১৫. নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণ
যেসব বড় রকমের আকর্ষণকে ঘিরে মানুষের জীবন গড়ে উঠেছে এই অধ্যায়ে আমি তা নিয়ে আলোচনা না করে, ছোট রকমের আকর্ষণ যা তার অবসরকে ভরে রাখে এবং যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে সে পূর্ব থেকেই নিয়োজিত তার চাপ থেকে মুক্ত করে, তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। সাধারণ লোকের জীবনে তার পত্নী, সন্তান, তার কাজ এবং আর্থিক অবস্থা এসব কিছু তার উদ্বেগ এবং গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার প্রধান অংশ দখল করে থাকে। এমনকী তার যদি বিবাহ-বহির্ভূত কোনও প্রেমের সম্পর্ক থাকে, তবু তার জন্যে মনে হয় ততটা গভীর দুশ্চিন্তা হয় না, যতটা হয় তার পারিবারিক জীবনে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। যে আকর্ষণ তাকে কাজের সাথে জড়িত করেছে, তাকে আমি আপাতত নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণ বলতে চাই না। যেমন একজন বিজ্ঞানসেবীকে তার বিষয় সংক্রান্ত সব ধরনের গবেষণার সাথে সমতা রেখে চলতেই হয়। এই ধরনের গবেষণায় তার মনোভাবে যে উদ্দীপনা এবং প্রাণশক্তি দেখা যায় তা তার বৃত্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত আন্তরিকতা। কিন্তু যদি তিনি তাঁর বিষয়ের সাথে সম্পর্কহীন বিজ্ঞানের অন্য কোনও শাখার গবেষণার কথা পড়েন, তাহলে তিনি তা পড়বেন ভিন্ন ধরনের আগ্রহ নিয়ে। বৃত্তিগত মন নিয়ে নয়, নিবিড়ভাবেও নয় এবং আরো আকর্ষণীয়ভাবে। সেখানে যা বলা হয়েছে তা যদি তিনি নির্দিষ্ট মনেও পড়েন তবু তা হত তার কাছে একটি আরামের ব্যাপার। কারণ সেই গবেষণাপত্র তার দায়িত্বের সাথে সম্পর্কিত নয়। যদি সেই বই তাঁর কাছে আকর্ষণীয় বোধ হয়, তবে তা নৈর্ব্যক্তিক, যা তাঁর নিজের বিষয়ের ওপর বই হলে বলা যেত না। মানুষের জীবনের মূল কাজের বাইরে যেসব আকর্ষণ আছে, এই অধ্যায়ে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই।
অসন্তোষ, অবসাদ এবং স্নায়ুপীড়ার একটি কারণ হচ্ছে জীবনের পক্ষে বাস্তব গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন জিনিসে আকৃষ্ট হওয়ার অক্ষমতা। এর ফলে সচেতন মন কিছু ছোট ধরনের ব্যাপার থেকে বিশ্রাম পায় না এবং সে সবের প্রত্যেকটিতে সম্ভবত কিছু উদ্বেগ এবং কিছু দুশ্চিন্তার উপাদান যুক্ত আছে। একমাত্র ঘুমের সময় সচেতন মন নিষ্ক্রিয় কিন্তু অবচেতন মন পুরোপুরি সক্রিয় থাকে এবং জ্ঞানের পথে বিকশিত হয়। এর ফল হল উত্তেজনা বৃদ্ধি, বিচক্ষণতার অভাব, অসহিষ্ণুতা এবং মাত্ৰাজ্ঞানের অভাব দেখা দেয়। এই সবই হল অবসাদের কারণ এবং প্রক্রিয়া। মানুষ যখন অতিমাত্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন তার বাইরের আকর্ষণ কমে যায়, যতই তা কমতে থাকে ততই বাইরের আকর্ষণ তাকে যে মুক্তির স্বাদ দিচ্ছিল তা হারিয়ে যায় এবং সে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এই দুষ্টচক্রের শেষ পরিণাম হচ্ছে একেবারে ভেঙ্গে পড়া। বাইরের আকর্ষণ বিশ্রাম দেয় এই জন্যে যে, তাতে কোনও কাজের আহ্বান থাকে না। কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ইচ্ছাকে পরিচালনার কাজ খুব ক্লান্তিকর, বিশেষ করে যখন তা খুব তাড়াতাড়ি করতে হয় এবং অবচেতন মনের সাহায্য ছাড়া করতে হয়। যারা মনে করে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে মনকে বিশ্রাম দিতে হবে, তারা সঠিকভাবেই তা মনে করে। অবচেতন মনের ক্রিয়া শুধু ঘুমন্ত অবস্থাতেই চলে না, সচেতন মন অন্য কোথাও ব্যস্ত থাকলে তার ক্রিয়া সচল থাকে। যে মানুষ কাজ শেষ হলে কাজের কথা ভুলে যেতে পারে এবং পরদিন কাজ শুরুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ভুলে থাকতে পারে এবং যে লোক মধ্যবর্তী সময়েও কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে, তার চেয়ে পূর্বোক্ত লোক অনেক ভালভাবে কাজ করতে পারে। নিজের কাজ ছাড়া কোনও লোকের যদি অন্য বিষয়ে আগ্রহ থাকে তার পক্ষে যার কাজ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে আগ্রহ নেই, তার তুলনায় যখন কাজের কথা ভুলে থাকা প্রয়োজন হয়, ঠিক তখন ভুলে থাকা সহজতর হয়। তবে যে শক্তি সমস্ত দিনের কাজের শেষে ফুরিয়ে যায়, অন্য বিষয়ে আকর্ষণ থাকার জন্যে তা যেন আবার প্রয়োজন না হয়। ইচ্ছাশক্তি এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজনীয়তাও যেন তাতে না থাকে। জুয়া খেলার মতো অর্থ বিনিয়োগের কোনও ঝুঁকি যেন না থাকে। তা ছাড়া সে সব কাজে মন অবসাদগ্রস্ত হতে পারে এমন কোনও উত্তেজনা যেন না থাকে, যা আগে থেকেই সচেতন বা অবচেতন মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে।
এমন অনেক আমোদ রয়েছে যা এইসব শর্ত পূরণ করতে পারে। খেলা দেখা, থিয়েটার দেখা, গলফ খেলা এই বিষয়ে অনিন্দনীয়। যার বই পড়ার নেশা আছে তার পক্ষে নিজের পেশা সম্পর্কিত বই বাদ দিয়ে অন্য বই পড়লে তৃপ্তিদায়ক হতে পারে। দুশ্চিন্তার কারণ যত জরুরী হোক সমস্ত দিন জেগে থাকার মুহূর্তে তা নিয়ে ভাবা উচিত নয়।
এই বিষয়ে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। সাধারণভাবে পুরুষেরা নারীদের তুলনায় সহজে কাজ ভুলে থাকতে পারে। মেয়েদের কাজ যেহেতু গৃহের মধ্যে তাই তাদের পক্ষে এটা স্বাভাবিক। কারণ তাদের কাজের স্থান পরিবর্তন হয় না, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে তা নয়। অফিসের কাজের শেষে পুরুষেরা বাড়ি ফিরে মনকে নতুন করে তুলতে সাহায্য করে। যদি আমি ভুল না করে থাকি, তাহলে বলা যায়, যেসব মহিলার কাজ বাড়ির বাইরে তারা এ বিষয়ে পুরুষের চেয়ে প্রায় ততটুকু আলাদা, যতটুকু আলাদা যার বাড়িতে কাজ করে তারা। তাদের কাছে যেসব জিনিসের ব্যবহারিক মূল্য নেই, তাতে উৎসাহিত হওয়া বেশ শক্ত তাদের পক্ষে। তাদের উদ্দেশ্যেই তাদের ভাবনা এবং কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সম্পর্ক দায়িত্বহীন কোনও বিষয়ে তারা কখনো আগ্রহী হয় না। এর ব্যতিক্রম থাকতে পারে সেকথা আমি অস্বীকার করি না, আমি শুধু সাধারণ নিয়মের কথা বলছি। মেয়েদের কলেজে যদি কোনও পুরুষ শিক্ষক না থাকে তাহলে মহিলা শিক্ষকরা সন্ধ্যায় বাজার করার গল্প করে। কিন্তু ছেলেদের কলেজে পুরুষ শিক্ষকরা তা করে না। এই বৈশিষ্ট্য মেয়েদের কাছে পুরুষদের তুলনায় অতিরিক্ত সচেতনতা বলে মনে হয়। কিন্তু আমার মনে হয় না শেষ পর্যন্ত এদের কাজের গুণগত মান কিছুমাত্রায় বাড়ে। বরং এতে দৃষ্টিভঙ্গী কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং তা থেকে জন্ম নেয় রক্ষণশীলতার।
সবরকম নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণই মানসিক চাপ থেকে মুক্তির গুরুত্ব ছাড়াও অন্যভাবে কাজে লাগে। প্রথমেই বলতে হয়, তারা মানুষকে পরিমিতিবোধ বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমরা পেশাগত কাজে, নিজেদের সমাজের পরিমণ্ডলে নিজেদের কাজের অনুরূপ কাজে ডুবে থাকি, যা এতই সহজ যে আমরা ভুলেই যাই যে সমগ্র মানবজাতির কাজের তুলনায় এই অংশটুকু কত ক্ষুদ্র। আমরা যা করি এই বিশ্বের কত শত জিনিস তার প্রভাবের বাইরে থাকে। কেন কোনও মানুষ তা মনে রাখবে? এর অনেকগুলি উত্তর আছে। প্রথমত প্রয়োজনীয় কাজের সাথে যতটুকু সংগতি রাখা যায় জগৎ সম্পর্কে ততটুকু আসল ধারণা অর্জন করা ভাল। ইহলোকে আমাদের অবস্থান বেশিদিনের জন্যে নয়। এই সময়ের মধ্যে এই অদ্ভুত গ্রহ এবং মহাবিশ্বে তার স্থান কোথায় তা নিয়ে যতটা সম্ভব জ্ঞানলাভ করতে হয়। আমাদের জ্ঞান অসম্পূর্ণ, তাই তা লাভ করার সুযোগকে অবহেলা করা আর থিয়েটারে গিয়ে নাটকের সংলাপ না শোনা একইরকম। এই বিশ্ব বহু বিয়োগান্ত অথবা মিলনান্তক, বীরোচিত অথবা উদ্ভট অথবা আশ্চর্যময় ঘটনায় পরিপূর্ণ। যে মানুষের এইসব দৃশ্যের প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই সে জীবনের একটি বড় সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত।
তাছাড়া পরিমিতিবোধ থাকাটা খুব মূল্যবান এবং তা অনেক সময়েই অত্যন্ত সান্ত্বনা প্রদায়ক। আমরা পৃথিবীর যে ক্ষুদ্র কোণায় বাস করি এবং জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে যে ক্ষণ মুহূর্ত পাওয়া,তা নিয়ে অকারণ উত্তেজিত হওয়া, স্নায়ুকে পীড়িত করা এবং তাকে অযথা বাড়িয়ে দেখার দিকে আমাদের সকলেরই একটা প্রবণতা আছে। এই উত্তেজনা এবং নিজেদের সম্বন্ধে উচ্চ ধারণার মধ্যে এমন কিছু নেই যা বাঞ্ছনীয়। এটা সত্যি যে এই ভাবনা আমাদের আরো কঠিন পরিশ্রম করাতে পারে, কিন্তু তা আমাদের কাজের দক্ষতা বাড়াতে পারে না। খারাপ উদ্দেশ্যে অনেক বেশি কাজ, ভাল উদ্দেশ্যে অল্প কাজ অনেক ভাল। যদিও যারা জীবনে কঠিন পরিশ্রমে বিশ্বাসী তারা এর বিপরীতটাকেই সমর্থন করবেন। কাজ নিয়ে যারা অতিরিক্ত ব্যস্ত তাদের সবসময় অন্ধ গোঁড়ামিতে পড়ে যাওয়ার বিপদ থাকে, যার মূল কথা হচ্ছে সবকিছু ভুলে গিয়ে একটি বা দুটি মনের মতো বিষয় মনে রাখা আর এই একটি বা দুটি বিষয় অনুসরণ করতে পারলে আর যা থাকে তা থেকে যে ক্ষতি হতে পারে তাকে তুচ্ছ মনে করা। মানুষের বিরাট জীবন কল্পনা এবং এই পৃথিবীতে তার স্থান সম্পর্কে উদারতর ধারণা তৈরী করাই হচ্ছে এই ধরনের গোঁড়ামির বড় প্রতিষেধক। এই ব্যাপারে এমন বৃহৎ প্রসঙ্গ তুলে ধরা বড় কিছু মনে হতে পারে। কিন্তু এই ছোট ব্যাপার না ধরলেও সেই বৃহৎ প্রসঙ্গটির নিজেরই একটি বড় মূল্য রয়েছে।
বর্তমান উচ্চশিক্ষার একটি গলদ এই যে, এতে কোনও একটি নির্ধারিত বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের জন্যে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা আছে কিন্তু হৃদয় মন যাতে উদার হয়, তার জন্যে নিরপেক্ষ সমীক্ষায় পৃথিবীকে দেখার কোনও ব্যবস্থা নেই। ধরুন আপনি কোনও রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত আছেন এবং নিজেদের দলের জয়লাভের জন্যে কঠিন পরিশ্রম করছেন, এই পর্যন্ত সবই ভাল, কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলাকালীন এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, যাতে সবার মনে ঘৃণা হিংসা এবং সন্দেহ বেড়ে যায়, এমন পথে গেলে জয়লাভের পথ কিছুটা সুগম হয়। যেমন, আপনি বুঝতে পারবেন জয়লাভের পথ অনেক সহজ হবে যদি কোনও বিদেশী জাতিকে অপমান করা যায়। আপনার মানসিক প্রসারতা যদি বর্তমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে অথবা যদি আপনি এই মতে দীক্ষা নিয়ে থাকেন যে যাকে কর্মদক্ষতা বলা হয় তা ছাড়া আর সব কিছু প্রয়োজনহীন, তা হলে আপনি এই ধরনের সন্দেহজনক পথ অবলম্বন করতে পারেন। এইভাবে আপনি আপনার তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যে জয়লাভ করবেন, কিন্তু তার সুদূরপ্রসারী ফল হবে মারাত্মক। যদি অন্যদিকে মানুষের অতীত যুগ, তার বর্বর অবস্থা থেকে ধীর এবং আংশিক উন্মেষ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাবে অকল্পনীয় কালের তুলনায় মানুষের সমগ্র অস্তিত্বের অতি-সংক্ষিপ্ততা– এইসব ধারণা আপনার মনের অভ্যস্ত অঙ্গ হয়, আমি বলি, যদি এই চিন্তাধারা আপনার সাধারণ অনুভূতিকে ছাঁচে তৈরী করে, তাহলে আপনি বুঝতে পারবেন যে, যে ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধে আপনি রত আছেন, তা এমন জরুরী নয়, যাতে আমরা যে অন্ধকার থেকে এত দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছি, তাহলে সেই ফেলে আসা পথে আবার এক ধাপ ফিরে যাওয়ার ঝুঁকিকে স্বীকার করে নেওয়া। শুধু তাই নয়, যদি আপনি তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যে পরাজিতও হন তাহলে তার ক্ষণস্থায়িত্ব নিয়ে সেই একই বোধ আপনাকে হীন অস্ত্রধারণ করতে দেবে না। তাৎক্ষণিক সব কার্যকলাপকে অতিক্রম করে আপনার মনে উদিত হবে সেই লক্ষ্য যা অনেক দূরে এবং খুব ধীরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে, যেখানে পৌঁছানোর চেষ্টায় আপনি সবার থেকে বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ নন বরং মানজাতিকে যে বিশাল বাহিনী সভ্যতার অস্তিত্বময় জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, আপনি সেই বাহিনীরই একজন। আপনি যদি এই দৃষ্টিভঙ্গী পেয়ে থাকেন, আপনার ব্যক্তিগত ভাগ্য যাই হোক এক গভীর সুখ কখনো আপনাকে ছেড়ে যাবে না। সর্ব যুগের মহামানবদের সাথে আপনার আত্মিক বন্ধন তৈরী হবে এবং কোনও ব্যক্তির মৃত্যুকে মনে হবে একটি তুচ্ছ ঘটনা।
আমার ইচ্ছানুযায়ী যদি উচ্চশিক্ষা সংগঠনের ক্ষমতা থাকত আমি তাহলে প্রাচীন রক্ষণশীল ধর্মসমূহের, তরুণদের মনে যার আবেদন খুব কম এবং যেসব নীতি অনুযায়ী সবচেয়ে কম বুদ্ধিদীপ্ত এবং দুর্বোধ্য ও সংস্কার বিরোধী, বদলে এমন কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসতাম যাকে ঠিক ধর্ম বলা যায় না কারণ তা হত শুধু কিছু নির্ধারিত সত্যের প্রতি মনোসংযোগ করা। আমি চেষ্টা করতাম তরুণরা যাতে অতীতকে প্রাণবন্তরূপে জানতে পারে এবং স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে যে মানুষের ভবিষ্যৎ তার অতীত থেকে অনেক অনেক দীর্ঘ, যা পরিমাপের যোগ্য নয়। যাতে তারা গভীরভাবে বুঝতে পারে, যে গ্রহে আমরা জীবন কাটাচ্ছি তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র এবং এই গ্রহে যে জীবনের আবির্ভাব হয়েছে তা একটি সাময়িক ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়। একই সাথে আমি ঐ ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতাবোধের পাশাপাশি আরেক গুচ্ছ তথ্য তুলে ধরতাম, তরুণদের মনকে প্রভাবিত করতে যে মানুষ কত মহৎ হতে পারে, তার জ্ঞান কত অসীম হতে পারে। সমগ্র মহাবিশ্বে এমন কিছু নেই যা তার সমান মূল্য বহন করে। স্পিনোজা বহুকাল আগে মানুষের বন্ধন এবং মানুষের মুক্তির কথা বলে গেছেন। তার লেখার ধরণ এবং ভাষা এত কঠিন দর্শনশাস্ত্রের ছাত্র ছাড়া অন্যদের পক্ষে সহজবোধ্য নয়। কিন্তু আমি যা বলতে চাই তার সারমর্ম, তিনি যা বলে গেছেন তার সাথে প্রায় অভিন্ন।
মানুষ একবার যদি বুঝতে পারে যত অস্থায়ী বা সংক্ষিপ্ত ভাবেই হোক, কিসে আত্মা মহান হয়, তা হলে সে আর নিজেকে ক্ষুদ্র এবং স্বার্থপর হতে দেবে না। তুচ্ছ দুর্ভাগ্যে বিচলিত বা ভবিষ্যতের ভাবনায় ভীত হতে দেবে না, যদি দেয় তাহলে কখনো সে আর সুখী হতে পারবে না। যে মানুষ আত্মার মহত্বে সক্ষম সে মনের বাতায়ন সম্পূর্ণ খুলে দেবে, যাতে সেই পথ বেয়ে বিশ্বের সর্ব অংশ হতে মুক্ত সমীর প্রবাহিত হতে পারে। সে তখন নিজেকে এবং জীবনকে এবং জগৎকে মানুষের সীমার মধ্যে যতটুকু সম্ভব সত্যরূপে দেখতে পাবে। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী এবং অণু প্রমাণ, এ কথা বুঝতে পেরে সে অনুভব করতে পারবে, পরিচিত এই বিশ্ব, মূল্যবান যা কিছুই ধারণ করুক তা প্রতিটি মানুষের মনে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। এবং সে দেখবে যে মানুষের মনের দর্পণে বিশ্ব প্রতিবিম্বিত, সে এক অর্থে বিশ্বের মতোই বৃহৎ। যে মানুষ অবস্থার দাস তার মনকে যেসব ভয় তাড়িত করে তা থেকে বেরিয়ে এসে সে এক গভীর আনন্দের অভিজ্ঞতা লাভ করবে এবং তার বাইরের জীবনের সকল ভাগ্য পরিবর্তনের মধ্যেও সুখী মানুষ বলে আনন্দের গভীরে ডুবে থাকবে।
এইসব বড় বড় দূর কল্পনা ছেড়ে আমরা যে অব্যবহিত প্রসঙ্গে কথা উত্থাপন করেছিলাম, সেখানে ফিরে যেতে পারি যেমন নৈর্ব্যক্তিক আকর্ষণের কথায়। অন্য একটা দিক থেকে এইসব আকর্ষণ সুখের পথে সাহায্য করতে পারে। খুব সৌভাগ্যের জীবনেও অনেক সময় দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে। খুব কম মানুষ আছে, অবিবাহিতরা ছাড়া যে নিজের স্ত্রীর সাথে কখনো ঝগড়া করেনি, খুব কম বাবা-মা আছে যারা নিজেদের সন্তানের অসুস্থতায় উদ্বিগ্ন হয়নি, খুব কম ব্যবসায়ী আছে যারা আর্থিক সংকট এড়াবার চেষ্টা করেনি, খুব কম পেশাদার ব্যক্তি আছে যারা কখনো ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়নি। এইরকম সময়ে উদ্বেগের বাইরে অন্য কিছুতে উৎসাহী হওয়া বিরাট মঙ্গল। এই সময়ে উদ্বেগ সত্ত্বেও যখন করার মতো কিছু থাকে না, তখন কেউ দাবা খেলে, কেউ গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে, কেউ জনপ্রিয় জ্যোতির্বিদ্যায় ডুবে থাকে। অন্য একজন হয়তো ক্যালডি’র উর নামক স্থানের পুরাতাত্ত্বিক খনন বিষয়ে বই পড়ে সান্ত্বনা পায়। এই চারজনের প্রত্যেকেই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে। বরং যে লোকটি মনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে কিছুই করেনি এবং তার কষ্টকে তার ওপর প্রভুত্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে সে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেনি। এবং প্রয়োজনে নিজেকে যখন সময় আসবে, বিপদের মুখোমুখি হওয়ার পক্ষে অনুপযুক্ত করে তুলেছে। অত্যন্ত প্রিয়জনের মৃত্যুতে সান্ত্বনার বাইরে যে বেদনা তার সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। এ রকম পরিস্থিতিতে যে নিজেকে দুঃখের হাতে তুলে দেয় তার ভাল কিছু হয় না। দুঃখ অনিবার্য এবং তা আসবেই, তার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখা উচিত, তা কমানোর যত রকম পথ আছে অবলম্বন করা উচিত, কোনও কোনও লোক যেমন করে, বলা যায়, দুর্ভাগ্য থেকে দুর্দশার শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত নিংড়ে বের করে নিতে চায় তাকে শুধুমাত্র ভাবপ্রবলতা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। আমি একথা অস্বীকার করি না যে কোনও মানুষ দুঃখে ভেঙ্গে পড়তে পারে, কিন্তু তবুও আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে এই ভাগ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে প্রত্যেকটি মানুষের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত এবং যে কোনও উপায়ে হোক, সে উপায় যত তুচ্ছ হোক, যদি তা নিজেই ক্ষতিকর অথবা মর্যাদাহানিকর না হয়। যে সব উপায় আমি ক্ষতিকর এবং মর্যাদাহানিকর মনে করি, তার মধ্যে আমি মাতলামি এবং মাদকাসক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করি। এদের উদ্দেশ্যই হল চিন্তার শক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া। অন্তত সাময়িকভাবে হলেও, চিন্তাশক্তিকে নষ্ট করে দেওয়া এর প্রতিকার নয়, প্রতিকার হচ্ছে নতুন নতুন খাতে প্রবাহিত করা অন্তত যে কোনও মূল্যে বর্তমান দুর্ভাগ্যের কাছ থেকে দূরের কোনও খাতে প্রবাহিত করা। কিন্তু জীবন যদি সামান্য কটা জিনিসে সব আকর্ষণকে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং সেই সামান্য কটাও যদি দুঃখে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব শক্ত। দুর্ভাগ্য এলে যদি তাকে বহন করতেই হয় তাহলে সুখের সময়ে আগেই আকর্ষণের বিষয়বৈচিত্র এবং সংখ্যার প্রসারণ করে নেওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তাহলে যে মনের ভাব বর্তমানকে বহন করতে পারছে না, তার চেয়ে ভিন্ন মনোভাব এবং আলাদা আকর্ষণ যেখানে আছে সেই শান্তিপূর্ণ স্থানে যাওয়ার জন্যে মন প্রস্তুত থাকবে।
প্রচুর প্রাণপ্রাচুর্য এবং উদ্দীপনা যে মানুষের আছে, সে প্রতি আঘাতের পর নতুন আকর্ষণের দ্বারা সব দুর্ভাগ্যকে লঙ্ঘন করে যাবে। তার কাছে পৃথিবী এত ছোট হয়ে যাবে না যাতে একটি মাত্র ক্ষতি ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। এক বা একের অধিক ক্ষতির কাছে হার মানা এমন ঘটনা নয় যা কোমলতার প্রমাণরূপে প্রশংসিত হতে পারে। বরং একে প্রাণপ্রাচুর্যের ব্যর্থতা বলেই ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত। আমাদের স্নেহ-মমতা-প্রেম মৃত্যুর দয়ার ওপর নির্ভরশীল আমাদের প্রিয়জনদের ওপর যে কোনও সময় চরম আঘাত হানতে পারে। তাই আমাদের জীবনে সেই সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়, যা আমাদের জীবনের সকল অর্থ এবং উদ্দেশ্যকে দুর্ঘটনার অধীন করে রাখতে পারে।
এইসব কারণে যে মানুষ বুদ্ধিমত্তার সাথে সুখের অন্বেষণ করছে তার পক্ষে যেসব মূল আকর্ষণের ওপর তার জীবন গড়ে উঠেছে, তার বাইরেও আরো কিছু অতিরিক্ত আকর্ষণ থাকা প্রয়োজন।
—-
১. স্পিনোজা, Benedict de Spinoza (১৬৩২-১৬৭৭)। জাতিতে ইহুদী, তার বাবা-মা ইনকুইজিসনের ভয়ে পর্তুগাল থেকে অভিবাসন নিয়ে নেদারল্যান্ডে বসতি স্থাপন করেন। যুক্তিবাদী মুক্ত দার্শনিক, ধর্মীয় চিন্তাবিদ। তিনি সর্বেশ্বরবাদী অদ্বৈতবাদে (pantheistic Monist) বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর এবং পৃথিবীর মধ্যে কোনও দ্বৈতবাদ থাকতে পারে না। পাশ্চাত্য দর্শনে তিনি অতীন্দ্রিয়বাদের নতুন তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। ‘Ethie’ তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ।