পোস্টকার্ডখানার মাথার উপর তারিখের নিচে লেখা ঠিকানাটা দেখে চোখটা যেন জুড়িয়ে গেল। আগ্রহে তুলে নিলেন সেটা, তুলে নিয়ে দ্রুত চোখ বুলিয়ে ফেললেন, তারপর আবার ধীরেসুস্থে পড়তে বসলেন।
অথচ অনামিকা দেবীর নামাঙ্কিত ওই পোস্টকার্ডটায় তো মাত্র দু’তিন ছত্র।
..অনেক দিন পরে কলকাতায় ফিরে তোমার কথাটাই সর্বাগ্রে মনে পড়লো, তাই একটা
চিঠি পোস্ট করে দিচ্ছি।
নিশ্চয় ভালো আছ।
সনৎকাকা।
এই ধরন সনৎকাকার চিঠির।
গতানুগতিক পদ্ধতিতে স্নেহ-সম্বোধনান্তে শুরু করে আশীর্বাদান্তে ইতির পাট নেই সনৎকাকার। বাহুল্য কথাও নয়। ঝরঝরে তরতরে প্রয়োজনীয় কয়েকটি লাইন। কখনো বা পোস্টকার্ডের পুরো দিকটা সাদাই পড়ে থাকে, ও-পিঠের অর্ধাংশে থাকে ওই লাইন কটা।
একদা, অনামিকা দেবীর বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, ওই চিঠির ব্যাখ্যা করে তীব্র আপত্তি তুলেছিলেন তিনি, এ আবার কি রকম চিঠি তোমার সনৎ? একে কি চিঠি বলে?
সনৎকাকা হেসে বলেছিলেন, চিঠি তো বলে না। বলে কার্ড। পোস্টকার্ড।
তাতে কি হয়েছে? লিখছো যখন সে চিঠিতে একটা যথাযোগ্য সম্পর্কের সম্বোধন থাকবে, কুশল প্রশ্ন থাকবে না, নিজে কেমন আছো এ খবর থাকবে না, প্রণাম আশীর্বাদ থাকবে না, মাথার ওপর একটা দেবদেবীর নাম থাকবে না, এ কেমন কথা? না না, এটা ঠিক নয়। এতে কু-দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়। তোমার দেখাদেখি অন্যেও এইরকম ল্যাজামুড়োহীন চিঠি লিখতে শিখবে।
শুনে কিন্তু সনৎকাকা কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে বরং হেসেই উঠেছিলেন। বলেছিলেন, তা চিঠিটা তো আর টাটকা রুইমাছ নয় যে, ল্যাজামুড়ো বাদ গেলে লোকসান আছে! যথাযোগ্য সম্বোধন তো নামের মধ্যে রয়েছে। তোমায় লিখলে লিখবো প্রবোধদা, বোঝাই যাবে তুমি গুরুজন, বকুলকে লিখলে শুধু বকুলই লিখবো, অতএব বুঝতে আটকাবে না লঘুজন।
তা বলে একটা শ্রীচরণকমলেষু কি কল্যাণীয়াসু লিখবে না?
সেটা না লিখলেই কি বোঝা যায় না? সনৎকাকা বোধ করি তার প্রবোধদার এই তুচ্ছ কারণে উত্তেজিত হওয়াটা দেখে আমোদ পেয়েছিলেন, তাই হেসে হেসে বলে চলেছিলেন, ঘটা করে না বললেও বোঝা যায় ছোটদের আমরা সর্বদাই কল্যাণ কামনা করি, আশীর্বাদ করি। এবং বড়দেরও ভক্তিটক্তি প্রণাম-টণাম করে থাকি। কুশল প্রশ্ন তো থাকেই। নিশ্চয় ভালো আছে এটাই তো কুশল প্রশ্ন। অথবা কুশল প্রার্থনা।
নিশ্চয় ভালো আছো এটা একটা কথা নাকি? মানে আছে এর? সনৎকাকার প্রবোধদা চটে লাল হয়ে গিয়েছিলেন, সব সময় মানুষ নিশ্চয় ভালো থাকে? এই যে আমি! ক’দিন ভাল থাকি?
আমাদের সকলের ইচ্ছের জোরে ভালো থাকবে, সেটাই প্রার্থনা।
বাজে কথা রাখো। এ সব হচ্ছে তোমাদের এ যুগের ফাঁকিবাজি। নিজে কেমন আছি এটুকু লিখতেও আলিস্যি।
সনৎকাকাকে তার প্রবোদা এ যুগের বলে চিহ্নিত করতেন। সেটা যেন কতদিন হয়ে গেল? সনৎকাকার বয়েসটাই বা কোথায় গিয়ে পৌঁছলো? অথচ তার প্রবোধদার অর্ধশতাব্দী পার হয়ে যাওয়া মেয়েটাও বলে, সনৎকাকাকে আমি বলি আধুনিক।
তার মানে সনৎকাকা হচ্ছেন সেই দলের, যারা চির-আধুনিক। সেই আধুনিক সনৎকাকা আজও তেমনি চিঠি লিখেছেন। যাতে ল্যাজামুড়ো নেই। আপন কুশলবার্তাও নেই। যেটাকে তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ওটাকে কিছুতেই আলসা বলতে দিতে রাজী হবো না আমি। আমার ভালো থাকা মন্দ থাকার খবর আমি যেচে যেচে দিতে যাবো কেন? কার কাছে। সেটা দরকারী জানি আমি। যার দরকার সে নিজে জানতে চেয়ে চিঠি লিখবে। পোস্টকার্ডের দাম ওই দু’লাইনেই উসুল হয় বাবা!
পারুলও এইরকম চিঠি লেখে। হয়তো ওই কু-দৃষ্টান্তের ফল।
খামের চিঠিতে অবশ্য ব্যতিক্রম ঘটে সনৎকাকার। সেটার দাম শুধু উসুল করেই ছাড়েন না তিনি। উসুলের উপর বাড়তি মাশুল চাপিয়ে তবে ছাড়েন অনেক সময়ই। আর সেটারও ওই ল্যাজামুড়ো থাকে না বলেই অনেক সময় পত্র না বলে প্রবন্ধও বলা চলে। হয়তো কোনো একটা বিশেষ প্রসঙ্গ নিয়েই তার শুরু এবং শেষ।
তেমনি একখানা চিঠি দিল্লীতে ভাইপোর কাছে গিয়ে মাত্র একবারই লিখেছিলেন সনৎকাকা। দিল্লীর সমাজ নিয়ে যার শুরু এবং সারা। তবে এও লিখেছিলেন, এটা হচ্ছে প্রথম ছাপ, অর্থাৎ বিশুদ্ধ বাংলায় ফাস্ট ইম্প্রেশান, দেখি এখানে থাকতে থাকতে এদের মর্মের গভীরে প্রবেশ করতে পারি কিনা এবং ছাপ বদলায় কিনা।
কিন্তু সে চিঠি আর আসেনি তার। দিল্লীর সমাজের মর্মমূলে প্রবেশ করাটাই কি হয়নি তার এখনো? নাকি সেই প্রবেশের ছাপটা প্রকাশ করতে বসার উৎসাহ পাননি আর?
কিন্তু অনামিকাই কি খোঁজ করেছিলেন, কি ধরনের ছাপ পড়লো আপনার সনৎকাকা? আর জানিয়েছিলেন কি, আপনি কেমন আছেন সেটা জানা আমার কাছে খুব দরকারী? না! হয়ে ওঠেনি।
ভাইপোর কাছেই শেষ জীবনটা থাকতে হবে, এই অনিবার্যকে মেনে নিয়েই থাকতে গিয়েছিলেন সনৎকাকা। কারণ লোকজন চরিয়ে একা সংসার করার মতো বয়েস যে আর নেই অথবা থাকবে না, এটা উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন। আর তা না পারলে শেষ গতি তো ওই ভাইপো আর ভাইপো-বৌ। নিজের স্ত্রীটি এমন অতীতকালে তাকে ছেড়ে গেছেন যে এখন আর বোধ করি মনেও পড়ে না–একদা তিনি ছিলেন। একালের পরিচিত সমাজ অনেকেই সনং ব্যানার্জিকে চিরকুমার বলেই জানে!
অনামিকা ওঁর স্ত্রীকে একবার মাত্র দেখেছিলেন। স্ত্রীকে নিয়ে কোথায় যেন বেড়াতে যাবার পথে একবার প্রবোধদার বাড়িতে নেমেছিলেন তিনি। প্রেমঘটিত বিবাহ বলে বৌভাতের ভোজ-টোজ তো হয়নি। তাই বিয়ের সময় কেউ বৌ দেখেনি।
.
অনামিকার মনে আছে, ওরা চলে গেলে প্রবোধচন্দ্র বলেছিলেন, এই বৌ? রোগাপটকা কেলে! কী দেখে মজলেন আমাদের সনৎবাবু! তাই বাড়ুয্যে হায় ঘোষালের গরে মাথা মুড়োতে গেলেন! ছ্যাঃ!
যাক সেই অতীত ইতিহাস নিয়ে আর কেউ চিন্তা করে না। ধরেই নিয়েছে সবাই, লোকটা এতোদিন স্বাধীনভাবে একা থাকলেও, এবার ওকে পরাধীন হতে হবে। আর সেই সূত্রে বাংলা বিহার উড়িষ্যা মধ্যপ্রদেশ, এক কথায় ভারতবর্ষের যে কোন প্রদেশেই হোক, শেষ জীবনটা কাটাতে হবে। অতএব বহুদিনই সনৎকাকা বাংলা দেশ ছাড়া।
এতদিন পরে যে হঠাৎ এলেন, সে কি কোনো বিশেষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্যে? সনৎকাকার সেই ভাইপোটি বদলি হয়ে আবার বাংলা দেশের কোনো চেয়ারে অধিষ্ঠিত হতে এলেন? তার সঙ্গে লটবহরের মত সনৎকাকাও?
অনামিকাকে উনি এ ইঙ্গিতের কণামাত্রও দেননি যে তুমি এসো অথবা তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে।
তবু অভিমানের কোনো প্রশ্ন নেই।
এসো শব্দটি ব্যবহার না করলেও অনামিকা দেবী যে সেখানে সর্বদাই স্বাগত এ কথা অনামিকা যতটা জানেন, ততটা বোধ করি সনৎ ব্যানার্জি নিজেও জানেন না…ওই চিঠিটাই তো এসো!
সেই একটি অনুক্ত এসো শব্দটি অনামিকাকে টেনে বার করলো ঘর থেকে।
বেরোবার সময় আশা অথবা আশঙ্কা করছিলেন, দুষ্ট মেয়েটা কোন্ ফাঁক থেকে এসে জেরা করতে শুরু করবে, এ কি শ্রীমতী লেখিকা দেবী, নিজে নিজে ট্যাক্সি ডেকে বেরোনো হচ্ছে যে? রথ আসেনি তোমার? পুষ্পমাল্য ভূষিত করে সভার শোভাবর্ধন করতে বসিয়ে রাখবার জন্যে?
না, মেয়েটাকে ধারেকাছে কোথাও দেখতে পেলেন না। নির্ঘাত সেই কারখানার কুলিটার সঙ্গে কোথাও ঘুরছে, নচেৎ আর কোথা? আজ তো কলেজের ছুটি।
বাড়ি জানা ছিল, তবু খুঁজে বার করতে কিছু দেরি হয়ে গেল। রাস্তার চেহারাটা একেবারে বদলে গেছে। অনেক দিন যে আসা হয়নি সেটা ধরা পড়লো ওই চেহারাটা দেখে।
মাঝারি একটা গলির মধ্যে পৈতৃক বাড়ি সনৎকাকাদের, সেই গলির মোড়ে অনেকখানিটা জমি পড়ে ছিল বহুকাল যাবৎ। সেটা ছিল পাড়ার বালকবৃন্দের খেলার মাঠ এবং পাড়ার ঝিয়েদের ডাস্টবিন। কষ্ট করে আর কেউ ছাইপাশ-জঞ্জালগুলোকে নিয়ে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে কর্পোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলতে যেতো না, ওই মাঠেই ফেলতো। তাতে যে ছেলেদের খেলার আমোদ কিছুমাত্র ব্যাহত হতো এমন নয়, শুধু খেলার শেষে বাড়ি ফেরার পর মা-ঠাকুমার জামাকাপড় ছাড়, পা ধুয়ে ফেল ইত্যাদি চিৎকারে তাদের শান্তিটা কিঞ্চিৎ বিঘ্নিত করতো।
অনেকদিন পরে এসে দেখলেন অনামিকা দেবী সেই মাঠটায় বিরাটকলেবর একটি ম্যানসন উঠেছে। যাতে অজস্র খোপ। সেই খোপ খোপ কে জানে কতো পরিবার এসে বাসা বেঁধেছে। কে জানে এর মধ্যে থেকেই তারা জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছে কিনা।
তবে আপাততঃ চেনা বাড়িটাও খুঁজে পেতে দেরি হলো ওই বহুখোপবিশিষ্ট আকাশছোঁয়া বাড়িটার জন্যে। তারপর ঢুকে পড়লেন।
হৈ-চৈ করে উঠলেন না সনৎকাকা, খুব শান্ত সহৃদয় হাস্যে বললেন, আয়। তোর অপেক্ষাই করছিলাম।
প্রণাম করে বসে পড়ে ছেলেমানুষের মতো বলে উঠলেন অনামিকা দেবী, অপেক্ষা করছিলেন মানে? আসতে বলেছিলেন নাকি আমায়?
বলিনি? সে কী রে? না বললে এলি কেন? হাসলেন সনৎকাকা।
লজ্জিত হলেন অনামিকা দেবী। বললেন, তারপর, কেমন আছেন বলুন।
খুব ভালো। খাচ্ছি দাচ্ছি বাড়ি বসে আছি, খাটতে-টাটতে হচ্ছে না, এর থেকে আরামদায়ক অবস্থা আর কি হতে পারে?
অনামিকা অবশ্য এই আরামদায়ক অবস্থার খবরে বিশেষ উৎসাহিত হলেন না, বরং ঈষৎ শঙ্কিত গলায় বললেন, কেন, বসে আছেন কেন? বেরোন না?
বেরোবো? কেন? সনৎকাকা দরাজ গলায় হেসে উঠলেন, চলৎশক্তি জুন্মাবার জন্যে যদি একটা বছর লেগে থাকে, সেটা বাদ দিয়েই ধরছি, উনআশী বছর কাল ধরে তো হাঁটলাম বেরোলাম বেড়ালাম, বাকি দিনগুলো ঘরে বসে থাকাই বা মন্দ কি?
ওটা তো বাজে কথা, অনামিকা আরো শঙ্কিত গলায় বলেন, আসল কথাটা বলুন তো! শরীর ভাল নেই?
এই দ্যাখো! শরীর ভাল নেই মানে? ভাল না থাকলেই হলো?
তবে? তবে বাড়ি বসে থাকবেন কেন?
বাঃ, বললাম তো! জীবনের প্রত্যেকটি স্টেজই চেখে চেখে উপভোগ করা দরকার নয়? নীরুকে বললাম, দ্যাখ নীরু, এই হৃদযন্ত্রটা তো বহুকাল যাবৎ খেটে মরছে, এবার যদি ছুটি চায় তো চাক না, ছুটি নিতে দে। তা শুনতে রাজী নয়। ধরে নিয়ে এলো এক ব্যাটা ডাক্তারকে, মোটা ফী, সে তার পাণ্ডিত্য না দেখিয়ে ছাড়বে কেন? ব্যস হুকুম হয়ে গেল নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। অতএব স্রেফ “গাব্বুপিল” হয়ে পড়ে আছি।
অনামিকা বুঝে নিলেন ব্যাপারটা। আস্তে বললেন, কতোদিন হয়েছে এরকম?
আরে বাবা, হয়নি তো কিছুই। তবে কী করে দিনের হিসেব দেবো? তবে তো কবে থেকে চুল পাকলো, কবে থেকে দাঁত নড়লো, এসব হিসেবও চেয়ে বসতে পারিস। একটা যন্ত্র বহুদিন খাটছে, একদিন তো সেটা বিকল হবেই, তাকে ঘষে মেজে আবার চাকায় জুড়ে দেবার চেষ্টা কি ঠিক? কিন্তু কী আর করা? কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আপাততঃ যখন নীরুবাবুই কর্তা, তার ইচ্ছাই বলবৎ থাকুক।
নীরুদা বুঝি আবার কলকাতায় বদলি হয়ে এলেন?
বদলি? আরে না না। ও তো রিটায়ার করে দেশে এসে বসলো।
রিটায়ার করে। অনামিকা অবাক হয়ে বলেন, এখুনি?
এখুনি কি রে? সরকারী হিসেব কি ভুল হয়? যথাযথ সময়েই হয়েছে। আমরাই শুধু মনে রাখতে ভুলে যাই দিন এগিয়ে চলেছে।
তাহলে এখন এখানেই, মানে কলকাতাতেই থাকবেন?
তাছাড়া? সনৎকাকা আবার হাসেন, নীরুর সংসারের আবোল-তাবোল আসবাবপত্তরগুলোর সঙ্গে এই একটা অবান্তর বস্তুও থাকবে। যতদিন না–
হেসে থেমে গেলেন।
কলকাতায় এসে আর কোনো ডাক্তার দেখানো হয়েছে?
দ্যা বকুল, যে রেটে কেবলই মনে করিয়ে দিতে চেষ্টা করছিস–কাকা তুমি বুড়ো হয়েছে, কাকা তুমি রুগী হয়ে বসে আছে, তাতে তোকে আর নীরুকে তফাৎ করা শক্ত হচ্ছে। এ প্রসঙ্গয় যবনিকাপাত কর। তোর কথা বল। খুব তো লিখছিস-টিখছিস। দিল্লীতেও নামডাক। নতুন কি লিখছিস বল?
নতুন কি লিখছি?
অনামিকা হাসলেন, কিছু না।
কিছু না? সে কী রে? এই যে শুনি এবেলা-ওবেলা বই বেরোচ্ছ তোর!
খবর তো যতো হাঁটে ততো বাড়ে! অনামিকা আর একটু হাসেন, নশো মাইল ছাড়িয়ে গিয়ে পৌঁছেছে তো খবরটা।
তার মানে, তুই বলছিস খবরটা আসলে খবরই নয়, স্রেফ বাজে গুজব। লিখছিস টিকছিস না!
লিখছি না তা বলতে পারি না, বললে বাজে কথা বলা হবে, তবে নতুন কিছু আর লিখছি কই?
কেন রে? সনৎকাকা একটু চাঙ্গা হয়ে উঠে বসে বলেন, সমাজে সংসারে এত নতুন ঘটনা ঘটছে রোজ রোজ, মুহূর্তে মুহূর্তে সমাজের চেহারা পাল্টাচ্ছে, তবু নতুন কথা লিখতে পারছিস না?
অনামিকা হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান, যেন নিজের সঙ্গে কথা বলেন, হয়তো এই জন্যেই পারছি না। রোজ রোজ যে নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে তার হিসেব রাখতে পারছি না, মুহূর্তগুলোকে ধরে যেতে পারছি না, হারিয়ে যাচ্ছে, অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে তারা।
ধরতে চেষ্টা করতে হবে, জোর দিয়ে যেন নির্দেশ দিলেন সনৎকাকা।
চেষ্টা করছি, হচ্ছে না। এই মুহূর্তগুলো তো স্থায়ী কিছু দিয়ে যাচ্ছে না, ওরা শুধু সাবানের ফেনার মতো রঙিন বুদবুদ কেটে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর একদিকে–, একটু যেন ভাবলেন অনামিকা দেবী, আর একদিকে কোথায় যেন চলছে ভয়ানক একটা ভাঙনের কাজ, তার থেকে ছিটকে আসা খোয়া পাথরের টুকরো, উড়ে আসা ধুলো গায়ে চোখে এসে লাগছে, কিন্তু সেই ভয়ানককেই বা ধরে নেব কী করে? তার সঙ্গে তো আমার প্রত্যক্ষের যোগ আছে, যোগ নেই নিকট অভিজ্ঞতায়। আধুনিক, না আধুনিক বলবো না, বলবো বর্তমান সমাজকে তবে আমি কলমের মধ্যে ভরে নেব কী করে? শুনতে পাই অবিশ্বাস্য রকমের সব নাম-না– জানা ভয়ানক প্রাণী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে ঘরের মধ্যে এসে ঢুকে পড়ছে, ঘরের লোকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, এবং সেই প্রাণীরা তাদের নখ দাঁত শিঙ লুকোবারও চেষ্টা করছে না। বরং ওইগুলোই গৌরবের বস্তু ভেবে সমাজে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। আর ঘরের লোকেরাও তাই দেখে উঠে পড়ে লাগছে নখ দাঁত শিও গাবার কাজে। কিন্তু এ সমস্তই তো আমার শোনা কথা। শোনা কথা নিয়ে লিখতে চেষ্টা করাটা তে হাস্যকর কাকা। অথচ এও শুনতে পাই, ওদের কাছেই নাকি সাহিত্যের নতুন খোরাক, ওদের কাছেই সাহিত্যের নতুন কথা।
সনৎকাকা আস্তে বলেন, বঙ্গভূমি সম্পর্কে একটা মোহ ছিল, সেটা তাহলে আর রাখবো লেছিস?
অমন জোরালো একটা রায় দিয়ে বসবো, এমন সাহস নেই কাকা! আমি তো নিজেই জানি না মোহটা একেবারে মুছে ফেলে দেবার মতো দুঃসময় সত্যিই এসেছে কিনা। তবে মাঝে মাঝে ভাবি, এইটাই কি চেয়েছিলাম আমরা? এইটাই কি আমাদের দীর্ঘদিনের তপস্যার পুরস্কার? বহু দুঃখ, বহু ক্লেশ সয়ে, এই দেবতাকেই জাগালাম আমরা আমাদের ধ্যানের মন্ত্র? তা যদি হয় তো সেটা সেই মন্ত্রেরই ত্রুটি।
তবে সেই কথাই বল্ জোর গলায়। তোরা সাহিত্যিকরা, কবিরা, শিল্পীরা, তোরাই তো বলবি। মানে তোরা বললেই লোকের কানে পৌঁছবে। আমাদের মত ফালতু লোকেরা একযোগে তারস্বরে চেঁচালেও কিছু হবে না। কি না!
অনামিকা হেসে ফেলেন, ওই আশী বছরের বৃদ্ধের এই একটা নেহাৎ ছেলেমানুষি ভঙ্গী। দেখে ভারী কৌতুক অনুভব করেন অনামিকা! হেসে বলেন, কারুর বলাতেই কিস্যু হবে না। সমাজের একটা নিজস্ব গতি আছে, যে গতিটা যাকে বলে দুরন্ত দুর্বার দুর্জয়। এবং তার নিজেরও জানা নেই গতির ছকটা কি। যতো দিন যাচ্ছে, ততই অনুভব করছি কাকা, গোটাতিনেক জিনিসকে অন্ততঃ পরিকল্পনা করে গড়ে তোলা যায় না। সে তিনটে হচ্ছে সমাজ, সাহিত্য এবং জীবন।
এই সেরেছে, মেয়েটা বলে কি! সনৎকাকা একটি বিস্ময়-আতঙ্কের ভঙ্গী করেন, বলিস কি রে! দুটো না হয় না পারা গেল, কিন্তু বাকিটা? সাহিত্যকে পরিকল্পনা মত গড়ে তোলা যায় না? সে তো নিজের হাতে।
আগে তাই ভাবতাম, অনামিকা আবার যেন অন্যমনা হয়ে যান, আগে তাই ধারণাই ছিল। ভাবতাম কলমটা তো লেখকের নিজের আয়ত্তে। কিন্তু ক্রমশই মনে হচ্ছে হয়তো ঠিক তা নয়। কোথাও কোনোখানে কারো একটি গভীর অভিপ্রায় আছে, সেই অভিপ্রায় অনুসারেই যা হবার হচ্ছে।
সর্বনাশ! তুই যে তত্ত্বকথায় চলে যাচ্ছিস। অর্থাৎ সকলই তোমারই ইচ্ছা ইচ্ছাময়ী তারা তুমি!
মাঝে মাঝে তাই মনে হয়। অনামিকা মৃদুস্বরে বলে চলেন, ইচ্ছাময়ী কি অনিবার্য যে নামই দেওয়া হোক, অদৃশ্য একটা শক্তিকে কি আপনি অস্বীকার করতে পারেন কাকা? কবিত্ব করে বললে, জীবনদেবতা। কবির কথাতেও এ কথা বলা হয়েছে, এ কী কৌতুক নিত্য নতুন ওগো কৌতুকময়ী, আমি যাহা চাই বলিবারে তাহা বলিতে দিতেছ কই?
সনৎকাকা মৃদু হেসে যোগ দেন, অন্তর মাঝে বসি অহরহ মুখ হতে তুমি ভাষা কেড়ে লহ, মোর কথা নিয়ে কি যে কথা কহ, এই তাহলে তোর বক্তব্য?
সব সময় না হলেও অনেক সময়ই। অন্তরদেবতাই বলুন, আর অনিবার্যই বলুন, একটা কিছু ঘটনা আছে। সে কোন্ ফাঁকে লেখকের কলমটাকে নিজের পকেটে পুরে ফেলে! সেই জন্যেই বলছিলাম, সাহিত্যের নিজের একটা গতি আছে। সভা ডেকে, আইন করে, অথবা নির্দিষ্ট কোনো ছক কেটে দিয়ে তাকে বিশেষ একটি গতিতে নিয়ন্ত্রিত করা যায় না। আমার তে অন্ততঃ তাই মনে হয়।
তার মানে তোর মতে যে যা লিখছে সবই ওই অদৃশ্য শক্তির ক্রীড়নক হয়ে?
কে কি করে জানি না কাকা, তবে আমি অনেক সময়ই অনুভব করি এটা।
সনৎকাকা মৃদু হাসেন, শুনতে পাই আরো একটা জোরালো শক্তিই নাকি তোদের আজকালের সাহিত্যের নিয়ন্ত্রক! তার শক্তির প্রভাবেই লেখকের কলম—
অনামিকা হেসে ফেলেন, শুনতে তো কিছু বাকি নেই দেখছি আপনার। কিন্তু যত দোষ নন্দঘোষ বললে চলবে কেন? এ ধাঁধ তো চিরকালের–পৃথিবীটা কার বশ?
আহা সে ধাঁধার উত্তর তো সকলেরই জানা। কিন্তু আমরা চাই কবি সাহিত্যিক শিল্পী, এঁরা সে পৃথিবীর বাইরের হবেন। অন্ততঃ সেটাই আমাদের ধারণার মধ্যে আছে।
তেমন হলে উত্তম। কিন্তু তেমন ধারণার কি সত্যিই কোনো কারণ আছে কাকা? সেকালেও মহা মহা কবিরা রাজসভার সভাকবি হতে পেলে কৃতার্থ হতেন। সেটাই তাদের পরম পাওয়ার মাপকাঠি ছিল। আর সেটা আশ্চর্যেরও নয়। পৃথিবীটা যেহেতু টাকার বশ, সেই হেতুই সব কিছুর মূল্য নির্ধারণ তো হয় ওই টাকার অঙ্ক দিয়েই নিজের প্রতি আস্থা আসারও তো ওইটাই মানদণ্ড! তার ওপর আবার সাহিত্য জিনিসটা আজকাল ধান চাল তুলো তিসির মত ব্যবসার একটি বিশেষ উপকরণ হয়ে উঠেছে। অতএব লেখকরাও টাকার অঙ্ক দিয়ে নিজের মূল্য নিরূপণ করতে অভ্যস্ত হবেন এ আর বিচিত্র কী? আর যে লেখা বেশী টাকা আনবে, সেই রকম লেখাকেই কলমে আনবার চেষ্টা করাটাও অতি স্বাভাবিক।
সনৎকাকা ঈষৎ উত্তেজিত গলায় বলেন, তার মানে তুইও ওই টাকার জন্যে লেখাটাকে সমর্থন করিস?
অনামিকা হেসে ফেলে বলেন, সমর্থনের কথা নয় কাকা, সমর্থনের কোনো প্রশ্নই নেই। আমি সেই অনিবার্যের কথাই বলছি। আমার ধারণায় এইটা হলে ওইটা হবেই। আপনি অবশ্যই জানেন, আজ এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সমাজের প্রতিটি স্তরের লোক অর্থাৎ প্রতিটি সুযোগ-সন্ধানীই লেখকের কলম ভাঙিয়ে খাচ্ছে। লেখকের কলমই তো বিজ্ঞাপনের বাহন। কাগজের সম্পাদকরা এখন আর লেখক তৈরি করে তোলার দায়িত্বর ধার ধারেন না, ধার ধারেন শুধু সেই লেখকের যার লেখা থাকলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আসবে। অতএব প্রতিষ্ঠিত লেখকরা ক্রমশই তাদের ওই বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কল হয়ে উঠছেন। আর তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হিসেবে নতুনরা ওই দরবারে ঢোকবার পথ না পেয়ে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে উৎকট রঙের উদ্ভট পোশাক গায়ে চাপিয়ে দরবারের দরজায় দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গী করে টিন পেটাচ্ছে। জানে এতে লোক জুটবেই। দরবারে ঢুকে পড়তে পারলে তখন দেখানো যাবে প্রতিভা।
অবস্থাটা তো বেশ মনোরম লাগছে রে!
কিন্তু কিছু বাড়িয়ে বলছি না কাকা। নতুন লেখকদের অনেক সংগ্রাম করে তবে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। অনেক নতুন ভঙ্গী, নতুন চমক লাগাতে না পারলে উপায় নেই। আর তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়াতে একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে বসতে পেলে আর কেউ খাটতে চায় না। আর নতুন কথা দেবার চিন্তা থাকে না, চিন্তা থাকে না কি বলবার জন্যে এসেছিলাম। ওই টিন পেটানোটাই যখন সহজ কার্যকরী, আর হাঙ্গামায় কাজ কি! তাছাড়া ওই জিনিসটার ওপর বিশেষ একটা আস্থাও থাকে। দেখেছে যখন ওইটাই দরবারের দরজা খোলার চাবি! আসল কথা কি জানেন কাকা, মননশীলতায় স্থির হতে পারার অবকাশও কেউ দিচ্ছে না শিল্পী সাহিত্যিককে, নির্জন থাকতে দিচ্ছে না। তার সেই স্থিরতার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ে ভিড় বাড়াচ্ছে।
সনৎকাকা হেসে বলেন, তাতে আর আক্ষেপের কি? তোর মতে তো এ সবই অনিবার্যের হাতের পুতুল!
সেটাও ভুল নয়। তাছাড়া মুশকিল কি, ওই টিন পেটানোদের কাছে লোকে টিন পেটানোই চাইবে। যেমন কৌতুক অভিনেতার কাছে কৌতুক অভিনয় ছাড়া আর কিছু নয়। জীবনে। একবার যে ভাড়ামি করে মরেছে, জীবনে কখনো আর তার সীরিয়াস নায়ক হবার উপায় নেই।
তাহলে তো দেখছি তোদের এই সাহিত্যক্ষেত্রটাও দস্তুরমতো গোলমেলে!
দারুণ গোলমেলে কাকা। নিভৃত চিন্তায় নিমগ্ন হবার গভীর আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে বেড়াচ্ছে সবাই।
তোরও তাই অবস্থা নাকি? সনৎকাকা একটু কৌতুকের হাসি হাসেন।
আমার কথা বাদ দিন। অনামিকা বলে ওঠেন, লিখলেই “সাহিত্যিক” হয় না। নিজেকে অন্ততঃ আমি “সাহিত্যিক” শব্দটার অধিকারী ভাবিও না। লেখার অধিকার আছে কিনা একথা ভেবেচিন্তেই একদা লিখতে শুরু করেছিলাম, এখন দেখি পাঠকরাই অথবা সম্পাদকরাই লেখাচ্ছেন। এর বেশী কিছু নয়। তবে ইচ্ছে করে নতুন কিছু লিখি, বিশেষ কিছু লিখি, হেসে ওঠেন অনামিকা, তা সেই বিশেষের ক্ষমতা থাকলে তো? সত্যিই বলবো কাকা, এ যুগকে আমি চিনি না। চেনবার চেষ্টা করবো এমন পরিবেশও নেই। এ যুগ সম্পর্কে যেসব ভয়াবহ চিত্র শুনি অথবা পড়ি সেটা বিশ্বাস করতে পেরে উঠি না।
কিন্তু–, সনৎকাকা আস্তে বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই তো “বাস্তব” বস্তুটা কল্পনার থেকেও অবিশ্বাস্য!
হয়তো তাই। আবার যেন কেমন অন্যমনা হয়ে যান অনামিকা, তার সত্য সাক্ষী পুলিসের রিপোর্ট, ডাক্তারের রিপোর্ট। কিন্তু সাহিত্যিকও কি সেই সত্যেরই সাক্ষী হবে? সাহিত্যিকও কি এই সত্য উদঘাটনের কাজে কলম ধরবে? জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের তফাৎ শুধু বাইরের চেহারাটায়! অন্য কোনো তফাৎ আছে কিনা সে সন্ধান না করেই হেসে বলে উঠবে, আরে বাবা থাক, তফাৎ থাকবে কেন? এখানেও রক্তমাংস, ওখানেও রক্তমাংস। রক্তমাংস ব্যতীত আর কোথায় কি?
এই প্রশ্নটাই আজকাল খুব প্রবল হয়েছে, তাই না রে?
খুব! হয়তো অনবরত ওইটা শুনতে শুনতে ওটাই বিশ্বাসের বস্তু হয়ে দাঁড়াবে।
সনৎকাকা দৃঢ়স্বরে বলেন, উঁহু, লোকে তো অনবরত নতুন কথা শুনতে চাইবে, এ কথা আর কতদিন নতুন থাকবে? মানুষ নামের জীবটা তো বাঘসিংহীর মতো অত বড়োও নয়, মাত্র সাড়ে তিন হাত দেহখানা নিয়ে তো তার কারবার! তার রক্তমাংস ফুরোতে কতক্ষণ?
সেই তো কথা। সেইটাই তো ভাবি। ওপরদিকে অনন্ত আকাশ, নিচের দিকে পা চাপালেই কায় পা। কোনটা সত্য?
না, যা বুঝছি তোর দ্বারা আর নতুন কথা লেখা হবে না! সনৎকাকা হাসেন।
হয়তো তাই। হাসেন অনামিকাও, অন্যমনস্কের হাসি। তারপর বলেন, মানুষের সংজ্ঞা যে শুধু জীব মাত্র, শিব শব্দটা যে অর্থহীন, এর প্রমাণ যখন এখনো স্পষ্ট পাইনি, তখন হবে নাই মনে হয়। তবে এটাও ঠিক কাকা, যা আমার অজানা, তা নিয়ে লিখতে গেলে পদে পদে ভুলই হবে সেটা জানি। আমার তো ভাবলে অবাক লাগে–
কথায় বাধা পড়ে।
সনৎকাকার ভাইপো-বৌ এসে দাঁড়ান। বলেন, ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে কাকামণি।
কোমল মধুর কণ্ঠ। মায়ের আদর ভরা। মনে হলো যেন একটি শিশুর কাছে এসে কথা বললেন।
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলেন অনামিকা, কারণ উত্তরে পরক্ষণেই সত্যসত্যই যেন একটি শিশুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন তিনি।
নাঃ, এই নির্ভুল হুঁশিয়ার মা-জননীটির কাছ থেকে বুড়ো ছেলেটার আর ছাড়ান-ছোড়ান নেই। দাও কোথায় কি ওষুধ আছে তোমার?
কে বললো কথাটা? সনৎকাকা? হ্যাঁ, তিনিই বটে।
অথচ অনামিকার কানে যেন ভয়ঙ্কর রকমের অপরিচিত লাগলো স্বরটা। স্বর, সুর, ভঙ্গী।
সর্বদা যারা সাজিয়ে গুছিয়ে ছেঁদো-ছেঁদো কথা বলে, ঠিক যেন তাদের মতো। অনামিকার খারাপ লাগলো, খুব খারাপ লাগলো, অথচ এমন কি আর ঘটেছে এতে খারাপ লাগার মত?
যে মহিলাটি তার একজন বৃদ্ধ গুরুজনকে স্নেহ-সমাদর জানাতে মহিমাময়ী মাতৃমূর্তিতে কাছে এসে দাঁড়িয়ে স্রেফ মায়ের গলাতেই জানালেন ওষুধ খাবার সময় হয়েছে, তার কণ্ঠস্বর সুরেলা, মুখশ্রী সুন্দর, সাজসজ্জা গ্রাম্যতা-বর্জিত, এবং সর্ব অবয়বে একটি মার্জিত রুচির ছাপ।
এঁর সঙ্গে কথা বলতে হলে তো ওই রকম গলাতেই বলা উচিত। মহিলাটি যদি তার পূজনীয় গুরুজনটির দ্বিতীয় শৈশবের কালের কথা স্মরণ করে তার সঙ্গে শিশুজনোচিত ব্যবহার করেন, গুরুজনটির কি শ্বশুরমোচিত ব্যবহার সঙ্গত?
তবু অনামিকার খারাপ লাগলো। সত্যিই খুব খারাপ।
মহিলাটি যেন এতক্ষণে অনামিকাকে দেখতে পেলেন, তাই ওষুধের শিশি গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে দুই হাত জোড় করে ঈষৎ নমস্কারের ভঙ্গীতে সৌজন্যের হাসি হেসে বললেন, শুনেছি আপনি আমার স্বামীর ছোট বোন, তবু কিন্তু আপনি করে ছাড়া কথা বলতে পারবো। না
হঠাৎ এরকম অদ্ভুত ধরনের কথায় বিস্ময়ের সঙ্গে কৌতুক অনুভব করলেন অনামিকা। মৃদু হেসে প্রতিনমস্কার করে বললেন, কেন বলুন তো?
মহিলাটি অবসরপ্রাপ্ত স্বামীর স্ত্রী, এবং দ্বিতীয় পক্ষও নয়, কাজেই নিতান্ত তরুণীর পর্যায়ে পড়েন না, তবু নিতান্ত তরুণীর গলাতেই সভয় সমীহে বলে উঠলেন, বাবা, আপনি যা একজন ভীষণ বড় লেখিকা! উঃ, আপনার সঙ্গে তো কথা বলতেই ভয় করে।
সনৎকাকার ভাইপো-বৌয়ের উচ্চারণ স্পষ্ট মাজা, প্রতিটি শব্দ যেন আলাদা আলাদা করে উচ্চারিত। কথা বস্তুটা যে একটি আর্ট, এ বোধ যে আছে তার তাতে সন্দেহ নেই। একজন ভীষণ বড় লেখিকার সঙ্গে কথা বলছেন বলেই কি ভাইপো-বৌ এমন কেটে ছেঁটে মেজে ঘষে কথা বললেন, না এই ভাবেই কথা বলেন?
হয়তো তাই বলেন।
হয়তো এইটাই ওঁর নিজস্ব ভঙ্গী; তবু কেনই যে অনামিকার মনে হলো অনেকদিনের চেষ্টায় উনি ওই কথা বলার আর্টটি আয়ত্ত করেছেন।
ভাইপো-বৌয়ের শাড়ি পরার ধরনটি ছিমছাম, চুলগুলি সুছাদের করবীতে সুবিন্যস্ত, গায়ে হালকা দু’একটি অলঙ্কার, চোখের কোণে হালকা একটু সুর্মার টান, পায়ে হালকা একজোড়া চটি, শাড়ির জমিটা ধরা যায়-কি-না-যায় গোছের হালকা একটু ধানীরঙের, এবং চশমার ফ্রেমও হালকা ছাই-রঙা।
অর্থাৎ, সব মিলিয়ে একটি হালকা ওজনের তরুণীই লাগল তাকে।
অনামিকা হেসে বললেন, বড় লেখিকা এই শব্দটাকে অবশ্য আমি মেনে নিচ্ছি না, তবু প্রশ্নটা হচ্ছে যদি কেউ কোনো ব্যাপারে বড়ই হয়, বাড়ির লোকেরাও কি তাকে সমীহ করবে?
ওরে বাবা তা আবার বলতে! ভাইপো-বৌ হেসে ওঠেন, এই তো আপনার দাদা যখন বড় অফিসার ছিলেন, ভীষণ বিগ অফিসার, তখন আমি তো একেবারে ভয়ে কাটা হয়ে থাকতাম। খিলখিল করে হেসে ওঠেন ভাইপো-বৌ, আর সেই হাসির সঙ্গে এমন লীলা বিচ্ছুরিত হয়, ওই বিগ অফিসারদের গৃহিণীদেরই মানায়।
এই ভঙ্গীতেই উনি হয়তো বলতে পারেন, বাড়ি সারাবো? কোথা থেকে? খেতেই কুলোয় তো বাড়ি।
সখী-সামন্ত নিয়ে যখন বসেন এরা, তখনো ওই বাজারদর দিয়েই আক্ষেপ যেন হয়তো এমনি লীলাভরে।
অনামিকা ওই লীলাহাস্যমণ্ডিত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, এখন আর ভয় করেন না। তো?
উহু। আর করবো কেন? এখন তো বেকার!
সনৎকাকা বলে ওঠেন, দেখছিস তো বকুল, মেয়েটা কী সাংঘাতিক!
অনামিকা বলেন, দেখছি বৈকি।
হ্যাঁ, দেখছেন। দেখতে পাচ্ছেন ওঁর ওই সাংঘাতিক মহিমায় সনৎকাকা সুদ্ধ সাজিয়ে কথা বলতে শিখেছেন। হয়তো শিখতে সময় লেগেছে, হয়তো শিখতে বিরক্তিই এসেছে, তবু শিখেছেন।
কিন্তু শেখার কি সত্যই দরকার ছিল? কে জানে, হয়তো বা ছিল। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না শিখলে তো প্রতিপদেই আবহাওয়া বিষময় হয়ে ওঠে।
দিল্লিতেও তো আপনার খুব নামডাক। ওষুধটি ঢেলে দিয়ে ওষুধ মাপা গলায় ওই মন্তব্যটি করলেন ভাইপো-বৌ।
অনামিকা মৃদু হেসে বলেন, তবে তো আর নিজেকে বড় লেখিকা না ভেবে উপায় নেই।
সনৎকাকা অনামিকার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাস্যে বলেন, করতে হলে তো স্বীকার তাহলেই বল মেয়েটাকে “সাংঘাতিক” বলতে হয় কিনা? আমার কাছে তো এতোক্ষণ স্বীকার করছিলিই না। মা-জননীদের কী যেন একটি সমিতি আছে, তার লাইব্রেরীতে তোর কত্তো বই আছে, তাই না মা-জননী?
ভাইপো-বৌ স্মিতহাস্যে বলেন, হ্যাঁ, আছে কিছু কিছু। আমিই কিনিয়েছি। লাইব্রেরীর সব কিছুর ভার আমার ঘাড়েই চাপিয়ে রেখেছে তো!
অনামিকার মুখে আসছিল, যাই ভাগ্যিস আপনি আমার একটি বৌদি ছিলেন রাজধানীতে, তাই আমার লেখা “কিছু কিছু” বইয়ের প্রবেশাধিকার ঘটেছে রাজধানী হেন ঠাইতে! তা মুখে আসা কথাটাকে আর মুখের বাইরে আনলেন না, বললেন, পড়েছেন তা হলে আমার লেখা?
ভাইপো-বৌ আর একবার লীলাভরে হাসলেন, ওই প্রশ্নটি করলেই উত্তর দেওয়া মুশকিল। আমি আবার ধৈর্য ধরে বসে বসে গল্প-উপন্যাস পড়তেই পারি না। তাছাড়া
ভাইপো-বৌ ওষুধের গ্লাস শিশি যথাস্থানে রাখতে রাখতে বলেন, তাছাড়া আজকালকার বইটই তো পড়ারই অযোগ্য।
পড়ারই অযোগ্য?
ভাইপো-বৌয়ের বক্তব্যটি অনুধাবন করবার আগেই প্রশ্নটি যেন স্খলিত হয়ে পড়ে অনামিকা দেবীর কষ্ট থেকে।
ভাইপো-বৌ তার হালকা চটি পরা একটি পা টেবিলের পায়ায় তালে তালে ঠক ঠক করতে করতে বললেন, তাই তো শুনি! ভীষণ নাকি অশ্লীল!
শোনেন! তবু ভালো! অনামিকা মৃদু হাসেন, ভাগ্যিস পড়েন না!
ভাইপো-বৌয়ের হাস্যরঞ্জিত মুখটা মুহূর্তে যেন কাঠ হয়ে যায়, গম্ভীর মুখে বলেন, রুচিও নেই। যে সব বই নিয়ে আদালতে কেস ওঠে, সে-সব বই যে মানুষ কী করে পড়ে।
আমিও তো তাই বলি, সনৎকাকা মৃদু হাস্যে বলেন, তোমার ওই মহিলা সমিতির মহিলারা যে কী বলে কেবলই আধুনিক সাহিত্য পড়বার জন্য অস্থির হন।
ভাইপো-বৌ একবার তার শ্রদ্ধেয় গুরুজনটির দিকে কটাক্ষপাত করেন, মুখটা আর একটু কাঠ হয়ে যায়, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান তিনি, সকলের রুচি সমান নয় বলে।
চেয়ারটা ঠিক করেন, ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
আর সেই মুহূর্তেই অনুভব করেন অনামিকা, সনৎকাকার কণ্ঠে অমন একটা অপরিচিত সুর শুনতে পেয়েছিলেন কেন?
ভাইপো-বৌ চলে যাবার পর সনৎকাকা মৃদু হেসে বলেন, বুদ্ধিমানের ধর্ম অ্যাডজাস্ট করে চলা, কী বলিস?
অনামিকা কিছু বলেন না, শুধু তাকিয়ে থাকেন ওঁর হাস্যরঞ্জিত মুখের দিকে।
কীরে, অমন করে হাঁদার মত তাকিয়ে আছিস কেন?
দেখছি!
কী দেখছিস?
কিছু না।
সনৎকাকা আর কিছু বলতেন হয়তো, হঠাৎ ঘরে ঢোকেন সনৎকাকার ভাইপো, যার পুরো নামটা জানাই নেই অনামিকার। নীরুদা বলেই জানেন।
নীরুদার পরনে গাঢ় রঙের সিল্কের লুঙ্গি, গায়ে একটা টেস্ গেঞ্জি, হাতে টোব্যাকোর টিন। স্ত্রীর সম্পূর্ণ বিপরীত ভঙ্গীতে একেবারে হৈ চৈ করতে করতে ঢোকেন তিনি, আরে আমাদের কী ভাগ্য! শ্রীমতী লেখিকা দেবীর আগমন! তারপর আছো কেমন? বাড়ির সব খবর কি? খুব তো লিখছো-টিখছে!
অনামিকা বলেন, একে একে জবাব দিই, কেমন? আছি ভালো, বাড়ির খবর ভালো, লিখছি অবশ্যই, তবে “খুব” কিনা জানি না।
জানো না কি! শুনতে পাই তুমি নাকি দারুণ পপুলার! মেয়েরা নাকি তোমার লেখার নামে পাগল!
অনামিকা হেসে ফেলে বলেন, মেয়েরা তো? মেয়েদের কথা বাদ দাও। ওরা কিসে না পাগল হয়?
তা যা বলেছে–, নীরুদা হো হো করে হেসে ওঠেন, খুব খাঁটি কথা। শাড়ি দেখলো তো পাগল, গহনা দেখলে তো পাগল, লোকের গাড়ি-বাড়ি দেখলো তো পাগল। সিনেমার নামে পাগল, খেলা দেখার নামে পাগল। বাজার করতে পাগল, বাপের বাড়ির নামে পাগল, এমন কি একটা উলের প্যাটার্নের জন্যও পাগল। তাছাড়া রাগে পাগল, সন্দেহে পাগল, অভিমানে পাগল, অহঙ্কারে পাগল, অপরের ওপর টেক্কা দেবার ব্যাপারে পাগল, মোট কথা নেচার ওদের আধাআধি পাগল করেই পাঠিয়েছে, বাকিটা ওরা নিজে নিজেই–
মেয়েদের তো তুমি অনেক স্টাডি করেছে নীরুদা? অনামিকা হাসেন, লিখলে তুমিও সাহিত্যে নাম করতে পারতে।
লিখলে?
নীরুদা উদাত্ত গলায় বলে ওঠেন, দরকার নেই আমার অমন নাম করার। দেশের ছেলেগুলোকে বখিয়ে সমাজকে উচ্ছন্ন দিয়ে জাতির সর্বনাশ করে নাম আর পয়সা করা হচ্ছে। এই সিনেমাগুলো হচ্ছে, কী থেকে এর উৎপত্তি? ওই তোমাদের সাহিত্য থেকেই তো? কী ঘটছে তা থেকে? ছেলেগুলো ওই থেকেই অসভ্যতা অভব্যতা খুনোখুনি রাহাজানি শিখছে না?
সনৎকাকা হেসে ফেলে বলে ওঠেন, শুনলি তো? এবার কী জবাব দিবি দে!
জবাব দেবার কিছু থাকলে তো? অনামিকা হাসলেন, জবাব দেয়া নেই, স্রেফ কাঠগড়ায় আসামী যখন। আর সিনেমার গল্পকেও যদি সাহিত্য বলে ধরতে হয়, তাহলে তো ফাঁসির আসামী!
বলে ফেলেই অনামিকা ঈষৎ ভীত হলেন, এর মুখেও সঙ্গে সঙ্গে কাঠের চাষ হবে না তো?
কিন্তু ভীতিটা অমূলক নীরুদা বরং আরো বীরদর্পে বলে ওঠেন, তা সাহিত্য নয় কেন? সাহিত্যিকদের লেখা গল্প-টল্পই যখন নেওয়া হচ্ছে।
তা বটে।
হুঁ বাবা! স্বীকার না করে উপায় আছে? নীলা কাকার সামনেই টোব্যাকোর টিন ঠুকে কুচো তামাক বার করে একটা সিগারেট বানাতে বানাতে বলেন, তা তোমার গল্প-টল্পও তো শুনেছি সিনেমা হয়, তাই না?
অনামিকা লক্ষ্য করলেন, নীরুদা আর তাকে ‘তুই’ করে কথা বলছেন না, অথচ আগে বলতেন। তুই ছাড়াই বলতেন না বরং। তার মানে এখন সমীহ করছেন। নাকি দীর্ঘদিন দূরে থাকার দূরত্ব? কিন্তু তাই কী হয়? কই সনৎকাকা তো তাকে ‘তুমি’ বলতে বসলেন না!
বেদনা অনুভব করলেন অনামিকা।
আত্মীয়জন সমীহ করছে, এটা পীড়াদায়ক। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই এটা ঘটতে দেখেন। পুরোনো সম্পর্কের সহজ ভঙ্গীটি যেন খুঁজে পান না। নেহাৎ যারা বাড়ির লোক তারাও কি মাঝে মাঝে এমন দূরত্ব দেখায় না? যেন বকুল নামের মেয়েটা অন্য নামের ছদ্মবেশ পরে অন্যরকম হয়ে গেছে।
অতএব তারাই বা অন্যরা হয়ে যাবে না কেন?
অথচ এই নামটার সম্পর্কে তাদের অনাগ্রহের শেষ নেই, জানবার ইচেছর লেশ নেই। শম্পা বাদে, বাড়ির আর সকলে অনামিকা দেবীর বহির্জীবন এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে শুধু উদাসীনই নয়, যেন বিদ্বিষ্ট। তাদের কথার সুরে কণ্ঠস্বরের ভঙ্গীতে অনেক সময়ই মনে হয়, অনামিকা বুঝি স্রেফ সংসারকে ফাঁকি দেবার জন্যেই দিব্যি একটি ছুতো আবিষ্কার করে নিয়ে মনের সুখে স্বাধীনতা উপভোগ করছে। যেন বকুলের যেটি প্রাপ্য নয়, সেটি ওই কৌশলটি করে লুটে নিচ্ছে বকুল।
অনামিকা কি লিখছেন, কতো লিখছেন, কোথায় লিখছেন, এ ব্যাপারে কারো মাথাব্যথা নেই, অনামিকা যে বিনা পরিশ্রমে শুধু কাগজের উপর কতকগুলো আঁকিবুকি টেনে অনেকগুলো টাকা পেয়ে যান, সেইটা নিয়েই কোনো এক জায়গায় ব্যথা। সেই টাকার সুযোগ যারা গাছে–ষোলো ছেড়ে আঠারো আনা, তাদেরও।
না, অনামিকার দাদা-বৌদিরা হাত পেতে কোনো খরচা নেন না অনামিকার কাছ থেকে, কিন্তু অনামিকারই বা ওরা ছাড়া আর কে আছে? কোথায় করবেন খরচ? দূর সম্পর্কের দুঃস্থ আত্মীয়জন? হয়তো কিছুটা করতে হয় সেখানে, কিন্তু তাতে পরিতৃপ্তি কোথায়?
কিন্তু ওই রূঢ় রুক্ষ কথাটা থাক, অভিমানের আরো ক্ষেত্র আছে বৈকি। অনামিকার সাহিত্যের ব্যাপারে একেবারে বরফ শীতল হলেও, বাইরে অনামিকার অসাক্ষাতে যে ওরা অনামিকার নিতান্ত নিকটজন বলে পরিচিত হতে পরম উৎসাহ, সে তথ্য অনামিকার অবিদিত নেই।
হয়তো জীবন এই রকমই। এতে আহত হওয়াটাই নির্বুদ্ধিতা। অনামিকা যখন তার পরিচিত বন্ধু সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখেন, তখন এই অনুভূতিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে–জীবন এই রকমই।
মানুষের সম্পর্কে মর্যাদাবোধ নেই, শুধু ভাঙিয়ে খাবার মতো মানুষকে ভাঙিয়ে খাওয়ার চেষ্টাটা আছে প্রবল। আজকের দিনের সব থেকে বড় শিল্প বোধ করি মানুষ ভাঙিয়ে খাওয়ার শিল্প।
যদি অনামিকা নামের মানুষটাকে ভাঙিয়ে কিছুটা সুবিধে অর্জন করে নিতে পারা যায়, তবেই সেই অর্জনকারীরা অনামিকার অনুরক্ত ভক্ত বন্ধু। কিন্তু অনামিকা ভালই জানেন যে মুহূর্তে তিনি ওই ভাঙিয়ে খাওয়াটা বুঝতে পারছেন সেটা জানতে দেবেন, সেই মুহূর্তে সকলের সব ভক্তি নিশ্চিহ্ন।
আর নিজে যদি তিনি প্রত্যাশার পাত্র হাতে নিয়ে একবার বলে বসেন, আমায় তো অনেক ভাঙালে, এবার আমার জন্যে কিছু ভাঙো না, তা হলেই লজ্জায় ঘৃণায় দুঃখে ধিক্কারে বন্ধুরা সহস্র যোজন দূরে সরে যাবেন!
হ্যাঁ, এই পৃথিবী।
তুমি যদি বোকা হও, অবোধ হও, আত্মস্বার্থে উদাসীন হও, বন্ধুর গুণগুলি সম্পর্কে চক্ষুষ্মান আর দোষগুলি সম্পর্কে অন্ধ হও, তুমি যে পৃথিবীর সব কিছু ধরে ফেলতে পারছ, সেটা ধরতে না দাও, তবেই তোমার বন্ধুজন তোমার প্রতি সহৃদয়।
নচেৎ? হৃদয়বর্জিত!
এই তো এখনই দেখো, এই নীরুদা নামের বিজ্ঞ বয়স্ক এবং আপন প্রাক্তন পদমর্যাদা সম্বন্ধে যথেষ্ট অবহিত আত্মীয়টি, অনায়াসেই ইনি ছেলেমানুষের মতো ওজনহীন উক্তি করছেন, কিন্তু তার উক্তি যে ছেলেমানুষী ও কথা একবার উচ্চারণ করুন দিকি অনামিকা দেবী?
সঙ্গে সঙ্গেই যে উনি ভিন্ন মূর্তি ধারণ করবেন, তাতে সন্দেহ নাস্তি। যেমন করলেন ওঁর স্ত্রী। তিনি হয়তো শিরিষ কুসম সম অতি সুকুমার, ইনি হয়তো তার থেকে কিছুটা সহনশীল, কিন্তু কলসীর মধ্যে গোখরো আছেই।
অতএব হাস্যবদনে উপভোগ কর ওঁর ছেলেমানুষী! অতএব বলে ফেলো, ও বাবা, তোমার ওই বিরাট কর্মচক্রের ঘর্ঘর ধ্বনির মাঝখানেও এতো খবর পৌঁছেছে তোমার কাছে? অতো দূরে থেকে?
পৌঁছবে না?
নীরুদা খুব একটা উচ্চাঙ্গের রসিকতার হাসি হেসে বলে ওঠেন, মোর সুখ্যাতিতে তো কান পাতা নয়। যাক, তুমি যে ওই সব আধুনিক লেখকদের মতো অশ্লীল-অশ্লীল লেখা লেখো না এতেই আমাদের পক্ষে বাঁচোয়া।
অনামিকা মনে মনে হাসলেন। ভদ্রলোক হয়তো তাবৎ জীবনকাল উচ্চ রাজকর্মচারী হিসেবে যথেষ্ট কর্মদক্ষতা দেখিয়ে এসেছেন, হয়তো সূক্ষ্ম দর্শন ক্ষমতায় অধস্তনদের চোখে সর্ষেফুল এবং ঊধ্বতনদের চোখে নিস্কৃতির আলো ফুটিয়ে এসেছেন, কিন্তু সংসারক্ষেত্রে যে আর একজনের চোখ দিয়ে জগৎ দেখে আসছেন, তাতে সন্দেহ নেই।
এ একটা টাইপ। বশংবদ স্বামীর উদাহরণ।
যাক, কথাবার্তাগুলো কৌতুককর।
তাই হাসি-মুখে উত্তর দেন অনামিকা, আমি যে ওই সব মারাত্বক লেখা লিখি না সে কথা কে বললে তোমায়?
আহা ওটা আবার একটা বলবার মতো কথা নাকি? তুমি ওসব লিখতেই পারবে না। হাজার হোক ভদ্রঘরের মেয়ে তো? আমাদের ঘরের মেয়ে! কচি অমন কু হতে যাবে কেন?
তা বটে।
অনামিকা অমায়িক গলায় সায় দেয়, সে কথা সত্যি। তাছাড়া আমি তো আর আধুনিক নই।
বয়সের কথা বলছো? নীরুদা উদাত্ত গলায় বলেন, সেটা আর আজকাল মানছে কে? যতো রাজ্যের বুড়োরাও তো শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢুকছে শুনছি। কী এরা? সমাজের শত্রু নয়? হয়তো এরাই কলেজের প্রফেসর-ট্রফেসর, হয়তো সমাজের মাথার মণি, অথচ স্রেফ পয়সার লোভে কদর্য-কদর্য লিখে
কথাটার উপসংহারটা বেশ জুৎসই করবার জন্যেই বোধ হয় নীরুদা একবার দম নিলেন, সেই অবকাশে অনামিকা খুব নিরীহ গলায় প্রশ্ন করলেন, আর কার লেখা তোমার এতো কদর্য লাগে নীরুদা?
কার আর? নীরুদা সুপুরি একগালে দেওয়ার সুরে বলেন, কার নয়? একধার থেকে সবাইয়ের। আজকাল কোন্ লেখকটা সভ্যভব্য লেখা লিখছে? লিখবে কেন? আজকাল তো অসভ্য লেখাতেই পয়সা। তাই না? যে বই অসভ্যতার দায়ে কোর্টে উঠবে, সেই বইয়ের তো এডিশন হবে।
অনামিকা মৃদু হেসে বলেন, কোর্ট ওঠেনি, এমন বইয়েরও অনেক সংস্করণ হয়। হতে পারে। আমি তার খবর-টবর রাখি না।
ও তাই বুঝি! শুধু এইসব আধুনিক সাহিত্যই পড়ো বুঝি খুব?
পড়ি? আমি?
নীরুদা যেন আকাশ থেকে পড়েন, আমি ছোঁবো ওই নোংরা অপবিত্র দুর্গন্ধ বই? রাবিশ! মলাটও উল্টে দেখিনি কারুর। আমার হাতে আইন থাকলে এইসব লেখকদের একধার থেকে জেলে পুরতাম, বুঝলে? যাবজ্জীবন কারাদণ্ড! ইহজীবনে যাতে আর কলম না ধরতে পারে বাছাধনেরা।
উত্তর দেবার অনেক কথা ছিল অবশ্য, তবে সেটা তো অর্থহীন। সেই নিরর্থক চেষ্টায় গেলেন না অনামিকা, শুধু খুব একটা ভীতির ভান দেখিয়ে বললেন, ওরে বাবা! ভাগ্যিস নেই! তাই বেচারীরা খেয়ে পরে বেঁচে আছে।
যার চোখ দিয়ে জগৎ দেখেন নীরুদা, তার মতো অনুভূতির সূক্ষ্মতা যে অর্জন করে উঠতে পারেননি নীরুদা এটা ঠিক। তাই শ্লেষের সুরে বলেন, শুধু খেয়ে পরে, গাড়ি-বাড়ি করে নয়? অথচ চিরদিনই শুনে এসেছি সরস্বতীর সঙ্গে লক্ষ্মীর বিরোধ। মাইকেল পয়সার অভাবে বই বেচে খেয়েছেন, গোবিন্দদাস না কে যেন না খেয়ে মরেছেন! গানেও আছে, হায় মা যাহারা তোমার ভক্ত, নিঃস্ব কী গো মা তারাই তত! অথচ এখন?
এতক্ষণ কৌতুকের হাসি মুখে মাখিয়ে নিঃশব্দে এই আলাপ-আলোচনা শুনে যাচ্ছিলেন সনৎকাকা, এখন হঠাৎ একটু যোগ দিলেন। বললেন, আহা হবেই তো। এঁরা তো আর মা সরস্বতীর ভক্ত নয়, ভক্ত হচ্ছেন দুই সরস্বতীর, কাজেই লক্ষ্মীর সঙ্গে বিরোধ নেই। কী বলিস বকুল?
তাই মনে হচ্ছে, অনামিকা হেসে ফেলে বলেন, কিন্তু যাই বলো নীরুদা, সরকারের অতোবড়ো একটা দায়িত্বের জোয়াল কাঁধে নিয়েও যে তুমি সাহিত্য নিয়ে এত ভেবেছো, চর্চা রেখেছে, এটা আশ্চর্যি! এমন কি এতো সব মুখস্থ-টুখস্থ রাখা—
চর্চা রাখতে দায় পড়েছ-, নীরুদা সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে অম্লান বদনে বলেন, তোর বৌদি বলে তাই শুনি। ও তো বলে-নাটক-নভেল গল্প-টল্প একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে যদি দেশের কিছু উন্নতি হয়! জিনিসপত্রগুলো কি? কতকগুলো বানানো কথা মাত্র, তাছাড়া আর কিছু? ওদের মেয়ে এদের ছেলের সঙ্গে প্রেম করলো, নয়তো এর বৌ ওর সঙ্গে পালিয়ে গেল, এই তো ব্যাপার! এই নিয়েই ফেনিয়ে ফেনিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে সাতশো পাতার বই, কুড়ি টাকা দাম, দশটা এডিশন, একটা ক্লাস ওয়ান অফিসারের থেকে বেশী আয় আজকাল নামকরা লেখকের! রাবিশ!
অনামিকার হঠাৎ মনে হয় গাত্রদাহটা বোধ হয় ওই আয়টাকে কেন্দ্র করেই এবং সহসা হাতের কাছে একটা ঘোরতর পাপীকে পেয়ে
চিন্তার ছেদ পড়লো।
সুদৃশ্য একটা ট্রে হাতে ঝাড়ন কাঁধে একটি ভৃত্যের আবির্ভাব ঘটলো। বলা বাহুল্য ট্রে-তে অনামিকার জন্য চা এবং টা!
নীরুদা একটু নড়েচড়ে বসলেন। একটু যেন অসহায়-অসহায় এবং অপ্রতিভ-অপ্রতিভ ‘গলায় বললেন, মেমসাহেব কোথায়?
ভৃত্যের গলায় কিন্তু গভীর আত্মস্থতা।
ঘরে আছেন। মাথা ধরেছে।
মাথা ধরেছে! এই সেরেছে!
নীরুদা চঞ্চল হয়ে ওঠেন, ওই একটি ব্যাধি সঙ্গের সাথী বেচারার। সনৎকাকা উদ্বিগ্ন গলায় বলেন, যা দিকিন দেগে তো একবার।
না, দেখবো আর কি, নীরুদার কণ্ঠস্বর স্খলিত, ও তো আছেই।
তারপর যেন জোর করেই নিজেকে চাঙ্গা করে নিয়ে বলেন, আচ্ছা বকুল, কাকাকে কেমন দেখছো বল?
ভালই তো।
তা এখন অবশ্য ভালই তো বলবে। যা অবস্থা হয়েছিল, আর যে ভাবে এই ভালর পর্যায়ে রাখা হয়েছে! কথা তো শুনতেই চাইতেন না। আর্গুমেন্টটা কী জানো? এতো সাবধানে সাবধানে নিজেকে জিইয়ে রেখে আরো কিছুদিন পৃথিবীতে থাকবার দরকারটা কী? বোঝ? শুনেছো এমন কথা? তোমার বইতে আছে এমন ক্যারেক্টার?
তাই নেই। অনামিকা ঈষৎ গভীর সুরে বলেন, সাধ্য কি যে এ ক্যারেক্টারকে আঁকি?
নীরুদা খোলা গলায় বলেন, অসাধ্য হবে না যদি আমার কাছে দু’দিন বসে ডিক্টেশান নাও। উঃ! তবে হ্যাঁ, একটি জায়গায় স্রেফ জব্দ।
এক ঝলক হাসিতে নীৰুদার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, বৌমাটির কাছে তার ট্যা-ফোঁটি চালাতে পারেন না। বললে তুমি বিশ্বাস করবে না বকুল, এখন কাকার আমার রাতদিন মা জননী ছাড়া
হঠাৎ কেমন যেন চাঞ্চল্য বোধ করেন নীরুদা। বোধ করি শিরঃপীড়াগ্রস্ত সেই বেচারীর পীড়ার কথা সহসা হৃদয়ে এসে ধাক্কা মারে।
উঠে পড়েন উনি। কই তুমি তো কিছুই খেলে না, স্যাণ্ডুইচটা অদ্ভুতঃ খাও বলেই শিথিল চরণে চটি টানতে টানতে এগিয়ে যান।
সনৎকাকা কয়েক সেকেণ্ড সেই দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বলেন, ছেলেটার জন্যে দুঃখ হয়।
সে কী কাকা! অনামিকা গালে হাত দেন, নিজে তো উনি সুখের সাগরে ভাসছেন!
সেটাই তো আরো দুঃখের।
সনৎকাকার কথাটা কি ধাঁধা? না খুব সোজা? জলের মতো একেবারে?
যারা সুখের সাগরে ভাসছে, তাদের জন্যেই চিন্তাশীলদের যতো দুঃখ! তাদের দুঃখবোধ জাগিয়ে তুলে, সেই দুঃখ নিরাকরণের জন্য মাথা খোঁড়াখুঁড়ি!
কিন্তু
মনে মনে একটু হাসলেন অনামিকা, কিন্তু যারা জেগে ঘুমোয়? যারা জেনে বুঝে কৃত্রিমতার দেবতাকে পুজো দিয়ে চলে? আচ্ছা কেন দেয়? চামড়া উড়ে যাওয়া শুধু রক্ত-মাংসের চেহারাটা সহ্য করতে পারে না বলে? রূপ-রস-রং-জৌলুসহীন পৃথিবীটায় বাস করতে পারবে না বলে?
.
সনৎকাকার বাড়ি থেকে অনামিকাদের বাড়ির দূরত্ব নেহাৎ কম নয়, ট্যাক্সিতে বসে চিন্তাকে ছেড়ে দিয়ে যেন গভীরে তলিয়ে যান অনামিকা।
নীরুদা উঠে যাবার পর আরো কিছুক্ষণ বসেছিলেন সনৎকাকার কাছে, আরো কত কথা হয়েছে, সনৎকাকার হাসির সুরমাখা প্রশ্নটা যেন কানের পর্দায় লেগে রয়েছে এখনো–চোখ থেকে মুছে যায় যদি, সব রং সব অনুরাগ, শুধিতে কাহার ঋণ, কাটাতেই হবে দিন, ধরণীর অন্নজলে বাইয়া ভাগ।
সনৎকাকা কি কবিতা লেখেন?
আস্তে আস্তে নিজের ভেতর থেকে আর এক প্রশ্ন ওঠে। লেখা নিয়ে তো অনেক হাস্যকর কথা হলো, হাসলামও। কিন্তু নিজের জমার খাতায় অঙ্কটা কী? সত্যিই কি কিছু লিখেছি?
যে লেখা কেবলমাত্র নগদ বিদায় নিয়ে চলে যায় না, কিছু পাওনা রেখে যায়?
আমি কি সত্যি সত্যি কারো কথা বলতে পেরেছি? আমি কি সত্যকার জীবনের ছবি আঁকতে পেরেছি? নাকি নীরুদার ভাষায়, শুধু কতকগুলো কাল্পনিক চরিত্র খাড়া করে গল্প বানিয়েছি?
হয়তো অপস্রিয়মাণ সমাজজীবনের কিছু ছবি রয়ে গেল আমার খাতায়, কিন্তু যে সমাজজীবন বর্তমানের স্রোতে উত্তাল? মুহূর্তে মুহূর্তে যার রং বদলাচ্ছে, গড়ন বদলাচ্ছে? আমার অভিজ্ঞতায় কি ধরতে পারছি তাদের? না, পারছি না। তার কারণ, আজ আর সমাজের একটা গোটা চেহারা নেই, সে খণ্ড ছিন্ন টুকরো টুকরো! সেই টুকরোগুলো অসমান তীক্ষ্ণ, তাতে যতটা ধার আছে ততটা ভার নেই। আর যেন ওই তীক্ষ্ণতাটা অদূর ভবিষ্যতে ভোতা হয়ে যাবার সূচনা বহন করছে। তবু এখন যারা সেটা ধরতে পারছে, তারা সামাজের সেই ধারালো টুকরোগুলো তুলে নিয়ে আরো শান দিচ্ছে।
তাহলে কি কলমকে এবার ছুটি দেবেন অনামিকা? বলবেন, তোমার ছুটোছুটি এবার শেষ হোক!
হয়তো অনামিকা দেবীর ভক্ত পাঠকের দল সেই অনুপস্থিতিতে হতাশ হবে, কিন্তু নতুন কিছু যদি তাদের দিতে না পারি, কী হবে পুরনো কথাকে নতুন মোড়কে সাজিয়ে?
গাড়ি একটা বাঁক নিল, সামান্য একটু নির্দেশ দিলেন চালককে, তারপর আবার ভাবলেন, কিন্তু সেই নতুন কথাটা কি? কেবলমাত্র নিষ্ঠুর হাতে সব কিছুর আবরণ উন্মোচন?
তা ছাড়া? তাছাড়া আর সবটাই তো পুরনো।
জীবন নিয়েই সাহিত্য, চরিত্র নিয়েই কল্পনা। আদ্যিকালেও যা ছিল, আজও কি তাই নেই? যেটা অন্যরকম সেটা তো পরিবেশ। সমাজে যখন যে পরিবেশ, তার খাঁজে খাজে ওই জীবনটাকে যেমন দেখতে পাওয়া যায়, সেটাই সাহিত্যের উপজীব্য। আজকের পরিবেশ যদি বাপছাড়া, পালছেঁড়া, হালভাঙা হয়, সাহিত্যই বা
না, না, বাঁ দিকে নয়, ডান দিকে– নির্দেশ দিলেন চালককে। তারপর শিথিল ভঙ্গী ত্যাগ করে উঠে বসলেন, এবার ঠিক জায়গায় নামতে হবে।
যে মনটাকে ছেড়ে দিচ্ছিলেন, তার দিকে তাকালেন, তারপর আস্তে বললেন, কিন্তু পরিবেশ সাহিত্যের উপর জয়ী হবে, না সাহিত্য পরিবেশের উপর? সাহিত্যের ভূমিকা কি পরাজিতের?
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থেকে নামলেন, একটু চকিত হলেন, দরজার কাছে ছোড়দা দাঁড়িয়ে, দাঁড়িয়ে বড়দার ছেলেও।
ওরা এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কেন? অনামিকার দেরি দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে? সেটা তো অলীক কল্পনা! অনামিকার গতিবিধি নিয়ে কে মাথা ঘামায়? ব্যস্ত তেমন হলেন না, ভাবলেন নিশ্চয় সম্পূর্ণ অন্য কারণ। ধীরেসুস্থে মিটার দেখছিলেন, বড়দার ছেলে এগিয়ে এলো, দ্রুত প্রশ্ন করলো, শম্পার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
শম্পার সঙ্গে!
হা হা, তোমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেছে?
ভাইপোর গলায় যেন একটা নিশ্চিত সন্দেহের সুর, যেন যে প্রশ্নটা করছে সেটার উত্তরটা তার অনুকূল হওয়ারই সম্ভাবনা।
অনামিকা বিস্ময় বোধ করলেন। বললেন, আমি তো তাকে সকালের পর আর দেখিইনি। কেন কী হয়েছে?
যা হবার তাই হয়েছে। বড় ভাইপো যেন পিসিকেই নস্যাৎ করার সুরে বলে ওঠে, কেটে পড়েছেন। সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।