সাজ্জাদ বলল, তুমি আমাকে চিনতে পারছ?
কণা না-সূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু তার চোখে চাপা হাসি। মনে হচ্ছে সে বেশিক্ষণ হাসি চেপে রাখতে পারবে না। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে।
আমাকে চিনতে পারছি না?
জ্বি না।
সাজ্জাদ বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, ও আচ্ছা। কণা শাড়ির আঁচল গায়ে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল, আচ্ছা, আপনে কেমন মানুষ ভাইজান? আপনেরে কেন চিনব না?
আপনে সাজ্জাত ভাইজান।
ও আচ্ছা, যাক, মনে আছে তাহলে?
ভাইজান বসেন দেখি।
কণার ঘরে এসে সাজ্জাদ বেশ অবাকই হয়েছে। সে ভেবেছিল ঘরের সাজসজা বস্তির মত হবে। ব্যাপার তা নয়। সবকিছুই সুন্দর করে গোছানো। পরিষ্কার, ছিমছাম। দুটা কাঠের চেয়ার আছে। চেয়ারে কুশন দেয়া। একপাশে খাট আছে। খাটে টানটান করে ফুলতোলা চাদর বিছানো। অপ্রত্যাশিতভাবে খাটের পাশে বুকশেলফ। বেশকিছু বই আছে বুকশেলফে! বইগুলির নোম পড়া যাচ্ছে না। একটা বই চেনা যাচ্ছে–বিষাদসিন্ধু।
সাজ্জাদ বসতে বসতে বলল, তোমার হাসবেন্ড কোথায়? ফার্মেসিতে?
জ্বি না। তার এই চাকরিও গেছে। সে চাকরির খুঁজে বাইর হইছে।
দুদিন পরপরই কি তার চাকরি চলে যায়?
কণা খিলখিল করে হাসল যেন এমন মজার প্রশ্ন সে শুনেনি। শাড়িপরা মেয়েরা হাসির সময় মুখে এক পর্যায়ে আঁচল চাপা দেয়। সে দিচ্ছে না। সাজ্জাদের ধারণা হল, কণা জানে তার উচ্ছ্বসিত হাসির আলাদা সৌন্দর্য আছে।
বুঝলেন ভাইজান, ওর হইছে চুরির অভ্যাস। অষুধপত্র সরায়। পকেটে কইরা প্রত্যেক রাইত দুনিয়ার ট্যাবলেট আনে। তারপরে একদিন ধরা পড়ে। চাকরি নট হয়। আবার চাকরি হয়।
চুরির অভ্যাস তুমি দূর করার চেষ্ট কর না?
চেষ্টায় কোন ফয়দা নাই ভাইজান। কথায় আছে না–কয়লা ধুইলে না যায় ময়লা।
সেটা কয়লার ব্যাপারে সত্যি। মানুষের ব্যাপারে সত্যি না। মানুষ তো কয়লা না।
মানুষ কয়লার চেয়েও খারাপ ভাইজান।
সাজ্জাদ বলল, এসট্রে আছে কণা? সিগারেট খাব।
কণা এসট্রে এনে দিল। সুন্দর বাহারি এসট্রে। এ রকম গৃহস্থালিতে এত সুন্দর এসট্রে থাকার কথা না। কৃস্টেলের মাছ। মাছের পিঠে ছাই ফেলার ব্যবস্থা। কণা বলল, এসট্রেটা কত সুন্দর, দেখছেন ভাইজান?
হুঁ সুন্দর।
এইটাও চুরির। তার এক দূর সম্পর্কের মামা আছে। বিরাট ধনী। গুলশানে বাড়ি। তার কাছে গেছিল। আসার সময় পকেটে কইরা নিয়া আসছে।
বল কি?
এইটা হইল ভাইজান কপাল। কপালে লেখা ছিল–চোর স্বামী। পাইলাম চোর স্বামী। হি হি হি। ভাইজান চা খাইবেন?
চা খাওয়া যেতে পারে।
কফিও আছে।
কফি আছে?
একটা টিন কিন্যা আনছে–সত্তর টেকা দাম। মাঝে মধ্যে মিজাজ খুব ভাল থাকলে বলে, ও চাঁদের কণা, দেখি কফি বানাও।
তোমাকে চাঁদের কণা ডাকে?
একেক সময় একেক নাম। আবার যখন রাগ উঠে তখন ডাকে–বান্দি।
কণা চা বানানোর জন্যে ভেতরে চলে গেল। সাজ্জাদ চেহারে বসে পা নাচাতে লাগল। বাজছে এগারোটা। এই সময় তার অফিসে থাকার কথা। আজ সে অফিস কামাই করেছে। তবে চিঠি পাঠিয়েছে–হাই ফিভারে সে শয্যাশায়ী। অফিস থেকে কেউ দেখতে না চলে এলেই হয়। কণার স্বামীর বাসায় ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটুকু? সে এসে যদি দেখে অপরিচিত একজন লোক তার ঘরে বসে পা নাচাচ্ছে, তখন তার কাছে কেমন লাগবে? খুব ভাল লাগার কথা না। তবে ভাল না লাগলেও সে চুপ করে থাকবে। বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলবে। কণার মত স্ত্রী যে স্বামীর আছে সেই স্বামী ভদ্র ও বিনীত হবে এটা ধরেই নেয়া যায়।
ভাইজান চা নেন।
কণা শুধু তার জন্যে চা আনেনি। তার নিজের জন্যেও এনেছে। সাজ্জাদের পাশের চেয়ারে সে বসেনি। বসেছে সামনে মেঝেতে। পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বাসা। বসার ভঙ্গি সুন্দর। এইসব সুন্দর সুন্দর বসার ভঙ্গি নিশ্চয় ছবির মডেল হতে গিয়ে শিখেছে। মোসাদ্দেক সাহেব শিখিয়েছেন।
চিড়িয়াখানা দেখতে গিয়েছিলে?
জ্বি। আতাহার ভাই নিয়া গেল।
তোমার হাসবেন্ড গিয়েছিল?
জ্বি।
কোন জন্তুটা দেখে সবচে মজা পেয়েছ?
আমার কাছে ভাল লাগছে হাতি।
হাতি দেখার জন্যে তো কেউ চিড়িয়াখানায় যায় না। হাতি তো সব সময়ই দেখা যায়।
তারপরেও হাতি দেখতে ভাল লাগে। কি বিরাট জানোয়ার!
তোমার স্বামীর কাছে কোন জন্তুটা ভাল লেগেছে?
তার এইসব চেৎ-ভেৎ নাই। তার কাছে ইন্দুরও যা, হাতিও তা।
তোমার যখন আবার হাতি দেখার ইচ্ছা করবে–আমাকে খবর দেবে–আমি ব্যবস্থা করব।
আপনেরে খবর দিব ক্যামনে?
একটা কাগজ দাও, আমি টেলিফোন নাম্বার লিখে দিচ্ছি।
সাজ্জাদ টেলিফোন নাম্বার লিখে উঠে দাঁড়াল। কণা তার পেছনে পেছনে আসছে। সাজ্জাদ বলল, দরজা খোলা রেখে চলে আসছি যে? কণা হাসিমুখে বলল, আর আছেই কি আর নিবই-বা কি?
রাস্তা পর্যন্ত কণা নেমে এল। সে নেমে এসেছে খালি পায়ে, তার জন্যে কোন রকম অস্বস্তিও বোধ করছে না।
ভাইজান, এইটা আপনের গাড়ি!
আমার না, আমার বাবার গাড়ি।
কি সুন্দর গাড়িা!
পছন্দ হয়েছে?
খুব পছন্দ হয়েছে। সুন্দর গাড়ি দেখলে আমার ইচ্ছা করে গাড়িত কইরা সারাদিন ঘুরি।
একদিন গাড়ি পাঠিয়ে দেব। সারাদিন ঘুরবে।
জ্বি আচ্ছা।
তোমার চা খুব ভাল হয়েছে। চার জন্যে ধন্যবাদ।
কণা হাসল। সাজ্জাদ। বলল, যাই, কেমন?
কণা ঘাড় কাত করে সম্পমতি জানোল। কণার কিছু ব্যাপার সাজ্জাদের চোেখ পড়েছে। যেমন সে যখন চা শেষ করে চলে যাবার জন্যে উঠ দাঁড়িয়েছে তখন কণা বলেনি, আরেকটু বসে যান। যা মেয়েরা সব সময় করে থাকে। গাড়িতে উঠে সে যখন বলল, কণা যাই? তখনো কণা ঘাড় কত করে সায় দিয়েছে। বলেনি, আবার আসবেন।
ড্রাইভার বলল, স্যার, কোনদিকে যাব?
শহরে কয়েকটা চক্কর দাও।
সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় কাঠানোর কোন ব্যবস্থা করা দরকার। আতাহার সঙ্গে থাকলে ভাল হত। আতাহার ঢাকায় নেই। দেশের বাড়িতে গিয়েছে। পৈতৃক জমিজমা বিক্রির জন্যে গিয়েছে। কবে আসবে কে জানে।
সুবর্ণের অফিসে যাওয়া যেতে পারে। গনি সাহেবকে ধন্যবাদ দেয়া দরকার। তিনি তার একটা অনুবাদ ছাপিয়েছেন–বেশ ভালভাবে ছাপিয়েছেন। মূল ইংরেজ্বি কবিতা পাশাপাশি ছাপিয়েছেন। এতে মূলের সঙ্গে অনুবাদ মিলিয়ে পড়ার আলাদা আনন্দ পাঠক পাবে। তিনি ফুটনোটে কিছু কথা বলেছেন। সেই কথাগুলিও সুন্দর। গুছিয়ে লেখা। গদ্যের অনুবাদ এবং কবিতার অনুবাদের পার্থক্য বলতে বলতে তিনি লিখেছেন। গদ্য অনুবাদেও মূলের খুব কাছাকাছি থাকে। এটা গদ্যের সার্বজনিন।তাই প্রমাণ করে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে–নতুন পৃথিবীতে সাৰ্বজনিন ব্যাপারগুলিই শেষ পর্যন্ত টিকবে। কাজেই এই আশংকা অমূলক নয়–ভবিষ্যতের পৃথিবীতে কবিতা থাকবে না। গদ্য গ্ৰাস করবে কবিতাকে। আজ হতে শতবর্ষ পরে–কেউ কবিতা পাঠ করবে। এমন মনে হয় না।
গনি সাহেব অফিসে ছিএলন, সাজ্জাদকে দেখে আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, আরে তুমি? আসি আসা। তোমার চেহারায় উজ্জ্বল একটা ভাব চলে এসেছে–কি ব্যাপার বল তো?
চাকুরি করছি।
ভেরী গুড।
একসিলেন্ট। আজকালকার ইয়ং ছেলেমেয়েদের একটা ধারণা হয়েছে কবিতা লিখলে চাকরি-বাকরি কিছু করা যাবে না। পুরোপুরি বোহেমিয়ান হতে হবে। রাতে ঘুমুতে হবে পার্ক করা বাসে। তড়িফাঁড়ি খেতে হবে। ওদের বলার চেষ্টা করি–ইয়ং ম্যান, রবীন্দ্রনাথ কবিতা যেমন লিখতেন, পাশাপাশি জমিদারিও দেখাশোনা করতেন। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে কাব্যের বিরোধ নেই। কাব্যচর্চা হচ্ছে সুন্দরের অনুসন্ধান।
সাজ্জাদ বলল, অসুন্দরের ভেতরও সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়।
এইসব ফালতু কথা–এবং বোগাস কথা। মল-মূত্রের ভেতরে সৌন্দর্য নেই। কি খাবে বল, চা না কফি?
আপনার বাড়ির সমস্যা কি মিটেছে?
কোন সমস্যা?
ঐ যে প্রতি বুধবার রাতে বাড়িতে কারা যেন মল-মূত্র ঢেলে আসত। হ্যাঁ, মিটেছে। সিকিউরিটি গার্ড রেখেছিলাম। গার্ড বিদায় করে দিয়েছি। ভাল কথা, সাজ্জাদ, তোমার চারটা অনুবাদের মধ্যে একটা ভাল হয়েছে। শুধু ভাল না, বেশ ভাল। ছেপে দিয়েছি। দেখেছি বোধহয়।
জ্বি দেখেছি। থ্যাংক য়্যু।
থ্যাংকস দেবার কিছু নেই। জিনিস ভাল হলে ছাপা হবে। বাসায় মল-মূত্র না ঢাললেও ছাপা হবে। মল-মূত্র দিয়ে বাড়ি মাখানোর শিশুসুলভ আচরণ করার কোন প্রয়োজন ছিল না।
সাজ্জাদ চুপ করে রইল। টেবিলে চা দিয়ে গেছে। চায়ের সঙ্গে বেলা বিসকিট।
খাও, চা খাও। যেদিন কাণ্ডটা প্রথম ঘটল আমি ভেবেছিলাম–কালপ্রিট হচ্ছে আতাহার। এর পেছনে তুমি আছ ভাবতে পারিনি। যাই হোক–পাস্ট নিয়ে হৈ চৈ করার কোন মানে হয় না। তবে তোমাদের প্রতি আমার এডভাইস হচ্ছে–গ্রো আপ। শিশু হয়ে থেকে না–গ্রো আপ। তোমরা গ্রোঁ আপ না করলে তোমাদের সৃষ্টিও গ্রো আপ করবে না। সৃষ্টিও শিশু থেকে যাবে। বুঝতে পারছি?
জ্বি পারছি।
ঐদিন রহমতউল্লাহ এসেছিল, তাকেও বললাম, রহমতউল্লাহ, গ্রো আপ। গ্রো আপ। ইনফেনসিতে আর কতকাল থাকবে? রহমতউল্লাহ ইদানীং ছদ্মনাম নিয়ে লিখছে–পার্থ সারথী বসু আমি বললাম, বাপ-মা রহমতউল্লাহ নাম রেখেছে, রহমতউল্লাহ নামেই লিখবো। পার্থ সারথী বসু লেখার মানে কি? তোমার কি ধারণা, হিন্দু নাম হলে লেখক-লেখক ভাব বেশি ফুটে? না-কি এই নাম বেশি আধুনিক বলে মনে হয়? সে কথা বলে না। তারপর গত শুক্রবারের পাত্রকা খুলে দেখি, সে আমাকে নিয়ে একটা ছড়া লিখেছে। ছড়ার শিরোনাম–কমিভূক। বুঝলাম, এখনো ইনফেনসিতে রয়ে গেছে।
সাজ্জাদ। বলল, উঠি গনি ভাই।
গনি সাহেব বললেন, না না, উঠবে কেন, বাস। তোমরা ইয়াং ব্লাড। তোমাদের সঙ্গে গল্প করতে ভাল লাগে। আতাহার কেমন আছে?
জ্বি, ভাল আছে।
ঐদিন নিউমার্কেটের পেছনে যে মার্কেটের মত আছে। সেখানে গিয়েছিলাম গ্রাস কিনতে, হঠাৎ দেখি আতাহার। দেখে মনে হল অসুখ-বিসুখ হয়েছে। চোখ-মুখ শূকনা। আমি বললাম, কি হয়েছে তোমার?
সে বলল, কিছু হয়নি। আমি খুব ভাল আছি। আনন্দে আছি। তাকে দেখে অবশ্যি মনে হল না সে আনন্দে আছে। অবশ্যি বাংলাদেশ যুবসমাজের জন্যে খুব আনন্দের জায়গা নয়।
আতাহারের বাবা মারা গেছেন।
সে কি! কবে?
গত শনিবারের আগের শনিবারে।
আতাহার তো আমাকে কিছু বলল না। বলল না কেন?
গনি সাহেব খুবই বিস্মিত হলেন। দুঃখিত গলায় বললেন, তোমাদের আমি অনেক কঠিন কঠিন কথা বলি। কিন্তু তোমাদের স্নেহ করি। এই স্নেহটাকে তোমরা হয়ত আন্তরিক বলে মনে কর না। আন্তরিক মনে করলে আতাহার তার বাবার মৃত্যু-সংবাদ আমাকে দিত। আমি সাহিত্যের বাইরে সান্তনার দু-একটা কথাও বলতে পারি। আতাহারের বাসার ঠিকানা কি?–
নতুন বাসার ঠিকানটা জানি না।
বাসা বদলেছে?
জ্বি।
তুমি তার এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তুমি তার নতুন ঠিকানাও জান না? আশ্চর্য তো! অবশ্য তোমাদের ব্যাপারে আশ্চর্য হওয়া ঠিক না। তোমরা অতি অদ্ভুত এক শ্রেণী। অতি অদ্ভুত!
অদ্ভুত বলছেন কেন?
তোমাদের আচার-আচরণ অদ্ভূত লাগে বলেই অদ্ভুত বলছি।
গনি ভাই, উঠি?
এই যে তুমি আমাকে গনিভাই বলছি, এটাও কি অদ্ভূত না? আমার বয়স তেষট্টি। মাথায় একটা কাচা চুল নেই–আমাকে ভাই বলছি। চাচা ডাকাটাই কি শোভন হত না? পনেরো বছরের চেংড়া ছেলে ঘরে ঢুকে বলে–গনি ভাই, একটা কবিতা নিয়ে এসেছি। কবিতা ছাড়া এমি দেখা করতে এলে চাচা ডাকত। হাতে কবিতা তাই–ভাই। এ হল সাহিত্যের ভাই।
সাজ্জাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, চাচা, আজ তাহলে উঠি? আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম।
গনি সাহেব ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন।
সাজ্জাদ ঠিক করল সে অফিসে ফিরে যাবে। অফিসে গিয়ে বলবে, ঘাম দিয়ে হঠাৎ জ্বর কমে গেল। ঘরে শুধু শুধু শুয়ে থাকার কোন কারণ না থাকায় চলে এসেছি। দেখি ফাইলপত্র কি আছে?
চিড়িয়াখানাতেও যাওয়া যায়। কণা যেমন হাতি দেখে এসেছে সেও গিয়ে হাতি দেখে এল। শিকলে বাধা হাতি দেখার ভেতর অন্য ধরনের আনন্দ আছে। হাতিকে বলা যায়–হে শক্তিমান পশু, সহস্ৰ শৃঙ্খলে মুক্তির স্বাদ পাবার ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হয়নি। এই ক্ষমতা শুধুমাত্র মানুষের।
অফিসে যাবে, না চিড়িয়াখানায় যাবে, এই দোটানা থেকে সাজ্জাদ মুক্তি পাচ্ছে না। মানিব্যাগে কোন কয়েন নেই যে হেড অর টেইল টস করবে। তার হয়ে অন্য কেউ এই সিদ্ধান্তটা নিলে ভাল হত।
ড্রাইভার বলল, স্যার কোনদিকে যাবেন?
সাজ্জাদ বলল, কোনদিকেই যাব না। তুমি গাড়ি নিয়ে চলে যাও। আমি খানিকক্ষণ হাঁটব।
জ্বি আচ্ছা।
আচ্ছা দাঁড়াও। চল, অফিসের দিকে চল।
সাজ্জাদের ড্রাইভার অন্যসব ড্রাইভারদের মতই রোবট শ্রেণীর। মালিকের অস্থিরতা তাদের স্পর্শ করে না। যা বলা হবে তাই তারা করবে। হুকুমের বাইরে যাবে না। সে বলবে না–গাড়ি রেখে আপনি হাঁটবেন কেন স্যার? বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে। তেমন জোরালো ভাবে হচ্ছে না। তবে জোরালোভাবে শিগগিরই শুরু হবে। আকাশে মেঘা জমছে। দীর্ঘদিনের ড্রাইভার তার জগৎ সংকুচিত করে ফেলে একটা গাড়ির ভিতর। গাড়ির বাইরে সে কিছু চিন্তা করতে পারে না। চাকায় হাওয়া কতটুক আছে? চল্লিশ পিএস আট। পিছনের বাঁদিকের চাকায় মনে হচ্ছে একটু কম। স্টিয়ারিং বদলানোর সময় ঘাস ঘ্যাস শব্দ হচ্চেছ কেন? সুন্দর সূর্যালোকিত সকল তাদের মুগ্ধ করে না। তাদের মুগ্ধ করে যখন সামনের রাস্তা থাকে ফাঁকা। গাড়ি চলে শব্দহীন মসৃণ ভঙ্গিতে। সমস্ত পৃথিবীটা চলে আসে চার চাকার সামান্য গাড়িতে।
মানুষের একটা চেষ্টাই থাকে পৃথিবীটাকে ছোট করে ফেলার। কেউ পৃথিবী নিয়ে আসেন তাঁর সংসারে। কেউ তাঁর অফিসে। একজন স্কুল টিচার–তাঁর স্কুলে। এই জন্যেই কি সাধকরা ঘর-সংসার ছেড়ে দেন?
সাজ্জাদ অফিসে ঢুকে পর পর দুইেকাপ কফি খেলো। প্রায় দুটার মত বাজে। প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। কফি খাওয়ায় খিদে নষ্ট হয়ে ভেঁাতা। যন্ত্রণার মত হচ্ছে। সে তৃতীয় আরেক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে প্যাড়ের কাগজ টেনে নিয়ে দ্রুত একটা দরখাস্ত লিখে ফেলল–
ডিরেক্টর, এডমিনস্ট্রেশন
এরনাস ইন্টারন্যাশনাল
ঢাকা
বিষয় : চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা।
জনাব, সবিনয়ে নিবেদন। আমার পক্ষে চাকরি করা সম্ভব হচ্ছে না। অফিসের খুঁটিনাটি আমি লিখতে পারছি না, আমার ভালও লাগছে না। যতই দিন যাচ্ছে আমার পৃথিবী ততই ছোট হয়ে আসছে। ভয় হচ্ছে, এক সময় পৃথিবীটা অফিসের এয়ারকুলার বসানো ঘরেই আবদ্ধ হয়ে যায়। কিনা। এরকম কোন ভয়াবহ সম্ভাবনার দিকে আমি যেতে চাই না। আমি আমার সমগ্র মানবজীবনে চারটি হলেও ভাল কবিতা লিখে যেতে চাই। তার জন্যে যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করে নিতে আমার কোন আপত্তি নেই। কাজেই আমি চাকরি থেকে অব্যাহতি কামনা করছি।
বিনীত
সাজ্জাদ হোসেন
চিঠি শেষ করেই সাজ্জাদ একটা টেলিফোন করল। জনৈকা ভদ্রমহিলা টেলিফোন ধরে বললেন, কে?
সাজ্জাদ বলল, মা, আমি সাজ্জাদ।
কয়েক মুহূর্ত ভদ্রমহিলা কোন কথা বললেন না।
সাজ্জাদ বলল, তুমি কেমন আছ মা?
ভাল।
আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করছি না কেন?
তুই কেমন আছিস?
খুব খারাপ। ভয়ংকর খারাপ। মা, আমি লিখতে পারছি না।
কবি-লেখক–এদের তো এমন সমস্যা প্রায়ই হয়। লেখা বন্ধ হয়ে যায়। রাইটার্স ব্লক তো লেখকদের পুরানো ব্যাধি। তুই বরং কোনখান থেকে ঘুরে আয়।
আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।
তুই বরং একটা বিয়ে-টিয়ে কর–তোর কি কোন পছন্দের মেয়ে আছে?
মেয়েটার নাম কি?
কণা।
কি রকম পছন্দ? বেশ পছন্দ, না মোটামুটি পছন্দ?
বেশ পছন্দ।
পছন্দ হলে বিয়ে করে ফেলে। পাশে সাবক্ষণিক একজন কেউ থাকলে তোর অস্থিরতা কমবে।
মেয়েটিকে বিয়ে করার সামান্য সমস্যা আছে মা।
সমস্যা কি?
মেয়েটি বিবাহিত।
সে কি?
তুমি চমকে উঠলে কেন মা?
তোর কি মনে হয় না–তুই চমকে ওঠার মত কথা বলেছিস?
না। কারণ তুমিও বিবাহিতা ছিলে— বাবাকে এক কথায় ছেড়ে অন্য একজনকে–
সাজ্জাদ টেলিফোন নামিয়ে সিগারেট ধরাল। বেল টিপে তার সেক্রেটারিকে ডেকে বলল, দ্রুত চিঠিটা টাইপ করে নিয়ে আসুন। দশ মিনিটের ভেতর। দশ মিনিটের বেশি এই অফিসে থাকলে দমবন্ধ হয়ে আমি মারা পড়ব।
এই দশ মিনিট কাটানো যায় কিভাবে? মাঝে মাঝে দশ মিনিট অনন্তকালের মত দীর্ঘ হতে পারে। আইনস্টাইন, স্পেশাল থিওরী অব রিলেটিভিটি। টাইম ডাইলেশন। সাজ্জাদের মনে হচ্ছে এই দশ মিনিট আর কাটবে না। এমন কেউ কি তার আছে যার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে ভাল লাগে? লীলাবতী আছে–লীলাবতী। তার টেলিফোন নাম্বারটা যেন কত? মনে পড়ছে না। তার শোবার ঘরের দেয়ালে লেখা। চোখ বন্ধ করে সাজ্জাদ শেবার ঘরের দেয়ালটা দেখার চেষ্টা করল। দেয়াল দেখা যাচ্ছে, কিন্তু লেখা পড়া যাচ্ছে না।
সাজ্জাদ যখন অফিস থেকে বের হল তখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। সে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এগুচ্ছে। সে বাসায় যাবে না। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে চলে যাবে। ঘোর বর্ষা নেমেছে–এখনো কদম ফুল দেখা হয়নি। কদম গাছের নিচে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আজ সে গাইবে–বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান। সাজ্জাদের গলা ভাল। আশ্চর্য রকম ভাল। গানের চর্চা করলে সে অনেকদূর এগুতে পারত। গান পরাশ্রয়ী বিদ্যা। অন্যের সুর আশ্ৰয় করে সে বিকশিত হয়। একজন কবি কখনো পরাশ্রয়ী বিদ্যার চাচা করতে পারেন না।