১৫. ঘাঁটির বন্ধ গুমোট ঘর

১৫.

ঘাঁটির বন্ধ গুমোট ঘরের দেউড়ি থেকে বেরুবামাত্রই কয়েদিদের রুদ্র অভ্যর্থনা জানাল শীতে জর্জর বৃষ্টি-বরফে মেশা অকরুণ দিবস। কাতেরিনা বেরিয়েছিল বুকে যথেষ্ট সাহস বেঁধে কিন্তু আপন সারিতে যোগ দেওয়া মাত্রই তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল, মুখের রঙ সবুজে পরিবর্তিত হয়ে গেল। তার চোখের সামনে বিশ্ব-সংসার অন্ধকার হয়ে গেল; তার প্রত্যেকটি হাড়ের জোড়া যেন তাকে ছুঁচের মতো খোঁচাতে আরম্ভ করল, যেন তার দুটি হাঁটু ভেঙে গেছে। ওই তার সামনে সোনেৎকা দেমাক করে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে পায়ের নীল পশমের মোজা– তার উপরের সিল্কের মিহিন কাজ– কাতেরিনা কত না ভালো করেই চেনে!

কাতেরিনা চলতে লাগল– যেন তার সর্বাঙ্গের কোনও জায়গায় জীবন-রসের বিন্দুমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। শুধু তার চোখদুটো পূর্ণ জীবন্ত, চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে যেন ভয়াবহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেরগেইয়ের দিকে সে দৃষ্টি তাকে ছাড়ল না, এক পলকের তরেও না।

জিরোবার পরের ঘাটিতে পৌঁছানো মাত্রই কাতেরিনা শান্ত পদক্ষেপে সেরগেইয়ের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, পিশাচ! সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ সোজা তার চোখে থুথু ফেলল।

সেরগেই লাফ দিয়ে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু আর সবাই তাকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখল।

শুধু বলল, দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।– আর হাত দিয়ে মুখ মুছল।

আর-সবাই ব্যঙ্গ করে বলল, অত রোয়াব কিসের, সে-ও তোমার মোকাবেলা করতে ডরায় না। আর-সকলের ঠাট্টা-হাসির মাঝখানে সোনেৎকার কলহাস্য শোনাল বড়ই ফুর্তিতে ভরা।

সোনেৎকার সাহায্যে যে গোটা ষড়যন্ত্রটা গড়ে উঠেছিল সেটা এখন তার সম্পূর্ণ পছন্দমতোই বিকশিত হচ্ছিল।

সেরগেই কাতেরিনাকে শাসাল, এত সহজে এর শেষ হবে না।

জলঝড়ের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্লান্ত অবসন্ন, ছিন্নভিন্ন হৃদয় নিয়ে কাতেরিনা সে রাত্রিতে কয়েদিদের শক্ত বেঞ্চে ছেঁড়া তন্দ্রার ভিতর মোটেই টের পেল না, কখন দুটো কয়েদি মেয়েদের ওয়ার্ডে ঢুকল।

ওরা ঢোকা মাত্রই সোনেল্কা তার বেঞ্চি থেকে গা তুলে নীরবে কাতেরিনাকে দেখিয়ে দিয়ে, ফের শুয়ে পড়ে কয়েদিদের লম্বা কোট দিয়ে সর্বাঙ্গ জড়িয়ে নিল।

সেই মুহূর্তেই কে যেন কাতেরিনার লম্বা কোট তার গা থেকে তুলে নিয়ে মুখের উপর ছুঁড়ে ঢেকে দিল আর তার পিঠের সুদ্ধমাত্র খসখসে শেমিজের উপর মোটা ডবল দড়ির শেষ প্রান্ত দিয়ে নির্মম চাষাড়ে বলপ্রয়োগ করে বেধড়ক চাবকাতে লাগল।

কাতেরিনা চিৎকার করে উঠল, কিন্তু মুখে-মাথায় জড়ানো কোটের ভিতর দিয়ে তার কণ্ঠস্বর বেরোতে পারল না। সে উঠে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তাতেও ওই একই অবস্থা– এক তাগড়া কয়েদি তার কাঁধের উপর বসে তার বাহু দু-খানা জোরে চেপে ধরে রেখেছিল।

পঞ্চাশ! শেষ পর্যন্ত গুনে শেষ হল। কারওরই বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হল না, এটা সেরগেইয়ের গলা। দুই নিশাচর দোর দিয়ে অন্তর্ধান করল।

কাতেরিনা কোট থেকে মাথা ছাড়িয়ে লাফ দিয়ে উঠল; সেখানে কেউ নেই, কিন্তু অদূরে লম্বা কোটের নিচে কে যেন হাসছে, নির্মম ব্যঙ্গের ঘেন্না ঈর্ষার হাসি। কাতেরিনা সোনেৎকার হাসি চিনতে পারল।

এ অপমান যে সর্ব-সীমানা পেরিয়ে গেল। আর সীমাহীন ঘৃণা যন্ত্রণা সেই মুহূর্তে কাতেরিনার অন্তরের অন্তস্তলকে যেন সিদ্ধ করতে লাগল। মতিচ্ছন্ন পাগলের মতো সে সমুখপানে ধেয়ে গেল, মতিচ্ছন্নের মতো টলে পড়ল তিয়েনার বুকের উপর পড়ার সময় সে তাকে তুলে ধরল।

কাতেরিনা ঢলে পড়ল তিয়োনার বুকের উপর। এই পূর্ণ উরসই কিছুদিন পূর্বে তারই বিশ্বাসঘাতক প্রেমিককে আনন্দ দিয়েছে পাপাত্মার কাম্য হেয় মাধুর্য দিয়ে। তারই উপর সে কেঁদে ভেঙে পড়ল তার অসহ বেদনার শোক নিয়ে। তারই সরলা কোমলা সপত্নীকে সে জড়িয়ে ধরল, শিশু যেরকম মাকে জড়িয়ে ধরে। তখন তারা দুজনাই এক সমান; দুজনাকে একই মূল্যে নামানো হয়েছে, দুজনাকেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে।

দুজনাই এক সমান… তিয়োনা– যার দিকে তার পয়লা খেয়াল গেল তার কাছেই যে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, আর কাতেরিনা– সে তার হৃদয়-নাট্যের শেষ দৃশ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।

কিন্তু সত্য বলতে কী, এখন আর কোনও অবমাননা তার কাছে অবমাননা বলে মনে হয় না। তার চোখের জল শেষ করে সে এখন শক্ত হয়ে গিয়েছে, যেন সে পাথর হয়ে গিয়েছে, আর এখন সে কাঠের পুতুলের মতো শান্ত হয়ে রোল কলে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল।

ড্রাম বেজে উঠল, দ্রম্-দ্রমাদ-দ্রমাদ-দ্রম্। শিকলে বাঁধা শিকলহীন উভয় শ্রেণির নিরানন্দ নিষ্প্রভ কয়েদির দল যেন অদৃশ্য হস্তের ধাক্কা খেতে খেতে ঘাঁটির চত্বরে বেরিয়ে এল। সেরগেই আছে সেখানে, আর আছে তিয়োনা, সোনেৎকা, কাতেরিনা, আছে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে দণ্ডিত আদর্শবাদী এক কয়েদি এক ইহুদির সঙ্গে শিকলে বাঁধা, একই শিকলে বাঁধা এক পোল আর তাতার।

প্রথম তারা একসঙ্গে জটলা করে দাঁড়িয়েছিল; পরে চলনসই রকমের শৃঙ্খলায় সারি বেঁধে তারা রওনা দিল।

এরকম নিরানন্দ দৃশ্য বড়ই বিরল; পাঁচজনের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হৃদয়ে যাদের কণামাত্র আশার ছায়াটুকু পর্যন্ত নেই– এরা কয়েকজন লোক কাঁচা রাস্তার হিমশীতল কালো কাদায় ডুবতে ডুবতে যেন এগিয়ে চলেছে। তাদের চতুর্দিকের সবকিছু এমনি বিসদৃশ যে, আতঙ্কে মানুষের গা শিউরে ওঠে; অন্তহীন কাদামাটি, সিসার মতো বিবর্ণ আকাশ, সর্বশেষ-পত্রবর্জিত নগ্ন সিক্ত উইলো গাছ–আর তাদের লম্বা লম্বা শাখায় বসে আছে উস্কোখুস্কো পালকসুদ্ধ দাঁড়কাকের দল। বাতাস কখনও গুমরে গুমরে ওঠে, তার কণ্ঠস্বর কখনও বা ক্রুদ্ধ, আর কখনও ছাড়ে তীব্র ক্রন্দনরব, আর কখনও-বা ভীষণ হুঙ্কার।

এই বীভৎস দৃশ্য দৃশ্যের পরিপূর্ণতা এনে দিয়েছে নরকের সেই গর্জন, যে গর্জন মানুষের আত্মাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সে গর্জনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বাইবেলের মহাপুরুষ আইয়ুবের অভিসম্পাত ধ্বংস হোক সেই দিন যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করি, আর তাঁর প্রতি তাঁর স্ত্রীর উপদেশ : তোমার ভগবানকে অভিশাপ জানিয়ে মরে যাও।

যারা এই উপদেশ-বাণীতে কর্ণপাত করে না, এরকম বীভৎস অবস্থায় যাদের মনে মৃত্যু-চিন্তা প্রলোভনের চেয়ে ভয়ের সৃষ্টি করে বেশি তাদের করতে হয় বীভৎসতর এমন কিছু যেটা এই আর্ত ক্রন্দনধ্বনির টুটি চেপে ধরে তাকে নীরব করে দেবে। এই তত্ত্বটি আমাদের নিত্যদিনের সাধারণ সাদামাটা সরল মানুষ উত্তমরূপেই হৃদয়ঙ্গম করতে জানে; এরকম অবস্থায় সে লাগাম ছেড়ে তার নির্ভেজাল নীচ পাশবিক প্রবৃত্তিকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেয়; সে তখন সাজতে যায় সঙ, নিজেকে নিয়ে আরম্ভ করে নিষ্ঠুর খেলা, অন্য পাঁচজন মানুষকে নিয়েও, তাদের কোমলতম হৃদয়ানুভূতি নিয়ে। এরা এমনিতেই অত্যধিক কোমল স্বভাব ধরে না– এরকম অবস্থায় পড়ে তারা হয়ে যায় দ্বিগুণ পিশাচ।

***

কাতেরিনা-নিগ্রহের পরের দিন ভোরবেলা কয়েদির দল যখন গ্রামের ভিতরকার ঘাটি ছেড়ে সবেমাত্র রাস্তায় নেমেছে তখন সেরগেই ইতর কণ্ঠে কাতেরিনাকে শুধাল, ওগো আমার পটের বিবি, সদাগরের ঘরণী–সম্মানিতা মহাশয়া সর্বাঙ্গীণ কুশলে স্বাস্থ্য উপভোগ করছেন তো?

কথা কটা শেষ করেই সে তৎক্ষণাৎ সোনেৎকার দিকে ফিরে তাকে তার লম্বা কোটের এক পাশ দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে তার তীব্র কণ্ঠ তীব্রতর করে গেয়ে উঠল :

সোনালি চুলের কোমল মাথাটি দেখিনু জানালা দিয়া,
 কুগ্রহ মোর,* ঘুমোও নি তুমি? আবার ভাঙিবে হিয়া! বুকের ভিতর জড়ায়ে রাখিব মম গুণ্ঠনে, প্রিয়া।

[* যে রাত্রে সেরগেই ফাঁকি দিয়ে কাতেরিনার কাছ থেকে মোজাজোড়াটি আদায় করে, তখন কাতেরিনা তাকে আমার সর্বনাশের নিধি বলে সোহাগ করেছিল। এখানে সেটা কুগ্রহ মোর। কাতেরিনাকে সেই সোহাগ স্মরণ করিয়ে দেবার জন্যই সেরগেই বিশেষ করে এই গানটাই ধরল।]

গানটা গাইতে গাইতে সেরগেই সোনেৎকাকে জড়িয়ে ধরে তামাম কয়েদির পালের চোখের সম্মুখে তাকে সশব্দে চুম্বন করল।

কাতেরিনা এসব দেখল, অথচ সত্যই যেন দেখতে পেল না। এমন অবস্থায় সে তখন পৌঁছেছে যেন প্রাণহীনা একটা পুতুল হেঁটে চলেছে আর সবাই তাকে খোঁচাতে আরম্ভ করেছে; তাকে দেখাচ্ছে, সেরগেই কীরকম অশ্লীলভাবে সোনেৎকার সঙ্গে ঢলাঢলি লাগিয়েছে। সে তখন সকলের সর্বপ্রকার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের বলির পাঁঠা।

যেন পিছন থেকে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে কাতেরিনা এগোচ্ছে। এ অবস্থায়ও কেউ তাকে নিয়ে ঠাট্টা জুড়ে দিলে তিয়োনা মাঝখানে পড়ত; বলত, ছেড়ে দে না ওকে, পিচেশের দল, দেখছিসনে, ওর যে হয়ে এসেছে।

এক ছোকরা কয়েদি যেন বাক্‌পটু হয়ে বলল, ওর ছোট্ট পা দুখানি বোধহয় ভিজে গিয়েছে।

সেরগেই পাল্লা দিয়ে বলল, এ তথ্য সর্বজন-স্বীকৃত যে, আমাদের সম্রান্ত বণিক সম্প্রদায়ের মহিলাগণকে সাতিশয় সুকোমলভাবে লালনপালন করা হয়। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, তার যদি একজোড়া গরম বিবিয়ানির মোজা থাকত তা হলে হাঙ্গামা কমে যেত।

কাতেরিনা যেন গভীর ন্দ্রিা থেকে সাড়া দিল, জেগে উঠল।

গুঁতোতে গুঁতোতে তাকে যেন সহ্যের সীমানার ওপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে- ঘাসেতে লুকনো জঘন্য সাপ তুমি! ঠাট্টা করে হাসো আমাকে নিয়ে ইতর বদমায়েশ হাসো, আরও হাসো!

কী বলছেন আপনি, সদাগরের পটের বিবি! আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করার কোনও মতলবই আমার নেই। আসলে সোনেল্কা হেথায় যখন সত্যই এত সুন্দর মোজা বিক্রি করছে, তখন ভাবলুম– কেন, দোষ করেছি নাকি? আমাদের সদাগরের বেগম সায়েবা হয়তো একজোড়া কিনলেও কিনতে পারেন।

প্রচুর হাস্যধ্বনি উঠল। দম দেওয়া কলের মতো কাতেরিনা সামনের দিকে পা ফেলল।

আবহাওয়া ক্রমাগত আরও খারাপ হচ্ছে। এতদিন যে ধূসর মেঘ আকাশ ঢেকে রেখেছিল এখন তার থেকে নেমে এল স্তরে স্তরে ভেজা-বরফের পাঁজ। মাটি ছোঁয়া মাত্রই এরা গলে গিয়ে রাস্তার কাদার গর্তকে করে দেয় আরও গভীর– সেটাকে ঠেলে ঠেলে পা চালানো করে দেয় আরও অসহ্য কঠিন কঠোর। অবশেষে সম্মুখে দেখা দিল সিসার রঙের একটা রেখা। সে রেখার অন্য তীর চোখে ধরা পড়ে না। এই রেখাঁটি ভলগা নদী। অল্প অল্প জোর হাওয়া ভলগার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে আর বড় বড় কাটা কাটা ঢেউ সামনে পিছনে খেদিয়ে নিয়ে চলেছে।

সর্বাঙ্গ জবজবে ভেজা, শীতে কাঁপতে কাঁপতে কয়েদির দল আস্তে আস্তে ঘাটে পৌঁছে খেয়ার বিরাট কাঠের ভেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

কালো ভেলার কাঠ থেকে জল ঝরছে। পাড়ে এসে ভিড়তে প্রহরীরা কয়েদিদের ভেলাতে ওঠবার ব্যবস্থা করতে লাগল।

সর্বত্র ভেজা বরফের পোঁচ-মাখা ভেলা ঘাট ছেড়ে উন্মত্ত নদীর ঢেউয়ের উপর দোলা খেতে লাগল। ভেলা ছাড়ার সময় কয়েদিদের একজন বলল, কারা সব বলাবলি করছিল, ভেলাতে কার কাছে যেন বিক্রির জন্য ভদ্কা শরাব আছে।

সেরগেই বলল, সত্যি বলতে কি, সামান্য কোনও মাল দিয়ে গলার নালিটা ভেজাবার এই সুযোগটা হারানো বড়ই পরিতাপের বিষয় হবে। সোনেৎকার ফুর্তির জন্য সে তখন কাতেরিনাকে পি খোঁচা দিয়ে উৎপীড়ন করতে শুরু করেছে– আপনি কী বলেন, আমাদের সদাগরের পটের বিবি? পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে এক পাত্তর ভদ্কা দিয়ে আমাদের চিত্তবিনোদন করলে কীরকম হয়? আহা, কিপটেমি করবেন না। স্মরণ কর, প্রিয়তমা, আমাদের অতীতের প্রেমের কথা! আমি আর তুমি ওগো আমার জীবনের আনন্দময়ী, তোমাতে-আমাতে দুজনাতে কত না দীর্ঘ শরৎ-হেমন্তের রাত কাটিয়েছি পাশাপাশি বসে, তোমাতে-আমাতে কত না আনন্দে সময় কাটিয়েছি কত না হেলাফেলায়; কেবলমাত্র তোমাতে-আমাতে দুজনাতে মিলে তোমার প্রিয় আত্মীয়-আত্মজনকে ওপারের চিরশান্তিতে পাঠিয়েছি– একটিমাত্র পাত্রিপুরুতের কণামাত্র সাহায্য না নিয়ে।

শীতে কাতেরিনার সর্বাঙ্গ থর থর করে কাঁপছিল। সে শীত তার জবজবে ভেজা কাপড়-জামা ভেদ করে তার অস্থি-মজ্জা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল… তার ওপর আরও কী যেন কী একটা তার সর্বসত্তা আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। তার মাথা জুলছিল… সত্যই যেন তার ভিতরে আগুন ধরানো হয়েছে… তার চোখের মণি অস্বাভাবিক রকমে বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছে, এক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ জ্যোতি এসে সে মণির এখানে-ওখানে নাচছে, আর তার দৃষ্টি ঢেউয়ের দোলার দিকে নিশ্চল-নিবদ্ধ।

সোনেৎকার গলা ছোট্ট একটি রুপোর ঘণ্টার মতো রিনিঝিনি করে উঠল, মাইরি বলছি, এক ফোঁটা ভদকা পেলে আমি বেঁচে যেতুম; এ শীতটা যে আমি কিছুতেই সইতে পারছিনে।

সেরগেই ক্রমাগত খোঁচা দিয়ে যাচ্ছিল, আসুন না, আমার সদাগরের বেগম, আমাদের একটু খাইয়েই দিন না।

ভর্ৎসনা-ভরা মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে তিয়োনা বলল, ছিঃ! তুমি আবার কেন? বিবেক বলে কি তোমার কোনও বস্তু নেই?

ছোকরা কয়েদি গদিউশকা তার সাহায্যে নেমে বলল, সত্যি, এসব ভালো হচ্ছে না।

ওর সম্বন্ধে তোমার বিবেকে না বাধলেও, অন্তত আর পাঁচজনের সামনে তোমার হায়া-শরম থাকা উচিত।

সেরগেই তিয়োনার দিকে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, তুই মাগী বিশ্বতোষক! তুই আর তোর বিবেক! তুই কি সত্যি ভাবিস ওর জন্যে আমাকে আমার বিবেক খোঁচাবে? কে জানে, আমি আদপেই তাকে কখনও ভালোবেসেছিলুম কি না, আর এখন– এখন তো সোনেৎকার হেঁড়া চটিজুতোটি পর্যন্ত ওই চামড়া-ছোলা বেড়ালটার জঘন্য মুখের চেয়ে আমার ঢের বেশি ভালো লাগে। কিছু বলছ না যে? শোন, আমি কি বলি। সে বরঞ্চ ওই বাকামুখো গদিউশকাটার সঙ্গে পিরিত করুক; কিংবা এবারে সে সন্তর্পণে চতুর্দিক দেখে নিয়ে হিজড়েপানা, ফেলুটের জোব্বা-পরা, মাথায়-ঝুঁটিদার-মিলিটারি-টুপিওলা, কয়েদিদের ঘোড়সওয়ার অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, তার চেয়েও ভালো হয় যদি দলের ওই বড় অফিসারের সঙ্গে জুটে যায় আর কিছু না হোক ওই জোব্বার নিচে সে বৃষ্টিতে ভিজবে না।

আবার সোনেৎকার গলা ছোট্ট একটি ঘণ্টার মতো রিনিঝিনি করে উঠল, আর, তখন সবাই তাকে অফিসারের বিবি বলে ডাকবে।

ফোড়ন দিয়ে সেরগেই বলল, একদম খাঁটি কথা… আর একজোড়া গোঁজার জন্য তার কাছ থেকে পয়সা জোগাড় করাটা হবে ছেলে-খেলা!

কাতেরিনা আত্মপক্ষ সমর্থন করল না; সে আরও স্থির অবিচল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঢেউগুলোর দিকে, শুধু তার ঠোঁট দুটি নড়ছে। সেরগেইয়ের জঘন্য কুবাক্যের ভিতর দিয়ে তার কানে আসছিল নদীর উত্তাল তরঙ্গের জুম্ভন-বিজড়নের বিক্ষোভিত ধ্বনি, যন্ত্রণাসূচক আতাঁরব। হঠাৎ একটা ঢেউ বিরাট হাই তুলে ভেঙেপড়ার সময় তার মাঝখানে কাতেরিনার সামনে দেখা দিল বরিস তিমোতেইয়েভিচের বিবর্ণ মুখ, আরেকটার মাঝখান থেকে উঁকি মেরে তাকাল তার স্বামী, তার পর সে ফেদিয়াকে কোলে নিয়ে ডাইনে-বায়ে দুলতে লাগল– ফেদিয়ার অবশ্য মাথা ঢলে পড়েছে। কাতেরিনা তার দেবতার উদ্দেশে কোনও প্রার্থনা স্মরণে আনবার চেষ্টা করে ঠোঁট নাড়াল, কিন্তু ক্ষীণস্বরে বেরিয়ে এল, তোমাতে-আমাতে দুজনাতে। কত না দীর্ঘ শরৎ-হেমন্তের রাত কাটিয়েছি পাশাপাশি বসে, তোমাতে-আমাতে কত না আনন্দে সময় কাটিয়েছি কত না হেলাফেলায়; এই বিরাট বিশ্ব থেকে তোমাতে-আমাতে মানুষ ওপারে পাঠিয়েছি নিষ্ঠুর মৃত্যুর ভিতর দিয়ে।

কাতেরিনা লভভনা কাঁপছিল। তার দৃষ্টি এদিক-ওদিক ছুটোছুটি ছেড়ে ক্রমেই একটি বিন্দুতে নিবদ্ধ হয়ে আসছিল। সে দৃষ্টি পাগলিনীর মতো। দু-একবার তার হাত দু-খানি মহাশূন্যের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে উঠে আবার পড়ে গেল। আরেক মিনিটকাল অতীত হল—- হঠাৎ তার সমস্ত শরীর সামনে-পিছনে দুলতে আরম্ভ করল; একবার এক মুহূর্তের তরেও তার দৃষ্টি কালো একটা ঢেউয়ের থেকে না সরিয়ে সে সামনের দিকে নিচু হয়ে সোনেৎকার পা দু-খানি চেপে ধরে এক ঝটকায় ভেলার পাশ ডিঙিয়ে তাকে সুদ্ধ নিয়ে ঝাঁপ দিল নদীর তরঙ্গে।

বিস্ময়ে সবাই যেন পাথর হয়ে গিয়েছে।

একটা ঢেউয়ের চূড়ায় কাতেরিনা ভনা দেখা দিয়ে আবার তলিয়ে গেল, আরেকটা ঢেউ সোনোকে তুলে ধরল।

নৌকোর আঁকশিটা! নৌকোর আঁকশিটা ছুঁড়ে দাও!– ভেলা থেকে সমস্বরে চিৎকার উঠল।

লম্বা দড়িতে বাঁধা নৌকার ভারী আঁকশিটা শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে জলের উপর পড়ল। সোনেল্কা আবার জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ভেলার পিছনকার স্রোতের টানে জলের নিচে অদৃশ্য অবস্থায় দ্রুতবেগে পিছিয়ে পড়ে সোনেৎকা দু সেকেন্ড পরে আবার উপরের দিকে তার দুবাহু উৎক্ষেপ করল; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা আরেকটা ঢেউয়ের উপরে প্রায় কোমর পর্যন্ত জলের উপর তুলে সোনেৎকার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল– দৃঢ় বর্ষা যেরকম ক্ষুদ্র মৎস্য-শাবকের ক্ষীণ প্রতিরোধ উপেক্ষা করে তাকে ভেদ করে চেপে ধরে।

দুজনার কেউই আর উপরে উঠল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *