১৫. দুপুরের খাবারের বিশাল এক আয়োজন

সুরমা দুপুরের খাবারের বিশাল এক আয়োজন করেছেন। ঢাকার সব আত্মীয়স্বজনদের বলেছেন। মেয়ে-জামাই চলে যাবে এই উপলক্ষে সবাই মিলে একটা উৎসব।

আনন্দ-উৎসবের সুর এখানে বাজছে না, মীরু অনবরত কাঁদছে। দেশ থেকে যাবার দিন মীরু সবসময় এরকম করে কেঁদে-কেঁদে ভাসায়। তার কান্নাকাটি দেখে নিমন্ত্ৰিত অথিতিরাও অস্বস্তি বোধ করেন। সুস্বাদু সব খাবারও মুখে রোচে না।

ইয়াকুব স্ত্রীকে কিছুক্ষণ সামলাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। সে এখন বসেছে। জহিরের পাশে। বারান্দার এক কোণায়। সাউথ ডেকোটার পেট্রোয়াড ফরেস্টের গল্প  এমন ভঙ্গিতে করছে যে জহির মুগ্ধ। শুরুতে জহিরের মনে হয়েছিল মানুষটা অহঙ্কারী। সেই ভুল তার দ্বিতীয় দিনেই ভেঙেছে। মানুষটা মোটেই অহঙ্কারী নয়। দারুণ আমুদে এবং খুবই খরচে স্বভাবের। দু হাতে টাকা খরচ করে। মুখ শুকনো করে বলে, সাত দিনের জন্যে দেশে বেড়াতে এসে দেখি পথের ফকির হলাম রে ভাই! বলেই পর মুহুর্তে আরো বড় সংখ্যার টাকা খরচ করে বসে।

খুব খরচে স্বভাবের মানুষও আমেরিকায় দীর্ঘ দিন থাকলে ধাতস্থ হয়ে যায়। খরচে স্বভাব নিয়মের ভেতর চলে আসে। এই লোকটির তা হয় নি। তার খরচে স্বভাবের একটা নমুনা কিছুক্ষণ আগে জহির দেখল এবং তার চমৎকার লাগল। ব্যাপারটা এই রকম

ইয়াকুব দেশে খরচ করবার জন্যে যা ডলার জমিয়েছিল তার পুরোটা সে খরচ করতে পারে নি। দু হাজার সাত শ টাকা বেঁচে গিয়েছে। এই টাকাটা সে ফেরত নিতে চায় না। টাকাটা খরচ করবার একটা কায়দাও সে বের করল। একটা লটারি হবে। এবাড়ির মানুষদের মধ্যে লটারি। যার নাম উঠবে সেই পুরো টাকাটা পাবে। সবার খুব উৎসাহ নাম লিখে একটা ঠোঙায় রাখা হল। ইয়াকুব বলল, এ-বাড়ির কাজের লোকদের নাম দেওয়া হয়েছে তো? সুরমা বিস্মিত হয়ে বললেন, সে-কী! ওদের নাম কেন? ইয়াকুব হেসে বলল, ওরাও তত এ-বাড়িরই লোক মা। ওরা বাদ থাকবে কেন? ভাগ্যক্রমে ওরা যদি কেউ পায় তো কেমন মজা হয় দেখবেন। ওদের আনন্দটা দেখবার মতো।

হলও তাই। মালীর নাম উঠে গেল।

সে কিছুক্ষণ ব্যাপারটা বুঝতেই পারল না। টাকা হাতে নিয়ে বোকার মতো সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল।

ইয়াকুব বলল, যাও, এবার টাকা খরচ কর। লটারিতে জিতলে। তোমার নাম উঠেছে।

মালী তবুও নড়ে না। ভয়ে-ভয়ে অন্যদের মুখের দিকে তাকায়। শেষটায়। কেঁদেকেটে বিরাট এক নাটক।

এই নাটকটি জহিরের পছন্দ হয়েছে। সে মুগ্ধ। এখনো সে পেট্রোয়াড ফরেষ্টের গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনছে। ইয়াকুব গল্প বলছে সমস্ত শরীর দিয়ে, হাত নাড়ছে, ভ্রূ কোঁচকাচ্ছে।

পুরো বনটাই অনেক অনেক বছর আগে কোনট-এক প্ৰাকৃতিক কারণে পাথর হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয় ব্যাপার। বনের কীটপতঙ্গ সবই পাথর। চোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না।

আপনি নিজে দেখেছেন দুলাভাই?

আফকোর্স। পাঁচ ডলার করে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। তবে ঢেকবার পর মনে হয় টিকেটের দাম আরো বেশি হওয়া উচিত ছিল। লোকজন আমেরিকা যায়। দেখে ফালত জিনিস। সিয়ার্স টাওয়ার, ডিজনিল্যান্ড। মানুষের তৈরি জিনিস তো সব জায়গায় এক রকম। প্রকৃতি একেক জায়গায় একেক রকম কাজ করে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের কথা তোমাকে বলি। এক মিনিট, সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে আসি।

ইয়াবুক উঠে চলে গেল। ঠিক তখন নিশাত এসে বলল, তুমি কি আমাকে একটু থানায় নিয়ে যাবে?

জহির ঠাণ্ডা গলায় বলল, কেন?

পুষ্প টেলিফোন করেছিল। মিজান সম্ভবত জামিনে ছাড়া পেয়েছে। কত বড় সাহস, দেখা করতে এসেছে পুষ্পের সঙ্গে।

তার জন্যে তুমি থানায় গিয়ে কি করবে?

জানব ব্যাপারটা কী। নন-বেইলেবল ওয়ারেন্টে যে গ্রেফতার হয় সে ছাড়া পায় কীভাবে, সেটা জিজ্ঞাসা করব। থানায় টেলিফোন করেছিলাম, শুধু এনগেজ পাচ্ছি।

জহির শান্ত গলায় বলল, আমি এখন তোমাকে নিয়ে কোথাও যাব না। তোমার যদি যেতেই হয় নিজে নিজে যাও। এই ব্যাপারটা নিয়ে তুমি যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করছ, আমি কিছু বলি নি। এই মুহূর্তে এটা নিয়ে আর ছোটাছুটি না করলে খুশি হব। এক দিন সোশ্যাল ওয়ার্ক না করলে তোমার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না এবং তোমার বান্ধবীরও কোন বড় ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। যা হবার ইতোমধ্যে হয়েছে।

নিশাত বলল, প্লীজ, তুমি আমার সঙ্গে এই সুরে কথা বলো না। আমার খুব খারাপ লাগছে।

আমি খুব সহজভাবেই তোমার সঙ্গে কথা বলব। তুমি দয়া করে এখানে বসে অন্তত এক দিনের জন্যে মাথাটা হালকা রাখ। তুমি প্রতিটি মানুষকে বিরক্ত করছ।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, তাই। তোমার মীরু আপা বলছিলেন, ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে তোমার মাথাটা দেখাতে। তোমার মাথায় নাকি কিছু গোলমাল হয়ে গেছে।

বোধহয় হয়েছে।

নিশাত, বস আমার পাশে। বী ঈজি। এস দুলাভাইয়ের গল্প শুনি।

ইয়াকুব সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ফিরে এসেছে। নিশাতকে দেখে হাসিমুখে বলল, বিখ্যাত সমাজ-সেবিকা এইখানে কেন?

সমাজ-সেবা আজকের দিনের জন্যে স্থগিত। আজ শুধু আপনাদের সেবা করব।

চমৎকার, খাবার দেওয়ার এখনো সম্ভবত ঘন্টাখানেক দেরি আছে। তুমি আমাদের জন্যে ঠাণ্ডা কিছু নিয়ে এস এবং ক্যামেরাটা এনে আমাদের দু জনের প্রাণখুলে, গল্প করার ছবিটা ধরে রাখা

আমি গল্প শোনবার জন্যে বসলাম দুলাভাই। আমি নড়াচড়া করতে পারব না।

ইয়াকুব গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গল্প শুরু করল। জহির লক্ষ করল নিশাত সেই গল্প। শুনছে না। সে খুবই অন্যমনস্ক। সে অন্য কিছু ভাবছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *