১৫. পরের দুটো তিনটে দিন

পরের দুটো তিনটে দিন অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। নানা জায়গায় নানা জনের সঙ্গে দেখাশুনা করে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হতো। তন্ময় নিশ্চয়ই আসত কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা হতো না।

সেদিন শনিবার। কদিনের অত্যধিক ঘোরাঘুরির জন্য অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম বলে বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছিলাম। হঠাৎ খুব জোরে ডোর বেল বাজতেই উঠতে হল। দরজা খুলে দেখি তন্ময়।

তুমি এখনও ঘুমোচ্ছা?

কেন? কটা বাজে?

তন্ময় একটু হেসে বলল, বেশি না, সাড়ে দশটা।

আমার চোখে তখনও ঘুম।

সেই ঘুম ঘুম চোখে একটু হেসে বললাম, ভাবছি, আরো একটু ঘুমোব।

ঘুমোও। কে বারণ করছে?

আমি সত্যি সত্যি আবার আমার ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। ঘুমোলাম না কিন্তু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে শুয়েই তন্ময়কে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি এর মধ্যে এসেছিলে?

রোজই এসেছি কিন্তু তোমার মতো নিঃসঙ্গ সুন্দরীর সঙ্গে দেখা হবার সৌভাগ্য হয়নি।

আমি একটু মুচকি হেসে বললাম, বেঁচে গেছ। আমার মতো ডাইনীর সঙ্গে যত কম দেখা হয় ততই ভালো।

তন্ময় চেয়ারটা আমার বিছানার খুব কাছে টেনে নিয়ে আমার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলল, তুমি সত্যি একটা ডাইনী। তোমার পাল্লায় পড়লে কোনো পুরুষের রেহাই নেই।

আমি আবার একটু হাসি। বলি, কি হল? এই সাত সকালে হঠাৎ এত রোমান্টিক হয়ে পড়লে কেন?

ছাত্রজীবনে যাকে দূর থেকে দেখে ধন্য হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, তার এত কাছে এসেও রোমান্টিক হব না?

এখন তুমিও ছাত্র নেই, আমিও সেদিনের মতো সুন্দরী বা যুবতী নেই। তাহলে এখন আবার রোমান্টিক হবে কেন?

তন্ময় একবার আমাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, আমিও ছাত্র আছি। তুমিও সেদিনের মতো সর্বনাশী আছ।

আমি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আমি সর্বনাশী হলেও নিজের সর্বনাশ করেই খুশি থাকব; অন্যের সর্বনাশ করব না।

ও আমার মুখের পরে ঝুঁকে পড়ে আমার কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি কথায় কথায় এত সিরিয়াস হবে না। তুমি নিজের সর্বনাশ করতে চাইলেও আমি তা করতে দেব না।

আমি জোরে হেসে উঠে বললাম, তুমি আমার কে যে আমাকে বাধা দেবে?

তন্ময় দুহাত দিয়ে আমার মখখানা ধরে বলল, তুমি যে আমার কবিতা।

আমি আবার একটু হাসলাম। বললাম, বিদেশে একলা একলা ভালো লাগছে না বলে মোহের ঘোরে কেউটে সাপের সঙ্গে বন্ধুত্ব কোরো না।

আজে বাজে কথা না বলে এবার ওঠ।

কেন? বেশ তো শুয়ে আছি!

তুমি শুয়ে থাকবে আর আমি তোমার পাশে বসে থাকব, তা হয় না।

কেন?

তন্ময় হাসতে হাসতে বলল, তা আমি পারব না।

তাহলে আমিও উঠব না।

না, না, কবিতা, প্লিজ, উঠে পড়।

চা খাওয়াও। বরং আমি শুয়ে থাকি; তুমি চা করে আনো।

সত্যি তন্ময় চা করে আনল। আমি বিছানায় বসে বসেই চা খেলাম।

চা খাওয়া শেষ হতেই ও প্রশ্ন করল, ডক্টর সরকারের কাজকর্ম শেষ করতে আর কদিন লাগবে?

কেন?

কেন আবার কি? চাকরি-বাকরি করবে না?

তুমি কী কোথাও কথা বলেছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কোথায়?

ঠিক কোথায় হবে জানি না; তবে ডক্টর জ্যাকসন বলেছেন, আই উইল ফিক্স হার আপ সামহোয়ার।

আমি আপন মনে বললাম, একটা চাকরি হলে ভালোই হয়। সময়টা বেশ কেটে যাবে।

এ বাড়ি কবে ছাড়বে?

আগে একটা আস্তানা ঠিক করে নিই; তারপর…

সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম, শাঁখা সিঁদুর না পরেই কি তোমার ওখানে থাকা ঠিক হবে?

তন্ময়ও হাসল। বলল, মনে মনে ইচ্ছে থাকলেও এ কথা শোনার পর আর সাহসে কুলোবে না।

.

যাই হোক, সারাটা দিন বেশ কাটল। দুজনে মিলে ব্রেকফাস্ট তৈরি করলাম। খেলাম। গল্প করলাম। চা খেলাম। একটু কেনাকাটা করলাম। রান্না করলাম। রান্না করতে করতে দু-তিনবার চা খেলাম। লাঞ্চ খেতে খেতে বেশ বেলা হল। দুজনে পাশাপাশি বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর তন্ময় বলল, চল, সিনেমায় যাই।

বেশ বৃষ্টি পড়ছিল। তাছাড়া অত্যন্ত ঠাণ্ডা পড়েছিল। বললাম, না, না, এই ঠাণ্ডায় বেরুব। তার চাইতে ঘরে বসে গল্প করে অনেক আনন্দ পাব।

গল্প করতে করতে আরো দু-একবার কফি খেলাম। তারপর তন্ময় বলল, কবিতা, চীজ পাকৌড়া ভাজো। আমি বরং একটা হুইস্কি কিনে আনি।

তারপর?

তারপর একটু খিচুড়ি। তারপর প্রস্থান।

কিন্তু না, সে রাত্রে তন্ময় যেতে পারল না। আমিই ওকে যেতে দিলাম না। ও যাবার জন্য তৈরি হয়েছিল কিন্তু বাইরের দরজা খুলতেই আমি ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, না না তন্ময়, এই ওয়েদারে যেও না। মারা পড়বে।

বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। তার সঙ্গে দারুণ ঠাণ্ডা কনে বাতাস। তন্ময় বলল, এ ওয়েদারে আগে বেরুতে ভয় করত কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তারপর হেসে বলল, তাছাড়া পেটে গরম খিচুড়ি ছাড়াও দু-চার পেগ হুইস্কি পড়েছে।

না, না, আজ যেও না। কাল তো রবিবার। তাছাড়া দুটো ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। শুধু শুধু কেন এই দুর্যোগের মধ্যে যাবে?

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে তন্ময় আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, তাহলে যাব না?

আমি শুধু মাথা নেড়ে বললাম, না।

তন্ময় হঠাৎ দুহাত দিয়ে আমাকে ধরে খুব জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কাম অন, লেট আস ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ড্যান্স।

আমি ঘরের দিকে পা বাড়িয়েই বললাম, ডিনারের পর কেউ ড্রিঙ্ক করে না।

ও সব নিয়ম-কানুন আমার জন্য নয়।

কেন?

বাইরের দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচবার জন্য তুমি আমাকে যেতে দিলে না কিন্তু ভিতরের দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে তো আমাকে মাতাল হতেই হতে

আমি থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ভিতরে আবার কিসের দুর্যোগ?

তন্ময় একটু হেসে বলল, তোমার মতো আগ্নেয়গিরির…

সত্যি ভাই রিপোর্টার, সে রাত্রে আমরা দুজনেই ভালোবাসার নেশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছিলাম। আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি; হয়তো ইচ্ছাও ছিল না। শুধু এইটুকু জানি, সমস্ত দেহ বিদ্রোহ করতে চেয়েছিল, মন চেয়েছিল অতীতকে নতুন ইতিহাসের পলিমাটির তলায় লুকিয়ে রাখতে। এ অস্বাভাবিক অবস্থার স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ হয়নি। যখন আবার স্বাভাবিক হলাম তখন ঘরে-বাইরের দুর্যোগ থেমে গেছে আর লন্ডনের আকাশ সূর্যের আলোয় ভরে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *