১৫. প্রকাশকদের সঙ্গে দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা

১৫.

প্রকাশকদের সঙ্গে আমার দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতা এস্থলে অবান্তর।

তবে এস্থলে এ বাবদে একটি কথা বলতে হয়। শহর-ইয়ারদের বিস্তর টাকাকড়ি। আমার অর্থাভাব সে ভালোভাবেই বুঝত, কিন্তু বুদ্ধিমতী রমণী বলে আরও জানত আমাকে কোনওপ্রকারের সাহায্য করতে চাইলে আমার আত্মাভিমানে লাগবে।

একদিন তাকে ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিলুম, আমি জীবনে সাতবার না আটবার কবার চাকরি রিজাইন দিয়েছি বলতে পারব না। কারও সঙ্গে আমার বনে না। যখন চাকরিতে থাকি, তখন সাহিত্য-সৃষ্টির কোনও কথাই ওঠে না। মাইনের টাকা তো আসছে, বই লেখার কী প্রয়োজন? চাকরি যখন থাকে না, তখন পঞ্চতন্ত্র, শন এসব আবোলতাবোল লিখতে হয়।

শহর-ইয়ার তাজ্জব হয়ে শুধিয়েছিল, আপনি শুধু টাকার জন্য লেখেন!

 আমি বলেছিলাম, এগজ্যাকটলি! মোস্ট সানেলি! 

তার পর বলেছিলুম, জানো শহর-ইয়ার, এ বাবদে অন্তহীন সাহিত্যাকাশে আমিই একমাত্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তারকা নই। মহা মহা গ্রহ-উপগ্রহও ওই একই নভোমণ্ডলে বিরাজ করার সময় বলেছেন, লজ্জাঘৃণাভয় অনায়াসে তাচ্ছিল্য করে বলেছেন, কথাগুলো আমার ঠিক ঠিক মনে নেই, তবে মোদ্দা কথা এই, না বাট এ ফুল রাইটস একসেপ্ট ফর মানি অর্থাৎ অর্থাগম ভিন্ন অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে লেখে শুধু গাড়োলরাই। স্বয়ং ডক্টর জনসন বলেছেন, আমি লিখি টাকার জন্য! বুঝলে ইয়ার, শহর-ইয়ার?

ঈষৎ ভ্রুকুঞ্চন করে শহর-ইয়ার শুধিয়েছিল, আচ্ছা, কাল যদি আপনি দশ লক্ষ টাকার লটারি জিতে যান তবে কী করবেন? (আমি জানতুম ডাক্তারের জমিদারি, কলকাতার গণ্ডা গণ্ডা বাড়ি থেকে প্রতি মাসে ওদের দশ-পনেরো হাজার টাকা আমদানি হয়, আর ব্যাংকে আছে দশ-পঁচিশ লাখ)।

আমি সোল্লাসে বললুম, দশ লাখ? পাঁচ লাখ পেলেই আমার কাজ হাসিল। সঙ্গে সঙ্গে কালি কলম কাগজ পুড়িয়ে দিয়ে বলব, বাঁচলুম। এখন থেকে লিখব শুধু প্রেমপত্র, আর, আর চেকের উল্টো দিকে নামসই।

শহর-ইয়ার টাকাকড়ি বাবদে বড়ই অনভিজ্ঞা। শুধাল, চেকের উল্টো-পিঠে সই, তার অর্থ কী? আমি লক্ষ করলুম, প্রেমপত্র নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন শুধাল না। আর চেকফেক তো তার স্বামীর নায়েব সই করে। সে-সব জিনিস তার জানার কথা নয়।

বললুম, চেকের উল্টোপিঠে সই, মানে সে-টাকা আমি পাব। আর এ পিঠে সই, তার মানে টাকাটা আমাকে দিতে হচ্ছে। জানো না, দিশি ছড়া :

হরি হে রাজা করো, রাজা করো।
যার ধারি তারে মারো ॥
যার ধারি দু চার আনা,
তারে করো দিন-কানা।
 যার ধারি দুশ চারশ
তারে করো নির্বংশ ॥

 বুঝলে, চেকের এ পিঠে সই করার প্রতি আমার অনীহা কেন?

এস্থলে বলে রাখাটা প্রয়োজন মনে করি যে, আমার যে কটি ইয়েমেন চেলা আছে, তারা সবাই তখন বলে, না, স্যার! আপনার দশ লাখ টাকা পাওয়ার কোনও প্রয়োজন নাই। ভগবান করুন, আপনার যেন চাকরি না জোটে। তাহা হইলে আপনি লেখনী বন্ধ করিবেন না। ফলস্বরূপ বঙ্গসাহিত্য শ্রীবৃদ্ধিশালী হইবেক, শনৈঃ শনৈঃ উন্নতিমার্গে উচ্চাশ্রমে প্রবেশ করিবেক।

কিন্তু শহর-ইয়ার এস্থলে সে-বুলি আওড়াল না। সে বুদ্ধিমতী মেয়ে। বিলক্ষণ জানে, আমার সাহিত্যসৃষ্টি সাম্প্রতিক যত মূল্যই ধরুক তার দীর্ঘস্থায়ী মূল্য না-ও থাকতে পারে।

তা সে যাই হোক, প্রকাশকের কাছে দরিদ্র লেখকের দু পাঁচ টাকার জন্য ধন্নে। দেওয়াটা সে বিতৃষ্ণার সঙ্গে শুনে যেত। তার সহানুভূতি ছিল লেখকের সঙ্গে।

তাই জানতুম সে আমাকে শুধাবে না, আমি টাকা পেলুম কি না।

.

ড্রাইভার যখন বঙ্কিম চাটুয্যে স্ট্রিটে পৌঁছল তখন তাকে বললুম, তুমি বাড়ি যাও, আমি ট্যাসি ধরে ফিরব। মা-জি পীরের বাড়ি যাবেন। গাড়িটার দরকার হবে।

কাঁচুমাচু হয়ে বললে, কিন্তক সায়েব যে বললেন, আমি আপনার জন্য গাড়িটা রাখি।

স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, ড্রাইভারও শহর-ইয়ারের এই গুরু নিয়ে মাতামাতি পছন্দ করে না।

তাই দৃঢ় এবং মোলায়েম কণ্ঠে বললুম, না, ভাই, তুমি বাড়ি যাও।

 ড্রাইভারকে শুধিয়েছিলুম, পীরের নাম-ঠিকানা কী?

 ঘণ্টাখানেক পরে সেই উদ্দেশে রওনা দিলুম।

আমার এক মুসলমান চেলা একদিন আমাকে বলেছিল, সে নাকি তার এক ল্যাটাই-ভক্ত দোস্তের পাল্লায় পড়ে সেই দোস্তের পীর দর্শনে যায়। গিয়ে তাজ্জব মেনে দেখে, গুরু বসে আছেন একটা বিরাট হলের মাঝখানে। আর তাঁকে ঘিরে গোটা আষ্টেক ডপকী হুঁড়ি দাঁড়িয়ে। তাদের উত্তমাঙ্গে ব্লাউজ-চোলি নেই। ক্ষণে ক্ষণে শাড়ি খসে পড়ে গিয়ে বক্ষঃস্থল অনাবৃত করে দিচ্ছে। কেউ তখন শাড়ি তোলে, কেউ তোলে না। আর গুরু বলছেন, এই দেখো, আমি চতুর্দিকে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছি, কিন্তু আমার ঘি গলছে না।

আমি ভেবেছিলুম, অতখানি না হলেও অনেকটা ওই রকমেরই হবে। শহর-ইয়ার নিশ্চয়ই কোনও বুজরুক শার্লাটেনের পাল্লায় পড়েছে।

বিরাট গৃহে বসে আছেন পীরসাহেব। আমি তার দিকে তাকিয়ে হতভম্ব।

পীরটি তো আমার প্রাচীন দিনের বন্ধু আমিনুর রশিদ মজুমদার!!

.

১৬.

আমি স্তম্ভিত।

আমি বেকুবের মতো বাক্যহারা। এমনকি পীরসাহেবকে সেলামটা পর্যন্ত করতে ভুলে গিয়েছি। পীর মানি আর না-ই মানি, স্বেচ্ছায় পীরের আস্তানায় গিয়ে তাকে সেলামটা পর্যন্ত করলুম না, এতখানি বেয়াদব, বেতমিজ মস্তান আমি নই।

বাড়িটা খুঁজে বের করতে আমার কিছুমাত্র অসুবিধা হয়নি। পার্ক সার্কাস আমার চেনা পাড়া। পীরমুর্শিদরা সচরাচর এ পাড়াতেই আস্তানা গাড়েন। আমার এক পুত্রবৎ সখা মুসলমান ছেলে, কচিবাবু যে আমাকে একদিন বলেছিল, ওই পীরসাহেবের কথা, গিয়ে দেখেছিল পীরসাহেবের চতুর্দিক গোটা আষ্টেক খাপসুরত ডপকী হুরী তার চতুর্দিকে তাঁকে ঘিরে বসে আছে। আর তিনি নাকি ক্ষণে ক্ষণে উদ্বাহু হয়ে বলছেন, এই দেখ, এই দেখ, আমার চতুর্দিকে আমি আগুন জ্বালিয়ে রেখেছি, কিন্তু আমার ঘি গলছে না, আমার ঘি গলছে না। কচিবাবু নাকি এক্কেবারে বেবাক নির্বাক হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।

আমি কিন্তু সেভাবে হতভম্ব হইনি।

সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় মনে হয়েছিল, একতলাতে বাড়ির মালিক সপরিবার বাস করেন, দোতলাতে পর্দা চিক ঝিলিমিলির প্রাচুর্য থেকে অনুমান করলুম, এখানে পীরসাহেবের শিষ্যরা আলাদাভাবে থাকেন, আসেন।

তেতলায় যে ঘরে পীরসাহেব বসে আছেন সেটি অনাড়ম্বর। খানচারেক তক্তপোশ মিলিয়ে একটি ফরাশ। পীরসাহেব ছোট্ট একটি তাকিয়াতে হেলান দিয়ে ওই তক্তপোশেই উপবিষ্ট কয়েকজন শিষ্যকে কী-একখানা চটিবই থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন।

তক্তপোশের এ পারে কয়েকখানি চামড়ামোড়া আরাম-কেদারা।

এসবেতে হতভম্ব হবার মতো কিছু নেই।

পীরসাহেবের চতুর্দিকে ঘি-গলানেউল্লী অষ্টরমণী নেই, এমনকি চিত্রে খ্রিস্টান সেন্টদের মস্তকের চতুর্দিকে যে হেলো বা জ্যোতিঃচক্র থাকে সেটি পর্যন্ত তার মস্তক ঘিরে নেই।

লৌকিক, অলৌকিক, কুলৌকিক কোনও কিছুই নেই। অত্যন্ত সাদামাটা পরিস্থিতি।

 আমি স্তম্ভিত হলুম পীরসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে।

আমি আন্দেশা করেছিলুম, দেখতে পাব এক বুজরুক, ভণ্ড, শার্লাটেন। আমারই ভুল, আমারই বোঝা উচিত ছিল, শহর-ইয়ার এরকম কাঁচা মেয়ে নয় যে বুজরুকি দেখে বানচাল হবে।

আমি অবাক, এই পীরটি আমার সাতিশয় পরিচিত জন।

 বছর পঁচিশেক পূর্বে এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় স্বর্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর খ্যাতনামা পুত্র, পণ্ডিত বিনয়তোষ ভট্টাচার্যের বাড়িতে বরদায়; বিনয়তোষ ও আমি তখন বরোদাতে সরকারি কর্ম করি। পীর খাঁটি বাঙালি মুসলমান।

শহর-ইয়ারকে মনে মনে পুনরায় সানন্দ নমস্কার জানালুম। বাঙালি মাত্রই কি হিন্দু, কি মুসলমান হরকত তাকিয়ে থাকে পশ্চিমবাগে। কনৌজের ব্রাহ্মণগুরু, দিল্লির মুসলমান পীর এরা যেন এই পাপ বঙ্গদেশে আসেন পশ্চিমের কোনও-এক পুণ্যলোক থেকে। একমাত্র কাবুলে দেখেছি, সেখানকার হাজার ষাটেক হিন্দু পুববাগে তাকায়, কারণ পশ্চিমবাগে তো আর কোনও হিন্দু নেই। তাই প্রতি দু তিন বৎসর অন্তর তাদের এক গুরু আসেন বৃন্দাবন থেকে। তাদের মন্ত্র নেওয়া প্রাচ্চিত্তির-ফিত্তির করা বছর দুয়েকের জন্য বন্ধ থাকে।

শহর-ইয়ারের হৃদয়-মন গড়ে দিয়েছেন বাঙালি রবীন্দ্রনাথ।

ধর্মক্ষেত্রে সে যখন অবতরণ করল তখন সে বরণ করেছে, বাঙালি পীর। বাঙালি পীরই তো বাঙালি রমণীর অভাব-অপরিপূর্ণতা বুঝতে পারবে সবচাইতে বেশি। শহর-ইয়ার পশ্চিমবাগে তাকায়নি।

এই পীরটির নাম অবশ্য তখনও তিনি পীর হননি– আমিনুর রশিদ মজুমদার। তিনি গুজরাতে এসেছিলেন মধ্যযুগের পীরদের আস্তানার সন্ধানে। কবীর, দাদু, জমাল কমাল, বুডট এদের অনেকেই তাদের হিন্দু-মুসলমান-সম্প্রীতিমূলক মতবাদ প্রচার করেন গুজরাতে। তদুপরি বরোদার অতি কাছেই নর্মদা নদী বয়ে যাচ্ছেন। হিমালয়ে প্রধানত থাকেন সাধু-সন্ন্যাসী। নর্মদার পারে পারে থাকেন পীর-ফকির সাধু-সন্ন্যাসী দুই সম্প্রদায়। স্বৰ্গত অরবিন্দ ঘোষ বরোদায় অধ্যাপনা করার সময় প্রতি শনি-সোম কাটাতেন নর্মদার পারে পারে উভয়ের সন্ধানে।

এই আমিন সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে তখনই বুঝে গিয়েছিলুম যে, বিনয়তোষ সত্যই একটি সত্যান্বেষীকে বাড়িতে এনেছেন তাঁর চিন্তাধারা তাঁর অভিজ্ঞতা জানবার জন্য।

বিনয়তোষের ধর্মপত্নী ছিলেন ভূদেববাবুর আদর্শ ছাড়িয়েও প্রাচীনতরা হিন্দু-গৃহিণী। এদিকে পূজাআচ্চা ব্রত-উপবাসে পান থেকে চুন খসত না, ওদিকে দরিদ্রনারায়ণ অতিথিসেবার বেলা তিনি বিলকুল নিষ্পরোয়া মুচি-মোচরমান ডোমাড়ালের সেবা করে যেতেন। বিরাট কাঁসার থালায় তিনি আমিনুর রশিদ মিঞার সেবা করলেন।

বিনয়তোষের অনুরোধে তাঁর ওপেল গাড়িতে করে মিঞাকে তাঁর বাসস্থানে নিয়ে গেলুম। সেখানে গিয়ে দেখি, তিনি একটি নিমবস্তি অশান্ত অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন।

আমি একটু আবছাভাবে যেন ক্ষীণস্ফুট আত্মচিন্তা করলুম, এখানে আপনার অসুবিধা হচ্ছে না?

আমিন সাহেবের স্মিতহাস্যটি বড় মধুর এবং কিঞ্চিৎ রহস্যময়। বললেন, তেমন কী আর অসুবিধে। এদের অধিকাংশই মুসলমান। কাপড়ের মিলে কাজ করে। মদ খায়, জুয়ো খেলে আর বউকে ঠ্যাঙায়। কিন্তু আমার মতো বেকারের প্রতি তাদের স্নেহ আছে প্রচুর। তবে মাঝে মাঝে বড্ড বেশি চিৎকার হৈহুল্লোড়ের দরুন আমার কাজের একটু-আধটু অসুবিধে হয় বৈ কি!

আমি একটু আশ্চর্য হয়ে শুধিয়েছিলুম, আপনার কাজটা কী?

রশিদ সাহেব কোনও উত্তর দেননি। আমি অনুমান করলুম, তিনি যে শুধু নর্মদার পারে পারে তত্ত্বানুসন্ধান করছেন তাই নয়, খুব সম্ভব ধ্যানধারণা, জিতসৃবি, যোগাভ্যাস, সুফি-চিত্তবৃত্তি-নিরোধও করে থাকেন।

অতিশয় সবিনয় কিন্তু কিন্তু করে নিবেদন করলুম, আপনার যদি কোনও আপত্তি না থাকে তবে আমার বাড়িতে এসে থাকুন না।

কী দরকার! এই তো বেশ চলে যাচ্ছে। আপনাদের অসুবিধে হবে হয়তো।

আমি বললুম, আমি তো একা থাকি। মাত্র একটি পাঁচক আছে। তবে সে মাছ-মাংস ছোঁয় না। ফলে আমিও বাড়িতে নিরামিষাশী। আপনার একটু কষ্ট হবে। আর আমার দিন কাটে কলেজে। অপরাহূ আর রাত্রির এক যাম কাটাই আমার পার্শি সহকর্মী অধ্যাপক ওয়াডিয়ার বাড়িতে।

জানিনে, হয়তো এই নিরামিষের চ্যালেঞ্জ মৎস্যভুক বঙ্গসন্তানকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসে।

কিন্তু আমিন মিঞা যদিও মাঝে মাঝে আমাকে নর্মদার পীর-ফকির সাধুসন্ন্যাসীদের কাহিনী শোনাতেন তবু তিনি ছিলেন ঘোরতর সংসারী। প্রতি ভোরে ফজরের নামাজ পড়ে পাঁচক ইন্দ্ররায়কে নিয়ে বেরুতেন বাজারে। কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরে কুটনো কুটতেন, কয়লা ভাঙতেন, উনুন ধরাতেন আর ইন্দ্ররায়কে হাতেকলমে বাতলাতেন কী প্রকারে ছানার ডালনা, ধোকার ঝোল, বড়ির চচ্চড়ি তৈরি করতে হয়।

আমি অত বোকা নই। আমি বুঝে গিয়েছি, তিনি কারও স্কন্ধারোহণ করে মুফতে থাকতে চান না। বরং যদ্যপি আমি সংসার চালানো বাবদে একটা আস্ত অগা, তথাপি লক্ষ করলুম, চিরকুমারকে বিবাহ বাবদে উৎসাহিত করে লোকে যে বলে, টু ক্যান লিভ অ্যাজ চিপলি অ্যাজ ওয়ান–স্বামী-স্ত্রীর যা খরচা অবিবাহিত পুরুষেরও সেই খরচা সেটা কিছু মিথ্যে প্রলোভনকারী স্তোকবাক্য নয়। দু জনার খরচাতে তিনজনেরও চলে। তদুপরি তখন ছিল সস্তাকড়ির বাজার।

বড় আনন্দে বড় শান্তিতে কেটেছিল ওই ছ টি মাস। কখনও আমিন মিঞার ঘরে, কখন বিনয়তোষের বারান্দায়, কখনও ওয়াডিয়ার রকে আমাদের চার-জনাতে নানাপ্রকারের আলোচনা হত। সবচেয়ে মজার লাগত, বিনয়ভোষ তন্ত্রঘেঁষা, আমিন মিঞা ভক্তিমার্গের সুফি, আর বরোদা-আহমদাবাদ, সুরাট-বোম্বাইয়ের তাবজ্জন জানত, চার্বাকের পর সোহরাব ওয়াডিয়ার মতো পড় নাস্তিক কস্মিনকালেও ইহভুবনে অবতীর্ণ হননি।

.

তার পর একদিন আমাদের কাউকে, এমনকি তার জান-দিলের দোস্তো ইন্দ্ররায়কে ছায়ামাত্র আভাস-ইঙ্গিত না দিয়ে আমিন মিঞা এক গভীর দ্বিপ্রহর রাত্রে নিরুদ্দেশ। জানতুম, অনুসন্ধান বৃথা, তবু আমরা তিনজনাই মাঝে-মধ্যে সেটা করেছিলুম। কোনও ফল হয়নি।

তার পরিপূর্ণ ত্রিশ বৎসর পর আবার আমাদের চারি চক্ষে মিলন।

পীরও কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলেন; তবে পীর, পুলিশ, ব্যারিস্টার, ডাক্তার সংসারের এত শত বিচিত্র জিনিস দেখবার সুবিধে-কুবিধে পান যে তাঁদের অভিজ্ঞতার কেলাইডেসকোপ যত বিচিত্র প্যাটার্ন তৈরি করুক না কেন, এঁরা সংবিৎ হারান না। কোন বাকে কী ধন দেখাবে, কোনখানে কী দায় ঠেকাবে? এই অপ্রত্যাশিতের আশা। কবিদের পীর-পুলিশের নয়।

ততক্ষণে আমি সংবিতে ফিরেছি। আদব-মাফিক মাথা ঝুঁকিয়ে ওঁকে একটা সালাম জানিয়েছি। তিনি প্রত্যভিবাদন জানালেন। যদিও আমার শোনা ছিল, বহু পীর বহু গুরু প্রতিনমস্কার করেন না।

কারণ এত রবাহূত, অনাহূত এমনকি অবাঞ্ছিত জনও পীরের ঘরে সুবোশা আনাগোনা করে যে এক পলিটিশিয়ান ভিন্ন অন্য কোনও প্রাণীর সাধ্য নেই যে, প্রত্যেককে ব্যক্তিগত সালামালিক জানায়, বা শতংজীব বলে।

আস্তানায় গিয়েছিলুম বেলা প্রায় চারটার সময়। ওই সময় আসরের নামাজ বা অপরাহুঁকালীন উপাসনা আরম্ভ হয়। পীরসাহেব আসন ত্যাগ করে অন্য ঘরে চলে গেলেন অনুমান করলুম, নামাজ পড়তে। মুরিদান (শিষ্য সম্প্রদায়) পাশের মসজিদে নামাজ পড়তে রওনা হলেন। আমি কী করব, কী করব ভাবছি এমন সময় একজন গেরেমভারি চেলা এসে আমাকে কানে কানে বললেন, হুজুর আপনাকে তসলিমাৎ জানিয়েছেন। হুজুরের নামাজ-ঘরে একটুখানি আসবেন কি? যে সসম্ভ্রম-কণ্ঠে চেলাটি আমাকে দাওয়াত-সন্দেশটি জানালেন, তার থেকে অনায়াসে বুঝে গেলুম যে পীরের নামাজ-ঘর হোলি অব্‌ হোলিজ, সানথটুম-সানকটরুম, হিন্দু-মন্দিরের গর্ভগৃহপ্রায়। সেখানে প্রবেশাধিকার অল্পজনেরই। আর আমি প্রথম ধাক্কাতেই!

নামাজ-ঘরে ঢুকতেই পীর আমাকে আলিঙ্গন করলেন, তার পর ঘরের এক কোণে পাতা একখানি সিলেটি শেতল-পাটিতে আমাকে বলেন, নিজেও বসলেন। দু একটি কুশল প্রশ্ন শুধিয়ে বললেন, আপনি একটু নাশতা করুন। ততক্ষণে আমি নামাজটি সেরে নিই।

আমি বাধা দিয়ে বললুম, সে কী করে হয়? আপনি নামাজ সারুন। তার পর একসঙ্গে খাব।

অভিমানভরা কণ্ঠে পীর আমিন বললেন, এই তো আপনার সখার প্রতি ভালোবাসা, আর এই তো আপনার স্মৃতিশক্তি। আমি যে দিনে একবার খাই সে-ও ভুলে গেছেন?

আমি বেহদ শরম পেলুম। এটা আমার মনে রাখা উচিত ছিল। তাই লজ্জাটা ঢাকবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গে আমার মতো মূখের মাথায়ও একটি মিথ্যা সদুত্তর জুটে গেল– নিছক আল্লার মেহেরবানিতেই বলতে হবে। কারণ আসমান-জমিনে কে না জানে, মা সরস্বতী মূর্খকেই (যথা কালিদাস) হরহামেশা দয়া করেন; নইলে চালাকরা নিশ্চয়ই এতদিনে আমার মতো কুল্লে বেওয়ারিশ বেকুবের সর্বস্ব গ্রাস করে, আমাদের সত্য নাশ করে আমাদের পিতামহাশয়দের নির্বংশ করত।

সেই কিস্মৎ-প্রসাদাৎ প্রাপ্ত কদুত্তরটি দিতে গিয়ে জড়িত কণ্ঠে বললুম, তা-তা-তা, সে-সে, সে তখন আপনি আপনি ছিলেন আমার গরিবখানায়।

পীরের কপালে যেন হালকা মেঘের সামান্য আবছা পড়েছে। তাই দেখে আমি থেমে গেলুম। তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, আর এখন আমি পীর– না? এখন আমি যত খুশী গাণ্ডেপিণ্ডে গোগ্রাসে যত চাই তত গোস্ত গিলতে পারি না?

থেমে গেলেন। আমি আশঙ্কা করেছিলুম, এর পর তিনি আমাকে খোটা দিয়ে বলবেন, তাই আমি পীর হয়েছি– না? চেলাদের ঘাড় ভেঙে তাদের মগজ দিয়ে মুড়িঘণ্ট খাব বলে না?

না। এ লোকটি যে অতিশয় ভদ্র।

আমি চুপ করে গিয়েছি দেখে বললেন, ভাই সৈয়দ সাহেব, আমি জানি, আপনি খাঁটি পীরের নাতি। আপনি কথার মুখে কথায় কথায় ওটা বলে ফেলেছেন।

আমি খুশি হয়ে বললুম, আমি যে পীরের নাতি সেটা মেহেরবানি করে আর তুলবেন না, সেটা দয়া করে ভুলে যান। আপনি তো নিশ্চয়ই ভুলে যাননি ধর্মাবদে আমি একটা আস্ত চিনির বলদ। ওটা দেখেছি, শুঁকেছি, ওর দরদাম নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছি, কিন্তু ওটা ককখনও চাখিনি– খেয়ে দেখা তো দূরে।

তিনি বললেন, এসব কথা পরে হবে; কেন আমি এখানে আছি, কেন আমি পীর রূপে এখানে দর্শন দিচ্ছি–

ইতোমধ্যে সেই গেরেমভারি চেলা একটা বিরাট ট্রে নিয়ে এসে আমার পাশে রেখেছেন। তার উপর অতিশয় সযত্নে সাজানো দু খানি মুড়মুড়ে চেহারা তেকোনা পরোটা, গ্রেট ইস্টারনের পাঁউরুটির মতো ফোলানো টেবো-টেবো বিরাট একটি মমূলেট, ডুমো-ডুমো আলু-ভাজা, এবং কাঁচালঙ্কার আচার।

আমি আবার পেলুম দারুণ শক। এসব যা এসেছে এ তো আমার জন্য তৈরি করা শহর-ইয়ারের ফেভারেট মেনু!

এ তো আমাদের উভয়ের প্রিয় মেনু!

কী করে শহর-ইয়ার জানল, আমি এখানে এসেছি?

 কিন্তু এ শকটা সামলাতে না-সামলাতে পেলুম এর চেয়ে মোক্ষমতর দুসরা শক্।

পীরসাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, শহর-ইয়ার বানু। আর কিছু না বলে খাটে উঠে নামাজ পড়তে আরম্ভ করলেন।

.

১৭.

আমি মিরাকল বা অলৌকিক কাণ্ডকারখানায় বিশ্বাস করিনে। যে ইরান কর্তাভজা গিরিতে ভারতের সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে তারই এক গুণীজন হাফ-মশকরা করে বলেছেন :

পীরেরা ওড়েন না, ওঁদের চেলারা ওঁদেরকে ওড়ায়।

 পীরহা নমিপরনদ, শাগিরদান উনহারা মিপরানদ।

 বিশেষত, এই পীর আমিন সাহেবকে আমি অন্তরঙ্গভাবে একদা চিনেছিলুম। তিনি যে এরকম একটা বাজে স্টার্ট মারবেন– খাস করে আমার ওপর– যে, তিনি অলৌকিক প্রক্রিয়ায় ধরে ফেলেছেন, আমি শহর-ইয়ারের সন্ধানে এসেছি সেটা আমি বিশ্বাস করতে নারাজ। কাজেই সেকথা পরে জিগ্যেস করে জেনে নেব।

কিন্তু শহর-ইয়ার জানল কী করে যে আমি এখানে এসেছি?

সে নিজে পর্দা মানে না, কিন্তু পীরসাহেব যে তাঁর শিষ্যাদের সম্পর্কে কিছুটা মানেন সেটা দোতলার চিহ্ন, পর্দা থেকে খানিকটে অনুমান করেছিলুম। কিন্তু সেই চিকের আড়াল থেকে শহর-ইয়ার যে উঁকিঝুঁকি মারবে সেরকম মেয়ে তো সে নয়। বরঞ্চ আজকের মতো মেনে নিলুম, শহর-ইয়ার অলৌকিক শক্তির অধিকারিণী হয়েছে। আজ বাড়ি ফিরে যদি কথা ওঠে, তবে সেই ইরানি গুণীর হাফ-মশকরাকে ডবল প্রমোশন দিয়ে তাকে বলব–

পীরেরা ওড়েন না, কিন্তু ওঁদের চেলাদের, বিশেষ করে চেলীদের কেউ কেউ ওড়েন।

 পীরহা নমিপরনদ, ওয়া লাকিল বাজি শাগিরাদান্ সখুসান জনানা মিপরন্দ।

এতে তাজ্জব বনবার মতো কীই-বা আছে? ঠাকুর রামকৃষ্ণ বিশ্বজয় করেননি কিন্তু তাঁর শিষ্য বাগ্মীরাজ বিবেকানন্দ করেছিলেন।

একজন নামাজ পড়ছেন, তার অনতিদূরে আরেকজন খাচ্ছে– এটা দৃষ্টিমধুর না হলেও ইসলামে বারণ নয়। হুঁঃ! বারণ হবে কেন? দূর-সম্পর্কের আমার ফুফুকে দেখেছি, বাচ্চার মুখে মাই তুলে দিয়ে তসবি-মালা জপ করতে।

আমি কোনওপ্রকারের শব্দ না করে মিনিমামতম পরোটা খাচ্ছি– যদ্যপি শহর-ইয়ারের আপন হাতে সযত্নে তৈরি (এটা ভুল বললুম, তাকে আমি অযত্বে কখনও কোনও কাজ করতে দেখিনি) খাস্তা, ক্রিসৃপ, মুরমুরে পরোটা মর্মর ধ্বনিবিবর্জিত কায়দায় খেতে পারাটা একটি মিনি-মিরা — এমন সময় আমার চিন্তাম্বরের একপ্রান্তে একটি বিদ্যুল্লেখা খেলে গেল।

ওহ্! তোমার আপন বাড়িতে আমি কী খাই না-খাই সে-বাবদে তুমি আমার যত না দেখ-ভাল করো তার চেয়ে এখানে তোমার হুশিয়ারি ঢের বেশি টনটনে। গুরুর বাড়ির ইজ্জত? না?

অভিমানভরে হাত-চলা বন্ধ হয়ে গেল।

 কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার বিবেকাম্বরে আরেকটি সৎ বুদ্ধির বিদ্যুতা শাখা-প্রশাখা মেলে দিলঃ

আমি কী নেমকহারাম! মাত্র অর্ধদিবস, তার চেয়েও কম, হয়তো সম্পূর্ণ অজানায়, সে বাড়িতে ছিল না বলে আমি আমার পরিচিত পরিচর্যা পাইনি। আর সঙ্গে সঙ্গে বেবাক ভুলে গেলুম তার এতদিনের দিল-ঢালা খেদমত, প্রাণ-ভরা সেবা? ছিঃ! এ তো সেই প্রাচীন কাহিনীর নিত্যদিনের পুনরাবৃত্তি! যে-লোক একদা আমাকে হাতি দিয়েছে, ঘোড়া দিয়েছে, সে আজ বেড়ালটা দিল না বলে তনুহূর্তেই নিলাজ নেমকহারামের মতো তাবৎ অতীতের অকৃপণ দান ভুলে গিয়ে মার মার, কাট কাট হুহুঙ্কার ছেড়ে তার পশ্চাতে খাণ্ডার নিয়ে তাড়া করা!

তদুপরি আরেকটা রীতি-রেওয়াজ মনে পড়ল। যদিও আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই তবু বিশ্বস্তজনের কাছে শুনেছি, যে পীরের কিছুমাত্র সামর্থ্য আছে সেখানেই মহিলা-শিষ্যারা আপন হাতে রান্নাবান্না করে, নাশতা বানিয়ে সমাগত জনের সেবা করেন। এ রীতি তো অত্যন্ত স্বাভাবিক।

যে কাজ যারা উত্তমরূপে করতে পারে বিধাতা তাদেরই স্কন্ধে সে কাজ চাপান।

নইলে তিনি শেয়ালের কাঁধে দিতেন সিংহের কেশর, বেড়ালকে দিতেন হাতির শুঁড়।

শহর-ইয়ার যে বস্তু সবচেয়ে ভালো তৈরি করতে পারে সেইটেই করেছে।

মনে শান্তি পেলুম। পীর মিরাল করতে পারুন আর নাই-ই পারুন, বহু তৃষিত নরনারী শুষ্ক হৃদয় নিয়ে যেখানে ভক্তিভরে সমবেত হয়েছে সেখানে আল্লাতালা কিছু-না-কিছু শান্তির সুধাবারি বর্ষণ করবেনই করবেন!

এর সঙ্গে অবশ্য আরেকটি কথা যোগ দিতে হয়। শহর-ইয়ারকে আমি দিনে দিনে, এতদিনে যেভাবে হৃদয়ে গ্রহণ করেছি, তার পর তার যে কোনও আচরণ– সে আপাতদৃষ্টিতে যতই অপ্রিয় হোক– গ্রহণ করতে গোপনে গোপনে সে-হৃদয় সবসময়ই তৈরি। চোরাবাজারির চোরাই মাল নেবার জন্য কালোবাজারি যে রকম তৈরি থাকে।

প্রসন্ন মনে আবার হাত চালালুম। পরোটার অন্যপ্রান্ত চুরমুরুলুম।

.

অপরাহ্নের যে-আসরের নামাজ পীর পড়ছিলেন শাম্রাদেশে সেটি হ্রস্ব।

পীরসাহেব পনেরো মিনিটের ভিতর নামাজ শেষ করে উঠলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি ঘরের এক কোণ থেকে একটা ভাজকরা ডেক চেয়ার টেনে এনে আমার সামনে সেটি পেতে বসলেন।

আমি চুপ করে আছি। যদিও একদা তিনি আমার সখা ছিলেন তবু তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড়। বাক্যালাপ তিনিই আরম্ভ করবেন।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না; তিনিই বললেন, শহর-ইয়ারের কথা ভাবছি।

আমার মনে সেই প্রথম প্রশ্নের পুনরুদয় হল, তিনি জানলেন কী করে, আমি শহর-ইয়ারের সন্ধানে এখানে এসেছি? তবু চুপ করে রইলুম।

বললেন, আমার কাছে অনেক লোক আসে। মনে আছে আপনার, আমরা যখন একসঙ্গে বরোদাতে বাস করতুম তখন একদিন আপনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা আমাকে পড়ে শোনাচ্ছিলেন?–

ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে।
 কুটির তাহার ঘিরিয়া দাঁড়ালো লাখো নরনারী এসে।
কেহ কহে, মোর রোগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহো,
 সন্তান লাগি করে কাদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ।
কেহ বলে তব দৈব ক্ষমতা চক্ষে দেখাও মোরে,
কেহ কয় ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে।

রবীন্দ্রনাথ মহান কবি। তিনি মানুষের কামনা-বাসনার সংক্ষিপ্ত একটি ফিরিস্তির ব্যঞ্জনা দিয়ে বাকিটা বিদগ্ধ পাঠকের কল্পনাশক্তির ওপর বরাত দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আমাকে তো কল্পনা করতে হয় না। মানুষের সম্ভব-অসম্ভব সব অভিলাষই আমাকে শুনতে হয়। বিশ্বাস করবেন কি, সৈয়দ সাহেব, জাল দলিলপত্র তৈরি করে, ভেজাল মোকদ্দমা রুজু করে আমার কাছে স্বেচ্ছায় অকপটে সেই কপটতা কবুল করে অনুরোধ জানায় আমি যদি তার জন্য সামান্য একটু দোওয়া করি তবে সে মোকদ্দমাটা জিতে যায়!

আমি বিস্ময় মেনে বললুম, সে কী?

ম্লান হাসির ইঙ্গিত দিয়ে পীর বললেন, উকিল, বৈদ্য আর পীরের কাছে কোনও কিছু লুকোতে নেই, এই হল এদের বিশ্বাস। বিশেষ করে পীরের কাছে তো নয়ই। কারণ তিনি নাকি দিব্যদৃষ্টি দিয়ে মনের গোপন কথা দেখতে পান। এক পীরসাহেব তো কোনও মেয়েছেলেকে সামনে আসতে দিতেন না, কারণ তাঁর আধ্যাত্মিক শ্যেনদৃষ্টি নাকি কাপড়জামা ভেদ করে সবকিছু দেখতে পায়।

আমি বললুম, থাক!

আপনি তো জানেন, আমি পারতপক্ষে ভালোমন্দের যাচাই করতে যাইনে। তবু শুনুন, সেদিন এক মারওয়াড়ি জৈন এসে উপস্থিত। ওদিকে জৈন কিন্তু এদিকে করুণাময়ের করুণাতে তার অশেষ বিশ্বাস। লোকটির সঙ্গে কথাবার্তা বলে বড় আনন্দ হল। বড় সরল, অকপট, সজ্জন। ইতোমধ্যে শহর-ইয়ার তার জন্যে এক জাম-বাটি লসসি পাঠিয়েছে। আমাদের কথাবার্তা সে বারান্দায় আড়ালে বসে শুনছিল। তার থেকে অনুমান করেছে, ইনি ছোঁয়াছুঁয়ি মানেন না, নইলে হিন্দু অভ্যাগতদের অনুমতি ভিন্ন সে কোনও খাবারের জিনিস ওঁদের সামনে পেশ করে না। আর আপনি তো জানেন, মেয়েটির দেহমনহৃদয় কতখানি সরলতা দিয়ে গড়া। সে মোহমুক্ত বলে প্রায়ই ভুল করে ভাবে ইহসংসারের সবাই বুঝি তারই মতো সংস্কারমুক্ত।–শহর-ইয়ারের কথা কিন্তু পরে হবে। এবারে সেই মারওয়াড়ি সজ্জনের কথা শুনুন। ….লসি সামনে আসতেই তার মুখ শুকিয়ে গেল। আমি বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি বললুম, না, না, আপনাকে খেতে হবে না। আপনি হয়তো যত্রতত্র পানাহার করেন না। সেটা তো কিছু মন্দ আচরণ নয়। আমিও তো বাড়ির বাইরে কোথাও খাইনে। তখন তিনি কী বললেন জানেন? তিনি নিরামিষাশী। আমি একটু আশ্চর্য হয়ে শুধালুম, লসি আবার আমিষ হয় কী প্রকারে? তিনি যা বললেন তার অর্থ একটা পশুর রক্তমাংস নিংড়ে যে নির্যাস বেরোয় সেটা সবচেয়ে কড়া আমিষ। তিনি খান– না, পান করেন সুদুমাত্র ডাবের জল। অন্য কোনও-কিছু খান না। সুন্দুমাত্র ডাবের জল খেয়ে লোকটি গত পঁচিশ বৎসর ধরে বেঁচে আছে!

আমি বললুম, এ ধরনের ডায়েটিং হয়, সে তো জানতুম না।

পীর বললেন, আপনি ভাবছেন, আমি পীর বনে গ্যাট হয়ে বসে আছি বলে আমার আর-কিছু জানবার নেই, শেখবার নেই! হাজার দফা ভুল! নিত্য নিত্য শিখছি। তার পর শুনুন বাকিটা। হঠাৎ, বলা নেই, কওয়া নেই, ভদ্রলোক দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে যা বললেন তার অর্থ, তাঁর ছেলেটা জাহান্নামে গেছে। মদমাংস মেয়েমানুষ নিয়ে অষ্টপ্রহর মেতে আছে। বুঝুন ব্যাপারটা, সৈয়দ সাহেব। যে-লোক মাছমাংস এমনকি দুধ পর্যন্ত না খেয়ে অজাতশত্রু হয়ে জীবনধারণ করতে চায়, তারই একমাত্র পুত্র হয়ে উঠেছে তার সবচেয়ে বড় শত্রু! তার পরিবারের শত্রু, তার বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যের শত্র, পিতৃপিতামহের আচরিত ধর্মের শত্রু।

সর্বশেষে কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমি নিশ্চয়ই পূর্বজন্মে কোনও পাপ করেছিলুম, তার জন্য আজ আমি এই শাস্তি পাচ্ছি। আপনি আমার ছেলের জন্য দোওয়া করুন।

বলুন তো, তার সঙ্গে তখন পূর্বজন্ম-পরজন্ম আলোচনা করে কী লাভ! আর দোওয়া তো আমি সকলের জন্যই করি, আপনিও করেন, কিন্তু আমি কি মিরাল করতে পারি?

তার পর পীর বেদনপীড়িত কণ্ঠে বললেন, কেন লোকে বিশ্বাস করে, আমি অলৌকিক কর্ম করতে সক্ষম!

পীরসাহেব অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে রইলেন বলে আমাকে বাধ্য হয়ে সে-নীরবতা ভঙ্গ করতে হল। বললুম, আপনাকে এসব ব্যাপারে আমার কিছু বলতে যাওয়া গোস্তাকি হবে। অপরাধ নেবেন না। তবু বলি, এসব লোক আসে আপনার কাছে ভক্তি-বিশ্বাসসহ। আপনি তাদের জন্য দোওয়া-আশীর্বাদ করলেই তারা পরিতৃপ্ত হয়।

পীর বললেন, ঠিক। আমি তাই মারওয়াড়িকে বললুম, আপনি শান্ত হোন। তার পর তাকে এই নামাজের ঘরে এনে দু জনাতে একাসনে বসে আল্লার কাছে। দোওয়া মালুম।

এর পর পীর একদম চুপ মেরে গেলেন বলে আমাকে বাধ্য হয়ে শুধাতে হল, তার পর কী হল?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, তার পর দীর্ঘ তিন মাস ধরে সে ভদ্রলোকের আর দর্শন নেই।

তার পর আমি শহর ইয়ারের মুখে খবর পেলুম, ছেলেটি নাকি সৎপথে ফিরে এসেছে, এবং সে-দ্রলোক আমাদের পাড়ার জরাজীর্ণ মসজিদটি নিদেন ত্রিশ হাজার টাকা খর্চা করে মেরামত করে দিয়েছেন। ঠিক ঠিক বলতে পারিনে, হয়তো আমি মুসলমান বলেই।

আচ্ছা এবারে বলুন তো, এর মধ্যে আমার কেরামতি– মিরাকল কী?

আমি আর কী বলি! কাকতালীয় হতে পারে, আল্লার অযাচিত অনুগ্রহ হতে পারে। কে জানে কী? আমি চুপ করে নিরুত্তর রইলুম।

পীরসাহেব তখন স্মিতহাস্য করে বললেন, শহর-ইয়ার কিন্তু তখন কী মন্তব্য করেছিল জানেন?

কিন্তু আমি অতশত নানাবিধ জিনিস আপনাকে বলছি কেন বলুন তো? ওইসব শত শত হরেক রকমের লোকের মাঝখানে এখানে এল শহর-ইয়ার।

কিন্তু আপনি একটু চিন্তা করবেন তো, শহুর-ইয়ার তখন কী মন্তব্য করেছিল?

খানিকক্ষণ চুপ থেকে পীরসাহেব বললেন, ভক্ত কবীরের কাছে কে কী চেয়েছিল, সে তো জানেন। আমি কবীর সাহেবের পদধূলি হবার মতো যোগ্যতাও ধরিনে, তবু আমারই কাছে কারা কী চায়, তার দুই প্রান্তের দুটি এক্সট্রিম উদাহরণ আপনাকে দিলুম।

আজ পর্যন্ত আমি যেসব পীরদের আস্তানায় ঘুরেছি, এবং আমার এই ডেরাতে যারা আসে, এদের ভিতর এমন একজনও দেখিনি যে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ দিল নিয়ে এসেছে। অবশ্য বেশকিছু লোক আসেন তথাকথিত শাস্ত্রালোচনা করতে। সে-ও এক বিলাস, ফ্যাশান। তা হোক। আল্লাপা কার জন্য কোন পথ স্থির করে দিয়েছেন, তার কী জানি আমি!

এরই মাঝখানে এল শহর-ইয়ার। এক মুহূর্তেই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, সে কোনও কামনা নিয়ে আসেনি। বিশ্বাস করবেন না, সে আজ পর্যন্ত একবারের মতোও আমার সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা পর্যন্ত করেনি। এযাবৎ একটি প্রশ্নমাত্রও শুধোয়নি।

আমি হতভম্ব হয়ে শুধালুম, সে কী?

হ্যাঁ। এটা আপাতদৃষ্টিতে রহস্যময় মনে হতে পারে। সেটার সমাধান হল, একদিন যখন শুনতে পেলুম, শহর-ইয়ার কার যেন প্রশ্নের উত্তরে জনান্তিকে বলছে, সে এমন কিছু জিনিয়াস নয় যে উদ্ভট নতুন কোনও প্রশ্ন শুধোবে। সে নাকি অতিশয় সাধারণ মেয়ে। তার মনে অতিশয় সাধারণ প্রশ্নই জাগে। সেগুলো কেউ না কেউ আমাকে শুধাবেই। আমি উত্তর দেব। ব্যস, হয়ে গেল। কী দরকার ওঁকে– অর্থাৎ আমাকে– বিরক্ত করে।

আমি জিগ্যেস করলুম, তা হলে সে আপনার শিষ্যা হল কেন?

পীরসাহেব একটু চমকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে বললেন, আমার কোনও শিষ্য-শিষ্যা নেই। আমি কখনও মুরশিদরূপে মন্ত্র দিয়ে কাউকে শিষ্য বা শিষ্যারূপে গ্রহণ করিনি!।

আমি হতভম্ব।

 ইতোমধ্যে বিস্তর লোক পাশের ঘরে জমায়েত হয়েছে।

এবং সান্ধ্য নামাজের আজান শোনা গেল।

পীর এবার এদের সঙ্গে নামাজ পড়বেন। তার পর শাম্রালোচনা তত্ত্বালোচনা হবে হয়তো।

আমি হতভম্ব অবস্থাতেই বিদায় নিলুম।

.

১৮.

যা জানতে চেয়েছিলুম তার কিছুই জানা হল না; কল্পনায় যে ছবি এঁকেছিলুম তার সঙ্গে বাস্তবের ফিঙার প্রিন্ট একদম মিলল না। উল্টো রহস্যটা আরও ঘনীভূত হল। কোনও কিছুর সঙ্গে কোনও কিছুই খাপ খাচ্ছে না।

আমি কলকাতা থেকে আকছারই ট্রেনে করে বোলপুর যাই। একবার বোলপুর স্টেশনে ঢোকার পূর্বে সবকিছু কেমন যেন গোবলেট পাকিয়ে গেল। কই, এতক্ষণে তো অজয় ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়িটা গম গম করে পেরোবে, তার পরে বাঁ দিকে পুকুর, ডান দিকে জরাজীর্ণ একটা দোতলা–কই সে-সব গেল কোথায়? উল্টো মাথার উপর দিয়ে হুশ করে একটা ওভারব্রিজ চলে গেল! এটা আবার রাতারাতি কবে তৈরি হল।

এখন হঠাৎ আমার হুশ হল, এবারে আমি কলকাতা থেকে বোলপুর আসছি না, আসছি। ভাগলপুর থেকে। অর্থাৎ আমি স্টেশনে ঢুকছি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে নয়, উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ভেল্কিবাজি। উত্তর হয়ে গেল দক্ষিণ, পুব হয়ে গেল পশ্চিম। বাইরের দু দিকের দৃশ্য ফটাফট ফিট করে গেল।

তবে কি আমি শহর-ইয়ার রহস্যের দিকে এগুচ্ছিলাম উল্টো দিক দিয়ে? তবে কি আমার অবচেতন মন প্রতীক্ষা করছিল, পীর আমার দিক্-ভ্রান্তি দেখিয়ে দেবেন আর সঙ্গে সঙ্গে শহর-ইয়ার রহস্য অর্থাৎ তার আকস্মিক গুরুধর্মের কাছে ঐকান্তিক আত্মসমর্পণ, সাংসারিক নিত্যনৈমিত্তিক কর্মের প্রতি প্রচ্ছন্ন ঔদাস্য, ত্রিমা যামিনী-ব্যাপী জপ-জ্বিক– এসব তার পূর্ববর্তী জীবনের সঙ্গে সহজ সরলভাবে ফিট করে যাবে, সর্ব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে?

বরঞ্চ পীর যেসব দুটি-একটি তথ্য পরিবেশন করলেন সেগুলো যেন চকিতে চকিতে বিজলি আলো হয়ে চোখেতে আরও বেশি ধাঁধা লাগাল।

সিঁড়ি দিয়ে আপন মনে ভাবতে ভাবতে নামছি এমন সময় জানা-অজানায় লক্ষ করলুম, কালো নরুনপেড়ে শাড়ি-পরা একটি বৃদ্ধা মহিলা নেমে যাচ্ছেন। মনে হল হিন্দু বিধবা। আকণ্ঠ রহস্যনিমজ্জিত অবস্থায়ও আমার মনে রত্তিভর কৌতুক সঞ্চারিত হয়ে মানসিক মৃদুহাস্য বিকশিত হল।… কে বলে, এদেশে হিন্দু-মুসলমান সুদু ঝগড়া-ফসাদই করে! যা না, যে কোনও পীর-মুর্শিদ গুরু-গোসাঁইয়ের আস্তানায়। হিন্দু-মুসলমান তো পাবেনই, তদুপরি পাবেন গণ্ডাখানেক দিশি সাহেব, দু চারটি খাস বিলিতি গোরা। তবে হ্যাঁ, কবি-রাজ ওমর খৈয়াম বলেছেন, সর্ব ধর্মের সর্বোত্তম সম্মেলন পাবে অঁড়িখানায়। সেখানে সব জাত, সব জাতি, সব ধর্ম সম্মিলিত হয়ে নির্বিচারে একাসনে বসে পরমানন্দে মদিরাপাত্রে চুম্বন দেয়।*[*ইরানের এক গণ্যমান্য সভাকবি নাকি নিকৃষ্টতম গুঁড়িখানায় চাড়ালদের সঙ্গে বসে ভাঁড়ে করে মদ্যপান করছিলেন। নগরপাল মারফত খবরটা জানতে পেরে বাদশা নাকি অনুযোগ করাতে কবি একটি দোহা রচনা করেন :

হাজার যোজন নিচেতে নামিয়া আকাশের ঐ তারা
গোস্পদে হল প্রতিবিম্বিত; তাই হল মানহারা?]

কিন্তু ভুললে চলবে না, সুফি-ফকির সাধুসন্তরা সাবধান করে দিয়েছেন, এ স্থলে মদিরা প্রতীক মাত্র, সিম্বল। মদিরা বলতে এস্থলে ভগবদ্‌প্রেম বোঝায়। তাই তো পীর গুরুর আস্তানায় এত শত ছাপ্পান্ন দেশের ইউনাইটেড নেশন, এবং তারো বাড়া, ইউনাইটেড রিলিজিয়ন ইউনাইটেড জাতবেজাতের সম্মেলন। এরা এখানে এসে জন্মগত পার্থিব সর্বপার্থক্য অগ্রাহ্য করে গুরুমুরশিদ যিনি সাকি– তার হাত থেকে ভগবদপ্রেমের পেয়ালা-ভরা শরাব তুলে নেয়।… থাগে এসব আত্মচিন্তা।

ততক্ষণে পেভমেন্টে নেমে গিয়েছি।

 সামনে দেখি একটা বেশ গাট্টাগোট্টা জোয়ান মর্দ কেমন যেন ঈষৎ চেনা-চেনা –একটা কালো মোটরগাড়ির স্প্রিং-ভাঙা দরজাটা নারকেলের সরু দড়ি দিয়ে বাঁধছে।

আমার পাশে ততক্ষণে সেই বৃদ্ধা হিন্দু বিধবাটি এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে দেখে সেই জোয়ান (মিলিটারি অর্থে নয়, রূঢ়ার্থে) তাঁর দিকে এগিয়ে এল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল আমার চোখের উপর। সঙ্গে সঙ্গেই একে অন্যকে চিনে ফেললুম।… বেশ কয়েক বছর পর পুনর্মিলন।

এ তো আমার শ্বশুরবাড়ির দ্যাশের লোক! নাম, ভূতনাথ খান। খান পদবি মুসলমানের হলেও ওটা ওদের সম্পূর্ণ একচেটে নয়। খান হিন্দুসন্তান।

তুমি এখানে? অবাক হয়েই শুধোলুম। খানকে আমি চিনি। মহা পাষণ্ড। দেবদ্বিজে ভক্তি নেই, পীর-মুর্শিদের তো কথাই ওঠে না।

আপনি এখানে? সে-ও সঙ্গে সঙ্গে জিগ্যেস করল। কারণ বিলক্ষণ জানত আমি পীরটিরের সন্ধানে কখনও বেরুই না। খান ঝাণ্ডু ছোকরা। তাই পুরো পাক্কা তরুণ, মডার্ন হয়েও প্রাচীন প্রবাদে বিশ্বাস করে, কাগে কাগের মাংস খায় না।

বৃদ্ধাকে কোমরে জড়িয়ে ধরে সে তাঁকে মোটরের পিছনের সিটে বসাল, কোনও প্রকারের প্রতিবাদ না শুনে আমাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে সামনে বসাল। স্টার্ট দিতে দিতে পিছনের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বললে, ঠাকুমা, একে তুমি কখনও দেখনি, কিন্তু চিনবে। তোমার ওই শাজাদপুরের প্রতিবেশী মৌলবি বশিরুদ্দিনের মেয়েকে বিয়ে করেছেন

বাকিটা কী বলেছিল আমার কানে আসেনি। বৃদ্ধা তাকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চুপ কর– বলে তার কম্পিত শীর্ণ হস্ত আমার মস্তকে রেখে বার বার আশীর্বাদ করতে লাগলেন। খানের সেই ভিন্টেজকারের নানাবিধ কর্কশ কানফাটা কোলাহল ভেদ করে যে কটি শব্দ আমার কানে এসে পৌঁছল তার একটি বাক্য শুধু বুঝতে পারলুম, আহ্! তুমি আমার বশির ভাইসাহেবের মাইয়ারে বিয়া করছ। বুড়ি একই কথা বার বার আউড়ে যেতে লাগলেন।

আমার মনে দৃঢ় প্রত্যয় হল, বুড়ির কাপড়ের খুঁটে আকব্বরি মোহর বাঁধা ছিল না বলে তিনি সাড়ম্বর জামাইয়ের মুখদর্শন কর্ম সমাধান করতে পারলেন না। বুড়ি পিছনের সিটে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লেন। হায় দিদিমা, তুমি হয়তো এখন মনে মনে চিন্তা করছ, জামাইরে কী খাওয়াইমু!

আমি খানকে শুধালুম, তুমি ওই পীরের আস্তানায় জুটলে কী করে?

খান তার সেলফ-মেড় একটা সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললে, না, আমার কোনও ইনট্রেট নেই। ঠাকুরমাকে আপিসে যাওয়ার সময় ড্রপ করে যাই, ফেরার সময় দুই-এক পেগ স্যাঁট স্যাঁট করে নামিয়ে, ঠিক মগরিবের নামাজের ওক্তে তাকে ফের পিক অপ্ করে নিই—

ঠাকুরমা যাতে শুনতে না পান তাই ফিসফিস করে শুধালুম, সে তো বুঝলুম, কিন্তু আমি তো জানতুম, তোমার ঠাকুরমা নিষ্ঠাবতী হিন্দু রমণী। তিনি আবার এই মুসলমান পীরের কাছে এলেন কী করে?

খান বললে, অতি সহজ এর উত্তর। তার নাতনির মারফত। সেই নাতনির এক ক্লাসফ্রেন্ডের সঙ্গে ঠাকুরমার পরিচয় হয়। মেয়েটা মুসলমান।

ওরে বাব্বা!

শিউরে উঠে ভূতনাথ খান বললে, অগ্নিশিখা, মশাই, অগ্নিশিখা। অগ্নিকুণ্ডও বলতে পারেন। জহরব্রতের অগ্নিকুণ্ড। যেখানে গণ্ডায় গণ্ডায় লেডি-কিলার ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ দিতে পারে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও নটবরই সে-অগ্নিকুণ্ডের কাছে যাবারও ইজাজত পাননি– ঝাঁপ দেওয়া দূরের কথা। লেডি-কিলার হিসেবে আহ্মে কম যাইনে, হেঁহেঁ হেঁহেঁ, কিন্তু ওই মুসলমানির দিকে একনজর বুলোতেই– সে তখন পীরসাহেবের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে নামছিল– হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেলুম এ রমণী ফঁসুড়ে। তার একটিমাত্র চাউনি যেন অদৃশ্য একখানা রুমালে পরিবর্তিত হয়ে সাঁ করে উড়ে এসে লটবরবাবুর গলাটিতে ফাঁস লাগিয়ে, জস্ট, স্ট্রেঙলস্ হিম্ টু ডেথ, কিংবা বলতে পারেন, তার হি-ম্যান হবার প্ল্যানটি নস্যাৎ করে দেয়! বাপ!

রগরগে বর্ণনাটা শুনে আমার মনে কেমন যেন একটু কৌতূহল হল। শুধালুম নামটা জানো?

দাঁড়ান, বলছি, স্যার। আরব্য উপন্যাসের কোন এক নায়িকা না নায়কের নাম। শহর-জাদি? শহর-বানু? হা, হ্যাঁ, শহর-ইয়ার–

আজ আমার বার বার স্তম্ভিত হবার অর্থাৎ নিশ্চল নির্বাক স্তম্ভে পরিণত হওয়ার পালা।

শুনেছি, একদা নগরের একাংশ সহস্র স্তম্ভের (খাম্বার) উপর নির্মিত হয়েছিল বলে অদ্যকার ক্যাম্বে বন্দরকে গুজরাতিতে খাম্বাৎ বলা হয়, প্রাচীন যুগে স্তম্ভপুরী বলা হত। দিল্লিবাসীর কাছে এ শব্দতত্ত্ব ফজুল। সেথাকার চৌষট্টিটি স্তম্ভের উপর খাড়া বলে আকবর বাদশার দুধবাপ আজিজ কোকলতাসের কবরকে চৌসট খাম্বা বলা হয়।

আজ আমি এতবার হেথাহোথা স্তম্ভে পরিণত হয়েছি যে আমার উপর দিয়ে অনায়াসে কলকাতার ওভার-হেড রেলওয়ে নির্মাণ করা যায়!

ইতোমধ্যে ভূতনাথ ফের বকর বকর আরম্ভ করেছে। আমি ফের ফিসফিস করে বললুম, চুপ, চুপ। ঠাকুরমা শুনতে পাবেন। তুমি নিতান্ত অর্বাচীন; তাই জানো না প্রাচীনারা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে-একটি মহৎ সদ্গুণ রপ্ত করে নেন সেটি হচ্ছে, যে কথা তারা শুনতে চান না, সেটা তাদের কানের কাছে কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে শোনালেও শোনেন না, আর যেটি ভঁরা শুনতে চান সেটি তুমি বাঁশবনের কলমর্মরের ভিতর রাজার মাথায় শিং গোছ গোপনে গোপনে বললেও তারা দিব্যি শুনতে পান। তাই তো তারা দীর্ঘজীবী হন! আফটার অল কানের ভিতর দিয়ে যে-সব কথা মরমে পৌঁছে তার চৌদ্দ আনাই তো দুঃসংবাদ। অন্তত এ যুগে।

ভূতনাথ নিশ্চয়ই ভূতকালটা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল। তদুপরি সে বৃথা-মাংস খায় না, বৃথা তর্ক করে না। গম্ভীর কণ্ঠে বললে, সর্ব যুগেই, সত্যযুগেও। পূর্বেই বলেছি, সে একটা আস্ত চার্বাক। আর আমার যদুর জানা, প্রথম চার্বাক এই পুণ্যভূমিতে অবতীর্ণ হন। সত্য ও ত্রেতাযুগের মধ্যিখানে।

ভূতনাথ জাতিস্মর।

.

ঠাকুমা গুটি গুটি রান্নাঘরের দিকে রওনা হলেন।

খাইছে!

ঠাকুমা নিশ্চয়ই তার ভাইয়া বশিরুদ্দিনের জন্য যেভাবে লুচি ভাজতেন সেইভাবে ভাজবার জন্য ভূতনাথের বউকে ফরমান ঝাড়বেন। তার বয়স ত্রিশ হয় কি না হয়। আমাদের পাড়ার চ্যাংড়া হীরু রায় বাজাবে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের সামনে বাজনা। তওবা, তওবা!

তা সে যাক গে।

ইতোমধ্যে ভূতনাথ আমাকে তার হাফ প্রাচীনপন্থি বৈঠকখানায় বসিয়ে ব্যাপারটি সংক্ষেপে সারলো :

আপনি ঠিক বলেছেন, আমার ঠাকুরমা নিষ্ঠাবতী হিন্দু রমণী। এখনও স্বপাকে খান। আমাকে তাঁর হেঁসেলে ঢুকতে দেন না। ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে– এমরাল। মরাল নয়, ইমরালও নয়। আমার ঠাকুরমা এলিবারেল। তিনি ধর্মবাদে লিবারেল নন, ইলিবিরেলও নন তিনি এলিবারেল। কথাটা একটু বুঝিয়ে বলতে হয়, কারণ ওই শহর-ইয়ার বিবির সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক আছে। অবশ্য সেটা অনেক পরের কথা।

উত্তরবঙ্গের কোন হিন্দু সর্ব মুসলমানের সংস্পর্শ বর্জন করে বাস করেছে কবে? তাই তিনিও মুসলমানদের কিছুটা চেনেন। যেমন আপনার মরহুম শ্বশুরসাহেবকে খুব ভালোভাবেই চিনতেন।

কিন্তু আপন ধর্মচার তিনি করতেন– এখনও করেন তার মা-শাশুড়ি যেভাবে করেছেন হুবহু সেইরূপ। অন্য ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর কোনও কৌতূহল কখনও ছিল না– এখনও নেই এবং সেখানে পুনরায় আসেন ওই শহর-ইয়ার বিবি। এমনকি এই হিন্দুধর্মেই যে– পূজাআচ্চার নানাবিধ পদ্ধতি রয়েছে সে সম্বন্ধে ঠাকুমা ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। তাই বলছিলুম তিনি ধর্মবাবদে ছিলেন এলিবারেল। তিনি তো, আর পাঁচটা ধর্ম সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল হয়ে সেগুলো রিজেক্ট করেননি। সে হলে না হয় বলতুম, তিনি ইলিবিরেল, কট্টর, কনজারভেটিভ। হাওয়ার ধাক্কায় যখন তেতলার আলসে থেকে ফুলের টব নিরীহ পদাতিকের কাঁধে পড়ে তাকে জখম করে তখন কি সে-টব চিন্তা করে এই কর্মটি করেছে? সে কি চিন্তা করে জানতে পেরেছে, উক্ত পদাতিক অতিশয় পাপিষ্ঠ ব্যক্তি? অতএব ফুলের টবের এ কর্মটি এমরাল। ঠিক ওইভাবেই আমার ঠাকুরমার যাবতীয় চিন্তাধারা কর্মপদ্ধতি পূজা-আচ্চা সব, সবকিছু ছিল এলিবারেল। ফুলের টবের মতোই তিনি ছিলেন অন্য পাঁচটা ধর্ম সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, আনকনশাস,–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, থাক, তোমার এসব কচকচানি। আমি জানতে চেয়েছিলুম, তোমার নিষ্ঠাবতী হিন্দু ঠাকুমা ওই মসলা পীরের মোকামে পৌঁছলেন কী করে?

খান বড় সহিষ্ণু ব্যক্তি। বললে, স্যার, ওই সময় নাট্যমঞ্চে শহর-ইয়ার বানুর অবতরণ। তাই আমি তার পটভূমি নির্মাণ করছিলুম মাত্র। এইবারে আসল মোদ্দা কথায় পৌঁছে গিয়েছি। শুনুন।

দেশ-বিভাগের পর ঠাকুমাকে প্রায় দৈহিক বল প্রয়োগ করে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। তিনি তার শ্বশুরের ভিটে স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে ছাড়তে চাননি। এরকম বিস্তর কে আপনি রেফুজি কলোনিগুলোতে পাবেন।

ঠাকুমার সঙ্গে দেশত্যাগ করে এসেছিল তাঁরই পিতৃকুলের সুদূর সম্পর্কের একটি অরক্ষণীয়া। রান্নাবান্না ধোয়ামোছার পরও আর কিছু করবার নেই বলে সে কলেজ যেত। ঠাকুমা ব্রাহ্মণী, ন্যাচলি আত্মীয় পালিতা কন্যাও ব্রাহ্মণী। কিন্তু, মোশয়, সে যে-ক্লাসফ্রেন্ডের সঙ্গে প্রেমে পড়লো সে এক বদ্যি-সন্তান। তাকে বিয়ে করতে চায়।

ঠাকুমা তো শুনে রেগে কাই! কী! বদ্যির সঙ্গে বামুন মেয়ের বিয়ে! বরঞ্চ গোহত্যা করা যায়, গোমাংস ভক্ষণ করা যায়, কিন্তুক বামুনের সঙ্গে বদ্যি! বরঞ্চ ছুঁড়িটা ডোমাড়াল, মুচিমোচরমান বিয়ে করুক। কারণ ঠাকুরমার মনঃসিন্দুকে একটি আপ্তবাক্য প্রায় গোপন তত্ত্বরূপে লুক্কায়িত আছে :

একশো গোখরোর বিষ নিয়ে সৃষ্টিকর্তা একটি বদ্যি তৈরি করেন।

কিন্তু ঠাকুমা জানতেন না যে, একশো বদ্যির বিষ নিয়ে সষ্টিকর্তা একটি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ তৈরি করেন। আমরা বারেন্দ্র। ভূতনাথ তার হোমেড় সিগরেটে আগুন ধাবার জন্য ক্ষণতরে চুপ করে গেল।

আমি গুনগুন করে বললুম, এবং একশোটি বারেন্দ্রের বিষ দিয়ে আল্লাতালা তৈরি করেন একটি সৈয়দ।

খান আস্ত একটা চাণক্য। কিন্তু এ নীতিটি জানত না। খানিকক্ষণ এই নবীন তত্ত্বটির গভীর জলে খাবি খেয়ে খেয়ে বললে :

তাই বুঝি সৈয়দরা এত বিরল?

আমি বললুম, চোপ, তুমি যা বলছিলে, তাই বল।

খান তাবৎ বাক্য হজম করে নিয়ে বলল, এ হেন সময়ে, যে নাট্যে ছিলেন সুদুমাত্র দুটি প্রাণী, ঠাকুমা এবং অরক্ষণীয়া, সেখানে প্রবেশ করলেন বীরপদভরে পৃথিবী প্রকম্পিত করে একটি তৃতীয়া প্রাণী।

ভুল বললুম, স্যার, আমার মনে হল যেন আমাদের সরু গলি দিয়ে ঢুকল একটি জ্বলন্ত মশাল। অথচ অলিম্পিকের টর্চ-বেয়ারার নেই। সুন্দুমাত্র মশালটাই যেন স্বাবলম্ব হয়ে, গলি পেরিয়ে, আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে, ঠাকুরমার ঘরে ঢুকল।

সেই মশাল শহর-ইয়ার। আপনাকে বলিনি, অগ্নিশিখা?

আমি শুধালুম, কেন এসেছিল?

আজ্ঞে –।

এমন সময় ঠাকুমা আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। হাতে পাথরের থালা। খান ঠোঁটে আঙুল রেখে ইঙ্গিত দিল, এই আর ও-কাহিনী বলা চলবে না।* [* এই উপন্যাসের পূর্ববর্তী এক অধ্যায়ে আমি লিখি যে, প্রসিদ্ধ ইওরোপীয় প্রণয়গাথা ত্রিস্তান ইজলদে বাঙলাতে অনুবাদিত হয়নি। বড়ই আনন্দের সঙ্গে জানাই, পক্ষাধিককাল পূর্বে জনৈক সাতিশয় মেহেরবান পাঠক আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি স্বয়ং ওই গাথা নিয়ে একটি কিছুটা অনুবাদ, কিছুটা স্বয়ংসৃষ্ট লিস্তান কাহিনী বাঙলায় রচনা করেছেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে বে-এক্তেয়ার মহব্বত বশত ওই পুস্তিকার একখণ্ড আমাকে সওগাত করেছেন।]

.

১৯.

এতদিনে বুঝতে পারলুম, শহর-ইয়ারকে আমি চিনিনি, চেনবার চেষ্টাও করিনি। কোনও মানুষকে দিনের পর দিন দেখলে, তার সঙ্গে কথা কইলেও তার একটামাত্র দিক চেনা হয়। কারণ যার যে রকম প্রবৃত্তি সে সেইরকমভাবেই অন্যজনকে গ্রহণ করে। শহর-ইয়ার মদ্য আমার মনের পাত্র যখন পূর্ণ করল তখন সে শে নিল আমার মনের গেলাসেরই শে। কিন্তু সেইটেই যে তার একমাত্র শেপ নয় সেটা আমি আনমনে ভুলে গিয়েছিলুম। এমনকি তার স্বামী, ডাক্তার তাকে কী শেপ-এ নিয়েছে সেটাও আমি ভেবে দেখিনি। এবং সে-ই বা তার গড়া– অবশ্য তার মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়া শহর-ইয়ারকে যে শেপ দিয়েছে সে নিয়ে আমার সঙ্গে ডিপ্লোমেটিক ডিসপ্যাঁচ একচেঞ্জ করতে যাবে কেন?

এইবারে একটি তৃতীয় পক্ষ পেলুম যে শহর-ইয়ারকে দেখেছে, একটুখানি দূরের থেকে এবং তাতে করেই পেয়েছিল বেসট পারসপেকটিভ– এবং তারই ভাষায়, সেই অগ্নিশিখাকে সাইজ অপ করতে গিয়ে একদম বিমূঢ় হয়ে গিয়েছে। আমিও মনে মনে বললুম, অগ্নিশিখা তো তরল দ্রব্য নয় যে তাকে তোমার মনের পেয়ালায় ঢেলে নিয়ে আপন শেপ দেবে!

ঠাকুমা চলে যেতেই ভূতনাথ দরজাতে ডবল খিল দিল।

ছেঁড়া কথার খেই তুলে নিয়ে বললে, দ্রৌপদী, মশাই, সাক্ষাৎ দ্রৌপদী। আমি শুধালুম, দ্রৌপদীর সঙ্গে তুলনা করছ কেন?

একগাল হেসে বলল, কেন স্যার, আপনিই তো হালে একখানা গবেষণাপূর্ণ রসরচনা ছেড়েছেন যাতে দেখিয়েছেন, এ সংসারে একটি প্রাণ, তা-ও রমণী, কী করে পাঁচ-পাঁচটা মদ্দাকে তর্কযুদ্ধে চাটনি বানাতে পারে। সেই নারীই তো দ্রৌপদী। দুঃশাসন যখন তাঁকে জোর করে কুরুসভাস্থলে টেনে এনে হাজির করল তখন তিনি যে স্বাধীনা, তাকে যে তার অনিচ্ছায় প্রকাশ্য সভাস্থলে টেনে আনা সম্পূর্ণ বে-আইনি, আজকের আদালতি ভাষায় যাকে বলে আলট্রা ভাইরিসা তাঁর সেই বক্তব্য যখন তিনি অকাট্য যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে পেশ করতে লাগলেন, ভুল বললুম, পুশ করতে লাগলেন, সজোরে কড়া কড়া যুক্তিসহ– তখন কি কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মদেব, কি দ্বিজশ্রেষ্ঠ নিষ্ঠাচারী দ্রোণাচার্য কেউ কি কোনও উত্তর দিতে পেরেছিলেন?… তার এক হাজার বছর পরে সোক্রাতেস না? তার পর এ তাবৎ ব্ল্যাঙ্কো! না?

আমি অধৈর্য হয়ে বললুম, থাক! তোমার কচকচানি থামাও। শহর-ইয়ারের কথা কও!

পূর্বেই বলেছি শ্ৰীমান ভূতনাথ বৃথা তর্ক করে না। ঘাড় নেড়ে বললে, শহর-ইয়ারের কথাই তাবৎ শহরের ইয়ার– অথবা হওয়া উচিত।

ভেবে দেখুন, ঠাকুমা একা। শহর-ইয়ার একাই একশো দ্রৌপদী। ঠাকুমা পারবেন কেন? শহর-ইয়ার কী যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছিলেন সে আমার জানা নেই, কারণ আমার কলিজাতে পুকুর খোঁড়ার ভয় দেখালেও তখন আমি সে-সভাঙ্গনে যেতে রাজি হতুম না। ঠাকুমা একে মেয়েছেলে তদুপরি বৃদ্ধা। তাঁর কথা আলাদা। কিন্তু আমি মদ্দা। আমাকে ওই দ্রৌপদী চিবিয়ে গিলে ফেলত না– যদিস্যাৎ তার মনে ক্ষণতরেও সন্দেহ হত, আমি ঠাকুমার পক্ষ সমর্থন করতে এসেছি!

আমি সত্যিই তাজ্জব মানলুম। শহর-ইয়ারকে তো আমি চিনি, শান্তা, স্নিগ্ধা কল্যাণীয়া রূপে। সে যে তর্কাঙ্গনে রণরঙ্গিনী হয়ে তার রুদ্রাণী রূপ দেখাতে পারে সে কল্পনা তো আমি কখনও করতে পারিনি।… তাই তো বলছিলুম, তৃতীয় পক্ষের মতামত অবর্জনীয়।

ইতোমধ্যে ভূতনাথ ঘাড় চুলকে চুলকে বললে, পরে আমার কানে কী একটা ঐতিহাসিক যুক্তিও এসেছিল। বেগম শহর-ইয়ার যা বলেছিলেন তার মোদ্দা নির্যাস ছিল :

বুদ্ধদেব ব্রাহ্মণ-শ্রমণকে একাসনে বসিয়ে বার বার বলতেন, ব্রাহ্মণ-শ্রমণ, ব্রাহ্মণ-শ্ৰমণ।

তার বহুশত বৎসর পর, বৌদ্ধধর্ম যখন এদেশ থেকে লোপ পেল, তখন সর্বশেষে, এই শ্রমণরা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করলেন। এবং হিন্দু ধর্মানুযায়ী বিবাহাদি করলেন। তাঁদেরই বর্তমান বংশধর বৈদ্যসম্প্রদায়। অতএব তাঁরা ব্রাহ্মণদেরই মতো কুলসম্মান ধারণ করেন। একদা তারা শ্ৰমণরূপে লোকসেবার জন্য আয়ুর্বেদ অধ্যয়ন করতেন, হিন্দুধর্মে প্রত্যাবর্তন করার পর তারা সেই বৈদ্য-বিদ্যাই জীবিকারূপে গ্রহণ করলেন। তার পর

আমার কান তার পর ভূতনাথের আর কোনও কথাই গ্রহণ করেনি। কারণ আমার মন তখন বিস্ময়বিমূঢ়। আমি ভালো করেই জানতুম, শহর-ইয়ার ইহজনে কখনও কোনওপ্রকারের গবেষণা করেনি।… এমনকি তার স্বামী যে মেডিকাল রিসার্চে আচৈতন্য নিমজ্জিত সেটাও সে বোধ হয় হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারেনি। অবশ্য সে এযাবৎ ইতালির লেওনে কাএতানির স্ত্রীর মতো বিদ্রোহ ঘোষণা করেনি।

তবে কি তাবৎ সমস্যা এভাবে দেখতে হবে যে, কাএতানির স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন, আর শহর-ইয়ার স্বামীকে ত্যাগ না করে ধর্মে আশ্রয় নিয়েছে।

ভূতনাথ বললে, সে বিয়ে তো নির্বিঘ্নে হল। কিন্তু আমার মনে হয়, বিবি শহর-ইয়ার ঠাকুমাকে কাবু করেছিলেন, যুক্তিতর্ক দিয়ে নয়, তার ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ব্যক্তিত্ব বা পার্সনলাটি বললে অল্পই বলা হয়। বরঞ্চ ওই যে আমি বললুম, অগ্নিশিখা–সেই অগ্নিশিখা যেন আগুনের পরশমণি হয়ে ঠাকুরমাকে।

হঠাৎ ভূতনাথের ভাব পরিবর্তন হল। আপন উৎসাহের আবেগ আতিশয্যের ভাটি গাঙে এতক্ষণ অবধি সে এমনই ভেসে চলেছিল যে শহর-ইয়ার সম্বন্ধে আমার কৌতূহলটা কেন সে-সম্বন্ধে সে আদৌ সচেতন হয়নি। এখন যেন হঠাৎ তার কানে জল গেল।

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে ঈষৎ সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে– অবশ্য পরিপূর্ণ লাল-বাজারি ডবল-ব্যারেল বন্দুকের দু নাল উঁচিয়ে নয়– জিগ্যেস করলে, স্যর, আপনি কি ওনাকে চেনেন?

হ্যাঁ।

বেচারা ভূতনাথ! অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বললে, মাফ করবেন, স্যর, প্লিজ। আপনার সামনে ওঁর সম্বন্ধে আমার এটা-ওটা বলাটা বড্ডই বেয়াদবি হয়ে গিয়েছে।

আমি বললুম, সে কী কথা! তুমি তো এখনও তার কোনও নিন্দে করোনি। এবং ভবিষ্যতে করবে বলেও তো মনে হয় না। এটাকে তো পরনিন্দা পরচর্চা বলা চলে না।… আর আমি জানতে চেয়েছিলুম বলেই তো তুমি আমাকে এসব বললে। আর, এগুলো আমার কাজে লাগবে।

যেন একটুখানি শঙ্কিত হয়ে খান শুধালে, এনি ট্রবল, স্যর?

আমি বললুম, ইয়েস। কিন্তু সে-কথা পরে হবে। তুমি যা বলছিলে, বলে যাও।

কথঞ্চিৎ শান্তি পেয়ে ভূতনাথ বললে, বলার মতো তেমন আর বিশেষ কিছু নেই। পূর্বেই বলেছি, বিয়ে হয়ে গেল। চতুর্দিকে শান্তি। শহর-ইয়ার ঠাকুমাকে দেখতে আসেন কি না তা-ও জানিনে।… ইতোমধ্যে ঠাকুমা যখন নিশ্চিন্দি মনে ওপারে যাবার জন্য যাব-যাচ্ছি যাব-যাচ্ছি করছেন তখন তাঁর জীবনসন্ধ্যায় এল একটা দুর্ঘটনা। তার এক পিঠাপিঠো ছোটভাই বহু বৎসর ধরে হিমালয়ে ঘোরাঘুরি করতেন, দু তিন মাস অন্তর অন্তর দিদিকে পোস্ট-কার্ডও লিখতেন।

হঠাৎ একদিন এক চিঠি এল সেই ভাইয়ের এক বন্ধুর কাছ থেকে তিনিও তাঁর সঙ্গে হিমালয় পর্যটন করতেন। চিঠির মূল বক্তব্য ছিল, মাস তিনেক ধরে সেই ভাইয়ের সন্ধান নেই।

ঠাকুমার আদেশে আমাকেই যেতে হল হিমালয়ে তার খোঁজে। সে দীর্ঘ নিষ্ফল কাহিনী আপনাকে আর শোনাব না। তিন মাস পর ঠাকুমার আদেশে কলকাতায় ফিরে এলুম।

এসে দেখি, যা ভেবেছিলুম ঠিক তার উল্টো।

ঠাকুমা শান্ত প্রশান্ত।

আমি অনুসন্ধান করে জানতে পারলুম, ইতোমধ্যে ওই শহর-ইয়ার বিবি নাকি ঠাকুমাকে কোন এক পীরের আস্তানায় নিয়ে গিয়েছেন এবং সেখানে তিনি মনের শান্তি পেয়েছেন। সে তো খুব ভালো কথা। দেহমনের শান্তিই তো সর্বপ্রধান কাম্য। কিন্তু আপনি জানেন, আমি এসব গুরুপীর কর্তাভজাদের একদম পছন্দ করিনে।

আমি বললুম, আমিও করি না।

ভূতনাথ বললে, কিন্তু অনুসন্ধান করে জানলুম, শহর-ইয়ার নাকি ঠাকুমাকে পীরের আস্তানায় নিয়ে যাবার পূর্বে পাকাপাকিভাবে বলেছে, পীর সাহেব আপনার ভাইকে হিমালয় থেকে এখানে উড়িয়ে নিয়ে আসবেন না। কিন্তু আমি আশা রাখি, তিনি আপনাকে কিছুটা মনের শান্তি এনে দিতে পারবেন আল্লার কৃপায়।

ভূতনাথ খান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, তাই তো এই মহিলার প্রতি আমার এত শ্রদ্ধা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *