পঞ্চদশ অধ্যায়
ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া
ভারতের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। বাংলার এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক আইনসভাকে নির্দেশ দেয়া হয় যেন তারা প্রত্যেক দুই দুই ভাগে মিলিত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোকে নিয়ে এক ভাগ এবং অবশিষ্ট আর এক ভাগ। প্রত্যেক আইনসভার দুটি অংশের সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বসবেন এবং তাঁদেরকে এ অধিকার দেয়া হবে যে, তাঁর প্রদেশের বিভাগ চান কি চান না। যে কোন অংশের সরল সংখ্যাগুরু (Simple majority) যদি বিভাগের সপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে বিভাগ কার্যকর হবে। বিভাগরে সিদ্ধান্তের পর আইনসভার প্রত্যেক অংশ যে এলাকার প্রতিনিধিত্ব করে তাদের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেবে যে তারা বর্তমান গণপরিষদে যোগদান করবে, না নতুন গণপরিষদে। এ সিদ্ধান্ত হওয়ার পর গভর্ণর জেনারেল একটি ‘বাউন্ডারী কমিশন’ নিয়োগ করবেন পাঞ্জাবের দু’অংশের সীমানা চিহ্নিত করার জন্য। তা করা হবে মুসলিম ও অমুসলিম একত্রে লাগানো (Contiguous) সংখ্যাগুরু এলাকা নির্ণয়ের ভিত্তিতে। কমিশনকে অন্যান্য কারণ বিবেচনারও পরামর্শ দেয়া হয়। অনুরূপ নির্দেশ বেঙল বাউন্ডারী কমিশনকেও দেয়া হয়।
সিন্ধু আইনসভার ইউরোপিয়ান সদস্যগণ ব্যতীত অন্যান্যগণ একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা বর্তমান গণপরিষদে –না নতুন পরিষদে যোগদান করবেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গণভোট গ্রহণ করা হবে যে, সেদেশের ভোটারগণ কোন গণপরিষদে যোগদান করবে।
এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ বেলুচিস্তানকেও দেয়া হবে। বাংলা প্রদেশ বিভাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে আসামের সিলেট জেলায় গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এর ফলে সিদ্ধান্ত হবে যে তারা আসামের অংশ হিসাবে সিলেটকে পেতে চায়, না পূর্ব বাংলার সাথে মিলিত হতে চায়। নতুন প্রদেশের সাথে মিলিত হতে চাইলে ‘বাউন্ডারী কমিশন’ সীমানা চিহ্নিত করবে।
পাঞ্জাব ও বাংলা বিভাগের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে নিম্নলিখিত ভিত্তিতে গণপরিষদের নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবেঃ
প্রদেশ সাধারণ আসন মুসলিম শিখ মোট
সিলেট জেলা ১ ২ ০ ৩
পশ্চিম বংগ ১৫ ৪ ০ ১৯
পূর্ব বংগ ১২ ২৯ ০ ৪১
পশ্চিম পাঞ্জাব ৩ ১২ ২ ১৭
পূর্ব পাঞ্জাব ৬ ৪ ২ ১২
বৃটিশ সরকার জুন ১৯৪৮ এর পূর্বেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক বিধায় পার্লামেন্টের চলতি অধিবেশনেই আইন পাশ করা হবে যাতে এ বছরেই ‘ডমিনিয়ন স্টেটাস’-এর ভিত্তিতে একটি বা দুটি কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়।
ভাইসরায় দুসরা জুন সাত নেতার এক আলোচনা সভা আহবান করেন। তাঁরা হলেন নেহরু, প্যাটেল, কৃপালনী, জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, আবদুর রব নিশতার এবং বলদেব সিং। পরিকল্পনাটি তাঁদের কাছে পেশ করা হয় এবং তা অনুমোদিত হয়। মাউন্টব্যাটেন গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে একথা ব’লে তাঁকে সম্মত করার চেষ্টা করেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিকল্পনাটি অতি উত্তম। যদিও গান্ধী পরিকল্পনাটি বৃটেনে প্রেরণের পূর্বেই সমর্থন করেন, এখন তিনি বিরোধিতা করছেন –শুধু পৃথিবী এবং লীগকে ধোকা দেয়ার জন্যে।
তেসরা জুন পরিকল্পনাটি সারা দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করা হয়। ভাইসরয় ৪ঠা জুন সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে প্রতিটি পর্যায়ে ও মুহুর্তে তিনি নেতৃবৃন্দের হাত ধরাধরি করে কাজ করেছেন। সেজন্য পরিকল্পনাটি তাঁদের ক্ষোভ অথবা বিস্ময়ের কারণ হয়নি।
বিশ্ববাসীকে ধোকা দেয়ার জন্য এমন নিরেট মিথ্যা কথা বলতে তাঁর মতো দায়িত্বশীলের বিবেকে বাধেনি। পরিকল্পনাটি তাঁর স্টাফ সদস্যবৃন্দ, পরিকল্পনা প্রণেতা ভিপি মেনন এবং নেহরু ব্যতীত আর কেউ ঘুনাক্ষরেও জানতেন না। লীগের কাছেও তা গোপন রাখা হয়েছিল।
যাহোক উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করা হয় যে, ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭, ক্ষমতা হস্তান্তরের পরীক্ষামূলক তারিখ নির্ধারিত হয়।
নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি ১৪ই জুন মিলিত হয় এবং পরিকল্পনা মেনে নেয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে।সেই সাথে ভারত বিভাগ সম্পর্কে জোর দিয়ে একথা বলেন যে, ভূগোল, পর্বতমালা ও সমুদ্র ভারতের যে আকার আকৃতি নির্মাণ করে দিয়েছে, যেমনটি সে আছে, কোন মানবীয় সংস্থা তা পরিবর্তণ করতে পারেনা এবং তার চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ণয়ের পথে প্রতিবন্ধক হতে পারেনা। কমিটি বিশ্বাস করে যে যখন বর্তমান ভাবাবেগ প্রশমিত হবে, তখন ভারতের সমস্যাসমূহ তার যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতেই বিবেচিত হবে এবং দ্বিজাতিত্বের ভ্রান্ত মতবাদ কলংকিত ও পরিত্যক্ত হবে। আবুল কালাম আজাদ বলেন
, আমি নিশ্চিত যে বিভাগটি হবে ক্ষণস্থানয়ী। হিন্দু মহাসভা বলে, ভারত এক ও অবিভাজ্য এবং যতোক্ষণ না বিচ্ছিন্ন এলাকাসমূহ ভারত ইউনিয়নের সাথে সংযুক্ত করা হবে, ততোক্ষণ কোন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না।
ভবিষ্যতে ভারত এক ও অখন্ড হবে এ আশা বিভিন্ন হিন্দু নেতা
, গ্রন্থকার এবং পত্রপত্রিকা পোষণ করতেন এবং বিভাগের পূর্বে, বিভাগের সময়ে এবংপরে সে আশা ব্যক্ত করেছেন। ১৫ই আগষ্ট গান্ধী বলেন, আমি নিশ্চিত যে এমন এক সময় আসবে যখন এ বিভাগ পরিত্যক্ত হবে। কংগ্রেস মুখপত্র ‘দি হিন্দুস্তান টাইমস’ও তার সম্পাদকীয় প্রবন্ধে উক্তরূপ আশা ব্যক্ত করে। বিবাগ পরিকল্পনা প্রণেতা মেনন স্বয়ং বলেন, আগষ্ট ১৯৪৭ এর উদ্দেশ্য এ ছিলনা যে, দেড় শতাধিক বছর যাবত যে বন্ধনে ভারত বাঁধা আছে তা ছিন্ন করা হবে। হিন্দুদের মধ্যে এ এক সাধারণ বিশ্বাস ছিল যে, পাকিস্তান বেশী দিন টিকে থাকবেনা এবং কংগ্রেসের অধীনে ভারত একটি অখন্ড ভারতে পরিণত হবে –(Economist, 17 May 1947; Sunday Times 1 June 1947; Manchester Guardian 15 Auh. 1947, Round Table Sept. 1947 p.370; Guy Wint The British in Asia-p.179; I.H. Quershi The Struggle for Pakistan, pp.195-96)।
এসব বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া থেকে এ কথাই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, হিন্দু ভারত মনে প্রাণে পাকিস্তানের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭ থেকে এ কথা লেখার সময় পর্যন্ত (অক্টোবর ১৯৯৩) হিন্দুভারত সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান নামের সমগ্র ভূখন্ড গ্রাম করে অখন্ড ভারতে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। ১৯৪৭-পূর্ব ভারতের ভৌগলিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করার কথা এখন বিভিন্ন সেমিনার জনসভায় প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে ভারতের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসত অত্যন্ত জোরদার করা হয়েছে।
বড়োলাটগিরি নিয়ে ক্যানভাসিং ও বিতর্ক
ভারতের এ উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কংগ্রেস ও ভাইসরয় কুঠির প্রত্যেকেই এ ধারণা পোষণ করতেন যে দুটি নতুন ডমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল একই ব্যক্তি হবেন এবং তিনি মাউন্টব্যাটেন।
কয়েকদিন পূর্বে জিন্নাহ বলেছিলেন, দুটি ডমিনিয়নের গভর্ণর জেনারেলের উপরে একজন সুপার গভর্ণর জেনারেল হওয়া উচিত। এ ধারণা সম্ভবত এ জন্যে করা হয়েছিল যে বিভাগ সম্পর্কিত প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ দৃষ্টিভংগীসহ সহজে সম্পন্ন করা হবে। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন এর বিরোধিতা করেন এবং হোয়াইট হল মাউন্টব্যাটেনকে সমর্থন করে।
নেহরু যখন মাউন্টব্যাটেনকে ভারতের গভর্ণর জেনারেল হওয়ার প্রস্তাব দেন তখন তিনি নেহরু ও প্যাটেলকে বলেন যে তিনি অনুরূপ প্রস্তাবের আশা মুসলিম লীগ থেকেও করেন।
মাউন্টব্যাটেন বহু চেষ্টা করেও জিন্নাহকে সম্মত করাতে পারলেন না।
দুসরা জুলাই জিন্নাহ তাঁকে জানিয়ে দেন যে তিনি স্বয়ং পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল হওয়ার সিদ্ধান্ত করেছেন। তারপরও মাউন্টব্যাটেন আশা ত্যাগ করেন নি। তিনি ভূপালের নবাবকে দিয়েও চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। মাউন্টব্যাটেন এতে তাঁর আত্মসম্মানে বিরাট আঘাত পান। তবে এ কথা সত্য যে মাউন্টব্যাটেনকে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল করা হলে তিনি হতেন পাকিস্তানের ভারতীয় গভর্ণর জেনারেল। জিন্নাহ দেশকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। (I.H. Wureshi: The Struggle for Pakistan, pp.296-300)।
জুন ৩ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন
বেঙল আইনসভার অধিবেশন ২০শে জুলাই অনুষ্ঠিত হয় এবং ১২৬-৯০ ভোটে নতুন গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতঃপর অমুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকার সদস্যগণ ৫৮-২১ ভোটে প্রদেশ বিভাগের এবং বর্তমান গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত করেন। পূর্ব বাংলা মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকার সগস্যগণ ১০৬-৩৫ ভোটে প্রদেশ বিভাগের বিরুদ্ধে এবং সেই সাথে নতুন গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত করে। অতঃপর প্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকার সদস্যগণ ৬৯-২৭ ভোটে প্রদেশ বিভাগের বিরুদ্ধে রায় দান করেন।পক্ষান্তরে হিন্দু সংখ্যাগুরু এলাকার বিভাগের বিরুদ্ধে রায় দান করেন। পক্ষান্তরে হিন্দু সংখ্যাগুরু এলকার সদস্যগণ ৫০-২২ ভোটে বিভাগের পক্ষে এবং ভারতীয় গণপরিষদে যোগদানের পক্ষে রায় দান করেন।
সিন্ধু আইনসভা ২৬শে জুন মিলিত হয় এবং ৩০-২০ ভোটে নতুন গণপরিসদে যোগদানের সিদ্ধান্ত করে। বেলুচিস্তানে শাহী জির্গার এবং কোয়েটা পৌরসভার সেবরকারী সদস্যগণ মিলিত হয়ে সর্বসম্মতিক্রমে নতুন গণপরিষদে যোগদানের সিদ্ধান্ত করেন।
অপরদিকে জুলাইয়ের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত সিলেটের গণভোটে বিপুল সংখ্যাগুরু ভোটার আসাম থেকে পৃথক হয়ে পূর্ব বাংলার যোগদানের সপক্ষে ভোটদান করেন।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গণভোটের শর্ত ছিল এই যে, ভোটারগণ ভারতীয় গণপরিষদে যোগদানের অথবা নতুন গণপরিষদে যোগদানের সমক্ষে ভোট দেবেন। আবদুল গাফফার খান দাবী করেন যে, ভোটারদের স্বাধীন পাখতুনিস্তানের সপক্ষে ভোটদানের সুযোগ দেয়া হোক। গান্ধী ও নেহরু আবদুল গাফফার খানের দাবী সমর্থন করেন। ভাইসরয় এই বলে দাবীটি নাকচ করেন যে ৩ জুন পরিকল্পনায় যে কার্যবিধি সন্নিবেশিত করা হয়েছে তা উভয় দলের সম্মতি ব্যতিরেকে পরিবর্তন করা যাবেনা। জিন্নাহ এ পরিবর্তন মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। গাফফার খান তাঁর অনুসারীদের ভোটদানে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। তার পরেও ২৮৯
, ২৪৪ ভোট নতুন গণপরিষদের পক্ষে এবং মাত্র ২৮৭৪ ভোট ভারতীয় গণপরিষদের পক্ষে প্রদত্ত হয়।
প্রধানমন্ত্রী এটলী ভারত স্বাধীনতা বিল হাউস অব কমন্সে ৪ঠা জুলাই পেশ করেন। ১৫ই জুলাই হাউস অব কমন্সে এবং ১৬ই জুলাই হাউস অব লর্ডসে তা গৃহীত হয়। বিলটি ১৮ই জুলাই রাজকীয় সম্মতি লাভ করে। অতঃপর ভারত ও পাকিস্তানের জন্য ২০শে জুলাই পৃথক পৃথক দুটি প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট কায়েম হয়।
বিগত সাত বছরের সংগ্রাসের ফসল হিসাবে পাকিস্তান নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো। এ ধরনের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দুনিয়ার ইতিহাসে এই প্রথম।
পাকিস্তান কায়েম হলো বটে, কিন্তু কংগ্রেস, হিন্দুভারত ও বৃটিশ সরকার এর চরম বিরোধিতা করে যখন ব্যর্থ হয়, তখন হঠাৎ করে অতি অল্প সময়ের মধ্যে কাটছাঁট করা (Truncated Pakistan) এক পাকিস্তানে সম্মত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তর পরিকল্পনাটি তৈরী হয় একজন কংগ্রেসপন্থী হিন্দু অফিসার কর্তৃক। এ বিষয়ে জিন্নাহকে একেবারে অন্ধকারে রাখা হয়। ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে হস্তান্তরের মাত্র আড়াই মাস পূর্বে পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় যেন মুসলিম লীগ কোন চিন্তাভাবনা করার কোন অবকাশ না পায়। এটা ঠিক যেন ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ শত্রু শিবির আক্রমণ করার মতো। কাটছাট করা পাকিস্তানকে আরও সংকুচিত করে বাউন্ডারী কমিশন। পাকিস্তানের ন্যায্যা প্রাপ্য অনেক মুসলিম মেজরিটি এলাকা বলপূর্বক ভারতভুক্ত করা হয়। উপরন্তু বিভাগের পর পাকিস্তানের ন্যায্যা প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকেও তাকে ষোল আনা বঞ্চিত করা হয়। সম্ভবতঃ এটা ছিল পাকিস্তান দাবী করার অপরাধের আর্থিক দন্ড। কংগ্রেস ও বৃটিশের ষড়যন্ত্রে এসব করা হয়েছিল যাতে পাকিস্তান কিছু সময়ের জন্যও টিকে থাকতে না পারে।
তারপর পাকিস্তান দাবীর মূল কারণ চিল এই যে হিন্দু সংখ্যাগুরুর কাছে ভারতের ক্ষমতা হস্তান্তর করলে মুসলমানদের জানমাল ইজ্জৎ আবরুই বিপন্ন হবে না, তাদের জাতিসত্তাকেই নির্মূল করা হবে। চল্লিশের পূর্বে হিন্দু সংখ্যাগুরু প্রদেশগুলোতে আড়াই বছরের কংগ্রেসী শাসন তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
কিন্তু ভারত বিভাগের পরও ভারতে মুসলিম নিধনযজ্ঞ বন্ধ করা হয়নি। খুনের দরিয়া সাঁতার দিয়ে লক্ষ লক্ষ মুসলিম নরনারী, শিশু সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়।
পাকিস্তান সরকারের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মচারী জনাব আলতাফ গওহর বলেন-
দিল্লীতে হত্যাকান্ড শুরু হওয়ার পূর্বেই আমি করাচী পৌঁছে যাই। ….সীমান্ত অতিক্রম করে আগমনকারী মজলুম আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলছিল এবং ব্যাপক গণহত্যার লোকহর্ষক কাহিনী প্রত্যেককে অধিকতর জাতীয় খেদমতে বাধ্য করছিল। (পাকিস্তানের একটি দৈনিক পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধ)।
আলতাফ গওহর ভারতের রাজধানী স্বয়ং দিল্লীতে হত্যাকান্ডের ইংগিত করেছেন। দিল্লীর বিভিন্ন স্থানে লোমহর্ষক হত্যাকান্ড বন্ধের উদ্দেশ্যে মিঃ গান্ধী অনশন ব্রত পালন করতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়েও তা বন্ধ করতে পারেন নি।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেনঃ
গান্ধীজি তাঁর অনশন ভাঙার শর্তগুলো বলতে থাকেন। তা হলোঃ
১। হিন্দু ও শিখদের পক্ষ থেকে মুসলামনদের আক্রমণ করা এক্ষুণি বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দিতে হবে যে তারা ভাইয়ের মতো একত্রে বাস করতে পারবে।
২। হিন্দু ও শিখকে এ নিশ্চয়তা দানে সকল চেষ্টা করতে হবে যেন কোন একজন মুসলমানও জানমালের নিরাপত্তার অভাবে ভারত থেকে চলে না যায়।
৩। চলন্ত রেলগাড়িতে মুসলমানদের উপর যে হামলা করা হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে এবং যে সকল হিন্দু ও মিখ হামলা চালাচ্ছে তাদেরকে অচিরেই বিরত রাখতে হবে।
৪। যেসব মুসলমান নিজামুদ্দীন আউলিয়া, খাজা কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকী এবং নাসিরুদ্দীন চেরাগ দেহলীর দরগার আশে পাশে বসবাস করতো তাঁরা বাতিঘর ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদেরকে তাদের বস্তীসমূহে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসিত করতে হবে।
৫। কুতুবউদ্দীন বখতিয়ার কাকীর দরগাহ ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। অবশ্যি সরকার এসব মেরামত করে দিতে পারে। কিন্তু হিন্দু এবং শিখদেরকেই প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ এ কাজ করতে হবে।
৬। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো এই যে মনের পরিবর্তন দরকার। শর্তগুলো পূরণ অপেক্ষা এর গুরুত্ব অধিক। হিন্দু ও শিখ নেতাদেরকে এ নিশ্চয়তা দিতে হবে যাতে এ কারণে আর অনমন করতে না হয়। অতঃপর গান্ধীজি বলেন –এটা আমার শেষ অনশন হোক। (Abul Kalam Azad India Wins Freedom, p.238)।
মাওলানা আজাদ বলেনঃ
দেশ বিভাগের পর পরিস্থিতি চরমে পৌঁছে। এক শ্রেণীর হিন্দু হিন্দু মহাসভা ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবা সংঘের নেতৃত্বে প্রকাশ্যে বলা শুরু করে যে গান্ধীজি হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সাহায্য করছেন। এ বিসয়ে প্রচার পত্রও বিতরণ করা হয়। একটি প্রচার পত্রে বলা হয়, গান্ধীজি যদি তাঁর নীতি পরিবর্তন না করেন, তাহলে তাঁকে হত্যা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। (Abul Kalam Azad India Wins Freedom, p.২৪০-২৪১)।
অবশেষে গান্ধীকে ৩০শে জানুয়ারী ১৯৪৮ জীবন দিতে হলো। মাওলানা আজাদ বলেন আমি পুনরায় বিড়লা হাউসে গেলাম এবং ফটক বন্ধ দেখে অবাক হলাম। হাজার হাজার লোক ভিড় করে আছে দেখলাম। আমি বুঝলাম ব্যাপার কি। গাড়ি থেকে নেমে তাঁর ঘরের দরজা পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। ঘরের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ দেখলাম। একজন কাঁচের জানালা দিয়ে আমাকে দেখে ভেতরে নিয়ে গেলেন। একজন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বল্লেন, গান্ধীজি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। দেখলাম তিনি মেঝের উপর শায়িত। চেহারা বিবর্ণ, চক্ষু বন্ধ তাঁর দুই পৌত্র তাঁর পা ধরে কাঁদছে। আমি স্বপ্নের মতো শুনলাম গান্ধীজি মৃত। (Abul Kalam Azad India Wins Freedom, p.১৪১-৪২)।
দেশ বিভাগের পর কয়েক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে লক্ষাধিক মুসলি স্বাধীন ভারতে নিহত, তাদের বহু মসজিদ ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংস করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে কাউকে অনশন করতে দেখা যায়নি। তবে কেউ এ সাহস করলে তাঁকে গান্ধীজির ভাগ্যই বরণ করতে হতো। স্বাধীন ভারতে মুসলমানদের সপক্ষে কথা বলাকে বিরাট অপরাধ মনে করা হয়। হত্যাকান্ডে শতসহস্র মুসলমান নরনারী ও শিশু নিহত হয়, তাদের দোকানপাট, বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং ধনসম্পদ লুণ্ঠন করা হয়। কিন্তু হত্যাকারী খুঁজে বের করে তাদের শাস্তির কোন ব্যবস্থা সরকার করেন না, বা করতে পারেন না। ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংস করার পর অপরাধীদের শাস্তি দেয়া ত দূরের কথা, তাদের হাতেই ভারত সরকারকে জিম্মী হয়ে থাকতে হয়েছে। এসব যে হবে তা নিশ্চিত বুঝতে পেরেই মুসলমানদের পৃথক ও স্বাধীন আবাসভূমির দাবী করতে হয়। বস্তুতঃ হিন্দুজাতি ও নেতৃবৃন্দের চরম মুসলিম বিদ্বেষই পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছে।