১৫. জীবন ডাক্তার ওই তিনজনের চেহারা দেখে

জীবন ডাক্তার ওই তিনজনের চেহারা দেখে একেবারে হইহই করে উঠলেন।

নিশানাথ বললেন, খিচুড়ি চাপাও তাড়াতাড়ি। খুব খিদে পেয়েছে।

নিজে বারান্দায় বসে পড়ে তিনি সুব্রত ও নাসিরুদ্দিনকেও বললেন, বোসো!

জীবন ডাক্তার বললেন, বসবে কী? শিগগির জামাকাপড় ছেড়ে নাও। তোমাকেও বলিহারি নিশি, এই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে কেউ নদী পার হয়? কতক্ষণ ধরে গায়ে জল বসেছে। চেহারা হয়েছে সব ঝড়ে-পড়া গাছের মতন। কোনো বিপদ-আপদ হয়নি তো?

নাসিরুদ্দিন ও নিশানাথ দু-জনেই একবার আড়চোখে তাকালেন সুব্রতর দিকে। নিশানাথ বললেন, না, সেরকম কিছু হয়নি।

তোমার জামায় রক্ত কেন? থুতনির কাছে কেটেছে।

ও কিছু নয়, আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।

জীবন ডাক্তারের বোনও বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। ডাক্তার তাকে বললেন, গোটা তিনেক ধুতি বার করে দে তো উমা।

তিনখানা ধুতি কাচা নেই বাড়িতে। দু-খানা জোগাড় হল। উমা আর একটা সরু কালো পাড়ের শাড়ি নিয়ে এসে নিশানাথকে বলল, আপনি এটা পরুন। ওরা দু-জনে ধুতি পরুক।

নাসিরুদ্দিন আড়ষ্ট হয়ে গেছে। সে আপত্তি করে বলল, তার ধুতির দরকার নেই, ভিজে লুঙি পরে থাকা তার অভ্যেস আছে। কিন্তু তার আপত্তি কেউ গ্রাহ্য করল না। বাথরুমে গিয়ে সবাইকে শুকনো কাপড় পরে আসত হল।

জীবন ডাক্তারের বাড়িখানা প্রায় মাঠের মধ্যে। বাড়িখানার কোনো শ্রীছাঁদ নেই, নিছক ইট সিমেন্টে গাঁথা কয়েকটি দেওয়াল ও ছাদ। লম্বা টানা বারান্দা, একটি হলঘর, দু-টি শোওয়ার ঘর, একটু দূরে বাথরুম, রান্নাঘর। উঠোনের মধ্যে বাঁশ ও টালি দিয়ে আরও কয়েকখানা ঘর বানানো হয়েছে এলোমেলোভাবে। জীবন ডাক্তার তাঁর স্ত্রী, বোন উমা আরও ছ-সাতজন মানুষ থাকে এখানে। স্থানীয় লোক এই বাড়িটার নাম দিয়েছে জীবন ডাক্তারের হাসপাতাল।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে নিশানাথ নাসিরুদ্দিনকে দেখিয়ে বললেন, ওকে একটু পরীক্ষা করে দেখো তো ডাক্তার এর ফিটের ব্যারাম আছে কি না।

জীবন ডাক্তার হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, কেন, কী হয়েছে?

ও হল নৌকোর মাঝি, অথচ আমাদের দিয়েই নৌকো বাইয়েছে। বুঝে দেখো ব্যাপার!

নাসিরুদ্দিন চুপ করে রইল।

জীবন ডাক্তার তার দু-চোখের তলার দিকটা একটু টেনে ধরে বললেন, ফিটের ব্যারাম আছে কি না জানি না। কিন্তু এর তো সাংঘাতিক অ্যানিমিয়া। শরীরে কিছুই নেই। বয়েস কত হল?

তিন কুড়ি আট।

নিশানাথ চমকে উঠে বললেন, আটষট্টি? আমি ভেবেছিলাম, ছাপ্পান্ন-সাতান্ন হবে।

জীবন ডাক্তার বললেন, এই বয়েসেও নৌকো চালিয়ে যাচ্ছ। শেখের পো, এবার মাঝিগিরি থেকে ছুটি নাও। বিশ্রাম নাও এবার।

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকের মতন নিরাসক্ত গলায় নাসিরুদ্দিন উত্তর দিল, পেটের ভাত জোগাবে কে?

একটু থমকে গেল বাকি দু-জন। জীবন ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কেন, ছেলেপুলে নেই?

নাসিরুদ্দিন মাথা নাড়ল দু-দিকে।

জীবন ডাক্তার বললেন, এর দেখছি আমারই মতন অবস্থা।

ওর আবার বউও নেই। আছে শুধু একটা নৌকো।

একটু চিকিৎসা না করলে, খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতন না করলে ও নৌকোর ওপরেই একদিন মুখ থুবড়ে মরবে। শোনো মিয়া, আমার এখানেই কিছুদিন থাকো।

নিশানাথ বললেন, তোমার এখানে আশ্রিতের সংখ্যা আরও বাড়বে। আমার ছোটো ছেলেটাকে নিয়ে এসেছি, এবার দেখে যাক, তারপর আমার ইচ্ছে ওকে এখানে কিছুদিনের জন্য রাখব।

জীবন ডাক্তার সুব্রতর দিকে তাকালেন। বারান্দায় উমার পেতে দেওয়া মাদুরে সুব্রত গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। এতক্ষণের ক্লান্তি আর মানসিক চাপ সে আর সহ্য করতে পারছে না। একটু দূর থেকে তার ঘুমন্ত মুখখানা অসহায়ের মতন দেখায়।

জীবন ডাক্তার বললেন, ও তো একেবারেই ছেলেমানুষ। ও এখানে কী করবে?

থাকুক। কিছুদিন খাটুক-পিটুক; জীবনটাকে দেখুক। অভিজ্ঞতা বলতে তো কিছুই হল না। এবার পরীক্ষাও দিতে পারেনি।

তোমার বড়োছেলের খোঁজখবর পেয়েছ?

হ্যাঁ, সে শিলং-এ কাজ করে।

রান্নাঘরে জীবন ডাক্তারের স্ত্রী সাবিত্রী ততক্ষণে খিচুড়ি চাপিয়ে দিয়েছেন। নিশানাথ হেঁটে এসে রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়ালেন। উমা তাকে দেখে বললেন, কী, খুব খিদে পেয়েছে বুঝি?

নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বউদি, বেশি করে বানাবেন কিন্তু—

সাবিত্রী বললেন, আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই হয়ে যাবে। উমা একটা সিঁড়ি পেতে দে না! বসুন, এখানেই বসুন।

না, থাক, আপনাকে একটু দেখতে এলাম। শরীর ভালো আছে?

হ্যাঁ।

উমা বলল, নিশিদা, আপনাকে শাড়ি পরে বেশ দেখাচ্ছে কিন্তু আপনার রং তো ফর্সা, আপনার নিশি নাম কে রেখেছিল?

নিশানাথ হেসে বললেন, অনেকেই এই ভুল করে। নিশানাথ কথাটার মানে হচ্ছে চাঁদ। অবশ্য আমার সঙ্গে মানায় না।

আপনার নাম মহাদেব রাখা উচিত ছিল!

উমার বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি, লম্বা ধাঁচের শরীর, এখনও খানিকটা বালিকার মতো চাঞ্চল্য আছে। বছর দশেক আগে নিঃসন্তান অবস্থায় বিধবা হয়েছে, সেই থেকে জীবন ডাক্তারের আশ্রয়ে। উমা দারুণ খাটতে পারে। রাত্তির বেলা এবাড়ির শেষ আলোটি সে-ই নেভায়, আবার জেগে ওঠে খুব ভোরে। তার অতিরিক্ত প্রাণশক্তি সবসময় একটা কিছু অবলম্বন খোঁজে।

জানো বউদি, আজ নিশিদা আর ওনার ছেলে জলে পড়ে গিয়েছিলেন।

সাবিত্রী শিউরে উঠে বললেন, ওমা, সে কী? এই ভরাগঙ্গায়? তারপর কী হল?

নিশানাথ একটু হেসে বললেন, এত ভয়ের কী আছে? আমি একসময় ভরাপদ্মাতেও সাঁতার কাটতাম।

সাবিত্রী বললেন, সেসব দিনের কথা আর এখনকার কথা কি এক? সাবিত্রীর জীবনে সময় অনেক বদলে গেছে সত্যিই। মাত্র বারো-তেরো বছর আগেও তিনি এলাহাবাদের একটি বড়ো বাড়ির অতি সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমে বসে অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন। বাবুর্চি-বেয়ারারা চা জলখাবার এনে দিত ট্রে সাজিয়ে। মাঝদুপুরে পারতেন না। অথচ এখনও স্বচ্ছন্দে করে যাচ্ছেন। মানুষের জীবন সব কিছুই মানিয়ে নিতে পারে।

বেশ কয়েক ঘণ্টা ঝড়-বৃষ্টির পর এখন হালকা করে রোদ উঠেছে। আকাশে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা চিল। তারা এখন ক্রমশ উঁচু থেকে আরও অনেক উঁচুতে উঠে যাবে। এইমাত্র তাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল একটা চকচকে রুপোলি বিমান।

উমা বলল, পরশুদিন নাজির শেখের গোরুর গাড়ির চাকা কাদায় আটকে গেল, কিছুতেই আর টানাটানি করে তোলা যায় না। আমি ভাবলাম, নিশিদা থাকলে, ঠিক একাই তুলে দিত।

নিশানাথ বললেন, ওইসব সময়ে বুঝি আমার কথা মনে পড়ে?

উমা হাসতে হাসতে বলল, না, আপনার কথা সবসময়েই মনে পড়ে।

সাবিত্রী বললেন, আপনাকে কত কষ্ট করে এতদূরে আসতে হয়।

আমিও তাই তো ভাবি, যদি এখানেই থেকে যেতে পারতাম।

উমা বলল, এ কী নিশিদা, আপনার থুতনি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে যে!

নিশানাথ তাড়াতাড়ি সেখানে হাত চাপা দিয়ে বললেন, কই? না তো! একটু আগে ধুয়ে ফেললাম যে!

দেখি, দেখি, হাতটা সরান তো! ইস, এ যে গর্ত হয়ে গেছে! কী করে লাগল?

উমা দৌড়ে চলে গেল বাইরে। তক্ষুনি নিয়ে এল ডেটল, তুলো, স্টিকিং প্লাস্টার। হুকুমের সুরে বলল, মুখটা তুলুন!

নিশানাথ থুতনি উঁচু করে বাধ্যছেলের মতন চুপ করে বসে রইলেন। উমা সামনে হাঁটু গেড়ে নিপুণহাতে একটা ছোট্ট ব্যাণ্ডেজ করে দিল। তারপর মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলল, আপনি কি বাচ্চাদের মতন এখনও হুটোপুটি করতে যান নাকি? নিজের কথা একদম ভাবেন না কেন? অন্তত আমাদের কথা ভেবেও তো নিজের একটু যত্ন নিতে পারেন!

নিশানাথ মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন।

খিচুড়ি রান্না হয়ে গেছে। পাত পেতে দেওয়া হল বারান্দায়। নাসিরুদ্দিন দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে ঝিম মেরেছিল, তাকে বসানো হল, ডেকে তোেলা হল সুব্রতকে।

গরম গরম খিচুড়ি, একটু ঘি আর ডিম ভাজা। তাও সুব্রতর মুখে রুচি নেই। হাত উঠতে চাইছে না। অসম্ভব ক্লান্ত, ইচ্ছে করছে খাবারের থালার পাশেই আবার শুয়ে পড়তে।

উমা এসে বলল, এ কী খোকন, খাচ্ছ না যে। খাও, আর একটু খিচুড়ি দিই?

সুব্রতর নিষেধ সত্ত্বেও উমা আর এক হাতা গরম খিচুড়ি ঢেলে দিল তার পাতে। সুব্রত বিরক্ত হয়ে উঠল। এসব বাড়াবাড়ি তার ভালো লাগে না।

নাসিরুদ্দিন খাচ্ছে ফেলে ছড়িয়ে। মনে হয়, খিদে থাকলেও খিচুড়ি জিনিসটা তার পছন্দ নয় ঠিক। আর একটি ডিমভাজা নিতে সে আপত্তি করল না।

নিশানাথ বললেন, বউদি, আপনার রান্না খুব স্বাদের হয়েছে।

উমা বলল, ওকী নিশিদা, আপনি কতগুলো কাঁচালঙ্কা খাচ্ছেন?

নিশানাথ মুচকি হেসে বলল, আরও কয়েকটা লাগবে বোধ হয়?

দাঁড়ান, এনে দিচ্ছি বাগান থেকে। দেখি আপনি কত ঝাল খেতে পারেন!

বাজি ফেলবে নাকি?

থাক বাবা! বাজি ফেলে দরকার নেই। আপনি সব পারেন। আর একটু খিচুড়ি দিই?

কী দিয়ে খিচুড়ি খাব? লঙ্কা ফুরিয়ে গেল যে!

সুব্রত অবাক হয়ে বাবার দিকে চেয়ে রইল। তার বাবাকে এ-রকম হালকাভাবে কথা বলতে সে কখনো শোনেনি। বাড়িতে কোনো রান্নার ভালো মন্দ সম্পর্কে বাবা মন্তব্য করেন না। এখানে সে বাবাকে অন্যরকম দেখছে।

হঠাৎ তার মনে পড়ল, বাবা ইচ্ছে করে নদীর মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। যদি সে ডুবে যেত। ভাবতেই শরীরটা ঝিমঝিম করে ওঠে। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার কী অসহ্য কষ্ট। রাগে তার শরীর জ্বালা করে, ইচ্ছে করে এক্ষুনি একটা কিছু প্রতিশোধ নেওয়ার।

খাওয়া শেষ হওয়ার পর হাত ধুয়ে এসে নাসিরুদ্দিন বলল, বাবু, এইবার তাহলে আমি যাই।

নিশানাথ এক ধমক দিয়ে বললেন, কোথায় যাবে তুমি? এখানেই শুয়ে থাকো!

ঘরে যেতি হবে না?

কে আছে তোমার ঘরে। কেউ তো নেই বললে! এত তাড়া কীসের?

নৌকোডা একলা একলা রয়েছে।

নৌকো কি কাঁদবে নাকি তোমার জন্য? নৌকো চুরি যাবে না, সেটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তুমি এখানে থাকবে। তোমার চিকিৎসা করা হবে। এই ডাক্তারবাবু সুঁই দিয়ে দিয়ে তোমার শরীরে গর্ত করে দেবে। তাহলে বাঁচবে তুমি, বুঝলে?

নাসিরুদ্দিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। জীবন ডাক্তার বলল, বুড়ো মাঝি, আর ক-টা দিন বাঁচতে চাও, না চাও না? তাহলে একটু ওষুধপত্তর খেতে হবে।

শুধু ওষুধ খেলি তো চলবে না। প্যাডে খাব কি?

এখানে থাকো। আমরা যা খাই, তাই খাবে।

আমাকে একবার ঘরে যেতি হবে।

নিশানাথ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, জীবন ডাক্তার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, জোর করে কারুর চিকিৎসা করা যায় না। তাতে ফল হয় না তেমন।

জীবন ডাক্তার ঘর থেকে এক পাতা ওষুধ এনে বললেন, যাও মাঝি, ঘুরে এসো। পারলে আবার এসো। এরমধ্যে যে বড়ি আছে, রোজ এবেলা-ওবেলা একটা করে খাবে। যদি শরীরটা একটু ভালো লাগে তাহলে আবার এসো। কোনো ভয় নেই, যখন ইচ্ছে হয় তখনই আসবে। না, না, ধুতি ছাড়তে হবে না। ওটা তুমি নিয়ে যাও।

নাসিরুদ্দিন আর বাক্যব্যয় করল না। ওষুধের পাতাটা ট্যাঁকে খুঁজে ভিজে জামা কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে রওনা দিল।

উমা সুব্রতকে যত্ন করে ঘরের মধ্যে বিছানা পেতে শুইয়ে দিয়েছে। জীবন ডাক্তার নিশানাথকে বললেন, তুমিও একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও?

নিশানাথ বললেন, আমার বিশ্রাম হয়ে গেছে। চলো, বেগুন খেতটা দেখে আসি। ফুল এসেছে?

দু-জনে বাড়ির পেছন দিকে চললেন। দূরে বুড়ো নাসিরুদ্দিনকে তখনও দেখা যায়। মাঠের মধ্য দিয়ে এবড়োখেবড়োভাবে হাঁটছে। সেদিকে তাকিয়ে নিশানাথ জিজ্ঞেস করলেন, কী মনে হয়, লোকটা আর ফিরবে।

জীবন ডাক্তার বললেন, বলা শক্ত। গ্রামের লোক এখনও ডাক্তারি ওষুধকে তেমনভাবে মেনে নিতে পারেনি। ভয় পায়। তা ছাড়া ওরা কলেরা, বসন্তের মতন দু-চারটে লোগ শুধু চেনে। হার্ট, লাঙস কিংবা ব্লাড প্রেশারের রোগের কথা টের পেতে পেতেই কাবার হয়ে যায়। এক-এক সময় আমার মনে হয়, ডাক্তারি না করে আমি যদি সাধু বা ফকির-এর ভেক নিতাম, তাহলে ঝাড়ফুক মন্ত্রতন্ত্রর ভেলকির নাম করে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ গেলালে আরও অনেক বেশি লোককে বাঁচাতে পারতাম।

তাতে অভিনয়ের প্রয়োজন হয়।

সেইটাই তো কথা!

ওই মাঝিটার মতন যদি আমার অবস্থা হত, সংসারে যদি আর কেউ না থাকত, তাহলে কি আমি ফিরে যেতাম?

মাঝিদের মুশকিল এই, ওরা জল ছেড়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। প্রত্যেক মানুষেরই একটা আলাদা আলাদা জায়গা আছে। সেখানেই সে বেশি স্বাধীন।

লোকটাকে আমার হিংসে হয়। এ-রকম খোলা আকাশের নীচে যদি জীবনটা কাটাতে পারতাম।

কি নিশি, বৈরাগ্য এসেছে নাকি? তোমার ছেলে-মেয়ে আছে, সংসার আছে, তার সুখ কি কম?

সুখ?

আমি কিন্তু ওইরকম সুখই চেয়েছিলাম।

 জীবন, তোমার কি এখনও আপশোস আছে?

জীবন ডাক্তার একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বললেন, না, আপশোস নেই। তবে বুঝতে পারছি আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

নিশানাথ তাঁর বন্ধুর হাত চেপে ধরলেন। জীবন ডাক্তার ক্লান্তভাবে হেসে বললেন, সত্যিই। আমি টের পেয়ে গেছি।

এলাহাবাদে ডাক্তার হিসেবে যথেষ্ট পসার ছিল জীবন ডাক্তারের। তা ছাড়া শ্বশুরের সম্পত্তি পেয়েছিলেন। লোকের হিংসা জন্মাবার মতন যথেষ্ট সচ্ছলতা ছিল। কিন্তু পর পর চারটি সন্তান হয়েও বাঁচল না। জীবন ডাক্তার এত বড়ো পরাজয়ে খেপে উঠেছিলেন, কোনোরকম পরীক্ষা করাতে বাকি রাখেননি। তৃতীয়বার গর্ভবতী সাবিত্রীকে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন ইংল্যাণ্ডে। সেখানেও বাঁচানো যায়নি সদ্যোজাত সন্তানকে। সেখানকার ডাক্তাররা বলেছিল সাবিত্রীর শরীরে কোনো খুঁত নেই।

দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন জীবনময়। স্ত্রী বন্ধ্যা হলে তাকে ত্যাগ করে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করার রেওয়াজ ছিল একসময়। কিন্তু নির্বীজ স্বামীকে মেয়েরা ত্যাগ করে না। তবু জীবনময় সাবিত্রীকে বলেছিলেন, আমার জন্য তুমি সন্তানহীনা থাকবে কেন? তোমার এখনও যৌবন আছে, তুমি আবার বিয়ে করতে পার! সাবিত্রী হেসে উঠে বলেছিলেন, কী পাগলের মতো কথা বল! নিজের ছেলে-মেয়ে নাই-বা থাকল, পরের ছেলে-মেয়েদের মানুষ করব!

তবু জীবনময় বুঝতে পারতেন। সাবিত্রী ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে। সন্তান না হওয়া আর চার-চারটি সন্তান হয়ে মারা যাওয়ার মধ্যে অনেক তফাত!

দ্বিতীয় পরাজয়টা এল অন্যভাবে। মাত্র চুয়াল্লিশ বছরে তাঁর হার্ট অ্যাটাক হল। এত লোকের চিকিৎসা করেছেন তিনি, অথচ নিজের শরীরের রোগটার সম্পর্কেই কিছু বুঝতে পারেননি। বহুবার তিনি বহুরুগির বাড়িতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন, মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তাই মৃত্যু একটা ছোট্ট প্রতিশোধ নিয়ে গেল।

প্রথম অ্যাটাকই বেশ গুরুতর হয়েছিল। মাস তিনেক নার্সিংহোমে থাকবার পর যখন ফিরে এলেন, তখন তিনি অন্য মানুষ। রোগা, দুর্বল, ভীত। দেখে চেনাই যেত না, এই লোকটাই একসময় কত তেজস্বী ও অহংকারী ছিল। এরপর আর তাঁর কিছু করবার ছিল না। বাকি জীবন শুধু আর দু-টি স্ট্রোকের প্রতীক্ষায় বসে থাকা। সেদ্ধ খাবার খেয়ে আর পরিশ্রম বাঁচিয়ে সেই প্রতীক্ষাটা যতখানি দীর্ঘ করা যায়।

সেইভাবেই হয়তো জীবনটা কাটত। কিন্তু জীবনময় হঠাৎ একসময় একটা অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিলেন। একবার গঙ্গাসাগর মেলায় বেড়াতে এসে এই এলাকাটা তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। তিনি ঠিক করলেন, এখানেই খানিকটা জমি কিনে বাকিজীবনটা কাটাবেন। এলাহাবাদে তাঁর জীবন শেষ হয়ে গেছে। প্র্যাকটিস প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন—তাঁর চোখের সামনেই জুনিয়র ডাক্তারদের পসার বেড়ে যাওয়ায় একটু হিংসার জ্বালা বোধ করতেন। অসহায় হিংসা। একদিন মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন সব। জীবনে যখন আর কিছুই পাওয়ার নেই, তখন যেটুকু দেওয়া যায়।

এলাহাবাদের বাড়িঘর সব বিক্রি করে জীবনময় চলে এলেন এখানে এই গঙ্গার ধারে। সাবিত্রী একটুও আপত্তি করেননি। প্রথমে ওঁরা ভেবেছিলেন, এখানে একটা ছোট্ট বাড়ি করে নিরিবিলিতে বাকি ক-টা বছর কাটিয়ে দেবেন। জীবনময় তাঁর মৃত্যুর পর সাবিত্রীর জন্য আলাদা ব্যবস্থা করে রেখে দিলেন। কিন্তু তাঁর শরীর ধীরে ধীরে বেশ সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। তিনি বুঝতে পারছিলেন এটা প্রলোভন। কিন্তু মাসের পর মাস মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করাও এক অসহ্য ব্যাপার। মৃত্যু যেন আবার তাঁকে ভুলে গেছে।

একসময় জীবনময় আবার স্বাস্থ্যের নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করতে লাগলেন। দেখাই যাক-না কী হয়! আবার তিনি রোগী দেখা শুরু করলেন, নিজে ঘুরে ঘুরে গ্রামে গ্রামে গিয়ে রোগী খুঁজে বেড়াতেন। তাঁর নিজের আয়ু যখন সংক্ষিপ্ত, তখন অন্যদের আয়ু বাড়াবার জন্য জেদ ধরলেন। এটাও যেন মৃত্যুর প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ। এখন আসুক সে, জীবনময় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলবেন, তুমি আমাকে নিয়ে যেতে পার। কিন্তু আমিও অন্তত এক হাজার মানুষকে তোমার মুখের গ্রাস থেকে বাঁচিয়েছি!

দেখতে দেখতে সাত বছর কেটে গেল। জীবনময় এখন রোদুরে ঘোরেন, বৃষ্টিতে ভেজেন, রাত্তির বেলা কোনো রুগির খারাপ খবর শুনলে ছুটে যান। মৃত্যুকে তিনি একেবারে অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন।

এদিকে স্থায়ী হয়ে বসবার পর তিনি কলকাতায় তার কলেজজীবনের পুরোনো বন্ধুদের মধ্যে দেবেন আর নিশানাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। দেবেন এসেছিলেন দু-একবার। কিছু সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। প্রথমবার যখন ডাকাতি হল, রাত্তির বেলা একদল লোক এসে জীবনময়ের বাড়ি থেকে বেশ কিছু জিনিস নিয়ে গেল, সেবার দেবেন কিছু অর্থ সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটা ছোটোখাটো হাসপাতাল তৈরি করে দিতে। জীবনময় রাজি হননি। তার বদলে তিনি গ্রামের লোকদের দিয়ে মাটি কাটিয়ে, ইটখোলা করে সেই ইটে হলঘরটা বানিয়েছেন। দেবেন আর আসে না।

নিশানাথ প্রথম একবার আসার পর থেকে প্রায় প্রতিসপ্তাহে আসেন নিয়মিত। এখন পাশাপাশি দু-একখানা গাঁয়ের অনেক লোকই তাঁকে চেনে। বদমেজাজি বলে সমীহও করে।

জীবনময়কে এখানে কাজ করতে দেখে নিশানাথ প্রথম প্রথম খানিকটা অপরাধ বোধ করতেন। জীবনময়ের আয়ু ফুরিয়ে এসেছে তবু তিনি অপরের উপকারের জন্য পাগলের মতন খাটছেন। আর নিশানাথ কী করছেন, কিছুই না! শুধু চাকরি আর সংসার! সারাজীবন তিনি একটা সততার আদর্শ আঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোনো রূপ দিতে পারেননি।

জীবনময়ের কোনো সন্তান নেই, সেইজন্য দুঃখ। কিন্তু তাঁর তত তিনটি ছেলে-মেয়ে— তাতেই বা কী লাভ হল? কেউ তো তাঁর মনের মতন হয়ে উঠল না!

কিছুদিন এখানে এসে বন্ধুকে সাহায্য করার পর নিশানাথ অনুভব করলেন, এখানেই তাঁর মনের আপন মুক্তি। এই খোলা আকাশ, গ্রামের সরল মানুষ তাদের মুখে একটু হাসি ফোটানো—এতে যে আনন্দ, তা তো আগে কখনো পাননি।

নিশানাথ বললেন, তুই কাল আমার সঙ্গে কলকাতায় চল। বছর খানেকের মধ্যে তোর ই সি জি করানো হয়নি।

জীবনময় বললেন, আমি সেজন্য ভাবছি না। আমি ছোট্ট একটা জিনিস করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দেখতে দেখতে সেটা এত বড়ো হয়ে গেল! এখন অনেক লোক আমার ওপর নির্ভর করে। এখন যদি আমি হঠাৎ চলে যাই—এসবই কি তাসের ঘরের মতন ভেঙে যাবে?

অন্য কেউ এসে ভার নেবে।

কে ভার নেবে?

আমার তো সে সাধ্য নেই, আমি তোর মতন ডাক্তারিও জানি না, মানুষকে কী করে সেবা করতে হয়, তাও জানি না। আমার ইচ্ছে করে, যেখানে যত কিছু অন্যায়, সব ভেঙে দিতে। কিন্তু এখন বুঝেছি, সে শক্তিও আমার নেই। আমি না পারলাম ঠিকমতন সংসার করতে না পারলাম বাইরের মানুষের জন্য কিছু করতে।

তুই অনেক কিছু করেছিস!

আমার ছেলেটাকে এইজন্যই এনেছি, তুই একটু গড়েপিঠে মানুষ করে নে। ভেবেছিলাম বি এসসি-টা যদি ভালোভাবে পাশ করে, তা হলে ওকে ডাক্তারি পড়াব। ধার দেনা করেও পড়াতুম। কিন্তু পড়াশুনোয় ওর মন নেই। জেদ ধরে কোনো কিছু করার সাহসও নেই। তোর এখানে থাকলে হাতে-কলমে কাজ শিখবে, পৃথিবীটাকে চিনবে। আমার ছেলেটাকে তুই নিয়ে নে!

ওর এখানে মন টিকবে কেন? ও তো তোর মতন গ্রাম থেকে আসেনি, শহরেই মানুষ।

কিছুদিন থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

তোর স্ত্রী রাজি হবেন কেন? মণীশের খবর কী?

কী জানি, তার খবর আমি রাখি না।

ওই ছেলেটার মধ্যে তেজ ছিল!

সেই তেজে লাভ কী, যার মধ্যে সততা নেই? আজকাল যারা নষ্ট, যারা ঠগ, তারাই বেশি চেঁচিয়ে কথা বলে।

জীবনময় হঠাৎ যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন। একটু দূরের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকের বাতাসটা কী সুন্দর! কীসের যেন একটা মিষ্টি গন্ধ আছে। খুব ছেলেবেলায় একবার নদীর ধারে এসে–

কথা শেষ না-করে থেমে গেলেন তিনি। যেন এই সুন্দর পৃথিবী, সুঘ্রাণ বাতাস, মাঠের মধ্যে সাদা রঙের বাড়ি—এইসব কিছু ছেড়ে অকস্মাৎ একদিন চলে যেতে হবে, এইকথা তাঁর মনে পড়ল।

নিশানাথ বন্ধুর এই ভাবান্তর লক্ষ করলেন না। তিনি বললেন, বাঃ বেশ ভালো ফুল এসেছে তো। গত সপ্তাহেও দেখিনি।

অনেকখানি জায়গা জুড়ে বেগুন খেত। এদিককার মাটিতে নোনা জলের জন্য ফলন ভালো হয় না। নিশানাথই উদ্যোগ করে দূর থেকে এক লরি মাটি এনে ফেলেছিলেন। কুয়োতে পাম্প বসিয়ে জল আনা হয়েছে। তবু ভয় ছিল। এমন নধর বেগুন চারায় সাদা সাদা ফুল দেখে তাঁর চোখ জুড়িয়ে গেল। যেন একটা সৃষ্টি। কোনো কোনো গাছ বৃষ্টিতে একটু হেলে আছে, কিছু আগাছাও পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার। নিশানাথ খেতের মধ্যে নেমে পড়লেন।

জীবনময় বললেন, নিশি, এখন থাক-না।

নিশানাথ বললেন, আবার বৃষ্টি আসবার আগে মাটিটা ঠিক করে দিই।

কাদামাখা জমিতে উবু হয়ে বসে আগাছা নিড়াতে লাগলেন নিশানাথ। জীবনময় দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। খেতের চারধারে কলা গাছ পোঁতা হয়েছে। সেগুলো এখন এক-মানুষ উঁচু। নবীন কলা গাছ থেকে যেন একটা হলুদ-সবুজ আভা বিচ্ছুরিত হয়। দুটো ঝুঁটিওয়ালা বুলবুলি ওড়াউড়ি করছে একটা বাবলা গাছের মাথায়। বড়ো মায়াময় দৃশ্য। জীবনময়ের চোখে জল এসে যায়।

দু-কাপ চা খুব সাবধানে ধরে নিয়ে এল উমা। জীবনময়কে এক কাপ চা দিয়ে চাপা গলায় বলল, একটা ছেলেকে নিয়ে এসেছে, পেটে খুব ব্যথা বললে—

ঘোর ভেঙে জীবনময় বললেন, কত বয়েস?

আঠারো-উনিশ হবে। এমন কাতরাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল অ্যাপেনডিক্স ফেটে গেছে।

চল যাচ্ছি।

—ব্যস্ত হয়ো না। চা-টা খেয়ে নাও। আমি একটা পেথিডিন ইঞ্জেকশন দিয়ে দিয়েছি।

জীবনময় আরও চমকে উঠে বললেন, পালসটা দেখেছিলি তো?

এক চুমুকে চা-টা শেষ করে জীবনময় খালি কাপটা নিয়ে হনহন করে চলে গেলেন।

উমা ডাকল, নিশিদা, নিশিদা, আপনার চা!

খেতের মধ্য থেকে নিশানাথ উত্তর দিলেন একটু পরে।

ঠাণ্ডা হয়ে যাবে যে।

তুমি খেয়ে নাও। আমি অত চায়ের ভক্ত নই।

না, না, আসুন। আমি চা খেয়েছি।

জল-কাদা মেখে নিশানাথ এগিয়ে এলেন। উমা ভর্ৎসনা করে বলল, খেয়ে উঠেই আবার এইসব করতে গেছেন?

জীবন কোথায় গেল?

একটা রুগি এসেছে, দাদা একটু দেখে আসতে গেছে।

নিশানাথ চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিয়ে বললেন, মিষ্টি কম হয়েছে।

আপনার আর কিছুতেই মিষ্টি ঠিক হয় না। চিনি নিয়ে আসব? আনতে আনতেই তো চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

থাক। আজ সন্ধ্যে বেলা গ্রামে যাত্রা-গান আছে না?

আছে বোধ হয়।

যাবে নাকি?

অনেকবার দেখেছি। আর ভালো লাগে না।

আমার বেশ লাগে। সিনেমা-থিয়েটারে আমি কোনো রস পাই না।

আপনি যাত্রায় নামলে পারতেন। আপনাকে বেশ মানাতো। ভীমের পার্টে যা চমৎকার দেখাতো আপনাকে!

নিশানাথ উমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উমা প্রায়ই তাঁর সঙ্গে ঠাট্টার সুরে কথা বলে। গোধূলির আকাশের দিকে ফিরে সে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসে উড়ছে চুল। তার চোখে বৈধব্যের কোনো ক্লান্তি নেই। ঠোঁটে অল্প হাসির রেখা।

নিশানাথ চোখ নামিয়ে নিলেন। আস্তে আস্তে বললেন, তা মন্দ বলনি। সুযোগ পেলে না হয় যাত্রার দলেই ভিড়ে যেতাম।

কেন এ-জীবনটা বুঝি আর পছন্দ হচ্ছে না?

কিছুই তো হল না। সব জায়গায় হেরে গেলাম।

আত্মগ্লানি ভালো নয়। আপনিই তো বলেছেন, আত্মগ্লানিতে মানুষের কাজের শক্তি কমে যায়।

তা ঠিকই। মানুষের জীবনে কতরকমের স্বপ্ন থাকে, একটা জীবনে সব কুলিয়ে ওঠা যায় না।

উমার মুখটা একটু ম্লান হয়ে গেল। যেন তারও মনে পড়ল এ-রকম কোনো স্বপ্নের কথা। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, তাও তো আপনি অনেক কিছু করেছেন। মানুষের তো একটু বিশ্রামেরও দরকার।

এখানে এলেই তো আমার বিশ্রাম হয়।

এর নাম বিশ্রাম? দৈত্যের মতন তো খাটেন দেখি। আগের রবিবার সারাদিন ধরে কী কান্ডটাই করলেন। কুয়ো কাটা কি চাট্টিখানি কথা!

আমি তো ওইটুকুই করতে পারি। বিদ্যা-বুদ্ধি তো তেমন নেই। টাকাপয়সারও জোর নেই। গায়ে খেটে যেটুকু সাহায্য করতে পারি সেইটুকু করি। সারাসপ্তাহ অফিসে কলম পিষি। সবসময় ঘেন্নায় গা গুলোয়। সন্ধ্যে বেলা হাতজোড় করে বলি, মা, আমাকে মুক্তি দাও। কবে এর থেকে মুক্তি পাব? মুক্তি নেই, তাও বুঝি?

আপনার তো রিটায়ার করার বয়েস হয়ে এল।

তবু আমার রিটায়ারমেন্ট হবে না। একটা-না-একটা কিছু করতেই হবে। সংসার চালাবার দায় তো আছে।

পুরুষমানুষকে দুঃখ করতে দেখলে আমার ভালো লাগে না।

দুঃখ করছি না। এমনিই মনে এল তাই বললাম।

আপনার কথা শুনলে মনে হয়, আপনি কখনো হার স্বীকার করবেন না।

নিশানাথ হাসলেন। তারপর বললেন, তা ঠিক! হারব কেন? জীবন বলছিল, ওর যদি হঠাৎ কিছু হয়, এই সব কিছুই নষ্ট হয়ে যাবে! আমি তা কিছুতেই হতে দেব না। দরকার হলে বাড়িঘর ছেড়ে আমি এখানেই এসে থাকব। কী উমা, আমরা সবাই মিলে পারব না এটাকে বাঁচিয়ে রাখতে?

ওপরের আকাশ থেকে একটা পাতলা চাদরের মতন অন্ধকার নেমে এল। উমার মাথার ওপরে এসে পড়ল। উমাকে এখন আর স্পষ্ট দেখা যায় না। সে হাত দিয়ে কপালের চুল সরালো। তারপর নিম্নস্বরে বলল, আপনার শখের লেবু গাছগুলো একবার দেখলেন না? চলুন দেখে আসি।

নিশানাথ বললেন, সন্ধ্যে হয়ে গেছে, এখন আর পুকুরধারে গিয়ে কাজ নেই। কাল সকালে গেলেই হবে। তোমাদের এখানে সাপখোপ বড় বেশি।

আমাদের সহ্য হয়ে গেছে। পরশু তো আমার ঘরের সামনেই একটা সাপ এসেছিল।

কী সাপ? বিষ আছে?

খুব বিষ। শিয়রচাঁদা!

 ভয় পাওনি?

আমি নিজেই তো সেটাকে মারলাম। দাদার কুসংস্কার আছে, দাদা সাপ মারতে চায় না।

ও তো কিছুই মারতে চায় না। প্রাণ বাঁচানোই ওর কাজ। চলল, দেখা যাক জীবন কী করছে।

দু-জনে মন্থরভাবে হাঁটতে লাগল মাঠের মধ্যে দিয়ে। উমা সামনে যাচ্ছে, নিশানাথ সতর্কভাবে মাটির দিকে দেখছেন। হঠাৎ উমা একটা হোঁচট খেতেই নিশানাথ বললেন, কী হল?

তিনি উমাকে ধরার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ধরলেন না। উমা নীচু হয়ে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুলটা চেপে ধরে বলল, কিছু হয়নি। তার নখের কোণ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, অন্ধকারে নিশানাথ তা দেখতে পেলেন না। উমা আবার সোজা হয়ে উঠে বলল, চলুন। ব্যথা চাপবার জন্য তার মুখে একটা অন্যরকম হাসি ফুটে উঠেছে।

জীবনময়ের বাড়িতে ইলেকট্রিক নেই। তাই জ্বালানো হয়েছে দুটো হ্যাজাক। কয়েকটি ছেলে উঠোনে বসে বাঁশের বেড়া বুনছে, আর একটা ঘর তৈরি হবে। সুব্রত ঘুম থেকে উঠে বসে আছে বারান্দায়, ফ্যাচর ক্যাচর করে হাঁচছে মাঝে মাঝে।

উমা তাকে দেখে বলল, ঘুম ভেঙেছে? এখানে বসে আছ কেন? একটু ঘুরে বেড়িয়ে এলে পারতে।

সুব্রত লাজুকভাবে বলল, যাচ্ছি!

এখন আর এই অন্ধকারে একা একা যেয়ো না। যাত্রা দেখতে যাবে নাকি? ভালো যাত্রা আছে।

সুব্রতর কিছুই ভালো লাগছে না। তার বুকে ঠাণ্ডা বসে গেছে। ম্যাজম্যাজ করছে শরীর।

বোধ হয় জ্বরও এসেছে। যাত্রা দেখতে যাওয়ার তার একটুও ইচ্ছে নেই।

জীবনময় হলঘরের মধ্যে রুগি দেখছেন। কাটাপাঁঠার মতন ছটফট করছে একটি ছেলে। সুব্রতরই বয়েসি।

উমাকে দেখে জীবনময় বললেন, তুই ঠিকই ধরেছিলি। এর অ্যাপেনডিক্স ফেটে গেছে, অপারেশন করা দরকার। হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলে ভালো হয়। অবশ্য অতদূর পোঁছোবে কি না সন্দেহ।

হাসপাতাল এখান থেকে এগারো মাইল দূরে। তার অর্ধেক রাস্তাই যেতে হবে গোরুর গাড়িতে।

ছেলেটির বাবা ও আরও দু-জন আত্মীয় কাছেই বসে আছে উবু হয়ে। তারা বলল, ডাক্তারবাবু, আপনিই যা-হোক ব্যবস্থা করুন।

জীবনময় বিরক্তভাবে বললেন, এখানে কি সব কিছু হয়? অপারেশন করার সব জিনিসপত্র কি আমার আছে?

ছেলেটির বাবা হঠাৎ বিশ্রীভাবে কান্না শুরু করে দিল। অসহায় লোকদের যা একমাত্র অস্ত্র।

নিশানাথ জিজ্ঞেস করল, অপারেশন না করে আর কিছু করা যায় না?

জীবনময় দু-দিকে ঘাড় নাড়লেন। তারপর বললেন, এসব কেস হাসপাতালেই পাঠানো উচিত। যদিও এখানকার হাসপাতালের ওপরেও আমার ভরসা নেই। মফসসলের হাসপাতাল দেখেছিস কখনো? নরক দর্শনের আর কিছু বাকি থাকে না।

ছেলেটির মুখ দিয়ে গাঁজলা বেরোচ্ছে। তার ঠিক জ্ঞান নেই, তবু গোঁ গোঁ শব্দ করছে মাঝে মাঝে। সেই শব্দে বাইরের কয়েকজন দরজার কাছে ভিড় জমালো।

জীবনময় ছেলেটির বাবার দিকে ফিরে বললেন, কান্না থামান এখন। একবার গোঁসাইবাবার কাছে নিয়ে গিয়ে চেষ্টা করে দেখুন-না। আমার ছেলেরাই পৌঁছে দিয়ে আসবে।

নিশানাথ অবাক হয়ে তাকালেন জীবনময়ের দিকে। জীবনময় বললেন, গোঁসাইবাবা ঝাড় ফুক করে অনেক লোককে সারায়। কী করে সারায় তা জানি না, কিন্তু সেরে তো যায় দেখি! যদি সেখানে কিছু উপকার হয় তো হোক-না।

ছেলেটির বাবা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, গোঁসাইবাবার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তিনি জবাব দিয়েছেন।

কেন?

আজ ওনার উপপাসের দিন। আজ উনি কারুকে ছোঁন না!

জীবনময় নিশানাথকে বললেন, দেখলে? আগেই ঘুরে এসেছে সেখান থেকে। তা হলে আর কী হবে? আমি আরও ব্যথা কমাবার ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি। তারপর চেষ্টা করে দেখুন, যদি হাসপাতালে পাঠানো যায়।

হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর অসুখ।

জীবনময়ের ঠোঁটে একটা ম্লান হাসি ফুটে উঠল। যেন তিনি বুঝতে পারলেন, এটাও মৃত্যুর একটা খেলা। স্বয়ং মৃত্যুই যেন এইসব রুগিকে তাঁর কাছে পাঠায়।

তিনি কম্পাউণ্ডারকে বললেন, তোলো একে অপারেশনের টেবিলে। শুনুন। আপনাদের একটা ফর্ম ফিলাপ করে দিতে হবে। অর্থাৎ আপনারা লিখে দিচ্ছেন যে, আপনারা স্বেচ্ছায় আমাকে দিয়ে এই অপারেশন করাতে রাজি হয়েছেন। উমা, ফর্মটা দে ওদের।

হলের একপাশে একটা অপারেশন টেবিল রয়েছে। খুব দরকারে দু-একটা ছোটোখাটো অপারেশন করতেই হয়। এলাহাবাদে জীবনময়ের প্র্যাকটিস ছিল চাইল্ড স্পেশালিস্ট হিসেবে, এখানে চিকিৎসা করতে হয় সব কিছুরই।

নিশানাথই ছেলেটিকে কোলে করে টেবিলে তুলে দিলেন। কম্পাউণ্ডার যন্ত্রপাতি এনে সাজাতে লাগল। উমা এখানে থেকে থেকে অনেক কিছুই শিখে গেছে। অ্যানিস্থিসিয়া সে-ই দেবে।

দুটো হ্যাজাক লাগানো হয়েছে টেবিলের দু-পাশে। ছুরি হাতে নেওয়ার পরও জীবনময় বেশ কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ছেলেটির দিকে। মৃদু গলায় নিশানাথকে বললেন, অপারেশনটা এমন কিছু নয়, কিন্তু আমার অনেকদিন অভ্যেস নেই, তা ছাড়া আমার হাত কাঁপে আজকাল, ঠিক ভরসা পাই না—

নিশানাথ বললেন, এ ছাড়া যখন আর উপায় কিছু নেই–

ছেলেটা গাছ থেকে পড়ে গেছে। গ্রামে এমন অনেক ছেলেই গাছ থেকে পড়ে মারা যায়। একে শুধু শুধু আমার কাছে আনা হয়েছে নিমিত্তের ভাগী করার জন্য।

চেষ্টা করা হচ্ছে, সেইটাই বড়োকথা।

আর একটা জিনিস লক্ষ করে দেখ। ছেলেটার চেহারা দেখেছিস? পেটটা মোটা, হাত দুটো সরু সরু, বুকের খাঁচাটা ছোটো—একটা যুবক ছেলের এই কী চেহারা? অথচ বেশিরভাগ লোকের চেহারাই আজকাল এইরকম। কী খায়? আজেবাজে জিনিস দিয়ে কোনোরকমে পেট ভরাচ্ছে। শরীরে কোনো রেসিসটেন্স নেই। অপারেশনের ধকল সহ্য করতে পারবে কি না সেটাই সন্দেহ।

তুই এত চিন্তা করছিস কেন?

নিশি, যদি আমার হাত কাঁপে!

কিছু হবে না।

জীবনময়কে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অসহায়। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর পেছন ফিরে তাকালেন।

ঘরের মধ্যে ভিড় হয়ে গেছে। সুব্রতও এসে দাঁড়িয়েছে টেবিলের পাশে। জীবনময় গম্ভীরভাবে বললেন, সবাই বাইরে যাও।

সকলে পিছিয়ে যেতে লাগল। নিশানাথও ছেলেকে বললেন, চল, বাইরে চল।

নিশা তুই থাক।

আমি কাছেই থাকব।

উমা আর কম্পাউণ্ডার শুধু ভেতরে রইল। নিশানাথ বাইরে এসে দরজার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। যতক্ষণ অপারেশন শেষ না হয়, তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে। অন্যরা ফিসফাস গুজগুজ করে কথা বলছে। তিনি নিঃশব্দ।

প্রায় চল্লিশ মিনিট বাদে বেরিয়ে এলেন জীবনময়। চোখ-মুখ খুব ক্লান্ত হলেও ঠোঁটে একটা অদ্ভুত সুন্দর হাসি। নিশানাথকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হল না। ওই হাসিটা দেখেই বুঝলেন।

নিশানাথ হাতটা চেপে ধরলেন জীবনময়ের। জীবনময় বললেন, মনে হয় বেঁচে যাবে। ছেলেটির আত্মীয়দের উদ্দেশে বললেন, আপনাদের মধ্যে একজন অন্তত এখানেই থেকে যান রাত্তিরটা। খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত এখানেই হয়ে যাবে।

নিশানাথ বুকের মধ্যে সামান্য একটু ব্যথা অনুভব করলেন। হঠাৎ যেন জীবনময়কে তাঁর হিংসে হচ্ছে। তিনি ভাবলেন, আমি কি জীবনে এমন একটি কাজও করতে পারব না, যাতে ওইরকম সুন্দরভাবে হাসতে পারি? কতখানি তৃপ্তি আর অহংকার মিশেছিল ওই হাসির সঙ্গে!

তিনি ছেলেকে খুঁজতে লাগলেন।

সুব্রত বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। নিশানাথ তার কাছে গিয়ে খুব নরম গলায় বললেন, খোকন, তোর কেমন লাগছে এই জায়গাটা? তোর এখানে থাকতে ইচ্ছে করে না? তুই এখানে থাকবি?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সুব্রত বলল, না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *