ফারাও
‘স্পন্দন।’
‘হুঁ।’
‘স্পন্দন, শুনছিস?’
‘হুঁ, বল।’
‘কী রে? মোবাইলটা থেকে মুখ তুলে শোন আমি কী বলছি।’
পিজির জন্য গেমটা হারলাম। বিরক্ত মুখে ওর দিকে তাকাতেই ও বলল,
‘আমার না, ভবেশদাকে কেমন একটা সন্দেহ হয়, বুঝলি।’
‘কেন, সন্দেহ হওয়ার কী আছে?’
‘কি আছে! তুইই বল, আজকে ব্যাঙ্কে আসার কী মানে?’
‘মানে আবার কী? মানুষ তো ব্যাঙ্কে আসতেই পারে। এতে অবাক হওয়ার কী আছে?’
‘তোর মাথাটা ওই কমিউনিটি মেডিসিন পড়ে পড়ে ভোঁতা হয়ে গেছে। অন্য কোনো ব্যাঙ্কে এলে কথা ছিল না। কিন্তু একেবারে স্টেট ব্যাঙ্কের মেন অফিসে? ফরেন ট্রান্সাকশনের উইংয়ে! কলেজ স্ট্রিটের একটা বইয়ের গুমটির মালিকের এখানে আসার কী মানে? কে কী পাঠাচ্ছে বিদেশ থেকে? নাকি নিজেই বিদেশে…’
পিজির কথা শেষ হওয়ার আগেই এন আর আই উইংয়ের দরজা খুলে ভবেশদা বেরিয়ে এল। হাতে দেখলাম সেই ক্যাটক্যাটে লাল রঙের ফাইলটাই আছে, যেটা নিয়ে ঢুকেছিল।
‘যাক, কাজটা মিটল। থ্যাঙ্ক ইউ পিজি ভাই, তোমার মামা এই ব্রাঞ্চে ছিলেন, তাই কাজটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেল।’
‘আরে, এটা কোনো ব্যাপারই না, ভবেশদা। তা আপনার এখানে দরকারটা কী ছিল? মানে যদি…’
‘তেমন কিছু নয়। আসলে আমার এক মামাতো ভাই থাকে ইংল্যান্ডে। তো, ওর ক-টা কাজ আমাকে করতে দিয়েছিল। হয়ে গেছে। বাঁচা গেছে। চলো, এবারে তোমাদেরকে সেই দারুণ জিনিসটা খাওয়াব!’
গত সপ্তাহে ভবেশদাকে নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার স্ট্র্যান্ড রোডের ব্রাঞ্চে, যেটাকে সবাই সমৃদ্ধি ভবন বলে। ভবেশদার নাকি ওখানেই কী-একটা কাজ ছিল। পিজির মামা ওখানে চাকরি করে। কেউ চেনাশোনা থাকলে একটু সুবিধা হয়, তাই পিজির আসা ভবেশদার সঙ্গে। তবে আমার আসার কারণটা ছিল অন্য।
স্কুপ!
ব্যাঙ্কের কাজ ঠিকঠাকভাবে হয়ে গেলেই আমাদেরকে স্কুপে খাওয়াবেন ভবেশদা। এই ছিল পিজির শর্ত। এতদিন স্কুপের নামই শুনে এসেছিলাম। দারুণ দারুণ আইসক্রিম পাওয়া যায় নাকি! আমি আর পিজি কেউই আগে আসিনি এখানে। স্ট্র্যান্ড রোডের স্টেট ব্যাঙ্কের অফিস থেকে মিনিট তিরিশের হাঁটাপথে স্কুপ। প্রিন্সেপ ঘাটের একটু আগেই। গঙ্গার ধারে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট। দোতলা, ছিমছাম।
‘আইসক্রিম তো খাওয়াবই, তার আগে তোমাদেরকে স্কুপের আরেকটা জিনিস খাওয়াই বরং।’
‘কী? মেনুতে তো দেখছি পিৎজাও আছে।’
‘না না, পিৎজা না, ওটা এখানে এমন কিছু বানায় না। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাই আগে চলো, এদের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের কাছে ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি নস্যি।’
দুটো বড়ো ঠোঙা ভরতি করে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিনে আমরা এসে বসলাম গঙ্গার ধারে। তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে চারটে। রোদের চড়া ভাবটা গায়ে লাগছিল না আশেপাশের গাছগুলোর জন্য। একটা ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছিল মুখে-চোখে। স্কুপের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সত্যি খুব ভালো, কী-একটা মশলা দিয়েছে, তাতে টেস্ট আরও খোলতাই হয়েছে, মুচমুচেও বেশ। মনের সুখে পা ছড়িয়ে বসে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছিলাম এমন সময় পিজি লাফিয়ে উঠল। দেখি এক পা তুলে নাচছে।
‘উফফ! কী জোর কামড়েছে রে! একদম ফুলে গেল!’
পিজি যেখানটায় বসেছিল সেখানে দেখি লাল ডেয়ো পিঁপড়ের দল, একেবারে গিজগিজ করছে, গাছের নীচে পড়ে-থাকা শুকনো পাতার আড়ালে ছিল তাই বুঝতে পারেনি। পিজি কী সব বিড়বিড় করতে করতে আর পা চুলকোতে চুলকোতে জায়গাটা বদলে বসল।
‘খুব রাগ ধরছে না, পিজি ভাই? এই পিঁপড়েরাই কিন্তু কয়েক হাজার বছর আগে মিশরের রাজাদের কামড়াত। তোমার একটু গর্ব করাও উচিত।’
ততক্ষণে পিজি আবার মুখে এক গাদা ফ্রাই পুরেছে, স্বর বেরোনোর জায়গা নেই। তাই আমিই বললাম,
‘মিশরের রাজা?! মানে ফারাওদের কথা বলছেন?’
‘হ্যাঁ, এই পিঁপড়েগুলোকে বলে ফারাও অ্যান্ট। প্রাচীন মিশরেই নাকি এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যেত, তাই এরকম নাম।’
‘আপনি কিন্তু খুফু ছাড়া বাকি ফারাওদের নিয়ে আমাদের কিছু বলেননি।’
‘বলাই যায়, হাতে সময় আছে তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সময় তো অঢেল। কাল তো রবিবার, কলেজের চাপ নেই।’
‘ওকে। তাহলে বলাই যায়। তবে ফারাও শব্দটা কিন্তু খুব পুরোনো নয়।’
‘মানে?’
‘মানে, মিশরের রাজাদের সবসময় ফারাও বলা হত না। প্রথম যে রাজাকে ফারাও বলে সম্বোধন করা হয় সে হল আখেনাতেন। সময়টা মোটামুটি ১৩৫০ বিসি। কিন্তু মিশরের রাজাদের ইতিহাস আরও অনেক অনেক পুরোনো। প্রথম যে রাজার হদিশ পাওয়া যায় সে হল নার্মার। যিশুর জন্মের একত্রিশশো বছর আগের কথা এটা।’
‘তাহলে আগে রাজাদের কী নামে ডাকা হত?’
‘সেইসময়ে রাজাদের একটা না, তিনটে নাম থাকত, বুঝলে।
প্রথমটা হল হোরাস নাম, মানে দেবতা হোরাসের সঙ্গে নিজেকে মেলানো।’
‘মানে?’
‘মানে ধরো এই নামগুলো— ‘‘যোদ্ধা হোরাস’’, ‘‘শক্তিশালী হোরাস’’, ‘‘সূর্যের সন্তান হোরাস’’ এরকম।
‘হোরাস নামের পরে যে নাম আসত সেটা হল ‘‘নেসুবিতি’’ নাম। মানে জন্মের সময় রাজার যে নাম ছিল।
‘আর নেসুবিতি নামের পরে আসত ‘‘নেবতি’’ নাম, যে নামের মানে রাজা মিশরের উত্তর আর দক্ষিণ এই দুই ভাগেরই অধীশ্বর। এই নামে রাজাকে লিঙ্ক করা হত উত্তর মিশরের দেবতা নেখবেত আর দক্ষিণ মিশরের দেবতা ওয়াজেতের সঙ্গে।’
পিজি এবারে বলল,
‘বাবা রে! এতগুলো নাম একজনের!’
‘এতে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই, ভাই। আমাদের রাজাদেরও তো একগাদা উপাধি থাকত।’
‘হুমম, তা বটে। কিন্তু ফারাও নামটা এল কী করে?’
‘এর পিছনের গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং, বুঝলে। মিশরীয়দের কাছে রাজাদের বিশাল প্রাসাদের উচ্চারণ ছিল ‘‘প্র-ও’’। রাজার হোরাস নাম লেখার সময় চৌকো রাজপ্রাসাদ এঁকে তার ভেতরে লেখা হত। একসময় এই রাজপ্রাসাদই রাজার নামের সঙ্গে মিশে যায়। পরে গ্রিকরা এই নাম উচ্চারণ করল পার-ও। আবার হিব্রু ভাষায় যখন ওল্ড টেস্টামেন্ট লেখা হল তখন রাজার নাম হল পার-ওহ। সেখান থেকে ল্যাটিনে এল ফারাও। কোরানেও এই রাজাদের কথা লেখা আছে বুঝলে, আরবিতে উচ্চারণ ছিল ফিরা-ওন। সবশেষে ইংরেজিতে ল্যাটিন নামটাই চলে এল। তাই আজকে সবাই ফারাও নামটাই জানে।’
‘আচ্ছা ভবেশদা, একটা জিনিস মাথায় ঢুকল না, ফারাওরা নিজেদের সঙ্গে ভগবানের নাম জুড়ত কেন? আমাদের কোনো রাজাকে এমনটা করতে দেখিনি।’
‘ফারাওদের তো নিজের নামের সঙ্গে ভগবানের নাম জুড়তেই হত! সাধারণ মানুষের কাছে ওরাই তো হল ভগবানের প্রতিভূ। দেবী ‘‘মাত’’-এর কথা বলেছিলাম মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, বলেছিলেন তো বুক অফ দ্য ডেড-এর কথা বলার সময়।’
‘ঠিক, মাত ছিলেন ন্যায়ের দেবী। ফারাওদের প্রধান কাজটাই ছিল দেশ জুড়ে মাত বা ন্যায়কে বজায় রাখা। দেশের ভারসাম্য যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। যা দেশের ব্যালান্স নষ্ট করে, তা-ই মাতের বিপক্ষে। তাই ফারাওদের যেমন বিদ্রোহ দমন করতে হত, বাইরের দেশের আক্রমণ প্রতিহত করতে হত তেমনই আবার দেশে খরা বা বন্যা হলে ফারাওদেরই দায়িত্ব ছিল ভগবানের উপাসনা করা। ভেবে দেখো একবার, কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। ফারাওদের প্রায় গোটা বছরটাই কাটত নীল নদে, দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ট্রাভেল করে। তার ওপরে কোথাও যুদ্ধ লাগলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হত। ক্ষমতার লোভে রাজপরিবারের মধ্যেও খুনখারাপি কম হত না। তাই বেশিরভাগ ফারাওই তিরিশ-চল্লিশ বছরের বেশি বাঁচেননি।
‘এবারে তোমরা একটা কথা বলো দেখি, ফারাওদের ছবি দেখে চিনবে কী করে?’
পিজি বলল, ‘ছবি দেখেছি তো অনেক, মাথায় একটা কভারের মতো থাকে, মুখে আবার লম্বা দাড়ি, এদিকে গোঁফ কামানো।’
‘হুমম, কিছুটা ঠিক বলেছ। তবে ফারাও বলতেই আমরা যার ছবির কথা ভাবি সেটা তুতানখামেনের মুখোশ। কিন্তু ওই মাথার কভার আর দাড়ি ছাড়াও আরও অনেক কিছু বোঝার আছে। গুগলে সার্চ দিয়ে তুতানখামেনের ছবিটা বার করো তো।’
ছবিটা এতই বিখ্যাত যে খুঁজে পেতে দশ সেকেন্ডও লাগল না, আমার মোবাইলের স্ক্রিনের ওপরে ঝুঁকে এলেন ভবেশদা আর পিজি।
‘ভালো করে দেখো ছবিটা, মাথার ওপরে সাপটা দেখতে পাচ্ছ? ওটা কী বলো তো?’
‘ইউরেয়াস? সেই দেবতা আতুম-এর মেয়ে?’
‘বাহ! একদম ঠিক ধরেছ। সেই ইউরেয়াসই বটে। তবে এখানে এই সাপ হল দক্ষিণ মিশরের সেই দেবতা ওয়াজেতের প্রতীক, আর তার পাশে দেখো, একটা শকুনের মাথা দেখতে পাবে।’
‘বুঝে গেছি, এটা হল উত্তর মিশরের অন্য আরেকটা দেবতা, কী যেন নাম বলেছিলেন?’
‘নেখবেত। তুতানখামেনের মাথার যে কভারটা, ওর নাম হল নেমেস। মিশরের প্রায় সব রাজার মূর্তি বা ছবিতে এই নেমেস দেখতে পাবে। কিছুর সঙ্গে এই কভারটার মিল পাচ্ছ? দেখো, কেমন কানের মাথার দু-পাশ দিয়ে কাঁধের কাছে নেমে গেছে।’
‘অনেকটা সিংহের কেশরের মতো!’
‘ঠিক ধরেছ! সিংহের কেশরের মতো করেই নেমেসকে বানানো হয়েছিল, যাতে সিংহের মতো সাহস আর শক্তি যে রাজার মধ্যে আছে সেটা বোঝা যায়। এবারে দাড়িটার দিকে খেয়াল করো। মিশরে পুরুষদের গাল পরিষ্কার করে কামানো থাকত, গোঁফ বা দাড়ি রাখার চল ছিল না। কিন্তু ফারাওদের একটা নকল দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক ছিল। নিয়মটা এতটাই কড়া ছিল যে হাতসেপসুত নামের একজন রানি যখন নিজেকে ফারাও বলে ঘোষণা করেন তখন মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তাকে এই ফলস দাড়ি লাগাতেই হয়। তুতানখামেনের দাড়ির নীচটা দেখো, একটু সামনের দিকে বাঁকা, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘এবারে চট করে রামেসিস সেকেন্ড বলে সার্চ দাও তো। যে ফারাওয়ের মূর্তিটা আসবে সেটা ভালো করে দেখো।’
রামেসিসের মূর্তিও চট করে পাওয়া গেল।
‘মাথার ওপরের সাপ আর নেমেস টুপিটা তো দেখতেই পাচ্ছ। শকুনটা নেই, মানে সেই সময় রামেসিস শুধুমাত্র দক্ষিণ মিশরের রাজা ছিলেন। এবারে দাড়িটা খেয়াল করো। কোনো তফাত আছে?’
‘আছে তো। এই দাড়িটা একদম সোজা নেমে গেছে দেখছি।’
‘হ্যাঁ, তার মানে যখন এই মূর্তি বানানো হয় তখন রাজা জীবিত ছিলেন। আর তুতানখামেনের মুখোশটা বানানো হয় ওঁর মারা যাওয়ার পরে। তাই দাড়িটাও সামনের দিকে বাঁকানো।’
‘বাহ, তাহলে শুধু মাথা দেখেই তো ফারাওয়ের ব্যাপারে অনেক কিছু বলে দেওয়া যায়!’
‘হ্যাঁ, যায়ই তো। এবারে তুতানখামেনের হাতের দিকে খেয়াল করো। কী দেখতে পাচ্ছ?’
দ্বিতীয় রােমসিসের শোয়ােনা মূর্তি
‘একটা হাতে একটা লাঠির মতো ধরা আছে, মাথার দিকটা গোল করে বাঁকানো। আরেক হাতে ধরা লাঠির মাথায় তিনটে ছোটো ছোটো কাঠি লাগানো আছে।’
‘পরের যে লাঠিটার কথা বললে সেটার বাংলা কোনো শব্দ নেই, ইংরেজিতে একে ফ্লেইল বলে। এইটা দিয়ে মেরে মেরে শস্য ঝাড়াই করা হত। এর মানে ফারাও দেশের শস্যেরও রক্ষাকর্তা। আর প্রথমে যে লাঠিটার কথা বললে সেটা হল রাজদণ্ড বা স্কেপটার। এটা সবসময় নেতার হাতে দেখবে, যেমনটা আগের দিন দেবতা আতুমের হাতে ছিল। এই মাথার কাছে বাঁকানো স্কেপটারের নাম হল হেকা। আবার আতুমের হাতে থাকা স্কেপটারের নাম হল ওয়াস। একটা মজার জিনিস দেখাই তোমাদের, মোজেসের একটা ছবি খুঁজে বার করো দেখি।’
বেরোল সেই ছবি।
‘এবারে ভালো করে দেখো তো মোজেসকে।’
‘হুমম, লম্বা দাড়িওলা, এক হাতে কমান্ডমেন্টস লেখা স্ল্যাব ধরে আছে, আরেক হাতে… আরে! সেই লাঠি! মাথাটা বাঁকানো! হেকা!’
‘ঠিক ধরেছ। বাইবেলের শুরুই তো মিশরে। মোজেসের এক্সোডাস মনে আছে? সেটা হয়েছিল ফারাও দ্বিতীয় আমেনহোতেপের সময়। ইংরেজি টেন কম্যান্ডমেন্টস সিনেমাটাতে যদিও দেখিয়েছিল দ্বিতীয় রামেসিসকে। সেটা একটা বেশ বড়ো ভুল।’
গল্প করতে করতে কখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ফুরিয়ে গেছে খেয়াল ছিল না। পিজি এবারে ডাস্টবিনে ঠোঙাটা টিপ করে ফেলে বলল,
‘একটা কথা বললেন না, ভবেশদা। হায়রোগ্লিফ শেখার সময় খেয়াল করেছিলাম শুধু ফারাওদের নামগুলো কেমন একটা চ্যাপটা চাকতির মতো জিনিসে কভার করা।’
‘ও, আচ্ছা। কার্তুজের কথা বলছ?’
‘অ্যাঁ? ওগুলোকে কার্তুজ বলে?’
‘হ্যাঁ, তাই বলে তো। তবে প্রথমে কিন্তু এমনটা ছিল না বুঝলে, এটা ছিল একদম গোল। নাম ছিল শেন। আকারটা গোল ছিল কারণ এর কোনো শুরু বা শেষ নেই। তাই ফারাওদের অমরত্ব প্রমাণ করার জন্য ওদের নাম লেখা হত শেনের মধ্যে। তবে এতে একটা মুশকিল হল। ভালো করে গুছিয়ে ফারাওয়ের নামটা শেনের মধ্যে লেখা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই শেনের আকার আস্তে আস্তে বদলে লম্বাটে হয়ে গেল।’
‘তাহলে কার্তুজ, এমন নাম কেন? এটাও কি ইজিপশিয়ান নাম?’
‘ধুস, মোটেই ইজিপশিয়ান নয়, ফ্রেঞ্চ। আর ফ্রেঞ্চ উচ্চারণে ওটা হয় কার্তুস।’
‘বলেন কী! ফ্রেঞ্চ?’
‘হ্যাঁ। নেপোলিয়নের সেনারা ইজিপ্টে আসার পরে চারিদিকের মন্দিরে, কবরের দেওয়ালে এই লম্বাটে চিহ্নগুলো দেখতে পাচ্ছিল। কিন্তু তখনও তো হায়রোগ্লিফের মানে কেউ জানতই না। তাই কী লেখা আছে ওতে সে-ব্যাপারে কোনো ধারণাই হয়নি ওদের। চিহ্নটা দেখতে অনেকটা বন্দুকের গুলির মতো ছিল, যার ফরাসি নাম কার্তুজ। তাই ওরকম নাম হয়ে গেল।’
‘আচ্ছা ভবেশদা, আপনি ফারাওদের গল্প জানেন? মানে আমরা তো যেটুকু জানি তা ওই তুতানখামেনেরই।’
‘হ্যাঁ, তুতানখামেন তো ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ইনসিগনিফিক্যান্ট ফারাও ছিলেন। রামেসিস, হাতসেপসুত, আখেনাতেন, সেতি এদের গল্প বললে অবাক হয়ে যাবে! আমি জানি কিছু কিছু, আরও কিছু পড়ছি এখনও। বলব তোমাদের এক এক করে। তবে ফারাওদের গল্পটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবরে শুরু, বুঝলে।’
‘কবরে? মানে ঠিক বুঝলাম না।’
‘অধিকাংশ ফারাওদেরই তো জীবদ্দশায় লেখা কোনো জীবনী পাওয়া যায়নি। সেইসময় রাজদরবারে হওয়া কাজকর্মের রোজনামচা লিখে রাখারও কোনো চল ছিল না। তাই ফারাওদের সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা ওই ফারাওদের প্রতিষ্ঠা করা মন্দিরের গায়ে অথবা ওদের কবরের গায়ে লিখে রাখা লিপি থেকে। অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো সেগুলো অনেক বাড়িয়ে বলা, রাজাকে গ্লোরিফাই করার জন্য। তবে ওইটাই আমাদের একমাত্র সম্বল। সেইসব কবর আর মন্দির আবিষ্কার করার গল্পও দারুণ ইন্টারেস্টিং! তাই ফারাওদের গল্প বলতে গেলে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আর্কিয়োলজিস্টদের গল্পও চলে আসবে।
‘যেমন হাওয়ার্ড কার্টার!’
‘শুধু কার্টার না, বেলজোনি, বুর্খার্ট, জাহি হাওয়াস এমন অনেকের কথা বলতে হবে। এখন চলো স্কুপে ফেরা যাক। আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করা যাবে না হয়।’