্রভু শব্দটা উচ্চারণ করিতে ভুলিয়া গিয়াছে।
কিছু উপদেশ দেবে নাকি?
কি আর উপদেশ দেব বলুন?
এই আমার কি করা উচিত, কি করা উচিত নয়–
মহেশ একটু ভাবিয়া বলে, উপদেশ তো নয়, পরামর্শ দিতে পারি। কথাটা মনে রাখলে কাজ হবে। মানুষ যখন উঁচু পাহাড় পর্বতে ওঠে, কত যত্নে, কত সাবধানে প্রাণপণ চেষ্টায় তিল তিল করে ওঠে, সময়ও লাগে অনেক, কিন্তু মানুষ যখন উঁচু থেকে হাত-পা এলিয়ে নিচে পড়ে, পড়বার সময় কোনো কষ্টই হয় না, সময়টা কেবল চোখের পলকে ফুরিয়ে যায়।
সদানন্দ গম্ভীর হইয়া বলে, পড়বার সময়টা ফুরিয়ে গেলেও অনেক সময় কষ্ট হয় না মহেশ। বরং উঁচু থেকে পড়লে চিরকালের জন্য কষ্ট ফুরিয়ে যায়।
ফুরিয়ে যায়, না শুরু হয়, কে তা জানে বলুন?
আমি জানি। যে সীমার মধ্যে কষ্ট, সে সীমাই যদি পার হয়ে গেলাম, তবে আর কষ্ট কিসের? যারা বোকা তারাই বেঁচে থেকে রোগের জ্বালা, শোকের জ্বালা সহ্য করে। অথচ আত্মহত্যা করা এত সহজ!
আত্মহত্যা করা সহজ? আত্মরক্ষা করা সহজ বলুন। আত্মহত্যা করা সহজ হলে মানুষের। জীবনটাই আগাগোড়া বদলে যেত, সমাজ, ধর্ম, রীতিনীতি, সুখ-দুঃখ, ভাবনা-চিন্তা, অনুভূতি সব অন্যরকম হত। ব্রহ্মচারী দু-চারজন আছে, কিন্তু ব্রহ্মচর্য কি সহজ, না মানুষের পক্ষে সম্ভব? আত্মহত্যা দু-চারজন করে, কিন্তু সেটাও সহজ নয়, মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি তো যন্ত্রণায় ক্ষেপে যাবার উপক্রম করেছেন, একবার দেখুন তো আত্মহত্যা করতে গিয়ে পারেন কিনা? কষ্ট পাবেন, বেঁচে থাকার সাধ থাকবে না, তবু বেঁচে থেকে কষ্ট ভোগ করবেন। এই সমস্যা আছে বলেই তো বেঁচে থাকার এত নিয়ম-কানুনের আবিষ্কার। আসল সাধু কি ঈশ্বরকে চায়, স্বৰ্গ চায়, পরকালের কথা ভাবে? সাধু চায়, বিশেষ কতকগুলি অবস্থায় বাঁচতে যখন হবেই, বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় কি, তাই আবিষ্কার করতে। অনেক যুক্তিই লাগসই মনে হয়, কিন্তু সব যুক্তিই কি খাটে? অতি তুচ্ছ বিষয়ে যুক্তি খাড়া করবার সময় বিচার করে দেখবেন, কত অসংখ্য বিষয়ের সঙ্গে যুক্তিটার যোগ আছে। কোন যুক্তিটা সবচেয়ে বেশি খাটবে, কোনটা সবচেয়ে কম খাটবে, ঠিক করতে নিরপেক্ষ মন নিয়ে জগতের সমস্ত যোগাযোগ বিচার করতে হয়। ওটা হল মহাপুরুষের কাজ। মূল্য যাচাই করার ক্ষমতা অর্জন করবার নাম সাধনা। এইজন্য সাধনা এত কঠিন। মানুষকে জানেন তো, মরুভূমিতে তৃষ্ণায় মরবার সময় পর্যন্ত এক গ্লাস জল আর একদলা সোনার মধ্যে বেছে নিতে বললে–
আমি তাই করেছি, না? সদানন্দ ব্যঙ্গ করিয়া জিজ্ঞাসা করে।
হ্যাঁ, একেই পাপ বলে।
পাপ? অনুতাপ না হলে আবার পাপ কিসের?
অনুতাপ যদি না হয়, তবে আর পাপ কিসের? হজম করতে পারলে আর শরীরের পুষ্টি হয়ে স্বাস্থ্য বজায় থাকলে, রাশি রাশি অখাদ্য, কুখাদ্য খাওয়া আর দোষ কি? কিন্তু মুশকিল কি জানেন, অনুতাপ হয়। ভগবান দেন বলে নয়, লোকে বলে বলে নয়, অনুতাপ হওয়ার কথা বলেই অনুতাপ হয়। একটা কাজ করলে যদি আনন্দ হয়, আরেকটা কাজ করলে নিরানন্দ হতে পারে না?
সাধারণ লোকের হতে পারে, সকলের হয় না। মনকে যদি বশ করা যায়, আফসোস হতে না দিলে কেন হবে?
সে তো বটেই, কিন্তু মনকে বশ করা হয় না। অনুতাপ বড় ভীষণ জিনিস, মনকে একেবারে ক্ষয় করে দেয়। অনুতাপ এড়িয়ে চলাও বড় শক্ত, একটা নখ কাটার জন্য পর্যন্ত অনুতাপ হতে পারে কিনা। যাই করুক মানুষ, হয় সুখ পাবে নয় কষ্ট পাবে, উঠতে বসতে চলতে ফিরতে এ দুটোর একটা ঘটবেই ঘটবে। মহাপুরুষেরা এর মধ্যে একটা সামঞ্জস্য ঘটাবার উপায় দেখিয়ে দেন। অনুতাপ হবেই, তবে মারাত্মক রকমের না হয়। মারাত্মক অনুতাপ যাতে হয়, তাকেই লোকে পাপ বলে। যেমন ধরুন, আপনি যদি গায়ের জোরে মাধুর ওপর অত্যাচার করেন–
সদানন্দ চমকাইয়া বলে, তার মানে?
মহেশ শান্তভাবেই বলে, কথার কথা বলছি, একবার মাধুকে ধরে টানাটানি করেছিলেন। কিনা, তাই কথাটা বলছি. ও রকম কিছু করলে আপনার অনুতাপ হবেই। হিসাব করে হয়তো দেখলেন ওজন্য অনুতাপ করা মনের দুর্বলতা, প্রকৃতির নিয়ম ধরে বিচার করলে ও কাজটা আপনার পক্ষে কিছুমাত্র অন্যায় হয় নি, তবু অনুতাপে আপনি ক্ষয় হয়ে যাবেন। উচিত হোক আর অনুচিত। হোক, এ প্রতিক্রিয়াটা ঘটবেই। মনকে যদি এমনভাবে বদলে নিতে চান, যাতে ওরকম পাপ করে অনুতাপ হবে না, তখন বিপদ হবে কি জানেন, যতদিন পাপ করার ইচ্ছা না লোপ পাবে, মনটা বদলাবে না। যোগসাধনার মূল নীতি এই। সাধারণ জীবনে উঠতে বসতে আমরা অসংখ্য ছোট-বড় পাপ করি আর অনুতাপ ভোগ করি, সব সময় টেরও পাই না। সেইজন্য যোগসাধনার নিয়ম এত কড়া কবার নিশ্বাস নিতে হবে তা পর্যন্ত ঠিক করে দেওয়া আছে। কানের চুলকানি জয় করলেই লোকে যোগী ঋষি হয় না, পিঠের চুলকানি পর্যন্ত জয় করতে হয়–নইলে মন বশে আসে না। তেইশ ঘণ্টা ঊনষাট মিনিট তপস্যা করেও হয়তো এক মিনিট শিষ্যকে দিয়ে ঘামাচি মারানোর জন্য তপস্যা বিফল হয়ে যায়।
গায়ে ছাই মেখে যে তপস্যা–
মহেশ মৃদু হাসে, আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলে, আপনাকে বলা বৃথা, আপনি আমার কথা বুঝবেন না। গায়ে ছাই মেখে হাত উঁচু করে বসে থাকা কি তপস্যা? না আমি সে তপস্যার কথা বলছি? আমি বলছিলাম আপনার তপস্যার কথা, আপনি যে তপস্যায় দিন দিন সফল হচ্ছিলেন।
এবার সদানন্দ অনেকক্ষণ নীরব হইয়া থাকে, তারপর ধীরে ধীরে প্রশ্ন করে, আমার আর কোনো উপায় নেই?
মনে তো হয় না। তবে তেমন গুরু যদি খুঁজে বার করতে পারেন—
শেষ বেলায় উপবাসী মহেশ বাড়ি ফিরিয়া গেল। খাইতে চাহিল মাধবীলতার কাছে।
মাধবীলতা অবাক হইয়া বলিল, এ আবার কোন দেশী ব্যাপার, নেমন্তন্ন করে নিয়ে গিয়ে খেতে না দেওয়া!
যে ব্যাপার সে জানিত তার চেয়ে এ ব্যাপারটা তার খাপছাড়া মনে হয়। তার সম্বন্ধে সদানন্দের খারাপ মতবল আঁটা আশ্চর্যের কিছু নয়, কিন্তু ডাকিয়া নিয়া গিয়া মহেশ চৌধুরীকে খাইতে না দেওয়ার কোনো মানে হয়?
বড় পাজি লোক ওরা।
ছি মা, রাগ করতে নেই। কোনো একটা কারণ নিশ্চয় ছিল, বিব্রত করার ভয়েই তো আমি বললাম না, নইলে চেয়ে খেয়ে আসতাম।
দুজনে এ সব কথা বলাবলি করিতেছে, শশধরের বৌ খাবার আনিয়া হাজির। কোথায় সে থাকে টের পাওয়া যায় না, কিন্তু সব সময়েই বোধহয় আশপাশে আড়ালে লুকাইয়া থাকিয়া সকলের কথা শোনে।
মাধবীলতা কিন্তু হঠাৎ বড় চটিয়া গেল।
সব ব্যাপারে তোমার বড় বড়াবাড়ি। আমিই তো দিচ্ছিলাম!
আড়ালে গিয়া শশধরের বৌ ঘোমটা ফাঁক করিয়া তাকে দেখাইয়া একটু হাসিল, হাতছানি দিয়া তাকে কাছে ডাকিল।
মাধবীলতা কাছে গেলে ফিসফিস করিয়া বলিল, তোমাকে না আজ কিছু ছুঁতে নেই–?
মাধবীলতা চুপ করিয়া রহিল। সদানন্দের আশ্রমে নিমন্ত্রণ রাখিতে না যাওয়ার মিথ্যা অজুহাতের কথাটা তার মনে ছিল না।
এদিকে আশ্রমে তখন সদানন্দ বিপিনকে ডাকিয়া আনিয়াছে।
মাধু এল না কেন?
উমা আর রত্নাবলীর কাছে বিপিন যা শুনিয়াছিল জানাইয়া দিল! সদানন্দ বিশ্বাস করিল না। দাঁতে দাতে ঘষিয়া বলিল, ও সব বাজে কথা, আসল কথা আসবে না। না আসুক, আমিও দেখে নেব কেমন না এসে পারে। তোকে বলে রাখছি বিপিন, ওর সর্বনাশ করব, মহেশকে পথে বসাব, তবে আমার নাম সদানন্দ।
কয়েকদিন পরে মহেশের বাড়িঘর, বাগান আর আশ্রম পুলিশ তন্ন তন্ন করিয়া খানাতল্লাশ করিয়া গেল। বিভূতির সঙ্গে যখন সংস্রব আছে মাঝে মাঝে হঠাৎ এ রকম পুলিশের হানা দেওয়া আশ্চর্য নয়। তবু, বাহির হইতে তাগিদ না পাইলে এ সময়টা পুলিশ হয়তো বিভূতির নূতন আশ্রম নিয়া মাথা ঘামাইত না। বিভূতিকে যে কতগুলি কথা জিজ্ঞাসাবাদ করিল, খবরটা সে-ই ফাঁস করিয়া দিয়া গেল। পুলিশের লোকটি একদিন সদানন্দকে প্রণাম করিতে গিয়াছিল, কথায় কথায় সদানন্দ নাকি এমন কতকগুলি কথা বলিয়া ফেলিয়াছিল যে তাড়াতাড়ি অনুসন্ধান না করিয়া উপায় থাকে নাই।
সত্যি সত্যি কিছু আরম্ভ করেছেন নাকি আবার? উনি তো মিথ্যে বলবার লোক নন।
উনিই মিথ্যে বলবার লোক।
পুলিশের লোকটি সন্দিগ্ধভাবে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিল, বিয়ে থা করেছেন একটু সাবধান থাকবেন, আর কি ও সব ছেলেমানুষি পোষায়?
পুলিশের খানাতল্লাশের পর মহেশের আশ্রমে লোকের যাতায়াত আরো কমিয়া গেল। এতদিন পরে লোকের মুখে মুখে কি করিয়া যে একটা গুজব রটিয়া গেল, মহেশ চৌধুরী লোক ভালো নয় বলিয়া সদানন্দ তাকে ত্যাগ করিয়াছে, সাধু সদানন্দ।