গান ভোররাত পর্যন্ত হবার কথা–বৃষ্টির জন্যে সব এলোমেলো হয়ে গেল। অল্পসল্প বৃষ্টি হলে একটা কথা ছিল–আষাঢ় মাসের মুষল ধারার বৃষ্টি। আসর ভেঙে দেয়া ছাড়া গতি কি?
মতি খুব মন খারাপ করে ভিজতে ভিজতে ঘরে ফিরেছে। ঘরে পৌঁছার পর মনে হয়েছে কেরোসিন নেই, হারিকেন জ্বালানো যাবে না। আজ বিকেলেই বোতলের সবটুক কেরোসিন হ্যাজাক লাইটে ভরতে হয়েছে। ঘরের জন্যে আর কেনা হয়নি।
ভেজা কাপড় বদলানোর জন্যে শুকনো কাপড় খুঁজে বের করতে হবে। অন্ধকারে এই কাজটা করা সম্ভব না। পাঞ্জাবির পকেটে রাখা দেয়াশলাই ভিজে চুপ চুপ করছে। ঘরে আর কোন দেয়াশলাই আছে বলেও মনে হয় না।
আলোর চেয়েও বড় সমস্যা–অসম্ভব খিদে লেগেছে। ভরপেটে গান গাইতে ওস্তাদের নিষেধ আছে। মতি ভরপেটে গানের আসর করে না। সে দুপুরে খেয়েছিল তারপর আর কিছু খায়নি। খিদেয় শরীর ভেঙে আসছে। প্রচণ্ড ঝাল কোন তরকারি দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। তরকারি না হলেও ক্ষতি নেই–গরম ভাত হলেও হবে। শুকনো মরিচ ভেজে, পেঁয়াজ তেল মাখিয়ে একটা ভর্তা বানাতে পারলে সেই ভর্তামাখা ভাত খেতে হবে অমৃতের মত। ভাত রাঁধার উপায় নে, আগুন নেই। থাকলেও রাঁধতে ইচ্ছা করবে না। শরীর ঝিম ঝিম করছে–জ্বর আসবে হয়ত। শরীর অশক্ত হয়ে পড়েছে, অল্পতেই জ্বরজারি হয়। গান-বাজনা পরিশ্রমের কাজ। শরীর ঠিক না থাকলে গান-বাজনা হয় না। মতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল–শরীর ঠিক রাখবে কি ভাবে–দুবেলা খাওয়াই জুটে না।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে শুকনো লুঙ্গি বের করল, গেঞ্জি বর করল। কাঁথা বের করে গায়ে দিল–শীত লাগছে। গায়ে কাঁপন ধরেছে।
খিদের জন্যে শরীর ঝিম ঝিম করছে। চিড়া বোধ হয় আছে। কয়েক মুঠো শুকনো চিড়া চিবিয়ে পানি খেয়ে শুয়ে থাকা যায়। শরীর যদিও ভাত ভাত করছে। করলে তো লাভ হবে না। সবই আল্লাহপাকের নির্ধারণ করা। তিনি যদি ঠিক করে রাখেন দু মুঠো শুকনো চিড়া তাহলে শুকনো চিড়াই খেতে হবে। উপায় কি!
অন্ধকারে মতি যে হাড়িতে চিড়া রাখা ছিল সেই হাড়ি খুঁজে পেল না। ভালই হল। খিদে পেটে ঘুম আসে না–কিন্তু খিদে প্রচণ্ড হলে ভাল ঘুম হয়। রাতটা পড়েছে ঘুমের।
গান গেয়ে মতি আজ খুশি। সে জানে সে ভাল গেয়েছে। এইসব জিনিশ কাউকে বলে দিতে হয় না। বোঝা যায়। নিজের মনই নিজেকে বলে দেয়। রাজবাড়ির মেয়ে দুটির গান ভাল লেগেছে কি না কে জানে। মনে হয় লাগেনি। গানের মাঝখানে দুজন উঠে গেল। মতি সবচে ভাল যে গানটি গেয়েছে সেটা শুনে যেতে পারল না।
তুই যদি আমার হইতি
আমি হইতাম তোর–
কোলেতে বসাইয়া তোরে করিতাম আদর…
এই গান তারা না শোনায় ভালই হয়েছে। এই গানের মর্ম শহরের মানুষের বোঝার কথা না। সবার জন্য সব জিনিশ না…
মতি জাগনা আছ?
কে?
আমি। আমি জয়নাল।
মতি দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। ছাতি মাথায় জয়নাল উঠোনে দাঁড়িয়ে। তার হাতে হারিকেন। অন্য হাতে গামছা বাঁধা এলুমিনিয়ামের গামলা।
বিষয় কি জয়নাল?
ভাত আনছি।
মতি বিস্মিত হয়ে বলল, ভাত?
হ ভাত। কুসুম পাঠাইছে। গান শেষ হইতেই কুসুম কইল–জয়নাল ভাই, আমারে এট্টু আগাইয়া দেন। আগাইয়া দিলাম। শেষে কইল, মতি ভাইয়ের জন্যে ভাত লইয়া যান।
মতির প্রাথমিক বিস্ময় কেটে গেল। এর আগেও কুসুম গানের শেষে ভাত পাঠিয়েছে। সে জানে, মতি খালি পেটে গান গাইতে আসরে উঠে। গান শেষে অভুক্ত অবস্থায় ঘুমুতে যায়।
জয়নাল দাওয়ায় ভাতের গামলা নামিয়ে রাখল। মতি বলল, হারিকেন থুইয়া যাও জয়নাল–আমার ঘরে বাত্তি নাই। আইজ গান কেন হইছে?
জয়নাল উৎসাহের সঙ্গে বলল, দুর্দান্ত গান ইইছে মতিভাই। গলা একখান আল্লাহপাক আপনেরে দিছিল। সোনাদিয়া,এই গলা বান্ধাইয়া রাখন দরকার। কুসুমেরও গান খুব মনে ধরছে।
বলছে কিছু?
বলছে–মতিভাই আইজ গান গাইয়া মাইনষের চউকে পানি আনছে। মতিভাইয়ের কপালে অনেক দুঃখ।
এই কথা বলল ক্যান?
কুসুমের কি মাথার ঠিক আছে–যা মনে অয় কয়–তয় মতিভাই, জব্বর গান হইছে–পিথিমীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। খাইতে বসেন–ভাত গরম আছে।
তুমিও চাইরডা খাও আমার সাথে জয়নাল।
না না–আফনে খান। আমি যাইগা–বিষ্টি কি নামছে দেখছেন মতিভাই…?
পিথিমী না ডুইব্যা যায়!
উঠোনে পানি জমে গেছে। পানিতে থপ থপ শব্দ তুলে জয়নাল চলে গেল। মতি খেতে বসল। গরম ভাত, ডিমের তরকারি, বেগুন ভর্তা, ডাল–এক্কেবারে রাজা বাদশার খানা।
খেতে খেতে মতির মনে হল–আজ সে আসলেই ভাল গেয়েছে। ভাল গেয়েছে বলেই আল্লাহপাক তার কপালে লিখেছেন–গরম ভাত, ডিমের ঝোল–তাকে তিনি অনাহারে ঘুমুতে দেননি। কুসুম কেউ না–সে শুধুই উপলক্ষ, উছিলা। আল্লাহপাক সরাসরি কিছু করেন না–যা করার উছিলার মাধ্যমে করেন।