দেবতার মতো দুজন এবং কয়েকজন অনুবাদক
কোনো ভাষা শুধু মৌলিক সাহিত্যে সমৃদ্ধ হতে পারে না। যে-ভাষা যতো ধনী, তার অনুবাদ সাহিত্যও ততো ধনী। আমাদের ভাষায় যা নেই, তা হয়তো আছে জর্মন ভাষায় বা ফরাশি ভাষায়। তাই আমাদের ভাষাকে আরো ঋদ্ধ করার জন্যে আমরা অপর ভাষা থেকে অনুবাদ করি। বাঙলা সাহিত্যের মধ্যযুগে কবিরা অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন, তাঁরা অনুবাদের আশ্চর্য ফসল ফলিয়েছিলেন। হিন্দু কবিরা সাধারণত অনুবাদ করেছেন তাঁদের পুরাণ কাহিনীগুলো; মুসলমান কবিরা অনুবাদ করেছেন ফারসি, হিন্দি থেকে রোমাঞ্চকর উপাখ্যান। এখানে হিন্দু কবিদের কথা বলবো। তাঁরা পুরাণ কাহিনী অনুবাদ করেছেন, অনুবাদ করেছেন রামায়ণ ও মহাভারত। রামায়ণ ও মহাভারত অনুবাদ করা সহজ কথা ছিলো না। সমাজের ধর্মের যারা ছিলেন মাথা, তাঁরা বাঙলা ভাষায় এসব গ্রন্থের অনুবাদের ভীষণ বিরোধী ছিলেন। তাঁরা মনে করতেন সংস্কৃত থেকে ওসব পুণ্যগ্রন্থ যদি অনূদিত হয় বাঙলায়, তবে ধর্মের মর্যাদাহানি হবে। এ-রকম কিন্তু হয়েছে সব দেশেই। ইংরেজিতে বাইবেল অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন অনুবাদকেরা। জর্মন ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন মার্টিন লুথার। তাঁকেও অনেক বিরোধিতা সহ্য করতে হয়েছিলো। বাঙলা ভাষায় কোরান অনুবাদ করতে গিয়েও কম বাধা আসে নি। তাই মধ্যযুগে কবিরা যখন বাঙলা ভাষায় রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদ করতে যান, তখন তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায় অনেক বাধা। কবিরা সে-সব বাধা অবহেলা করেছেন। কবিদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন তখনকার মুসলমান সম্রাটরা। মুসলমান সম্রাটদের উৎসাহে বাঙলা ভাষায় রামায়ণ-মহাভারত অনূদিত হতে পেরেছিলো। অনুবাদ সাধারণত করেছেন হিন্দু কবিরা। এ-অনুবাদ কাজে তাঁরা মুসলমান সম্রাটদের সহায়তা পেয়েছেন বলে তারা সম্রাটদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
রামায়ণ-মহাভারত শুধু ধর্মগ্রন্থ নয়। এ-দুটি বইয়ে রয়েছে নানা মনোহর কাহিনী। কাহিনীর মনোহারিত্বে মুগ্ধ হয়েছিলেন মুসলমান রাজারা, আর বারবার তাঁরা কবিদের উৎসাহ দিয়েছেন রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদ করতে। রামায়ণ ও মহাভারতের দুজন অনুবাদক আজ প্রায় দেবতার মর্যাদা লাভ করেছেন। তারা হচ্ছেন রামায়ণের অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস এবং মহাভারতের অনুবাদক কবি কাশীরাম দাস। এ-দুজন ছাড়াও আছেন আরো অনেক অনুবাদক, যাঁরা রামায়ণ-মহাভারত কবিতায় অনুবাদ করেছেন। তাঁদের সকলের রচনা আজ আর পড়া হয় না, কিন্তু প্রবল ভক্তিতে বাঙলার হিন্দুরা পড়ে কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীরামের মহাভারত। মধ্যযুগের কোনো অনুবাদই মূল রচনার হুবহু অনুবাদ নয়। কবিরা মূল কাহিনী ঠিক রেখে মাঝেমাঝে নিজেদের মনের কথাও বসিয়ে দিয়েছেন এখানেসেখানে। তাতে এগুলো অনুবাদ হয়েও নতুন রচনা হয়ে উঠেছে। তাই আজ আর বলি না যে কাশীরাম অনুবাদ করেছেন মহাভারত, কৃত্তিবাস অনুবাদ করেছেন রামায়ণ। বলি, বাঙলায় মহাভারত লিখেছেন কাশীরাম দাস এবং রামায়ণ রচনা করেছেন কৃত্তিবাস। বাঙলায় তাঁরা দুজন বাল্মীকি এবং বেদব্যাসের সমান।
মুসলমান রাজারা রামায়ণ-মহাভারত এবং অন্যান্য পুরাণকাহিনী অনুবাদের প্রেরণা দিয়েছিলেন কবিদের। তেমন কয়েকজন রাজার নাম বলছি। ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গৌড়ের রাজা ছিলেন নাসির খাঁ। তাঁর অনুপ্রেরণায় মহাভারতের একটি অনুবাদ হয়েছিলো। অবশ্য এ-বইটি পাওয়া যায় নি। কৃত্তিবাস অনুবাদ করেছেন রামায়ণ। কৃত্তিবাসকে প্রেরণা, উৎসাহ ও সাহায্য দিয়েছিলেন রুকনুদ্দিন বারবক শাহ [১৪৫৯–৭৪]। পরাগল খান কবীন্দ্র পরমেশ্বর নামক এক কবিকে দিয়ে অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের অনেকখানি। পরাগল খানের পুত্রের নাম ছিলো ছুটি খান। ছুটি খানের উৎসাহে শ্রীকর নন্দী নামক আরেকজন কবি অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের আরো অনেকখানি। এভাবে আরো অনেক মুসলমান রাজার নাম পাওয়া যায়, যাঁরা উৎসাহ দিয়েছিলেন এ-সব গ্রন্থ অনুবাদে। মুসলমান রাজারা রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদে উৎসাহ দিয়েছিলেন নানা কারণে। তাঁরা গল্প শুনতে চেয়েছিলেন বলে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাঁরা হিন্দু প্রজাদের বশীভূত করতে চেয়েছিলেন বলে অনুবাদে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
রামায়ণের প্রথম অনুবাদকই শ্রেষ্ঠ অনুবাদক; তাঁর নাম কৃত্তিবাস। মহাভারতের বেলা ঘটেছে অন্যরকম। কাশীরাম দাস মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক, তবে তিনি প্রথম অনুবাদক নন, বেশ পরবর্তী অনুবাদক। আমরা এখানে কৃত্তিবাস এবং কাশীরাম দাস সম্বন্ধেই বেশি কথা বলবো। তার আগে অন্যান্য অনুবাদকের কথা কিছুটা বলে নিই। কৃত্তিবাস ছাড়া আর যারা রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন, তাঁদের একজন চন্দ্রাবতী [জন্ম ১৫৫০]। চন্দ্রাবতী মনসামঙ্গলের কবি বংশীদাসের কন্যা। রামায়ণের আরো কয়েকজন অনুবাদকের নাম : ভবানীদাস, জগত্রাম রায়, রামমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামানন্দ ঘোষ, দ্বিজ মধুকণ্ঠ, কবিচন্দ্র। মহাভারতের অনুবাদও করেছেন অনেক কবি। মহাভারতের প্রথম অনুবাদক শ্রীকর নন্দী। তিনি হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খানের অনুপ্রেরণায় সর্বপ্রথম মহাভারত অনুবাদ করেন। মহাভারতের আরো কয়েকজন অনুবাদকের নাম : নিত্যানন্দ ঘোষ, রামেশ্বর নন্দী, রাজীব সেন, সঞ্জয়, রামনারায়ণ দত্ত, রাজেন্দ্র দাস। হিন্দুধর্মের একটি পবিত্র বই অনুবাদ করেছিলেন মালাধর বসু। বইটি ভাগবত। মালাধর বসুও একজন মুসলমান রাজার প্রেরণায় ভাগবত অনুবাদ করেছিলেন। সে-রাজা তাঁকে ‘গুণরাজ খান উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। মালাধর বসু লিখেছেন, “গৌড়েশ্বর দিলা নাম গুণরাজ খান। মালাধর বসুর ভাগবতের অন্য নাম শ্রীকৃষ্ণবিজয়।
বাঙলা রামায়ণ মানেই কৃত্তিবাসের রামায়ণ। এ-বই কয়েক শশা বছর ধরে বাঙলার হিন্দুদের ঘরেঘরে পরম ভক্তিতে পঠিত হচ্ছে। রামসীতার বেদনার কথা কৃত্তিবাস পয়ারের চোদ্দ অক্ষরের মালায় গেঁথে বাঙালির কণ্ঠে পরিয়ে গেছেন। রামায়ণ কৃত্তিবাসের হাতে বাঙলার সম্পদে পরিণত হয়েছে; বাল্মীকির অসীম বৃহৎ জগৎ বাঙলাদেশে পরিণত হয়েছে। রামসীতা এবং আর সবাই হয়ে পড়েছে কোমল কাতর বাঙালি। যে-কৃত্তিবাস এমন অসাধারণ কাজ করে গেছেন, তাঁকে নিয়ে কিন্তু সমস্যার অন্ত নেই। কৃত্তিবাস কখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কোন রাজার আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন, এ নিয়ে বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে বেশ বড়ো এক বিতর্ক রয়েছে। আজ মনে করা হয় কবি কৃত্তিবাস তার আত্মপরিচিতিতে যে-রাজার ইঙ্গিত করেছেন, তার নাম রুকনুদ্দিন বারবক শাহ। কৃত্তিবাস পঞ্চদশ শতকের কবি। তাঁর একটি দীর্ঘ আত্মপরিচিতি পাওয়া গেছে। এ-আত্মপরিচিতিতে তিনি অনেক কথা বলেছেন; বেলা ক-টার সময় তিনি রাজার দরবারে গেলেন, তখন রাজা কী করছিলেন, তাঁর চারপাশে কারা ছিলেন, এসব তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কবি শুধু রাজার নামটি বলতে ভুলে গেছেন! এমন হয়েছে তার জন্মকালের বিবরণ দিতে গিয়েও। কখন তাঁর জন্ম হলো, কারা তাঁর পূর্বপুরুষ, তার জন্মের সময় কোন তিথি ছিলো, তিনি সব বলেছেন। শুধু ভুলে গেছেন তাঁর জন্মের অব্দ বা সালটি উল্লেখ করতে! তাই কৃত্তিবাসকে নিয়ে মহাবিতর্ক, তিনি যেমন মহাকবি, তাঁকে নিয়ে বিতর্কটিও মহাকাব্যিক।
কৃত্তিবাসের আত্মপরিচিতিটি চমৎকার। এটি পড়লে বোঝা যায় কবি কী রকম ছিলেন। নিজের সম্বন্ধে তাঁর ছিলো বড়ো বিশ্বাস; তিনি যে বড়ো কবি সে-সম্পর্কে তাঁর নিজের কোনো সন্দেহ ছিলো না। উনিশশতকের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত কৃত্তিবাসকে উদ্দেশ করে বলেছেন, কৃত্তিবাস, কীর্তিবাস কবি।’ রাজদরবারে যাওয়া সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন, তার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি :
পাটের চাঁদোয়া শোভে মাথার উপর।
মাঘ মাসে খরা পোয় রাজা গৌড়েশ্বর।।
দাণ্ডাই গিয়া আমি রাজ-বিদ্যমানে।
নিকটে যাইতে রাজা দিল হাতসানে।।…
নানা ছন্দে শ্লোক আমি পড়িনু সভায়।
শ্লোক শুনি গৌড়েশ্বর আমা পানে চায়।।
নানা মতে নানা শ্লোক পড়িলাম রসাল।
খুশি হৈয়া রাজা দিলা পুষ্পমালা।।…
পাত্রমিত্র সবে বলে শুন দ্বিজরাজে।
যাহা ইচ্ছা হয় তাহা চাহ মহারাজে।।
কারো কিছু নাহি লই করি পরিহার।
যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সারা।।
যত যত মহাপণ্ডিত আছয়ে সংসারে।
আমার কবিতা কেহ নিন্দিতে না পারে।।…
প্রসাদ পাইয়া বাহির হইলাম সত্বরে।
অপূর্ব জ্ঞানে ধায় লোক আমা দেখিবারে।।
চন্দনে ভূষিত আমি তোক আনন্দিত।
সবে বলে ধন্য ধন্য ফুলিয়া পণ্ডিত।।
মুনি মধ্যে বাখানি বাল্মীকি মহামুনি।
পণ্ডিতের মধ্যে কৃত্তিবাস গুণী।।
কবির স্নিগ্ধ মহান অহমিকার এমন প্রকাশ খুবই দুর্লভ। রাজা তাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়েছেন; রাজার পাত্রমিত্ররা কবিকে বলেছেন, তোমার যা ইচ্ছে তা তুমি চাইতে পারো রাজার কাছে। কিন্তু কবি কৃত্তিবাস কিছুই চান না, কবিতাই তাঁর গৌরব; তাই বললেন, কারো কিছু নাহি লই করি পরিহার। যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সার।’ কবির মহান ঔদ্ধত্যের প্রকাশরূপে পংক্তি দুটি অমর হয়ে আছে। কৃত্তিবাসের আত্মপরিচিতিটির এ-অংশ পড়লে বাঙলা ভাষার অন্য একটি সেরা কবিতার কথা মনে পড়ে। কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’। ‘পুরস্কার’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের কবিতার নায়ক কৃত্তিবাস বা অন্যকালের কৃত্তিবাস রোম্যানটিক রবীন্দ্রনাথ।
‘পুরস্কার’ কবিতার নায়ক কবি। তিনি বাড়িতে বসে বসে শুধু কবিতা রচনা করেন। তাঁর হাঁড়িতে চাল নেই, মাথার ওপর ঘরের চাল পড়োপড়ো। কবির সে-দিকে দৃষ্টি নেই, তিনি মেতে আছেন কাব্যলক্ষ্মীকে নিয়ে। তাঁর কবিতা অসাধারণ, কিন্তু সেগুলোকে তিনি অর্থ উপার্জনের পণ্য হিশেবে ব্যবহার করেন না। একদিন কবির স্ত্রী অনেক বুঝিয়ে কবিকে রাজি করালেন রাজদরবারে যেতে। রাজা যদি খুশি হয় কবিতা শুনে, তবে আর কোনো অভাব থাকবে না সংসারে। রাজার কাছ থেকে অনেক ধন চেয়ে আনতে পারবেন কবি। স্ত্রীর কথায় কবিতা নিয়ে যান রাজদরবারে। রাজা কবিকে কবিতা শোনাতে বলে। কবি শোনান কালজয়ী অমর কবিতা। ওই কবিতার কয়েক স্তবক :
শুধু বাঁশিখানি হাতে দাও তুলি
বাজাই বসিয়া প্রাণমন খুলি,
পুষ্পের মতো সঙ্গীতগুলি
ফুটাই আকাশভালে।
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিরচন,
গীতরসধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধূলিজালে।…
সংসার মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু’একটি কাঁটা করি দিব দূর–
তার পরে ছুটি নিব।
আরো অনেক স্তবক শোনান কবি, রাজা হয় আনন্দে আত্মহারা। রাজা কবিকে কী দান করবে ভেবে পায় না। কবিকে রাজা বলেন, আমার ভাণ্ডারে যা আছে তা থেকে যা ইচ্ছে তুমি নিতে পারো, কবি। কবি কিন্তু কোনো ধন চাইলেন না, তিনি শুধু চাইলেন রাজার কষ্ঠের ফুলমালাখানি।
কৃত্তিবাস জন্মগ্রহণ করেছিলেন নদীয়ার ফুলিয়া গ্রামের এক বিখ্যাত পণ্ডিত পরিবারে। তাঁর পিতার নাম বনমালী। তিনি পদ্মা পেরিয়ে উত্তরে বরেন্দ্র অঞ্চলে গিয়েছিলেন বিদ্যালাভের জন্যে। সেখানে প্রচুর পড়াশুনো করার পর কৃত্তিবাস যান গৌড়ের রাজার কাছে। এ-রাজা রুকনুদ্দিন বারবক শাহ। তারপরে লিখেন রামায়ণ। বাল্মীকির রামায়ণকে তিনি অপূর্বরূপে বাঙলা ভাষায় রূপান্তরিত করেন। তাঁর রামায়ণের অন্য নাম হলো শ্রীরামপাঞ্চালি। বর্তমানে যে-কৃত্তিবাসী রামায়ণ প্রচলিত আছে, তাতে কৃত্তিবাসের রচনার আদিরূপ পাওয়া যায় না। কেননা তার পর কয়েক শো বছর অতীত হয়েছে, কৃত্তিবাসের জনপ্রিয় কাব্যে কালেকালে নতুন কবিরা নিজেদের রচনা গেঁথে দিয়েছেন। তাছাড়া সেকালে কবিতা লিখিত হতো খুব কম, সাধারণত গায়কেরা নিজেদের মুখেমুখে বাঁচিয়ে রাখতেন কবিতা। এভাবে এক গায়কের কণ্ঠ থেকে কবিতা চলে যেতো অন্য গায়কের কণ্ঠে, তাতে অনেক পংক্তি পরিবর্তিত হতো, কখনো কোনো অংশ হয়তো বাদ পড়তো, আবার নতুন কোনো অংশ তৈরি করে নিতেন গায়কেরা। কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙলার সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থে পরিণত হয়েছিলো। বাঙালি হিন্দুরা রামসীতার পুণ্যকাহিনী পড়ার জন্যে পাঁচশো বছর ধরে আর বাল্মীকির রামায়ণ খুলে ধরে না, তারা খুলে ধরে কৃত্তিবাসের রামায়ণ। কৃত্তিবাসের রামায়ণ ১৮০২ কিংবা ১৮০৩ সালে সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয়। এটি ছেপেছিলেন শ্রীরামপুরের খ্রিস্টীয় পাদ্রিরা। এরপর ১৮৩০ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার কৃত্তিবাসের ভাষা বেশ মেজেঘষে নতুন করে কৃত্তিবাসী রামায়ণ মুদ্রিত করেন। এখন এ-বইটিই চলছে, এটিকেই অকৃত্রিম কৃত্তিবাসী রামায়ণ মনে করে ভক্তিতে আকুল মনে পাঠ করছে ভক্তরা।
কৃত্তিবাসের হাতে রাজপুত্র রাম, রাজবধূ সীতার অনেক বদল ঘটেছে। বদলে গেছে লক্ষ্মণ, রাবণ। সবাই বাঙালিতে পরিণত। প্রাচীন মহিমা এ-বইতে রক্ষিত হয় নি বলে দুঃখ করার কিছু নেই, কেননা এটি নবরামায়ণ। রামায়ণ বলতে যেমন বাঙলায় বোঝায় কৃত্তিবাসের রামায়ণ, তেমনি মহাভারত বলতে বোঝায় কাশীরাম দাসের মহাভারত। কাশীরাম মহাভারতের প্রথম কবি নন, অনেক কবি যখন মহাভারত রচনা করে ভূলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন তখন সতেরোশতকে দেখা দেন বাঙলার বেদব্যাস কাশীরাম দাস। তার মহাভারত অনেকদিন ধরে বাঙলার ঘরেঘরে গল্পের স্বাদ এবং ধর্মের পুণ্য বিলিয়ে আসছে। কাশীরামের বিখ্যাত স্তবকটি কে না জানে :
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।
কাশীরাম অবশ্য সারাটি মহাভারত অনুবাদ করেন নি। অনেকে মনে করেন কাশীরাম দাস ১৬০২ থেকে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মহাভারত রচনা করেন। কাশীরামের পরিবারটি ছিলো কবি-পরিবার, এক বংশে এতো কবির জন্ম বেশি হয় নি। কাশীরামের পিতার নাম কমলাকান্ত। তাঁর বড়ো ভাই লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণবিলাস নামে একটি কাব্য, ছোটো ভাই গদাধর লিখেছেন জগতমঙ্গল নামে একটি কাব্য। আর কাশীরাম তো মহাকবি। প্রচলিত আছে যে কাশীরাম দাস মহাভারত পুরোপুরি অনুবাদ করে যেতে পারেন নি। এ সম্বন্ধে যে-শ্লোকটি প্রচলিত, তা হচ্ছে :
আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেলা স্বর্গপুর।।
ধন্য হইল কায়স্থ কুলেতে কাশীদাস।
তিন পর্ব ভারত যে করিল প্রকাশ।।
তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ভাইয়ের ছেলে এবং আরো কয়েকজন মিলে মহাভারতের অনুবাদ সম্পূর্ণ করেন। কাশীরামের মহাভারতের সাথে সংস্কৃত মহাভারতের অমিল অনেক। মহাভারতের শৌর্য সংঘাতের বিরাটত্ব এতে নেই; এ-কাব্য হয়ে উঠেছে বাঙালির মহাভারত এবং পরিণত হয়েছে বাঙলার সাধারণ সম্পত্তিতে।
রামায়নের দুজন অনুবাদের নাম কী?