১৫. কিছু জিনিস কেনাকাটার ছিল

পনেরো

কিছু জিনিস কেনাকাটার ছিল। তার মধ্যে জামা-কাপড়ই প্রধান। এখানে আসার পর থেকে জামা-কাপড় বানানো হয়নি। তা ছাড়া এই বনেজঙ্গলে যে রকম জামা কাপড়ের প্রয়োজন, তারও অভাব ছিল আমার। সামনে শীত আসছে। শীতের প্রলয়ংকারী রূপের যা বর্ণনা শুনছি, তাতে তো আগে থাকতেই দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। কিছু গরম কাপড়-চোপড় বানানো দরকার।

ডালটনগঞ্জে গেলাম একদিন। রুমান্ডি থেকে প্রায় তিরিশ মাইল পথ। কিছুদূর অবধি রাস্তা চেনা ছিল, তারপর থেকে অচেনা রাস্তা। ঘোষদার বাড়িই দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করব বলে ঠিক ছিল।

ডালটনগঞ্জ থেকে একটা রাস্তা সোজা চলে গেছে লাতেহার হয়ে চাঁদোয়াটোরী, সেখান থেকে বাঁয়ে চলে গেছে চাতরার রাস্তা জাবরা বা বাঘরা মোড় হয়ে। বাঘরা মোড় থেকে ডাইনে ঘুরে গেলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সীমারীয়া-টুটিলাওয়া হয়ে হাজারিবাগ শহর। যশোয়ন্ত এই পথেই হাজারিবাগ যায়। চাঁদোয়া-টোরী থেকে অন্য রাস্তাটা চলে গেছে আমঝারিয়া হয়ে কুরু, কুরু থেকে রাঁচী, উল্টোদিকে গেলে লোহারডাগা। সেখান থেকে বানারী হয়ে নেতারহাট। আর একটা রাস্তা ডালটনগঞ্জ থেকে চলে গেছে ঔরঙ্গাবাদ—গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে।

এই সমস্ত জায়গায়ই শুধু পাহাড় আর পাহাড়। জঙ্গল আর জঙ্গল। আদিগন্ত।

ডালটনগঞ্জ বেশ জমজমাট মফস্বল শহর। সিনেমা আছে, কোর্ট-কাছারি ইনকামট্যাক্স অফিস সবই আছে। বাঁশ, কাঠ, গালা ইত্যাদির বেশ বড় বড় ব্যবসাদার আছেন। আমাদের রামদেও সিংহের বাড়িও এখানে।

ঘোষদার বাড়ি পৌঁছে একটু বিশ্রাম নিয়ে ঘোষদার সঙ্গেই বাজারে বেরোলাম। দোকানপত্তর সব ঘোষদার জানাশুনো। কাপড় পছন্দ করে মাপ দিতে সময় লাগল না বেশি। খাকি ট্রাউজার আর বুশসার্ট বানাতে দিলাম দুটি করে। টুইডের একটি কোট। ফ্লানেলের শার্ট একটি—এইসব আর কী।

ডালটনগঞ্জ বাজারে হঠাৎ টাবড়ের ছেলের সঙ্গে দেখা। আমাদের দেখে সেলাম করে বলল, ওর বোন-ভগ্নিপতির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আমি বললাম, আমি তো আজই বিকেলে ফিরছি—আমার সঙ্গে চল। একাই তো ফিরব। টাবড়ের ছেলে আপত্তি জানাল। বলল, ওর নাকি আর একদিন থাকার ইচ্ছা।

স্টেশনারি দোকানে কিছু কেনাকাটার ছিল, জুম্মানের অর্ডার। চাকফি ভিনিগার। চিলি-সস্, টোমাটো-সস্, মাখন, জেলি ইত্যাদি ইত্যাদি।

থলি বোঝাই করে দোকান থেকে বেরোচ্ছি, দেখি দোকানের সামনে একটি লাল অ্যাম্বাসাড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে। গাড়ির সামনের সিটে দুজন লোক, ড্রাইভারসুদ্ধ। টেরিলিনের জামা পরা। আমার দিকে প্যাট প্যাট করে তাকিয়ে আছে। সুন্দরী নই যে, অমন করে তাকাবে! ব্যাপার বুঝলাম না।

ঘোষদার জিপ নিয়ে এসেছিলাম। জিপ ঘোষদাই চালাচ্ছিলেন। ডানদিকে ঘোষদার পাশে গিয়ে বসলাম। এমন সময় ওই লাল গাড়িটা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। হঠাৎ মনে হল, যে লোকটি ড্রাইভারের পাশে বসে আছে, তাকে যেন কোথায় দেখেছি। ভাবলাম, মনেরই ভুল হয়তো। কোথায়ই বা দেখব?

ঘোষদার বাড়ি ফেরার পথে রামদেওবাবুর ছেলের সঙ্গে দেখা। ভারী ভাল ছেলেটি। সে কিছুতেই ছাড়বে না। তাদের বাড়ি নিয়ে গেল। বিরাট বাড়ি। সারি সারি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। বহু লোক অফিসে গিসগিস করছে। রামদেওবাবুর সঙ্গে আলাপ হল। ভারী অমায়িক সাদাসিধে লোক। পরনে ধুতি ও টুইলের সাদা ফুলহাতা শার্ট, কলার তোলা, মাথার চুল এলোমেলো। অনুক্ষণ সিগারেট খাচ্ছেন। বুকপকেটে একটি রুমাল বলের মতো পাকিয়ে রেখেছেন। আমাদের দারচিনি এলাচ দেওয়া চা খাওয়ালেন। বললেন, দুপুরে না খেয়ে গেলে খুব দুঃখিত হবেন। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ঘোষদা অনেক অনুনয়-বিনয় করায় তারপর আমাদের ছাড়লেন।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ঘোষদা বললেন, একটু জিরিয়ে নাও, তারপর তোমাকে এগিয়ে দেবখন। কেচকীতে গিয়ে চা খাওয়া যাবে। সেখানে কিছুক্ষণ বসে, চা খেয়ে তুমি তোমার পথ ধরবে, আমি ফিরে আসব ডালটনগঞ্জে।

যেতে যেতে তো তোমার রাত হয়ে যাবে বেশ, প্রায় ন’টা বাজবে। এতখানি পাহাড়ি রাস্তা, তোমার একা চলাফেরা করার অভ্যেস নেই। এক কাজ করো, সঙ্গে আমার একজন খালাসি নিয়ে যাও।

কথাটা আমার মনে হচ্ছিল। কিন্তু কেন যেন পৌরুষে লাগল; যশোয়ন্তের সঙ্গে থেকে আমারও বোধহয় পুরুষ হবার ইচ্ছে জেগেছে। তাছাড়া বন্দুকটা তো সঙ্গেই আছে।

একমাত্র জিপ খারাপ হবার ভয় রয়েছে। কারণ এ সময় জঙ্গলে কাজ বন্ধ থাকে বলে জঙ্গলের পথে ট্রাক চলাচলও সম্পূর্ণ বন্ধ। জিপ পথে খারাপ হলে ওখানেই পড়ে থাকতে হবে। আমার গুরুবাক্য স্মরণ করে ভাবলাম, যো-হোগা সো-হোগা। বললাম, না, না, কোনও দরকার নেই।

বিকেলে আমরা কেচকীতে গেলাম। যশোয়ন্ত ও সুমিতা বউদির কাছে অনেক গল্প শুনেছিলাম। কেচকী আজ চাক্ষুষ দেখলাম। ছবির মতো জায়গা। ন্যাশনাল পার্ক হয়ে যাবে শিগগিরই এ সমস্ত অঞ্চল।

ঔরঙ্গা আর কোয়েল এসে মিশেছে এখানে। এখন বর্ষাকাল। বেশ অনেকটা জায়গায় জল চলেছে—বালির সীমানা দখল করে। নদীর উপরে রেলের ব্রিজ।

ঘোষদা সঙ্গে আছেন, অতএব জল-খাবারের জন্যে দুজনের সঙ্গে যে পরিমাণ খাবার এসেছে, তাতে এক প্লেটুন সৈন্য ডিনার সারতে পারে। মারিয়ানা বলে, ঘোষদা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে The only way to the heart is through the stomach.

সঙ্গে যে লোকটি এসেছিল, সে একটি শতরঞ্চি নিয়ে জলের ধারে পাতল। আমরা ইচ্ছে করলে বাংলোয় বসতে পারতাম। বাংলোটি বেশ উঁচু বলে সেখানে বসে চতুর্দিক ভারী সুন্দর দেখা যায়। বনবিভাগের বাংলো এটি। কিন্তু জলের পাশেই পরিষ্কার দেখে একটি জায়গায় আমরা বসলাম। টিফিন ক্যারিয়ারের বাটি পর পর সামনে খোলা হল।

রোদ পড়ে গেলেই বেশ শীত শীত লাগে আজকাল। পুজোর আর দিন-কুড়ি বাকি

একঝাঁক বুনো ময়না কোনাকুনি উড়ে গেল, ঔরঙ্গা আর কোয়েলের সঙ্গমস্থলের ঠিক উপর দিয়ে। একটা মালগাড়ি গেল গুম গুম করে ব্রিজ পেরিয়ে। নদীর বুকে এবং পাহাড়ে বনে প্রতিধ্বনি তুলে।

কাবাব খেতে খেতে ঘোষদা বললেন—তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছি বহুদিন থেকে ভায়া, কিন্তু এতদিন সুযোগ-সুবিধে হয়নি। কথাটা হচ্ছে এই যে, যশোয়ন্তের সঙ্গে বন্ধুত্বটা একটু কমাও। ও এক ধরনের লোক এবং আমরা অন্য ধরনের। ওর শত্রুও অনেক; সংসারে থাকতে হলে যেসব নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, সে সবের তোয়াক্কা ও করে না। বিয়ে-থাও করেনি, করবেও না কোনওদিন, কাউকে কোনও ব্যাপারে পরোয়া করার প্রয়োজনও মনে করে না। বড়লোকের ছেলে, ও তো জানেই যে, চাকরি ওর শখের চাকরি। কিন্তু আমার তোমার তো তা নয়। আজ চাকরি গেলে কাল করবে কী? বুঝলাম, না হয় বলবে যে, মফস্বলের কলেজে প্রফেসারি কি নিদেনপক্ষে একটা স্কুলমাস্টারিও কি জুটবে না? কিন্তু পাবে কত? এ-চাকরিতে যা প্রসপেক্ট, তা কি সেখানে আছে?

ভদ্রঘরের ছেলে, বিয়ে-থা করবে সংসারধর্ম করবে, সভ্য জীবনযাপন করবে, তা নয়; তুমি যেন নন্দী-ভৃঙ্গীর দলে দিনকে দিন নাম লেখাচ্ছ। ওই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের পোচিং কেসে তোমাকে যে ওরা সাক্ষী করেছে, সে-খবর হুইটলি সাহেবের কানেও গেছে।

আমি চুপ করে থাকলাম।

জাবর কাটতে কাটতে হঠাৎ ঘোষদা বললেন, চুপ করে বসে কেন? খাও খাও, বলে চাপাটির বাটিটা এগিয়ে দিলেন। পরক্ষণেই একদলা কাবাব মুখে ফেলে বললেন, প্রাকটিক্যাল হও বাবা, প্র্যাকটিক্যাল হও। ওই হুইটলি সাহেবই বলো আর যেই বলো, তাঁরা অবশ্য যশোয়ন্তকে ভালবাসেন। কিন্তু আসলে তাঁরা বোঝেন বিজনেস। টাকা কামাবার যন্ত্র হচ্ছি আমরা। আপাতদৃষ্টিতে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের হয়ে তুমি সাক্ষী দেবে; এতে আমরা যে তাদের পরম হিতাকাঙক্ষী এটাই প্রমাণিত হবে। কিন্তু যতদূর পারো ওইসব ঝামেলা এড়িয়ে যাবে। বনে-জঙ্গলে বাস করতে হবে, একা একা লোকের সঙ্গে খামোকা ঝগড়া করলে চলবে কেন? কে বেশি টিম্বার ফেলিং করল, কোন রেঞ্জার কুপে মার্কা মারার সময় ঘুষ খেল, কে কোথায় মাদী শম্বর মারল, কে কোন কাহার ছুঁড়িকে গাড়িতে তুলে মজা লুঠল, এত সব খবরে তোমার আমার দরকার কী? এই জঙ্গল-পাহাড়ের লোকগুলো সব হাড়ে-হারামজাদা। আমরা শহুরে চিড়িয়া, আলগা আলগা থাকো। ধরি মাছ না-ছুঁই পানি, এই পলিসি নিয়ে চলো, দেখবে কোনওদিন বিপদ হবে না।

ঘোষদা যা বললেন, তার সবটুকুই মন দিয়ে শুনলাম। সুবোধ বালকের মতো মুগ্ধ হয়েই শুনলাম। কারণ যাঁরা উপদেশের মাধ্যমে তাবৎ জাগতিক প্রশ্নের টীকাসহকারে নিজেরাই উত্তর দিয়ে দেন, তাঁদের কাছে বলার কী থাকতে পারে? এবং উপদেশ হিসাবে খারাপ কিছুই বলেননি।

সূর্যের তেজ কমে আসছে। আগুনে শুকনো কাঠ গুঁজে ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঘোষদার খিদ্মদগার চায়ের জল গরম করেছে। চা-ও হয়ে গেল। পর পর দু’ কাপ চা আরাম করে খেয়ে আমার জিপে উঠে বসলাম।

ঘোষদা বললেন, আশা করি আমি যা বললাম, তা মনে রাখবে।

ঘোষদার চোখের দিকে চেয়ে আমার হঠাৎ মনে হল এটা যেন একটা আদেশ, একটা ওয়ার্নিং।

কোনও জবাব দিলাম না।

বন্দুকটা বাক্সে ভরে এনেছিলাম। বাক্স থেকে খুলে সামনের সিটে লম্বালম্বি করে পিঠের কাছে শুইয়ে রাখলাম। গুলির থলিটা সামনে পা রাখার জায়গায় ডানদিকে রাখলাম। বলা যায় না, বাঘ, হাতি কি বাইসন পথরোধ করতে পারে।

ঘোষদা বললেন—বাহাদুরি কোরো না, আস্তে চালিয়ে যাও। এই বেতলার জঙ্গলে হাতির বড় ভয়। হাতির সামনে পড়লে হর্ন-টর্ন যেন বাজিয়ো না, গুলিও কোরো না। চুপ করে হেড-লাইট জ্বেলে দাঁড়িয়ে থেকো। নিজেরাই সরে যাবে।

ঘোষদাও তাঁর জিপে উঠলেন। কেচকী পেরিয়ে এসে লেভেল ক্রসিংটা পেরিয়ে ঘোষদা বাঁদিকে মোড় নিলেন, আমি ডানদিকে।

অন্ধকার বেশ দ্রুত নেমে আসছে। দেখতে দেখতে পশ্চিমাকাশের লাল-বেগুনে আভাটা মিলিয়ে গেল।

তিরিশ পঁয়ত্রিশ মাইল জিপ চালাচ্ছি। ইঞ্জিনের একটানা স্বাস্থ্যবান গোঁ-গোঁ আওয়াজে নিস্তব্ধ বনপথ চমকে চমকে উঠছে।

ছিপাদোহরের কাছে রাস্তাটা বড়ই আঁকাবাঁকা ও খারাপ। ছিপাদোহরের পর রাস্তাটা কাঁচা হলেও অপেক্ষাকৃত ভাল এবং প্রায় সোজা।

হেডলাইটটা জ্বাললাম। ড্যাশবোর্ডের আলোটা জ্বলল। ‘ডিমারে’ দিয়ে চলেছি। কারণ, এইখানে রাস্তায় প্রতি সেকেণ্ডে সেকেণ্ডে বাঁক এবং ঘণ্টায় দশ-পনেরো মাইলের বেশি চালানো যায় না গাড়ি।

খারাপ রাস্তাটুকু পেরিয়ে এলাম। এবার একেবারে ‘টিকিয়া উড়ান’ চালাব।

প্রায় রাত আটটা বাজে। কেচকী থেকে অনেকখানি পথ এসে গেছি। হঠাৎই মনে পড়ে গেল, আসবার সময় একটা ডাইভার্শন দেখেছিলাম, একটা ব্রিজ মেরামত হচ্ছে। কাঠের বোর্ডে লেখা, Caution! Diversion Ahead।

ডাইভার্শনের কাছে গতি একেবারে কমিয়ে দিয়ে বাঁয়ে রাস্তা ছেড়ে নেমে গেলাম। বড় বড় পাথর পড়ে রয়েছে লালমাটির পথটিতে। আসবার সময় এগুলো লক্ষ করেছি বলে মনে হল না। সেগুলোকে কাটাতে গিয়ে, ব্রেক কষে, জিপ স্পেশ্যাল গিয়ারে দিয়ে যেমনি উপরে উঠতে যাব, অমনি একেবারে আমার কানের কাছে গুডুম করে একটা বন্দুকের আওয়াজ হল। এবং একটা বুলেট প্রায় কান ঘেঁষে হিস্-স্ করে বেরিয়ে গেল। কী ভয় যে পেলাম, কী বলব। প্রাণপণ চেষ্টায় যত জোরে পারি আ্যাক্‌সিলারেটরে চাপ দিলাম। গাড়ি এমনিতেই ফার্স্ট গিয়ারে ছিল, তাতে স্পেশ্যাল গিয়ারে চড়ানো। গাঁক গাঁক করে বড় রাস্তায় পড়ল জিপ, সেই অবস্থাতেই সেকেন্ড গিয়ারে ফেললাম, কিন্তু স্পেশ্যাল গিয়ার ছাড়িয়ে নিয়ে সেকেন্ড গিয়ারে দিতে যতটুকু সময় লেগেছিল তার মধ্যেই আর একটি গুলি আমার পেছন থেকে এসে আমার সিট থেকে দেড় ফুট দূরে উইন্ডস্ক্রিনে লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝুরু-ঝুরু করে কাচ ঝরে ছিটকে আমার গায়ে পড়ল।

ততক্ষণে থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করেছে পা-দুটো। মনে হচ্ছে পা-দুটো আমার নয়। ভাল করে ক্লাচ চাপব কি আ্যাক্‌সিলারেটার চাপব, কোনও জোরই যেন পায়ে নেই। কিন্তু কী করে হল জানি না, জিপটা মনে হল একটা জেট প্লেন, গোঁ-গোঁ আওয়াজ করতে করতে মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। পলকে গিয়ার চেঞ্জ করলাম। মনে হল জিপ থেকে একটা রবার পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে, ক্লাচপ্লেট পুড়ে গেল কিনা ভগবান জানেন।

একেবারে ঊর্ধ্বশ্বাসে বোধহয় মাইল পাঁচেক এসে জিপটা রাস্তার বাঁদিক করে দাঁড় করালাম। একটা খরগোশ দৌড়ে রাস্তা পার হল। কান পেতে শুনলাম কোনও গাড়ি আমার জিপকে ধাওয়া করে আসছে কিনা, কিন্তু হাওয়ায় শালপাতার ঝুরুকুরু আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলাম না।

আকাশে একফালি চাঁদ। আমার আতঙ্কগ্রস্ত মুখের দিকে চেয়ে নিষ্প্রাণ হাসল। ওয়াটার বট্ল বের করে ঢকঢক করে জল খেলাম, তারপর আর বেশি দেরি করা ঠিক নয় মনে করে তক্ষুনি স্টিয়ারিং-এ বসলাম। বন্দুকটা পাশেই পড়ে রইল। সে মুহূর্তে আমি হঠাৎ বুঝতে পেলাম যে, আমি আমিই; আর যশোয়ন্ত, যশোয়ন্ত।

যত জোরে পারি, তত জোরে চালিয়ে ছিপাদোহর পেরিয়ে যশোয়ন্তের নইহারে এসে পোঁছালাম। আমার একা একা রুমান্ডিতে যেতে ভয় করছিল। পথে যদি আবার কোনও বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে।

নইহার তখন গভীর ঘুমে। রাত প্রায় নটা বাজে। চায়ের দোকানটা বন্ধ। ফরেস্ট অফিস বন্ধ। তবে দেখা গেল যশোয়ন্তের বাংলোর দোতলার ঘরে লণ্ঠন জ্বলছে। একেবারে সোজা ওর বাংলোর হাতায় গাড়ি ঢুকিয়ে স্টিয়ারিং-এর উপর শুয়ে পড়লাম।

সঙ্গে সঙ্গে যশোয়ন্ত তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে উৎকণ্ঠিত গলায় বলল, ক্যা হুয়া? লালসাব, ক্যা হুয়া? আমি কোনও কথা বলতে পারলাম না। আমার হাঁটুর সেই কাঁপুনিটা আবার ফিরে এল। থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। আমি যে মরিনি, আমি যে নইহারে যশোয়ন্তের কাছে জিপ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছি, এইটে ভেবেই আমার চোখে জল এসে গেল। যখন গুলি এসে কাঁচে লেগেছিল, তখনকার ভয়টা আমার শিরদাঁড়ায় শিরশির করে কাঁপতে লাগল। আমি স্টিয়ারিং জড়িয়ে শুয়ে রইলাম। কিছু বলতে পারলাম না।

বলতে গেলে যশোয়ন্তই প্রায় আমাকে ধরে উপরে নিয়ে গেল। ওর বসবার ঘরের চৌপাইতে বসে ওকে সব বললাম। ফৌজদারী আদালতের উকিল যেমন করে সাক্ষীকে জেরা করে, তেমনি করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ও সব আমার কাছে জিজ্ঞেস করল। কখন ডালটনগঞ্জে পৌঁছেছিলাম? আগে ঠিক ছিল কিনা সেখানে যাওয়া? সেখানে গিয়ে কার কার সঙ্গে কখন কখন দেখা হল? সব। সব বললাম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।

যশোয়ন্ত বলল, একটু ব্র্যান্ডি খাও লালসাহেব। তুমি খুব আপসেট হয়ে পড়েছ।

তখন আমার যা অবস্থা, তাতে আমার নিজের কোনও ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছিল না।

একটু গরম জলে বেশ খানিকটা ব্রান্ডি মিশিয়ে আমায় দিল যশোয়ন্ত। ঢক-ঢক করে গিলে ফেললাম। তারপর যশোয়ন্তের খাটটায় পা লম্বা করে শুলাম। একটু আরাম লাগল। যশোয়ন্ত ওর চাকরকে ডেকে আমার জন্যে খিচুড়ি চাপাতে বলল। তারপর আমায় বলল, তুমি একটু আরাম করো, আমি নীচে থেকে আসছি। এই বলে একটা টর্চ নিয়ে ও নীচে চলে গেল। বুঝলাম জিপটাকে ও ভাল করে পরীক্ষা করছে। দেখছে, গুলি কোথায় লেগেছে। কীভাবে লেগেছে।

বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল ও। এসে টর্চটা জায়গায় রাখতে রাখতে বলল, আজ তুমি নতুন জীবন পেলে লালসাহেব। আজকের রাতটা সেলিব্রেট করতে হবে। এই বলে চাকরকে ডেকে বলল, মোরগা পাকাও। যশোয়ন্তের চাকর কাঁচুমাচু মুখ করে বলল—মোরগা শেষ হয়ে গেছে কাল। যশোয়ন্ত বলল, লেগ-হর্ন কাটো। পোষা মুরগির ঘর থেকে বের করো। আজ রাতে মোরগা চাই-ই চাই—যে করে হোক।

আমি বললাম, তোমার এত আদরের পোষা মুরগি কাটবে কেন মিছিমিছি। ও ধমকে বলল, কথা বোলো না কোনও। তোমার জানটাও আমার কাছে কম আদরের নয়। সেটা গেছিলই। ফিরে পেয়েছি তার জন্যে মুরগির জান না হয় যাবেই।

আমার সামনে একটা চেয়ার টেনে চেয়ারের পিঠটা ওর বুকের কাছে নিয়ে দু’ দিকে দুটি পা লম্বা করে ছড়িয়ে বসে যশোয়ন্ত বলল, আচ্ছা, ডালটনগঞ্জে বিশেষ কিছু দেখেছিলে? এমন কিছু, যা তোমার অস্বাভাবিক লেগেছিল? এমন কোনও লোক, যাকে তুমি চেনো, অথচ চিনতে পারোনি।

হঠাৎ ডালটনগঞ্জে মনিহারী দোকানের সামনের সেই লাল অ্যাম্বাসাডরটার কথা আমার মনে হল। ওকে বললাম সেই লোকটি, যে গাড়িতে বসেছিল, তার কথাও বললাম।

যশোয়ন্ত লাফিয়ে উঠে বলল, লোকটির কী বড় বড় জুলপি ছিল?

আমি চমকে উঠে বসলাম, কী করে জানলে? হ্যাঁ, ছিল।

যশোয়ন্ত বাঁ হাতের তালুতে ডান হাত দিয়ে ঘুষি মেরে বলল, বুঝেছি।

আমি বললাম, তা তো বুঝেছ, এখন চলো পুলিশে একটা ডায়েরি করে আসি।

ও বলল, পাগল নাকি? এই রাত্তিরে আবার ডালটনগঞ্জে ফিরতে গিয়ে মরি আর কী! ডাইরি-ফাইরি করব না। ডাইরি করলে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে। বদলা নেওয়া যাবে না। তুমি কি মনে করো, ওদের ছেড়ে দেব আমি লালসাহেব? যারা একজন নির্দোষ লোককে কাপুরুষের মতো আড়াল থেকে গুলি করে মারতে চায়, তাদের শিক্ষা যা হওয়া উচিত, তাই আমি দেব।

আমি বললাম, যশোয়ন্ত, তা তুমি বলছ বটে, কিন্তু শিক্ষা দেওয়ার আগে তোমাকেও তো ওরা এমনি করে মেরে ফেলতে পারে?

যশোয়ন্ত কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ভাবল। তারপর বলল, তা পারে। কিন্তু একবার চেষ্টা করেই দেখুক। আমি তো আর তোমার মতো মাখনবাবু নই যে, ওদের অত সহজে ছেড়ে দিয়ে আসব।

যশোয়ন্তের লোক গরম জল করে এনে বাথরুমে দিয়ে গেল। যশোয়ন্ত দেওয়াল-আলমারি খুলে একটা তোয়ালে বের করে দিল। বলল, যাও, স্নান করে এসো। আরাম লাগবে।

স্নান সেরে বেরিয়ে দেখি, যশোয়ন্ত ওর পিস্তলটা পরিষ্কার করছে। তেল দিতে দিতে বলল, অনেকদিন ব্যবহার করা হয় না। শিকারে তো আর পিস্তলের তেমন দরকার হয় না। মানুষ মারতেই বেশি কাজের। বুঝলে লালসাহেব, কাল ভোরে, যে জায়গায় তোমার উপর গুলি চালিয়েছিল ওরা, সেখানে যাব। সে জায়গাটা আমি নিজে দেখব। তারপর ঠিক করব ডায়েরি করব কি করব না পুলিশে।

আমি বললাম, যা ভাল বোঝো। প্রাণ একবার গেলে আর তা ফেরত হবে না।

যশোয়ন্ত সে রাতে প্রচুর মদ গিলল। সেই হুইট্‌লি সাহেবরা শিকারে আসার পর একসঙ্গে ওকে এত মদ কখনও খেতে দেখিনি। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে একটা হুইস্কির বোতল প্রায় শেষ করে আনল। তারপর আমার সঙ্গে আবার খিচুড়ি আর মুরগির রোস্ট খেল।

ব্রান্ডি খাওয়ার জন্যেই হোক, কি ভয়জনিত ক্লান্তির জন্যেই হোক, ঘুমটা খুব ভাল হয়েছিল সে রাতে।

ঘুম ভেঙে উঠে এক কাপ চা খেয়ে আমরা জিপ নিয়ে সেই গুলির জায়গায় গিয়ে পোঁছালাম। যশোয়ন্তের পেছনে পেছনে গিয়ে দেখলাম—যে একটা জিপ ডাইভার্সনে নেমে, বাঁদিকে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে এবং সেখান থেকে বেরিয়েছে যে, তার চাকার দাগ স্পষ্ট।

জিপটা জঙ্গলে ঢোকার দাগ ওখানকার ঝুরঝুরে শুকনো লাল মাটিতে কাল রাতেও নিশ্চয়ই ছিল। কাল চোখ খুলে গাড়ি চালালে আমার নজরে নিশ্চয়ই পড়ত।

আমাকে গালাগালি করল যশোয়ন্ত, কালকে তা নজর করিনি বলে।

জিপের চাকার দাগ ধরে জঙ্গলের মধ্যে কুড়ি-পঁচিশ হাত গিয়ে বোঝা গেল, যে জিপটা যেখানে দাঁড় করানো ছিল, সেই জায়গাটায় ঘন ঝোপ থাকায় জিপটা সহজেই লুকিয়ে রাখা যায় সেখানে। পুটুস-ঝোপের পাশে একটি বড় কালো পাথর। সেই পাথরের পেছনের মাটি বেশ পরিষ্কার করা। পাতা, শুকনো ডালপালা, ইত্যাদি সাফ করা। যশোয়ন্ত ভাল করে লক্ষ করল জায়গাটা। এবং পরক্ষণেই একটি গোল্ডফ্লেক সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে পেল। আমায় বলল, ভাল করে খোঁজ তো, খালি কার্তুজ পাও কিনা।

খালি কার্তুজ পেলাম না, কিন্তু একটা ঠোঙা কুড়িয়ে পেলাম। ঠোঙাটা দেখেই যশোয়ন্ত বলল, ডালটনগঞ্জের বিখ্যাত চাটের দোকানের ঠোঙা। বাবুরা চাট কিনে এনে এখানে বসে মাল খেয়েছিলেন। নইলে কি আর কুড়ি হাত দূর থেকে তোমার তাক্ করা গুলি ফসকাত? তোমার খুপরি ফাঁক হয়ে যেত। খুদাহ যা করবেন, তাই তো হবে।

পর্যবেক্ষণ শেষ করে যশোয়ন্ত বলল, চলো লালসাহেব, ডাইরি-ফাইরি করব না। আমি ওদের শিখলাব। অনেকদিন হয়ে গেল কাউকে ভাল করে রগড়াই না। হাতে-পায়ে মরচে ধরে গেল। জগদীশ পাণ্ডে কতবড় রংবাজ হয়েছে আমি দেখতে চাই। এ ব্যাপারের ফয়সালা আমার উপরই ছেড়ে দাও।

আমি ভয় পেয়ে বললাম, কি? তুমি ওদের খুন করবে নাকি?

যশোয়ন্ত হেসে বলল, প্রায় সেইরকমই। কী করি, তা দেখতেই পাবে।

ষোলো

রামদেও বাবুদের কর্মচারী সেই রমেনবাবু—বেঁটে-খাটো, গাট্টা-গোট্টা চেহারা, অনর্ঘল সিগারেট খান; সেদিন আমার বাংলোর সামনের পথ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যবটুলিয়াতে যাচ্ছিলেন। সেখানে নাকি বিঘা দশেক জমি কিনেছেন। ভাগে দেওয়া আছে, গেঁহু কেমন হল, তাই তদারক করতে যাচ্ছিলেন।

বাঁশ-কাটা কাজের সময় একসঙ্গে আমাদের দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে হয়েছে। ভারী মজার লোক। এই এক-ধরনের মানুষ। এঁদের পিছুটান বলে যে কিছু আছে, তা বোঝার উপায় নেই এঁদের দেখলে। হয়তো সত্যিই নেই। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও এঁদের অদ্ভুত। এই রকম লোকই জঙ্গলে-পাহাড়ে এই ধরনের কাজ তদারক করতে সক্ষম। মুখে হাসি লেগেই আছে। পথচলতি দেহাতি ছেলে-মেয়ে-বুড়োর সঙ্গে দেখা হল তো দু-একটা হাসি-মশকরার কথা বলছেন, তারা দুলে দুলে হাসছে, রমেনবাবু আবার সাইকেল চালিয়ে চলেছেন। এঁদের তুলনায় সত্যিই আমরা মাখনবাবু। অসম্ভব কষ্টসহিষ্ণু এই রমেনবাবু। রোদে জলে গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে।

রমেনবাবুকে বললাম, ফেরবার সময় দুপুরে আসবেন কিন্তু। খাওয়া-দাওয়া এখানেই করবেন।

ভরপেট খেয়ে কি সাইকেল চালিয়ে এতদূর যেতে পারব মশাই?

আজ যে যেতেই হবে এমন কথাও তো নেই। এসেছেন তো জমিদারী দেখতে।

উনি হেসে বললেন, তা যা বলেছেন। জমিদারীই বটে।

বেশ ভাল খেতে পারেন ভদ্রলোক। প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম, পাহাড়ের স্বাস্থ্য-প্রদায়িনী জলবায়ু এসব মিলে বেশি না খাবার কথা নয়। আমিই আজকাল যা খাই, শহুরে লোকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যাবে।

আমার রামধানীয়া রমেনবাবুকে দেখেই দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করে বলল, সেলাম পালোয়ানবাবু।

মানে বুঝলাম না।

শুধোলাম, আপনার নাম আবার পালোয়ান হল কবে থেকে?

রমেনবাবু মুখে ভাত দিয়েছিলেন, হাসতে হাসতে ভাত ছিটকে পড়ল।

বললেন, সে আর বলবেন না মশাই—সে এক ইতিহাস।

তারপর উনি খেতে খেতে পালোয়ান হবার গল্প বলতে লাগলেন।

ডালটনগঞ্জে প্রথম চাকরি নিয়ে এসেছি। মাইনে বেশি পাই না। টাকা-পয়সার বড়ই টানাটানি। টাকা পয়সা রোজগারের শর্টকাট মেথডগুলো তখনও রপ্ত হয়নি। একটা লং মেথড মাথায় এল।

আমি বললাম, মানে?

বাঁশ-কাটা কুলিদের দলে দুজন রং-রুট ছিল। একজনের বাড়ি দ্বারভাঙা জেলা, অন্যজনের ছাপরা। দুজনেরই চেহারা একেবারে দশাসই। দেখলেই মনে হয় প্রফেশনাল কুস্তিগীর। ওরা দুজনেই, রাম সিং আর দশরথ, নতুন এসেছিল। বাইরের লোক দূরে থাকুক, আমাদের কুলিরাই ওদের ভাল করে চেনে না। একদিন ওদের দুজনকে পাঠিয়ে দিলাম ছিপাদোহর। সেখানে তখন মালদেও বাবুর কাজ হচ্ছিল। ছিপাদোহর হয়ে রেল লাইনটা ডালটনগঞ্জ এসেছে। ছিপাদোহর থেকে সামান্যই রাস্তা। তখন ফার্স্ট ক্লাসেরই ভাড়া ছিল বোধ হয় এক টাকা।

দাশরথ আর রাম সিংহকে ছিপাদোহরে পাঠিয়ে দিয়ে লাল-নীল ব্যাঙ্ক পেপারে প্যামপ্লেট ছাপিয়ে দিলাম দুজন পালোয়ানের ছবি দিয়ে। প্যামপ্লেটে বলা হল যে, পালোয়ান রাম সিং ও পালোয়ান দাশরথ সিং, ভীষণ এক জীবন-মরণ কুস্তি প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে—দশদিন পর হাটীয়ার পাশের বড় মাঠে। টিকিট দু-আনা মাত্র। আশ্চর্য! প্রথম তিন দিনে দেড় হাজার টাকার টিকিট বিক্রি হয়ে গেল। তারপরও যখন টিকিট বিক্রি হতে লাগল, তখন আমার ভয় করতে লাগল।

এদিকে রাম সিং আর দশরথ সিং ছিপাদোহরের বাবুদের মোকামের কুয়োতলার পাশে, নরম মাটি, নিমপাতা আর হলুদের গুঁড়ো মেশানো আখড়ায় চটাপট ফটাফট করে মহড়া দিয়ে চলেছে। ওদের কাছে এক শো টাকা ক’রে প্রাইজ, একজোড়া করে নাগরা জুতো, একজোড়া ধুতি এবং এক হাঁড়ি করে হাঁডিয়া কবুল করেছিলাম। তারা দিনরাত ‘জয় বজরঙ বলী কা জয়’ বলে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে ধাই-ধপ্পর করে কুস্তির আখড়া সরগরম করে রাখল।

এদিকে প্রতিযোগিতার দিন আসন্ন। আখড়া তৈরি হয়েছে। চারপাশে বেড়া দেওয়া হয়েছে। বেড়ার গায়ে গায়ে কচি শালপাতার ফেস্টুন লাগানো হয়েছে। মহাবীরের নিশান ওড়ানো হয়েছে আখড়ায়, একটা লম্বা বাঁশের ডগায়। এখন পালোয়ানেরা এসে পড়লেই হয়।

ডালটনগঞ্জ স্টেশনে কী ভিড়। ফার্স্ট ক্লাসের দরজায় দাশরথ সিং আর রাম সিং দাঁড়িয়ে মৃদু-মৃদু হাসছে। আসবার আগে ওদের দুজনের মাথা মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে এখানের লোকেরা চিনতে না পারে। সে হই-হই ব্যাপার। কাঠ-বওয়া ট্রাকের মাথায় তাদের দুজনকে বসিয়ে ‘জয় বজরঙবলী কা জয়’ ধ্বনি দিতে দিতে পৃষ্ঠপোষকেরা ওদের নিয়ে সোজা আখড়ায়। আমি হলাম রেফারি। একটা নীল রঙা সুইমিং ট্রাক ছিল অনেকদিনের পুরনো। হেদোতে সাঁতার কাটতাম। সেটা পরলাম আর রামলীলার মেক আপ ম্যানের কাছে গিয়ে ভাল করে মেক আপ নিলাম, ভূষোকালি, সাদা রং ইত্যাদি মেখে, যাতে আমাকে বুড়ো কুস্তিগীর বলে মনে হয়।

দর্শক তো সবই বাঁশ কিংবা কাঠ, গোলার কুলি। ভেবেছিলাম ধরতে পারবে না।

কুস্তি খুব জোর জমে উঠেছে। মাঝে মাঝে আমি হুইসেল দিচ্ছি। ঘন ঘন দর্শকবৃন্দ হাততালি দিচ্ছে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যে ব্যাপার গুরুতর। রাম সিং একটা গুণ্ডা। ও দাশরথকে ধরে এমন আছাড় মারতে আরম্ভ করল যে, কী বলব। দেখলাম, দশরথ হাত নেড়ে রাম সিংকে কী বলল এবং আমাকেও যেন কী বলল। কিন্তু রাম সিং ছাড়ছে না মোটে। ধুপধাপ করে আছড়ে চলেছে। মেরে ফেলে আর কী। এমন সময় দাশরথ আখড়া ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল, ঈ রমেনবাবু, আইসি বাত থোড়ী থা। হামকো নাগড়া না চাইয়ে, কুচ্ছু না চাইয়ে, আরে বাপ্পারে বাপ্পা, বলেই ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল।

যেই না কথা, আর রমেনবাবু বলে আমাকে ডাকা, আমার কুলিদের মধ্যে জগদ্দল বলে যে একটা কুলি ছিল, ভারী সেয়ানা, সে সঙ্গে সঙ্গে মাল ক্যাচ করে ফেলল। চেঁচিয়ে আর সবাইকে বলল, আরে ঈ ত রমেনবাবু বা। ঔর হামারা দাশরথ ঔর রামসিং বা।

দৌড়, দৌড়, দৌড়। দৌড়ে গিয়ে ট্রাকে বসলাম, বসে সঙ্গে সঙ্গে একবারে স্টেশন। ভাগ্যক্রমে ট্রেন তক্ষুনি ছাড়ছিল, মানে ছেড়ে গেছিলই, সেই অবস্থায় দুজন লাল-নীল ভেলভেটের ল্যাঙোট পরিহিত অনুচর সঙ্গে নিয়ে লাফিয়ে উঠলাম গাড়িতে। ঘামে ততক্ষণে সব রঙ গলে গেছে। দশরথ রাম সিংকে গালাগাল করছে আর রাম সিং দাশরথকে গালাগাল করছে।

গল্প শুনে হাসতে হাসতে মরি।

শুধোলাম, ফিরলেন কী করে তারপর আবার?

উনি বললেন, তক্ষুনি ফিরি। সাতদিন পরে অবস্থাটা শান্ত হলে ডালটনগঞ্জে ফিরলাম।

ফিরেই মালদেওবাবুর পদতলে অনুচরদ্বয়সমেত সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত হলাম।

মালদেওবাবু খুব হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘এই রকম বুদ্ধি, ভাল দিকে লাগালে কী হত?’

সেইদিন থেকে পঞ্চাশ টাকা মাইনে বেড়ে হেল আমার। অনুচরেরাও চাকরিতে পুনর্বহাল হল। আমিও মোটা নিট প্রফিট করলাম। অবশ্য কুস্তিগীরদেরও ঠকাইনি। সকলে খেতে চাইল। একদিন কেচকীতে পিকনিক হল। সব খরচা আমি দিলাম।

এ রকম গল্প-গুজব করতে করতে খাওয়া হল। রমেনবাবুর স্টকে আরও গল্প ছিল। তার প্রতিটি গল্প এমনই মজার। হাসতে-হাসতে পেট ফাটে শুনে।

প্রায় দুপুর দুটো অবধি রইলেন রমেনবাবু। তারপর আবার সাইকেলে চড়ে পাহাড়ি পথে বাঁ হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে, আর ডান হাত নেড়ে নেড়ে, ‘পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়, খুলে দাও প্রিয়া, খুলে দাও বাহুডোর’—গান গাইতে গাইতে পাড়ি জমালেন।

সতেরো

মারিয়ানার কাছ থেকে গোটা চারেক বই আনিয়েছিলাম লোক মারফত। একটি বই নিয়ে বারান্দায় ইজি-চেয়ারে বসে মোড়ায় পা তুলে দেখতে লাগলাম। আমি কোনও বিশেষ বই চাইনি। কারণ মারিয়ানার কাছে কোন বই আছে, কোন বই নেই তা আমার জানার কথা নয়। মারিয়ানা তিন লাইনের সুন্দর একটি চিঠি পাঠিয়েছে বইগুলির সঙ্গে। আমাকে শিরিণবুরু যাবার নেমন্তন্ন জানিয়ে।

জার্মান কবি রিলকের ‘সনেটস টু অরফ্যিয়ুস’ খুলতে গিয়েই মারিয়ানার নাম লেখা দুটি সাদা খাম বইটি থেকে মাটিতে পড়ে গেল। খাম দুটিকে তুললাম। মারিয়ানাকে নিশ্চয়ই কেউ লিখেছিল। ও বইয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছিল। আমাকে বই পাঠানোর আগে বের করে নিতে ভুলে গেছে।

চিঠি দুটি রীতিমত ভারী-ভারী ঠেকল। পরের চিঠি। ভদ্রতার সবরকম মাপকাঠিতেই অন্যের চিঠি পড়া গর্হিত অপরাধ। চিঠি দুটি বেতের টেবলের উপর তুলে রাখলাম।

তারপর রিলকের কবিতা পড়তে চেষ্টা করলাম। অন্য বইগুলো নাড়াচাড়া করলাম, কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও যখন মন বসল না তখন হঠাৎ আবিষ্কার করলাম যে, আমার সমস্ত মন ওই চিঠি দুটির মধ্যে কি আছে তা জানার অসভ্য আগ্রহে অধীর। সাধে কি বলি যে, জংলি হয়ে গেছি।

সব বুঝি। সব বুঝি, তবু সুমিতাবউদি যেমন মুখ করে কুলের আচার খান, যশোয়ন্ত যেমন মুখ করে হুইস্কির বোতল খোলে, আমি বোধ হয় তেমনি মুখ করে চিঠি দুটি খুললাম।

হাতের লেখাটি ভাল না। বড় জড়ানো—খুব তাড়াতাড়ি লেখা। বড় প্যাডে লেখা চিঠি। প্রথম চিঠিটায় ‘মারিয়ানা-সোনা’ বলে সম্বোধন, ‘সুগত’ বলে সমাপ্তি।

কলকাতা

১৭/৮

আমার মারিয়ানা সোনা,

গতকাল মেট্রোতে একটি ছবি দেখলাম ‘The Sandpipers’ এলিজাবেথ টেলর ও রিচার্ড বার্টনের। এডওয়ার্ড বলে একটি চরিত্রে বার্টন অভিনয় করেছেন। সেই চরিত্রটি ও লিজ টেলরের মিস রেনোল্ডস বড় ভাল লাগল। তোমায় গল্পটি বলছি।

পাহাড় ও জঙ্গল-ঘেরা সমুদ্রের পাশে একটি সুন্দর দু’-কামরা উঁচু বাড়ি। চারদিকে কাঁচের জানালা।

বাড়ির সামনে সারাদিন সি-গালেরা জলের উপর উড়ে বেড়ায়, ভেসে বেড়ায়, আর স্যান্ডপাইপার পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে বালুবেলায় ছড়িয়ে পড়েই আবার উড়ে যায়।

মিস রেনোল্ডস একা-একা থাকেন এই লোকালয়বর্জিত নির্জন স্থানে। একেবারে একা নয়। সঙ্গে বছর দশেকের ছেলে থাকে।

কৈশোরের শেষে, মানুষের কৌতূহল যখন অসীম থাকে, যে বয়সে ছেলেরা হামানদিস্তায় হাতঘড়ি গুঁড়িয়ে ঘড়ি কী করে চলে সেই তথ্য আবিষ্কার করতে চায়, ঠিক সেই বয়সে, শারীরিক সম্পর্কে মজাটা কোথায় তা বুঝতে গিয়ে মিস রেনোল্ডস অন্তঃসত্তা হয়। সমাজের মানুষ এবং বাবা-মা’র স্বাভাবিক কারণে তার শরীরের মুকুলিত অন্য শরীরটিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে পরামর্শ দেন। কিন্তু মিস রেনোল্ডস তা না শুনে এবং পাছে বাবা-মায়ের কোনও অসম্মানের কারণ ঘটায়, সেই কনসিডারেশনে, নিজের দেশ ছেড়ে বহু দূরে এক অন্য রাজ্যে (আমেরিকাতেই) এসে এই পাহাড়-সমুদ্রের কোলে বাসা বাঁধে।

পুরুষ মানুষ সম্বন্ধে মিস রেনোল্ডসের অনেকানেক অভিযোগ ছিল। যেমন তোমাদের অনেকেরই আছে। ওর বারো বছর বয়স থেকেই, যেহেতু ও দেখতে সুন্দরী ছিল, পুরুষেরা ওর কাছে ঘেঁষে, কাছে আসে, অন্তরঙ্গতা করতে চায়। কিন্তু সত্যিকারের ভালবাসা যাকে বলে, তা ও কোনওদিন কোনও পুরুষের মধ্যে দেখেনি। ভালবাসার সংজ্ঞাও জানত না। ওর অন্তরের অভিধানে পুরুষের ভালবাসা অর্থবাহী হয়ে অন্য একটি জ্বলন্ত শব্দ লেখা হয়ে গিয়েছিল। যা কেবল দাহ বাড়ায়, দাহ নেবায় না।

প্রকৃতিকে সত্যি-সত্যি ভালবাসত মিস রেনোল্ডস। ছবি আঁকত, সারাদিন ছবি আঁকত। ডানা-ভাঙা স্যান্ডপাইপার পাখিকে বুকে তুলে ঘরে এনে যত্ন করত। স্বার্থপর ও নোংরা পুরুষ মানুষের হাত থেকে বাঁচবার একমাত্র নিশ্চিন্ত স্থান যে প্রকৃতি, তা সে বুঝেছিল।

কিন্তু একদিন তার জীবনে এডওয়ার্ড এল। এডওয়ার্ড বিবাহিত। স্ত্রীর সঙ্গেই সে থাকে। বিশ্বস্তা স্ত্রী। সুন্দরী স্ত্রী। স্ত্রী তাকে ভালবাসে, সেও স্ত্রীকে ভালবাসে। এডওয়ার্ড সুপুরুষ। বিখ্যাত মিশনারি স্কুলের কর্ণধার। নিষ্ঠায়, আদর্শে, পবিত্রতায় বিখ্যাত। মিস রেনোল্ডসের ছেলের স্কুলে ভর্তির ব্যাপার নিয়ে দুজনের প্রথম দেখা হল।

মিস রেনোল্ডস জীবনে এমন পুরুষ মানুষ দেখেনি আর আগে। সুপুরুষ তো বটেই। শিক্ষা আছে, কিন্তু দম্ভ নেই। চাওয়া আছে, কিন্তু চাতুর্য নেই। জ্বালা আছে কিন্তু সে জ্বালা বিকিরিত হয় না। নিজের বুকে ঝড় উঠলে নিজে নৌকো ডুবিয়ে দিয়ে সে ঝড়কে সে প্রশমিত করে, সেই ঝড়কে কূল ছাপিয়ে অন্য মনে ঠেলে পাঠায় না।

এডওয়ার্ড বিবাহিত। অথচ সেও নতুন করে ভালবাসল। সমাজের চোখে এ বিষম অপরাধ। নিজের বিবেকের কাছে সে সব সময়েই ছোট হতে থাকল।

মাঝে-মাঝে এডওয়ার্ড এসে রাতে থাকত মিস রেনোল্ডস-এর স্বপ্নের মতো ঘরে। স্যান্ডপাইপারের ডানার গন্ধবাহী হাওয়ার বাস নিত বুক ভরে। সমুদ্রের ফেনোচ্ছাসে নিজের সমাহিত উচ্ছাসকে দিত ডুবিয়ে।

ধীরে-ধীরে ওদের অন্তরঙ্গতা যখন ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতম হয়ে উঠল, তখন একদিন বিবেকসম্পন্ন মূর্খ পুরুষ এডওয়ার্ড তার স্ত্রীকে জানাল তার নতুন ভালবাসার কথা।

মিস রেনোল্ডস যখন শুনল যে এডওয়ার্ড তার স্ত্রীকে তাদের সম্পর্কের কথা বলেছে, সে ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে কাঁদতে লাগল। কারণ সে সত্যিই নিজেকে প্রকৃতির কন্যা বলে মনে করত। সে বলল, এতে বলার মতো কী ছিল? পাপের কী ছিল? একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে গোপনীয় কোনও মধুর সম্পর্ক থাকা কি পাপ? কোন স্বীকৃত গোপনীয়তা দিয়ে কি এ সম্পর্ক ঢেকে রাখা যেত না? তোমার এ কেমন পাপবোধ? তোমার এ কেমন বিবেক? ন্যায়-অন্যায় চেনোনি?

কিন্তু মারিয়ানা, ন্যায়-অন্যায় বিচার আমার মতো, মিস রেনোল্ডসের মতে, দু-একজন পাগল লোকের মত-সাপেক্ষ নয়। তোমাদের বদ্ধমূল সংস্কার, তোমাদের বিবেক, তোমাদের সমাজ কিন্তু এডওয়ার্ড যে শাস্তি পাবার যোগ্য নয় তাকে সেই শাস্তিই দিল। মিস রেনোল্ডসও শাস্তি পেল। এডওয়ার্ডের স্ত্রীও সেই শাস্তি পেল। শাস্তি কোনও আদালতে হল না বটে, কিন্তু এডওয়ার্ড অর্ন্তদ্বন্দ্ব ও বিবেক-দংশনে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তার স্ত্রী এবং রেনোল্ডস দুজনকেই ছেড়ে চলে গেল। একজন স্বয়মারোপিত বিচ্ছেদ পেল; অন্যজন অন্যারোপিত বিচ্ছেদ। আর এডওয়ার্ড ধর্মপুস্তকের শুকনো পাতা খুঁড়ে-খুঁড়ে সোনা খুঁজতে খুঁজতে তার কবরের দিকে এগিয়ে চলল।

বুঝলে মারিয়ানা, তোমরা বড় খারাপ, তোমরা বড় খারাপ। তোমরা যাই চাও না কেন, তা ব্যক্তিগত মালিয়ানায় চাও। মানুষের মনকে যে লখীন্দরের বাসর ঘরের মতো পরিসরে আটকে রাখা যায় না, এবং গেলেও যে তাতে সাপের মতো সূক্ষ্ম শরীরে ভালবাসার প্রবেশ সম্ভব, তা তোমাদের কিছুতেই বোঝানো গেল না।

এডওয়ার্ড চলে গিয়ে হয়তো বেঁচেছিল, আমি চলে না যেতে পেরে মরছি। অনুক্ষণ মরছি। তুমি, আমি, মহুয়া, আমরা সবাই রেনোল্ডস, এডওয়ার্ড ও এডওয়ার্ডের স্ত্রীর ছায়া—অবিকল ছায়া নয়—বিকৃত ছায়া।

ছবিটি বড় ভাল লাগল। দেখতে-দেখতে তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল। আমার এই একতরফা, পরিণতিহীন, ভবিষ্যৎহীন ভালবাসার সমাপ্তি হয়তো কেবলমাত্র আমার মৃত্যুতে। একটা পাগল, অবুঝ মন নিয়ে জন্মেছিলাম—সেই অশান্ত, অতৃপ্ত মন নিয়েই পৃথিবী থেকে ফিরে যাব।

ভয় নেই। তোমার কোনও ভয় নেই। প্রেতাত্মা হয়ে তোমাকে ভয় দেখাব না; বরং স্বর্গ যদি থেকে থাকে, সে স্বর্গের দরজায় বসে তোমার জন্যে অপেক্ষা করব—কবে তুমি জঙ্গলের গন্ধ মেখে রাধাচুড়োর পুষ্পস্তবকে সেজে, সেই দারুণ দরজায় এসে পৌঁছবে—তার দিন গুনব।

আদর জেনো

ইতি—তোমার সুগত

পরের চিঠিটা খুললাম, খুলেই পড়তে শুরু করলাম। আমার ভিতরে উত্তেজনা বাড়ছিল সঙ্গে ঔৎসুক্যও।

১৫/৯ কলকাতা

আমার মারিয়ানা,

কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। ধন্যবাদ দিয়ে তোমাকে ছোট করতে মন চায় না। তার চেয়ে কৃতজ্ঞতা জানানোই ভাল। কৃতজ্ঞতায় মন নুয়ে আছে।

তুমি আজ আমায় যা দিয়েছ তা তোমার কাছে অকিঞ্চিৎকর হয়তো, কিন্তু আমার কাছে তার কী দাম, তুমি তা কোনও দিনও জানবে না। তোমার কাছে এই দানের কণামাত্র মূল্য থাকলে আমার গর্ব হত। তাহলে জানতাম, বরাবর তোমার কাছে শুধু চাইনি, বদলে কিছু দিতেও পেরেছি। জেনে আনন্দিত হতাম যে, আমার কাছ থেকেও তোমার কিছু নেওয়ার ছিল।

আমি জানি, জীবনের যে সব বড় বড় পাওয়া, সমস্ত শরীর মনকে এক স্বর্গীয় দ্যুতিতে ভর দিয়ে যায়, যার রোমাঞ্চ সমস্ত শরীর, সমস্ত সত্তা বারে বারে শিহরিত হয়, সেইসব অনুভূতির স্বীকৃতি একটি-দুটি গল্প লিখে দেওয়া যায় না। হয়তো তার স্বীকৃতি কিছু দিয়েই দেওয়া যায় না। তার চেয়ে নিজের মনে মনে, নিজের একাকিত্ব, নিজের শীতার্ত দিনগুলি সেই সব দুর্মূল্য মুহূর্তর উষ্ণতার স্মৃতি দিয়ে আজীবন ভরিয়ে রাখাই ভাল।

তোমাকে যতদিন দেখছি, তুমি বরাবর আমাকে বলে এলে, তুমি খারাপ, তুমি ভীষণ খারাপ। আমি জানি না, খারাপ বলতে তুমি কী বোঝো? আমার সর্বস্ব বিলানো ভালবাসাটাই কি খারাপত্বর নিদর্শন?

যেটা সত্যি, সেটা সত্যিই। সত্যির সূর্যটাকে, চোখের সামনে দু’হাত তুলে কি বেশিদিন আড়ালে রাখা যায়? এই সত্যিটাকে স্বীকার করা সম্বন্ধে বোধহয় তোমার কোনও কিছুই করণীয় নেই। এর জন্য তোমার কোনও দুঃখও নেই। শুধু মাঝে মাঝে আমাকে খারাপ বলেই আমার প্রতি তোমার সব কর্তব্য শেষ।

দুঃখ যা পাবার তা আমাকে একাই পেতে হয়। এই সূর্যের মতো সত্যিটাকে অনুক্ষণ মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করতে গিয়ে নিজেকে আমি প্রতিমুহূর্তে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছি। অথচ তা তুমি কোনও দিনও চোখ দিয়ে দেখলে না।

তোমাকে বরাবর চিঠিতে বা অন্যভাবে যা বলেছি, আমার শারীরিক সত্তাও মাঝে মাঝে আবেগের সঙ্গে সে কথাই বলতে চায়। সেই সত্তারও একটা নিজস্ব ভাষা আছে। তোমাকে একমুহূর্ত বুকে জড়িয়ে ধরে সে যদি এতদিনের শীতল তপস্যার শৈত্যকে উষ্ণ করে নিতে পারে, তাতে তোমার এত তীব্র আপত্তি কেন?

মারিয়ানা, আমি জানি যে, তুমিও আমাকে ভালবাসো। এক বিশেষভাবে। আমি অন্তরে অন্তরে তা নিশ্চয়ই জানি। আমি যে জানি, সে কথা তুমিও জানো। যদি আমরা দু’জনে দু’জনকে ভালইবাসি তবে একমুহূর্তের জন্যে আমার বুকে আসতে তোমার এত সংকোচ কীসের? ভয় কীসের? কীসের তোমার এই দুর্বোধ্য অপরাধবোধ?

আমি জানি না, তুমি কোনও দিন আমাকে বুঝবে কিনা; ভরসা নেই বুঝবে বলে। আজ অথবা কাল, শিগগিরই অথবা কিছুদিন বাদে তুমি কাউকে বিয়ে করবে—তখন আমার চোখের সামনে থেকে কতদূর চলে যাবে তুমি। রাতের অন্ধকারে চিৎকার করে কেঁদেও তোমার সাড়া পাব না—তুমি তখন তোমার স্বামীর বুকে শুয়ে থাকবে। তোমার স্বামীর সঙ্গে আমি কীরকম ব্যবহার করব আমি বুঝতে পারি না। আমায় হাসতে হবে, তার সঙ্গে মিশতে হবে, তার কাছে সব সময় গোপন থাকতে হবে, লুকিয়ে রাখতে হবে আমার এই রক্তক্ষরা বঞ্চিত হৃদয়টাকে। যে মারিয়ানা আমার সব কিছু, সেই মারিয়ানাই সে চিরদিনের মালিক হয়ে যাবে। তার শরীরের, তার মনের, তার যা কিছু আছে; সব কিছুর।

সে যে কে, তা আমি এখনও জানি না। সে তখন আমার সামনে ঘুরবে-ফিরবে, আস্ফালন করবে, বীরত্ব দেখাবে, আমারই সামনে বসে আমার সমস্ত সুখ চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে। অথচ আমি আমার রাইফেলে হাত ছোঁয়াতে পারব না। ভাবতে পারি না। জানি না, সে আমার চেয়ে কতগুণ ভাল হবে। এবং এ জন্মে কী করলে আমি তার মতো হতে পারতাম, তাও জানি না। আমি তো একজন সামান্য মানুষ। সে হয়তো অসামান্য হবে। আমার সমস্ত অসামান্যতা তো শুধু আমার এই অবিশ্বাস্য ভালবাসারই মধ্যে।

জানি না, বিয়ের পর পর সেই মানসিক ও শারীরিক আনন্দের মধ্যে আমার কথা হয়তো তোমার আর মনেই পড়বে না। তবু ভাবি, হয়তো ঘোর কেটে গেলে, দু’-এক বছর পেরিয়ে গেলে, তখন হয়তো তুমি বুঝতে পারবে যে, তোমার জীবনে সুগত বলে একজন অনেক দোষে দোষী, সাধারণ লোক এসেছিল, যাকে তুমি তোমার চোখের অনুপ্রেরণায় একজন মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে পারতে—তাকে একজন বড় লেখক করতে পারতে। তাকে তুমি বাঁচাতে পারতে। সে তোমাকে তার মা-বাবা, ভাই-বোন-স্ত্রী সকলের চাইতে বেশি ভালবেসেছিল। তাকে তুমি দু’হাত দিয়ে যতই মানা করো না কেন, তবু সে কালবৈশাখি ঝড়ের মতোই এক সময় তোমার জীবনে এসেছিল। সে তোমার সমস্ত শরীরে মনে স্বর্ণলতার মতো ভালবাসার নরম আঙুল ছুঁইয়েছিল। হয়তো এক দিন একথা তুমি বুঝতে পারবে। কিংবা জানি না, হয়তো এ কথা কোনওদিনও বুঝবে না।

তুমি যেদিন বিয়ে করবে, সেদিন আমি কী করব জানি না। সেদিন আমি এমন কিছু নিশ্চয় করব না যাতে তোমার আনন্দটা মাটি হয়, যাতে তোমার অসম্মান হয়, যাতে তুমি অপ্রতিভ হও। অন্তত তেমন কিছু আমার করা উচিত নয়। কিন্তু যখনই সে কথা ভাবি, এখন থেকেই কেমন অস্বস্তি লাগে।

সেদিনটির কথা ভাবতেও আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।

কাল আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি। সারারাত কেবল সেই মুহূর্তটির কথা ভেবেছি আর ভাললাগায় ভরে গেছি। শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভেবেছি। আমি যে অনুভূতিকে আমার পরম সম্মান বলে মনে করেছি, তাকে তুমি তোমার অসম্মান বলে ভুল করোনি তো? ভেবেছি; আর ভয় পেয়েছি। আমি সজ্ঞানে কোনও দিন তোমাকে অসম্মান করার কথা ভাবতে পারি না—যদিও তুমি আমাকে কোনও দিনও সম্মান দাওনি—আমাকে বরাবর ভুলই বুঝেছ।

তুমি যা দিয়েছ আমাকে, তোমার যা হারিয়েছে; তা তোমার অসীম ভাণ্ডারের এক কণামাত্র। কিন্তু আমার শূন্য ভিক্ষাপাত্র সেই পরশ পাথরের এক কণায় সোনা হয়ে গেছে। সত্যিই সোনা হয়ে গেছে।

মারিয়ানা, আমার সকলকে শুনিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। আমাকে যে যাই বলুক, মারুক, বকুক, আমাকে অপমান করুক, অসম্মান করুক—সমস্ত পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে দাঁড়াক; তবু আমি তোমাকে ভালবাসি।

তোমাকে আমি সমস্ত পৃথিবীর সমস্ত ভালবাসা দিয়ে ভালবাসি।

প্রতিবারের নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমি তোমায় নতুন করে ভালবাসি।

ইতি—

তোমার সুগত

পুনঃ তুমি শিরিণবুরু পৌঁছাবার আগেই হয়তো আমার এ চিঠি সেখানে পৌঁছে তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকবে।

চিঠি দুটি পড়া শেষ করে, বাংলোর হাতায় চেয়ে ভাবছিলাম যে, মনে মনে আমি আদৌ এই আকস্মিকতার জন্যে তৈরি ছিলাম না। যা শুনেছি, মারিয়ানার টুকরো-টুকরো কথায়, তাতে ভদ্রলোকের আপাতদৃষ্টিতে দুঃখ পাওয়ার মতো কিছুই নেই। শিক্ষা আছে, স্বাস্থ্য আছে, অর্থ আছে, যশ আছে, বিশ্বস্তা ও সুন্দরী স্ত্রী আছে, তবুও কেন দুঃখ, এত দুঃখ?

কে এর জবাব দেবে?

আঠারো

টোরী বস্তিতে ভাল দুর্গাপূজা হয়। রুমান্ডি থেকে জঙ্গলে জঙ্গলে একটা রাস্তা লাতেহার গিয়ে পৌঁছেছে। লাতেহার থেকে টোরী। জিপেও সে পথে অত্যন্ত কষ্ট করে যেতে হয়। সুমিতাবউদি ফিরে এসেছেন। তাই ঘোষদা অষ্টমী পুজোর দিন ভোরবেলা বউদিকে নিয়ে রুমান্ডিতে এলেন। যশোয়ন্তকে আগেই খবর পাঠিয়েছিলেন বউদি। যশোয়ন্তও এসে হাজির হল। কলকাতা থেকে বউদি আমার এবং যশোয়ন্তের জন্যে ধুতি ও তসরের পাঞ্জাবি বানিয়ে এনেছেন।

বললেন, পরো শিগগিরি। চান করে এসে পরো—আজ সকালে বীরাষ্টমীর অঞ্জলি দিতে যাব টোরীতে। চাঁদোয়া টোরী।

যশোয়ন্ত সম্বন্ধে আমার কাছে ঘোষদা যতই বুলি কপচান না কেন, বউদির কাছে একেবারে চুপ। ঘোষদা যেন স্ত্রৈণ, শুধুমাত্র সেই জন্যেই নয়। সুমিতাবউদির এমন একটা ব্যক্তিত্ব ছিল যে, উনি যা করেছেন তা যে খারাপ কখনও হতে পারে, তা কারও পক্ষে মনে করাই অসম্ভব ছিল।

আমি আর যশোয়ন্ত জগাই-মাধাই দুই ভায়ের মতো চান করে ধুতি পাঞ্জাবি পরলাম।

যশোয়ন্ত বলল, আরে ইয়ার, ম্যায় চলনে নেই শেকতা ধোতি পেহেনকে। আজ হামারা নাকহি টুট যায়েগা।

বেশ দেখাচ্ছে কিন্তু যশোয়ন্তকে। কাপালিক কাপালিক। ঋজু অর্জুন গাছের মতো শরীর। মাথায় লাল সিঁদুরের ফোঁটা। বউদি পরিয়ে দিয়েছিলেন। গতকালের ডালটনগঞ্জের পুজোর সিঁদুর।

সকালে আমরা শুধু এক কাপ করে চা খেলাম। বউদির নির্জলা উপবাস। অঞ্জলির আগ পর্যন্ত। যশোয়ন্ত ধুতি হাঁটুর উপর তুলে জিপের স্ট্রিয়ারিং-এ বসল। জিপ ছাড়ার আগে আমার বন্দুকটা নিয়ে পেছনের সিটে আমার ও ঘোষদার মধ্যে দিল। বউদি সামনে বসলেন।

আমাকে যশোয়ন্ত আগে থাকতে বারণ করেছিল যে, ঘোষদা বউদিকে সেদিনের সেই গুলির ঘটনার কথা যেন না বলি।

ঘোষদা যশোয়ন্তকে বললেন, অঞ্জলি দিতে যাচ্ছ, আবার বন্দুক কীসের! মায়ের কাছে যাচ্ছ, তাও কি একটু শান্ত সভ্য হয়ে যেতে পারো না?

যশোয়ন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আজ যে মহাষ্টমী ঘোষদা, মা যে শক্তিদায়িনী। আজ বীরের দিন—। মার কাছে যাচ্ছি বলেই তো বন্দুকটা নিলাম।

ভারী চমৎকার অঞ্জলি দিলাম টোরীতে।

অন্য এক কাগজ কোম্পানির ফরেস্ট অফিসার মিহিরবাবু ওখানেই থাকেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ হল। অঞ্জলির পর তাঁর বাড়িতে চা-জলখাবার না খাইয়ে ছাড়লেন না। ভারী ভাল লাগল এই পুজোর পরিবেশ। এই পুজো অনাড়ম্বর আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। কলকাতার অ্যামপ্লিফায়ারের কর্কশ চিকার নেই, বিকারগ্রস্ত ও ন্যক্কারজনক কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি নেই। এখানে মা দশভূজা নিজের মহিমায় স্মিতহাস্যে ভক্তবৃন্দের সামনে আসীন।

লাতেহারে এসে কাছারির সামনে পণ্ডিতের দোকানে একপ্রস্থ মিষ্টি খাওয়া হল। তারপর আবার রুমান্ডি।

পথে সুমিতাবউদি বললেন, ফিরে হয়তো দেখব মারিয়ানা এসে গেছে। ওকে আনতে গেছে ড্রাইভার অনেকক্ষণ।

বউদি লুচি ভাজলেন। সকালের জলখাবার। সঙ্গে আলুর তরকারি ও আচার—এবং প্রসাদী সন্দেশ। আলু এই রুমান্ডিতে একটি দুষ্প্রাপ্য জিনিস। আলুর তরকারি একটা অতিবড় মুখরোচক খাওয়া এখানে। বাইরে বসে আমরা গল্প করতে করতে খেলাম।

রীতিমতো শীত পড়ে গেছে। কলকাতার ডিসেম্বরের চেয়েও বেশি। সবসময়ই প্রায় গরম জামা গায়ে পরে থাকতে হয়। রোদে বসে থাকতে ভারী আরাম। রোজ পেছনের কুয়োতলায় অন্তর্বাস পরে বসে রামধানিয়াকে দিয়ে সর্বাঙ্গে কাড়ুয়া তেল মর্দন করাই—তারপর ঝপঝপিয়ে বালতি বালতি ঠাণ্ডা কুয়োর জল ঢেলে দেয় রামধানিয়া ওইখানেই। কী আরাম যে লাগে, কী বলব। প্রথম প্রথম অমন বাইরে বসে খালি গায়ে তেল মাখতে লজ্জা করত খুব—লজ্জার চেয়েও বড় কথা, সংস্কারে বাধত। খালি গায়ে বাইরে খোলা আকাশের নীচে ফুরফুরে হাওয়া লাগলে, গায়ে সুড়সুড়ি লাগত। রোদ পড়লে গা চিড়-চিড় করত। যশোয়ন্তই বলে বলে এবং সবসময় আমার পেছনে লেগে লেগে খোলা জায়গায় চান করার অভ্যাস করিয়েছে।

যশোয়ন্ত ধমক দিয়ে বলেছে, তুমি কি মেয়েমানুষ? লোকের সামনে অথবা উদোম জায়গায় গা খুলতে পারো না?

যশোয়ন্ত নিজে নির্বিকার চওড়া পাথরের মতো বুকে একরাশ কোঁকড়া চুল—সরু কোমর—দীর্ঘ গ্রীবা—মাথাভরা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল—সযত্নে বর্ধিত পাকানো গোঁফ—পা থেকে মাথা অবধি কোথাও কোনও খুঁত নেই। পুরুষের সংজ্ঞা যেন। ও কোনওরকম সংস্কারের বালাই নেই—তা ছাড়া অমন সুপুরুষ চেহারাতে ওকে সব-কিছু করাই মানায়।

যশোয়ন্ত বলছিল, কুটকুতে যাবে শিকারে। কুটকু ব্লকে চিফ-কনসার্ভেটর বাইরের কাউকে বড় একটা শিকার-টিকার করতে দেন না। যশোয়ন্ত পারমিট বের করবে ডিসেম্বরে। তখন মারিয়ানার বন্ধু সুগত শিকারে আসবেন। তাই মারিয়ানার অনুরোধে যশোয়ন্ত ওই সময় শিকারের বন্দোবস্ত করেছে। কুটকুতে।

মারিয়ানার কথা আলোচনা হচ্ছে। এমন সময়েই মারিয়ানা এসে পৌঁছাল।

সে এসেই ফিসফিস করে শুকনো মুখে আমার কানে কানে শুধাল, কোনও চিঠি পেয়েছেন আমার, আমার বইয়ের মধ্যে?

আমি যেন ভাল করে জানিই না, এমনি ভান করে বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছিলাম বটে—তাতে যেন আপনারই নাম লেখা ছিল। থাকলে সেই বইয়ের মধ্যেই আছে। যেখানে ছিল।

মারিয়ানা উদ্বিগ্ন চোখে বলল, আছে?

ওর চোখ দেখে বুঝতে পারলাম, ও আমার মুখ দেখে বুঝতে চাইছে চিঠি দুটি আমি পড়েছি কিনা। আমি পাকা জোচ্চোরের মতো বললাম, ভয় নেই। চিঠি পড়িনি আমি। পরের চিঠি পড়ার কোনও অসভ্য কৌতূহল আমার নেই।

মনে হল, বিশ্বাস করল ও কথাটা। তারপর আমাদের কাছে না বসে সুমিতাবউদির কাছে যাবার ছুতোয় আমার ঘরের টেবিল হাতড়ে চিঠি দুটো বের করল। নিশ্চয়ই বইটার মধ্যে থেকেই। তারপর মানসচক্ষে দেখতে পেলাম ওর হাতব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল চিঠি দুটো।

বেশ কাটল অষ্টমীর দিনটি। হাসি, গান, হৈ-হুল্লোড়, তাস খেলা, দাবা খেলা, কোনও খেলাই বাকি রইল না।

সন্ধে নামতে না নামতেই বেশ হিম পড়তে লাগল। রামধানিয়াকে ডেকে যশোয়ন্ত বড় বড় শলাই গাছের গুঁড়ি এনে বাংলোর হাতায় জ্যাকারান্ডা গাছের গোড়ায় আগুন ধরাল। আমরা সকলে আগুনের চারপাশে বসলাম গোল হয়ে।

আমাদের পীড়াপীড়িতে মারিয়ানা গান শোনাতে রাজি হল। কিন্তু গান শুরু করার আগেই বাংলোর গেট দিয়ে গ্রামের একটা কুকুর প্রাণপণে দৌড়ে ভিতরে ঢুকল, এবং পেছন পেছন আর একটি কুকুর তার চেয়েও জোরে ধাওয়া করে ঢুকল। এবং দুজনেই আমাদের থেকে প্রায় পঁচাত্তর গজ দূর দিয়ে কোনাকুনিভাবে হাতাটাকে পেরিয়ে কাঁটাতারের বেড়া টপকে আবার বাংলোর বাইরে জঙ্গলে চলে গেল।

যশোয়ন্তকে দেখলাম, উঠে দাঁড়িয়েছে।

কুকুর দুটো অদৃশ্য হতেই বলল, শালার তো বড় সাহস।

ঘোষদা শুধোলেন, কোন শালার?

যশোয়ন্ত বলল, চিতাটার। একেবারে ভরসন্ধ্যায় বাংলোর সীমানায় ঢুকে কুকুর তাড়ায়।

আমরা সমস্বরে বললাম, পেছনেরটা চিতা নাকি? যশোয়ন্ত বলল, তা নয় তো কী? দৌড়ানোর ঢঙ দেখে বুঝতে পারলে না? চিতার চাল আলাদা।

চিতা আর কুকুরের উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা শেষ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গেটের কাছে দেহাতি চাদরে মাথা ঢাকা একটি মূর্তি এসে দাঁড়াল। শরীরের গড়ন দেখে মনে হয় চেনা চেনা। এমন সময় চিতাটা যেমন করে কুকুরটাকে তেড়ে গিয়েছিল, প্রায় অমন করেই যশোয়ন্ত লোকটার দিকে ধেয়ে গেল এবং তাকে ধাওয়া করতে দেখেই লোকটাও ঊর্ধ্বশ্বাসে সুহাগী গ্রামের দিকে দৌড়াল।

কিন্তু যশোয়ন্ত বোসের সঙ্গে দৌড়ে পারে এমন লোক এ তল্লাটে বেশি নেই। একটু গিয়েই যশোয়ন্ত মোড়ের মাথায় লোকটাকে ধরে ফেলল। তারপর চাদর মোড়া অবস্থায়ই তাকে রাস্তার ধুলোয় ফেলে লাথি কিল চড় ঘুসি মারতে লাগল। লোকটির আর্তস্বর শরতের রাতে বন-পাহাড় মথিত করে তুলল। গলার স্বর শুনে মনে হল ওই টাবড়ের ছেলে আশোয়া। কিন্তু হঠাৎ যশোয়ন্ত এমন করে মারছে কেন? আমি দৌড়ে গেলাম কিন্তু ফলে দু-একটা ঘুসি খেলাম মাত্র, তাকে থামাই আমার এমন সাধ্য কী?

এমন সময় সুমিতাবউদি এসে যশোয়ন্তকে প্রায় আক্ষরিকভাবে জড়িয়ে ধরলেন এবং সেই ফাঁকে আশোয়া মাটি থেকে উঠে চাদরটা কুড়িয়ে নিয়ে অলিম্পিক প্রিন্টারের গতিতে সুহাগী বস্তির দিকে পালাল।

সুমিতাবউদি বললেন, লোকটাকে অমন করে মারছিলে কেন?

যশোয়ন্তকে খুব উত্তেজিত দেখাল। ও বলল, বলব না! কারণ ছিল বলেই মারছিলাম।

আমাকে কিছু না বললেও বুঝলাম, সেদিনের সেই গুলি-ঘটিত ব্যাপারে ওরও কোন হাত ছিল না। ও হয়তো জগদীশ পাণ্ডেদের ইনফর্মার।

জুম্মান রাতে পোলাও রেঁধেছিল। পোলাও এবং পাঁঠার মাংসের লাব্বা। সঙ্গে তক্কর। রায়তা বানিয়েছিলেন বউদি। জুম্মান সত্যিই অনেক পদ রাঁধতে জানে। খাসিরই যে কত পদ রাঁধে তার ইয়ত্তা নেই। চাঁব, চৌরী, লাব্বা, পায়া, কোর্মা, কাবাব, কলিজা, কবুরা—শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে বিভিন্ন রান্না।

এই খাওয়ার ব্যাপারে স্থানীয় লোকদের মধ্যে নানারকম সংস্কার আছে। আমার বন্দুক কেনার পরে পরেই একটি বুড়ো ট্রাক ড্রাইভার, যার সঙ্গে আমার জানা-শোনা ছিল, এসে একদিন আমাকে বলল, ‘হুজৌর আপ কভি ভাল্ মারনেসে উসকা কবুরা মুঝে দিজিয়েগা। গোস্তাফী মাফ কিজিয়েগা হুজৌর।’ অর্থাৎ আমি যদি কখনও ভাল্লুক মারি তাহলে ভাল্লুকের শরীরের এক বিশেষ অংশ যেন তাকে দিই।

এ কেমন বেয়াদবি আবদার? আবদার শুনে বুঝলাম না, রাগ করব কি করব না। জুম্মান দেখি মুখ নিচু করে আছে। আমার মনে হল, ও হাসি চাপার চেষ্টা করছে। আমার সামনে হেসে ফেললে বেয়াদবি হবে বলে আপ্রাণ হাসি চাপার চেষ্টা করছে।

লোকটা চলে যেতে, আমি জুম্মানকে ডেকে শুধোলাম, লোকটি এমন অনুরোধ কেন করল? ভাল্লুকের কবুরা কি কোনও ওষুধে লাগে? জুম্মান মাথা নিচু করেই বলল, না হুজৌর, ভাল্লুকের কবুরা খেলে কমজোরী মানুষও একদম মস্ত হয়। এই ড্রাইভারের বয়স সত্তর, কিন্তু ছ’মাস হল তৃতীয় পক্ষের বউ ঘরে এনেছে। বউয়ের বয়স পঁচিশ।

সেদিন মনস্থ করেছিলাম একটা নিদারুণ পরোপকার করার জন্যে আমার অন্তত একটি ভাল্লুক মারা দরকার।

আমরা দেখতে বসলাম। এখনও ফায়ার-প্লেসে আগুন লাগে না। সুমিতাবউদি বলছিলেন, নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির শেষ অবধি ফায়ার-প্লেসে আগুন জ্বালাতে হবে—নইলে অত্যন্ত কষ্ট পেতে হবে শীতে।

যশোয়ন্ত বলল, তোমাদের নিরেট মাথা বলে সারা ঘর গরম করার জন্যে মণ মণ কাঠ পোড়াও। তার চেয়ে আমার মতো দু আউন্স তরল জিনিস পেটে ঢালো, সারা রাত পেটের মধ্যে ফায়ার প্লেস নিয়ে বেড়াও—‘ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, হুইস্কি-পানি পেটে আছে, শীত করবে কী?’

সুমিতাবউদি ওকে বড় বড় চোখ করে ধমকে বললেন, তোমাকে কতদিন বলেছি যে, তুমি আমাদের সামনে তোমার মদ খাওয়া নিয়ে বাহাদুরি করবে না নির্লজ্জর মতো। আবার তুমি অমন করছ।

সুমিতাবউদির বকুনি খেয়ে যশোয়ন্ত যেন হঠাৎ নিবে গেল।

রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর আমার ঘরে সুমিতাবউদি আর মারিয়ানা শুলেন। আর আমার পাশের ঘরে তিনটে পাশাপাশি ফেলা নেয়ারের চৌপায়াতে আমি, যশোয়ন্ত আর ঘোষদা।

শুয়ে শুয়ে বাবুর্চিখানার প্যানট্রিতে জুম্মানের কাঁচের বাসন ধোয়ার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। রামধানিয়া রোজকার মতো কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে দড়ির চৌপায়ায় বসে তুলসীদাস পড়ছে গুন-গুন করে। ‘সকল পদারথ্ হ্যায় জগ্‌মাহী, কর্মহীন নর্ পাওয়াত নাহী।’

এই সব শব্দ, এই সব ঘুমপাড়ানি সুর আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে চিতাবাঘ, কোটরা, কি চিতল হরিণের ডাক শুনে সুহাগী বস্তির কুকুরগুলো কেঁউ কেঁউ করে ডেকে উঠছে। এ পর্যন্ত কোনও রাতে বড় বাঘের ডাক শুনিনি। তবে লোকে বলে, নভেম্বর ও মে মাসে বাঘেদের মিলনকালে এখানে সে ডাক প্রায়ই শোনা যায়।

পাশের ঘর থেকে সুমিতাবউদি ও মারিয়ানার ফিসফিস করে মেয়েলি গল্পের গুঞ্জরন শুনতে পাচ্ছি। পাশ ফেরার শব্দ। চুড়ির রিনঠিন।

বাংলোর হাতায় শুকনো পাতার উপর গাছের পাতা থেকে টুপটুপিয়ে শিশির পড়ছে, তার শব্দ পেলাম। কখন যে চেতন থেকে অবচেতন এবং সেখান থেকে সুপ্তচেতন হয়েছি জানি না।

সে রাতে পোলাও মাংস বোধ হয় বেশি খাওয়া হয়েছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কেমন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে। বুক থেকে কম্বলটাকে সরালাম। চোখটা মেলালাম। চেয়ে দেখি, আমার ঘরের দরজাটা খোলা। যশোয়ন্ত বাইরের বারান্দায় কম্বলমুড়ি দিয়ে ঠাণ্ডার মধ্যে ইজিচেয়ারে বসে আছে একা-একা। ওরও নিশ্চয়ই শারীরিক অস্বস্তি হচ্ছে কোনও।

সদ্য ঘুম-ভাঙা শরীরে এমন একটা আমেজ যে, ওর সঙ্গে কথা বলে সেই আমেজটা নষ্ট করতে মন চাইছে না। শুয়ে শুয়ে বাইরের তারা-ভরা আকাশ দেখতে পাচ্ছি। রাত কত তা জানি না। অষ্টমীর চাঁদ উঠেছে এক ফালি। পাণ্ডুর শিশির ভেজা জ্যোৎস্নায় বারান্দাটা ভিজে রয়েছে। একটা খাপু পাখি ডাকছে সুহাগী নদীর দিক থেকে—খাপু-খাপু-খাপু-খাপু-খাপু-খাপু…. আর ঝিঁঝির একটানা গান।

দেখলাম যশোয়ন্ত কম্বলের পাটটা খুলে ভাল করে জড়াল কম্বলটাকে।

যে ঘরে মেয়েরা শুয়েছিলেন, হঠাৎ সে ঘরের বাইরের দিকের দরজা খোলার একটা আওয়াজ পেলাম খুট করে। দুটি ঘরের মাঝে যে দরজা, সেটি বউদিরা শোবার সময় ভেতর থেকে বন্ধ করেই দিয়েছিলেন। ঘোষদার নাক এখন বেশ জোর ডাকছে। ফঁরর-ফঁ-ফোঁস-ফঁরর-ফঁরর।

সুমিতাবউদির ভারী চাপা গলা শুনতে পেলাম। এই, তুমি এই ঠাণ্ডায় এখানে বসে আছ যে?

যশোয়ন্ত জবাব না দিয়ে বলল, আপনি এত রাতে বাইরে বেরুলেন যে একা! ভয় করল না?

আমার ভয় করে না। তা ছাড়া তোমার কাছে থাকলে তো করেই না।

যশোয়ন্ত বলল, বসুন। শুধু চাদর নিয়ে বাইরে এসেছেন? যান কম্বলটা নিয়ে আসুন। আমার ঠাণ্ডা লাগবে না। তোমার কম্বল থেকে আমাকে একটু ভাগ দাও না? দেবে? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যশোয়ন্ত ঘুরে বসে বলল, আচ্ছা আপনার কথা আমি সবসময় শুনি, আপনি আমার কোনও কথা কোনও সময় শোনেন না কেন? বলতে পারেন?

সুমিতাবউদি যশোয়ন্তের পাশের চেয়ারটায় বসলেন। কম্বলের কোণটা নিয়ে গায়ে দিলেন। বললেন তাই বুঝি? শুনি না? কখনওই শুনি না? তাহলে আমার কথা তুমি শোনো কেন? আমি তো তোমাকে আমার কথা শুনতেই হবে, এমন কথা বলিনি?

যশোয়ন্ত আবার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর বলল, আপনাকে ভালবাসি বলে শুনি।

আমাকে কেন ভালবাসে?

জানি না।

আমার কাছে তুমি কিছু কি চাও?

যশোয়ন্ত বলল, জানি না।

সুমিতাবউদি বললেন, তুমি জানো না, কিন্তু আমি জানি। চাইলেই তো সব কিছু পাওয়া যায় না যশোয়ন্ত। আমিও কি মনে মনে কিছু চাই না কারও কাছে? আমিই জানি, আর ভগবানই জানেন। আমরা মেয়েরা আমাদের সব চাওয়া চোখের তারায় বয়ে বেড়াতে পারি, কিন্তু হয়তো ছেলেরা তা পারে না। তোমার মতো ছেলে তো তা পারেই না। আমি সব বুঝি, সবই বুঝি যশোয়ন্ত। কিন্তু কী করব বলো? ভগবানকে সব সময়ে বলি, ভগবান আমাকে জোর দাও, আমি যেন কারও কাছে ভিখারিণীর মতো কিছু চেয়ে না বসি।

থামুন তো। ভর্ৎসনার গলায় যশোয়ন্ত বলল। আমার সামনে আপনাদের ভগবানের কথা বলবেন না। শালাকে একদিন দেখতে পেলে হত, রাইফেলের তাক কাকে বলে দেখাতাম, শালাকে হার্ড নোজড বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে দিতাম। মেয়ে মাত্রই ন্যাকা। আপনিও। নিজেদের ঘুঘু পাখির মতো কলজে, নিজেরা পয়লা নম্বরী স্বার্থপর—আপনাদের পক্ষেই নিজেদের খুশিমতো ভগবানের নামে সব কিছু চালানো সম্ভব। এই আমি আপনার বুকে হাত রাখছি। বলুন তো, বলুন, এবারে আপনার বুকের মধ্যে আপনি কী শুনেছেন? রক্ত ছলাৎ ছলাৎ করছে কিনা বলুন? এর মধ্যে ভগবান শালার কী করার আছে আমি জানি না। আপনারা ভারী ভণ্ড। মিথুক আপনারা। একটা মেয়ের চেয়ে একটা মাদি চিতাবাঘকে আমি অনেক বেশি শ্রদ্ধা করি।

তুমি একটা আস্ত পাগল।

আমি পাগল নই।

তবে তুমি কী?

জানি না।

এ রকম করো কেন? আমার বুঝি কষ্ট হয় না?

হয় না। আপনার কিছুই হয় না। আপনি অদ্ভুত।

বেশ। তা হলে তাই। আমার প্রতি অবিচার কোরো না যশোয়ন্ত।

ঠিক আছে।

তারপর আবার অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল দুজনে।

দুরগুম দুরগুম করে একটা পেঁচা ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে।

হঠাৎ সুমিতাবউদি যশোয়ন্তের মাথার একরাশ চুল হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে ওর গালের সঙ্গে গাল ছুঁইয়ে বসে রইলেন। আমার সেই সায়ান্ধকারেও মনে হল, যশোয়ন্তের সারা শরীরে যেন কেমন একটা শিহরন খেলে যেতে লাগল। যশোয়ন্ত বউদির হাত দুখানি একটানে নিয়ে নিজের হাতে মুঠি করে ধরল। তারপর হাতের তেলো দুটি ওর ঠোঁটে কয়েকবার ঘষল।

অনেকক্ষণ নিজের হাতে সুমিতাবউদির হাত দুটি ধরে রাখল যশোয়ন্ত। মনে হল, আর কখনও ছাড়বে না!

কেউ কোনও কথা বলল না। হঠাৎ সুমিতাবউদি বললেন, এই তুমি কাঁদছ?—এই বোকা! তুমি কাঁদছ? ছি-ছি-ছি, কি বোকা। তুমি কাঁদছ? এই বলতে বলতে বউদির গলার স্বরও কান্নায় বুজে এল।

বউদি যশোয়ন্তের মুঠো থেকে হাত দুখানি ছাড়িয়ে এবার যশোয়ন্তের মুখটি দুহাতে ধরলেন, তুমি খুব ভাল যশোয়ন্ত, তুমি খুব ভাল।

তারপর অনেকক্ষণ দুজনে চুপচাপ বসে রইল।

বউদি বললেন, আমি কী করব যশোয়ন্ত? আমি যে পারি না।

তারপর আরও অনেকক্ষণ চুপচাপ।

অনেকক্ষণ পর বউদি বললেন, কী করব বলো? লোকটার জন্যে মায়া হয়।

তারপর প্রায় জোর করে বউদি যশোয়ন্তকে ঘরে ঠেলে পাঠালেন। এবং নিজে গিয়ে দুয়ার দিলেন।

যশোয়ন্ত এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

পাছে আমি জেগে আছি জানতে পায় ও, তাই তাড়াতাড়ি চোখ বুজে ফেললাম।

যশোয়ন্তের মতো ছেলেও কাঁদে! এবং এমনভাবে কাঁদে! ভাবা যায় না।

এখানে আসার পর থেকে কত কী শিখলাম, দেখলাম। আমার জীবন কোনওদিনও বৈচিত্র্যময় ছিল না। সাহিত্যে অনেকানেক নায়ক-নায়িকার দেখা পেয়েছি—পড়েছি। কিন্তু কখনও আগে বুঝতে পারিনি যে, নায়ক-নায়িকারা দূরের কি কল্পনার লোক নয়, তারা সকলেই আমাদের চেনা লোক। যাদের আমরা চোখ দিয়ে পরশ করি, হাত দিয়ে ছুঁই। প্রতিনিয়ত যাদের অস্তিত্ব আমরা অনুভব করি, যারা আমাদের নিজের নিজের নিজস্ব জগতের মধ্যেই বাস করে। শক্তিমান লেখকেরা এই নিত্যতার, দৈনন্দিনতার ডালি থেকেই যাদুকরের মতো তাদেরই কত অন্যভাবে আমাদের কাছে উপস্থিত করেন। প্রত্যেক ঔপন্যাসিকই নিশ্চয়ই ঐশী ক্ষমতার অধিকারী।

উনিশ

রাংকার রামরিচ সিং-এর মাটির দেওয়াল, খাপরার- চালের ভাণ্ডার থেকে চতুর্দিকের উপত্যকা চোখে পড়ে। একটি নদী পাহাড়টাকে জড়িয়ে জড়িয়ে ঘুঙুর পায়ে নেচে চলেছে। খেম্‌টার সুর বাজছে যেন পায়ে পায়ে। ‘বল গোলাপ মোরে বল, তুই ফুটিবি সখী কবে। বল গোলাপ মোরে বল।’

আমরা যেদিন এসে পৌঁছলাম, তার আগের দিনই বাঘে মড়ি করেছে পাহাড়ের নীচে নদীর পাশে। এক ওঁরাও চাষার ফুটফুটে দুধ-সাদা দুধেল গাই মেরে দিয়েছে বাঘে।

আমরা পৌঁছেছিলাম সকাল ন’টা নাগাদ। পৌঁছানো মাত্র একবার মড়িটা দেখতে গেলাম। ভাণ্ডার থেকে প্রায় পনেরো মিনিটের পাকদণ্ডী পথ। ঝরনাটার কাছেই কতগুলো পুটুস ঝোপের আড়ালে গরুটা পড়ে রয়েছে কাত হয়ে। দুধের বাঁট দুটো খেয়ে নিয়েছে আর পেছনের নরম অংশ। গলার কাছে দুটি পরিষ্কার ফুটো। মনে হল কেউ যেন ড্রিলিং মেশিন দিয়ে ড্রিল করেছে। গরুটাকে ধরেছিল এখান থেকে কম করে ‘চারশ’ গজ দূরে; বিকেলে যখন চরে বেড়াচ্ছিল। সেখান থেকে এতদূর টেনে এনেছে। কোথাও ছ্যাঁচড়ানোর দাগ আছে, কোথাও তাও নেই।

যশোয়ন্ত চতুর্দিকে নিরীক্ষণ করল ভাল করে।

কুলকুল করে ঝরনাটাতে এক চিলতে জল বয়ে চলেছে। এই রোদে-ভরা আকাশের নীচে দাঁড়িয়েও জায়গাটায় বেশ শীত শীত করছে। গরুটার কাছাকাছি বড় গাছ আছে, তাতে নীচের দিকে মোটেই মাচা বাঁধার উপযুক্ত ডাল নেই। যেখানে ডাল আছে, তা অনেক উঁচু।

যশোয়ন্ত আমাকে বলল, তোমার অত উঁচু থেকে গুলি করতে অসুবিধা হবে। তার চেয়ে মাটিতে বসব। মাটিতে বসে জানোয়ার দেখতে অনেক সুবিধা, গুলি লাগাতেও সুবিধা।

আমি বললাম, তা তো সুবিধা, কিন্তু প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ারও খুব সুবিধা।

যশোয়ন্ত বলল, প্রাণ বেরুনো অত সোজা নাকি?

আমি বললাম, তোমার জগদীশ ভাইয়ের গুলির হাত থেকে বেঁচেছি বলে কি বাঘের হাতেও বাঁচব?

যশোয়ন্ত বলল, এখানে কথা বোলো না—বাঘ তো বেশি দূরে যায়নি, ধারেকাছেই আছে। ঘুমুচ্ছে। বেশি চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত হতে পারে।

গাছের নীচে ভিজে স্যাঁতসেতে মাটিতে বাঘের পায়ের দাগ দেখলাম। আমারও হুইটলি সাহেবের বন্ধুর মতো ‘মাঁই গঁড, হিঁ ইজ দ্যা ড্যাঁডি অঁব অঁল গ্র্যান্ড ড্যাঁডিজ’ বলতে ইচ্ছে করল। বাঘের থাবার ছাপ দেখলেই মাখনবাবুর বুকের ভেতরটা কেমন করে।

নিরীক্ষণ করে বোঝা গেল যে, বাঘ নদী পেরোয়নি। নদীর যেদিকে গরু আছে, সেই দিকেই ফিরে গেছে। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, বাঘ যে-পথে গেছে, সে পথেই ফিরে আসবে।

বেশ বুদ্ধি করে নদীর পাশে যশোয়ন্ত একটা গর্ত খুঁড়ল। সেই ওঁরাও চাষা আর নিজে মিলে। আমাকে একটা ছুরি দিয়ে বলল, বেশ দূর থেকে কয়েকটা করৌঞ্জের ঝাঁকড়া ডাল কেটে আনতে। বলল, বন্দুক নিয়ে যাও। বাঘ কোথায় শুয়ে আছে কে জানে? ডাল কাটতে গিয়ে বাঘের নাকে কোপ বসিয়ো না। করৌঞ্জের ডাল কেন কাটতে বলল বুঝলাম। মড়ির চারপাশে করৌঞ্জের বন।

দশ-পনেরো মিনিট বাদে ডাল কেটে ফিরে এসে দেখি, নদীর খাড়া পাড়ে যেখানে এক রাশ করৌঞ্জের ডাল আছে তার ঠিক পাশেই যশোয়ন্ত গর্তটা সম্পূর্ণ করেছে। আমি পৌঁছাতে গর্তের সামনে যেখানে করৌঞ্জের গাছগুলো ছিল তার সঙ্গে মিলিয়ে আমার কেটে-আনা ডালগুলো বসিয়ে দিল বালিতে। গরুটার কাছ থেকে এবং গরুটা যেদিকে আছে, সেদিক থেকে করৌঞ্জের ঝোপের আড়ালে গর্ততে বসে থাকলে বাঘ আমাদের মোটেই দেখতে পাবে না। অবশ্য যদি আমরা নড়া-চড়া বা শব্দ না করি।

মাটিতে বসে থাকব, আর অতবড় রয়্যাল টাইগার এসে আমাদের থেকে দশ পনেরো হাত দূরে গরুর হাড় কড়মড়িয়ে খাবে—এ দৃশ্য কতখানি ভয়াবহ জানি না, তবে এ দৃশ্যের কল্পনাও কম ভয়াবহ নয়। তা ছাড়া আমাদের পেছনে তো উদোম টাঁড়। মাত্র কুড়ি হাত চওড়া বালিময় নদী—যাতে এক চিলতে জল চলছে মাত্র। বাঘ যে পেছন দিক থেকে আসবে না, এমন গ্যারান্টি যশোয়ন্ত দিচ্ছে কী করে জানি না। অবশ্য বাঘের পায়ের দাগ দেখে যশোয়ন্ত যা সাব্যস্ত করেছে, সেটাই সম্ভাব্য ও ঠিক বলে মনে হল।

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ এনামেল করা মগে এক কাপ করে গরম চা কৃপণের মতো রয়ে সয়ে খেয়ে, ভাল করে গরম জামা-কাপড় পরে এবং দুটো দেহাতি কম্বল এবং একটি ছোট নারকেলের দড়ির চারপাই নিয়ে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম মড়ির কাছে।

সূর্যের তেজ কমে গেছে। বেলা পড়ে এসেছে। চৌপায়াটা নদীর বালুরেখার পাড় ঘেঁষে পেতে, তার উপর কম্বল দুটো বিছিয়ে আমরা বসলাম। রামরিচবাবুর চাকর এসেছিল সঙ্গে, তাকে বললাম, দেখ তো বাবা, ও পাশ থেকে আমাদের মাথা দেখা যাচ্ছে কি না? সে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি করে বলল, কুচ্ছো না দিখ্‌তা হো বাবু, একদম ঠিক্কে হ্যায়।

তারপর সে এবং তার সঙ্গী দু’জনে জোরে কথা বলতে বলতে চলে গেল বস্তির দিকে।

বেশ শীত। রোদের তেজটা যত কমে আসছে, তত মনে হচ্ছে, কার অদৃশ্য হিমেল দু-খানা হাত কাঁধের দু-পাশে চেপে বসছে। তা ছাড়া নদীতে বসেছি, ঠাণ্ডা যেন আরও বেশি বলে মনে হচ্ছে।

কাছেই জঙ্গলের মধ্যে কোনও ফাঁকা মাঠ আছে। তাতে যেন পাখিদের মেলা বসেছে। তিতির আর বটেরের ডাকে বন সরগরম। বন-মোরগ ডাকছে থেকে থেকে। ময়ূরের কেঁয়া-কেঁয়া রব চতুর্দিকে গোধূলিবেলার নিস্তরঙ্গতাকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছে। আমাদের সামনের গাছে একটা সুন্দর, বড় নীল আর খয়েরিতে মেশা কাঠঠোকরা এসে বসল। বসে কাঠ ঠুকতে লাগল ঠকাঠক-ঠকাঠক করে।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে এল। কোজাগরী একাদশীর চাঁদ উঠতে লাগল।

গরুটার পা শক্ত দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল, যাতে বাঘ এসে টেনে এদিক-ওদিক নিয়ে না যায়—তা হলে আমাদের বসবার জায়গা থেকে সম্পূর্ণ দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। সাদা গরুটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এখনও পশ্চিমাকাশে বেগুনি-গোলাপিতে মেশা একটা আভা আছে। তবে জঙ্গলে, পাহাড়ের পাদদেশে এবং কোলে-কাঁখে অন্ধকার নেমে এসেছে।

আমরা উৎসুক হয়ে গরুর মড়ির দিকে চেয়ে বসে আছি। উৎকর্ণ হয়ে আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছি—বড় জোড় পনেরো মিনিট হল চাঁদ উঠেছে; এমন সময় হঠাৎ আমাদের একেবারে সোজাসুজি পেছনে একটা নুড়ি গড়িয়ে নদীতে পড়ার শব্দ হল। যশোয়ন্ত ছিলাভাঙা ধনুকের মতো মুহূর্তে রাইফেলটা কাঁধে ঠেকিয়ে উল্টোদিকে ঘুরে বসল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে থেকে দু বার হাঁউ হাঁউ করে একটা চাপা গুরু গম্ভীর বিরক্তিসূচক আওয়াজ হল।

যশোয়ন্ত আমাকে ফিসফিসিয়ে বলল, টর্চটা নিয়ে আমার সঙ্গে এসো। আমার ডান কাঁধের উপর দিয়ে ব্যারেলের উপর আলো দেবে।

আমার বন্দুকটা কাঁধে ঝুলিয়ে, তাড়াতাড়ি জল পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম যশোয়ন্তের সঙ্গে। পাঁচ ব্যাটারির টর্চের আলো জঙ্গলময় আলোর বন্যা বইয়ে দিল। সেই আলোর কেন্দ্রে দেখলাম বিরাট ফিকে হলদে রঙা বাঘ আমাদের দিকে পেছন ফিরে হেলতে দুলতে চলেছে। পেটটা প্রায় মাটিতে ঠেকে গেছে। আলোটা গায়ে পড়তেই ভেবেছিলাম দৌড়ে পালিয়ে যাবে ভয়ে। অথবা আমাদের উল্টে আক্রমণ করবে; কিন্তু মনে হল, কাউকে ভয় করা বাঘের কুষ্টিতে লেখা নেই। বড় জোর এড়িয়ে চলতে চায়—ভাবটা, Leave and let alone.

চার কদম গিয়েই বাঘ দাঁড়িয়ে পড়ে মাথাটা নিরুদ্বেগে ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাল। একটা প্রকাণ্ড মুখ—হলদে-সাদায় মেশানো। কপালের কাছটা সাদা—ইয়া বড় বড় খানদানী গোঁফ। একবার মুখ তুলে তাকালেই বুকের রক্ত হিম হবার জোগাড়। আমি টর্চটা ধরে রইলাম এবং যশোয়ন্ত মুহূর্তের মধ্যে আমার উত্তোলিত ডান হাতের নীচে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েই ওর ফোর-ফিফটি-ফোর হান্ড্রেড ডাবল ব্যারেল দিয়ে গুলি করল। কী বলব, বাঘটা ওইখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। সমস্ত শরীরটা কিছুক্ষণ থরথর করে কাঁপল। তারপর স্থির হয়ে গেল।

যশোয়ন্ত বলল, ভেবেছিলাম তোমাকে দিয়ে শিকার করাব। তা হল না। ব্যাটা আমাদের একদম বুদ্ধ বানিয়ে দিল। নদী টপকে একেবারে পেছন দিয়ে আসছিল। এ যদি মানুষখেকো বাঘ হত, তাহলে আর দেখতে হত না।

আমি বললাম, বাঘ কোন ঝুটঝামেলা না করে মরল কেন? তবে যে লোকে বাঘকে এত ভয় পায়?

যশোয়ন্ত বলল, গুলি করার আগে পর্যন্ত বাঘের মতো ‘ডোন্টকেয়ার’, ‘আয়-না-দেখি’, ‘কুছ পরোয়া নেহী’ গোছের জানোয়ার দুটি নেই। মানুষকে বাঘ এড়িয়ে চলতে চায় এ পর্যন্তই। কিন্তু কখনও মানুষকে ভয় করে না। ফলে বুক-ফুলিয়ে রাজার মতো আস্তে আস্তে হেলে-দুলে চলে, থেমে দাঁড়ায়—মুখ ঘুরিয়ে তাকায়। তাই মাথা ঠাণ্ডা করে মারতে পারলে বাঘ মারা সব শিকারের চেয়ে সোজা। আর এ যদি চিতা হত, তা হলে দেখতে আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কেমন লেজ তুলে দৌড়োয়। বাঘ ভাবতেই পারে না যে, তার সঙ্গে ইয়ারকি-মারনেওয়ালা কোনও জীব আছে দুনিয়ায়। সে কারণে আলো ফেলতেই আমাদের ধৃষ্টতা দেখে বাঘ অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

সফট-নোজড গুলিটা কাঁধে ঢুকে ঘাড় ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। চলো কাছে, দেখাব। তা না হয়ে যদি গুলি কোন বে-জায়গায় লাগত তা হলে দেখতে বাঘ কী জিনিস, আর মানুষ বাঘকে ভয় পায় কেন। ভয় পাওয়ার মতো জানোয়ার সে তো বটেই! আরও কিছুদিন জঙ্গলে থাকো, বাঘ যে কী জিনিস তা জানবার দুর্ভাগ্য নিশ্চয়ই হবে। প্রতিবারই কপিবুক শিকারের মতো বাঘ পাকা আমের মতো ধপ করে পড়ে গিয়ে আমাদের যে কৃতার্থ করে না, তা জানতে পারবে।

কতকগুলো পাথর ছুঁড়ে আমরা বাঘটার কাছে গেলাম। গুলি করেছিল যশোয়ন্ত প্রায় তিরিশ গজ দূর থেকে। বাঘের মতো বাঘ বটে। বনের রাজা যাকে বলে। বেচারির গরু খাওয়া হল না।

পরে আমরা মেপেছিলাম। ন’ ফুট এগারো ইঞ্চি Between the pegs.

Between the pegs—মানে, বাঘকে লম্বা করে লেজ সমেত একটি সমান্তরাল রেখায় শুইয়ে, নাকের কাছে এবং লেজের কাছে দুটি খোঁটা পুঁতে সেই খোঁটা দুটির দূরত্ব যত হয়, তত|

গুলির শব্দ শুনেই রামরিচবাবু নিজেই লোকজন নিয়ে এসেছিলেন। তা না করলেও পারতেন। কারণ গুলিটা ছোঁড়ার কথা ছিল আমার। এবং আমি গুলি ছুঁড়লে, গুলি ঘাড়ে না লেগে লেজেও লাগতে পারত। এবং সেই অবস্থায় অতজন নিরস্ত্র লোকজন নিয়ে সেই জঙ্গলে ঢোকাটা নিতান্ত নির্বুদ্ধির কাজ হত।

পরদিন দুপুরে ফলাও করে মুরগি-তিতিরের কাবাব, বাজরার-রোটি এবং হরিণের মাংসের আচার দিয়ে খাওয়া সেরে কষে দিবানিদ্রা লাগালাম। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। বাঘের চামড়া ছাড়াতে ছাড়াতে প্রায় রাত দেড়টা হয়ে গেছিল, তারপর সকালে অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে।

সারা দুপুর ঘুমিয়ে ক্লান্ত শরীরকে মেরামত করে বিকেলে রামরিচবাবুর ভাণ্ডারের সামনের উঠোনের আম গাছের নীচে বসে, ভয়সা দুধে ফোটান দারুচিনি-এলাচ দেওয়া চা খেলাম রসিয়ে রসিয়ে।

বেলাও পড়ে এল। এবার আমরা রওয়ানা হব রুমান্ডির দিকে। বাঘের চামড়াটা জিপের পিছনে রাখা হয়েছে। ভাঁজ করা চামড়াটাতে সিটটা প্রায় ভরে গেছে। নুন লাগানো হয়েছে পুরো চামড়াতে। নুনের গন্ধ, রক্তের গন্ধ; বাঘের লোমের গন্ধ সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা বদ গন্ধ বেরুচ্ছে।

রুমান্ডিতে ফিরে চামড়ার যত্ন-আত্তি করা যাবে।

আপাতত ওই অবস্থাতেই রাখা আছে। যশোয়ন্ত বলেছে, এ চামড়াটা কলকাতায় কাথবার্টসন অ্যান্ড হার্পারে পাঠাবে ট্যান করাতে।

যাত্রাকাল সমুপস্থিত, এমন সময় জিপে মবিল ঢালতে গিয়ে দেখা গেল, মবিলের টিন সুদ্ধ গায়েব।

এই অজগ্রামে গভীর জঙ্গলের মধ্যে ওঁরাও-গঞ্জুরা কেরোসিন তেলই কিনতে পারে। তাদের সে পয়সাও জোটে না। তাই চকচকে টিন-ভর্তি মবিল তেল কে চুরি করে নিয়েছে, কে জানে! কাড়ুয়া তেল ভেবেও চুরি করতে পারে। অথচ, মবিল গাড়িতে নেই-ই বলতে গেলে। চড়াই-এ উৎরাই-এ পাহাড়ি রাস্তায় সইদৃপ ঘাট হয়ে রুমান্ডি পৌঁছতে হবে, এ রাস্তায় মবিল না থাকলে ইঞ্জিন জ্বলে যাওয়া বিচিত্র নয়।

রামরিচবাবু তো খুবই লজ্জিত হলেন, বললেন, এখন কাকে ধরি বলুন তো? ছি ছি আপনারা সব মেহমান লোক আর আমার কাছে এসে আপনাদের এহেন হেনস্থা! রাগারাগি করতে আরম্ভ করলেন তিনি। সামনে যাকে পান, তাকেই গালাগালি করেন।

এমন সময়ে যশোয়ন্ত তাঁকে আড়ালে ডেকে বলল যে, রাগারাগি কাজ হবে না। কী করলে যে কাজ হবে তা আর বলল না। রামরিচবাবুকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে কী সব ফিসফিস করতে লাগল ও।

আমি ভান্ডারে বিছানো চৌপাইয়ে আলোয়ান মুড়ে বসে বসে চাঁদ ওঠা দেখতে লাগলাম। আর কিছুদিন বাদেই লক্ষ্মী-পূর্ণিমা। নিষ্কলঙ্ক শরতকালে বন পাহাড়ে চাঁদের সে রূপ বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার নেই।

হঠাৎ রামরিচবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তারস্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডালটনগঞ্জী ‘একরা-কেকরা’ ভাষায় বলতে লাগলেন, যশোয়ন্তবাবু তন্ত্রমন্ত্র জানেন। তিনি ওই বাইরের ঘরে পুজোয় বসেছেন। কে মবিলের টিন নিয়েছে, তা উনি এক ঘণ্টার মধ্যে জেনে ফেলবেন। এবং তার আর নিস্তার নেই। তার সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিন্তু যে নিয়েছে, সে যদি টিনটি চুপি চুপি গোয়াল ঘরের খড়ের গাদায় রেখে আসে, তবে যশোয়ন্তবাবু তার নাম কাউকে বলবেন না এবং তাকে ক্ষমা করে দেবেন।

যশোয়ন্ত কালীভক্ত জানতাম। কিন্তু সে যে তন্ত্রমন্ত্রও জানে, তা জানা ছিল না।

সেই চুরালিয়া বস্তির লোকেদের, প্রথমে সেই সাংঘাতিক খবরে বিশেষ প্রত্যয় হল না, এবং আমারও হল না। কিন্তু দেখলাম, যে-ঘরে যশোয়ন্ত ধ্যানে বসেছে, সেই ঘরে দু-একজন লোক উকি মারতে লাগল একে-একে। এমনি করে ভিড় ক্রমশ বাড়তেই লাগল। ভাণ্ডারের চারপাশে গুজ-গুজ ফুস-ফুস শুরু হল।

এত লোককে এমন করতে দেখে আমরাও কিঞ্চিৎ সখ হল যে, যশোয়ন্ত কী প্রকার ধ্যান করছে, গিয়ে একবার দেখে আসি।

ঘরের সামনে গিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়েই যা দেখলাম, তাতে প্রায় আঁতকে উঠলাম।

সে ঘরে আসবাবপত্র কিছু নেই। সেটি অনেকগুলি খাপরার চালের ঘরের একটি। মাটির মেঝেতে একটি কেরোসিনের কুলি জ্বলছে। যশোয়ন্ত দরজার দিকে পেছন ফিরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে হাত দুটো মাথার উপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে এবং সরল বাংলায় সুর করে জলদ গম্ভীর গলায় কেটে কেটে বলছে—

দুটো ঘুঘু পাখি,

দেখিয়ে আঁখি,

জাল ফেলেছে পদ্মার জলে,

দু’টো ছাগল এসে

হেসে হেসে,

খাচ্ছে চুমু বাঘের গালে।

এই লাইন ক’টিই বারংবার অত্যন্ত গাম্ভীর্য ও পবিত্রতার সঙ্গে কেটে কেটে উচ্চারণ করছে। শুনে কাপালিকের মন্ত্র বলেই মনে হচ্ছে। যশোয়ন্তের চকচকে ময়াল সাপের মতো উদ্ধত উলঙ্গ মসৃণ শরীরে কেরোসিনের কুপির আলোটা ধেই-ধেই করে নাচছে। সে এক অকল্পনীয় দৃশ্য।

বলা বাহুল্য, ওইখানে যে-সব লোক ওই বীভৎস প্রক্রিয়ায় ধ্যান করা দেখছিল, তারা কেউই বাংলার ব-ও জানে না। তারা নিশ্চয়ই ভাবছে যে, কোনও সাংঘাতিক চোর ধরা মন্ত্র। রামরিচবাবু ব্যাপারটা জানতেন, কিন্তু সেই পরিবেশে উলঙ্গ যশোয়ন্তের মুখে ঘুঘু পাখির গান যে কেমন শোনাচ্ছিল, তা বোধহয় তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার লোক আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। হাসব না কাঁদব বুঝতে না পেরে পালিয়ে এসে আবার চৌপাইতে বসলাম।

একটু পরেই রামরিচবাবুর খাস চাকর ‘একরা টিনা মিললই হো—একরা টিনা মিললই হো’ বলতে বলতে মবিলের টিনটা নিয়ে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করল। ওকে জেরা করতে ও বলল, একটা লোক এইমাত্র টিনটা গোয়ালঘরের খড়ের গাদায় রেখে দিয়ে পড়ি কি মরি করে দৌড়ে পালাল।

একটু পরে তান্ত্রিক যশোয়ন্ত ধ্যান ভেঙে জামা-কাপড় পরে বাইরে এসে দাঁড়াল। সমবেত ভক্তমণ্ডলী সমস্বরে বলল, বাপ্পারে বাপ্পা, তুহর গোড় লাগি বাপ্পা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *