খোকনদের বাড়ি খুব চুপচাপ হয়ে গেছে।
অনজু আর বিলু এখন আর চেঁচিয়ে এক্কাদোক্কা খেলে না। বড়চাচা সারা দিন তার নিজের ঘরেই বসে থাকেন। কারও সঙ্গে বিশেষ কথাটথা বলেন না। খোকনও বেশিরভাগ সময় থাকে তার নিজের ঘরে। সময় শুথ হয়ে গিয়েছে। মা মারা গেছেন মাত্র তিন দিন আগে অথচ খোকনের কাছে মনে হয় বহু বৎসর কেটে গেছে। আজ সকালবেলা হঠাৎ কী মনে করে খোকন তার মায়ের ঘরে গেল। সবকিছু আগের মতো আছে। মার লাল রঙের চটি দুটি পর্যন্ত যত্ন করে তুলে রাখা।
খোকন।
খোকন দেখল, বাবা এসে দাঁড়িয়েছে, দরজার পাশে।
কী করছ খোকন?
কিছু করছি না।
এসো আমার ঘরে এসো। আমরা গল্প করি।
খোকন তার বাবার সঙ্গে চলে গেল। বাবাও যেন কেমন হয়ে গেছেন। হঠাৎ করে তার যেন অনেক বয়স বেড়ে গেছে।
খোকন, মার জন্যে খারাপ লাগছে?
হুঁ।
লাগাই উচিত।
বাবা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ব্যক্তিগত দুঃবই সবচেয়ে বড় দুঃখ। আমাদের কথাই ধরো, আমরা নিজেদের দুঃখে কাতর হয়ে আছি, ঠিক না?
হ্যাঁ।
কিন্তু দেশের কী অবস্থা হচ্ছে বুঝতে পারছ তো? খুব খারাপ অবস্থা। এবং যতই দিন যাবে ততই খারাপ হবে।
খোকন কিছু বলল না। নিচ থেকে এই সময় বড়চাচির কান্না শোনা গেল। বাবা চুপ করে গেলেন। কবীর ভাই এখনো ফিরে আসেননি। বড়চাচি দিনরাত সর্বক্ষণ তার জন্যে কাঁদেন। দিনেরবেলায় কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু রাতেরবেলা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাবা বললেন, একমাত্র মহাপুরুষদের কাছেই ব্যক্তিগত দুঃখের চেয়েও দেশের দুঃখ বড় হয়ে ওঠে। আমরা মহাপুরুষ না। আমাদের কাছে আমাদের কষ্টটাই বড় কষ্ট।
বড়চাচির কান্নার শব্দ ক্রমেই বাড়তে লাগল। বাবা চুপ করে বসে রইলেন। তারপর প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যে বললেন, তোমার কি মনে হয় বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছেন?
আমি জানি না।
সে তো কেউ জানে না। কিন্তু তোমার কী মনে হয়?
আমার কিছু মনে-টনে হয় না।
এভাবে কথা বললে তো হবে না খোকন। এখন থেকে আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। খুব খারাপ সময় আমাদের সামনে।
খোকন চুপ করে রইল। বাবা শান্তস্বরে বললেন, এখন ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হবে। সেই যুদ্ধ অনেকদিন পর্যন্ত হয়তো চলবে। এর মধ্যেই তোমরা বড় হবে। কী খোকন, চুপ করে আছ কেন, কিছু বলো।
কী বলব?
ওদের সঙ্গে যুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে।
কে বলেছে?
বোঝা যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি। তোমার কী মনে হয়? হচ্ছে না?
হ্যাঁ।
খোকন, এই যুদ্ধে কে জিতবে?
উত্তর দেওয়ার আগেই ছোটচাচি এসে বললেন, খাবার দেওয়া হয়েছে?
রাহেলাকে দেখে মনে হচ্ছে তার জীবনের ওপর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। গত দুরাতে এতটুকুও ঘুমুতে পারেননি। তার চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ ফ্যাকাসে। বাবা বললেন, আমরা একটু পরে আসি।
না, এখনই চলে আসেন। ঝামেলা সকাল সকাল চুকে যাক।
আসছি, আমরা আসছি।
খাবার টেবিলে বড়চাচা বললেন, আমাদের এখন কী করা উচিত, গ্রামে যাব।
আমিন চাচা গম্ভীর মুখে বললেন, গ্রামে পালিয়ে গিয়ে কী হবে?
এখানে এরকম আতঙ্কের মধ্যে থাকা। সবার মনের ওপর খুব চাপ পড়ছে।
গ্রামে পালিয়ে গেলেও সেই চাপ কমবে না। তা ছাড়া কবীর কোথায় আছে আমরা জানি না। ওকে এখানে ফেলে রেখে যেতে পারি না।
ছোটচাচার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাহেলা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলল, আমি কোথাও যাব না। আমি আমেরিকা চলে যাব। আমি এই দেশে থাকব না।
আমিন চাচা কী একটা বলতে চাইলেন। বড়চাচা ইশারা করে তাকে থামিয়ে দিলেন। রাহেলা শিশুদের মতো কাঁদতে শুরু করলেন।
সব ঠিক হয়ে যাবে রাহেলা।
না, কিছুই ঠিক হবে না।
শান্ত হয়ে বসো।
আমি আর সহ্য কবুতে পারছি না।
হঠাৎ আমিন চাচা বললেন, সবাই চুপ। একটি কথাও না। সবাই তাকাল তার দিকে। তিনি চাপা গলায় বললেন, শব্দ শোনা যাচ্ছে।
কিসের শব্দ?
আমার মনে হয় একটা মিলিটারি গাড়ি এসে থেমেছে।
সবাই নিঃশব্দ হয়ে গেল। দীর্ঘসময় কেউ কোনো কথা বলল না। গেটের কুকুরটি শুধু ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। আমিন চাচা ভুল শুনেছিলেন, ওটা মিলিটারি গাড়ি ছিল না।
সাজ্জাদরা নীলগঞ্জে এসে পৌঁছল আটাশ তারিখ সন্ধ্যায়। খুব ঝামেলা করে আসা। প্রথমে শোনা গেল মীরপুর ব্রিজ কাউকে পার হতে দেওয়া হচ্ছে না। মিলিটারি চেকপোস্ট বসেছে। যারাই শহর ছাড়তে চাচ্ছে তাদেরকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কথাবার্তা পছন্দ হচ্ছে না তাদের আলাদা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদের ভাগ্যে কী ঘটছে কিছু বলা যাচ্ছে না। দাদুমণিরা মীরপুর ব্রিজের কাছে এসে পৌঁছলেন দুপুরে । তের চোদ্দজন মিলিটারির একটা দলকে সেখানে সত্যি সত্যি দেখা গেল। এবং দেখা গেল দুটি ছেলেকে ওরা কী সব যেন জিজ্ঞেস করছে। ছেলে দুটি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। নীল বলল, ওদের কী জিজ্ঞেস করছে? দাদুমণি উত্তর দিলেন না। নীলু বলল, ওরা এরকম করছে কেন?
তুমি ওদিকে তাকিয়ো না। ওদের যা ইচ্ছা করুক।
সাজ্জাদের বোন বলল, ওরা আমাদের ধরবে?
না, আমাদের ধরবে না।
ওরা সত্যি সত্যি কিছু বলল না। তবে বাস থেকে প্রতিটি লোককে নামাল। এবং কোনো কারণ ছাড়াই বুড়োমতো একটা লোকের পেটে হাঁটু দিয়ে প্রচও গুতো দিল। লোকটি উলটে পড়ে কো কো শব্দ করতে লাগল। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে মিলিটারির সেই জোয়ান হাত নেড়ে সবাইকে বাসে উঠতে বলল। সবাই বাসে উঠল। বুড়ো লোকটি উঠতে পারল না। তার সম্ভবত খুব লেগেছে। সে মাটিতেই গড়াগড়ি খেতে লাগল। নীলু ফিসফিস করে বলল, ওকে মারল কেন দাদুমণি? ও কী করেছে?
জানি না। কিছু করেছে বলে তো মনে হয় না।
তাহলে শুধু শুধু মারল কেন?
মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে চায়। এইজন্যেই এসব করছে। কিংবা হয়তো অন্যকিছু। আমি জানি না।
আরিচাঘাটে পৌঁছে খুব মুশকিল হলো। ফেরী নেই। নৌকায় করে কিছু লোক পারাপার করছে। কিন্তু নৌকার সংখ্যা খুবই কম। নৌকা জোগাড় হলো না। মাথার ওপর কড়া রোদ। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। নীলু বলল তার শরীর খারাপ লাগছে।
দাদুমণি চিন্তিত মুখে বললেন, ঢাকায় ফিরে যাওয়াই বোধহয় ভালো। সাজ্জাদ কী বলো?
না, ঢাকায় যাব না।
নীল, তুমি কী বলো?
নীলু থেমে থেমে বলল, আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।
সন্ধ্যার দিকে একটা ট্রাক এল, সেটি আবার ঢাকা ফিরে যাবে। ট্রাকের ড্রাইভার বলল, আপনারা যাবেন ঢাকায়।
না গিয়েই বা উপায় কী? রাত কাটানোর একটা জায়গার দরকার। ট্রাকে উঠেই নীলুর প্রচণ্ড জ্বর এসে গেল। সে দুবার বমি করে নেতিয়ে পড়ল।
আকাশের অবস্থা ভালো না। ঝড়বৃষ্টি হবে হয়তো। দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সাজ্জাদের বোন নীলুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আরও চারজন মহিলা আছেন ওদের সাথে। ওরা সবাই বসেছে পাশাপাশি। তাদের সঙ্গে তিন-চার বছরের দুটি ফুটফুটে বাচ্চা। এরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ট্রাকে বসে থাকা লোকগুলি কোনো কথা বলছে না। সবাই চিন্তিত। সবাই তাকিয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। একজন কে যেন বলল, বৃষ্টি নামলে মুশকিল হবে। কেউ তার জবাব দিল না।
কিছুদর পর ট্রাককে আবার ফিরে আসতে হলো আরিচা ঘাটে। ঢাকায় যাওয়া যাবে না। খুব গণ্ডগোল হচ্ছে। মিলিটারিরা নাকি মার্চ করে আসছে।
তারা সারা রাত বৃষ্টি মাথায় করে ট্রাকে অপেক্ষা করল। নদী পার হওয়ার নৌকা পাওয়া গেল না। কী কষ্ট, কী কষ্ট!