১৫. জানালার দুপাশে দুজন

জানালার দুপাশে দুজন।

একপাশে মাসুদ। অন্য পাশে লীলাবতী। মাসুদ জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লীলা জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসেছে। লীলার মুখ বিষণ্ণ। তার কিছুই ভালো লাগছে না। নিজেকে এই বাড়ির সঙ্গে জড়ানো ভুল হয়েছে–এমন একটা চিন্তা মাথায় ঢুকেছে। বাড়িটা যেন অদৃশ্য সুতায় তাকে ধরে রেখেছে। অদৃশ্য সুতা কাটতে যে কাচি লাগে সেই কাচি তার কাছে নেই।

মাসুদ বলল, বুবু, দরজা খুলে দাও।

লীলা বলল, আমার কাছে চাবি নাই।

মাসুদ বলল, তালা ভাঙার ব্যবস্থা করো। আজি দুপুরের মধ্যে যদি আমাকে বের না করো আমি কিন্তু ঘটনা ঘটাব।

কী ঘটনা?

মাসুদ জবাব দিল না। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। রাগে তার শরীর কাঁপছে। জানালার শিক ধরে সে শরীরের কাপুনি থামানোর চেষ্টা করছে। তার গায়ের হালকা সবুজ রঙের পাঞ্জাবি ঘামে ভেজা।

বুবু, আমি কিন্তু সত্যি ঘটনা ঘটাব।

লীলা উঠে দাঁড়াল। তার বসে থাকতে ভালো লাগছে না। মাসুদ বলল, বুবু, চলে যাচ্ছ কেন? তুমি যেতে পারবে না। বসো।

লীলা বলল, বসে থেকে কী করব?

আমি কিন্তু ঘটনা ঘটাব।

ঘটনা ঘটাতে চাইলে ঘটাও। আমাকে বলার দরকার কী?

মাসুদ তীব্র গলায় বলল, ঘটনা ঘটে গেলে কিন্তু তোমার উপরে দোষ পড়বে। কারণ তোমাকে আগে সাবধান করে দিয়েছিলাম। আমি ফাঁস নিব, দড়ি জোগাড় করেছি। দেখতে চাও?

লীলা কিছু বলল না। মাসুদ খাটের নিচ থেকে লম্বা দড়ির গোছা বের করে দেখাল। বেশ আগ্রহ নিয়েই দেখাল। শিশুরা তাদের পছন্দের খেলনা বড়দের যেমন আগ্রহ নিয়ে দেখায় সেরকম আগ্রহ। আগ্রহে উত্তেজনায় মাসুদের চোখ জ্বলজ্বল করছে।

ফাঁস কখন নিবে?

আছরের ওয়াক্তে। আছরের আজানের পর। বুবু, তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতেছ না? আমি সত্যি ফাঁস নিব। আল্লাহর কসম, নবীজির কসম, পরীবানুর কসম। বুবু, তুমি এখনো আমার কথা বিশ্বাস করতেছ। না?

লীলা বলল, আমার বিশ্বাস করা না-করায় কিছু যায় আসে না।

বুবু, আমি জানি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করতেছ না। কোরানশরিফ আনো, আমি কোরানশরিফ ছয়ে কসম কাটব। বুবু শোনো, পরীবানুর পেটে যে সন্তান আছে সেই সন্তানের কসম, আমি ফাঁস নিব। এইবার কি বিশ্বাস করেছ?

লীলা বলল, করেছি।

মাসুদ বলল, যাও এখন ব্যবস্থা নাও।

লীলা বের হয়ে এলো। তার মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। আছর ওয়াক্তের অনেক দেরি আছে। অস্থির হবার কিছু নেই। তার আগেই অনেককিছু করা যাবে। কিন্তু লীলার অস্থির লাগছে। ঝামেলা এখনই শেষ করে দেয়া উচিত। লীলা তার বাবার খোজে বের হলো। তিনি মূল্যবাড়িতে নেই। শহরবাড়িতেও নেই। পাখিদের ধান খাওয়াতে গেছেন। লীলার একবার মনে হলো, সেও পাখির ধান খাওয়া দেখতে যাবে। বাবার সঙ্গে যা কথা বলার সেখানেই বলবে। তার একা যেতে ইচ্ছা করছে না, আবার কাউকে সঙ্গে নিতেও ইচ্ছা করছে না। বাড়ির সীমানার বাইরে যেতে হলে বোরকা পরতে হবে। এটা সিদ্দিকুর রহমান সাহেবের সাম্প্রতিক নির্দেশ। লীলা যে বোরকা পরে নি তা-না। কিন্তু বোরকা পরলেই কেমন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

লীলা বাড়ির বারান্দায় হাঁটছে। মন শান্ত করার ব্যাপারে। হাঁটা ভালো কাজ করে। কেন করে কে জানে!

লীলা আম্মাজি!

রমিলা ডাকছেন। তাঁর গলার স্বর নিচু। ডাকছেন মমতা নিয়ে। লীলা রমিলার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়াল। রমিলা বললেন, মা, তোমাকে অস্থির লাগাতেছে কেন?

লীলা জবাব দিল না।

রমিলা বললেন, কোনো বিষয়ে অস্থির হওয়া ঠিক না মা। আল্লাহপাক মানুষের অস্থিরতা পছন্দ করেন না। কোরআন মজিদে উনি বলেছেন।

কী বলেছেন?

উনি বলেছেন, হে মানুষ! তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া।

আপনি কোরআন শরীফের সূরার অর্থ জানেন?

আমি জানি না গো মা। আমাদের এক হুজুর ছিলেন বিরাট আলেম। উনার কাছে যখন সবক নিতাম উনি সূরা ব্যাখ্যা করতেন।

তাহলে আমাদের তাড়াহুড়া করা উচিত না?

না গো মা।

আমাদের উপর যখন বিরাট বিপদ এসে পড়বে তখনো আমরা অস্থির হবো না?

না।

আপনি তো অনেক কথা আগে আগে বলতে পারেন— আপনার কি মনে হয় আমাদের উপর বড় বিপদ আসবে?

সবসময় বলতে পারি না মা। মাঝে মাঝে পারি।

এখন কিছু বলতে পারছেন না?

না। আল্লাহপাক মাঝে মাঝে আমাদের সাবধান করার জন্য বিপদের কথা আগেই জানান। মাঝে মাঝে তিনি চান না। আমরা সাবধান হই। তিনি চান যেন আমরা বিপদে পড়ি।

লীলা বলল, আপনার ব্যাখ্যা সুন্দর। এমনভাবে বলেন যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে।

রমিলা বলল, আমার হুজ্বর ছিলেন উনি এইভাবে কথা বলতেন। উনার কাছ থেকে এইভাবে কথা বলা শিখেছি।

লীলা বলল, আমি এইবার ঢাকা যাওয়ার সময় আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব। আপনার চিকিৎসা করাব।

রমিলা বললেন, মাগো, তুমি তো ইনশাল্লাহ বললা না। আল্লাহপাকের ইচ্ছা হইলেই তুমি আমারে নিতে পারবা। উনার ইচ্ছা বিহনে পারব না।

লীলা বলল, আপনার ঘরের তালা খুলে দেই? আসুন আমরা বাগানে হাঁটি?

রমিলা বললেন, তোমারে একটা সিমাসা দিব। যদি ভাঙ্গাইতে পারো তাহলে তোমার সঙ্গে হাঁটতে যাব। না পারলে যাব না।

সিমাসাটা কী?

এক পাখি নড়েচড়ে
দুই পাখি খায়
তিন পাখি নাওএ বসা
চার পাখি নাও বায়।

লীলা বলল, পারব না। রমিলা জানালার পাশ থেকে সরে গেলেন।

 

মাসুদ আছর ওয়াক্তে ফাঁস নেবে–এই ব্যাপারটা অতি দ্রুত জানাজানি হয়ে গেছে। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। কেউ বিশ্বাস করছে না, আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করছে না। পরীবানুর মধ্যে কোনোরকম চাঞ্চল্য লক্ষ করা গেল না। সে তার নিজের ঘরে খাটের উপর আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। তার প্রধান কাজ এখন বই পড়া। এই বাড়িতে বেশকিছু বই আছে। শরৎ, বঙ্কিমচন্দ্র, যোগেন্দ্রনাথ গ্রন্থাবলি। সকালবেলা সে আলমিরা থেকে একটা বই বের করে বসে। পড়তে পড়তে বারবার তার চোখে পানি আসে। আনন্দের কোনো ঘটনাতেও পানি আসে। দুঃখের ঘটনাতেও পানি আসে। নিজের ঘর ছেড়ে তাকে বাইরে বের হতে দেখা যায় না। তার স্বামীকে একটা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে, এটা ভেবেই সে হয়তো নিজেকে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে রেখেছে। তবে মাসুদের ব্যাপারে। সে কারো সঙ্গেই কোনো কথা বলে না।

লীলা যখন তার ঘরে ঢুকল সে তখন খাটে শুয়ে আছে। তার বুকের উপর মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু। লীলাকে ঘরে ঢুকতে দেখে সে উঠে বসল। বই একপাশে রেখে লীলার দিকে তাকিয়ে বলল, বুবু, আপনার কি জ্বর এসেছে? চোখ লাল।

লীলা বলল, জ্বর আসতে পারে। মাথা ধরেছে।

পরী হাত বাড়িয়ে লীলার হাত ধরল। জ্বর দেখার জন্যে হাত ধরা। কিন্তু সে হাত ছেড়ে দিল না। হাত ধরেই থাকল।

লীলা বলল, কী দেখলে, আমার গায়ে কি জ্বর আছে?

জি আছে। বেশি না, অল্প। কিন্তু জ্বর বাড়বে।

কীভাবে বুঝলে?

শরীর অল্প অল্প কাপতেছে। যতক্ষণ শরীর কাপে ততক্ষণ জ্বর বাড়ে। এটা আমি আমার দাদাজানের কাছে শিখেছি। উনি কবিরাজ ছিলেন। বুবু বসেন।

লীলা বসল। পরী বলল, আপনের ভাই নাকি ঘোষণা দিয়েছে। ফাঁস নিবে?

লীলা কিছু বলল না। পরী নিজের মনে মিটমিটি হাসছে। লীলা বিস্মিত হয়ে দেখল— মেয়েটার হাসি খুবই সুন্দর।

পরী বলল, আপনার ভাইয়ের মাথা খুব গরম। যখন মাথা বেশি গরম হয়ে যায়। তখন কেউ মাথা ঠাণ্ডা করতে পারে না।

তুমিও পারো না?

আমি পারি। তার মাথা ঠাণ্ডা করার মন্ত্র আমি বের করেছি।

লীলা বলল, কী মন্ত্ৰ— আমাকে শিখিয়ে দাও। মন্ত্র পড়ে আমি মাথা ঠাণ্ডা করে দিয়ে আসি।

এই মন্ত্র আপনি পড়লে কাজ হবে না। আমার পড়তে হবে।

যাও, তুমি পড়ে দিয়ে আসো।

পরী বলল, না। আমি যাব না।

পরীর হাসিহাসি মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল। সেই কাঠিন্য স্থায়ী হলো না। মুখ স্বাভাবিক হলো। ঠোঁটের কোনায় অস্পষ্ট হাসি ফিরে এলো। পরী বলল, বুবু, আপনি নাকি ঢাকায় চলে যাবেন?

লীলা বলল, হ্যাঁ।

করে যাবেন?

বাবার সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব। যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি, আমার জন্যে তত ভালো।

বুবু, যদি রাগ না করেন। আপনাকে একটা কথা বলি?

বলো।

আমাকে আপনার সঙ্গে নিয়ে যান। আমি কয়েকটা দিন আপনার সঙ্গে থেকে আসি। এখানে আমি একা একা থেকে কী করব? একটা মানুষ থাকবে না। যার সঙ্গে আমি দু’টা কথা বলতে পারব। আপনার সঙ্গে যাওয়া কি সম্ভব?

না।

পরী খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে।

লীলা বলল, তুমি যাতে তোমার বাবা-মা’র সঙ্গে গিয়ে কিছুদিন থাকতে পারো আমি সেই ব্যবস্থা করতে পারি।

পরী শান্ত গলায় বলল, আমাকে এ-বাড়ি থেকে ছাড়বে না। আপনার ভাইকে তালাবন্ধ করে আটকে রেখেছে। আমাকে তালা ছাড়া আটকে রেখেছে। জিনিস একই। বুবু, আপনার জ্বর তো আরো বেড়েছে, আপনি আমার ঘরে শুয়ে থাকেন। আমি কপালে হাত বুলিয়ে দেই। আমি খুব ভালো মাথা মালিশ করতে পারি। মাথা মালিশ করা আমি শিখেছি আমার দাদির কাছে। আমার দাদি মাথা মালিশ করে যে-কাউকে দশ মিনিটের মধ্যে ঘুম পাড়ায়ে দিতে পারতেন।

লীলা বলল, তুমি দেখি অনেকের কাছে অনেক জিনিস শিখেছ।

আমি সবার কাছ থেকেই কিছু-না-কিছু শেখার চেষ্টা করি।

আমার কাছ থেকে কী শিখেছ?

আপনার কাছ থেকে অনেক বড় একটা জিনিস শিখেছি। কিন্তু কী শিখেছি সেটা এখন আপনাকে বলব না।

লীলা বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে বলল, তুমি আসলে আমার কাছ থেকে কিছু শেখ নি। কিন্তু এটা বলতে লজ্জা পাচ্ছি। ভাবিছ এটা শুনলে আমার মন খারাপ হবে। এইজন্যে বলেছ— কী শিখেছি। এটা আপনাকে বলব না। পরী, আমি কি ঠিক বলেছি?

পরী কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর শান্ত গলায় বলল, জি, ঠিক বলেছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় মনে থাকে না যে আপনার অনেক বুদ্ধি। বুবু, আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই?

দাও, কিন্তু তোমার দাদির মতো ঘুম পাড়িয়ে দিও না। আমি অবেলায় ঘুমাতে চাই না।

পরী খাট ছেড়ে নামল। লীলা বলল, কোথায় যাচ্ছ? পারী বলল, আমার হাত দুটা কিছুক্ষণ ঠাণ্ডা পানিতে ড়ুবিয়ে রাখব। তখন হাত ঠাণ্ডা হবে। ঠাণ্ডা হাত কপালে রাখলেই দেখবেন আপনার খুব আরাম লাগছে।

এই বুদ্ধিও কি তোমার দাদির কাছ থেকে শেখা?

জি।

পরী তার বুদ্ধি প্রয়োগ করতে পারল না। তার আগেই লোকমান এসে বলল, মাস্টার সাব লীলা বইনজির সঙ্গে কথা বলতে চান।

 

আনিস মাস্টার দেশে চলে যাবে, সে এই প্ৰস্তৃতি নিয়ে বড়বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে সুটকেস-ট্রাংক। দড়ি দিয়ে বাধা বইপত্র। লীলা অবাক হয়ে বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

দেশে চলে যাচ্ছি। শরীরটা এখন ভালো। মার সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়। না। মার শরীরও ভালো না।

লীলা বলল, বাবা কি জানেন। আপনি চলে যাচ্ছেন?

জি, উনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি।

আপনি আবার ফিরে আসছেন তো?

জি না। গ্রামে আমার মন টেকে না। দেখি শহরে কিছু করতে পারি কি না। তাছাড়া…

তা ছাড়া কী?

এখানে কলেজে অনেক দিন শিক্ষকতা করলাম। বেতন পাই না।

ছাত্র কম। আদায়পত্র নাই। নাম কামাবার জন্যে লোকজন স্কুল-কলেজ দেয়, পরে আর চালানোর ব্যবস্থা করে না।

লীলা বলল, আপনার ট্রেন কখন?

দেড় ঘণ্টার মতো সময় হাতে আছে। আপনার সঙ্গে কথা শেষ করে রওনা দেব।

আমার সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে। এখন রওনা দিতে পারেন।

আনিস বলল, আপনার সঙ্গে কথা শেষ হয় নি। জরুরি কিছু কথা ছিল।

বলুন, শুনছি।

আনিস বলল, দয়া করে আমার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।

লীলা বলল, আমি সবার সব কথাই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি। আপনি কোন প্রসঙ্গে কথা বলবেন?

মাসুদ প্রসঙ্গে।

বলুন।

আপনি নিশ্চয়ই জানেন মাসুদ আছরের ওয়াক্তে ফাঁস নেবার কথা বলেছে। সবাই তার কথা শুনছে। মজা পাচ্ছে। কেউ তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে না।

আপনার ধারণা— তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত?

জি।

আপনার ধারণা— সে সত্যি সত্যি ফাঁসিতে ঝুলবো?

সম্ভাবনা আছে।

সম্ভাবনা আছে— কেন বলছেন?

আনিস শান্ত গলায় বলল, তার ভেতরে প্রচণ্ড রাগ তৈরি হয়েছে। ক্ষোভ আছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভিমান। আপনি আপনার বাবাকে বলে তাকে বের করে আনুন। আপনার কাছে এটা আমার বিশেষ অনুরোধ। এইটুকুই আমার কথা। আমি আপনার বাবাকে আমার কথা বলার চেষ্টা করেছি। উনি ধমক দিয়ে থামিয়ে দিয়েছেন। আপনাকে ধমক দিয়ে থামাবেন না। আপনার কথা উনি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। আমার কথা শেষ হয়েছে, এখন আমি যাই।

আচ্ছা যান।

আনিস বলল, আপনি আমার উপর কোনো রাগ রাখবেন না। লীলা বিস্মিত হয়ে বলল, আমি আপনার উপর রাগ রাখব কেন? আমি রাগ করতে পারি। এমন কিছু কি আপনি করেছেন?

আনিস কিছু বলছে না, হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে কথার পিঠে কথা বলতে পারে। আজি বলতে পারছে না। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

আনিস ইতস্তত করে বলল, আমি কি আমার ঠিকানাটা আপনার কাছে দিয়ে যাব?

লীলা বলল, আমার কাছে ঠিকানা দিয়ে যাবেন কেন? আপনার ঠিকানা দিয়ে আমি কী করব?

আনিস খুবই বিব্রত হলো। লীলা বলল, আপনি বরং একটা কাজ করুন। বাবার কাছে ঠিকানা রেখে যান। উনার কোনো দরকার হলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

আনিস বলল, মাসুদের কথাটা মনে রাখবেন।

হ্যাঁ, আমি মনে রাখব। ভালো কথা, মাসুদের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি এত চিন্তিত, আপনার কি দেখে যাওয়া উচিত না সে কী করে? আছরের ওয়াক্ত পার করে গেলে হয় না?

আনিস বলল, জি-না হয় না। যদি সত্যি সত্যি কিছু ঘটে যায় সেটা আমি নিতে পারব না।

সে জন্যেই পালিয়ে যেতে চাচ্ছেন?

আনিস বিড়বিড় করে বলল, অন্য একটা কারণও আছে, কারণটা আপনাকে বলব না।

লীলা বলল, ঠিক আছে বলতে হবে না। চলে যান। শরীরের দিকে লক্ষ রাখবেন। দুদিন পর পর অসুখ বাঁধিয়ে যূথি নামের একজনকে ডাকাডাকি করা কোনো কাজের কথা না।

 

সিদ্দিকুর রহমান খেতে বসেছেন। লীলা তার সামনে বসে আছে। খাবার সময় তিনি কথাবার্তা বলা পছন্দ করেন না। নিঃশব্দে খেয়ে যান। রান্না ভালো বা মন্দ এই নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করেন না। খাওয়া শেষ করেন অতিদ্রুত। শুধু শেষ পাতে তার টক দই লাগে। টক দই-এ গুড় মাখিয়ে আরাম করে খান। আজও তা-ই করলেন। তিনি অতিদ্রুত টক দই-এ চলে এলেন। লীলা একটি কথাও বলল না। নিঃশব্দে বসে রইল।

সিদ্দিকুর রহমান হাত ধুতে ধুতে বললেন, মা, বলো কী বলবে?

লীলা সামান্য বিস্মিত হলো। তার হাবভাবে এক মুহুর্তের জন্যেও প্রকাশ পায় নি সে কিছু বলতে চায়। অতি বুদ্ধিমান এই মানুষটি কিন্তু ধরতে পেরেছেন।

মাসুদের ব্যাপারে কিছু বলতে চাও?

জি।

ঢাক-ঢোল পিটায়ে কেউ মরতে যায় না। ঘরে তার নতুন বউ। নতুন বউয়ের পেটে সন্তান। এই অবস্থায় কেউ দড়িতে ঝুলে না। তুমি এইসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। মাস্টার তোমার মাথায় এই জিনিস ঢুকায়েছে। মাস্টারের বেশির ভাগ চিন্তা-ভাবনা ভুল।

লীলা বলল, দুর্ঘটনা একবারই ঘটে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, দুর্ঘটনা নিয়ে দুশ্চিন্তা করলে জীবনযাপন করা যাবে না। সবকিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে। আমাদের এই বাড়িতে দুটা বাস্তুসাপ থাকে। পদ্মগোখরা। দুর্ঘটনার কথা চিন্তা করলে এই বাড়িতে বাস করাই সম্ভব হবে না। সারাক্ষণ সাপের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকা লাগত। তুমি কি আমার কথা মন দিয়ে শুনছ?

জি।

মাসুদ গাধাটা গলায় ফাঁস নিবে বলে ভয় দেখাচ্ছে। আজ যদি ভয় পেয়ে গাধাটাকে ছেড়ে দেই, সে দুদিন পরেপরে ভয় দেখাবে। বুঝতে পেরেছ?

জি।

এখন তুমি বলো গাধাটাকে কি ছেড়ে দেয়া উচিত?

উচিত না, কিন্তু ছেড়ে দিন। মাঝে মাঝে আমরা সবাই কিছু অনুচিত কাজ করি।

সিদ্দিকুর রহমান পান মুখে দিলেন। সুলেমান তার জন্যে তামাক নিয়ে এসেছে। তিনি কিছুক্ষণ নলে টান দিয়ে হুক্কা পরীক্ষা করে শান্ত গলায় বললেন, লীলা, তুমি দুশ্চিন্তা করবে না। আমার উপর বিশ্বাস রাখো। বাদ আছর কিছুই হবে না। এই বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলব না। তোমার কি শরীর খারাপ?

সামান্য খারাপ। জ্বর-জ্বর লাগছে।

খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে থাকো। বিশ্রাম করে। তোমাকে দেখে মনে হয়। তুমি সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করো। দুশ্চিন্তা করবে না। দুশ্চিন্তা পুরুষের বিষয়। পুরুষ দুশ্চিন্তা করবে, মেয়েরা দুশ্চিন্তাহীন জীবনযাপন করবে।

লীলা বলল, আমি ঠিক করেছি। কাল ভোরে চলে যাব।

সিদ্দিকুর রহমান ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আসা-যাওয়া এইসব সিদ্ধান্ত মেয়েদের নেয়া ঠিক না। যা-ই হোক, তোমার সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা বলব না। কাল ভোরে যেতে চাও যাবে। বাকি আল্লাহপাকের ইচ্ছা।

আমি মাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাই। উনার চিকিৎসা করাব।

সিদ্দিকুর রহমান মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। লীলাবতী বলল, আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?

আমার কোনো আপত্তি নাই। তুমি তাকে সামলাতে পারবে?

লীলাবতী বলল, আপনিও সঙ্গে চলেন। আমি ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া নিব। আপনার বড় জায়গায় বাস করে অভ্যাস, আপনার হয়তো কষ্ট হবে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি সত্যি আমাদের নিতে চাও?

জি চাই।

এইখানের কাজকর্ম কে দেখবে? মাসুদ দেখবে। তাকে দায়িত্ব দেন। বটগাছের ছায়ায় অন্য কোনো গাছ বড় হয় না। তাকে বড় হবার সুযোগ দিন।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঠিক আছে তুমি ব্যবস্থা করো। ঢাকা রওনা যেদিন হবো সেদিন মাসুদের তালা খুলে তাকে দায়িত্ব দিব।

 

লীলা দুপুরে কিছু খেল না। পরীর ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যেই সে বুঝতে পারছে— পরী খুব হালকাভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এত আরাম লাগছে! তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার পর। ঘুম ভাঙার পরপরই খবর নিল— মাসুদকে পেঁপে দেয়া হয়েছে, সে পেঁপে খাচ্ছে। ঘিয়ে ভাজা মুড়ি চেয়েছে। তার জন্যে মুড়ি ভাজা হচ্ছে। লীলার বুকে যে চাপ ভাব ছিল তা নেমে গেল। গায়ে জুরও মনে হয় নেই। সে অবেলায় গোসল করল। পরপর দুকাপ চা খেয়ে বাড়ির পেছনের বাগানের দিকে গেল। শ্বেতপাথরের বেদিতে কিছুক্ষণের জন্যে বসে থাকা। এই জায়গাটা তার খুব প্রিয়। মানুষের স্মৃতির বেশিরভাগ অংশ জুড়েই মানুষ থাকে। দৃশ্যাবলি থাকে না। তবে বাগানের এই অংশের স্মৃতি হয়তোবা তার মাথায় থাকবে। হঠাৎ-হঠাৎ মনে পড়বে।

বাগানে বসে-থাকা অবস্থাতেই লোকমান ছুটে এসে খবর দিল–মাসুদ ভাইজান ফাঁস নিছে।

 

আছরের ওয়াক্তে মাসুদ ঘটনা ঘটাতে পারে নি। সে ঘটনা ঘটিয়েছে মাগরেবের আজানের ঠিক আগে—আগে। তার আশেপাশে তখন কেউ ছিল না। দরজা ভেঙে ঝুলন্ত দড়ি থেকে কেউ তাকে নামানোর জন্যে ছুটে আসে নি।

 

রাতে রমিলার ঘরে কখনো বাতি দেয়া হয় না। ঘরের জানালার সামনের বারান্দায় হারিকেন ঝুলানো থাকে। হারিকেনের আলো ঘরে যতটুকু যাবার যায়। আজ হারিকেন ঝুলানোর কথা কারো মনে নেই। ঘর পুরোপুরি অন্ধকার। রমিলা জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে দেখা যাচ্ছে না। বাড়িতে অনেক লোকজন। কিছুক্ষণ পর-পর তার সামনে দিয়ে কেউ-না-কেউ আসা-যাওয়া করছে। তিনি প্রতিবারই বলছেন, ডর লাগে গো, একটা বাতি দেও। কেউ তাঁর কথা শুনছে বলে মনে হয় না।

পরীবানু খাটের মাঝখানে বসে আছে। পরীবানুর হাত ধরে আছে লীলাবতী। সে বসেছে খাটের বা পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার গায়ে কোনো শক্তি নেই, যে-কোনো মুহূর্তেই সে গড়িয়ে পড়ে যাবে। পরীবানুর ঘরের মেঝেতে হারিকেন জ্বলছে। মেঝে আলো হয়ে আছে। কিন্তু খাট অন্ধকার। অন্ধকারে পরীবানু বা লীলাবতী কারো মুখই দেখা যাচ্ছে না। ঘরের দরজা খোলা। এই দরজার সামনে দিয়ে কেউ আসা-যাওয়া করছে। না। লীলা পরীর দিকে একটু বুকে এসে বলল, পানি খাবে? একটু পানি খাও।

পরী স্পষ্ট গলায় বলল, না।

লীলা বলল, একটা কাজ করো, বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকো। পরী বলল, আপনার শরীর বেশি খারাপ করেছে, আপনি শুয়ে থাকুন।

লীলা সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। পরী একটা হাত তুলে দিলা লীলার কপালে। হাত ঠাণ্ডা। বেশ ঠাণ্ডা। হাত বা হাতের আঙুল একটুও নড়ছে না। পরী নিজেই স্থির হয়ে আছে। শুধু লীলাবতী একটু পর-পর কেঁপে উঠছে।

সিদ্দিকুর রহমান উঠানে বসে আছেন। লোকমান এবং সুলেমান দুজনই তার ইজিচেয়ারের পেছনে জবুথবু হয়ে বসে আছে। সুলেমানের সামনে একটা হারিকেন রাখা। সে কিছুক্ষণ পর-পর তার বা হাত হারিকেনের চিমনির গায়ে রাখছে। প্রচণ্ড শীতের সময় এই কাজটা সে করে। ঠাণ্ডা হাত চিমনির গরমে সেঁকে নেয়। আজ গরম পড়েছে। গরমে শরীর ঘামছে। এই গরমে হাত সেঁকার প্রয়োজন নেই। সিদ্দিকুর রহমানের হাতে হুক্কার নল। তিনি মাঝে মাঝে নিলে টান দিচ্ছেন। কিন্তু কোনো ধোঁয়া বের হচ্ছে না। আগুন অনেক আগেই নিভে গেছে। তিনি নিজেও তা জানেন। আগুন আনতে কাউকে পাঠাচ্ছেন না। তার ভয়-ভয় লাগছে। তিনি চাচ্ছেন লোকমান বা সুলেমান তাঁর পাশেই থাকুক। সিদ্দিকুর রহমান গলা খাকারি দিয়ে ডাকলেন, সুলেমান!

দুই ভাই একসঙ্গে জবাব দিল— জি চাচাজি?

সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, বাড়িতে একটা মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে কোনো কান্নার শব্দ নাই। এটা কেমন কথা?

লোকমান এবং সুলেমান নড়েচড়ে বসল। কেউ জবাব দিল না। তারা খুব ভালো করে জানে সিদ্দিকুর রহমান তার বেশিরভাগ প্রশ্নেরই জবাব শুনতে চান না।

জন্ম এবং মৃত্যু এই দুই সময়েই শব্দ করে কাঁদতে হয়। জন্মের সময় দুজন কাদে। যার জন্ম হয় সে কাব্দে। আর কাদে তার মা। মৃত্যুর সময় অনেকেই কাব্দে। শুধু যে মারা গেল সে কাঁদতে পারে না। সুলেমান!

জি চাচাজি?

থানায় কি লোক গিয়েছে?

জি, ওসি সাহেব আসতেছেন।

জানাজার ব্যাপারে কোনো মীমাংসা হয়েছে?

জি-না। মওলানা সাহেব বলেছেন, অপঘাতে মৃত্যু, জনাজা হবে না। কিতাবে লেখা আছে।

তুমি মাওলানা সাহেবকে বলে আসো— অপঘাতে মৃত্যু হলে জানাজা হবে। না এটা কোন কিতাবে লেখা আছে আমাকে যেন এনে দেখায়।

এখন যাব?

হ্যাঁ, এখন যাবে।

সুলেমান চলে গেল। লোকমান হারিকেনের দিকে একটু এগিয়ে গেল। মনে হচ্ছে একা হয়ে যাওয়ায় সে খানিকটা ভয় পাচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমান চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তাঁর মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে। তিনি এই মুহুর্তে রমিলার কথা ভাবছেন। মাতা কি পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন? হঠাৎ তাঁর কাছে মনে হলো, মস্তিষ্ক বিকৃত থাকার কিছু সুবিধা আছে। পুত্রের মৃত্যুসংবাদ এই মস্তিষ্কবিকৃত মহিলা সহজভাবে গ্রহণ করবে। চিৎকার-কান্নাকাটি করবে না। ঘটনাটা হয়তো সে বুঝতেই পারবে না। এটা তার জন্যে মঙ্গলজনক।

লোকমান!

জি চাচাজি?

মাসুদের মাতাকে কি মৃত্যুসংবাদ দেয়া হয়েছে?

চাচাজি, আমি জানি না। খোঁজ নিয়া আসি।

খোঁজ নিয়া আসার প্রয়োজন নাই। আমি নিজেই যাব।

হুক্কা ঠিক করে দিব চাচাজি? আগুন নাই।

দাও, হুক্কা ঠিক করে দাও।

লোকমান প্ৰায় বিড়বিড় করে বলল, বাংলাঘরে অনেক লোক আসছে। আপনের সঙ্গে কথা বলতে চায়।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কথা বলার কিছু নেই। তারা যেন এইদিকে না। আসে।

জি আচ্ছা।

পরীবানুর বাড়ি থেকে কেউ এসেছে?

উনার পিতা এসেছেন।

তাকে ভিতর-বাড়িতে নিয়ে যাও। মেয়ের সঙ্গে কথা বলায়ে দাও।

জি আচ্ছা।

মরাবাড়িতে তিনদিন তিনরাত চুলা জ্বালানো হয় না। চুলা যেন না জ্বালানো হয়।

জি আচ্ছা।

আশেপাশের বাড়ি থেকে মরাবাড়িতে খানা পাঠায়। এই বাড়িতে কেউ যেন খানা না পাঠায়।

জি আচ্ছা।

লোকমান কল্কেতে আগুন ধরিয়ে দিল। সিদ্দিকুর রহমান হুক্কার নিলে একটা টান দিয়েই উঠে দাঁড়ালেন। রমিলার সঙ্গে কথা বলা দরকার। মাতাকে পুত্রের মৃত্যুসংবাদ দেয়া প্রয়োজন। তার মন বলছে, এই সংবাদ রমিলা এখনো পায় নাই। লোকমান তার পেছনে পেছনে আসছিল। তিনি লোকমানকে বললেন, তুমি বাংলাঘরে যাও। যারা এসেছেন তাদের দেখভাল করো। পান-তামাক দাও।

রমিলার ঘরের সামনের হারিকেনটা এখন জ্বালানো হয়েছে। হারিকেনের আলোয় দেখা যাচ্ছে, রমিলা জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। সিদ্দিকুর রহমানকে দেখেই তিনি মাথায় কাপড় তুলে দিলেন।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, কেমন আছ?

রমিলা বললেন, ভালো আছি। আপনার শরীর কেমন?

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমার শরীর ভালো। বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, এই খবর কি পেয়েছ?

রমিলা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, খবর কে দিয়েছে?

রমিলা বললেন, আমি একজনের কাছ থেকে খবর পেয়েছি। তার নাম আপনেরে বলব না। আপনি মাসুদের বিষয় নিয়া অস্থির হবেন না। এখন অস্থির হওয়ার সময় না।

তুমি অস্থির না?

না। সবেই সবের কপাল নিয়া আসে। মাসুদ তার কপাল নিয়া আসছে। তার কপালে যা ছিল তা-ই ঘটেছে। আল্লাহপাকের এইরকম ইচ্ছা ছিল।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি যা ভেবেছ তা ভাবলে মনে শান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু ঘটনা সেরকম না। মানুষ নিজে তার কপাল তৈরি করে। এই স্বাধীনতা আল্লাহপাক মানুষকে দিয়েছেন।

রমিলা বললেন, মানুষের ভাগ্যে যা লেখা তার অতিরিক্ত কোনোকিছু করার ক্ষমতা তার নাই। এই বিষয়টা আমার মতো ভালো কেউ জানে না। আপনে যদি চান আপনারে বুঝায়ে বলতে পারি।

সিদ্দিকুর রহমান বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছেন। এই মুহূর্তে রমিলাকে তাঁর কাছে মনে হচ্ছে অত্যন্ত সুস্থ একজন মহিলা, যে-মহিলা জটিল তর্ক শুরু করতে পারে এবং তর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তিনি রমিলার জানালার কাছে এগিয়ে গেলেন। কোমল গলায় বললেন, তোমার খাওয়াদাওয়া কি হয়েছে?

রমিলা বললেন, জি না। আইজ রাইতে আমি কিছু খাব না। আমি উপাস দিব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, তুমি যদি চাও আমি তোমার ঘরের দরজার তালা খুলে দিব। তুমি লীলার সঙ্গে থাক। লীলার মন ভালো হবে। সে বড়ই অস্থির হয়ে আছে।

রমিলা বললেন, আপনি লীলার কথা বললেন। তার মন ঠিক করার ব্যবস্থা নিলেন, কিন্তু মাসুদের স্ত্রীর বিষয়ে কিছু বললেন না। তার মন ঠিক করার বিষয়ে কিছু ভেবেছেন?

না।

যান, তার মনটা ঠিক করে দেন।

কীভাবে ঠিক করব?

রমিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে স্পষ্ট গলায় বললেন, আপনি তার কাছে যান। তার মাথায় হাত রেখে শুধু মা বলে একবার ডাকেন।

তাতেই মন ঠিক হবে?

হুঁ। মা বলে ডাক দিলে মেয়েটা কাঁদতে শুরু করবে। বড় কষ্ট পেলে মনে বিষ তৈরি হয়। তখন যদি কেউ কাঁদে, মনের বিষ চোখের পানির সঙ্গে বের হয়ে যায়।

বাহ, ভালো বলেছ। এইসব কি নিজে নিজেই বের করেছ, না কেউ তোমাকে আগে বলেছে?

রমিলা জবাব দিলেন না। বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি লোকমানকে পাঠাচ্ছি। সে তোমার ঘরের দরজা খুলে দিবে।

আপনার মেহেরবানি।

মাসুদের মৃত্যুসংবাদ তোমাকে কে দিয়েছে এটা আমাকে বলতে চাচ্ছি না কেন?

বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না। কেউ আমাকে বিশ্বাস না করলে আমার খারাপ লাগে।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, অবিশ্বাস করার তো কিছু নাই। তুমি শুধু শুধু মিথ্যা কথা কেন বলবো?

রমিলা চাপা গলায় বললেন, মাসুদের মৃত্যুসংবাদ আমাকে সে নিজেই দিয়েছে। আমার ঘরে সে এসেছিল। আমার বিছানায় অনেকক্ষণ বসেছিল। বারান্দায় যখন হারিকেন জ্বালাল তখন চলে গেল। আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করেছেন?

সিদ্দিকুর রহমান জবাব দিলেন না। রমিলা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এইজন্যেই তার নামটা আপনারে বলি নাই।

সিদ্দিকুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বদ্ধ উন্মাদের প্রলাপ। স্বাভাবিক আচরণের মাঝখানে ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিকতা। তালা খুলে এই উন্মাদকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না। যে-কোনো মুহুর্তে সে ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলবে। তিনি পরীবানুর ঘরের দিকে রওনা হলেন। আশ্চর্য কাণ্ড, পা টেনে এগোতে তার কষ্ট হচ্ছে। শরীর ভারী হয়ে গেছে। পা ক্লান্ত। শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই কি আলাদা করে বিশ্রাম চায়? চোখ ক্লান্ত হলে চোখের পাতা নেমে আসে। পা ক্লান্ত হলে হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। তারও কি এরকম হবে? পরীবানুর ঘরের কাছে এসে পা থেমে যাবে?

পরী ঠিক আগের জায়গাতেই আছে। লীলা পরীর পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। পরীর একটা হাত লীলার কপালে। শ্বশুরকে দেখে পরী লীলার কপাল থেকে হাত তুলে নিল। শ্বশুরের দিকে তাকাল।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন–মা, তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমার ছেলে যে এমন কাণ্ড করবে। আমি বুঝতে পারি নাই।

পরী জবাব দিল না। শ্বশুরের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টিতে রাগ, অভিমান, দুঃখ কিছুই নেই। আবেগহীন, ভাষাহীন বড় বড় চোখ।

সিদ্দিকুর রহমান পরীর কাছে এগিয়ে গেলেন। তার মাথায় হাত রাখলেন। পরী সামান্য কেঁপে উঠল। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, এত বড় দুর্ঘটনা আমার কারণে ঘটেছে। তার জন্যে তুমি যদি আমাকে কোনো শাস্তি দিতে চাও দিতে পারে।

সিদ্দিকুর রহমান পরীর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। পরীর সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। একসময় তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে শুরু করল।

 

রাত এগারোটা।

বড়বাড়ির পেছনের বাগানে মাসুদের জন্যে কবর খোড়া হয়েছে। লাশ ধোয়ানো হয়েছে। কাফন পরিয়ে রাখা হয়েছে। জানাজা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে লাশ কবরে নামানো হবে। মধ্যরাতের আগেই লাশ কবরে নামাতে হয়।

সিদ্দিকুর রহমানকে মধ্যরাতে জানানো হলো, ইমাম সাহেব জানাজা পড়তে কিছুতেই রাজি না। তবে তিনি খাস দিলে দোয়াখায়ের করবেন। সিদ্দিকুর রহমান বললেন, ঠিক আছে। আল্লাহপাক মাসুদের কপালে যা রেখেছেন তা-ই হবে। লাশ কবরে নামানোর ব্যবস্থা করো। তবে মাটি দিও না। লাশ কবরে নামানোর পর ইমাম সাহেবকে খবর দিয়ে আনবে, তিনি যেন দোয়া করেন। তার দোয়ার পরে মাটি দেয়া হবে।

ইমাম সাহেব সঙ্গে সঙ্গেই এলেন। তিনি কিছুটা সংকুচিত। সেই সঙ্গে ভেতরে ভেতরে আনন্দিত। অতি ক্ষমতাবান, একজনের হুকুম তিনি অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন। এমন যুক্তিতে করেছেন যে ক্ষমতাবান মানুষটার বলার কিছু নাই। এই অঞ্চলে তাকেও লোকজন ক্ষমতাধর মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করবে।

ইমাম সাহেবের নাম আব্দুল নূর। ফরিদপুরের মানুষ। এই অঞ্চলে স্থায়ী হয়ে গেছেন। ঘর-বাড়ি করেছেন। স্ত্রীকে নিয়ে বাস করেন। তার বাড়ির নাম হয়েছে ইমামবাড়ি। ইমাম সাহেবের জিন-সাধনা আছে এমন জনশ্রুতি। এই বিষয়ে কেউ কিছু জানতে চাইলে তিনি মধুর ভঙ্গিতে হাসেন। হ্যাঁ-না কিছুই বলেন না।

আব্দুল নূর উঠানে সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে এসে অতি বিনয়ী গলায় বললেন, জনাব, আপনি আমার উপর বিরাগ হবেন না। অপঘাতে মৃতের জানাজা হবার নিয়ম নাই। ইসলামি কানুনের বরখেলাপ হয় এমন কিছুই আমি করব না। যদি করি তাহলে আল্লাহপাক নারাজ হবেন। মানুষের নারাজি আমি নিতে পারব, আল্লাহপাকের নারাজি নিতে পারব না।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আপনার নিজের যদি অপঘাতে মৃত্যু হয় তাহলে তো আপনারও জানাজা হবে না। ঠিক না?

জি ঠিক।

সিদ্দিকুর রহমান শান্ত গলায় বললেন, আমার ছেলের যদি জানাজা না হয় তাহলে আপনারও যেন জানাজা না হয়— সেই ব্যবস্থা আমি নিতে পারি, তা কি আপনি জানেন?

আব্দুল নূর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, আমি যে মানুষ খারাপ এটা সবাই জানে। আপনি বিদেশী লোক বলে আপনি জানেন না। আমার ছেলের জন্যে দোয়া করবেন। এইজন্যে আপনারে আমি ডাকি নাই। এই কথাগুলি বলার জন্যে ডেকেছি। এখন আপনি যান।

আব্দুল নূর বিড়বিড় করে বললেন, জনাব, আমি জানাজা পড়াব।

সিদ্দিকুর রহমান বললেন, খুবই ভালো কথা, লাশ কবরে নামানো হয়ে গেছে, লাশ কবর থেকে তুলে জানাজার ব্যবস্থা করেন। একবার লাশ কবরে নামানোর পর সেই লাশ আবার তোলার বিষয়ে কি কোনো বিধি-নিষেধ আছে?

জি-না।

এখন আমার সামনে থেকে যান।

জি আচ্ছা।

আব্দুল নূর মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলেন। আব্দুল নূর এবং সিদ্দিকুর রহমান দু’জনের কেউই টের পেলেন না। এই নাটকীয় কথোপকথন বারান্দা থেকে শুনল পরীবানু। সিদ্দিকুর রহমান নামের মানুটার উপর থেকে হঠাৎ তার সব রাগ দূর হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *