পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কলেজে যাইবে বলিয়া কাজল বইপত্র গোছাইতেছে, হৈমন্তী ডাকিয়া বলিল—হ্যাঁ রে, কলকাতার অবস্থা কেমন? শুনলাম লোকজন নাকি খুব পালাচ্ছে? ভট্টাচার্যপাড়ায় বকুলের বাবার যে বাড়িটা খালি পড়েছিল, সেটায় এক পরিবার এসে উঠেছে। এখানে থাকবে না বলেছে, আরও গায়ের দিকে চলে যাবে।
কাজল বলিল—আমি তো এখন পর্যন্ত ভয়ের কিছু দেখলাম না। লোজন কিছু গাঁয়ের দিকে পালিয়েছে ঠিকই, রাস্তাঘাট একটু ফাঁকা ঠেকে আগের চেয়ে। তবে অফিস কাছারি ঠিকই চলছে
—আমাদের এদিকে ভয়ের কিছু নেই, না?
–দুর! কোথায় রইল যুদ্ধ, কোথায় আমরা! যারা পালিয়েছে তারাও ফিরলো বলে, দেখ না।
একদিন কলেজ হইতে ফিরিবার সময় কাজল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইবার খবর পায়। শেয়ালদূহের মোড়ে খবরের কাগজের হকার হাঁকিতেছে—টেলিগ্রাম! টেলিগ্রাম! বহুলোক ভিড় করিয়া পড়িতেছে এবং সরব আলোচনা করিতেছে। একখানা কিনিয়া কাজল পড়িয়া দেখিল। পোলিশ করিডর দাবি করিয়া হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করিয়াছেন। যুদ্ধ শুরু হইয়াছে।
ক্রমে কলিকাতার চেহারা পালটাইল। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় কালো ঠুলি পরাইয়া দেওয়া হইল। এ. আর. পি. বাড়ি বাড়ি ঘুরিয়া নাম ধাম লিখিয়া লইতে লাগিল, প্রয়োজনীয় উপদেশ দিতে লাগিল। অন্ধকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটিতে কাজলের মনে একটা বিশ্রী ভাব যেন চাপিয়া বসিত। শীতকালে সন্ধ্যা হয় বিকাল শেষ হইতে না হইতেই। কলেজ হইতে বাহির হইয়া কাজল দেখিত, বিশাল শহরের উপরে দুঃস্বপ্নের মতো অন্ধকার চাপিয়া বসিতেছে।
মালতীনগরে বিশেষ পরিবর্তন হয় নাই। কাঠালিয়ার কাছে একটা বিরাট মাঠ সৈন্যেরা কাটাতারে ঘিরিয়া সেখানে রাইফেল প্র্যাকটিস করে। সাধারণের সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
সকালে উঠিয়া শোনা যায়। দূর হইতে রাইফেলের আওয়াজ আসিতেছে। সুন্দর সকাল। জানালার পাশে গিরগাছায় সকালের রোদূর আসিয়া পড়িয়াছে, এটা টুনটুনি পাখি বার বার ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার ডালে আসিয়া বসিতেছে। মিষ্টি আমেজের ভিতর রাইফেলের শব্দে কাজলের মেজাজ খারাপ হইয়া যায়। তাহার জীবনের সহিত বন্দুকের শব্দ মাই খাপ খায় না।
একদিন রাস্তায় আদিনাথবাবুর সহিত দেখা হইয়া গেল। সে প্রণাম করিয়া বলিল—ভালো আছেন সার?
আদিনাথবাবু কাজলকে জড়াইয়া ধরিলেন, বলিলেন—তুই কেমন আছিস অমিতাভ? তোর চেহারা বড় খারাপ হয়ে গেছে, অসুখবিসুখ করেছিল নাকি?
–না সার।
—তবে এমন চেহারা কেন?
কাজলের মনে হইল আদিনাথবাবু তাহার মনের কথা বুঝিবেন, তিনি তাহাকে সমাধানের পথ বলিয়া দিতে পারিবেন। কিন্তু বলিতে গিয়া দেখিল, জিনিসটা সে সহজে প্রকাশ করিতে পারিতেছে না। জীবনের কোনো অর্থ নাই, একথা ভাবিয়া তাহার বয়সী একটি ছেলের রাত্রে ঘুম হইতেছে না, ইহা রীতিমত হাস্যকর। এই কথা ভাবিয়া শরীর খারাপ হওয়া নিঃসন্দেহে অন্যদের কাছে অবিশ্বাস্য। সে বলিল—আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না সার। ছোটবেলা থেকে যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি, তার সঙ্গে আমার মন যেন আর খাপ খাচ্ছে না।
–পরিষ্কার করে বল।
-সার, এত দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকার মানে কী? এত কষ্ট করে পড়াশুনা করা, জীবনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, জীবনকে ভালোবাসা-এর কী অর্থ? মৃত্যুর পর তো একটা ভয়ানক অন্ধকার আমাদের গ্রাস করে নেবেই।
মালতীনগর স্টেশনের লোকের ভিড়ে ব্যাগ হস্তে আদিনাথবাবুর সামনে দাঁড়াইয়া কথাটা ভীষণ নাটকীয় শোনাইল। কাজল বুঝিতে পারল, বিষয়টা সে পরিষ্কার করিতে পারে নাই কিছুটা ফঁকা আওয়াজ হইয়াছে।
কিন্তু আদিনাথবাবুর মুখ আস্তে আস্তে গম্ভীর হইল। কাজলের কাঁধে হাত দিয়া বলিলেন—চ, কোনো জায়গায় বসে কথা বলি।
স্টেশন ছাড়াইয়া নির্জন পথে পড়িয়া বাঁধানো কালভার্টের উপব আদিনাথবাবু বসিলেন। বলিলেন–বোস আমার পাশে।
কাজল বসিল।
কিছুক্ষণ আদিনাথবাবু কথা বলিলেন না, ব্যাগটা পায়ের কাছে নামাইয়া চুপচাপ বসিয়া রহিলেন। কাজলও পাশে বসিয়া রহিল। সময় কাটিতেছে, কাহারও যেন কথা বলিবার চাড় নাই।
আদিনাথবাবু হঠাৎ কাজলের দিকে তাকাইয়া গম্ভীর স্বরে মন্ত্র পড়িবার মতো করিয়া বলিলেন—তোর জীবনের সুখ একেবারে চলে গেছে অমিতাভ, আর কখনও আসবে না।
কাজল চমকাইয়া উঠিল। কথাগুলি তাহার বুকের গভীরে যেন তীক্ষমুখ শলাকার মতো বিধিয়া গেল। মাস্টারমশাই ঠিকই বলিয়াছেন—তাহার মতো করিয়া আর কে বুঝিয়াছে যে সুখ আর কখনও আসিবে না? সঙ্গে সঙ্গে কাজলের মেরুদণ্ড বাহিয়া একটা ভায়ের স্রোত নিচে নামিয়া গেল। যে অসুখ শুরু হইয়াছে, তাহা কখনও সারে না।
—অমিতাভ।
—সার?
আদিনাথ বলিলেন-যে চিন্তা করে, তার জীবনে কখনও সুখ আসে না। তুই জীবনের একেবারে আসল জায়গায় ঘা দিয়েছিস। ভাবতে অবাক লাগছে, এত অল্প বয়সে তুই এই চিন্তা পেলি কোথা থেকে।
—একটা কথা বলব সার?
–বল্?
–কী মনে হয় আপনার জীবন সম্বন্ধে? আপনি কি বিশ্বাস করেন মৃত্যুতেই জীবনের শেষ?
–সত্যি উত্তর দেবো?
–তা নইলে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করবো কেন?
-আমার কিছুই মনে হয় না। অনেকদিন আছি পৃথিবীতে, কিছুই বুঝতে পারলাম না। সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগেই আমার চিন্তাশক্তি নিঃশেষ হয়ে গেল। এখন আমি দেনায় জর্জরিত ভবিষ্যৎহীন বৃদ্ধ। আমার এই বর্তমানের চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে? তবুও অমিতাভ আমার মন চায়, একটা কিছু অর্থ থাকুক এ-সবের। কিন্তু আমি জানি, সমস্ত জিনিসটা signifies nothing কেবল sound অমিতাভ, কেবল fury, আর কিছু নয়।
অকস্মাৎ আদিনাথবাবু হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। হাসিতে হাসিতে বলিলেন-ওসব চিন্তা একদম বাদ দিয়ে দিয়েছি। এককালে খুব ভাবতাম, বুঝলি? এখন তোদর জন্যই বেঁচে আছি বলতে পারিস। তোরা মানুষ হবি, বড়ো হবি—বিশ্বাস কর, আমার খুব ভালো লাগবে দেখতে।
-আপনি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন সার?
–তুই বিশ্বাস করিস?
–করতে ইচ্ছা হয়, পারি না।
–কেন?
–বুদ্ধি দিয়ে যাচাই করে দেখলে কোনো মানে হয় না বলে।
–বুদ্ধি দিয়ে যা বোঝা যায় না, তা মিথ্যে?
—তাকে হৃদয় দিয়ে মেনে নেওয়া যায়, বাস্তবে স্বীকার করা যায় না।
—স্বীকার না করায় বাহাদুরি কী অমিতাভ? তাতে তো শুধু কষ্ট—
–কষ্ট তো বটেই মাস্টারমশাই। স্বীকার না করায় কিছু বাহাদুরি নেই, আমি বিশ্বাস করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। কিন্তু বুদ্ধিতে বাধা দেয় যে।
–অমিতাভ, আমি তোকে আশীর্বাদ কবি, তোব জীবনে যেন বিশ্বাস আসে, তুই যেন কখনও পরাজিত না হোস।
–শুধু বিশ্বাস দিয়ে কী হবে সার, যদি আসলে কোনো অর্থ না থাকে? শূন্যতায় বিশ্বাস করা কি নিজেকে ঠকানো নয়?
আদিনাথবাবু কাজলের কাঁধে হাত দিয়া একটা ঝাকুনি দিলেন, তারপর বলিলেন—তবু সে নিছক sound আর fury থেকে ভালো। বড় হয়ে তোর মনে হবে, বিশ্বাসের একটা মূল্য আছে। মনে হবেই, দেখিস।
আদিনাথবাবুর সঙ্গে কাজলের এই শেষ দেখা। এর কিছুদিন বাদেই র্তাব মৃত্যু হয়। ব্যোমকেশ হঠাৎ আসিয়া খবরটা দিয়াই আবার চলিয়া গিয়াছিল।
রাত্রে বিছানায় শুইয়া পরদিন আদিনাথবাবু আর ঘুম হইতে ওঠেন নাই। ঘুমের ভিতরেই তাহার মৃত্যু হইয়াছিল। সংসারের জন্য এক পয়সাও বাখিয়া যাইতে পারেন নাই, কিন্তু দেনা পাই পয়সা পর্যন্ত মিটাইয়া দিয়াছিলেন।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের পয়লা সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। ৩রা সেপ্টেম্বর ব্রিটেন এবং ফ্রান্স যুদ্ধে নামিল। ১৮ই সেপ্টেম্বরের ভিতর পোল্যান্ডের পতন হইল। ওয়ারশ-তে নাজী বাহিনীর এমুনিশন বুটের শব্দ শোনা যাইতে লাগিল।
প্রথমদিকে কাজল কলিকাতায় বিশেষ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখে নাই। কিন্তু যত দিন যাইতে লাগিল, মানুষ ততই দিশাহারা হইয়া পড়িল। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে জাপান হঠাৎ পার্ল হারবার আক্রমণ করায় আমেরিকা যুদ্ধে নামিল। ইহার কিছুদিন বাদে ব্রহ্মদেশের পতন হওয়ায় ভারতবর্ষ অনুভব করিল, বিপদ একেবারে ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। শুরু হইল বা বিনা ঘাড়ে গ্রামের দিকে সদলে পলায়ন। তাড়া খাওয়া প্রাণীর মতো অবস্থা।
অনেক সময় কাজলের ক্লাস করিতে ভালো লাগত না। পরমেশের সঙ্গে রাস্তায় ঘুরিতে ঘুরিতে তাহার মনে হইত, মানুষ মোকা যুদ্ধ করে মরছে কেন? এমনিই তো মরবে কদিন বাদে।
সে বলিত-পরমেশ, যুদ্ধ বড়ো বীভৎস আর অর্থহীন, না?
—হয়তো তাই, কিন্তু যুদ্ধেরও যে অনেক সৃষ্টিশীল দিক আছে। কলকারখানা বাড়ছে, নতুন নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। কত প্রথম শ্রেণীর সাহিত্য সৃষ্টি হবে হয়তো পরে। প্রথম মহাযুদ্ধের ফসল যেমন রেমার্ক, রুপার্ট ব্রুক–
–ভালো সাহিত্যের জন্য, নতুন আবিষ্কারের জন্য কি মানুষ মারতে হবে?
পরমেশ হাসিল। বলিল—তুমি নিজেই বলে থাকো জীবনের কোন অর্থ হয় না, জীবনটা দীর্ঘদিন ধরে ক্লান্ত হবার একটা পন্থা মাত্র। মানুষের জীবন থাকলে কী গেল, তাতে তোমার দুঃখিত হবার কারণ নেই।
কাজল ভাবিয়া দেখিল, পরমেশ ঠিকই বলিয়াছে। তাহার দর্শন অনুযায়ী যুদ্ধে মন-মরা হইবার কারণ নাই।
অথচ এ কথাও ঠিক যে, সে হাঁপাইয়া উঠিয়াছে। কলিকাতার আলোকহীন নিপ্রাণ সন্ধ্যা, লোজনের পলায়ন, প্রতিদিন যুদ্ধের নূতন নূতন নারকীয় সংবাদ তাহার মনে এত অবসাদ আনিয়াছে যে, আই-এ পরীক্ষায় যেমন করা উচিত ছিল, তাহা সে পারে নাই। পরীক্ষার হলে বসিয়া অনেকবার কাগজ জমা দিয়া উঠিয়া আসিবার কথা ভাবিয়াছে, কিন্তু মায়ের কথা ভাবিয়া পারে নাই।
মায়ের আশা সে বড়ো হইবে। টাকার দিক দিয়া নহে, যশের দিক দিয়া। রাত্রে শুইয়া সে বাচ্চা ছেলের মতো মায়ের বুকে মুখ খুঁজিয়া থাকে। সারাদিনের চিন্তার পরিশ্রমে ক্লান্ত মস্তিষ্ক তাহাতে বিশ্রাম পায়। পৃথিবীর বড়ো বড়ো ফাঁকির ভিতরে মায়ের ভালোবাসাই তাহার কাছে একটুকু সার পদার্থ বলিয়া বোধ হয়। প্রায় রাত্রে দুইজনে নিশ্চিন্দিপুরের গল্প করে, মৌপাহাড়িব গল্প করে। গল্প কিছুক্ষণ চলিবার পর কাজল টের পায়, মা কাঁদিতেছে। তখন সে বলে—মা, তোমার ছোটবেলার গল্প বলল।
হৈমন্তী কাজলকে বুকের কাছে লইয়া মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে তাহার রঙিন শৈশবের গল্প করে।
ভারি সুন্দর ছিল সে সমস্ত দিন। কত জায়গায় সে ঘুরিয়াছে বাবার সঙ্গে। এক জায়গায় সংসার পুরাতন হইতে না হইতেই সব কিছু গুটাইয়া আবার নূতন স্থানে যাত্রা শুরু হইত। জামালপুরে তাহাদের পাশের বাড়ির সেই সুমিত্রাদি কী ভালোই না বাসিত তাহাকে! স্বামী রাত্রে মদ খাইয়া বাড়ি ফিরিত, হুঁশ থাকিত না। সুমিত্রাদি জামাকাপড় ছাড়াইয়া বিছানায় শোয়াইয়া বাতাস করিয়া ঘুম পাড়াইত। একদিন অভিযোগ করিতে গিয়া কী মারটাই না খাইয়াছিল স্বামীর হাতে! হৈমন্তীকে ডাকিয়া সে একদিন গহনাপত্র দেখাইয়াছিল। শখ করিয়া কত কিছু গড়াইয়াছিল সুমিত্রাদি, খুব শখ ছিল ভালো করিয়া সংসার করিবে। হয় নাই। মাতাল, অপদার্থ স্বামী কোথা হইতে আর একজনকে বিবাহ করিয়া আনিল। কয়েকদিন বাদে সুমিত্রাদি গেল পাগল হইয়া। তাহাকে বাপের বাড়ি পাঠাইয়া দেওয়া হইল। সুমিত্রাদি আর সারিয়া উঠে নাই, তাহার সংসার করিবার সাধ পূর্ণ হয় নাই।
—তখন ভারি টক খেতে ভালোবাসতাম, জানিস বুড়ো। আমি আর দিদি সারাদিন এ বাগানে ও-বাগানে ঘুরতাম চালতে করমচার খোঁজে। এক বুড়োর বাগানে লুকিয়ে ঢুকেছিলাম। বুড়ো দেখতে পেয়ে আমাদের ডেকে বলললুকিয়ে নিচ্ছ কেন খুকিরা, যত ইচ্ছে নিয়ে যাও, কেউ কিছু বলবে না। কোথায় থাকো মা তোমরা?
মায়ের জন্য কাজলের দুঃখ হয়। মা জীবনে কিছু পায় নাই। কত অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছে, এখন পুরাতন স্মৃতি মন্থন করিয়া দিন কাটায়। বাবা মারা যাইবার পর হইতে কী-ই বা রহিয়াছে। একটা বড়ো রকমের কিছু করিয়া মাকে খুশি করিতে হইবে। সে বলে—একটা গল্প শুনবে মা?
-কী গল্প রে খোকন?
সে ফিয়োদর সোলোগাব-এর ‘দি হুপ’ গটা মাকে বলে। সোলোগা এমন কিছু বড়ো সাহিত্যিক নন। কিন্তু গল্পটা তাহার খুব ভালো লাগিয়াছিল। আশি বছরের এক বৃদ্ধের গল্প। মায়ের সহিত বাচ্চাকে হাঁটিয়া যাইতে দেখিয়া বৃদ্ধের শিশু হইতে ইচ্ছা করিয়াছিল। বাচ্চাটি বেশি দূরে গিয়া পড়িলেই মা ডাকিয়া বলিতেছে–ওদিকে যাস নে, পড়ে যাবি। পরের দিন বৃদ্ধ কাজ কামাই করিয়া সারাদিন বালকের মতো নির্জন পাহাড়ের ধারে খেলিয়া বেড়াইল। বৃদ্ধের কেহ ছিল না। শৈশবে সে মায়ের স্নেহ পায় নাই। অশক্ত শরীরে পাহাড়ের পথে দৌড়াইতে দৌড়াইতে কেবল তাহার মনে হইতেছিল, মা পিছন হইতে সাবধান করিয়া দিতেছে—ওদিকে যাস নে, পড়ে যাবি।
সম্বলহীন আত্মীয়হীন বৃদ্ধের গল্পটা কাজলের মনে দাগ কাটিয়াছিল। বলিতে বলিতে সে বিছানার উপর উঠিয়া বসিল। শেষ দিকটায় তাহার গলার কাছটায় একটা কান্না আটকাইয়া যাইতেছিল। অবাক হইয়া সে লক্ষ করিল, জীবনের অর্থহীনতা আবিষ্কারের পরেও সে জীবনকে কত ভালোবাসে। অরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল—কত লোক জীবনে কিছু না পেয়েই মবে যায় মা!
হৈমন্তী তাহাকে কাছে টানিয়া বলিল–ওমা বুড়ো, তুই কাঁদছিস? তুই না বি. এ. পড়িস? বই পড়ে কান্না!
–আমি মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য একটা কিছু করবো, দেখে নিয়ো। সারাজীবন যারা কষ্ট পায়, চোখের জলে ডুবে থাকে, আমি তাদের নতুন পৃথিবী তৈরি করে দেবো।
-আমি জানি বাবা, তুই পারবি।
–বি. এ.-টা দিয়ে আমি চাকরি নিয়ে চলে যাবো কোনো নির্জন জায়গায়। মৌপাহাড়ি স্কুলে মাস্টারি করবে হয়তো। তুমি আমার সঙ্গে যাবে তো মা?
–তোকে ছেড়ে কোথায় থাকব বুড়ো? তুই তো আমার সব।
-আমি বেশি টাকাপয়সা দিতে পাবো না মা, কিন্তু তোমাকে শাস্তি দিতে পারবো। তাতে তুমি তৃপ্তি পাবে না?
–আমার কিছু চাই নে। কীর্তিমান স্বামী পেয়েছি, পুত্র যদি বিদ্বান হয়, তবে আমার সমস্ত পাওয়া হবে।
কাজল আবার শুইল বটে, কিন্তু ঘুম আসিল না। বলিল—মা, আমার একদম ভালো লাগছেন এই জীবন। পড়াশুনো হয়ে গেলেই বেরিয়ে পড়ব যেখানে হোক। এই তো আর কদিন পর থেকে মাঠে শিশির পড়তে শুরু করবে। বাত্তিবের পরিষ্কার আকাশে ঝকঝক করবে নক্ষত্র। পৃথিবীটা আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমি বাইরে বেরুব মা, আমি কিছুতেই ঘরের কোণে সারাজীবন কাটাব না।
—তোর বাবার রক্ত রয়েছে যে তোর শরীরে, কে তোকে আটকাবে খোকন?
–বাঁচতে গেলে বিশ্বাস লাগে, তা কেন পাই না?
–ঈশ্বরে বিশ্বাস?
–শুধু ঈশ্বরের নয়, জীবনের বিশ্বাস।
—বিশ্বাস আসবে, দেখতে পাবি। মনটা খুব উদার খুব বড়ো করে রাখিস, যাতে সুখ-দুঃখ সবই সেখানে ধরে। দেখবি, দুঃখ আর সুখ তুল্যমূল্য হয়ে গেছে-দুঃখের জন্য আর কষ্ট নেই।
কাজলের মনে হইল, মা এইভাবে দুঃখকে জয় করিয়াছে। সুখ আর দুঃখের বিরাট ভার মনের ভিতর জমা করিয়া দুইটাকে এক করিয়া দেখিতে সক্ষম হইয়াছে মা। এইটাই মায়ের স্থৈর্যের মূল কথা।
পরমেশ বলিল—কী অমিতাভ, চুপ করে আছ যে?
কাজল মুখ তুলিয়া তাহার দিকে তাকাইতে সে অবাক হইল। পূর্বের সে আশাহত পাণ্ডুর ভাবটা কাটিয়া গিয়া নূতন একটা উদ্যমের আলো কাজলের মুখে প্রতিফলিত হইয়াছে। চোখ দুইটা চকচক করিতেছে।
-তোমাকে বেশ উত্তেজিত বলে মনে হচ্ছে।
—পরমেশ, আমি বোধহয় ভুল করছিলাম। জীবনের অর্থ হয়তো সত্যিই নেই—আমার এক মাস্টারমশাই বলতেন, জীবন শুধুই sound আর fury, আর কিছু নয়। শেকপীয়রই হয়তো ঠিক, তবু বেঁচে থাকার মানে একটা খুঁজে বের করবোই পরমেশ। লোক ভুলোনো দর্শন নয়, বাস্তব একটা কিছু দিয়ে যাবো–
পরমেশ কাজলের হাত চাপিয়া ধরিল।
–আমি বিশ্বাস করি অমিতাভ, তা তুমি পারবে
-আমাকে দূরে চলে যেতে হবে মানুষের থেকে, আরও বেশি করে মানুষের ভেতরে ফিরে আসার জন্য। আমি পেছনে হাঁটবো পরমেশ।
দুইজনে হাঁটিয়া মিউজিয়ামে গেল। পরমেশ জানে, কাজল সঙ্গে থাকিলে মিউজিয়াম দেখার আনন্দ আলাদা। বেলা গড়াইয়া বিকালের দিকে ঝুঁকিয়াছে। মিউজিয়ামে লোক প্রায় নাই বলিলেই হয়। বড়ো বড়ো মূর্তি এবং দুষ্প্রাপ্য অনেক বস্তু বোমার ভয়ে মাটির নিচে পুঁতিয়া ফেলা হইয়াছে। ঘরগুলি কেমন ন্যাড়া ন্যাড়া লাগে।
পরমেশ বলিল—অনেক কিছু নেই, রিপ্লেসড লেখা টিকিট পড়ে আছে।
–ইউনিভার্সিটিও বহরমপুরে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে, জান না?
বহুদিন বাদে কাজলের মনে আবার পুরাতন আনন্দটা ফিরিয়াছে। মিউজিয়াম হইতে বাহির হইয়া দেখিল রৌদ্র পড়িয়া গিয়াছে, শীতকালের বেলা নাই বলিলেই চলে। গেটের সামনে ফুটপাতের উপর ইটের বেড় দিয়া ঘেরা কৃষ্ণচূড়া গাছ। তাহার ডালগুলি অস্তদিগন্তের পটে আঁকা বলিয়া মনে হইতেছে। বাতাস নাই, সব নিঝুম। সন্ধ্যার কেমন একটা বিষণ্ণতা–তাহাদের দিকে তাকাইয়া বুঝি ওষ্ঠে তর্জনী রাখিয়া চুপ করিতে সঙ্কেত করিতেছে।
পাতলা জামা গায়ে কাজলের শীত করিতেছিল। ফিরিতে এত দেরি হইবে, তাহা সে বুঝিতে পারে নাই। পরমেশকে বলিল—চলো, রাত হয়ে এলো।
ধর্মতলা মোড়ে একটা বাচ্চা মেয়ে, নোংরা জামা পরা, কাজলের গায়ে ধাক্কা খাইল। কাজলের হাত হইতে বইখাতা ধুলায় পড়িয়া গেল। পালায নাই মেয়েটি, ভয়ে পালাইতে পারে নাই। আতঙ্কে কেমন যেন হইয়া গিয়া তাহার দিকে তাকাইয়া আছে। বয়স বেশি নহে, নয় কী দশ হইবে হতদরিদ্রের চেহারা, কিন্তু চোখ দুটি উজ্জ্বল। কাজলের হঠাৎ ওল্ড কিউরিওসিটি শপ-এর ডিক সইভেলারের ছোট্ট বান্ধবীটির কথা মনে পড়িল। কাজল ভাবিল-ও ভেবেছে, আমি ওকে বকবো। কী সুন্দর চোখ দুটো ওর!
মেয়েটির হাতে একখানি একআনা দামেব পাঁউরুটি, এইটি কিনিতেই সে আসিয়াছিল, রাস্তা পার হইয়া ফিরিবার সময় ধাক্কা লাগিয়াছে। পাঁউরুটি শক্ত করিয়া ধরিয়া মেয়েটি কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। মেয়েটির চোখ, পাউরুটি আঁকড়াইয়া ধরিবার ভঙ্গি, সন্ধ্যাবেলার বিষণ্ণতা, সব মিলাইয়া কাজলের মনে একটা ঢেউ তুলিল—মেয়েটির চোখে চোখ রাখিয়া সে হাসিল। মেয়েটি হাসিল না।
কাজল বলিল–তোমার নাম কী খুকি? কোথায় থাকো?
উত্তর না দিয়া মেয়েটি রাস্তার ওপাবে তাকাইল, সেখানে এক অন্ধ ভিখারি ঘোড়ার জল খাইবার চৌবাচ্চার কিনারায় বসিয়া আছে। কাজল বলিল–ও কে হয় তোমার–বাবা?
মেয়েটি ঘাড় নাড়িল। কাজল পকেট হইতে একটা আনি বাহির করিয়া বলিল—এটা তুমি নাও।
মেয়েটি কিছুতেই লইবে না। অনেক সাধ্যসাধনার পর হাত হইতে আনিটা লইয়া সে সংকুচিতভাবে হাসিল, তারপর হঠাৎ ফিরিয়া লোহার চৌবাচ্চাটা লক্ষ করিয়া দৌড় দিল।
ট্রেনে জানালার পাশে বসিয়া কাজল সমস্ত রাস্তা ভাবিতে ভাবিতে চলিল। ঠাণ্ডা বাতাসে হাড়ের ভিতর কাঁপন ধরে। গলা বাড়াইলে দেখা যায় কালপুরুষমণ্ডলীর বেটেলজয়ুস নক্ষত্রটা লালচে আভায় ঝকঝক করিতেছে।
কাহারা গোপন ছাউনির নিচে আগুন করিয়া হাত-পা সেঁকিতেছে। হাওয়ায় শীতের ঘ্রাণ, পোড়া ডালপালার ঘ্রাণ। বোমারু বিমানের ভয়ে উন্মুক্ত স্থানে আগুন জ্বালায় নাই।
ট্রেনের এঞ্জিন হইতে বারদুয়েক হুইস্লের শব্দ ভাসিয়া আসিল।
(কাজলের ডায়েরি থেকে)
গতকাল আমাদের একজন অধ্যাপক না আসায় একটা পিরিয়ড ছুটি পাওয়া গেল। পরমেশ লাইব্রেরিতে বসে পড়ছিল, তাকে না ডেকে আমি একাই একটু হাঁটছিলাম রাস্তায়।
অন্যমনস্ক ভাবে চলতে চলতে ভেবে দেখলাম, আমার ভেতরে যে দ্বন্দ্বটা চলছে সেটা মোটেই আকস্মিক নয়। ছোটবেলা থেকেই ধীরে ধীরে পরিপক্ক হয়ে উঠেছিল, হঠাৎ একদিন বেরিয়ে পড়েছে। আমার সমস্যা অন্যের কাছে অবাস্তব, কিন্তু আমার কাছে অন্ধকারের ভেতর প্রজ্বলন্ত আগুনের মতো বাস্তব ও প্রত্যক্ষ। চিন্তার একটা বিশেষ ধাপ পর্যন্ত এসে আটকে গেছি আমি, মৃত্যুকে অতিক্রম করতে পারছি না। হয়তো কেউই তা পারে না।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, চলা বন্ধ করে আমি সামনের তেতলা বাড়ির ছাদের ওপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবছি। চোখ নামিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করবো, দেখি রাস্তার ওপারে মিষ্টির দোকানে গোলমাল-বোগামতো একটা লোকের ঘাড় ধরে বিশালদেহ দোকানদার ঝাকুনি দিচ্ছে, আর একজন তার কাপড়চোপড়ের ভেতর হাতড়ে কী খুঁজছে। রোগা লোকটি হাতজোড় করে কী বলতে গেল—দোকানদার মারল তাকে এক রদ্দা, ছিটকে সে ফুটপাথে গিয়ে পড়ল।
ভারি খারাপ লাগল ব্যাপারটা। হাত জোড় কবে লোকটা কী বলতে চাইছে, কেউ শুনছে না। রাস্তা পেরিয়ে ওপারে গেলাম—ততক্ষণে সে এক হাতে ভর দিয়ে উঠে বসেছে। থমকে গেলাম আমি, দেখলাম লোকটি রামদাস বৈষ্ণব। রামদাস বৈষ্ণবকে এরা মারছে।
-রামদাস কাকা!
রামদাস চমকে আমার দিকে তাকাল। কী চেহারা হয়ে গিয়েছে তার। চোখের নিচে গভীর কালি, চুল লালচে, উস্কোখুস্কো। শরীর শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। মারের চোটে এখনও সে অল্প অল্প কাপছে।
রামদাস আমায় চিনতে পেরেছে। পুরোনো দিনের মতোই খুশি-খুশি গলায় বলে উঠলো বাবাজী, তুমি!
দোকানদার এবং তার দুই সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম—কী হয়েছে? আপনারা মারছেন কেন একে?
দোকানদার খিচিয়ে উঠল—মারবে না তো কি সিংহাসনে বসিয়ে পুজো করবে? চারআনার জিলিপি খেয়ে এখন বলছে পয়সা নেই! শালা ইয়ের বাচ্চা–
ইতর কথা এবং তাদের মুখচোখের ইতর ভাব দেখে আমার এত খারাপ লাগলো! বললাম–বৈষ্ণবকে মারতে হাত উঠলো আপনার? আবার গালগালও দিচ্ছেন–
-যান যান মশাই, অমন অনেক বোষ্টম দেখেছি। ভেক নিলেই বোষ্টম হয় না, ওসব লোক ঠকাবার ফন্দি–
রামদাসকে জিজ্ঞাসা করলাম–কী হয়েছে রামদাস কাকা?
রামদাস তখন দাঁড়িয়ে উঠেছে। বলল–গেঁজেতে পয়সা রেখেছিলাম। কখন পড়ে গেছে বুঝতে পারিনি। সারাদিন ঘুরছি তো রাস্তায় রাস্তায়। তুমি তো জানো বাবাজী, পয়সা নেই জানলে আমি একদানাও মুখে দিতাম না এখানে–
দোকানদারের লোক বলল—ওরে আমার ধার্মিক যুধিষ্ঠির রে!
তাকে থামিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম-কত পয়সা আপনাদের? চার আনা? এই নিন, ছেড়ে দিন একে। চলো রামদাস কাকা–
রামদাস বলল—আমার একটা থলে ওরা রেখে দিয়েছে। একটা দোতারা ছিল সঙ্গে, সেটা ভেঙে দিয়েছে–
দোকানদার ভেতর থেকে দোতারা এবং একটা ছেঁড়া ক্যাম্বিসের থলে এনে দিলে। খানিকদূর এসে দোতারায় হাত বুলিয়ে রামদাস বললো—এটা একদম ভেঙে দিয়েছে বাবাজী। তারগুলো ছিঁড়ে দিয়েছে, আর বাজানো যাবে না
থলের ভেতর হাতড়ে খঞ্জনীটা বের করল সে, হেসে বলল–এটা নেয় নি। যাক, একটা তবু রইলো
খঞ্জনী বাজিয়ে সে তার অভ্যেসমতো হাসলো। বলল—জয় গুরু, জয় গুরু!
-তুমি হাসছ রামদাস কাকা! তোমাকে ওরা অপমান করল, মারল—তার পরেও হাসছো?
–হাসবো না কেন? দুঃখ করার সময় কোথায় আমার?
—ওদের ওপর রাগ হচ্ছে না?
—না বাবাজী, সত্যি বলছি—ওরা যদি বুঝতো খারাপ কাজ, তাহলে কি আর মারত আমাকে? না বুঝে যা করেছে তার জন্য ওদের আমি দোষ দেব না। গুরু ওদের ভালো করুন।
–তুমি বড়ো ভালো মানুষ রামদাস কাকা। আমরা হলে অপমান সইতে পারতাম না।
মার খাওয়াটা যেন ভারি একটা মজার ব্যাপার, রামদাস এমনিভাবে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল–একটা কথা তো তোমায় বলা হয়নি বাবাজী, আমার যক্ষ্মা হয়েছে।
যক্ষ্মা রামদাসের! সে কথা এতক্ষণ না বলে দিব্যি হাসছিল সে!
—কী বলছো রামদাস কাকা! যক্ষ্মা?
–হ্যাঁ, বাবাজী। ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম কলকাতায়। গাঁয়ের ডাক্তার বললো শহরে গিয়ে দেখাতে। হাসপাতালে হাঁ করে বসেছিলাম সারাদিন, আমার ডাক আসার আগেই ডাক্তারের রুগী দেখার সময় পেরিয়ে গেল। চাপরাসী বলেছে, কাল যেতে। কাল যাব আবার–
–রাত্তিরে থাকবে কোথায়?
—শুয়ে পড়ব রাস্তার ধারে কোথাও কাপড় মুড়ি দিয়ে। রাস্তায় শুলে তো মারবে না।
এই হিমবর্ষী রাতে রামদাস অচেনা শহরের ফুটপাতে শুয়ে থাকবে, খাওয়া মিলবে কিনা ঠিক নেই। তা সত্ত্বেও সে হাসছে।
—তুমি আমার সঙ্গে চলো রামদাস কাকা, আমাদের বাড়ি চলল। আমি তোমায় ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করে দেবো।
খঞ্জনী বাজাতে বাজাতে রামদাস বললো–তা হয় না। কালব্যাধি হয়েছে, বড্ড ছোঁয়াচে। এ রোগ আমি তোমার বাড়িতে ছড়াতে পারবো না। এই জন্য দোকানেও আজকাল শালপাতায় খেয়ে আঁজলা ভরে জল খাই। এঁটো গেলাসে থালায় খেয়ে অন্য লোকের যদি অসুখ করে!
কিছুতেই সে যেতে রাজি হলো না। পকেট থেকে তিনটে টাকা (এ ছাড়া আমার কাছে আর ছিল না) বের করে বললাম—টাকা কটা তোমায় নিতে হবে। কোনো আপত্তি শুনবো না-তোমার এখন টাকার দরকার।
আমার দিকে তাকিয়ে রামদাস একটুখানি ভেবে তারপর বলল–দাও।
—থলের ভেতরে কিছুতে বেঁধে রাখো, আবার না হারায়।
কাপড়ের খুঁটে সে শক্ত করে বেঁধে নিল। বাঁধবার সময় ফাঁস করে একটু ছিঁড়ে গেল কাপড়টা। রামদাস মুখ তুলে অপ্রতিভ ভাবে হেসে বলল–বড্ড পুরোনো কিনা।
-আবার দেখা কোরো, আমাদের বাড়িতে যেয়ো কাকা।
–যদি গুরু টেনে না নেন, নিশ্চয়ই যাবো খোকন।
–আমাকে খোকন বলছে, আমি কিন্তু আর ছোট নেই।
রামদাস হেসে স্নেহপূর্ণ চোখে আমার দিকে তাকাল। একটা হাত আমার কাঁধে রেখে কী বলতে গিয়ে হাতটা সরিয়ে নিল। বলল—তোমাকে না ছোঁয়াই ভালো। যদি তোমার যক্ষ্মা হয়।
তাকিয়ে দেখলাম, ভবঘুরে রামদাস গুনগুন করে গান করতে করতে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। জানি না, তার সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা।