১৫.
একটা চোরা আশঙ্কায় দোলা ক্রমশ বিহ্বল হয়ে পড়ছিল। এ কী এক অস্বাভাবিক আচরণ করে চলেছে তিয়া? নয় নয় করে পাঁচটা দিন কেটে গেল, এখনও নিজের কুঠুরি ছেড়ে প্রায় বেরোচ্ছেই না। ওই হয়তো দোলা সাত বার ডাকাডাকি করল, তো মেয়ে এল খেতে। তবে টেবিলে বসাই সার, মুখে কিছুই তুলছে না সেভাবে। মাথা নিচু করে ভাত খুঁটছে, কিংবা অভিব্যক্তিহীন মুখে কুচুর কুচুর চিবোচ্ছে রুটি। যেন স্রেফ খেতে হয় বলেই খাওয়া। যেন খিদেতেষ্টা, স্বাদগন্ধের বোধই আর নেই। ঘরেও কি সে করছে কিছু? শুয়ে আছে, শুয়েই আছে। হয় চোখ বোজা, নয় বোবা দৃষ্টি সিলিংয়ে স্থির। কম্পিউটার খুলছে না, আইপড অবহেলায় পড়ে, এমনকী মোবাইল পর্যন্ত বন্ধ রেখেছে পাকাপাকি। হল কী মেয়ের?
তুহিনও কম দুশ্চিন্তায় নেই। তাকে দেখেও দোলা যথেষ্ট চিন্তিত। মুখ-টুখ কেমন যেন হয়ে গেছে তুহিনের, গলার তেজ উধাও। কেমন দিশেহারা দিশেহারা দশা। অফিসে গেলে কষ্মিনকালে বাড়ির ব্যাপারে তুহিনের হুঁশ থাকে না, এখন দু’বার-তিনবার করে ফোন। কেমন আছে? খেয়েছে তো? কথা বলল? টিভি দেখছে? তুহিনের এত উৎকণ্ঠা দোলা কখনও দেখেনি। চাকরি নিয়ে, মায়ের অসুখের সময়ে, অনেক দুর্বিপাক গেছে, তখনও না। টেনশনে টেনশনে মানুষটা অসুস্থ না হয়ে পড়ে!
কালও তো অফিস থেকে ফিরেই প্রথম প্রশ্ন,— কিছু বুঝলে? জানতে পারলে?
দোলার হতাশ জবাব,— নাহ্।
ছেলেটা আবার ফোন করেছিল?
সে তো বারবারই করছে। তিয়া এসে ধরছে কই! বিছানা ছেড়ে উঠছেই না।
কী বলল ছেলেটা আজ?
একই কথা। ওর সঙ্গে তিয়ার কিছুই হয়নি। যে এন-জি-ও-টায় তিয়া নাকি যেত, সেখানকার লোকটা ফোরটোয়েন্টি কেসে ধরা পড়েছে দেখেই তিয়ার নাকি শরীর খারাপ লাগতে আরম্ভ করল, ছেলেটা তিয়াকে পৌঁছে দিয়ে গেল, ওপরেও নাকি আসতে চেয়েছিল, তিয়া মানা করায়…।
ওই এন-জি-ও-র সঙ্গে তিয়া জড়িয়ে পড়েনি তো? কিংবা ওই লোকটার সঙ্গে…?
সূর্যর কথা শুনে… তেমন তো মনে হল না। তবে ছেলেটাও ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছে। বারবার বলছে, আমি একবার যাই, কথা বলি…! আমি বললাম, আর দু’-চারটে দিন যাক।
তুমি জানিয়েছ তিয়াকে?
কী?
ওই যে… ছেলেটা আসতে চাইছে?
তিয়া দেখা করতে চাইছে না বলেই তো আমি বারণ করলাম।
উম্ম্। কিন্তু কেন মিট করবে না? যদি কিছু নাই হয়ে থাকে…
জানি না। বুঝতে পারছি না।
না পারলে তো চলবে না। তুহিন রীতিমতো অধৈর্য,— আজ আমি এক ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। অফিসের দত্তর চেনাজানা। সাইকিয়াট্রিস্ট, বেশ নাম আছে। ওভার ফোন কথা হল। উনি তো শুনে বললেন, ডিপ্ মেন্টাল ডিপ্রেশন। নিজে নিজে কাটিয়ে উঠতে পারলে ভাল, নইলে মেডিসিন দিতে হবে। …তুমি কিন্তু ওকে চোখে চোখে রেখো। বলা তো যায় না, হঠাৎ যদি কিছু…
রাখছি তো। সারাক্ষণ গিয়ে গিয়ে দেখে আসছি।
রাতেও তো ঘুমোচ্ছে না। আমার অমন চনচনে মেয়েটার কী যে এমন ঘটল…!
এই প্রশ্নটাই তো এখন অনবরত পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে গোটা ফ্ল্যাটে। ছুঁয়ে যাচ্ছে, বিঁধছে বাড়ির তিনটে প্রাণীকেই। হ্যাঁ, বাইরের দুনিয়া নিয়ে যে সর্বক্ষণ মশগুল, বাড়ির প্রতি যার ডোন্ট কেয়ার ভাব বেড়ে চলেছে দিন দিন, সেই তিতানও এর বাইরে নেই। সে তো তিয়াকেই কতবার বলল,— তোকে যে হার্ট করেছে, তার নাম-ঠিকানাটা আমায় দে তো দিদি। সেই এলাকার লোকাল কমিটিকে দিয়ে অ্যাইসান্ কড়কাব, জিন্দেগিতে আর লোচা করার হিম্মত হবে না!
এই বলশালী আশ্বাসও ভস্মে গেছে। আমল দেয়নি তিয়া।
নাহ্, দোলা থই পাচ্ছে না। কোনও হিসেবই মিলছে না তার। তবে বলতে নেই, আজ সকাল থেকে একটু যেন বদলেছে মেয়ে। না ডাকতেই টুকটুক করে এসে জলখাবার খেয়ে গেল। খুবই সামান্য অবশ্য, মাত্র দু’পিস স্যান্ডুইচ। কম্পিউটারও একবার খুলেছে। মিনিট পনেরো-কুড়ি কী সব করল, তারপর ফের বিছানায়।
বেলা বারোটা নাগাদ হঠাৎ তুহিনের ফোন। ঈষৎ উত্তেজিত গলা,— আজকের কাগজটা পড়েছ?
এখনও দেখা হয়নি। কেন?
আমিও দেখিনি। অফিসে একজন, ক্যাজুয়ালি বলছিল, কোন একটা এন-জি-ও-র ফ্রড কেস নিয়ে কাগজে কী সব লিখেছে আজ। কথা শুনে মনে হল, তিয়ার সেই নরেন্দ্রপুরের ঘটনাটা। …একটু দ্যাখো তো।
হ্যাঁ, তুহিনের আন্দাজই ঠিক। ভয়ংকর এক শয়তানের কার্যকলাপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। এবং সূর্য যেমন বলেছিল, লোকটা সেই ইন্দ্রজিৎ রায়ই। গতকাল লোকটাকে আবার কোর্টে তোলা হয়েছিল, আরও পনেরো দিন তাকে পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
উফ্, এই লোকটাই কি যত নষ্টের গোড়া? আর একবার খবরটা খুঁটিয়ে পড়ল দোলা। তারপর ভাবল একটু। কী মনে করে সটান এসেছে মেয়ের ঘরে, কাগজটা নিয়েই।
তিয়া চোখে হাত চেপে শুয়ে। শান্ত গলাতেই মেয়েকে ডাকল দোলা,— শুনছিস?
উঁ?
ওঠ তো একটু। কথা আছে।
মাত্র ক’দিনেই কেমন ফ্যাকাশে মেরে গেছে তিয়া। দোলার স্বর শুনে সেই নীরক্ত মুখে আবছা বিস্ময়। উঠে বসল আস্তে আস্তে।
দোলা সন্ধানী চোখে জিজ্ঞেস করল,— ইন্দ্রজিৎ রায়ের নিউজ বেরিয়েছে আজ। নিশ্চয়ই দেখিসনি?
মা’র মুখে নামটা শুনে তিয়া কি চমকাল একটু? দোলা বুঝতে পারল না। তিয়ার ঠোঁট শুধু নড়েছে সামান্য,— না।
দোলা খবরের কাগজখানা বাড়িয়ে দিল,— দ্যাখ্।
তিয়ার যেন তেমন কৌতূহল নেই। ওপর ওপর চোখ বুলিয়ে পাশে রেখে দিল কাগজ।
দোলা সংশয়ের সুরে বলল,— পড়া হয়ে গেল?
নতুন তো কিছু নেই। মেয়ের মুখ ফুটেছে, সেদিন টিভিতেও তো এ-সবই বলল।
বাব্বা, এ তো সাংঘাতিক বদমাইশ! ধরা পড়ে আপদ চুকেছে।
আশ্চর্য, তিয়াও সায় দিল,— অবশ্যই।
দোলা এতক্ষণে বুঝি খানিক জোর পেল মনে। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,— তা হলে বুঝছিস তো, এমন একটা বাজে লোকের জন্য মন খারাপ করার কোনও মানে হয় না!
তিয়া চোখ কুঁচকে তাকাল,— ইন্দ্রজিৎ রায়ের জন্য মন খারাপ? এরকম উদ্ভট ধারণা তোমার হল কী করে?
দোলা নরম করে হাসল,— বুঝি রে, বুঝি। এক আধটা ভুলভাল এই বয়সে হয়েই যায়। ও এমন কিছু দোষের নয়। …সত্যি তো, কে যে কী রকম সব সময়ে কি চেনা সম্ভব?
হঠাৎই ছিটকে সরে গেল তিয়া। নিষ্প্রভ চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠেছে। তীক্ষ্ণ গলায় বলল,— কিস্যু বোঝোনি। আমি সূর্যকে ভালবাসতাম। এখনও বাসি। ফর নাথিং ইন্দ্রজিৎ রায়ের ওপর আমার উইকনেস গ্রো করবে কেন?
ও। দোলা থতমত,— তা হলে তো… কোনও সমস্যাই নেই!
আছে মা, আছে। তিয়ার স্বর ফের নিবে এল,— কোনও একটা বিশ্বাস, কিংবা কোনও একটা আদর্শ, যদি ভেঙে যায়, সেটা মানুষকে দুঃখ দেয় মা। কিন্তু সেই দুঃখটাকে যদি একান্ত আপনজনও ফিল করতে না পারে, সেটা কি আরও বেশি দুঃখের নয়?
দোলা কথাগুলো ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারল না। ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে আছে।
তিয়া খাটের বাজুতে হেলান দিল। দোলাকেই দেখছে। হঠাৎই জিজ্ঞেস করল,— তুমি নাটকের গ্রুপটা ছেড়ে দিয়েছিলে কেন মা?
অতর্কিত প্রশ্নটার জন্য দোলা এতটুকু প্রস্তুত ছিল না। আমতা আমতা করে বলল,— বা রে, সংসার-টংসার ফেলে কি ওসব নিয়ে মাতলে চলে?
উঁহুঁ, তুমি সত্যি বলছ না।
আর কী কারণ থাকতে পারে?
নিজের মুখেই বলো। এত বছর পর আর মিথ্যে যুক্তির প্রয়োজন আছে কি?
কেন জিজ্ঞেস করছিস তিয়া? দোলা ঈষৎ অশান্ত হয়েছে। অভিমানী স্বরে বলল,— দেখেছিসই তো, তোর বাবা কেমন করত! তার পরে কারও আর…
জানি। তখন আমি এমন কিছু শিশু ছিলাম না। …এবার বলো তো, তখন কি তোমার বাবাকে ছেড়ে চলে যেতে ইচ্ছে হয়নি? চিরকালের মতো? সম্পর্কটাকে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে?
দোলা থরথর কেঁপে উঠল। মেয়ের চোখ কি সার্চলাইট? এ যেন সেই দৃষ্টি, যা দিয়ে একটা মেয়েই শুধু আর একটা মেয়ের ভেতরটাকে পড়তে পারে। কিন্তু দোলা কী করে তিয়াকে বলে, এখনও সেই বাসনাটা মনে মনে গুমরোয়? ধিকিধিকি জ্বলে? দোলাকে পোড়ায়?
তিয়া ফের বলল,— কী হল? চুপ কেন? বলো? আটার সামথিং।
দোলা সত্যিটাকে অসন্তোষের আবরণে ঢাকতে চাইল। বিরক্ত মুখে বলল,— কেন আজেবাজে বকছিস? এসব প্রশ্নের কোনও অর্থ হয়?
এতক্ষণে তিয়ার ঠোঁটে এক ফালি হাসি দেখা দিয়েছে। মলিন। আকাশছাওয়া ঘন মেঘের ফাঁক দিয়ে যেটুকু আলো আসে, এ যেন ততটুকুই। মৃদু গলায় বলল,— থাক। জবাব আমি পেয়ে গেছি।
কী…? কী…? কী বুঝলি?
শুনে কী হবে? তুমি তো আর নিজেকে…। তিয়া থেমে গেল। অনেকটা বাতাস টানল ফুসফুসে। কেটে কেটে বলল,— আমি তোমার মতো নই মা। সারেন্ডার আমি করব না। নেভার। যাকে ভালবাসি, তার কাছেও না।
তুই সূর্যকে ছেড়ে দিবি নাকি?
ডিসিশনটা কঠিন ছিল। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করা তো…।
ভুল করবি তিয়া। সূর্য তোকে এত ভালবাসে… দিনরাত তোর জন্যে পাগলের মতো করছে…
শুধু ভালবাসাই যথেষ্ট নয় মা। সংসার গড়ার জন্য আরও কিছু লাগে। তুমি জানো না…?
দোলা স্তব্ধ তাকিয়ে। হঠাৎই অনুভব করতে পারছিল, তিয়া অনেক অনেক বড় হয়ে গেছে। বুঝি বা দোলার চেয়েও। মেয়েকে সে এত দিনে যেন একটু একটু চিনতে পারছে। হয়তো মেয়ের মধ্যে দিয়ে নিজেকেও।
ইস, কেন যে একটা গোটা জীবন ভুল ভাবে কাটাল দোলা!
________