ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
বড় মামা বলেছিলেন উঠোন ভরা জ্যোৎস্নার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। পূর্ণিমার চাঁদকে রুটি বলাতে কানামামু জলচৌকিতে বসা কানামামু সোহরাব রুস্তমের গল্প থামিয়ে বড়মামার কথায় থেমে, হেসে–কে খাইতে চায় রুটি, কার পেটে এত ক্ষিদা! জিজ্ঞেস করেন।
–হাজার হাজার গরিব মরে না খাইয়া।
বড়মামা খড়ম পায়ে খট খট হেঁটে উঠোনে, বলেন।
কেউ যেন শুনতে না পায় বলেছিলাম
–পেড়ে দাও চাঁদরুটি, কিছু খাবো, বাকিটুকু বস্তিতে বিলাবো।
কানা মামুর কান খাড়া। বললেন–সবাই কবি হইয়া গেলি নাকি! কে কইল বস্তিতে বিলানোর কথা! কে!
আমি শব্দ না করে মুখ ঢেকেছিলাম হাতে।
নিজে নিজে ছড়া বানানো আমার বদঅভ্যেসগুলোর মধ্যে একটি। মা পড়াতেন তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, আমি বলতাম বটগাছ পাঁচ পায়ে দাঁড়িয়ে, সাত হাত বাড়িয়ে!
ইস্কুলে ছড়া বলতে বললে আসল ছড়া ভুলে তামাশার ছড়া মাথায় ঘুরঘুর করত। মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি দাঁড়াও না একবার ভাই।
নানিবাড়ির উঠোনে সন্ধেবেলা শীতল পাটির ওপর হারিকেনের আলোয় বই মেলে শব্দ করে ছড়া পড়তে পড়তে কানামামুকে হেঁটে আসতে দেখে মৌমাছির বদলে বলেছিলাম–
কানামামু কানামামু কোথা যান হাঁটি হাঁটি দাঁড়ান না একবার ভাই।
কিচ্ছা শুনাতে হবে, পুলাপান খুঁজিতেছি, দাঁড়াবার সময় ত নাই।
মা ঘরের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলেছিলেন–এইসব কি হইতাছে? বড় বদঅভ্যাস তর। ছড়া লইয়া তামাশা করস।
নববর্ষে ইস্কুলের মেয়েদের নাম দেয় ফাজিল মেয়েরা। ভোরবেলা নাম টাঙানো থাকে দেয়ালে। কে লিখেছে, কে টাঙিয়েছে, কেউ জানে না। সকলে ভিড় করে নাম পড়ে। আমার নাম এক দেয়ালে ফাডা বাঙ্গি, আরেক দেয়ালে–ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। দিলরুবা, ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটির নাম দেওয়া হয়েছে–খানকি।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার নাম দিয়েছে খানকি, খানকি মানে কি?
ওর চোখে মুহূর্তে জল চলে আসে। কোনও উত্তর দেয় না ও। ওকে দেখে এমন মায়া হয় আমার, আমি ওর পাশে এসে বসে নরম একটি হাত রাখি ওর পিঠে। শব্দটি আমি মা’র মুখে, যখন গাল দেন কাজের মেয়েদের, শুনেছি, কিন্তু অর্থ জানি না এর। দিলরুবার জন্য মায়া হওয়ার পর, ওর কাছে এসে বসার পর, একটু একটু করে অন্ধকার কাটতে কাটতে যেমন ভোর হয়, তেমন দিলরুবার আলোয় অল্প অল্প করে আমি পদ্ম ফুলের মত ফুটি। দিলরুবা আমার বন্ধু হয়ে ওঠে নতুন বছরের মন খারাপ করা দুপুরে। বন্ধু হওয়ার পর ও লতার গল্প, পাতার গল্প, টোনার গল্প, টুনির গল্প আমাকে করে। গল্প শুনতে শুনতে আমি লতাপাতাদের ঘর টোনাটুনির জীবন মনের ভেতর সাজিয়ে নিই, পরে ওর বাড়ি গিয়ে লতা পাতা টোনা টুনিকে দেখি, মামুলি কিছু কথাও হয়। কিন্তু সত্যিকার ওরা আর গল্পের ওরা ভিন্ন মনে হয় আমার কাছে। সত্যিকার ওদের চেয়ে গল্পের ওদের আমার আপন মনে হয় বেশি। লতার সঙ্গে দেখা হলে ওর অসুখ সেরেছে কি না জিজ্ঞেস না করে দিলরুবাকে জিজ্ঞেস করতাম, লতার তারপর কি হল! দিলরুবা বলে লতার তারপর অসুখ সারেনি, বৈদ্য এল, কবিরাজ এল, ডাকতার এল, লতা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে লাগল, শুকোতে শুকোতে চিকন একটি সুতো হতে লাগল, সুতোটি ঝুলতে লাগল ঘরে, সুতোটিকে কেউ বলল জলে ভাসিয়ে দাও, কেউ বলল বুকে জড়িয়ে রাখো। তারপর একজন বুকে জড়ালো লতাকে, চুমু খেল, লতা চোখ মেলল, হাসল, লতাকে দেখে মনে হল লতা বাঁচবে এবার। দিলরুবা যখন গল্প বলে, ও ঠিক এই জগতে দাঁড়িয়ে বলে না। ওর চোখে আমি তাকিয়ে দেখেছি, ও যখন আমার দিকে তাকায়, আমাকে দেখে না, দেখে অন্য কিছু।
লতার অসুখ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা যাওয়ার পর, দিলরুবা এক খাতা কবিতা আমাকে দেখালো, ওর লেখা। পড়তে পড়তে ঘাস নামে একটি কবিতায় আমি থমকালাম।
ঘাস,
তুমি আমাকে নেবে? ঘাসফুল, নেবে? খেলায়?
আমি দিন ফুরিয়েছি ঘুরে ঘুরে মেলায়,
আমার যা কিছু আছে নাও,
তবু একবার স্পর্শ কর আমাকে, ছুঁয়ে দাও।
এসেছি তোমার কাছে বড় অবেলায়।
তুমি যদি ছুঁড়ে ফেলো হেলায়,
ভাসিয়ে দাও নিরুদ্দেশে ভেলায়।
আমি ফিরে তোমার কাছেই যাব
শতবার নিজেকে হারাব।
–আমারে কবিতা লেখা শিখাবা, দিলরুবা?
ঘাস কবিতাটির ওপর ঝুঁকে বলি আমি।
দিলরুবার নিখুঁত মুখখানায় চিকন গোলাপি ঠোঁট, এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল মাথায়, চুল পেছনে খোঁপার মত বাঁধা, বেরিয়ে আসে কিছু অবাধ্য চুল কপালে, ঘাড়ে, চিবুকে। ওকে কোথায় যেন দেখেছি এর আগে। ওর অবাধ্য চুলগুলো দেখেছি আগে কোথাও। এর আগে, মনে হয় এই যে আমি কবিতা শিখতে চাইছি, আর ও আমাকে বলছে না যে ও আমাকে শেখাবে, যেন দৃশ্যটির ভেতরে কখনও ছিলাম আমি, বড় চেনা একটি ছবি। আমি যেন এরকম একা এক মেয়ের পাশে বসেছিলাম কোথাও কবে। মেয়েটি দেখতে ঠিক এরকমই ছিল, আমাদের সামনে ছিল খোলা কবিতার খাতা, সামনে ছিল খোলা জানালা, জানালার ওপারে ছিল ধু ধু মাঠ, আকাশ এসে গড়াচ্ছে সে মাঠে।
আমার চেয়েও দিলরুবা কম কথার মেয়ে। আমার চেয়েও দু’কাঠি লাজুক। ইস্কুলের মাঠে যখন হৈ চৈএ মাতে মেয়েরা, ও দিব্যি জানালায় বসে তাকিয়ে থাকে দূরের আকাশে।
–কবিতা লেখা কাউকে শিখানো যায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে, দেখবে কান্না আসবে। তুমি যদি অনেক কাঁদতে পারো, লিখতে পারবা। দিলরুবা উষ্ণ গলায় বলে আমাকে।
দিলরুবা ক্লাসে মন দেয় না বলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ওকে সারা ক্লাস। ক্লাস থেকে বেরও হয়ে যেতে হয় কখনও কখনও। ও ক্লাসের বাইরে দরজার কাছে দিব্যি এক পায়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। আকাশের সঙ্গে অদ্ভুত এক ভালবাসা ওর। ওকে দেখলে আমার ঘোর লাগে। ঘোরের মধ্যে আমি ওর পাশে পাশে হাঁটি, কথা বলি, কাঁধে হাত রাখি।
আকাশে তাকিয়ে দিলরুবার মত আমার কান্নাও আসে না, কবিতা লেখাও হয় না। বরং দিলরুবার মুখটি মনে করে, একদিন হঠাৎ লিখি ইস্কুলের মাঠে ছেঁড়া একটি ঠোঙা পেয়ে, ওতে।
আমি তোমায় খেলায় নেব দিলরুবা,
গোল্লাছুট খেলতে জান?
গোল্লা থেকে এক বিকেলে হঠাৎ করে ছুটে
হারিয়ে যাব দূরে কোথাও, অনেক দূরে।
সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপার যাব, যাবে?
ঠোঙার লেখাটি পড়ে দিলরুবা মিষ্টি হাসে। এমন মিষ্টি হাসি আমি দেখিনি আগে। সম্ভবত রুনির ছিল এমন হাসি, অথবা এমন নয়, খানিকটা অন্যরকম। এমন হাসি যার, তার কথা বলার দরকার হয় না, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ঠিকই লিখেছিলেন। রুনির সামনে আমি ছিলাম লজ্জাবতী লতা। দিলরুবার সামনে নই। দিলরুবাকে নিয়ে আমার অন্যরকম এক জগত তৈরি হয়। শব্দ নিয়ে খেলার জগত। দিলরুবা লেখে ওর কবিতার খাতায়–
যেদিকেই যেতে বল যাব,
নিজেকে হারাব।
কাছে এসো,
একটিই শর্ত শুধু, ভালবেসো।
আমি তো ওই জানি শুধু, ভালবাসতে। আমাদের ভালবাসা গভীর হতে থাকে, গভীর। দু’জন আমরা হারিয়ে যাই যেদিকে দুচোখ যায়, সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে। সে কেবল মনে মনেই। দিলরুবার বা আমার কারও সত্যিকার হারানো হয় না সমাজ সংসার থেকে। দিলরুবা যে তার কবিতার মত, কবিতা তার শান্ত একটি পুকুরের মত, কোনও এক অরণ্যে একটি নিরালা নিভৃত পুকুর, আকাশের রঙের মত রঙ সে জলের, হঠাৎ হঠাৎ একটি দু’টি পাতা পড়ে টুপ করে সে জলে, যেন ভেলা, দিলরুবার জলে ভাসার ভেলা, একান্ত ওরই। সেই দিলরুবা একদিন আমাকে চমকে দিয়ে বলে, তার বিয়ে হয়ে যাবে শিগরি, তার বাবা বিয়ে ঠিক করেছে।
–না। দিলরুবার ম্লান মুখ আর ধূসর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বলি–তুই না করে দে। বল যে বিয়ে করবি না।
দিলরুবা আবারও ম্লান হাসে। গা পুড়ে যাওয়া জ্বরে পড়লে মানুষ এমন হাসে। পরদিন থেকে দিলরুবা আর আসে না ইস্কুলে। আমি এত একা হয়ে যাই। এত একা, যে, ক্লাসঘরে জানালার কাছে ওর না থাকা জুড়ে বসে থাকি, ছুটির পরও, অনেকক্ষণ। আকাশে তাকিয়ে ওকে খুঁজি। ও কি আকাশে চলে গেল অভিমান করে, কে জানে! এই প্রথম আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার কান্না আসে।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার দু’দিন আগে দিলরুবা এসেছিল অবকাশে। এসেছিল সত্যিকার হারিয়ে যেতে, সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে কোথাও! কোনও নিভৃত অরণ্যে। স্বপ্নলোকে। এই নিষ্ঠুর জগত সংসার থেকে অনেক দূরে, যেখানে পাখা মেলে দুঃখবতী মেয়েরা উড়ে উড়ে মেঘবালিকাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। কালো ফটক খুলে ও ঢুকেছিল। জানালায় দাঁড়িয়ে ওর নিখুঁত মুখটি আমি অপলক দেখছিলাম, দেখছিলাম স্বপ্নের বাগান ধরে ওর হেঁটে আসা, যেন ও হাঁটছে না, দুলছে। দিলরুবাকে জানালায় দাঁড়িয়েই আমি দেখলাম ফেরত যেতে। আমার সঙ্গে ওর দেখা হয়নি। দরজা থেকে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছেন বাবা। তাড়িয়ে দিয়েছেন কারণ তিনি কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি একটি কিশোরীর লেখাপড়া ফেলে বিকেলবেলা কারও বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার। তাই ওর নাম ধাম জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কোথায়, কেন এসেছ, কী কারণ ইত্যাদির উত্তর নিয়ে রক্তাভ চোখ আর বা হাতের তর্জনি তুলেছেন কালো ফটকের দিকে।
এক্ষুনি বেরোও, গপ্প মারতে আসছ! বাজে মেয়ে কোথাকার!
বাজে মেয়ে বেরিয়ে গেছে। খানকি মেয়ে বেরিয়ে গেছে। আর কখনও ওর সঙ্গে আমার দেখা হবে না, আমি তখন জানিনি। কোনও এক বেশি বয়সের অচেনা এক লোকের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে যাবে। কবিতার খাতা পুড়িয়ে দিয়ে, লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে মশলাবাটার, পিঁয়াজ কাটার, রেঁধে বেড়ে কাউকে খাওয়ানোর আর বছর বছর পোয়াতি হওয়ার জীবনে ওকে ঢুকতে হবে, সত্যিই, আমি তখনও জানিনি।
আর আমি, দিলরুবার হয়ে আকাশ দেখতে থাকব, আমার কান্না আসতে থাকবে, আর আমি কবিতা লিখতে থাকব। ্আমি ঘৃণা করতে থাকব সমাজ সংসার। ঘৃণা করতে থাকব আমার এই অদৃশ্য বন্দিত্ব। আমি অনুভব করতে থাকব আমার হাত পায়ের শেকল। অনুভব করতে থাকব আমার ডানা দুটো কাটা, একটি শক্ত খাঁচার ভেতরে বসে আছি অনন্তকাল ধরে।
অথবা একটি খাঁচা আমার ভেতরে বসে আছে ঘাপটি মেরে, আমাকেই দলামোচা করে পোরে ভেতরে, যখন উড়াল দিতে চাই।