একটা ছোট্ট জানালা। জানালার একপাশে বাবা, অন্যপাশে আমি। তিনি ইচ্ছা করলেই হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে পারেন। তা তিনি করছেন না। মাথা নিচু করে বসে আছেন। মনে হচ্ছে খুব লজ্জা পাচ্ছেন। প্রথম কথা কে বলবে? তিনি বলবেন, না আমি? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমিই প্রথম কথা বললাম।
বাবা, কেমন আছ?
তিনি মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই তো লম্বা হয়ে গেছিস রে। মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ।
বাবা, তোমার জন্য সিগারেট এনেছি।
আমি তিন প্যাকেট বেনসন অ্যান্ড হেজেস সিগারেট কাউন্টার দিয়ে এগিয়ে দিলাম। তিনি আগ্রহের সঙ্গে সিগারেট নিতে নিতে বললেন, কাজটা ঠিক হয়। নাই। ছেলে বাবার জন্য সিগারেট আনবে— এটা কেমন কথা!
তিনি সিগারেটের পাকেট নাকের কাছে নিয়ে শুকছেন। তাঁর চোখে-মুখে আনন্দ।
বলল, বাসার সবাই ভালো?
জি।
নীলাকে কিছুদিন আগে স্বপ্নে দেখলাম। ভালো স্বপ্ন। ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চার সঙ্গে এক্কা দোক্কা খেলছে। নীলা আছে কেন?
ভালো আছে। নীলা ফুপুর বিয়ে হয়ে গেছে। বরের সঙ্গে ইটালিতে আছেন।
মাশাল্লাহ, মাশাল্লাহ।
ইটালিতে যাবার দিন তোমার কথা মনে করে খুব কান্নাকাটি করেছিলেন।
নীলার মনটা নরম, এটাই হয়েছে সমস্যা। আর ইয়ে, তোর মা? সে নিশ্চয়ই এখন আপসেট। সে তো ভাবে নাই সত্যি সত্যি ছয় বছরের জেল দিয়ে দিবে।
আমি বললাম, বাসার প্রসঙ্গ থাক। তুমি কেমন আছ বলো।
ভালো আছি। আমি খুবই ভালো আছি। জেলখানায় নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। এর উপকার আছে। আর খাওয়া-দাওয়া যতটা খারাপ বাইরে থেকে শোনা যায় তত খারাপ না। সপ্তাহে একদিন মাংস হয়। তারপর বিশেষ বিশেষ দিনে হয় ইমপ্রুভড ডায়েট। যেমন ধর স্বাধীনতা দিবস, দুই ঈদ। ইমপ্রুভড ডায়েটে পোলাও-মাংস-দই কিংবা পোলাও-মাংস-মিষ্টি থাকে। অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তার আছে। তারপর খেলাধুলার ব্যবস্থাও আছে।
তুমি খেলাধুলা কর?
ভলিবল খেলি। সারাদিন পরিশ্রম করি বলে রাতে ঘুমটা ভালো হয়, শুধু স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙলে খুব অস্থির লাগে। বাকি রাত ঘুম হয় না।
প্রায়ই স্বপ্ন দেখ?
হুঁ। তোকে প্রায়ই দেখি।
কী দেখ?
রিকশা করে দুজন যাচ্ছি, এইসব হাবিজাবি।
বাবা, যূথীকে স্বপ্নে দেখ না?
এই প্রশ্নটা করা ঠিক হয় নি। বাবার চেহারা কেমন যেন হয়ে গেল। তিনি অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ওরা কোথায় আছে জানিস?
আমি বললাম, না।
বাবা বিড়বিড় করে বললেন, তোর জানার তো কথাও না। মালতীর এক বোন থাকে খুলনার বাগেরহাটে। মনে হয় সেখানেই গেছে। সেই বোনের অবস্থাও খুব খারাপ। তারপরেও বোন কি আর বোনকে ফেলে দেবে! কী বলিস?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। বাবা বললেন, জেল থেকে ছাড়া পেয়েই প্রথমে খুলনা যাব। ওদের খুঁজে বের করব। তারপরে নতুন করে সংসার শুরু করব। অনেক বড় বড় লোকজন আমার চেনাজানা। তাদেরকে ধরলে একটা চাকরি পাওয়া আমার জন্যে কোনো ব্যাপারই না। ঠিক না?
হুঁ ঠিক।
রিয়েল অ্যাস্টেটের ব্যবসা করে সুলেমান শাহ্ এখন কোটিপতি। একসময় তাঁর সঙ্গে বিরাট খাতির ছিল। তাকে যদি গিয়ে চাকরির কথা বলি সঙ্গে সঙ্গে দশ-পনেরো হাজার টাকা বেতনের একটা চাকরি হয়ে যাবে। একটা ফ্ল্যাট কেনা দরকার। মেয়েটার নামে ফ্ল্যাট লিখে দিব। মেয়েটার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। একটা কিছু তো করা দরকার।
বাবা কাঁদতে শুরু করেছেন। তাঁর চোখের পানি সিগারেটের প্যাকেটে পড়ছে। টপ টপ শব্দ হচ্ছে। আমি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাবার কাঁধ স্পর্শ করলাম। তিনি মাথা ঘুরিয়ে আমার হাতে তার থুতনি রাখলেন। এখন তার চোখের পানি পড়ছে আমার হাতে। একটু আগে টপটপ শব্দ হচ্ছিল। এখন সেই শব্দ হচ্ছে না।
পরিশিষ্ট
বাবা যূথী এবং তার মার খোঁজ বের করতে পারেন নি। ষোল কোটি মানুষের দেশে এই দুজন মনে হয় হারিয়েই গেল। বাবা আশা ছাড়েন নি। তিনি খুঁজেই যাচ্ছেন। বাকি জীবনটা তিনি খুঁজে খুঁজেই পার করবেন।
তিনি কোথায় থাকেন আমি জানি না, কী খান তাও জানি না। তাঁকে দেখায় ভিক্ষুকের মতো। আমার ধারণা তিনি ভিক্ষাও করেন। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, তুমি কি ভিক্ষা কর? তিনি বিরক্ত গলায় বলেন, ভিক্ষা করব কেন? আমি কি ভিখিরি? তবে হঠাৎ হঠাৎ কেউ ভিক্ষুক মনে করে একটা দুটা টাকা দেয়, সেগুলি রেখে দেই। চা বিস্কুট খাই। টাকা কেন রাখি সেটা শুনতে চাস?
কেন রাখ?
ওরা টাকা দেয় সোয়াবের আশায়, আমি যদি টাকা না নেই ওরা তো সোয়াবটা পাবে না। খামাখা ওদের বঞ্চিত করার দরকার কী? ঠিক বলেছি না?
হুঁ।
তাছাড়া ভিক্ষুকদের ছোট করে দেখারও কিছু নাই। তারাও পরিশ্রম করে উপার্জন করে। সারাদিন হাঁটে। হাঁটা পরিশ্রমের ব্যাপার না?
বাবা আগের মতোই আছেন। তাঁর চরিত্রের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় নি, তবে অহংকার নামের জিনিসটি ইদানীং যুক্ত হয়েছে। মা তাঁর প্রতি কিছুটা নমনীয় হয়ে একতলার একটি ঘরে তাঁকে থাকতে দিতে চেয়েছিলেন। প্রস্তাবটা মায়ের হয়ে আমিই তাঁকে দিয়েছি। বাবা বলেছেন, আরে না।
আমি বললাম, না কেন?
বাবা বললেন, আমি তো কোনো জায়গায় স্থির না। ছোটাছুটির মধ্যে আছি। যূথী আর যূথীর মার একটা পাত্তা লাগাতে হবে না? এর মধ্যে তোদের বাড়িতে উঠলে আলস্যে ধরবে। দুপুরে ঘুমাতে ইচ্ছা করবে। আমি এইসবের মধ্যে নাই।
নীলা ফুপু ইটালি থেকে বাবার জন্যে দুশ ডলার এবং এক প্যাকেট চকলেট পাঠিয়েছিলেন। বাবা চকলেটের প্যাকেটটা রেখেছেন। যূথীর সঙ্গে দেখা হলে তাকে দেবেন। ডলার রাখেন নি। বিরক্ত মুখে বলেছেন, ছোটবোনের কাছ থেকে টাকা নেব এটা কেমন কথা? আমি কি ফকির না-কি?
আমি বললাম, বাবা, তুমি তো ফকিরই।
বাবা রাগ করে উঠে চলে গেছেন। তারপর অনেকদিন তার সঙ্গে আমার দেখা হয় নি। যেসব জায়গায় তাকে সাধারণত পাওয়া যায় তার কোনোটিতেই তিনি নেই। কমলাপুর রেলস্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, হাইকোর্টের মাজার, হন্টন পীরের দরবার।
এক বর্ষায় আবার তার সঙ্গে দেখা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বেঞ্চিতে জবুথবু হয়ে বসে আছেন। আমি পাশে বসলাম। নরম গলায় বললাম, কেমন আছ বাবা? তিনি নিচু গলায় বললেন, প্রচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে, কিছু খাওয়া তো।
আমি বার্গার কিনে নিয়ে এলাম। তিনি আগ্রহের সঙ্গে বার্গারে কয়েকটা কামড় দিয়ে বার্গার আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। কোমল গলায় বললেন, জিনিসটা ভালো বানিয়েছে— এক কামড় খেয়ে দেখ।
এরকম একটা কাণ্ড অনেকদিন আগে যূথী করেছিল। প্রকৃতি একই ঘটনা বাবলু!
জি বাবা।
মুন্সিগঞ্জে এক পীর সাহেবের সন্ধান পেয়েছি–কামেল মানুষ। উনি হারানো মানুষের সন্ধান নিমিষের মধ্যে দিতে পারেন। ঠিক করেছি উনার কাছে যাব।
আমাকেও সঙ্গে নিও।
না। কাউকে সঙ্গে নেব না।
না কেন?
তিনি জবাব দিলেন না। এই সময় বর্ষার ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে চলে গেল। বাবা বিড়বিড় করে বললেন, আহারে, কী মিঠা লিলুয়া বাতাস!