১৫. নষ্টনীড়

নষ্টনীড়

দ্য বোভোয়ার নারীর মাসিক রক্তক্ষরণের প্রক্রিয়াটিকে দৃষ্টি ও আবেগগ্রাহ্য ক’রে তুলেছেন একটি চিত্রকল্পে; বলেছেন (১৯৪৯, ৬১) নারীর ভেতরে প্রতি মাসে গ’ড়ে ওঠে একটি দোলনা, অপেক্ষা করে শিশুর জন্যে, কিন্তু শিশু আসে না ব’লে ভেঙে যায় দোলনটি; ওই নষ্ট দোলনা নারীর ভেতর থেকে ক্ষরিত হয় বিষন্ন রক্তিম ধারারূপে। নারী এ-সময় তার শরীরকে অনুভব করে সবচেয়ে যন্ত্রণার মধ্যে, মনে করে ওই শরীর তার নিজের নয়; এক অচেনা রাক্ষসীকে বেঁধে দেয়া হয়েছে তার সাথে। নারী, পুরুষেরই মতোই, দেহ; তবে এ-সময় তার দেহ সে নয়, অন্য কিছু। নারী প্রজাতির শিকার: নারী তার জীবনের অনেকগুলো বছর বিশেষ বিশেষ সময়ে বন্দী থাকে তার আভ্যন্তরে ঋতুচক্ৰে। প্রতিটি নারী মোটামুটি দশ থেকে পয়তাল্লিশ বছর বয়সের মধ্যে, বয়ঃসন্ধি থেকে ঋতুবন্ধ পর্যন্ত, চার শো পঞ্চাশ বারের মতো গড়ে আর ভাঙে নিজের আভ্যন্তর দোলনা; একে বলা হয় ঋতু, ঋতুস্রাব, মাসিক, রজঃ, পুষ্প, মেনস্ট্রয়েশন, মেনসিজ। বলা হয়ে থাকে যে ঋতুস্রাব জরায়ুর কান্না-সন্তান আসে নি বলে মাসে মাসে বক্তধারায় কাব্দে জরায়ু। নারী একে মেনে নিতে বাধ্য হয়, তবে এটা তার জন্যে প্ৰীতিকর নয়। অ্যাংলো-স্যাক্সানরা একে বলে “অভিশাপ’: প্রতিটি নারীই একে মনে করে তার জীবনের পুনরাবৃত্ত অভিশাপ। নারী যদি এর হাত থেকে রেহাই পেতো, তবে বাঁচতো। ঋতুক্ষরণ তার জীবনের এক বড়ো বিরক্তি, বড়ো বোঝা; সন্তান ধারণ আর প্রসবও এমন বিরক্তিকর নয়। নারীর কাছে। তবে নারীর জীবনের এ-সত্যটির জন্যে পিতৃতন্ত্র নারীকে পুরস্কার দেয় নি, তার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে নি, তাকে দিয়েছে শাস্তি। নারী খুব বিব্রত বোধ করে তার মাসিক নিয়ে, তার কারণ পিতৃতন্ত্রের চোখে এটা দূষণ; এ-সময়ে নারী নিজে দূষিত, দূষিত করে পুরুষদের, এমন বাজে ধারণা সৃষ্টি করেছে সমস্ত পিতৃতন্ত্র। এ-ধারণা দিয়ে আধুনিক সময়ও আচ্ছন্ন। এ-সময়েও নারীও বলে যে তার শরীর “খারাপ’। কোনো কোনো সমাজে মেয়ে প্রথম ঋতু দেখার সময় উৎসব করা হতো; আঠারোশতকের কবি নসরুল্লাহ খোন্দকার জানিয়েছেন। চট্টগ্রামে ঋতুসূচনাকে বলা হতো পুষ্পদেখা”; এবং সেখানে ‘কন্যা বা বধূ প্রথম রজস্বলা হলে বাজনা বাজিয়ে এবং সহেলা ও নৃত্যাদির অনুষ্ঠান করে উৎসব করা হত; তবে রজম্বালা নারীকে মুসলিম ঘরেও অপবিত্ৰ মনে করা হত।’ (আহমদ শরীফ (১৯৭৭, ১৫০)]। পিতৃতন্ত্রের তিরষ্কারের ফলেই ঋতুস্ৰাব পরিণত হয়েছে গোপন নিষিদ্ধ ঘটনায়, তবে এটা গোপন নিষিদ্ধ ব্যাপার হওয়ার মতো কিছু নয়। একে প্রকাশ্য ঘটনার মর্যাদা দেয়ার জন্যে সিলভিয়া প্লাথ কবিতা লিখেছেন ঋতুস্রাব নিয়ে; এবং জারমেইন গ্রিয়ার প্রস্তাব করেছেন আধুনিক ঋতুস্রাব উৎসবের। তাতে যে-বালিকা প্রথম রক্ত দেখে শিউরে উঠেছে, নিজেকে ভাবতে শুরু করেছে। ঘূণ্য, সে পাবে আত্মবিশ্বাস, নিজেকে মনে করবে জীবনের জন্যে প্রস্তুত।

আদিম মানুষেরা নারীর পুনরাবৃত্ত ক্ষরণকে দেখেছে ভয় বিস্ময় ঘৃণার চোখে। ঋতুমতী নারীকে নির্দেশ করেছে অশুচি, তাকে ক’রে তুলেছে নিষিদ্ধ অস্পৃশ্য প্রাণী। পৃথিবীর চারটি প্রধান ধর্ম-হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্ট, ইসলাম ধর্মের চোখে নারীর মাসিক চক্র অত্যন্ত অপবিত্র। প্রতিটি ধর্মের চোখেই নারীর শরীর ঘৃণার বস্তু; নারীর রন্ধটির জন্যে পুরুষ পাগল থাকলেও ওটির নিন্দা করতে কেউ কুষ্ঠা বোধ করে নি, তাই ওই রন্ধ থেকে রক্তক্ষরণকে প্রতিটি ধর্মই ঘূণ্য ব’লে গণ্য করেছে। প্রতিটি ধর্মে ঋতুমতী নারী পশুর থেকেও নিকৃষ্ট। মানুষের চোখে রক্ত বিস্ময়কর বস্তু, তা একই সাথে শক্তি ও ভয়ের ব্যাপার; আদিম মানুষেরা মাসিক রক্তকে মনে করেছে ভীতিকর। তারা ঋতুকে মনে করেছে শয়তানের কাজ, তাই ঋতুমতী নারীর জন্যে নিষিদ্ধ করেছে সব কিছু, এবং তাকে নিষিদ্ধ করেছে সব কিছুতে। জুরথুস্ত্রীয় বিধান হচ্ছে ঋতুমতী নারী পবিত্ৰ শিখার দিকে তাকাতে পারবে না, জলে নামতে পারবে না, সূর্যের দিকে তাকাতে পারবে না, পুরুষের সাথে কথা বলতে পারবে না। পাপুয়া নিউগিনির কাফিরা ঋতুমতী নারীকে একলা এক সপ্তাহ ধরে আটকে রাখে অন্ধকার কুঁড়েঘরে, তাকে কিছু খেতে দেয়া হয় না। এভাবে তাকে শিখিয়ে দেয়া হয় যে সে নিজের ও অন্যদের জন্যে ভয়ঙ্কর। তার শরীর ও বক্তের ছোয়ায় পুরুষের বমি পায়, পুরুষের রক্ত কালো হয়ে যায়, পুরুষের মাংস দূষিত ও বুদ্ধি নষ্ট হয়, মৃত্যু হয়। পিতৃতন্ত্রগুলো এমন আদিম বিশ্বাস থেকেই বিধান তৈরি করেছেঋতুমতী নারীর জন্যে। বাইবেলের লেবীয় পুস্তক-এ /লেভিটিকাস} ঋতুমতী নারীকে বারো দিনের জন্যে নিদাহা’ বা অশুচি হিশেবে নির্দেশ করা হয়েছে; এবং ১৫৬৫ সালে লেখা একটি বিধানে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে যে সে স্বামীর সাথে একই শয্যায় শোবে না, পরিবারের কারো সাথে খাবে না, অনাদের সাথে এক ঘরে থাকবে না, স্যাবাথের প্রদীপ জ্বালবে না, সিনেগাগে ঢুকবে না, স্বামীকে স্পর্শ করবে না, তাকে কিছু দিতেও পারবে না। তাকে পরতে হবে এমন পোশাক যাতে তাকে দেখায় ইহুদিদের মধ্যে ইহুদি দ্ৰ মাইলস্ (১৯৮৮, ৮২-৮৩)!! অর্থাৎ সে পচা নোংরা প্রাণী। খ্রিষ্ট ও মুসলমানধর্ম ইহুদিধর্ম থেকে প্রচুর ধার করেছে প্যালেস্টাইনের গোত্রীয় কুসংস্কার; আর সেগুলোকে বিধিবদ্ধ করেছে ধর্মের বিধানরূপে। ঋতুমতী নারী সম্পর্কে হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমানের বিধানও নিষ্ঠুর, হিন্দু নিষ্ঠুরতায় ইহুদির সমান [দ্র ‘দেবী ও দানবী’]। সব ধর্মেই ঋতুকালে নিষিদ্ধ করেছে সঙ্গম, তবে অধিকাংশ নারী এ-সময়েই বোধ করে তীব্র কাম, ও পুলক বোধ করে সবচেয়ে বেশি।

পিতৃতন্ত্রের নিন্দিত নারীর শরীর ও সত্তা জুড়ে এ-সময় ঘটে এমন ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া, যা তাকে ক’রে রাখে অভিভূত। অনেক নারীর জন্যে এটা কোনো বিশেষ বিপন্নতা নয়, কিন্তু ঋতুক্ষরণকালে, এবং শুরুর কয়েক দিন আগে থেকেই, অধিকাংশ নারী বোধ করে বিপন্ন। শুরুর আগে অনেক নারীর দেখা দেয় একরাশ উপসর্গ, যাকে বলা হয় প্রাকত্ৰাব সিড্রোম। চিকিৎসকেরা মনে করে। এসবের পেছনে কোনো বাস্তব কারণ নেই, তবে ওগুলো অনেকের জন্যেই বাস্তব; সেগুলো হয়তো নেই, কিন্তু তারা বোধ করে; তাদের জীবন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। অনেক নারী বোধ করে তাদের শরীর ভারী হয়ে উঠছে, জুতোতে পা আংটিতে আঙুল ঢুকছে না; দেখা দিচ্ছে মাথা ব্যথা, পাচ্ছে বিবমিষায়। শুরুর আগে বাড়ে তাদের রক্তচাপ, আবার শেষের দিকে হ্রাস পায় রক্তচাপ, অনেক সময় শরীরে দেখা দেয় উত্তাপ, বোধ হয় জ্বর, তলপেটে দেখা দেয় যন্ত্রণা। অনেকের দৃষ্টি আর শুতিতে ঘটে ব্যাঘাত, অনেকের শরীরে দেখা দেয় দুৰ্গন্ধ। নারী হয়ে পড়ে অস্থির। তার মনোজগতে দেখা দেয় বিচলন। অনেকের মেজাজা ঠিক থাকে না, বোধ করে চরম বিষন্নতা, স্মৃতিভ্ৰংশত ঘটে অনেকের, অনেককে পায় স্বপ্নগ্ৰস্ততায়। টি এস এলিঅটের প্রথম স্ত্রী এর শিকার হয়ে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। এ-সময়েই নারী শরীরকে বোধ করে সবচেয়ে যন্ত্রণার মধ্যে, বাস করে রাক্ষসীর সাথে।

বালিকার জীবনের দশ থেকে বারো বছর বয়সের সময়টি তার বয়ঃসন্ধির কাল: এ-সময়ে সে হয়ে ওঠে কিশোরী। দশ থেকে ষোলো বছর বয়সের সময়টিকে ধরতে পারি কৈশোর হিশেবে। তার কৈশোরজীবনের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা ঋতুস্রাবসূচনা। দশ থেকে ষোলো, এমনকি উনিশ, বছর বয়সের মধ্যে যে-কোনো সময় এটা ঘটতে পারে। ঋতুর প্রথম আবির্ভাবকে বলা হয় ঋতুসূচনা মেনার্কি। ঋতুসূচনাকে মনে করা হয় বালিকার নারী হয়ে ওঠা; অর্থাৎ পিতৃতন্ত্রের মতে নারীর প্রধান যে-কাজ, সন্তানধারণ, বালিকা তার উপযুক্ত হয়ে ওঠে। ঋতুসূচনা কখন ঘটবে নির্ভর করে বালিকার শরীরের পুষ্টির ওপর; গরীব পরিবারের মেয়েদের ঋতুসূচনা ঘটে দেরীতে, ধনী পরিবারের মেয়েদের ঘটে কিছুটা কম বয়সে। এর সাথে জলবায়ুর সম্পর্ক নেই; উষ্ণ অঞ্চলে তাড়াতাড়ি আর শীতল অঞ্চলে বিলম্বে ঘটে, এমন নয়; এর সম্পর্ক শরীরের পুষ্টির সাথে। আর্থসামাজিক অবস্থার প্রভাব সুদূরপ্রসারী, তা স্বৰ্গকে প্রভাবিত করে, করে বালিকার মস্তিষ্ককেও। ঋতুসূচনা বালিকার শরীরের ভেতরে ঘটা একরাশ ঘটনার পরিণতি। তার শরীরের এ-পরিবর্তন ঘটে কয়েকটি গ্ল্যান্ড বা লালাগ্ৰন্থির পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের ফলে। এ-সব ক্রিয়াকলাপের নিয়ন্ত্রক গ্ৰন্থিটির নাম হাইপোথালামাস; এটি অবস্থিত মস্তিষ্কের এক বিশেষ স্থানে। এটি পিটুইটারি গ্রন্থির সাথে সমন্বয় ক’রে কাজ করে, এবং নিয়ন্ত্রণ করে পয়াবতী ঘটনাগুলো। অজানা কেনো কারণে ঋতুসূচনার বছর চারেক আগে থেকে হাইপোথালামাস এক ধরনের বস্তু নিঃসরণ করতে থাকে, তার নাম নিঃসারিক হরমোন। নিঃসারিক হরমোনের কাজ অন্য হরমোনের নিঃসরণ ঘটানো। হাইপোথালামাস ও পিটুইটারির সংযোজক রক্তনালিগুলোর ভেতর দিয়ে নিঃসারিক হরমোন বইতে থাকে, এর ফলে পিটুইটারি থেকে নিঃসৃত হয় কয়েকটি হরমোন। এগুলোর একটি শরীরবৃদ্ধিকারক হরমোন, যার ক্রিয়ায় ঋতুসূচনার আগে শবীর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ঋতুসূচনার চার বছর আগে থেকে বালিকা বাড়তে শুরু করে; প্রথম দু-বছর বেশি বাড়ে, ঋতুসূচনা যতোই কাছিয়ে আসে ততোই তার বাড়া কমতে থাকে। বারো বছর বয়সের দিকে পিটুইটারি গ্রন্থি দেড় ঘন্টা পর পর ঝলকে ঝলকে নিঃসরণ করে আয়েকটি নিঃসাবক হরমোন। এর নাম গোনাডোট্রোফিন নিঃসরক হরমোন। এ-হরমোন সক্রিয় ক’রে তোলে পিটুইটারির বিশেষ কিছু কোষকে। ওই কোষগুলো উৎপাদন করে এমন দুটি হরমোন, যা নিয়ন্ত্রণ করে বালিকার ডিম্বাশয়কে। এর একটির নাম ফলিকল-উদ্দীপক হরমোন; অন্যটির নাম হলুদ-উৎপাদক হরমোন।

বয়ঃসন্ধির কালে বালিকার ডিম্বাশয়ে থাকে দু-লক্ষের মতো ডিম্বাণু, তার মধ্যে এক ধরনের ডিম্বাণু থাকে, যেগুলোর ভেতরে দেখা দেয় তরল পদার্থ; ওগুলোর নাম ফলিকল। ফলিকল শব্দের অর্থ আধার। ফলিকল-উদ্দীপক হরমোনের কাজ ফলিকলকে উদ্দীপ্ত করা, এর ক্রিয়ার ফলে ডিম্বাশয়ের কোনো কোনো ফলিকল বিকশিত হয়। প্রথম দিকে খুব কম ফলিকলই বিকশিত হয়; তবে সেগুলো বৃদ্ধি পাওয়ার সময় উৎপন্ন হয় ইষ্ট্রোজেন নামের একটি হরমোন। ইষ্ট্রোজেন শব্দের অর্থ “ডিম্ব-উৎপাদক’ নাম থেকেই এর কাজ বোঝা যায়। ইষ্ট্রোজেন বালিকাকে করে নারী। উদ্দীপ্ত ফলিকলগুলো মাসখানেক ধ’রে ইষ্ট্রোজেন উৎপাদন ক’রে মারা যায়। এ-সময়ে আরো অনেক ফলিকলও উদ্দীপ্ত হয়, এগুলোও ইস্ট্রোজেন উৎপাদন করে। প্ৰতি মাসে আরো বেশি ক’রে (১২ থেকে ২০টি) ফলিকল উদ্দীপ্ত হ’তে থাকে, তাই ধীরেধীরে ইষ্ট্রোজেন উৎপাদনও বাড়ে। ইস্ট্রোজেনের অনেক কাজ; এটি স্তননালি ও স্তনবৃন্তের চারপাশের এলাকার বৃদ্ধি ঘটায়; এটি ডিম্বনালি, জরায়ু ও যোনিকে বাড়ার জন্যে উদ্দীপ্ত করে। এটি নিতম্বে মেদ সঞ্চার করে, তবে শরীরের বৃদ্ধি শ্লথ ক’রে দেয়। ক্রমশ শরীরে বেশ বৃদ্ধি পায় ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ, ঋতুসূচনা সন্নিকট হয়ে আসে। ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ার ফলে জরায়ুর ভেতরের দেয়ালের আস্তরণ বাড়ে। ওই আস্তরণকে বলে এন্ডোমেট্রিয়াম। এ-সময়ে হ্রাস পায়ে ফলিকল-উদ্দীপক হরমোন। যেই ফলিকলউদ্দীপক হরমোনের পরিমাণ কমতে থাকে, অমনি ডিম্বাশয়ে ফলিকল বাড়া থেমে যায়, এবং ইস্ট্রোজেন নিঃসরণও হ্রাস পায়। তখন জরায়ুর ভেতরের দেয়ালের আস্তরণ গঠিত যে-সব রক্তনালিতে, সেগুলো ভেঙে যায়; জরায়ুতে রক্তক্ষরণ ঘটে। চুৰ্ণবিচূর্ণ হয়ে যায এন্ডোমেট্রিয়াম। রক্ত, তত্ত্বর তরল পদাৰ্থ এবং এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষ জমা হয় জরায়ুতে, তারপর বাইরে বেরিয়ে আসে যোনিপথ দিয়ে। শুরু হয়। রক্তস্রাব, দেখা দেয় ঋতুসূচনা।

ঋতুসূচনার পর থেকে প্রথমে অনিয়মিত, পরে নিয়মিতভাবে কিছু দিন পর পর দেখা দেয় মেয়েদের ঋতুস্রাব। সূচনার চার থেকে ছ-বছর, সতেরো থেকে উনিশ বছর বয়সের মধ্যে প্রতিটি মেয়ের ঋতুস্রাবের একটি বিশেষ ধরন দাঁড়িয়ে যায়। প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব ধরন, তবে অধিকাংশ নারীরই, যদি সে গর্ভবতী না হয়, পয়তাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত মাসে একবার ঋতুস্ৰাব ঘটে। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের দিকে আবার অনিয়মিত হয়ে ওঠে; এবং চিরকালের জন্যে ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়। একে বলে ঋতুসমাপ্তি মেনোপজয়। এক ঋতুস্রাবের সূচনা থেকে আরেক স্রাবের সূচনা পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ঋতুস্রাব চক্র। প্রতিটি চক্র শুরু হয়ে ক্ষরণ শুরুর দিন। তাই ঋতুচক্রের মধ্যে পড়ে ক্ষরণেব দিনগুলো, এবং আরেক স্রাব শুরু হওয়া পর্যন্ত দিনগুলো। অধিকাংশ নারী নিজের ঋতুচক্ৰ সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কিছুই জানে না; এমনকি চক্রের দিনগুলো গোণার নিয়মও জানে না। উচ্চশিক্ষিত অধিকাংশ নারীও মনে করে একেকটি চক্র শুরু হয় ক্ষরণ সমাপ্ত হওয়ার পর দিন থেকে, যদিও চক্র শুরু হয় ক্ষরণ শুরুর দিন থেকে। সবার চক্ৰ সমান দীর্ঘ নয়; ঋতুচক্র ২২ থেকে ৩৫ দিনের হতে পারে, এবং গড়ে হয় ২৯ দিনের। পরবতী স্রাব ঠিক কোন দিন শুরু হবে, তা একশো ভাগ নিশ্চিতির সাথে বলা অসম্ভব, সাধারণত দু-চারদিন এদিক-সেদিক হয়। কিশোরীদের ঋতুস্রাব বেশ অনিয়মিত, সাধারণত স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দিন পর পর হয়, তবে কোনো কোনো মেয়ের হয় ঘন ঘন। ঋতুসূচনার পর প্রথম দু-এক বছর বছরে মাত্র দু-তিনবার দেখা দেয়, যখন দেখা দেয় তখন প্রবলভাবে দেখা দেয়। তবে পরে একটা নিয়মিত চক্র দাঁড়িয়ে যায়। ঋতুস্রাবে নারীর আভ্যন্তর ঘটনারাশির নিয়ন্ত্রক হাইপোথালামাস। মস্তিষ্কের এ-অংশটিও আবেগকাতর হয়, বিপর্যস্ত হয়; এবং প্রবল আবেগকাতরতার ফলে ঋতুস্রাব সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে যেতে পারে। কোনো মেয়ে বাড়ি থেকে অন্য কোথাও গেলে, বা পেশা বদলালেও সাময়িকভাবে স্থগিত হতে পারে তার চক্ৰ। আবেগগত কারণে দু-তিন মাস, এমনকি বছর খানেকের জন্যেও স্থগিত হয়ে যেতে পারে ঋতুচক্র। এর নাম আমেনোিরয়েয়া বা ঋতুবিরতি। এটা রোগের ফলে ঘটতে পারে, এবং এর পেছনে কোনো রোগ নাও থাকতে পারে। রোগের কারণে না হ’লে ঋতুবিরতি কোনো গুরুত্বের ব্যাপার নয়। অনেকের ধারণা ঋতুস্রাবে শরীর পরিচ্ছন্ন হয়, তবে ঋতুস্রাবে শরীর পরিচ্ছন্ন হয় না; আর ঋতুস্রাব না হ’লেও তার ভেতরে কোনো আবর্জনা জমে না। ঋতুক্ষরণকে পুরুষেরা ঘেন্না করে, কামুকও এ-সময় নারীকে ছুতে চায় না; নারীরাও নিজেদের মনে করে অশুচি। এতে অশুচিত্বের কিছু নেই, সঙ্গম না। করারও কিছু নেই; বরং এ-সময়টা সম্পূর্ণ নিরাপদ, এবং অধিকাংশ নারী এ-সময়েই বোধ করে বেশি কামবেগ। ঋতুক্ষরণের রক্ত দূষিত নয়, ঘৃণার বস্তু নয়। গ্রিয়ার (১৯৭০, ৫১) বলেছেন, যদি তুমি নিজেকে মুক্ত মনে করো, তবে তুমি তোমার ঋতুরক্ত একটু চেখে দেখার কথা ভেবে দেখতে পারো-যদি তোমার এতে ঘেন্না লাগে, তবে আরো অনেক পথ বাকি আছে, মেয়ে।’

নারীর অভ্যন্তরে তার জীবনের প্রায় পয়ত্ৰিশ বছর ধরে মাসে মাসে পুনরাবৃত্ত হতে থাকে একই ধরনের সংকেত, সংকেতের ফলে ঘটতে থাকে একই ধরনের ঘটনা। ঘটনাগুলোর নিযন্ত্রক মস্তিষ্কের একটি অংশ, তার নাম হাইপোথালামাস। প্রথমে হাইপোথালামাস কাজ শুরু করে, সেটি গোনাডোট্রোফিন-নিঃসারিক হরমোন পাঠায় পিটুইটারি গ্রন্থিতে, উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে পিটুইটারির কোষ। পিটুইটারি ক্ষরণ করে দুটি হরমোন : একটি ফলিকল-উদ্দীপক হরমোন, আরেকটি হলুদ-উৎপাদক হরমোন। ফলিকল-উদ্দীপক হরমোনের কাজ ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণু ফলিকলগুলোকে উদ্দীপ্ত করা। রক্তে ফলিকল উদ্দীপক হরমোন বাড়ার ফলে ডিম্বাশয়ে ১২ থেকে ২০টির মতো ডিম্বাণু উদ্দীপ্ত হয়। এ-ফলিকলগুলো বৃদ্ধি পায়, এবং উৎপাদন করে ইস্ট্রোজেন। ইস্ট্রোজেন-এর অর্থ ডিস্ক-উৎপাদক, এক্স কাজ ডিম্বাণু ফোটানো। ইস্ট্রোজেন একটি নারী হরমোন, এটি নারীদেহে নানা কাজ করে; তবে এর বিশেষ কাজ হচ্ছে জরায়ুর ভেতরের দেয়ালের আস্তরণ সৃষ্টি করা। ইষ্ট্রোজেন জরায়ুর আস্তরণকে উদ্দীপ্ত করে, তার ফলে আস্তরণ বিকশিত হয়। এ-আস্তরণের নাম এন্ডোমেট্রিয়াম। এর বৃদ্ধি ঘটে চক্রের ৫ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত। এটি সরু সরু নালিতে গঠিত, এতে থাকে কোষের কয়েকটি স্তর { ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে কোষের স্তর বৃদ্ধি পায়। জরায়ুতে যে পরিবর্তন ঘটে, তা বৃদ্ধিমূলক, তাই ঋতুচক্রের এ-পর্বকে বলা হয় চক্রের বৃদ্ধিপর্ব। এ-পর্বে নারীর ভেতরে তৈরি হয় নীড়, যেখানে বাসা বঁধতে পারে ভ্রূণ।

ফলিকল বাড়তে থাকে, সাথে সাথে রক্তে বাড়তে থাকে ইষ্ট্রোজেন। চক্রের ১৩ দিনের দিন রক্তে এর পরিমাণ শুরুর দিনের ছ-গুণ হয়ে দাঁড়ায়। এ-সংবাদ পৌঁছে যায় হাইপোথালামাসে, সেটি বুঝতে পারে যে আর ফলিকল উদ্দীপ্ত করার দরকার নেই; তাই কমিয়ে দেয়। ফুলকল-উদ্দীপক হরমোন উৎপাদন। তখন হাইপোথালামাস নিঃসরণ করে একটি হরমোন, যার নাম হলুদ-উৎপাদক-হরমোন-নিঃসারিক হরমোন। বাঙলায় নামটি বেশ বিদঘুটে শোনাচ্ছে, এর কাজ হচ্ছে হলুদ-উৎপাদক হব।মোন নিঃসরণে পিটুইটারিকে উদ্দীপ্ত করা। এর প্রভাবে পিটুইটারি উৎপাদন করে হলুদ-উৎপাদক হরমোন বা লিউটিনাইজিং হরমোন। এ-হরমোন ডিম্বাণু ফলিকলগুলোর কোনো একটিকে ফুটিয়ে তার ভেতরের ডিম্বাণুটিকে বের হতে সাহায্য করে; এবং ফলিকলের কোষগুলোকে উজ্জ্বল হলুদ বর্ণেরঞ্জিত ক’রে তোলে। এ-জন্যেই এর নাম লিউটিনাইজিং বা হলুদ-উৎপাদক হরমোন। চক্রের ১৪ দিনের দিন হঠাৎ রক্তনালি দিয়ে হলুদ-উৎপাদক হরমোনের প্রবল প্রবাহ বয়ে যায়। এ-হরমোন পৌঁছে ডিম্বাশয়ে, সেখানে এটি সবচেয়ে বিকশিত ফলিকলটিকে ফুটিয়ে ডিম্বাণুটিকে বের করে দেয়। একে বলা হয় ওভিউলেশন বা ডিম্বস্ফোটন। ডিম্বাণুটি ধৰিঃ পড়ে ডিম্বনালির আঙুলাকৃতির প্রান্তে, এবং সেটি ডিম্বাণুটিকে ছেড়ে দেয় ডিম্বন্যালিতে। ফোটা বা উর্বর ডিম্বাণু এগোতে থাকে সামনের দিকে।

ডিম্বনালিতেই ঘটে উর্বরায়ণ বা গর্ভসূচনা। ডিম্বাণু বেরিয়ে যাওয়ার পর তার শূন্য ফলিকল বা আধারটি চুপসে যায়, হলুদ-উৎপাদক হরমোন সেটিকে হলদে ক’রে তোলে। চোপসানো ফলিকলটিকে বলা হয় হলুদ বস্তু। এ-হলুদ বস্তুটি, এবং অন্যান্য ১১ থেকে ১৯টি ফলিকল যেগুলো তাড়াতাড়ি বাড়তে পারে নি, সবাই মিলে একটি নতুন হরমোন উৎপাদন করতে থাকে। এর নাম প্রোজেসটেরোন। এর অর্থ গর্ভ-উৎপাদক। প্রোজেসটেরোন দ্বিতীয় প্রধান নারী হরমোন। এর নানা কাজের মধ্যে প্রধান কাজটি হচ্ছে জরায়ুকে ভুণধারণ ও লালনপালনের জন্যে প্রস্তুত করা। প্রোজেসটেরোন জরায়ুর দেয়ালআস্তরণকে পুরু করে তোলে, গ্রন্থি থেকে পুষ্টিকর তরল পদার্থের নিঃসরণ ঘটিয়ে জরায়ুকে ভূণলালনের উপযুক্ত করে। ডিম্বাণু ফোটার পর চক্রের পর্বকে বলা হয় হলুদপর্ব বা গর্ড-উৎপাদক পর্ব। যদি ডিম্বাণু উর্বর অর্থাৎ গর্ভসঞ্চার না হয়, এবং ভূণ এন্ডোমেট্রিয়ামে স্থান না নেয়, তাহলে ডিম্বাশয়ে হলুদ বস্তুটি ও উদ্দীপ্ত ফলিকলগুলো মারা যায়। তখন রক্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেসটেরোন হ্রাস পায়। এর ফলে হাইপোথালামাস আবার গোনাডোট্রোফিন নিঃসারিক হরমোন ছাড়তে থাকে, এবং পিটুইটারি। আবার ফলিকল-উদ্দীপক হরমোন উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়। রক্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেসটেরোন ক’মে যাওয়ার ফলে পরবর্তী ঋতুস্রাবের দিন চারেক আগে থেকে জরায়ুর মোটা রসপূর্ণ আস্তরণ কুঁচকে যেতে থাকে; এর ফলে এর রক্তনালিগুলো গুটিয়ে যায়। ভাঙতে শুরু করে গোটানো রক্তনালিগুলো, আস্তরণের গভীরতর স্তরে ঘটতে থাকে রক্তপাত। এর ফলে রক্তের ওপর ভাগের আস্তরণ পৃথক হয়ে পড়ে; এটি ভেঙেচুরে পড়ে জরায়ুতে, এর সাথে পড়ে এন্ডোমেট্রিযাম থেকে টুইয়ে পড়া রক্ত ও তরল পদার্থ। ঋতুস্রাবে রক্ত বেশি থাকে না, নিঃসৃত বস্তুর এক তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক হয় রক্ত। এ-রক্ত সাধারণত চাপ বাঁধে না। কয়েক ঘন্টার মধ্যে এতোটা বর্জ্য জমে যে জরায়ু সংকুচিত হয়ে যোনির ভেতর দিয়ে তা বের করে দেয়। শুরু হয় ঋতুস্রাব।

ঋতুক্ষরণ তিন থেকে পাচ দিন ধরে চলে; তবে এক দিনের ক্ষরণ যেমন ঘটে, তেমনই আট দিন ধরেও ক্ষরণ ঘটতে পারে। ক্ষরণে সাধারণত গড়ে ৩০ মিলিলিটার রক্ত ঝরে। চক্রের প্রথম পর্ব, অর্থাৎ ঋতুক্ষরণ শুরু থেকে ডিম্বাণু ফোটা পর্যন্ত সময়টা নির্দিষ্ট নয়। এ-পর্বটি ৯ থেকে ২৫ দিনের, বা তারও বেশি দিনের হতে পারে। ডিম্বাণুটি কবে ফুটবে, তা জানাই কঠিন; জানলে সহজে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যেতো। কেননা ডিম্বাণু ফলিকল থেকে বোরোনোর পর বাঁচে প্ৰায় ৭২ ঘন্টা, তবে তা উর্বর হতে পারে ৩৬ ঘন্টা পর্যন্ত। শুক্রাণু বাঁচতে পারে। ৪৮ ঘন্টা। তাই ২৮ দিনের একটি চক্রে উর্বরতার কাল ১২০ ঘন্টার বেশি নয়; কমও হতে পারে। সমস্যা হচ্ছে নারীর ডিম্বস্ফোটনের দিনটি জানা দুরূহ। তবে চক্রের ৯ম দিনের আগে ও ২০তম দিনের পর গর্ভসঞ্চারের সম্ভাবনা কম। চক্রের দ্বিতীয় পর্ব, অর্থাৎ ডিম্বাণু ফোটার দিন থেকে নতুন চক্রের ক্ষরণ শুরুর দিন সব সময়ই হয় ১৪ দিন; তাই ডিম্বাণু ফোটার দিনটি জানা গেলে পরবতী চক্র শুরুর দিন কবে হবে, তা ব’লে দেয়া যায়। কিন্তু ডিম্বাণু ফোটার দিনটি নির্দিষ্টভাবে জার্নাঁ খুবই কঠিন। নারীর ভেতরে যা ঘটে, তার জন্যে তার প্রাপ্য ছিলো স্তব; কিন্তু পিতৃতন্ত্র তাকে করেছে তিরষ্কার; ঘোষণা করেছে। দূষিত ব’লে। কারণ নারীর কোনো-না-কোনো দোষ খুঁজে বের করতে পারলেই পিতৃতন্ত্র তার বিধানকে করে তুলতে পারে আরো নির্মম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *