পঞ্চদশ অধ্যায় – ধর্ম, চারুকলা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি
ধর্ম
১৬শ, ১৭শ, ও ১৮শ শতাব্দীতে হিন্দু এবং ইসলাম উভয় ধর্মের মধ্যেই একদিকে উদারতা ও সর্বজনিনত্ব এবং অপর দিকে কঠোর আত্ম-সর্বস্বতা এবং রক্ষণশীলতা এই দুই পরস্পরবিরোধী ধারা লক্ষ করা গিয়েছিল। নানক–যার শিক্ষার এবং উপদেশের ফলে শিখ ধর্ম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, জাতিবর্ণ ভেদের বিরোধিতার বিষয়ে তার সঙ্গে নির্গুণ সাধুদের বহু সাদৃশ্য ছিল এবং এ ছিল এক উদার এবং সর্বমত সহিষ্ণুতার পরম্পরার অঙ্গ।
হিন্দু ধর্ম
কোনো কোনো বৈষ্ণব এবং নিগুণ ভক্তিসাধক এবং তান্ত্রিক গুরুরা আধ্যাত্মিক জগতে শূদ্র এবং স্ত্রীলোকদের অংশগ্রহণের পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন। তারা আদিবাসী এবং পাহাড়ি জনজাতির অধিবাসীদের সাদরে জীবনযাত্রার ধরন এবং চিন্তাধারা স্বীকার করতে যারা প্রস্তুত ছিলেন, তাদেরও স্থান দিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণদের এক বিশাল সমষ্টি এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন এবং হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের যেসব প্রণেতারা আনুষ্ঠানিক শুদ্ধাচারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করতেন এবং যারা তাদের বিবেচনায় অশুচি তাদের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্কের দ্বারা দূষিত’ হতে চাইতেন না, সেইসব ব্যক্তিরাও এর প্রতিবাদে মুখর হলেন। এর অর্থ হল শক্তিশালী মুসলিম সম্প্রদায়ের ছোঁয়া থেকে বাঁচতে নিজেকে রক্ষা করার জন্য এঁরা নিজেদের একটি খোলসের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চাইতেন। তাই এঁরা জাতিভেদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তত্ত্বের সম্পূর্ণ মান্যতার মাধ্যমে সমগ্র হিন্দু সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট ছিলেন। এই চিন্তাধারার সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী বাহক ছিলেন নদিয়ার রঘুনন্দন। তিনি হিন্দুদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের বিভিন্ন অঙ্গের উপর আঠাশটি পুস্তক রচনা করেছিলেন। রঘুনন্দন ব্রাহ্মণদের অধিকার স্থাপনের ওপর জোর দিয়ে বলেন যে ব্রাহ্মণরা ছাড়া আর কারুর হিন্দুশাস্ত্র পাঠ বা প্রচার করার অধিকার নেই। উপসংহারে তিনি বলেন যে কলি যুগে মাত্র দুটি ধর্ম আছে, ব্রাহ্মণ আর শূদ্র। প্রকৃত ক্ষত্রিয়েরা বহুদিন আগেই অদৃশ্য হয়েছে। এবং যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার জন্য অথবা সুনির্দিষ্ট পেশা অবলম্বন না করার জন্য বৈশ্যরা তাদের বর্ণভিত্তিক অবস্থান হারিয়ে ফেলেছে। তিনি আবার ব্রাহ্মণদের এবং অন্যান্য বর্ণের মানুষদের সংগঠিত করার জন্য বিভিন্ন শাস্তির বিধান দেন।
বারাণসীর অধিবাসী তুলসীদাসের মতো কোনো কোনো ব্রাহ্মণ শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুসারে তাদের কর্তব্য পালন করে গেলেও, তারা আপস করতেও প্রস্তুত ছিলেন। তুলসীদাস বলেছিলেন যে নিরন্তর রামনাম জপ করে রামকে ব্রাহ্মণের মর্যাদা দিলে যে দীনাতিদীন, তারও মুক্তি হয়ে যায়। আবার শূদ্ররা অন্যায় ভাবে ব্রাহ্মণদের প্রাপ্য। সুবিধাগুলি ভোগ করার চেষ্টা করলে বা নিজেদের গুরুরূপে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস। পেলে, তিনি তার জন্যও দুঃখ প্রকাশ করে বর্ণাশ্রমের স্বপক্ষে ছিলেন। কিন্তু নিজে তিনি এমন একটি বর্ণবিন্যাসের ঘোষণা করেন, যা ব্যক্তিবিশেষের গুণের উপর নির্ভরশীল, জন্মের উপর নয়।
তৎকালীন গোঁড়া ব্রাহ্মণেরা তাঁর কঠোর নিন্দা করলেও বংশপরম্পরায় উত্তর ভারতের মানুষের উপর তুলসীদাসের অসীম প্রভাব ছিল। মীরা ও সুরদাসের প্রদর্শিত পথে রাধা ও কৃষ্ণের উপাসনা ছিল খুবই জনপ্রিয়, সম্ভবত পুরুষদের অপেক্ষা মহিলাদের মধ্যেই বেশি।
দক্ষিণ ভারতে শৈব ধর্মের প্রতিপত্তি অব্যাহত ছিল, তবে এই সময়কালে দাক্ষিণাত্যে কোনো নতুন আধ্যাত্মিক বা সম্প্রদায়গত ভক্তি আন্দোলনের খবর পাওয়া যায় না।
পূর্ব ভারতে চৈতন্যের ভক্তরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও লিঙ্গ ভেদে সমভাবে তাঁর মতের পরম্পরা অব্যাহত রাখলেন, যেখানে সর্বজীবে সমজ্ঞানই ছিল মূলমন্ত্র। তবে শ্রীচৈতন্যের মতের টীকাকার ও বৃন্দাবনের গোস্বামীরা তার চিন্তাধারায় নৈষ্ঠিক ধর্মের একটি ভাব আরোপ করতে চেষ্টা করেছিলেন। যে তান্ত্রিকরা সাধন-কার্যে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণের কোনো পার্থক্য স্বীকার করতেন না, তাদের তন্ত্র সাধনা এবং শক্তি ও দেবীপূজাও ছিল বহুল প্রচারিত। পূর্ব ভারতে মাধবদেবের মতো শংকরাচার্যের শিষ্যরা বহু আদিবাসীদের নরবলি বর্জন করতে এবং বৈষ্ণব ধর্মগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। মাধবানন্দ নিজে সংসারী হলেও তাঁর শিষ্যেরা ছিলেন সন্ন্যাসী।
মহারাষ্ট্রে ভক্তি আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী এবং শ্রেষ্ঠ নেতা ছিলেন। তুকারাম, যিনি সপ্তদশ শতকের প্রথম অর্ধের লোক ছিলেন। তার ভজন সংগীত বা আভাঙ্গগুলি ভিটোভার প্রতি প্রেম ও ভক্তির এক গভীর ভাব নিয়ে আসে। ভিটোভা পান্ধারপুরস্থিত বিষ্ণুর এক অবতার ছিলেন। তুকারাম নিজের সম্বন্ধে বলছেন ‘শূদ্র বংশে জন্মেছিলাম বলেই আমি সকল ধর্ম থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলাম। গুরু রামদাস মহারাষ্ট্রের গোঁড়া বা সনাতন ধর্মবাদীদের প্রতিনিধি ছিলেন ও কর্মযোগের দর্শন প্রচার করেন–কিন্তু ততটাই জোরের সঙ্গে ব্রাহ্মণদের প্রাপ্য সুযোগ সুবিধাগুলির পক্ষ অবলম্বন করেন। তাঁর আদর্শ প্রচারের জন্য তিনি মন্দিরগুলির সঙ্গে অনেকগুলি মঠও সংলগ্ন করেন। শিবাজি তার শিষ্যত্ব বরণ করে এই মঠগুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু অর্থও প্রদান করেন।
ব্রাহ্মণদের সেই সময় গোঁড়া ধর্মমত প্রচার করার এবং হিন্দু শাসকদের একত্রিত হবার আহ্বান করার একটি প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। এই দুইটিই ব্রাহ্মণদের পক্ষে সুবিধাজনক ছিল। যদিও শাসকেরা শক্তিশালী মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে এবং নিম্নবর্গের হিন্দুদের সঙ্গে শত্রুতা বৃদ্ধি না করার বিষয়ে অবহিত ছিলেন। এই দুটিই সামাজিক স্থায়িত্বের উপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বা জোর দেয়–যার অর্থ হল নীচ জাতিয়দের সমাজে তাদের যথোপযুক্ত স্থানে রেখে দেওয়া।
কবীর মানুষের মৌলিক সমতার এক ব্রম্পরা সৃষ্টি করেছিলেন। জাতি, বর্ণ এবং ধর্মের সমস্ত ভেদাভেদকে তিনি অস্বীকার করেন ও প্রত্যাখ্যান করেন। শাস্ত্রগত বিদ্যা এবং অন্তঃসারশূন্য ক্রিয়াকর্মের প্রতি তার বিরোধিতাকে পাঞ্জাবে নানক এবং রাজস্থানে দাদু আরও অগ্রসরমান করে তোলেন। ধর্মের সমস্ত বাহ্যরূপকে প্রত্যাখ্যান। করে দাদু ঘোষণা করেন যে তিনি হিন্দুও নন, আবার মুসলমানও নন–এবং শাস্ত্র লিখিত উপদেশের কোনো মূল্যই তাঁর কাছে নেই (শতদর্শন)। তিনি নি-পা বা কোনো দলাদলিহীন বা সম্প্রদায়গত বৈষম্যহীনতার পথ অবলম্বন করার উপদেশ দেন। সুন্দর দাস এবং রজ্জব তাঁর উত্তরসূরি ছিলেন। রজ্জব সবার ঊর্ধ্বে ভক্তি ও শ্রমের দর্শনকে স্থান দিতেন। যে ব্যক্তি পরিশ্রম না করে সে শুধু তার পরিবারের অন্ন সংস্থান করতে পারবে না তাই নয়, পরন্তু রামনাম জপ করারও তার কোনো অধিকার থাকে না।
এই উদারতা ও গোঁড়া অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাশাপাশি বর্তমান ছিল। প্রাণনাথ, বুন্দেলখণ্ডের শাসক ছত্রপালের উপর যাঁর বিশাল প্রভাব ছিল, তিনি কোরান এবং বেদের বাণীকে পাশাপাশি রেখে প্রমাণ করতে চান যে তারা মূলগত ভাবে পরস্পর পরস্পরের পৃথক নয়। তিনি তার হিন্দু ও মুসলমান শিষ্যদের নিজ নিজ ধর্মাচরণ ও আইন অনুসরণ করার অনুমতি দেন। কিন্তু দীক্ষার সময় তাদের সকলকে এক সঙ্গেই খাদ্যগ্রহণ করতে হত।
শিখ ধর্ম
নানকের ধর্মপ্রচারের মাধ্যমেই শিখ চিন্তাধারার এবং আন্দোলনের সূত্রপাত। কিন্তু এর। ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে গুরুদের আদর্শের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। প্রথম চারজন গুরুর সময় কালে শান্তি, ধ্যান এবং গভীর অধ্যয়নের পরম্পরা অক্ষুণ্ণ ছিল। পঞ্চম গুরু, অর্জুন। দাসই শিখ ধর্মগ্রন্থ আদি গ্রন্থ-সাহেবের গ্রন্থনা সম্পূর্ণ করেন। গুরু যে আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক উভয় বর্গেরই নেতৃস্বরূপ, সে সত্য সকলের সামনে তুলে ধরার জন্য তিনি। অভিজাত-সুলভ জীবনধারা অবলম্বন করেন। তিনি অমৃতসরে কয়েকটি সু-উচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করেন, নিজে মহার্ঘ বেশভূষা পরিধান করতেন, মধ্য এশিয়া থেকে আনীত মূল্যবান অশ্ব সকল তার অশ্বশালে রক্ষিত ছিল এবং নিজের প্রয়োজনে চুক্তিবদ্ধ কর্মচারী রাখতেন। তিনি আবার শিখদের কাছ থেকে তাদের আয়ের এক দশমাংস প্রণামী হিসাবে দাবি করতেন।
গুরুরা গুরু নানকের দর্শনকে বা মতবাদকে এমন ভাবে দৃঢ়তর করে তুলতেন যাতে করে তার মৌলিক আদর্শকে ক্ষুগ্ন না করেই, তাতে আরও নূতন মাত্রা আরোপ করা যায়। (জে. এস. গ্রেওয়াল) যথা, সকল গুরুকেই সমান ভেবে গুরুদেব সর্বাঙ্গীন একতার নীতির সঙ্গে এই নীতিও যুক্ত হয় যে ব্যক্তিগত গুরুর থেকে তার গুরুত্ব’-ই অধিক মহত্ত্বপূর্ণ। এবং গুরুর যে-কোনো সিদ্ধান্তই প্রবর্তক গুরু নানকের সিদ্ধান্তের সমতুল্য এই বিশ্বাসও হৃদয়ে উপলব্ধি করতে হবে। এর সঙ্গে আবার ধর্ম যাজকদের। সম্মেলন বা সিঙ্গত’কে আরও অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। এইসব আদল এবং কয়েকটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একত্রিত হয়ে শিখরা একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করে এবং এই একতাই সকল প্রকার অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের রুখে দাঁড়াতে প্রেরণা। জোগায়। ১৬শ শতাব্দীতে শিখ এবং মুঘলদের মধ্যে সংঘর্ষের কারণগুলি বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি।
ইসলাম
একদিকে উদারতা ও সর্বজনীনতা এবং অপরদিকে কঠোর বিচ্ছিন্নতা এবং রক্ষণশীলতা, এই দুইয়ের মধ্যেকার সংঘাত হিন্দু ধর্মের তুলনায় ইসলাম ধর্মে আরও প্রবলতর ছিল। শরিয়ত মুসলিম আইনবিধি এবং তারিকত বা সুফিভাবের মধ্যেকার যে দ্বন্দ্ব পশ্চিম এশিয়াতে সুফিবাদের উত্থানের সঙ্গে শুরু হয়েছিল তা ভারতেও বিলক্ষণ দৃশ্যমান ছিল। বাদশাহর দরবারে লোভনীয় পদমর্যাদার অধিকারী সরকারি উলেমারা, তাঁদের মতে যে-সমস্ত ধর্মীয় আন্দোলন ইলসামের চিরন্তন পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করার জন্য এবং অবিশ্বাসী কাফিরদের সঙ্গে ইমান বা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসের মধ্যে সন্ধি করবার জন্যে পথ উদ্ভাবন করে, তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন। (এম. ওয়াহিদ মির্জা),
ওয়াহদাত–উল–ওয়াজুদ, বা সকল প্রাণীর একতার তত্ত্ব আকবর সমর্থন করতেন, তা বহু সুফিসন্ত গ্রহণ করেন। একদল গোঁড়া চিন্তক কিন্তু তার বিরোধিতায় সচেষ্ট হন। তাদের যুক্তি ছিল যে এতে স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যেকার ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলে বহু দেবতার উপাসনার দ্বার উন্মুক্ত করা হবে। কাদিরিয়া ধর্মমতের সন্ত শেখ আবদুল হক নতুন আলোকে শরিয়ার পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেন। আকবরের উদারপন্থী ধর্মীয় মতবাদের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তুর্কিস্তানে জনপ্রিয় নাশবন্দি নামের নৈষ্ঠিক সুফি মতবাদের সমর্থক বাকি বিল্লাহ তার নেতৃত্ব দেন। বাকি বিল্লাহ দিল্লির নিকটে বসবাস শুরু করেন এবং আকবরের দরবারের বহু অভিজাত ব্যক্তি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারীর নাম শেখ-আহমেদ, যিনি সিরহিন্দের অধিবাসী ছিলেন।
শেখ আহমেদ ওয়াদাত–আল–ওয়াজুদ বা সর্বজীবের একতা তত্ত্বের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি সুফিবাদ থেকে এই সমস্ত চর্চা ও বিশ্বাসকে বহিষ্কার করতে বলেন। কেননা তার মতে এইসব ভাব ছিল ইসলাম-বিরোধী। তাই আধ্যাত্মিকতার উচ্ছ্বাসের জন্য ধর্মীয় সংগীত শ্রবণ, দীর্ঘ তীর্থযাত্রা, সন্তদের সমাধিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন ইত্যাদির বিরোধিতা করেছিলেন। হিন্দু ধর্ম থেকে উদ্ভূত সকল অনুষ্ঠান ও আচারের তিনি বিরোধী ছিলেন এবং হিন্দুদের সঙ্গে কোনো সামাজিক সম্পর্ক না রাখার জন্য তিনি আদেশ দেন। প্রকৃতপক্ষে শেখ আহমেদ হিন্দুদের কুকুরের থেকেও অধম জ্ঞান। করতেন। শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেদের অবিশ্বাসীদের থেকেও অধম মনে করা হত। আকবর অমুসলমানদের যে প্রশয় দিয়েছিলেন তিনি তার তীব্র সমালোচক ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর যেন পুনর্বার আরোপ করা হয়, এবং গো-হত্যা যেন আবার আরম্ভ করা হয়। তিনি তার নীতি কার্যকরী করবার জন্য এবং তার মত প্রচারের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সমাজের সম্ভ্রান্তদের নিকট পত্র দেন। যেসব শাস্ত্রজ্ঞ উলেমারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন তিনি তাদের এবং সুফিদেরও নিন্দা করে বলতেন এটা নৈষ্ঠিক সুন্নি মতবাদ থেকে বিচ্যুতির কারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইসলামের প্রতিষ্ঠার প্রথম শতবর্ষে তার নবীকরণ করার দায়িত্ব তারই উপর ন্যস্ত, অর্থাৎ তিনিই মুজাদ্দিদ। ঈশ্বর (আল্লা) তাঁকে নৈষ্ঠিক সুন্নি মতবাদকে তার আদি গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। (এস.এ.এ.রিজভি)
কিন্তু যেসব গোঁড়া মুসলিমদের তিনি নিন্দা করেছিলেন তারাই তার বিরুদ্ধে চলে যান। তারা অনুযোগ করেন যে তিনি নিজেকে ইলসাম ধর্ম-প্রবর্তক মহাপুরুষের (নবি) সঙ্গে সমশ্রেণি ভুক্ত বলে দাবি করেন, কেননা একটি চিঠিতে তিনি লেখেন যে তিনি ঈশ্বরের শিষ্য এবং তিনিই তার ইচ্ছা (তার ইচ্ছার প্রতিরূপ)। এই অভিযোগেই জাহাঙ্গির তাকে কারারুদ্ধ করেন। শাহজাহানও শেখ আমেদের পুত্রদের দিকে কোনো মনোযোগ দেননি। নৈষ্ঠিক ধর্মাচরণের থেকে ভিন্ন সমস্যা সামাজিক রীতিনীতি ও অভ্যাসকে ঔরঙ্গজেব বাতিল করে দিলে মুজাদ্দিদের পুত্ররা তাকে সমর্থন করেন, এছাড়া ১৬৬৫ সালে নাশবন্দি ধারার সদস্যপদ গ্রহণ করলেও, ঔরঙ্গজেব কিন্তু মুজাদ্দিদের সমর্থন করতেন না। পাঞ্জাব এবং অন্য স্থানের অনেক উলেমাই মুজাদ্দিদের চিঠিপত্রগুলিকে ধর্মীয় পবিত্রতার অপমানকারী বলে ফতোয়া বা আদেশ দেন। ১৬৮২-৮৩ সালে মক্কা শরিফের মহানাগরিক ঔরঙ্গজেবকে এক পত্রে জানান যে সেখানকার শাস্ত্রজ্ঞ উলেমারা একমত যে শেখ আহমেদ একজন অবিশ্বাসী নাস্তিক। সেইজন্য বাদশাহ ভারতে সম্ভবত মুজ্জাদিয়ার বিরোধী প্রধান কেন্দ্র ঔরঙ্গবাদে মুজাদ্দিদের প্রশিক্ষণ বন্ধ করার আদেশ দিতে বাধ্য হন।
কাদিরিয়া মতবাদ শেখ আবদুল কাদিরের (মৃত্যু ১৫৩৩) চেষ্টায় পাঞ্জাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার পুত্রেরা আকবর ও আবুল ফজল-এর ঘনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। কাদিরিয়া মতবাদকে ওয়াহদাত-আল–ওয়াজুদ-এর শিক্ষার শক্তিশালী সমর্থক বলা যায়। মিয়া মির (সালে ১৬৩৫) সুফিবাদের মরমি অতিন্দ্রীয়বাদের উপরই গুরুত্ব আরোপ করতেন। বনে-জঙ্গলে দীর্ঘদিন কঠোর সাধনা করে শেষ পর্যন্ত তিনি লাহোরে বসতি স্থাপন করে সকলের অজস্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেন। মুল্লা শাহ বাদাখশানি তার সবথেকে খ্যাতিমান শিষ্য ছিলেন। অবিশ্বাসী অর্থাৎ হিন্দুদের নঞর্থক বা নিন্দনীয় ভাবে দেখানোর জন্য গোঁড়া মতবাদ-পন্থীদের প্রয়াসকে বাতিল করে দিয়ে তিনি বলেন যে অবিশ্বাসী বাস্তব সত্যকে উপলব্ধি করে তাকে চিনতে পারে তিনি অন্তরে একজন বিশ্বাসী। আর যে তথাকথিত বিশ্বাসী তিনি অন্তরে একজন বিশ্বাসী। আর যে তথাকথিত বিশ্বাসী বাস্ততাকে স্বীকার করেন না, তিনি। অবশ্যই আসলে অবিশ্বাসী।
১৬৩৯-৪০ সালে শাহজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র দারা এবং কন্যা জাহানারা উভয়েই মিয়া মিরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দারা মানসিকতার দিক দিয়ে একজন শাস্ত্রজ্ঞ বিদ্যান পুরুষ ছিলেন এবং ধর্মীয় ঈশ্বর বৃত্তান্ত নিয়ে বাক্যালাপ করতে ভালো বাসতেন। কাশ্মীরি ব্রাহ্মণদের সাহায্যে তিনি গীতাকে পারসিতে অনুবাদ করেন। তবে তাঁর। সবথেকে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের নাম মাজ মা–উল–বাহারিন, বেদের একটি সংকলন গ্রন্থ। এর মুখবন্ধে দারা বেদকে ‘সেই সময়ের পটভুমিকায় স্বর্গীয় গ্রন্থরাজি’ বলে উল্লেখ করে বলেন যে ‘বেদ পবিত্র কুরানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।’ এর দ্বারা হিন্দু ধর্ম এবং ইসলামের মধ্যে যে কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই, সেই কথাটিই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এই ভাবে ইসলামের সঙ্গে অবিশ্বাসীদের একসঙ্গে বসাবার অপরাধেই উলেমারা (শাস্ত্রজ্ঞরা) ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দি দারার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
ঔরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণের পরেই ধর্মশাস্ত্রের চর্চার উপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হতে থাকল। এর ফলে ধর্মতত্ত্ববিদ বা উলেমাদের এক সমিতি মিলে ভারতবর্ষ এবং তার বাইরের বিভিন্ন বিষয়ে ঔরঙ্গজেব যেসব ফতোয়া বা বিধান দিয়েছিলেন ফতোয়া–ই–আলমগিরি নামে তার এক সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
নাকশ্বন্দি ধারাকে সচরাচর কট্টরপন্থী এবং কাদিরিয়াদের উদার মনোভাবাপন্ন বলা হয় বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে এইরকম পার্থক্য রচনা করা যায় না। যেমন শেখ আবদুল হক কাদিরিয়াপন্থী হলেও তাঁর চিন্তাধারা কট্টরপন্থী ছিল। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তীকালে নাশবন্দি সম্প্রদায়ের সদস্য মির্জা মজহর জান-ই-জানান এই মীমাংসায় আসেন যে বেদ ঈশ্বরের ভাবেরই প্রকাশ, এবং সেইজন্য হিন্দুরা ছিল আহল–ই–কিতাব-এর মর্যাদাসম্পন্ন। সুতরাং আরবে কাফিরদের সঙ্গে যেভাবে ব্যবহার করা হয়, হিন্দুদের সঙ্গে তা সমীচীন হবে না।
ঔরঙ্গজেবের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মশাস্ত্রের চর্চার অগ্রগতি হলেও একথা ভাবলে ভুল হবে যে ওয়াহদাত–আল–ওয়াজিদ(সকল সৃষ্টির একাত্মতা)-এর চিন্তাধারার অবনতি হয়েছিল। ১৮শ শতাব্দীতে সুফিবাদের উদার এবং গোঁড়া উভয় ধারার অভ্যাসই অব্যাহত ছিল। শেখ কলিমুল্লার নেতৃত্বে চিস্তিয়া ধারারও পুনরার্ভিাব ঘটল। অনেকেই আবার একাধিক গোষ্ঠীতে যোগদান করে বহু যাজকীয় সম্পর্কে আসেন। এমনকি ঔরঙ্গজেবের পুত্ররাও উদার সুফি মতবাদে গভীর ভাবে আগ্রহী ছিলেন।
ভারতে এই যে উদারপন্থী এবং কট্টরপন্থার পৌনঃপুনিক আবির্ভাব, অন্তত অংশত, ভারতবর্ষের সমাজের পরিকাঠামোর মধ্যে নিহিত পরিস্থিতির মধ্যে তাকে দেখতে হবে। একদিকে অভিজাতদের সুরক্ষিত সুযোগ-সুবিধা এবং ক্ষমতা, এবং অপরদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সহমর্মীতা এবং মনুষ্যত্বমুখী আশা-আকাঙ্ক্ষা, এই দুইয়ের সংঘর্ষেরই একটি প্রতিরূপ এর মধ্যে ফুটে উঠেছে। উদারপন্থী ও গোঁড়া ধর্মীয় চিন্তা উভয়ই কিন্তু অভিজাত এবং সাধারণ মানুষ দুই পক্ষকেই প্রভাবিত করেছিল।
কারুশিল্প
মুঘল সাম্রাজ্যকালে স্থাপত্য, চিত্রকলা, সংগীত এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক সক্রিয়তার প্লাবন এসেছিল। এই সময়ে যেসব শৃঙ্খলা এবং প্রথার পরম্পরা সৃষ্টি হয় অনুক্রমিক ভাবে তা পরবর্তী প্রজন্মগুলিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। মুঘলরা তাদের সঙ্গে তুর্ক-মোঙ্গল যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এনেছিল তা এই দেশের সমৃদ্ধ, সাংস্কৃতিক পরম্পরার সঙ্গে মিলেমিশে যায়। আমরা আগেই দেখেছি যে চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর সুলতানি এবং প্রাদেশিক সাম্রাজ্যগুলিতে এক বহুমুখী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বিকাশ ঘটেছিল। এই সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মুঘলেরা আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন–যার ফলে এর পরবর্তীকালের সংস্কৃতি ছিল বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী, আঞ্চলিকতা এবং বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের অবদান। তবে এই ধরনের সংস্কৃতিকে বৃহৎ ভাবনায় ভারতীয় বা জাতীয় সংস্কৃতি বলা যেতে পারে।
স্থাপত্য
মুঘলরা মহান দুর্গ ও প্রাসাদ, অতিসুন্দর তোরণ (দরওয়াজা) এবং জনসাধারণের ব্যবহারে জন্য নির্মিত সরাই, হামাম (স্নানঘর), মসজিদ, বাওলি (জলাধার) ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। এ ছাড়া তারা বহমান জল সহ বহু প্রথাগত উদ্যান রচনা করেন। বিশেষ করে মুঘলেরা তাদের প্রাসাদে এবং বিলাস গৃহগুলিতেও সদাসর্বদা জল পাওয়ার ব্যবস্থা রাখতেন। বাবর বাগান খুবই ভালোবাসতেন এবং আগ্রা ও লাহোর। অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বাগান রচনা করেছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়–তাদের মধ্যে কাশ্মীরে নিশাত বাগ, লাহোরে শালিমার বাগ, কালকায় পর্বতের পাদদেশে পিনজোর উদ্যান, আগ্রার সন্নিকটে আরাম বাগ (যার বর্তমান নাম রাম বাগ) ইত্যাদি কয়েকটি মাত্র আজ অবশিষ্ট আছে। উঁচু জমিতে করা এই সব বাগান থেকে উদ্যান শিল্প সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।
এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের এক সুন্দর নান্দনিক রুচি ছিল, যদিও তিনি ভারতে অনেকগুলি অট্টালিকা নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি। এবং তার নির্মিত বেশিরভাগ গৃহই আর অবশিষ্ট নেই। বাবরের নিকট শৃঙ্খলা এবং সামঞ্জস্যই ছিল স্থাপত্যের মুখ্যতম বস্তু, যা ভারতের বেশিরভাগ গৃহই পাননি। সম্ভবত দিল্লি, আগ্রা এবং লাহোরে লোদিদের নির্মিত গৃহগুলি দেখেই তাঁর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। অযোধ্যা এবং সম্ভলের যে মসজিদগুলি তার দ্বারা নির্মিত বলে কথিত আছে, সেগুলি আসলে সেখানে পূর্বে নির্মতি ভবনের পরিবর্তন করে নির্মীত এবং তার থেকে বাবরের স্থাপত্য-চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় না।
তবে সেই সময়কার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রাসাদগুলি নিঃসন্দহে সাসারাম এবং দিল্লিতে শের শাহ নির্মাণ করেছিলেন। সাসারামের নির্মাণগুলি কয়েকটি স্মৃতিসৌধের সমষ্টি, যা দিল্লির অষ্ট-কোনাকৃতি লোদিদের সমাধির ধরনে নির্মীত। তবে সাসারামের সব স্থাপত্যের মধ্যে শের শাহের সমাধিকেই সর্বোত্তম বলা যায়। একটি বৃহৎ জলাশয়ের মধ্যভাগে নির্মিত এই অট্টালিকাটির প্রতিবিম্ব সঞ্চরণের ভ্রম সৃষ্টি করে, মনে হয় যেন এটি চলমান, আবার সেই সঙ্গে এর আয়তনও দ্বিগুণ বলে মনে হয় (পার্সি ব্রাউন)। এই বিশাল অষ্টকোনা সৌধটি একটি উচ্চ বর্গাকার বেদীর উপর স্থাপিত হওয়ার জন্য এর উচ্চতা এবং বলিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বেদীটি আবার মূল সৌধটির সঙ্গে কোনায়-কোনায় কয়েকটি সুঠাম চালের দ্বারা সংযুক্ত। এই ভবনের চারপাশ বেষ্টন করে যে খিলান আকারে বাঁকানো বারান্দাটি এবং ধাপে ধাপে উত্থিত বিশাল গম্বুজটি এর মধ্যে এক উচ্চ সমতলের ভাব এনে দিয়েছে। গম্বুজের কণ্ঠদেশ প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত যার উপর কয়েকটি সুষমামণ্ডিত বেদী আছে। বিশাল গম্বুজটির উপরে একটি পদ্মফুলাকৃতি বিশিষ্ট ঢাকা আছে। লক্ষ করলে বোঝা যাবে যে শের শাহের স্মৃতিসৌধের বহু স্থাপত্যকর্মই কিছুটা পরিবর্তন করে তাজমহলে সংযুক্ত হয়েছে। কিন্তু তাজমহলের স্থাপত্যকে যেমন লঘু, কোমল এবং বায়ুময় মনে হয়, তেমনি শের শাহর স্মৃতিসৌধ এক শক্ত এবং সুগঠিত, সবল স্থাপত্যময়। এইগুলি আবার স্থাপত্যশিল্পের প্রয়োজনীয় অংশ এবং শের শাহের চরিত্রের সঙ্গেসামঞ্জস্যপূর্ণ।
শের শাহ দ্বারা নির্মিত ‘পুরানা কিল্লা’ বা পুরাতন দুর্গ হয়তো হুমায়ুনের জাঁহাপনার অংশ। এটি একটি বিরাট পুরাকীর্তি যার দেওয়ালগুলি ধূসর রঙের পাথরের দ্বারা প্রস্তুত। এর দর্শনীয় তোরণটি লাল বালিপাথরের মধ্যে শ্বেতপ্রস্তর দিয়ে সজ্জিত এবং মধ্যে মধ্যে সবুজ স্ফটিক বসানো। শেরশাহ নির্মিত কোনো প্রাসাদ বা জন ভবন আজ অবশিষ্ট নেই। কিল্লার বাইরে খায়ের-উল-মজলিস নামক সম্মিলিত মসজিদ ও মাদ্রাসা ১৫৬১ সালে মাহাম আনাগা নির্মাণ করেছিলেন। এর একটি চমৎকার তোরণ আছে। এই দুর্গের মধ্যে একমাত্র যে স্থাপত্যটি এখনও অক্ষত আছে সেটি একটি রাজকীয় উপাসনা গৃহ, যার নাম কিলা-ই কুহনা-মসজিদ। এর প্রধান গঠন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার মনোহর সম্মুখভাগ যেখানে পাঁচটি চমৎকার পরিমাপ সম্পন্ন পাঁচটি খিলানযুক্ত প্রবেশ পথ আছে। এই প্রতিটি তোরণ আবার একটি আয়তাকৃতি কাঠামোর মধ্যে স্থাপিত। কেন্দ্রীয় তোরণটি তার দুই পাশের তোরণগুলির থেকে বৃহত্তর। মধ্যেকার তিনটি খিলান-যুক্ত তোরণে সুন্দর পক্ষী-শোভিত জানালা আছে যেগুলি রাজস্থান শৈলীর স্থাপত্যের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। এর অন্যান্য সাজসজ্জা কিন্তু সাধাসিধা। সাদা পাথর বসানো এবং যার মধ্যে মধ্যে রঙিন স্ফটিক দিয়ে সজ্জিত। মসজিদের মধ্যেকার তোরণের দুই পার্শ্বে এবং পিছনের দেওয়ালের কোণে সরু বুরুজগুলি স্থাপত্যটির শক্তি বাড়ায়, আকবর লোদিদের ধরনে নির্মিত একক ছাদটির সন্তুলনও রক্ষা করে।
এই হর্ম্যগুলিকে লোদি গৃহনির্মাণ শিল্পের শেষ পর্যায় এবং একটি নতুন শৈলীর প্রাথমিক স্তর বলে গণ্য করা যেতে পারে।
আকবস্ত্রে সময় থেকেই প্রকৃত মুঘল স্থাপত্যের সূত্রপাত হয়েছিল বলা যায়। বৃহৎ পরিমাণে নির্মাণ শিল্প পরিচালনা করার মতো সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ ছাড়াও গৃহনির্মাণ কার্যে তিনি স্বয়ং উৎসাহী ছিলেন। আকবর ব্যক্তিগত ভাবে বহু নির্মাণ কার্যের তদারকি তো করতেনই এমনকি সময় সময় সেই কাজে হাতও লাগাতেন। সর্বোপরি, দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপত্য শিল্পের যেসব সূক্ষ্ম ঐতিহ্য বর্তমান ছিল, সেগুলিকে একত্রিত করাই ছিল তাঁর প্রধান চিন্তা।
আকবরের সময় দুইটি বিভিন্ন শৈলীর স্থাপত্যকর্ম একসঙ্গে দেশে প্রচলিত ছিল। প্রথমটি হল পারসিক ঘরানা, শাহ তাহমাসপ-এর দরবারে যার সঙ্গে হুমায়ুনের পরিচয় হয়। হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধে এই পারসিক ঘরানার পরিচয় পাওয়া যায়। তার বিধবা পত্নী হাজী বেগম সম্ভবত ১৫৬৪ সালে এর নির্মাণ শুরু করেন, যা সম্পূর্ণ হতে আট বৎসর কাল সময় লেগেছিল। এই বর্গাকার লাল বালিপাথরে নির্মিত সৌধটি একটি উচ্চ বেদীর উপর নির্মিত হয় এবং এর শীর্ষে সুন্দর সীমারেখা বিশিষ্ট শ্বেতপাথরের একটি গম্বুজ ছিল। এই গম্বুজটির কণ্ঠদেশ বা গলা একটু সরু কিন্তু গম্বুজটি ঊর্ধ্বাকাশে উঠে গিয়েছিল। একজন আধুনিক ঐতিহাসিক এস. কে. সরস্বতীর মতে এটি তৈমুরীয় স্থাপত্য থেকে একেবারে নকল না করা হোক, তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। পারসি ব্রাউনের মতে এটি একটি পারসিক চিন্তার ভারতীয় রূপায়ণ। সিকান্দার লোদির কবরের উপর যে জোড়া গম্বুজ দেখা যায়, ভারতে নির্মিত পারসিক স্থাপত্যের সেইটি প্রথম নিদর্শন হলেও, তখনও সেই শিল্পের ব্যবহার এদেশে পরিণত হয়ে ওঠেনি, অবশ্য পশ্চিম এশিয়ায় এই ধারা দীর্ঘদিন ধরেই পরিচিত ছিল। জোড়া গম্বুজ আকাশের গায়ে এক সুন্দর রূপরেখা এঁকে দিত এবং অভ্যন্তরের প্রকোষ্ঠের উপর এই ভিতরের ছাদটি যথেষ্ট মানানসই মনে হত।
পারসিক স্থাপত্যের দ্বিতীয় প্রভাব দেখা যায় গৃহের ভিতরে কক্ষগুলির বিন্যাসের মধ্যে। ভিতরে একটি ঘেরা জায়গার পরিবর্তে অনেকগুলি কক্ষ বারান্দার ধারে পর পর নির্মাণ করা হত এবং সেগুলি যাতায়াতের পথ দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত থাকত। তবে পূর্বেকার তুরস্কের গৃহগুলিতেও এই ধরনের বন্দোবস্ত দেখা যেত।
ভারতীয় স্থাপত্যের নিদর্শন হিসাবে বলতে গেলে সমগ্র ভবনটিই বেশ বড়ো তোরণ সমেত একটি যথাযথ বাগানের মধ্যে নির্মিত হত। গম্বুজটি কতকগুলি হালকা মিনারের উপরে গুজরাট ঘরানার অনুসরণ করে স্থাপিত হত। আবার মনোরম দালানগুলিই ছিল রাজস্থানী ঘরানার বৈচিত্র্য। চারদিকেই নির্মিত খিলানগুলি এবং সুন্দর সাদা পাথরের কাজ গৃহটিকে আরও মনোরম করে তুলত।
দিল্লিতে যখন হুমায়ুনের সমাধি নির্মিত হচ্ছিল, তখন আকবর আগ্রাতে সেই মহান দুর্গটি নির্মাণে ব্যস্ত ছিলেন এবং সেই সঙ্গে ২৬ মাইল (৪২ কি.মি) দূরে সিক্রিতে। একটি নূতন শহর ও প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপনও করছিলেন। ১৫৬৫ সালে শুরু হয়ে আগ্রার দুর্গ আট বৎসরে সম্পূর্ণ হয়। আগ্রার দুর্গের বিশাল গুলি চালাবার ছিদ্র সমন্বিত প্রাচীর, যুদ্ধ করার উপযুক্ত দেওয়াল, লাল বালিপাথরের তৈরি দুটি পরস্পর সংযুক্ত আটকৌন মিনার সমন্বিত প্রবেশদ্বার ইত্যাদি সম্বন্ধীয় যে গঠনশৈলী, পরবর্তীকালে আকবর লাহোর, আজমীর, এলাহাবাদ ইত্যাদি শহরে কেল্লা বানাবার সময় সেই স্থাপত্যই প্রয়োগ করেছিলেন। শাহজাহানের দ্বারা নির্মিত দিল্লির লালকেল্লাও আগ্রার দুর্গের ধরনেই গঠিত। আবুল ফজলের বক্তব্য অনুযায়ী আগ্রা কেল্লার অভ্যন্তরে আকবর বাংলা এবং গুজরাটের নির্মাণশৈলী অনুসারে লাল পাথরে গড়া পাঁচশোটির অধিক অট্টালিকা নির্মাণ করেন। যদিও নিজের মতো করে স্থাপত্য নির্মাণ করার জন্য শাহজাহান এই সমস্ত অট্টালিকার অধিকাংশকেই ধ্বংস করেছেন, তথাপি আকবরি মহল ও জাহাঙ্গিরি মহলের যে অংশটুকু এখনও আছে, তা থেকে আমরা আকবরের নিজস্ব স্থপতি শিল্পের কিছুটা অনুমান পাই। এই সমস্ত প্রাসাদের অধিকাংশরই ছাদ সমতল এবং কয়েকটি সুন্দর কারুকার্যময় স্তম্ভ এর ভার বহন করত। শোনা যায় যে গোয়ালিয়র দুর্গের মানমন্দিরের ধরনে এই প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল এবং রাজস্থানী। নির্মাণের অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য এর মধ্যে দেখা গিয়েছিল। যথা ভারী ও শক্তিশালী বালি-পাথরের বন্ধনী এবং ময়ূর ও সর্পের নকশা-সমন্বিত বারান্দা। দেওয়ালে এবং সিঁড়ির উপরে হাঁস, ফ্ল্যামিঙ্গো, পদ্মফুল–এছাড়া কিছু কল্পকাহিনির পশুপক্ষী যেমন ডানাওয়ালা ড্রাগন, অর্ধেক হাতি, পাখি ইত্যাদির রূপ খোদাই করা আছে।
সিক্রির বিশাল স্থাপত্য, গুজরাটে যুদ্ধ জয়ের পর যার নামে ফতেপুর রাখা হয়েছিল, তার নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৫৬৮-৬৯ সালে, যখন কাচ্ছাওয়াহা বেগম সেলিমকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। এর পরবর্তী ১৫ বৎসরে বহু রাজপ্রাসাদ এবং জনগৃহ এখানে নির্মিত হয়। এই সমগ্র উপনগরী একটি কৃত্রিম হ্রদের পাশে একটি পাহাড়ের উপর নির্মিত হয়েছিল। নীচেকার সমতল ভূমিতে নির্মিত একটি দেওয়াল সমগ্র প্রাসাদ নগরীটিকে বেষ্টন করে রেখেছিল, যেখানে বেশিরভাগ গৃহই আজ অদৃশ্য হয়ে গেছে। এইসব বিষয় ভালো করে লক্ষ না করেই পারসি ব্রাউন এই প্রাসাদভিত্তিক উপনগরীটিকে একটি শহর বলে ভুল করে বলেছিলেন, এই শহরে যথাযথ নগর পরিকল্পনার কোনো নিদর্শন নেই।’ এস. কে. সরস্বতীও এই একই ভুল করেছিলেন।
তিন খিলান-সমন্বিত একটি তোরণ দিয়ে এই প্রাসাদ নগরীতে প্রবেশ করতে হয়। যার নাম নওবত খানা। তারপর ডানদিকে অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাদশাহের কারখানা এবং টাকশালকে রেখে, এক বিশাল চত্বরে পৌঁছানো যায় যার নাম দিওয়ান–ই–আম। দিওয়ান-ই-আম-এর পেছনে ডান অর্থাৎ পশ্চিম দিকে গেলে একটি প্রাসাদ দৃষ্টিগোচর হবে যাকে লোকে দিওয়ান–ই–খাস বলে। কিন্তু আধুনিক গবেষণা মতে এটি প্রকৃতপক্ষে তামা, রুপা ও সোনার মুদ্রার তোষাখানা সমেত অনেকগুলি প্রাসাদের সমষ্টি। এই সব প্রাসাদের অনেক অংশ ভেঙে পড়েছে বা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর পাশের বাড়িটি, মানুষজন যাকে আঁক–মিছাউনি (লুকোচুরি) বলে, সেটিও তোষাখানারই একটি অঙ্গ বলা যায়।
দিওয়ান–ই–আম-এর পশ্চাতে একটি বিশাল চত্বরের পরেই যে দোতলা প্রাসাদটি দেখা যায় সেটি ছিল দৌলতখানা রাজপ্রাসাদ। এর একতলার ঘরগুলিকে গোপন মন্ত্রণাগৃহ বলা হয়। দোতলায় একটি অত্যন্ত সুসজ্জিত কক্ষ আছে যেখানে আকবর দুপুরে বিশ্রাম করতেন, বা তাকে সেখানে বই পড়ে শোনানো হত। সাধারণের জন্য নির্দিষ্ট গৃহগুলি থেকে রাজপ্রাসাদকে আড়ালে রাখবার জন্য একটি দেওয়াল নির্মাণ করা হয়, যা অবশ্য আজ ভেঙে গেছে। সম্রাটের প্রাসাদের সামনেই ছিল অনুপ তালাও যার মধ্যিখানে একটি বেদী নির্মাণ করা হয়েছিল। এখানে এবং নীচেরতলার ঘরগুলিতে আকবর মাঝেমধ্যে দার্শনিক তর্কসভা বসাতেন বা গানের আসরের আয়োজন করতেন। এখানেই দার্শনিকদের একটি খাটে বসানো হত, যেখান থেকে তারা আলাপ আলোচনা করতেন। অনুপ তালাওয়ের এক কোণে লাল বালিপাথরে তৈরি একটি ছোটো বর্গাকৃতি গৃহ ছিল যার দেওয়ালগুলি ছিল এত সুন্দর কারুকার্যময়। যে দেখে মনে হত সেটি যেন কাঠের তৈরি। এটিকে তুর্কি সুলতানার গৃহ বলা হলেও, সেই নামকরণ ছিল অবশ্যই ভুল–কেননা কোনো রাজকুমারী এত আব্রুহীন ঘরে থাকতে পারেন না। সম্ভবত এটি বিশিষ্ট অতিথিদের বিশ্রামস্থল ছিল, রাজকীয় হারেম বা মহিলামহল ছিল বাদশাহের প্রাসাদের এক পাশে। এর একটি স্বতন্ত্র রক্ষীগৃহ ছিল এবং একটি সুউচ্চ দেওয়াল সাধারণ গৃহগুলি থেকে একে আড়াল করে রাখত। সেই দেওয়ালটিও অবশ্য আর নেই। প্রাসাদের আরও পশ্চাতে জামা মসজিদের নীচে সমতলভূমিতে অবস্থিত শহর থেকে সোজাসুজি আসা যেত।
সুতরাং এই প্রাসাদনগরী পরিকল্পনা মাফিকই রচিত হয়েছিল। কৃত্রিম হ্রদের জল তুলে ব্যবহারের জন্য এবং ফোয়ারার জন্য ব্যবহৃত হত। সিক্রি প্রাসাদটিকে দুইভাগে ভাগ করা যায়, যথা ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ। ধর্মনিরপেক্ষ গৃহগুলি সর্দল (লিনটেল)-এর উপর নির্মিত। হারেম-এর মধ্যবর্তী একটি প্রাসাদকে যোধাবাইয়ের প্রাসাদ বলা হয়, যদিও যোধাবাই আকবরের স্ত্রী ছিলেন না, ছিলেন পুত্রবধূ। সম্ভবত এই প্রাসাদে বাদশাহের হিন্দু স্ত্রীরা বাস করতেন। এই বৃহদাকার প্রাসাদটিতে একটি বড়ো চত্বরের চারিদিকে কিছু কিছু ঘরের একটি করে সমষ্টি নির্মিত হয়েছিল। এটি একটি গৃহনির্মাণের পরম্পরা যা সাম্প্রতিক কালেও অনেক গৃহে প্রচলিত ছিল। এর ভূমি, স্তম্ভ এবং কারুকার্যময় উপরিভাগ সবই ছিল মন্দিরের স্তম্ভগুলির পরম্পরায় নির্মিত। এছাড়া এটি উপাসনা বা পূজাকক্ষও ছিল।
হারেম গৃহমণ্ডলীর মধ্যে আরও তিনটি গৃহ লক্ষণীয়। প্রথম প্রাসাদটিকে ভ্রমবশত বীরবলের প্রাসাদ বলা হয়। এই দোতলা বাড়িটির একতলার প্রবেশের ঢাকা পথটি নীল চতুর্ভুজাকৃতি স্ফটিকের দ্বারা শোভিত। আধুনিক সমালোচক এস. কে. সরস্বতীর মতে এটি বাসগৃহের একটি অপূর্ব নিদর্শন। এর পরিকল্পনা, স্থাপত্য ও সমতা অতুলনীয়। এর গঠনমূলক এবং শোভাবর্ধক উপাদানগুলি একে অন্যের সঙ্গে সুন্দরভাবে সমযোজী।
দ্বিতীয়টি হল সালিমের মাতা, কাচ্ছাওয়াহা রাজকুমারীর ছোটো অথচ অতীব সুসজ্জিত প্রাসাদ। এই মহিষীকে মরিয়ম-উজ–জামানি বা (পৃথিবীর মেরি বলে ডাকা হত)। এই কথাটি বহুদিন থেকেই বিশেষ অর্থবহ। এইসব ঘরের অভ্যন্তর ভাগ ছিল বৃহৎ সুন্দর দেওয়াল চিত্র দ্বারা সুশোভিত। যাদের মধ্যে অনেকগুলিই পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। বন্ধনীর উত্তরদিকে রাম এবং তাকে পূজারত হনুমানের একটি মূর্তি খোদাই করা আছে। অন্য বন্ধনীগুলিতে হংস, হস্তী ইত্যাদির মূর্তি দেখা যায়। গোড়ার কাছে যেগুলি ছিল অভিশপ্ত বস্তু।
তৃতীয় প্রাসাদটি হারেম গৃহসমষ্টির ঠিক ভিতরেই স্থাপিত এবং এর নাম পাঞ্চমহল। কিন্তু সাধারণ গৃহগুলির সঙ্গে এর মধ্যকার দেওয়ালটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। এটি একটি পাঁচতলা গৃহ যার ছাদটি ক্রমশ পিছনের দিকে সরে গেছে এবং প্রতি স্তরেই সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত স্তম্ভগুলি সেই অংশের ছাদটিকে ধরে রেখেছে। প্রতিটি স্তম্ভের অলংকরণ আবার পৃথক ধরনের। বৃহিরাগত সকলে বিদায় নিলে হারেমের মহিষীগণ এইখানেই মুক্ত হাওয়ায় বিশ্রাম নিতেন। যেসব শ্বেতপাথরের জাফরি মহিলাদের স্বাতন্ত্র রক্ষা করত লর্ড মেয়ো ১৮৯০ সালে ‘শোভাবর্ধনের জন্য সেগুলিকে ভেঙে দেন।
এই গৃহগুলি সৃজনমুখী এবং পরীক্ষমূলক স্থাপত্য ছিল বলে বোঝা যায়। এইদিক দিয়ে দেখতে গেলে গৃহের সবথেকে গুরুত্বপুর্ণ অংশকে দিওয়ান–ই–খাস, যা এখন রত্নগৃহ বলে পরিচিত। এটি একটি একক কক্ষ যার মধ্যে একক বৃহৎ এবং শক্তিশালী স্তম্ভ একটি বৃত্তাকার পাথরের মঞ্চকে ধরে রেখেছে। এই কেন্দ্রীয় মঞ্চ থেকে কয়েকটি পাথরের সেতুপথ ঘরের চারদিকে নির্গত হয়ে উপর থেকে ঝুলন্ত আসলগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। নানা প্রকার অলংকরণে সমৃদ্ধ যে মধ্যবর্তী স্তম্ভটি তৎসংলগ্ন বন্ধনীগুলি সহ কেন্দ্রীয় মঞ্চটিকে ধরে রেখেছিল সেটি একটি কাষ্ঠনির্মিত গুজরাটি স্তম্ভের প্রতিরূপ। এখানেও কল্পকথার প্রাণীদের ছোটো ছোটো মূর্তি খোদাই করা দেখা যায়।
সিক্রির সবথেকে সম্ভ্রম উদ্দীপক স্থাপত্যটি হল জামা মসজিদ। এই মসজিদের একটি অস্বাভাবিক বৃহৎ চত্বর আছে। এর পুণ্য কক্ষটির কয়েকটি খিলান-যুক্ত প্রবেশপথ ছিল, গৃহটির সমগ্র কার্নিশ বরাবর ছিল স্তম্ভস্থাপিত চাতালসহ অনেকগুলি গম্বুজ এবং চত্বরে একটি খিলান দ্বারা আচ্ছাদিত পায়ে চলা পথ, যেখানে বিভিন্ন ধরনের স্তম্ভ এবং অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। পারসিব্যারন বলছেন, ‘অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে এই পুণ্যস্থানটির পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করা হয়েছে, তাই থেকে এই মসজিদটি তার সুন্দর নিজস্বতা লাভ করেছে।’ এই চত্বরেই সুন্দরভাবে নির্মিত পাথরের জাফরিসহ মহাত্মা শেখ সেলিম চিস্তির কবর আছে। বাইরের দিকের শ্বেতপাথরের বারান্দাটি শাহজাহান পরে নির্মাণ করেন।
মসজিদের একদিকে একটি বিশাল তোরণ সোপানশ্রেণির সম্মুখে দণ্ডায়মান। এই সেই বিখ্যাত বুলন্দ দরওয়াজা (সুউচ্চ তোরণ) যা ১৫৭৩ সালে গুজরাট জয়ের পর আকবর নির্মাণ শুরু করেন। এই তোরণটি অর্ধগম্বুজাকৃতি প্রবেশ পথের একটি নিদর্শন। প্রকৃতপক্ষে একটি গম্বুজকে দ্বিখণ্ডিত করে নির্মাণ করার ফলে গম্বুজের খণ্ডটি তোরণের বিশাল বহির্মুখী সম্মুখভাগের রূপ ধারণ করেছে। আবার পেছনের দেওয়ালে যেখানে গম্বুজ মেঝের সঙ্গে মিশেছে সেখানে ক্ষুদ্রতর দরজাগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। ইরান থেকে সংগৃহীত এই স্থাপত্যটি ভবিষ্যতে অন্যান্য মুঘল প্রাসাদে ব্যবহত হয়েছে। তোরণের সম্মুখভাগের নীচু দেওয়ালটির উপর অনেকগুলি ছোটো গম্বুজ সহ ছত্রি ছিল এবং সেই গম্বুজগুলি আকাশরেখাকে যেন খণ্ডে খণ্ডে ভাগ করে দিচ্ছিল। এই বিশাল তোরণটি অবশিষ্ট প্রাসাদটিকে অনুপাত বহির্ভূত ভাবে ক্ষুদ্র প্রতিপন্ন করে দেওয়া সত্ত্বেও ফতেপুর সিক্রি একটি অতি চিত্তাকর্ষক স্থাপত্য–যা মনে শ্রদ্ধা-মিশ্রিত ভয়ের উদ্রেক করে।
সাম্রাজ্য ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত হবার সঙ্গে সঙ্গে মুঘল স্থাপত্য তার চরম উৎকর্ষে পৌঁছায়। জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালের শেষ পর্যায়ে সম্পূর্ণভাবে শ্বেতপাথবের তৈরি প্রাসাদ সৃষ্টির ব্যবস্থা শুরু হয়। এইসব গৃহের দেওয়ালগুলি আবার বহুমূল্য পাথর দিয়ে প্রস্তুত ফুলের নকশা দিয়ে সুশোভিত করা হত। এই ধরনের অলংকরণ, যাকে বলা হত ‘পিএট্রা ডিউরা’, জাহাঙ্গিরের সময়ে নির্মিত ইতমাদ-উদ-দৌলার ছোটোখাটো সমাধিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এই ধরনের আয়তাকার গৃহের বিশেষ অনুষঙ্গ ছিল গৃহের চারকোণে সুন্দর গম্বুজ সম্পন্ন আটকোনা মিনার। আকবরের নিজের সমাধির সূত্রপাত তিনি নিজে করলেও শেষ অবশ্য জাহাঙ্গির করেছিলেন। সেই সমাধিতে কোনো গম্বুজ ছিল না, কেবল সমতল ছাদের উপর একটি ছোটো খিলানে ঢাকা পথ ছিদ্রযুক্ত নানারঙের পর্দার দ্বারা সুশোভিত করা হয়েছিল।
নির্মাণ শিল্পের রত্ন বলে বিবেচিত তাজমহলের মধ্যে স্থাপত্যশৈলীর যেসব ধারা মুঘলরা অন্যদের কাছ থেকে গ্রহণ করে শেষপর্যন্ত নিজেদের করে নিয়েছিল সেসবই অত্যন্ত মনোজ্ঞভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, স্মৃতিসৌধটিকে যথাযথ ভাবে নির্মিত উদ্যানের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেই উদ্যানে ফোয়ারা আছে। আছে স্রোতস্বিনী জলপ্রবাহ। সমাধি গৃহটিকে দৃঢ়তা প্রদান করার জন্য একটি উঁচু বেদীর উপর এটিকে স্থাপন করা হয়েছে, যার জন্য আকাশের পটভূমিকাটি আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। সর্বশেষে অর্ধ গোলাকৃতি প্রবেশ পথটি সমাধিসৌধের ভিতরে আসার ব্যবস্থাটিকে সুন্দর করে তোলে। তবে বিশাল গম্বুজটি এবং বেদী বা মঞ্চটিকে মূল গৃহের সংযোগ-রক্ষাকারী চারটি লম্বা ও কৃশ মিনারকেই একযোগে তাজমহলের মুখ্য গৌরব বলা যায়। সৌধের অঙ্গসজ্জাকে যথাসম্ভব সীমিত করে রাখা হয়। কেবল হালকা শ্বেত জাফরি পিএত্রা ডিউরা খোদাই কর্ম এবং ছত্রিগুলিকে এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
তাজমহল দেশের রাজকীয় স্থাপত্যশিল্পের যুক্তিসঙ্গতভাবে গড়ে ওঠা সর্বোচ্চ সীমা। এই সত্যটিই সেই কথাটিকে অপসারণ করতে সক্ষম। যেখানে বলা হয়েছে যে। একজন ইতালীয় জেরোমিমো ভেরোসে তাজমহলের নির্মাণশিল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন। অন্য যেসব স্থপতির কথা বলা হয়েছে তারা হলেন লাহোরের স্থপতি উস্তাদ ইসা এফেন্দি ও উস্তাদ আহমাদ। তাজমহলের নির্মাণ কার্য সম্বন্ধে যে বিশদ পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে তার থেকে জানা যায় যে শাহজাহান তাকে পরামর্শ দেবার জন্য বিশেষজ্ঞদের একটি সমিতি গঠন করেছিলেন এবং নকশা প্রস্তুতকারীরা তাদের পরিকল্পনা কাগজে-কলমে বাদশাহকে নিবেদন করতেন। এই সমাধি সম্বন্ধে শাহজাহানের নিজস্ব কিছু পরিকল্পনা ছিল তাই তিনি কয়েকটি মূল্যবান প্রস্তাবও রাখতে সক্ষম হন। উভয়ের মতামতের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি কাষ্ঠ-নির্মিত নমুনা প্রস্তুত হয়। এবং সর্বসম্মত যে কাঠের নমুনা, তার ভিত্তিতেই এই প্রস্তরনির্মিত সমাধি ভবনের নির্মাণ শুরু হয়।
তাহলে এর থেকে এই তত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত হয় যে মুঘল চিত্রকলার মতো তাজমহলের পরিকল্পনাও ব্যক্তিগত ভাবে বা একক ভাবে, কেউ করেননি। এটি ছিল একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এইভাবেই জানা গেছে যে আমানত খান শিরাজী ছিলেন হস্তলিপি শিল্পী, এবং ইসমাইল খান গম্বুজ নির্মাতা। আমরা ই. বি. হ্যাঁভেলের সঙ্গে সহমত হতে পারি যে ‘তাজ’ ‘ভারতীয় শিল্পচেতনা থেকে উদ্ভূত একটি জৈব উত্থান। বা ভারতীয় শিল্পচেতনার একটি জীবন্ত প্রকাশ। তাজ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বা কোনো একক উদ্ভাবকের সৃষ্টিও নয়। তাজ শিল্পসৃষ্টির এক মহান পরস্পরের চূড়ান্ত উৎকর্ষ।
শাহজাহানের সময় মসজিদ নির্মাণও এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তাঁর স্থাপিত সবথেকে লক্ষণীয় দুটি মসজিদ হল আগ্রা দুর্গের সন্নিকটে তাজমহলের মতো। শ্বেতপাথরে নির্মিত মোতি মসজিদ এবং দিল্লির লাল বালিপাথরের তৈরি জামা। মসজিদ। জামা মসজিদের বিশিষ্ট অঙ্গ বলতে এর সুউচ্চ তোরণ, দীর্ঘ পেলব মিনার-সমূহ এবং অনেকগুলি গম্বুজের সমাহারের করা উল্লেখ করা যায়।
শাহজাহানের নির্মিত দিল্লির লালকেল্লা যেমন তার রঙমহলের জাল দেওয়া বিচারের দাঁড়িপাল্লার জন্য বিখ্যাত, তেমনি স্থাপত্যগত ভাবে সমতল ছাদ যুক্ত। দিওয়ান–ই–আম-ই সর্বাপেক্ষা চিত্তকক, যেখানে হিন্দু স্তম্ভস্থপতির সবটুকু নৈপুণ্য ব্যবহার করে যাতে সিংহাসন থেকে পরিষ্কার ভাবে স্তম্ভের মধ্য দিয়ে সব কিছু দৃষ্টিগোচর হয়, তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বহু পত্ৰ সুশোভিত বিলানগুলি ঢেউ খেলানো জলের ধারণা সৃষ্টি করে।
এইভাবে আমরা শাহজাহানের লালকেল্লার প্রাসদগুলিতে ধনুকের মতো বক্রাকার এবং trabeate উভয় ধরনের স্থাপত্য দেখতে পাই।
যদিও অর্থব্যয় সম্বন্ধে সচেতন ঔরঙ্গজেব খুব বেশি প্রাসাদ নির্মাণ করেননি। কিন্তু হিন্দু এবং তুর্ক-ইরানি শিল্পকলার মিশ্রণ-ভিত্তিক মুঘল স্থাপত্যের পরম্পরা নানা অলংকরণে সুশোভিত হয়ে অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এইভাবে বহু প্রাদেশিক এবং স্থানীয় রাজ্যের প্রাসাদ এবং দুর্গগুলিতে এই মুঘল স্থাপত্যের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এমনকি শিখদের হরমন্দির বা অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির যা এই সময়কালে বহুবার পুনর্নির্মিত হয়, তাও মুঘলদের খিলান ও গম্বুজশৈলীর উপরে গঠিত এবং এর মধ্যে মুঘল স্থাপত্যের আরও বহু চিহ্ন দেখা যায়। এখানে যা লক্ষণীয় যে এই স্থাপত্যগুলিতে কিছু হিন্দু শৈলী এবং কিছু ইসলাম শৈলী থাকা সত্ত্বেও এর মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়নি। শাসকেরা যে সমস্ত অনুষঙ্গকে কার্যকরী এবং শিল্পসম্মত মনে করেছেন সেইগুলিকেই ব্যবহার করেছেন। তাদের সৌন্দর্যবোধ এবং ভারতীয় কারুশিল্পের দক্ষতা উভয় মিলে যে সম্মিলিত ধারার সৃষ্টি করেছিল তা ছিল একাধারে লাবণ্যময় এবং দৃষ্টি মুগ্ধকর।
চিত্রকলা
মুঘল ধারার চিত্রাঙ্কন ধীর নিশ্চিতভাবে কালক্রমে একটি স্বতন্ত্র শৈলীর চিত্রশিল্প বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রগাঢ় ঐতিহ্যসম্পন্ন এই চিত্রকলা ১৭শ শতাব্দীতে সম্পূর্ণভাবে পরিণত হয়। এই কলা চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে এক জীবন্ত পরম্পরার সৃষ্টি করে, যা মুঘল গৌরব অস্তমিত হবার পরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে প্রচলিত থাকে।
কোনো কোনো সংস্কৃত ও সাহিত্যকর্মে চিত্রকলার উল্লেখ আছে এবং অজন্তার গুহাশিল্প প্রাচীন ভারতে অঙ্কন শিল্পের ঐতিহ্যের পূর্ণ নিদর্শন। ৮ম শতাব্দী থেকে এই ধারার ক্ষয় শুরু হয়, যদিও তালপাতায় আঁকা কিছু জৈন চিত্রকলা থেকে বোঝা যায় যে, তখনও এই অঙ্কনশৈলী প্রচলিত ছিল। ১৩শ শতাব্দীতে কাগজের প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এখন শিল্পী ইচ্ছামতো বিভিন্ন রং ব্যবহার করার স্বাধীনতা পায় এবং ছবি আঁকার উপযোগী আরও অধিক স্থান বা ক্ষেত্রও তার আয়ত্তে আসে। ‘অনুশিল্পগুলির অঙ্গে, রচনা বৈচিত্রে, নকশা বা অলংকরণে এবং সাজসজ্জার খুঁটিনাটিতে উন্নতির লক্ষণ ফুটে উঠতে লাগল।তবে এই পরিবর্তন বা উন্নতি কিন্তু ছিল ধীরগতি এবং অনিশ্চিত। একমাত্র গুজরাট ও মালব, এই দুইটি অঞ্চলের চিত্রশিল্পে প্রচুর উন্নতি দেখা যায়।
আমির খসরু বলেছিলেন বটে, যে শাসকশ্রেণির সদস্যরা তখন অঙ্কন শিল্পের চর্চা করতেন, তবে সুলতানি আমলের চিত্রকলার কোনো পাণ্ডুলিপি আমাদের কাছে নেই। ফিরুজ তার প্রাসাদের দেওয়াল চিত্রগুলি মুছে দিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে পারস্যের শিরাজে একটি সমৃদ্ধ চিত্রকলার একটি ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। চিনা চিত্রকলার দ্বারা এই শৈলীটি প্রভাবিত হয়েছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন গুজরাট, মালব এবং শোনপুরের মতো প্রাদেশিক রাজ্যগুলি ললিতকলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক এবং সহায়ক রূপ আত্মপ্রকাশ করে তখন শিল্পী, সাহিত্যিক ইত্যাদিরাও শিরাজ থেকে এই রাজ্যগুলিতে আগমন করলেন। সুতরাং পারসিক এবং পশ্চিম-ভারতীয় শ্রেণির শিল্পধারার প্রথম সম্পর্ক পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্থাপিত হয়। এর শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ হল ‘নিয়ামত-নামা’ বা রান্নার বই। মাণ্ডুতে এই পুস্তিকাটি চিত্রায়ণের সময়ে একটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট ভারতীয় শরীরের পার্শ্বরেখা প্রথাগত পারসিক রীতিতে অঙ্কিত গাছপাতার পশ্চাদপটের উপর মেলে ধরা হয়েছে।
মুঘলরীতির অঙ্কন শিল্পের সূত্রপাত কাবুলেই হয়েছিল এবং প্রসঙ্গত ১৫০৪ সালে বাবরের কাবুল জয়ের পূর্বেই কাবুল ছিল একটি প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বাবরের পূর্বকালে কাবুলের তৈমুর প্রশাসক উলুঘ বেগ (২) চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বাবর এবং কামরাজ উভয়েই পরস্পরকে অনুসরণ করেন। হুমায়ুন এই শিল্পধারাকে শুধু অগ্রসরই করাননি, একে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন। হুমায়ুনের পারস্যে নির্বাসনের সময় সুদক্ষ শিল্পী বিহজাদ তার খ্যাতির চরমসীমায় পৌঁছান। হুমায়ুনও তার অনেক শিষ্যকেই সর্বতোভাবে সহায়তা করেন। তাদের মধ্যে দুইজন, যথাক্রমে মির সৈয়দ আলি এবং আবদুস সামাদ হুমায়ুনের সঙ্গে আফগানিস্তানে যোগাযোগ করেন এবং পরে তার সঙ্গে দিল্লি এসে পৌঁছান।
১৫৬৭ সালে আকবর হামজা নামা নামক একটি গ্রন্থের পারসিক ভাষায় অনুরাদের একটি অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণ চিত্রমালায় শোভিত পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করার আদেশ দেন। হামজা নামা রূপকথার নায়কের মতো একজন ব্যক্তিত্বের (যিনি পয়গম্বরের কোনো আত্মীয়, নন) উপর রচিত একটি আরব মহাকাব্যের নাম হামজা নামা। সায়িদ আলি এবং আবদুস সামাদের নেতৃত্বে গোয়ালিয়র, গুজরাট, লাহোর, কাশ্মীর, মালব ইত্যাদি দেশ থেকে প্রায় ১০০ জন শিল্পীকে এই অঙ্কনকার্যের জন্য নিয়ে আসা হয়। একহাজার চারশতটি মহার্ঘ চিত্র এই শিল্পীরা অঙ্কন করেন এবং এই অঙ্কন কার্য সম্পন্ন করতে পনেরো বছর লেগেছিল। বহু ভারতীয় শিল্পী এই সময় চিত্রশিল্পে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এই সময়ে আরও অনেক পাণ্ডুলিপিতেও চিত্রাঙ্কণ কার্য সম্পন্ন করা হয়। এইভাবে আনোয়ার সুহেলী মহাভারত এবং রামায়ণের মতো মহাকাব্য, চেঙ্গিসনামা, আকবরনামার মতো ঐতিহাসিক গ্রন্থ ইত্যাদির পাণ্ডুলিপিতে চিত্রাঙ্কন কার্য সম্পন্ন করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত এই সমস্ত পাণ্ডুলিপির অনেকগুলিই বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং বাকিগুলি প্রিন্স অফ ওয়েলস মিউজিয়াম, জন রাইল্যাভ গ্রন্থাগার ইত্যাদি ব্রিটিশ পাঠাগারে এবং অন্যত্র বহু গ্রন্থাগারে ছড়িয়ে গেছে। এরকম অনেক
সচিত্র পাণ্ডুলিপি অধুনা বস্টন সংরক্ষণাগারের (মিউজিয়ামে) মতো আমেরিকারও বহু সংরক্ষণাগারে পাওয়া গেছে। এর ফলে মুঘল চিত্রকলার চর্চা কঠিন এবং পরিশ্রমসাধ্য হয়ে উঠেছে।
চিত্রাঙ্কন আকবরের বিশেষ প্রিয় ছিল এবং তাঁর রাজত্বকালে বহু রাজকীয় কর্মশালায় চিত্রাঙ্কনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই সংস্থাগুলিকে কারখানা বলা হত। আবুল ফজল বলেছেন যে মহামহিম শাহেন শাহ তার একেবারে প্রথম যৌবন থেকেই চিত্রকলার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন এবং এই কলার চর্চাকে তিনি নানাভাবে উৎসাহিত করে গেছেন। প্রথম থেকেই মুসলিম ও হিন্দু উভয় ধর্মেরই শিল্পীগণ কাজে যোগদান করেন। তাই দেখা যায় যে আবুল ফজলের উল্লিখিত ১৭ জন অঙ্কনশিল্পীর মধ্যে ১৩ জনই হিন্দু ছিলেন। কোনো কোনো হিন্দু নিম্নবর্গের লোক ছিলেন। যথা পালকিবাহক দাসওয়ান্ত, কিন্তু তিনি আকবরের চোখে পড়ে যান ও তার শিক্ষা লাভের সুযোগ মেলে। এই সব শিল্পীরা মাসিক বেতন তো পেতেনই এবং তাদের কার্যের উৎকর্ষের উপর ভিত্তি করে বাদশাহ তাদের বিশেষ পুরস্কারও দিতেন। কেননা এদের সমস্ত চিত্রকর্ম নিয়মিতভাবে বাদশাহের নিকট প্রদর্শিত হত। তাদের যা যা প্রয়োজন তা দরবারের পক্ষ থেকে দেওয়া হত। রঙের সংমিশ্রণের উন্নতিসাধন করার চেষ্টাও করা হয়েছিল।
সেই সময়কার কোনো কোনো গোঁড়া মনোভাবাপন্ন ব্যক্তি এই চিত্রকলাকে ইসলাম-বিরোধী বলে আপত্তি জানাতেন। তাদের আপত্তির জবাব দিয়ে আবুল ফজল বলেছিলেন যে অঙ্কনকার্যে নিযুক্ত শিল্পী এবং অন্যেরা ঈশ্বরকে চিনতে পারেন। কেননা যখনই তারা জীবন্ত বস্তু বা প্রাণী চিত্রাঙ্কন করতেন তখনই তাদের এই উপলব্ধি হত যে একমাত্র ঈশ্বরই তাদের বিশিষ্টতা দিয়েছেন। যাতে করে একটিকে অন্যটির থেকে পৃথক বলে চেনা যায়।
এই শিল্পীদের সৃষ্টিক্ষেত্র ছিল বিশাল। যুদ্ধ, শিকারের দৃশ্য, রূপকথার প্রাণীকুল, নির্মাণকার্য ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়েই তারা চিত্রাঙ্কন করেছেন। ব্যক্তিবিশেষের স্থিরচিত্র আর-একটি জনপ্রিয় বিষয় ছিল। আকবর তাঁর রাজত্ব কালের সকল অভিজাতদেরই চিত্র প্রস্তুত করার আদেশ দেন। তিনি নিজেও তার নিজের চিত্র অঙ্কনের জন্য শিল্পীর সামনে উপবেশন করেছেন। আবুল ফজল-এর মতে বাসাওয়ান মুখ, চোখ ইত্যাদি প্রত্যঙ্গ, স্থিরচিত্র অঙ্কন এবং আরও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিল। তবে কোনো একটি বিষয় নিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল না বললেই হয়। একটি চিত্র সম্পন্ন করতে দুজন এমনকি তিনজন শিল্পীও প্রয়োজন হত। কেউ হয়তো অবয়বের রেখাচিত্র বা পরিলেখ অঙ্কন করল, দ্বিতীয়জন রঙের প্রয়োগ করল এবং তৃতীয় শিল্পী মুখমণ্ডলকে চিত্রায়িত করল। প্রথম ছবিতে যে রেখাচিত্র অঙ্কন করল, পরের ছবিতে তাকে হয়তো রঙের কাজ করতে বলা হয়। এবং মুখ যিনি অঙ্কন করেছিলেন, তাকে হয়তো শরীরের রেখাকে ফুটিয়ে তুলতে বলা হল। জাহাঙ্গির পরে বলেছিলেন যে ছবি দেখে তিনি বলতে পারেন কে শরীরের রেখাবয়ব সৃষ্টি করেছে, কে রং লাগিয়েছে বা কে মুখাবয়ব অঙ্কন করেছে।
যদিও বেশিরভাগ চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল মিশ্র প্রকৃতির, তা সত্ত্বেও শিল্পীদের ধারার পার্থক্য এইসব চিত্রের থেকেও বোঝা যেত, সব মিলিয়ে বলতে গেলে আকবরের। সময় ভারতীয় চিত্রকলা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতীয় চিত্রকলার নমনীয় গোলাকৃতি বা বক্ররেখা বহুল ধরনের ব্যবহার শুরু করে পারসিক চিত্রকলার ধারার কঠোরতা থেকে শিল্প সৃষ্টি মুক্ত হয়। এর ফলে পূর্বেকার সমতলে ন্যস্ত ত্রিমাত্রিক চরিত্র থেকে মুক্ত হয়ে ভারতীয় বৃক্ষ ও পুষ্প, ভারতীয় গৃহ রূপ ইত্যাদিও বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। তাছাড়া ময়ূরকণ্ঠী, ভারতীয় লাল ইত্যাদি ভারতীয় বর্ণও ব্যবহৃত হতে শুরু হয়।
জাহাঙ্গিরের সময়কালে মুঘল চিত্রকলা চরম উৎকর্ষে উপনীত হয়। জাহাঙ্গিরের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অতি তীক্ষ্ণ। যুদ্ধ, শিকার এবং দরবারের দৃশ্য ছাড়াও। জাহাঙ্গিরের সময় প্রতিকৃতি অঙ্কন, পশু-পক্ষী গাছপালা ও ফুল ইত্যাদি চিত্রকল্পেও প্রভূত উৎসাহ দেখা যায়। এক্ষত্রে মনসুরের নাম ছিল বিখ্যাত।
আকবরের সময় পর্তুগিজ যাজকেরা তার দরবারের ইউরোপীয় শিল্পকলার প্রবর্তন করেন। আবুল ফজল ইউরোপীয় ধারার চিত্রাঙ্কনের প্রশংসা করেছেন। ইউরোপীয় পদ্ধতির প্রভাবেই রেখাগুলিকে ছোটো করার রীতির চর্চা শুরু হয়। এর প্রভাবে নিকটের এবং দূরের বস্তুগুলিকে যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে রাখা সম্ভব হয় এবং বস্তুগুলি অনেক স্বাভাবিক দেখায়। তবে ভারতীয় শিল্পীরা কখনোই পরিপ্রেক্ষিতকে সঠিক দেখাতে পারেননি। দূরবর্তী বস্তুগুলির রেখাগুলিকে ছোটো করে দেখানোর পদ্ধতির পরিবর্তে প্রায়ই খাড়াভাবে দেখানো হত। আগে যে পাখির চোখে দেখা দৃশ্যের। পদ্ধতিতে (অর্থাৎ অনেক উঁচু থেকে যেমন দেখায়) বিভিন্ন স্তরবর্তী বস্তুকে একই ছবিতে দেখানো হত, তার পরিবর্তে এখন বৃত্তাকার ভাবান্তরের প্রয়োগ শুরু হয়।
পশু-পক্ষী ইত্যাদির বিশেষ প্রাণোচ্ছল চিত্রাঙ্কন সত্ত্বেও মুঘল চিত্রকরেরা কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে কাজ করেননি। তবে অনেক শিকার বা যুদ্ধের ছবির পটভূমিকায় গাছ, পাখি, প্রস্রবণ, ছোটো পাহাড় ইত্যাদির ব্যবহার করা হয়েছে। এর একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল গাছের গুঁড়ির ব্যবহার, যার দ্বারা ছবিতে বৃত্তাকার রূপ ছাড়াও চিত্রে একটি নতুন সুর জেগে উঠত।
