১৫. কিছুক্ষণের জন্যে হাবীব বিভ্রান্ত হলেন

মেয়েটা কি সফুরা? ফরিদের বউ!

কিছুক্ষণের জন্যে হাবীব বিভ্রান্ত হলেন। ভ্রান্তি কাটতে সময় লাগল না। মেয়েটা সফুরাই। হলুদ চাদরে শরীর ঢেকে রেখেছে। চাদর থেকে হলুদ আভা পড়েছে মুখে। সামান্য আলোছায়া কী করতে পারে ভেবে হাবীব যথেষ্ট বিস্ময় বোধ করলেন। সফুরা রূপবতী, কিন্তু এতটা রূপবতী না যে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। অতি রূপবতীরা বর পায় না। সফুরা বর পেয়েছে। কাজেই সে অতি রূপবতীর একজন না। হাবীব কোর্টের কর্মকাণ্ডে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

কোর্টের অবস্থা গ্রামের হাটের মতো। লোকজন ঢুকছে, বের হচ্ছে। আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে পান চিবুচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে উঁকি মেরে দেখছে কোর্টরুমে কী ঘটছে।

টাকাপয়সার লেনদেন নিয়ে বারান্দায় মারামারি বেধে গেল। হুটাপুটি শব্দ। গালাগালি। শুরুটা দুজনের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিন-চারজন যুক্ত হয়ে গেল। তীক্ষ্ণ চিৎকারে কেউ একজন বলল, মাইরালছে রে। আমারে মাইরালছে। এর মধ্যেই কোর্টে বিচারকার্য শুরু হলো।

আসামি ফরিদ কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। হাবীব লক্ষ করলেন, সে বেশ রোগা হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। সে তাকিয়ে আছে সফুরার দিকে। অবাক হয়ে স্ত্রীকে দেখছে। একবার হাবীবের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে সালামের ভঙ্গি করল। কাজটা ভুল। কোর্টরুমে তিনি ফরিদের পরিচিত কেউ না।

হাবীব তার পাশে বসা প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললেন, খবরের কাগজ পড়া এখন বন্ধ রাখে।

প্রণব বললেন, গরম খবর আছে।

যত গরম খবরই থাকুক কাগজ বন্ধ।

প্রণব কাগজ বন্ধ করলেন। হাবীব নিচুগলায় বললেন, ফরিদের স্ত্রী সফুরা এখন ধীকে কই?

আমাদের কাছে থাকে।

তারে কখনো দেখি না কেন?

নিজের মনে থাকে। পোয়াতি মেয়েছেলেরা পুরুষের সামনে আসতে লজ্জা পায়।

তারে বলবা যেন আমার সঙ্গে দেখা করে। এখন বলব?

না, সে বাড়িতে যাক তারপর বলবা। কোনো কাজে হুটহাট আমার পছন্দ।

প্রণব কানেকানে বললেন, স্যার লক্ষ করেছেন মেয়েটা এখন কেমন সুন্দর হয়েছে। শাস্ত্রে বলে স্বামী যদি দীর্ঘদিনের জন্যে পরবাসে যায় তাহলে পরবাস যাওয়ার প্রাক্কালে স্ত্রীর চেহারা পূর্ণশশীর মতো হয়।

হাবীব বললেন, এখন চুপ করো।

পাবলিক প্রসিকিউটর জেরা করার জন্য এগিয়ে আসছে। হাবীব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের নাম হারুন। বয়স অল্প, কিন্তু কথার মারপ্যাঁচ ভালো শিখেছে। অতি বুদ্ধিমান। লম্বায় খাটো। কোর্টে তার নামে প্রচলিত ছড়া হলো —

বাইট্যা হারুন
চাইট্যা খায়।

হাবীব বললেন, হারুন কি বিবাহিত?

প্রণব বললেন, বাঁটকুটারে বিয়ে করবে কে? স্যার কি জানেন, ইবলিশ শয়তান বাঁটি ছিল?

না।

আমি বইয়ে পড়েছি, এইজন্যেই কথায় আছে, বাঁটি শয়তানের লাঠি।

এখন চুপ থাকো। বাঁটুটা সওয়ালজবাব কী করে শুনি।

হাবীবের সিগারেটের তৃষ্ণা হয়েছে। তিনি পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট স্পর্শ করলেন। তাঁর মনে হলো, কোর্টরুমে সিনিয়র আইনজীবীদের এবং জজ সাহেবের সিগারেট খাওয়ার অনুমতি থাকলে ভালো হতো। প্রায় সময়ই জটিল মামলায় চিন্তার গিট্টু লাগে। সিগারেটের ধোঁয়া সেই গিট্টু খুলতে পারে।

আপনার নাম ফরিদ?

জি।

আপনি ভালো আছেন?

জি।

মুখে বলছেন ভালো আছেন। আপনি তো ভালো নাই। আপনার চোখ লাল। চোখের নিচে কালি। রাতে তো আপনার ঘুম হয় না।

হাবীবের ইশারায় তার জুনিয়র আব্দুল খালেক বললেন, অবান্তর প্রশ্ন। অবজেকশন ইউর অনার।

হারুন বলল, অবজেকশন যখন উঠেছে তখন এই বিষয়ে কথা বলব না। আমি স্বাভাবিক সৌজন্যে প্রশ্ন করেছি।

মূল প্রশ্নে যান। আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছ?—এইসব বাদ থাক।

কোর্টরুমে হাসির শব্দ উঠল অনেকেই হাসছে, তাদের সঙ্গে হারুনও হাসছে। হঠাৎ সে হাসি থামিয়ে বলল, ফরিদ সাহেব, আপনি গল্প-উপন্যাস পড়তে পছন্দ করেন, তাই না?

জি।

আমি খোঁজ নিয়েছি জেলখানার লাইব্রেরি থেকে আপনি প্রায়ই বই নিয়ে পড়েন। গতকাল রাতে কি কোনো বই পড়েছেন?

আব্দুল খালেক বললেন, অবজেকশন ইউর অনার। অবান্তর প্রশ্ন। জজ সাহেব কিছু বললেন না। তাকে খানিকটা কৌতূহলী মনে হলো ফরিদ বলল, রবি ঠাকুরের লেখা একটা বই পড়েছি স্যার নাম নৌকাডুবি’।

কবিতার বই?

জি-না স্যার। উপন্যাস। ঘটনাটা বলব?

ঘটনা বলার প্রয়োজন নাই। একটা বিষয় জানতে চাই, আপনি যখন হাজি রহমতু রাজা চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে ছিলেন তখন কি বই পড়ার সুযোগ ছিল?

জি না।

আপনার বক্তব্য অনুযায়ী আপনি তার সঙ্গে তিন বছর ছিলেন। তাহলে ধরে নিতে পারি এই তিন বছর বই পড়তে পারেন নাই।

ফরিদ জবাব দিল না। হারুন বলল, ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরিতে অনেক বই, এই তথ্য কি আপনি জানেন?

জানি।

কীভাবে জানেন? পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে যাওয়ার অভ্যাস কি ছিল?

ফরিদ অস্বস্তি নিয়ে জজ সাহেবের দিকে তাকাল। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

আপনি তো সবসময় হাজি সাহেবের সঙ্গেই থাকেন। তাই না?

জি।

হঠাৎ হঠাৎ উনি যখন ময়মনসিংহ আসেন, তখন আপনিও আসেন।

জি।

ক্ষিতিশ বাবু নামে কাউকে চিনেন?

ফরিদ বিড়বিড় করে বলল, চিনি না।

মনে করার চেষ্টা করুন। উনি ময়মনসিংহ পাবলিক লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান।

চিনি না স্যার।

হারুন বলল, আপনি বলছেন চেনেন না, কিন্তু ক্ষিতিশ বাবু ভিন্ন কথা বলেন। তার ভাষ্যমতে আপনি নিয়মিত লাইব্রেরি থেকে বই আনা নেওয়া করেন। আপনি শরৎচন্দ্রের লেখা ‘বিন্দুর ছেলে’ বইটা পড়েছেন?

জি পড়েছি।

পাবলিক লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়েছেন?

ইয়াদ নাই।

আপনি সর্বশেষ এই বইটা ইস্যু করেছেন। আপনি থাকেন এক জায়গায়, বই আনা নেওয়া করেন আরেক জায়গায়। ঘটনা কী?

ফরিদ টোক গিলল। তাকাল হাবীবের দিকে। তার চোখে হতাশা।

ঘটনা কি এরকম যে, অন্য একজন খুন করেছে আপনি তার দায়ভাগ সেধে নিচ্ছেন, বিনিময়ে অর্থ পাচ্ছেন?

ফরিদ অস্পষ্ট গলায় বলল, পানি খাব স্যার। তিয়াস লাগছে। জজ সাহেব ইশারায় পানি দিতে বললেন। টিনের গ্লাসে তাকে পানি দেওয়া হলো। ফরিদ তৃষ্ণার্তের মতো পানি খাচ্ছে না। চা খাওয়ার মতো খাচ্ছে।

হারুন বলল, আদালতের কাছে আমি ক্ষিতিশ বাবুকে সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত করার অনুমতি প্রার্থনা করছি। জজ সাহেব হ্যা-সূচক মাথা নাড়লেন।

হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। হারুন বিপদজনক দিকে যাচ্ছে। ক্ষিতিশ বাবু, লাইব্রেরি—এইসব তথ্য হারুন ডিটেকটিভের মতো বের করেছে তা হয় না। উকিলরা সিনেমা উপন্যাসে ডিটেকটিভ হয়। বাস্তবে পান সিগারেট খেয়ে অবসর কাটায়। হারুনকে কেউ একজন তথ্য দিয়েছে। সেই কেউ একজনটা কি ফরিদের স্ত্রী সফুরা? হারুন যখন ক্ষিতিশ বাবু সম্পর্কে কথা বলছিল তখন তাকিয়ে ছিল সফুরার দিকে।

হাবীব কাঠগড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। আয়োজন করে হাই তুললেন। এর অর্থ এতক্ষণ যে আলোচনা হলো তা হাই তোলার মতো গুরুত্বহীন। ডাক্তার এবং উকিল এই দুই শ্রেণীর মানুষদের নিজ নিজ বিদ্যার পাশাপাশি অভিনয়ও জানতে হয়। হাবীব জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইউর অনার। ডুবন্ত মানুষ খড়খুটা আঁকড়ে ধরে। আসামি ফরিদ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আদালতকেও বলেছে। আমি তার পক্ষের আইনজীবী। এমন সব তথ্য তার বিষয়ে এখন উপস্থিত হচ্ছে যা আমি নিজে জানি না। ক্ষিতিশ বাবু ভুল করেছেন। সমিল চেহারার মানুষ থাকে। বলা হয় একই চেহারার মানুষ সাতজন করে তাকে। এদের একটা নাম আছে। পুরুষ হলে এদের বলে সন্তু ভ্রাতা। মেয়ে হলে সপ্ত ভগ্নি। আমি চাই ক্ষিতিশ বাবু আদালতে উপস্থিত হয় বলুক এই সেই আসামি যে নিয়মিত বই আনা নেওয়া করে।

হাবীবের বক্তৃতার পর পর আদালত মুলতবি হয়ে গেল। হাবীব এসে বসলেন প্রণবের পাশে। প্রণব বললেন, স্যার আপনার কোনো তুলনা হয় না।

হাবীব ললেন, কোনো মানুষেরই তুলনা হয় না। সারা পৃথিবীতে আমি হাবীব একজনই, আবার তুমি প্রণবও একজন। বুঝেছ?

হুঁ।

পত্রিকাটা নামাও। সারাক্ষণ মুখের উপর পত্রিকা ধরা।

বললাম না গরম খবর আছে। পড়বেন?

না।

আমি সফুরাকে বলেছি আজ সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে।

কখন বললা?

এক ফাঁকে বলেছি। সে খুব চিন্তিত। তার হাত দেখে কে যেন বলেছে তার স্বামীর ফাঁসি হবে।

হাবীব বললেন, একটা পান দাও।

প্রণব পানের কৌটা বের করুলেন। কোর্টরুম খালি হয়ে গেছে। হাবীব এবং প্রণব এগুলো বসে আছেন। হাবীব অস্থির বোধ করছেন। অস্থিরতার কারণ ধরতে পারছেন না। প্রণব বলব, জজ সাহেবের মেয়ের বিয়ের কথা মনে আছে, স্যার?

মনে আছে। উনার মেয়ের নাম কী?

শায়েরা বানু। উনি বিরাট আয়োজন করেছেন। আজই ঢাকা থেকে বাবুর্চি আসবে মিষ্টির কারিগরও আসবে।

বিয়ের তারিখ যেন কী?

জানুয়ারির ২০ তারিখ।

হাবীব উঠে দাঁড়ালেন। জজ সাহেব খাস কামরায় আছেন। তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হওয়া দরকার।

 

ডিসট্রিক জজ আবুল কাশেম ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। হাবীবকে দেখে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, চেয়ারটা কাছে এনে বসুন। কোমরের ব্যথাটা আবার শুরু হয়েছে। বেশিক্ষণ সোজা হয়ে বসে থাকতে পারি না।

আমার পরিচিত এক কবিরাজ আছে। সে গাছগাছড়া দিয়ে মালিশ করার তেল তৈরি করে। অনেকেই উপকার পেয়েছে। আপনাকে তৈরি করে দিতে বলব?

বলুন। আমার মেয়ে রাতে ইন্ডিয়ান বাম ঘষে দেয়, লাভ কিছু হয় না।

হাবীব বসতে বসতে বললেন, আপনার কোন মেয়ে, যার বিয়ের আলাপ হচ্ছে সে? শাহেদা বানু?

হুঁ।

মেয়ে চলে গেলে আপনার তো খুব কষ্ট হবে।

তা তো হবেই। এই মেয়ে বাপঅন্ত প্রাণ। রোজ দুপুরে টেলিফোন করে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছি কি না। টিফিন কেরিয়ারে নিজে খাবার ভরে দেয়।

হাবীব বললেন, এই কয়দিন কোর্টে খাওয়াদাওয়া না করে বাসায় মেয়ের সঙ্গে যান।

কথাটা মন্দ বলেন নাই। বিয়েতে খাবারের আয়োজন কী করেছেন, একটু কি বলবেন?

অবশ্যই বলব। সবই আমার স্ত্রী ঠিক করেছেন। প্রথম মেয়ের বিয়ে, ধুমধাম করতে চায়।

উনি একা তো ধুমধাম করবেন না। আমরা সবাই মিলে করব।

জজ সাহেব আগ্রহ উত্তেজনায় উঠে বসলেন। আনন্দিত গলায় বললেন, পোলাও, মুরগির কোরমা, খাসির কান মাংস, দই মিষ্টি, পিঠা, পান-সুপারি।

গরু রাখবো না?

হিন্দু  অতিথিদের কথা বিবেচনা করে গরু বাদ দিয়েছি।

হাবীব বললেন, হিন্দু-মুসলমান এক টেবিলে খাবে না। ওরা মুরগি দিয়ে খাবে। মুসলমান মেয়ের বিয়েতে গরু না থাকলে চলে? গোমাংস ছাড়া বাকি সব মাংসই নিরামিষের পর্যায়ে পড়ে।

দেখি আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করি।

আপনার মেয়ের বিয়েতে আমার একজন অতিথি নিয়ে আসার বাসনা আছে। উনি আবার গোমাংস পছন্দ করেন।

জজ সাহেব বললেন, অতিথি কে?

গভর্নর সাহেব। মোনায়েম খান। উনি সামাজিক উৎসবে যেতে পছন্দ করেন। অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। অবশ্যি আপনি যদি অনুমতি দেন।

জজ সাহেব উত্তেজিত গলায় বললেন, অবশ্যই উনাকে বলবেন। এটা হবে আমার মেয়ের জন্যে বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। আমি তো চিন্তাই করতে পারি না আমার মেয়ের বিয়েতে স্বয়ং গভর্নর উপস্থিত।

হাবীব বললেন, বরযাত্রী এবং বিশিষ্ট অতিথিদের জন্যে আমি একটা আইটেম আপনাকে করে দিতে চাই। মাছের আইটেম। পাবদা মাছ। একেকটা বোয়ালের মতো সাইজ। মাছটা মাখনের মতো। মুখে নিলে মুখের মধ্যেই গলে যায়। আমাদের গভর্নর সাহেবের পছন্দের মাছ।

পাবদা মাছের ব্যবস্থা অবশ্যই করবেন। খরচ যা লাগে আমি দিব।

তাহলে তো স্যার হবে না। শাহেদা বানু মায়ের জন্যে আমি কিছু করব না? আর যে পাবদা মাছের কথা বলেছি টাকা দিলে সেটা পাওয়া যায় না। ব্যবস্থা আমাকে করতে হবে। আমি ব্যবস্থা করে আপনার কাছ থেকে টাকা নিব? স্যার বলুন আমি কি মাছের ব্যবসা করি।

জজ সাহেব বললেন, আপনার কথায় যুক্তি আছে। করুন ব্যবস্থা। ভালো কথা, গভর্নর সাহেবের দাওয়াতের চিঠি কি আপনার কাছে দিব?

হাবীব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমার কাছে দেবেন। এই শুক্রবারে ঢাকায় যাচ্ছি। চিঠি হাতে হাতে পৌঁছে দিব।

 

মাগরেবের নামাজ শেষ হয়েছে। হাজেরা বিবি নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। এখন সেজদার জন্যে মাথা নিচু করলে সেই মাথা খাড়া করতে কষ্ট হয়। আমেনা বলে এক তরুণীকে রাখা হয়েছে, সে হাজেরা বিবির হয়ে নামাজ পড়ে। নিজের জন্যে পড়ে না। মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছ থেকে ফতোয় আনা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় এটা সম্ভব। বদলি-হজের মতো বদলি-নামাজ। বদলি-হজ যে করে সে হজের সোয়াব পায় না, যার জন্যে হজ করা হয় তিনি সোয়াব পান। বদলি-নামাজেও একই ব্যাপার। নামাজি সোয়াব পায় না, যার জন্যে নামাজ পড়া হচ্ছে তিনি সোয়াব পান।

আমেনাকে বলা হয়েছে তাকে বদলি-হজে পাঠানো হবে। হাজেরা বিবির হয়ে বদলি-হজ করে আসবে। আমেনা অতি আনন্দে আছে। সে অন্দরমহলেও বোরকা পরে। চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। তাকে সময়ে অসময়ে নামাজ পড়তে দেখা যায়। যখন নামাজ পড়ে না, তখন তার হাতে লম্বা তসবি ঘুরে। এই তসবি দুই হাতে ধরে রাখতে হয়। সে দাসীমহলে কিছু গল্প চালুর চেষ্টা চালাচ্ছে। একটি গল্প জ্বিন নিয়ে। তার বাবার একটা পালা জ্বিন ছিল। জ্বিনটা তাকে বিয়ে করার জন্যে পাগল ছিল। জ্বিনের কাণ্ডকারখানায় বিরক্ত হয়ে আমেনার বাবা জ্বিনকে আজাদ করে দেন। তবে সেই জিন এখনো আশা ছাড়ে নাই। এখনো বছরে একবার শীতের সময় আসে। আমেনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।

লাইলী তাঁর নতুন দাসীকে তার শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। নতুন কেউ বাড়িতে দাখিল হওয়ার পর তিনি প্রথম পনেরো দিন তাকে দেখেন। তারপর একদিন ডেকে পাঠান। সেইদিন ঠিক হয় নতুন দাসী চাকরি করতে পারবে নাকি তাকে চলে যেতে হবে।

আমেনা ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলে ঘরে ঢুকল। তার হাতে যথারীতি লম্বা তসবি।

লাইলী বললেন, এক জ্বিন তোমার প্রেমে দেওয়ানা হয়েছে বলে শুনতে পাই। ঘটনা কি সত্য?

জি আম্মা।

সে একাই দেওয়ানা হয়েছে, না-কি তুমিও দেওয়ানা?

সে একাই দেওয়ানা। আমি কোন দুঃখে জ্বিন বিবাহ করব! জ্বিন-মানুষের বিয়ায় সন্তানাদি হয় না।

লাইলী বললেন, বিয়ে হলে সন্তান হবে না কেন? সন্তান অর্ধেক হবে মানুষ, অর্ধেক জ্বিন।

আমেনা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। এই মহিলাকে সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। অতিরিক্ত শান্ত চোখমুখ। ঠোটে হাসির আভাস। কিন্তু কথা বলার সময় মহিলার চোখ তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। কপালে ভাঁজ পড়ে।

লাইলী বললেন, এত বড় তসবি কি জ্বিন তোমারে এনে দিয়েছে?

জি। আপনি ঠিক ধরেছেন আম্মা।

লাইলী শান্তগলায় বললেন, ফাইজলামি গল্প আমার সাথে করবা না। এই মালা জন্মাষ্টমির মেলায় কিনতে পাওয়া যায়। সাধু সন্নাসীরা এই রুদ্রাক্ষের মালা গলায় পেচায়া রাখেন। এখন বুঝেছ?

আমেনা চুপ করে রইল।

সারা দিন নামাজ কালাম পড়ো, তসবি টানো, ঘটনা কী?

জ্বিনের যন্ত্রণায় এই কাজ করতে হয়। দোয়া কালামের উপরে থাকতে হয়।

লাইলী বললেন, ঘটনা তা-না। তুমি কাজকর্মের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই ভাব ধরেছ। আজ তার শেষ। তুমি নামাজের সময় নামাজ পড়বা। অন্য সময় কাজকর্ম করবা। বোরকা খোলো।

আমেনা বোরকা খুলল। লাইলী ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুমি সুন্দরী মেয়ে। গরিবের ঘরে রূপ নিয়া আসছ। মানুষের কাছ থেকে সাবধান থাকবা। জিনের হাত থেকে সাবধান থাকার প্রয়োজন নাই। নাদিয়ার বাবার সামনে কখনো পড়বা না। তুমি অন্দরমহলের দাসী। অন্দরমহলে থাকবা।

জি আম্মা।

এখন সামনে থেকে বিদায় হও। রুদ্রাক্ষের এই মালা যেন আর কোনোদিন দেখি 1 মাল আমার খাটে রাখে।

আমেনা খাটে মালা রেখে দৌড়ে বের হতে গিয়ে চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। অন্য দাসীরা ছুটে এসে ধরাধরি করে তাকে কুয়াতলায় নিয়ে গেল। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেওয়ার পর সে চোখ মেলে অস্পষ্ট গলায় বলল, জ্বিন থাপ্পড় মারছে।

লাইলী নিজের মনেই বললেন, এই মেয়েকে রাখা যাবে না। সে অনেক যন্ত্রণা করবে। আজ যন্ত্রণার শুরু।

 

হাবীব বসেছেন চেম্বারে। তার সামনে জড়সড় হয়ে বসে আছে সফুরা। সফুরার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাবীব বলল, ভালো আছ?

সফুরা হা-সূচক মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না।

হাবীব বললেন, হারুন উকিলকে ক্ষিতিশ বাবুর কথা তুমি বলেছ?

সফুরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার হা-সূচক মাথা নাড়ল।

হাবীব বললেন, একটা কথা আছে–নারীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। এটা মনে রাখবা। শাপা অরণে আসে না। বুঝেছ?

জি।

কে না-কি ভোষর হাত দেখে বলেছে তোমার স্বামীর ফাঁসি হবে। ঘটনা কি সতা?

জি।

ভালো গণকের সন্ধান পেয়েছ। স্ত্রীর হাত দেখে স্বামীর ভাগ্য বলে দেয়। সহজ কাজ না, কঠিন কাজ। গণকের নাম কী?

সফুরা স্পষ্ট গলায় বলল, নাদিয়া আম্মা হাত দেখে বলেছেন।

ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে হাবীব বললেন, নাদিয়া হাত দেখাও শিখেছে। ভালো তো। তারে বলব সে যেন আমার হাত দেখে তার মার ভাগ্য বলে দেয়। আচ্ছা ঠিক আছে, এখন তুমি সামনে থেকে যাও। কথা যা বলেছি মনে রাখবা। তোমার স্বামীর মামলা মোকদ্দমার বিষয় আমি দেখছি। তোমার পরামর্শের প্রয়োজন নাই।

জি আচ্ছা।

সন্তান কবে নাগাদ হবে?

জানুয়ারি মাসে।

যে-কোনো সমস্যায় প্রণব বাবুকে বলবা।

জি আচ্ছা।

প্রণবকে আমার কাছে পাঠাও।

সফুরা উঠে দাঁড়াল। হাবীবকে কদমবুসি করে ঘর থেকে বের হলো। আশ্চর্যের কথা, ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সেও দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল। প্রণব কাছেই ছিল, ছুটে এসে সফুরাকে টেনে তুলল। বিরক্ত গলায় বলল, তুমি ভরা মাসের পোয়াতি। সাবধানে চলাফেরা কর না? ব্যথা পেয়েছ?

জি-না।

যাও ঘরে গিয়া শুয়ে থাকো। নড়াচড়া করবা না।

প্রণব এসে হাবীরের সামনে রাখা চেয়ারে বসল। হাবীব বললেন, নাদিয়াকে একটা খবর দাও তো। সে আছে কোথায়?

দিঘির ঘাটে বসেছে।

এত রাতে দিঘির ঘাটে কী?

জোছনা দেখে। ভয়ের কিছু নাই। পাহারাদার রেখে দিয়েছি। ভাদু আড়ালে বসে পাহারা দিতেছে। নাদিয়া আম্মার সাথে হোসনা মেয়েটাও আছে। আপনাকে একটা খবর দিতে ভুলে গেছি।

এখন দাও।

আপনি রোকেয়া হলের দু’টা মেয়ের ব্যাপারে সন্ধান নিতে বলেছেন। সন্ধান নিয়েছি। আগেই সন্ধান পেয়েছিলাম। বলতে ভুলে গেছি। আজকাল কিছু মনে থাকে না। বানপ্রস্থের সময় হয়ে গেছে।

হাবীব বিরক্ত গলায় বললেন, ফালতু কথা না বলে মূল কথা বলো। সন্ধানে কী পেয়েছ?

তিনশ’ এগারো নম্বরে যে মেয়ে দুটা থাকে তাদের একজনের নাম বকুল বালা। সে কেমিস্ট্রির ছাত্রী। অন্যজনের নাম শেফালী, তার সাবজেক্ট পলিটিক্যাল সায়েন্স। শেফালী মেয়েটার বিবাহ ঠিক হয়েছে। ছেলে ডাক্তার। এই দুই মেয়ের বাড়ির ঠিকানাও নিয়ে এসেছি। ঠিকানা বলব স্যার?

না। আর কিছু লাগবে না।

হাবীব দিঘির ঘাটের দিকে রওনা হলেন। নাদিয়াকে দেখা যাচ্ছে। কেমন হতাশ ভঙ্গিতে বসে আছে। নাদিয়ার সামনে হোসনী। তার শরীর যথারীতি চাদর দিয়ে ঢাকা। সে মাথা নিচু করে আছে।

ঘাটের সিঁড়ির পেছনে ঘাপটি মেরে বসে আছে ভাদু। ভাদু তাকিয়ে আছে। নাদিয়ার পায়ের দিকে। শাড়ি সামান্য উঠে থাকার কারণে ডান পাটার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। তার ভাগ্য ভালো হলে পা নড়াচড়ার সময় শাড়ি হয়তো আরও উপরে উঠবে। ভাদুর কাছে মেয়েছেলের আসল সৌন্দর্য পায়ে। এই মেয়ের পা সুন্দর আছে। ভাদু চোখ বন্ধ করল। নিজেকে সামলানোর জন্যে কাজটা করল। ইশ এমন যদি হতো মেয়েটা একা। আশেপাশে কেউ নেই। আচমকা তার মুখ চেপে ধরলে সে শব্দ করতে পারবে না। মুখ চেপে কার্য সমাধা করে কিছুক্ষণ গলা চেপে ধরে থাকা, তারপর পালিয়ে যাওয়া। ভাদু ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে।

হাবীব মেয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে কোমল গলায় ডাকলেন, নাদিয়া।

জি বাবা!

অন্ধকারে বসে আছিস কেন?

নাদিয়া বলল, অন্ধকার কোথায়! চাঁদের আলো আছে।

হাবীব মেয়ের পাশে বসে মনে মনে একটি অতি জরুরি চিঠির মুসাবিদা করা শুরু করলেন। চিঠিটা লেখা হবে হাসন রাজা চৌধুরীর বাবা রহমত রাজা চৌধুরীকে।

রহমত রাজা চৌধুরী

জনাব,

আসসালাম! একটি জরুরি বিষয় জানাইবার জন্যে আমি আপনাকে পত্র দিতেছি। নানান কারণে আপনার পুত্রকে আমার পছন্দ। আমার একমাত্র কন্যা নাদিয়ার সঙ্গে কি তার বিবাহ হইতে পারে? আমি অধিক কথা বলিতে পছন্দ করি না। এই কারণে এক লাইনে মূল কথা বলিলাম।

ইতি
হাবীব খান।

পুনশ্চ : জানুয়ারি মাসের কুড়ি তারিখে আমার সর্ববৃহৎ আকারের একশ’ পাবদা মাছের প্রয়োজন। ডিসট্রিক্ট জজ আবুল কাশেম সাহেবের কন্যার বিবাহে এই মাছ প্রয়োজন।

এই চিঠি এখনই পাঠানোর প্রয়োজন নাই। আগে মামলার রায় হোক। তারপর। নিশ্চিন্ত মনে আগাতে হবে। মামলা চলতে থাকা মানে অস্বস্তি নিয়ে বাস করা। আজ বাটকু হারুন অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষিতিশাকে ভুলা দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। বই লেনদেনের রেকর্ড কোনো কাজের রেকর্ড না। তারপরেও রেকর্ড বই নষ্ট করে ফেলা দরকার। অতি দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে।

হাবীব বললেন, মা যাই।

নাদিয়া বলল, যাও।

হোসনা মেয়েটার জবান ফুটেছে? নাকি এখনো চুপ?

এখনো চুপ, কোনো কথা বলে না বাবা।

কথা না বলাই ভালো। জগতে বড় অনিষ্ট অধিক কথার কারণে হয়।

হাবীব চলে গেলেন। ভাদু জন্তুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে আরেকটু কাছে এগিয়ে এল। এত দূর থেকে ভালোমতো দেখা যায় না। সে খানিকটা চিন্তিত নতুন মেয়েটা সবসময় নাদিয়ার সঙ্গে আছে। দুইজনকে একসঙ্গে কায়দা করা যাবে না। দুইজনের একজন চিৎকার করবেই।

 

দিঘির ঘাটে হোসনা এবং নাদিয়া বসে আছে। তাদের গায়ে চাদের আলো পড়েছে। দিঘির এক কোনায় অনেকগুলি শাপলা ফুল ফুটেছে। এই ফুলগুলি বড় বড়। চাঁদের আলোয় ফুলের প্রতিবিম্ব পড়েছে পানিতে। বাতাসে ফুল কাঁপছে, প্রতিবিম্বও কাপছে। নাদিয়া আঙুল উঁচিয়ে বলল, ওই জায়গায় আমি একবার ভূত দেখেছিলাম।

হোসনা আঙুল লক্ষ করে তাকাল। আর কোনো ভাবান্তর হলো না।

নাদিয়া বলল, মাঝেমাঝে তুমি কেঁপে ওঠো। এর কারণ কী বলো তো।

হোসনা জবাব দিল না।

নাদিয়া বলল, তোমার ঘটনা আমি শুনেছি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে। তোমার মতোই আমি কষ্ট পাচ্ছি। যতবার তোমাকে দেখি ততবার কষ্ট পাই। আমি তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাব। সাইকিয়াস্ট্রিস্ট দিয়ে তোমার চিকিৎসা করাব। I Promise.

নাদিয়া বলল, তুমি একটু কাছে আসো। আমি তোমার পিঠে হাত রেখে কথা বলি।

হোসনা নড়ল না। যেখানে বসে ছিল, সেখানেই বসে রইল। নাদিয়া বলল, তোমার হোসনা নামটা আমার পছন্দ না। আমি তোমার একটা নতুন নাম দিলাম, পদ্ম! এই নামটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?

পদ্ম হঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

নাদিয়া বলল, প্রণব কাকার কাছে শুনেছি তুমি সুন্দর গান করতে। একটা গান কি আমাকে শোনাবে?

পদ্ম স্পষ্ট গলায় বলল, না।

মানুষ যখন কাদে তখন চোখের জলের সঙ্গে কষ্ট বের হয়ে আসে। আবার যখন মানুষ গান গায়, তখন সুরের সঙ্গে কিছু কষ্ট বের হয়। লক্ষ্মী পদ্ম, আমাকে একটা গান শোনাও। কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে দেখো! এমন সুন্দর জোছনায় বনে যেতে ইচ্ছা করে। আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। এই গানটা কি জানো?

পদ্ম হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

গাইবে।

পদ্ম না-সূচক মাথা নাড়ল।

আকাশের চাঁদ তার আলো ফেলে যেতে থাকল। মানুষের আবেগের সঙ্গে এই আলোর কোনো সম্পর্ক নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *