ওদিকে সূর্যদা আর এক মৃত্যু দেখছিল।
সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষা দেবার পর অত্যন্ত বদলে গিয়েছিল সূর্যদা। খুব বাল্যকাল থেকেই সে গম্ভীর প্রকৃতির, কিন্তু এই সময়কার গাম্ভীর্য সম্পূর্ণ অন্য রকম। তার মনের মধ্যে সব সময় যেন একটা অস্থিরতা রয়েছে, মুখ-চোখ দেখলেই সেটা বোঝা যায়, অথচ কথায়বার্তায় তার কোনও প্রকাশ নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপচাপ তাকে তার টেবিলে বসে। থাকতে দেখেছি।
আমি সব সময় সূর্যদার কাছে কাছে ঘুরঘুর করতাম, কিন্তু সূর্যদা সেই সময় আমাকেও বেশি সহ্য করতে পারত না। অনেক সময়েই কথার উত্তর পেতাম না। এককথা বার বার জিজ্ঞেস করলে বিরক্ত হয়ে বলত, এখন যা তো এখান থেকে। তা সত্ত্বেও আমি না গেলে ধমকে উঠত, তোকে যেতে বলছি না! গেট লস্ট!
আমার অভিমান হত, তবু ফিরে আসতাম একটু বাদেই। সূর্যদার প্রতি আমার ভালোবাসায় কোনও খাদ ছিল না।
ওই সময়েই সূর্যদার দাড়িগোঁফ উঠতে শুরু করে। আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম সূর্যদার দাড়ির রং সম্পূর্ণ কালো নয়, খানিকটা লালচে রঙের। এবং তখন বুঝতে পারি, সূর্যদার মাথার চুলও ঠিক কুচকুচে কালো বলা যায় না–এটা আগে টের পাওয়া যায়নি, কিন্তু তার ফরসা গালের ওপর দাড়ি দেখে আরও স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। আগেই বলেছি, সূর্যদার চোখের মণিদুটোও খয়েরি ধরনের। যে-কেউ প্রথম দেখে সাহেবের বাচ্চা বলে ভুল করত। অদ্ভুত সুন্দর দেখাত সূর্যদাকে, শুধু ওই কিশোর বয়সে হাসিখুশি মুখের বদলে তার গাম্ভীর্যটুকুই ছিল বেমানান।
আমার বড়দি শ্রীলেখা তো সূর্যদার প্রেমেই পড়ে গিয়েছিল। আমার আপন দিদি সান্ত্বনারও ওই রকম কিছু হয়েছিল কিনা ঠিক জানি না, তবে আমার দুই দিদির মধ্যে ওই সময় থেকে খানিকটা রেষারেষি শুরু হয়।
মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে প্রেম জন্মাবে তখন এমন কিছু অলীক ব্যাপার ছিল না, বন্ধ সমাজের মধ্যেই এর প্রাদুর্ভাব ঘটে। কোনও কোনও বন্ধ সমাজে এইসব সম্পর্কের মধ্যে বিয়েথা-ও হয়।
বাঙালি মেয়েরা তখন কিছু কিছু পড়াশুনো শিখতে শুরু করেছে বটে কিন্তু পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশা প্রায় নিষিদ্ধ। বিয়ের আগে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় ছাড়া আর কারওর সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ নেই। কলকাতার যে দুটি-একটি কলেজে কো-এডুকেশন চালু হয়েছে, সেখানেও ছাত্রীরা ছেলেদের সঙ্গে একসঙ্গে ক্লাসে যায় না–ঘণ্টা পড়লেও দল বেঁধে ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রফেসারের সঙ্গে ঢোকে, প্রফেসারের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। অথচ মধ্য যুগের অন্ধকার পেরিয়ে এসে মেয়েরা আবার শিক্ষার সুযোগ পাবার ফলে এবং ইংরেজি রোমান্টিক সাহিত্যের অনুকরণে বাংলা গল্প-উপন্যাস রচিত হওয়ায় বিবাহ সম্পর্ক বিরহিত প্রণয় বেশ প্রসিদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং মধুর অভাবে গুড়ের মতন, চঞ্চল স্বভাবের মেয়েরা মামাতো, পিসতুতো দাদা কিংবা জামাইবাবুর ভাইয়ের সঙ্গে খানিকটা হৃদয় সম্পর্ক পাতিয়ে প্রণয়-লিপ্সা মেটায়। আয়েষা জগৎ সিংহকে কখনও দাদা বলেনি, কিন্তু প্রেমিকদের প্রকাশ্যে ওমুক তমুকদা বলে ডাকার রেওয়াজ এই শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকেই চালু হয়।
সেই সময়কার সাধারণ গল্প উপন্যাসে প্রেমিকরা অধিকাংশই ব্যর্থ প্রেমিক এবং তারা টিউবারকুলোসিসে ভোগে। প্রেমিকাদের অবধারিত ভাবে পরপুরুষের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। কদাচিৎ বাড়ির ড্রাইভার কিংবা লাজুক প্রাইভেট টিউটরের সঙ্গে প্রেম হলেও শেষ। পর্যন্ত দেখা যায়, তারা আসলে ছদ্মবেশী রাজপুত্র। অর্থাৎ হয় ডবল এম. এ অথবা জমিদার-তনয়, অভিমান করে ওইরূপ পেশা নিয়েছিল। মর্ডান মেয়ে বলতে বোঝায় রায়বাহাদুর-দুহিতা কিংবা স্কুল শিক্ষয়িত্ৰী। তেজস্বিনী নায়িকা তার লম্বা বেণী চাবুকের মতন ধরে শপাং করে মারে ভিলেনের মুখে। নায়ক-নায়িকার হঠাৎ দেখা হয়ে যায়। সাঁওতাল পরগণায় কিংবা হিমালয়ে সভ্যতার কড়া দৃষ্টির বাইরে।
আমার বড়দি ও সূর্যদার ব্যাপারটা অবশ্য অন্য রকম ছিল। সূর্যদা আমার বড়দির সঙ্গে এমন ব্যবহার করত যেন বড়দি তার একটা নিজস্ব পোষা প্রাণী। সূর্যদা যখন তখন যে। কোনও হুকুম করত বড়দিকে। অথচ সূর্যদা অদ্ভুত রকমের স্বাবলম্বী, চিরকাল নিজের জামাকাপড় নিজে কেচেছে, নিজের এঁটো থালাবাসন অন্যকে তুলতে দেয়নি। কিন্তু বড়দির ব্যাপারটা ছিল আলাদা। নরম করে কিংবা মধুর করে কোনও কথা বলার স্বভাব ছিল না সূর্যদার। হঠাৎ গাম্ভীর্য ভেঙে ডাকত, শ্রীলেখা, শুনে যাও! এইখানে এসো, আরও কাছে এসো! বড়দি কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই সূর্যদা খপ করে চেপে ধরত বড়দির হাত, তারপর হিড়হিড় করে টেনে এনে গায়ের সঙ্গে লেপটে ধরত। আমাদের সামনেই।
আমি জানি, এই রকম শুরু হবার প্রথম দিকে বড়দি খুব ভয় পেত সূর্যদাকে। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াত। একদিন সূর্যদার পা জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে পর্যন্ত। সূর্যদা ভুরু কুঁচকে বিরক্ত ভাবে তাকিয়ে থেকেছে বড়দির দিকে। তার কোনও কাজে বাধা-পড়া তার একটুও পছন্দ নয়। এমনও একদিন হয়েছে, সূর্যদা হয়তো টেবিলে বসে খাতায় অঙ্ক কষছে খুব মনোযোগ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, আমি মেঝেতে বসে দুলে দুলে পড়া মুখস্ত করছি, হঠাৎ সূর্যদা মুখ তুলে আমাকে বলল, এই বাদল, একবার শ্রীলেখাকে ডাক তো! বলবি এক্ষুনি আসতে। আবার অঙ্ক কষায় মনোযোগ। আমি বড়দিকে ডেকে আনলাম। সূর্যদা খাতা-পেনসিল রেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাম হাম করে কয়েকটা চুমো খেল বড়দিকে। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে ফের ফিরে গেল পড়ার টেবিলে।
এই ধরনের ব্যবহার সত্ত্বেও বড়দি সম্পূর্ণ পোষ মেনে গেল সূর্যদার! নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পণ করে দিল ওর কাছে। তার মানে অবশ্য এই নয় বড়দি সূর্যদার সঙ্গে ঘোরতর কোনও রকম শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিল। সেদিকটা তখনও সূর্যদার মাথায় আসেনি। সূর্যদা সে রকম কিছু হুকুম করলে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা বড়দির ছিল কি না আমি জানি না। বড়দির প্রেম দেখা দিয়েছিল প্রবল স্নেহের রূপ নিয়ে। বড়দি সূর্যদার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকত যেন পুরুষটির সকল রকম ভালো-মন্দের দায়িত্ব তারই। আমি দেখেছি, বড়দি সূর্যদার মাথার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। সূর্যদার মাথায় একটু কেঁকড়া ধরনের খুব ঘন চুল। সূর্যদা বাথরুম থেকে স্নান করে যে-ই নিজের ঘরে। ঢুকেছে, অমনি কোথা থেকে বড়দি এসে হাজির, হাতে চিরুনি। বড়দি ঠিক লক্ষ রেখেছে। সূর্যদা আয়নার সামনে যেতেই বড়দি বলল, দাঁড়াও। এক হাতে সূর্যদার গাল চেপে ধরে অন্য হাতে কী যত্ন করে বড়দি আঁচড়ে দিচ্ছে চুল, শিশুর প্রতি মায়ের স্নেহের মতন। আবার কখনও কখনও সূর্যদা হয়তো বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে, বড়দি দরজার আড়াল থেকে ডেকে বলল, এই শোনোনা, এই নাও। এটা নিয়ে যাও! সুগন্ধমাখা একটা রুমাল। সূর্যদা অবশ্য এর উত্তরে এক টুকরো হাসিও কখনও উপহার দেয়নি। তবু বড়দি নিঃস্বার্থ ভাবে স্নেহ মমতা-মাখানো ভালোবাসা দিয়ে গেছে সূর্যদাকে।
আমাদের বাড়ির লোক তো অন্ধ কিংবা উদাসীন নয়, এসব তাদের চোখে পড়বেই। বিশেষত জ্যাঠামশাই, জ্যাঠাইমা এবং আমার মা–এই তিন জনের নৈতিক শুচিবাই কিছু কম ছিল না। তবুও ধরা পড়তে একটু দেরি হয়েছিল। তা ছাড়া বড়দির বিয়ের জন্য তখন পাত্র দেখা চলছে পুরোদমে।
পরীক্ষার পরে ছুটিতে সূর্যদা আমার সঙ্গে রেণুদের বাড়িতে বিশেষ যেতে চাইত না। একা একাই বেরিয়ে পড়ত মাঝে মাঝে। বাড়ির কারোকে কোনও কিছু বলে যাওয়া ধাতে ছিল না তার। বড়বাবু একদিন খেয়াল করলেন, সন্ধ্যার পর অন্য ছেলেমেয়েরা সবাই বাড়িতে থাকলেও সূর্যদা প্রায়ই অনুপস্থিত থাকে। ছেলের সঙ্গে তার কথাবার্তা খুবই কম। হত। রাত্তিরবেলা খেতে বসে বড়বাবু হঠাৎ মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, সূয্যি এখনও ফেরেনি?
কেউ কিছু উত্তর দেবার আগেই বড়দি টপ করে বলল, এই তো সিংহীদের বাড়ির মাঠে বোধহয় ব্যাডমিন্টন খেলছে বাদল, একটু যা না, ডেকে নিয়ে আয় না!
আমি জানি, সূর্যদা সেখানে নেই। তাই গা করলুম না। সিংহীদের বাড়িতে রাত্রে আলো জ্বেলে ব্যাডমিন্টন চালু হয়েছিল, এখন তা বন্ধ। এখন রোজ সন্ধ্যার পর খুব হাওয়া দেয়–এই হাওয়ায় কেউ ব্যাডমিন্টন খেলতে পারে?
জ্যাঠামশাই বললেন, প্রায়ই তো তাকে দেখি না, কোথায় থাকে সে?
বড়বাবু আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, চুপচাপ খাওয়া শেষ করলেন। তারপর চটি ফট ফট করে নেমে গেলেন একতলার বসবার ঘরে।
বড়বাবুর নিজস্ব ঘরটি তিনতলায়। সকালে কিছুক্ষণ মাত্র বসবার ঘরে থাকেন, বাকি সময়টা তিনতলায় নিজের ঘরেই কাটান। তিনতলায় আর কোনও ঘর নেই বলে বাড়িতে তার উপস্থিতি সব সময় টের পাওয়াও যায় না। আজ তিনি একতলায় নেমে এলেন নিশ্চিত সূর্যদার সঙ্গে কথা বলার জন্য।
একটু বাদে নেমে এলেন জ্যাঠামশাই, হাতে কিছু কাগজপত্র। তিনি বড়বাবুর সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু আলোচনা করবেন। চাকর নিয়ে এল গড়গড়া। জ্যাঠামশাই গড়গড়ার নল ধরে টান দিয়ে বললেন, অমর, এবার ভাবছি একটা কার্ডবোর্ড কোম্পানির এজেন্সি নেব। আস্তে আস্তে এসব জিনিসের চাহিদা বাড়ছে–
বড়বাবু অন্যমনস্ক ভাবে বললেন–বেশ তো, নাও না!
আমি তো একা আর সব দিক পেরে উঠছি না। তুমি নিজে কিছু দেখো টেখো।
কেন, চিরুকে লাগিয়ে দাও।
ওর দ্বারা বিশেষ কিছু হবে না। দিনরাত কী যে এত ভাবে। ঢাকুরিয়ার দিকে খানিকটা জমি দেখেছি, বুঝলে, একটা বড় মতন গোডাউন না তৈরি করলে তো আর চলছে না।
ঢাকুরিয়া? ও তো জলা জায়গা। ভিত গাঁথার খরচ পোষাবে না। ইটের হাজার এখন কত করে যাচ্ছে?
গত মাসেও পৌনে আট টাকা ছিল, এ-মাসে বোধহয় আট।
আট টাকা এ যে সাঙ্ঘাতিক কথা! গোয়ালিয়রে কিনেছিলাম সাড়ে তিন টাকা হাজার। জিনিসপত্তরের দাম কী রকম বাড়ছে, তুমি কিছু খবর রাখো? পোনা মাছের সের ন’ আনা! গত রোববারেও কিনেছি সাড়ে সাত আনায়, ব্যাটারা এক লাফে ন’ আনা করে দিল! দিনকাল সুবিধের না হে! চালের মণও দেখতে দেখতে চার টাকা হয়ে গেল। যুদ্ধ বোধহয় এবার একটা লাগবে। শেয়ার বাজারে দাপাদাপি শুরু হয়েছে।
বড়বাবু সিগারেট নিবিয়ে বললেন, কোথায় আর যুদ্ধ লাগবে। আর লাগবে না বোধহয়! সবাই মিলে হিটলারকে তোয়াজ করছে। চেম্বারলেন যে ভাবে ওই দেশটাকে… কী যেন দেশের নামটা? মনেও থাকে না ছাই।
কোন দেশটা?
ওই যে, যেটার খানিকটা অংশ আগে বোহেমিয়া ছিল। হ্যাঁ, চেকোস্লোভাকিয়া, সে দেশটাকে তো সন্দেশের বাক্সর মতন হিটলারের হাতে তুলে দিল।
আমাদের কাগজের দামও বাড়ছে। এই সময় কিছু স্টক ধরে রাখা যায় যদি।
ব্যবসায়ের আলোচনা আর বেশি দূর এগোল না। এই সময় সূর্য বাড়ি ফিরল। বাইরে কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সূর্যর সর্বাঙ্গ বৃষ্টিতে ভেজা। ভেতরে যেতে হলে বসবার ঘরের মধ্য দিয়েই যেতে হয়, সূর্য দু’জন গুরুজনকে সেখানে উপবিষ্ট দেখেও কোনও কথা বলল না, জামা থেকে নিংড়ে জল ফেলতে লাগল দরজার বাইরে। মাথার চুল জবজবে।
প্রিয়রঞ্জন বললেন, এ কী, একেবারে ভিজে গেলে যে! ছাতা নিয়ে বেরোওনি কেন?
এটা নিছক কথার কথা। সূর্য বেরিয়ে ছিল দুপুরে, তখন বৃষ্টির নামগন্ধও নেই। তা ছাড়া ওই বয়সের ছেলে সচরাচর ছাতা নিয়ে বেরোয় না। সূর্য উত্তর দিল না।
বড়বাবু খুব স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলি রে?
সূর্য সংক্ষিপ্ত ভাবে জানাল, বেলেঘাটায়!
সে তো অনেক দূর! এত রাত পর্যন্ত ওখানেই ছিলি?
হ্যাঁ।
কে আছে ওখানে?
সূর্য একটু ইতস্তত করে বলল, আমার এক বন্ধু।
বড়বাবু বললেন, ও। কী, তোর স্কুলের বন্ধু?
হ্যাঁ।
বন্ধুর বাবা কী করেন?
ওর বাবা নেই।
গার্জিয়ান কে?
ওর কাকা।
কী করেন তিনি?
আমি ঠিক জানি না।
কাল আমি তোর সঙ্গে বেলেঘাটায় তোর বন্ধুর বাড়িতে যাব। ওর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আলাপ করে আসব।
সূর্য কোনও কথা না বলে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। যে-কেউ সূর্যকে দেখলেই বুঝতে পারবে, সে মিথ্যে কথা বলছে, তার প্রশান্ত সুন্দর মুখে প্রতিটি অভিব্যক্তির ছায়া পড়ে। মিথ্যে কথা বলার অভ্যাস তার একেবারে নেই, কেন সে এ রকম অসম্ভব চেষ্টা চালাচ্ছে কে জানে। তার বাবা তাকে জব্দ করে দিয়েছে।
তৎক্ষণাৎ উত্তর না দিয়ে সূর্য দু’-এক মুহূর্ত ভাবল, তারপর বলল, ওরা সবাই কাল বেড়াতে যাচ্ছে বাইরে–
কোথায়? কাছাকাছি?
পুরীতে।
ও তা হলে কাল থেকে আর ফিরতে দেরি করিস না। এখন সাড়ে নটা বাজে, এত রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকা ভালো নয়। কাল থেকে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরিস। মাথাটা ভালো করে মুছে নে!
পরক্ষণেই বড়বাবু প্রিয়রঞ্জনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তুমি গোডাউন তৈরির কথা যা বলছিলে। অর্থাৎ সূর্যর সঙ্গে তাঁর কথা শেষ হয়ে গেছে। সূর্য ঘর থেকে। বেরিয়ে গেল, ভিজে পায়ের ছাপ ফেলে ফেলে উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে। নিজের ঘরে গিয়ে দেখল শ্রীলেখা তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পরের দিন সূর্য ফিরল আরও অনেক দেরি করে। সমস্ত পাড়া তখন নিঝুম, ঘোড়ারগাড়ির শব্দও শোনা যায় না, কুলপি মালাই বরফওয়ালাদের ডাকও থেমে গেছে।
বড়বাবু সে-দিন খেতে বসে সূর্যর কথা এক বারও জিজ্ঞেস করেননি। কিন্তু বার বার ঘড়ি দেখছেন। তিনি সূর্যর জন্য সেদিন আর নীচে নামলেন না, ওপরে উঠে যাবার সময় বললেন, সূর্য ফিরলে যেন তার সঙ্গে একবার দেখা করতে বলা হয়।
সূর্য সেদিন দরজা ধাক্কাতেই তরতর করে নেমে গিয়েছিল শ্রীলেখা। দরজা খুলে দারুণ আশঙ্কার সঙ্গে ফিসফিস করে বললে, এই, তুমি আজও দেরি করে ফিরলে? রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলে নাকি?
না।
বড়বাবু তোমার ওপর ভীষণ রেগে গেছেন।
হুঁ।
শ্রীলেখা সূর্যর হাত জড়িয়ে ধরে কাতর ভাবে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় গিয়েছিলে? কেন এত দেরি করলে? বলো, আমাকে বলবে না?
সূর্য নির্লিপ্ত ভাবে শুধু প্রশ্ন করল, আমার খাবার কি ঢাকা দেওয়া আছে?
বড়বাবু তোমাকে একবার দেখা করতে বলেছেন। খেয়ে নিয়ে তারপর যাবে? তাই যেয়ো বরং।
না, আগেই দেখা করে আসি।
দোতলার রেলিং থেকে দেখা যায়, বড়বাবুর ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে। কাঁচের জানলায় তাঁর বসে থাকা চেহারার সিলুয়েট। হাতে বই। সূর্য সে-ঘরে প্রায় পনেরো মিনিট ছিল। সেদিন দু’জনে কী কথা হয়েছিল তা জানি না। কিন্তু কোনও বকাবকি ধমকানির আওয়াজ শোনা যায়নি।
নীচে নেমে এসে সূর্য বলল, আমি আজ খাব না। আমার খিদে নেই।
পরদিন সকালে সূর্যদা অতি সামান্য কারণে আমার কান মূলে দিয়েছিল। আমি শুধু সূর্যদার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সূর্যদা, তোমার ঘড়িটা কোথায়? সূর্যদার সোনার হাতঘড়ি ছিল, ভারী সুন্দর দেখতে। কোনও কোনও দিন সূর্যদা সেটা আমার হাতে জোর করে পরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তখন সেই সামান্য প্রশ্নেই সূর্যদা রেগে গিয়ে আমার কান মূলে দিয়ে বলল, তোর অত কথায় দরকার কী রে?
সূর্যদা যে ঘড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে, সে কথা তখন আমি জানব কী করে? সূর্যদা কোনও দিন আমার গায়ে হাত তোলেনি, কোনও দিন একটাও বিসদৃশ ব্যবহার করেনি–সেদিন আমার এমন অভিমান হল যে আমি সূর্যদার সঙ্গে সারা দিন আর কথাই বললাম না।
এর কয়েক দিন পরে এক রাত্রে সূর্যদা বাড়িই ফিরল না। বাবা পুলিশে এবং হাসপাতালে খোঁজ নেবার কথা বলেছিলেন, বড়বাবু বারণ করলেন।
সূর্যদা ফিরল পরদিন সকাল নটায়। নিদ্রাহীন চোখ, পোশাক বিভ্রস্ত, বিষণ্ণ মুখ। বাইরের ঘরে তখন অনেকেই উপস্থিত। সূর্যদাকে দেখেই সবাই চুপ করে রই। বড়বাবু মোটামুটি শান্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করলেন, রাত্রে ফিরিসনি যে?
ফিরতে পারিনি। আটকে গিয়েছিলাম।
কোথায় ছিলি?
এক বন্ধুর বাড়িতে।
সেই বেলেঘাটায়? তাদের যে বাইরে বেড়াতে যাবার কথা ছিল।
যেতে পারেনি। আমার বন্ধুর খুব অসুখ।
বড়বাবু চেয়ার ছেড়ে যেন লাফিয়ে উঠলেন। সিংহের মতন হুংকার করে উঠলেন, বললেন, চল, এক্ষুনি আবার চল। আমিও যাব বেলেঘাটায়! আমি তোর বন্ধুকে দেখব।
বড়বাবুর ও রকম ক্রুদ্ধ মূর্তি কেউ কখনও দেখেনি। তার চিৎকারে সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিল। সূর্যদা আস্তে আস্তে বলল, সেখানে আপনার যাবার অসুবিধে আছে।
বড়বাবু নিজেকে সামলাতে পারলেন না। ঠাস ঠাস করে চড় মারলেন সূর্যদার দু গালে। জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি করে বল কোথায় গিয়েছিলি?
সূর্যদা একটুও নড়ল না, মুখের একটি রেখারও পরিবর্তন হল না, ফরসা গালদুটি শুধু লাল টকটকে হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বলল, বলার অসুবিধে আছে।
বড়বাবু আবার প্রচণ্ড জোর মেরে বললেন, অসুবিধে? কীসের অসুবিধে? বল আগে?
সূর্যদা পুনরাবৃত্তি করল–আমার অসুবিধে আছে।
বড়বাবু কতগুলো চড় মেরেছিলেন তার ঠিক নেই। সূর্যদা আর মুখ খুলল না। দোকানে বেরোবার আগে জ্যাঠামশাই এইসব কাণ্ড দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ সূর্যদার দিকে তাকিয়ে থেকে অস্ফুট ভাবে বললেন, আশ্চর্য! আশ্চর্য! অবিকল বিশ্বরঞ্জনের মতন!
বাবার দিকে ফিরে জ্যাঠামশাই বললেন, চিরু তোর মনে পড়ে? রঞ্জুও ঠিক এই রকম ছিল! রঞ্জুর সঙ্গে ওর চেহারারও পর্যন্ত একটু একটু মিল আছে না? একই বংশের রক্ত তো!
বাবা কোনও উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলেন। বড়বাবু তখন সূর্যদার চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিতে যাচ্ছিলেন, বাবা মাঝখানে বাধা না দিলে রক্তারক্তি ব্যাপার হয়ে যেত।
সারা দিন আমাদের বাড়িটা থমথমে হয়ে রইল। সূর্যদা স্নান করল না, খেল না, ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইল। অন্যদের কথা শোনা তো দূরে থাক, বড়দি কত করে অনুনয়বিনয় করল, সূর্যদা একবারও দরজা খুলল না, কারওর সঙ্গে একটিও কথাও বলল না। ভাগ্যিস জানলাটা খোলা ছিল, সেই জানলা দিয়ে বার বার উঁকি মেরে আমরা দেখতে লাগলাম সূর্যদাকে।
দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর বাবা গেলেন তিনতলায় বড়বাবুর ঘরে। বড়বাবু অন্যমনস্ক ভাবে একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছেন। বাবাকে দেখে প্রশ্ন করলেন, সূর্যি খেয়েছে?
বাবা বললেন, না।
কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। বাবা খুব ভালো করেই জানেন, বড়বাবু নিজে কখনও সূর্যদাকে খেতে অনুরোধ করবেন না। বড়বাবুর কাছ থেকে সে রকম ব্যবহার আশাই করা যায় না।
বাবা একটু বাদে জিজ্ঞেস করলেন, কী, খুব কষ্ট পাচ্ছেন তো?
বড়বাবু চমকে উঠে বললেন, আমি? তুমি আমার কথা বলছ?
বাবা একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ আপনার কথাই জিজ্ঞেস করছিলাম।
বড়বাবু কাতর ভাবে হাসলেন। তারপর বললেন, তুমি ঠিকই ধরেছ. কিন্তু কেন এমন হয় বলো তো? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বার বার ইচ্ছে হচ্ছে, সূর্যিকে বুকে জড়িয়ে ধরি। ওর কাছে ক্ষমা চাই। অথচ দেখো, ওকে যে শাস্তি দিয়েছি, অন্যায় তো কিছু করিনি। ওকে আমি সুযোগ দিয়েছিলাম। কথা শুনল না। অবাধ্য সন্তানকে মারব না? শাস্তি দেব না? তবু কেন কষ্ট হয়?
বাবা বললেন, এটাই তো মহা মায়া! আপনারই আত্মার একটা অংশ তো। কষ্ট তো হবেই!
এত মারধর বাধা-নিষেধও সূর্যদাকে আটকাতে পারেনি। সূর্যদা তবু আবার গেছে বেলেঘাটায়। সেখানে কাঠগোলার পিছনে একটা টিনের দোতলা বাড়িতে হরকুমার মুমূর্ষ হয়ে পড়ে আছে।
হাজারিবাগের জেলখানা ভেঙে বন্দিদের উদ্ধার করার পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। বিপ্লবীদের অধিকাংশ পরিকল্পনার মতন এটিও গুপ্তচরদের উপদ্রবে মাঝপথে ফেঁসে যায়। আলিমুদ্দিন মাস্টার ও আর একজন ধরা পড়ে। হরকুমার পুলিশের হাতে। প্রচণ্ড মার খেয়েও পালিয়ে আসতে সমর্থ হন।
কিন্তু হরকুমার আগে থেকেই যক্ষ্মায় ভুগছিলেন। কোনও দিন চিকিৎসা করাননি, এই মারখাওয়া আর সহ্য হল না। তার নামে তখনও হুলিয়া রয়েছে। কলকাতার বাড়িতে। আত্মগোপন করে তিনি মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছেন।
হরকুমারের প্রতি সূর্যদার ভালোবাসা ছিল যেন অনেকটা প্রাণীসুলভ, যারা কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। যে-কোনও কারণেই হোক, হরকুমারের প্রতি সূর্যদার অদ্ভুত একটা আকর্ষণ জন্মে গিয়েছিল। সূর্যদার চরিত্রে স্নেহ-দয়া-মায়ার প্রকাশ কখনও তেমন দেখা যায়নি। কিন্তু হরকুমারের সেবা সে করেছিল প্রাণ দিয়ে। নিজের জিনিসপত্র বিক্রি করে টাকার জোগাড় করেছে। নিজের আস্তানার কথা গোপন করার প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন হরকুমার। সূর্যদার পক্ষে সেইটাই খুব অসুবিধাজনক হয়ে গিয়েছিল। সব মানুষ তো আর অভিনয় করতে পারে না কিংবা মিথ্যে কথা বলতে পারে না!
হরকুমার শেষ পর্যন্ত মরলেন সূর্যদার কোলেই মাথা রেখে। মৃত্যুর কিছু আগে হরকুমারকে সূর্যদা ফিসফিস করে বলল: হরদা, তোমার পিস্তলটা আমাকে দেবে বলেছিলে?
হরকুমার বালিশের তলা থেকে পিস্তলটা বার করলেন, শেষ কয়েকটি নিশ্বাস বুকে এক সঙ্গে জমা করে অতি কষ্টে বললেন, তোর সঙ্গে আমার আরও কথা আছে। তুই আমার কথা রাখবি তো?