কোমল সেই হাত
প্রায় এক ঘণ্টার মতো হলো মবিন এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে। চিঠি যখন পড়েছে তখন ঘরে দিনের আলো ছিল। এখন অন্ধকার। মবিন আলো জ্বলে নি। অন্ধকার ঘরেই বসে আছে। তার চারদিকে পিনপিন করছে মশা। মশা তাড়াবার স্বাভাবিক ইচ্ছাটাও হচ্ছে না।
অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয় একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। সিলেটের চা বাগানের এক ব্রিটিশ মালিক খোদ ইংল্যান্ড থেকে জানাচ্ছেন–তাকে লাক্কা টি গার্ডেনের ম্যানেজারের নিয়োগপত্র দেয়া হচ্ছে। এক বছরের ট্রেনিং পিরিয়ডের পর চাকরি স্থায়ী হবে। ট্রেনিং পর্ব দুভাগে বিভক্ত। প্রথম চার মাস ট্রেনিং হবে শ্ৰীলঙ্কার ‘ইয়ালো বিং টি গার্ডেন’। পরের আট মাস ইংল্যাণ্ডে।
ট্রেনিং পিরিয়ডের ভাতা উল্লেখ করা আছে। অঙ্কটা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। পোশাক পরিচ্ছদ এবং প্যাসেজ মানির জন্যে চেস ম্যানহাটন ব্যাংকের ইসু্য করা একটি ব্যাংক ড্রাফট চিঠির সঙ্গে আছে। পাউন্ড স্টারলিঙে যে অঙ্ক সেখানে বসানো তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।
চা বাগানের চাকরির চেষ্টা সে করেছিল। ইন্টারভ্যু দিতে চিটাগাং পর্যন্ত গিয়েছিল। যাওয়া-আসার ভাড়া মিতু দিয়েছিল। সেই চাকুরি ছোট একটা চাকুরি। অন্য চা বাগান। এই যোগাযোগ কী করে হলো মবিন বুঝতে পারছে না। ইন্টারভ্যু বোর্ডের কেউ কি তার জন্যে সুপারিশ করেছেন? রহস্যটা কি?
মবিনের হতভম্ব ভাব কিছুতেই কাটছে না। চেস ম্যানহাটন ব্যাংকের ড্রাফটটা সঙ্গে না থাকলে ভাবত কেউ রসিকতা করছে। মানুষ নির্মম রসিকতা মাঝে মধ্যে করে।
এখন সে কী করবে? আনন্দ প্রকাশের জন্যে কিছু একটা করা উচিত। কাকে খবরটা প্রথম দেয়া যায়? মিতুকে তো বটেই। যদিও তার ইচ্ছা হচ্ছে একটা মাইক ভাড়া করে গাজীপুর শহরে রিকশায় ঘুরে ঘুরে খবরটা বলে বেড়ায়।
এ রকম একটা খবর মিতুকে খালি হাতে জানানো যাবে না। এক লাখ গোলাপ কিনতে পারলে এক লাখ গোলাপ নিয়ে মিতুর কাছে যাওয়া যেত। কত দাম এক লাখ গোলাপের?
মিতু খবরটা শুনে কী করবে? কী করবে। মবিন আন্দাজ করতে পারে। চট করে উঠে দাঁড়াবে, তারপর ছুটে সামনে থেকে চলে যাবে। কাঁদার জন্যে যাবে। মিতু তার সামনে কাঁদতে পারে না। অনেকক্ষণ পর সে ফিরে আসবে। খুব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারবে না। মিতুর ধারণা অভিনেত্রী হিসেবে সে খুব বড়ো। আসলে বড়ো না। আসলে সে কাঁচা অভিনেত্রী। আবেগ লুকাতে পারে না।
না মিতুকে খবরটা এভাবে দেয়া যাবে না। মজা করে দিতে হবে। মুখ শুকনো করে তার কাছে যেতে হবে। বেশ রাত করে। মিতু উদ্বিগ্ন হয়ে বলবে, কী ব্যাপার এত রাতে? তখন সে বলবে, ঘরে কোনো খাবার আছে মিতু? সারাদিন খাই নি। হাত একেবারে খালি। লজ্জায় আসতেও পারছিলাম না। এটা শুনে মিতুর মুখ ছাইবৰ্ণ হয়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে পানি এসে যাবে এবং সে দৌড়ে সামনে থেকে চলে যাবে। আধঘণ্টা পর এসে বলবে, এস খেতে এস। এমনভাবে বলবে যেন কিছুই হয় নি।
মা’কে একটা চিঠি লিখতে হবে। আজ রাতেই চিঠি লিখতে হবে।
মা,
আমার সালাম নিও।
তোমার চিঠি পেয়েছি। নানান ঝামেলায় ব্যস্ত ছিলাম বলে। উত্তর দিতে দেরি হলো। জোছনার ছেলে হয়েছে শুনে খুব খুশি হয়েছি। ওকে আমার অভিনন্দন দিও। বাবার চোখের খবর শুনে উদ্বিগ্ন বোধ করছি। আমার উচিত নিজে গিয়ে বাবাকে নিয়ে আসা। সেটা সম্ভব হচ্ছে না। চা বাগানের ম্যানেজারের একটি চাকরি পেয়েছি। প্রাথমিক ট্রেনিঙে আমাকে শ্ৰীলঙ্কা এবং পরে ইংল্যান্ডে যেতে হবে। ভিসা এবং অন্যান্য ব্যাপারে খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে। যাই হোক, আমি টাকা পাঠাচ্ছি। তুমি বাবাকে নিয়ে চলে এস, আমি এখানে ভালো একটা হোটেল ব্যবস্থা করে রাখব। তোমরা ঢাকায় আসার পর বাবাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটির কাজগুলো মিতু করবে। মিতু হচ্ছে রফিকের বোন। ঐ যে একবার রফিককে নিয়ে এসেছিলাম। বাঁশি বাজিয়ে যে সবাইকে হতভম্ব করে দিয়েছিল।
মিতু খুবই চালাকচাতুর মেয়ে। সে তোমাদের কোনো অসুবিধাই হতে দেবে না। আমি যখন দেশের বাইরে থাকব। তখনো সে-ই তোমাদের দেখাশোনা এবং খোঁজখবর করবে।
তোমরা কবে নাগাদ আসবে। আমাকে টেলিগ্ৰাম করে জানিও। ভালো কথা, জোছনার ছেলের জন্যে সোনার চেইন, জোছনার জন্যে ভালো একটা শাড়ি কেনার জন্যে আলাদা করে টাকা পাঠালাম। তোমরা ভালো থেক। বাবাকে আমার সালাম দিও…
ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন?
মবিন দারুণ চমকে উঠল। মিতু দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। মনে হয় অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। মবিন উঠল। বাতি জ্বালাল। অদ্ভুত গলায় বলল, ভেতরে এস মিতু।
মিতু ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, অন্ধকারে মূর্তির মতো বসে কী করছিলে?
চিঠি লিখছিলাম?
চিঠি লিখছিলে মানে?
মনে মনে লিখছিলাম। মনে মনে চিঠি লিখতে কাগজ, কলম, আলো কিছুই লাগে না। মনে মনে লেখা চিঠিতে কোনো বানান ভুলও হয় না।
কী হয়েছে তোমার বল তো?
অদ্ভুত একটা চিঠি পেয়েছি। চিঠিটা রেজিস্ট্রি ডাকে ইংল্যান্ড থেকে এসেছে।
খারাপ কিছু?
ভয়ঙ্কর খারাপ। নাও পড়। মিতু চিঠি পড়ছে। মনিব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিতুর দিকে। সে যা ভেবেছে তাই। মিতুর চোখে পানি এসে গেছে। সে আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। ধরা গলায় বলল, দশ হাজার পাউন্ড স্ট্যার্লিং মানে কত টাকা?
ষাট দিয়ে গুণ দাও। গুণ দিলেই বেরিয়ে পড়বে।
তোমার হাতে তো একদম সময় নেই।
মবিন উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ছোটাছুটি করতে করতে জান বের হয়ে যাবে। শোন তোমাকে আগেভাগে বলে রাখছি, যাবতীয় ছোটাছুটিতে তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। সিনেমা টিনেমা বাদ দাও। তুমি অনেক কষ্ট করেছ। আর কষ্ট করতে হবে না।
আর কষ্ট করতে হবে না?
অবশ্যই না। আজ এই মুহুর্ত থেকে তোমার যাবতীয় কষ্টের অবসান হলো, ঝুমুরকে নিয়ে বা তোমার মা’কে নিয়েও তোমার চিন্তা করতে হবে না।
সব চিন্তা তোমার?
অবশ্যই। বিয়ের ব্যাপারটা এক সপ্তাহের মধ্যে সেরে ফেলব। বাবা চোখ দেখানোর জন্যে ঢাকা আসবেন, মাও আসবেন। ঝুমুর আছে, তোমার মা আছেন–আমরা আমরাই, বাইরের কাউকে বলার কোনো দরকার নেই। বাইরের কেউ তো নেইও। তুমি যদি তোমার ফিল্ম লাইনের কাউকে বলতে চাও বলবে।
টেপীকে বলব?
মিতু এমনভাবে প্রশ্ন করল যে মবিন চমকে তাকাল। তাকিয়েই রইল। মিতু হাসল। সহজভাবেই হাসল। সেই হাসিতেও কিছু একটা ছিল। মবিন চোখ ফেরাতে পারল না। মিতু বলল, তোমার জন্যে সিগারেট এনেছি। নাও।
মবিন হাত বাড়িয়ে সিগারেট নিতে নিতে অস্পষ্ট গলায় বলল, মিতু তুমি হঠাৎ করে টেপীর কথা তুললে কেন?
মিতু শান্ত স্বরে বলল, তোমার এত বুদ্ধি। তারপরেও একটা সাধারণ ব্যাপার ধরতে তোমার এত সময় লাগল কেন?
মবিন সিগারেট ধরাল। তার হাত কাঁপছে। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। মিতু বলল, আমার ধারণা টেপীকে তুমি অনেক আগেই ধরেছ। তারপরেও না ধরার ভান করে গেছ। নিজের সঙ্গে ভান। নিজেকে প্রতারণা। তাই না?
মবিন কিছু বলল না।
মিতু বলল, এখন বল। আমার দিকে তাকিয়ে বল, এখন কি তুমি আমাকে বিয়ে করতে পারবে?
পারব।
সত্যি পারবে?
অবশ্যই পারব।
মিতু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমারও মনে হয় তুমি পারবে। কিন্তু বিয়েটা ভালো হবে না। যতবারই আমাকে জড়িয়ে ধরবে ততবারই মনে হবে–আরো অনেকে এই ভঙ্গিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। মনে পড়বে না?
না।
ছেলেমানুষের মতো কথা বলবে না তো মবিন ভাই। তুমি ছেলেমানুষ না। তুমি এখন চোখ-কান বন্ধ করে আমাকে বিয়ে করবে। তার পেছনে ভালোবাসা অবশ্যই আছে। সেই সঙ্গে কৃতজ্ঞতাবোধও আছে। আমি তোমার দুঃসময়ে তোমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছি। সেই কৃতজ্ঞতাবোধ। ঠিক কিনা বল?
মবিন চুপ করে রইল। তার হাতের সিগারেট নিভে গেল। মিতু হালকা গলায় বলল, দু’জনের জীবন নষ্ট করে তো লাভ নেই। একজনেরটাই নষ্ট হোক। একজন টিকে থাক। তুমি খুব ভালো দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে কর। তুমি সুখে আছ, আনন্দে আছ–এই দৃশ্য দূর থেকে দেখলেও আমার ভালো লাগবে। একদিন হয়তো তোমার চা বাগানে বেড়াতে যাব। তোমার বাংলোতে বসে তোমার সঙ্গে এককাপ চা খাব। তোমার স্ত্রী, তোমার ছেলেমেয়ের সঙ্গে ছবি তুলব। সেই আনন্দও কম কি?
মিতুর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে বলল, মবিন ভাই তোমার কাছে রুমাল আছে, দাও রুমাল দিয়ে আমার চোখ মুছিয়ে দাও। আমি এখন চলে যাব।
মবিন সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। হালকা পায়ে নেমে যাচ্ছে মিতু। সে মাথার উপর শাড়ির আঁচল টেনে দিয়েছে। তাকে কেমন বউ বউ লাগছে। চারদিকের বিপুল অন্ধকারে মিশে যাবার জন্যে নেমে যাচ্ছে অপূর্ব একটি মেয়ে। তাকে কি এইভাবে নেমে যেতে দেয়া উচিত?
মবিন কঠিন গলায় ডাকল, মিতু দাড়াও। কোথায় যাচ্ছ তুমি? উঠে এস। উঠে এস বললাম।
মবিন এখন পর্যন্ত কোনোদিন মিতুর হাত ধরে নি। তার খুব লজ্জা লাগে। এই প্রথম লজ্জা ভেঙে সে মিতুর হাত ধরল। আহ্ কী কোমল সেই হাত!
Im just amazed.What a ending Humayon sir
What an ending.
শেষটা অপূর্ব….!
সমাপ্তি টা পুরো কষ্ট মুছে দিলো