১৫. কাহিনি (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

১৫. কাহিনি (অপারেশন ওয়ারিস্তান)

শেয়ালদা স্টেশান থেকে এন্টালি। ২ অক্টোবর।

সাড়ে বারোটা থেকে একটা।

‘গাঁধীজির জন্মদিনে মারামারি করতে হবে?’ ফিসফিস করে বলল প্রথমা।

সিন্টু বলল, ‘গায়ের জোরে এদের সঙ্গে পারা যাবে না। হাওড়া স্টেশনে একটা দামড়া ছেলে আমার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে আসত। তাকে বান্ডিল করে দিয়েছি হেড অফিস খাটিয়ে।’

‘হেড অফিস?’ প্রথমা ভুরু কুঁচকোয়।

সিন্টু তর্জনি দিয়ে প্রথমার মাথায় খোঁচা দিয়ে বলে, ‘হেডে বেরেন নেই নাকি? এই নাও।’

‘কী দিলি? বেরেন?’ হাত পেতে প্রথমা একটা কাগজের পুঁটলি নেয়।

‘গোলমরিচ আর লঙ্কাগুঁড়ো মেশানো আছে। ওদের কাছাকাছি গিয়ে ডায়রেক্ট মুখ লক্ষ্য করে চার্জ করবে। মায়াদয়া করলে হবে না কিন্তু।’

বাসে যখন এই কথাবার্তা চলছে, তখন বাসের কনডাক্টর বালাজির সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করছে। ‘কোনও আক্কেল নেই নাকি মশায়? এইখেনে গাড়ি রেকেচেন? এটা কি আপনার পার্কিং লট? পুঁচকে গাড়ি নিয়ে বারফট্টাই করতে লজ্জা করে না?’

বালাজি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কন্ডাক্টরের কথা শুনছে না।

কন্ডাক্টর চ্যাঁচল, ‘দাদাগিরি ফলানো হচ্ছে? ও জমানা শেষ। দাঁড়ান, পুলিশ ডাকছি। অ্যাই পুলিশ, পুলিশ!’

সিন্টুও জানলা দিয়ে মাথা গলিয়ে মড়াকান্না জুড়ল, ‘মেরে ফেলল। বাঁচাও! দশ-নয়-আটে ফোন করো।’

‘দশ-নয়-আট আবার কী?’ সিন্টুকে প্রশ্ন করে প্রথমা। পুঁটলি হাতে নেওয়ার পর থেকে তার হাত চুলকোচ্ছে। কাগজে মোড়া অবস্থায় এত ঝাঁঝালো হলে, চোখে নাকে পড়লে না জানি কী হবে!

‘ওটা সিসু নিযযাতনের টোল ফিরি লম্বর। দেয়ালে লেখা থাকে। দেখোনি? ও, তুমি তো আবার পাঁচ বছর ধরে ঘুমোচ্ছিলে। এসব জানো না।’ প্রথমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সিন্টু আবার চিৎকার শুরু করেছে। ‘মেরে ফেল্লো! বাঁচাও!’

চিৎকারে কাজ হচ্ছে। পুলিশ না এলেও সিড়িঙ্গে এক হোমগার্ড এসে বালাজিকে কী একটা বলছে। হকার, সবজিউলি, বেকার, পাতাখোর, অন্য স্টেটবাসের ড্রাইভার আর কনডাক্টররা এসে গেছে। প্রথমা নিশ্চিন্ত হল। এত লোকের মধ্যে বালাজি তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।

পিছন ফিরে প্রথমা দেখল, গণেশ দুটো সিটের ফাঁকে, বাসের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে। চিবুক উঁচু, দু’হাত সামনে। হাতে ধরা কৌটোর মতো একটা জিনিস। প্রথমা বলল, ‘এটা কী?’

উত্তর না দিয়ে কারগোর পকেট থেকে একই রকম দেখতে একটা লম্বাটে, ধাতব পাত্র বার করে প্রথমার দিকে এগিয়ে দিল গণেশ। ডিয়োডোর্যান্ট যেরকম ক্যানিস্টারে পাওয়া যায়, এটা সেইরকম পাত্র। ওপরে স্প্রে করার মতো মুন্ডু লাগানো। ঢাকনা খুলে গন্ধ শুকতে যাচ্ছিল প্রথমা। গণেশ বলল, ‘পাগল হয়েছিস? এটা পিপার স্প্রে। বালাজি আর বুনোর কাছাকাছি পৌঁছে মুখ লক্ষ্য করে স্প্রে করে দিবি। আধ ঘণ্টা উঠতে পারবে না।’

একহাতে গোলমরিচের গুঁড়োর প্যাকেট, অন্য হাতে মরিচের স্প্রে। কনফিডেন্টলি সিট থেকে প্রথমা উঠে দাঁড়াল।

গুড়ুম!!

বিকট শব্দ করে আকাশের দিকে ফায়ারিং করল বালাজি। মুহূর্তের মধ্যে চারদিক খালি। হকার, সবজিউলি, বেকার পাতাখোর, অন্য স্টেটবাসের ড্রাইভার আর কনডাক্টর দৌড়ে পালিয়ে গেল। এই বাসের ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরও ড্রাইভারের পাশের দরজা খুলে একলাফে পালাল। প্রথমা খেয়াল করল, তাদের সঙ্গে পালাল সিন্টুও। চারদিক এখন শুনশান।

বুনো বাসে উঠে এসে প্রথমার চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। সেই টানে বুনোর কোলে গিয়ে পড়ল প্রথমা। সিন্টুর দেওয়া পুঁটলিটা খোলার সময় নেই। নিজের চোখ-মুখ বন্ধ রেখে আন্দাজে বুনোর মুখে পুঁটলিটা ঘষে দিল।

ফল হল ম্যাজিকের মতো। জান্তব চিৎকার করে বুনো বাসের মধ্যে গড়াগড়ি খেতে লাগল। ড্রাইভারের পাশের দরজা খোলা। সেদিকে দৌড় দেয় প্রথমা। স্টিয়ারিং আর বসার আসনের মাঝখান দিয়ে গলে যেতে হবে। লাট্টু গিয়ার টপকে আসনে পা রাখে। এবার একটা লাফ! তারপরেই মুক্তি!

আবার প্রথমার চুলের মুঠি ধরেছে কেউ। অসম্ভব জোরে টানল। দুটো হাত পিছমোড়া করে বালাজি বলল, ‘পালাবার চেষ্টা করিস না।’

বাস ড্রাইভারের আসন থেকে চ্যাংদোলা করে প্রথমাকে সামনে নিয়ে এল বালাজি। এখন প্রথমার দু’হাত পিছমোড়া অবস্থায় বালাজির বাঁ-হাতে বন্দি। প্রথমাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে বালাজি। একটা পিস্তল ডান হাতে ধরে রয়েছে। টার্গেট গণেশ। দু’সারি বসবার আসনের মাঝখানে অসহায়ের মতো শুয়ে রয়েছে গণেশ। হাতে পিপার স্প্রে-র ক্যানিস্টার। প্রথমার জন্য ব্যবহার করতে পারছে না।

প্রথমা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বসে পড়তে চাইছে। হাতে লাগছে, কাঁধে লাগছে, তা-ও সে চেষ্টা চালায়। মাথা নীচের দিকে ঝুঁকিয়ে গণেশদার সুবিধে করে দেয়। চোখ বন্ধ করে ফেলে।

হিশশশ করে একটা শব্দ। বালাজির দিকে তাক করে গণেশ পিপার ক্যানিস্টার স্প্রে করেছে। প্রথমার ঘাড়ে মরিচগুঁড়ো লেগে ঘাড় জ্বালা করছে। বালাজিরও মুখে লেগেছে মরিচগুঁড়ো। সে প্রথমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। এই ছোট্ট সময়টুকুই প্রথমার প্রয়োজন ছিল। নিজের পিপার স্প্রে-র ক্যানিস্টারের নজল টিপে পুরোটা সে খালি করে দিল বালাজির মুখের ওপরে। হাওড়ায় ট্রেনের কামরায় বালাজির হাতে কামড়ে দিয়েছিল সে। স্প্রের শেষটুকু ওইখানে ঢালল। ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’ বলে বাংলায় একটা কথা আছে না?

বালাজি আর বুনো বাসের মেঝেয় শুয়ে জন্তুর মতো চ্যাঁচাচ্ছে। এক পাশে ছিটকে গেছে পিস্তল। গণেশ তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়। পড়ে থাকা পিস্তল হাতে নিয়ে ড্রাইভারের পাশের জানলা দিয়ে একলাফে বাস থেকে নামে। সঙ্গে প্রথমা। এখনও একটা গুণ্ডা বাকি আছে। লাল হ্যাচব্যাকের ড্রাইভার।

হ্যাচব্যাকের সামনে পৌঁছে গণেশ আর প্রথমা অবাক। বেঁটেখাটো লোকটা রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে, দু’হাত দিয়ে চোখ ঘষছে আর পাশে দাঁড়িয়ে সিন্টু মজা দেখছে। গণেশকে দেখে বলল, ‘এই গাড়িটায় করেই পালাই। চলো।’

গণেশ চারিদিক দেখল। শেয়ালদা চত্বর অন্যদিনের তুলনায় ফাঁকা। যে কয়েকজন ছিল, গুলির আওয়াজ শুনে ভেগেছে। শেয়ালদা কোর্টের পাশ দিয়ে, সাবওয়ের পাশ দিয়ে, অটোর আড়াল থেকে, রেল হাসপাতালের গেটের কোণ থেকে কয়েকজন তাদের নজরে রাখলেও কেউ এগিয়ে আসছে না। এই মওকায় গাড়ি নিয়ে কেটে পড়লে খারাপ হয় না।

গণেশ একলাফে স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে বসল। প্রথমা বসল পিছনের সিটে। সিন্টুও প্রথমাকে গুঁতিয়ে পিছনের সিটে উঠে পড়েছে। ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল গণেশ। ক্লাচে পা দিয়ে ফার্স্ট গিয়ার চাপল। স্টেট বাস পেরিয়ে সেকেন্ড গিয়ার দিল। লোকজন আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। গাড়ির স্পিড বাড়ছে। পনেরো, কুড়ি, পঁচিশ…

টলতে টলতে বালাজি বাস থেকে নামছে। মোজার ভিতর থেকে বার করছে আরও একটা রিভলভার। বাঁ-হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে লক্ষ্য স্থির করছে। রেল হাসপাতালের সামনের রাস্তায় অল্প কিছু লোকের জটলা। থার্ড গিয়ারে যায় গণেশ। গাড়ির স্পিড বাড়ায়। তিরিশ, পঁয়ত্রিশ, চল্লিশ। ফোর্থ গিয়ার। পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ, পঞ্চান্ন…লোকগুলো সরবে না, না কি? তাহলে কি গণেশকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে?

গুড়ুম!! গুড়ুম!!

আবার গুলির শব্দ! গাড়ির কাচে গুলি লাগার ভোঁতা ‘ধপ’ শব্দ হল। কিন্তু কাচ ভাঙল না। গণেশদা চিৎকার করে উঠল, ‘শুয়ে পড়! শুয়ে পড়!’ সঙ্গে সঙ্গে কান ফাটানো শব্দ করে গাড়ির টায়ার বার্স্ট করল। গাড়িটা কোণাকুণি গিয়ে রেল হাসপাতালের সামনের ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মারল। গণেশ সিটবেল্ট বেঁধে নিয়েছিল। তা সত্বেও তার মাথা স্টিয়ারিঙে ঠুকে গেল। প্রথমা আর সিন্টু সিটবেল্ট বাঁধেনি। তারা পিছনের সিটের লেগস্পেসে মুখ থুবড়ে পড়ল।

রিভার্স গিয়ারে গণেশ গাড়ি ব্যাক করছে। সিটে উঠে বসে নীচু হয়ে পিছন দিকে তাকাল প্রথমা। রাস্তাঘাট আবার শুনশান। স্টেট আর প্রাইভেট বাস, ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার, তিনচাকার ভ্যান আর দু’চাকার রিকশা নাটকের প্রপের মতো এখানে ওখানে পড়ে রয়েছে। আর তার মধ্যে দিয়ে বালাজি দৌড়তে দৌড়তে আসছে! বাঁহাতে ভর দিয়ে ডিভাইডারের রেলিং টপকাল। ডান হাতের আগ্নেয়াস্ত্র আবার তাক করেছে গাড়ির টায়ারের দিকে। বুনোও চোখ কচলাতে কচলাতে এদিকেই আসছে।

পাংচার টায়ার নিয়েই গণেশ অ্যাকসিলারেটারে পা দাবিয়েছে। ফেটে যাওয়া টায়ারের ফ্যাটফ্যাট আওয়াজ, টায়ারের রিমের সঙ্গে রাস্তার সংঘর্ষের ঢনঢন শব্দ, হর্নের ট্যাঁ ট্যাঁ আওয়াজে প্রথমা আর সিন্টুর কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। রেল হাসপাতালের সামনের রাস্তা পেরিয়ে ডানদিকে বেঁকে ফ্লাইওভার উঠল গণেশ। রাস্তা ফাঁকা। ট্রাফিক সিগন্যালে একজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে। সিগন্যাল লাল।

গণেশ গাড়ি নিয়ে কনস্টেবলের দিকে ধেয়ে যায়। লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে একলাফে দু’পা পিছিয়ে, গালাগাল দিয়ে বলে, ‘দাঁড়া বলছি!’

না দাঁড়িয়ে গণেশ বাঁ-দিকে ঘোরে। ফ্লাইওভার বরাবর নেমে মৌলালির দিকে এগোয়। রাস্তা ফাঁকা। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, মৌলালির সিগন্যাল সবুজ।

প্রথমা এতক্ষণে একটু ধাতস্থ হয়েছে। সে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘কনস্টেবলটাকে ঘাবড়ে দিলে কেন? ও গাড়ির নম্বর নিয়ে এক্ষুনি রিপোর্ট করবে।’

‘ওই জন্যেই তো…’ গাড়ি চালাতে চালাতে বলে গণেশ। ‘এই গাড়ি করে বেশি দূর যাবার উপায় নেই। নেমে যাওয়ার আগে পুরো কলকাতা শহরকে জানিয়ে যাচ্ছি যে গাড়িটা সন্দেহজনক। এই গাড়ির কাচ বুলেটপ্রুফ, এটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস। তা না হলে প্রথম বুলেটটা আমাদের কাউকে ফুঁড়ে দিত।’

কাচে হাত বুলিয়ে সিন্টু বলে, ‘কাচে আঁচড়ও লাগেনি।’

‘তাহলেই বোঝ। একটা পুরনো গাড়িকে এই রকম হাই-টেক রিমডেলিং করার পিছনে বড় বড় মাথা আছে। পুলিশ তদন্ত করে দেখুক এর মালিক কে।’

পিপার স্প্রের এফেক্ট কমছে। প্রথমা ঘাড় চুলকানো থামিয়ে বলে, ‘পুলিশ কিছু পাবে বলে মনে হয় না।’

‘আমারও তাই মনে হয়। যদি পায়ও, তার সঙ্গে মেঘনাদ লাহিড়িকে অ্যাসোসিয়েট করতে পারবে না।’

মৌলালির ক্রসিং পেরিয়ে গেল গাড়ি। চৌমাথার লোকে অবাক হয়ে দেখল, ফ্যাটাস ফ্যাটাস আওয়াজ করে, পাংচার হয়ে যাওয়া টায়ার নিয়ে একটা লাল গাড়ি খোঁড়াতে খোঁড়াতে এন্টালির দিকে এগোচ্ছে। মৌলালির ট্রাফিক সার্জেন্ট হাত দেখিয়ে দাঁড়াতে বলল। গণেশ দাঁড়াল না।

‘এতক্ষণে তোমার উদ্দেশ্য সফল হল।’ জানলা দিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে বলে প্রথমা, ‘সার্জেন্ট ওয়াকিটকি বার করেছে। পরের সিগন্যাল আসার আগে আমাদের নেমে যেতে হবে। তা না হলে সবাইকে পুলিশে ধরবে।’

‘খারাপ বলিসনি।’ জেম সিনেমার সামনে গাড়ি পার্ক করে বলে গণেশ। ‘বালাজির থেকে নেওয়া পিস্তল গাড়িতেই থাক। তাহলে খেলা আরও জমবে। সামনের সিটে একটা ন্যাপস্যাক রয়েছে। ওটাও থাক।’

‘ওরা যদি ট্যাক্সি ধরে এখানে চলে আসে? ভিতু গলায় বলে প্রথমা।

‘অন্য টায়ারগুলোর হাওয়া বার করে দিচ্ছি। এই গাড়িকে চালানোর উপযোগী করতে অন্তত একদিন সময় লাগবে।’ গাড়ি থেকে নেমে চাকার হাওয়া খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে গণেশ।

সিন্টু এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। হঠাৎ বলল, ‘ওই লোকগুলো জানল কী করে যে আমরা শেয়ালদা কোর্টের কাছে স্টেট বাসে আছি?’

গণেশ সামনের চাকার হাওয়া বার করার কাজ শেষ করে পিছনের চাকায় হাত দিয়ে বলল, ‘আমিও এটা ভাবছিলাম। প্রথমা, তুই আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলি জিপিএস কেমন দেখতে হয়। কেন জিজ্ঞাসা করেছিলি?’

প্রথমা মাথা নীচু করে ডানহাত গণেশের দিকে এগিয়ে দিল। কামিজের হাতার আড়াল থেকে ঝিলমিল করে উঠল বালা।’

‘মাই গড! মাইক্রোচিপ বসানো ব্যাঙ্গল। লেখা রয়েছে, ”প্রথমা, রি-লাইফ।” এটার কথা তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন?’ হতাশ হয়ে কপাল চাপড়ায় গণেশ। ‘এটাই তো জিপিএস! এটা পরে পালিয়ে বেড়ানোর কোনও মানে হয়? মেঘনাদ ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছে তুই কোথায়।’

‘আমি ভেবেছিলাম এটা দামি কিছু হবে। তাই তোমাকে বলিনি।’ অপরাধীর মতো মুখ করে বালা খুলে ফেলে প্রথমা। গণেশের হাতে দিয়ে বলে, ‘কী করছ?’

বালাজির পিস্তলের কার্তুজ বের করে, পিস্তল গাড়িতে রেখে গণেশ বলল, ‘এটা পুলিশের হাতে পড়লে তারা হাতিয়ারের মালিকের খোঁজ করবে। আর বালাজির হাতে পড়লে সে যাতে গুলি চালাতে না পারে, তার জন্য কার্তুজ বার করে নিলাম।’

‘আর এই জিপিএস?’ জানতে চায় প্রথমা। গণেশ উত্তর না দিয়ে একটা ট্যাক্সিকে দেখে হাঁক পাড়ে, ‘এই ট্যাক্সি, হেস্টিংস যাবে?

‘যাব।’ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায় ট্যাক্সি।

ট্যাক্সির জানলা দিয়ে মুখ গলায় গণেশ, ‘কত নেবে?’

‘মিটারে যা উঠবে তার থেকে পঞ্চাশ টাকা এক্সট্রা।’

‘মিটারে যা উঠবে তাই দেব।’

‘পারব না।’ গণেশের মুখের ওপরে ধোঁয়া ছেড়ে ট্যাক্সি চলে যায়।

সিন্টু আর প্রথমা পানওয়ালার কাছে গিয়েছে। সিন্টু জিজ্ঞাসা করল, ‘লেবু লজেন আছে?’

পান চিবোতে চিবোতে দোকানদার বলল, ‘আছে।’

প্রথমা বলল, ‘এক প্যাকেটের কত দাম?’

‘আট টাকা।’

‘ও পমদি, নিয়ো না। আমাদের হাওড়া স্টেশনে এর দাম পাঁচ টাকা।’ আর্তনাদ করে ওঠে সিন্টু।

প্রথমা বলে, ‘ষাঁড়ের মতো চ্যাচাস না।’ এক প্যাকেট লজেন্স কিনে সিন্টুর হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দু’টাকা ফেরত নিয়ে গণেশের দিকে ফেরে। গণেশ আর একটা ট্যাক্সি পাকড়ে ড্রাইভারকে বলছে, ‘অ্যাই ট্যাক্সি, হেস্টিংস যাবে?’

‘যাব।’

‘কত নেবে?’

‘মিটারে যা উঠবে তার থেকে দশ টাকা বেশি লাগবে।’

‘গুড। তোরা ওঠ। সিন্টু আর প্রথমাকে পিছনের সিটে তুলে নিজে সামনের সিটে বসে গণেশ। ট্যাক্সির জানলা দিয়ে পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে হুটারের ওঁয়াও ওঁয়াও আওয়াজ করতে করতে পুলিশের জিপ আর কয়েকটা এনফিল্ড বুলেট লাল হ্যাচব্যাককে ঘিরে ফেলেছে। প্রথমা ভাবল, এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি পালানো যায় ততই মঙ্গল।

কিন্তু এখান থেকে পালিয়ে কোথায় যাবে সে? পাঁচবছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা একটা মেয়ে কোথায় যেতে পারে? হয় বালাজি তাকে ধরবে। তারপর পাচার করে দেবে কোথাও। সেখানে তার হার্ট, কিডনি, লিভার পিস পিস করে কেটে নিয়ে খোবলানো শরীর ফেলে দেওয়া হবে। আর যদি ওদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারে, তাহলে আশ্রয় ও পরিচয়হীন হয়ে জীবন কাটাতে হবে।

একজন মানুষের প্রধান সম্বল তার পরিচয়, তার ঠিকানা, তার আপনজন। প্রথমার কোনও পরিচয় নেই, কোনও ঠিকানা নেই, কোনও আপনজন নেই। বাকি জীবনটা সে কী নিয়ে বাঁচবে? কেনই বা বাঁচবে?

ট্যাক্সিতে বসে বেকবাগানের দিকে যেতে যেতে দু’হাটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে প্রথমা।

১৬

রাষ্ট্রপতি ভবন। গেট নম্বর পঁয়ত্রিশ। প্রকাশ বীর শাস্ত্রী অ্যাভিনিউ, নতুন দিল্লি, ভারতবর্ষ। দুপুর পৌনে দুটো।

.

‘আমাদের এই মিটিং এখানেই শেষ হল। আপনার আবেদনকে সম্মান জানিয়ে দু’ঘণ্টার ডেডলাইন আমরা গ্রহণ করলাম। দু’ঘণ্টা মানে কিন্তু দু’ঘণ্টাই। তার মধ্যে আপনাদের ফোন না এলে আমরা আমাদের কাজ শুরু করে দেব। ধন্যবাদ।’ বললেন আরুণ। ভাণ্ডারী হাত বাড়িয়ে ফোন অফ করে দিল।

হরভজন অরুণকে বললেন, ‘এক্সেলেন্ট পারফরম্যান্স।’

রাকেশ অবাক হয়ে বলল, ‘পারফরম্যান্স মানে?’

রাকেশের উপস্থিতিকে গুরুত্ব না দিয়ে টেলিফোনের পিছনে বসে থাকা টেকনিক্যাল পারসনকে হরভজন প্রশ্ন করলেন, ‘কী বোঝা গেল?’

‘জিয়া ড্রাঙ্ক। প্লাস ও মিথ্যে কথা বলেছে।’

‘কীভাবে বুঝলেন?’ জানতে চাইছে ইউ কে নায়ার।

‘প্রথমে ও ঠান্ডা মাথায় কথা বলছিল। মাননীয় রাষ্ট্রপতি ইন্টারোগেট করতে ও ঘাবড়ে গিয়েছিল। ভুল যুক্তি প্রয়োগ করে মূল ইস্যু থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল। বিষয়ান্তরে চলে যাওয়া, ভয়েস মডিলেশন, তাড়াতাড়ি কথা বলার প্রবণতা, স্পিচের টেমপো বদলে যাওয়া—এই সবই বলে যে জিয়া লায়ার।’

যশপাল নেগি ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এইসব জেনে একজ্যাক্টলি কী হবে?’

অরুণ বললেন, ‘আপনারা নিজের নিজের বিভাগে ফিরে গিয়ে নির্দেশ জারি করুন যে, ঠিক দু’ঘণ্টার মাথায় আমরা অ্যাটাকে যাচ্ছি। আমি আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই অফিস ছেড়ে নড়ছি না। মিটিঙের জন্য মন্ত্রীদের এখানেই ডেকে নেব। কিন্তু সব হবে দু’ঘণ্টা পরে।’

‘হঠাৎ দু’ঘণ্টা কেন? এখনই নয় কেন?’ জানতে চাইছে অরূপ রাহা।

‘ভেরি অনেস্টলি, উত্তরটা আমার জানা নেই। বলতে পারেন, এটা একটা ক্যালকুলেটেড রিস্ক। আমি আশা করছি যে আগামী দু’ঘণ্টার মধ্যে ওদের আভ্যন্তরীণ সংকট বাড়বে। আমি আশা করছি, আগামী দু’ঘণ্টার মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপের কাছে ওরা নতিস্বীকার করবে। আমি আশা করছি কোনও এক মির‌্যাকলের, যা যুদ্ধকে আটকাবে। গাঁধিজির জন্মদিনে এইটুকু চাওয়ার অধিকার আমার আছে।’

রাকেশ বলল, ‘আই বেগ টু ডিফার উইথ ইয়ু, রেসপেক্টেড প্রেসিডেন্ট…’

রাকেশকে অবাক করে হরভজন বললেন,

.

‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা

হম বুলবুলে হ্যায় ইসকে, ইয়ে গুলসিতা হামারা।’

.

তিন সেনাপ্রধান এক সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে হরভজন ও অরুণের দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে স্যালুট করল। চিৎকার করে বলল, ‘জয় হিন্দ!’ তারপর মার্চ পাস্ট করে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।

রেণুকা মান্ডি অরুণকে বলল, ‘এখন আমার কী কর্তব্য স্যার?’

অরুণ হরভজনের দিকে তাকালেন। হরভজন বললেন, ‘তুমি, মেধা আর রাকেশ সংসদে যাও। ওখানে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমাদের স্পিকার পোড় খাওয়া ভেটেরান। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় থেকে সংসদীয় রাজনীতিতে আছেন। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা ওঁর মতো আর কারো নেই। যাবার আগে কিচেনে বলে যাও, আমাদের দু’কাপ চা দিতে।’

তিন মন্ত্রী একসঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অরুণ গলা নামিয়ে বললেন, ‘মায়ার কোনও খবর নেই।’

‘হুম!’ মাথা নীচু করে বললেন হরভজন।

.

ওয়ারিস্তান রাষ্ট্রের ইস্টার্ন প্রভিন্স। আশিকানা প্রাসাদ।

দুপুর পৌনে দুটো।

.

জিয়াকে গালাগালি দিতে দিতে গ্রিনবার্গ একতলায় নামল। ছ’ফুট লম্বা চার জওয়ান হাসিঠাট্টা করছিল। গ্রিনবার্গকে দেখে রোবটের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আশিকানা প্রাসাদের সৈন্যরা গ্রিনবার্গের পরিচয় না জানলেও এইটুকু জানে যে এই লোকটা এই রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ। প্রধানমন্ত্রীও এর কথায় ওঠে বসে।

একতলা থেকে বেসমেন্টে নামে গ্রিনবার্গ। এখানকার জওয়ানরা নিজের কাজে ব্যস্ত। বেসমেন্টের আন্ডা সেল আশিকানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখানে বন্দি আছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মায়া মল্লিক। আন্ডা সেলের এইরকম নাম হয়েছে তার কারণ এই জেলে একটাই সেল আছে। ডিমে যেমন একটাই মুরগি থাকে, আন্ডা সেলে তেমন একজনই বন্দি থাকে। সব ক্ষেত্রেই তাঁরা ভিআইপি। ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অথবা সেনাপ্রধান। ক্যু’য়ের পরে এটাই তাঁদের বাসস্থান হয়।

দশফুট বাই বারো ফুট ঘরে ভেন্টিলেশানের ব্যবস্থা নেই। একটাই স্টিলের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। এয়ারকন্ডিশান মেশিন চলছে সর্বক্ষণ। তাপমাত্রা এমন অঙ্কে সেট করা যে প্যাচপ্যাচে অনুভূতি হচ্ছে না। সংলগ্ন বাথরুমটি ভদ্রস্থ। স্নান এবং অন্যান্য নিত্যকর্মের জন্য ঠিকঠাক ব্যবস্থা আছে। লোহার খাটে পাতলা তোষক ও চাদর পাতা। মাথার বালিশও আছে। বন্দিদশায় আর কী চাই?

ওয়ারিস্থানে ক্যু হওয়ার সময় মায়া সংসদে ছিল। জিয়া তার মাথায় বন্দুক তাক করে হঠাৎ বলল, ‘ইয়ু আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’

জিয়া যে মিলিটারি হেডকোয়ার্টার দখল করে নিয়েছে, একথা মায়া জানলেন গ্রেফতার হওয়ার পরে। প্রথমে ঠাঁই হয়েছিল মিলিটারি হেডকোয়ার্টারের জেলখানায়। সেখান থেকে এখানে আনা হয়েছে।

জিয়া মায়াকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে আন্ডা সেলের সুব্যবস্থা মায়ার বাবার আমলে হয়েছে। ক্যুদেতার মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও তিনি বিরোধীদের প্রাপ্য মর্যাদা দিতেন।

আন্ডা সেলের খাটে শুয়ে মায়া ভাবছিলেন, তার পরিণতি কী হবে। আন্ডা সেলে সবচেয়ে কম সময়ের জন্য বন্দি ছিলেন মায়ার বাবা। তিনদিন চার ঘণ্টা। সব চেয়ে বেশি ছিলেন ওয়ারিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। পঞ্চান্ন বছর। পঁচিশ বছরে ক্ষমতায় আসেন। এক বছরের মাথায় ক্যু হওয়ার পরে যুদ্ধবন্দি হয়ে এখানে ঢোকেন। আমৃত্যু এখানেই ছিলেন।

এইসব উলটোপালটা চিন্তার মধ্যে দরজা খুলে এক অচেনা মানুষ ঢুকল। মায়া তাড়াতাড়ি উঠে বললেন, ‘আপনি কে?’

ছোট্টখাট্টো, রোগাপাতলা লোকটি মায়ার দিকে সবুজ দৃষ্টি বিছিয়ে বলল, ‘আমার পরিচয় না জানলেও চলবে। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি। আশিকানা প্রাসাদের প্রতিটি গার্ড একটু আগে পর্যন্ত আপনার অধস্তন কর্মচারী ছিল। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত আছে, আছে চাকরি বাঁচানোর দায়। কিন্তু এরা প্রত্যেকে আপনাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। এরা তলায় তলায় ফুটছে। এরা জিয়ার শাসন চাইছে না। সেনারাই চাইছে, আপনি এগিয়ে আসুন। সেনাশাসন গুঁড়িয়ে দিন।’

মায়া আবার বলল, ‘আপনি কে?’

কোনও কথা না বলে আন্ডা সেল থেকে বেরিয়ে গেল গ্রিনবার্গ। মায়া মাথা নীচু করে বসে রইলেন। এ তিনি কী শুনলেন? সেনারা চাইছে যে তিনি জিয়াকে গদিচ্যুত করুন? সে কীভাবে সম্ভব? আন্ডা সেলে পচে পচে তা হওয়ার নয়। উত্তেজিত মায়ার গরম লাগছে। কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে তাঁর মনে হল, গরম কেন লাগবে? আন্ডা সেলে তো সব সময় এসি চলে!

দরজার দিকে তাকান মায়া। অবাক হয়ে দেখেন, দরজা খোলা!

১৭

শেয়ালদা থেকে বেহালা। ২ অক্টোবর।

দুপুর একটা থেকে পৌনে দুটো।

.

রকি চৌধুরী ট্যাক্সিতে বসে চোখ চুলকোচ্ছিল। একটা বাচ্চা ছেলে চোখে লঙ্কাগুঁড়ো ঘষে, গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাবে, এটা এক্সপেক্ট করতে পারেনি। বাপরে! ইন্ডিয়ার বাচ্চাগুলো কী ডেঞ্জারাস! ওয়ারিস্তানে অনেক চাইল্ড সুইসাইড বোম্বার বা চাইল্ড টেররিস্ট আছে। কিন্তু সেগুলো গামবাট। বুদ্ধি নেই। অবশ্য বুদ্ধি থাকলে কি আর সুইসাইড বোম্বার হত?

চোখে মিনারেল ওয়াটারের ঝাপটা দিতে দিতে নিজের অবস্থা অ্যাসেস করল রকি। লাল হ্যাচব্যাক নিয়ে প্রথমা আর দুই সাকরেদ পালিয়েছে। সৌভাগ্যবশত ট্যাবটা রকি হাতছাড়া করেনি। তাহলে সেটার দশাও বালাজির আগ্নেয়াস্ত্রর মতো হত। গাড়ির সঙ্গে গায়েব। রকির ন্যাপস্যাক গায়েব হলেও পাউচটা কোমরে বাঁধা আছে। ভাগ্যিস!

বালাজির সঙ্গে রকির মোলাকাত হয়েছিল হাওড়া ব্রিজের ওপরে। বালাজিকে ফোন করে রকি শুনে নিয়েছিল যে প্রথমা বালাজির হাত ফসকে পালিয়েছে। একটাই সুবিধে, প্রথমার জিপিএস। মেঘনাদ ফোনে বালাজিকে বলেছিল, ‘রেড ডট মহাত্মা গাঁধী রোড বরাবর আস্তে আস্তে হাওড়া থেকে শেয়ালদার দিকে যাচ্ছে। প্রথমা কোনও বাসে আছে।’

‘ট্যাক্সি বা অটো নয় কেন?’

‘এখন রাস্তা ফাঁকা। ট্যাক্সি বা অটো অত আস্তে যাবে না।’ উত্তর দিয়েছিল মেঘনাদ।

বালাজির কাছ থেকে সব শুনে রকি বুঝেছিল, রাস্তা দিয়ে সে এসেছে, সেই রাস্তা দিয়েই মেয়েটা এখন যাচ্ছে। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে রকি বিট্টুকে বলেছিল, ব্রিজের হাওড়া প্রান্তে দাঁড়াতে। বিট্টু বেআইনি ভাবে ব্রিজের ওপরে ইউ টার্ন করেছিল। অন্যদিন হলে পুলিশ ক্যাঁক করে ধরত। কিন্তু আজ পুলিশ নেই। যানবাহন কম। সময় যত গড়াচ্ছে, রাস্তায় লোক কমছে।

রকি গাড়ির মধ্যে চুপচাপ বসেছিল। হতে পারে এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি, হতে পারে ইন্ডিয়া জুড়ে নৈরাজ্য ক্রমশ বাড়বে, কিন্তু রকি কখনওই ভুলছে না যে এটা ইন্ডিয়া। শত্রুপক্ষের দেশ। এই দেশে সে ঢুকেছে জাল পাসপোর্ট দিয়ে। এই অবস্থায় যত কম লোকে তাকে দেখে, ততই মঙ্গল।

বালাজি এল এসইউভি বা স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকলে। গাড়ি দেখেই অপছন্দ হল রকির। গাবদা এসইউভির সামনে পিছনে ডাক্তারি ছাপ মারা। এই গাড়িতে ওঠা যাবে না। একবার ধরা পড়ে গেলে দুই আর দুইয়ে চার করতে কোনও অসুবিধে হবে না।

বালাজির সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ সেরে রকি বুঝতে পারে, এ তার সম্পর্কে কিছু জানে না। তবে এককথায় রকিকে নেতা বলে মেনে নিল। রকির নির্দেশে এসইউভি ফেরত পাঠিয়ে দিল। ড্রাইভারের আসনে হুমদো একটা লোক বসেছিল। সে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। বিট্টুকেও ছেড়ে দিল রকি। একে আর সঙ্গে রাখা ঠিক হবে না। বিট্টু টুক করে হাওয়া হয়ে গেল। যেমন হাওয়া হয়ে গিয়েছিল দিপু। ইন্ডিয়ান নাগরিক হিসেবে ওয়ারিস্তানের হয়ে খুচখাচ কাজ করে দেওয়ার জন্য এরা কাঁচা টাকায় মোটা অ্যামাউন্ট পাবে। দুজনের মোবাইল নম্বর রকির ট্যাবে সেভ করা আছে। কখন কাকে দরকার লাগে, কে বলতে পারে!

বালাজি ছাড়া বুনো নামের এক ছোকরা লাল হ্যাচব্যাকে উঠে বসল। চালকের আসনে বসল রকি। বালাজি বা বুনো কেমন গাড়ি চালায় কে জানে! ওদের হাতে গাড়ি ছাড়ার রিস্ক নেওয়া যাবে না। রকি তার মিলিটারি কেরিয়ারে কয়েক লাখ মাইল গাড়ি চালিয়েছে। সাইকেল থেকে যুদ্ধবিমান—সব চালানোর অভিজ্ঞতা আছে।

হাওড়া থেকে শেয়ালদা ফিরতে ফিরতে আজ ভোর থেকে যা-যা ঘটেছে, বালাজির মুখ থেকে শুনে নিয়েছে রকি। পুরো ছবিটা এখন তার কাছে জলের মতো পরিষ্কার। প্রথমাকে ধরতে না পারার জন্য বালাজিকে মনে মনে গালিগালাজ করছিল সে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, মেয়েটা অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সাকরেদ দুটিও স্ট্রিটস্মার্ট। মেঘনাদ ফোনে বালাজিকে জানায় যে রেড ডট এখন শেয়ালদা কোর্টের পাশে। এরপরই প্রথমার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয় বালাজি। দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘হাওড়ায় পারিনি। শেয়ালদায় বুঝে নেব।’

শেয়ালদাতে বোঝা হয়ে ওঠেনি। উলটে গাড়ি গায়েব হয়ে গেছে। এবং রকি নিশ্চিত, ওই গাড়ি পুলিশের হাতে পড়া মাত্র গাড়ির মালিকের খোঁজ শুরু হবে। লাল হ্যাচব্যাকের মালিক কি বিট্টু? যদি হয়, তাহলে বিট্টুকে অ্যারেস্ট করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সে রকি সম্পর্কে যা জানে বলে দেবে। হিসেব করে রকির মনে হয়েছে, তার হাতে ঘণ্টাপাঁচেক সময় আছে। যুদ্ধকালীন পরিবেশে আরও ঘণ্টাখানেক ছাড় নেওয়া যেতে পারে। তার পরে সে আর কলকাতায় নিরাপদ নয়।

বাচ্চাটা গাড়ির কাচে টকটক আওয়াজ করে হাত পেতে ভিক্ষের মুদ্রা দেখিয়েছিল। দয়া পরবশ হয়ে রকি গাড়ির কাচ নামিয়েছিল। ছেলেটা মুহূর্তের মধ্যে রকির চোখে কী একটা ঘষে দিল। ব্যস! তার পরের দশ-পনেরো মিনিট কী ঘটেছে, রকি জানে না। গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাথে গড়াগড়ি খেয়েছে আর ‘পানি! পানি!’ বলে চিৎকার করেছে।

এখন ট্যাক্সিতে বসে ক্রমাগত চোখে মিনারেল ওয়াটারের ঝাপটা দিয়ে চোখের জ্বালা কমছে। রকি শুনল বালাজি মোবাইলে বলছে, ‘মিস্টার রায় গাড়ি চালাচ্ছিলেন।’

‘রায়কে ফোনে দাও।’ স্পিকার ফোনে ঘেউঘেউ করে ওঠে মেঘনাদ। বালাজি বলে, ‘স্পিকার ফোন অন আছে। উনি শুনতে পাচ্ছেন।’

স্পিকার ফোন অন আছে শুনে মেঘনাদের গলার ঝাঁঝ কমল। সে বলল, ‘একটা বাচ্চা মেয়ে মুরগি করে পালাল?’

রায় ঠোঁট নেড়ে বালাজিকে বলল, ‘জিজ্ঞাসা করো, এখন প্রথমা কোথায়? জিপিএস কী বলছে?’

বালাজি প্রশ্নটা ফোনে চেঁচিয়ে বলল।

মেঘনাদ বলল, ‘ওঁকে বলো, উনি কথা বলতে পারেন। এটা সিকিয়োরড লাইন। দুদিকের নম্বরই মাস্কিং করা আছে।’

‘ও কে!’ চোখে আর এক প্রস্থ জলের ঝাপটা দিয়ে রকি বলল, ‘প্রথমা এখন কোথায়?’

বেকবাগান পেরোচ্ছে। বেশ দ্রুত। আমার ধারণা ওরা ট্যাক্সিতে। ফাঁকা রাস্তায় ষাট কিলোমিটার পার আওয়ারে রান করছে।’

বালাজি এইটুকু শুনে ট্যাক্সিওয়ালাকে বলল, ‘সার্কুলার রোড ধরে দৌড় লাগা। দেখি কেমন পারিস।’

বি আর সিং হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সি দৌড় দিল। শেয়ালদা চত্বরের কেউ বাধা দিতে এল না। বালাজিকে পিস্তল চালাতে দেখার পরে কারো কোনও কথা বলার সাহস হয়নি। ট্যাক্সি ড্রাইভারটি সব জানে। সামনের সিটে বসে বালাজি তার কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে রয়েছে।

শেয়ালদা ফ্লাইওভারের ওপরে জটলা। কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্ট ওয়াকিটকি কানে চিৎকার করছে। ‘লাল রঙের গাড়ি বাঁ-দিকে ঘুরে টুয়ার্ডস মৌলালি গেছে।’

বালাজি ড্রাইভারের কোমরে আবার পিস্তলের খোঁচা দিল। ট্যাক্সি বাঁ-দিকে ঘুরল।

হুশহুশ করে পেরিয়ে যাচ্ছে প্রাচী সিনেমা হল, সরকারি হাসপাতাল, লোরেটো স্কুল, ক্রিক রো, মৌলালি যুব কেন্দ্র। ক্রসিঙের আলো সবুজ। ট্যাক্সি যাচ্ছে শনশন করে। এন্টালিতে আবার পুলিশের জটলা। বালাজির পিস্তলের খোঁচা খেয়ে ড্রাইভার ট্যাক্সি আস্তে করল। রকি দেখল, লাল হ্যাচব্যাক ঘিরে রয়েছে বোম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের গাড়ি, পুলিশ কুকুর, ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি। রকি সিদ্ধান্তে এল, আর্মি যখন ইনভলভড হয়নি, তখন এই গাড়িকে এক্সটার্নাল থ্রেট ভাবা হচ্ছে না। অর্থাৎ তার কথা ইন্ডিয়ান ইনটেলিজেন্স এখনও জানে না। সো ফার সো গুড।

মোবাইলে মেঘনাদ বলল, ‘ওরা চিড়িয়াখানা পেরোচ্ছে। তোমরা কোথায়?’

‘মল্লিকবাজার।’ জানায় বালাজি। ‘ফাস্ট! গাড়লের দল! ফাস্ট!’ চিৎকার করে মেঘনাদ। বালাজি ড্রাইভারের কোমরে পিস্তলে খোঁচা মেরে বলে, ‘জলদি। চিড়িয়াখানা!’

ড্রাইভার প্যাঁ-প্যাঁ করে হর্ন দিয়ে অ্যাক্সিলারেটারে পা দাবায়। রকি দেখে, ফাঁকা রাস্তায় ঘণ্টায় নব্বই কিলোমিটার বেগে গাড়ি চলছে। এক্সাইড মোড়, পিজি হাসপাতাল, রেসকোর্স পেরিয়ে ট্যাক্সি এখন চিড়িখানার সামনে।

বালাজি ফোন করে বলল, ‘ওরা এখন কোথায়?’

‘ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে বেহালার দিকে যাচ্ছে।’

ফাঁকা রাস্তায় চারচাকার স্পিড ষাটের নীচে নামছে না। বালাজি ফোনে মেঘনাদকে বলল, ‘আমরা ডায়মন্ড হারবার রোডে। সামনেই বেহালা চৌরাস্তা।’

‘গুড। রেড ডট চৌরাস্তা ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে। সামনে কোনও ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে?’

‘চারটে।’

‘তোমরা ট্যাক্সির থেকে কত দূরে?’

‘আমাদের সামনে দুটো সরকারি বাস আর কয়েকটা অটো। ক্রসিঙের লাল আলো সবুজ হল।’

হুম। রেড ডটটাও মুভ করছে। সামনের দিকে।’

‘সামনের দিকে মানে কী? চারটে ট্যাক্সির মধ্যে দুটো ডানদিকে ঘুরল। বাকি দুটো সোজা যাচ্ছে।’

‘সামনের দিক মানে তোমার নাক বরাবর ইডিয়ট।’ গর্জে ওঠে মেঘনাদ। কথোপকথনে কান না দিয়ে রকি ড্রাইভারকে বলে, ‘বাস দুটোকে ওভারটেক করো। কুইক!’

বাধ্য ড্রাইভার বাঁ-দিক দিয়ে বেআইনি ওভারটেক করল। পরপর দুটো বাস টপকে এখন সে একটা ট্যাক্সির পাশে। ট্যাক্সিতে চারজন সর্দারজি বসে। রকি বলল, ‘পরের ট্যাক্সির সামনে গিয়ে দাঁড়াও।’

ড্রাইভার আবার বাঁ-দিক দিয়ে ওভারটেক করে গাড়ি ঘুরিয়ে পরের ট্যাক্সিকে ব্লক করল। ট্যাক্সিওয়ালা বিকট শব্দে ব্রেক কষে কলকাতার বিখ্যাত এবং বাছাই গালাগালগুলো এক এক করে ছাড়তে লাগল।

রকি এক লাফে ট্যাক্সি থেকে নামল। বালাজির হাত থেকে ফোন নিয়ে কানে দিয়ে বলল, ‘রেড ডট চলছে, না স্ট্যাটিক?’

‘দাঁড়াল। এক্ষুনি। আপনারা প্রথমাকে পেয়েছেন?’

মোবাইল বালাজির হাতে ধরিয়ে ট্যাক্সির ভিতরে উঁকি দিল রকি। সামনের বা পিছনের সিটে কেউ নেই। রকি ড্রাইভারকে বলল, ‘ডিকিতে কে আছে?’

‘ডিকিতে কিছু নেই। কেন বলুন তো বাবু? দেশে যুদ্ধু লেগেছে বলে কি সবাই পাগল হয়ে গেল?’ ট্যাক্সি থেকে নেমে ডিকি খুলে ড্রাইভার বলে, ‘দেখুন।’

ডিকিতে একপলক উঁকি মেরে রকি পিছনের দরজা খুলে ট্যাক্সিতে উঠে বসে। এদিক-সেদিক দেখে বলল, ‘খালি গাড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?’

‘গাড়ি গ্যারাজ করব। সকালে প্যাসেঞ্জার নিয়ে শেয়ালদা গিয়েছিলাম। তারপর টিভিতে বলল যুদ্ধ বাঁধবে। রাস্তায় আর কোনও লোক নেই। খালি গাড়ি নিয়ে ফিরছি।’

কোনও প্যাসেঞ্জার পাওনি?’

‘এন্টালিতে পেয়েছিলাম। হেস্টিংস যাবে বলল। আমি পঞ্চাশ টাকা এক্সট্রা চাইলাম। দিতে রাজি হল না। আমিও ”না” বলে দিলাম।’

রকি ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল, ‘তুমি চলন্ত ট্যাক্সি থেকে ”না” বলেছিলে, ”না” ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে?’

‘দাঁড় করিয়ে বাবু।’

‘এই বালাটা তোমার গাড়িতে কীভাবে এল?’ সোনালি রঙের বালা ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে বলে রকি। ড্রাইভার বলে, ‘এতক্ষণে বুঝলাম আপনারা কেন জেরা করছেন। এটা সোনার বালা। আপনারা পুলিশের লোক।’

‘আমরা পুলিশের লোক না আর্মির লোক তোমার জানার দরকার নেই। বালাটা কোথা থেকে এল বলো।’

‘বাবু, ও বালা কার আমি জানি না।’ ভয়ের চোটে ড্রাইভার থরথর করে কাঁপছে। হাতজোড় করে বলল, ‘আজ সকালে একটা বুড়োকে স্টেশানে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই বালা তার হতে পারে। আমি রোজ রাতে গাড়ি গ্যারাজে ঢুকিয়ে গাড়ি ধুই। গতকাল কোনও প্যাসেঞ্জার এই জিনিস গাড়িতে ফেলে গেলে গাড়ি ধুতে গিয়ে কাল রাতেই আমার চোখে পড়ত।’

ড্রাইভারের থেকে দূরে সরে গিয়ে রকি মোবাইলে মেঘনাদকে বলল, ‘প্রথমা আবার আমাদের বোকা বানিয়েছে। ওরা ট্যাক্সিতে জিপিএস ফেলে দিয়েছিল। আপনি আমাদের ডাইরেকশান দিচ্ছিলেন ট্যাক্সির জিপিএস দেখে।’

‘সেটা কি আমার দোষ?’ খেঁকিয়ে ওঠে মেঘনাদ।

‘না। আমার দোষ। আপনার বুদ্ধির ওপরে ভরসা করে আমি ভুল করেছিলাম। বাই।’ ফোন কেটে দেয় রকি।

যে ট্যাক্সিতে তারা এসেছে, তার ড্রাইভারের ঘাড়ে বালাজি এখনও পিস্তল ঠেকিয়ে রয়েছে। রকি ড্রাইভারকে বলে, ‘আমরা আর্মির লোক। এই দেখো আইকার্ড।’

জামার পকেট থেকে যে কার্ডটা বেরোল, সেটাই দেখিয়ে দেয় রকি। ‘তোমাকে আমরা ছেড়ে দিচ্ছি। তুমি কিন্তু পুলিশে ইনফর্ম করবে না।’

‘আচ্ছা।’ ঢক করে ঘাড় নাড়ে ড্রাইভার। রকির ইশারায় বালাজি আর বুনো ট্যাক্সি থেকে নেমে এসেছে। ড্রাইভার বলল, ‘আপনারা কি কোনোও সিক্রেট মিশনের সঙ্গে যুক্ত?’

‘কী করে বুঝলে?’ রকি অবাক হয়ে বলে।

‘মেজর, আমি এমএ পাশ। পেড্রো আলমাডোভারের ছবি ছাড়া দেখি না। মুরাকামি আর পামুকের বই ছাড়া পড়ি না।’ গর্বের সঙ্গে বলল ড্রাইভার।

অরিগামি বা কামুক—রকি কারো নাম শোনেনি। সে বলল, ‘গুড। তোমার ভাড়া কত হল?’

‘একশো সত্তর টাকা। পঞ্চাশ টাকা এক্সট্রা দেবেন মেজর! ইনারিতু গনজালভেসের নতুন ছবির ডিভিডি বেরিয়েছে। ওটা কিনব। ইসাবেল আলেন্দের নতুন বইটাও কিনতে হবে।’

পাঁচশো টাকা লোকটার হাতে ধরিয়ে সিরিয়াস মুখ করে রকি বলল, ‘এই সিক্রেট মিশনের কথা যেন কেউ জানতে না পারে।’

‘ইয়েস মেজর!’ ট্যাক্সি ঘুরিয়ে চলে গেল ড্রাইভার। রকি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এই ড্রাইভারকে বলল, ‘হেস্টিংস যাওয়ার কথা তোমায় জিগ্যেস করা হয়েছিল ঠিক কোনখানে?’

‘এন্টালিতে। যেখানে একটা লাল গাড়িকে পুলিশ ছানবিন করছিল।’

ড্রাইভারের উত্তরে রকি, বালাজি আর বুনো পরস্পরের দিকে তাকাল। রকি ড্রাইভারকে বলল, ‘সেইখানে আবার ফেরত চলো। কুইক।’

‘আমি গাড়ি গ্যারাজ করব।’ আপত্তি করে ড্রাইভার।

রকি বলে, ‘এই তো বলছিলে সকাল থেকে প্যাসেঞ্জার পাওনি। আমাদের পেয়ে খুশি নও? এই নাও অ্যাডভান্স।’ হাজার টাকার লাল নোট ড্রাইভারের পকেটে গুঁজে দেয় রকি।

ড্রাইভার লম্বা সেলাম ঠুকে বলে, ‘দেশের জন্যে আমাকেও কিছু করার সুযোগ দিন মেজর!’

রকি দীর্ঘ:শ্বাস ফেলে বলে, ‘তুমি কি কিছু শুনেছ?’

‘ওই ড্রাইভারকে যা বললেন, সবই তো শুনলাম।’

মুচকি হেসে রকি পিছনের আসনে বসে। পাশে বসে বুনো। বালাজি সামনের আসনে বসে বলে, ‘পনেরো মিনিটের মধ্যে এন্টালি পৌঁছোতে হবে।’

‘ইয়েস মেজর।’ অ্যাক্সিলারেটার দাবায় ড্রাইভার। ট্যাক্সি ‘গঁক’ শব্দ করে সামনের দিকে ঝাঁপ মারে।

বেহালা থেকে এন্টালি। ২ অক্টোবর।

দুপুর পৌনে দুটো থেকে সওয়া দুটো।

পনেরো মিনিট না হলেও আধ ঘণ্টার মধ্যে এন্টালি পৌঁছে গেল ড্রাইভার। এখন রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা। রাস্তায় লোক নেই। দোকান খোলা থাকলেও খদ্দের নেই। লাল গাড়িটাও নেই। ইউ-টার্ন করে মল্লিকবাজারের দিকে মুখ করে ট্যাক্সি রেখে ড্রাইভার বলল, ‘এইখানে আমার ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছিল মেজর।’

রকি ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ে। সামনেই যে পানের দোকানটা আছে, সেখানে গিয়ে প্রশ্ন করে, ‘যে লাল গাড়িটা আমাদের লোক একটু আগে সিজ করল, ওটায় একটা লোক আর দুটো বাচ্চা ছিল। মনে আছে?’

‘হ্যাঁ।’ পান চিবোতে চিবোতে ঘাড় নাড়ে দোকানদার। ‘মেয়েটার নাম পম। বাচ্চা ছেলেটার নাম জানি না। তবে ও হাওড়ায় থাকে। ওরা তিনজন মিলে ট্যাক্সি ধরে হেস্টিংস গেল।’

রকি অবাক হয়ে দোকানদারের দিকে তাকিয়ে রইল। এত কথা এই দোকানদার জানল কী করে? এ তো ঈশ্বরপ্রেরিত দূত! রকির মুখ দেখে দোকানদার বলল, ‘অবাক হচ্ছেন কেন স্যার? বাচ্চা দুটো আমার কাছ থেকে লজেন্স কিনেছিল। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। তার থেকে এইসব জেনেছি। ওইরকম অদ্ভুত গাড়ি থেকে নামলে সবাই খেয়াল করবে। তাছাড়া লোকটা গাড়িতে বসে পিস্তল নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল।’

‘অদ্ভুত গাড়ি কেন?’ রকি জানতে চাইল। সে চেয়েছিল সব চেয়ে কমন গাড়ি। যেটা কারো চোখে পড়বে না। সেটা পুলিশ ও জনতার নয়নের মণি হয়ে গেল কী করে?

‘পুঁচকে গাড়িতে বুলেট-প্রুফ কাচ থাকলে সবাই দেখবে। আপনাদের লোক এসে ওইসব দেখে হাঁ। গাড়িটা লালবাজার নিয়ে গেছে।’

বালাজি রকির হাত ধরে টানছে। কানে কানে বলছে, ‘লালবাজার মানে কলকাতা পুলিশের হেডকোয়ার্টার। আপনি এখান থেকে চলুন। আমরা এবার হেস্টিংস যাব।’

দোকানদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাক্সির পিছনের সিটে বসে রকি। বলে, ‘হেস্টিংসে কী আছে?’

‘এইটা আমাকেও অবাক করছে।’ দাঁতের ফাঁক দিয়ে হিশহিশ করে বলে বালাজি। ‘ওখানে মেঘনাদ লাহিড়ির রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার আর রি-লাইফ অনাথ আশ্রম। ওইটা একমাত্র জায়গা যেখানে ওদের যাওয়া উচিত না। কেন না আমরা ওদের ওখানেই নিয়ে যেতে চাইছি।’

বালাজির কথা শুনে চোখ বোজে রকি। সিচুয়েশান কি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে? কে জানে! চোখ বোঁজা অবস্থায় রকি শুনতে পেল, বালাজি মোবাইলে বলছে, ‘হ্যালো, স্যার, শুনতে পাচ্ছেন?’

১৮

এন্টালি থেকে হেস্টিংস। ২ অক্টোবর।

দুপুর একটা থেকে পৌনে তিনটে।

.

নোনাপুকুর ট্রাম ডিপোর কাছে এসে প্রথমা মুখ তোলে। অনেকক্ষণ ধরে সিন্টু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অসহায় মুহূর্তে ওই স্পর্শটুকু ওষুধের কাজ করেছে। একটা লজেন্স প্রথমার হাতে দিয়ে সিন্টু বলল, ‘ভিনিরভিনির করে কেঁদে কী হবে? কাউকে কাঁদতে দেখলে আমার হেব্বি রাগ হয়।’

‘কেন?’ লজেন্স মুখে পুরে ঝগড়া করার মুডে বলে প্রথমা।

‘আমি এই দুনিয়ার সবচেয়ে স্যাড ছেলে। বাবা-মা নেই। ভাইবোন নেই। নানা-নানি, চাচা-চাচি, তাউজি—কেউ নেই। বাড়িঘর নেই, টাকাপয়সা নেই, পেটে ভাত নেই। নেশার মাল সাপ্লাইয়ের লোক আছে, চুরিচামারির লাইনে নিয়ে যাওয়ার লোক আছে, মেরে হাডডি চুরচুর করে দেওয়ার লোক আছে। আমি যখন কাঁদছি না, তখন তুমি কাঁদছ কেন? তোমার জীবনে কি আমার থেকে বেশি কষ্ট?’

প্রথমা বলল, ‘ওই ভাবে কি কষ্ট মাপা যায় রে! আমি কতটা নিতে পারছি, সেটা দেখবি না?’

‘নিতে পারা মানে কী?’ খচরমচর করে লজেন্স চিবিয়ে বলে সিন্টু।

গণেশ বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রথমার দিকে তাকাল। তিনজনেই পিছনের সিটে বসেছে। ওপ্রান্তে জানলার ধারে সিন্টু। মাঝখানে প্রথমা। গণেশ ফিসফিস করে প্রথমাকে বলল, ‘আমার দু:খের কথা জানতে চাস? তাহলে হয়তো কান্না কমবে।’

প্রথমা কিছু বলল না। গণেশের কোলে মাথা রাখল। সিন্টু একটা লজেন্স গণেশের হাতে গুঁজে দিল।

‘আমারও মা-বাবা নেই।’ প্রথমার কানে কানে বলে গণেশ। প্রথমা একঝটকায় উঠে বসে। বলে, ‘মানে?’

সিন্টু জানলার ধার ছেড়ে প্রথমার কোলে বসে পড়েছে। সে গলা নামিয়ে বলল, ‘ঘাপলাটা কী বস?’

গণেশ বলল, ‘মেঘনাদের বাবা-মায়ের মাজদিয়ার বাড়িতে আমার মা কাজ করত। মা মারা যাওয়ার পরে মেঘনাদ আমাকে পুষ্যি নেয়। ও-ই আমার নামকরণ করে গণেশ। গণেশ আসলে কী?’

প্রথমা বলল, ‘মা দুর্গার ছেলে, যার মাথাটা হাতির আর শরীরটা মানুষের।’

‘একদম ঠিক। মেঘনাদের মাথার মধ্যে তখন থেকেই কাইমেরা তৈরির প্ল্যান ঘুরছে।’

‘কাইমেরা মানে?’ প্রথমা আর সিন্টু এক সঙ্গে জিগ্যেস করে।’

‘সবটা বুঝতে পারবি না। বুঝতে পারলেও বিশ্বাস করবি না। এই কারণেই প্রথম আলাপের পরে কথাগুলো তোকে বলিনি। বললে, তুই আমার সঙ্গে না এসে বালাজির সঙ্গে চলে যেতিস।’

‘বালাজির কথা বাদ দাও। তোমার কথা বলো।’

ট্যাক্সি মল্লিকবাজার ক্রসিং পেরোচ্ছে। গণেশ বলল, ‘সারা পৃথিবী জানে যে মেঘনাদ ক্লোনিং নিয়ে গবেষণা করে। এই গবেষণার ধোঁকার টাটির আড়ালে ও যে কাজটা করে, তার নাম অরগ্যান ফারমিং। অর্থাৎ ল্যাবরেটরিতে লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন তৈরি করা। এগুলো আলাদা আলাদা তৈরি না করে ও ল্যাবরেটরিতে মানুষ তৈরি করে। আজ থেকে বহুকাল আগে থেকে এই ধান্দা ও শুরু করেছে। যখন সাধারণ মানুষ কাইমেরা বা অরগ্যান ফারমিং-এর নামই শোনেনি।’

‘অরগ্যান ফারমিং?’ প্রথমা অবাক। গণেশ বলল, ‘পার্ক স্ট্রিট ক্রসিং আসছে। এখান থেকে এক্সাইডের মোড় পৌঁছোতে যতক্ষণ সময় লাগবে, তার মধ্যে আমি সহজ করে এেমব্রায়ো ক্লোনিং আর সারোগেট মাদারের ব্যাপারটা বোঝাব। শোন। তাহলে…’

পিজি হাসপাতাল আর রেসকোর্সের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে ট্যাক্সি যাচ্ছে। সব্বাই চুপ। প্রথমা বলল, ‘যে ব্লাসোসিস্ট তৈরি হল সেটা তো ভ্রূণ। সেটাকে নিয়ে কী করা হয়?’

হাতের তালুতে চাপড় মেরে গণেশ বলে, ‘বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ল্যাবরেটরিতে তৈরি হাইব্রিড ভ্রূণকে চোদ্দো দিনের বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। যারা মানে না, তাদের ল্যাবে ওই হাইব্রিড ভ্রূণ চোদ্দো দিন পরেও বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে একমাস, দু’মাস, ছ’মাস, ন’মাস…সারোগেট মাদারের ভাড়া করা জরায়ুতে তারা বড় হয়। এক সময় জন্ম নেয় জোড়কলম প্রাণী। কাইমেরা। তারা ভাত-ডাল-মাছ খায়, পড়াশুনো করে, ইশকুলের পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়।’

ট্যাক্সি পুলিশ ট্রেনিং স্কুল পেরোচ্ছে। সামনেই হেস্টিংস। প্রথমা বলল, ‘এত অবধি বুঝলাম। তারপর?’

‘ল্যাবরেটরিতে তৈরি এমব্রায়োকে জরায়ুতে রেখে আস্ত প্রাণী বানানোর এক্সপেরিমেন্টে তিরিশটা এমব্রায়োর মধ্যে জন্ম নেয় দশটা। জন্মের পরপর তিনটে প্রাণী মারা যায়। সাতটা প্রাণীকে মেঘনাদ ষোলো বছর পর্যন্ত অবজার্ভ করেছিল। ততদিনে ওর বিজনেস মডেল রেডি। লুসি মুন্নারে অরগ্যান ট্রানসপ্ল্যান্ট করছে, তনয়া খড়গপুরে মানুষকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে রাখার যাবতীয় সেট আপ করে ফেলেছে।’

হেস্টিংসের মোড়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছে। গণেশ ড্রাইভারকে বলল, ‘ডানদিকে নেবেন।’ প্রথমা দুরুদুরু বক্ষে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাইমেরাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার কী দরকার?’

‘এরা বায়ো-হ্যাজার্ড। এরা আনন্যাচারাল। সমাজের মূল স্রোতে এদের ভিড়তে দিলে মেঘনাদের বিপদ। কখন কার অ্যাক্সিডেন্ট হল, তাকে হাসপাতালে ভরতি করতে হল, ব্লাড টেস্ট হল…মোদ্দা কথা এই সাতজন মেঘনাদের অ্যাকিলিস হিল। এদের স্বাধীন ঘোরাফেরা কাম্য নয়।’

প্রথমা কিছু শুনছে না। কিছু বুঝতে পারছে না। আজ ভোররাতে জ্ঞান ফেরার সময় যেমন শীত করেছিল, সেই কালশীত আবার ফেরত আসছে। শরীরের সমস্ত অনুভূতি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। ঘুম পাচ্ছে। শীতঘুম। যে ঘুম সাপের, যে ঘুম মরু ভল্লুকের, যে ঘুম প্রথমার।

‘প্রথম ব্যাচের প্রথম কাইমেরা কি আমি?’ উত্তর জানা, তাও প্রশ্নটা করে প্রথমা।

‘হ্যাঁ। প্রথম ব্যাচের কাইমেরা হল প্রথমা, দু’কড়ি, তিন্নি, চার্বাক, পঞ্চম, ষষ্ঠীচরণ আর সাত্তার।’

‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত!’ অবাক হয়ে বলে প্রথমা।

হ্যাঁ। বিজ্ঞানী মানুষ তো। নবজাতকের নামকরণ আর সদ্য আবিষ্কৃত প্রাণীর নোমেনক্লেচার এক করে দিয়েছে। নাম থেকে বুঝতে পারত, কত নম্বর প্রাণী নিয়ে কথা হচ্ছে।’ ট্যাক্সির জানলা দিয়ে একদলা থুতু ফেলে বলে গণেশ।

‘বাকিরা কোথায়?’ যন্ত্রমানবীর মতো অনুভূতিহীন এবং নিষ্প্রাণ গলায় প্রশ্ন করে প্রথমা।

গণেশ বলে, ‘বাকিরা মানে, তোর ব্যাচের অন্য কাইমেরা? তুই আর আর ষষ্ঠী ছাড়া কেউ বেঁচে নেই। ওরা অরগ্যান ডোনার হয়ে মারা গেছে। দু’কড়ি তোর মতোই খড়গপুরের ক্রায়ো-ল্যাবে ঘুমিয়েছিল। যে অ্যাক্সিডেন্টে তুই বেঁচে গেছিস, সেই অ্যাক্সিডেন্টেই ও মারা গেছে।’

প্রথমার চোখের সামনে ভাসছে গতরাতের সেই দৃশ্য। উলটে থাকা অ্যাম্বুল্যান্সের পাশে পড়ে থাকা কফিন সদৃশ কন্টেনার। মাইনাস টেম্পারেচারে রাখা ওই কন্টেনারে শুয়ে সে আর দু’কড়ি কলকাতায় আসছিল। অ্যাক্সিডেন্টে দু’কড়ি মারা গেছে। সেও কেন মরল না? তাহলে অমানুষ কিংবা না-মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট সহ্য করতে হত না।

খিদিরপুর ব্রিজ পেরিয়ে ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মেটাচ্ছে গণেশ। সিন্টু পাশ থেকে কোমরে খোঁচা মেরে বলল, ‘মানুষ নও বলে মন খারাপ?’

প্রথমা নড়ল না। সিন্টু বলল, ‘মেনিবেড়ালের মতো মুখ করে বসে থাকলে চলবে? ঝাড় দিতে হবে না?’

সিন্টুর কথা শুনে ট্যাক্সি থেকে নেমে প্রথমা গণেশকে বলল, ‘আমরা কোথায় যাব?’

প্রথমার পিছন পিছন সিন্টুও ট্যাক্সি থেকে নেমেছ। সে প্রথমার হাতে লজেন্স গুঁজে দিয়ে বলল, ‘মানুষ নও বলে লজেন্স খাবে না? চিড়িয়াখানার শিম্পঞ্জিরা তো খায়।’

‘মারব কিন্তু!’ রেগেমেগে বলে প্রথমা। তবে সিন্টুর হাত থেকে লজেন্স ছিনিয়ে নিয়ে কড়মড় করে খেয়েও ফেলে। গণেশ ট্রামরাস্তা পেরোচ্ছে। তার পিছন পিছন রাস্তা পেরোয় দুজনে । ওষুধের দোকান, পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান, কোল্ড ড্রিঙ্ক-আইসক্রিম-পোট্যাটো চিপসের দোকান, হেকিমি দাওয়াখানা—এই সবের মধ্যে দিয়ে সরু, প্যাঁচানো রাস্তা। লোকজন বেশি বেশি বাজার করে বাড়ি ফিরছে আর ওয়ারিস্তানের চোদ্দোগুষ্টি উদ্ধার করছে। জায়গায় জায়গায় সভা হচ্ছে। সেখানে নানা দল ও নানা ধর্মের মানুষ এক হয়ে একটাই বার্তা দিচ্ছে। ‘এই সংকটের সময় আমাদের ঐকবদ্ধ থাকতে হবে। বিদেশি শক্তির ধমকে আমরা মাথা নোয়াব না।’

‘কী ব্যাপার কে জানে!’ আপনমনে বলে প্রথমা। ‘এরা এমন ভাব করছে, যেন যুদ্ধু লাগবে।’

‘সত্যিই লাগবে।’ সরু গলির থেকে আরো সরু গলিতে ঢুকে পড়ে বলে গণেশ। কানে মোবাইল ঠেকিয়ে সে কারো সঙ্গে কথা বলছে।

প্রথমা বলল, ‘পাঁচ বছর বাদে ঘুম ভেঙে উঠে যদি শুনি যে যুদ্ধ বাঁধবে, তাহলে আবার ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।’

ছোট একতলা বাড়ির কলিং বেল বাজাল গণেশ। ইটের গাঁথনি, অ্যাসবেসটসের ছাদ, মোল্ডেড প্লাস্টিকের দরজা। চোখে পড়ার মতো কিছু নয়। দরজা খুলে দিল বছর কুড়ি-বাইশের এক ছোকরা। লম্বা, শ্যামলা, একগাল ফুরফুরে দাড়ি, পাতলা গোঁফ, দৃষ্টিতে আশঙ্কা। দরজা আটকে সে গণেশকে বলল, ‘এ তো প্রথমা। ও কে? ইঙ্গিত সিন্টুর দিকে। বুঝতে পেরে সিন্টু বলল, ‘আমার নাম সিন্টু। হাওড়া স্টেশনের ডন। তুমি তো ষষ্ঠী। তাই না?’

ষষ্ঠী দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল, ‘আগে ভেতরে আয়, তারপর মার খাবি।’

সবার আগে ঢুকল সিন্টু। সবার শেষে প্রথমা। সে অবাক হয়ে ষষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে। কত বড় হয়ে গেছে ছেলেটা! কত লম্বা হয়ে গেছে! অথচ, গতকালও এইটুকু ছিল।

গতকাল নয়। পাঁচ বছর আগে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমা। যে সময়টায় সে শীতঘুমে ডুবেছিল, সেই অমূল্য সময়ে তার বন্ধু বড় হয়ে গেছে। শরীরে, মনে, আত্মায়। প্রথমা আর ষষ্ঠীর কেউ নয়। পাশাপাশি অন্য একটা চিন্তা উঁকি মারে প্রথমার মনে। ষষ্ঠী তারই মতো কাইমেরা। চতুর্দিকে মানব সম্প্রদায়ের এই মেজরিটির মধ্যে সে আর ষষ্ঠী মাইনরিটি। তারা অন্যরকম। তারা আলাদা। ষষ্ঠীর প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করে সে।

ষষ্ঠী দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রথমা দেখল, বাড়িটা যত ছোট ভেবেছিল, তত ছোট নয়। টেবিল, চেয়ার কম্পিউটার, খাতাপত্তর মিলিয়ে আপিস আপিস ভাব। এই ঘরের খিড়কি দরজা বন্ধ। সেটা খুলে ষষ্ঠী আর গণেশ ভিতরে ঘরে ঢুকে গেল। পিছনে প্রথমা আর সিন্টু। ওদিককার কাণ্ডকারখানা দেখে প্রথমা তাজ্জব! লম্বা করিডোরের দুদিকে ছ’টা দরজা। দরজার গায়ে লেখা নোটিশ পড়ে আন্দাজ করা যাচ্ছে, কোন ঘরে কী হয়। মেল ডর্মিটরি, ফিমেল ডর্মিটরি, কিচেন, টয়লেট, স্টোররুম, রেকর্ড রুম।

প্রথমা জিগ্যেস করল, ‘এখানে কী হয়? কারা থাকে?’

ষষ্ঠী বলল, ‘অনেক প্রশ্ন আছে। তার আগে এক কাপ চা হয়ে যাক। কী বলো? আমাদের জন্মসাল আর জন্মতারিখ এক। আমরা তো বন্ধু!’

‘যদি ওটাকে জন্ম বলা যায়।’ কিচেনে ঢুকে চেয়ারে বসে বলে প্রথমা।

‘এক ব্যাচের প্রাোডাক্ট বলতে পারো।’ শ্রাগ করে ষষ্ঠী। ‘আমি চা বানাতে বানাতে তোমার কৌতূহল দূর করছি। গণেশদা ততক্ষণে যা শোনার, শুনে নিক।’

প্রথমা দেখল, গণেশ একটা ছোট্ট যন্ত্রের মধ্যে জ্যাক ঢুকিয়ে, কানে ইয়ারফোন গুঁজে মন দিয়ে কিছু শুনছে। চোখ বোজা। সিন্টু বাথরুমে ঢুকে গেছে। ষষ্ঠী বলল, ‘তোমাকে যে-রাতে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে খড়গপুরে পাঠিয়ে দিল, সেইদিন সকালে তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। মনে পড়ে?’

‘পড়ে।’

‘আমরা জানতাম যে আমরা অনাথ। মেঘনাদ আমাদের দত্তক নিয়েছে। সারা দুনিয়া তাই জানে। এই বিষয়ে জালি ডকুমেন্ট তৈরি করার জন্য ও টাকা দিয়ে পেশাদার লোক রেখেছে। অনাথ আশ্রম এবং দত্তক সংক্রান্ত কাগজপত্রের কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। গণেশদা সত্যি কথাটা জানত। জানত যে আমরা কাইমেরা। সেই রাতে প্রথম জানতে পারে যে আমাদের ক্রায়োপ্রিজার্ভ করা হবে।’

ষষ্ঠীর মুখে ‘কাইমেরা’ শব্দটা শুনতে খারাপ লাগছে প্রথমার। কিন্তু কথাটা তো সত্যি! সে মানুষ নয়। সে কাইমেরা। ল্যাবরেটরির পেট্রিডিশে তৈরি হওয়া জোড়কলম প্রাণী। যার অর্ধেক মানুষের। বাকি অর্ধেক কোন প্রাণীর—কে জানে! কথা ঘুরোতে প্রথমা বলল, ‘তোমরা এখানে কী করছ? ওই লোকটা জানতে পারলে…’

‘জানতে পারলে রি-সাইকলে পাঠিয়ে দেবে।’ মুচকি হেসে প্রথমার সামনে এককাপ চা রাখে ষষ্ঠী। সিন্টু বাথরুমে থেকে বেরিয়েছে। স্নান করে গা থেকে ময়লা তুলেছে। পুরোনো জামা-প্যান্ট ছেড়ে কোমরে পুঁচকে তোয়ালে জড়িয়েছে।

গণেশের যা শোনার শোনা হয়ে গেছে। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে সে সিন্টুকে বলল, ‘তোর মাপের পোশাক আমাদের কাছে আছে। তুই আমার সঙ্গে আয়।’ গণেশ সিন্টুকে নিয়ে কিচেন থেকে বেরোল।

প্রথমা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না। তুমি আর গণেশদা এখানে কী করছ?’

‘ওয়েল…’ চায়ে চুমুক দিয়ে টেবিলে আঙুল ঠোকে ষষ্ঠী। বলে, ‘আমি কাইমেরা। যতই মানুষের মতো দেখতে হই না কেন, আমি পুরো মানুষ নই। এই চিন্তা প্রতি মুহূর্তে হন্ট করে। গণেশদাকে হন্ট করে মেঘনাদের শয়তানি। আমার আর গণেশদার জীবনের লক্ষ্য একটাই। ওই শয়তান আর তার নরক-সাম্রাজ্য ধ্বংস করা। কিন্তু খালি পেটে এই কাজ সম্ভব নয়। আমাদের খেটে খেতে হয়। তোমাকে গণেশদা হেল্পিং হ্যান্ডের কথা বলেছে?’

‘বলেছে।’

‘বিনায়ক বাগচি মানে গণেশদা, আর মোহন দাস মানে আমি—এই দুজন মিলে হেল্পিং হ্যান্ড থেকে লোকের বাড়ি কাজের লোক বা আয়া পাঠাই। রি-লাইফেও পাঠাই। একবার এক ইলেকট্রিক মিস্ত্রি পাঠাতে হয়েছিল। তার মারফত শক্তিশালী একটা মাইক্রোরেকর্ডার শয়তানটার চেম্বারের টেবিলের নীচে ফিট করা আছে। আমরা খুব খুঁটিয়ে, বেছেবুছে ওখানে কাজের লোক পাঠাই। এমন কাউকে, যে একশো শতাংশ বিশ্বাসযোগ্য। তার হাত দিয়ে সিডি পাঠাই। আমাদের দুই হেল্পিং হ্যান্ড, মলিনাদি আর সুজাতাদি প্রতি বারো ঘণ্টায় সিডি বদলে দেয় আর পুরোনো সিডি নিয়ে আসে।’

‘গণেশদা এখন সেই সিডি শুনছিল?’

‘হ্যাঁ। ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে শোনে। বেশিরভাগ সময়টাই তো চেম্বার নীরব থাকে। বারো ঘণ্টার মেটিরিয়াল শুনতে ঘণ্টাচারেক লাগে। আমি আর গণেশদা ভাগ করে শুনি। ওটা শুনেই তো আমরা তোমার অ্যাক্সিডেন্টের কথা জানলাম। জানলাম তুমি বেঁচে আছ। জানলাম তোমার লোকেশান। তা না হলে গণেশদার সঙ্গে লোকাল ট্রেনে তোমার দেখা হল কী করে?’

‘এইবারে বুঝেছি।’ ঘনঘন ঘাড় নাড়ে প্রথমা। ‘বালাজি আমাকে ট্রেস করতে পেরেছিল, কেন না আমার গায়ে জিপিএস লাগানো ছিল। আর গণেশদা আমার অবস্থান জেনেছে সিডিতে লোকটার বকবক শুনে।’

‘একদম তাই। হেল্পিং হ্যান্ড আরও দু’একটা কাজ করে। লোকের বাড়ির টেলিফোন বিল, মোবাইলের বিল, ইলেকট্রিসিটি বিল জমা দেওয়া, এলআইসি-র প্রিমিয়াম জমা দেওয়া, ব্যাঙ্কে গিয়ে পাশবই আপডেট করা বা টাকা জমা দেওয়া—এইসব। এই এলাকায় নিম্নবিত্ত অশিক্ষিত মানুষের বাস। ওদের হয়ে আমরা কাজ করে দিই। ওরা সামান্য প্রফেশনাল ফি দেয়। কাজের পরিমাণ হিউজ বলে মোটামুটি মার্জিন থাকে।’

‘রি-লাইফের সঙ্গে তোমাদের এত ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। যে-কোনওদিন ধরা পড়ে যাবে।’

‘ঠিক উলটোটা। রোজ এই অফিসে এত লোকজন আসে যে নতুন কেউ এলে প্রতিবেশীরা সন্দেহ করে না। ইনফ্যাক্ট প্রতিবেশীদের বেশ কয়েকজনকে আমরা বিভিন্ন জায়গায় কাজ দিয়েছি। অফিসটা গণেশদা সামলায়। ও খুব একটা বাইরে বেরোয় না। পাঁচ বছরে আমার চেহারায় অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বালাজি আমাকে দেখলে ষষ্ঠী বলে চিনতে পারবে না। গণেশদাও নেড়া হয়ে, জিম করে, অন্য রকমের পোশাক পরে, নতুন নাম নিয়ে নিজেকে বদলে ফেলেছে।’

গণেশদার ভোলবদল এত অব্যর্থ যে প্রথমা চিনতে পারেনি। কিন্তু বালাজি চিনতে পেরেছিল। ষষ্ঠীকে কিছু না বলে অন্য বিষয়ে যায় প্রথমা। ‘ওই লোকটার আসল চেহারা কীভাবে সবার সামনে তুলে ধরবে এ নিয়ে কিছু ভেবেছ?’

‘আমি আর গণেশদা সারাক্ষণ এই নিয়েই ভাবি। মিডিয়া বা পুলিশের কাছে গিয়ে লাভ নেই। মেঘনাদ লাহিড়ি বাঙালির আইকন। তাকে নিয়ে কোনও বাজে কথা কেউ সহ্য করবে না। কিন্তু ওই শয়তানের মুখোশ খুলে দেওয়াই আমাদের জীবনের ব্রত। কীভাবে জানি না। যেমন, তোমাকে আমাদের মধ্যে পাওয়া গেল, এটা একটা বড় ব্রেক থ্রু। মলিনা আর সুজাতাদির আনা সিডি থেকে নানা তথ্য পাই। সব জুড়ে, সব বুনে কোথাও একটা পৌঁছোব একদিন।’

‘আর চারদিকে এই যে যুদ্ধের আবহাওয়া? এটা নিয়ে কী মত?’

‘তোমার আর আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই যুদ্ধ। বেঁচে থাকাটা আমাদের কাছে উপরি পাওনা। কবেই তো মরে যাওয়া উচিত ছিল। তাই না?’ ষষ্ঠী হাত বাড়িয়ে দেয়।

‘হ্যাঁ।’ হাত বাড়িয়ে দেয় প্রথমাও। নিজের হাতের মধ্যে সেই হাত নেয় ষষ্ঠী। এক কাইমেরা স্পর্শ করে অন্য কাইমেরাকে।

১৯

রি-লাইফ। হেস্টিংস। কলকাতা। ২ অক্টোবর।

দুপুর সওয়া দুটো থেকে আড়াইটে।

.

ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়ে, চেম্বারে বসে মেঘনাদ চুপচাপ ভাবছিল। বালাজি ফোনে জানিয়েছে সে প্রথমার সন্ধান পেয়েছে। এন্টালি থেকে ট্যাক্সি করে প্রথমা, গণেশ আর একটা বাচ্চা ছেলে হেস্টিংসে আসছে। শুনে মেঘনাদের মাথায় পরপর কয়েকটা প্রশ্ন এল। কেন হেস্টিংসে আসছে? কোথায় আসছে? ওরা কী চাইছে? বাচ্চাটা কে?

প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করতে থাকে মেঘনাদ। প্রশ্ন থেকে উত্তরে পৌঁছোনো যাবে। সত্যের কাছে পৌঁছোনো যাবে। এমন কোনও সত্য, যা সবার সামনে ভাসছে। কেউ দেখতে পাচ্ছে না। মেঘনাদ বিশ্বাস করে, প্রথমে আসে ইনফরমেশান। সেখান থেকে আসে নলেজ। তথ্য থেকে জ্ঞানের এই যাত্রায় মানুষ হেদিয়ে যায়। এর পরের ধাপে, বোধ ও দর্শনের ধাপে পৌঁছোতে পারে না। সাধে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে নিউটন বলেছিলেন, জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহন দূরের কথা, তিনি সাগরতীরে নুড়ি কুড়োচ্ছেন!

মেঘনাদও নুড়ি কুড়োচ্ছে। তবে অন্য নুড়ি। গতকাল থেকে আজ পর্যন্ত যত কথা হয়েছে, যত ঘটনা ঘটেছে, যত নতুন চরিত্রের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে, সেই সব তথ্য-নুড়ি এক জায়গায় জড়ো করে দেখছে কোন পরম সত্যের কাছে পৌঁছোনো যায়।

নতুন চরিত্র এক, গণেশ! রি-লাইফ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল পাঁচ বছর আগে। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল প্রথম ব্যাচের সিক্সথ স্পেসিমেনকে। নামটা মনে ছিল না। ডেটাবেস খুঁজে বার করেছে মেঘনাদ। ষষ্ঠী।

গণেশের পালিয়ে যাওয়ার পরে থানায় ডায়রি করা হয়েছিল। পুলিশ খোঁজপাত্তা চালিয়েছিল। কিন্তু নো ট্রেস! ষষ্ঠীর কথা মেঘনাদ মাথা থেকে উড়িয়ে দিয়েছিল। কাজটা ঠিক হয়নি। আজ সকালে যখন বালাজির মুখে শুনল যে হাওড়া স্টেশানে প্রথমার সঙ্গে রয়েছে গণেশ, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি। এ আবার কোথা থেকে এল? কীভাবে এল? কেন এল?

এখন মনে হচ্ছে, সমাপতন নয়। অ্যাক্সিডেন্টের খবর জেনেই গণেশ ওই চত্বরে গিয়েছিল। বালাজি মাথামোটা। জিপিএস থাকা সত্বেও মেয়েটাকে আগে ট্রেস করতে পারেনি। গণেশ কীভাবে বালাজির আগে প্রথমার কাছে পৌঁছোল? প্রথমা বারবার বালাজির হাত থেকে পালিয়ে গেছে। কেন পালিয়েছে? কেন না, প্রথমা জানে, তার পরিণতি কী হতে চলেছে।

পাঁচবছর বাদে ঘুম থেকে উঠে প্রথমা কীভাবে নিজের পরিণতি জানল? সহজ উত্তর, গণেশ বলেছে। পরের প্রশ্ন, গণেশ কীভাবে জানল? এইখানে এসে মেঘনাদ আটকে যাচ্ছে। অ্যাক্সিডেন্টের খবর মেঘনাদ যখন পায় তখন চেম্বারে কে কে ছিল? মেঘনাদ নিজে, সাংবাদিক যশোধরা আর বালাজি। নিজেকে সন্দেহ তালিকার বাইরে রেখে মেঘনাদ ভাবে। প্রাইম সাসপেক্ট যশোধরা সেন। সাক্ষাৎকার নিতে এসে এত প্রাইভেট প্রশ্ন করছিল…

ঘাড় নাড়ে মেঘনাদ। যশোধরা নয়। তিন মাস ঘুরিয়ে মেয়েটাকে ইন্টারভিউয়ের ডেট দিয়েছে মেঘনাদ। সেই দিনই অ্যাক্সিডেন্ট হবে, একথা থোড়াই কেউ জানত! তাহলে কি বালাজি? এত দিন ধরে যাকে বিশ্বাস করেছে মেঘনাদ, সে-ই বিট্রে করবে? গণেশের সঙ্গে গটআপ গেম খেলে প্রথমাকে ছেড়ে দিচ্ছে?

এই যুক্তিও উড়িয়ে দেয় মেঘনাদ। বালাজির সঙ্গে রকি রয়েছে। সে প্রথমাকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। বুনোও ছেড়ে দেবে না। তাদের হাত থেকে প্রথমা পালিয়েছে মানে, এটা গটআপ গেম নয়।

মলিনা এসেছে জিজ্ঞাসা করল, ‘দুপুরে খাবেন না?’

‘খাব।’ টেবিল ছেড়ে ওঠে মেঘনাদ। ঘর থেকে বেরিয়ে দোতলায় ওঠে। আজ সারাদিন এত হেকটিক যাচ্ছে যে ব্রেকফাস্ট করা হয়নি। লাঞ্চও না। মলিনা কী রেঁধেছে দেখা যাক।

মলিনা! এই মহিলাও গত রাতে চেম্বারে ঢুকেছিল। কেন এসেছিল? কিছু বলতে? চা দিতে? ঘর সাফ করতে? মনে পড়ে না মেঘনাদের। গত রাতের মুহূর্তগুলো মনের মধ্যে রি-কনস্ট্রাক্ট করতে করতে আবার চেম্বারে ফেরে। চেম্বারের দরজার হ্যান্ডল ঘুরিয়ে ভিতরে যেতে চায়।

হ্যান্ডল ঘুরছে না। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। উত্তেজিত মেঘনাদ চেম্বারের দরজায় তিন লাথি মারে। চিৎকার করে, ‘কে ভিতরে?’

‘আমি স্যার।’ মলিনা ঝাঁটা হাতে দরজা খুলে দিয়েছে। ‘ঘর সাফ করছিলাম। পরে করব?’

‘না। ঠিক আছে।’ লজ্জা পায় মেঘনাদ। এত উত্তেজিত হওয়া উচিত হয়নি। বেচারি মলিনা দরদর করে ঘামছে। আবার সিঁড়ির দিকে এগোয় মেঘনাদ।

ঘামছে? সেকেন্ড অক্টোবরের শীতে ঘামছে? আবার চেম্বারে ঢোকে মেঘনাদ। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে ড্রয়ার থেকে বার করে কোল্ট আগ্নেয়াস্ত্র। মলিনার কপাল তাক করে বলে, ‘সত্যি কথা বললে বেঁচে এই ঘর থেকে বেরোবে। মিথ্যে বললে লাশ গায়েব করে দেওয়ার লোকের অভাব নেই।’

এন্টালি থেকে হেস্টিংস। হেল্পিং হ্যান্ডের অফিস।

২ অক্টোবর। দুপুর সওয়া দুটো থেকে তিনটে।

এন্টালি থেকে বেকবাগান হয়ে মিন্টোপার্ক। পনেরো মিনিটে চলে এল ট্যাক্সি ড্রাইভার। শহীদ ভগত সিং উদ্যানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রকি বলল, ‘এই রাস্তা দিয়ে আমরা আগে গিয়েছিলাম।’

‘হ্যাঁ।’ জবাব দেয় বালাজি। হঠাৎ তার মোবাইল বেজে ওঠে। মোবাইল কানে দিয়ে বালাজি বলে, ‘বলুন স্যার।’

‘রি-লাইফে যারা কাজ করে, যেমন মলিনা বা সুজাতা—এদের কে হায়ার করে?’ জানতে চাইছে মেঘনাদ।

‘আমি। কেন? ওরা কিছু ভুলভাল করছে নাকি?’

‘না, না। সেরকম কিছু না। তুমি এদের কোথা থেকে জোগাড় করো?’

‘খিদিরপুরে হেল্পিং হ্যান্ড নামে একটা এনজিও আছে। ওরা আয়া আর কাজের লোক সাপ্লাই করে। মেয়েগুলো চুরিচামারি করেছে নাকি? তাহলে হেল্পিং হ্যান্ডে খবর দিতে হবে। ওদের বস খুব কড়া। সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে দেবে।’

‘তুমি ওদের বসকে চেনো?’

‘বস মানে ওই আর কি! এনজিওটা যে চালায়। মোহন নামের কমবয়সি ছোকরা।’ বালাজি শঙ্কিত গলায় বলে, ‘কেন স্যার? কোনও প্রবলেম?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঘনাদ বলে, ‘তোমার হেল্পিং হ্যান্ডে একবার এসো।’

বালাজি ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, ‘প্রথমারা কি হেল্পিং হ্যান্ডে লুকিয়ে রয়েছে?’

মেঘনাদ বলল, ‘প্রশ্ন কোরো না। চলে এসো।’

ট্যাক্সি রেসকোর্সের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। রকি বলল, ‘কোনও গণ্ডগোল?’

‘জানি না। বস খিদিরপুরের একটা এনজিওতে যেতে বলল।’

ড্রাইভার কান খাড়া করে শুনছিল। সে হঠাৎ বলল, ‘জয় হিন্দ মেজর! আমি কি বাঁয়ে মুড়ব?’

বালাজি বলল, ‘হ্যাঁ। খিদিরপুর ব্রিজ পেরিয়ে রাখবে।’

‘অল রাইট মেজর।’ হেস্টিংস চারমাথার মোড় থেকে বাঁ-দিকে ঘুরে, ব্রিজ টপকে ট্যাক্সি দাঁড় করায় ড্রাইভার। বলে, ‘একশো কুড়ি টাকা। যুদ্ধকালীন লেভি পঞ্চাশ টাকা।’

বুনো ঘুষি পাকাচ্ছিল। তার কাঁধে হাত দিয়ে থামাল রকি। ড্রাইভারের হাতে দুশো টাকা ধরিয়ে বলল, ‘মুখ বন্ধ রাখার জন্য সরকারি অনুদান আরও তিরিশ টাকা। আমাদের এই গোপন মিশনের কথা কেউ যেন জানতে না পারে। সায়লেন্স ইজ গোল্ডেন।’

‘স্পিকটি নট মেজর।’ ড্রাইভারের ঠোঁটে তর্জনী। রকি রাস্তা পেরোল। বুনো আর বালাজি ঢুকে পড়েছে গরিব মহল্লায়। এইখানে প্রথমা লুকিয়ে আছে? হাঁটতে হাঁটতে ঘড়ি দেখল রকি। আড়াইটে বাজে। ইন্ডিয়া ওয়ারিস্তানকে দু’ঘণ্টা সময় দিয়েছিল যুদ্ধবিরতির আবেদন করতে। না করলে পৌনে চারটের সময় ইন্ডিয়া অ্যাটাকে যাবে। পৌনে চারটে বাজতে আর একঘণ্টা পনেরো মিনিট বাকি আছে। তার আগে দমদম থেকে প্রথমাকে নিয়ে কেরালায় প্লেনে উঠতে পারবে রকি? লুসির হাতে প্রথমাকে তুলে দিয়ে রকি ইন্ডিয়া থেকে পালাবে। রাজুর অপারেশান এবং রিকভারি নির্বিঘ্নে হওয়ার পরে তাকে আবার ফিরতে হবে। রাজুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সেসব পরের কথা। এখন মেয়েটাকে হাতে পেতে হবে।

রকি দেখল, অ্যাসবেটসের ছাউনিওয়ালা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ছে বালাজি। একবার, দুবার, তিনবার…কেউ খুলছে না। সন্তর্পণে পকেটে হাত ঢোকাল রকি। স্পর্শ করল গ্লক। তার মন বলছে, একটা কিছু হবে। এখানে। এখনই।

দরজা আস্তে আস্তে খুলছে।

রি-লাইফ থেকে হেল্পিং হ্যান্ড। ২ অক্টোবর।

দুপুর আড়াইটে থেকে পৌনে তিনটে।

.

মলিনার মুখ থেকে সবটা শুনে নিশ্চিন্ত হল মেঘনাদ। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে। পুরো ছকটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। জিগ-স পাজলের টুকরোগুলো নিজের নিজের জায়গায় বসে বড় ক্যানভাস তৈরি করে দিয়েছে। সব ভেবে মেঘনাদ দেখল, এই ঘটনার জন্য একজনই দায়ী। সে নিজে। বালাজির মতো একটা গাম্বাটের হাতে এত ক্ষমতা দেওয়া উচিত হয়নি।

টেবিলের তলা থেকে মাইক্রো-রেকর্ডারটা উপড়ে নিল মেঘনাদ। স্ক্রু দিয়ে এমনভাবে লাগানো যে খোলা শক্ত। কত বছর ধরে এটা এখানে আছে কে জানে! মলিনা বলতে পারল না!

মলিনাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে মেঘনাদ। কারণ হেল্পিং হ্যান্ডে পৌঁছোতে হবে। তারপরে একে বা সুজাতাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তবে সেসব পরের চিন্তা। আগে মলিনা। এর সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে। কোল্ট দেখিয়ে যা জানার জানা হয়ে গেছে। এখন ইমেজ মেকওভারের পালা।

‘আসলে কি জানো মলিনা, তুমি দুটো পয়সার জন্য যে কাজটা করছ, সেটা আমার গবেষণার পক্ষে ভয়ানক ক্ষতিকর। রিসার্চ নিয়ে আমি যা যা বলেছি, সেসব কথা সিডিবাহিত হয়ে পৌঁছে গেছে প্রতিদ্বন্দ্বীর হাতে। হয়তো তোমার এই ছিঁচকেমির জন্য আমি নোবেল প্রাইজ মিস করব। আমার রিসার্চ চুরি করে অন্য লোক পেয়ে যাবে। ওই জন্যেই রেগে গিয়ে তোমায় খেলনা পিস্তল দেখিয়েছিলাম।’

‘আমার ভুল হয়ে গেছে স্যার।’ মলিনা কাঁদছে, ‘আপনি আমায় ক্ষমা করে দিন। আমি ওদের কথা আর শুনব না।’

‘চলো, আমরা এখনই হেল্পিং হ্যান্ডে যাই। ওদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলা উচিত। অন্যায় কাজকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। এতে সামাজিক অবক্ষয় বাড়ে। তুমি গাড়িতে ওঠো।’ ড্রাইভওয়ে থেকে সবচেয়ে ছোট, জলপাই সবুজ রঙের একলাখি গাড়ি বেছে নিয়ে ড্রাইভারের সিটে বসে পড়েছে মেঘনাদ। মলিনা বলল, ‘আমি যাব? আপনার সঙ্গে? ড্রাইভার কই?’

‘ড্রাইভার নেব না। এসব কথা পাঁচকান হওয়া ঠিক নয়। তুমি পিছনের সিটে বোসো। তোমার কাজ বাড়ি চিনিয়ে দেওয়া।’

মলিনা জড়সড় হয়ে পিছনের সিটে বসে। গাড়ি স্টার্ট করে একমিনিটের মধ্যে মেঘনাদ পৌঁছে যায় চারমাথার মোড়ে। ডানদিকে ঘুরলেই খিদিরপুর ব্রিজ। ব্রিজ টপকানোর পরে মলিনা বলল, ‘গাড়ি এখানে রাখুন। গাড়ি আর যাবে না।’

‘কতটা যায় দেখি।’ গলির মধ্যে গাড়ি ঢোকাল মেঘনাদ। রাস্তা দিয়ে ছোট গাড়ি যেতে পারবে। উলটো দিক দিয়ে গাড়ি চলে এলে বিপদ আছে। সন্তর্পণে গাড়ি চালায় মেঘনাদ। রাস্তার ওপরে বাচ্চারা খেলছে, মেয়েরা বাসন মাজছে, ছেলেরা চান করছে। তরিতরকারি নিয়ে দোকানদার বসে পড়েছে। নেহাত ডাক্তারি চিহ্নের স্টিকার লাগানো, তাই কেউ কিছু বলছে না।

‘এসে গেছি।’ পিছন থেকে মলিনা বলল।

মেঘনাদ জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন বাড়িটা?’

মলিদা আঙুল তুলে একটা একতলা বাড়ি দেখাল।

এখানে গাড়ি ঘোরানোর মতো জায়গা আছে। গাড়ি ঘুরিয়ে হেল্পিং হ্যান্ডের দরজার সামনে পার্ক করে মেঘনাদ বলল, ‘কলিং বেল রয়েছে দেখছি। তুমি বেল বাজাও। দরজা খুলে দিলে ভিতরে ঢুকে যেয়ো। আমার কথা বলবে না কিন্তু।’

‘আচ্ছা।’ গাড়ি থেকে নেমে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজায় মলিনা। মেঘনাদ গাড়ি থেকে নেমে বনেটের আড়ালে দাঁড়িয়ে। হাতে চলে এসেছে কোল্ট।

হেল্পিং হ্যান্ড থেকে রি-লাইফ। ২ অক্টোবর।

দুপুর পৌনে তিনটে থেকে সওয়া তিনটে।

‘আজ একটু পায়েস রান্না করেছি। খাবে?’ প্রথমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জানতে চায় ষষ্ঠী।

প্রথমা বলে, ‘পায়েস? সে তো জন্মদিনে খায়। আজ কার জন্মদিন?’

‘আজ মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিন। কিন্তু সেই জন্যে আমি পায়েস বানাইনি। তোমার সঙ্গে পাঁচ বছর বাদে দেখা হবে বলে বানিয়েছি। নতুন আলাপের সময় সামান্য মিষ্টিমুখ।’

‘খেতেই পারি। কিন্তু সব্বাই মিলে খাব। সিন্টু আর গণেশদা কোথায় গেল?’

‘ওরা স্টোররুমে। ওখানে নানান মাপের জামাকাপড় আছে। সিন্টুর মাপের কিছু না কিছু পেয়ে যাবে।’ ফ্রিজ থেকে পায়েসের বাটি বার করে বলে ষষ্ঠী। ‘কাবার্ডে স্টিলের বাটি আর চামচ আছে। বার করো। আমি ওদের ডেকে আনছি।’

কাবার্ড থেকে বাটি আর চামচ বার করতে যাবে প্রথমা, এমন সময় কলিং বেল বাজল। ষষ্ঠী বলল, ‘ঘাবড়ানোর দরকার নেই। আমি দেখছি।’

ষষ্ঠী কিচেন থেকে বেরোচ্ছে, আবার বেল বাজল। প্রথমা চারটে বাটিতে পায়েস ঢেলে চামচ দিয়ে একটুখানি চাখল। কিটকিটে মিষ্টি হয়েছে। ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বার করতে গিয়ে প্রথমা করিডোরে ঝটাপটির আওয়াজ শুনল। কী রে বাবা! কিচেনের বাসনকোসন ঘেঁটে ছুরি বার করে সে ফ্রিজের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। আসুক দেখি! কে আসবে!

কেউ এল না। সব চুপচাপ। কোথাও আওয়াজ নেই। ফ্রিজের আড়াল থেকে বেরিয়ে, পা টিপে টিপে দরজার কাছে এল প্রথমা। গেল কোথায়, সবাই? সন্তর্পণে কিচেনের দরজার হ্যান্ডেলে হাত রাখে প্রথমা। শব্দ না করে দরজা খোলে। দরজা একটুখানি ফাঁক করে করিডোরে উঁকি মারে।

ফাঁকা করিডোর। কোত্থাও কেউ নেই। দুদিকের সব দরজা বন্ধ। করিডোরে বেরোয় প্রথমা। এমন সময় ফিমেল ডরমিটরির দরজা খুলে যায়! শিউরে উঠে ছুরি বাগিয়ে ধরে প্রথমা। দরজা খুলে বেরিয়ে এল মাঝবয়সি, সাদা থান পরা এক মহিলা। হাতের ইশারায় সে প্রথমাকে ডাকল।

‘কে আপনি?’ চেঁচিয়ে বলে প্রথমা। ‘গণেশদা কোথায়?’

‘এখানে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।’ মহিলা ফিসফিস করে বলে।

প্রথমা অবাক হয়ে বলে, ‘আপনি কে? সিন্টু কোথায়? ষষ্ঠী কোথায়?’

এক পা এগিয়ে আসে মহিলা, ‘এদিকে এসে নিজেই দেখে যাও।’

প্রথমা ছুরি তুলে বলে, ‘কে আপনি? ওদের কোথায় গায়েব করলেন?’ লম্বা করিডোরের শেষ প্রান্তে মহিলা ব্যথাহত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। প্রথমা দেখল, লম্বা করিডোরের আলোগুলো এক এক করে নিবে যাচ্ছে। মহিলা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

প্রথমা সিদ্ধান্ত নিল। এখান থেকে পালাতে হবে। এক্ষুনি। উলটো দিকে মুখ করে সে দৌড় দিল। পড়ে থাক হেল্পিং হ্যান্ড। পড়ে থাক গণেশদা, ষষ্ঠী, সিন্টু। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। করিডোরের শেষে দরজা। দরজার ছিটকিনি ভিতর থেকে লাগানো। অন্ধকারে ছিটকিনি খুঁজে টানাটানি করছে প্রথমা, এমন সময় মাথায় প্রবল জোরে আঘাত।

তারপর সব অন্ধকার।

কোল্টের বাঁট দিয়ে মেরেছে মেঘনাদ। পিস্তলটা এবার সোজা করে ধরল। একে একে সব আলো জ্বেলে দিল। পকেট থেকে মোবাইল বার করে বালাজিকে ফোন করে বলল, ‘রি-লাইফে যারা কাজ করে, যেমন মলিনা বা সুজাতা—এদের কে হায়ার করে?’

‘আমি। কেন? ওরা কিছু ভুলভাল করেছে নাকি?’

মলিনা আবার করিডোরে চলে এসেছে। তার দিকে কোল্ট তাক করে মেঘনাদ বলল, ‘না, না। সেরকম কিছু না। তুমি এদের কোথা থেকে জোগাড় করো?’

মলিনা হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইছে মেঘনাদের কাছে। বালাজি ফোনে বলছে, ‘খিদিরপুরে হেল্পিং হ্যান্ড নামে একটা এনজিও আছে। ওরা আয়া আর কাজের লোক সাপ্লাই করে। মেয়েগুলো চুরিচামারি করেছে নাকি? তাহলে হেল্পিং হ্যান্ডে খবর দিতে হবে। ওদের বস খুব কড়া। সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে দেবে।’

ঠান্ডা মাথায় মলিনাকে গুলি করল মেঘনাদ। এসব চালানোর অভ্যাস নেই। গুলি লাগল পেটে। সাদা থান রক্তে ভেসে যাচ্ছে। প্রবল চিৎকার করছে। এদিকে মরার নাম নেই। মলিনার কাছে গিয়ে রগে নল ঠেকিয়ে আর একবার গুলি করল মেঘনাদ। যাক! এতক্ষণে মরেছে। বডিটা ফিমেল ডরমিটরিতে ঢুকিয়ে দিল মেঘনাদ। ফোনে কথা চলেছে। বালাজি জিজ্ঞাসা করছে, ‘প্রথমারা কি হেল্পিং হ্যান্ডে লুকিয়ে রয়েছে?’

মেঘনাদ বলল, ‘প্রশ্ন কোরো না। চলে এসো।’ তারপর লাইন কেটে দিয়ে ডরমিটরির অবস্থা দেখল। গণেশ, ষষ্ঠী, এবং সিন্টু অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। তাদের পাশে মলিনার লাশ। ডরমিটরি থেকে বেরিয়ে মেঘনাদ করিডোরে পড়ে থাকা অজ্ঞান প্রথমাকে চুল ধরে টানতে টানতে ডরমিটরিতে ঢোকাল। সিন্টুর জ্ঞান ফিরছে। ঘড়ঘড়ে গলায় সে বলল, ‘গণেশদা…’

‘তোমার পাশেই আছি।’ জবাব দেয় গণেশ। মেঘনাদ এদের কথার মধ্যে না ঢুকে ঘর থেকে করিডোরে বেরিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়।

হেল্পিং হ্যান্ডে ঢোকা নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়েছিল ঢোকার পরে। মলিনাকে দেখে গণেশ দরজা খুলে দিয়েছিল। বলেছিল, ‘হঠাৎ এই সময়ে? কোনও ঝামেলা হয়েছে নাকি?’

মলিনার মুখচোখ দেখে গণেশের কিছু একটা মনে হয়েছিল। সে মলিনাকে হাত ধরে টেনে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করতে গিয়েছিল। পারেনি। গাড়ির পিছন থেকে একলাফে সামনে এসে, গণেশের পেটে কোল্ট ঠেকিয়েছিল মেঘনাদ। গণেশ মেঘনাদকে ভিতরে ঢুকতে দিতে বাধ্য হয়। অফিসে প্রবেশ করা মাত্র গনেশের মাথায় পিস্তলের বাঁট দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে দেয় মেঘনাদ। বাচ্চা ছেলেটা দরজা দিয়ে উঁকি মারছিল। তার মাথাতেও এক ঘা। কাজ শেষ।

‘এখানে আর কে কে আছে?’ মলিনার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে জানতে চেয়েছিল মেঘনাদ।

‘মোহনদা।’ কাঁপতে কাঁপতে বলেছিল মলিনা।

‘তুমি করিডোরে যাও। দেখে এসো ওরা কোন ঘরে আছে। বেচাল কিছু করলে গুলি করে মারব।’ পিস্তল নাচিয়ে বলেছিল মেঘনাদ।

তার কথার মধ্যে কিচেনের দরজা খুলে গিয়েছিল। ষষ্ঠী বেরিয়ে এসে মলিনাকে দেখে বলেছিল, ‘তুমি এখন এখানে? কী ব্যাপার?’ আর কিছু বলতে পারেনি। পিস্তলের বাঁটের আঘাতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

রইল বাকি এক। মানে প্রথমা। তার জন্য আলাদা প্ল্যান করেছিল। মলিনাকে পাখি পড়া করিয়েছিল, কী বলতে হবে। আর মলিনার কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল, এই বাড়ির সুইচবক্সটা কোথায়। মেঘনাদের থিয়োরি সিম্পল। মেয়েটাকে ভয় দেখাতে পারলে ও পালানোর চেষ্টা করবে। আর তাহলে এই দরজার কাছেই আসবে।

পরিকল্পনা মতো কাজ হয়েছে। মেঘনাদ খুশি। মলিনাকে এখানে না মারলেও হত। কিন্তু রাগ সামলাতে পারেনি। এর জন্যেই এত গণ্ডগোল।

কলিং বেল বাজছে। বালাজিরা এসেছে। দরজার দিকে এগোয় মেঘনাদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *