১৫. পাতঞ্জল দর্শন
এই দর্শন ভগবান পতঞ্জলি মুনির প্রণীত বলিয়া পতিধ্রুল শব্দে প্রসিদ্ধ হইয়াছে । আর ইহাতে যোগের বিষয় বিশেষরূপে নির্দিষ্ট থাকায় ইহাকে যোগশাস্ত্রশব্দে, এবং পদার্থ নির্ণয়াংশে সাঙ্খ্যদর্শনের সহিত ঐকমত্য থাকায়, অর্থাৎ মতভেদ না থাকায় সাঙ্খ্য-প্রবচন শব্দেও নির্দেশ করা যায়। সাঙ্খ্যমতপ্রদর্শক কপিল মুনি, যে রূপ প্রকৃতি ও মহৎ তত্ত্ব প্রভৃতি পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব স্বীকার করিয়াছেন, সেই রূপ পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব, মহর্ষি পতঞ্জলিরও অভিমত, কিন্তু কপিল মতে জীবাতিরিক্ত, সৰ্ব্ব-নিয়ন্তা, সৰ্ব্বব্যাপী, সৰ্ব্বশক্তিমান, লোকাতীত পরমেশ্বরের সত্তা স্বীকৃত হয় নাই (১)। ভগবান পতঞ্জলি মুনি যুক্তি প্রদর্শন পুৰ্ব্বক ঈশ্বরসত্তা প্রতিপাদন করিয়াছেন । এ কারণেই কপিলদর্শন ও পাতঞ্জল দর্শনকে যথাক্রমে নিরীশ্বর ও সেশ্বর সাঙ্খ্যদর্শন কহে । পাতঞ্জল দর্শন পাদচতুষ্টয়ে বিভক্ত। প্রথম পাদে যোগশাস্ত্র করিবার প্রতিজ্ঞা, যোগের লক্ষণ, ষোগের অসাধারণ উপায়স্বরূপ যে অভ্যাস ও বৈরাগ্য তাহাদিগের স্বরূপ ও ভেদ, সম্প্রজ্ঞাত ও অসম্প্রজ্ঞাত ভেদে সমাধিবিভাগ, সবিস্তার যোগোপায়, ঈশ্বরের স্বরূপ, প্রমাণ, উপাসনা ও তৎফল, চিত্তবিক্ষেপ, দুঃখাদি, চিত্তবিক্ষেপের ও দুঃখাদির নিরাকরণোপায়, এবং সমাধি প্রভেদ প্রভূতি বিষয় সকল প্রদর্শিত হইয়াছে। দ্বিতীয়ে ক্রিয়াযোগ, ক্লেশ সকলের নির্দেশ, স্বরূপ, কারণ ও ফল, কৰ্ম্মের প্রভেদ, কারণ স্বরূপ ও ফল, বিপাকের কারণ ও স্বরূপ, তত্ত্বজ্ঞান রূপ বিবেকখ্যাতির অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ ভেদে কারণ যে যম নিয়মাদি তাহাদিগের স্বরূপ ও ফল, এবং আসনাদির লক্ষণ, কারণ ও ফল প্রদর্শিত হইয়াছে। তৃতীযে যোগের অন্তরঙ্গ স্বরূপ যে ধারণা, ধ্যান ও সমাধি তাহাদিগের স্বরূপ, পরিণাম ও প্রভেদ, এবং বিভূতিপদবাচ্য সন্ধি সকল প্রদর্শিত হইয়াছে। চতুর্থপাদে সিদ্ধিপঞ্চক, বিজ্ঞানবাদনিরাকরণ, সাকারবাদসংস্থাপন, এবং কৈবল্য প্রদর্শিত হইয়াছে । ঐ চারিট পাদ যথাক্রমে যোগপাদ, সাধনপাদ বিভূতিপাদ ও কৈবল্যপাদ শব্দে বুঝিতে হইবেক ।
পতঞ্জলি মতে ষড়বিংশতি তত্ত্ব স্বীকৃভ হইয়াছে । এই ষড়বিংশতি তত্ত্বেই যাবতীয় পদার্থ অন্তর্ভূত হইবেক, এতদতিরিক্ত পদার্থান্তর নাই। প্রকৃতিতত্ত্ব প্রভৃতি পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব সাস্থrদর্শনসংগ্রহে সবিশেষ প্রদর্শিত হইয়াছে, এস্থলে পুনরুক্তিভয়ে পরিত্যক্ত হইল । ষড়বিংশ তত্ত্ব পরমেশ্বর ।
পরমেশ্বর স্বীকারের যুক্তি এই ; সাভিশয় অর্থাৎ তারতম্যরূপে অবস্থিত বস্তুসকলের শেষ সীমা আছে, যথা অল্পত্ত্ব ও অধিকত্ব পরিমাণের শেষ সীমা যথাক্রমে পরমাণু ও আকাশ । অতএব যখন কাহাকে ব্যাকরণমাত্রে, কাহাকে কাব্য ও আলঙ্কারে, আর কাহাকে বা ঐ ঐ শাস্ত্র এবং দর্শন শাস্ত্রে অভিজ্ঞ দেখিয়া স্পষ্ট প্রতীয় মান হইতেছে যে, জ্ঞানাদিও সাতিশয় পদার্থ, তখন অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবেক জ্ঞানাদিও কুত্ৰাপি শেষ সীমা প্রাপ্ত হইয়া নিরতিশয়তা পদে পদার্পণ করিয়াছে। যে পদার্থ যাদৃশ গুণের সম্ভাব ও অভাবে যথাক্রমে উৎকৃষ্ট ও অপকৃষ্টরূপে পরিগণিত হয়, সেই পদার্থের সর্বভোভাবে তাঙ্কুশ গুণবত্তারূপ অত্যুৎকৃষ্টতাকে নিরতিশয়তা কহে । অণুর পরম অণুতা, স্থূলের পরম স্থূলতা, মূর্খের অত্যন্ত মূর্খত, বিদ্বানের সকল বিদ্যাবত্তাই অত্যুৎকৃষ্টত বলিতে হইবে, নতুবা তদ্বিপরীত স্থূলতাদি অণু প্রভূতির উৎকৃষ্টতা হইবে না । জ্ঞানের উৎকৃষ্টতা ও অপকৃষ্টত বিবেচনা করিতে হইলে অধিক বিষয়কতা ও অপবিষয়কতাই লক্ষিত হইবেক ; এ কারণই কিঞ্চিম্মাত্র শাস্ত্রজ্ঞানীকে অপকৃষ্ট জ্ঞানী, আর অধিকশাস্ত্রজ্ঞানীকে উৎকৃষ্টজ্ঞানী কহে । এই রূপে যখন অধিকবিষয়ক ভাই জ্ঞানের উৎকৃষ্টত ইহা সিদ্ধ হইল, তখন এই অপরিচ্ছিন্ন-ব্রহ্মাণ্ডস্থ খেচর, অরণ্যচর ও অস্মদাদির চক্ষুর অগোচর সর্ববস্তুবিষয়কভাই যে জ্ঞানের অত্যুৎকৃষ্টতারূপ নিত্য নিরভিশয়্তা তাহা আর বলিবার অপেক্ষা কি ? ঐ নিত্য নিরতিশয়জ্ঞান স্বরূপ সৰ্ব্বজ্ঞতা জীবের সম্ভবে না ; ষেহেতু জীবের বুদ্ধিবৃত্তি রজোগুণ ও তমোগুণ দ্বারা কলুষিত থাকায় দৃকশক্তি পরিচ্ছিন্ন ; পরিচ্ছিন্ন দৃকশক্তি দ্বারা কখনই সৰ্ব্বগোচর জ্ঞান সম্ভবে না, সুতরাং অপরিচ্ছিন্ন দৃকশক্তিমানকেই তাদৃশ সৰ্ব্বজ্ঞতার এক মাত্র আশ্রয় বলিয়া স্বীকার করিতে হইবেক সন্দেহ নাই। ঐ অপরিচ্ছিন্ন দৃকশক্তিমান যিনি তিনিই অস্মদাদির অভিমত পরমেশ্বর, তদ্ভিন্ন অন্যকে আমরাও পরমেশ্বর বলিয়া স্বীকার করি নাই । এই রূপে যখন পরমেশ্বরসত্তা সিদ্ধ হইল, তখন পরমেশ্বর নাই বলিয়া বাগাড়ম্বর করা কেবল অজ্ঞানবিজুস্তিতমাত্র সন্দেহ নাই। পরমেশ্বর বক্ষ্যমাণ ক্লেশ, কৰ্ম্ম, বিপাকাশয়াদি রহিত, জগন্ধিৰ্ম্মণার্থ স্বেচ্ছানুসারে শরীর ধারণ পূৰ্ব্বক সংসারপ্রর্ত্তক, সংসারানলে সন্তপ্যমান ব্যক্তি সকলের অনুগ্রাহক, অসীমকৃপানিধান, এবং অন্তর্যামিরূপে সৰ্ব্বত্র দেদীপ্যমান রহিয়াছেন । আর পরমেশ্বর যোগপরতন্ত্র অর্থাৎ যথানিয়মে যোগামুষ্ঠান করিলে অভীষ্টকলপ্রদ ও সাক্ষাৎপ্রত্যক্ষ হয়েন ।
চিত্তবৄত্তির নিরোধকে, অর্থাৎ বিষয় সুখে প্রবৃত্ত চিত্তকে বিষয় হইতে বিনিৰুত্ত ও ধ্যেয়বস্তুমাত্রে সংস্থাপিত করিয়া তন্মাত্রের ধ্যান বিশেষকে যোগ কহে । অন্তঃকরণকে চিত্ত কহে । ক্ষিপ্ত, মৃঢ়, বিক্ষিপ্ত, একাগ্র আর নিরুদ্ধ ভেদে চিত্তের অবস্থা পঞ্চবিধ। রজোগুণের উদ্রেক হওয়ায় ষে অবস্থাতে চিত্ত অস্থির হইয়া সুখ দুঃখাদি জনক বিষয়ে প্রবৃত্ত হয়, সেই অবস্থাকে ক্ষিপ্তাবস্থা কহে । দৈত্যদানবাদির চিত্ত প্রায় ঐ অবস্থাভে থাকে । যে অবস্থায় তমোগুণের উদ্রিক্ততানিবন্ধন কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্যবিচারমূঢ় হইয়া ক্রোধাদিবশতঃ চিত্ত সৰ্ব্বদা বিরুদ্ধ কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়, তাহাকে মূঢ়াবস্থা কহে । ঐ মূঢ়াবস্থান্ধিত চিত্ত রক্ষ পিশাচাদির স্বভাবসিদ্ধ । সত্ত্বগুণের উদ্রেক হইলে চিত্ত দুঃখকর বিষয় হইতে নিৰ্বাত্ত হইয়া সৰ্ব্বদা সুখসাধনে প্রবৃত্ত হয় । ঐ কালে চিত্তের বিক্ষিপ্তাবস্থা জন্মে ; দেবতাদিগের চিত্ত প্রায় বিক্ষিপ্তাবস্থা পরিত্যাগ করে না । এই তিন অবস্থাই যোগের প্রতিকুল, অর্থাৎ এই তিন অবস্থাতে কখনই যোগসাধন হয় না । সত্ত্বগুণে বিশুদ্ধ ও উৎকৃষ্ট হইলে চিত্তের একাগ্রতা ও নিরুদ্ধ অবস্থা জন্মে । এই দুই অবস্থাই যোগের অনুকূল ; এ অবস্থাদ্বয় না হইলে কখনই যোগ সিদ্ধ হয় না।
চিত্তের অবস্থ। বিশেষকে চিত্তবৃত্তি কহে। চিত্তবৃত্তি পাঁচ প্রকার ; প্রমাণ, বিপর্য্যয়, বিকল্প, নিদ্রা, আর স্মৃতি । প্রত্যক্ষ, অনুমান ও আগম, অর্থাৎ শব্দ ভেদে প্রমাণ ত্ৰিবিধ । মিথ্যাজ্ঞান অর্থাৎ ভ্রমজ্ঞানকে বিপৰ্য্যয় কহে, যেমন রজ্জ্বকে সর্প ও শুক্তিকে রৌপ্য বলিয়া জানা। কোন বিষয় বাস্তবিক অত্যন্ত অসম্ভাবিত বলিয়া স্থির থাকিলেও তদৰ্থপ্রতিপাদক শব্দ শ্রবণমাত্র আপাততঃ তদ্বিষয়ের যে জ্ঞান জন্মে ভাহাকে বিকম্পে কহে । মধ্যাহ্নে চন্দ্রোদয় হওয়া অলীক বলিয়া, দৃঢ়বিশ্বাস থাকিলেও যদি কেহ কহে যে, মধ্যাহ্নে চন্দ্রোদয় হইয়ছে দর্শন কর, তবে সকলেরই তৎক্ষণাৎ ঐ শদের প্রয়োগবশতঃ ঐ অসম্ভাবিত অর্থের বোধ হইবে ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে, অন্যথা ঐ শব্দশ্রবণমাত্র ঐ অসঙ্গত অর্থ বুদ্ধিবৃত্তিতে অধিরূঢ় না হইলে ঐ শব্দপ্রযোক্ত ব্যক্তি বুদ্ধিমৎসমাজে মিথ্যাবাদী বলিয়া ঘৃণিত হইভ না । পশু পক্ষি প্রভৃতি জন্তুদিগের শব্দ শ্রবণ করিয়া কোন ব্যক্তি ঐ ঐ জন্তুদিগকে অসংলগ্নবাদী বলিয়া থাকে ? তাহার কারণ কেবল ঐ ঐ জন্তুদিগের শব্দ শ্রবণ করিয়৷ অর্থ বোধের অভাব । এই রূপে যখন সিদ্ধ হইতেছে, অর্থ সঙ্গতই হউক বা অসঙ্গতই হউক, শব্দশ্রবণমাত্রেই তদর্থের বোধস্বরূপ শব্দবোধ হয়, তখন নৈয়ায়িক ও আলঙ্কারিক প্রভৃতি মহোদয়গণের “অসঙ্গত অর্থ বোধক শদের অর্থ বোধ স্বরূপ শব্দবোধ হয় না” এই সিদ্ধান্ত ধ্বান্তে পতিভ হইতেছে সন্দেহ নাই । আরও দেখ, শব্দশ্রবণাধীন অসঙ্গতার্থের বোধ স্বীকার না করিলে ঐ ঐ মহোদয়দিগের অধুনা সম্মান সংবৰ্দ্ধনের অদ্বিতীয় উপায় স্বরূপ বিচারই হইতে পারে না ; কারণ যদি প্রতিবাদী সঙ্গতার্থ শব্দ প্রয়োগ করে, তবে তাহার প্রভি দোষোস্তাবন করা হয় না ; আর যদি অসঙ্গতার্থ শব্দ প্রয়োগ করে, তাহা হইলে ঐ ঐ মতে তাহার অর্থবোধই হয় না, সুতরাং বিচার কালে উক্ত মহাশয়দিগকে উভয়থাই মৌনাবলম্বন করিতে হয় ; কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, উক্ত মহাশয়েরাই বিচারকালে প্ৰগলভভা প্রদর্শন পুৰ্ব্বক অধিক বাগাড়ম্বর করেন । এই এই স্থলে শাব্দবোধের পদে বোধান্তরকে প্রতিষ্ঠিত করিতে ইচ্ছা করা, ঔদ্ধত্যমদে মত্ত হইয় অকৃতাপরাধী চিরপ্রতিপালক প্রভূর সম্পদে অপরিচিত ব্যক্তির অভিষেক করাইতে বাঞ্ছা করার ন্যায়, নিতান্ত গৰ্হিত, বিশেষতঃ পণ্ডিতগণের কদাচ কৰ্ত্তব্য নয় । আরও বিবেচনা কর, ঐ ঐ মহোদয়দিগের যদি নিতান্ত শব্দবোধের প্রতি বিদ্বেষ এবং বোধান্তরের প্রতি অনুরাগ জন্মিয়া থাকে, তাহা হইলে সৰ্ব্বত্রই শাব্দবোধ পরিত্যাগ করিয়৷ বোধান্তরের শরণ লওয় উচিত, নতুবা পতি ও উপপতি উভয়েরই প্রণয়াকাক্ষিণী রমণীর বৃত্তি অবলম্বন করা কি পণ্ডিতের পক্ষে প্রশংসাকর হইতেছে ? অতএব নব্য ন্যায়গ্রন্থকারক কোন কোল সূক্ষ্মদর্শী মহাশয়ের গড্ডলিকাপ্রবাহে পতিত না হইয়া অসংগতার্থেরও শাব্দবোধ স্বীকার করিয়াছেন । নিদ্রা শব্দে প্রসিদ্ধ নিদ্রাকে বুঝিতে হইবেক । ফলতঃ যৎকালে তমোগুণের অত্যন্ত উদ্রেক হয় তৎকালে নিদ্রা জন্মে। এবং স্মরণকে স্মৃতি কহে। এই পাঁচ প্রকার চিত্তবৃত্তিই চিত্তের পরিণামবিশেষ বলিয়। চিত্তের ধৰ্ম্ম, আত্মধৰ্ম্ম নহে; যেহেতু আত্মা অপরিণামী, কুটস্থ ও নিত্য । আত্মা ও পরমেশ্বরভিন্ন সকল বস্তুই পরিণামী, কোন বস্তুই পরিণামবিনিমুখে ক্ষণ কালও থাকে না, সকল বস্তুরই সৰ্ব্বদা পরিণাম হইতেছে ।
পরিণাম ত্ৰিবিধ ; ধৰ্ম্ম, লক্ষণ ও অবস্থা। মৃত্তিক ও সুবর্ণাদির যথাক্রমে ঘট সরাবাদি ও কটক কুণ্ডলাদিকে ধৰ্ম্ম পরিণাম, ঐ ঐ ধৰ্ম্মের বর্তমানত্ব ও ভূতত্ত্বাদিকে লক্ষণ পরিণাম, আর ধৰ্ম্মিস্বরূপ মৃত্তিকা ও সুবর্ণাদির নূতনত্ব ও পুরাতনত্বাদিকে অবস্থাপরিণাম কহে । যোগস্বরূপ চিত্তবৃক্তিনিরোধ অভ্যাস ও বৈরাগ্য দ্বারা সমুৎপন্ন হয় । বহুকাল নিরস্তুর আদরাতিশয় সহকারে কোন বিষয়ে যত্ব করাকে, অভ্যাস, আর বিষয়সুখবিতৃষ্ণাকে বৈরাগ্য কহে। যাহার বৈরাগ্য উপস্থিত হয়, সে বিবেচনা করে, সুখদুঃখজনক বিষয়ের বশীভূত আমি নই, আমারই বশবর্তী সুখদুঃখাদিজনক বিষয় ; এ কারণ বৈরাগ্যকে বশীকারশব্দে নির্দেশ করা যায় বিষয় দ্বিবিধ, দৃষ্ট ও অনুগ্রবিক ।
ইহলোকে উপভূজ্যমান বিষয়কে দৃষ্ট, আর পরলোকে ভোক্তব্য বিষয়কে আহুপ্রবিক কহে । ইহার উদাহরণ যথাক্রমে বনিতা, স্ৰক ও চন্দনাদি, এবং স্বর্গ নরকাদি । ব্যাধি, স্ত্যান, সংশয়, প্রমাদ, আলস্য, অবিরতি, ভ্রান্তি দর্শন, অলব্ধভূমিকত্ত্ব, আর অনবস্থিতত্ত্ব এই কয়েকটা যোগের প্রতিবন্ধক, অর্থাৎ ইহারা, রজোগুণ ও তমোগুণের প্রাদুর্ভাব উৎপন্ন হইয়া চিত্ত বিক্ষেপ সম্পাদন দ্বারা একাগ্রতার প্রতিরোধ করে । ধাতু বৈষম্য নিমিত্ত জ্বরদিকে ব্যাধি, অকৰ্ম্মণা তাকে স্ত্যান, “যোগ করা যায় কি না” ইত্যাদি সন্দেহকে সংশয়, অনবধানতাকে প্রমাদ, যোগসাধনে ঔদাসীন্যকে আলস্য, যোগে প্রবৃত্তাভাবের হেতুভূত চিত্তের গুরুত্বকে অবিরতি, যোগাঙ্গ ভ্রান্তিকে ভ্রান্তিদর্শন, সমাধি-ভূমির অপ্রাপ্তিকে অলব্ধভূমিকত্ব, এবং সমাধিতে চিত্তের অস্থিৰ্য্যকে অনবস্থিতত্ব কহে । এই কয়েক কারণ বশতঃ চিত্ত বিক্ষিপ্ত হইলে দুঃখ, দেীর্মনস্য, অঙ্গমেজয়ত্ব, শ্বাস ও প্রশ্বাসাদি জন্মে। চিত্তের রজে ইংশের পরিণামবিশেষকে দুঃখ কহে । দুঃখ প্রতিকুলবেদনীয়, কেহই দুঃখকে অমুকুল বিবেচনা করেন না । বাহ বা আন্তরিক কোন কারণ বশতঃ চিত্তের ঔদাসীন্যকে দেীর্মনসা, সৰ্ব্বাঙ্গ কম্পকে অঙ্গমেজয়ত্ব প্ৰাণ বায়ুর বহির্দেশ হইতে অন্তঃপুবেশকে শ্বাস, আর অন্তর হইতে বহির্দেশ গমনকে পুশ্বাস কহে । দুঃখাদি কয়েকটা দোষ চিত্ত বিক্ষিপ্ত হইলে পুনরায় চিত্তের একাগ্রতার পুতিবন্ধক হয়। কিন্তু বিক্ষিপ্তচিত্ত ব্যক্তি, চিত্তপ্রসাদ জন্মিলে পুনরায় যোগ করণে সমর্থ হয়। চিত্তপুসাদজনক উপায় অনেক আছে; তন্মধ্যে কয়েকটা প্রদর্শিত হইতেছে। চিত্তশুদ্ধিসমুৎসুক ব্যক্তি-সকলের কৰ্ত্তব্য, সাধু ব্যক্তির সুখ সন্দর্শন করিয়া ঈর্ষ্য পরিত্যাগ পূৰ্ব্বক ঐ ব্যক্তির সহিত মিত্রত করেন, এবং দুঃখী ব্যক্তির দুঃখ পরিহারের চেষ্টা করেন । দুঃখী ব্যক্তির প্রতি ঔদাসীন্য প্রকাশ করা অতি অকৰ্ত্তব্য । পুণ্যবানের পুণ্য প্রশংসা করিয়া হৃষ্ট হওয়া কৰ্ত্তব্য, তাহার প্রতি বিদ্বেষ করা অনুচিত্ত | পাপী ব্যক্তির পুতি ঔদাসীন্য পুষ্কাশ করিবে, ভদ্বিষয়ে অনুমোদন বা বিদ্বেষ কিছুই করিবে না । এই কয়েকট কৰ্ম্মকে পরিকর্ম্ম কহে ।
যোগ দ্বিবিধ; জ্ঞানযোগ আর ক্রিয়াযোগ । পুৰ্ব্বোক্ত যোগকে জ্ঞানযোগ কহে । জ্ঞানযোগের অধিকারী সকলে নহে ; যাহাদিগের চিত্ত প্রসন্ন হইয়াছে, তা হাদিগেরই জ্ঞানযোগে অধিকার আছে। যাহাদিগের চিত্তপ্রসাদ না হইয়াছে তাহাদিগকে প্রথমতঃ ক্রিয়াযোগ করিতে হয় । ক্রিয়াযোগ তপঃ, স্বাধ্যায় ও ঈশ্বরপুণিধান ভেদে তিন প্রকার । বিধিপ্রদর্শিত মার্গ অবলম্বন করিয়৷ কৃচ্ছ্র চান্দ্রায়ণাদির অনুষ্ঠান দ্বারা শরীরশোধনকে তপস্যা কহে । প্রণব ও গায়ত্রী প্রভৃতি মন্ত্রের অধ্যয়নকে স্বাধ্যায় কহে । ঐ মন্ত্র দ্বিবিধ ; বৈদিক ও তান্ত্রিক । বৈদিক মন্ত্রও দ্বিবিধ ; প্রগীত আর অপ্রগীত । সামবেদীয় মন্ত্রকে প্রগীত কহে, যেহেতু সামমন্ত্রের গান করিতে হয়। অপ্রগীতও দ্বিবিধ ; ঋক ও যজুর্যন্ত্র। তন্ত্রোক্ত মন্ত্রকে তান্ত্রিক মন্ত্র কহে। তান্ত্রিক মন্ত্র স্ত্রী, পুরুষ ও নপুংসক ভেদে ত্ৰিবিধ । যে মন্ত্রের অন্তে ‘নমঃ” এই শব্দ আছে, তাহাকে নপুংসক মন্ত্র, আর যাহার অন্তে ‘বহ্নিজীয়া” অর্থাৎ স্বাহা এই শব্দ আছে, তাহাকে স্ত্রী মন্ত্র কহে ; এতদতিরিক্ত সকল মন্ত্রই পুরুষমন্ত্র । পুরুষ মন্ত্রই সিদ্ধ মন্ত্ৰ ; অর্থাৎ অন্যান্য মন্ত্ৰ সকলের সংস্কার না করিলে কাৰ্য্য সদ্ধ হয় না, কিন্তু পুরুষমন্ত্রের সংস্কার হউক বা না হউক, ঐ মন্ত্র যদৰ্থে অনুষ্ঠিত হইবে সেই কার্য্য তৎক্ষণাৎ সুসিদ্ধ হইবে সন্দেহ নাই । বিশেষতঃ পুরুষ মন্ত্র বশীকরণাদি কৰ্ম্মে অতি প্রশস্ত ।
মন্ত্রের সংস্কার দশ প্রকার, জনন, জীবন, তাড়ন, বোধন, অভিষেক, বিমলীকরণ, আপ্যায়ন, তৰ্পণ, দীপন ও গুপ্তি । মাতৃকাবর্ণ, অর্থাৎ স্বর ও হলবর্ণ, হইতে বিধিপুৰ্ব্বক মন্ত্রের উদ্ধারকে জনন, মন্ত্রের অন্তর্গত বর্ণ সকলকে প্রণবযুক্ত করিয়া জপ করাকে জীবন, মন্ত্রঘাটক বর্ণ সকলকে লিখিয়া চন্দনযুক্ত জল দ্বারা বায়ু বীজ (২) উচ্চারণ পূৰ্ব্বক প্রত্যেক বর্ণের তাড়নাকে তাড়ন, ঐ রূপ মন্ত্রবর্ণকে লিথিয় করবার পুষ্প দ্বারা প্রতি বর্ণের প্রহরকে বোধন, স্বকীয় তন্ত্রাদুসারে অশ্বথাপত্রের দ্বারা মন্ত্রের অভিষেককে অভিষেক, মন্ত্রকে চিন্তা করিয়া জ্যোতিৰ্ম্মন্ত্র দ্বারা মন্ত্রের মলত্রয়ের দাহ করাকে বিমর্ণীকরণ, মন্ত্রপূত কুশোদক দ্বারা বারিবীজ (৩) উচ্চারণ করিয়া বিধিবৎ মন্ত্রের প্রেক্ষিণকে আপ্যায়ন, মন্ত্রে মন্ত্রপুত বারি দ্বারা তৰ্পণকে তৰ্পণ, তার (৪), মায়, (৫) রক্ষা, (৬) ঔ বীজাদির যোগ করাকে দীপন, এবং জপ্য মস্ত্রের অপ্রকাশনকে গোপন কহে । এই দশ বিধ সংস্কার করিলে মন্ত্রের রুদ্ধ, কীলিত, বিচ্ছিন্ন, সুপ্ত ও শপ্তাদি দোষ থাকে না, এ কারণ মন্ত্রজপের পূৰ্ব্বে এই দশবিধ সংস্কার করা অতি আবশ্যক এবং প্রকৃতফলোপযোগী। জ্ঞানকৃত বা অজ্ঞানকৃত শুভাশুভ কৰ্ম্ম সকলের ফলাভিসন্ধি ব্যতিরেকে ঈশ্বরে সমর্পণ করাকে ঈশ্বর প্রণিধান কহে । এই ঈশ্বর প্রণিধানকেই ক্রিয়াফল সন্ন্যাস কহে । ফলাভিসন্ধি ব্যতিরেকে যে কৰ্ম্ম করা যায়, তাহাতেই ঈশ্বর সস্তুষ্ট হয়েন ; ফলাতিসন্ধান করিয়া কৰ্ম্ম করিলে কখনই ঈশ্বর সস্তুষ্ট হয়েন না ইহা পণ্ডিতপ্রধান নীলকণ্ঠ ভারতী স্পষ্ট লিখিয়াছেন, যথা “যে কৰ্ম্ম ফলাভিসন্ধিভে আরব্ধ করা যায়, সে কৰ্ম্ম অতি প্রযত্ব সহকারে সম্পন্ন করিলেও তাহাতে ঈশ্বরের ভুষ্টি জন্মে না, সে কৰ্ম্ম কুঙ্কুর কর্তৃক অবলীঢ় পায়সাদির সদৃশ ।”
উল্লিখিত ক্রিয়াযোগের অনুষ্ঠান করিলে ক্লেশ সকলের তনুতা অর্থাৎ ক্ষীণত জন্মে । অবিদ্যা, অস্মিতা, রাগ, দ্বেষ ও অভিনিবেশ ভেদে ক্লেশ পঞ্চবিধ । অবিদ্যা শব্দে অজ্ঞান স্বরূপ মোহকে বুঝায়। অভথাভূত বস্তুকে তথাভূত করিয়া জানাকে অজ্ঞান কহে । এই অবিদ্যাই অন্যান্য ক্লেশের মুলীভূত, সুতরাং অবিদ্যা নিৰ্বত্ত হইলেই অন্যান্য ক্লেশও নিৰ্বত্ত হয়, এবং অবিদ্যা প্রবৃত্ত হইলেই সকল ক্লেশ প্রৱত্ত হয়। আত্মার সহিত অন্তঃকরণের অভেদজ্ঞানকে অমিত কহে । এই অমিতা বশতই নিলেপ আত্মাকে ও “অহং কৰ্ত্তা” ইত্যাদি কর্তৃত্বাদ্যক্তিমানে লিপ্ত করে । সুখকর বিষয়ে অভিলাষকে রাগ কহে ; এই রাগবশতঃ সকলে সংসারে প্রবৃত্ত হয় । দুঃখজনক বিষয়ে যে বিদ্বেষ ভাব তাঁহাকে দ্বেষ কহে ; এই দ্বেষৰূপ দোষ থাকাতেই আপাততঃ ক্লেশকর যোগাদিভে সৰ্ব্ব সাধারণ জনগণ প্রবৃত্ত হয় না। পূৰ্ব্ব পুৰ্ব্ব জন্মে অনুভূত ষে অসথ্য মরণদুঃখ ভদ্বাসনা বশতঃ ; অর্থাৎ তাহার স্মরণ বশতঃ ইহ জন্মে যে মরণভয় উপস্থিত হয়, তাহাকে অভিনিবেশ কহে । এই অপরিছিন্ন ধরামণ্ডলে সচেতন পদার্থ মাত্রেরই অন্তঃকরণে অতিনিবেশ সৰ্ব্বদ জাগরূক রহিয়াছে ।
এই পঞ্চবিধ ক্লেশ কৰ্ম্ম, বিপাক ও কৰ্ম্মশয়ের মূলীভূত । বৈধ ও অবৈধ ভেদে কৰ্ম্ম দ্বিবিধ । বৈধকৰ্ম্ম বেদ বোধিত যজ্ঞাদি, আর অবৈধ কৰ্ম্ম বেদ নিষিদ্ধ ব্ৰহ্মহত্যাদি । কৰ্ম্মফলকে বিপাক কহে । বিপাক জাতি, আয়ুঃ ও ভোগভেদে তিন প্রকার। জাতি দেবত্ব মনুষ্যত্ত্বাদি। অয়ুঃ চিরজীবিত্ত্ব অল্পজীবিত্ত্বাদি । ভোগসাধন ও ভোগ্য ভেদে ভোগও দ্বিবিধ । ভোগসাধন ইন্দ্রিয়াদি, ভোগ্য সুখ-দুঃখ-জনক বিষয়জাত । সংসার রূপে অবস্থিত যে পুৰ্ব্বোক্ত কৰ্ম্ম তাহাকেই কৰ্ম্মাশয় কহে । কৰ্ম্মাশয় পুণ্য ও পাপভেদে দ্বিবিধ । সংস্কার রূপে অবস্থিত কৰ্ম্মকে পুণ্য, আর বেদবিরুদ্ধ কৰ্ম্মকে পাপ কহে । ঐ উভয় কৰ্ম্মাশয়ও দ্বিবিধ ; দৃষ্টজন্মবেদনীয় ও অদৃষ্টজন্মবেদনীয় । ইহ জন্মে যে পুণ্য বা পাপ স্বরূপ কম্মশিয়ের ভোগ হয় তাহাকে দৃষ্টজন্মবেদনীয়, এবং জন্মান্তরে যাহার ভোগ হয় তাহাকে অদৃষ্টজন্মবেদনীয় কহে । যদি অতিশয় ষত্ব ও বিশেষ নিয়ম সহকারে নিরস্তুর বহুকাল দেবতার আরাধনাদি করা যায়, অথবা ব্রহ্মবধাদি নিন্দনীয় কৰ্ম্ম করা যায়, তাহা হইলে ইহ জন্মেই ঐ ঐ কৰ্ম্মের ফল ভোগ হয় সন্দেহ নাই; যেমন মহাদেবের আরাধনা করাত্তে নন্দীশ্বরের বিশিষ্ট জন্মাদি এবং তপোবলে বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণজাতি প্রাপ্তিরূপ শুভ কৰ্ম্মের ফল ইহ জন্মেই ঘটি য়াছে, এবং কুকৰ্ম্ম বশতঃ নহুশ ও উৰ্ব্বশীর যথাক্রমে জাত্যন্তর ও কাৰ্ত্তিকেয়বনে লতারূপে অবস্থান ঘটিয়াছে ।
পূৰ্ব্বোক্ত কৰ্ম্মফলস্বরূপ বিপাক যদিও পুণ্য পাপ জন্য বটে, তথাপি উহার। পরম্পরায় পুণ্য পাপের জনকও হয়। দেখ যাঁহারা পুণ্যবলে যে জাতি প্রাপ্ত হয়েন তাঁহারা সেই জাতিতে কেবল পুণ্যই করেন, যেমন যোগিকুলজাত মহাপুরুষগণ । আর যাঁহারা পাপবলে যে জাতি প্রাপ্ত হয় তাঁহারা সেই জাতিতে নিরন্তর পাপানুষ্ঠানই করে, যথা ব্যাধিকুলজাত পামরগণ । ফলতঃ সকলেই পূৰ্ব্ব পুৰ্ব্ব জন্মকৃত কৰ্ম্মবলে জন্ম গ্রহণ করিয়া পর পর জন্মের কারণীভূত কৰ্ম্ম করে সন্দেহ নাই । কিন্তু যোগাদিগের পক্ষে সেরূপ নহে । যোগীরা অত্যন্ত সুখজনক বিষয়কেও বিষসম্পূক্ত সুস্বাদু মিষ্টান্নের ন্যায় জ্ঞান করিয়া পরিত্যাগ করেন, এবং প্রারব্ধ কৰ্ম্ম অপরিহার্য্য বিবেচনায় তাহারই ফল ভোগে সন্তুষ্ট হইয়৷ সংসার যাত্রা নিৰ্বাহ করেন, কখনই পুনর্জন্মকারণীভূত কোন কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করেন না ; কৰ্ম্মের মধ্যে কেবল নিত্য নৈনিত্তিক ও চিত্তশুদ্ধিকর যোগাঙ্গের অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন ।
যোগাঙ্গ অষ্টবিধ ; যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি । অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য্য এবং অপরিগ্রহ ভেদে যম পাঁচ প্রকার । প্রাণিবিনাশন স্বরূপ হিংস পরিত্যাগকে অহিংসা কহে । এই অহিংসাকে যে সিদ্ধ করিতে পারে তাহর নিকটে স্বভাবতঃ পরস্পর বিরোধী জন্তুসকলও বৈরভাব পরিত্যাগ পুৰ্ব্বক সুহৃদের ন্যায় ব্যবহার করে । একারণ যে বনে যোগীরা বাস করেন, তথায় অহি, নকুল, মৃগ, ব্যাঘ্র প্রভৃতি চিরবৈরাবলম্বী পশু সকলও সহজ সুহৃদের ন্যায় একত্র বিচরণ করে। বাক্য ও মনে মিথ্যাশূন্যতাকে সত্য কহে । সত্যসিদ্ধ ব্যক্তি যাহাকে যাহা বলেন, অবিলম্বে তাহার সে বিষয় সিদ্ধ হয় । সত্যাবলম্বীর কথা কখনই মিথ্যা হয় না ; যদি কহেন ‘এই বন্ধ্যার : পুত্র হইবে, অথবা অদ্য মধ্যাহ্নে বা অমাবস্যায় পূর্ণ চন্দ্র উদিত হইবেন” তবে ঐ ঐ বিষয়ও সিদ্ধ হয়। পরদ্রব্য অপহরণ স্বরূপ চৌর্য্যের অভাবকে অস্তেয় কহে । অস্তেয়ের অনুষ্ঠান করিলে কিছুই অপ্রাপ্য থাকে না ; অমূল্য রত্নাদিও সন্নিধানে উপস্থিত হয় । ইন্দ্রিয়দোষশূন্যতাকে ব্রহ্মচর্য্য কহে । ব্রহ্মচৰ্য্য করিলে আ প্রতিহতবীৰ্য্য অর্থাৎ আসাধারণ সামর্থ্য জন্মে। ভোগসাধন বিষয়ের অস্বীকারকে অপরিগ্রহ কহে । অপরিগ্রহের অনুষ্ঠান করিলে পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব জন্মের বৃত্তান্ত সকল স্মৃতিপথারূঢ় হয় । এই অহিংসাদি পাঁচটা কাৰ্য যদি জাতি, দেশ, কাল আর সময়কে অপেক্ষ না করিয়াই অমুষ্ঠিত হয় তাহা হইলে ইহাদিগকেই মহাব্ৰত কহে । “ইনি ব্রাহ্মণ ইহাকে বধ করা হইবে না৷” ‘”ঙ্গাতীরে কি রূপে বধ করিব” “পুণ্যাহ চতুৰ্দশী তিথিতে বধ করা অতি অনুচিত” “যে ব্যক্তি দেবতা বা ব্রাহ্মণের প্রয়োজন ব্যতিরেকেও পরহিংসা করে সে অতি নৃশংস ও পামর” এই কয়েক প্রকার বিবেচনা করিয়া ঐ ঐ স্থলে অহিংসাদির অসুষ্ঠানকে যথাক্রমে জাতি, দেশ, কাল ও সময়কে অপেক্ষ। করিয়া অহিংসানুষ্ঠান কহে । কিন্তু যোগীরা এরূপ জাত্যাদি অপেক্ষ না করিয়াই অহিংসাদির অনুষ্ঠান করেন, একারণ উহাদিগের অহিংসাদিগকে মহাব্রত বলা যায় । শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায়, আর ঈশ্বর প্রণিধান ভেদে নিয়মও পাঁচ প্রকার। বাহ্য ও অভ্যন্তর ভেদে শৌচ দ্বিবিধ । মৃত্তিক ও জলদি দ্বারা শরীরমলের প্রক্ষালনকে বাহ্য শৌচ, আর মিত্ৰতাদিদ্বারা মনোমল প্রক্ষালনকে অভ্যন্তর শৌচ কহে । সকল বিষয়ে তুষ্টিকে সন্তোষ কহে । তপস্যাদি পুর্বেই উক্ত হইয়াছে ।
উল্লিখিত যম নিয়মের অনুষ্ঠান করিলে বিভকাদি বিনষ্ট হয় । বিতর্ক শব্দে হিংসাদি পাপ কৰ্ম্ম বুঝিতে হইবে । ঐ বিতর্ক ত্ৰিবিধ ; কৃত, কারিভ ও অনুমোদিত। স্বয়ং সম্পাদিত বিতর্ককে কৃত, আর অন্যকে নিযুক্ত করিয়া তদ্ারা সম্পাদিতকে কারিত বিভক কহে ; এবং অন্যকুত বিতর্কে অসন্তুষ্ট ন। হঠয়া বরং ভদ্বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ পুরঃসর সম্মত হইলে উহাকে অনুমোদিত বিতর্ক বলা যায় । এস্থলে, যখন কারিত ও অনুমোদিত বিতর্ক কৃত বিতর্কের সহিত তুল্য রূপে নির্দিষ্ট হইয়াছে, তখন “আমি স্বয়ং হিংসা করি না তবে ঐ ব্যক্তিকৃত হিংস বিষয়ে আমার সম্মতি বা ইচ্ছ। ছিল এই মাত্র, অতএব আমার এ বিষয়ে পাপ হইভে পারে না” এইরূপ যুক্তিতে যে কারিত ও অনুমোদিত দুষ্কৰ্ম্মের পাপীজনকভা খণ্ডন, সে কেবল খণ্ডজ্ঞানীর দুরাগ্রহ মাত্র সন্দেহ নাই । যেরূপ যমস্বরূপ যোগাঙ্গের অন্তর্গত অহিংসাদির এক একটা অবাস্তর ফল প্রদর্শিত হইয়াছে, সেই রূপ নিয়মের অন্তর্গত শৌচাদিরও এক একটা আন্তরীয় ফল আছে । যথা শৌচামুষ্ঠান করিলে শরীরের কারণকলাপ অনুসন্ধান করিয়া শরীরে অপবিত্রতা জ্ঞান এবং নিজ শরীরের প্রতি ঘৃণা জন্মে ; ঐ ঘূণার ফল এই যে “যখন শরীর অপবিত্র হইতেছে তখন তাহার পুতি আস্থা বা ষত্ব করা অবিধেয়” এইরূপ ৰিবেক উপস্থিত হইয়া নিজ শরীরের প্রতিও আগ্রহ নিবারণ করিয়া এবং তাদৃশ অপবিত্রশরীরশালী ব্যক্তি সকলের সংসর্গ পরিত্যাগ করাইয়া যোগীর অসঙ্গত্ব সম্পাদন করে । শৌচ দ্বারা পরম্পরায় তত্ত্বজ্ঞানের স্বরূপ বিবেক খ্যাতিও জন্মে। তাহার প্রণালী এইরূপ, শৌচ দ্বারা চিত্তশুদ্ধি, চিত্তশুদ্ধি দ্বারা সৌমনস্য অর্থাৎ মনঃপ্রসন্নতা, সৌমনস্য দ্বারা একাগ্রতা, একাগ্রভা দ্বারা ইন্দ্রিয় জয়, ইন্দ্রিয় জয় হইলেই উল্লিখিত বিবেক খ্যাতি সম্পাদনে সামর্থ্য জন্মে।
সন্তোষের অভ্যাস দ্বারা এক অনিৰ্ব্বচনীয় মানসিক সুখ আবির্ভূত হয় । সমুদায় বিষয় মুখ ঐ মুখের শতাংশের একাংশও হইবে না । তপস্যার অনুষ্ঠান করিলে ইন্দ্ৰিয়, চিত্ত ও কায়ের অশুদ্ধি ক্ষয় হয়। ঐ অশুদ্ধি নির্মুল হইলে ইন্দ্রিয় ও কায়ের এক অপুৰ্ব্ব শক্তি জন্মে। ভদ্বারা অভি স্বক্ষ, অত্যন্ত ব্যবহিত বা দূরবর্তী বস্তু সকলও দর্শনপথে অধিরূঢ় হয়, এবং স্বেচ্ছানুসারে কখন অতি স্থঙ্ক শরীর, কখন বা অতি বৃহৎ শরীর ধারণ করিতে পারা যায়। উল্লিখিত স্বাধ্যায় অনুষ্ঠিত হইলে ইষ্টদেবতার সাক্ষাৎকার লাভ হয় । পৃর্বোক্ত ঈশ্বর প্রণিধান করিলে ঈশ্বর প্রসন্ন হইয়। আন্তরিক ক্লেশকলাপের বিলয় করিয়া সমাধি সম্পাদনে সামর্থ্য প্রদান করেন । ঈশ্বর প্রণিধানের দ্বারা যেরূপ সমাধিসামর্থ্য জন্মে ঈশ্বরের উপাসনা দ্বারাও সেইরূপ জন্মে, বিশেষতঃ ঈশ্বরের উপাসনা দ্বারা আশু বিবেকখ্যাতি অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞান জন্মে। ঈশ্বরের উপাসনা শব্দে ঈশ্বর বাচক প্রণব, ভৎ এবং সৎ, ইত্যাদি শব্দের উচ্চারণ এবং ঐ ঐ শদের অর্থ যে ঈশ্বর তাহার নিরন্তর মরণ বুঝিতে হইবেক । শাস্ত্রানুসারে স্থান বিশেষে হস্তপদাদির সংস্থাপন পুৰ্ব্বক উপবেশনকে আসন কহে । আসন দশবিধ, পদ্মাসন, তদ্রাসন, বীরাসন, স্বস্তিকাসন, দণ্ডকাসন, সোপপ্রয়, পৰ্যঙ্ক, ক্রৌঞ্চ, নিষদন, উষ্ণনিষ দন আর সমসংস্থাপন । ঐ ঐ আসনের বিশেষ বিশেষ লক্ষণ ভগবান যাজ্ঞবল্ক্য মুনি নিরূপণ করিয়াছেন । আসনের অনুষ্ঠানে এক চমৎকার স্থির মুখের অনুভব হয় ।
প্রাণবায়ুর স্বাভাবিক গতি বিচ্ছেদকে প্রাণায়াম কহে । প্রাণায়াম ত্ৰিবিধ ; রেচক, পূরক ও কুম্ভক । অন্তর হইতে যথাশাস্ত্র প্রাণবায়ুর বহির্নিঃসরণকে রেচক, বহির্দেশ হইতে অস্তরে অনিয়নকে পুরক, এবং অন্তঃস্তম্ভৱত্তিকে অর্থাৎ নিঃসারণ বা আকর্ষণ না করিয়া কেবল অন্তরে ধারণকে কুম্ভক কহে। যেরূপ পূর্ণকুম্ভস্থিত জল নিশ্চলরূপে অবস্থিত হয়, সেইরূপ কুম্ভক স্বরূপ চরম গ্রাণায়ামের অনুষ্ঠানকালে প্রণবায়ু চাঞ্চল্য পরিত্যাগ করিয়া নিশ্চলবৃত্তি অবলম্বন করে ; এইরূপে কুম্ভক প্রাণায়ামের কুম্ভের সহিত দৃষ্টান্ত ঘটে বলিয়া ইহাকে কুম্ভক প্রাণায়াম বলা যায়। প্রাণায়ামের অনুষ্ঠান করিলে চিত্তের মলক্ষয় হয় এবং ধারণার অনুষ্ঠানে শক্তি জন্মে। যেরূপ মধুমক্ষিক সকল মধুকররাজের অনুবর্তী হয় সেইরূপ ইন্দ্রিয়গণ অবিকৃতস্বরূপ চিত্তের অনুবৰ্ত্তন করে । ঐ অনুবর্তনকে প্রত্যাহার কহে । ঐ প্রত্যাহারের অনুষ্ঠানে ইন্দ্রিয় সকল বিষয় হইতে নিৰুত্ত হইয়। বশত্তাপন্ন হয়, যদি কখন বিষয়াভিমুখে নীয়মান হয়, তাহা হইলে তাহান্তে অমুরত্ত্ব হয় না । নাভিচক্র বা নাসিকা প্রদেশে বিষয়াস্তুর হইতে বিনিবৃত্ত চিত্তের স্থিরীকরণকে ধারণা কহে । অন্যান্য বিষয়ের চিন্তু পরিত্যাগ করিয়া ধোয় বস্তুর চিন্তা-প্রবাহকে ধ্যান কহে। ঐ ধ্যানই পরিপাকাবস্থায় সমাধিপদবাচ্য হয়।
ধারণা, ধ্যান ও সমাধি এই তিনটী যোগাঙ্গকে সংযম এবং যোগান্তরঙ্গ কহে। ঐ তিনটা যোগাঙ্গ ইতর যোগাঙ্গ অপেক্ষ উৎকৃষ্ট, যেহেতু ইহারা যোগ সিদ্ধির সাক্ষাৎ কারণ। অন্যান্য যোগাঙ্গ এরূপ নহে, তাহার পরম্পরায় যোগের কারণ, একারণ অন্যান্য যোগাঙ্গকে বহিরঙ্গ কহে । উল্লিখিত ধারণাদি তিনটা যোগাঙ্গ অনুষ্ঠিত হইলে কিছুই আর অজ্ঞাত থাকে না, অতীত বা অনাগত বিষয় সকলও বর্তমানের ন্যায় প্রত্যক্ষপরিদৃশ্যমান হয়, এবং স্বেচ্ছাক্রমে আবির্ভূত 3 তিরোভূক্ত হইতে শক্তি জন্মে, অধিক কি বলিব, যোগীরা যখন যাহা ইচ্ছা করেন তখন তাহাই করিতে পারেন, তাহাদিগের অসাপ কিছুই নাই এই বলিলেই পর্যাপ্ত হইতেছে । যত প্রকার সিদ্ধি জগতে প্রসিদ্ধ আছে সে সকলই যোগীদিগের হস্তগত । সিদ্ধি নানা প্রকার ; তন্মধ্যে অণিমা, মহিমা, লঘিমা, গরিমা, প্রাকাম্য, ঈশিত্ব, বশিত্ব ও কামাবসায়িত্ব এই আটটা সিদ্ধিকে (৭) মহাসিদ্ধি কহে ।
সকল ব্যক্তিরই সংসারের কারণ একমাত্র প্রকৃতিপুরুষসংযোগ। ঐ প্রকৃতিপুরুষ সংযোগ পূৰ্ব্বোক্ত অবিদ্যাবশতই জন্মে ঐ অবিদ্যার বিনাশক কেবল বিবেকখ্যাতি, এতদ্ভিন্ন অবিদ্যার উন্মূলক উপায়ান্তর নাই। বিবেকখাতিশব্দে, প্রকৃতি প্রভূতি জড় পদার্থ হুইভে পুরুষ পৃথগ ভূত অপৃথক নহে, এইরূপ তত্ত্বজ্ঞানকে বুঝায় । ষেমন ধন হইলে আর নিধনভাস্বরূপ দৈন্য থাকে না, সেইরূপ অবিদ্যাবিরোধী বিবেক খ্যাতি যাহার চিত্তভূমিতে পদার্পণ করে, তাহার চিত্তহইতে তৎক্ষণাৎ অবিদ্যা দূরে পলায়ন করে ; ইহার অনুরূপ দৃষ্টান্ত সিংহসমাগমে গজের পলায়ন । আর যেরূপ মৃত্তিকা বিনষ্ট হইলে তৎকার্য্য শরাবাদিও বিনষ্ট হয়, সেই রূপ অবিদ্যা বিনষ্ট হইলে যে তৎকার্য প্রকৃতিপুরুষ সংযোগ বিনষ্ট হইবে এবং প্রকৃতিপুরুষ সংযোগ বিনষ্ট হইলে যে তৎকার্য্য সংসারও এককালে বিনিবৃত্ত হইবে তাহ আর বলিবার অপেক্ষ কি । এইরূপে বিবেকখ্যাতি দ্বারা সংসার নিবৃত্তি হইলেই পুরুষের কৈবল্য হয় ৷ যথা জরাসন্নিধানেই তৎ প্রতিবিম্বে স্বচ্ছ স্ফটিককেও রক্ত বলিয়া বোধ হয়, জবার অসন্নিধানে কখনই স্ফটিক রক্ত বলিয়া প্রতীয়মান হয় না, প্রতু্যত তাহার স্বাভাবিক শুভ্রতারই অনুভব হয়, সেইরূপ পুরুষ নিলেপ ও স্বচ্ছ হইলেও সংসার দশাতেই চিত্তগত সুখদুঃখাদির আভাস মাত্রে “আমি সুখী, আমি দুঃখী, আমি কৰ্ত্তা” ইত্যাদি অভিমানে লিপ্ত হয়েন, সংসার নিবৃত্ত হইলে আর ঐ ঐ অভিমান জন্মে না তৎকালে পুরুষের স্বাভাবিক চিন্মাত্রস্বরূপ কেবলরূপতাই থাকে। ঐ কেবলব্ধপতাকেই কৈবল্য ও মুক্তি কহে । যাহার বিবেকখ্যাতি উৎপন্ন হইয়াছে তাহার প্রজ্ঞা অর্থাৎ বুদ্ধি দ্বিবিধ ; কাৰ্য্যবিমুক্তি আর চিত্তবিমুক্তি । কার্য্যবিমুক্তি চারি প্রকার ; প্রথম যত জ্ঞাতব্য বস্তু আছে সে সকলই অবগত হইয়াছি আমার অজ্ঞাত কিছুই নাই এইরূপ জ্ঞান, দ্বিতীয় আমার সকল ক্লেশই ক্ষীণ হইয়াছে কোন ক্লেশই নাই এইরূপ, ভূতীয় আমার দুঃখাদি অনিষ্ট সকল বিগত হইয়াছে এইরূপ, চতুর্থ আমি বিবেকখ্যাক্তি প্রাপ্ত হইয়াছি এইরূপ জ্ঞান । চিত্তবিমুক্তি তিন প্রকার ; প্রথম আমার বুদ্ধির গুণ সকল চরিতার্থ হইয়াছে ইহাদিগের আর প্রয়োজনান্তর নাই এইরূপ চিন্তা । দ্বিতীয় আমার সমাধি সুসম্পন্ন হইয়াছে এইরূপ চিন্তা, তৃতীয় সমাধি সুসপন্ন হওয়াতে আমি স্বরূপে অবস্থিত হইয়াছি এইরূপ চিন্তা । কার্য্যবিমুক্তি ও চিত্তবিমুক্তির অবাস্তুর ভেদ লইয়া গণন৷ করিলে ঐ প্রজ্ঞাকে সপ্তবিধ বলা যাইতে পারে । এই সপ্তবিধ প্রজ্ঞা ভিন্ন আর কোনরূপ প্রজ্ঞ। বিবেকখ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্মে না ।
যেরূপ চিকিৎসা শাস্ত্র রোগ, রোগহেতু, আরোগ্য ও আরোগ্যহেতু ভেষজ ভেদে চতুর্বাহ, সেইরূপ যোগশাস্ত্রও হেয়, হেয়হেতু, মোক্ষ ও মোক্ষহেতু ভেদে চতুর্বাহ । দুঃখময় সংসারকে হেয়, প্রকৃতি পুরুষ সংযোগকে হেয়হেতু, আভ্যন্তিক প্রকৃতি পুরুষ সংযোগ নিৰ্বত্তি স্বরূপ কৈবল্যকে মোক্ষ, আর বিবেকথ্যাতি স্বরূপ সম্যকু দর্শনকে মোক্ষ হেতু কহে ।
——————–
(১) কপিলকৃত সাঙ্খসূত্রের সাঙ্খ্যপ্রবচনভাশ্যে, বিজ্ঞানাচার্য্য লিখিয়াছেন, সাঙ্খ্যমতেও ঈশ্বরসত্তা স্বীকৃত আছে ; কিন্তু ষড়দর্শনটীকাকার বাচস্পতিমিশ্র তত্ত্বকৌমুদীতে লিখিয়াছেন যে, সাঙ্খ্যমতে ঈশ্বর নাই। এবং মাধবাচার্য্য সর্ব্বদর্শনসংগ্রহে কপিলকৃত সাঙ্খ্যদর্শনকে নিরীশ্বর সাঙ্খ্যদর্শনশব্দে নির্দেশ করিয়া জানাইয়াছেন যে কপিলমতে ঈশ্বর নাই। বস্তুতঃ “ঈশ্বরাসিন্ধেঃ” এই কপিলসূত্র সন্দর্শন করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় সাঙ্খ্যমতে ঈশ্বর নাই। অতএব আমরা এস্থলে কপিলমতে ঈশ্বর নাই লিখিলাম।
(২) অর্থাৎ য়ং ।
(৩) “বং” এই নীজকে সারিবীজ কহে ।
(৪) ওঁ।
(৫) শ্রীং।
(৬) অর্থাৎ হ্রীং।
(৭) এই আটটা সিদ্ধি সাঙ্গদর্শন প্রস্তাৰে বিশেষরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছে বলিয়া এ স্থলে পুনৰ্ব্বার উহাদিগের লক্ষণদি প্রদর্শিত হইল না ।