১৫. দেশভ্রমণ আমি বিস্তর করেছি

১৫.

দেশভ্রমণ আমি বিস্তর করেছি। সামান্য কিছু ঘটতে না ঘটতেই আমি বিচলিত হয়ে পড়িনে। রিফ্রেশমেন্ট রুমে চা খেতে গিয়েছি, ওদিকে গাড়ি আমার বাক্স-তোরঙ্গ বিছানা-বালিশ নিয়ে চলে গিয়েছে, বিদেশ-বিভুঁইয়ে মানিব্যাগ চুরি যাওয়াতে আমি কপর্দকহীন, ইতালির এক রেস্তোরাঁয় দুই দলে ছোরা-ছুরি হচ্ছে– আমি নিরীহ বাঙালি এক কোণে দেয়ালের চুনকামের মতো হয়ে গিয়ে আত্মগোপন করার চেষ্টা করছি– এসব ঘটনা আমার জীবনে একাধিকবার ঘটেছে। কিন্তু এবার সুয়েজ বন্দরে, আবুল আসফিয়ার পাল্লায় পড়ে যে বিপদে পড়লুম তার সঙ্গে অন্য কোনও গর্দিশের তুলনা হয় না।

আমাদের জাহাজ তার আপন পথে চলে গিয়েছে। আমরা এখানে আটকা পড়েছি হেলথ সার্টিফিকেট নেই বলে। তা হলে এখানকার কোনও হোটেলে উঠতে হয় এবং প্রতি জাহাজে ধন্না দিতে হয়, আমাদের জায়গা দেবে কি না। খুব সম্ভব দেবে না। কারণ সেই পোড়ামুখো হেলথ সার্টিফিকেট না থাকলে জাহাজেও উঠতে দেয় না। এস্থলে জলে কুমির ডাঙায় বাঘ নয় এখানে জলে সাপ ডাঙায়ও সাপ।

জাপানি আক্রমণের সময়ে একটা গাঁইয়া গান শুনেছিলুম,

সা রে গা মা পা ধা নি
বোমা পড়ে জাপানি
বোমা-ভরা কালো সাপ
ব্রিটিশ কয় বাপ রে বাপ!

তাই মনে হল জাপানিরা যেন জলে-ডাঙায়, উভয়ত হেলথ সার্টিফিক্যেটের সাপ ফেলে গেছে।

আর ডাঙার হোটেলে থাকতে দেবেই-বা কদিন? আমাদের ট্যাকে যা কড়ি তার খবর হোটেলওয়ালা ঠিক ঠিক ঠাহর করতে পেরে নিশ্চয়ই আমাদের দুদূর করে তাড়িয়ে দেবে। তখন যাব কোথায়, খাব কী? তখন অবস্থা হবে সুয়েজ বন্দরের ধনী-গরিব সক্কলের কাছে ভিখ মাঙবার, কিন্তু কেউ কিছু দেবে কি? রেল ইস্টিশনে যখন কেউ এসে বলে, মশাই মানিব্যাগ চুরি গিয়েছে; চার গণ্ডা পয়সা দিন, বাড়ির ইস্টিশানে যেতে পারব, তখন কি কেউ শোনামাত্রই পয়সা ঢালে?

ইয়া আল্লাহ এ কোথায় ফেললে বাবা? এ যেন অকূল সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপবাস।

মানুষ যখন ভেবে কোনওকিছুর কূলকিনারা করতে পারে না তখন অন্যের ওপর নির্ভর করার চেষ্টা করে। পল-পার্সিকে নিয়ে ফিরে গেলুম আবুল আসফিয়ার কাছে।

তিনি দেখি ঠিক সেই মুহূর্তেই পোর্ট অফিসারকে শুধাচ্ছেন, তা হলে হেলথ সার্টিফিকেট কোথায় পাওয়া যায়?

এ যেন পাগলের প্রশ্ন! হেল্থ সার্টিফিকেট তো পাওয়া যায় আপন দেশে; এখানে পাব কী করে?

তাই আপন কানকে বিশ্বাস করতে পারলুম না যখন অফিসার বললেন, কেন ওই তো পাশের দফতরে।

তাহলে এতক্ষণ ধরে এসব টানাহ্যাঁচড়ার কী ছিল প্রয়োজন? ভালো করে শোনার পূর্বেই আমরা সব কটা প্রাণী ছুট দিলুম সেই দফতরের দিকে। জলের সাপ, ডাঙার সাপ, সা-রে-গা-মার জাপানি সাপ সব-কটা তখন এক জোটে যেন আমাদের তাড়া লাগিয়েছে।

দফতরের দরওয়াজা খোলাই ছিল। দেখি এক বিরাট বপু ভদ্রলোক ছোট্ট একখানা চেয়ারে তার বিশাল কলেবর খুঁজে-পুরে টেবিলের উপর পা দুখানি তুলে ঘুমুচ্ছেন। আমরা অট্টরোল করে না ঢুকলে নিশ্চয়ই তাঁর নাকের ফরফরানি শুনতে পেতুম। আমাদের হেলথ সার্টিফিকেট হেলথ সার্টিফিকেট, প্লিজ, প্লিজ, এ উৎকট সমবেত সঙ্গীতে অবশ্য ইয়োরোপীয় সঙ্গীত, যার এ সপ্তকে বাজে তোড়ি অন্য সপ্তকে পূরবী ভদ্রলোক চেয়ারসুদ্ধ লাফ মেরে উঠলেন।

শতকরা নিরানব্বই জন যাত্রী হেলথ সার্টিফিকেট নিয়ে বন্দরে নামে। সুতরাং এ ভদ্রলোকের শতকরা নিরানব্বই ঘণ্টাই কাটে আধো ঘুমে, আধো জাগরণে। তাই আমরা কী বেদনা-কাতর হয়ে তার কাছে এসেছি সেটা বুঝতে তার বেশ একটু সময় লাগল।

তাঁর ভাষা আমরা বুঝিনে, তিনি আমাদের ভাষা বোঝেন না। তৎসত্ত্বেও যে মারাত্মক দুঃসংবাদ তিনি দিলেন তার সরল প্রাঞ্জল অর্থ, যে ডাক্তার আমাদের পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দেবেন তিনি বাড়ি চলে গেছেন।

গোটা সাতেক ভাষায় তখন যে আরব উঠল তাকে বাঙলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়–

ওই য-যা!
ফরাসিরা বলেছিল মঁ দিয়ো, মঁ দিয়ো!
জর্মনরা বলেছিল, হের গট, হের গট!
 ইরানিরা বলেছিল, ইয়াল্লা, ইয়া খুদা!
আর কে কী বলেছিল, মনে নেই।

 কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণা, আল্লাতায়ালার বেহ মেহেরবানি, রাখে কেষ্ট মারে কে, ধন্যবাদ ধন্যবাদ। শুনি অফিসার বলছেন, কিন্তু আপনারা যখন বহাল তবিয়তে, দিব্য ঘোরাফেরা করছেন তখন আপনারা নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যবান! সার্টিফিকেট আমিই দেব। এই নিন ফর্ম। ফিল্ আল্ করুন। বলেই এক তাড়া বিশ্রী নোংরা বাদামি ফরম আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার মনে হল, আহা কী সুন্দর! যেন ইস্কুলের প্রোগ্রেস রিপোর্ট, আর সব-কটাতে লেখা আছে আমি ক্লাসে ফার্স্ট হয়েছি।

শকুনির পাল যেরকম মড়ার উপর পড়ে, আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লুম সেই গাজী মিয়ার বস্তানির উপর। উঁহু, ভুল উপমা হল, বীভৎস রসের উপমা দিতে আলঙ্কারিকরা বারণ করেছেন। তা হলে বলি, ফাঁসির হুকুম নাকচ করে দেবার অধিকার পেলে মা যেরকম নাকচের ফর্মের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

উৎসাহে, উত্তেজনায় আমাদের সবাইকার মাথা তখন ঘুলিয়ে গিয়েছে। ফর্মে প্রশ্ন, কোন সালে তোমার জন্ম? কিছুতেই মনে পড়ছে না, ১৮০৪– না ১৭০৪? প্রশ্ন, কোন বন্দরে জাহাজ ধরেছে? বেবাক ভুলে গিয়েছি, হংকং না তিব্বত। প্রশ্ন, যাবে কোথায়? হায়, হায়, টাকের বাকি আড়াই গাছা চুল ছিঁড়ে ফেললুম, তবু কিছুতেই মনে পড়ছে না, শনি গ্রহে না ধ্রুবতারায়!

তা সে যাক গে, আমরা কী লিখেছিলুম তাই নিয়ে উত্তষ্ঠিত হওয়ার কোনও প্রয়োজন ছিল না। পরে জানলুম, সেই সহৃদয় অফিসারটি ইংরেজি পড়তে পারেন না।

ঝপাঝপ বেগুনি স্ট্যাম্প মেরে তিনি আমাদের গণ্ডা আড়াই সার্টিফিকেট ঝেড়ে দিলেন। আমরা সেগুলো বসরাই গোলাপের মতো বুকে খুঁজে খোলা ধোঁয়াড়ের গরুর মতো বন্দরের অফিস থেকে সুড়সুড় করে স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে এলুম। এখন আমরা ইচ্ছে করলে কেপ করিন যেতে পারি, ইচ্ছে না করলে কোথাও যাব না।

পল বললে স্যর, কী লিখতে কী লিখেছি কিচ্ছটি জানিনে।

আমি বললুম, কিছু পরোয়া কর না ভাই! অম্মো তদবৎ!

ফরাসি রমণী হেসে বললেন, মঁসিয়ে পল, আমাকে যদি জিগ্যেস করত তুমি বকরি না মানুষ? তা হলে আমি প্রথম খানিকটে ব্যা ব্যা করে নিতুম, তার পর আপন মনে খানিকটে ফরাসি বলে নিয়ে দেখতুম কোনটা ভালো শোনাচ্ছে এবং সেই হিসেবে লিখে দিতুম বকরি না মানুষ।

তার পর খানিকটে ভেবে নিয়ে বললেন, অবশ্য বকরির সম্ভাবনাই ছিল বেশি।

আমার বুকে বড্ড বাজল। নিজের প্রতি এ যে অতিশয় অহেতুক অশ্রদ্ধা। বললুম, মাদমোয়াজেল বরঞ্চ কোকিল লিখলে আমি আপত্তি জানাতুম না। আপনার মধুর কণ্ঠ

ব্যস, ব্যস হয়েছে, হয়েছে; থ্যাঙ্ক্যু!

ততক্ষণে রেলস্টেশনের কাছে এসে পৌঁছেছি। দূর থেকে দেখি ট্রেন দাঁড়িয়ে। আমরা পা চালালুম। কিন্তু গেটের কাছে আসতে না আসতেই ট্রেনখানা ধ্যাৎ-ধ্যাৎ করে যেন আমাদের ঠাট্টা করে প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে গেল।

এবং একটা লোক– চেনা-চেনা মনে হল আমাদের দিকে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বিদায় জানালে তার পর যেন কত না বিরহ বেদনাতুর সেইভাবে দু হাতের উল্টো দিক দিয়ে অদৃশ্য অশ্রু মুছলে।

এ মস্করার অর্থ কী?

শুনলুম, আজ সন্ধ্যায় কাইরো যাবার শেষ ট্রেন এই চলে গেল। কাল সকালের ট্রেন ধরলে কাইরো মাথায় থাকুন সঈদ বন্দরে পৌঁছতে পারব না, অর্থাৎ নির্ঘাত জাহাজ মিস্ করব। এই শেষ ট্রেন ছিল আমাদের শেষ ভরসা।

এ দুঃসংবাদ শুনে আমি তো মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লুম।

কিন্তু ভগবান মানুষকে নিয়ে এরকম লীলা-খেলা করেন কেন? সেই যদি সুয়েজ বন্দরে আটক হতে হল, সেই যদি বোট মিস করতে হল, তবে ওই হেলথ সার্টিফিক্যেটের প্রথম খেয়াড়ে আটকা পড়লেই তো হত। সে ফাড়াকাটিয়ে এসে এখানে আবার কানমলা খাবার কী প্রয়োজন ছিল?

শুনেছি, কোনও কোনও জেলার ফাঁসির আসামিকে নাকি গারদের দরজা সামান্য খুলে রেখে জেল থেকে পালাবার সুযোগ দেয়। আসামি ভাবে, জেলার বেখেয়ালে দরজা খুলে রেখে গিয়েছে। তার পর অনেক গা ঢাকা দিয়ে, একে এড়িয়ে, ওকে বাঁচিয়ে যখন সে জেলের বাইরে মুক্ত বাতাসে এসে ভাবে সে বেঁচে গেছে, ঠিক তখনই তাকে জাবড়ে ধরে দুই পাহারাওয়ালা– সঙ্গে জেলার তাকে চুমো খেয়ে বলে, ভাই, জীবন কত দুঃখে ভরা। তার থেকে তুমি নিষ্কৃতি পাবে কাল ভোরে। আহামুখের মতো সে নিষ্কৃতি থেকে এই হেয় নিষ্কৃতির চেষ্টা তুমি কেন করছিলে, সখা?

পরদিন তার ফাঁসি হয়।

আমার মনে হয়, ফাঁসির চেয়েও ওই যে জেলের বাইরে ধরা পড়া সেটা অনেক কঠোর, কঠিন, নির্মম।

কারণ, মৃত্যু, সে তো কিছু কঠিন কঠোর অভিজ্ঞতা নয়। ডাক্তাররাও বলেন, রোগে মানুষ কষ্ট পায় কিন্তু ঠিক প্রাণত্যাগ করার সময় মানুষ কোনও বেদনা অনুভব করে না।

তাই গুরুদেব বলছেন–

কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়
জয় অজানার জয়!

 ঠিক সেইরকমই এক মহাপুরুষ– হিটলারের নৃশংসতার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত ছিলেন বলে এঁর ফাঁসির হুকুম হয়– জেলে বসে কবিতা লিখেছিলেন,

ডু কান্ স উনস্ ডুর্ষ ডেস টডেস ট্যুরেন
 ট্রয়েমেন্ত ফুরেন্।
উন্ট মাখস্ট উস্ আউফ আইনমাল ফ্রাই।

তুমি আমাদের মৃত্যুর দ্বার দিয়ে হাতে ধরে নিয়ে চল।
 — আমরা যেন স্বপ্নে চলেছি–
হঠাৎ দেখি, আমরা স্বাধীন।

এই বই ছোটদের জন্য লেখা। তারা হয়তো শুধাবে, মৃত্যুর কথা তাদের শোনাচ্ছি কেন? আমার মনে হয়, শোনান উচিত। সাধারণত বড়রা ছোটদের যত আহাম্মুখ মনে করেন আমি বুড়ো হয়েও সেরকম ভাবিনে।

আমার বয়স যখন তেরো, তখন আমার সবচেয়ে ছোট ভাই বছর দুয়েক বয়সে মারা যায়। ভারি সুন্দর ছেলে ছিল সে। আমার কোলে বসতে বড় ভালোবাসত। ওই দু বছর বয়সে সে আমার সাইকেলের রডে বসে হ্যাঁন্ডেল আঁকড়ে ধরে থাকত আর আমি বাড়ির লনে পাক লাগাতুম। মাঝে মাঝে সে খল খল করে হেসে উঠত আর মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে খুশি হয়ে আমাদের দিকে তাকাতেন কিন্তু মাঝে মাঝে বলতেন, থাক হয়েছে। এখন ওকে তুই নামিয়ে দে।

একদিন সে চলে গেল।

 আমি বড্ড কষ্ট পেয়েছিলুম।

তখন আমায় কেউ বুঝিয়ে বলেনি, মৃত্যু কাকে বলে? তার অর্থ যদি তখন আমাকে কেউ বুঝিয়ে বলত তবে বেদনা লাঘব হত।

বড়রা ভাবেন, ছোটদের বেদনাবোধ কম। সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।

তোমরা যারা আমার বই পড়ছ, তোমাদের কেউ কি ভাই-বোন হারাওনি? সে বুঝবে।

কবিগুরুর ছোট ভাই-বোন ছিলেন না। তাই বিস্ময় মানি তিনি কী করে লিখলেন–

কাকা বলেন, সময় হলে
সবাই চলে
যায় কোথা সেই স্বর্গপারে।
বল তো কাকী।
সত্যি তা কি একেবারে?
 তিনি বলেন, যাবার আগে
তন্দ্রা লাগে
ঘণ্টা কখন ওঠে বাজি,
 দ্বারের পাশে।
তখন আসে
ঘাটের মাঝি।
 বাবা গেছেন এমনি করে
কখন ভোরে
তখন আমি বিছানাতে।
 তেমনি মাখন
গেল কখন।
অনেক রাতে।* [* শিশু ভোলানাথ, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড ১০৮-পৃ.।]

এই কাকাটি সত্যই ছোট ছেলের বেদনা বুঝতেন।

কিন্তু মূল কথা থেকে কত দূরে এসে পড়েছি। তাই মৃত্যু সম্বন্ধে শেষ কথা বলে মূল কথায় ফিরে যাই। ভগবানে আমার অবিচল বিশ্বাস। তাই আমি জানি, আমি যখন মরণের সিংহদ্বার পার হব তখন দেখব বাবা, ঠাকুরদা, তার বাবা তার বাবা আরও কত শত ঊর্ধ্ব-পুরুষ সৌম্যবদনে এগিয়ে আসছেন আমাকে তাদের মাঝখানে বরণ করে নেবার জন্য। এবং জানি, জানি, নিশ্চয় জানি, তাঁদের সকলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মা আমার ছোট ভাইকে হাসিমুখে কোলে নিয়ে। তার চেয়েও আশ্চর্য বোধহয় তখন মনের চোখে ছবি দেখি, আমার এই ছোট ভাই, একদা টলটলায়মান পায়ে আমার মায়ের দিকে এগিয়ে এসেছিল, তাঁকে আপনজনের মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য, তার কোলে ওঠার জন্য। সে তো ও লোকে গিয়েছিল মায়ের বহু পূর্বে।

আমি যখন সে লোকে যাব তখন ভগবান শুধাবেন, তুমি কী চাও? আমি তৎক্ষণাৎ বলব, একখানা বাইসিকেল। পাওয়ামাত্রই তাতে ভাইকে রডে চড়িয়ে স্বর্গের লনে চক্কর লাগাব। সে খল খল করে হাসবে। মা দেখবে কিন্তু কখনও বলবে না, থাক্‌, হয়েছে। এখন ওকে তুই নামিয়ে দে।

***

অতএব সব বিপদ থেকেই নিষ্কৃতি আছে। গাড়ি গেছে তো তাতে ভয় পাবার অত কী?

দেখি, আবুল আসফিয়া নেই।

আমাদের এই অকূল সমুদ্র আর অন্তহীন মরুভূমির মাঝখানে ফেলে দিয়ে লোকটা পালাল নাকি?

স্টেশনের বাইরে তার খোঁজ করতে এসে দেখি, তিনি এক জরাজীর্ণ মোটরগাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে রসালাপ আরম্ভ করেছেন। অনুমান করলুম তিনি ট্যাকসিযোগে কাইরো পৌঁছবার চেষ্টাতে আছেন।

কিন্তু ট্যাকসিওয়ালা আমাদের মজ্জমান অবস্থা বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছে এবং যা দর হাঁকছে তা দিয়ে দু খানি নতুন ট্যাক্সি কেনা যায়।

আবুল আসফিয়া তাকে বহুতর ধর্মের কাহিনী শোনাবার চেষ্টা করলেন, ততোধিক ভারত-মিশরীয় মৈত্রীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করলেন এবং সর্বশেষে তিনি মুসলমান সে-ও মুসলমান, সে সত্যের দোহাই-কসম খেলেন কিন্তু ট্যাসিওয়ালাটি ধর্মে মুসলমান হলেও কর্মে খাঁটি দুর্যোধন। বিনা যুদ্ধে সে সূচ্যগ্র পরিমাণ ভূমি এগোবে না।

আবুল আসফিয়ার চোখে-মুখে কিন্তু কোনও উষ্মর লক্ষণ নেই। ভূ-পদাহত তিতিক্ষু শ্রীকৃষ্ণের ন্যায় তিনি তখন চললেন হেলথ অফিসের দিকে। আমিও পিছু নিলুম।

সেই বিরাটবপু, ভদ্রলোক, যিনি আমাদের সার্টিফিকেট দিয়ে প্রথম ফাড়া থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি ততক্ষণে আবার ঘুমিয়ে পড়েছেন। এবার তাকে জাগাতে গিয়ে আবুল আসফিয়াকে রীতিমতো বেগ পেতে হল।

তাকে তখন তিনি যা বললেন, তার সরল অর্থ, তিনি ডাকাতকে ডরান না, ডাকাত বন্দুক উঁচালে তিনিও বন্দুক তুলতে জানেন কিন্তু এরকম বন্দুকহীন ডাকাতির বিরুদ্ধে লড়বার মতো হাতিয়ার তো তার নেই? অবশ্য তিনি ঘাবড়াননি, কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা করবেনই, তবে কি না অফিসারটি যদি একটু সাহায্য করেন তবে আমাদের উপকার হয়, তারও পুণ্য হয়।

অফিসার বললেন, চলুন।

তিনি ট্যাকসিওয়ালাদের সঙ্গে দু চারটি কথা বলেই আমাদের জানালেন কত দিতে হবে। হিসাব করে দেখা গেল, গাড়িতে ফার্স্ট ক্লাসে যা লাগত, ট্যাসিতে তাই লাগবে। আমরা তাতেই খুশি। কাইরো তো পৌঁছব, পোর্টসঈদে তো জাহাজ ধরতে পারব, তবে আর ভাবনা কী?

আমরা হুড়মুড় করে দু খানা ট্যাকসিতে কাঁঠালবোঝাই হয়ে গেলুম।

আমি অফিসারকে ধন্যবাদ দিয়ে ওঠার সময় বললুম, আপনি আমাদের জন্য এতখানি করলেন। সত্যই আপনার দয়ার শরীর।

তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে যা বললেন তা শুনে আমি অবাক। তার অর্থ তার শরীর আদপেই দয়ার শরীর নয়। তিনি কিছুমাত্র পরোপকার করেননি। আমরা একপাল ভিখিরি যদি সুয়েজ বন্দরে আটকা পড়ে যাই তবে শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই ঘাড়ে পড়ব। আমাদের তাড়াতে পেরে তিনি বেঁচে গেছেন–ইত্যাদি।

আমি আপত্তি জানিয়ে মোটরে বসে ভদ্রলোকের কথাগুলো ভাবতে লাগলুম।

 হঠাৎ বুঝতে পারলুম ব্যাপারটা কী—বহুদিন পূর্বেকার একটা ঘটনা মনে পড়ে যাওয়াতে।

রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারি ছিলেন তাঁর দাদার নাতি দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার এক চিত্রকর বন্ধু বিনোদবিহারী একদিন তার দুরবিনটি ধার নিল- বেচারী চোখে দেখতে পেত কম। কয়েকদিন পরে সেটা ফেরত দিতে গেলে দিনুবাবু জিগ্যেস করলেন, কী রকম দেখলে?

আজ্ঞে, চমৎকার! বিনোদ এত দূরের জিনিস এর আগে কখনও দেখতে পায়নি। তবে ওটা তোমার কাছেই রেখে দাও। লোকে বড় জ্বালাতন করে। আজ ওটা এ চায়, কাল ওটা ও চায়, পরশু ওটা সে চায়। আমি পেরে উঠিনে। তোমার কাছে ওটা থাক।

বিনোদ একাধিকবার চেষ্টা করেও দুরবিন ফেরত দিতে পারেনি।

এই হল খানদানি লোকের পরোপকার পদ্ধতি। সে দেখায়, যেন সে আদপেই পরোপকার করেনি। নিতান্ত নিজের মঙ্গলের জন্য, আগাগোড়া সে স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে।

বুঝলাম এ অফিসারটিও দিনুবাবুর সগোত্র। ইচ্ছে করেই সগোত্র শব্দটি ব্যবহার করলুম; আমার বিশ্বাস ইহসংসারের যাবতীয় ভদ্রলোক একই গোত্রের– তা তারা ব্রাহ্মণ হন আর চণ্ডাল হন, হিন্দু হন আর মুসলমান হন, কাফ্রি হন আর নর্ডিক হন।

ততক্ষণে আমরা বন্দর ছেড়ে মরুভূমিতে ঢুকে গিয়েছি। পিছনে তাকিয়ে দেখি, শহরের বিজলিবাতি ক্রমেই নিষ্প্রভ হয়ে আসছে– বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরনো স্মৃতি যেরকম আবছায়া আবছায়া হয়ে থাকে।

.

১৬.

মরুভূমির উপর চন্দ্রালোক। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। সে দৃশ্য বাংলা দেশের সবুজ শ্যামলিমার মাঝখানে দেখা যায় না। তবে যদি কখনও পদ্মার বিরাট বালুচড়ায় পূর্ণিমা রাতে বেড়াতে যাও–রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই যেতেন এবং নিশীথে গল্প তারি পটভূমিতে লেখা– তা হলে তার খানিকটে আস্বাদ পাবে।

সমস্ত ব্যাপারটা কেমন যেন ভুতুড়ে বলে মনে হয়। চোখ চলে যাচ্ছে দূর দিগন্তে অথচ হঠাৎ যেন ঝাপসা আবছায়ার পর্দায় ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। মনে হয়, যেন দেখতে পাচ্ছি, তবু ঠিক ঠিক দেখতে পারছিনে, চিনতে পারছি তবু ঠিক ঠিক চিনতে পারছিনে। চতুর্দিকে ফুটফুটে জ্যোৎস্নার আলো যেন উপচে পড়ে মনে হয় এ আলোতে অক্লেশে খবরের কাগজ পড়া যায়, অথচ এ আলোতে লাল-কালোর তফাত যেন ঘুচতে চায় না। মেঘলা দিনে এর চেয়ে অনেক ক্ষীণালোকে রঙের পার্থক্য অনেক বেশি ধরা পড়ে।

তাই, মনে হল পাখি, মনে হল মেঘ, মনে হল কিশলয়,
ভালো করে যেই দেখিবারে যাই মনে হল কিছু নয়।
দুই ধারে একি প্রাসাদের সারি, অথবা তরুর মূল।
অথবা এ শুধু আকাশ জুড়িয়া আমারই মনের ভুল?

 মাঝে মাঝে আবার হঠাৎ মোটরের দু মাথা উঁচুতে ফুটে ওঠে, জ্বলজ্বল দুটি ছোট সবুজ আলো; ওগুলো কী? ভূতের চোখ নাকি? শুনেছি ভূতের চোখই সবুজ রঙের হয়। নাহ! কাছে আসতে দেখি উটের ক্যারাভান এদেশের ভাষাতে যাকে বলে কাফেলা (কবি নজরুল ইসলাম এ শব্দটি বাঙলায় ব্যবহার করেছেন) উটের চোখের উপর মোটরের হেডলাইট পড়াতে চোখদুটো সবুজ হয়ে আমাদের চোখে ধরা দিয়েছে। দেশে গরু-বলদের চোখে আলো পড়ে ঠিক এ রকমই হয়, কিন্তু বলদের চোখে যে লেভেলে দেখি উটের চোখে তার অনেক উপরে দেখতে পেলুম বলে এতখানি ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম।

আর কেনই পাব না বল? জনমানবহীন মরুভূমির ভিতর দিয়ে চলেছ, রাত্রিবেলা– আবার বলছি, রাত্রিবেলা। মরুভূমি সম্বন্ধে কত গল্প, কত সত্য, কত মিথ্যে পড়েছি ছেলেবেলায়। তৃষ্ণায় সেখানে বেদুইন মারা যায়, মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বেদুইন তার পুত্রের চেয়ে প্রিয়তর উটের গলা কাটে, সেখান থেকে উটের জমানো জল খেয়ে প্রাণ বাঁচাবার জন্য, তৃষ্ণায় মতিচ্ছন্ন হয়ে গিয়ে সে হঠাৎ কাপড়-চোপড় ফেলে দিয়ে উলঙ্গ হয়ে সূর্যের দিকে জিভ দেখিয়ে দেখিয়ে নাচে শুষ্ককণ্ঠে বীভৎস গলায় গান জোড়ে,

তুই (অশ্লীলবাক্য)– তুই ক্যা রে?
তুই আমার কী করতে পারিস তুই ক্যা রে?

 এবং তার চেয়েও বদখদ বেতালা পদ্য।

যদি মোটর ভেঙে যায়? যদি কাল সন্ধে অবধি এ রাস্তা দিয়ে আর কোনও মোটর না আসে? পষ্ট দেখতে পেলুম এ গাড়ি রওনা হওয়ার পূর্বে পাঁচশো গ্যালন জল সঙ্গে তুলে নেয়নি; তখন কী হবে উপায়?

কিন্তু করুণাময়কে অসীম ধন্যবাদ, পল-পার্সি দেখলুম অন্য ধরনের ছেলে। তারা সেই জরাজীর্ণ মোটরগাড়ির কটকটহি মরকট বিকট ভট কোটি কোটিনহ ধাবহি (তুলসীদাস তার রামায়ণে বানরদের কলরোলের বর্ণনা দিতে গিয়ে ট-এর অনুপ্রাস ব্যবহার করেছেন) শব্দ ছাপিয়ে বিকটতর কটকট করছে। তাদের কী আনন্দ!

পল : সবকিছু ভালো করে দেখে নে; মাকে যাবতীয় জিনিস যেন গুছিয়ে লিখতে পারিস।

পার্সি : তোর জীবনে এই দুই প্রথম একটা খাঁটি কথা কইলি। কোনও জিনিস যেন বাদ না পড়ে। ওহ, মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। জাহাজে চড়ার সময় কি কল্পনা করতে পেরেছিলুম। জাহাজে চড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোকটে মরুভূমির ভিতর দিয়ে চড়ে যাব?।

পল : ঠিক বলেছিস্। আর মা-বাবা কীরকম আশ্চর্য হবেন ভাব দিকিনি। কিন্তু, ভাই, ওনারা যদি তখন ধমক দেন, জাহাজ ছেড়ে তোমরা এরকম বাউণ্ডুলিপনা করতে গিয়েছিলে কেন? তখন?

পার্সি বললে : ওই তোর দোষ! সমস্তক্ষণ ভয়ে মরিস। তখন কি আর একটা সদুত্তর খুঁজে পাব না! ওই স্যর রয়েছেন। ওঁকে জিজ্ঞাসা কর না। উনি কী বলেন।

আমি বললুম, দোষ দেবেন, তো তখন দেবেন। এখন সে আলোচনা করতে গিয়ে দেখবার জিনিস অবহেলা করবে নাকি? বিশেষত, যদি আমাদের অভিযান অন্যায় কর্মই হয়ে থাকে, সেটাকে যখন রদ করার শক্তি আমাদের হাতে নেই।

পার্সি বললে : আর ফিরে গিয়েই-বা কী লাভ? আমাদের জাহাজ তো অনেকক্ষণ হল ছেড়ে দিয়েছে।

চালাক ছেলে; সর্বদিকে খেয়াল রাখে।

মরুভূমিতে দিনের বেলা যেরকম প্রচণ্ড গরম, রাত্রে ঠিক তেমনি বিকট শীত। বৈজ্ঞানিকেরা তার একটা অত্যুকৃষ্ট ব্যাখ্যা দেন বটে, কিন্তু ধোপে সেটা কতখানি টেকে আমি যাচাই না করে বলতে পারব না। উপস্থিত শুধু এইটুকু বলতে পারি, জাহাজে দিনের পর দিন রাতের পর রাত দুঃসহ গরমে হাড়মাংস যেন আচার হয়ে গিয়েছিল; ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ পেয়ে সর্বাঙ্গ যেন জলে-ভেজা জুইফুলের মতো ফুলে উঠল।

এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে একাধিকবার হয়েছে। পেশাওয়ার, জালালাবাদের ১২০/১২২ ডিগ্রি সওয়ার পর আমি খা-ই-জব্বারের ৬০ ডিগ্রিতে পৌঁছতে কী আরাম অনুভব করেছিলুম সে বর্ণনা অন্যত্র করছি। কোথায়? উঁহু সেটি হচ্ছে না। বললেই বলবে, আমি সুযোগ পেয়ে আমার অন্য বইয়ের বিজ্ঞাপন এখানে নিখরচায় চালিয়ে দিচ্ছি।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম মনে নেই। যখন মোটরের হঠাৎ একটুখানি জোর ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল তখন দেখি চোখের সামনে সারি সারি আলো। কাইরো পৌঁছে গিয়েছি। গাড়ির আর সবাই তখনও ঘুমোচ্ছে। আমার সন্দেহ হল ড্রাইভারও বোধ করি ঘুমোচ্ছে। গাড়ি আপন মনে বাড়ির দিকে চলেছে; সোয়ার ঘুমিয়ে পড়লেও ঘোড়া যেরকম আপন বাড়ি খুঁজে নেয়।

পার্সিকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিয়ে বললুম : তবে না, বস্ত্র, বলেছিলে, মরুভূমির সব টুকিটাকি পর্যন্ত মনের নোটবুকে টুকে নেবে? যেন আমি নিজে কতই না জেগে ছিলুম।

পার্সিও তালেবর ছেলে। তখুনি দিল পলের কানে ধরে একখানা আড়াই গজি টান। আমি পার্সিকে যা বলেছিলুম সে পলকে তাই শুনিয়ে দিল। পল বেচারী আর কী করে? সে আস্তে আস্তে মাদমোয়াজেল শেনিয়েকে জাগিয়ে দিয়ে বললে, কাইরো পৌঁছে গিয়েছি।

বাঙাল দেশে কথায় কয়– পশ্চিম বাঙলায় বলে কি না জানিনে– সায়েব বিবিকে মারলেন চড়, বিবি বাঁদিকে দিলেন ঠ্যাঙ্গা, বাঁদি বেড়ালকে মারলে লাথি, বেড়াল খামচে দিলে নুনের ছালাটাকে।

সংসারে এই রীতি!

এখানে অবশ্য প্রবাদ টায়টায় মিলল না। তাই পল অতি সবিনয়ে মেমসাহেবকে জাগিয়ে দিল।

মাদমেয়োজেল হ্যান্ডব্যাগ থেকে পাউডার বের করে নাকে ঘষতে ঘষতে ফরাসিতে শুধালেন, আমার বিশ্বাস ফরাসিনীরা ঘুমন্ত অবস্থায়ও ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে পারেন এবং লাগান–আমরা কোথায় পৌঁছলুম, মঁসিয়ে?

ল্য ক্যার।

পল বেশ খানিকটে ফরাসি জানত। আমাকে শুধাল : ল্য ক্যার অর্থ হল দি কাইরো। ল্যটা আবার পুংলিঙ্গ। একটা শহরের আবার পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ কী করে হয়?

আমি বললুম : অত বিদ্যে আমার নেই, বাপু! তবে এইটুকু জানি এ বাবদে ফরাসিই একমাত্র আসামি নয়। আমরা ব্ৰহ্মপুত্রকে বলি নদ, অর্থাৎ পুংলিঙ্গ এবং গঙ্গাকে বলি নদী অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গ। কেন বলি জানিনে।

পার্সি বললে : আমরা ইংরেজরাই-বা জাহাজকে শি অর্থাৎ স্ত্রীলিঙ্গ দিয়েছি কেন?

আমি বললুম : উপস্থিত এ আলোচনা অক্সফোর্ডের জন্য মুলতুবি রেখে দাও– সেখানেই তো পড়তে যাচ্ছ– এবং নিশির কাইরোর সৌন্দর্যটি উপভোগ করে নাও।

সত্যি, এরকম সৌন্দর্য সচরাচর চোখে পড়ে না। আমরা যখন চন্দননগর থেকে কলকাতা পৌঁছই তখন মাঝখানে ঘনবসতি আর বিস্তর জোরালো বাতি থাকে বলে কলকাতার রোশনাই ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারিনে। এখানে মরুভূমি পেরিয়ে হঠাৎ শহর বলে একসঙ্গে সব-কটা আলো চোখে পড়ে এক অদ্ভুত মরীচিৎকার সৃষ্টি করে।

ছ-তলা বাড়ির উপরে অবশ্য বাড়িটা দেখা যাচ্ছে না– দেখি, লাল আলোতে জ্বালানো সেলাইয়ের কলের উঁচ ঘন ঘন উঠছে-নামছে, আর সবুজ আলোর চাকা ঘুরেই যাচ্ছে ঘুরেই যাচ্ছে। নিচে এক বিলিতি কোম্পানির নাম। আমার মনে হল, হায়! কলটার নাম যদি উষা হত। সেদিন আসবে যেদিন ভারতীয়– যাগে।

আরও কতরকমের প্রজ্বলিত বিজ্ঞাপন। এ বিষয়ে কলকাতা কাইরোর পিছনে।

করে করে শহরতলিতে ঢুকলুম। কলকাতার শহরতলি রাত এগারোটায় অঘোরে ঘুমোয়। কাইয়োর সব চোখ খোলা– অর্থাৎ খোলা জানালা দিয়ে সারি সারি আলো দেখা যাচ্ছে। আর রাস্তার কথা বাদ দাও। এই শহরতলিতেই কত না রেস্তোরাঁ কত না কাফে খোলা; খদ্দেরে খদ্দেরে গিসগিস করছে। (আমাদের যেরকম চায়ের দোকান, মিশরিদের তেমনি কাফে অর্থাৎ কফির দোকান! আমি প্রায়ই ভাবি কফির দোকান যদি কাফে হতে পারে তবে চায়ের দোকান চাফে হয় না কেন? চলো ভাই চাফেতে যাই বলতে কী দোষ?)।

আবার বলছি রাত তখন এগারোটা। আমি বিস্তর বড় বড় শহর দেখেছি কিন্তু কাইরোর মতো নিশাচর শহর কোথাও চোখে পড়েনি।

কাইরোর রান্নার খুশবাইয়ে রাস্তা ম-ম করছে। মাঝে মাঝে নাকে এসে এমন ধাক্কা লাগায় যে মনে হয় নেমে পড়ে এখানেই চাটি খেয়ে যাই। অবশ্য রেস্তোরাঁগুলো আমাদের পাড়ার চায়ের দোকানেরই মতো নোংরা। তাতে কী যায়-আসে? কে যেন বলছে, নোংরা রেস্তোরাঁতেই রান্না হয় ভালো; কালো গাই কি সাদা দুধ দেয় না?

আমার খেতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ওইসব সায়েব-মেমরা যখন রয়েছেন তাঁরা ‘মঁ দিয়ো’, ‘হ্যার গট’ কী যে বললেন তার তো ঠিকঠিকানা নেই।

আচম্বিতে দুখানা গাড়িই দাঁড়াল। বসে বসে সবাই অসাড় হয়ে গিয়েছি। সব্বাই নেমে পড়লুম। সক্কলেরই মনে এক কামনা। আড়ামোড়া দিয়ে নিই, পা দুটো চালিয়ে নিই, হাত দু খানা ঘুরিয়ে নিই।

এমন সময় আবুল আসফিয়া আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, মাথা পিছনের দিকে ঈষৎ ঠেলে দিয়ে, হাত দুখানা সামনের দিকে সম্প্রসারিত করে, পোলিটিশিয়নদের কায়দায় শ্ৰদ্ধানন্দ-পার্কি লোর ঝাড়তে আরম্ভ করলেন, কিন্তু ভাঙা ভাঙা ফরাসিতে

মেদাম, মেমোয়াজেল এ মেসিয়ো–

(ভদ্রমহিলাগণ, ভদ্রকুমারীগণ এবং ভদ্রমহোদয়গণ)

আমরা সকলেই এক্ষণে তৃষ্ণার্ত এবং ক্ষুধাতুর। নগরী প্রবেশ করত আমরা প্রথমেই উত্তম কিংবা মধ্যম শ্রেণির ভজনালয়ে আহারাদি সমাপন করব। কিন্তু প্রশ্ন, সেখানে খেতে দেবে কী? জাহাজে যা দেয় তা-ই। সেই বিস্বাদ সুপ, বিস্বাদতর স্টু, তদিতর পুডিং। অর্থাৎ সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কিংবা অ্যাংলো-ইজিপশিয়ন– যাই বলুন– রস-সহীন খানা।

পক্ষান্তরে, এই শহরতলিতে যদি আমরা কিঞ্চিৎ আদিম এবং অকৃত্রিম মিশরীয় খাদ্য, মিশরীয় পদ্ধতিতে সুপকু খাদ্য ভোজন করি তবে কি এক নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে না?

আমরা কিছু বলার পূর্বেই তিনি হাত দুখানা গুটিয়ে নিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ঘাড়ের ডান দিকটা চুলকোতে চুলকোতে বললেন : অতি অবশ্য, রেস্তোরাঁগুলো নোংরা। চেয়ার-টেবিল সাফসুরো নয়, কিন্তু মেদাম, মাদমোয়াজেল, মেসিয়ে, আমরা তো আর টেবিল-চেয়ার খেতে যাচ্ছিনে। আমরা খেতে যাচ্ছি খানা। জাহাজের রান্না যখন আমাদের খুন করতে পারেনি তখন এ রান্নাই-বা করবে কী করে? আপনারাই বলুন?

কেউ কিছু বলার পূর্বেই পার্সি চেঁচিয়ে উঠল : অফুঁকোস, অকোস্ –আলবৎ, আলবৎ আমরা নিশ্চয়ই খাব। আমরা যখন মিশরীয় হাওয়াতেই খাস নিচ্ছি, মিশরীয় জলই খাব, তখন মিশরীয় খাদ্য খাব না কেন?

মাদমোয়াজেল শেনিয়ে বললেন; যারা খেতে চান না, তারা খাবেন না। আমি যাচ্ছি।

আর আমি বুঝলুম, ফরাসি দেশটা কতখানি স্বাধীনতার দেশ। স্বাধীনতা ফরাসিদের হাড়ে-হাড়ে মজ্জায়-মজ্জায়।

শেনিয়ে ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ডেলিকেট প্রাণী। জাহাজের রান্না তার পছন্দসই ছিল না বলে তিনি টোস্ট, দুধ, ডিম, মটর, কপি, আলুসেদ্ধ খেয়ে প্রাণ ধারণ করতেন। তিনি যখন রাজি তখন–?

আমার মনে হয়, আমরা যে তখন সবাই নিকটতম রেস্তোরাঁয় হুড়মুড় করে ঢুকলুম তার একমাত্র কারণ এই নয় যে, মাদমোয়াজেল ঢুকতে প্রস্তুত, আমার মনে হয় আর সবাইও তখন মিশরি খানার এক্সপেরিমেন্ট করবার জন্য তৈরি। সর্বোত্তম কারণ সবাই তখন ক্ষুধায় কাতর। কোথায় কোন খানদানি রেস্তোরাঁয় কখন পৌঁছব তার কী ঠিক-ঠিকানা? সেখানে হয়তো এতক্ষণে সব মাল কাবার। খেতে হবে মাখন-রুটি, দিতে হবে মুরগি-মটনের দর। তার চেয়ে ভর-ভর খুশবাইয়ের খাবারই প্রশস্ততর। হাতের কাছে যা পাচ্ছি, তাই ভালো, সেই নিয়ে আমি খুশি।

রবিঠাকুর বলেছেন,

কাছের সোহাগ ছাড়বে কেন
দূরের দূরাশাতে?

 ইরানি কবি ওমর খৈয়ামও বলেছেন,

Oh, take the Cash, and let the Credit go,
Nor heed the rumble of distant Drum!

কান্তি ঘোষ তার বাঙলা অনুবাদ করেছেন,

নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক,
দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক!

রেস্তোরাঁগুলো ছুটে এসে আমাদের আদর-কদর করে অভ্যর্থনা (ইসতিকবাল) জানাল। তার বয়-রা বত্রিশখানা দাঁতের মুলো দেখিয়ে আকর্ণ হাসল। তড়িঘড়ি তিনখানা ছোট ছোট টেবিল একজোড়া করে, চেয়ার সাজিয়ে আমাদের বসবার ব্যবস্থা করা হল, রান্নাঘর থেকে স্বয়ং বাবুর্চি ছুটে এসে তোয়ালে কাঁধে বার বার ঝুঁকে ঝুঁকে সেলাম জানাল। বসতে গিয়ে দেখি, শ্যামবাজারের সেই লোহার চেয়ার। শীত-গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতেই বসতে গেলে ছ্যাকা দেয়।

আমি তখন আমার অভিজ্ঞতা গিলছি। অর্থাৎ দেখছি বয়গুলোর কী সুন্দর দাঁত। এরকম দুধের মতো সুন্দর দাঁত হয় কী করে? সে দাঁতের সামনে এরকম রক্তকরবীর মতো রাঙা ঠোঁট এরা পেল কোথা থেকে? এবং ঠোঁটের সীমান্ত থেকেই সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে কী অদ্ভুত এক নবীন রঙ! এ রঙ আমার দেশের শ্যামল নয়, এ যেন কী এক ব্রোঞ্জ রঙ! কী মসৃণ কী সুন্দর!

কিন্তু সর্বাধিক মনোরম বাবুর্চির ভুড়িটা। ওহ! কী বিশাল, কী বিপুল, কী জাঁদরেল!

তার থেকেই অনুমান করলুম আমরা ভালো রেস্তোরাঁতেই ঢুকেছি।

ইতোমধ্যে আবুল আসফিয়া এবং মাদমোয়াজেল শেনিয়ে বাবুর্চিকে নিয়ে খুদ রান্নাঘরে চলে গিয়েছেন, আহারাদির বাছাই তদারক করতে এবং গোটাচারেক ছোকরা এসে আমাদের চতুর্দিক ঘিরে চেঁচাচ্ছে, বুৎ, বালিশ, বুৎ বালিশ!

সে আবার কী যন্ত্রণা!?!

বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না; কারণ এদের সকলের হাতে কাঠের বাক্স আর গোটা দুই করে বুরুশ। ততক্ষণে আবার মনে মনে, ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনা করে বুঝে নিয়েছি, আরবিতে ট নেই বলে বুট হয়ে গিয়েছে বুৎ এবং প নেই বলে পলিশ হয়ে গিয়েছে বালিশ–একুনে দাঁড়াল বুৎ বালিশ! তাই আরবরা পণ্ডিত জওহরলালের নাম উচ্চারণ করে বান্দিৎ জওয়াহরলাল। ভাগ্যিস আরবি ভাষায় ট নেই। থাকলে নিরীহ পণ্ডিত আরবিস্থানের ব্যান্ডিট হয়ে যেতেন! আদন অঞ্চলের আরবিতে আবার গ নেই, তাই তারা গান্ধীর নাম উচ্চারণ করে জান্দী। অবশ্য সেটা কিছু মন্দ নয়–সত্যের জন্য জান দিই বলেই তো তিনি প্রাণ দান করে দেহত্যাগ করলেন।

বাঙালি তেড়ি কাটতে ব্যস্ত, ইংরেজ সমস্তক্ষণ টাইটা ঠিক গলার মাঝখানে আছে কি না তার তদারকিতে ব্যস্ত, শিখেরা পাগড়ি বাঁধতে ঘণ্টাখানেক সময় নেয়, কাবুলিরা হামেহাল জুতোতে পেরেক ঠোকাতে ব্যতিব্যস্ত, আর কাইরোবাসীরা দেখলুম বুৎ বালিশের নেশাতে মশগুল। তা না হলে রাতদুপুরে গণ্ডায় গণ্ডায় বুৎ বালিশওয়ালারা কাফে-রেস্তোরাঁয় ধন্না দিতে যাবে কেন?

তবে হ্যাঁ, পালিশ করতে জানে বটে। স্পিরিট দিয়ে পুরনো রঙ ছাড়াল, সাবানজল দিয়ে অন্য সব ময়লা সাফ করল, ক্রিম লাগাল, পালিশ ছোঁয়াল, প্রথম হাল্কা ক্যাম্বিস পরে মোলায়েম সিঙ্ক দিয়ে জুতোর জৌলুস বাড়াল। তখন জুতোর যা অবস্থা! তাতে তখন আয়নার মতো মুখ দেখা যায়। বুরুশের ব্যবহার তো প্রায় করলই না– চামড়া নাকি তাতে জখম হয়ে যায়।

কিন্তু আশ্চর্য বোধ হল, সেই ঝাঁ চকচকে জুতোজোড়াকে সর্বশেষে কাপড় দিয়ে ঘষে অল্প– অতি অল্প– ম্যাটমেটে করে দিল কেন? এতখানি মেহনত করে চাকচিক্য জাগানোর পর সেটাকে ম্যাটমেটে করে দেবার কী অর্থ?

একটা গল্প মনে পড়ল :

এক সাহেব পেসট্রিওয়ালাকে অর্ডার দিলেন একটা জন্মদিনের কেক বানাবার জন্যে। কেকের উপর যেন সোনালি-নীলে তার নামের আদ্য অক্ষর পি. বি. ডাবলইউ লেখা থাকে। ডেলিভারি নেবার সময় দোকানদারকে বললেন, হু, কেকটি দেখাচ্ছে উত্তম, কিন্তু হরফগুলো বানানো হয়েছে সোজা অক্ষরে। আমি চাই ট্যারচা ধরনে, ফ্লুরাল ডিজাইনে।

দোকানি খদ্দেরকে সন্তুষ্ট করতে চায়। বললে এক্ষুণি করে দিচ্ছি। জন্মদিনের ব্যাপার চাট্টিখানি কথা নয়।

প্রচুর পরিশ্রম করে সে কেকের উপরটা চেঁচে নিল। তার পর প্রচুরতম গলদৃঘর্ম হয়ে তার উপর হরফগুলো বাঁকা ধরনের আঁকল, আরও মেলা ফুল ঝালর চতুর্দিকে সাজাল।

সায়েব বললেন, শাবাস, উত্তম হয়েছে।

দোকানি খুশি হয়ে শুধাল, প্যাক করে আপনাকে দেব, না কোনও বিশেষ ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে হবে?

সাহেব হেসে বললেন, কোনওটাই না। আমি ওটা নিজেই খাব।

বলেই ছুরি দিয়ে চালা চা করে গব-গব করে আস্ত কেকটা গিললেন। দোকানি তো থ। তা হলে অত-শত করার কী ছিল প্রয়োজন?

বুৎ বালিশের বেলাও তাই।

বুৎ বালিশওলাকে শুধালুম, পালিশ কমিয়ে দেওয়ার কারণটা কী?

একটুখানি হকচকিয়ে সামলে নিয়ে বললে, গাইয়ারাই শুধু অত্যধিক চাকচিক্য পছন্দ করে। শহরের ভদ্রলোক সব জিনিসেরই মেকদার মেনে চলেন।

অ-অ-অ-!

তখন মনে পড়ল, অবন ঠাকুরও বলেছেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা আগের দিনে সোনার গয়না পরে পাল্কিতে বেরুবার সময় তার উপর মলমলের পট্টি বেঁধে দিতেন। বড় বেশি চাকচিক্য নাকি গ্রাম্যজনসুলভ বর্বরতা!

.

১৭.

আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি। ইংরেজ খায় মিষ্টি আর নোনা; ঝাল অতি সামান্য, টক তার চেয়েও কম এবং তেতো জিনিস যে খাওয়া যায়, ইংরেজের সেটা জানা নেই। তাই ইংরিজি রান্না আমাদের কাছে ভোঁতা এবং বিস্বাদ বলে মনে হয়। অবশ্য ইংরেজ ভালো কেক-পেট্রি-পুডিং বানাতে জানে– তাও সে শিখেছে ইতালিয়ানদের কাছ থেকে এবং একথাও বলব আমাদের সন্দেশ রসগোল্লার তুলনায় এসব জিনিস এমনকি, যে নাম শুনে মূর্ছা যাব?

মিশরীয় রান্না ভারতীয় রান্নার মামাত বোন অবশ্য ভারতীয় মোগলাই রান্নার। আমি প্রমাণ করতে পারব না, কিন্তু বহু দেশে বহু রান্না খেয়ে আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, মোগলরা এ দেশে যে মোগলাই রান্নার তাজমহল বানালেন (এবং ভুললে চলবে না সে রান্না তাঁর আপন দেশে নির্মাণ করতে পারেননি, কারণ ওঁদের মাতৃভূমি তুর্কিস্থানে গরম মসলা গজায় না) তারই অনুকরণে আফগানিস্থান, ইরান আরবিস্থান, মিশর-ইস্তেক স্পেন অবধি আপন আপন ক্ষুদে ক্ষুদে রান্নার তাজমহল বানাতে চেষ্টা করেছে। এ রান্নার প্রভাব পূর্ব-ইয়োরোপের গ্রিস, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, আলবেনিয়া, ইতালি পর্যন্ত পৌঁছেছে।

এসব তত্ত্ব আমার বহুদিনকার পরের আবিষ্কার। উপস্থিত আবুল আসফিয়া আর ক্লোদেৎ নিয়ে এলেন বারকোশে হরেকরকম খাবারের নমুনা। তাতে দেখলুম, রয়েছে মুরগি মুসল্লম, শিককাবাব, শামিকাবাব আর গোটা পাঁচ-ছয় অজানা জিনিস। জানা জিনিসগুলো যে ঠিক ঠিক কলকাত্তাই খুশবাই নিয়ে এল তা নয়, কিন্তু তাতেই-বা কী? জাহাজের আইরিশ স্টু আর ইটালিয়ান মাক্কারনি খেয়ে খেয়ে পেটে তো চর পড়ে গিয়েছে; এখন এসব জিনিসই অমৃত। আমার প্রাণ অবশ্য তখন কাঁদছিল চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য অত-শত বলি কেন, শুধু ঝোলভাতের জন্য, কিন্তু এসব জিনিস তো আর বাঙলা দেশের বাইরে পাওয়া যায় না, কাজেই শোক করে কী লাভ?

তাই দেখিয়ে দিলুম, আমার কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন সেই বারকোশ থেকেই।

পাশের টেবিলে দেখি, একটা লোক তার প্লেটে দুটি শসা নিয়ে খেতে বসেছে। দুটি শসা– তা সে যত তিন ডবল সাইজই হোক না– কী করে মানুষের সম্পূর্ণ ডিনার হতে পারে বহু চিন্তা করেও তার সমাধান করতে পারলুম না। তা-ও আবার দোকানে ঢুকে, টেবিল-চেয়ার নিয়ে সস্-চাটনি সাজিয়ে। আর ইংলন্ডের মতো খানদানি দেশেও তো মানুষ রাস্তায় দুটো আপেল কিনে চিবোয় রেস্তোরাঁয় ঢুকে সস্-চাটনি নিয়ে সেগুলো খেতে বসে না। তবে কি এদেশ ইংল্যান্ডের চেয়েও খানদানিতর? এদেশে কি এমন সব সর্বনেশে আইন-কানুন আছে যে রাস্তায় শসা বিক্রি বারণ, যে রকম শিব ঠাকুরের আপন দেশে,

কেউ যদি পা পিছলে পড়ে,
 প্যায়দা এসে পাকড়ে ধরে,
 কাজীর কাছে হয় বিচার
একুশ টাকা দণ্ড তার।
 সেথায় সন্ধে ছটার আগে,
 হাঁচতে হলে টিকিট লাগে;
 হাঁচলে পরে বিনা টিকিতে
 দমদমাদম্ লাগায় পিঠে
 কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।*
কী জানি কী ব্যাপার!

[* সুকুমার রায়, আবোল-তাবোল, পৃ. ৩২, তৃতীয় সিগনেট সংস্করণ।]

এমন সময় দেখি, সেই লোকটা শসা চিবুতে আরম্ভ না করে তার মাঝখানে দিল দুহাতে চাপ। অমনি হড়হড় করে বেরিয়ে এল পোলাও জাতীয় কী যেন বস্তু, এবং তাতেও আবার কী যেন মেশানো। আমি অবাক! হোটেলওলাকে গিয়ে বললুম, যা আছে কুলকপালে, আমি ওই শসাই খাব।

এল দু খানা শসা।*[* আসলে শসা নয়, একরকমের ছোট লাউ।] কাঁটা দিয়ে একটুখানি চাপ দিতেই বেরিয়ে এল পোলাও। সে পোলাওয়ের ভিতর আবার অতি ছোট ছোট মাংসের টুকরো (এদেশে যাকে বলা হয় কিমা) টমাটোর কুচি এবং গুঁড়নো পনির। বুঝলুম এসব জিনিস পুরেছে সেদ্ধ শসার ভিতর এবং সেই শসাটা সর্বশেষে ঘিয়ে ভেজে নিয়েছে। যেন মাছ-পটলের দোলমা শুধু মাছের বদলে এখানকার শসায় পোলাও, মাংস, টমাটো এবং চিজ! তার-ই ফলে অপূর্ব এই চিজ।

শসাকে চাক্তি করে পোলাওয়ের সঙ্গে মুখে দিয়ে বুঝলুম, একই সঙ্গে ভাত, মাংস, শবজি, ফল এবং সেভরি খাওয়া হয়ে গেল।

আর সে কী সোয়াদ! মুখে দেওয়ামাত্র মাখনের মতো গলে যায়।

 এরকম পাঁচেক্কে পাঁচ পদ আমি পৃথিবীতে আর কোথাও খাইনি।

আরেকটা জিনিস খেলুম সে-ও অতুলনীয়। মিশরি শিম-বিচি। আলীবাবা বায়স্কোপে যে সব বিরাট বিরাট উঁচু তেলের জালা দেখছ তারই গোটা দু তিন সিমেতে ভর্তি করে সমস্ত রাত ধরে চালায় সিদ্ধক। সেই সিমে অলিভঅয়েল আর একরকমের মসলা মিশিয়ে খেতে দেয় সকালবেলা থেকে। আমরা খেলুম রাত্তিরে। তার যা সোয়াদ! এখনও জিভে লেগে আছে। আমাদের শিম-বিচি তার কাছে কিছুই না। পল-পার্সিও মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করল চীন দেশের সোয়াবিনও এর সামনে কেন, পিছনেও দাঁড়াতে পারে না।

শুনলুম এই শিম-বিচি গরিব থেকে আরম্ভ করে মিশরের রাজা দু-সন্ধ্যা খেয়ে থাকেন। হোটেলওলা বললে, পিরামিড নির্মাতা এক ফারাও মহারাজ নাকি এই বিন খেতে এত ভালোবাসতেন যে, প্রজাদের বারণ করে দিয়েছিলেন তারা কেউ যেন বিন না খায়! সাধে কি আর লোকে ফারাওদের খামখেয়ালি বলত?

শুনলুম এই বিনের আরবি শব্দ ফুল।

পরের দিন সকাল বেলাকার ঘটনা। কিন্তু এর সঙ্গে যোগ আছে বলে এই সুবাদেই বলে নিই।

কাইরোতে ফরাসি, গ্রিক, ইতালি, ইংরেজ বসবাস করে বলে এবং জাত-বেজাতের বিস্তর টুরিস্ট আসে বলে কাইরোর বহু দোকানি তরো-বেতনরা ভাষায় সাইনবোর্ড সাজায়। পরদিন সকালবেলা আমরা যখন শহরের আনাচে-কানাচে ঘুরছি তখন দেখি, এক সাইনবোর্ডে লেখা–

FOOLS RESTAURANT

পল, পার্সি, আমি একসঙ্গেই বোর্ডটা দেখেছিলুম। একসঙ্গেই থ মেরে দাঁড়িয়ে গেলুম। একসঙ্গেই অট্টহাস্য করে উঠলুম।

আহাম্মুকদের রেস্তোরাঁ।

বলে কী?

তখন হঠাৎ ঝাঁ করে আমার মনে পড়ল Fool শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে ফুল অর্থাৎ বিন অর্থাৎ সিমের-বিচি অর্থে। আহাম্মুক অর্থে নয়। অর্থাৎ এ দোকানি উত্তম শিম-বিচি বেচে। তার পর দোকানের সামনে আমরা ত্রিমূর্তি উঁকি-ঝুঁকি মেরে দেখি, যে কটি খদ্দের সেখানে বসে আছে তাদের সক্কলেরই সামনে শুধু শিম-বিচি ফুল–Fool।

***

হাসলে তো?

আমিও হেসেছিলুম।

 কিন্তু তার পর কলকাতা ফিরে– বহু বৎসর পরে দেখি, এক দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা–

কপির শিঙাড়া

 অর্থাৎ ফুলকপির-পুর-দেওয়া শিঙাড়া। এই তো?

আমি কিন্তু কপি শব্দের অর্থ নিলুম বাদর। অর্থাৎ বাঁদরদের শিঙারা। তা হলে অর্থ দাঁড়াল, ও দোকানে যারা শিঙাড়া খেতে যায় তারা বাদর। অর্থাৎ Fools Restaurant-তে যেরকম আহাম্মুকরা যায়!

যেমন মনে কর, যখন সাইনবোর্ডে লেখা থাকে—

 টাকের ঔষধ

তখন কী তার অর্থ, টাকা দিয়ে এ ঔষধ তৈরি করা হয়েছে। তার অর্থ এ ঔষধ টেকোদের জন্য। অতএব কপির শিঙাড়ার অর্থ ফুলকপি দিয়ে বানানো শিঙাড়া নয়, কপি–বাঁদরদের জন্য এ শিঙাড়া!

বিজ্ঞাপনে মানুষ জানা-অজানাতে– অজানাতেই বেশি– কত যে রসিকতার সৃষ্টি করে তার একটি সচিত্র কলেকশন করেছিল আমার এক ভাইপো। হবিটা মন্দ নয়। তার মধ্যে একটা ছিল;–

বিশুদ্ধ ব্রাম্ভনের হাটিয়াল।
মচ্ছ–  (চার আনা)
মাঙ্গশ–  (আট আনা)
নিড়ামিস- (ছয় আনা)

 যাক গে এসব কথা। আবার কাইরো ফিরে যাই। আহারাদি সমাপ্ত করে আমরা ফের গাড়িতে উঠলুম। আবুল আসফিয়া দেখলুম ড্রাইভারদের নিজের পয়সায় খাওয়ালেন। তার পর গাড়িতে উঠে বললেন, কাইরোতে ট্যাক্সি চালাবার অনুমতি তোমাদের নেই। অথচ আমরা তোমাদের বাইরে থেকে নিয়ে এসেছি। আমাদের যেখানে খুশি নিয়ে গিয়ে দু পয়সা কামাতে পার।

তারা তো প্রাঞ্জল প্রস্তাবখানা শুনে আহ্লাদে আটখানা। কিন্তু আবুল আসফিয়া যে দর হাঁকলেন তা শুনে তাদের পেটের ফুল পর্যন্ত আচমকা লাফ মেরে গলা পর্যন্ত পৌঁছে গেল।

ব্যাপারটা হয়েছে কী, আবুল আসফিয়া ইতোমধ্যে কাইরোতে ট্যাক্সি ফি মাইলে কত নেয় খবরটা জেনে নিয়েছেন এবং হাঁকছেন তার চেয়ে অনেক কম। এবার তিনি ওদের বাগে পেয়েছেন। ওরা বেশি কিছু আপত্তি জানালেই তিনি অভিমানভরা কণ্ঠে বলেন, তা ভাই, তোমরা যদি না যেতে চাও তবে যাবে না। আমি আর তোমাদের বাধ্য করতে পারিনে। তোমাদের যদি, ভাই, বড্ড বেশি পয়সা হয়ে যাওয়ায় আর কামাতে না চাও, তা হলে আমি আর কী করতে পারি বল। আল্লাতালাও তো কুরআন শরিফে বলেছেন, সন্তুষ্টি সদ্‌গুণ।

তার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, তবে, ভাইরা, আমরা তা হলে অন্য ট্যাক্সি নিই। তোমরা সুয়েজ ফিরে যাও। আল্লা তোমাদের সঙ্গে থাকুন। রসুল তোমাদের আশীর্বাদ করুন। কিন্তু ভাই, এ ক-ঘণ্টা তোমাদের সঙ্গে কেটেছিল বড় আনন্দে।

কেটেছিল আনন্দে না কচু! পারলে আবুল আসফিয়া ওদের গলা কাটতেন।

 কিন্তু আশ্চর্য হলুম লোকটার ভণ্ডামি দেখে। গুটিকয়েক টাকা বাঁচাবার জন্য কী অভিনয়ই না লোকটা করল!

আর পায়রার মতো বকবকানি! এবং এ সেই লোক যে জাহাজে যেভাবে মুখ বন্ধ করে থাকত তাতে মনে হত কথা বলা রেশন্ড হয়ে গিয়েছে।

ঠিক আবুল আসফিয়ার দরে নয়, তার চেয়ে সামান্য একটু বেশি রেটে তারা শেষটায় রাজি হল।

আবুল আসফিয়া মোগলাই কণ্ঠে বললেন, পিরামিড। ততক্ষণে আমরা কাইরো শহরের ঠিক মাঝখানে ঢুকে গিয়েছি।

কোথায় লাগে কলকাতা রাত বারোটার সময় কাইরোর কাছে। গণ্ডায় গণ্ডায় রেস্তোরাঁ, হোটেল, সিনেমা, ডান্স-হল, ক্যাবারে। খদ্দেরে খদ্দেরে তামাম শহরটা আবৃজা করছে।

আর কত জাত-বেজাতের লোক।

ওই দেখ, অতি খানদানি নিগ্রো। ভেড়ার লোমের মতো কোঁকড়া কালো চুল, লাল লাল পুরু দুখানা ঠোঁট, বোঁচা নাক, ঝিনুকের মতো দাঁত আর কালো চামড়ার কী অসীম সৌন্দর্য! আমি জানি এরা তেল মাখে না কিন্তু আহা! ওদের সর্বাঙ্গ দিয়ে যেন তেল ঝরছে। এদের চামড়া এতই সুচিকূণ সুমসৃণ যে আমার মনে হয়, এদের শরীরে মশা-মাছি বসতে পারে না পিছলে পড়ে মশার পা ছ-খানা কম্পাউন্ড ফ্রেকচর হয়ে যায়, ছ মাস পট্টি বেঁধে হাসপাতালে থাকতে হয়।

ওই দেখো সুদানবাসী। সবাই প্রায়ই ছ ফুট লম্বা। আর লম্বা আলখাল্লা পরেছে বলে মনে হয় দৈর্ঘ্য ছ ফুটের চেয়েও বেশি। এদের রঙ ব্রোঞ্জের মতো। এদের ঠোঁট নিগ্রোদের মতো পুরু নয়, টকে লালও নয়। কিন্তু সবচেয়ে দেখবার জিনিস ওদের দুখানি বাহু। এক্কেবারে শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে আজানুলম্বিত– অর্থাৎ জানুর শেষ পর্যন্ত যেখানে হাঁটুর হাড্ডি অর্থাৎ নি-ক্যাপ সেই অবধি।

শ্রীরামচন্দ্রের বাহু ছিল আজানুলম্বিত এবং তার রঙ ছিল নবজলধরশ্যাম, কিংবা নবদূর্বাদলশ্যাম। তবে কি শ্যামবর্ণ কিংবা ব্রোঞ্জবর্ণ না হলে বাহু এতখানি লম্বা হয় না। তবে কি ফর্সাদের হাত বেঁটে, শ্যামলিয়াদের হাত লম্বা? কে জানে! সুযোগ পেলে কোনও এক নৃতাত্ত্বিককে জিগ্যেস করতে হবে।

হঠাৎ দেখি, সম্মুখে হৈ-হৈ-রৈরৈ-কাণ্ড! লোকে লোকারণ্য!

সমস্ত রাস্তা জুড়ে এত ভিড় যে দুখানা গাড়িকেই বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হল। আমি বারণ করার পূর্বেই পল-পার্সি দু জনই লাফ দিয়ে উঠে গেল হুডের উপর। ওরা দেখতে চায় ভিড়ের মাঝখানে ব্যাপারটা কী। আমার ওসব জিনিস দেখবার বয়স গেছে। মাদমোয়াজেল ক্লদে শেনিয়ে পর্যন্ত উঠি উঠি করছিলেন; আমি তাকে বাইরে যেতে বারণ করলুম।

ইতোমধ্যে ঘোড়সওয়ার পুলিশ এসে রাস্তা খানিকটে সাফ করে দেওয়াতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। পুল-পার্সি হুড থেকে নেমে এসে আমার দু পাশে বসেছে।

আমাকে কিচ্ছুটি জিগ্যেস করতে হল না ব্যাপার কী। ওরা উত্তেজনায় তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে। একসঙ্গে কথা বলছে। শেষটায় পলকে বাধা দিয়ে আমি বললুম, পার্সি তুমিই বল কী হয়েছিল?

ওই যে আপনি দেখালেন সুদানবাসীদের তাদেরই একজন একটা ইংরেজ সেপাইয়ের গলা ধরেছে বাঁ হাত দিয়ে আর ঠাস ঠাস করে চড় মারছে ডান হাত দিয়ে। গোরা কিছুই করতে পারছে না, কারণ সুদানির হাত লম্বা বলে গোরাকে এমনই দূরে রেখেছে যে, গোরা তার গাল নাগাল পাচ্ছে না। এরকম তো চলল মিনিট দু-তিন। তার পর পুলিশ এসে গোরাকে ধরে নিয়ে চলে গেল।

আমি আশ্চর্য হয়ে শুধালম, সুদানিই তো ঠ্যাঙাচ্ছিল, তাকে ধরে নিয়ে গেল না? যে মার খেল তাকে ধরে নিয়ে গেল, যে মার দিল তাকে ধরে নিয়ে গেল না, এটা কী করে হয়?

পল-পার্সি সমস্বরে বললে, সেই তো মজার কথা, স্যর। সাংহাই-টাংহাই কোনও জায়গাতে কেউ যদি গোরাকে ঠ্যাঙায়, তবে তাকেই ঠ্যাঙাতে ঠ্যাঙাতে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। কেউ একবারের তরেও প্রশ্ন করে না দোষটা কার?

আমি তখন ড্রাইভারকে রহস্য সমাধান করার জন্য অনুরোধ জানালুম।

ড্রাইভার বললে, দারোয়ানির কাজ এ দেশে করে সুদানিরা। তাদের ওপর কাইরোবাসীদের অসীম বিশ্বাস। কোনও সুদানি কখনও কোনও বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, একথা আমি বলতে পারব না, কিন্তু আমার কানে কখনও পৌঁছায়নি। এরা বড়ই ধর্মপ্রাণ। পাঁচওত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হজ যায়, তসবি জপে। আর বসে বসে বাড়ি আগলায়। এই যে সুদানি গোরাকে মার দিচ্ছিল, সে এক রেস্তোরাঁর দারোয়ান। গোরা রেস্তোরাঁয় খেয়ে-দেয়ে পয়সা না দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল বলে হোটেলওলা তাকে চ্যালেঞ্জ করে খেল ঘুষি। তখন সুদানি দারওয়ান তার যা কর্তব্য তাই করেছে। পুলিশ একবার জিগ্যেস করেই বিশ্বাস করেছে সুদানিকে, আর ধরে নিয়ে গিয়েছে গোরাকে। সবাই জানে, সুদানিরা বড় শান্ত স্বভাব, তারা মারপিটের ধার ধারে না।

যাক, সব বোঝা গেল। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করব; একা একা কারও সাহায্য না নিয়ে পল্টনের গোরাকে ঠ্যাঙাতে পারে সুদানিই। পাঠান পারে কি না জানিনে, পারলে পারতেও পারে, কিন্তু তার বাহু আজানুলম্বিত নয় বলে সে-ও নিশ্চয় দু চার ঘা খাবে।

.

কাইরোতে বৃষ্টি হয় অতি দৈবাৎ। তা-ও দু এক ইঞ্চির বেশি নয়। তাই লোকজন সব বসেছে হোটেল-কাফের বারান্দায় কিংবা চাতালে। শুনলাম, এখানকার বায়স্কোপও বেশিরভাগ হয় খোলামেলাতে।

 বাঙলা দেশে আমরাও চায়ের দোকানে বসে গালগল্প করে সময় কাটাই। কেউ কেউ হয়তো রোজ একই দোকানে গিয়ে ঘণ্টা দুয়েক কাটায়, কিন্তু কাফেতে বসে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটানোর রেওয়াজ আরম্ভ হয় ফ্রন্টিয়ার থেকে। কাবুলে দেখবে, চার বন্ধু চলেছেন বরফ ভেঙে চা-খানায় গিয়ে গল্পগুজব করবেন বলে যেমন বাড়িতে বসে ও-কর্মটি করা যায় না। ওদের জিগ্যেস করলে তারা বলে বাড়িতে মুরুব্বিরা রয়েছেন, কখন এসে কাকে ধমক লাগান তার ঠিক নেই। কিংবা হয়তো বলবেন, দেখ বাছা, ফিরোজ বস্তৃত যাও দিকিনি মামার বাড়িতে (আড়াই মাইলের ধাক্কা) সেখানে গিয়ে মামাকে বলো, আমার নাকের ফুস্কুড়িটা একটু সেরেছে, তিনি যেন চিন্তা না করেন। আর দেখো, আসবার সময় ধোপানিকে একটু শুধিয়ে এস (সে আরও দেড়-মাইলের চক্কর)– আমার নীল জোব্বাটা, ইত্যাদি।

এবং সবচেয়ে বড় কারণ, বাড়িতে মা-জ্যাঠাইমা ওরকম জালা জালা চা দিতে রাজি হন না। ওনারা যে কঞ্জুস তা নয়। আমি যদি এখুনি বলি, জ্যাঠাইমা, আমার বন্ধুরা এসেছে, ওরা বলেছে, পিসিমার বিয়ের দিনে আপনি যে দু-মুসল্লম করেছিলেন তারা সেইটে খাবে। কিন্তু ওদের বায়নাক্কা, দুম্বার ভিতর যেন কোফতা পোলাও আর মুরগি থাকে, মুরগির ভিতর যেন পোলাও আর আণ্ডা থাকে এবং আণ্ডার ভিতর যেন পোনা মাছের পূর থাকে–জ্যাঠাইমা তদ্দণ্ডেই লেগে যাবেন ওই বিরাট রান্না করতে। তাতে দশ-বিশ টাকা যা লাগে লাগুক।

অথচ আমাদের চায়ের খরচা এক সন্ধ্যায় কতটুকুন? দু আনা চার আনা, মেরে কেটে আট আনা। উঁহু, সেটি হচ্ছে না। ঘন ঘন চা খেলে নাকি ক্ষিদে মরে যায়, আহারের রুচি একদম লোপ পেয়ে যায়।

তাই, ভাই চায়ের দোকানই প্রশস্ততর। সেখানে একবার ঢুকতে পারলে বাবা-চাচার তম্বিতম্বার ভয় নেই, মামা-বাড়িতে গিয়ে বাবার নাকের ফুসকুড়িটার লেটেস্ট বুলেটিন ঝাড়তে হয় না, জালা জালা চা পাওয়া যায়, অন্য দু-চারজন ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে মোলাকাতও হয়, তাস-দাবা যা খুশি খেলাও যায় সেখানে যাব না তো, যাব কোথায়?

প্রথমবারেই প্রথম কাবুলি ভদ্রসন্তান যে আমাকে এইসব কারণ এক নিশ্বাসে বুঝিয়ে বলেছিল তা নয়, একাধিক লোককে জিগ্যেস করে ক্রমে ক্রমে চায়ের দোকানে যাবার যাবতীয় কারণ আমি জানতে পেরেছিলুম।

আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, এঁরা সত্য কথাই বলেছিলেন, এবং এঁরা যে ঘর ছেড়ে চায়ের দোকানে যান তাতে আপত্তি করবার কিছুই নেই।

কিন্তু প্রশ্ন, বাঙালিদের বেলাও তো এইসব আপত্তি-ওজুহাত টেকে? আমাদের মা-পিসিরাও চান না আমরা যেন বড় বেশি চা গিলি, বাবা-কাকাও ফাই-ফরমায়েস দেওয়াতে অতিশয় তৎপর; তবে আমরা চায়ের দোকানকে বাড়ির ড্রয়িংরুম করে তুলিনে কেন?

এর সদুত্তর আমি এ যাবৎ পাইনি। তা সে যাই হোক, এটা বেশ লক্ষ করলুম, রাত বারোটা-একটা অবধি কাফেতে বসে সময় কাটানোতে কাইরোবাসী সবচেয়ে বড় ওস্তাদ; বন্ধুর বাড়িতে জমানো আচ্ছা দশটা-এগারটার ভিতর ভেঙে যায়, কারণ বাড়িসুদ্ধ লোক তাড়া লাগায় খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ার জন্য। এখানে সে ভয় নেই। উঠি-উঠি করে কেউই ওঠে না। বাড়ির লোকেরও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তারা আর একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছে। শুনছি, এখানকার কোনও কোনও কাফে খোলে রাত বারোটায়!

মোটরগাড়ি বড্ড তাড়াতাড়ি চলে বলে ভালো করে সবকিছু দেখতে পেলুম না। কিন্তু এইবারে চোখের সামনে ভেসে উঠল অতি রমণীয় এক দৃশ্য! নাইল, নীল নদ।

আমি পুব বাঙলার ছেলে। যা তা নদী আমাকে বোকা বানাতে পারে না। আমি যে গাঙে সাঁতার কাটতে শিখেছি সেই ছোট্ট মনু নদ থেকে আরম্ভ করে আমি বিস্তর মেঘনা- পদ্মা, গঙ্গা-যমুনা এবং পরবর্তী যুগে গোদাবরী-কৃষ্ণা-কাবেরী তাপ্তী-নর্মদা-সিন্ধু, ইয়োরোপে রাইন-ডানয়ব-মোজেল-রোন দেখেছি। নদী দেখলে আর পাঁচ জন বাঙালের মতো আমিও গামছা খুঁজতে আরম্ভ করি– ওই নদীতে কটা লোক গত সাতশো বছরে ডুবে মরেছিল তার স্ট্যাটিসৃটিকসের সন্ধান না নিয়ে একটা ডিঙি কী কৌশলে চুরি করা যায় তার সন্ধানে মাথায় গামছা বেঁধে নিই, পাটনিকে কী প্রকারে ফাঁকি দিয়ে খেয়ানৌকো থেকে নামাতে হয় সেটা এক মুহূর্তেই আবিষ্কার করে ফেলি।

এই যে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ভাটিয়ালি গীত! সৃষ্টিকর্তা যদি তাঁর পুব-বাংলার লীলাঙ্গনে শত শত নদীর আলপনা না আঁকতেন তবে কি কখনও ভাটিয়ালি গানের সৃষ্টি হত? আর একথাও ভাবি, তিনি রয়েছেন মোহনিয়া প্রবাহিনী আর আমরা তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রচেছি ভাটিয়ালি। অবশ্য তারই কাছ থেকে ধার করে। আমরা যখন ও-ও-ও বলে ভাটিয়ালির লম্বা সুর ধরি, মাঝে মাঝে কাঁপন জাগাই তখন কি স্পষ্ট শুনতে পাও না, দেখতে পাও না ও-র লম্বা টানে যেন নদী শান্ত হয়ে এগিয়ে চলেছে, যখন কাঁপন লাগাই তখন মনে হয় না, নদী যেন হঠাৎ থমকে গিয়ে দ-এর সৃষ্টি করেছে?

প্যারিস-ভিয়েনার রসিকজনের সম্মুখে আমি আমার হাজারোটা নদী কাঁধে বয়ে নিয়ে হাজির করতে পারব না, কিন্তু ভাটিয়ালির একখানা উত্তম রেকর্ড শুনিয়ে দিতে পারি।

আমি বে-আক্কেল তাই একবার করেছিলুম। তার কী জরিমানা দিয়েছিলুম শোনো।

ভিয়েনাতে পাশের ঘরে থাকত এক রাশান। সে এসেছিল সেখানে কন্টিনেন্টাল সঙ্গীত শিখতে। ভিয়েনা শহর বেটোফেন মোসার্টের কর্মভূমি– আমাদের যেরকম তানসেন, ত্যাগরাজ, বাঙালির যেরকম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম।

ভিয়েনা ডানয়ুব নদীর পারে। বু ডানয়ুব তোমাদের কেউ কেউ হয়তো শুনেছ।

একদিন সেই রাশান বললে, ডানয়ুব-ফানয়ুব সব আজে-বাজে নদী। এসব নদী থেকে আর কী গান বেরিয়েছে যে পাল্লা দেবে, আমাদের রাশার ভলগা নদী থেকে যে ভলগার মাঝির গান উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে? তুমি গড়-ফড় কী সব মানো, না? আমি মানিনে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি প্রকৃতিকে। তারই অন্যতম মধুর প্রকাশ নদীতে। সেই নদীকে আমরা মাধুর্যে হার মানাই ভল্গা মাঝির গান দিয়ে।*[* রবীন্দ্রনাথও এই দম্ভ করেছেন তার বাদল দিনের প্রথম কদমফুল গানে। রেকর্ডে গেয়েছেন, শ্রীযুক্তা রাজেশেরী বাসুদেব।]

বাড়ি ফেরা মাত্রই সে ভলগা-মাঝির রেকর্ড শোনাল। আমি মুগ্ধ হয়ে বললুম, চমৎকার!

কিন্তু ততক্ষণে আমার বাঙাল রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। বাঙালরা অবশ্য জানে, তার অর্থ কী? ঘটি অর্থাৎ পশ্চিম বাঙলার লোক তাই নিয়ে হাসাহাসি করুক। আমার তাতে কোনও খেদ নেই। ওরা তো আমাদের ভাটিয়ালি ভালোবাসে, আমরা তো ওদের বাউল শুনে বাউলে হয়ে যাই।

আমার গরম রক্ত তখন টগবগ করে বলছে, বাঙলা দেশ শত শত নদীর দেশ। রাশাতে আর কটা নদী আছে। তারই একটা ভলগা। সে নদী হারিয়ে দেবে বাঙলা দেশের তাবৎ নদীকে দাঁড়াও দেখাচ্ছি।

ভাগ্যিস, আব্বাস উদ্দিনের রঙিলা নায়ের মাঝি আমার কাছে ছিল। সেইটে চড়িয়ে দিলুম রাশানের গ্রামোফোনে।

সে চোখ বন্ধ করে শুনল। তার পর বললে– যা বললে তার অর্থ ধাপ্পা।

আমি বললুম, মানে?

সে বললে, সুরটি অতি উচ্চ শ্রেণির এবং তার চেয়েও বেশি কানে ধরা পড়ে ওর অভিনবত্ব। আমি করজোড় স্বীকার করছি, এরকম গীত আমি পূর্বে কখনও শুনিনি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলব, এ গীত লোক-গীত নয়। কারণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও ভূমিতেই গ্রাম্য গীতে এতগুলো নোট লাগে না। তাই বলছিলুম তুমি ধাপ্পা দিচ্ছ।

আমি বললুম, বাছা, ওই হল ভাটিয়ালির বৈশিষ্ট্য। ও যতখানি ওঠা-নামা করে পৃথিবীর আর কোনও লোক-গীত তা করে না।

কিছুতেই স্বীকার করে না ওটা লোকগীত। তার ধারণা ওটা লোকগীত এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাঝখানে উপস্থিত ঝুলছে, আর কয়েক বৎসর যেতে না যেতেই কোনও গুণী সেটাকে উচ্চাঙ্গ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বরণ করে তুলে নেবেন।

তার পর একদিন সে স্বীকার করলে। বিবিসি-র কল্যাণে। বিবিসি পৃথিবীর লোকগীত শোনাতে শোনাতে ভাটিয়ালি শুনিয়ে বললে এটা পূর্ব বাংলার লোকগীত।

আমি লড়াই জিতলুম কিন্তু তখন থেকেই শুরু হল আমার জরিমানা। আশ্চর্য লাগছে না, যে জিতল সে দেবে জরিমানা? হয়, প্রায়ই হয়। মার্কিনিংরেজ জর্মনি জয় করে বহু বৎসর ধরে সেখানে ঢালছে এবং এখনও ঢালছে বিস্তর টাকা। সেকথা যাক, জরিমানাটা কীভাবে দিতে হল বুঝিয়ে বলি।

এর পর যখনই সে আমাকে সাজা দিতে চাইত তখনই তার বেয়ালাতে বাজাতে আরম্ভ করত ভাটিয়ালির সুর।

বোঝ অবস্থাটা! বিদেশে বিভূঁইয়ে একেই দেশের জন্য মন আঁকুপাঁকু করে তার ওপর ভাটিয়ালির করুণ টান!

রবীন্দ্রনাথের শ্রীকণ্ঠ বাবুর মতো আমি কাতর রোদনে তাঁকে বেয়ালা বন্ধ করতে অনুনয়-বিনয় করতুম।

কিন্তু আজও বলি, লোকটা যা বেয়ালাতে ভাটিয়ালি চড়াতে পারত তার তুলনা হয় না।

কত দেশ ঘুরলুম, কত লোক দেখলুম, কত অজানা জনের প্রীতি পেলাম, কত জানা জনের দুর্ব্যবহার, হিটলারের মতো বিরাট পুরুষের উত্থান-পতন দেখলুম, সেসব বড় বড় জিনিস প্রায় ভুলে গিয়েছি, কিন্তু এইসব ছোটখাটো জিনিস কিছুতেই ভুলতে পারিনে। মনে হয় যেন আজ সকালের ঘটনা।

চাঁদের আলোতে দেখছি, নীলের উপর দিয়ে চলছে মাঝারি ধরনের ভোলা মহাজনি নৌকা হাওয়াতে কাত হয়ে তেকোনা পাল পেটুক ছেলের মতো পেট ফুলিয়ে দিয়ে। হাওয়া বইছে সামান্যই, কিন্তু এই পেটুক পাল এর-ওর সবার হাওয়াই খাবার যেন কেড়ে নিয়ে পেটটাকে ঢাকের মতো ফুলিয়ে তুলেছে। ভয় হয়, আর সামান্য একটুখানি জোর হাওয়া বইলেই, হয় পালটা এক ঝটকায় চৌচির হয়ে যাবে, নয় নৌকোটা পেছনের ধাক্কা খেয়ে গোটা আড়াই ডিগবাজি খেয়ে নীলের অতলে তলিয়ে যাবে।

এই নীলের জল দিয়ে এ দেশের চাষ হয়। এই নীল তার বুকে ধরে সে চাষের ফসল মিশরের সর্বত্র পৌঁছিয়ে দেন। তাই এ দেশের কবি গেয়েছেন,

ওগো নীলনদ প্লাবিতা ধরণী আমি ভালোবাসি তোরে,
 ওই ভালোবাসা ধর্ম আমার কর্ম আমার ওরে।

.

১৮.

পিরামিড! পিরামিড!! পিরামিড!!!

কোনও প্রকাশের আশ্চর্য প্রকাশ করতে হলে আমরা তিনটে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন–!!!– দিই। তাই কি চোখের সামনে দাঁড়িয়ে তিনটে পিরামিড কিংবা উল্টোটা? তিনটে পিরামিড ছিল বলে আমরা তিনবার আশ্চর্য হই।

এই পিরামিডগুলো সম্বন্ধে বিশ্বজুড়ে যা গাদা গাদা বই লেখা হয়ে গিয়েছে তার ফিরিস্তি দিতে গেলেই একখানা আস্ত জলে-ডাঙায় লিখতে হয়। কারণ এই তিনটে পিরামিড পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো কীর্তিস্তম্ভ যুগ যুগ ধরে মানুষ এদের সামনে দাঁড়িয়ে বিস্তর জল্পনা-কনা করেছে, দেয়ালে খোদাই এদের লিপি উদ্ধার করে এদের সম্বন্ধে পাকা খবর সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছে, জান তো, পিরামিডের ঠিক মাঝখানে একটা কুঠুরিতে বিস্তর ধনদৌলত জড়ো করা আছে– তারই পথ অনুসন্ধান করছে পাকা সাড়ে ছ হাজার বছর ধরে। ইরানি, গ্রিক, রোমান, আরব, তুর্কি, ফরাসি, ইংরেজ পরপর সবাই এদেশ জয় করার পর প্রথমেই চেষ্টা করেছে পিরামিডের হাজার হাজার মণ পাথর ভেঙে মাঝখানের কুঠুরিতে ঢুকে তার ধনদৌলত লুট করার। এবং আশ্চর্য, যিনি শেষ পর্যন্ত ঢুকতে পারলেন তিনি ধন লুটের মতলবে ঢোকেননি। তিনি ঢুকেছিলেন নিছক ঐতিহাসিক জ্ঞান সঞ্চয়ের জন্য। ফারাওয়ের রাজমিস্ত্রিরা কুঠুরি বানানো শেষ করার পরে বেরোবার সময় এমনই মন্ত পাথর দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে বাইরের দেয়ালে পালিশ পলস্তরা লাগিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর মানুষের সাড়ে ছহাজার বছর লাগল ভিতরে যাবার রাস্তা বের করতে!

মিশরের ভিতরে-বাইরে আরও পিরামিড আছে কিন্তু গিজে অঞ্চলের যে তিনটে পিরামিডের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে সেগুলোই ভুবনবিখ্যাত, পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম।

রাজা     নির্মাণের সময়     ভূমিতে দৈর্ঘ্য     উচ্চতা

খুফু      ৪৭০০ খ্রি. পূ.      ৭৫৫ ফুট        ৪৮১ ফুট

খাফরা   ৪৬০০               ৭০৬            ৪৭১

সেনকাওরা ৪৫৫০            ৩৪৬            ২১০

প্রায় পাঁচশো ফুট উঁচু বললে, না দেখে চট করে পিরামিডের উচ্চতা সম্বন্ধে একটা ধারণা করা যায় না। এমনকি চোখের সামনে দেখেও ধারণা করা যায় না, এরা ঠিক কতখানি উঁচু। চ্যাপ্টা আকারের একটা বিরাট জিনিস আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে পাঁচশো ফুট উঁচু না হয়ে যদি চোঙার মতো একই সাইজ রেখে উঁচু হত তবে স্পষ্ট বোঝা যেত পাঁচশো ফুটের উচ্চতা কতখানি উঁচু।

বোঝা যায় দূরে চলে গেলে। গিজে এবং কাইরো ছেড়ে বহু দূরে চলে যাওয়ার পরও হঠাৎ চোখে পড়ে তিনটে পিরামিড সবকিছু ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। আর পিরামিড ছেড়ে যদি সোজা মরুভূমির ভিতর দিয়ে যাও তবে মনে হবে সাহারার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পরও বুঝি পিরামিড দেখা যাবে।

তাই বোঝা যায়, এ বস্তু তৈরি করতে কেন তেইশ লক্ষ টুকরো পাথরের প্রয়োজন হয়েছিল। টুকরো বলতে একটু কমিয়ে বলা হল কারণ এর চার-পাঁচ টুকরো একত্র করলে একখানা ছোটখাটো এঞ্জিনের সাইজ এবং ওজন হয়। কিংবা বলতে পার ছ ফুট উঁচু এবং তিন ফুট চওড়া করে এই পাথর নিয়ে একটা দেয়াল বানালে সে দেয়াল লম্বায় ছ-শো পঞ্চাশ মাইল হবে। অর্থাৎ সে দেয়াল কলকাতা থেকে দার্জিলিং গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারবে।

সবচেয়ে বড় পিরামিডটা বানাতে নাকি এক লক্ষ লোকের বিশ বত্সর লেগেছিল।

ভেবে কূলকিনারা পাওয়া যায় না, সে সম্রাটের কতখানি ঐশ্বর্য আর প্রতাপ ছিল, যিনি আপন রাজধানীর পাশে এক লক্ষ লোককে বিশ বচ্ছর খাওয়াতে-পরাতে পেরেছিলেন। অন্য খরচের কথা বাদ দাও, এই এক লক্ষ লোকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য যে বিরাট প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন সেটা গড়ে তোলা এবং তাকে বিশ বছর ধরে চালু রাখা তারাই করতে পারে যারা সভ্যতার খুব একটা উঁচু স্তরে উঠে গিয়েছে।

এইবারে আমরা পিরামিড নির্মাণের কারণের কাছে পৌঁছে গিয়েছি।

প্রথম কারণ সকলেরই জানা। ফারাওরা (ম্রাটরা) বিশ্বাস করতেন, তাঁদের শরীর যদি মৃত্যুর পর পচে যায়, কিংবা কোনও প্রকারের আঘাতে ক্ষত হয় তবে তারা পরলোকে অনন্ত জীবন পাবেন না। তাই মৃত্যুর পর তাদের দেহকে মামি বানিয়ে সেটাকে এমন একটা শক্ত পিরামিডের ভিতর রাখা হত যে, তার ভিতরে ঢুকে কেউ যেন মামিকে ছুঁতে পর্যন্ত না পারে। কিন্তু হায়, তাঁদের এ বাসনা পূর্ণ হয়নি। পূর্বেই বলেছি, হাজার হাজার বছর চেষ্টা করে দুষ্ট (অর্থাৎ ডাকাত) এবং শিষ্টেরা (অর্থাৎ পণ্ডিতেরা) শেষ পর্যন্ত তাদের গোপন কবরে ঢুকতে পেরেছেন। তাই করে অবশ্য গৌণত কোনও কোনও ফারাওয়ের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে– পণ্ডিতেরা তাদের মামি সযত্নে যাদুঘরে সাজিয়ে রেখেছেন। সেখানে তারা অক্ষত দেহে মহাপ্রলয়ের দিন গুনছেন, যেদিন তারা নব দেহ নব যৌবন ফিরে পেয়ে অমৃতলোকে অনন্ত জীবন আরম্ভ করবেন।

কিন্তু যদি ইতোমধ্যে আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ লেগে যায়? ফলে গুটিকয়েক অ্যাটম বম্ পড়ে? তবে?

আমার মনে ভরসা, এঁরা যখন চোর-ডাকু ধনিক-পণ্ডিতদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে এত হাজার বৎসর অক্ষত দেহে আছেন, তখন মহাপ্রলয় পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন-ই যাবেন। অ্যাটম বম পড়ার উপক্রম হলে আমি বরঞ্চ তারই একটার গা ঘেঁষে গিয়ে বসব। মামিটা রক্ষাকবচের মতো হয়ে তার দেহকে তো বাঁচাবেই, সেই সঙ্গে আমাকেও বাঁচিয়ে দেবে। চাই কি, গোটা শহরটাই হয়তো বেঁচে যাবে!

পিরামিড নির্মাণের দ্বিতীয় কারণ– এই কারণের উল্লেখ করেই আমি এ অনুচ্ছেদ আরম্ভ করেছি–

ফারাওরা বলতে চেয়েছিলেন সভ্যতার যে স্তরে আমরা এসে পৌঁছেছি, আমরা যে প্রতাপশালী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছি, সেগুলো যেন এই পিরামিডের মতো অজর অমর এবং বিশেষ করে অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে। পরিবর্তন যেন না হয়, যা আছে তাই থাকবে, এই ছিল পিরামিড গড়ার দ্বিতীয় কারণ। পিরামিড জগদ্দল পাথর হয়ে অতি শব্দার্থে জগদ্দল পাথরই বটে- যুগ যুগ ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য, রাজবংশ, ধর্মনীতি সবকিছু, অপরিবর্তনীয় করে চেপে ধরে রাখবে।

তাই পিরামিড দেখে মানুষের মনে জাগে ভয়। আজ যদি সেই ফারাওরা বেঁচে থাকতেন তবে তাঁর প্রতি জাগত ভীতি। এই পিরামিড যে তৈরি করতে পেরেছে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবার কল্পনাও তো মানুষ করতে পারে না।

তাজমহলের গীতিরস কঠিন মানুষের পাষাণ হৃদয়কেও গলিয়ে দেয়, কুতুবমিনারের ঋজু দেহ উন্নতশির দুর্বলজনকে সবল হয়ে দাঁড়াতে শেখায়– এই দুই রস কাব্যের, সঙ্গীতের প্রাণ। তাজমহল নিয়ে তাজমহলের মতো কবিতা রচনা করা যায়, কিন্তু পিরামিড নিয়ে কবিতা হয়েছে বলে শুনিনি। বরঞ্চ পিরামিডের দোহাই দিয়ে বেঙ্গল অর্ডিনানুসের অনুকরণে আজ এক নতুন ইজিপশিয়ান অর্ডিনান্স তৈরি করা যায়।

কিন্তু হায়, ফারাওরা অপরিবর্তনের যে অর্ডিনান্স জারি করে বিরাট পিরামিড গড়েছিলেন, সেটা টিকল না। ফারাও বংশ ধ্বংস হল, দূর ইরানের রাজারা মিশর লণ্ডভণ্ড করে দিল, তার পর গ্রিক, রোমান এবং শেষটায় সারা মিশরের লোক ইসলাম গ্রহণ করে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলল। মুসলমানরা দেহ এবং আত্মার পার্থক্য চেনে। অনন্ত জীবন পাওয়ার জন্য দেহটাকে যে মামি করে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই, সেকথা তারা বোঝে।

কিন্তু ফারাওদের দোষ দিয়ে কোনও লাভ নেই। প্রায় সব দেশেই মানুষ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে বলেছে, এই ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছি আর এগিয়ে যাবার প্রয়োজন নেই। যা সঞ্চয় করেছি তাই বেঁচে থাকুক, সেইটেই অপরিবর্তনীয় হয়ে থাক। ফলে হয়েছে পতন।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন এই বিষয় নিয়ে তাজমহলের মতো কবিতা লিখেছেন তখন আমার আর বাক্যব্যয় কী প্রয়োজন?

.

১৯.

চাঁদের আলোতে বিশ্বজন তাজমহল দেখবার জন্য জড়ো হয়।

পিরামিডের বেলাও তাই।

চতুর্দিকে লোকজন গিগি করছে। এদেশের মেলাতেও বোধ করি এত ভিড় হয় না।

অবশ্য তার কারণও আছে। নিতান্ত শীতকাল ছাড়া গরমের দেশে দিনের বেলা কোনও জিনিস অনেকক্ষণ ধরে রসিয়ে রসিয়ে দেখা যায় না। বিশেষ করে যেখানে কোনও সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখবার বালাই নেই সেখানে তো আরও ভালো। তাজের মিহি কাজ চাঁদের আলোতে চোখে পড়ে না, তবু সবসুদ্ধ মিলিয়ে তার যে অপূর্ব সামঞ্জস্য চাঁদের আলোতে ধরা দেয় দিনের কড়া আলোতে সেটা দর্শককে ফাঁকি দেয় বলে মানুষ চাঁদের আলোতে তাজ দেখে। পিরামিডে সেরকম কোনও নৈপুণ্য নেই, তদপুরি পিরামিডের চতুর্দিকে মরুভূমি বলে সেখানে দিনের বেলাকার গরম পীড়াদায়ক, কাজেই নিতান্ত শীতকাল ছাড়া দিনের বেলা কম লোকই পিরামিড দেখতে যায়।

পক্ষান্তরে শীতের দেশে ব্যবস্থা অন্যরকম। আমি ফটফটে চাঁদের আলোতে কোন গির্জার পাশ দিয়ে শীতের রাতে হি-হি করে বহুবার বাড়ি ফিরেছি। কাক-কোকিল দেখতে পাইনি।

পল-পার্সি আর আমাদের দলের আরও কয়েকজন পিরামিডের মাঝখানকার কবর-গৃহ দেখতে গেছেন। আমি যাইনি।

আমি বসে বসে শুনছি জাত-বেজাতের কিচিরমিচির, স্যান্ডউইচ খোলার সময় কাগজের মড়মড়, সোডা-লেমনেড খোলার ফটাফট। ইয়োরোপীয়েরা খাবার ব্যবস্থা সঙ্গে না নিয়ে তিন পা চলতে পারে না। পিরামিড হোক আর নিমতলাই হোক, মোকামে পৌঁছানো মাত্রই বলবে, টম, বাস্কেটটা এই দিকে দাও তো। ডিক, তুমি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালো আর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ডার্লিং, আপেলগুলো ভুলে যাওনি তো? ইতোমধ্যে হ্যারি হয়তো গ্রামোফোনের জাতা চালিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য যদি দলে মেয়েরা ভারি হন তবে কোনওকিছুই শুনতে পাওয়া যায় না। লাভলি, গ্র্যান্ড, সবলাইম ইত্যাদি শব্দে তখন যে ঘ্যাট তৈরি হয় তার কোনটা কী, ঠিক ঠাহর করা যায় না।

কোনও কোনও টুরিস্ট আমাকে বলেছেন, নায়াগ্রার গম্ভীর জলনির্ঘোষ শুনতে হলে নাকি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যেতে নেই। যে ধ্বনি তাদের ভিতর ওঠে তাতে নাকি নায়াগ্রার থাক, মেয়েরা আমার ওপর এমনিতেই চটে আছেন। কিন্তু আমার ওপর চটে আর লাভ কী? ওয়াদের খাস-পেয়ারা কবি রবিঠাকুরই এ বাবদে কী বলেছেন

ছেলেরা ধরিল পাঠ, বুড়ারা তামুক,
এক দণ্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ।

পল-পার্সি ফিরে এসেছে। আমি শুধালুম, কী দেখলে, বাছারা? তার পর নোটবুক খুলে বললুম, গুছিয়ে বল, সবকিছু টুকে নেব; আমি তো বে-আক্কেলের মতো এই এখানে বসে বসে সময় কাটালুম।

পার্সি করুণ কণ্ঠে বললে, আর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবেন না স্যর। দেখেছি কচু-পোড়া। মশালের আলোতে হাতের তেলো চোখে পড়ে না। তারই জোরে বিস্তর সুড়ঙ্গ পেরিয়ে একটা চৌকো ঘরে শেষটায় পৌঁছলুম। বেবাক ভোঁ ভো। এক কোণে একখানা ভাঙা ঝটা পর্যন্ত নেই! গাইড বললে, ব্যস্ ফিরে চলুন। আপনি তখনই বারণ করলেন না কেন?

আমি বললুম, বারণ করলে কি শুনতে? বাকি জীবন মনটা খুঁত খুঁত করত না, ফারাওয়ের শেষ শোওয়ার ঘর দেখা হল না? এ হল দিল্লির লাড্ডু।

শুধাল, সে আবার কী?

আমি বুঝিয়ে বললুম।

পল বললে, গাইড বলছিল, পিরামিডের যে বিরাট বিরাট পাথর সেগুলো নাকি টেনে টেনে নদীর ওপার থেকে এখানে আনা হয়েছিল। আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না ওর যা ইংরেজি!

আমি বললুম, ঠিকই বলেছে! নীলের এপারে পাথর পাওয়া যায় না। তাই ওপার থেকে পাথর কেটে ভেলায় করে এপারে নিয়ে আসা হত। আর সে যুগে মানুষ চাকা কী করে বানাতে হয় জানত না বলে সেই পাথরগুলো ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেত। কাঠ বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হত পিছলে নিয়ে যাবার সুবিধের জন্য। এবং শুনেছি, সে পথে নাকি ঘড়া ঘড়া তেল ঢালা হত, সেটাকে পিছলে করার জন্য। আশ্চর্য নয়! এর ছ-টা পাথরে যখন একটা এঞ্জিনের আকার ধরতে পারে, এবং স্পষ্ট দেখেছি, এঞ্জিন রেললাইন থেকে কাত হয়ে পড়ে গেলে তাকে খাড়া করবার জন্য আজকের দিনের কপিকল পর্যন্ত কীরকম হিমসিম খায়, তখন তো তেল-ঘি ঢালার কথা আর অবিশ্বাস করা যায় না।

তখন আলোচনা আরম্ভ হল চাকা আবিষ্কার নিয়ে। আগুন যেরকম মানুষকে সভ্যতার পথ দেখিয়ে দিল চাকাও মানুষকে ঠিক তেমনি বাকি পথটুকু অক্লেশে চলতে শেখাল। শুনেছি, ভারতের মোন-জো-দছড়াতে প্রথম চাকা আবিষ্কার হয় এবং ক্রমে ক্রমে সেটা সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

আমরা এখনও যখন পাল্কি চড়ি তখন বোধহয় আদিম যুগে ফিরে যাই, যখন মানুষ চাকা আবিষ্কার করতে শেখেনি। ছ জন বেয়ারা একটি মেয়েকে বইতে গিয়ে ঘেমে নেয়ে যায়, ঘড়ি ঘড়ি জিরোয় আর গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খায়; ওদিকে একজন রিকশাওলা দুটো লাশকে দিব্যি টেনে নিয়ে যায়– সবই চাকার কল্যাণে।

আবুল আসফিয়া বললেন, চাকা এরা আবিষ্কার করতে পারেনি সত্য, কিন্তু হাতের নৈপুণ্যে এরা আর সবাইকে হার মানিয়েছে। এই যে হাজার হাজার টনী লক্ষ লক্ষ পাথর একটার গায়ে আরেকটা জোড়া দিয়েছে, সেখানে এক ইঞ্চির হাজার ভাগের একভাগের ফাঁক। আজকের দিনের জহুরিরা, চশমা বানানেওলারাও এত সূক্ষ্ম কাজ করতে পারে কি না সন্দেহ। আর জহুরিদের কাজ তো এক ইঞ্চি আধ ইঞ্চি মাল নিয়ে। এরা সামলেছে লক্ষ লক্ষ ইঞ্চি।

আমরা শুধালুম, তা হলে তারা সে নৈপুণ্য কোনও সূক্ষ্ম কলা নির্মাণে, কোনও সৌন্দর্য সৃষ্টিতে প্রয়োগ করল না কেন?

আবুল আসফিয়া বললেন, সেটা দেখতে পাওয়া যায় তাদের মন্দিরগাত্রে, তাদের প্রস্তরমূর্তিতে।

হায়, সেগুলো এখন দেখার উপায় নেই।

পার্সি ততক্ষণে বালু জড়ো করে বালিশ বানিয়ে তারই উপর মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। তত্ত্বালোচনার প্রতি তার একটা বিধিদত্ত আজন্মলব্ধ নিরঙ্কুশ বৈরাগ্য আছে। স্বতই ভক্তিভরে মাথা নত হয়ে আসে।

আবুল আসফিয়া বললেন, অনেক রাত হয়েছে। শহরে ফেরা যাক।

পল অনেকক্ষণ ধরে গম্ভীর হয়ে কী যেন ভাবছিল। মোটরের দিকে যেতে যেতে বললে, আমার কিন্তু সমস্ত জিনিসটা একটা হিউজ ওয়েস্ট বলে মনে হয়। আমরা সবাই চুপ করে শুনলুম।

আমাদের দলের মধ্যে একটি প্রৌঢ়া মহিলা ছিলেন। তিনি বললেন, না, মসিয়ো পল। পিরামিডের একটা গুণ আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। এর সামনে দাঁড়ালে, বয়সের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, আমাকেও তরুণী বলে মনে হয়।

একটা কথার মতো কথা বটে।

আমি বললুম, শাবাশ!

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *