১৫
জাহাজটা অলস গতিতে ভেসে চলেছিল। নির্মেঘ পরিষ্কার রাতের আকাশ। নক্ষত্ররা সব নির্নিমেষ নয়নে প্রত্যক্ষ করে চলেছে। দক্ষিণমুখী বাতাস বইছে উত্তমগতিতে। জাহাজের তিনটি মাস্তুলে পাঁচস্তরে পনেরোটি পাল সেই বাতাসে ফুলে ফেঁপে উঠছে।
জাহাজের কেন্দ্রীয় মাস্তুলের ওপরে একটি ধাতব চক্রচিহ্ন। সেই চিহ্নই দূর থেকে বলে দেয় জাহাজটা ইংরেজদের নাকি ফরাসি, পর্তুগিজ বা দিনেমারদের। এই জাহাজটি ইংরেজদের।
কৃষ্ণসুন্দর উদাসচোখে জাহাজের ডেকে বসেছিলেন। ডেকের ওপর চারটি কেবিন। সেগুলোয় মিটমিট করে আলো জ্বলছে। কেবিনগুলো জাহাজের প্রধান নাবিক ও তার সহকারীদের জন্য বরাদ্দ। কেবিন পেরিয়ে বেশ কিছুটা হেঁটে গেলে ডেকের জমিতেই পড়বে একটা বড় পাটাতন। সেই পাটাতন খুলে সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নামতে হয় জাহাজের খোলে।
সেখানে সারিসারি ওপর নীচে খোপ। সম্পূর্ণ অন্ধকারে সেখানেই অষ্ট প্রহর গাদাগাদি করে বসে থাকে গিরমিটওয়ালারা। দুর্গন্ধ, বদ্ধ পরিবেশ সব সহ্য করে। বেশিরভাগই ঝিমোয়। দিনে দু’বার সিঁড়ির ওপরের খুপরি মতো দরজাটা খুলে যায়। সেখান দিয়ে জাহাজের দুজন খালাসি নামে খাবার দিতে।
খাবারের লোভে নয়, বাইরের আকাশ থেকে যে সামান্য আলো এসে পড়ে খোলের মধ্যে, তাতেই উজ্জীবিত হয়ে নড়েচড়ে বসে বন্দি শ্রমিকরা। কিছুক্ষণ মাত্র। তারপরই আবার বন্ধ হয়ে যায় সেই দরজা।
আজ বিকেলের পর থেকে কৃষ্ণসুন্দরের পেটের ভেতর কেমন পাক দিচ্ছিল। তাই পায়ে পায়ে তিনি উঠে এসেছিলেন ওপরের ডেকে। তারপর ইতস্তত পদচারণা করতে করতে চলে এসেছেন এখানে।
বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন তিনি। সামনে সুবিশাল সমুদ্র ও সুবিশাল মহাকাশের কাছে নিজেকে বড় তুচ্ছ, বড় অকিঞ্চিৎকর মনে হচ্ছিল তাঁর।
মনে হচ্ছিল, এই সাগর ও এই আকাশ কত কিছু প্রত্যক্ষ করেছে। সেই আদিপ্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান সময়। কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে কত প্রাণ, কত সময়। এই যে তিনি একটু একটু করে নিজের স্বদেশ, নিজের মাতৃভূমি থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন, প্রতিটা দিনান্তে তিনি অগ্রসর হচ্ছেন অজানা এক ভবিষ্যতের দিকে, তার সাক্ষী এই সাগর ও এই আকাশ।
‘কী ভাবছেন ঠাকুরমশাই?’
কৃষ্ণসুন্দরের সম্বিৎ ফিরল। পেছনে তাকাতেই তিনি দশাসই চেহারার লোকটিকে চিনতে পারলেন। নাম উমেশচন্দ্র গুই। সে এই জাহাজের গাঙ সারেঙ। জাহাজের ক্যাপ্টেন ফিরিঙ্গি হলেও গাঙ সারেঙ বাঙালি। জাহাজ যখন সাগর থেকে নদীতে এসে পড়ে, তখন গাঙ সারেঙ দায়িত্ব নেয়।
যেদিন বালুঘাট থেকে ওদের জাহাজ প্রচণ্ড ভোঁ বাজিয়ে ছেড়েছিল, সেদিন থেকে শুরু করে পরপর কয়েকদিন জাহাজের দায়িত্ব ছিল এই উমেশ গুইয়ের ওপরেই। তা প্রায় দিনদশেক হল। তখনই কৃষ্ণসুন্দর দেখেছিলেন, নদীপথের গোটাটাই লোকটার একদম নখদর্পণে। কোথায় চড়া পড়েছে, কোথায় রয়েছে ডুবো-চর, আর কোনদিকে বড়গঙ্গার গভীর খাদ, সব কিছু বলতে গেলে তার মুখস্থ।
জাহাজ কপিলমুনির আশ্রম পেরিয়ে মোহনায় পৌঁছে সাগরে নামার পর থেকে তার কাজ শেষ হয়েছে। সে এখন এদিক ওদিক তদারক করছে।
কৃষ্ণসুন্দর হাসলেন, ‘কিছু ভাবিনি। এই একটু বসে রয়েছি। আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?’
উমেশচন্দ্র গুই সদ্য পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘এখন আমার খাওয়া কী? আপনারা যখন সবাই খোলের মধ্যে ঢুকে ঘুমিয়ে যাবেন, তখন আমি খাব। আমার আবার একটু সঙ্গে মা কালীর চরণামৃত না হলে চলে না, বুঝলেন কিনা। হে হে!’
কৃষ্ণসুন্দর কিছু না বলে মুখ ফেরালেন কালো মিশমিশে জলের দিকে। মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমি ভেবেছিলাম স্টিমার জাহাজে করে যেতে হবে আমাদের। বছরখানেক আগে একটা কাজে চাঁদপাল ঘাট গিয়েছিলাম। তখনই দেখেছিলাম বড় বড় বাষ্পচালিত জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকতে। ভেবেছিলাম এই পালতোলা জাহাজ বুঝি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে।’
‘ঠিকই ভেবেছিলেন ঠাকুরমশাই।’ উমেশচন্দ্র গুই বলল, ‘এখন মালবাহী বলুন বা যাত্রীবাহী, সব জাহাজই স্টিমার। সময়ও কম লাগে, ঝক্কিও কম। কিন্তু এই গিরমিট চালানে এখনো পালতোলাই চলছে।’
‘কেন?’
উমেশচন্দ্র এবার চারপাশ চকিতে দেখে নিল। তারপর কৃষ্ণসুন্দরের একবারে মুখের কাছে ঝুঁকে এসে বলল, ‘খরচ যে অনেক কম। ও দেশের খামার মালিকেরা কি শুধু আখের খেতেই মুনাফা লোটে ঠাকুরমশাই? জাহাজের পালেও লোটে। তাতে সময় বেশি লাগে লাগুক। জাহাজ দুলে লোকেরা বমিতে গড়াগড়ি যায় যাক।’
লোকটার মুখের বোটকা গন্ধে কৃষ্ণসুন্দরের গা গুলিয়ে উঠল। তিনি দ্রুত মুখ সরালেন। বললেন, ‘আমাদের যেতে কতদিন লাগবে?’
উমেশচন্দ্র বলল, ‘তা ধরুন, হাওয়া ঠিকঠাক থাকলে হপ্তা কুড়ি তো লাগবেই। দুটো বড় বড় মহাসমুদ্র পেরোতে হবে। চাট্টিখানি কথা নয়।’
কুড়ি সপ্তাহ? মানে প্রায় পাঁচ মাস!
লোকটা চলে যাওয়ার পরেও কৃষ্ণসুন্দর বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল নির্জন ডেকে। দূরের ফসফরাস মাখা সাদা ঢেউগুলোর দিকে তাকিয়ে তাঁর প্রায় ঘোর লেগে যাচ্ছিল। গ্রামের চতুষ্পাঠীতে তিনি ছাত্রদের পড়াতেন ইতিহাস, ভূগোল। অপালাও তার কাছে পড়েছে মহাসমুদ্র, মহাদেশের কথা।
সে কি কল্পনাও করতে পারবে তার বাবা মা ভাই এখন সেই মহাসমুদ্র পেরোবে?
কৃষ্ণসুন্দর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মেয়েদুটো কেমন আছে কে জানে। নবকিশোর লোকটা একটা পাকা ধূর্ত শয়তান। নাহলে কেউ নিজের নাতনির বয়সি মেয়েকে বিয়ে করতে পারে না! আর করলেও তার বাবা-মা’কে গিরমিটওয়ালা করে দেশান্তরি হতে বাধ্য করে না।
তবে একটা কথা কৃষ্ণসুন্দর কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না। ভুবনমণি গেল কোথায়? সেদিন নবকিশোর একটুর জন্য ভুবনকে ওঁদের সঙ্গে আসতে দিল না। বলল একেবারে জাহাজঘাটে দেখা হবে। কিন্তু সে এল কই?
জাহাজে ওঠার আগে পর্যন্ত কৃষ্ণসুন্দর উদ্ভ্রান্তের মতো সেকথা জিগ্যেস করেছেন মধুসূদন গোমস্তা, রামবিলাস দারোয়ান থেকে শুরু করে নবকিশোরের সাঙ্গোপাঙ্গোদের প্রত্যেককে। কেউ কোনো উত্তর দেয়নি। জাহাজে উঠেও ব্রহ্মময়ী আর তিনি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন এই বুঝি শেষ মুহূর্তে ভুবনমণি এসে পড়বে।
দিব্যসুন্দর বারবার জানতে চাইছিল, ‘বাবা, পিসিমা কখন আসবে? পিসিমা আমাদের সঙ্গে যাবে না?’
ভোঁ বাজার অনতিকাল পরে প্রচণ্ড শব্দে একবার দুলে উঠেছিল জাহাজটা। সেই আকস্মিক দোলায় উল্টে পড়ে যেতে যেতেও নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন ব্রহ্মময়ী। আর তারপরই কেঁদে উঠেছিলেন, ‘বাপ-মা মরা মেয়েটাকেও নিয়ে নিল ওরা!’
সেদিনের সেই কথা মনে পড়লে এখনো কৃষ্ণসুন্দরের চোখ ছলছল করে ওঠে। তিনি নিজে তো বটেই, ব্রহ্মময়ীও নিজের তিন সন্তানের থেকে কোনোদিনও এতটুকু আলাদা করে দেখেননি ভুবনমণিকে। কিছু কিছু মানুষের জীবনে বিধাতার আশীর্বাদ বোধ হয় বিপরীতমুখে বহমান থাকে। তাদের জীবনে ঝড়ঝঞ্ঝার কোনো বিরাম থাকে না। তার ওইটুকু ছোট বোন, তাকে একের পর এক কত কষ্ট, কত বিপর্যয়, কত যাতনা সহ্য করতে হচ্ছে।
কৃষ্ণসুন্দরের চোখ দিয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে। দূরের আকাশ ও সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে তিনি কাঁদতে থাকেন। যে কোনো মানুষ, সে যতই বুদ্ধিমান হোক, জীবনে একবার না একবার তার মতিভ্রম হয়ই। হরিহর আড়কাঠির মুখের কথায় বিশ্বাস করে একবস্ত্রে গ্রাম ত্যাগ করা ছিল কৃষ্ণসুন্দরের সেই মতিভ্রম। যার মাশুল ওঁর পরিবারের সবাইকে দিতে হচ্ছে। দিয়ে যেতে হবে। কতদিন, তা তিনি নিজেও জানেন না।
ঘোর ভাঙে ঢেউয়ের জলোচ্ছ্বাসের শব্দ পেরিয়ে ভারী বুটের মসমস আওয়াজে।
কৃষ্ণসুন্দর পেছন ফিরে দেখেন, ডেকের একটা ঘর থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছে এক ইংরেজ। পরনে পুরোদস্তুর নাবিকের পোশাক। এই জাহাজের প্রধান নাবিককে প্রথমদিন একবারের জন্য দেখতে পেয়েছিলেন কৃষ্ণসুন্দর। ধপধপে সাদা পোশাক। মাথায় কালো টুপি। তিনি ছিলেন বৃদ্ধ। শ্বেতশুভ্র দাড়ি ও সুঠাম চেহারা।
তুলনায় এই লোকটি যুবক। সম্ভবত এ সহকারী নাবিকদের একজন।
‘হে! হোয়াট আর ইউ ডুইং হিয়ার!’ লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো বলল।
কৃষ্ণসুন্দর কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি ইংরেজি জানেন না। এর আগে কদাচিৎ ইংরেজদের দেখলেও কখনো বাক্যালাপ করেননি। তবে শুনেছেন, ইংরেজরা খুব নিষ্ঠাবান জাতি। তারা পরাজিতকেও সম্মান দেয়। কৃষ্ণসুন্দর সহবৎবশত দু’হাত জোড় করে নমস্কার করলেন।
কিন্তু লোকটা প্রতিনমস্কার বা করমর্দনের ধার ধারল না। সে টলতে টলতে আরো কাছে এগিয়ে এল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে আকণ্ঠ মদ্যপান করেছে। খোলা ডেকে প্রচণ্ড হাওয়ায় তার মাথার চুলগুলো উড়ছে। চোখ রক্তাভ, পায়ের ভারসাম্য রাখতে পারছে না।
কৃষ্ণসুন্দরকে মৌন থাকতে দেখে সে আরো রেগে গেল। চিৎকার করে আবার কিছু বলল, তারপর এগিয়ে এসে সোজা কৃষ্ণসুন্দরের পেট লক্ষ্য করে চালাল একটা লাথি।
ঘটনার আকস্মিকতায় কৃষ্ণসুন্দর এতটাই বিস্মিত হয়ে গেলেন যে ভারী বুটের আঘাতে তার তলপেট প্রায় বিদীর্ণ হয়ে গেলেও তাঁর মুখ দিয়ে একটাও আওয়াজ বেরল না। যেখানে বসেছিলেন, সেখান থেকে পড়ে গেলেন মাটিতে।
লোকটা পরোয়া করল না। মুখে একরাশ ঘৃণা এনে নাগাড়ে কী যেন বলে যেতে লাগল। তারপর কৃষ্ণসুন্দরের মুখ লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল একদলা থুতু।
কৃষ্ণসুন্দরের তলপেটে এতটাই লেগেছিল, যে কয়েকমুহূর্তের জন্য তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন। তার মধ্যেই সাহেবের থুতুতে মাখামাখি হয়ে গেল তার গাল। কোনোমতে হাতড়ে হাতড়ে উঠে বসলেন তিনি।
সাহেবের পেছন পেছন ততক্ষণে ছুটে এসেছে তার দেশীয় ভৃত্য। সে সাহেবের খিদমদগারও বটে, দোভাষীও বটে। সে মুহূর্তে গোটা পরিস্থিতিটা বুঝে নিল, তারপর সাহেবকে বোঝাতে লাগল, ‘ব্রামহিন স্যার! ব্রামহিন! ইয়োর চার্চ প্রিস্ট, আওয়ার টেম্পল প্রিস্ট। ডোন্ট হিট হিম। আওয়ার গড উইল অ্যাংরি স্যার। হি বেগিং পার্ডন স্যার!’
তারপর সে দ্রুতগতিতে টেনে তুলল কৃষ্ণসুন্দরকে। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘ভর সন্ধ্যাবেলা মরতে এখানে কেন বসে আচেন ঠাকুরমশাই? জানেন না ডেকে গিরমিটওয়ালাদের বসা নিষেধ? ইশ, ছি ছি! উঠুন উঠুন। দেকতে পেলে আমি আগেই সাবধান করে দিতুম। শুধু শুধু যম সাহেবের চোখে পড়ে অপমানের একশেষ…!’
কৃষ্ণসুন্দর যেভাবে খোলের সিঁড়ির দিকে পা ঘষে ঘষে হাঁটতে লাগলেন, তাতে যে কেউ ভাববে তিনিও ওই যমসাহেবের মতো আকণ্ঠ মদ্যপান করেছেন। তীব্র অপমানে তার গোটা শরীরটা টলছিল। ঠোঁটদুটো কাঁপছিল থরথর করে।
জাহাজের খোলের মধ্যে প্রখর রোদেও ঘুটঘুটে অন্ধকার। অন্ধকারে দিনের পর দিন থাকতে গেলে চোখ তার মধ্যে যে আলো খুঁজে নেয়, সেই আলোতে লোকে বসে থাকে ভূতের মতো। এখানে গাদাগাদি করে ঢোকানো হয়েছে গিরমিটদের। যে খোপে বড়জোর দুজন বসতে পারে, সেখানে যথেচ্ছভাবে চারজন পাঁচজন করে ময়দার তালের মতো ঠেসে দেওয়া হয়েছে। খোলের এক পাশে সার দিয়ে দিয়ে আটটা শৌচালয়, দেড়শো মানুষের জন্য। স্ত্রী পুরুষের পৃথক ব্যবস্থার কোনো বালাই নেই। অর্ধেক শৌচালয়ের ছিটকিনিও ভাঙা। জাহাজের খালাসিদের সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করার কথা। কিন্তু, কেউ তা করে না। সারাক্ষণ সেগুলো প্রস্রাব-পুরীষে মাখামাখি হয়ে থাকে। সেদিকে গেলেই দুর্গন্ধে অন্নপ্রাশনের ভাত পেট থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।
সমুদ্রযাত্রার এখনো এক পক্ষকালও পূর্ণ হয়নি, এরই মধ্যে সব গিরমিটওয়ালা যেন নরক দর্শন করে ফেলেছে।
ব্রহ্মময়ী চারহাত লম্বা একটা খোপে দিব্যকে নিয়ে কোনোমতে আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন। বেশ কয়েকদিন হল তিনি সারাদিনে একবার মাত্র সামান্য কিছু মুখে দেন। বাকি সময় এভাবেই শুয়ে থাকেন। ভয়ে জলও খান না। পাছে শৌচালয়ে যেতে হয়।
স্বামীকে হ্যাঁ চোড়প্যাঁচোড় করে খোপে উঠতে দেখে ব্রহ্মময়ী ফিসফিস করলেন, ‘ভুবনের একটা খবর পেলুম জানো।’
কৃষ্ণসুন্দর অবসন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘কী খবর?’
‘সেই রাঙামাসিমার ছেলে, যাকে তুমি গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলে, তিনিই ভুবনমণিকে নিয়ে গিয়েছেন।’
ভেতরে ক্ষতবিক্ষত হতে হতেও কৃষ্ণসুন্দর তাকালেন স্ত্রীর দিকে, ‘মানে? তুমি কী করে জানলে, দ্বারকা ভুবনকে নিয়ে গিয়েছে?’
ব্রহ্মময়ী আঙুল তুলে ইশারা করলেন একটু দূরের এক খোপের দিকে। অন্ধকারে কৃষ্ণসুন্দর কিছুই বুঝতে পারলেন না, ব্রহ্মময়ী কাকে দেখাচ্ছেন।
‘মানদা বলল। দুখীলাল ওকে বলেছে।’
‘মানদা কে? দুখীলালটাই বা কে?’ কৃষ্ণসুন্দর বললেন। তলপেটের যন্ত্রণাটা তাঁর ক্রমশই বাড়ছিল। কিন্তু তিনি প্রাণপণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলেন।
ব্রহ্মময়ী বললেন, ‘দুখীলাল ডিপোর একজন দারোয়ান। ওর হাত দিয়েই তোতারাম তোমার চিঠি পাঠিয়েছিল দ্বারকাকে। মানদা লাইনের মেয়ে, দুখীলালের কাছে রোজ রাতে যেত। জাহাজে ওঠার আগের রাতে দুখীলাল মানদাকে বলেছে, দ্বারকাবাবু শহরে নেই, কিন্তু তাঁর স্ত্রী চিঠি পেয়েই নবকিশোর দত্তকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি যেন এখুনি ভুবনমণি আর অপা লোপাকে পাঠিয়ে দেন।’
ব্রহ্মময়ী এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন। ডিপোয় দিনযাপনের আগে লাইন, লাইনে নামা, এসব কিছুই জানতেন না। কিন্তু এখন সব বোঝেন।
কৃষ্ণসুন্দর এই অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে কুঠুরিতেও যেন আশার আলো দেখতে পেলেন।
‘তার মানে কি দ্বারকার কাছে অপা লোপাও পৌঁছে গিয়েছে?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না গো! তবে মনে হচ্ছে ওরাও গিয়েছে।’ ব্রহ্মময়ী বললেন।
‘হে ঈশ্বর!’ কৃষ্ণসুন্দর মুহূর্তের মধ্যে বিস্মৃত হলেন একটু আগের প্রচণ্ড লাঞ্ছনাটার কথা।
ম্লান চোখদুটো চিকচিক করে উঠল তাঁর। বললেন, ‘তা যদি হয়, এর চেয়ে সুসংবাদ আর কিছু হয় না কৃষ্ণা। দ্বারকার বাড়িতে ভুবন আর মেয়েদুটো পৌঁছতে পারলে ওদের জীবন বর্তে যাবে।’
১৬
মানদা নামক দেহোপজীবিনী মহিলাটি ব্রহ্মময়ীকে যে সংবাদ দিয়েছিল, তা নির্ভুল। কিন্তু, সেই সংবাদ থেকে চট্টোপাধ্যায় দম্পতি আশার সমুদ্রে ভেসে যে উপসংহারে উপনীত হলেন, তা আংশিক সত্য।
দ্বারকার বাড়িতে পৌঁছেছে শুধুমাত্র ভুবনমণি। অপালা তখনো স্বামীর ভালোবাসার অত্যাচারে সুস্থ হতে পারেনি। আর লোপামুদ্রা রয়েছে দত্তবাড়িরই অন্দরমহলে, ধাত্রীমা’র কাছে।
অন্তরালে যে নাটকটি সংঘটিত হয়েছে, তা সংক্ষিপ্ত হলেও বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।
যেদিন সকালে ধনঞ্জয় পণ্ডিতের কথায় লোপামুদ্রাকে দত্তবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল, সেদিনই বিকেলে নবকিশোর দত্ত চিঠিটা পেয়েছিলেন।
তখন তিনি নিজের মথুর সেন গার্ডেন লেনের গদিতে। তাঁর বাসভবনের সঙ্গে লাগোয়া এই গদি। এটাই তাঁর মূল ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু। দিনের গরিষ্ঠভাগ সময় তিনি এখানে থাকেন। দেখাশুনো করেন। দুপুরের পর মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিজের জুড়িগাড়িটিতে চেপে বেরিয়ে যান। কোনোদিন যান নবাবের নাচমহলে গজল শুনতে, কোনোদিন যান মোতির কাছে, আবার কোনোদিন চলে যান মেছুয়াবাজারের ডিপোতে।
আর যেদিন কিছুতেই মন লাগে না, গিয়ে পৌঁছন পেয়ারাবালার কাছে।
পেয়ারাবালা বামুন ঘরের বিধবা, দু-তিন হাত ঘুরে এসে পড়েছিল চিতপুরে। গান শুনতে গিয়ে সেখান থেকে নবকিশোর দত্ত তাকে তুলে নিয়ে এসেছিলেন। বাঁধা রয়েছে তা আজ বছরপাঁচেক হল। তার বয়স বাইশ-তেইশ। গাত্রবর্ণ ময়লা হলেও বেশ আঁটসাঁট গড়ন। নাকটা টিয়াপাখির মতো লম্বা। সেই নাকে সে প্রতিদিন নতুন নতুন নাকছাবি পরে। কথায় কথায় হাসে আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে।
নবকিশোর তার কাছে গিয়ে যে বিশেষ মনের আরাম পান, তা নয়। মেয়েটা মোতির মতো বুদ্ধিমতী তো নয়ই, বোকাসোকা বললেও কম বলা হয়। নিরেট গাধার মতো তার মস্তিষ্ক। গানের গলাও ভালো নয়। তার ওপর প্রতিদিন তার হাজারো বায়নাক্কা। কানের ঝুমকো, হাতের বাউটি, কোমরের বিছা, বায়না লেগেই থাকে। নবকিশোর যতটা পারেন সেই দাবিদাওয়া মেটান।
তার একটা কারণ আছে। বাড়ির তিন-তিনটে স্ত্রী, গোটা জীবনে অগণিত উপপত্নী পেরিয়ে তিনি প্রৌঢ়ত্বে চলে এসেছেন, কিন্তু পেয়ারাবালার মতো নির্বিরোধী শয্যাসঙ্গিনী কাউকে পাননি।
পেয়ারাবালা তাঁর সঙ্গিনীদের মধ্যে একমাত্র, যে অপরিসীম ব্যথা সহ্য করতে পারে। নবকিশোরের আবার ওই এক শখ, রতিক্রিয়ার সময় সঙ্গিনী যন্ত্রণায় চিৎকার করবে, ছটফট করবে, তাই দেখে তিনি কেমন এক স্বর্গীয় সুখ পান। সব মেয়েই তাঁর অত্যাচারে চিৎকার করে। কিন্তু পরের দিন থেকে আতঙ্কে আর সহজ হতে পারে না।
কিন্তু পেয়ারাবালা তেমন নয়। তার পাকা বেলের মতো স্তনে আর কলাগাছের মত ঊরুতে জ্বলন্ত কাঠকয়লা চেপে ধরে ধরে চামড়াগুলো সাদা কালো হয়ে গিয়েছে, কিন্তু তবু মেয়েটা প্রতিবারই স্বেচ্ছায় ধরা দেয় তাঁর কাছে।
নবকিশোর দু-একবার জিগ্যেস করেছেন তাকে, ‘হ্যাঁ রে পেয়ারা। তোর ব্যথা লাগে না?’
পেয়ারাবালা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল, ‘লাগবে না কেন বাবু। খুবই লাগে।’
‘তবে? পরের দিন যে আবার নিজে থেকেই শুয়ে পড়িস?’
‘আমি যে দাঁতে দাঁত চিপে সহ্যি করি। জানি, সহ্যি করলেই মিলবে সিতেহার! হি হি।’
সেদিন সকাল থেকে বাড়িতে নতুন বউয়ের ওই দশা, ধনঞ্জয় পণ্ডিতের নানা আদেশ, সব মিলিয়ে নবকিশোর কিছু উন্মনা ছিলেন। ভেবেই রেখেছিলেন দুপুরের খাওয়া সেরে রওনা দেবেন পেয়ারার কাছে। রাতটা ওর কাছেই কাটাবেন। সেইমতো তাড়াতাড়ি কাজ গোটাচ্ছিলেন।
মেটিয়াবুরুজ থেকে বুলবুল মিয়াঁ নতুন অর্ডার নিয়ে এসেছে, সেগুলো বুঝে নিচ্ছিলেন।
তাঁর বিপরীতে বসেছিল প্রশান্ত বসু বলে এক ছোকরা। সে মোক্তার। দক্ষিণের দিকে কোন এক গ্রামে তার আদি বাড়ি, বছরকয়েক হল কলকাতা শহরে এসে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। সঙ্গে এক বড় মোক্তারের কাছে শিক্ষানবিশি করছে। তার চোখদুটো খয়েরি রঙের, কুতকুতে। দেখলেই বোঝা যায় সে অতি ধুরন্ধর ছেলে।
নবকিশোর দত্তের কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে বলে চলেছিল, ‘বুইলেন কিনা দত্তমশাই, বন্যার মতো বেনোজল ঢুকচে ওকানে। যে যেমনভাবে পারচে। এইসময়ে ঢুকে পড়তে পারলে আপনার আর চিন্তা নেই।’
‘কিন্তু এও তো সেই যেচে সাহেবদের শত্তুর করা। সাহেবদের বিরুদ্ধেই তো কংগ্রেস হচ্চে, নাকি?’ নবকিশোর বললেন, ‘তোমাকে তো বলেইচি সাহেবদের চটালে আমার পেট চলবে না। নবাব যদি আমার মা হয়, তারা আমার বাপ।’
প্রশান্ত হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘আরে আপনি আগে পুরোটা শুনুন দত্তমশাই। কংগ্রেস কার মাথা থেকে বেরিয়েচে জানেন? হিউম বলে একজন সাহেবের। খোদ বড়লাটের এতে সায় রয়েচে।’
নবকিশোর বিস্মিত হয়ে হিসেবের খাতা থেকে মুখ তুললেন, ‘কেন? সাহেবদের বিরুদ্ধে মিটিং মিছিল হবে, আর তারাই সায় দিচ্চে? এ কী রকম উলটপুরাণ হল?’
প্রশান্ত বলল, ‘উল্টো কিছুই নয়। এ হল বড়লাট ডাফরিনের চাল। সিপাহী বিদ্রোহ থেকে তারা শিক্ষে নিয়েচে। আবার যদি দুম করে কখনো দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষেপে ওঠে, তাতে যেন শিক্ষিত অভিজাত সম্প্রদায় সরকারকেই সমর্থন করে, সেজন্য আগে ভাগে এইসব করা। ওসব ছাড়ুন। আমরা হলুম গিয়ে আদার ব্যাপারি, জাহাজ কখন ছাড়ল, তা নিয়ে আমাদের কাজ কি। আপনাকে আমি কথা দিয়েচি সমাজের মান্যগণ্য মহলে ঢোকাব, আমি সেই কথাই বলতে এসেচি। সেখানে ঢোকার জন্য এখন সবচেয়ে সহজ রাস্তা হল কংগ্রেসে নাম লেখানো। এই তো, ডিসেম্বরে ওদের প্রথম অধিবেশন বোম্বাই শহরে। কলকাতা থেকে সব নামীদামি লোকেরা যাবেন। আপনাকেও তো যেতে হবে, নাকি?’
নবকিশোর বললেন, ‘কিন্তু তুমি যে বললে, ভারত সভা থেকে শুরু করে ব্রাহ্ম সমাজের সবাই সেকানে গিয়ে জুটচে? তারা কি আমাকে নেবেন?’
প্রশান্ত এইবার চোখ টিপল, ‘তারা নিল কি নিল না, তাতে আপনার ভারি বয়েই গেল। তাদের বাপকে ধরেচি আপনাকে নেওয়ার জন্য। আর সেই কথা বলতেই দিনেদুপুরে ছুটে আসচি আপনার গদিতে। যদি একটু ভালো খরচাপাতি করতে পারেন, তবে আপনি এবারে বোম্বাইয়ের সভায় একজন সম্ভ্রান্ত অতিথি হিসেবে ডাক পাবেন।’
আনন্দে নবকিশোরের চোখদুটো চকচক করে উঠল। বললেন, ‘কীভাবে?’
‘ওই যে হিউম সাহেব, যিনি কংগ্রেসের আসল মাথা, তিনি হলেন পাখিপাগল। দিনরাত পাখি নিয়ে পড়ে থাকেন। বইও লিখেছেন। হিমালয় থেকে সিংহল সব জায়গায় চষে বেড়িয়েছেন পাখি খুঁজতে। বিরল পাখি তিনি কোনোকিছুর বিনিময়েই হাতছাড়া করেন না।’ প্রশান্ত আবার চোখ টিপল, ‘বুইতে পারচেন কি বলচি?’
নবকিশোর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘পারচি। তেমন পাখি আমি অনেক যোগান দিয়েচি নবাবের মঞ্জিলে। এমন এমন চিড়িয়া পাঠিয়েচি, যা সারা দুনিয়ায় হয়ত মেরেকেটে পাঁচটা আচে।’
‘এই তো। তেমন কিছু ভেট দিন। আপনার কংগ্রেসে ঢোকা পাকা।’ প্রশান্ত বলল, ‘তবে হ্যাঁ । একটা কথা সাবধান করে দিই। বেরাম্মদের তেলও যেমন মারবেন না, তেমনই রাগাবেনও না। বলা যায় না, হিউম সাহেব চাইলেও কলকাঠি নেড়ে পেছন থেকে তারা আপনাকে বাঁশ দিল। বুয়েচেন কিনা?’
খুব বুঝেছেন নবকিশোর। লম্বা ঘাড় নাড়তে যাচ্ছিলেন, আর ঠিক সেইসময়ই গদির দারোয়ান এসে একটা লম্বা সেলাম ঠুকে চিঠিটা দিয়ে গেল।
হালকা আকাশি রঙের শক্ত কাগজে মোড়া সাধারণ লেফাফা। কিন্তু পত্রপ্রেরকের নাম ঠিকানা দেখে তিনি সোজা হয়ে বসেছিলেন। কোনো কথা না বলে দ্রুতহাতে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন লেফাফাটা।
মাত্র একপাতার সংক্ষিপ্ত পত্র। কিন্তু তা পড়তে পড়তেই তাঁর রক্তচাপ হু-হু করে বাড়তে শুরু করেছিল। দরদর করে ঘাম দেখা দিয়েছিল গলায়।
তাঁকে হাতে হাতে সাহায্য করছিল গণেশ। কর্তার এমন হঠাৎ অসুস্থতায় সে ঘাবড়ে যায়। দ্রুত ঘোলের শরবৎ নিয়ে আসে।
‘কী হয়েছে কত্তা? শরিল খারাপ লাগচে? বদু ডাক্তারের বাড়ি পালকি পাঠাব?’ গণেশ জিগ্যেস করেছিল।
নবকিশোর ঘামতে ঘামতে মাথা নাড়লেন। তারপর ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন পুরো শরবৎটা।
প্রশান্ত বসুও বলল, ‘কী হয়েচে? অমন করচেন কেন?’
নবকিশোর একটু দম নিয়ে বললেন, ‘বেরাম্মদের নেতা দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির নাম শুনেচ? কেশব সেন তার মেয়ের কমবয়সে কুচবিহারের রাজার সঙ্গে বিয়ে দিতে যে রে রে করে উঠেছিল?’
‘তা শুনব না? ব্রাহ্ম সমাজ নয়, তিনি হলেন সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের নেতা। কেশব সেনের সঙ্গে ঝামেলা করে উনি, শিবনাথ শাস্ত্রী, উমেশ দত্ত, এঁরা নতুন দল গড়েচেন। খুব দাপুটে।’ প্রশান্ত বলল।
‘ওই হল।’ নবকিশোর বললেন, ‘সে আমায় চিঠি পাঠিয়েচে। আমি নাকি তার আত্মীয়াদের আমার ডিপোয় আটকে রেখেচি। এখুনি মুক্তি না দিলে নাকি তার কাগজে সব ফাঁস করে দেবে।’
‘বলেন কী?’ প্রশান্ত বিস্ময়ে গদি থেকে পড়ে যায় আর কি, ‘আপনি দ্বারকা গাঙ্গুলির বাড়ির মেয়েদের আটকে রেকেচেন? একি সাংঘাতিক কাণ্ড! শিগগির তাদের ছেড়ে দিন। এই ভুলটি করবেন না।’
‘আহ, আমি কি জেনেবুঝে ভুল করিচি?’ কাতর কণ্ঠে বললেন নবকিশোর, ‘আড়কাঠিরা কোত্থেকে কাদের ধরে আনে, তা কি আমি জানি? এখনো তো বুইতে পারচি না, তারা কারা। যদি অ্যাদ্দিনে জাহাজে উঠে পড়ে, তবেই তো চিত্তির। হাজার চাইলেও ফেরত আনতে পারব না। ওদেশের খামারমালিকরা কিচুতেই ছাড়বে না।’
দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভ্রাতুষ্পুত্রী যে তাঁরই চতুর্থ পত্নী, এবং কৃষ্ণসুন্দর যে দ্বারকানাথের সম্পর্কে ভাই হন, তা বের করতে গণেশের একবেলা সময় লাগল। কিন্তু তা জেনে নবকিশোরের মুখ শুকিয়ে গেল। গত কয়েক বছর ধরে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন সমাজের অভিজাত শিক্ষিত মহলে প্রবেশের, তার জন্য ওই প্রশান্ত বসুর মতো লোকেদের পেছনে মুড়ি-মুড়কির মতো পয়সা ছড়াতে দ্বিধা করছেন না। নিয়ম করে উপস্থিত থাকছেন শিক্ষিত মহলের নানা সভায়। হ্যাঁ , তেমন কল্কে পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু অর্থের উৎকোচে শিগগিরই তিনি নিজের সম্মান আদায় করে নেবেন, এমনটিই ভেবে রেখেছেন।
কিন্তু এমন সন্ধিক্ষণে এই ঘটনা জানাজানি হলে তার ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়বে। তিনি যে একজন ব্রাহ্মণকন্যার ধর্মনষ্ট করেছেন, সেই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে একদিকে যেমন গোঁড়া সনাতন মহল রেগে উঠবে, অন্যদিকে বলপূর্বক বিবাহ ও বন্দীত্বের জন্য ক্ষেপে উঠবে শিক্ষিত ব্রাহ্ম সমাজ। আর অপালার এই শারীরিক অবস্থার জন্য তো ছিছিক্কার পড়ে যাবে চারদিকে।
বলাই বাহুল্য, সেদিন তাঁর আর পেয়ারাবালার কাছে যাওয়া হল না। বিমর্ষ হয়ে বসে রইলেন গদিতেই। আর থেকে থেকে দোষারোপ করতে লাগলেন গণেশকে, ‘তোর জন্যই এত বড় ফ্যাসাদে পড়লুম। আমি পেত্থমেই বলেছিলুম যে ব্যবসার জিনিসকে ঘরে ঢোকাব না। তুই শুনলি না। ওদিকে পণ্ডিতমশাইও চাঁদ সদাগর আউড়ে রাজি করালেন। এখন খাঁড়ার কোপ আমার ওপরেই পড়বে।’
গণেশ উত্তর করল না। মনিবের গালাগালি হজম করাটাও তার কাজের মধ্যেই পড়ে। সে সংবাদ পাঠিয়ে পরের দিন প্রত্যুষে ডেকে আনল ধনঞ্জয় বাক্যবাগীশকে।
ধনঞ্জয় পণ্ডিত চতুরশ্রেষ্ঠ, লোকে বলে তার ডাইনে, বামে এবং পেছনেও একজোড়া করে চোখ কান আছে। ধুরন্ধরতার শেষ কথা তিনি। কোনোকিছুই তাঁর চোখ এড়িয়ে যায় না। ধনবান খদ্দেরদের পুত্রবান করার ব্যবসা চালালেও দেশের কোথায় কি হচ্ছে, সমস্ত সংবাদ থাকে তাঁর নখদর্পণে। এবং নবকিশোরকে সাহস জোগালেন তিনিই।
পত্রটি ভালো করে পড়ে বললেন, ‘এই চিঠিতে দ্বারকানাথ নিজে তো স্বাক্ষর করেননি। করেছেন অন্য একজন। দ্বারকানাথ করবেনই বা কী করে, তিনি তো এখন আসামে ঘুরছেন। সঞ্জীবনী কাগজে তো ফি হপ্তায় সেখানকার কুলিদের দুর্দশা নিয়ে তাঁর লেখা বেরোচ্ছে। আজ সকালেও পড়েছি। আমার মনে হয়, দ্বারকানাথ নিজে ব্যাপারটা এখনো জানেন না। তাঁর হয়ে এখন যিনি দেখভাল করছেন, তিনিই চিঠিটি পাঠিয়েছেন।’
‘তাহলে? কী করব আমি?’ নবকিশোর দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন, ‘তিনটে মেয়েমানুষকেই পাঠিয়ে দেব?’
ধনঞ্জয় বাক্যবাগীশ এবার বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আপনি আপনার অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করা পত্নীকে অন্যের গৃহে পাঠিয়ে দেবেন? এতো বড় আশ্চর্য কথা বললেন দত্তমশাই। যাকে এত পরিকল্পনা করে আপনার পুত্রলাভের জন্য নিয়ে এলাম, তাঁকেই আপনি সামান্য এক পত্রাঘাতে ত্যাগ করতে চাইছেন।’
‘না না। ঠিক তা নয়।” দ্রুত বললেন নবকিশোর, আসলে আপনাকে কী যে বলি, আমি এখন ব্রাহ্মদের সঙ্গে বিবাদে জড়াতে চাইছি না।’
ধনঞ্জয় পণ্ডিত বললেন, ‘বিবাদে জড়ানোর প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে? এই যে গণেশ, আপনার পেছনে পেছনে সবসময় মজুত থাকে, সে তো আগে কাজ করত শামুকপোতার চৌধুরীদের বাড়িতে। চৌধুরীদের মেজতরফ আপনাকে গণেশের মতো কর্মঠ ও বুদ্ধিমান ভৃত্য উপহার পাঠিয়েছিলেন। তা তাঁদের সঙ্গে তো আপনার এখন মুখ দেখাদেখি নেই, তাহলে কি আপনি গণেশকেও তাড়িয়ে দেবেন?’
নবকিশোর দত্ত অকৃত্রিম বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। তিনি যত ধনঞ্জয় পণ্ডিতের সংসর্গে আসছেন, ততই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন। শামুকপোতার চৌধুরীবাড়ি থেকে গণেশ এসেছিল প্রায় এক দশক হয়ে গেল। শামুকপোতার জমিদারবাড়ির মেজ পুত্র হরেকৃষ্ণ আর নবকিশোরের তখন গলায় গলায় ভাব। প্রায়ই দুজনের মধ্যে লেগে থাকত উপহার পাঠানোর প্রতিযোগিতা। অধিকাংশই তুচ্ছ উপলক্ষে। তেমনই একবার মূল্যবান রেশম, মিষ্টান্ন, সুন্দরী দাসী সমেত এসে হাজির হয়েছিল গণেশ।
তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। যে কারণে নবকিশোরের সঙ্গে হরেকৃষ্ণর সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, তা অত্যন্ত গোপন।
কিন্তু সেই প্রাগৈতিহাসিক সংবাদ এই উপবীতধারী ব্রাহ্মণ কী করে জানলেন?
ইনি কি হরেকৃষ্ণকেও পুত্রবান হতে সাহায্য করেছিলেন?
পরমুহূর্তেই নবকিশোরের মনে হল, না না। তা কী করে সম্ভব! হরেকৃষ্ণ তো সেইসময়েই দুই পুত্রের জনক ছিলেন! কী যেন নাম ছিল তাঁর সেই সুন্দরী পত্নীর? লাবণ্যপ্রভা না কী যেন। সার্থকনাম্নী রমণী, তার লাবণ্যের চটকে যুবক নবকিশোরের মাথা এমনই ঘুরে গিয়েছিল, যে রাতের অন্ধকারে বন্ধুপত্নীকে বিছানায় টানতে চেয়েছিলেন।
যদিও উদ্দেশ্য সফল হয়নি। পতিব্রতা লাবণ্যপ্রভা চিৎকার করে সব পণ্ড করে দিয়েছিল।
ক্ষণিকের দুর্বলতা হলে যা হয়। কিন্তু ওতেই বন্ধুবিচ্ছেদ। হরেকৃষ্ণ পরের দিন সকালে একরকম তাড়িয়েই দিয়েছিলেন তাঁকে।
নবকিশোর ধনঞ্জয় পণ্ডিতকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। শামুকপোতার নামই যেন তিনি শুনতে পাননি, এইভাবে বললেন, ‘কী যে বলেন পণ্ডিতমশাই, বাড়ির চাকর আর ঘরের বউ এক হল?’
‘বিলক্ষণ।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত নাসারন্ধ্রে একটিপ নস্য চালিয়ে বললেন, ‘ভৃত্য আর ভার্যা দুটিই তো এসেছে ‘ভৃ’ ধাতু থেকে। দুটোকেই খাওয়াপরা দিয়ে ভরণ করতে হয়। ভৃত্য করবে খেতে শস্য উৎপাদন এবং বাইরে শ্রমদান। আর ভার্যা করবে সন্তান উৎপাদন ও ঘরের ভেতরে শ্রমদান। দুজনেরই অবশ্যকর্তব্য গৃহস্বামীর পদসেবা। ভৃত্যকে দান করা হয় ব্যবহৃত জীর্ণ পোশাক, আর স্ত্রীকে আহারান্তে দেওয়া হয় উচ্ছিষ্ট, ‘ভুক্তেবাচ্ছিষ্টংবধ্বৈ দদাৎ।’ এ আমার কথা নয় ভায়া, গৃহ্যসূত্রেই রয়েছে।’
নবকিশোর এবার চুপ করে রইলেন।
ধনঞ্জয় পণ্ডিত আবার বললেন, ‘পত্রের ভাষা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারতেন, যিনি লিখেছেন তিনি আদৌ দ্বারকানাথের আত্মীয়দের চেনেন না। তাই লিখেছেন,
‘আমার আত্মীয়াকে সত্বর আমার বাসভবনে প্রেরণ করিয়া বাধিত করিবেন।’
‘দত্তমশাই, আপনি আপনার চতুর্থ পত্নী ও তাঁর ভগ্নিকে পাঠাবেন না। ওরা ভবিষ্যতের স্বর্ণডিম্বপ্রসবিনী। আপনি বরং ওই পিসিমা মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিন। দ্বারকার এসে পৌঁছতে এখনো বেশ কিছু দেরি আছে, তদ্দিনে বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যাবে।’
সেইমতোই কাজ হয়েছিল। যেদিন কৃষ্ণসুন্দরের সপরিবারে জাহাজে ওঠার দিন, নবকিশোর গিয়ে সুকৌশলে ভুবনমণিকে আটকেছিলেন। তারপর সযত্নে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন দ্বারকানাথের গৃহে। বোনঝিদের মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে ছিলেন ভুবনমণির মুখ।
তারপরই কৃষ্ণসুন্দরের সপত্নীক সমুদ্রযাত্রা ও অপালার স্বামী-সোহাগে শয্যাশায়ী হয়ে পড়া।
১৭
স্বামীর ভালোবাসার অত্যাচারে অপালা আর ভালো হল না।
ক্রমাগত রক্তক্ষরণে শয্যার সঙ্গে লীন হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় সে যেদিন মারা গেল, সেদিন সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি। ধরিত্রীমাতা যেন নিজের এই কন্যাকে অকালে হারিয়ে ফেলে কাঁদছেন।
শহরের হাতেগোনা কয়েকটা পাকারাস্তা বাদ দিলে কাঁচাপথগুলোয় মাটি গলে কাদায় পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। মথুর সেন গার্ডেন লেনের মুখ থেকেই সেই কাদা। পথচারীরা সামান্য অন্যমনস্ক হলেই উল্টে পড়ছে। তাদের ধুতি মুহূর্তে কর্দমাক্ত হয়ে উঠছে।
রাস্তার একেবারে মুখের বাড়িটার বৈঠকখানায় বসে গড়গড়া টানছিলেন জনাইয়ের পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায়। এই বাড়িটি বছরখানেক ধরেই ভাড়া নেওয়া আছে। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি কলকাতায় এসেছেন। আগামী কয়েকদিন দফায় দফায় নানা মান্যগণ্য মানুষের সঙ্গে আলোচনা রয়েছে।
তাঁর কাছে বসে শাস্ত্রালোচনা শুনছিলেন আট-দশজন টুলো ব্রাহ্মণ। তাঁরা নেহাতই গরিব, শহরের এদিক ওদিক থেকে খবর পেয়ে এসে জুটেছেন। টুকটাক পুজোআচ্চা করে তাঁদের দিনাতিপাত হয়। বিক্ষোভ আন্দোলনে শামিল হলে তাঁদের জন্য রয়েছে দৈনিক সাম্মানিকের ব্যবস্থা। এই সংবাদ লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা শহরেই। তাই প্রতিদিনই আবির্ভাব ঘটছে নতুন নতুন বামুনের।
তাঁদের মধ্যে একজন যুক্তকরে বললেন, ‘আচ্ছা পণ্ডিতমশাই, সত্যিই কি শাস্ত্রে মেয়েদের লেকাপড়া শেখা মানা?’
পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায় গড়গড়াটা ধীরেসুস্থে নামিয়ে রাখলেন পাশে। রাখামাত্র তাঁর খিদমদগার লালু সেটা নিয়ে চলে গেল অন্দরমহলে।
পাঁচকড়ি বললেন, ‘তোমরা পুজোআচ্চা, মন্ত্রপাঠ করো, এদিকে শাস্ত্রটাই যদি ভালো করে না জানো, তবে লোকে তোমাদের কী করে ভক্তিশ্রদ্ধা করবে?’
‘আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। ওই বে, ছেরাদ্দ আর ক’টা পুজোর মন্তর মুখস্থ করে রেকেচি শুধু।’ ব্রাহ্মণ নতনেত্রে বললেন, ‘তাই তো জানতে চাই।’
পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায় বললেন, গৃহ্যসূত্র পড়ো। মনুসংহিতা পড়ো। স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে, নারীদের কখনো কোনো শাস্ত্রজ্ঞান হবে না, কারণ তাদের বেদপাঠে অধিকার নেই। তারা মন্ত্রহীন, তাই তাদের দেহ পাপস্পর্শ থেকে কখনও মুক্ত হতে পারে না। তারা মিথ্যার মতোই অপবিত্র।
নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবসিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি সিতিঃ।।
‘এই মনু কে পণ্ডিতমশাই? কোনো প্রাচীন ঋষি?’ আরেকজন ব্রাহ্মণ তাঁর ব্রহ্মশিখা দুলিয়ে প্রশ্ন করলেন।
পাঁচকড়ি বললেন, ‘মনুসংহিতার প্রথমেই মনু নিজের পরিচয় দিচ্ছেন এইভাবে—
তপস্তপ্তবাসৃজৎ যং তু স স্বয়ং পুরুষো বিরাট।
তং মাং বিত্তাস্য সর্বস্য স্রষ্টারং দ্বিজসত্তমাঃ।।
অর্থাৎ, হে শ্রেষ্ঠ দ্বিজগণ! সেই বিরাট পুরুষ বহুকাল তপস্যা করে যাকে সৃষ্টি করলেন আমিই সেই মনু, আমাকে এই সমস্ত জগতের স্রষ্টা বলে জেনো।
এখানে বিরাট পুরুষ অর্থে প্রজাপতি ব্রহ্মা। ব্রহ্মাই সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মনুর শাসনকালের অবসানে আসে দুর্ভিক্ষ, অরাজকতা। তাকে বলে মন্বন্তর। পরবর্তী মনুর বিধান শুরুতে সেই বিপদ কেটে যায়।’
‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর!’ একজন ব্রাহ্মণ অস্ফুটে বললেন।
‘মনুসংহিতার একের পর এক শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে, কীভাবে আদি মনু দশজন প্রজাপতির জন্ম দিলেন তপস্যার বলে, কোনো নারীর গর্ভে নয়। এই দশজনই পুত্র, কোনো কন্যাসন্তান নেই। সেই দশজন প্রজাপতি আবার সাতজন মনু সৃষ্টি করলেন। আদি মনুর পৌত্র সপ্তমনুর মধ্যে কারোরই স্ত্রীর উল্লেখ নেই। স্ত্রীজাতি মনুসংহিতায় সঙ্গত কারণেই বর্জিত করা হয়েছিল।’ একটানা বলে গেলেন পাঁচকড়ি।
একজন ব্রাহ্মণ টোলের ছাত্রের মতো হাত তুললেন। বললেন, ‘শুনিচি আমরা ভগবানের মুখ দিয়ে বেরিয়েচি?’
পাঁচকড়ি গর্বিত কণ্ঠে বললেন, ‘হ্যাঁ । ভগবান বলতে পরমেশ্বর ব্রহ্মা।
লোকানাং তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহুরুপাদতঃ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশ্যং শূদ্রঞ্চ নিরবর্তয়ৎ।।
ব্রহ্মা প্রথমে নিজের মুখ থেকে সৃষ্টি করলেন ব্রাহ্মণকে। বাহু এবং উরু থেকে সৃষ্টি করলেন ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যকে। শেষে নিজের পা থেকে সৃষ্টি করেছিলেন শুদ্রকে।
ধা কৃত্বাত্মনো দেহমদ্রণে পুরুষোহভবৎ।
অদ্রনে নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভু।।
তারপর ব্রহ্মা নিজের দেহকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এক অর্ধেক নারী এবং এক অর্ধেক পুরুষ হলেন। সেই পুরুষ সেই নারীতে মিলে বিরাট নামক এক পুরুষকে উৎপাদন করলেন। এই হল সৃষ্টির আদিতত্ত্ব। তাহলেই দেখতেই পাচ্ছ, আমরা ব্রাহ্মণরা কত শক্তিশালী। আর মনুসংহিতায় নারী ও শুদ্রের স্থান সবচেয়ে নীচে। অথচ মনু নিঃসন্দেহে ব্রাহ্মণ ছিলেন। নিজের মা-বোনকে এত নীচে স্থান দেওয়াটা নিশ্চয়ই না ভেবেচিন্তে করেননি। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, স্ত্রীলোক ও শুদ্রের বেদের মন্ত্র শোনাও পাপ। তোমাদেরও উচিত সেই পথে চলা। মেয়েদের শিক্ষার এই নতুন ঢং বন্ধ করতেই হবে। বুঝেছ?’
সবাই ঘাড় নেড়ে ভক্তিভরে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে লাগলেন এই অসামান্য জ্ঞানী ব্রাহ্মণকে।
সব মিটলে পাঁচকড়ি উঠে পড়লেন। আর দেরি করা চলে না। লালু এর মধ্যেই কানে কানে বলে গিয়েছে, বাইরে ছ্যাকরাগাড়ি এসে উপস্থিত হয়েছে। আজকের দিনটা একটু ফাঁকা রয়েছে, নিশ্চিন্তে মালতীর কাছ থেকে ঘুরে আসতে চান। বৃষ্টিবাদলার দিন, আজ রাতটা ওখানেই কাটাবেন। কাল সকাল থেকে পরপর অনেক কাজ রয়েছে, আর সময় হবে না। তখন আবার সুন্দরীর গোঁসা হবে।
পাঁচকড়ি মুখোপাধ্যায়ের ছ্যাকরাগাড়িটা হুড়মুড়িয়ে চলে গেল দত্তবাড়ির পাশ দিয়ে। মুখুজ্জেমশাই জানতেও পারলেন না, এখানেই শেষ শয্যায় শায়িত রয়েছে তাঁর প্রতিবেশী গ্রামের সেই কৃষ্ণসুন্দরতনয়া।
নবকিশোর দত্তের বাড়ির সামনেও অনেকক্ষণ ধরে দণ্ডায়মান রয়েছে একটি বড় এক্কাগাড়ি। তাতে করে ভোরবেলা এসেছিলেন আয়ুর্বেদাচার্য প্রসন্ন কবিরাজ। গত কয়েকদিন ধরেই আসছেন।
কিন্তু এখন তাঁর থাকার প্রয়োজন সাঙ্গ হয়েছে। তিনি একটু পরেই বাড়ি থেকে বেরোবেন। বৃষ্টি একটু ধরলে তাঁর কোচোয়ান তাই গাড়িটা মুছছে।
দত্তবাড়ির ভেতর থেকে কোনো কান্নার রোল বা আর্তনাদ ভেসে আসছে না। আসছে না কোনো উচ্চস্বরে কোলাহলও। যে বাড়িটা সারাক্ষণ দাসদাসীদের কলরোলে, গৃহকর্তার সিংহনাদে মুখরিত হয়ে থাকে, তা যেন আজ প্রস্তরপর্বতের মতোই নিশ্চল, নিঃস্পন্দ।
অন্দরমহলের চিত্রটা অবশ্য কিঞ্চিৎ অন্যরকম। দয়াময়ী একাকী তার ঘরে নির্বাকচোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। এখন আর বৃষ্টি না পড়লেও স্বচ্ছ কাচের মতো জলবিন্দু খুব ঢিমে লয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে জানলার বাইরের কার্নিশ দিয়ে।
দয়াময়ী লক্ষ করছিল, কার্নিশ থেকে ঝুলে থাকা নিম্নমুখী জলের ফোঁটাগুলো প্রথমে খুব সতর্কভাবে জন্ম নিচ্ছিল। তারপর ক্রমশ শক্তিবৃদ্ধি করে ভারী করছিল নিজেকে। তারপর একসময় ভার সামলাতে না পেরে পূর্ণবিকশিত হওয়ার আগেই খসে পড়ে যাচ্ছিল নীচে।
দেখতে দেখতে ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কত প্রাণ যে এইভাবে অকালে খসে পড়ে যায়!
ওর হঠাৎ একটু আগে দেখে আসা অপালার রক্তশূন্য মুখটা মনে পড়ে গেল। মাঝে ছ’টা দিন কেটে গিয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও মেয়েটার রক্তপাত বন্ধ হয়নি। নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে যখন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছিল, তখন প্রথম দু-তিনদিন কেউ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তারপর একরকম অনিচ্ছাসহকারেই ডেকে আনা হয়েছিল প্রসন্ন কবিরাজকে। তাঁর নানা ঔষধ-অনুপান চলেছে, ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। অপালার শীর্ণদেহটি ক্রমেই পাণ্ডুরবর্ণ হয়ে উঠেছে।
দয়াময়ীর চোখদুটোতে কেমন যেন জ্বালা করে। নিজেকে প্রাণপণ শক্ত করতে করতে সে মুখে আঁচলচাপা দেয়।
মনে পড়ে যায় গতপরশু একেবারেই অপ্রত্যাশিতভাবে শুনে ফেলা কথোপকথনটা।
প্রশান্ত বসু বলে যে ছোকরা মোক্তারটা মাঝে মাঝেই শ্মশানের শকুনগুলোর মতো ঘুরঘুর করে নবকিশোর দত্তের পেছনে, সে এসেছিল সেদিন। নবকিশোর দত্ত আর ধনঞ্জয় পণ্ডিত বসেছিলেন বৈঠকখানায়, সেখানেই সে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল।
বৈঠকখানা ঘর লাগোয়া একটা ছোট কুঠুরিতে রান্নাঘরের কিছু পুরোনো জিনিসপত্র থাকে, তেমনই কোনো প্রয়োজনে সেদিন সেখানে গিয়েছিল দয়াময়ী।
নবকিশোর দত্ত যতই গোপন রাখার চেষ্টা করুন, এইসব সংবাদ আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। মোক্তার ছেলেটি বোধ হয় কিছুটা শুনেছিল আর বাকিটা অনুমান করে নিয়েছিল। বলছিল, ‘দত্তমশাই, গতিক তো খুব সুবিধের বলে বোধ হচ্চে না!’
ধনঞ্জয় পণ্ডিত বলেছিলেন, ‘গতিক সুবিধার নয় তুমি কী করে জানলে বাছা? মোক্তারির সঙ্গে সঙ্গে কি আজকাল ডাক্তারিও শুরু করলে নাকি?’
‘না, তা নয় পণ্ডিতমশাই।’ প্রশান্ত বলেছিল, ‘আসলে আমি দত্তবাবুর ভালোর জন্যই বলচি। কোবরেজ-বদ্যিতে তো কাজের কাজ কিচু হচ্চে না। ভালোমন্দ কিচু হয়ে যাওয়ার আগে কোনো অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারকে একবার কল দিলে হয় না?’
নবকিশোর দত্ত গড়গড়ায় লম্বা টান দিয়ে বলেছিলেন, ‘পাগল হলে নাকি? বণিকবাড়ির অন্দরমহলে ঢুকবে পুরুষ ডাক্তার? ঘরের বউয়ের কাপড় তুলে তলপেট, বুক টিপে টিপে দেকবে? তোমার মাতা খারাপ হল নাকি হে? বলি বাড়ির একটা সম্মান আচে তো নাকি!’
‘বেশ তো।’ প্রশান্ত বলেছিল, ‘তবে কোনো মেমসাহেব ডাক্তারকে ডেকে আনব? এখন তো শহরে আছেন কয়েকজন। তাতে তো কোনো সমস্যা নেই।’
‘সমস্যা আছে প্রশান্ত।’ ধনঞ্জয় পণ্ডিত বলেছিলেন, ‘পবিত্র হিন্দুবাটি বিধর্মীর প্রবেশে অশুদ্ধ হয়ে পড়ে।’
প্রশান্ত বসু তবু কিন্তু কিন্তু করছিল, ‘যদি মরে যায়? তবে কিন্তু আরো বড় বিপদ দত্তমশাই। দেখছেন তো সারাদেশে কীরকম বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য আন্দোলন শুরু হয়েচে?’
‘কই জানি না তো!’ নবকিশোর দত্ত ভ্রু কুঞ্চিত করলেন, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধ? সতী বন্ধ হল, বেধবাদের বে’ চালু হল, এবার এই নতুন ধুয়ো! কে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্চে শুনি? বিদ্যেসাগর নিশ্চয়ই?’
‘না না। উনি নন। কাগজ কি পড়েন না নাকি? সমাচার দর্পণে তো রোজ এ-ই নিয়ে পাতার পর পাতা খবর!’ প্রশান্ত বলল, ‘বোম্বাইয়ের একজন পার্সি ভদ্রলোক, নাম বেহরামজি মালবারি। তিনি বিদ্যাসাগরের চেয়েও এককাঠি ওপরে। তাঁর নিজের একটা কাগজ আছে। অন্যান্য কাগজে লেখালেখি করেন। একেবারে চাবুকের মতো কলম। তাঁর বক্তব্য অল্পবয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া বন্ধ করতে হবে। এতে রুগ্ন সন্তান হয়, নিজেদের শরীর ভাঙে, বৈধব্যও আসে তাড়াতাড়ি।’
‘ইল্লি আর কী! ধেড়ে মেয়েকে বে’ করার চেয়ে লাইনের মাগি নিয়ে আসাই ভালো।’ মুখ বেঁকিয়ে বলেছিলেন নবকিশোর, ‘এইসব ম্লেচ্ছগুলোর জ্বালায় আমাদের হিঁদুয়ানি এবার রসাতলে যাবে। এদের প্রলাপে কেউ আর গুরুত্ব দেয় না।’
‘গুরুত্ব দেয় না কী বলছেন!’ প্রশান্ত বলেছিল, ‘বড়লাট রিপন তো চলে যাওয়ার আগে মালাবারির কথা অনেকবার গুরুত্ব দিয়ে শুনেছিলেন। ডাফরিন সাহেবও এসে তদন্তের কমিটি বসিয়েছেন। তবে ধাঁচটা একটু বদলেচে। বারো বছরের কম বয়সের মেয়ের সঙ্গে সহবাস করা চলবে না, এরকম কিচু পেনাল কোডে নতুন ধারা আসতে চলেচে নাকি।’
‘অ্যাঁ! মাগের বয়সও এবার গভর্নমেন্ট ঠিক করে দেবে নাকি?’ বাড়ির এই বিপদসংকুল অবস্থার মধ্যেও নবকিশোর সব ভুলে এমন চেঁচিয়ে উঠেছিলেন যে, বিস্ময়ে চমকে অন্ধকার কুঠুরিতে দয়াময়ীর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছিল।
‘কেন, এখনো তো নিয়ম রয়েছে। দশ বছর।’ প্রশান্ত গলা নামিয়ে বলেছিল, ‘কেউ মানে না তাই। কিন্তু ধরা পড়লে…।’
ভাবতে ভাবতে কোথায় চলে গিয়েছিল দয়াময়ী।
বাদলের মা ঘরে ঢুকে বলল, ‘সধবার বেশে সাজাতে তো হবে। মেজ’মা বললেন ওর বে’র শাড়িটাই পরিয়ে দিতে। কী করব মা?’
দয়াময়ী সম্বিৎ ফিরে পেল। অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘তাই কর!’
বাদলের মা প্রস্থানোদ্যত হয়েছিল, দয়াময়ী পিছু ডাকল, ‘হ্যাঁরে বাদলের মা, কোবরেজ মশাই কিচ্ছু করতে পারলেন না, নারে?’
‘উনি আর কী করবেন মা ঠাকরুন!’ বাদলের মা মুখে আঁচলচাপা দিয়ে বলল, ‘নতুন বউ তো কাল থেকে ঘনঘন মুচ্ছা যাচ্চিল, আজ ভোরে সেই যে মুচ্ছা গেল, আর ফিরল না।’
জলবিন্দু এখনো টুপটাপ ছন্দে খসে পড়ছে কার্নিশ থেকে। অদূরে গাছের ভেজা পাতায় জল পড়ে নড়ে উঠছে তিরতির করে। নীচের বাগানে আজ পালোয়ানরা কুস্তি লড়ছে না। বৃষ্টির জন্য না অন্য কারণে, কে জানে।
দয়াময়ীর কানে মহাকালের কোন অতল থেকে ভেসে আসে কাতরকণ্ঠে বলা কয়েকটি শব্দ।
‘আমি মরতে চাই না দিদি। আমি মরতে চাই না!’
১৮
মোতি তার সুরমাপরা দু’চোখে ঝিলিক তুলে বলল, ‘আপনি দিনরাত ওই বুঢঢা নবাবের ঘরে খিল এঁটে কী করেন?’
চন্দ্রনাথ নদীতে ছোট ছোট ঢিল ছুড়ছিল। সেগুলো নিস্তরঙ্গ জলে পড়ে ছোট ছোট বৃত্তাকার তরঙ্গের সৃষ্টি করছিল। ও বলল, ‘খিল এঁটে?’
‘তা নয়তো কী?’ মোতি তার বাহারি ওড়নার খুঁট মুখে চাপা দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ল, ‘গুলশন বলছিল, বন্ধ ঘরের বাইরে থেকে নাকি নবাবের কান্না শোনা যায়।’
চন্দ্রনাথ গুলশনকে চিনতে পারল না। সুলতানখানা থেকে শুরু করে সমস্ত নবাবি মঞ্জিলেই অসংখ্য পরিচারিকা কাজ করে। গুলশন হয়ত তাদেরই কেউ।
বার্ধক্যে উপনীত হয়ে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ-র এখন জীবনী রচনার শখ হয়েছে। আর সেই শখ মেটানোর ভার পড়েছে চন্দ্রনাথের ওপর। রোজ বিকেলে চন্দ্রনাথ নিজের কোঠিবাড়ি থেকে বেরিয়ে গুটিগুটি পায়ে চলে যায় সুলতানখানায়। হাতে থাকে কয়েক দিস্তা কাগজ, কলমতরাশ ছুরি আর বেশ কিছু নরকট। সেইসব নিয়ে কোনোদিকে দৃকপাত না করে সে সটান উঠে যায় ছাদে।
প্রহরীরা তাকে এতদিনে বেশ চিনে গিয়েছে। ছোট সেলাম ঠুকে তাঁরা বল্লম সরিয়ে উন্মুক্ত করে দেয় দ্বার।
ছাদের ওপর সেই পরিচিত ভঙ্গিতে বসে আনমনা নবাব উদাস ভঙ্গিতে তারপর একে একে বলে যান তার শৈশব, কৈশোর, যৌবনের কথা। তাঁর কথায় কখনো আসে ফেলে আসা লক্ষ্নৌনগরীর সুন্দরীরা, কখনো ইংরেজদের অন্যায়ের কথা।
এই কয়েকদিনে প্রায় সবই তিনি বলেছেন চন্দ্রনাথকে।
সিংহাসনে প্রথম আরোহণের পর তাঁর শাসক হিসাবে অতিসক্রিয়তা ও প্রজাদের কাছে জনপ্রিয়তা খর্ব করতে রাজ্যের ইংরেজ রেসিডেন্ট কীভাবে কৌশলে তাঁকে ঠুঁটো করে দিয়েছিল, ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস সহ ব্যক্ত করেছেন।
অসংকোচে জানিয়েছেন, তিনি স্বভাবপ্রেমিক। মাত্র আটবছর বয়সে লক্ষ্নৌয়ের প্রাসাদে মায়ের এক বয়স্ক পরিচারিকার কাছে তিনি নিয়েছিলেন যৌনশিক্ষার প্রথম পাঠ। তারপর একে একে জীবনে এসেছে বহু নারী। পনেরো বছর বয়সে প্রথম বিবাহের পর মৌমাছির মতো বহুফুলের মধু খেয়েছেন তিনি। হারেমের মেয়েদের নিয়ে বানিয়েছিলেন ‘পরিখানা’।
‘বেটা তু জানতা হ্যায়, তোদের যে রাসযাত্রা হয়, সেই আদলে আমি একটা নাটক লিখেছিলাম। রাধা কৃষ্ণ কা কিসসা। লোগোনে বহত তারিফ কিয়া। কৃষ্ণ সেজেছিল আমার পরিখানার মাহরোক পরি। আহা, ক্যা আদায়ে থি উসকি। এতদিন পর মুখটা সেভাবে মনে পড়ে না, কিন্তু গুলাবের মতো গাল দু’খানা মনে আছে বেশ। সুলতান পরি সেজেছিল রাধা। আহাহা, ক্যা খুবসুরত দিন থা উয়ো!’
এইভাবে সারারাত নবাব স্মৃতিচারণ করেন আর চন্দ্রনাথ লেখে। কোনো কোনোদিন বলতে বলতে নবাব চিৎকার করেন, কাঁদেন, অনর্গল শায়েরি আউড়ে যান। শেষে পূর্বাকাশে যখন সূর্যদেবের উদয়াভাষ পাওয়া যায়, তখন নবাবের চোখ ক্লান্তিতে জুড়ে আসে। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়ায় তিনি শিশুর মতো ওইভাবেই ঘুমিয়ে পড়েন ছাদে। চন্দ্রনাথ তখন নিঃশব্দে উঠে গিয়ে খবর দেয় খানসামাদের। তারপর সে চলে যায় নিজের ঘরে।
সেইসব কথা ভাবতে ভাবতে চন্দ্রনাথ এখন বাস্তবে ফিরে এল। সে আর মোতি বসে আছে গঙ্গার ঘাটে। মূল মেটিয়াবুরুজ থেকে এই ঘাট কিছুটা দূরে। বিকেল প্রায় পড়ে এসেছে। সন্ধ্যা হয় হয়।
মোতি আজ পরে আছে গোলাপি রঙের একটা ঘাগরা। অবগুণ্ঠনহীন মাথা থেকে সাপের মতো মোটা বিনুনি এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে পিঠ ছাপিয়ে কোমরের দিকে। সেই বিনুনির ফাঁকে ফাঁকে খেলা করছে জড়োয়ার গয়না।
ঘাটের পাশ দিয়ে যারাই যাচ্ছে, তাদের কৌতূহলী চোখ একবার করে চলে যাচ্ছে মোতির কাজলটানা চোখের দিকে।
কিন্তু মোতি নির্বিকার। সামনের আঁটসাঁট বক্ষাবরণটির একপ্রান্ত সে আলগোছে পাকাচ্ছে এক হাতে। কারণে অকারণে হেসে উঠছে।
চন্দ্রনাথের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কাফি খাঁ-র সেই সাবধানবাণীর পর সে কয়েকদিন সচেতনভাবে মোতিকে এড়িয়ে যাচ্ছিল। মোতি বারবার তার ছুটকি নামক বালিকা দাসীকে দিয়ে এত্তেলা দিয়ে পাঠালেও সেতার শেখাতে যাচ্ছিল না। নানা ঘাটের জল খেয়ে সে অবশেষে এখানে থিতু হয়েছে, নবাবের নেকনজরেও রয়েছে। কোনোভাবেই সে এই নিশ্চয়তাকে নষ্ট করতে রাজি নয়।
কিন্তু কিছুদিন আগে একটা অবাক করা ঘটনা ঘটেছে। চন্দ্রনাথ তখন আশাদ মঞ্জিলের বারমহলে বসে নবাবকে গজল শোনাচ্ছিল। সেদিন সে আর তবলচি ছাড়া কেউ ছিল না নবাবের কাছে।
আর তখনই সটান নবাবের সামনে এসে হাসিমুখে সেলাম ঠুকেছিল মোতি।
চন্দ্রনাথ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। মোতি অপাঙ্গে একবার ওর দিকে তির্যক দৃষ্টি হেনে এগিয়ে এসেছিল। তারপর নবাবের পায়ে কদমবুশি করে বলেছিল, ‘আদাব খোদাবন্দ।’
‘কৌন হ্যায় তু?’ নবাব বিস্মিত চোখে তাকিয়েছিলেন।
‘মোতি। ফতেহ চকে থাকি। আপকা এক মুতআ বেগমকি বেটি।’
চন্দ্রনাথ অবাক হয়ে দেখেছিল, শেষ বাক্যটা শুনে নবাবের সেভাবে কোনো ভাবান্তর হয়নি। বরং এক চিন্তিত প্রশাসকের মতো বলেছিলেন, ‘মাহিনা নেহি মিল রহি হ্যায় ক্যা?’
‘নেহি। মাহিনা মিল রহে হ্যায়। মেরি মা গুজার গয়ি, আব মুঝে মিল যাতে হ্যায়।’ মোতি একটু থেমে সরাসরি চন্দ্রনাথের দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, ‘মেহেরবানি করকে আপ উসকো মেরা ঘর জানে কে লিয়ে বোল দিজিয়ে জাহাঁপনা। মেরা সিতার শিখনে কি বহত দিক্কত হো রহি হ্যায়।’
গোটা বিষয়টি অনুধাবন করে নবাব ফেটে পড়েছিলেন অট্টহাস্যে। চন্দ্রনাথকে হতবাক করে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘মেটিয়াবুরুজের কলাকার হয়ে তুই এমন বেরসিক কী করে হলি বেটা? ইতনি খুবসুরত এক লেড়কি তোর কাছে সিতার শিখতে চাইছে, কোথায় তুই মনপ্রাণ উজাড় করে তাঁকে সেখাবি, তা না, এই বুঢঢার কাছে বসে আছিস? ক্যায়সা জওয়ানি হ্যায় তেরা?’
চন্দ্রনাথের মতামতের অপেক্ষা করেননি নবাব। মোতিকে বলেছিলেন, ‘তু ঘর যা বেটি। আজ সে উয়ো হরদিন তেরে ঘর জায়েঙ্গে। ইয়ে মেরা ওয়াদা হ্যায়। ঠিক হ্যায়?’
মোতি আবার কদমবুশি করেছিল তার পিতার পায়ে। তারপর চন্দ্রনাথের দিকে একবার তাকিয়ে উজ্জ্বল চোখে প্রায় উড়তে উড়তে বেরিয়ে গিয়েছিল মহল থেকে।
নবাবের হুকুমের পর আর কোনো কথা চলে না। চন্দ্রনাথকে রোজ বিকেলে সেতার শেখাতে আসতে হয় মোতিকে। রসিক নবাব মধ্যরাতে জীবনী রচনা করতে বসে খোঁজও নেন, চন্দ্রনাথ মোতির কাছে গিয়েছে কিনা।
নবাবের আশকারায় মোতির সাহস এখন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। সেতার সে মন দিয়ে শেখে, তবে মাঝে-মাঝেই মাস্টারকে পর্যুদস্ত করতে ছাড়ে না। চন্দ্রনাথ কপট রাগ দেখালে সে আবার নবাবকে বলে দেওয়ার ভয় দেখায়।
শুধু যেদিন নবকিশোরের পালকি এসে দাঁড়ায় তার বাড়ির সামনে, ছুটকি গোপনে ছুটে যায় চন্দ্রনাথের কোঠার দিকে। বারণ করতে।
এভাবেই চলছে।
চন্দ্রনাথ লক্ষ করেছে, মোতি মেয়েটা বেশ অন্যরকম। কখনো কখনো তার অত্যধিক প্রগলভতায় বিরক্তি জাগে, আবার কখনো চেনা মেয়েটাই কেমন অচেনা হয়ে ওঠে। তখন অনেক বুঝিয়েও তার মেজাজ ঠিক করা যায় না, নির্বাক নিষ্প্রাণ চোখে সে তখন শুধু তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে।
সৌভাগ্যক্রমে আজ তার মেজাজ খুব প্রসন্ন রয়েছে। দূরে মাঝগঙ্গায় ভাসতে থাকা নৌকোগুলো দেখতে দেখতে সে খিলখিল করে হেসে লুটিয়ে পড়ছে, কপালের সামনে থোকার মতো ঝুলে থাকা কুচো চুলগুলো এসে পড়ছে চোখের ওপর।
চন্দ্রনাথ বলল, ‘তোমার ওই গুলশনের নাম পাল্টে গুলবদন করে দেওয়া উচিত। আমি তো নবাবের সঙ্গে ছাদের ওপর থাকি। সে দরজা, খিল এসব পেল কোত্থেকে?’
মোতি বলল, ‘বাহ, তা আমি কী জানি? গুলশন তো সুলতানখানায় আতর ছিটাতে যায়, আমি ভাবলুম সে বুঝি সবই জানে। তা আপনিই বলুন, কী করেন আপনারা ছাদের ওপর? নবাব তো সারাদিন গান শোনেন, রাতেও তাই করেন?’
‘না।’ চন্দ্রনাথ গম্ভীর গলায় বলল, ‘নবাব বলেন। আমি লিখি।’
‘কী লেখেন?’
‘নবাবের জীবনের নানা ঘটনা। ওঁর লক্ষ্নৌর দিন। সেখানকার ঠাটবাট। মেটিয়াবুরুজে আসার পরের নানা ঘটনা। এইসব।’ চন্দ্রনাথ বলল।
মোতি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। এইভাবে যে কারুর গোটা জীবনটা লিখে রাখা যায়, সেই ভাবনাটা সম্ভবত ও প্রথম শুনল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘এখানকার কথা কী লেখেন?’
‘অনেক কিছু। কলকাতায় আসার পর সাহেবরা কীভাবে নবাবকে ফোর্ট উইলিয়ামে বন্দী রেখেছিল, কীভাবে নবাবের মা-ভাইদের বিলেতে ইন্তেকাল হল, মেটেবুরুজে এসে নবাব কীভাবে নতুন পরিখানা বানালেন, এতগুলো ইমারৎ গড়লেন, চিড়িয়াখানায় জন্তুজানোয়ার আমদানি করলেন, সব।’
মোতি নিজের পাতলা গোলাপি ঠোঁটটা কামড়ে ধরে বলেছিল, ‘আচ্ছা, আমার আম্মুর কথা লিখেছেন কিছু?’
‘তোমার মা?’
মোতি নিজের কাঁচুলির মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট বিবর্ণ হয়ে যাওয়া হলদেটে ছবি বের করেছিল। হাতে আঁকা ছবি। বহুদিন ধরে চাপা জায়গায় থেকে থেকে কেমন অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবু তার মধ্যে বোঝা যায় একটি নারীর আবছা প্রতিকৃতি। পরনে ঘাগরা, মাথায় ওড়না। মুখের আদল কিছুটা মোতির মতোই।
মোতি চাপা গলায় বলল, ‘বাহারুন্নিসা বেগম। আমার আম্মু। সুলতানখানায় ধোপাওয়ালির কাজ করত। একদিন নবাবের চোখে পড়ে গেল। মুতআ করে তিনরাত মঞ্জিলে রাখলেনও। কিন্তু তারপর দেখলেন, আম্মু নাচগান একেবারেই পারে না। তাই পরিখানায় জায়গা হল না। আম্মু চলে এল বাইরের দিকে কোঠাবাড়িতে। তারপর আম্মুর নসিব আর ফেরেনি।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি? নবাবের সেই তিনরাত্তিরের পেয়ারে ম্যায় ধরতি পর আ গয়ি। দিন গুজরতে লাগল, আমিও বড় হতে লাগলাম। আমি বোধ হয় নবাবের নাচা গানার শখ পেয়েছিলাম। আম্মু অনেক কষ্ট করে উস্তাদ রেখে আমায় গান শেখাচ্ছিলেন। মুজরো করতেও শিখছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন আম্মু মরে গেল। পেটের জ্বালা মেটাতে তখন আমাকে নামতে হল বাঈজিগিরি করতে।’ মোতি গড়গড়িয়ে বলে গেল।
এই গরমের দিনেও চন্দ্রনাথের কেমন শীত শীত করছিল। বস্তুত নবাবের যে রূপ সান্নিধ্যে আসার পর থেকে দেখে আসছে, তাতে ও এইটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছে যে, নবাব স্বভাব দার্শনিক। তিনি মদ্যপান বা অন্য কোনো নেশা করেন না। তাঁর নেশা বলতে সঙ্গীত ও সাহিত্যচর্চা এবং রমণীসঙ্গ।
সত্যি বলতে কি, কোনো বৃদ্ধ যে এখনো রমণীসঙ্গের জন্য এতটা ব্যাকুল হতে পারেন, তা নবাবের সংস্পর্শে না এলে বিশ্বাস করা যায় না।
কিন্তু নিজের ঔরসজাত কন্যার প্রতিও কি কোনো টান নেই তাঁর?
ওর মনে পড়ে গেল, একদিন রাতে কথায় কথায় নবাব বলেছিলেন, তাঁর বৈধ সন্তানসংখ্যা তেরো। আট পুত্র। পাঁচ কন্যা। কিন্তু মুতআ বেগমদের সন্তানদের ধরলে সেই সংখ্যা কোথায় পৌঁছবে কে জানে!
সেই শতাধিক জারজ হতভাগ্য সন্তানদের মধ্যে মোতিও একজন। যাদের জন্মের পর থেকেই ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে অন্ত্যজ হয়ে বেঁচে থাকার। বিশ্বের আদিমতম ব্যবসায় নেমে জীবনধারণ করার।
চন্দ্রনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনুভব করল, প্রত্যেক মানুষেরই অন্তর ধূসর কুয়াশার চাদরে মোড়া। কেউ সম্পূর্ণ কালো বা সম্পূর্ণ সাদা হয় না। সাদা-কালোর দ্বৈত সহাবস্থানই মানুষের মন।
নবাবের আপাত শিশুসুলভ মানসিকতা, শিল্পপ্রিয়তা তাঁকে যতই শ্রদ্ধার আসনে বসাক, ইংরেজদের অভিযোগ অনুযায়ী শাসক হিসেবে তাঁর অপদার্থতা এবং জন্মদাতা হয়েও সন্তানদের প্রতি এই কর্তব্যহীনতার জন্য তিনি ক্ষমার যোগ্য নন।
‘আপ ক্যা সোচ রহে হ্যায়?’ মোতি হঠাৎ চন্দ্রনাথের হাতের ওপর তার নরম হাতটা রাখল।
চন্দ্রনাথ শিহরিত হয়ে উঠল। তার নিজের গ্রাম খাদাকুঁড়িতে কোনো মেয়ে প্রকাশ্যে অনবগুন্ঠিতা অবস্থায় একা বেরোত না। বাসস্থানের সামনে বিকেলবেলা একজোট হয়ে গল্পগুজব করলেও সেখানে কোনো পুরুষের আগমন ছিল অচিন্ত্যনীয় অপরাধ।
সেখানে মেটিয়াবুরুজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চেয়েও এগিয়ে। এখানে মেয়েরা অবলীলায় প্রকাশ্য জনপথে হাঁটে। বাড়ির রোয়াকে বসে নিজেদের মধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে, ইশারা করে। পুরুষরাও তা উপভোগ করে। মেটিয়াবুরুজের প্রায় সব স্ত্রীলোকই বারবনিতা।
কিন্তু তাই বলে প্রকাশ্য দিবালোকে হাতে হাত?
সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে কয়েক মাস আগে তুলসীর সেই অভিমানভরে বলা কথাটা মনে পড়ে গেল।
‘তুমি ওকানে গিয়ে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়বে না তো চাঁদদাদা?’
১৯
গোধূলিবেলা। সূর্যদেব অস্ত যাওয়ার প্রাক্কালে হরিদ্রাভ নরম রোদ বিকিরণ করছেন চারপাশে। পাখিরা নিজেদের কাজ গুটিয়ে নিচ্ছে, একটু পরেই তারা উড়ে যাবে নিজেদের বাসস্থানে।
ব্যস্ত কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রিটে বেশ জনসমাগম। কিছুক্ষণ অন্তরই টগবগিয়ে ছুটে যাচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি, কখনো এক্কা কখনো জুড়ি। তাদের কোচোয়ানের ‘হেঁইয়ো’ ডাকে চমকিত হওয়ার আগেই এসে পড়ছে কোনো পালকি। পালকিবাহকদের ‘হুহুম না হুহুম না’ ডাক ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে।
পথচারীরা হেঁটে চলেছে। দ্রুত তাদের গতি। তাদের মধ্যে কেউ ঝাঁকাওয়ালা, কেউ মুটেওয়ালা। কারুর হাতে আবার বই দেখে বোঝা যায় সে ছাত্র।
এমনই একজন ছাত্র হেঁটে চলেছিল। তার নাম সৌরেন্দ্র। বয়স কুড়ি ছুঁয়েছে সবে। সে আগের বছর মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে বি এ পাশ করেছে। বাড়ি পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ জেলায়। তার এখন খুব ইচ্ছে ডাক্তারি পড়ার।
কর্ণওয়ালিস ষ্ট্রিটে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের যে উপাসনা মন্দিরটি রয়েছে, তার বিপরীতের বাড়িটির সামনে উপস্থিত হয়ে সৌরেন্দ্র কিছুক্ষণ দাঁড়াল। তারপর পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল।
এই বাড়িটি তিনতলা ও সুবিশাল। এদিক ওদিক জানলা ও তাতে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড়ের পরিমাণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, বাড়িতে সদস্যসংখ্যা অনেক।
সৌরেন্দ্রর ভাবগতিক দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সে আর এগোতে ইতস্তত করছে। খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করল। কিন্তু সেভাবে কাউকে না দেখতে পেয়ে একরকম বোধ হয় নিরুপায় হয়েই এগোল বাড়ির প্রধান দরজার দিকে।
প্রধান দরজায় এসে করাঘাত করার আগেই দরজাটা সশব্দে খুলে গেল। অন্য একটি তরুণ হাস্যোজ্জ্বলমুখে বলল, ‘এই তো! তোমার কথাই ভাবছিলাম। এসো এসো।’
সৌরেন্দ্র বেশ সঙ্কুচিত ছিল। কিন্তু বন্ধুর স্বতঃস্ফূর্ত ও জড়তাহীন ব্যবহারে সে মুহূর্তে সহজ হয়ে উঠল। তার বন্ধু উপেন্দ্রকিশোর আলিঙ্গনের জন্য দু-হাত বাড়াতেই সে জড়িয়ে ধরল তাকে। মাঝের কয়েক মাস যে ঝড় তার ওপর দিয়ে গিয়েছে, যে প্রচণ্ড অনাদরে অপমানে তার দিন কেটেছে, তারপর একজনের কাছ থেকে এমন উষ্ণ আলিঙ্গন তাকে দুর্বল করে তুলল। সে আবেগপ্রবণ মানুষ, মুহূর্তে চোখের পাতা ভিজে উঠল।
উপেন্দ্রকিশোর বলল, ‘চলো, আর দেরি কোরো না। বাবামশাইকে তোমার কথা বলে রেখেছি। উনি অপেক্ষা করছেন।’
বাম হাতের চেটো দিয়ে চোখের কোনা মুছে সৌরেন্দ্র বন্ধুকে অনুসরণ করল।
এই বাড়িটি তার বন্ধু উপেন্দ্রকিশোরের শ্বশুরালয়। উপেন্দ্রকিশোরের বিবাহ হয়েছে বছরখানেক হল, সে এই বাড়িতেই থাকে।
বাড়ির মধ্যে বেশ কিছু অলিগলি ও ঘর পেরিয়ে তাকে নিয়ে উপেন্দ্রকিশোর যে ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হল, সেটি প্রকাণ্ড এবং চারটি দেওয়ালের প্রায় পুরো অংশটাই বইয়ে ঠাসা। একদম মাঝখানে একটি বড় পড়ার টেবিল। তাতে এই দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছে। সেখানে বসে মনোযোগ সহকারে কিছু লিখে চলেছেন এক প্রৌঢ়। কৃষ্ণবর্ণ একহারা দেহ, দীর্ঘকায় হওয়ায় টেবিলটি তাঁর পক্ষে একটু নীচু হয়ে গিয়েছে। ফলে কিছুটা ঝুঁকে লিখতে হচ্ছে তাঁকে।
লেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনে তিনি বিড়বিড় করছেন। সমান্তরালে কাঁপছে তার কাঁচাপাকা গোঁফটিও।
সৌরেন্দ্রর বুকের ভেতর কেউ যেন দুম দুম করে হাতুড়ি পেটাচ্ছিল।
ইনিই সেই অবলাবান্ধব দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়? ‘সঞ্জীবনী’তে যার প্রখর যুক্তিজালে রচনা করা প্রবন্ধ পড়ে সে শিহরিত হয়ে ওঠে? ইনিই সেই, যিনি ‘বীর নারী’ লিখেছেন? বীর শব্দের সঙ্গে যে নারীর মেলবন্ধন ঘটানো যায়, সেই কাব্য না পড়লে যে সে জানতেই পারত না।
আর যবে থেকে সেই কাব্য পড়েছে, তবে থেকে বাস্তবে অমনই একটি বীরাঙ্গনাকে দেখার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।
উপেন্দ্রকিশোর এক ঝলক বন্ধুর দিকে তাকাল, তারপর ঘরের ভেতরদিকে মুখ ঘুরিয়ে নম্রকণ্ঠে বলল, ‘বাবামশাই, আসব?’
দ্বারকানাথ মুখ তুলে তাকালেন। চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি।
উপেন্দ্রকিশোর গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘আমার যে বন্ধুর কথা বলেছিলাম আপনাকে, সে এসেছে। ওর নাম সৌরেন্দ্র ঘোষাল। বাড়ি ময়মনসিংহে, মসুয়া গ্রামে। এখানে থাকত শিয়ালদার এক মেস বাড়িতে।’
দ্বারকানাথ ভালো করে একবার নিরীক্ষণ করলেন সৌরেন্দ্রকে। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ । মনে আছে। এসো। ভেতরে এসো।’ তারপর সামান্য পিছন ফিরে কাউকে একটা বললেন, ‘কিরে, তোর হল?’
সৌরেন্দ্র এতক্ষণ লক্ষ্য করেনি, বিশাল পড়ার টেবিলের পেছনদিকে মেঝেতে শতরঞ্জি পেতে বসে উবু হয়ে বসে রয়েছে এক তরুণী বিধবা। নিরাভরণ। ঘরে অপরিচিত যুবকের প্রবেশে সে কিছুক্ষণ আগেই মাথায় ঘোমটা টেনেছে, কিন্তু সেই অবস্থাতেই দোয়াতে কলম ডুবিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে কী যেন লিখছে সাদা কাগজে।
দ্বারকানাথের প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি মিনমিন করে বলল, ‘পি-এর পরে কী, কিছুতেই মনে করতে পারচি না নতুন দাদা। এস?’
দ্বারকানাথ বিরক্তমুখে বললেন, ‘প্রতিদিন ওই পি-তেই গিয়ে তুই কেন হোঁচট খাস, সেটা তো বুঝতে পারি না বাপু। পি-এর পরে কিউ। তারপর আর, তারপর এস। এত সাধারণ ভুল বারবার করলে কে তোকে ইশকুলে ভর্তি নেবে ভুবন?’
ভুবন নামের মেয়েটি অপরাধী মুখে অমনি হুমড়ি খেয়ে খাতার ওপর বড় বড় করে কিউ লিখতে লাগল।
রকম সকম দেখে সৌরেন্দ্রর হাসি পেল। মেয়েটির পুরো নাম কী? ভুবনময়ী না ভুবনমোহিনী? যাইহোক, উপেন্দ্রকিশোর এগিয়ে যাচ্ছে দেখে সে পিছু পিছু গিয়ে দ্বারকানাথকে প্রণাম করল।
দ্বারকানাথ চোখ থেকে চশমা খুললেন। সৌরেন্দ্রর দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘বাড়ি থেকে কি শুধু তাড়িয়েছে? নাকি সঙ্গে খাইখরচের টাকা পাঠানোও বন্ধ করেছে?’
সৌরেন্দ্র নতনেত্রেই লজ্জিতভাবে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে, বাবা আর টাকাও পাঠাচ্ছেন না তিনমাস হল।’
‘হুম।’ দ্বারকানাথ বললেন, ‘তবে আর কি। আমার ভিটে তো রয়েইছে, এখানেই তল্পিতল্পা নিয়ে চলে এসো। সামনেই মেডিকেল কলেজে ভর্তি শুরু হবে। বি এ পাশ করেছ যখন, চান্স পেয়ে যাবে। তবে একটা কথা আগেভাগেই বলে রাখি বাপু, আমরা খুব সাদামাটা খাই। সপ্তাহে তিনদিন নিরামিষ, চারদিন আমিষ। মাংস এবাড়িতে ঢোকে না। তা তোমার এতে চলবে তো?’
সৌরেন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে লম্বা করে ঘাড় নাড়ল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ বাবামশাই। খুব চলবে।’
আবেগে তার চোখে জল এসে পড়েছিল, কোনোমতে লুকিয়ে সেই জলটুকু সে মুছে নিল। জন্মাবধি দারিদ্র কাকে বলে সে জানত না। ছোট থেকে বিত্তের মধ্যেই বড় হয়েছে। তার বাবা পূর্ববঙ্গের ছোটখাট একজন জমিদার। তিনি চেয়েছিলেন সৌরেন্দ্র জমিদারির কাজ ধীরে ধীরে শিখুক। কিন্তু সে নিজে মহল পরিদর্শনের চেয়ে বইয়ের পাতায় ডুব দিতেই বেশি ভালোবাসত। কাছারিবাড়িতে হিসাবের খাতায় চোখ বুলোনোতে ছিল তার ঘোর অনীহা।
নিজের লেখাপড়া শেখার আগ্রহে ও মেধার জোরে বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও সে পড়তে এসেছিল কলকাতায়। শিয়ালদা স্টেশনের কাছে একটা মেসবাড়িতে ভাড়া নিয়েছিল গোটা তিনতলাটা। ও নিজে আপত্তি তুললেও বাবা সেদিন শোনেননি। জমিদারতনয় হয়ে সে কি যেমন তেমন ছেলেদের সঙ্গে একঘরে থেকে জাত খোয়াবে নাকি? তার জন্য গোটা তিনতলা সাজানো হয়েছিল বড় পালঙ্ক, দেরাজ, জাজিমের গদিতে।
প্রতিমাসে ময়মনসিংহ থেকে তার জন্য আসত ফল, মিষ্টি, আরো কতরকম জিনিস। সৌরেন্দ্র সেসব ভাগ করে খেত বন্ধুদের সঙ্গে। এইভাবে সে পাশ করল এন্ট্রান্স, এফ এ।
কিন্তু, তারপরই ছোটখাটো একটা বজ্রপাত ঘটে গেল তার জীবনে। তখন সে বি এ পড়ছে।
হঠাৎ করেই সে এসে পড়ল এক নব্য যুবকদলের সংস্পর্শে। যারা বিশ্বাস করে না সনাতন পৌত্তলিকতায়। যারা যুগযুগ ধরে চলে আসা কুসংস্কারগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়। যারা বিশ্বাস করে, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। এবং তাঁকে পাওয়ার একমাত্র উপায় নিঃশর্ত উপাসনা।
উপেন্দ্রকিশোরের মতো ব্রাহ্ম বন্ধুদের ছুঁৎমার্গশূন্য ও কুসংস্কারহীন চিন্তার জোয়ারে ভেসে সৌরেন্দ্র উদ্বুদ্ধ হয়ে যেদিন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হল, ঘটনাচক্রে সেদিনই দেশ থেকে এসে উপস্থিত হলেন ওর বাবা। যদিওবা পরে রয়েসয়ে দুঃসংবাদটা পাঠানো যেত, নেহাতই দৈবের দুর্বিপাকে তা আর হল না।
একমাত্র পুত্রের এহেন পদস্খলনে বাবা বজ্রাহত হয়ে গেলেন। তারপর পুত্রের ঘরে আর জলস্পর্শ পর্যন্ত করলেন না। বেরিয়ে গেলেন।
পরে দেশ থেকে এল এক দীর্ঘ পত্র। পুত্রকে কলকাতায় পাঠিয়ে তিনি যে কত বড় ভুল করেছেন, সেই আক্ষেপই বর্ণিত হয়েছিল চিঠির ছত্রে ছত্রে। সৌরেন্দ্রকে তিনি আর পুত্র বলে স্বীকার করেন না। তাই সৌরেন্দ্রও যেন আর ময়মনসিংহে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা না করে। যদি যথোপযুক্ত প্রায়শ্চিত্ত করে সে হিন্দু ধর্মে ফেরত যেতে স্বীকৃত হয়, তবে তিনি সানন্দে পুত্রাগমনের প্রতীক্ষা করবেন।
সেই প্রথম। তারপর এই কয়েক মাসে নানারকম প্রলোভন দেখানো হয়েছে তাকে। কখনো দেওয়া হয়েছে অসুস্থ মায়ের দোহাই, কখনো দেশ থেকে জমিদারি দেখাশোনা করার দায়িত্বে থাকা নায়েব মহাশয় এসে বুঝিয়েছেন তাকে।
এমনকী, দেশে যে তার জন্য পরমাসুন্দরী একটি পাত্রী নির্ধারিত হয়ে রয়েছে, হিন্দুত্বে ফেরামাত্র গোটা গ্রাম জুড়ে বেজে উঠবে নহবত, সেই নববধূর অলক্তরঞ্জিত পদচিহ্নে ভরে যাবে সৌরেন্দ্রর মহল, তার প্রলোভনও দেওয়া হয়েছে বারবার।
কিন্তু সৌরেন্দ্র কিছুতেই বিচলিত হয়নি। জন্মাবধি যে ধর্মের জীর্ণ অনুশাসন সে প্রতিফলিত হতে দেখেছে নিজের পরিবারে, পারিপার্শিক সমাজে, তার অসারতা উপলব্ধি করে সে বীতশ্রদ্ধ, বিরক্ত। ব্রাহ্মধর্মের মুক্তমনা সংস্পর্শে এসে সে বুঝেছে, বর্তমান হিন্দু ধর্মের অধিকাংশ আচার বিচার আদিবৈদিক যুগের অনুশাসনের বিকৃত অপভ্রংশ মাত্র। আদি যুগে যে বেদে ছিল নারীপুরুষের স্বচ্ছন্দ সহাবস্থানের উদাহরণ, নারীরা যেখানে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আলোকপ্রাপ্তা হতেন, প্রকাশ্যে বেরোতেন, এমনকী অধ্যাপনা করতেন, কয়েক শতাব্দী পরেই স্মার্ত পণ্ডিতদের স্বকল্পিত ও স্বপ্রণোদিত শাস্ত্রে ক্রমশই তাঁদের ঠেলে দেওয়া হল অন্তরালের অন্ধকারে। রুদ্ধ করা হল তাঁদের শিক্ষা, চাপানো হল নানারকম বিধিনিষেধ। গৃহ্যসূত্র, মনুসংহিতার মতো অনুশাসনে ছেয়ে গেল দেশ। মানুষ বিস্মৃত হল ঋকবেদের সমতা, আঁকড়ে ধরল পরবর্তী যুগের অপভ্রংশগুলোকে।
শুরু হল বাল্যবিবাহ, সতীদাহের মতো কুৎসিত প্রথাগুলি।
নারীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমাজে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল বর্ণাশ্রম। ব্রাহ্মণ, সে যতই হীন হোক—সর্বশ্রেষ্ঠ, আর শূদ্র, সে যতই মহৎ হোক—সে নীচ। এই বৈষম্যে অভ্যস্ত হতে শুরু করল সমাজ।
সৌরেন্দ্র বিশ্বাস করে, নারী ও শূদ্রের প্রতি এই প্রচণ্ড অবিচারের জন্য হিন্দু ধর্মের আজ এই দশা। রামমোহনের দেখানো পথে সেও বিশ্বাস করে, ধর্মান্তর নয়, কুসংস্কারমুক্ত হয়ে আদি বেদকে আঁকড়ে ধরলেই হবে সমাজ সংস্কার। আর সেই জন্যই পরিবারের কোনোরকম আকর্ষণে সে প্রলোভিত হয়নি। দীক্ষিত হয়েছে ব্রাহ্ম ধর্মে। যুক্ত হয়েছে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে। প্রতিজ্ঞা করেছে শিবনাথ শাস্ত্রী, উমেশ দত্ত, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির মতো মানুষের প্রভাবে থেকে সে ভালো কিছু কাজ করবে।
বাবা ধীরে ধীরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। বুঝেছেন কোনো শর্তেই তাঁর এই জেদি অবাধ্য পুত্রটিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। অপরিসীম ক্রোধে তিনি তখন নিয়েছেন ‘ভাতে মারা’র পন্থা। বন্ধ করেছেন কলকাতায় টাকা পাঠানো।
সৌরেন্দ্র গোটা তিনতলা ছেড়ে দিয়ে নিয়েছে একটা ছোট ঘর। তিন-চারমাস বন্ধুদের থেকে চেয়েচিন্তে কাটিয়েছে। কিন্তু সে আর কতদিন? ক্রমে ডাক্তারি পড়া তো দূর, কলকাতা শহরে থাকা খাওয়ার সঙ্কুলান করাই তার পক্ষে সমস্যার হয়ে দাঁড়াল।
বাধ্য হয়ে সে যখন ভাবছে গ্রামের দিকে কোথাও স্কুল মাস্টারির কাজ নিয়ে চলে যাবে, তার বন্ধু উপেন্দ্রকিশোর অযাচিতভাবে তাকে এই প্রস্তাব দিয়েছে।
‘আমার শ্বশুরমশাই এক আশ্চর্য মানুষ, সৌরেন্দ্র। তুমি বললে বিশ্বাস করবে না, মেয়েদের দুঃখকষ্ট কী করে দূর করা যায়, তা নিয়ে তিনি দিনরাত যেভাবে চিন্তাভাবনা করেন, জানলে তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে। শুধু মেয়েরা কেন, চা-বাগানের গরীব শ্রমিক, কারখানার কুলি, সমস্ত শোষিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদে। তোমাকে সৎ কারণে এইভাবে অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে জেনে তিনি নিজে থেকেই তোমাকে আশ্রয় দিতে চেয়েছেন।’
সৌরেন্দ্র চুপ করে ছিল। ও শুনেছে ‘অবলাবান্ধব’ পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথের বিশাল বাড়িতে এত মানুষ আশ্রিত থাকেন, যে লোকে তার নামই দিয়ে দিয়েছে অবলাব্যারাক। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর স্ত্রীও এক মহিয়সী নারী, যিনি সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে জয় করছেন একের পর এক বাধা। যিনি গোটা বাংলাকে আশ্চর্য করে পড়ছেন মেডিকেল কলেজে। সামনের বছর পাশ করলে তিনিই হবেন প্রথম বাঙালি মহিলা চিকিৎসক।
কী অসামান্য এই দম্পতি!
এমন সাহচর্যে থাকার লোভ সৌরেন্দ্র সংবরণ করতে পারেনি। তাই, শিয়ালদা’র মেস ছেড়ে সে অবশেষে এই বিখ্যাত বাড়িটিতেই চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।