শাহজাহান চিত্রাঙ্কনের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও জাহাঙ্গিরের মতো তার চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য বোধের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাই এই সময়ে প্রচুর দরবারের দৃশ্য এবং সোনালি রঙের পর্যাপ্ত ব্যবহার দেখা যায়।
চিত্রশিল্পে ঔরঙ্গজেবের উৎসাহের অভাবের জন্য শিল্পীরা দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়েন। এর ফলে রাজস্থান এবং পাঞ্জাবের পার্বত্য অঞ্চলে অঙ্কনশিল্পের প্রচুর উন্নতি হয়।
রাজস্থানী চিত্রকলায় পশ্চিম ভারতের বা জৈন রীতির পূর্বেকার চিত্রভাবনার সঙ্গে মুঘল রীতি ও বিন্যাসের মেলবন্ধন ঘটে। তাই শিকার ও রাজসভার চিত্র ছাড়াও অনেক পৌরাণিক বিষয় রাজস্থানী চিত্রকলায় রূপায়িত হয় যথা, কৃষ্ণ-রাধার লীলা, বারমাসা, অর্থাৎ ঋতুরঙ্গ, এবং সুরের রূপ। পাহাড়ি চিত্রকলাও এই ধারাই বহন করে।
ভাষা ও সাহিত্য
চিন্তা প্রকাশ করার মাধ্যম হিসাবে বা সরকারি কাজকর্মে পারসিক (ফারসি) এবং সংস্কৃতের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা এবং আঞ্চলিক ভাষাগুলির বিকাশ সম্বন্ধে আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। আঞ্চলিক ভাষাগুলি প্রধানত ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল। এছাড়া স্থানীয় এবং আঞ্চলিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা সুবাদেও এই সব স্থানীয় ভাষার উন্নতি সাধন সম্ভব হয়।
১৬শ ও ১৭শ শতাব্দীতে ও এই ধারা প্রচলিত ছিল। আকবরের সময়কালের মধ্যে সমগ্র উত্তর ভারতে ফারসি এত বহুল প্রচারিত হয়ে পড়ে যে ফারসি ছাড়া স্থানীয় ভাষা হিন্দাভিতেও রাজস্বের হিসাবপত্র রাখার যে বহুদিনের রেওয়াজ ছিল, আকবর তা বন্ধ করে দেন। তবে ১৭শ শতাব্দীর শেষ ভাগে তাদের অবলুপ্তি ঘটা পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলিতে স্থানীয় ভাষায় রাজস্ব কাগজপত্র রাখার অভ্যাস অব্যাহত ছিল।
আকবরের রাজত্বকালে ফরাসি গদ্য সাহিত্য এবং পদ্য তার সর্বোচ্চ সীমায় উপনীত হয়। বিখ্যাত পণ্ডিত ও রমনীয় লেখনভঙ্গির অধিকারী এবং সেই সময়কার অগ্রণী ইতিহাসবিদ আবুল ফজল গদ্য রচনার যে চিত্তকাৰ্ষক পদ্ধতির সূচনা করেন, পরবর্তী বহু প্রজন্মের লেখকেরাও তার অনুসরণ করে চলেছেন। তাঁর ভ্রাতা ফৈজী ছিলেন সে যুগের প্রধান কবি এবং তিনি আকবরকে অনুবাদ কার্যেও বহু সাহায্য করেছেন। তার তত্ত্বাবধানেই মহাভারতের অনুবাদ সম্পন্ন হয়। অন্য দুইজন অগ্রণী ফারসি কবির নাম ছিল উৎবি এবং নাসিরি। পারস্যে জন্ম হলেও তারা আরও অনেক কবি ও জ্ঞানী ব্যক্তির সঙ্গে অভিবাসী রূপে ভারতে বসতি স্থাপন করেন এবং তাদের উপস্থিতিতে মুঘল দরবার ইসলামি দুনিয়ার অন্যতম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রূপে মর্যাদা পায়। পারসিক সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে হিন্দুদেরও অবদান ছিল। এই সময়কালে ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম ছাড়াও পারসিক বা ফারসি ভাষায় কয়েকটি বিখ্যাত অভিধানেরও গ্রন্থনা করা হয়।
এই সময়ে সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ কোনো মৌলিক ও লক্ষণীয় কাজ না হলেও, সংস্কৃতে প্রকাশকের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য। পূর্বেকারের বেশিরভাগই স্থানীয় শাসকদের আনুকূল্যে দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে লিখিত হলেও কয়েকটি আবার বাদশাহের অনুবাদ বিভাগে কর্মরত ব্রাহ্মণদের দ্বারাও লিখিত হয়েছিল।
স্থানীয় ভাষাগুলির প্রয়োজন ছিল স্থিতিশীলতা। এবং এই সময়ে কয়েকটি শ্রেষ্ঠতম পর্যায়ের কাব্য রচিত হয়। এই সময়কার বাংলা, ওড়িয়া, হিন্দি, রাজস্থানি এবং গুজরাটি কবিতায় প্রধানত রাধা-কৃষ্ণ ও গোপীদের লীলাখেলা, শিশু কৃষ্ণের দুষ্টুমি এবং ভাগবত পুরাণের কাহিনিগুলিই স্থান পেত। রামের উদ্দেশ্যে অনেক স্তোত্র রচনা ছাড়াও আঞ্চলিক ভাষায় রামায়ণ ও মহাভারতের অনুবাদও সম্পন্ন হত, বিশেষ করে যদি সেগুলো সেই ভাষায় পূর্বে অনুবাদ না হয়ে থাকে। পারসিক ভাষা থেকে কিছু গ্রন্থের অনুবাদ বা ভাব গ্রহণও করা হত এবং এই ভাষান্তর কার্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই অংশ নিয়েছিল। আলাওল বাংলায় রচনা করতেন এবং ফারসি থেকে অনুবাদও করতেন। সুফি সাধু মালিক মহম্মদ পদ্মাবতী নামে হিন্দিতে যে রচনা সম্পন্ন করেন, তাতে আলাউদ্দিন খলজির চিতোর আক্রমণের ঘটনাকে আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কের সুফি মতবাদকে প্রচার করার জন্য একটি প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করা হয় এবং হিন্দুদের মায়াবাদকেও বিধৃত করা হয়।
মধ্যযুগে, বিশেষ করে আগ্রার সমীপবর্তী অঞ্চলে ব্রিজ ভাষা নামে যে কথ্য হিন্দি প্রচলিত ছিল, মুঘল বাদশাহ এবং হিন্দু শাসকেরা তাকেও উৎসাহ প্রদান করেন। আকবরের সময় থেকেই হিন্দু কবিরা মুঘল দরবারে আসন পেতেন। আবদুর রহিম খান-ই-খান্নান নামক একজন অগ্রণী মুঘল অভিজাত জীবন ও মানবিক সম্পর্ক-ভিত্তিক পারসিক দর্শনের সঙ্গে হিন্দু ভক্তিবাদ মিলিয়ে একটি সুন্দর কাব্য রচনা করেন। এইভাবে ফারসি এবং হিন্দি সাহিত্য-পরম্পরা একে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তবে এই সময়ে সবথেকে প্রভাবশালী হিন্দি কবি ছিলেন তুলসীদাস। রাম তুলসীর মহাকাব্যের নায়ক ছিলেন এবং তাঁর রচনায় তিনি উত্তরপ্রদেশের পূর্বভাগের কথ্য ভাষা ব্যবহার করেন। তুলসী দাস প্রকৃতপক্ষে এক মানবতাবাদী কবি ছিলেন। যিনি সাংসারিক আদর্শকে তুলে ধরতেন। তুলসী দাসের মতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্যই রামের প্রতি অখণ্ড ভক্তিই মোক্ষলাভের পথ।
দক্ষিণ ভারতে নিজ অধিকারেই মালায়ালম ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। একনাথ এবং তুকারামের হাত ধরে মারাঠি ভাষা তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। মারাঠির গুরুত্ব সম্বন্ধে জোর দিয়ে তুকারাম বলেন সংস্কৃত ভাষা যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তাহলে প্রাকৃত ভাষাকে কি চোর আর জুয়াচোরেরা জন্ম দিয়েছিল? এই সমস্ত অহঙ্কারের কথা ছেড়ে দিয়ে আমরা বলি যে ঈশ্বর কোনো ভাষার প্রতিই পক্ষপাতিত্ব করেন না। তার কাছে সংস্কৃত ও প্রাকৃত উভয়েই সমান। আমার ভাষা মারাঠি সর্বোচ্চ অনুভবকে প্রকাশ করতে সমর্থ। এই ভাষা সমৃদ্ধশালী, ঐশ্বরিক জ্ঞানের ফল ভারে পরিপূর্ণ।
এই উক্তিটির মধ্য দিয়ে সমস্ত স্থানীয় ভাষার লেখকদের মনোভাব নিঃসন্দেহে ব্যক্ত হয়। এর দ্বারা এই সমস্ত ভাষার আত্মবিশ্বাস এবং অবস্থানও পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। শিখ গুরুদের রচনাবলির মধ্য দিয়ে পাঞ্জাবি ভাষা এক নতুন জীবন লাভ করে।
১৮শ শতাব্দীর আর-একটি ভাষার বিকাশ হয়, যার নাম উর্দু। উর্দু যাকে প্রায়ই রেখাতা বলা হয়, দক্ষিণাত্যেই উদ্ভূত হয়, কিন্তু ১৭শ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে এই ভাষা মুঘল দরবারে আত্মপ্রকাশ করে। তাই যেসব অভিজাত ব্যক্তিবর্গ দাক্ষিণাত্যে নির্বাসিত হয়েছিলেন, তাদের কষ্ট এবং উত্তর ভারতে তাদের পরিবারের একাকিত্বের কথা বলতে গিয়ে, ঔরঙ্গজেবের সময়কার শ্লেষাত্মক কবি জাফর জাটালি, চারিদিকের আইন শৃঙ্খলার অভাব ঔরঙ্গজেবকে কঠোর বিদ্রূপ বিদ্ধ করে বলেন ‘এ যেন এক বিশাল দৈত্যের পশ্চাদ্দেশের নিম্নস্থ অন্ধকার।
১৭২১ সালে ওয়ালি দাখানির দিল্লিতে আগমনের সঙ্গে সঙ্গে উর্দু এক নিজস্ব রূপ, শব্দভাণ্ডার এবং শৈলীর অধিকারী হয়। তবে যে সমস্ত কবিরা উর্দুকে পারসিকের সঙ্গে একমনে উন্নীত করেন তারা হলেন মির, দর্দ এবং সৌদা (১৭১১-১৭৮১)। উর্দু শহরের অভিজাতদের সাহিত্য ভাষা হয়ে ওঠে এবং মুসলিম এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিবর্গই এর বিকাশে সহায়তা করেন। সেই সময়কার উর্দু কবিতায় অতিন্দ্রীয়তা, মানবিকতা এবং উদারমনস্কতার সুর ঝংকৃত হয়ে উঠেছিল।
সংগীত
সংগীত সাংস্কৃতিক জীবনের আর-একটি অঙ্গ, যেখানে হিন্দু ও মুসলিমরা সহযোগিতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিল। আমরা আগেই দেখেছি যে কীভাবে ১৪শ শতাব্দীতে সুলতানি রাজত্বকালে সংগীত দরবারগুলিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমনকি ফিরুজ তুঘলকের মতো রক্ষণশীল সুলতানও সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। ১৫শ ও ১৬শ শতাব্দীতে প্রাদেশিক শাসকেরা সংগীতের বিশেষ সহায়ক ছিলেন। গোয়ালিয়রের রাজা মান সিংহ নিজে একজন দক্ষ সংগীতজ্ঞ এবং সংগীতের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। তিনি নিজে অনেক নূতন সুর সৃষ্টি করেছিলেন যেগুলি ‘মান কৌতূহল’ নামক একটি পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে। তবে কেবল রাজদরবারেই নয়, মন্দিরে এবং সুফি জমায়েতেও সংগীত যথেষ্ট উৎসাহ লাভ করত। উদাহরণস্বরূপ বৃন্দাবনের স্বামী হরিদাস সংগীতের এক বিশাল সমঝদার ছিলেন। শোনা যায় যে আকবর নিজেই ছদ্মবেশে তাঁর সংগীত শুনতে যেতেন। এ কথা মনে রাখা উচিত যে অনেক ভক্তিযোগীর রচিত প্রার্থনাই বিভিন্ন রাগ এবং সুর সহযোগে সংগীত হয়ে উঠেছে।
দিল্লির শাসকদের মধ্যে ইসলাম শাহ সুর-এর পুত্র আদালি সংগীতের একজন মহান পৃষ্ঠপোষক তো ছিলেনই, এছাড়া ছিলেন একজন সুদক্ষ পাখোয়াজ-বাদক। আবুল ফজল বলেছেন যে তার জীবনের প্রথম থেকেই আকবর সংগীতের বিশেষ ভক্ত ছিলেন, তিনি বলেছেন শাহেন শাহর সংগীতশাস্ত্রে যা জ্ঞান ছিল তা প্রশিক্ষিত সংগীতজ্ঞদের থেকেও অধিক। এ ছাড়া তার বাদ্যযন্ত্র চালনায়, বিশেষ করে নাকাড়ায়। বিশেষ ব্যুৎপত্তি ছিল। তিনি একজন সুদক্ষ নাকাড়া-বাদক ছিলেন। তাঁর এই সংগীত প্রেমের জন্যই আকবর তানসেনের সংগীত নিবেদনকে মান সিংহ-এর থেকে নিজে অধিগ্রহণ করেন (বা মান সিংহ-এর সভা থেকে সংগীত পরিবেশনের জন্য। তানসেনকে নিজের সভায় নিয়ে আসেন)। আবুল ফজল আকবরের সভায় ৩৬ জন গায়কের নাম ধরে উল্লেখ করেছেন এবং তানসেন আকবরের সভায় প্রধান সংগীতজ্ঞের ভূমিকা পালন করেন। তানসেন হিন্দিতে বহু গান রচনা করেন এবং এমন সব রাগের সৃষ্টি করেন যা আজও গীত হয়ে চলেছে। গোয়ালিয়র থেকে যে গায়কী তিনি গ্রহণ করেন তা ছিল রাজসিক ধ্রুপদি গায়ন পদ্ধতি।
শাহজাহান তার দরবারে সংগীতকে আনুকূল্য প্রদান করতেন এবং তিনি নিজেও সংগীতকলায় যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ঔরঙ্গজেব নিজে একজন দক্ষ বীণাবাদক ছিলেন এবং তার সাম্রাজ্যের প্রথম দশ বৎসরে সংগীতকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। তবে একদিকে তাঁর ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অপরদিকে ব্যয়সংকোচের একটি ভ্রান্ত ধারণা, এই উভয়ের বশবর্তী হয়ে তিনি তাঁর রাজসভা থেকে গায়কদের বিদায় করে দেন। তবে যন্ত্রসংগীতের অনুষ্ঠান চলতে থাকে।
ঔরঙ্গজেব প্রতিবাদী সংগীতশিল্পীদের বিদ্রূপ করে সংগীতকে গভীর করে কবর দিতে বলেন বটে, কিন্তু তার সময়কালে সংগীতের উপর অনেকগুলি পুস্তক রচিত হয়েছিল। এর মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত সংকলনটির নাম তাহফাৎ-উল-হিন্দ, যা তার পৌত্র জাহান্দার শাহ-এর জন্য রচিত হয়েছিল। হারেম-এর মহিলাগণ সহ রাজপরিবারের সব সদস্যই সংগীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
মুহম্মদ শাহের রাজত্বকালে (১৭১৯-৪৮) সংগীতের অনেক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল। তার সর্বাধিক প্রিয় গায়কেরা ছিলেন নিয়ামত খান সদারঙ্গ এবং ফিরুজ খান আদারঙ্গ। এঁরা উভয়েই শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদীয়া ছিলেন, কিন্তু এঁরা বহু শিষ্যকেই খেয়াল অঙ্গের গানে তামিল দেন। খেয়ালের রচনা ছিল কাব্যধর্মী এবং মূলভাব প্রণয়ধর্মী। এই কারণেই খেয়াল বিপুল জনপ্রিতা লাভ করে। মহম্মদ শাহ নিজেই রঙ্গিলা পিয়া ছদ্মনামে খেয়াল রচনা করতেন। আবার অনেক সভাঙ্গনেও তাদের সংগীত ও নৃত্যের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন।
এই যুগে তবলা ও সেতার জনপ্রিয়তা লাভ করে, কিন্তু আমরা জানি না কবে এগুলির উদ্ভাবন হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে যদিও ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এক সুসমৃদ্ধ। ঐতিহ্য ছিল, কিন্তু ৮ম শতাব্দীর পরে এর অগ্রগতি ব্যাহত হয় যদিও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। ১৭৫০ সালের শ্রীপতি এবং ভাস্করাচার্যের গণিত বিজ্ঞানের অবদানই তার। প্রমাণ। আলবারুনির মতে ভারতীয় ব্রাহ্মণদের ঔদ্ধত্য এবং সাধারণের সংসর্গ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখার ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টাই এর কারণ। তুর্কিরা এদেশে আসার পর ইসলামি বা আরবি বিজ্ঞানের সঙ্গে ভারতের অনেক বেশি যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এর ফলে অনেক নূতন প্রযুক্তির সূচনা হয়। যথা কাগজ, চরকা (অথবা সুতো কাটার। চক্র) জলতোলার চাকার এক উন্নততর রূপ (রাহাত) এবং লোহার রেকাবের প্রভূত ব্যবহার। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পারস্পরিক মত বিনিময় মূলত যে সকল বিষয়ে হয়েছিল তা হল জ্যোতির্বিজ্ঞান, অঙ্কশাস্ত্র এবং চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি। তবে কৃষি বিজ্ঞান ও জৈব বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ ভাবে অবহেলা করা হয়নি। যাই হোক, ১১শ শতাব্দী থেকে। ইসলামি দুনিয়াতে যুক্তি এবং বিজ্ঞানের উপর (দর্শনের নামে) তুমুল আঘাত নেমে আসে। মহান শিক্ষক নামে খ্যাত আল গাঁজালি (মৃত্যু, ১১১১) যুক্তির উপর আক্রমণে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। অনবরত এই আক্রমণাত্মক প্রচারের ফলে ধর্ম, অতীন্দ্রিয়তা রুচিজ্ঞান ইত্যাদির নীচে বিজ্ঞান একেবারে নিজস্থিত হয়ে গেছিল। এই সময় বিজ্ঞান নিয়ে বহু রচনা প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে কিছু কিছু ভারতবর্ষেও হয়েছিল, তবে তার মূল্যায়ন এখনও হয়নি। এই সব গবেষণায় অনেক নতুন বিষয় সংযোজিত হয়–যথা ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, বিশেষ করে আলোক বিজ্ঞান, আপেক্ষিক গুরুত্ব, চৌম্বকত্ব, এবং ঘুর্ণন ও সময়-বিষয়ক ধারণা। তবে বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা সচরাচর ধর্ম, অতিন্দ্রীয়বাদ, সৌন্দর্য বিদ্যা ইত্যাদির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় থাকত। এটি অবশ্য একটি নূতন ঘটনা নয়। কারণ বহু ধর্মেই বিজ্ঞান, ধর্ম, জাদুবিদ্যা এবং অতিকথার সঙ্গে মিশ্রিত থাকত। যাই হোক, বিজ্ঞানের গড়ে ওঠার জন্য যৌক্তিকতা বা বিচারবুদ্ধির একটি পরিমণ্ডলের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা ছিল। ইউরোপে ধর্মের থেকে দূরে যৌক্তিকতার একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেই ১৫শ শতাব্দী থেকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। ধর্ম এবং দুজ্ঞেয়ত্ব থেকে নিজেকে পৃথক করতে না পারার কারণেই ভারতবর্ষ এবং ইসলামীয় বিশ্বের অন্যত্র বিজ্ঞানের অগ্রগতি এত ব্যাহত হয়েছে।
আকবরের সময়ে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবন, যথা একসঙ্গে অনেকগুলি বন্দুকের নল পরিষ্কার করার যন্ত্র, শস্য গুঁড়ো করার জন্য একটি চলমান যান সৃষ্টি করা হয়। এর থেকে উদ্ভাবনী চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়, তবে এর বিশেষ প্রসার ঘটেনি। কারণ তখন শাসক অভিজাত বা, শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রপাতিতে কোনো মনোযোগ দেননি।
পর্তুগিজদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে ইউরোপীয়দের প্রভাব প্রথম অনুভূত হয়। পর্তুগিজ জাহাজ এবং কামানগুলিকে পর্তুগিজদের নৌবিদ্যার উৎকর্ষের নিদর্শন বলেই ধরা হয় এবং এগুলিকে নকল করারও চেষ্টা হয়। যেমন কালিকট-বাসী জামোরিন, পর্তুগিজেদের থেকে দু’জন মিলানবাসীকে সরিয়ে নিয়ে তার জন্য বন্দুক প্রস্তুত তৈরির কাজে লাগান। কাস্টানহেডা নামক পর্তুগিজ লেখক লিখছেন যে চারজন ভেনিসীয় (ভেনিসের অধিবাসী) জাহাজ নির্মাতা ১৫০৫ সালে কামান বন্দুক ঢালাই করতে মালাবারে আসেন। জাহাজ নির্মাণ সম্বন্ধে আমরা শুনেছি যে দাভোলে ১৬১২ সালের মতো জাহাজ নির্মিত হত এবং পাল সহ জেড্ডার জাহাজগুলি। ‘ক্রিশ্চিয়ান ঢং’-এ নির্মিত হয়েছিল। আর একজন সমসাময়িক বাউরী বুঝেছিলেন যে কৃষ্ণা গোদাবরী নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে করমণ্ডল উপকূলে কর্মরত কাষ্ঠকর্মী বা সূত্রধরেরা যে-কোনো জাহাজ নির্মাতার মতোই পোত নির্মাণ করতে এবং জলে ভাসাতে সক্ষম ছিল। এদের অনেকেই ইউরোপীয় কারিগরদের কাছ থেকেই ইউরোপীয় ধরনে জাহাজ নির্মাণ শিখেছিল। সুরাট এই ধরনের জাহাজ নির্মাণের আর-একটি কেন্দ্র ছিল। কে. এন. চৌধুরী লিখেছেন যে ১৭শ শতাব্দীর শেষ ভাগের মধ্যেই ইউরোপীয় দেশের বণিকেরা পাশ্চাত্য দেশীয় এবং ভারত মহাসাগরীয় দেশ সমূহে নির্মিত জলপোতদের মধ্যে কোনো প্রযুক্তিগত পার্থক্য খুঁজে পেতেন না। বরঞ্চ তারা এই সব স্থানীয় জাহাজগুলিকেই বেশি পছন্দ করতেন কেননা কারিগরি দক্ষতা এবং অঙ্গসজ্জা উভয়েই এই জাহাজগুলি উচ্চমানের ছিল। জাহাজের নির্মাণ পরিকল্পনার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গোলন্দাজির প্রতিঘাত সহ্য করার উপযুক্ত করে এর কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে তোলা হয়। ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজগুলিও আত্মরক্ষার জন্য কামান ও সশস্ত্র রক্ষীদল সমেত সমুদ্রযাত্রা করত। একটি জাহাজে ২০টি, ৪০টি কি আরও বেশি অর্থাৎ বিভিন্ন সংখ্যার কামান থাকত। ঔরঙ্গজেবের সবথেকে বড়ো জাহাজ ‘গঞ্জ-ই-সওয়াইতে ৮০টি কামান এবং ৪০০ বন্দুক বহন করত। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এই সব কামানগুলি ইউরোপীয় বাণিজ্যপোতের সামনে ব্যর্থ। প্রতিপন্ন হত, যার অনেকগুলি কারণ ছিল। যথা কামানগুলির অবস্থান প্রায়ই ভুল থাকত–গোলন্দাজদের লক্ষ্যভেদ করার কৌশল জানা ছিল না। এবং নৌচালনারও দক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। একজন সমসাময়িক ফ্রায়ার ১৬৭০ সালে বলেন যে ‘তাদের কোনো কোনো জাহাজে ৩০টি কি ৪০টি কামান থাকত বটে, তবে সেগুলো। প্রকৃতপক্ষে লোক দেখানোর জন্য, কোনো কাজের জন্য নয়।’ তাই ‘গঞ্জ-ই-সাওয়াই’ প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রতিরোধ ব্যতিরেকে একটি ইংরেজি জাহাজের দ্বারা নিমজ্জিত হয়। প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রযুক্তিগত কারণের থেকেও রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণসমূহ এবং কোনো নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর অভাবের জন্যই সমুদ্রবক্ষে ভারত বারবার দুর্বল প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেছে যে ভারতীয়রা যখন জলদস্যু রূপে নিজেদের জন্য লড়াই করেছে তখন তারা যে দক্ষতা প্রদর্শন করেছে, সুদূরবর্তী কোনো প্রভুর অধীনে কর্মরত অবস্থায় তারা নৌযুদ্ধে সেই কুশলতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ভারতে নির্মিত ওমানী নৌবহরও ইংরাজ জলদস্যুদের দমন করতে সক্ষম হয়েছে এবং সুরাটকে বিপদে ফেলেছে।
এই সমস্ত থেকে দেখা যাচ্ছে যে প্রাচীন যন্ত্রপাতি সম্বল করেও ভারতীয় কারিগররা কোনো একটি বস্তুকে নকল করে শেষ পর্যন্ত তার এমন একটি জুড়ি প্রস্তুত করতে সক্ষম, যাকে আদি বস্তুটির থেকে পৃথক বলে চেনাই যায় না। উদাহরণস্বরূপ জাহাঙ্গিরের জন্য নির্মিত একটি ঘোড়ার গাড়ির কথা বলা যায়। তবে যে বস্তুর প্রতিরূপ সৃষ্টি করা হবে, তার বিশ্লেষণ করা হয়নি–বা তাকে উন্নততর করার কোনো চেষ্টাও করা হয়নি।
বহুসংখ্যক দক্ষ কারিগর এবং হাতে প্রচুর পরিমাণে নগদ টাকা থাকা সত্ত্বেও ১৭শ এবং ১৮শ শতাব্দীতে ভারত প্রযুক্তিবিদ্যায় কেন পশ্চাদপদ ছিল তা নিয়ে অধুনা প্রচুর। বিতর্ক হয়েছে। তবে ইংরেজ এবং ওলন্দাজ বণিকেরা আসার সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন স্তরে ইউরোপীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায় এবং ইউরোপ সম্বন্ধে ধারণাও সৃষ্টি হতে থাকে।
শাসক এবং অভিজাত পরিবারের মানুষজন সর্বদাই ইউরোপের নানান অভিনব বস্তুর জন্য সর্বদাই উন্মুখ ছিলেন। তাই বিশ্বগোলক, চশমা, কাঁচ, বাড়ির বড় ঘড়ি ইত্যাদি ক্রয় করার বা উপহার দেবার সংবাদ সর্বদাই পাওয়া যেত। তবে ভারতীয় শাসকেরা কেবল মাত্র খেলনা নিয়েই খুশি থাকতেন না। আবুল ফজল ইউরোপীয়দের দ্বারা আমেরিকা আবিষ্কারের কথা জানতেন এবং ইউরোপীয় চিত্রকলার প্রশংসাও করেছিলেন। জুন্নার-এর প্রশাসক ১৬৭০ সালে ফ্রায়ারকে ডেকে ইউরোপের অবস্থা, তার সরকার, সরকারের নীতি, এবং বিদ্যা চর্চার বিষয়ে নানা প্রশ্ন রেখেছিলেন। বানিয়েরের পৃষ্ঠপোষক দামিমন্দ খান দেকার্তের দর্শন সম্বন্ধে আগ্রহী ছিলেন এবং জ্যোতির্বিদ্যা ভূগোল এবং শারীরতত্ত্ব প্রমুখ বৈজ্ঞানিক বিষয়ে উৎসুক ছিলেন।
তবে এই সমস্ত যোগাযোগ আরও বিস্তার লাভ করেনি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সম্বন্ধে প্রথাগত চর্চার কোনো মনোভাবেরও সৃষ্টি হয়নি। বার্নিয়ের দুঃখ করে বলেছিলেন একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট মাদ্রাসা ছাড়া আর এমন কোনো শিক্ষায়তন ছিল না যেখানে এই ধরনের বিষয় সম্বন্ধে চর্চা করা যায়। পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনে কৌতূহল ছিল নেহাতই ব্যক্তিগত এবং ব্যক্তির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তারও অবসান হয়।
এমনকি কামান বা হাতবন্দুক উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ভারত প্রযুক্তিগত ভাবে পশ্চাদমুখী ছিল। এর কারণ বন্দুকগুলিকে একটি-একটি করে ঢালাই করা হত না। ছাঁচের মধ্যে ফুটো করা হত, তারপর উপরে গরম চাকা এমন ভাবে রাখা হত যাতে সেটি বন্দুকের নলের সঙ্গে একযোগে গলিত হয়ে সমস্ত বন্দুকগুলিকে একসাথে নিয়ে আসে। আসলে চুল্লিগুলি খারাপ হাপরের জন্য নেহাতই ছোটো হওয়ায় এককভাবে একটি বন্দুক ঢালাই করানো যেত না। উত্তম গুণসম্পন্ন ঢালাই লোহার প্রস্তুতকল্পে বড়ো চুল্লি, উচ্চ তাপমাত্রা এবং শক্তিচালিত হাপরের প্রয়োজন ছিল। ১৫৫০ সালের মধ্যে ইউরোপের কর্মশালায় হাপর বা ভস্ত্রাগুলি জলের শক্তিদ্বারা চালিত দণ্ড দিয়ে চলত।
ভারতে কাঠের হাতল বা হাতের দ্বারা চালিত চামড়ার তৈরি হাপরের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাবরের মতে একটি কামান বানাবার জন্য সাতটি বা আটটি চুল্লির লোহা ব্যবহৃত হত। যেহেতু সব কটি খণ্ড এই ভাবে সমগুণসম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং এই কামান ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত। তবে ভাবলে বিস্ময় লাগে যে, মির জুমলা ১৬৬৬ সালে এবং পরে বঙ্গদেশে কামান ঢালাই করার জন্য যেসব ইউরোপীয়কে কাজে লাগান তারা ভারতীয়দের সঠিক ভাবে কামান ঢালাই করতে শেখাননি। মনে হয় পরবর্তীকালে বাংলায় মির কাসিম এবং পাঞ্জাবে রঞ্জিত সিংহ এই ত্রুটির প্রতিকার করেন।
আর-একটি দুর্বলতা ছিল সুদক্ষ জল তোলবার কলের অভাব। এক ইংরেজ জাহাঙ্গিরকে যমুনার থেকে জল তোলার প্রস্তাব দেন, যাতে করে লন্ডনে টেমস্ নদীর জলের মতো এই জল সাধারণের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু সার থমাস রো এই ধারণাটি হেসে উড়িয়ে দেন এবং সেখানেই এর সমাপ্তি ঘটে। জাহাজের মধ্যে যন্ত্রের সাহায্যে জল তোলার প্রস্তাব বাতিল করে খালাসি বা শ্রমিকদের দ্বারা জল তুলে আনার ব্যবস্থা চালু হয়। তবে লোহার পেরেক, লোহার নোঙর এবং নোঙর ওঠানো বা নামানের জন্য রশি জড়াবার যন্ত্র ব্যবহার স্বীকৃত হয়েছিল। জল তোলার যন্ত্রের অভাবের জন্য কোনো খনিই জলের স্তরের নীচে আর কাটা যেত না। কিন্তু তাহলেও রাজস্থান এবং অন্ধ্রপ্রদেশে খনি থেকে দস্তা পিতল ও রৌপ্য উত্তোলনের গৌরবময় পরম্পরার কথা কখনোই ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
একটা জিনিস লক্ষ করা গেছে যে সামান্য স্ক্র এবং স্প্রিং-এর অভাবে ভারতে যন্ত্রপাতির উৎপাদন কঠিন হয়ে উঠেছিল। ভ্রু-র স্থলে এক টুকরো তার ঝালাই করে দেওয়া হত।
এই স্ক্র এবং স্প্রিং-এর অভাবের জন্যই ইউরোপীয় ধরনের গৃহে ব্যবহার করার মতো ঘড়ি ব্যবহৃত হত না। এই দেওয়ালঘড়িগুলির পদার্থবিদ্যার নূতন তত্ত্ব প্রয়োগ করে এবং এখানে ঘূর্ণক, ভারউত্তোলক দণ্ড এবং ওজনের ব্যবহার আছে। বাড়ির দেওয়ালঘড়ির ব্যবহার স্বীকৃত না হওয়ার আর-একটি কারণ এই যে ইউরোপের থেকে ভারতে বিভিন্ন ভাবে সময়ের গণনা করা হত। তবে এ সত্ত্বেও চীন দেশে এই ইউরোপীয় ধরনের ঘড়িকে মেনে নিতে কোনো অসুবিধা হয়নি।
কাপড় বোনা এবং রং করার ক্ষেত্রে কিন্তু ভারতীয় পদ্ধতি তৎকালে বিশ্বে প্রচলিত পদ্ধতির থেকে পশ্চাদপদ ছিল না। ইউরোপীয়রা ভারতে উৎপন্ন কাপড়ের বহর নিয়ে অভিযোগ করলেও এর সমাধান কিন্তু কঠিন ছিল না। এছাড়া কয়েক ধরনের রং করার ব্যাপারে তারা মুর্শিদাবাদে নিজেদের কারিগর পাঠিয়ে ছিল। তবে রেশমি সুতো বুননের কাজে ভারত পিছিয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে বহু প্রতিবাদ সত্ত্বেও এখানে ইউরোপীয় কলাকৌশলের ব্যবহার শুরু হয়।
কাঁচ নির্মাণের ক্ষেত্রেও ভারত অনেক পিছিয়ে ছিল। যদিও এদেশে কাঁচের বৈয়াম (জার) তৈরি হত, তাহলেও ইউরোপে প্রস্তুত পানপাত্র, আয়না এবং চশমার প্রচুর চাহিদা ছিল। এর কোনোটিই ভারতে প্রস্তুত হত না। আবার ১৮শ শতক অবধি দূরবিনের অভাব বিশেষ অসুবিধার কারণ হয়ে উঠেছিল। এরজন্য সমুদ্রে শত্রুজাহাজগুলিকে দূর থেকে দেখা যেত না। এছাড়া জয় সিংহ-এর মানমন্দিরগুলিও পুরাতন পদ্ধতির জন্য পরিত্যক্ত হচ্ছিল। কারণ তিনি দূরবিনের ব্যবহার জানতেন না। তিনি অবশ্য পর্তুগালে বারেবারে অনেক প্রতিনিধিকে এই ব্যাপারে পাঠিয়েছিলেন– তাও ইংল্যান্ড ও হল্যান্ডে জ্যোতির্বিদ্যায় যে উন্নতি হয়েছিল, সেই বিষয়ে অবহিত ছিল না। তাছাড়া জয় সিংহ-এর মানমন্দিরগুলি টলেমির নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল, উলুঘ বেগও যার পুনরাবৃত্তি করেন। এই রীতি অনুসারে পৃথিবীকেই মহাবিশ্বের কেন্দ্র বলে মানা হত, যদিও ব্রহ্মগুপ্ত ও কোপারনিকাসের মতে সূর্যই ছিল বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত।
যে সমস্ত ইউরোপীয় প্রযুক্তিবিদ্যা সুপরিচিত হলেও ভারতে ব্যবহৃত হয়নি এখানে তার তালিকা প্রণয়ন করা নিষ্প্রয়োজন। তবে ভারতের বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকার জন্য অন্যান্য যেসব কারণ যথা ভারতীয়দের ভাবুক এবং অদৃষ্টবাদী জীবনবোধ–যার জন্যই তারা নতুন কিছু করতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি, বা তাদের বর্ণবিভাগ, যার জন্য তারা জীবনের এক স্থলেই স্থবির হয়ে থাকতে চেয়েছিল, সেসব আর গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। বলা হয়েছে যে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান বিষয়ে ভারতীয়রা অনেক খুটিনাটি বিচার করে তবেই পা ফেলত। সব বৈজ্ঞানিক বিষয়কে তারা সুবিধা, উপযযাগিতা, বাধা-বিঘ্ন বা অন্য বস্তুবাদী চিন্তাধারার পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার করত। (এ. জান, কাইসার)।
একথাও বলা হয়েছে প্রচুরসংখ্যক শ্রমজীবীর সহজলভ্যতা এবং তাদের দরুন আনুষঙ্গিক ব্যয়ের স্বল্পতার জন্যও নূতন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনে ভারতীয়রা কোনো উৎসাহ দেখায়নি। ইরফান হাবিবের মতে ‘কোনো যান্ত্রিক অনুষঙ্গ ছাড়াই আরও অনেক স্বল্পমূল্যে অধিক সংখ্যক কুশলী কারিগরদের নিয়োগ করে, একটি উন্নততর বস্তু উৎপাদন করা সম্ভব?’ তবে যেসব ক্ষেত্রে কেবল ‘বেশিসংখ্যক কুশলী শ্রমিকদের নিয়োগ করে অভীষ্ট ফল পাওয়া সম্ভব নয় বা যেখানে বহুসংখ্যক লোকশক্তিকে নিয়োগ করার তুলনায় সেখানে যন্ত্রপাতির উদ্ভাবন সুলভতর হবে।’ ছাপাখানার যন্ত্রপাতি এবং নকশাদার কাপড় বোনার জন্য যথাযথ তাতকে গ্রহণ করার অনিচ্ছা এই যুক্তির সত্যতা প্রকাশ করছে। যদিও কাপড়ের ওপর কাঠের ছাঁচ দিয়ে নকশা প্রস্তুত করার পদ্ধতি ভারতেই উদ্ভূত হয়েছে এবং চীনদেশে কাগজের উপর ছাপাবার জন্য ব্যবহার করা হয়নি। এটি কী এই জন্য যে হাতে লিখে লিখনশিল্পীরা অনেক সস্তায় এই কাজটি করে দিতে পারত? যদিও এরজন্য দেশে সাক্ষরতার বিপুলতর। প্রসারের প্রয়োজন ছিল মনে হয়, নাকি অন্য কোনো কারণ আছে ঠিক বলা যায় না। তবে যে কারণেই হোক, এতে দেশের মধ্যে জ্ঞানের প্রসার অবশ্যই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল।
আরও বলা হয়েছে বর্ণাশ্রমের জন্যই পেশাদারিত্ব এক চরম সীমায় পৌঁছেছিল। পিতাদের নিকট অন্য কোনো পেশার পথ খোলা না থাকায় তারা পুত্রদের নিজ কারুবিদ্যাতেই শিক্ষিত করতেন (যথা সূত্ৰধারের বংশের সকলেই হতেন সূত্রধার)। তবে এই কথাটিও আংশিকভাবে সত্য। আধুনিক সমাজ পত্তনের পূর্বে ইউরোপেও পিতা নিজ পুত্রকে তার কারিগরি বিদ্যায় শিক্ষিত করতেন। তাছাড়া যখন কোনো নতুন। পেশা বা কারুকর্মের সূত্রপাত হত যথা কাগজ প্রস্তুত, আতসবাজি তৈরি, কাপড়ে রঙ ছোপানো, মুদ্রণ বস্ত্রাদিতে রং লাগানো, তখন এই নতুন শিল্পকর্মে প্রবেশ করার জন্য বর্ণভেদ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াত না।
তাছাড়া যেসব যন্ত্রানুষঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা হ্রাস পায় তার বিরোধিতাও কিছু নতুন বিষয় নয়, যেমন ১৮শ শতাব্দীর ব্রিটেনে লুডাইট আন্দোলনে দেখা গিয়েছিল।
যেহেতু কারিগর বা কর্মশিল্পীরা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করার পক্ষে অত্যন্ত দরিদ্র ছিলেন, তাহলে সওদাগর কি বণিকেরা, সেই মূলধন কি নিজেরা নিয়োগ করতে পারতেন না? এই প্রশ্নটি বারবার করা হয়েছে।
এখন এই ব্যবসায়ীরা দাদনি প্রথার মাধ্যমে কারুশিল্পীদের অর্থের ব্যবস্থা করে তাদের নিজ নিয়ন্ত্রণে এনে রাখতেন বটে, কিন্তু নতুন প্রযুক্তিতে বা উৎপাদন পদ্ধতিতে উন্নতিকরণের কার্যে অর্থ বিনিয়োগ করার কোনো উৎসাহই তারা দেখাননি। তাই যন্ত্রপাতিগুলি কারিগরদের হাতেই রক্ষিত ছিল। যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে ব্যবসায়ীদের। উৎসাহের অভাবের জন্যই ভারতীয় যন্ত্রশিল্পীরা ইউরোপীয় ধরনের জাহাজ নির্মাণে সক্ষম হলেও তারা কিন্তু পুরাতন, আদিম যন্ত্রপাতি ব্যবহার করত। তাই তখন বড়ো বড়ো করাত বা বড়ো বড়ো চাকার কথা শোনাই যেত না।
শাসকশ্রেণির ব্যক্তিরা কিন্তু শ্রমজীবী মানুষদের অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। আকবর কারখানায় নিজে কাজ করে যে দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন, তাঁর উত্তরসূরিরা কেউই সেই উদাহরণ অনুসরণ করেননি। সুতরাং বিজ্ঞানের ব্যবহার করে উৎপাদকতা বা উৎপন্ন বস্তুর মান উন্নয়ন করার কথা তাদের চিন্তারও অগোচর ছিল।– সবশেষে এ কথা অনস্বীকার্য যে বহিবিশ্বে মুঘল বা হিন্দু শাসকদের সম্বন্ধে ধারণা। ছিল তারা পরম্পরাগত ভাবে গঠিত এবং ধর্মের উপর ভিত্তিশীল। এই ঐতিহ্যগত ধারণা ভাঙবার জন্য এক সুদীর্ঘও কঠিন প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল। উলুঘ বেগের জিক-এর মুখবন্ধে জয় সিংহ লিখেছেন ‘ধর্মবোধ কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায়, সাম্রাজ্যও ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের অবদান চিরদিনই অটুট থাকে। তবে জয় সিংহ তার সময়কার একজন ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন। আবুল ফজল দুঃখ করে লিখেছেন তকলিদ অর্থাৎ ঐতিহ্যের গম্ভীর বাতাসে জ্ঞানের প্রদীপ নিভে যায়। ‘কেমন করে?’অথবা কেন? এই দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। প্রশ্ন করা এবং সত্যর অনুসন্ধান শুধু নিষ্ফলই নয়, ধর্মবিরোধিতার সমতুল বলেও গণ্য হয়।
এই যে নিজেকে একটি খোলসে বন্দি করে রাখা, বহিবিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডারের প্রতি উদ্ধত অবজ্ঞা, এবং যুক্তিভিত্তিক অনুসন্ধান বা বুদ্ধি দিয়ে কিছু জানার প্রতি অনীহা, আলবেরুনি সনাতনী ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে এই কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু মুঘল প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ সম্বন্ধেও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। এই মুঘল আমির ওমরাহর তৎকালে সর্বোচ্চ আরাম ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপন করতেন। সমুদ্রবক্ষে ইউরোপীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব তাদের মনে কোনো আশঙ্কার সৃষ্টি করেনি, আবার তারা ঘরের বাইরে পা ফেলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনেরও কোনো স্পৃহা দেখাননি। এই ধরনের বাতাবরণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কখনোই বেড়ে উঠতে পারে না। তাই একজন আধুনিক ইতিহাসবিদ এ. রহমানের উক্তি অনুযায়ী প্রযুক্তিবিদ্যার জ্ঞান রচনা ও পুস্তকের মাধ্যমে যথাযথ ভাবে গড়ে উঠলে পরে তবেই প্রযুক্তি বা যন্ত্রবিদ্যার প্রকৃত উন্নতিসাধন সম্ভব, এবং এই বিজ্ঞান শাস্ত্রীয় জ্ঞানের মাধ্যমেই প্রযুক্তিবিদ্যার পরিবর্তন বা উন্নয়ন সম্ভব হয়। বৈজ্ঞানিক শাস্ত্রীয় জ্ঞান যদি প্রযুক্তিবিদ্যার থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে যদি প্রযুক্তিবিদ বা যন্ত্রশিল্পী এবং কারিগরদের মধ্যে যদি সামাজিক বা অন্য কারণে যোগাযোগ না সম্ভব হয়, তাহলে তা বিজ্ঞান ও সমাজ উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকর।