দরজা খুলল বড় মেয়েটি।
অপালা এর নাম জানে না। শুধু এর কেন, কারোরই নাম জানে না। আজও হয়ত জানা হবে না। অপালা ক্ষীণ স্বরে বলল, ভেতরে আসব? বড় মেয়েটি হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। শুধু দরজা ছেড়ে একটু সরে গেল। অপালা বলল, তোমার নাম কী?
আমার নাম সোমা!
তোমারই কী বিয়ে হচ্ছে?
হ্যাঁ।
বিয়েটা যেন কবে? আমার তারিখটা মনে নেই। কার্ড হারিয়ে ফেলেছি।
এগার তারিখ। আমি আবার আসায় তুমি কী রাগ করেছ?
রাগ করব কেন?
সোমা অপালার কাধে হাত রাখল। অপালা বলল, তুমি কী আমার বড়, না ছোট?
সোমা সে কথার জবাব দিল না। হালকা গলায় বলল, এসো, ভেতরে এসে বসো।
বাসায় কেউ নেই? কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে।
ওরা বাজারে গিয়েছে।
বিয়ের বাজার?
হ্যাঁ।
তোমার মা? উনি যাননি?
মা অসুস্থ, এখন ঘুমুচ্ছে। তুমি আমার সঙ্গে এসো।
তারা ভেতরের দিকে একটা ছোট্ট ঘরে এসে দাঁড়াল। দুদিকে দু’টি চৌকি পাতা। একটা পড়ার টেবিল। সুন্দর করে গোছানো।
এটা তোমার ঘর?
হ্যাঁ।
কে কে শোয় এখানে?
আমরা চার বোন। দু’জন দু’জন করে। তুমি বস।
অপালা বসল। বসতে বসতে বলল, শাড়িটা কী তোমার পছন্দ হয়েছে?
সোমা এবারও হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। সে বসেছে অপালার মুখোমুখি। কিন্তু এক বারও অপালার দিকে তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করে আছে।
যে ছেলেটির সঙ্গে তোমার বিয়ে হচ্ছে তাকে কী তুমি দেখেছ?
হ্যাঁ।
ছেলেটিকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
না।
পছন্দ হয়নি কেন?
সোমা উত্তর দিল না। তার মুখ ঈষৎ কঠিন হয়ে গেল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। সে। অপালা বলল, আচ্ছা, আমরা দু’জন কী যমজ বোন? দু’জন দেখতে অবিকল এক রকম, তাই না?
সোমা এবারও চুপ করে রইল।
আমার মনে হচ্ছে আমরা যমজ বোন। ছোটবেলায় আমাদের বোধ হয় একই রকম জামা
জুতো পরানো হত। হত না?
অপালা লক্ষ্য করল, সোমা কাঁদছে। নিঃশব্দ কান্না। মাঝে মাঝে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। গালে সূক্ষ্ম জলের রেখা।
সোমা।
বল।
আমার কী নাম ছিল তখন? আমার কী ধারণা, জানো? আমার ধারণা, সোমার সঙ্গে মিলিয়ে আমার নাম ছিল রুমা।
সোমা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। সে বোধহয় চোখে কাজল দিয়েছিল, সারা মুখে কাজল লেপেট গেল।
তোমার চোখ তো এমনিতেই সুন্দর, কাজল দিতে হবে কেন? আমাদের দুজনের মধ্যে কে বেশি সুন্দর? তোমাদের ঘরে বড় আয়না আছে? এস না, দু’জন পাশাপাশি দাঁড়াই।
সোমা যেভাবে বসেছিল, সেভাবেই বসে রইল। অপালা স্পষ্ট স্বরে বলল, আমি যদি ফিরে আসি, তাহলে কার সঙ্গে ঘুমুবো? তোমার সঙ্গে?
ভেতর থেকে সোমার মা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, কে কথা বলে? কে ওখানে?
সোমা বলল, কেউ না মা, কেউ না।
আমি স্পষ্ট শুনলাম!
ভদ্রমহিলা নিজে-নিজেই বিছানা থেকে উঠলেন। পা টেনে-টেনে সোমাদের ঘরের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন। অপালা বলল, আপনি ভাল আছেন?
এই বলেই সে অস্পষ্টভাবে হাসল। ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। টলে পড়ে যাচ্ছেন। সোমা ছুটে গিয়ে তার মাকে ধরল। একা সে সামলাতে পারছে না। সে তাকাল অপালার দিকে। অপালা নড়ল না, যেভাবে বসে ছিল, সেভাবেই বসে রইল। সোমা বলল, তুমি একটু পানি এনে দেবে? মুখে পানির ছিটা দেব।
অপালা উঠে দাঁড়াল। হালকা পায়ে বারান্দায় চলে এল। ঐ তো পানির কল। মাগে করে পানি নিয়ে আসা যায়। সে পানির কলের দিকে গেল না। নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে চলে এল। তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কান্না আসছে না।
ফখরুদিন সাহেব ঘণ্টাখানেক আগে এসে পৌঁছেছেন। হেলেনারও টিকিট ছিল। তিনি আসতে পারেননি। ডাক্তাররা শেষ মুহূর্তে ঠিক করেছেন হার্টে বাই পাস সার্জারির প্রয়োজন, এবং তা অল্পদিনের মধ্যেই করতে হবে। ফখরুদিন সাহেব সব ব্যবস্থা করে এসেছেন। দিন সাতেকের মধ্যে তিনি অপালাকে নিয়ে ফিরে যাবেন।
বাড়িতে পা দিয়েই তিনি মেয়ের খোঁজ করলেন। মেয়ে বাড়িতে নেই। কোথায় গিয়েছে। কেউ বলতে পারেনি। গাড়ি নিয়ে যায়নি। আজকাল প্রায়ই গাড়ি ছাড়া বের হয়। ফখরুদ্দিন সাহেব কিছুই বললেন, না। সারপ্রাইজ দেবার জন্যে খবর না দিয়ে এসেছেন। সেই সারপ্রাইজটি দেয়া গেল না।
তিনি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সারলেন। পর পর তিন কাপ বিস্বাদ কালো কফি খেলেন। চুরুট ধরিয়ে নিচে নেমে এলেন। নিশানাথবাবুর সঙ্গে আগেই তার দেখা হয়েছে। তিনি কোনো কথা বলেননি, এখন বললেন।
কেমন আছেন?
জি স্যার, ভাল।
বসার ঘরটির এই অবস্থা করেছে?
অপালা মা খুব পছন্দ করেছে।
তার জন্যে এ রকম ঘর একটা সাজিয়ে দেয়া যাবে। আপনি এক্ষুণি আগের ডেকোরেশনে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করুন।
স্যার, করছি।
আর্টিস্ট লোকটি কী প্রায়ই এ বাড়িতে আসে?
কার কথা বলছেন স্যার?
যে এই অদ্ভুত ডেকোরেশন করেছে, তার কথাই বলছি।
জি না স্যার।
আপনি না জেনে বলছেন। দারোয়ানকে ডেকে নিয়ে আসুন।
নিশানাথবাবু ছুটে গেলেন। দারোয়ানের কাছে একটা বড় খাতা থাকার কথা। সেখানে সে
লিখে রাখবে কে আসছে কে যাচ্ছে। কখন আসছে কখন যাচ্ছে। দারোয়ান খাতা নিয়ে এল। ফখরুদিন সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যাও, আমার ঘরে রেখে এস। নিশানাথবাবু।
জি স্যার।
আপনার স্ত্রী এখানে কেন?
অপালা মা একা-একা থাকে…।
সে কী বলেছিল তাঁকে আনবার কথা?
জি না স্যার।
তাহলে..?
নিশানাথবাবু ঘামতে লাগলেন। ফখরুদিন সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, খবরের কাগজে এত কেচ্চা-কাহিনী ছাপা হল, আপনারা ছিলেন কোথায়? পি.আর-ও সাহেবকে আসতে বলুন। যে সব পুলিশ অফিসার এই ঘটনার তদন্ত করছেন, তাদেরকে খবর দিন যে আমি এসেছি। তারা ইচ্ছা! করলে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক এক ঘণ্টার মধ্যেই চলে এলেন। পুলিশ অফিসার বলে মনে হয় না, অধ্যাপক-অধ্যাপক চেহারা। পায়জামা-পাঞ্জাবির ওপর একটা শাল চাপানো। শাল গায়ে দিয়ে কেউ অপরাধের তদন্ত করতে আসে! ফখরুদিন সাহেব বিরক্তি চেপে রেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললেন।
কী জানতে চান আমার কাছ থেকে, বলুন?
একটা তারিখ আপনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাই। আসামি বলছে, সে আপনার নির্দেশে এই কাজ করেছে। কোন তারিখে সে আপনার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে, তাও সে বলেছে। আমরা দেখতে চাই, ঐ তারিখে আপনি দেশে ছিলেন কী না।
আমার কাছ থেকেই জানতে চান?
জি স্যার।
এটা একটা কাঁচা কাজ হচ্ছে না। কী? এয়ারপোর্টে কাগজপত্র দেখলেই তো তা জানতে পারেন। আমার মুখের কথার চেয়ে ঐ সব প্রমাণ নিশ্চয়ই অনেক মূল্যবান।
তাও স্যার করা হবে। আপনার একটা স্টেটমেন্ট নেব।
ভাল কথা, নেবেন। আপনার নাম কী?
রশিদ। আব্দুর রশিদ।
শুনুন রশিদ সাহেব, এই ধরনের কোনো কিছু আমার বলার ইচ্ছা যদি থাকে, তাহলে আমি কী তা সরাসরি বলব? অন্যদের দিয়ে বলাব। এমন একটা কাঁচা কাজ কী আমি করতে পারি?
মাঝে মাঝে খুব পাকা লোকও স্যার কাঁচা কাজ করে ফেলে।
হ্যাঁ, তা করে। কথাটা আপনি ভালই বলেছেন। ওয়েল সেইড।
পুলিশ অফিসার আধা ঘণ্টা সময় নিয়ে স্টেটমেন্ট নিলেন। তাকে চা-বিসকিট কিছু দেয়া হল না। ভদ্রলোক চলে যাবার পরপরই পি. আর. ও. আব্বাসার সাহেবকে ফখরুদিন সাহেব ডেকে পাঠালেন।
আবসার সাহেব।
জি স্যার।
পুলিশ অফিসার আব্দুর রশিদ সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। লোকটির টাকা নেয়ার অভ্যেস আছে কী না দেখুন। পুলিশ অফিসারদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ত্যাদড় ধরনের থাকে। টাকা পয়সা নেয় না। তবে আমার ধারণা, এ নেয়। এর গায়ের শালটি বেশ দামি। বেতনের টাকায় এ-রকম শাল কেনার কথা নয়।
আমি স্যার খোঁজ নেব।
আজি সন্ধ্যার মধ্যে নেবেন। ইনভেসটিগেশন টিমে আর কে-কে আছে দেখুন। ডি.আই.জি. রহমতউল্লাহ সাহেব এখন কোথায় আছেন, কোন সেকশনে, তাও দেখবেন।
জি স্যার।
আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে আমি এই সমস্যার পুরো সমাধান চাই।
জি স্যার।
আপনি এখন যান।
অফিসে আসবেন স্যার?
হ্যাঁ। তিনটার দিকে যাব।
জি আচ্ছা স্যার।
দুপুরে ফখরুদিন সাহেব একা একা ভাত খেলেন। অপালা এখনো ফেরেনি। ভাত খেতে খেতে দারোয়ানের দিয়ে যাওয়া খাতাটি খুঁটিয়ে-খুটিয়ে পড়লেন। ফাঁকে-ফাকে গোমজের সঙ্গে রান্নাবান্না নিয়ে গল্প করলেন। এটি তাঁর পুরনো অভ্যেস।
গোমেজ।
জি স্যার।
পৃথিবীর সব দেশে রান্নায় পনির ব্যবহার করে, বাংলাদেশে কেন করে না?
আমি তো স্যার বলতে পারব না।
এমন তো নয় যে এ দেশে পনির তৈরি হত না। হাজার-হাজার বছর ধরে পনির তৈরি হচ্ছে। হচ্ছে না?
জি স্যার।
আমাদের দেশী রান্নায় খানিকটা পনির দিয়ে দিলে কেমন হবে বলে তোমার ধারণা?
আমি তো স্যার বলতে পারছি না।
এক বার দিয়ে দেখবে।
জি আচ্ছা স্যার।
তিনি বিশেষ কিছু খেতে পারলেন না। কিছুদিন ধরেই তার খিদের সমস্যা দেখা দিয়েছে।
গোমেজ।
জি স্যার।
লাঞ্চের পর কাউকে তুমি মাটিনি খেতে দেখেছ?
জি স্যার, দেখেছি। মেক্সিকান এক সাহেবকে দেখেছি।
একটা মাটিনি তৈরি কর তো।
মাটিনি খেয়ে তাঁর শরীর আরো খারাপ লাগতে লাগল, তবু তিনি ঠিক তিনটায় অফিসে গেলেন। ডেকে পাঠালেন ঢাকা ব্ৰাঞ্চের এ. জি. এম. মোস্তফা সাহেবকে। অত্যন্ত ঠাণ্ডা, গলায় বললেন, মোস্তফা, আমার ধারণা যাবতীয় ঝামেলার পেছনে আপনি আছেন।
এইসব আপনি কী বলছেন স্যার!
আমি ঠিকই বলছি। ভুল বললে এত দূর আসতে পারতাম না, অনেক আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে যেতাম। আপনি আপনার চার্জ বুঝিয়ে দিন।
স্যার, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!
আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন।
ফখরুদিন সাহেব কোটের পকেট থেকে বরখাস্তের চিঠি বের করলেন। এই চিঠি তিনি ইংল্যান্ড থেকেই টাইপ করে নিয়ে এসেছেন।
চিঠি হাতে মোস্তফা দাঁড়িয়ে, তিনি তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পি.এ.-কে বললেন, বাসায় টেলিফোন করে দেখ তো আমার মেয়ে ফিরেছে কী না।
পি.এ. জানাল এখনো ফেরেনি। ফখরুদ্দিন সাহেবের কপালে সূক্ষ্ম একটা ভাজ পড়ল। সেই ভাজ স্থায়ী হল না। তিনি পি.এ.-কে বললেন, গাড়ি বের করতে বল, আমি কারখানা দেখতে যাব। ইউনিয়নের নেতাদেরও খবর দিতে বল–আমি ওদের সঙ্গে কথা বলব।
আপনার ওখানে এখন যাওয়াটা ঠিক হবে না। স্যার।
আমাকে উপদেশ দেয়া তোমার কাজের কোনো অঙ্গ নয় বলেই আমি জানি। তোমাকে যা করতে বলেছি, কর।
স্যার, এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি।
গুড। ভেরি গুড।
হাজি সাহেবের স্ত্রী ভিজিটার্স আওয়ারে ফিরোজকে দেখতে এসেছেন। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ভদ্রমহিলার গায়ে বোরকা নেই। ফিরোজ তাকে আগে দেখেনি। সে অবাক হয়ে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে চিনতে পারছি না।
ভদ্রমহিলা একগাদা ফলমূল নিয়ে এসেছেন। এর সঙ্গে আছে একটা হরলিকস, একটা ওভালটিন। তিনি বেশ সহজ ভঙ্গিতে বললেন, আমি হাজি সাহেবের স্ত্রী।
ও আচ্ছা। বসুন বসুন।
বেশিক্ষণ বসতে পারব না। হাসপাতালে ফিমেল ওয়ার্ডে আমাদের একজন রুগী আছে, তাকে দেখতে যাব। তোমাকেও চট করে দেখে গেলাম।
এইসব খাবারদাবার আমার জন্যে এনেছেন, না ওনার জন্যে?
ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন। ভদ্রমহিলার এই হাসি ফিরোজের পছন্দ হল। রসবোধ আছে। মেয়েদের এই জিনিসটা একটু কম। সাধারণ রসিকতাতেও এরা রেগে যায়।
আপনি আমাকে দেখতে আসবেন, এটা তো স্বপ্নেও ভাবিনি!
পুনু দেখতে আসব না? শুধু আমি একা না, আমার মেয়েও এসেছে।
সে-কী?
ভেতরে আসতে লজ্জা পাচ্ছে–বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। থাকুক দাঁড়িয়ে, আমি আমার রুগী দেখে আসি।
ভদ্রমহিলা চলে গেলেন। তাঁর ঠোঁটে সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা। ফিরোজ বাইরে এসে দেখল সমস্ত বারান্দা আলো করে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। এত সুন্দর হয় মানুষ!
এই মেয়ে, তুমি একা একা দাঁড়িয়ে আছ কেন? এস, ভেতরে এস।
সে সঙ্গে-সঙ্গে রওনা হল। তার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা দেয়ার জন্যে কেমন বউ-বউ লাগছে।
বোরকা কোথায় তোমার?
মেয়েটিও তার মায়ের মতো ভঙ্গিতে হাসল।
এস, বস।
বেডের সামনে একটা খালি চেয়ার। সে সেখানে বসল না। বিছানায় মাথা নিচু করে বসে রইল।
তুমি কী আমাকে দেখতে এসেছি, না। আরেকজন যে রুগী আছে, তাকে দেখতে এসেছ?
মেয়েটি বিস্মিত গলায় বলল, আর তো কোনো রুগী নেই!
ফিরোজ কী বলবে ভেবে পেল না। কিছু একটা বলতে ইচ্ছে করছে। বড় মায়া লাগছে মেয়েটির জন্য।
তুমি চা খাবে?
জি না।
খাও-না এক কাপ। তোমার সঙ্গে আমিও খাব। এখানে একটা বয় আছে, ওকে বললেই নিচ থেকে চা এনে দেয়।
বলুন!
ফিরোজ চায়ের কথা বলে এল। মেয়েটি কৌতূহলী হয়ে রুগীদের দিকে দেখছে।
হাসপাতাল নিশ্চয়ই তোমার খুব খারাপ লাগে, তাই না?
জি না। অনেক দিন আমি হাসপাতালে ছিলাম, হাসপাতাল আমার ভালই লাগে। আপনার অসুখ এখন সেরে গেছে, তাই না?
হ্যাঁ।
চা এসে গেল। মেয়েটি ছোট ছোট চুমুকে চা খাচ্ছে। বার-বার তাকাচ্ছে ফিরোজের দিকে। এখন আর সেই দৃষ্টিতে কোনো লজ্জা আর সঙ্কোচে নেই। ফিরোজ আন্তরিকভাবেই বলল, তুমি এসেছি, আমার খুব ভাল লাগছে।
মেয়েটি অত্যন্ত মৃদু স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, অপালা বলে যে-মেয়েটি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল, ওকে আপনি কীভাবে চেনেন?
হঠাৎ করে পরিচয়। ও আমাকে সুন্দর একটা চিঠি লিখেছে, তুমি কী ঐ চিঠিটা পড়বে?
জি না।
তুমি পড়, তুমি পড়লে আমার ভাল লাগবে।
ফিরোজ চিঠি বের করল। মেয়েটি তাকিয়ে আছে তার দিকে। কী সুন্দর স্বচ্ছ চোখ। শুধু চোখের দিকে তাকালেই যেন এই মেয়েটির অনেকখানিই দেখে ফেলা যায়।
বিকেল হয়ে আসছে। দিনের আলো কেমন যেন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। চেনা পৃথিবীও এই আলোতে অচেনা হয়ে যায়।
ফখরুদিন সাহেব বাগানে চেয়ার পেতে বসে আছেন। তাকে চা দেয়া হয়েছে। তিনি চা খাচ্ছেন না। তাঁর পায়ের কাছে অরুণা ও করুণা। তিনি বরুণার পিঠ মাঝে মাঝে চুলকে দিচ্ছেন। তাঁর কাছেই গোমেজ দাঁড়িয়ে। তাকে তিনিই ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এখন কিছু বলছেন না। গোমেজ যেতে পারছে না, অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
গোমেজ।
জি স্যার।
কটো বাজে বল তো?
সাড়ে চারটা বাজে স্যার।
মাত্র সাড়ে চার, কিন্তু চারদিক এমন অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? সূৰ্য কাঁটার সময় ডোবে?
ঠিক বলতে পারছি না। স্যার।
খবরের কাগজে দেখ তো ওখানে দেয়া আছি কী না। সানসেট এবং সানরাইজ যদি দেয়া না থাকে, তাহলে আবহাওয়া অফিসে টেলিফোন করবে।
জি আচ্ছা স্যার।
ঘট-ঘট শব্দ হচ্ছে কিসের?
বসার ঘরটা নতুন করে সাজানো হচ্ছে স্যার।
ওদের নিষেধ করতে বল। আমার মেয়ে পছন্দ করে সাজিয়েছে ওটা, যেমন আছে তেমন থাকুক।
জি আচ্ছা স্যার।
গোমেজ চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। মৃদু স্বরে বলল, আপাকে কী খুঁজেত বের হব?
না।
ফখরুদিন সাহেব অরুণার পিঠ চুলকে দিতে লাগলেন। বাগান এখন প্রায় অন্ধকার। তার শীত লাগছে, তবু তিনি বসেই আছেন। আকাশে একটি-দু’টি করে তারা ফুটতে শুরু করেছে। গোলাপ-ঝাড় থেকে ভেসে আসছে মিষ্টি সৌরভ।
অপালা বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা মেলানোর পর। সে ভেবেছিল, গেটের পাশে সবাই ভিড় করে থাকবে। তা নয়, গোট ফাঁকা। অন্য সময় তালা দেয়া থাকে, আজ তাও নেই। দারোয়ান টুলের ওপর বসে বসে ঝিমুচ্ছে। অপালাকে দেখে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু কিছু বলল না।
অপালা বারান্দায় উঠে এসে প্রথম লক্ষ্য করল বাগানে বেতের চেয়ারে কে যেন বসে আছে। বাগানের আলো জ্বলছে না। জায়গাটা অন্ধকার। সিগারেটের আগুন ওঠানামা করছে। অপালা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডাকল, বাবা!
ফখরুদিন সাহেব উত্তর দিলেন না। সিগারেট ছুড়ে ফেললেন। অপালা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বালিকার মতো শব্দ করে কাঁদতে শুরু করল। ফখরুদিন সাহেবের একটা হাত মেয়ের পিঠে। তিনি গাঢ় স্বরে বার-বার বলছেন, মাই চাইন্ড। মাই চাইল্ড।
অপালা ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, কখন এসেছ?
এই তো সকালে। তুমি সারা দিন কোথায় ছিলে?
নানান জায়গায় ছিলাম। তুমি কেমন আছ বাবা?
ভাল। আমি খুব ভাল আছি।
ঠাণ্ডার মধ্যে এখানে বসে আছ কেন?
তোমার জন্যে বসে আছি।
মা আসেনি, তাই না?
কী করে বুঝলে?
মা এলে সেও তোমার সঙ্গে বসে থাকত। তুমি এসেছি, বাবা, আমার খুব ভালো লাগছে।
অপালা আবার ফোঁপাতে শুরু করল।
মা এল না কেন?
ডাক্তাররা এখন বলছে, বাই পাস সার্জারি লাগবে।
একেক সময় এরা একেক কথা বলে কেন?
কি জানি, কেন!
বাবা এস, তোমাকে আমাদের বসার ঘরটা দেখাই, কী সুন্দর যে করেছে।
ফখরুদিন সাহেব এই ঘর আগেই দেখেছেন, তবু মেয়ের সঙ্গে ঢুকলেন।
কেমন লাগছে বাবা?
ভাল।
শুধু ভাল? এর বেশি কিছু না?
না মা, এর বেশি কিছু না। তবে তোমার ভাল লাগছে, এটাই বড় কথা। আমার পুরনো চোখ। পুরনো চোখ সহজে মুগ্ধ হয় না।
বাবা, তুমি চা খেয়েছ?
হ্যাঁ। তবে আরেক বার খেতে পারি।
তুমি বাগানে গিয়ে বস, আমি তোমার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।
তোমার বানাতে হবে না, তুমি আমার সঙ্গে এসে বস।
না, আমিই বানাব। আর শোন, একটা চাদর গায়ে দিয়ে যাও। নাও, আমারটা নাও।
অপালা তার গায়ের নীল চাদর তার বাবার গায়ে জড়িয়ে দিল।
তুমি রাতে কী খাবে, বাবা?
কোন?
আমি রান্না করব।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
ফখরুদ্দিন সাহেব। আবার বাগানে গিয়ে বসলেন। অরুণা এবং বরুণা দু’জন দুপাশ থেকে এসে দাঁড়িয়ে আছে। গভীর আনন্দে ফখরুদিন সাহেবের চোখ ভিজে উঠছে। চোখের জল মানেই দুর্বলতা। তার মধ্যে কোনোরকম দুর্বলতা থাকা উচিত নয়। এই অশ্রুবিন্দু এক্ষুণি মুছে ফেলা উচিত। কিন্তু তিনি মুছলেন না। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। এই অন্ধকারে তাঁর দুর্বলতা কেউ দেখে ফেলবে না।
অপালা আসছে চা নিয়ে। বারান্দার আলো তার মুখে পড়েছে। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে।