বড় তেঁতুল গাছটার নিচে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপী। আজ আকাশে বড় বেশী জ্যোৎস্না। এই মাঝরাতে জ্যোৎস্না একেবারে ফটফট করছে। দুটো কুকুর লেজ নাড়ছে এসে গোলাপীর পায়ের কাছে, কিন্তু ডাকছে না, গোলাপীর গায়ের গন্ধ তাদের খুব চেনা, তাছাড়া গোলাপী তাদের খেতে দেয়। খানিকটা দূরের কোনো ঘরে একটা বাচ্চা কাঁদছে টা টা করে। আর কোনো শব্দ নেই। সারাদিন অসহ্য গরমের পর এখন বাতাস একটু মোলায়েম হয়েছে, এই সময় সবাই গাঢ়ভাবে ঘুমোয়।
গোলাপী চোখ দুটো যেন জ্বেলে রেখেছে, তার মুখে ও শরীরে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই, সে অতিরিক্ত সাবধানী হতে চায়। তেঁতুল গাছটার তলায় ছায়া আছে, কিন্তু জ্যোৎস্নার মধ্যে হাঁটতে গেলে দৈবাৎ কেউ তাকে দেখে ফেলতে পারে। নেপীর ঠাকুদা কেশো রুগী, সে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকে ঘরের সামনের দাওয়ায়। গুদাম ঘরের দু’জন গার্ড আছে, তাদেরও জেগে। থাকবার কথা।
একটা দমকা হাওয়ায় গাছের পাতার সরসর শব্দ হলো, তখনই একটা দৌড় দিল গোলাপী। সে নিজেও যেন চলন্ত বাতাস। কুকুর দুটো কিছু দূর এলো তার সঙ্গে, তারপর হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গিয়ে উল্টো দিকে ফিরলো। গোলাপী নেমে গেল ঢালু জমিতে, বেশ খানিকটা ঘুরে স্টাফ কোয়াটারের পেছন দিক দিয়ে এসে একটা দরজার সামনে দাঁড়ালো। দরজাটা একটুখানি ফাঁক করা, ভেতরে মোম জ্বলছে। ঘরের মধ্যে একটি মাত্র তাপোশ ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। বিছানার ওপর বসে স্টোর ক্লার্ক বাসুদেব চক্রবর্তী একমনে কী যেন লিখে যাচ্ছে।
গোলাপী দরজাটা সামান্য ঠেলতেই সেই শব্দ শুনে বাসুদেব মুখ ফেরালো। তড়াক করে খাট থেকে নেমে এসে সে গোলাপীর হাত ধরে ভেতরে আনলো, খিল দিল দরজায়। গোলাপীকে খাটে বসিয়ে সে চোপসানো গলায় জিজ্ঞেস করলো, কেউ, কেউ দেখেনি তো?
গোলাপীর চেয়ে বাসুদেবই অনেক বেশী বিচলিত, তার মুখখানা অতিরিক্ত ভয় পাওয়া মানুষের মতন। ঘরের একটি মাত্র জানলাও বন্ধ করে দিয়ে সে আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো, সুশীলবাবুর ঘরে আলো জ্বলছিল? ব্যাটা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে।
গোলাপীর ঠোঁটে পাতলা হাসি, সে মাথা নেড়ে জানালো, না। বাসুদেব একটু দূরে দাঁড়িয়ে বললো, তুমি সত্যি এসেছো? আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। গোলাপী, তুমি জল খাবে? তোমার তেষ্টা পায় নি?
গোলাপী আবার দু’দিকে মাথা নাড়লো।
বাসুদেব নিজেই ঘরের কোণে রাখা কুঁজো থেকে খানিকটা জল গেলাসে ঢেলে খেতে গিয়ে গেঞ্জি ভেজালো। গেঞ্জিটা খুলে ফেললো সে। তার পরণে শুধু লুঙ্গি। গোলাপীও শুধু একটা হলদে ডুরে শাড়ী পরে আছে। রাত্তিরে শোবার সময় সে শায়া-ব্লাউজ পরে না। সেই ভাবেই বিছানা থেকে উঠে এসেছে। গোলাপীকে খাটে বসিয়ে বাসুদেব দাঁড়িয়ে রইলো দরজায় পিঠ দিয়ে। সে গলগল করে ঘামছে। চোখ দুটি বিস্ফারিত। ঘরের মধ্যে জলজ্যান্ত একটি নারী বসে–আছে, এটা সে যেন এখনও হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে না। গোলাপী বললো, আপনি আমারে ডেকেছিলেন…
বাসুদের মাটিতে বসে পড়লো গোলাপীর পায়ের কাছে।
গোলাপী বিব্রত হয়ে বললো, একী, একী, আপনি উঠে বসেন।
গোলাপী পা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করতেই বসুদেব তার পা চেপে ধরে বললো, না, আমি এখানেই একটু বসি, তোমাকে দেখি। জানো গোলাপী, আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে আমার এত কাছে এসে বসেনি! কারুকে আমি এভাবে ছুঁয়ে দেখিনি। গোলাপী, তুমি কি ভালো, তুমি আমার মতন একজন মানুষকে গোলাপী, তুমি কি সুন্দর!
–না, আপনি ওপরে উঠে আসেন। মোমবাতিটা নিভায়ে দ্যান, শুধু শুধু জ্বলছে।
–অ্যাঁ, আলো নিভিয়ে দেবো? ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে?
–আলো দেখে যদি কেউ এদিকে আসে?
–কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে আমার ভয় করবে! অন্ধকার হলে তোমাকে আমি দেখবো কী।
গোলাপী হেসে ফেললো। বাসুদেবের বাহু দুয়ে সে বললো, আমাকে দেখার কী আছে? আমি একটা সামান্য মেয়ে। অন্ধকারের মধ্যে আপনার ভয় করবে? আমাকে ভয়?
বাসুদেব বললো, তোমাকে ভয় পাবো কেন? আমার এমনিই ভয় করছে। বুকের মধ্যে দুড়ম দুড়ুম শব্দ হচ্ছে। অন্য সময় তোমার দিকে ভালো করে তাকাতে পারি না।
–আপনি ঐ ভাবে বসে থাকলে আমার লজ্জা করে না?
–ঐ আলোটুকু থাক। গোলাপী, তুমি আমার একটা কবিতা শুনবে?
–কবিতা? পদ্য? আমি তো কিছু বুঝবো না!
–হ্যাঁ বুঝবে! নিশ্চয়ই বুঝবে। সব মানুষই কবিতা বোঝে। মানুষের জন্যই তো কবিতা। ঠিক মতন মন দিয়ে পড়তে হয়।
–আমি যে লেখা পড়া শিখিনি। ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি। কুপার্স ক্যাম্পে প্রাইমারি ইস্কুল ছিল।
তাতে কী হয়েছে। তোমার অক্ষরজ্ঞান তো আছে। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল, কোনো মেয়ের পায়ের কাছে বসে কবিতা শোনানো। সেইজন্যই তো ডেকেছি তোমাকে। এই দ্যাখো, এখনও আমার বুক কাঁপছে, তুমি সত্যি সত্যি এসেছো!
–আমি বেশীক্ষণ থাকতে পারবো না।
–না, না, বেশীক্ষণ না, মোটে দুটো কবিতা, ঐ খাতাটা দাও।
কবিতা পড়তে গিয়ে বাসুদেবের গলা কাঁপতে লাগলো। গোলাপী মাথা নিচু করে শুনলো। খুব মন দিয়ে, সে কিছুটা বুঝলো, অনেকটাই বুঝলো না।
পড়া শেষ করে বাসুদেব ব্যাকুল ভাবে জিজ্ঞেস করলো, বুঝতে পারলে? কেমন লেগেছে?
বাসুদেবের মাথার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে গোলাপী বললো, খুব সুন্দর হয়েছে! আপনি আমার পায়ে হাত দেবেন না, আমরা ছোট জাত।
–জাত? আমি ওসব জাত-টাত মানি না। মেয়েরা হলো বসুন্ধরার মতন, তারাই তো আমাদের ধারণ করে, তাদের আবার নীচু জাত, উঁচু জাত কী? আমি তোমার পায়ে একটা চুমু খাবো? মোটে একবার। তুমি রাগ করবে না?
গোলাপী জোর করেও পা সরিয়ে নিতে পারলো না। বাসুদেব তার পায়ের পাতায় চুমু খাবার পর মুখ তুলে খুব কাতর ভাবে বললো, গোলাপী, তুমি আমার ওপর রাগ করলে না তো? আমি কি অন্যায় করছি? রাত্তিরবেলা তুমি আমার ঘরে এসেছে, কেউ জেনে ফেললে আমায় খুব খারাপ ভাববে, না? কিন্তু আমি যে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি, গোলাপী! আর একটা কবিতা শোনাবো?
গোলাপী এবার খাট থেকে নেমে বাসুদেবের পাশে বসে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরলো। বাসুদেব যেন শিউরে উঠলো খানিকটা। অবাক ভাবে গোলাপীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, এত ভালো লাগে? কোনো মেয়ের শরীরের সঙ্গে শরীর ছোঁয়াতে …এতদিন শুধু কল্পনা করেছি। আর একটা কবিতা শুনবে? এই সবগুলোই তোমাকে নিয়ে লেখা, তা বুঝতে পারছো? সেই যে একদিন কোণ্ডাগাঁও-এর রাস্তায় তুমি আমাকে দেখে একটা ধান খেত থেকে উঠে এলে, তোমার সারা গায়ে কাদা, কালো পাথরের মতন মূর্তি, তোমাকে দেখে মনে হলো এক ভিল রমণী, যেন নিবিড় কোনো জঙ্গলে তুমি থাকো, তুমি জঙ্গলের দেবী। এই কবিতায় যে ভিল রমণীর কথা, সে হচ্ছো তুমি!
–ভিল কী?ভিল রমণীরা কোথায় থাকে?
–তা জানি না। কোন বইতে যেন পড়েছি! গোলাপী, তোমার বাবা খুব রাগী লোক, আমায় কিছু সন্দেহ করেনি তো?
–না।
–যদি আমার সাধ্য থাকতো, তোমাকে এই কলোনী থেকে নিয়ে চলে যেতাম। কোনো একটা জঙ্গলে গিয়ে থাকতাম তুমি আর আমি। আমরা বিয়ে করতাম গন্ধর্ব মতে। কিন্তু তার যে উপায় নেই। আমার বাবা মারা গেছে, পাঁচটা ভাই বোন, শুধু আমার দিদি বর্ধমানের একটা ইস্কুলে চাকরি করে, দিদির বিয়ে হয়নি, আমার আরও দুটো বোনের বিয়ে হয়নি। কী করে বিয়ে দেবো বলো, সংসারই চলে না, আমি আড়াই শো টাকা মাইনে পাই, তার মধ্যে দুশো টাকাই মানি অর্ডার করি প্রত্যেক মাসে। দিদি আর বোনেদের বিয়ে না দিতে পারলে আমারও বিয়ে হবে না। বলো, আমি কি বিয়ে করতে পারি?
–দেশে আপনাদের জমি নাই?
–কিসের জমি! নিজস্ব বাড়িই নেই।
–আপনারাও কি আমাদের মতন রিফিউজি?
–না গো! রিফিউজি হলেও গভর্নমেন্টের কাছ থেকে কিছু ভাতা পেতাম। আমরা মেদিনীপুরের লোক। আমার বাবা ছিল পোস্ট অফিসের পিওন, আমি অতিকষ্টে স্কুল ফাইনাল পাস করেছি। আগে জ্যাঠামশাইয়ের সংসারে থাকতুম, বাবা মারা যাবার পর তাড়িয়ে দিয়েছে। এই চাকরিটা না পেলে না খেয়ে মরতুম।
–পশ্চিমবাংলার মানুষেরও নিজের বাড়ি থাকে না?
–কাটোয়ায় দিদি পঁয়তিরিশ টাকা দিয়ে একখানা ঘর ভাড়া নিয়েছে। জানো গোলাপী, এখানে স্টোরের চাবি আমি নিজের কাছে রাখি না। ক্ষিতিবাবু স্টোর থেকে চাল সরায়, বাল্লু সিং তোমাদের ওজন কম দেয়, আমি সব জানি, ক্ষিতিবাবু আমাকে ভাগ দিতে চেয়েছিল, আমি নিই না, চুরির কথা ভাবলেই আমার বুক ধড়ফড় করে। ক্ষিতিবাবুরা ভাবে আমি ভীতু! আর আমি মনে মনে কী ভাবি জানো, আমি ভাবি, আমি তো কবি, আমি কি চোর হতে পারি? মা সরস্বতী তা হলে আমাকে অভিশাপ দেবেন না? গোলাপী, তুমিও কি আমাকে ভীতু ভাবো?
গোলাপী খিলখিল করে হেসে ফেললো!
–আস্তে আস্তে। আচ্ছা গোলাপী, আগে এখানে সুধীর দাস বলে একজন কাজ করতো, তোমার বাবা নাকি তাকে মেরেছিল?
–বাবা আর যোগানন্দ তার এক পায়ের হাঁটু ভেঙে দিয়েছিল। সে খারাপ লোক ছিল। সে আমাকে বিয়ে করবে বলে মিথ্যা কথা বলেছিল।
–সর্বনাশ! তোমার বাবা যদি টের পায় গোলাপী, আমার ইচ্ছে থাকলেও যে তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না! বাড়িতে তিন তিনটে অবিবাহিত বোন, সেখানে তোমাকে নিয়ে গেলে তারা তোমাকে এক দণ্ড তিষ্ঠোতে দেবে না! তাছাড়া আমি এখন বিয়ে করলে সবাই আমাকে বলবে স্বার্থপর! আমার তিন বোনের বিয়ে দিতে দিতেই আমি বুড়ো হয়ে যাবো?
–আপনাকে বিয়ে করতে হবে না। আপনি আর একটা পদ্য বলেন!
–শুনবে? সত্যি শুনবে? আঃ, এর আগে আমাকে কেউ এরকম অনুরোধ করেনি! গোলাপী, আমি তোমার হাতে, এইখানে একটা চুমু খাবো? তাতে কি দোষ হবে? মোটে একবার! আমার ওপর একটু দয়া করো, অনুমতি দাও!
গোলাপী আবার দুলে দুলে হাসতে লাগলো।
মোমটা নিবু নিবু হয়ে আসছে। ঘরের মধ্যে আলোর চেয়ে অন্ধকার বেশী, সেই অন্ধকারও দুলছে। আঁচলটা সরে গিয়ে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে গোলাপীর নগ্ন বুক, সেদিকে প্রগাঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বাসুদেব। ঐ বুক স্পর্শ করার সাহস তার নেই, শুধু দেখেই যেন তার জীবন ধন্য হয়ে যাচ্ছে।
গোলাপী বাসুদেবের একটা হাত ধরে বললো, আপনি সেদিন আমারে বলেছিলেন, আপনার ঘরে আসলে আপনি আমারে পদ্য শোনাবেন। আমি ভেবেছিলাম, পদ্য শোনাবার কথাটা মিছা। কথা।
–না, না, মিছে কথা কেন হবে? আমার জীবনে আর কী আনন্দ আছে বলো? জন্ম থেকেই শুধু দেখছি, অভাব আর অভাব। না খেতে পাওয়ার কষ্ট। বাড়িতে কান্নাকাটি। ছোটবেলা থেকেই আমি শুধু কবিতা লিখে আনন্দ পাই। কয়েকটা পত্রিকায় পাঠিয়েছি, কোথাও ছাপা হয়নি, তবু লিখতে ভালো লাগে।
–আপনি আমারেই শোনাতে চাইলেন কেন? আমি অতি সামান্য মেয়ে, মুখ্যু কিছু জানি না।
–তুমি সামান্য কেন হবে? ঐ যে বললাম, প্রথম দিন ধান খেতের পাশে তোমাকে দেখেই মনে হয়েছিল বনদেবী। আমি একটা নগণ্য মানুষ, কোনো মেয়েকে কোনোদিন কবিতা শোনাতে পারবো, এ তো স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি কবিতা লিখি শুনে ক্ষিতিবাবু, সুশীলবাবুরা ঠাট্টা করে, আমাকে বলে কপি, কপি মানে জানো তো, বাঁদর! আমি চাকরি খোয়াবার ভয়ে কারুর কোনো কথায় প্রতিবাদ করি না। রিফিউজিদের সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার করি কখনো? তোমাকে আমার ঘরে আসতে বলে দোষ করেছি? আমি শুধু তোমার পায়ে আর হাতে চুমু খেয়েছি। আর কোনো অন্যায় করেছি?
–না। আমি এবার যাই?
–গোলাপী, তুমি আমাকে যে কতখানি ধন্য করে গেলে, তা তুমি নিজেও বুঝবে না! আবার একদিন আসবে? আমি…আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না, শুধু তুমি আমার পাশে একটু বসবে, আমার কবিতা শুনবে…দিনের বেলায় তো এসব করা যায় না…
গোলাপী বাসুদেবের হাতটা নিজের বুকে ছোঁয়ালো। যেন বিদ্যুতের স্পর্শ লেগেছে, এইভাবে বাসুদেব সরিয়ে নিল হাতটা। গোলাপী এবার মাথা ঝুঁকিয়ে এনে বাসুদেবের ঠোঁটে রাখলো নিজের ঠোঁট। গোলাপীর চোখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে।
খানিক পরে গোলাপী বাসুদেবের কোয়াটার থেকে বেরিয়ে আবার ঢালু জমিটা ঘুরে তেঁতুল গাছটার কাছে আসতেই এক জায়গার দেখতে পেল আগুনের ফুলকি। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। গোলাপীর মুখের ওপর জ্যোৎস্না, কিন্তু লোকটি দাঁড়িয়ে আছে গাছতলার অন্ধকারে।
গোলাপী একটা দৌড় মারবার চেষ্টা করতেই হারীত মণ্ডল ডাকলো, এদিকে আয় হারামজাদী!
গোলাপী পালাতে পারলো না, এগিয়ে এলো পায়ে পায়ে। হারীত মণ্ডল খপ করে চেপে ধরলো তার মাথার চুল, তার এক হাতে একটা টাঙ্গি। এই টাঙ্গিটা সে মাত্র কয়েকদিন আগে কিনেছে আদিবাসীদের হাট থেকে, এখনো এতে রক্তের ছোঁয়া লাগেনি।
হারীত বললো, দেই এক কোপে ঘেটি ফ্যালাইয়া?
গোলাপী মৃদু স্বরে বললো, দাও!
হারীত দাঁতে দাঁত চেপে বললো, অইন্যেরে আর কত শাস্তি দেবো? এক একবার ভাবি, এক কোপে তরেই শ্যাস কইরা দেই! তুইই যত নষ্টের গোড়া!
গোলাপী বললো, দাও, বাবা, আমারে শ্যাস কইরা দাও!
হারীত গোলাপীর চুল ছেড়ে দিল, টাঙ্গিটা ফেলে দিল মাটিতে।
–তোরে সেই কুপার্স ক্যাম্পেই মাইরা ফালান উচিত ছিল আমার। তাইলে আমি বাঁচতাম। আমারে এইখানকার সক্কলে গুরু বইল্যা মানে, আর তুই আমার মাইয়া হইয়া এমন কলঙ্কের কাজ করোস! আমার মুখে কালি দ্যাস তুই!
–সক্কলেই জানে, আমি তোমার মাইয়া না। আমার বাপ-মা নাই, আমি একটা নষ্ট মাইয়ামানুষ! আমারে নিয়া তোমার এত জ্বালা, তুমি আমারে তখনই খেদাইয়া দ্যাও নাই ক্যান? ক্যান আমারে সাথে লইয়া আদ্র আইছো?
–আইজ তুই আমারে এমন কথা কইলি? আমি তোরে খেদাইয়া দিমু? তুই নিজে নষ্ট না হইলে কেউ তোরে নষ্ট করতে পারে?
–মাইয়া মানুষ একবার নষ্ট হইলেই চিরকালের নষ্ট! এই কলোনির কেউ আমারে ঘরে ঢোকতে দেয় না! কেউ আমারে ভালো চক্ষে দেখে না!
–সেইজইন্যেই বুঝি তুই বাবুদের ঘরে যাস? তোর লজ্জা করে না, আমি বামুন কায়েতগো দুই চক্ষে দ্যাখতে পারি না, তুই জানোস! কলোনির পুরুষ গুলার সাথে তুই গোপনে গোপনে আশনাই করোস, আমি এখন দেইখ্যাও না দেখার ভাণ কইরা থাকি। কিন্তু তুই বাবুগো সাথে…
গোলাপী এবার কেঁদে উঠলো। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ভাঙা ভাঙা ভাবে বলতে লাগলো যে, সে কলোনির সব পুরুষদের ঘেন্না করে। এই কলোনির পুরুষরা কেউ প্রকাশ্যে তার সঙ্গে কথা বলার সাহস পায় না, কিন্তু আড়ালে তাকে নিয়ে টানাটানি করে, তার ওপরে জোর করে, এই কলোনিতে তার আর একটুও থাকতে ইচ্ছে করে না!
হারীত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শত চেষ্টা করেও সে গোলাপীর সমস্যাটা সামাধান করতে পারছে না। গোলাপীকে কেউ বিয়ে করতে চায় না, তার একটি অবৈধ সন্তান আছে সে কথা কেউ ভুলতে পারে না, অথচ গোলাপীর শরীরের প্রতি পুরুষেরা লাভ করে। হারীত কজনকে শাসন করবে?
কিন্তু গোলাপী বাবুশ্রেণী বা ভদ্রলোকশ্রেণীর কারুর সঙ্গে ব্যভিচার করবে, এটা তার আরও অসহ্য মনে হয়। এর থেকে মেয়েটার মরে যাওয়াও ভালো। যুবতী মেয়ে, শরীর না যেন। আগুন!
হারীত জিজ্ঞেস করলো, কার ঘরে গেছিলি?
গোলাপী মুখ তুলে বললো, তুমি তার হাত কিংবা পাও ভাঙবা? না, তার দোষ নাই, আমি নিজের ইচ্ছায় গেছি। সে জোর করে নাই।
–কার ঘরে গেছিলি, নামটা ক! আমি তার নামে হেড অফিসে নালিশ করুম। রিফিউজি মাইয়ারা শস্তা! তাদের ধর্ম নাই, সম্মান নাই!
–বাবা, তোমারে কইলাম তো, আমি নিজের ইচ্ছায় গেছি। আমারে জীবনে কেউ কখনো এমন সম্মান করে নাই। সে ব্রাহ্মণ হইয়া আমার পায় হাত দিছে!
–ব্রাহ্মণ? স্টোরের ছোটবাবু? সে তোর পায় হাত দিছে, ক্যান?
–সে জাইত মানে না। সে আমারে দেবী কইয়া ডাকছে।
–ঐসব ঐ বান্দরদের মন ভুলানো কথা। হারামজাদারা! তোরে পয়সা দিছে? তুই পয়সা ন্যাস!
–পয়সা দেবার ক্ষ্যামতা তার নাই। সে গরিব। তার বাড়িতে অনেকগুলি খাওয়ার মানুষ।
–গরিব? স্টোরের বাবু গরিব হয়? চোর, সব শালারা চোর!
–সে চুরি করতে জানে না। সে আমারে পদ্য শুনাইছে, আর কিছু করে নাই! এবার হারীত বিমূঢ় বোধ করলো। এসব কী নতুন কথা সে শুনছে! কোনো মেয়েকে রাত্তিরবেলা ডেকে নিয়ে একজন পুরুষ পদ্য শোনায়? লোকটা কি অতি বড় শয়তান, না। পাগল। গোলাপীর কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরও অনেক কথা শুনলো হারীত, মনে মনে তখনই ঠিক করলো, এরপর ঐ স্টোরের ছোটবাবুটিকে ভালো করে যাচাই করে দেখে নিতে হবে।
পরের দিনটিই সাপ্তাহিক র্যাশান দেবার দিন। স্টোর খোলার পরই হারীত গিয়ে বসলো সেখানে। স্টোরের দু’জন বাবু, ক্ষিতীশ আর বাসুদেব, আর বাল্লু সিং চাল-ডাল ওজন করে দেয়। ক্ষিতীশ মোটাসোটা, লম্বা চওড়া চেহারা, সে-ই বড়বাবু, আর বাসুদেব রোগা-পাতলা, তার চেহারায় একটা শালিক শালিক ভাব।
হারীত একটা টুল টেনে নিয়ে বসে বললো, ওজন টোজন ঠিক মতন দেও তো, সিংজী? দ্যাখতে আইলাম!
বাল্লু সিং রাগের ভাণ করে বললো, কিউ! ম্যায় ওজন কম দেতা? কৌন বোলা!
হারীত মুচকি হেসে বললো, আমি কি কম দেওয়ার কথা কইছি? গত হপ্তায় তুমি আমারে এক কিলো অড়হর ডাইল দিলা। আমি বাড়ি গিয়া মাইপ্যা দেখি এক কিলোর উপরে এক শো গেরাম বেশী।
ক্ষিতীশ হেসে ফেললো। হারীত লোকটা অত্যন্ত ধূর্ত সে জানে, তার আক্রমণ যে কোন্ দিক দিয়ে আসবে বোঝা যায় না। বাসুদেব হাসলো না, সে মন দিয়ে খাতা লিখছে। হারীতকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখখানা ছাই রঙের হয়ে গেছে।
কলোনির অন্য কোনো লোক এই ফুড স্টোরে টুল টেনে বসবার সাহস পাবে না। কিন্তু হারীত যে এখানকার নেতা তা ক্ষিতীশদের মতন বাবুশ্রেণীর কর্মচারীরা জানে। হারীতকে রাস্তায় ঘাটে দেখলেও কলোনির প্রত্যেকটা লোক জয়বাবা কালাচাঁদ বলে ধ্বনি দেয় এবং প্রণাম করে।
হারীত বললো, সত্যি সিংজী আমারে বেশী দ্যায়। চাউলও বেশী বেশী ঠ্যাকে। তাই আমি ভাবি, আমারে বেশী দিলে অইন্য কেউ কি কম পায়?
ক্ষিতীশ বললো, বসুন, বসুন, একটা সিগারেট খাবেন নাকি?
হারীত নির্লিপ্ত ভাবে হাত বাড়িয়ে বললো, দ্যান একটা!
তারপর বাসুদেবের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ছোটবাবু সিগ্রেট খান না?
বাসুদেব মুখ না তুলেই বললো, না!
হারীত ক্ষিতীশের জ্বালানো দেশলাই কাঠি থেকে সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললো, বড়বাবু, এই চাউল কি বম মুলুক থিকা আনছেন নাকি?
ক্ষিতীশ বললো, না, না, বার্মা থেকে আসবে কেন? এ তো ইউ পি’র চাল!
হারীত বললো, কইলাম এই জন্য যে যুদ্ধের সময় আমাগো পূর্ববঙ্গে চাউলের খুব আকাল পড়ছিল। দুর্ভিক্ষ হইছিল জানেন নিশ্চয়। কত মানুষ না খাইয়া মরছে। তারপর গভোর্নমেন্ট র্যাশোনে একরকম চাউল দিল, সে চাউলের রং কালা কালা, তাতে আবার ছাইরপোকার গন্ধ। তখন অনেকে কইলো যে সেই চাউল বর্মা মুলুক থিকা আসছে, অতদূর থিকা আসছে তো তাই গন্ধ হইয়া গেছে। এখানের চাউলেও সেই গন্ধ পাই কি না!
ক্ষিতীশ বললো, গন্ধ? কই না তো! আমিও তো এই চাল খাই, কোনো গন্ধ পাই না তো!
–বড়বাবু, আপনেও এই চাউল খান? আপনার তো তাইলে দাঁত খুব শক্ত!
–হেঁ হেঁ হেঁ, দু’চারটে কাঁকর আছে বটে…তা গভর্নমেন্টের চাল, যখন যেমন পাওয়া যায়, একটু কাঁকর বেছে নিতে হয়।
–সেই যে কথায় আছে না, ভিক্ষার চাউল, তার আবার কাঁড়া না আকাঁড়া! আরও একটা কথা আছে, ঠক বাছতে গাঁ উজাড়!
কথা ঘোরাবার জন্য ক্ষিতীশ বললো, ও মশাই, আপনাদের দেশে তো যুদ্ধ বেঁধে গেছে।
চমকে উঠে হারীত জিজ্ঞেস করলো, যুদ্ধ-মানে? ইন্ডিয়া-পাকিস্তান, আবার?
–না, ইন্ডিয়া নেই। এবার ওরা নিজেরাই লড়ালড়ি করছে। মোছলমানরাই মারছে মোছলমানদের। খবরের কাগজে তো প্রত্যেক দিনই জবর খবর! পড়েননি?
–আপনার কাছে খবরের কাগজ আছে?
–আমি মেইন অফিসে গিয়ে পড়ে আসি। আজকেরটা পড়তে যাবো আর খানিক বাদে। বুঝুন দেখি কাণ্ড, মোছলমানরা আলাদা দেশ চায় বলে ইন্ডিয়া থেকে কেটে পাকিস্তান বানালো, আপনাদের দেশ থেকে তাড়ালো, এখন নিজেরা সামলাতে পারছে না। ওয়েস্ট পাকিস্তানীরা ইস্ট পাকিস্তানীদের ধরে বেধড়ক প্যাঁদাচ্ছিল, এখন ইস্ট পাকিস্তানীরাও উল্টে হাতিয়ার ধরেছে, যশোর-খুলনা-চিটাগাঙে জোর লড়াই চলছে।
হারীত তবু অবিশ্বাসের সুরে বললো, মুসলমানরা মুসলমানদের সঙ্গে লড়াই করছে, এ কখনো হয়?
ক্ষিতীশ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললো, কেন হবে না? মোগল-পাঠানে লড়াই হয় নি? শের শা’র সঙ্গে হুমায়ুন বাদশার যুদ্ধ-সে সব হিস্ট্রিতে আছে! ইস্ট পাকিস্তানের এখন নাম হয়েছে বাংলাদেশ, ওরা নাকি স্বাধীন হতে চায়! আরও মজার কথা শুনবেন ইন্ডিয়াতে আবার রিফিউজি আসছে দলে দলে। এবার কারা আসছে জানেন, মোছলমানেরা। বোঝে ঠ্যালা! আপনাদের মতন লাখ লাখ রিফিউজি নিয়েই এখনো গভর্নমেন্ট হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে, তার ওপর আবার মোছলমান রিফিউজি। বনগাঁ বড়ার দিয়ে নাকি রোজ হুড় হুড় করে ঢুকছে। কলকাতা ভরে গেছে।
বাসুদেব একবার উঠে গিয়ে বাথরুম করে এলো, তারপরও সে হিসেবের খাতা লিখতে লাগলো ঘাড় নিচু করে, এসব কোনো আলোচনাতেই যোগ দিচ্ছে না।
হারীতের মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। অন্তত গত পাঁচ বছর সে খবরের কাগজ চোখেই দেখেনি, পূর্ব পাকিস্তানের সংবাদ সে কিছুই জানে না। পশ্চিম বাংলায় কমুনিস্টরা নির্বাচনে জিতে সরকারি দলে এসেছে, এরকম একটা ভাসা ভাসা খবর সে শুনেছিল বাবুদের মুখে। তাতে তার মনে একটা আশা জেগেছিল। কমুনিস্টরা বরাবরই রিফিউজিদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে। কংগ্রেস সরকারই তো তাদের পশ্চিম বাংলা থেকে ঠেলে পাঠিয়েছে এই এতদূরে, জঙ্গলে আর পাথুরে জমিতে। কমুনিস্টরা ক্ষমতায় এলে নিশ্চয়ই রিফিউজিদের জন্য একটা। কিছু ভালো ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু এ যে একেবারে অন্য খবর। পাকিস্তানের মধ্যে ঘরোয়া যুদ্ধ! পূর্ব পাকিস্তানের নাম। এখন বাংলাদেশ? কী মধুর একটা শব্দ।
ক্ষিতীশ আবার বললো, আমার মনে হয় কী জানেন, এ লড়াই বেশীদিন টিকবে না। আবার এতগুলো রিফিউজির বোঝা ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট কতদিন ঘাড়ে নিয়ে বইবে? এবার ইন্ডিয়া। একটা গুতো দিলেই পাকিস্তান ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যাবে! তাতে তো আপনাদেরই সুবিধে হয়ে যাবে মশাই!
হারীত আরও বেশী বিস্মিত হয়ে বললো, আমাদের সুবিধা হবে? কেমন করে?
ক্ষিতীশ বললো, বাঃ, এটা বুঝলেন না? বাংলাদেশ একটা আলাদা রাষ্ট্র হয়ে গেলেই ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট বলবে, তোমাদের রিফিউজিদের ফেরত নাও। তারা নিতে বাধ্য। তখন এই রিফিউজিদের সঙ্গে আপনারাও হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়বেন। কে কবে এসেছে তার কে হিসেব রাখে। তাহলে আপনারা আপনাদের জায়গা জমি ফেরত পেয়ে যাবেন আবার।
হারীতের চোখের সামনে যেন একটা সোনালি রঙের স্বপ্ন ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আবার সেই ভিটে মাটিতে ফিরে যাওয়া যাবে? সেই পুকুর-আমবাগান-ধান ক্ষেত। এখানে এই রিফিউজি কলোনিতে চরম অপমানজনক বন্দী জীবনের চেয়ে নিজের ভিটে মাটিতে গিয়ে আধপেটা খেয়ে থাকাও সহস্র গুণ ভালো! সত্যিই কি এই স্বপ্ন সম্ভব হতে পারে! গুরু কালাচাঁদ একদিন স্বপ্নে বলেছিলেন, আবার সুদিন আসবে। সেই সুদিন কাছাকাছি এলে তিনিই জানিয়ে দেবেন। কই, তিনি তো অনেকদিন আর স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন না।
ক্ষিতীশ বললো, তবে ওয়েস্ট বেঙ্গলে যেসব রিফিউজি আছে, বিশেষ করে ক্যালকাটার আশেপাশে, তারাই বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার চান্স নেবে। আপনারা এতদূর থেকে আর কী করবেন? আপনারা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই থাকবেন। কী বললো বাসুদেব, ঠিক বলিনি!
বাসুদেবের সারা কপালে ঘাম, ঠোঁট একেবারে শুকনো। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ক্ষিতিদা, আমায় একমাস ছুটি দিতে হবে। আমি দেশে যাবো!
ক্ষিতীশ বললো, সে কি, এখন ছুটি নেবে? এই গরমের মধ্যে ছুটি নিয়ে করবে কী?
বাসুদের বললো, আমি এক বছর আর্নড় লীভ নিইনি। আমার বিশেষ দরকার।
–এখন তোমাদের বর্ধমানে খুব নকশালী হামলা চলছে, এখন যেও না, বিপদে পড়ে যাবে।
–আমায় যেতেই হবে ক্ষিতিদা, আমার মায়ের অসুখ। আমি মেইন অফিসে গিয়ে দরখাস্ত দিয়ে আসবো? এখন যাই!
হারীতও উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি মেন অফিসে যাচ্ছেন, ছোটবাবু? আপনার সাইকেলে আমারে একটু ডাবল ক্যারি করে নিয়ে যাবেন? আমি মেন অফিসে গিয়া খবরের কাগজ পড়ে আসবো!
বাসুদেব প্রায় কাঁপতে কাঁপতে বললো, আমি ডাল ক্যারি করতে পারি না। আমি ভালো সাইকেল চালাতে জানি না!
ক্ষিতীশ হাসতে হাসতে বললো, ও ল্যাকপ্যাক সিং আপনাকে ক্যারি করতে পারবে না। আপনি বরং খানিক ওয়েট করুন। স্টোর বন্ধ করার পর আমি যাবো, তখন আমি নিয়ে যাবো। আপনাকে।
হারীত বললো, থাক আমি হেঁটেই যাবো, কতই বা দূর। আট-নয় মাইলের বেশী না!
পারুলবালার কাছে একটা ছেলেকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে হারীত যোগানন্দকে সঙ্গে নিল। তার মাথায় একটা নতুন চিন্তা এসেছে। কোনোক্রমে গাড়ি ভাড়া জোগাড় করে তাকে একবার কলকাতায় ঘুরে আসতে হবে। অনেকগুলো বছর কেটে গেছে, পুলিশ নিশ্চয়ই তার ওপর এখন নজর রাখবে না। কলকাতায় গেলে সত্যি সত্যি সীমান্তের ওধারে কী ঘটছে তা জানা যাবে। তার ছেলেটার খোঁজ নিতে হবে। ত্রিদিব-সুলেখার বাড়িতে নিশ্চয়ই কয়েকদিনের জন্য থাকার জায়গা পেয়ে যাবে সে। কাছাকাছি দু’তিনখানা কলোনির মানুষ তাকে গুরু বলে মানে। প্রত্যেকটি পরিবার থেকে যদি দুটো টাকাও চাঁদা দেয়, তাতেই আসা-যাওয়ার খরচ কুলিয়ে যাবে হারীতের।
বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হারীত জিজ্ঞেস করলো, যোগা, তোরে যদি কেউ কয়, দ্যাশের বাড়িতে ফিরা যাবি, না ইন্ডিয়াতেই থাকবি, তাইলে তুই কী করবি?
যোগানন্দ বললো, আপনে এ কী জিগাইলেন বড়কা? সে চাছ পাইলে আমি অ্যাক্ষুনি ইন্ডিয়া ছাইড়া দৌড় লাগামু! কিন্তু সে চানছ কি এই জীবনে আর আসবে!
হারীত বললো, কওন যায় না। আসতেও পারে। পাকিস্তানে ভারী গণ্ডগোল লাগছে। বাংগালী মুসলমানরা নাকি ভেন্ন হইয়া স্বাধীন হইতে চায়। স্বাধীন হইলে তারা আমাগো ফিরাইয়া নেবে না!
–হ্যারাই তো আমাগো তাড়াইছে। হ্যরা আর আমাগো নেবে ক্যান?
–ইন্ডিয়ার সাথে যদি বন্ধুত্ব হয়? পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে তো ওরা মাইর খাইলো। এখন যদি ভাবে যে হিন্দুগো সাথে আর কাইজ্যা কইরা লাভ নাই, বরং মিলা মিশা থাকলে শান্তিতে থাকবে।
–আমার বিশ্বাস হয় না। বড়কর্তা, আমাগো ঘর বাড়ি কি আছে? সেই সব অরা অ্যাদ্দিনে দখল কইরা লয় নাই?
–হেইডা গিয়া একবার ঘুইরা দেইখ্যা আইলে হয়! হ দ্যাখ, আমাগো গেরামের মুসলমানরা খারাপ আছিল না, আমাগো কোনো ক্ষতি করে নাই। শহরে দাঙ্গা হইছে বইল্যাই তো আমরা ভয় পাইছি, তাই না? আমাগো ভিটায় তুলসীমঞ্চ আছিল, মুসলমানরা তুলসীগাছ সহজে নষ্ট করে না।
–বড় কত্তা, জীবনে যদি আর কোনোদিন বাপ-ঠাকুদার ভিটায় তুলসী মঞ্চের ধারে বইস্যা এক গাল মুড়ি খাইতে পারি।
কথা বলতে বলতে গলা ধরে গেল যোগানন্দর, সে বাঁ হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছলো।
প্রখর গ্রীষ্মের গনগনে দুপুর। দু’জনেরই খালি গা, ঘামে চকচক করছে। মাঝে মাঝে দু’একটা লরি ছাড়া এ রাস্তায় এই সময় আর বিশেষ গাড়ি চলে না। পেছন দিক থেকে লরি আসছে কি না, তা ওরা এক একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। একবার দেখতে পেল খুব কাছেই সাইকেল সমেত বসুদেবকে। ছুটির দরখাস্তের মুশাবিদা করতে তার খানিকটা দেরি হয়েছে।
হারীতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বাসুদেব সাইকেল থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। যেন তার সামনে একটা বিরাট বাধা, আর যাবার উপায় নেই। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো হারীতদের দিকে।
হারীত ভাবলো বাসুদেব বোধহয় তাদের কিছু বলবার জন্য থেমেছে। সে ঘুরে কয়েক পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে, ছোটবাবু!
বাসুদেবের চোখ দুটো ঝিমিয়ে এলো, যেন সে এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। এখানে গরমের সময় সর্দি-গর্মিতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। প্রত্যেক বছরই এই সময় কয়েকটা শিশু ও বৃদ্ধ মারা যায়। হারীত ব্যস্ত হয়ে আরও এগিয়ে এসে বললো, কী হয়েছে, শরীর খারাপ লাগছে?
বাসুদেব অতিকষ্টে চোখ মেলে ফ্যাসফেসে গলায় বললো, আপনারা আমাকে মারবেন তো, মারুন!
হারীত বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, কী বললেন? কে মারবে আপনারে?
বাসুদেব বললো, আপনারা মারুন। আমি দোষ করেছি, যত ইচ্ছে মারুন। তবে দয়া করে আমার ডান হাতটা ভেঙে দেবেন না, তাহলে আর আমি লিখতে পারবো না। আমার বাঁ হাত, কিংবা যে-কোনো পা…এইটুকু শুধু দয়া করুন আমাকে।
হারীত হা হা করে হেসে উঠে বললো, আপনাকে আমরা মারতে যাবো কেন? আমরা কি ডাকাত? আরে ছিছিঃ! আমি বরং আপনার কাছে একটা সাহাইয্য চাই। আপনি ছুটি নিয়া দ্যাশে যাবেন তো, আমারে সাথে লইয়া যাবেন? আমি তো এইদিকের রেলগাড়ির সব ব্যাপার জানি না। কোথায় কী টিকিট-টুকিট কেনতে হয়…আপনি বর্ধমান পর্যন্ত আমারে পৌঁছাইয়া দিলেই আমি কলকাতায় যাইতে পারবো। নেবেন আমারে আপনার সাথে?