১৫. দার্শনিক ফলাফল
অনেক সময় যেরকম ভাবা হয়, অপেক্ষাবাদের দার্শনিক ফলাফল সেরকম বিরাটও নয় কিংবা সেরকম চমকপ্রদও নয়। বাস্তববাদ এবং ভাববাদে দ্বন্দ্বের মতো চিরায়ত মর্যাদা যে দ্বন্দ্বগুলির রয়েছে সেগুলির উপর অপেক্ষাবাদের সামান্যই আলোকপাত করে। কান্টের ধারণা ছিল স্থান এবং কাল ব্যক্তিনিষ্ঠ (subjective) এবং একাধিকরূপ স্বজ্ঞা (forms of intuition)। অনেকে ভাবেন। অপেক্ষবাদ এ বিষয়ে কান্টের সমর্থক। আমার ধারণা অপেক্ষবাদ সম্পর্কে লেখকরা যেভাবে পর্যবেক্ষকের কথা বলেন তার জন্যই লোকে বিপথগামী হয়েছে। পর্যবেক্ষক একজন মানুষ-অন্ততপক্ষে একটি মন-এ কথা ভাবা স্বাভাবিক কিন্তু একটি ফটোগ্রাফের প্লেট কিংবা একটি ঘড়িরও পর্যবেক্ষক হওয়ার সম্ভাবনা একই রকম, অর্থাৎ একটি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গির দ্বন্দ্বের জন্য যে বিষম ফল হয় সে ফল জড়িত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। ব্যাপারটা অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের ক্ষেত্রে যতটা প্রযোজ্য, ততটাই প্রযোজ্য ভৌত যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে। অপেক্ষবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিনিষ্ঠতা আসলে ভৌত ব্যক্তিনিষ্ঠতা। বিশ্বে যদি মন কিংবা বোধ নাও থাকত তাহলেও এ ব্যক্তিনিষ্ঠতা থাকত।
তাছাড়া, এ ব্যক্তিনিষ্ঠতা কঠোরভাবে সীমিত। সবকিছু আপেক্ষিক এরকম ঘোষণা এ তত্ত্ব করে না। বরং উল্টো। কোনটা আপেক্ষিক এবং কোনটা নিজস্ব অধিকারে ভৌত ঘটনার অংশ সেটা নির্ণয়ের কৌশল পাওয়া যায় অপেক্ষবাদ থেকে। আমরা যদি বলতে যাই স্থান ও কাল বিষয়ে এ তত্ত্ব কান্টকে সমর্থন করে তাহলে আমরা বলতে বাধ্য যে স্থান-কাল বিষয়ে এ তত্ত্ব কান্টকে খণ্ডন করে । আমার মতে এগুলির কোনোটিই সঠিক নয়। এই সমস্ত বিষয়ে দার্শনিকরা কেন পূর্বেকার মতে স্থির থাকবেন না তার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। কোনো পক্ষেই প্রামাণ্য কোনো যুক্তি এর আগে উপস্থিত করা হয়নি। এখনো কোনো যুক্তি নেই। সুতরাং কোনো একটি মতকে আঁকড়ে থাকা বৈজ্ঞানিক মেজাজের লক্ষণ নয়, লক্ষণ মতান্ধতার।
তবুও, অপেক্ষবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিন্তাধারা যখন সুপরিচিত হবে তখন আমাদের চিন্তার অভ্যাসের কতগুলি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। স্কুলে যখন অপেক্ষবাদ পড়ানো হবে তখন এ তত্ত্বের পরিচিতি বাড়বে, ভবিষ্যতে এর গুরুত্ব হবে বিরাট।
একটি তথ্য প্রকাশিত হয়েছে : আমরা যা ভাবতাম, ভৌত জগৎ সম্পর্কে পদার্থবিদ্যা আমাদের তার চাইতে অনেক কম সংবাদ দিতে পারে। চিরায়ত পদার্থবিদ্যার মহান নীতিগুলির বেশিরভাগই হয়ে দাঁড়ায় সেই মহান বিধির মতো ‘এক গজে তিন ফুট সবসময়ই হয়। তাছাড়া দেখা যায় অন্যগুলি সর্বৈব মিথ্যা। একটি বিধির যে এই দুরকম দুর্ভাগ্যেরই আশঙ্কা রয়েছে তার একটি উদাহারণ ভরের নিত্যতা বিধি (conservation of mass)। আগে ভরের সংজ্ঞা ছিল ‘পদার্থের পরিমাণ। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছিল ওর কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি হয় না। কিন্তু আধুনিক মাপনের নির্ভুলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে দেখা গেল। প্রথমত লক্ষ্য করা গেল মাপিত ভর বেগের সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এবং আবিষ্কৃত হল এই ধরনের ভর এবং শক্তি আসলে অভিন্ন। একটি বস্তুপিণ্ড সাপেক্ষ এই ধরনের ভর নিত্য নয়। এই বিধিকে কিন্তু স্বতত একটি স্বয়ংসিদ্ধ সত্য (truism) রূপে বিচার করা উচিত, অনেকটা এক গজে তিন ফুট হয় এইরকম বিধির মতো। আসলে এটা আমাদের মাপন পদ্ধতির ফলস্বরূপ। পদার্থের সত্য ধর্ম এ থেকে প্রকাশ পায় না, বস্তুপিণ্ডের সঙ্গে চলমান পর্যবেক্ষক যে ভর দেখতে পান সে ভর অন্য ধরনের কিন্তু সেটাই সঠিক ভর (proper mass)। এটা হল সাধারণ পার্থিব ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে যে বস্তুপিণ্ড আমরা ওজন করছি সেটা হাওয়ার ভিতর দিয়ে উড়ছে না। একটি বস্তুপিণ্ডের সঠিক ভর প্রায় নিত্য কিন্তু সম্পূর্ণ নিত্য নয়। লোকে ভাবে, আপনার যদি চারটি এক পাউন্ডের বাটখারা থাকে আর আপনি যদি সব কটাকে ওজন কলে চাপান তাহলে সেগুলির মোট ওজন হবে চার পাউন্ড। এটা একটা পছন্দসই ভ্রম। ওজনটা কমই হবে, কিন্তু কমের মাত্রা এমন বেশি নয় যে সবচাইতে সতর্ক মাপনে ধরা পড়বে। তবে যেখানে চারটা হাইড্রোজেন পরমাণুকে একত্র করে একটি হিলিয়াম পরমাণু বানানো হয় সেখানে দোষটা লক্ষ্য করা যায়। একটি হিলিয়াম পরমাণুর ওজন চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর চাইতে কম-এই হাসপ্রাপ্তি মেপে বার করা সম্ভব।
মোটামুটি বলা যায় চিরায়ত পদার্থবিদ্যা দুটি অংশে ভেঙে পড়েছে : স্বতঃসিদ্ধ সত্য (truism) এবং ভূগোল।
অপেক্ষবাদ যে বিশ্বকে আমাদের কল্পনে উপস্থিত করেছে সে বিশ্ববস্তু এমন গতির ততটা নয়, যতটা ঘটনার । একথা সত্য যে এখনো এমন সমস্ত বস্তুকণা রয়েছে যেগুলিকে স্থায়ী মনে হয় কিন্তু (আগের অধ্যায়ে আমরা যেরকম দেখেছি) আসলে এগুলিকে কল্পনা করা উচিত পরস্পর সংযুক্ত ঘটনামালা রূপে, অনেকটা গানের পারস্পরিক স্বরের মতো। ঘটনাই আপেক্ষিক পদার্থবিদ্যার উপাদান। ব্যাপক এবং বিশিষ্ট অপেক্ষবাদ অনুসারে দুটি ঘটনা যদি পরস্পর থেকে বেশি দূরবস্থিত না হয় তাহলে তাদের ভিতরে একটা মাপনযোগ্য সম্পকে থাকে, সে সম্পর্কের নাম ‘অন্তত’। এই অন্তরই ভৌত বাস্তববতারূপে দেখা দেয়, কালিক এবং স্থানিক দূরত্ব এই অন্তরেরই বিভ্রান্তিকর প্রতিরূপ। পরষ্পর থেকে দূরবর্তী দুটি ঘটনার কোনো নির্দিষ্ট নিশ্চিত অন্তর নেই। কিন্তু একটি ঘটনা থেকে অন্য ঘটনায় যাওয়ার একটি পথ আছে। সে পথে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অন্তরের যোগফল অন্য যে কোনো পথের সমরূপ যোগফলের চাইতে বেশি। এই পথের নাম ‘ধরাকৃতি’–একটি বস্তুপিণ্ডকে যদি তার নিজস্বতার উপর ছেড়ে দেওয়া যায় তাহলে সে এই পথই গ্রহণ করবে।
আপেক্ষিক পদার্থবিদ্যার সমস্তটা আগেকার দিনের পদার্থবিদ্যা এবং জ্যামিতির তুলনায় অনেক বেশি পারস্পরিক সোপানরোহণের বিষয় (step-by step matter)। ইউক্লিডীয় ঋজুরেখার স্থলে প্রতিস্থাপন করতে হবে আলোকরশ্মি। আলোকরশ্মি যখন সূর্য কিংবা ঐরকম ভারী বস্তুপিণ্ডের কাছ দিয়ে যায় তখন ঠিক ঋজুতার ইউক্লিডীয় মান রক্ষা করে না। শূন্যস্থানের খুব ক্ষুদ্র অঞ্চলে একটি ত্রিভুজের তিনটি কোণের যোগফল এখনো দুই সমকোণ ভাবা হয় কিন্তু বিস্তৃত কোনো অঞ্চলে একথা ভাবা হয় না। কোথাও এমন কোনো জায়গা পাওয়া যায় না যেখানে ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নির্ভুলভাবে সত্য। যে সমস্ত প্রতিজ্ঞা (proposition) যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা হতো এখন সেগুলি হয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, রীতি, নয়তো পর্যবেক্ষণের দ্বারা প্রমাণিত আসন্ন সত্য (approximate truths) মাত্র।
যুক্তি যত উন্নত হয় তার বাস্তব ঘটনা প্রমাণ করার ক্ষমতা তত কমে-এরকম অদ্ভুত ঘটনার দৃষ্টান্ত শুধু অপেক্ষবাদই নয়। আগে মনে করা হতো যুক্তি আমাদের শিক্ষা দেয় কি করে অনুমিতি (inferenc) আহরণ করতে হয়, এখন বরং শিক্ষা দেয় কি করে অনুমিতি আহরণ করা না যায়। শিশু এবং জন্তু অত্যন্ত অনুমিতি প্রবণ। অনভ্যস্ত স্থানে মোড় ঘুরলে ঘোড়া অপরিমিতি বিস্ময় বোধ করে। মানুষ যখন যুক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করেছে তখন সে অতীত যুগে চিন্তা না করে যে সমস্ত অনুমিতি আহরণ করেছিল সেগুলির যৌক্তিকতা দেখানোর চেষ্টা করেছে। এই প্রবণতা থেকে প্রচুর পরিমাণ মন্দ দর্শন এবং মন্দ বিজ্ঞান উৎপন্ন হয়েছে। ‘প্রকৃতির সমরূপতৃ’ কিংবা ব্রহ্মাণ্ডীয় কার্যকরণ বিধির মতো মহান নীতিগুলি আসলে অতীতে যা বার বার ঘটেছে, ভবিষ্যতেও তাই ঘটবে-আমাদের এই বিশ্বাসকে দৃঢ় করার চেষ্টা। এ বিশ্বাসের ভিত্তি-আপনি সাধারণত যে দিকে বাঁক নেন সেই দিকেই বাঁক নেবেন-ঘোড়ার এই বিশ্বাসের চাইতে কোনোক্রমেই দৃঢ়ভিত্তিক নয়। এই মেকি নীতির (pseudo principle) স্থলে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে কি প্রতিস্থাপিত হবে সে সম্পর্কে পুর্বাভাস দেওয়া খুব সহজ নয় তবে অপেক্ষবাদ হয়তো আমরা কি আশা করতে পারি সে সম্পর্কে একটা আভাস দিতে পারে। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় প্রাচীন অর্থে-কার্য-কারণ তত্ত্বের (causation) আর কোনো স্থান নেই। অন্য একটা কিছু অবশ্যই তার স্থান গ্রহণ করেছে। প্রাচীন নীতিগুলিকে বাতিল করেছে এই প্রতিকল্প (substitute)। কিন্তু যাকে বাতিল করা হয়েছে তার তুলনায় এ প্রতিকল্পের পরীক্ষামূলক ভিত্তি দৃঢ়তর।
একটি সর্বব্যাপক কালের মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী সমস্ত ঘটনার দিনাঙ্ক নির্ণয় সম্ভব, এ বিশ্বাস ভেঙে পড়েছে। ভবিষ্যতে এর প্রতিক্রিয়া, কার্যকারণ তত্ত্ব, বিবর্তন এবং অন্যান্য অনেক বিষয় আমাদের মতকে প্রভাবিত করবে। দৃষ্টান্ত :
মোটের উপর ব্রহ্মাণ্ডে প্রগতি হচ্ছে কিনা এ প্রশ্নের অনেকটাই নির্ভর করতে পারে আমাদের কালের মাপন নির্বাচনের উপর। একই রকম উত্তম একাধিক ঘড়ির ভিতর থেকে যদি আমরা একটিকে বেছে নিই তাহলে আমরা হয়তো দেখব ব্রহ্মাণ্ড সবচাইতে বিষাদগ্রস্ত শ্লাভ (slave) যা কল্পনা করতে পারে সেইরকম দ্রুত চলেছে মন্দ থেকে মন্দতরতে। সুতরাং আশাবাদ কিংবা নৈরাশ্যবাদ সত্যও নয় মিথ্যাও নয়। তারা শুধু ঘড়ির নির্বাচন নির্ভর।
কতকগুলি ভাবাবেগের উপর এর ক্রিয়া সম্পূর্ণ ধ্বংসাত্মক। কবি সে সম্পর্কে বলেন :
একটি দূরতর ভাগবৎ ঘটনা
যার অভিমুখে চলেছে মহাসৃষ্টি
কিন্তু ঘটনাটি যদি যথেষ্ট দূরবর্তী হয় এবং সৃষ্টি যদি যথেষ্ট দ্রুতগামী হয়। তাহলে কোনো অংশ ভাববে ঘটনাটি আগেই ঘটেছে আবার কোনো কোনো অংশ ভাববে ঘটনাটি এখনো ভবিষ্যতের গর্ভে। ফলে সম্পূর্ণ কবিতাটাই নষ্ট হয়। দ্বিতীয় লাইন হওয়া উচিত :
যার অভিমুখে সৃষ্টির কোনো কোনো অংশ চলমান আর কোনো অংশ চলমান তার বিপরীত মুখে।
কিন্তু এতে চলবে না। যে ভাবাবেগ সামান্য গণিতের চাপে ধ্বংস হতে পারে আমার মতে সে ভাবাবেগ খাঁটিও নয়, মূল্যবানও নয়। কিন্তু এই জাতীয় যুক্তি আমাদের ভিক্টোরীয় যুগের সমালোচনার পথে নিয়ে যাবে। সেটা কিন্তু আসার বিষয়বস্তু বাইরে।
আমি আবার বলছি : ভৌত জগৎ সম্পর্কে আমরা যা জানি সেটা আগে বা ভাবা হতো তার চাইতে অনেক বেশি বিমূর্ত। বস্তুপিণ্ডগুলির মধ্যবর্তী রয়েছে ঘটনা, যেমন আলোকতরঙ্গ। এগুলির বিধি সম্পর্কে আমরা কিছুটা জানি। গাণিতিক সঙ্কেতে যতটা জানা যায় এ বিষয়ে ততটাই আমাদের জ্ঞান কিন্তু তাদের চরিত্র সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি বস্তুপিণ্ডগুলি স্বতত কি সে সম্পর্কে আমরা এত কম জানি যে কিছু আছে কি না সে সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত হতে পারি না : হয়তো তারা অন্য জায়গায় সংঘটিত ঘটনাগোষ্ঠী মাত্র। সেই ঘটনাগুলিকে আমরা স্বভাবতই তাদের ক্রিয়া বলে ভাবব। স্বভাবতই আমরা বিশ্বকে ব্যাখ্যা করি চিত্রের মতো। আমরা কল্পনা করি আমরা যা দেখি ব্যাপারটা প্রায় সেই রকমই ঘটে। আসলে কিন্তু সাদৃশ্য শুধুমাত্র কিছু রীতিগত যৌক্তিক ধর্ম পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। তারা প্রকাশ করে অবয়ব যার ফলে আমরা এর পরিবর্তনের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য মাত্র জানতে পারি। একটা দৃষ্টান্ত বোধ হয় ব্যাপারটাকে সহজ করতে পারে। একটা ঐকতান বাদন এবং সেই একই ঐকতানের স্বরলিপির ভিতরে একটা বিশেষ সাদৃশ্য রয়েছে। তাকে বলা যেতে পারে অবয়বের সাদৃশ্য। সাদৃশ্য এমন যে নিয়মটা জানা থাকলে স্বরলিপি থেকে সুরটা বোঝা যায়-আবার সুর থেকে স্বরলিপি বোঝা যায়। কিন্তু অনুমান করুন আপনি জন্ম থেকে সম্পূর্ণ বধির কিন্তু থেকেছেন গাইয়ে বাজিয়েদের সঙ্গে। কথা বলা এবং অপরের ঠোঁট নাড়া দেখে তার কথা বোঝা (lip reading) শিখে থাকলে আপনি বুঝতে পারতেন স্বরলিপিগুলি এমন একটি জিনিসের প্রতিরূপ যা স্বতত তাদের চাইতে পৃথক অথচ তাদের অবয়ব* একই রকম। সুরের মূল্যবোধ আপনার কাছে অকল্পনীয় হতো কিন্তু তার গাণিতিক বৈশিষ্ট্য আপনি সবটাই বুঝতে পারতেন। তার কারণ স্বরলিপির সঙ্গে তার পূর্ণ ঐক্য রয়েছে। প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানও অনেকটা এই রকম। স্বরলিপি আমরা পড়তে পারি। আমাদের সম্পূর্ণ বধির লোকটি সুর যতটা অনুমান করতে পেরেছিল প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা ততটাই অনুমান করতে পারি। কিন্তু গাইয়ে বাজিয়েদের সঙ্গে সাহচর্যের ফলে ঐ লোকটির যে সুবিধা ছিল আমাদের সে সুবিধা নেই। আমরা জানতে পারি না স্বরলিপিটা যে সুরের প্রতিরূপ সে সুর বীভৎস না সুন্দর। হয়তো শেষ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে আমরা নিশ্চিত হতে পারব না স্বরলিপিটা তার নিজস্ব রূপ না আর কিছু। কিন্তু একজন পদার্থবিদ্যাবিদ তার ব্যবসায়িক পদাধিকারে এ সন্দেহ পোষণ করতে পারেন না।
পদার্থবিদ্যার সপক্ষে যদি সবচাইতে বেশি দাবীও করা যায় তাহলেও এ কথা বলা যায় না যে পদার্থবিদ্যা বলতে পারে যেটা পরিবর্তিত হচ্ছে সেটা কি, কিংবা কি এর বিভিন্ন অবস্থার। পদার্থবিদ্যা শুধুমাত্র বলতে পারে একাধিক পরিবর্তন পরষ্পরকে পর্যাবৃত্তিক্রমে (periodically) অনুসরণ করে কিংবা একটি বিশেষ দ্রুতিতে বিস্তার লাভ করে। শুদ্ধ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মর্মস্থলে পৌঁছাতে হলে শুদ্ধ কল্পনার আবরণ সম্পূর্ণ খুলে ফেলতে হয়। সে কাজ এখনো বোধ হয় আমরা শেষ করতে পারিনি। এ ব্যাপারে অপেক্ষবাদ অতি বিরাট কর্ম সম্পাদন করেছে। এই কাজ করতে গিয়ে অপেক্ষবাদ ক্রমশই আমাদের নগ্ন কাঠামোর (bare structure) নিকটতর করেছে। এটাই গণিতবেত্তার (mathematician) লক্ষ্য। তার কারণ এ নয় যে মানুষ হিসাবে এটাই তার একমাত্র আকর্ষণ।
আসলে তার কারণ হল : গাণিতিক সঙ্কেতে সে এই একটি জিনিসই প্রকাশ করতে পারে। বিমূর্তনের (abstraction) দিকে আমরা অনেকটা এগিয়েছি সন্দেহ নেই কিন্তু হয়তো আমাদের অগ্রসর হতে হবে আরো ।
আগের অধ্যায়ে আমি পদার্থের সর্বনিম্ন সংজ্ঞা যাকে বলা যেতে পারে তার একটা আভাস দিয়েছিলাম। অর্থাৎ বলতে গেলে সে সংজ্ঞায় সর্বনিম্ন বস্তু থাকবে কিন্তু সে বস্তুতে (substance) শুধুমাত্র তাই থাকবে যা পদার্থবিদ্যার সত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই সংজ্ঞা গ্রহণ করা আসলে আমাদের নিরাপত্তার প্রচেষ্টা। যদি আরো স্থূল কিছুর অস্তিত্ব থাকে তবুও আমাদের সূক্ষ্ম পদার্থের অস্তিত্ব থাকবে। আমাদের পদার্থের সংজ্ঞাকে আমরা জেন অস্টেনের (Jane austen) ইসাবেলার জাউভাতের (Isabella’s gruel) মতো করতে চেষ্টা করেছি–’পাতলা, কিন্তু খুব পাতলা নয়।‘ আমরা যদি সজোরে সুস্পষ্ট ঘোষণা করি ‘পদার্থ’ এর চাইতে বেশি কিছু নয় তাহলে কিন্তু আমরা ভুল করব। লাইবনিজ (Leibnitz) ভাবতেন একটুকরো পদার্থ আসলে কতকগুলি আত্মার উপনিবেশ (colony of souls)। তিনি ভুল করেছিলেন একথা প্রমাণ করার মতো কিছু নেই। তবে তিনি সঠিক বলেছিলেন একথা প্রমাণ করার মতোও কিন্তু কিছু নেই। আমরা মঙ্গলগ্রহের জীবজন্তু গাছপালা সম্পর্কে যা জানি তার চাইতে বেশি কিছু আমরা এ বিষয়ের কোনো পক্ষেই জানি না।
অগাণিতিক মন হলে আমাদের ভৌতজ্ঞানের বিমূর্ত চরিত্র সন্তোষজনক মনে হতে পারে। শিল্প কিংবা কল্পনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটা হয়তো দুঃখের কিন্তু ব্যবহারিক দিক থেকে এতে কিছু এসে যায় না। বিমূর্তন কঠিন হতে পারে কিন্তু বিমূর্তনই ব্যবহারিক ক্ষমতার উৎস। একজন মূলধন বিনিয়োগকারী ধনপতির (financier) পৃথিবীর সঙ্গে লেনদেন একজন ‘কর্মদক্ষ’ (parctical) লোকের চাইতে বেশি বিমূর্ত হতে পারে কিন্তু কর্মদক্ষ ব্যক্তিটির তুলনায় ধনপতির ক্ষমতা অনেক বেশি। ধনপতি গম কিংবা তুলোর ব্যবসা করতে পারেন কিন্তু সেজন্য তাঁর কখনোই কোনোটা দেখার প্রয়োজন হয় না। তাঁর শুধু জানার প্রয়োজন দামটা বাড়বে না কমবে। কৃষকের জ্ঞানের সঙ্গে তুলনায় একে বলা হয় বিমূর্ত গাণিতিক জ্ঞান। সেইরকম, একজন পদার্থবিদ্যাবিদের হয়তো গতির কয়েকটি বিধি ছাড়া পদার্থ সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই না থাকতে পারে কিন্তু পদার্থকে স্বকার্যে পরিচালনা করার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান তার থাকে। পদার্থবিদ্যাবিদ সমীকরণের একটি পূর্ণ মালিকা নিয়ে পরিশ্রম করেন। সে সমীকরণের প্রতীকগুলি যার প্রতিরূপ তার স্বকীয় চরিত্র আমরা কখনোই জানতে পারব না। তিনি শেষ পর্যন্ত যে ফলে এসে পৌঁছান সে ফল আমাদের দৈনন্দিন অনুভূতির বাগ্বিধিতে প্রকাশ করা সম্ভব এবং তার দ্বারা সম্ভব আমাদের নিজেদের জীবনে আকাঙ্ক্ষিত ক্রিয়া আনয়ন। পদার্থ সম্পর্কে আমরা যা জানি না তা বিমূর্ত এবং ছককাটা (schematic) হতে পারে, কিন্তু আমাদের ভিতরে তারা কি নিয়ম অনুসারে অনুভূতি ও বেদনা (feeling) উৎপাদন করে সেটুকু জানার পক্ষে নীতিগতভাবে সে জ্ঞান যথেষ্ট। এই নিয়মগুলির উপরই পদার্থবিদ্যার ব্যবহারিক প্রয়োগ নির্ভরশীল।
শেষ সিদ্ধান্ত : আমরা এত কম জানি, অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার আমরা এত বেশি জানি, আরো আশ্চর্যের ব্যাপার এত অল্প জ্ঞান এত বেশি ক্ষমতা দান করতে পারে।
——
* অবয়বের সংজ্ঞার জন্য এই লেখকের গাণিতিক দর্শনের ভূমিকা দেখুন।